পবনপুরে হইচই

পবনপুরে হইচই

তপন বলল, এবার একটা কিছু করতে হবে। নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

দেবু বলল, কী করব সেটা ভেবেছিস? আমরা এই ক’টা ছেলে মিলে ওদের সঙ্গে লড়ে পারব কেন?

সুমন বলল, সেটাই তো কথা। আমরা এই ক’টা ছেলে থাকব কেন? আমরা আরও অনেক হব। স্কুলের সব ছেলেকেই আমরা ডাকব। বিপদ তো সবার, যা করতে হয় সবাই মিলে করব।

পিন্টু বলল, সুমন খুব ভাল কথা বলেছে। এগোতে হবে সকলকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু স্কুলের অত ছেলেকে আমরা বিপদের কথাটা জানাব কেমন ভাবে। আমরা তো নেতাদের মতো লেকচার দিতে জানি না।

রথীন তখন বলল, ওটা আমার হাতে ছেড়ে দে। ব্যবস্থা আমি করব। আমার মাথায় একটা চমৎকার আইডিয়া এসেছে। এটা করলে তোদের বক্তৃতাও দিতে হবে না, আবার সবার কানে কানে গিয়ে বলতেও হবে না। অথচ স্কুলের সবাই জেনে যাবে।

মানস বলল, বল না কী আইডিয়া।

রথীন মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। এতে তপন হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল, ঠিক আছে বলতে হবে না। রইল তোদের মিটিং, আমি ক্লাসে চললাম। বলে তপন সত্যি সত্যি হাঁটতে শুরু করল। অমনি রথীন এক লাফে তপনের সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে বলল:

তপন তুই রাগিস না/ আমাদের ফেলে ভাগিস না/ দুমদাম রেগে যাস/ কিছু বুঝিস না।/ জানলে আগে/ মজা থাকে? এটা কেন ভাবিস না?

রথীনের এই একটা চমৎকার গুণ। যখন-তখন ও সুন্দর ছড়া তৈরি করতে পারে। সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। এখনও এই ছড়া শুনে আমরা সবাই হেসে উঠলাম। তপনও হাসতে লাগল। এমন সময় টিফিন শেষের ঘণ্টা বাজল, আমরাও মিটিং বন্ধ করে ক্লাসের দিকে দৌড় দিলাম।

আমরা পবনপুর উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশুনো করি। আমাদের পবনপুর যেমন সুন্দর, তেমন আমাদের স্কুলটাও চমৎকার। দুইই আমরা খুব ভালবাসি। আমাদের স্কুলে যেমন পড়াশুনো হয়, তেমন খেলাধূলো আর নানারকম মজাও হয়। আমাদের স্কুলের বাড়িটা ছিমছাম। বড় বড় গাছ আছে। আর স্কুলবাড়ির গায়েই একটা বড় মাঠ। এই মাঠই আমাদের খেলার মাঠ। এখানে আমাদের স্কুলের ফুটবল লিগ হয়, ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়, স্পোর্টস হয়। এখানেই আমরা টিফিনের সময় খেলি, স্কুল ছুটি হলে খেলি। এমনকী বৃষ্টিতে জল জমলে মাস্টারমশাইদের লুকিয়ে এখানে দাপাদাপিও করি।

কিন্তু কিছুদিন হল একটা ভয়ানক বিপদের কথা আমরা জানতে পেরেছি। প্রণবের ছোটকাকা পবনপুর মিউনিসিপ্যালিটি অফিসে কাজ করেন। তিনি প্রণবকে বলেছেন, এই মাঠে একটা বিরাট বাড়ি তৈরি হবে। সেখানে অনেক থাকার জায়গা আর দোকান-বাজার হবে। বাড়ি তৈরির কাজ দু’-একদিনের মধ্যেই নাকি শুরু হয়ে যাবে।

প্রণব আমাদের এসে খবরটা জানিয়েছে। আমাদের মাথায় হাত পড়েছে। তার মানে স্কুলের খেলার মাঠ নষ্ট হয়ে যাবে? কীভাবে মাঠটাকে বাঁচানো যায় তা ঠিক করতেই আমরা টিফিনের সময় মিটিংয়ে বসেছিলাম।

পরদিন স্কুলে ঢোকার মুখেই দেখি ঝলমলে একটা সবুজ রঙের পোস্টার। রোদ পড়ে সেটা আরও ঝলমল করছে। স্কুলে ঢোকার আগে সব ছাত্র গেটে দাঁড়িয়ে সেটা পড়ছে। পোস্টারে লেখা আছে—

ওই আসছে তেড়ে রাক্ষস/ খেলার মাঠ খাবে,/ তুই ঘাসেদের বন্ধু নোস?/ ছুটে আয় তবে।/ সবাই যদি হতে পারি একসাথে/ রাক্ষস কি পালাবার পথ পাবে?

আমরা বুঝতে পারলাম এ রথীনের কীর্তি। স্কুলে একেবারে হইচই পড়ে গেল। ছড়াটা অনেকেই মুখস্থ করে আওড়াতে লাগল। সব থেকে বড় কথা, এই ছড়াতে কাজ হল দারুণ। সিক্স, সেভেন, এইট, টেন সব ক্লাস থেকেই ছেলেরা এসে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল ছুটির পর।

স্কুলের মাঠে একধারে আমরা সবাই জড়ো হলাম। ক্লাস সিক্সের তমাল বলল, এই মাঠ নষ্ট হয়ে যাবে শুনে আমার কান্না পাচ্ছে। ক্লাস সেভেনের অপূর্ব বলল, এই মাঠে বাড়ি হলে আমরা খেলব কোথায়? মাঠ ছাড়া কি স্কুল হয়? ক্লাস এইটের শান্তনু বলল, মাঠ যদি না থাকে তা হলে আমি এই স্কুলও ছেড়ে দেব। ক্লাস টেনের প্রদীপ বলল, এই মাঠ শেষ হতে দেওয়া চলবে না। আমাদের আদরের খেলার মাঠ আমরাই বাঁচাব। মাঠটাকে বাঁচাতে হবে তা আমরা সকলেই বুঝেছি, কিন্তু কীভাবে? তা আমরা কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছিলাম না। অনেকেই অনেক কথাই বলল, কিন্তু কিছুতেই একমত হতে পারছিলাম না। শেষে পিন্টু বলল, আমার মনে হয়, পবনপুরের কয়েকজন বিশিষ্ট মানুষকে চিঠি লিখে আমাদের অনুরোধ করা উচিত যে তাঁরা যেন এই মাঠটা রক্ষা করেন। বড়রা না-এলে আমরা কয়েকজন স্কুলের ছাত্র কতটা কী করতে পারব? পিন্টুর কথা আমাদের সকলেরই মনে ধরল। চিঠি লেখার দায়িত্ব দেওয়া হল সেই রথীনকেই। রথীনের ওপর আমাদের সকলের ভরসা খুব বেড়ে গেছে। ওর ছড়ার জন্যই তো আমরা এত তাড়াতাড়ি সবাই কাছে এলাম। রথীনও তেমনি বটে! দশ মিনিট মাঠের এককোণে গিয়ে খাতা কলম নিয়ে কী জানি আঁকিবুঁকি করল, তারপর চলে এসে বলল, হয়ে গেছে। নে শোন—

আমরা পড়িখেলাও করি
স্কুলের পাশেমাঠ আমাদের
সবুজ আরপরিষ্কার
মহাশয়নমস্কার।।
সেই মাঠেতেহচ্ছে বাড়ি
শুনে মোদেরমুখ তো হাঁড়ি
মাঠই তোসবার কাছে
পুরস্কার,
মহাশয়নমস্কার।।
অন্য কিছুনিন
আবেদন মাঠফিরিয়ে দিন,
রেগে গিয়েকরবেন না
তিরস্কার
মহাশয়নমস্কার।।

রথীনের পড়া শেষ হতেই আমরা হাততালি দিয়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে মানস তালিকা তৈরি করে ফেলল কাদের কাদের কাছে এই চিঠি পাঠানো হবে।

দু’দিন যেতে-না-যেতেই আমরা টের পেলাম কত শক্ত কাজে হাত দিয়ে ফেলেছি। পবনপুর মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান আমাদের চিঠি পেয়েই হেডস্যারকে এত বড় একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে লিখেছেন— আপনার স্কুলের ডেঁপো ছেলেগুলোকে এখনই সামলান। পবনপুরে কি আর খেলার মাঠ নেই? শুধু কি এই একটাই? মোটেই নয়। আমাদের অনেকের বাড়িতেও নালিশ হয়েছে যে আমরা নাকি পড়াশুনো ফেলে, গুন্ডামি শিখছি! যারা আমাদের মাঠ নষ্ট করে দিয়ে বাড়ি বানাচ্ছে তারাই আমাদের কয়েকজনের দাদাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে নালিশ করেছে। বাবা, মা, মাসিরা তো রেগে আগুন।

আমাদের প্ল্যান পুরো ভেস্তে গেল। কোথায় আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের চিঠি পেয়ে পবনপুরের বড়রা আমাদের সঙ্গে আসবেন, উলটে তাঁরা আমাদের ওপরই রেগে গেলেন। সব থেকে বেশি রেগে গেছে রথীন। ওর ছড়াতে এবার কাজ হল না। আমরা যখন বিকেলবেলা মাঠে বসে এসব আলোচনা করছি, তখন রথীন শুধু পায়চারি করছে আর রাগরাগ মুখে এক-একটা ছড়া কাটছে। প্রণব বলল, মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান যদি রাজি না-হতেন তা হলে কেউ মাঠ নষ্ট করতে পারত না।

রথীন বলল,

আমাদের চেয়ারম্যান/ ছোটদের ধমক দিয়ে/ মাঠ নষ্টের কেয়ার নেন

দেবু বলল, জানিস আমার মা’র কানেও সব গেছে। আমি খুব বকুনি খেয়েছি।

রথীন বলল,

আমাদের মা আর মাসি/ চান কি শুধু অঙ্ক কষি?/ বিকেলবেলা খেলব না?/ মাঠে একটু ছুটব না?

পিন্টু কাঁদোকাঁনো মুখে বলল, দেবু, তোকে শুধু মা বকেছে। আর আমাকে আমার দাদা কান মুলে দিয়ে বলেছে শুনে রাখ ওখানে যারা বাড়ি বানাচ্ছে তারা আমার বন্ধু। একদম গন্ডগোল করবি না।

রথীন বলল,

আমাদের দাদারাম,/ এক একটা হাঁদারাম/ জানে ভাইদের/ কান মুলতে/ নেই কোনও চাঁদারাম

এরপর রথীন পায়চারি থামিয়ে আমাদের মাঝে এসে বসল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, কিছুতেই হারব না, আবার চান্স নেব। লাস্ট চান্স। দেখি আমার ছড়া পবনপুরের বড়দের খেপিয়ে দিতে পারে কি না।

পরদিন সকালে পবনপুরে দুটো ঘটনা ঘটল।

প্রথম ঘটনাটা হল, গোটা পবনপুরে কয়েক হাজার ছোট ছোট কাগজের টুকরো বিলি হল। কতগুলো পোস্টার পড়ল দেওয়ালে। মিউনিসিপ্যালিটি অফিসের গায়ে চুন দিয়ে লেখাও হল। সবেতেই দুটো মাত্র লাইন:

বড়রা যখন ছোট ছিলে/ কেমন লাগত মাঠ না পেলে?

বেলা যত বাড়তে লাগল তত এই লাইন দুটো মুখে মুখে ছড়াতে থাকল। বলতে গেলে, পবনপুরের প্রত্যেকটা বাড়িতে বাড়িতে দুপুরের মধ্যে এই লাইন দুটো আশ্চর্যভাবে পৌঁছে গেল! বেশিরভাগ বড়ই লাইন দুটো নিয়ে আলোচনা করছে। আর ছোটরা? তারা তো তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে আর বলছে, কেমন লাগত মাঠ না পেলে?

কেউ জানুক আর না-জানুক আমরা তো জানি এই ভয়ানক ছড়া কার তৈরি। তিনি আমাদের ক্লাস নাইনের রথীন। আর দু’নম্বর ঘটনাটা হল, সকাল থেকেই স্কুলের মাঠে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেল। লরি করে ইট, বালি, চুন, সুরকি এসে গেল। বেশ কয়েকজন গর্ত খুঁড়তে শুরু করল, আর কয়েকজন সেই কাজকর্ম তদারকি করতে লাগল।

প্রথম ঘটনায় আমাদের যেমন আনন্দ হল, দ্বিতীয় ঘটনায় আমাদের তেমন কান্না পেল। খুব রাগও হল। এতরকম কাকুতি মিনতি করলাম তবু পবনপুরের একজন বড়ও আমাদের খেলার মাঠ বাঁচাতে এল না?

টিফিনের সময় মানস বলল, আর নয়, যা থাকে কপালে, আমরা নিজেরাই নিজেদের খেলার মাঠ বাঁচাতে নামব।

তপন বলল, ঠিক কথা। আর কারওর ভরসা নয়।

পিন্টু বলল, আর যদি অপেক্ষা করি তা হলে কোনওদিন আর মাঠ ফিরে পাব না।

তারপর সারা স্কুলে আমরা মুখে মুখে ছড়িয়ে দিলাম, বিকেলবেলায় মাঠে।

স্কুল ছুটি হতেই স্কুলের কয়েকশো ছেলে জড়ো হলাম মাঠের ধারে। কারও হাতে ফুটবল, কারও হাতে ক্রিকেট ব্যাট আর বল। কেউ নিয়েছে হকি স্টিক, কেউ এনেছে ভলিবল। ক্লাস সিক্সের ছেলেরা বলল, আমরা হা-ডু-ডু খেলব। মানস, রথীন, দেবু, পিন্টু সবার আগে। পিছনে সবাই। হইহই করে নেমে পড়লাম মাঠে। শুরু করে দিলাম খেলতে। যারা মাঠে গর্ত খুঁড়ছিল তারা তো বেজায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আমরা গিয়ে গর্তগুলো বোজাতে শুরু করে দিলাম। এবার বদমাইশ লোকগুলো কোদাল, বেলচা, শাবল নিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে এল। এবার কী হবে? পালাতে হবে নাকি আমাদের?

এমন সময় দেখি, কয়েক হাজার মানুষ ছুটে আসছে মাঠের ওপর দিয়ে! আরে! এরা তো সব আমাদের পবনপুরের লোক! ওই তো সবার আগে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান! বাবা কাকা দাদারাও আছেন দেখছি! বাপ রে! দু’লাইনের ছড়ায় এত কাজ দেয়? এ যে বিশ্বাসই হচ্ছে না।

আমরা আনন্দে লাফিয়ে উঠলাম। এদিকে যারা বাড়ি বানাচ্ছিল, তারা অত মানুষ দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে টেনে দৌড় লাগাল।

আমরাও পবনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র। আমরাও ছাড়বার পাত্র নই। আমরা তাড়া করলাম। পবনপুর-ছাড়া করতে হবে তাদের। সবাই মিলে তখন রথীনের তৈরি করা ছড়া ধরলাম—

ক্যাচ ক্যাচ ক্যাচ/ ক্যাচাং ক্যাচাং/ সবার প্রিয় মাঠং/ ঘাট/ করছে যারা নষ্ট/ নটং/ করব তাদের মুণ্ডু/ ছেদং।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *