পপলারের মগডালে

পপলারের মগডালে

দুই মহা চাণক্যে বিশ্রম্ভালাপ হচ্ছিল। নিদাঘের মধ্যরাত্রি আসন্ন। প্রচুর সুরা পান হয়েছে। ফলে সর্বাঙ্গ দিয়ে অজস্র স্বেদ ও তজ্জনিত বাষ্প বিনির্গত হচ্ছে। এমতাবস্থায় সেই স্টিম থেকে যে স্পিরিট বেরুচ্ছে সেটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সামান্যতম স্পর্শ পেলেই দপ করে জ্বলে উঠবে বলে চাণক্যদ্বয় সিগার ধরাচ্ছেন না।

ইতোমধ্যে একজন গভীরতম চিন্তায় নিমজ্জিত থাকার পর দ্বিতীয়জনকে প্রশ্ন করলেন, একটা সমস্যা নিয়ে আমি অত্যন্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি, ভ্রাতঃ! ভেবে ভেবে কোনও কূলকিনারা পাচ্ছি নে। মার্শাল থেকে শুমপেটার হয়ে কেইনস রবিনস সবাইকে চষেছি বেকার বেকার। তা আপনার কাছে তো কিছুই অজানা নেই

হুম।

এই ডাক-বিভাগটা চলে কী প্রকারে? অত অঢেল টাকা পায় কোথায়? ভাবুন দিকিনি, বিরাট বিরাট মাইনের ডাঙর ডাঙর আপিসাররা রয়েছেন, দশাসই সব আপিস দপ্তর, অগুনতি ভ্যান, লম্বা দৌড়ের রেলগাড়ি হলেই তার আধখানা জুড়ে ডাকের জন্য খাস ব্যবস্থা– এ তো আর ফোকটে-মুফতে হয় না! হ্যাঁ, মানলুম, তারা কোটি কোটি টাকার ডাকটিকিট বেচে। কিন্তু ওটাকে তো আর ব্যবসা বলা চলে না। ১০ পয়সার ডাকটিকিট বেচে ১০ পয়সায়, ১৫ পয়সার টিকিট বেচে ১৫ পয়সায়, কুড়ির কুড়ি পয়সায়ই। এক কানাকড়িরও তো মুনাফা নেই ওতে, যা দর তাতেই বিক্রি! লাভ রইল কোথায়? তা হলে ডাক-বিভাগটা চলে কী করে?

অতি হক কথা কয়েছেন, আমিও সানন্দে স্বীকার করছি, টিকিট বিক্রি করে ডাক-বিভাগের রত্তিভর মুনাফা হয় না। যে দাম আছে, তাতেই সে বিক্রি করতে বাধ্য। কিন্তু জানেন তো, দাদা, বড় বড় মুনাফার ব্যবসা মাত্রেই লাভের পথটা থাকে লুকানো যেদিকে সরল জনের নজর যায় না, তার মনে কোনও সন্দেহই হয় না। আচ্ছা! এইবারে দেখুন সমস্যাখানার রহস্য। পনেরো গ্রাম ওজনের খামের জন্য পোস্টাপিস চায় পনেরো পয়সা টিকিট নয় কি? এইবারে আপনাকে আমি শুধধাই হক্ক কথা কন। প্রত্যেকখানি চিঠির ওজনই কি টায়-টায় পনেরো গ্রাম? হাজারখানার ভিতর একখানারও হয় কি না হয়– এ তো কানায়ও দেখতে পায়। একটার ওজন হয়তো বারো গ্রাম, কোনওটার আট, কোনওটার-বা তেরো। এইবারে বুঝলেন তো, এই যে তফাতটা– এই যে ফারাকটুকু, এর থেকেই ডাকবিভাগের নিরেট লাভ–ওই দিয়ে তার দিব্যি চলে যায়।

পাঠক ভাবছেন, আমি অর্থশাস্ত্রের জটিলতম সমস্যায় কণ্টকিত এই প্রস্তাবটি উত্থাপিত করলুম কেন? আমিও তাই ভাবছি। বস্তুত আমি মেহতা-চৌধুরী-জনসুলভ এই পঞ্চতন্ত্র কাহিনীটি যখন শ্রবণ করে কৃতকৃতার্থ হই তখন, কিংবা আমার বাতুলতম মুহূর্তেও আমি ওহেন সম্ভাবনার কণামাত্র আভাস পাইনি যে, ইটি একদিন আমার কাজে লাগবে।

লেগেছে। টায়-টায় না হলেও হরেদরে। সর্ব কাহিনী, তাবৎ উপমাই দাঁড়ায় তিন ঠ্যাঙের উপর ভর করে। চার পায়েই যদি দাঁড়ায়, তবে তো সে হুবহু একই বস্তু হয়ে গেল। উপমা রূপক, প্রতীক হতে যাবে কেন?

বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ দেখি, এক দরদী সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায় বিকট চিৎকার করে চিল্লি দিয়ে কেঁদে উঠেছেন, বিদেশি পুস্তক বিক্রেতাদের জন্য। হায় হায় হায়, এদের কী হবে? এরা কোজ্জাবে, মা!

কান্নার বহর দেখে মনে হল, এঁরা যেন ফুটপাথের পুরনো বই বিক্কিরিওলাদের চেয়েও বিকটতর বিপাকে পড়েছেন। এদের দুরবস্থা (প্রেস! হ্যাঁ, আমি আকার দিয়ে দুরবস্থাই লিখছি) দেখ সেই সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায় ঘটি ঘটি চোখের জল ফেলছেন।

আম্মো দরদী। কিন্তু এই ডুকরে-ওঠা, চিল-চাঁচানো মড়া-কান্না শুনে আমার হৃদয়ে মিলক অব মেন কাইন্ডনিস না বয়ে লেগে গেল সেথায় অন্য ধুন্ধুমার। খাঁটি মড়া-কান্না আমি বিলক্ষণ চিনি। আমার বসত-বাসা শুশানের লাগোয়া।

***

মহাকবি হাইনরিষ হাইনের মরমিয়া প্রেমের গীতি-কবিতা সম্বন্ধে একাধিকবার লেখবার সুযোগ আমি পেয়েছি। ইনি সাক্ষাৎ চণ্ডীদাস। পাঠককে শুধোই, সুখের লাগিয়া এঘর বাঁধিনু, তোমার চরণে আমার পরাণে লাগিল প্রেমের ফাঁসি শুনে কি তোমার কখনও মনে হয়েছে, এ কবি …চিঠির মতো (এ মাসিকের বিরুদ্ধে আমার ব্যক্তিগত কোনও ফরিয়াদ নেই– অম্মদ্দেশে শত্রু-মিত্র উভয়ভাবেই পুজো করার পদ্ধতি ঐতিহ্যসম্মত) কিংবা কংগ্রেস কমুনিস্টের মতো কটুকাটব্য কস্মিনকালেও করতে পারে?

তাই যখন বিঘ্নসন্তোষী, পরশ্রীকাতর একপাল (লুমপেন-পাক) ফেউ লাগল হাইনের পিছনে তখন তিনি কোনও উত্তর দিলেন না। সবাই ভাবল, যার মুখ দিয়ে সদাই মধু ঝরে সে আবার এসব বেতালা বদখদ বেত্তমিজি বাতের কীই-বা জবাব দেবে। ভুল, ভুল! সব্বাই করলেন ক্ষ-তে গলদ।

একদিন তার হল ধৈর্যচ্যুতি।

কী যেন একটা আমার ঠিক স্মরণে আসছে না– ভ্রমণ-কাহিনী না কী যেন কিসে মোলায়েম প্রাকৃতিক বর্ণনা দিতে দিতে তিনি বললেন, সবাই জানেন, আমি সাতিশয় সাধারণ কবি, তাই আমার খাঁইও অতিশয় সাধারণ। কবি মানুষ, দয়াময় ভগবান যদি নদীপারে আমাকে একখানা কুঁড়েঘর দেন, তা হলেই আমার দিব্যি চলে যাবে। আর ঘরের তৈরি সাদামাটা কিঞ্চিৎ রুটি- শহুরে বান, ক্রোআঁশা(১) কিসসুটি না– আর ঘরেই তৈরি মাষা পরিমাণ মাখম, ব্যস। তদুপরি দয়াময় ভগবান যদি আমাকে আরও খুশি করতে চান, তবে তিনি যেন ওই নদীপারে উঁচাসে উঁচা একসারি পপুলার লাগিয়ে দেন। সর্বশেষে, তাঁর অসীম করুণাবশে যদি দয়াময় আমাকে পরিপূর্ণ কৈবল্যানন্দ দিতে চান, তবে তিনি যেন আমার পিছনে যারা লেগেছে ওই দুশমনদের পলারের মগডালে ফাঁসি দেন। অন্তবিহীন আনন্দরসে ভরপুর হৃদয় নিয়ে, কুটিরের দাওয়ায় বসে আমি তখন উপরপানে তাকিয়ে দেখব, সাতিশয় মনঃসংযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করব, আহা কী রমণীয় দৃশ্য! দুশমনদের পাগুলো মৃদুমন্দ পবনে দুলছে– দোদুল দোলায় হিল্লোল লাগিয়ে।(২) হ্যাঁ, আলবৎ প্রভু যিশুখ্রিস্ট আদেশ দিয়েছেন(৩) শত্রুকে ক্ষমা করবে, তাকে প্রেম দেবে। নিশ্চয় করব, নিশ্চয়ই দেব– আমার সর্বসত্তা উজাড় করে, কিন্তু ওই যে বললুম, ওদের ফাঁসি হয়ে যাবার পর।

***

কিন্তু যে গল্পটা দিয়ে আরম্ভ করেছিলুম সেটা গেল কোথায়?

যারা বিদেশি বই বেচনেওলাদের তরে ঘটি ঘটি অশ্রু বর্ষণ করছেন তাঁদের একজনের ভাবখানা অনেকটা : পচ শিলিঙের বই যদি তারা তারই ন্যায্য এক্সচেঞ্জে ভারতীয় টাকায় বেচে, তবে তাদের মুনাফা রইল কোথায়? এক ডলারের দাম সাত টাকা পঞ্চাশ পয়সা (কথার কথা কইছি, আমি সঠিক ভাও জানিনে), যদি সাত টাকা পঞ্চাশেই বেচে, তবে লাভ রইল কোথায় ওই সেই ডাকটিকিট বিক্রির মতো!

তিনি তার পর আরেক ঘটি এন্ট্রা চোখের জল ফেলে বলছেন, তাদের কত খর্চা। চিঠি লিখতে হয়। (মরে যাই!), ডাকমাশুল দিতে হয় (ও বাছারে!) এবং তার পর আর কী সব ধানাইপানাই করেছেন আমার মনে নেই। কিন্তু এইবারে অসহিষ্ণু পাঠক, ক্ষণতর, মেহেরবানি করে তুমি নিচের মোক্ষম তত্ত্বটি মনোযোগ সহকারে পড়।

উপরের উল্লিখিত ওই একজনই না, যাদের হাত দিয়ে বিলিতি বইওলারা তামাক খাচ্ছেন তাদের কেউই তো বলছেন না (কিংবা আমার হয়তো চোখে পড়েনি)– অন্তত সেই সরল বিপ্রসন্তান (ইনি পণ্ডিত তথা বি– এ দুয়ের সংযোগে মানুষ বড় সরল, neif হয়) বলেননি–

বিলিতি বইওলারা কত কমিশন পায়?

আমানউল্লার মাতা রানিমার আদেশে তার বন্দি চাচা নসরউল্লাকে খুন করা হয়। সর্বত্র খবর রটল, কফি খেয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।

সংবাদদাতা বিলকুল ভুলে গেলেন মাত্র একটি সামান্যতম তথ্য পরিবেশন করতে। কফিতে ছিল সেঁকো বিষ।

এঁনারা এই সেঁকো বিষ অর্থাৎ কমিশনটির বাৎ বেবাক ভুলে যাচ্ছেন।

কত কমিশন পায়? জানিনে। তবে বঙ্গসন্তানদের ধারণা ২৫% ৩০%-এর বেশি হবে না, কারণ বাঙলা পুস্তক বিক্রেতা সচরাচর এর বেশি পায় না (হালে জনৈক প্রখ্যাত পুস্তক-বিক্রেতা গুদোম সাফ করার জন্য শতকরা ৪০/৫০ দিচ্ছেন বলে– পাঠক পরম পরিতোষ পাবেন, ওর মধ্যে আমার বইও ছিল– বাঙলা বইয়ের বাজারে ধুন্ধুমার লেগে যায়)। তাই প্রশ্ন, যেস্থলে বাঙালি প্রকাশক দু হাজার বই ছাপিয়ে শতকরা ২৫/৩০ কমিশন দেয়, সেস্থলে মার্কিন ইংরেজ এক ঝটকায় পঞ্চাশ হাজার এক লক্ষ ছাপিয়ে কত দেয়? কুইক টানঅভার নামক একটি বস্তুও আছে। শুনেছি এরা ষাট পার্সেন্ট পর্যন্ত দেয়। আমি বলতে যাচ্ছিলুম আশি। তা বলব না কেন? তোমরা যখন এই জীবনমরণ ভাইটাল তত্ত্বটি চেপে যাচ্ছ। দেখাও না কাগজপত্র। আমি অবশ্য বিশ্বাস করব না। তোমরা সব পার।

ঈশ্বর সাক্ষী, স্বরাজ লাভের পর থেকে সরকার বিস্তর বিস্তর আইন পাস করেছেন– আমি চাঁদপানা মুখ করে সব সয়েছি, রা-টি কাড়িনি। কিন্তু সরকার যখন এই কমিশন ব্যাপারের গুহ্য, সযত্নে লুক্কায়িত কমিশন তত্ত্বটি জানতেন বলে হুকুম দিলেন, বাপধনরা যখন দশ টাকার বই চার টাকায় পাচ্ছ তখন আর লাভ করতে যেও না, শিলিঙের দাম ১.০৫, এক পাচেই বেচো, কিনছ তো অষ্ট গণ্ডা পোহা দিয়ে–তখন উল্লাসে নৃত্য করে উঠলুম। আহা হাহা হা! কী আনন্দ, কী আনন্দ!

সস্তায় বই পাব বলে? মোটেই না। বই এমনিতে পাব না, অমনিতেও পাব না। ডিভ্যালুয়েশনের পূর্বেও পাইনি, এখনও পাব না। শুনবেন, কেন? বছর দুই ধরে আমি ধন্না দিচ্ছি, কয়েকখানা ফরাসি ও জর্মন বইয়ের জন্য (হিটলারের জীবনীটি সম্পূর্ণ করব বলে। যুদ্ধের কয়েকটা বছর বাদ দিলে ১৯৩৪ থেকে ১৯৬৪ অবধি আমি এ বিষয়ে বই কিনেছি– কয়েক হাজার টাকার)। সম্প্রতি কলকাতার বইয়ের বাজারে এক ঝাণ্ডু শ্রী রায় (ইনি এম এ, সুশিক্ষিত, সুপণ্ডিত) আমাকে জানালেন, আমি যদি প্রত্যেক বইয়ের অর্থাৎ একই বইয়ের পাঁচখানা করে কপি কিনি(!), তবে বিলিতি বইয়ের বুকসেলার আমাকে আমার প্রার্থিত বই আনিয়ে দিতে পারবেন। তার যুক্তি, একসঙ্গে পাঁচখানা বই না কিনলে বুকসেলার কমিশন পান না!

এ প্রস্তাবটি এমনই উন্মাদের বাতুলতা যে, কোনও পাঠকই এটা বিশ্বাস করবেন না। একই বইয়ের পাঁচখানা করে কপি নিয়ে আমি করব কী? পঞ্চবীর-পতিগর্বিতা দ্রৌপদীর পাঁচটি স্বামীই যদি একই রবর স্ট্যাম্পের পঞ্চলাঞ্ছন, পাঁচ অ্যানকোর হতেন তবে তিনিও যে খুব সন্তুষ্ট হতেন না, অনুমান করা যায়। পাঁচ কেন, দুটো হলেই চিত্তির। আমার শোনা মতে এক রমণীর বিয়ে হয়, যমজ ভাইয়ের একজনের সঙ্গে। ভাশুর ভাদ্রবধূ উভয়ই সন্ত্রস্ত। শেষটায় সাবধানী ভাশুর আরম্ভ করলেন টিকিটিতে পুজোর সময় একটি জবা ফুল বেঁধে নিতে। শয্যায় পদ্মনাভকে স্মরণ না করা পর্যন্ত ক্ষণে ক্ষণে চৈতনপ্রত্যন্তে হাত বুলিয়ে চেক অপ করে নিতেন, ফুলটি স্থানচ্যুত হয়নি তো! কাহিনীটি শুনে ইন্দ্রজিৎ ব্রিামীয় একখান পান ছেড়ে মন্তব্য করলেন, টিকিতে ফুল! তা হলে স্বামী নিয়ে fooling বন্ধ হল।

পাঁচখানা বই- একই বই (পাঁচখানা ভিন্ন ভিন্ন বই নয়, যে-ব্যবস্থাতে তো আমি হরবকত রাজি)– না কিনলে নাকি বাবুরা কমিশন পান না!

তবে আইস পাঠক, শূন্বন্তু বিশ্বে–

কারণ বিশ্বজোড়া ছড়িয়ে-পড়া একটি মাসিক থেকে (জুলাই, ১৯৬৮) বিজ্ঞাপনটি তুলে দিচ্ছি :

Published in England at Rupees 105.00 you have the chance of buying them (the book is in six volumes)-under our NO-RISK money-back guarantee for a mere Rs. 72.00-a saving of 30% on the published price.

অস্য বিগলিতাৰ্থ– সাদামাটা খদ্দের হিসেবেই তুমি ৩০% কমিশন পাবে; এবে শুধোই– অনাথা, অবলা বিলিতি বুকসেলাররা কত পাবেন? সে দিশি কোম্পানি বোম্বায়ে বসে, বিলেত থেকে প্রাগুক্ত বই আনিয়ে এদেশে বিক্রি করছেন, তিনি বুঝি আলা খয়রাতি হাসপাতাল খুলেছেন! তা হলে সাধু! সাধু!! সাধু!!!

বিস্ময়ে অধম নির্বাক! তবু অতি কষ্টে ক্ষীণ কণ্ঠে চি চি করে বলছি, অবিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য, স্বপ্ন নু মায়া নু মতিভ্রম নু– আপনাকে শ্রীরায়ের তন্বী মাফিক একই বইয়ের পঞ্চগব্য খেতে হবে না, হল না– পাঁচ ঢালা গোবর খেতে হবে না– একই বইয়ের পাঁচ কপি কিনতে হবে না।

এস্থলে আরেকটি নিবেদন– বিলিতি পুস্তক-বিক্রেতার বিরুদ্ধে আমার পুঞ্জীভূত বহুবিধ আক্রোশ আছে, গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে জমে উঠেছে ঘোরতর বিতৃষ্ণা এবং আমি তাই আদৌ নিরপেক্ষ নই, আমি প্রাইভেট এবং পাবলিক প্রসিকিউটর উভয়ই দিশি পুস্তক বিক্রেতা ২৫% কমিশন পেয়ে, রোক্কা টাকা ঢেলে বই কিনে নিয়ে যায় আপন রিকে; সে বই বিক্রি না হলে তার পুরোপুরি সমুচহ লোকসান। প্রকাশক বই ফেরত নেবে না। বিলিতি বাবুরা অর্ডার নিয়ে, কোনও কোনও স্থলে পুরো দাম বায়না পকেটস্থ করে বইয়ের জন্য বিদেশে অর্ডার দেন। সিকি কানাকড়ির রিস্ক নেই। এ যে কত বড় ঈশ্বর-প্রতিশ্রুত স্বর্গরাজ্য সে জানে বিক্রেতা।

***

এবারে একটি ব্যক্তিগত নিবেদন; একমাত্র তাদেরই উদ্দেশে যারা আমার অক্ষম লেখনীপ্রসূত মন্দ-ভালো পড়েন। তারাই বলুন, এই যে প্রায় কুড়ি বছর ধরে আমি লিখছি, কখনও দলাদলিতে ঢুকেছি? কখনও কাউকে আক্রমণ করেছি? এমনকি আমি যখন আক্রান্ত হয়েছি, তখন আত্মপক্ষ সমর্থন করেছি? হ্যাঁ, দুএকবার বাদ-প্রতিবাদে নেমেছি, যখন দেখেছি কোনও নিরীহ, বেকসুর, অখ্যাত লেখক আক্রান্ত হয়েছেন কোনও বুলি দ্বারা, যিনি তাঁর নামের পিছনে জুড়ে দিয়েছেন তার সবকটা ডিগ্রির ফিরিস্তি যাতে করে সাধারণ পাঠক, প্রাগুক্ত নিরীহ লেখক এবং সম্পাদক স্তম্ভিত, বিস্মিত এবং সর্বোপরি আতঙ্কিত হন– সেই নিরীহের পক্ষ সমর্থন করে। তখন সেই ফিরিস্তি-পুচ্ছধারী হামলা করেছেন আমার প্রতি। আমি তদ্দশ্যেই নিরুদ্দেশ, কারণ, আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনও প্রয়োজনবোধ করিনি, সেকথা পূর্বেই সবিনয় নিবেদন করেছি। ইতোমধ্যে সেই নিরীহ কিছুটা সান্ত্বনা পেল যে, এ দুনিয়ায় অন্তত আরেকটা মূর্খ আছে, যে তার মতে সায় দেয়।

কেন নামিনি? আমার কলমে বিষ নেই?

কিন্তু এবার নামতে হল। ১৯২১ সালে যখন সর্বপ্রথম জর্মন ফরাসি পাঠ্যপুস্তক কিনতে গিয়েছি, তখন বিলিতি বই বিক্রি করত শুধু বিলিতিরা, এবং তারা কান পাকড়কে নিয়েছে ঢালাও হিসেবে এক শিলিঙের জন্য এক টাকা। তখন বোধহয় শিলিঙের দাম ছিল দশ আনা। এটা নিশ্চয়ই দুর্নীতি নয়। সেই সকল বিপ্রসন্তান বলেছেন, এতদিন পর্যন্ত বই-এর ব্যবসার মধ্যে দুর্নীতি ছিল না বললেই হয়। মোক্ষম তত্ত্ব এবং তথ্য। কারণ সে যুগে, এবং এই পরশুদিনতক সরকার পুস্তকের ব্যাপারে কোনও নিরিখ, প্রাইস-শেডুল বা কেনা-বেচার সময় এক শিলিঙের জন্য কত ভারতীয় মুদ্রা নেবে তার কোনও আইন করে দেননি (controlled price)। কাজেই দুর্নীতির কোনও প্রশ্নই ওঠেনি। কিন্তু সাধারণ গেরস্ত এ নীতিটি মানবে কি? তুলনা দিয়ে শুধোই, আজ মাছের বাজারে আর কন্ট্রোল নেই; মাছওলা যদি কাদা চিংড়ির জন্য ১০ টাকা কিলো চায় তবে তো সেটা দুর্নীতি নয়–মানবে গেরস্ত? দমদমা তো মানছে না। তাদের ওপর এ বৃদ্ধের আশীর্বাদ রইল।

তখন কলকাতায়, বিলিতি বইয়ের ব্যবসাতে প্রাক্তন সুনীতিতে টইটম্বুর টাকার হরিনুট দেখে সে-বাজারে নাবলেন লেটিভরা।

কিন্তু সেই ১৯২১ থেকে ১৯৬৬-র ইতিহাস লিখতে হলে তো এক কিস্তিতে হবে না। তবে লিখব।(৪)

এ সুবাদে সদাশয় সরকারকে আবার বলি তোমার রেশনের চাল অখাদ্য, তুমি ভেজাল কালোবাজার ঠেকাতে পারছ না, বিদেশ গিয়ে দু মাসের জন্য রিসার্চ করে আমার দুখানা বই শেষ করার জন্য কুল্যে দু হাজার মার্ক চেয়েছিলুম তুমি দাওনি, বিদেশি বই কেনার জন্য তুমি ক্রমাগত এক্সচেঞ্জ কমাচ্ছ (এবং যা দিচ্ছ সে-ও ছুতোর-কামারের টেকনিকাল বই আর পাঠ্য পুস্তকের জন্য আমার কাজে লাগে না, ফলে মৃত্যুর পূর্বে আমাকে তুমি বিদেশি বইয়ের দুর্ভিক্ষ লাগিয়ে অন্নহীনবৎ মারছ– আমি রত্তিভর প্রতিবাদ করিনি, করছি না, করবও না। কিন্তু তুমি এই যে বিদেশি বইয়ের দাম কন্ট্রোল করছ, তার জন্য আমি তোমাকে দু হাত তুলে আশীর্বাদ করি। শঙ্কর তোমাকে জয়যুক্ত করুন।

ভেবো না আমি স্বার্থপর। আমি বই পাব না, এমনিতে না, অমনিতেও না। তুমি অঢেল হার্ড কারেসি ছেড়ে দিলেও না, না ছেড়ে দিলেও না। কেন, তার ইঙ্গিত বক্ষ্যমাণে দিয়েছি। বারান্তরে সবিস্তর।

হায়! কোথায় সেই কুটির আর সামনের সুদীর্ঘ পপলার গাছ। সরকার না একবার বলেছিলেন, তারা কালোবাজারিদের ল্যামপোস্ট ঝোলাবেন! পপলার গাছ অনেক ভালো। অনেক দূর থেকে দেখা যায়।

হ্যাঁ, আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল। যদ্যপি আমি বৃদ্ধ এবং শঙ্কর খেদ করেন, বৃদ্ধস্তাবৎ চিন্তামগ্ন আমি কিন্তু তরুণে আরক্ত। তাদের প্রতি এই সুবাদে একটি সদুপদেশ দিই; দুষ্টেরা তোমাদের বিদেশি ভাষা শেখার জন্য উপদেশ দেবে; সরল কনস্যুলেটগুলো তার জন্য ব্যবস্থা করবে এবং করছে। কিন্তু অমন কম্মটি কর না। বিদেশি বই না কিনতে পারলে বিদেশি ভাষা শিখে তোমার লাভ? এ যেন একগোচ্ছা চাবি নিয়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে সিন্দুক কিন্তু একটাও নেই! এ যেন রশি নিয়ে হাওয়ার কোমর বাঁধার মতো বন্ধ্যাগমন! এবং পারলে বাঙলাটাও শিখবে না। বলা তো যায় না, সে বাজারেও কোনদিন কী হয় না হয়! হয়তো একই বই পাঁচ কপি কেনবার বায়নাক্কা বাঙলা পুস্তক বিক্রেতাও করবেন এবং অথবা পাঁচ টাকার বইয়ের জন্য সাত টাকা চাইবেন। আগের থেকে সাবধান হওয়া বিচক্ষণের কর্ম। কেন, নিরক্ষরের দিন কাটে না এদেশে? টিপসই দিয়ে চালাবে।

আমি ভালো করেই জানি, এ প্রবন্ধ ইংরেজিতে লিখলে ধুন্ধুমার লেগে যেত। কারণ, তা হলে হয়তো বিদেশি পুস্তকবিক্রেতাদের চাই, বোম্বাইবাসী শ্রীল শ্রীযুক্ত সদানন্দ বিটকল এটি পড়তেন (শুনেছি, বোম্বাইওয়ালারা নাকি এ বাবদে কলকাতাকে কল্কে দেয় না বড় আনন্দ হল)। যারা বাঙলা জানেন, তাঁরা যদি হুহুঙ্কার সচিৎকার যুদ্ধং দেহি রব ছেড়ে আসরে নামেন তবে আমি প্রস্তুত।

শুধু দয়া করে পরের হাত দিয়ে তামাক খাবেন না।(৫)

সুপণ্ডিত বিপ্রসন্তানকে ডোবাবেন না। অবশ্য তার যদি ব্যবসাতে শেয়ার থাকে তো আলাদা কথা। আমার বিশ্বাস তার নেই।

আর সরকার যদি শেষটায় কন্ট্রোল তুলে নেন মাছের বেলা যা হয়েছে তা হলে আম্মো শেয়ারের সন্ধানে বেরুব। টাকা নিয়ে কথা, মশাই। তার আবার সুনীতি দুর্নীতি কী?

ঝুলবই না হয় একদিন পপলারের মগডালে। ক্রুশবিদ্ধ ক্রাইস্টের দু দিকে আরও কে যেন দুজন ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিল।

———–

১. ক্রোআঁশা =ক্রেসেন্ট অর্ধচন্দ্রের ন্যায় দুধেমাখমে তৈরি ফিনসি রুটি। তুর্করা ভিয়েনা যুদ্ধে পরাজিত হলে পর, ভিয়েনাবাসী তুর্কদের পতাকা-লাঞ্ছন অর্ধচন্দ্র আকারে রুটি বানিয়ে তাঁদের জয় সেলেব্রেট করে। আজ যদি ইস্টবেঙ্গল একটি কেকের উপর মার্শপেনের বাগান বানিয়ে সেটা খায়– অনেকটা সেইরকম! আমি কিন্তু মোহনবাগানি।

২. যাঁরা আর্ট হিস্ট্রির চর্চা করেন, তাদের স্মরণে আসবে গোঁয়ার ছবি, যেখানে গাছে ঝোলানো শত্রুকে পর্যবেক্ষণ করছেন এক অফিসার টেবিলে কনুই রেখে হাতে আরামসে মাথা রেখে। বস্তুত এ ছবি বেরোবার (১৮১০-১৩) কয়েক বছর পরই হাইনে তার প্রবন্ধ লেখেন।

৩. হাইনে ইহুদি। ইহুদিরা খ্রিস্টকে স্বীকার করে না।

৪. এস্থলে নিবেদন, বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা তথা দুর্বলতাবশত আমাকে মাঝে মাঝে পত্রিকায় পঞ্চতন্ত্র বন্ধ করতে হয়। সাতিশয় শ্লাঘা সহকারে স্বীকার করছি তখন কোনও কোনও পাঠক সম্পাদকও আমার কাছে কৈফিয়ত চেয়ে কখনও মিঠে কখনও কড়া চিঠি লেখেন। (যেসব বিচক্ষণ জন আমার লেখা অপছন্দ করেন, তাদের সান্ত্বনার্থে বলি, I am a fool; এবং প্রবাদ আছে One fool raiseth a hundred)। কাজেই পরের কিস্তির গ্যারান্টি দিতে পারি না বলে আমি সন্তপ্ত।

৫. যেসব ভারতীয় বিদেশি বইয়ের ব্যবসা করেন, তাঁদের সম্বন্ধে একটি আপ্তবাক্য প্রযোজ্য। শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণে এসেছেন এক সদ্য বিলেত-ফো– ইভনিং জ্যাকেট, বয়েলড শার্ট পরে। অতি কষ্টে পিড়িতে বসতে বসতে বললেন, মুশকিল, বাঙালাটা ভুলিয়া গেইছি। রবিঠাকুর নাকি শুনে বললেন, সত্যি মুশকিল হে ভড়, ইংরেজিটাও শিখলে না; বাঙলাটাও ভুলে গেলে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *