পয়মন্ত

পয়মন্ত

ওঃ, সেই ঘোড়া! লাগাম কেনার ক্ষমতা নেই, ঘোড়া কিনে বসলে! তিন—তিন বছর হয়ে গেল, ফার্স্ট—সেকেন্ড হওয়া দূরের কথা, ঘোড়াটা থার্ড—ও হয়নি। ওই ঘোড়াই তোমার কাল হয়ে গেছে। বিক্রি করে দাও ওটাকে!’

দেড় মাস হাসপাতালে থাকার পরে বাড়ি আসার সময় ইন্দিরা সুগতকে বলল, ‘তোমার—আমার অ্যাকাউন্টে মাত্র তিরিশ হাজার পড়ে আছে। অথচ হাসপাতাল বলছে, যা দিয়েছি তারপরেও নব্বুই হাজার দিতে হবে। টাকাটা কোত্থেকে দেবে?’

সুগত এই দেড় মাসে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ক’দিন থেকে তার মনে হচ্ছিল হাসপাতালে বেশি দিন থাকলে সে আর বাঁচবে না! কথাটা শুনে সে ফাঁপরেই পড়ল। ওই নব্বুই হাজার না—দিলে হাসপাতাল তাকে ছাড়বে না। সে স্ত্রী’র দিকে তাকাল। ইন্দিরা বলল, ‘আমার দিকে তাকিয়ে কোনো লাভ হবে না। যখন তোমার জ্ঞান ছিল না তখন বাধ্য হয়ে আমি হাসপাতালে টাকা জমা দিয়েছি। আমার পক্ষে আর দেওয়া সম্ভব নয় তা জানাতেই আজ এসেছি।’

‘আমার আর টাকা নেই ইন্দিরা।’ কাঁপা গলায় বলল সুগত।

‘ব্যাঙ্কে নেই, নিশ্চয়ই অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছ।’

‘বিশ্বাস করো, কোথাও নেই। থাকার মধ্যে শুধু ওই ঘোড়াটা আছে।’ কাতর গলায় বলল সুগত।

‘ওঃ, সেই ঘোড়া! লাগাম কেনার ক্ষমতা নেই, ঘোড়া কিনে বসলে! তিন—তিন বছর হয়ে গেল, ফার্স্ট—সেকেন্ড হওয়া দূরের কথা, ঘোড়াটা থার্ড—ও হয়নি। ওই ঘোড়াই তোমার কাল হয়ে গেছে। বিক্রি করে দাও ওটাকে!’ ইন্দিরা বেশ চেঁচিয়ে কথাগুলো বলল।

‘কেউ কিনবে না।’ মাথা নাড়ল সুগত হাসপাতালের বেডে শুয়ে। ট্রেনার বলেছে, এই বছরটা দেখবে তারপর ছেড়ে দেবে। ইন্দিরা, আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে নিয়ে যাও। এই নব্বুই হাজার আমি ঠিক শোধ করে দেব।’

‘অসম্ভব! তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। তুমি একটা ভয়ংকর মিথ্যেবাদী, মিথ্যে ছাড়া তোমার মুখ থেকে কোনোও শব্দ বের হয় না। ভাগ্যিস বিয়ের পর তোমার কথায় ভুলে আমি চাকরিটা ছাড়িনি, নইলে আজ না—খেয়ে মরতে হত। চাকরি করি বলে তুমি কখনও আমার দায়িত্ব নাওনি। আমি অনেক করেছি, আর তোমাকে দয়া দেখাতে চাই না।’ ইন্দিরা বলল।

‘শেষবার, শেষবার, প্লিজ—!’

‘তোমার হয়ে কেউ টাকা না—মেটালে হাসপাতাল কী করবে? মারতে তো পারে না। পুলিশকে জানাবে। পুলিশ তোমাকে অ্যারেস্ট করবে। কিন্তু ওরা তো দু’বেলা খেতে দেবে তোমাকে।’ ইন্দিরা হাসল।

‘উঃ, ভগবান! একথাও, আমাকে শুনতে হল!’

‘বিয়ের সময় ভাত—কাপড়ের দায়িত্ব কি আমি নিয়েছিলাম?’

চোখ বন্ধ করল সুগত। জবাব দিল না।

‘ঠিক আছে। এবার আর দয়া করব না। নব্বুই হাজার টাকা তুমি একবছরের মধ্যে শোধ করবে দশ হাজার টাকা ইন্টারেস্ট যোগ করে।’

‘ঠিক তাই। আর বাড়িতে তোমার থাকার ব্যবস্থা আমি আলাদা করে দিয়েছি। আমার রান্নাঘর এবং বেডরুমে তোমার অ্যাকসেস নেই।’

‘তাহলে আমি খাব কোথায়?’

‘ওটা তোমার সমস্যা।’ ইন্দিরা উঠে গিয়েছিল।

সেই দিন বিকেলে নবনী তাকে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে বাড়িতে নিয়ে এল। পুরনো বন্ধুরা সবাই হাওয়া হয়ে গেলেও নবনীটা আসা—যাওয়া করে। তবে ইদানীং সুগতর মনে হয়, সেটা তার বন্ধু হিসেবে যতটা, তারচেয়ে অনেক বেশি ইন্দিরার জন্য। নবনী বলল, ‘এই রইল পাঁউরুটি—মাখন। খিদে পেলে খেয়ে নিয়ো। আর এসব ওষুধ—যা হাসপাতাল থেকে দিয়েছে, তা কখন খেতে হবে নিশ্চয়ই জানো? আমি চললাম।’

এই বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরজা দুটো। একটা, পাশের দিকটা, এতকাল বন্ধ থাকত। নবনী তাকে ওই দরজা খুলে ঢুকিয়েছে। একটা ঘর, বাথরুম, চিলতে জায়গা —যেখানে স্টোভ, হাঁড়ি, থালা—গ্লাস রাখা আছে। ওদিকে যাওয়ার দরজা ওধার থেকে বন্ধ। ওদিকে গোটাতিনেক বড় ঘর, ভালো টয়লেট; দারুণ কিচেন—যা ইন্দিরা ভোগ করছে। করুক।

বাথরুম থেকে বিছানায় ফিরে আসতে মাথা সামান্য টলল। এটা অত দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকার জন্য, দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে আশ্বস্ত করল সুগত। তারপর বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়ে ভাবল, সে আর টেনশন নেবে না। আজ পর্যন্ত সাতজন লোক তার কাছে টাকা পায়। তিন লক্ষ বাহাত্তর হাজার টাকা। এই টাকা সে ধার করেছিল। ব্যবসাটা ডুবে যায় আড়াই বছর আগে। সেই ক্ষতি সামলাতে ধার করতে হয়। ইন্দিরা বলে ওই ঘোড়াটাই নাকি অপয়া! অথচ ওর নাম ‘পয়মন্ত’। ট্রেনার হাবিব খানকে সে প্রতি মাসে দশ হাজার দিত ঘোড়ার খাওয়া আর ট্রেনিংয়ের জন্য। গত একবছর দিতে পারেনি। হাবিব খান সহানুভূতি দেখিয়েছিল, ‘আপনার প্রবলেম বুঝতে পারছি স্যর। ঠিক আছে, আপনাকে প্রত্যেক মাসে টাকা দিতে হবে না। ওটা আমিই দিয়ে দেব। আমরা স্টেবলে কোনো ঘোড়া তো না—খেয়ে থাকতে পারে না। অবশ্য আপনি যদি চান তা হলে ওকে অকশনে তুলতে পারি। কেউ যদি কিনে নেয়, যা টাকা পাবেন তাই আপনার লাভ।’

মন চাইছিল না, তবু বাধ্য হয়ে সম্মতি দিল সুগত। রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব আরও ওইরকম পাঁচটা ঘোড়াকে অকশনে তুললে চারটে বিক্রি হয়ে গেল। পড়ে রইল পয়মন্ত আর অন্য একটা ঘোড়া। যে—ঘোড়া কুড়িটা রেস করেও প্রথম দিকে আসতে পারেনি, তাকে কেউ কিনতে চাইল না। আর তখন থেকে বুকে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে গেল সুগতর। হাবিব খান তাকে বলেছে এই বছরটা দেখবে। যদি পয়মন্ত প্রথম তিন ঘোড়ার মধ্যে দৌড় শেষ করে, তা হলে যে—টাকা প্রাইজ মানি হিসেবে পাবে, তা হাবিব খান ওর ‘খরচ’ হিসেবে নিয়ে নেবে। না—হলে পয়মন্তকে কেউ ‘রেসের ঘোড়া’ হিসেবে কিনবে না। ময়দানের ঘোড়ার গাড়ির মালিকরা নিশ্চয়ই কিনে নেবে।

চোখ খুলল সুগত। আর কিছু দিন পরে মরশুম শেষ হয়ে যাবে। তার মধ্যে যদি পয়মন্ত কিছু না—করতে পারে তা হলে হাবিব খান ওকে স্টেবল থেকে বের করে দেবে। চিরকাল তো কেউ ভস্মে ঘি ঢালতে পারে না!

অথচ এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না। তখন ব্যবসা রমরমিয়ে চলছিল। ‘সাদা’ টাকার সঙ্গে ‘কালো’ টাকা। হাবিব খানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অসিত মিত্তির। বিশাল বড়লোক। বারোটা রেসের ঘোড়া মুম্বই—বেঙ্গালুরুতে দৌড়য়। হাবিব খান বলেছিল, ‘মিত্তির সাহেব তো কলকাতার রেসকোর্সে ইন্টারেস্টেড নন, কিন্তু দারুণ একটা বাচ্চচা আছে। ইচ্ছে করলে কিনতে পারেন।

সেই মাথায় ঢুকেছিল। ঘোড়া কিনলে কী—কী লাভ হয় তার ছবি সুন্দর এঁকেছিল হাবিব খান। ‘কালো’ টাকা কীভাবে ‘সাদা’ করা যায় তা বুঝিয়েছিল। কিন্তু ‘কালো’ দূরের কথা, সব ‘সাদা’ টাকা যে ব্যবসা ডুবে যাওয়ায় জল হয়ে যাবে—তা তো সে—সময় জানা ছিল না!’ ঘোড়ার মালিক’ হিসেবে রেসকোর্সে যাওয়ার সেসব সুদিনের কথা খুব মনে পড়ে। তারপর যখন ব্যবসা গেল, রেসকোর্সে গেলেই পাওনাদাররা তাগাদা দিতে লাগল, তখন ভয়ে—লজ্জায় যাওয়া বন্ধ করল সুগত। যেদিন পয়মন্ত দৌড়ত, সেদিন সকালে হাবিব খানের ফোন আসত, ‘আজ দৌড়চ্ছে, প্রে করুন, প্রে করলে যদি আপনার ভগবান দয়া করেন।’

‘প্রে’ করত সুগত, কিন্তু পরদিন কাগজের কোথাও পয়মন্তের নাম না—দেখে যা বোঝার বুঝে যেত। হাবিব খানকে জিগ্যেস করেছিল, কেন সে মিথ্যে কথা বলে পয়মন্তকে কিনিয়েছিল? হাবিব খান বলেছিল, বাচ্চচা যখন ছিল তখন পয়মন্ত দারুণই ছিল, কিন্তু ট্রেনিংয়ের সময় একটু সেট ব্যাক হয়ে গিয়েছে। সুগত বুঝে গিয়েছিল, তার সঙ্গে পয়মন্তের কোনো পার্থক্য নেই।

তিন লক্ষ বাহাত্তরের সঙ্গে ইন্দিরার এক লক্ষ যোগ করলে যা দাঁড়ায় তা এই জীবনে জোগাড় করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। হাসপাতালে যাওয়ার আগে এই ঘরের আলমারিতে রাখা বইয়ের ভাঁজে দশটা একশো টাকার নোট রেখে গিয়েছিল সে। ওই এক হাজার টাকাই তার ভরসা। দু’বেলা রুটি—তরকারি কিনে খেলেও পঞ্চাশ দিনে শেষ হয়ে যাবে। হোক! ওই টাকার শেষ দশটা যতদিন পকেটে থাকবে ততদিন সে মৃত্যুর কথা ভাববে না।

পরের দিন ওদিকের দরজায় পা দেওয়ার আগে নবনী এই ঘরে এল, ‘এই তো অনেক ভালো দেখাচ্ছে। দোকানের খাবার বেশি দিন না—খেয়ে নিজে হাত পুড়িয়ে যা পারো রেঁধে খাও।’

‘অনেক ধন্যবাদ। তোমার মোবাইলটা একটু দাও তো, আমারটায় ব্যালেন্স আর নেই।’ হাত বাড়াল সুগত।

নবনী মোবাইলটা দিলে হাবিব খানের নাম্বার ডায়াল করল সুগত। নাম বলতেই হাবিব চিৎকার করে বলল, ‘আরে! আপনি কোথায় ছিলেন এত দিন? গতকালও ফোন করে শুনেছি সুইচড অফ। শুনুন, কাল পয়মন্ত জীবনের শেষ দৌড় দৌড়চ্ছে। আপনাকে জানিয়ে দিলাম।’

‘শেষ দৌড় মানে?’ হতভম্ব সুগত।

‘আর ওর পিছনে পয়সা খরচ করব না। কাল একটা কাপের বাজি আছে। দুই মাইল ছুটতে হবে। এই দূরত্ব ও কোনোদিন দৌড়য়নি। যদি থার্ড হয়, তা হলে আমাদের তিন লাখ আসবে। সেক্ষেত্রে আর একবছর রাখতে পারি ওকে। নইলে ময়দানের ঘোড়ারগাড়ির মালিক মনসুর আলি চল্লিশ হাজার দিয়ে ওকে নিয়ে যাবে। ওই টাকার অনেক বেশি আমি খরচ করেছি ওর পিছনে, তাই আপনাকে শেয়ার দিতে পারব না।’

‘কাল কখন রেসটা হবে?’ সুগত জিগ্যেস করল।

‘বিকেল সাড়ে তিনটেতে।’

‘হাবিব ভাই, আজ সন্ধেবেলায় আপনার স্টেবল যেতে পারি? পয়মন্তকে শেষবার দেখে আসতে ইচ্ছে করছে।’

‘ঠিক আছে, আসুন।’

আজ দুপুরে ভাত, আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ, মাখন দিয়ে মেখে খেয়ে ঘণ্টাদুয়েক ঘুমিয়ে নিল সুগত। অল্প টাকার মধ্যেই খরচটা থাকল। মাখন তো নবনী দিয়ে গিয়েছিল। পেটে ভাত এবং শরীরে দুপুরের ঘুম পাওয়ায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছেছিল সুগত। কিন্তু বুঝতে পারছিল, বাসে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। হাজার টাকা দ্রুত কমে যাচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেই তার। ট্যাক্সি নিল সে।

হাবিব খানের স্টেবল পৌঁছতে সন্ধে নেমে গেল। হাবিব নেই। কিন্তু হেড সহিস তাকে চিনতে পারল। ‘আইয়ে সাব। আপনার লাক খুব খারাপ। একটা ঘোড়া তিন বছরে একবারও ফ্রেমে আসবে না এমন হয় না। আমিই বড় সাহেবকে বললাম, পয়মন্তকে লম্বা দৌড়ে দিন বলা যায় না কিছু। কোনো দরকার আছে?’

‘একবার পয়মন্তকে দেখতে চাই।’ সুগত বলল।

হেড সহিস একটি জুনিয়র সহিসকে সঙ্গে দিল।

পরপর ঘরগুলোতে হাবিব খানের কাছে ট্রেনিং—পাওয়া ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে আছে। পয়মন্তের কাছে পৌঁছে দিয়ে ছেলেটি চলে গেলে সুগত ঘোড়াটার দিকে তাকাল। পয়মন্ত তার দিকে তাকাচ্ছে। তারপর মাথা নীচু করল। সুগতর মনে হল পয়মন্ত লজ্জা পাচ্ছে। ও কিছুই করতে পারেনি বলে অপরাধবোধে আক্রান্ত হচ্ছে। হঠাৎ মাথা, ঘুরতে লাগল সুগতর। সে ধীরে—ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। স্টেবলের আবছা অন্ধকারে যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন তার মাথায়, গালে, গলায় ভিজে—ভিজে অনুভূতি। পয়মন্তের মুখ নেমে এসেছে তার মুখের ওপর। জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে পয়মন্ত। উঠে বসল সুগত। তারপর দুই হাতে পয়মন্তের মুখ ধরে ফুঁপিয়ে উঠল, ‘পয়মন্ত, তুই আমাকে বাঁচা। একমাত্র তুই পারিস আমাকে বাঁচাতে।’

হাবিব খান তার স্টেবল থেকে সুগতকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিল। ডাক্তার বলেছেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। টেনশনে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল সুগত। কালই ছেড়ে দেওয়া হবে।’ সুগত চাইছে দুপুরেই ছাড়া পেতে। কারণ সাড়ে তিনটের যে—রেসটায় দু’মাইল পয়মন্ত দৌড়বে, এমন দৌড় কখনও দৌড়য়নি সে। মনে—মনে দৌড় শুরু করল সুগত। পয়মন্তর হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *