পদ্মজা – ৬০

৬০

রাতের আঁধার কেটে ভোরের আলোর মাধ্যমে শুরু হয়েছে আরেকটি নতুন দিন। পূর্ণা ও মগা মেঠোপথ ধরে হাওলাদার বাড়ি যাচ্ছে। মাথার ওপর আকাশ আলো করা তেজবিহীন সূর্য। পূর্ণার পায়ের গতি চঞ্চল। সে অস্থির হয়ে আছে। পাশেই কৃষকের ফসলি জমি ছেয়ে গেছে সবুজের সমারোহে। ফসলি জমির সবুজ আর ঘাস, গাছ-পালার ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু সকালের প্রকৃতিতে এক অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে। অথচ সেই সৌন্দর্য পূর্ণাকে ছুঁতে পারছে না। অন্যবেলা হলে সে শিশিরভেজা ঘাসে গা এলিয়ে দিত। কোনো এক অদ্ভুত কারণে ঠান্ডার মধ্যেও তার শিশিরে ভিজতে ভালো লাগে। এখন সেই মন-মানসিকতা নেই। মগা কিছুক্ষণ আগে তাকে খবর দিয়েছে: গতকাল রাতে পদ্মজা আহত অবস্থায় জঙ্গল থেকে ফিরেছে। প্রেমা ঘরে পড়ছিল। বাসন্তী রান্নাঘরে। তাই তারা শুনতে পায়নি। পূর্ণা রোদে বসে সকালের খাবার খাচ্ছিল। খবরটা শোনা মাত্র খাবার রেখে মগাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

কুয়াশা ঢাকা পথে উত্তরে হাওয়ায় কাঁপতে কাঁপতে পূর্ণা হাওলাদার বাড়ি আসে। এক ছুটে পদ্মজার ঘরে যায়। পদ্মজা ঘুমে। শিয়রে ফরিনা বসে আছেন। পূর্ণা করুণস্বরে জানতে চাইল, ‘ও খালাম্মা, আপার কী হয়েছে?’

ফরিনা ইশারায় শান্ত হতে বলে, ধীরেসুস্থে রাতের ঘটনা খুলে বললেন। গতকাল এশার আজানের সময় পদ্মজা কোত্থেকে দৌড়ে সদর ঘরে এসে লুটিয়ে পড়ে। পা থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিল, কাঁটার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। শ্বাস নিচ্ছিল ঘন ঘন। গালের চামড়ারও একই অবস্থা। ফরিনা, লতিফা, আমিনা, রিনু পদ্মজাকে দেখে চমকে যায়। আমিনা দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাকি তিনজন পদ্মজাকে ধরে ঘরে নিয়ে আসে। পদ্মজা পানি খেতে চায়। পানি খাওয়ার পর বলে যে সে জঙ্গলে গিয়েছিল। জঙ্গলের কথা শুনে উপস্থিত দুজন কাজের মেয়ে ও ফরিনার মুখ পাংশুটে হয়ে যায়। তারা আর প্রশ্ন করেনি। বরং বুঝে গিয়েছিল কী হয়েছে! কাঁটা বের করতে গিয়ে আরো রক্তক্ষরণ হয়েছে। পদ্মজা যন্ত্রণায় ঠোঁট কামড়ে শুয়েছিল, অনবরত চোখের জল ফেলেছে। ব্যান্ডেজ করাটা জরুরি হয়ে যায়। কাটাছেঁড়ার প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে ফরিনার ধারণা নেই। তাই তিনি মজিদ হাওলাদারকে গিয়ে বলেন। এই বাড়িতে প্রায়ই মারামারি, কাটাকাটি চলে। তাই মজিদ হাওলাদারের কাছে ব্যান্ডেজ, স্যাভলনসহ বিভিন্ন জিনিসপাতি রয়েছে। তিনি প্রাথমিক চিকিৎসার জিনিসপাতি নিয়ে আসেন। তারপর পদ্মজার পা ভালো করে পরিষ্কার করিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন।

বোনের পায়ের কাছে বসে হাহাকার করে বলল পূর্ণা, ‘আমার আপা এত কষ্ট পেয়েছে!’ পূর্ণার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সে ফরিনার কাছে জানতে চায়, ‘ভাইয়া কোথায়?’

তাৎক্ষণিক ফরিনার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তিনি মিনমিনে গলায় বললেন, ‘জানি না।’

পূর্ণা অবাক স্বরে বলল, ‘ভাইয়া জানে না আপার কথা? রাতে দেখেনি?’

‘বাবু তো বাড়িত আহেই নাই। রানিরে যে খুঁজতে গেল আর আইছে না।’

‘রানি আপারে পাওয়া যায়নি?’

‘না।’

‘আচ্ছা।’

পদ্মজা শরীর নাড়াচ্ছে দেখে পূর্ণা কথা থামিয়ে দিল। সে পদ্মজার পেটের কাছে এসে বসল। বলল, ‘আপা।’

পদ্মজা পিটপিট করে চোখ খোলে। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো টুপ করে পদ্মজার ঝাঁপিয়ে পড়ল চোখেমুখে। দ্রুত চোখ বুজে ফেলল পদ্মজা। তারপর আবার ধীরে ধীরে চোখ খুলল। পূর্ণাকে দেখে অবাক হয়ে উঠে বসতে চাইলে অনুভব করল পায়ে অনেক ব্যথা। সে পায়ের দিকে চেয়ে আরও অবাক হলো। পায়ে ব্যান্ডেজ এলো কী করে! মনে করার চেষ্টা করল, কী হয়েছে তার সঙ্গে। আপন মনে নিজেকেই বলল, ‘রাতে এক ছুটে অন্দরমহলে চলে আসি। ভুলেও পেছনে ফিরে তাকাইনি। সদর ঘর থেকে আম্মা ঘরে নিয়ে আসেন। আব্বা ব্যান্ডেজ করে দেন। আম্মা খাইয়ে দেন। অনেক রাত হয়। উনি তখনো ফিরেননি। তাই চিন্তা হয়। আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলে আম্মা বলছিলেন, চলে আসবে। তারপর কী হয়েছিল মনে নেই। ঘুমিয়ে পড়েছি বোধহয়!’

পদ্মজা ভাবনা থেকে বেরিয়ে সর্বপ্রথমে ফরিনাকে প্রশ্ন করল, ‘উনি ফিরেছেন?

‘না।’

পদ্মজা কী বলবে বুঝতে পারছে না। সে অনেক্ষণ পর বলল, ‘চাচা আর রিদওয়ান ভাই ফিরেছে?’

আইছে তো। তোমার চাচা এহন কই জানি না। রিদওয়ান হের ঘরেই আছে।

‘তাহলে আপনার ছেলে কোথায়?’ পদ্মজা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পূর্ণা পদ্মজার এক হাতে চেপে ধরে অনুরোধ করে, ‘আপা, শান্ত হও। খালাম্মা, রিদওয়ান ভাই আর ছোটো চাচা কিছু বলেনি ভাইয়ার ব্যাপারে? আপনি জিজ্ঞাসা করেননি?’

ফরিনা নির্বিকার স্বরে বললেন, ‘আমি হেরার লগে কথা কই না।’

‘আপনার ছেলের জন্য আপনার চিন্তা হচ্ছে না? রাতে বাড়ি ফেরেনি। আপনি তো মা নাকি?’ পদ্মজার গলা কাঁপছে। তার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে আমিরের কিছু হলে সে মাঝসমুদ্রে পড়বে। হেমলতার পর এই একটা মানুষকেই সে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। ফরিনা নিশ্চুপ। তিনি পদ্মজার কথায় পাত্তা দিচ্ছেন না।

ব্যথায় টনটন করে উঠল পদ্মজার পা। শীতের সময় কাটাছেঁড়া খুব যন্ত্রণার, যে যন্ত্রণায় পূর্ণা এখনও ভুগছে। সেদিন কাঁধে আঘাত পেল, আজও শুকায়নি ভালো করে। কিছুর ছোঁয়া লাগলেই ব্যথা করে। পূর্ণা পদ্মজাকে অনুরোধ করে বলল, ‘আপা, এমন করো না। ভাইয়া চলে আসবে। রানি আপাকে খুঁজতে গেছে। এজন্যই আসতে পারেনি।’

‘রানি আপার বাপ-ভাই তো চলে আসছে।’

‘তুমি তো জানোই, তারা কেমন। রানি আপার জন্য মায়া শুধু ভাইয়ার। তাই ভাইয়া রানি আপাকে ছাড়া আসতে পারছে না।’

পূর্ণার কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত হলেও, পদ্মজার মন মানছে না। গোলমাল তো আছেই। পদ্মজা পূর্ণাকে এক হাতে সরিয়ে বিছানা থেকে নামার জন্য এক পা মেঝেতে রাখে। সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীরে একটা সূক্ষ্ম তীব্র ব্যথা ছড়িয়ে পড়ে। আর্তনাদ করে আবার শুয়ে পড়ল পদ্মজা। ফরিনা ও পূর্ণা আঁতকে উঠে জোর করে শুইয়ে দিল পদ্মজাকে। কিন্তু পদ্মজা নাছোড়বান্দা, সে তার স্বামীর খবর যতক্ষণ না পাবে শান্ত হবে না। ফরিনা আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ওরা বাবুর ক্ষতি করব না। বাবুর কাছে ওদের অনেক কিছু পাওনের আছে। কাগজে-কলমে এই বাড়িডার মালিক বাবু।’

পদ্মজা তীর্যকভাবে তাকাল। বলল, ‘আপনি সব জানেন তাই না?’

পূর্ণা ফোড়ন কাটে, ‘কী জানবে?’

পূর্ণার উত্তর না দিয়ে পদ্মজা ফরিনাকে প্রশ্ন করল, ‘বলুন, আম্মা।’

ফরিনা আড়চোখে দরজার দিকে তাকালেন। ফরিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে পদ্মজা-পূর্ণাও তাকাল। কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ি দেখে মনে হচ্ছে লতিফা। পূর্ণা ডাকতে উদ্যত হয়। পদ্মজা পূর্ণার হাত ধরে ফেলে। ইশারা করে চুপ থাকতে। তারপর ফরিনাকে প্রশ্ন করে, ‘তাহলে আপনি নিশ্চিত ওরা উনার ক্ষতি করবে না?’

‘জানে মারব না।’

এ কথা শুনে পদ্মজা হকচকিয়ে যায়। সে উৎকর্ণ হয়ে বলল, ‘এ কথা কেন বলছেন?’

ফরিনা আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। পদ্মজার মাথার রগ রাগে দপদপ করছে। এই বাড়ির মানুষগুলোর মস্তিষ্কের কী চলে তার কোনো কিনারা নেই! এত জটিল! কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। একেকবার একেকজনের একেক রূপ।

.

পদ্মজাকে সারাদিন এটা-ওটা বলে বিছানায় রাখা হলো। ফরিনাও সারাদিন পাশে রইলেন। পদ্মজা সারাক্ষণ উনি, উনি করে গেছে। ফরিনা কোনো জবাবই দিলেন না। দরজার ওপাশেও সারাক্ষণ লতিফা ছিল। পূর্ণা অনেকবার লতিফাকে ধরেছে। তখন লতিফা হেসে বলেছে, ‘পদ্ম আপা কেমন আছে, দেখতে আইছিলাম।’ পূর্ণা কঠিনস্বরে অনেকবার নিষেধ করেছে যাতে আর না আসে। তবুও লতিফা এসেছে। পদ্মজা নিষেধ করার পর, পূর্ণা স্থির হয়। বিকেল হয়ে গেল, তবুও আমিরের দেখা নেই। এদিকে পদ্মজা বিছানায় বসে ইশারায় ফজরের কাজা নামাজ পড়েছে। দুপুরের, আছরের নামাজও বসে বসে ইশারায় করেছে। ফরিনা দুপুরে না করেছিলেন, ‘এত কষ্ট কইরা নামাজের কী দরহার! কইরো না। আল্লাহ মাফ করব এমনিতে।’

পদ্মজা তখন মিষ্টি করে হেসে জবাব দিয়েছিল, যতক্ষণ হুঁশজ্ঞান আছে নামাজ ছাড়ার পথ নেই, আম্মা। আল্লাহ তায়ালা অসুস্থ মানুষকে ইশারায় নামাজ পড়ারও পথ দিয়েছেন। কেন দিয়েছেন? নামাজ বাধ্যতামূলক বলে। ইসলামে নামাজের গুরুত্ব অনেক বেশি।’

ফরিনা এই কথার ওপরে কিছু বলতে পারেননি। পদ্মজা ধর্মকর্ম নিয়ে খুব জানে। পদ্মজার কাছ থেকে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। ধর্মের কথা বলার সময় পদ্মজা অন্য সবকিছু ভুলে যায়। তাই পুরোটা দুপুর তিনি পদ্মজাকে ইসলাম ধর্মের খুঁটিনাটি নিয়ে প্রশ্ন করেই গেছেন। বিকেলবেলা পূর্ণা জানাল, সে আজ এই বাড়িতে থাকবে। পদ্মজা এ কথা শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে জোরাজুরি করে পূর্ণাকে মোড়ল বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। এই বাড়ি মোটেও সুবিধার না। সে ঝুঁকি নিতে চায় না। পূর্ণা চলে যাওয়ার আগে পদ্মজা কিছু সুরার নাম বলে দেয়। পড়ে ঘুমানোর জন্য একটা দুই লাইনের সুরা শিখিয়ে দেয়। পড়ে ঘুমালে বিপদ হবে না।

পূর্ণা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আজান পড়ে সন্ধ্যার। পূর্বের নিয়মেই নামাজ পড়ে পদ্মজা। ফরিনা পদ্মজার ঘর ছেড়ে রান্নাঘরে চলে যান। পদ্মজা নামাজ শেষ করে বালিশে হেলান দিয়ে চোখ বুজে। আমিরের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। দুইদিন কেটে যাচ্ছে আমিরের দেখা নেই। তার মনের অবস্থা করুণ। বার বার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে। প্রহর গুণছে এই বুঝি মানুষটা চলে এলো। পদ্মবতী, পদ্মবতী বলে একাকার করে দিল ঘর। কিন্তু আসে না।

পদ্মজার বুকের বাঁপাশে চিনচিন ব্যথা বেড়েই চলেছে। গতকাল রাতে আক্রমণ করা লোকটিকে সে তখন চিনতে পারেনি। কিন্তু এখন আন্দাজ করতে পারছে তার পরিচয়। তবে আমিরের শূন্যতা তাকে পোড়াচ্ছে খুব। সে এমন ছটফটানি নিয়ে আর থাকতে পারছে না। আহত পা মাটিতে রেখে ভর দিতেই আবার সেই তীব্র ব্যথা। কিন্তু এর চেয়েও গভীর ব্যথা আমিরের দেখা না পাওয়া। পদ্মজার দুই পায়ের পাতার এক পাশ অক্ষত। সে ওই এক পাশ দ্বারা মাটিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে এক তলায় যায়। সোজা চলে আসে রিদওয়ানের ঘরে। দরজা একটু খোলা ছিল। পদ্মজা একবার ভাবল কড়া নেড়ে ঘরে ঢুকবে। কী মনে করে আর নাড়ল না, সোজা দরজায় ধাক্কা মারল। রিদওয়ান চমকে ঘুরে তাকাল। পদ্মজাকে দেখে তাড়াতাড়ি শার্ট পরতে উদ্যত হয়। পদ্মজা মুচকি হেসে বলল, শার্ট পরে লাভ নেই। চোখে পড়ে গেছে।’

রিদওয়ান ফিরে দাঁড়াল। লম্বা করে হেসে শার্ট পরল। বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, ‘বুদ্ধিমতী। তো দেখতে এসেছো কেমন আছি? ভালো নেই। ছুরি এবং চুরির মালিক দুজনেরই তেজ বেশি ছিল।’

পদ্মজা তিরষ্কার করে হাসল। দুই কদম এগিয়ে এসে বলল, ‘পাগলের প্রলাপ! আন্দাজ ঠিক হবে ভাবিনি। এবার বলুন উনি কোথায়?’

রিদওয়ান ভ্রু দুটি বাঁকিয়ে বলল, ‘আমির?’

পদ্মজা জবাব দিল না। রিদওয়ান বলল, ‘আমি জানব কী করে তোমার জামাই কোথায়?’

‘জানেন না?’ পদ্মজার কড়া প্রশ্ন।

রিদওয়ান উত্তরে হাসল। একটা ছুরি বের করল সে আলমারি থেকে, শীতল স্বরে প্রশ্ন করল, ‘তোমার ছুরিটার নাম কী? আমির কোন দেশ থেকে এনে দিয়েছে?

ফুটপাত থেকে কেনা। ছুরির ধার থাকলেই চলে। অভিজ্ঞ হতে হয় আক্রমণকারীর হাত। তাই ছুরির নাম না খুঁজে নিজের হাতটাকে অভিজ্ঞ করুন।’ পদ্মজার সূক্ষ্ম অপমান বুঝতে রিদওয়ানের অসুবিধা হলো না। সে আলমারির কপাট লাগিয়ে এগিয়ে এসে বলল, ‘ব্যঙ্গ করছ?’

পদ্মজা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল রিদওয়ানের দিকে। বলল, ‘কী আছে জঙ্গলে? কী আড়াল করছেন?’

‘তা জেনে তুমি কী করবে?’

‘কোন অপরাধ চলছে?’

‘তোমাকে জানতে হবে না।’

তখনো তো মারতে এসেছিলেন। এখন তো কাছে আছি, আক্ৰমণ করছেন না কেন?’

রিদওয়ান হাসল। পদ্মজার পেছনে গিয়ে ঘাড়ে ফুঁ দিল। সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজা দূরে সরে যায়। হুমকি দিয়ে বলল, ‘নোংরামি করার সাহস করবেন না। তখনের আঘাতগুলো ভুলে যাবেন না। আমি আমাকে রক্ষা করতে জানি।’

‘এজন্যই পালিয়ে এসেছিলে?’

‘পদ্মজা ক্ষণকালের জন্য পালিয়েছে। যা-ই থাকুক, আমি খুঁজে বের করবই। আর ধ্বংসও করব এই আমি।’

‘দেখো, পদ্মজা, তুমি আর এসব ঘেঁটো না। সুখে আছো সুখে থাকো। নয়তো পরিণতি খারাপ হবে। ভালো করে বলছি ঢাকা ফিরে যাও। আর এসো না।’

‘ভয় পাচ্ছেন?’

‘কাকে? তোমাকে?’ রিদওয়ান সশব্দে হাসল। রিদওয়ানের হাসি পদ্মজার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে। রিদওয়ান হাসতে হাসতে বলল, ‘তোমাকে ভয় পাবে রিদওয়ান?’

‘উনি কোথায় সত্যি জানেন না?’

‘না, জানি না।’

‘আমি কিন্তু—’

‘কী করবে? খুন করবে?’ রিদওয়ান কিড়মিড় করে এগিয়ে আসে। পেছন থেকে পদ্মজার দুই হাত মুচড়ে ধরে বলল, ‘ভালো করে বলছি আর গভীরে যেয়ো না। এককালে তোমাকে বিয়ে করার কথা ভেবেছিলাম বলে বলছি, আর গভীরে যেয়ো না। তোমার করুণ দশা আমিও আটকাতে পারব না।’

‘ছাড়ুন আমাকে।’

‘ছাড়ব না।’ রিদওয়ান পদ্মজার কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়াতেই পদ্মজার সারা শরীর রি রি করে ওঠে। মাথা দিয়ে পেছনে থাকা রিদওয়ানের মুখে আঘাত করে সে।

রিদওয়ান কিছুটা পিছিয়ে গেল, নাকে ভীষণ ব্যথা পেয়েছে। সে কিড়মিড় করে তাকাল হিংস্র জন্তুর মতো। বলিষ্ট, মোটাসোটা শরীরটাকে হারানো যেকোনো মেয়ের জন্য অসাধ্য। পদ্মজা নিজেকে রক্ষা করার জন্য টেবিল থেকে জগ নিলো হাতে। রিদওয়ান বলল, ‘তুমি বাড়াবাড়ি করছো, পদ্মজা।’

‘উনি যদি জানতে পারেন যে আপনি আমার সঙ্গে এই অসভ্যতা করেছেন, আপনার দেহে প্রাণ থাকবে না।’

রিদওয়ান ফিক করে হেসে দিল, যেন মাত্রই মজার কোনো কথা বলল পদ্মজা। রিদওয়ান হাসি ঠোঁটে রেখে বলল, ‘আগে তো ও নিজেকে বাঁচাক। তারপর আমাকে প্রাণে মারবে নাহয়।’

রিদওয়ানের এই কথাটি যেন বজ্রপাত ঘটাল। চিৎকার করে জানতে চাইল পদ্মজা, ‘কোথায় রেখেছেন উনাকে? কী করেছেন উনার সঙ্গে?’

‘ঘরে যাও, পদ্মজা।’

‘আপনি বলুন, উনি কোথায়?’

‘যাও ঘরে।’

‘বলুন আপনি।’

‘পদ্মজা!’

পদ্মজা জগ ছুঁড়ে মারল রিদওয়ানের দিকে। ঝট করে সরে দাঁড়াল রিদওয়ান। জগ স্টিলের থালাবাসনের ওপর পড়ে বিকট শব্দ হলো। সেই শব্দ শুনে ছুটে আসে ছুটে মজিদ, খলিল।

তবে আসেনি একজন মহিলাও।

পদ্মজা বিছানার ওপর ছুরি দেখে দ্রুত হাতে তুলে নিলো সেটা। সে তার নিজস্ব কৌশল ব্যবহার করে রিদওয়ানকে আঘাত করতে উদ্যত হলো। রিদওয়ান ছুরিসহ পদ্মজার হাত ধরে ফেলে। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোমার তিন বছরের ছুরি চালানোর অভিজ্ঞতা আর আমার বিশ বছরের পেশা। পেরে উঠবে না।’

পদ্মজার হাত থেকে খলিল ছুরি টেনে নিলো। পদ্মজা যেন হিংস্র বাঘিনী হয়ে উঠেছে। আমিরের শোকে তার মাথা কাজ করছে না। দুই দিন হয়ে গেল আমিরের দেখা নেই। তার ওপর সারা শরীরে ব্যথা। তার নিজেকে উন্মাদ মনে হচ্ছে। রাগে রিদওয়ানের গলা চেপে ধরল সে। রিদওয়ান পদ্মজার হাত থেকে ছোটার চেষ্টা করতে গিয়ে পদ্মজাকে নানাভাবে আঘাত করল বটে, তবে পদ্মজা কিছুতেই ছাড়ছে না। তার শরীরের শক্তি হঠাৎই দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। আমির তার জীবনে কতটা মূল্যবান—তা কেউ জানে না। আমিরের জন্য সে সবকিছু করতে পারে। খলিল এক হাতে পদ্মজার চুল মুঠ করে ধরে, অন্য হাতে পদ্মজার গাল চেপে ধরে বলল, ‘বেশ্যার ছেড়ি, আমার ছেড়ারে ছাড়।’

তাও পদ্মজা ছাড়ল না। মজিদ এগিয়ে এসে পদ্মজাকে টেনে সরালেন। পদ্মজার শরীর কাঁপছে। সে চিৎকার করে বলছে, ‘উনার কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়ব না। মেরে ফেলব। মেরে ফেলব একদম।’

রিদওয়ান ছাড়া পেয়ে প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো। তারপরই তেড়ে এসে থাপ্পড় বসাল পদ্মজার গালে। পদ্মজার গালের ক্ষত থাপ্পড়ের ভার নিতে ব্যর্থ হয়, ছিলে গেল চামড়া। পদ্মজার দুই হাত মজিদ ধরে রেখেছেন। পদ্মজা আম্মা মজিদকে খেয়াল করেনি। সে চেঁচিয়ে ফরিনাকে ডাকল, আম্মা, আপনি কোথায়? আম্মা ওরা আপনার ছেলেকে মেরে ফেলবে। আম্মা…’

ফরিনা এলেন না। খলিল হুংকার ছাড়েন, ‘এই খানকির ছেড়ির গত্রে আগুন বেশি। ছিঁইড়া দে ওরে।’

পদ্মজার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে মুখভরতি থুতু ছুঁড়ে দেয় খলিলের মুখের ওপর। তাৎক্ষণিক রিদওয়ান পদ্মজার শাড়ির আঁচল দিয়ে পদ্মজারই গলা পেঁচিয়ে ধরে কিড়মিড় করে বলল, ‘এই মাঘীর ঝি, তোরে অনেক্ষণ ধরে বোঝাচ্ছিলাম। ভালো কথা কান দিয়ে ঢুকে না? মায়ের মতো হইছস? তোর মারেও মেরে দিতাম, যদি নিজে থেকে না মরত।’

পদ্মজার চোখ উলটে যাচ্ছে। মজিদ রিদওয়ানকে বললেন, ‘রিদওয়ান ওরে ছেড়ে দে। মরে যাবে!’

রিদওয়ান তাও ছাড়ছে না। অবশেষে খলিল রিদওয়ানকে জোরে ধাক্কা দিয়ে সরালেন। পদ্মাজার শরীরের সব শক্তি শেষ। সে কাশতে কাশতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল, চোখ বুজে আসছে। কল্পনায় ভেসে উঠল আমিরের শ্যামবর্ণের মায়াময় মুখ। আর মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে ডাকল, ‘আম্মা।’

তারপরই হারিয়ে ফেলল জ্ঞান। তিনজন পুরুষের মাঝে লুটিয়ে পড়ে আছে পদ্মজা। বুকে শাড়ি নেই। খয়েরি রঙের ব্লাউজ পরা। গলায় লাল দাগ। মুখে নখের আঁচড়। গালে চেপে ধরার দাগ। চামড়া ছিলে যাওয়ার রক্ত। ফরসা দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরার দাগ জ্বলজ্বল করে ভাসছে। চুল কয়টা ছিঁড়ে পড়ে আছে আশপাশে। পায়ের সাদা ব্যান্ডেজ আবার লাল হয়ে উঠেছে। আগুন সুন্দরী পদ্মজার খুঁতহীন রূপে খুঁতের মেলা বসে গেছে! জানালা দিয়ে আসা উত্তরে হাওয়ায় হুঁশহারা পদ্মজার রক্ত ধীরে ধীরে শুকাতে থাকে। কেউ নেই তাকে বুকে আগলে ধরার জন্য।

পদ্মজার অবস্থা দেখে ঘরের দেয়ালগুলোও গুমরে গুমরে কাঁদছে।

৬১

মাথার ওপর সূর্য নিয়ে কলসি কাঁখে আজিদের বাড়িতে ঢুকল পূর্ণা। পাতলা ছিপছিপে গড়ন অথচ কাঁখে পিতলের প্রকাণ্ড কলসি! খালি কলসির ভারেই বাঁকা হয়ে পড়েছে! পানিভরতি কলসি নিয়ে কী করে বাড়ি ফিরবে কে জানে! সকাল থেকে তাদের টিওবওয়েলে সমস্যা। পানি আসছে না। সকালে বাসন্তী আজিদের বাড়ি থেকে পানি নিয়েছেন। এখন আবার আসতে চেয়েছিলেন, পূর্ণা আসতে দিল না। সে নিজে দায়িত্ব নিয়ে এসেছে। বাসন্তী অনেকবার বলেছেন, ‘এইটুকু শরীর নিয়ে পারবি না।’

পূর্ণা অহংকার করে বলেছে, ‘আমি পারি না এমন কিছু নেই। তুমি ঘরে যাও তো।’

আজিদের বাড়ির সামনে পুকুর আছে। সেখানে নতুন ঘাট বাঁধানো হয়েছে। ঘাটে গোসল করছে আজিদের বউ আসমানি। ছয় মাস আগে বিয়ে হলো। আসমানির সঙ্গে পূর্ণার অনেক কথা হয়েছে।

পূর্ণা আসমানিকে না দেখলেও আসমানি পূর্ণাকে দেখে ডাকল, ‘কি গো পূর্ণা! ফেইরাও চাইলা না। ভাবিরে চোক্ষে পড়ে নাই?’

পূর্ণা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। অপরাধী কণ্ঠে বলল, ‘খেয়াল করিনি, ভাবি।’

‘পানি নিতে আইছো?’

‘হু, আমাদের টিউবওয়েল—’

‘শুনছি খালাম্মার কাছে। একটু বইসো। আমি ডুব দিয়া আইতাছি।’

‘আচ্ছা, ভাবি।’

পূর্ণা মুখে আচ্ছা বললেও মনে মনে পরিকল্পনা করে পানি নিয়ে অন্য পথ দিয়ে বাড়িতে চলে যাবে। আসমানি একবার কথার ঝুড়ি নিয়ে বসলে, কথা ফুরোয় না। পূর্ণা আড্ডাবাজি খুব পছন্দ করে। কিন্তু এখন তার তাড়া আছে। তাড়াতাড়ি ফেরা চাই। দুপুর হয়ে গেছে। পদ্মজাকে এখনও দেখতে যেতে পারেনি সে। গতকাল বিকেলে যে দেখে এলো, তারপর আর খোঁজ মিলেনি। চিন্তায় সারারাত ঘুম হয়নি পূর্ণার। আজিদের বাড়ির অঙ্গণ শূন্য, ঘরের বাইরে কেউ নেই। পূর্ণা সোজা কলপাড়ে এসে দ্রুত কল চেপে কলসি ভরে নিলো। কিন্তু কলসি কাঁখে তুলতে গিয়ে হলো সমস্যা, কিছুতেই তুলতে পারছে না। আসমানি গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে এলো। ফরসা, সুন্দর একটা মুখ। নতুন বউ-নতুন বউ ছাপটা এখনও মুখে লেগে আছে। আসমানি কাছে এসে হেসে বলল, ‘এত বড়ো কলসি নিবা কেমনে? খালাম্মারে পাঠাইতা।’

‘তুমি একটু সাহায্য করো।’

‘কী কও? আমি লইয়া যামু কলসি?’

‘আমি কি তা বলছি, ভাবি! কাঁখে তুলতে সাহায্য করো।’

আসমানি ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল, ‘ওহ! বাড়ির বউ তো শরম লজ্জার ডরেই বাইর হই না। নয়তো বাড়ি অবধি দিয়া আইতাম।’

‘বাড়ি থেকে বের হতেই লজ্জা, ভাসুরের সঙ্গে শুতে লজ্জা নাই?’

পূর্ণা কটাক্ষ করে বলল, ঠোঁটে তিরস্কারেরা হাসি। আসমানির চোখমুখের রং পালটে গেল, লাল হয়ে গেল ফরসা মুখটা। চোখ ছাপিয়ে নেমে এলো জল। ক্ষণমুহূর্ত পূর্ণার দিকে চেয়ে থাকে সে। তারপর এদিক- ওদিক দেখে পূর্ণার এক হাত চেপে ধরে চাপা স্বরে বলল, ‘কী কইরা জানছো?’

পূর্ণা এক ঝটকায় আসমানির হাত সরিয়ে দিল। বলল, ‘তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসে জানালা দিয়ে এই নোংরামি দেখছি। আজিদ ভাই মাটির মানুষ। কত ভালো উনি। উনাকে কেন ঠকাচ্ছো, ভাবি?’

আসমানি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার হাত দুটি অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। চোখ থেকে জলের ধারা নেমেছে। পূর্ণার দেখে মায়া হয়। সে কণ্ঠ নরম করে বলল, ‘কাউকে বলিনি আমি। বারো-তেরো দিন যখন চেপে রাখতে পেরেছি, সারাজীবন পারব। ভালো হয়ে যাও, ভাবি। আজিদ ভাইকে ঠকিও না। পাপ করো না।’

আসমানি অশ্রুরুদ্ধকর কণ্ঠে বলল, ‘আমারে খারাপ ভাইবো না।’

পূর্ণা কিছু বলল না। খারাপ কাজ করার পরও কী করে খারাপ না ভেবে থাকা যায়! সে আসমানিকে অগ্রাহ্য করে কলসি তোলার চেষ্টা চালাল। আসমানি দ্রুত পায়ে কলপাড় ছাড়ে। পূর্ণা কলসি কাঁখে তুলতে সক্ষম হলো, কিন্তু খুব বেশি ভার। এখনই কোমর মচকে যাবে! পূর্ণা কলপাড় ছাড়তেই সামনে এসে দাঁড়াল আসমানি। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে এক নিশ্বাসে বলল, ‘কাউরে কইয়ো না, পূর্ণা। আমারে তোমার ভাই আর ঘরে রাখব না। আমি চাই নাই এমন করতে। শফিক ভাই তো আমগোর থানার পুলিশ মানুষ। আমার ছোডু বইনডা এক মাস ধইরা হারায়া গেছে। অনেক খুঁজছি পাই নাই। পুলিশ দিয়া খোঁজানোর ক্ষেমতা আমার বাপের নাই। শফিক ভাইরে কইছিলাম, তহন উনি কইছে উনার সঙ্গে—’  

আসমানি ফোঁপাতে থাকে। চোখ থেকে বৃষ্টির মতো জল পড়ছে, সমুদ্র বয়ে যাবে এক্ষুনি। পূর্ণা খুব অবাক হয়। একটা মানুষ কতটা নিকৃষ্ট হলে এভাবে ছোটো ভাইয়ের বউয়ের বিপদে সাহায্য করার নামে এমন কুৎসিত শর্ত রাখতে পারে? পূর্ণার রাগ হয় খুব। আসমানিকে আশ্বাস দিয়ে পূর্ণা বলল, ‘ভাবি, কেঁদো না। যে মানুষ এমন শর্ত দিতে পারে সে কখনোই কাউকে সাহায্য করতে পারে না। উনি তোমার বোনকে খুঁজবে না। কিন্তু আশা দেখিয়ে ভোগ ঠিকই করবে। আর সুযোগ দিয়ো না। দোয়া করো শুধু তোমার বোন যেন ফিরে আসে।’

আসমানি শাড়ির আঁচল দিয়ে দুই চোখ মুছে বলল, ‘জানো পূর্ণা, আমি আমার বইনরে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারতাম না।’

‘তোমার সঙ্গে তো এক মাসে আরো দুইবার দেখা হয়েছে। কখনো তো বললে না তোমার বোনকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘আম্মা কইছে, ছেড়ি মানুষ হারায়া গেলেও কেউরে কইতে নাই। মানুষ ভাববো ছেড়া নিয়ে পলাইছে।’

‘আমি আসি আজ। কাল এসে সব শুনব। অনেক কথা বলব।’

আসমানি ঘাড় কাত করে সম্মতি জানাল। পূর্ণা ধীর পায়ে আজিদের বাড়ির উঠোন ছাড়ে। পথে উঠতেই দেখা হয় আজিদের মার সঙ্গে। নাম মালেহা বানু। সঙ্গে পাশের বাড়ির বৃদ্ধা জয়তুনি বেগম রয়েছেন। বৃদ্ধার মাজা বয়সের ভারে ঈষৎ ভেঙে শরীর সামনে ঝুঁকে পড়েছে। পূর্ণাকে দেখে মালেহা বললেন, ‘কি রে ছেড়ি, পানি নিতে আইছিলি?’

‘জি, খালা।’

‘কলসির ভারে দেহি সাপের লাহান বাঁইকা গেছস লো!’ বললেন জয়তুনি বেগম।

পূর্ণার সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছে। সে কলসি নামাল। প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলো একটা। মালেহা বললেন, ‘বিয়েশাদি কী করবি না? তোর বইনে না আইছে বিয়া দিব?’

‘দিবে মনে হয়।’

‘তোর লগে হাওলাদার বাড়ির কোন ছেড়ার নাকি ঢলাঢলি চলে?’ বললেন জয়তুনি বেগম। কথা বলার ভঙ্গিটা দৃষ্টিকটু ছিল। পূর্ণার গা জ্বলে উঠে। রেগে যায়। বলল, ‘আপনাকে কে বলেছে?

‘এইসব কিচ্ছা বাতাসে ছড়ে। এমন আর করিছ না, পূর্ণা। গায়ের রঙডা ময়লা, বয়সও বেশি; আবার তো আরেক কিচ্ছাও আছে। কয়েক বছর আগে বেইজ্জতি হইছিলি গ্রামবাসীর হাতে। এহন আবার এমন কিচ্ছা কইরা বেড়াইলে কেউ বিয়া করব না। এহন দেখ তোর বইনে কোনো ল্যাংড়া, লুলা দেইখা বিয়া দিতে পারেনি।’ বললেন মালেহা।

পূর্ণার মাথার আগে মুখ চলে বেশি। সে কিছু কড়া কথা শোনাতে উদ্যত হয়। তার পূর্বেই একটা প্রিয় পুরুষ কণ্ঠ ধেয়ে আসে, ‘পূর্ণারে কে বিয়া করব না করব সেটা তো আপনেরে দেখতে কয় নাই কেউ।’

পূর্ণা না তাকিয়েই চিনে যায় কণ্ঠটির মালিককে। বুকের বাঁ পাঁজর ছ্যাঁত করে উঠল। উপস্থিত তিনজন একসঙ্গে ঘুরে তাকাল। কিছুটা দূরে মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় গামছা বাঁধা। পরনে কালো শার্ট আর নীল লুঙি। রোদের আলোয় গায়ের ফরসা রঙ চিকচিক করছে। কী সুন্দর! পূর্ণা হেসে আবার চোখ ঘুরিয়ে নিলো। মৃদুল মালেহাকে উদ্দেশ্য করে আবার বলল, নিজের চরকায় তেল দেন। পূর্ণার গায়ের রঙ ময়লা আর আপনের কি পরিষ্কার? নিজের রঙডা আগে দেখেন।’

‘এই ছেড়া তুমি কই থাইকা আইছো? বাপের নাম কিতা?’ বললেন মালেহা।

‘কেন? পছন্দ হইছে? ছেড়ি আছে? বিয়া দিবেন? ছেড়ির গায়ের রং পরিষ্কার তো?

মালেহা বানু হকচকিয়ে গেলেন। এ কেমন জাতের ছেলে! কেমন ফটফট করে! মৃদুল যেন বিরাট রসিকতা করেছে এমনভাবে হাসল পূর্ণা। মৃদুল কলসি কাঁধে তুলে নিয়ে পূর্ণাকে আদেশের স্বরে বলল, ‘হাসি থামায়া হাঁটো।’

মালেহা বানু ও জয়তুনি বেগমকে অবাক করে মৃদুল, পূর্ণা চলে যায়। কিছুটা দূর এসে পূর্ণা প্রথম মুখ খুলল, ‘কখন এসেছেন?’

‘কিছুক্ষণ আগে। মুখটা শুকনা দেখাইতাছে কেন? ‘আপাকে দেখেছেন আপনি?’

‘না। অন্দরমহলে ঢুকি নাই।’

পূর্ণা চুপ হয়ে যায়। মৃদুল বলল, ‘এত ভার কলসি নিতে পারছো?’

‘কষ্ট হয়েছে।’

‘তো নিতে গেলা কেন?’

পূর্ণা আবার চুপ হয়ে গেল। মৃদুল দাঁড়িয়ে পড়ে। আর এক মিনিট হাঁটলেই মোড়ল বাড়ি। সে পূর্ণার মুখের দিকে চোখ রেখে বলল, ‘খুশি হও নাই?’

‘কী জন্য?’ পূর্ণা অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘এই যে আইয়া পড়ছি।’

পূর্ণা চোখ নামিয়ে ফেলে। মুচকি হাসে। চোখেমুখে লজ্জা ফুটে উঠে। মৃদুলও হাসল। সে যা বোঝার বুঝে গেছে। আশপাশে অনেক গাছপালা। বড়ো একটা গাছের ছায়ায় তারা দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামের কেউ দেখে ফেলবে এই ভয় দুজনের কারোর মধ্যে নেই। পূর্ণার পরনের কাপড়খানি ভেজা। কলসি থেকে পানি পড়ে ভিজে গেছে। পেট ও কোমরের একাংশে লেপ্টে আছে কাপড়। মাথায় ঘোমটা নেই। গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে এক ঝলক রোদ পূর্ণার মুখ ঘেঁসে কাঁধ ছুঁয়ে মাটিতে পড়ে। সবকিছু মৃদুলের নজরে বন্দি! সে চমৎকার করে পূর্ণাকে বলল, ‘ঘোমটা দিয়ে পথে হাঁটবা। বুঝছো, ডাগরিনী?’

পূর্ণা ঠোঁটে হাসি রেখেই বাধ্যের মতো হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াল। তারপর চট করে টেনে নিলো ঘোমটা। মৃদুলের মুখের ডাগরিনী শব্দটা তার মন কাঁপিয়ে তুলেছে। খুশিতে উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। ডাগরিনী বলেছে মানে, তার চোখ দুটি ডাগর ডাগর…যা মৃদুলের ভালো লেগেছে! তার প্রশংসা করেছে!

দুপুরের খাওয়াদাওয়া করে পূর্ণা তৈরি হয় হাওলাদার বাড়ি যাওয়ার জন্য। সঙ্গে তৈরি হয় বাসন্তী, প্রেমা ও প্রান্ত। তখন মগা এলো। পূর্ণার হাতে চিঠি দিয়ে বলল, ‘তোমার বইনে দিছে।’

চিঠি হাতে নিয়ে পূর্ণা মনে মনে ভয় পেল। আপা চিঠি কেন পাঠাবে? অজানা আশঙ্কায় পূর্ণার বুক ধুকপুক করতে থাকে। মগা চলে যায়। চিঠি খুলল পূৰ্ণা—

আদরের বোন,

তুই আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসিস, আমি জানি। আমার সব কথাও মানিস। মাঝে মাঝে ফাঁকিবাজিও করিস তবে এখন আমি তোকে যা করতে বলব একদম অমান্য করবি না। এটা আমার অনুরোধ।

যতদিন না আমি আসছি বা চিঠি লিখছি, একদম এই বাড়িতে আসবি না। কেউ যদি বলে আমি পাঠিয়েছি তোকে আনতে। তাও আসবি না। চোখ-কান খোলা রাখবি। প্রেমাকে দেখে রাখবি। আমি ভালো আছি। পায়ে একটু আরাম পেয়েছি। একদম চিন্তা করবি না। আমি খুব দ্রুত আসব। কেন নিষেধ করেছি আসতে, তা নিয়ে মাথা ঘামাস না। আমি একদিন তোকে সব বলব। এখন আমার কথাটা রাখ। এমুখো হস না। আমি ভালো আছি। আবার ভাবিস না আমি কোনো বিপদে আছি। শুনবি কিন্তু আমার কথা। আমার কথা অমান্য করলে আমার সঙ্গ আর পাবি না, মনে রাখবি। খাওয়াদাওয়া করবি ঠিকমতো। নামাজ পড়বি। ঘরের কাজকর্মে হাত লাগাবি।

ইতি

তোর আপা

লেখাগুলো এলোমেলো, অগোছালো। মনে হচ্ছে তাড়াহুড়ো করে লিখেছে অথবা অনেক কষ্টে লিখেছে একেকটা অক্ষর। কপালে ছড়িয়ে থাকা এক গাছি চুল কানে গুঁজে পূর্ণা আবার চিঠিটা পড়ল। পড়ার পর এতটুকু নিশ্চিত হয়েছে যে তার বোন ভালো নেই।

বড়ো বিপদে আছে সে!

৬২

ঘুম ভাঙতেই হকচকিয়ে গেল পদ্মজা। চোখের সামনে সব কালো। কালো রং ব্যাতীত কিছু নেই। ঘোর অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। পদ্মজা চোখ কচলে আবার তাকাল। না, কিছুই বদলায়নি! সবকিছু কালো। বিকেলে সে বৈঠকখানার সোফায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। তারপর নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ে। আর ঘুম ভাঙতেই দেখছে সব অন্ধকার! পদ্মজা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় দেয়ালের সুইচ। তখন সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসে একটা আলো। আলোয় ভেসে উঠে আমিরের মুখ। পদ্মজা দেয়াল থেকে হাত সরিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আমির পদ্মজার চেয়ে দুই হাত দূরে এসে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি আবেগপ্রবণ। পদ্মজার হৃদস্পন্দন থমকে যায়। কাঁচুমাচু হয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি সব বাতি নিভিয়েছেন?’

আমির জবাব না দিয়ে হাতে থাকা সুন্দর কাচের হারিকেনটি পাশে রাখল। পদ্মজা কিছু বুঝে ওঠার আগে পদ্মজাকে কোলে তুলে নিলো। পদ্মজা আমতা আমতা করে শুধু বলতে পারল, ‘এ…এ… কি…কী?’

আমির তাদের ঘরে নিয়ে আসে পদ্মজাকে। পদ্মজা ঘর দেখে অবাক হয়। ঘরের চারিদিকে অদ্ভুত সুন্দর কাচের ছোটো হারিকেন। আর মাঝে এক ঝুড়ি পদ্মফুল! সময়টা শরৎকাল। দিনের বেলা শরতের সাদা মেঘ নীল আকাশে পাল তোলে, ছবির মতো ঝকঝকে সুন্দর করে তোলে আকাশটাকে। কমে আসে যখন তখন বৃষ্টির জ্বালাতন। সময় বিল ঝিল ছাপিয়ে শাপলা আর পদ্ম ফোঁটার। এত পদ্ম ফুল দেখে মনে হচ্ছে বড়ো এক বিলের সব পদ্ম ফুল তুলে নিয়ে এসেছে আমির। পদ্মজা প্রশ্ন করার পূর্বে আমির পেছন থেকে দুই হাতে পদ্মজার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, মনে আছে প্রথম রাতে বলেছিলাম একদিন পদ্ম ফুল দিয়ে আমার পদ্মাবতীকে সাজাব! সময়টা নিয়ে এসেছি। দেখো তাকিয়ে।’

পদ্মজা ঝুড়ি ভরতি পদ্ম ফুলগুলোর দিকে তাকাল। তার চোখ দুটি জলে ছলছল করে উঠছে। ঘাড় ঘুরিয়ে আমিরের দিকে চেয়ে আবেগমাখা কণ্ঠে বলল, ‘সে কথাটাও মনে রেখেছেন!’

উত্তরে আমির হেসেছিল। প্রথম রাতের চেয়ে কোনো অংশে কম সুন্দর ছিল না সেই রাত। পদ্মজা সেজেছিল পদ্ম ফুল দিয়ে। স্বামী যত্ন করে সাজিয়েছিল। সময়টাকে আরো সুন্দর করে তুলতে প্রকৃতি দিয়েছিল মৃদু শীতল বাতাস।

জানালা দিয়ে প্রবেশ করা বাতাসের দাপটে পদ্মজার ঘুম ছুটে যায়। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। হাত বাড়িয়ে খোঁজে আমিরকে। নেই, বিছানা খালি! আবার সে পুরনো দিনের আরেকটি সুন্দর মুহূর্ত স্বপ্নে দেখেছে।

জলে ভরে উঠে তার চোখ দুটি। আজ পাঁচ দিন আমির নেই, কোনো এক অজানা জায়গায় বন্দি হয়ে আছে। পদ্মজা এক হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। বালিশের ওপর থাকা আমিরের শার্টটায় চুমু খেল একবার, আবার ভিজে উঠল তার চোখ দুটি। সেদিন রিদওয়ান, খলিল, মজিদ দ্বারা আহত হওয়ার পর তাকে ওখান থেকে কে নিয়ে এসেছে, সে জানে না। চোখ খুলে ফরিনাকে দেখেছিল। তিনি ডুকরে কাঁদছেন আর চোখের জল মুছছেন। লতিফাকে জিজ্ঞাসা করে পদ্মজা জানতে পারে, সময়টা দুপুর। সারা শরীরে তখন বিষধর ব্যথা। ওঠার শক্তিটুকু নেই। গলায় ব্যথা একটু বেশি ছিল। প্রথমে তার মাথায় আসে আমিরের কথা। রাতের ঘটনা মনে পড়তেই বুঝে যায়, এভাবে সে এদের সঙ্গে পারবে না। তাকে তার মায়ের মতো শান্ত হতে হবে। সময়-সুযোগ বুঝে কাজ করতে হবে। ফরিনা আদর করে খাইয়ে দিলেন। তিনি পদ্মজার ওপর করা নির্মম অত্যাচার আটকাতে পারেননি বলে বারবার ক্ষমাও চেয়েছেন। তিনি নাকি চেষ্টা করেছিলেন। কীরকম চেষ্টা করেছেন সেটা বলেননি। পদ্মজা জিজ্ঞাসাও করেনি। এরপর পদ্মজা কাঁপা হাতে পূর্ণাকে চিঠি লিখে ফরিনার হাতে দেয়। তিনি মগাকে দিয়ে পাঠিয়ে দেন মোড়ল বাড়ি।

পরের দিনগুলো চুপচাপ কাটিয়ে দেয় পদ্মজা। আমিরের শোকে ভেতরে ভেতরে ঝড় বইলেও সামনে সে নিশ্চুপ থেকেছে। সুস্থ হওয়াটা আসল। নয়তো কাজের কাজ কিছুই হবে না। উলটো নর্দমার কীটগুলোর হাতে মরতে হবে। আমিরের জন্য দোয়ায় দুই হাত তুলে অঝোরে কেঁদেছে, আমির যেন ভালো থাকে। তার কাছে ফিরে আসে। খুব মনে পড়ে মানুষটাকে! হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। পদ্মজা আমিরের শার্ট বুকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। দরজার সামনে এসে ফরিনা দাঁড়ান। কেউ একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে খেয়াল হতেই পদ্মজা হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছে তাকাল। ফরিনা ঘরের ভেতরে ঢুকলেন, গায়ে সাদা খয়েরি মিশ্রণের শাল। পদ্মজা আমিরের শার্ট বালিশের ওপর রেখে বলল, ‘আছরের আজান পড়েছে, আম্মা?’

মৃদুল অন্দরমহলের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে। তাকে মদন কিছুতেই অন্দরমহলে ঢুকতে দিচ্ছে না। চারদিন ধরে সে চেষ্টা করছে অন্দরমহলে ঢোকার। গত তিন দিন ভুঁড়িওয়ালা একজন লোক অন্দরমহল পাহারা দিচ্ছিল, ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না। এখন দিচ্ছে না মদন। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে সে মৃদুলের সঙ্গে তর্ক করছে। মৃদুল বলছে, ‘দুলাভাই, ঢুকতে দেন কইতাছি। সমস্যাটা কী ঢুকলে? সেটাই তো বুঝতাছি না।’

‘দেহো মৃদুল মিয়া, এইডা আমার কথা না। মজিদ চাচার কথা। উনি কইছে বাড়ির ভেতরে নতুন কেউরে ঢুকতে না দিতে।’

‘আমি তো আত্মীয়, নাকি? আমার সঙ্গে এমন করা হইতাছে কেন? আগে তো ঠিকই ঢুকতে দিত। এহন দেয় না কেন?’

‘হেইডা তো আমি জানি না।’

‘সরেন কইতাছি। নইলে ওই যে গাছের মোড়াডা ওইডা দিয়ে আবার মাথাডা ফাডায়া দিব। একবার মারছে আপাই, এহন আমি মারাম।’

‘হেইডাই করো, তবুও আমি চাচার কথা অমান্য করতে পারতাম না।’

‘আমার কিন্তু কইলাম রাগ উঠতাছে। মাটির তলায় গাইরালামু।’

‘মিয়া ভাই, তুমি আমারে যা ইচ্ছা কইরালাও। আমি—’  

মৃদুলের মাথা বরাবরই চড়া! হুট করে খুন করার মতো রাগ চেপে যায় মাথায়। সে মদনের গলা চেপে ধরতেই মদন কাশতে থাকল। আলো কান্না শুরু করে। আলোর কান্না শুনে খলিল ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সদর দরজার সামনে এমন দৃশ্য দেখে দৌড়ে ছুটে এলো সে। মৃদুলকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে হুংকার ছাড়ল, ‘তোমার এত সাহস কেমনে হইছে? আমার জামাইয়ের গলা চাইপা ধরো!’

মৃদুলের নাক লাল হয়ে গেছে রাগে। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। রাগী মেজাজ নিয়েই দুই হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল, ‘আপনার জামাই আমারে ভেতরে ঢুকতে দেয় না।’

তুমি মেহমান মানুষ, আলগ ঘরে থাকবা। এইহানে কী দরকার?’

‘এই নিয়ম কবে করছেন আপনেরা? আগের বার যখন ছিলাম তহন তো ঠিকই ঢুকতে দিছেন ‘

‘এহন আর ঢুহন যাইব না। এইডা অন্দরমহল। বাড়ির বউ-ছেড়িদের জায়গা।

‘সত্যি কইরা কন তো, বাড়ির ভিতর কী চলে?’

খলিলের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে, অসভ্য ছেলেটার কানের নিচে কয়টা দিয়ে দিতে। সে কটাক্ষ করে মৃদুলকে বলল, ‘নিজের বাড়ি রাইখা এইহানে পইড়া রইছো কেন? মাইনষের অন্ন নষ্ট করতাছো। নিজের বাড়িত যাও। ‘

অপমানে মৃদুল বাকহীন হয়ে পড়ে! সে ক্ষণকাল কথা বলতে পারল না। তার আপন ফুফা এমন কথা বলল! ক্ষণমুহূর্ত পর সে জ্বলে উঠে বলল, ‘আপনের বাড়ির উপর থুতু মারি। আমি ব্যাঠা মিয়া বংশের ছেড়া। শত বিঘার মালিক আমি একাই। আপনের অন্নের ঠেকা পড়ে নাই আমার। আমার বাড়িত কামলাই আছে দশ-বারো জন। আমি কাইলই চইলা যাইয়াম বাড়িত।’

মৃদুলের আর এক মুহূর্তও এখানে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। সে ঘুরে দাঁড়াল। কাছেই একটা বিরাট পাতিল ছিল। কোনো কাজে হয়তো বের করা হয়েছে। সে পাতিলে জোরে লাথি মেরে হনহন করে চলে যায়। পূর্ণা তার বোনের খবর নিয়ে দিতে বলেছে বলেই সে বার বার অন্দরমহলে ঢোকার চেষ্টা করেছে। নয়তো মৃদুলকে কেউ একবার কোনো ব্যপারে না করলে সে দ্বিতীবারের মতো সেখানে ফিরেও তাকায় না।

.

পদ্মজার কথার জবাব দিলেন না ফরিনা। তিনি পদ্মজার পাশে গিয়ে বসলেন। পেছনে রিনু আসে। হাতে খাবারের প্লেট। তিনবেলা ফরিনাই খাইয়ে দিচ্ছেন। যত্ন নিচ্ছেন। মায়ের চেয়ে কোনো অংশে কম করছেন না। তবুও এই মানুষটা কোন কারণে সেদিন তার চিৎকার শুনেও বাঁচাতে যাননি? ফরিনা প্লেট হাতে নিতেই পদ্মজা বলল, ‘আমি এখন মোটামুটি ভালোই আছি, আম্মা। আমি খেয়ে নিতে পারব। হাঁটতেও তো পারি।’

তার এক কথায় খাবারের প্লেট পদ্মজার হাতে তুলে দিলেন ফরিনা। রিনুকে চলে যেতে বললেন। পদ্মজা চুপচাপ খেয়ে নেয়। তার খেতে ইচ্ছে করে না একদমই। কিন্তু সামনের যুদ্ধটার জন্য তার খেতেই হবে। তাকে সুস্থ থাকতে হবে। সুস্থতা ছাড়া যুদ্ধে সফল হওয়া সম্ভব নয়। যতক্ষণ পদ্মজা খেল ততক্ষণ ফরিনা পাশে বসে থাকলেন। খাওয়া শেষ হওয়ার পর পদ্মজা ফরিনাকে বলল, ‘আব্বাকে খুব ভয় পান আম্মা?’

ফরিনা স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলেন, ‘সব বউরাই স্বামীরে ডরায়।’

‘না, আপনি একটু বেশি ভয় পান। যমের মতো।’

‘কবিরাজের দেওয়া ওষুধডি খাও এহন।’

‘আপনি কথা এড়াচ্ছেন, আম্মা। আচ্ছা, ওষুধ দেন আগে।’

ফরিনা আলমারি খুলে ওষুধ বের করলেন। এগিয়ে দিলেন পদ্মজার হাতে। পদ্মজা ওষুধ খেয়ে বলল, ‘কবিরাজ আনার অনুমতি ওরা দিয়েছে ভেবে আমি অবাক হয়েছি আম্মা! ওরা কেন চায়? আমি সুস্থ থাকি?’

ফরিনা কিছু বললেন না। পদ্মজা ফরিনার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মানুষটার আয়ু কী শেষের পথে? কেমন যেন মৃত মৃত ছাপ মুখে। চোখ বুজলে মনে হবে অনেক দিনের উপোষ করে মারা গিয়েছেন। পদ্মজার মায়া হয় মানুষটার জন্য। কোন দুঃখে তিনি ধুঁকে, ধুঁকে মরছেন! পদ্মজা বিছানা থেকে নেমে এসে ফরিনার সামনে দাঁড়াল। বলল, ‘আম্মা, আপনি আমাকে নিজের মেয়ে ভেবে একটা আবদার রাখবেন?

‘তুমি তো আমার ছেড়িই।’

‘তাহলে আবদার রাখবেন?’

‘রাখাম।’ ফরিনার শুষ্ক চোখ। গলা ভেজা।

পদ্মজা বলল, ‘তাহলে আপনার সব গোপন কথা আমাকে বলুন। যা ভেবে ভেবে আপনি কষ্ট পান।’

ফরিনা দুই হাতে পদ্মজার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু খেলেন। এক ফোঁটা চোখের জল পড়ে পদ্মজার হাতে। মমতাময়ী স্পর্শে পদ্মজার শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায়। ফরিনা বললেন, ‘তার আগে কও আমি সব কওয়ার পর তোমারে যা করতে কইয়াম তাই করবা তুমি।’

পদ্মজা অপলক নয়নে ফরিনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী করতে বলবেন তিনি? যদি সে সেটা করতে না পারে! সম্ভব না হয়! পদ্মজা বলল, ‘আপনার চাওয়া যদি যুক্তিগত হয় তো তাই করব, আম্মা।’

ফরিনা চোখের জল মুছে বললেন, ‘আমি বাবুর বাপরে দেইখা আইতাছি। তুমি শুইয়া থাকো।’

কথা শেষ করেই ফরিনা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যান। পদ্মজার মাঝে উত্তেজনা কাজ করছে। সে জানে না সে কী শুনতে চলেছে তবে সেটা কোনো সাধারণ ঘটনা বা কথা হবে না—এটা নিশ্চিত। সে ঘরে পায়চারি করতে করতে জানালার ধারে আসে। দেখতে পায় রিদওয়ানকে। হাতে একটা পলিথিন নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে। এই জঙ্গলের মাঝেই তো আছে তালাবন্ধ রহস্যজাল; যার চাবি তার কাছে আছে। আলমগীরের দেয়া চাবিটাকে পদ্মজার কোনো তালাবন্ধ রহস্যজালের চাবি মনে হয়! রিদওয়ান গত দিনগুলোতে তিন-চার বার তাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু কিছু বলেনি। রিদওয়ানের মতিগতি বোঝা যায় না। অদ্ভুত সে। রিদওয়ানকে দেখলে পদ্মজার শরীর রাগে কাঁপে।

বেশ কিছুক্ষণ পর পায়ের শব্দ আসে কানে। শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে পুরুষের পায়ের শব্দ। পদ্মজা দ্রুত এসে বিছানার এক কোণে বসে, যে কোণে ছুরি রাখা আছে। ঘরে প্রবেশ করে রিদওয়ান। পদ্মজাকে দেখেই লম্বা করে হেসে বলল, ‘তারপর বলো, কেমন আছো?’ পদ্মজার থেকে জবাব না পেয়ে রিদওয়ান আবার প্রশ্ন করল, ‘সুস্থ আছো তো?’

পদ্মজা সাড়া দিল না। রিদওয়ান চেয়ার টেনে বসল। বলল, ‘তোমাকে এত চুপচাপ দেখে অবাক হচ্ছি। কী পরিকল্পনা করছো বলো তো?’

পদ্মজা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। বলল, ‘কাপুরুষ বোধহয় আপনার মতো মানুষকেই বলা হয়।’

রিদওয়ানের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তারপর হুট করেই হেসে দিল। বলল, ‘কাপুরুষের কী করেছি?’

স্বামীর অবর্তমানে তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছেন। আবার সেই স্ত্রী অসুস্থ ছিল। এমন তো কাপুরুষরাই করে।’

‘এত কথা না বলে চুপচাপ যা বলি শুনো। আমির আমাদের ব্যপারে অনেক নাক গলিয়েছে। অনেক সমস্যা করেছে। তবুও আমরা আমিরকে এক শর্তে ফিরিয়ে দেব। যদি তুমি সেই শর্ত মানো।’

‘কী শর্ত?’

‘তুমি আমিরকে নিয়ে ঢাকা চলে যাবে। কখনো অলন্দপুরে ফিরবে না।’

‘যদি না মানি?’

‘অবুঝের মতো প্রশ্ন করতে বলিনি। শর্ত দিয়েছি, মানা না মানা তোমার ব্যপার।’

‘আপনারা আমাকে ভয় পাচ্ছেন কেন?’

রিদওয়ান হাসল।

পদ্মজা বলল, ‘সেদিন মেরে আধমরা করেছেন। এবার একদম মেরে দিন। তাহলেই আপনাদের সমস্যা শেষ। বেহুদা, আমাদের মুক্তি দিয়ে ভেজাল কেন বাড়াচ্ছেন? ঢাকা ফিরে গিয়ে পুলিশ নিয়েও তো আসতে পারি।’

রিদওয়ান বিরক্তিতে ‘চ’ সূচক উচ্চারণ করল। বলল, ‘তোমাকে মারা যাবে না।’

‘আমাকে দিয়ে আপনাদের কী কাজ হবে যে মারা যাবে না?’

‘এত প্রশ্ন কেন করছো?’

‘মনে আসছে তাই।’

রিদওয়ান রাগে উত্তেজিত হয়ে পড়ছে, ‘তুমি শর্তে রাজি নাকি না?’

‘আগে বলুন, কার কাজে আমি লাগব? কার খাতিরে আমাকে মারা যাবে না?’

তুমি শর্তে রাজি নাকি সেটা বলো। এই যে আমার পাঞ্জাবিতে তাজা লাল দাগটা দেখছো, এটা কিন্তু রক্তের। আর রক্তটা আমিরের।’

পদ্মজার চোখ দুটি জ্বলে উঠে। এমনিতেই এই হিংস্র মানুষটার হাসি, কথা তার গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তার উপর তার স্বামীর রক্ত দেখাচ্ছে! পদ্মজা উঁচু গলায় প্রশ্ন করল, ‘উনাকে জঙ্গলেই রেখেছেন তাই না?’

‘শর্তে রাজি তুমি?’

‘না।’

‘তোমাকে তো আমি—’

রিদওয়ান রেগে তেড়ে আসে। পদ্মজা পাশের টেবিল থেকে ওষুধের কাচের বোতলটা নিয়ে আঘাত করে রিদওয়ানের মাথায়। আকস্মিক আক্রমণে বিছানায় পড়ে গেল রিদওয়ান। পদ্মজাও দ্রুততার সঙ্গে ছুরি তুলে নিলো হাতে। রিদওয়ান বিছানায় পড়ার দুই সেকেন্ডের মধ্যে তার পিঠে আঘাত করল ছুরি দিয়ে। আহত রিদওয়ান আর্তনাদ করে উঠল। পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ছুরির আঘাত শরীরের মাংস পর্যন্ত চলে গিয়েছে। সুযোগ পদ্মজার হাতের মুঠোয়। সে এই সুযোগ হারাবে না। এতদিন সে এদের মানুষ ভেবে এসেছে। কিন্তু এরা মানুষরূপী শয়তান। আর শয়তানকে বুঝেশুনে নয়, ইচ্ছামতো আঘাত করা উচিত।  

পদ্মজা দ্রুত কাঠের চেয়ারটা তুলে নিলো হাতে, শরীরের সব শক্তি দিয়ে আঘাত করল রিদওয়ানের মাথায়। রিদওয়ানের কানের পাশ দিয়ে নামল রক্তের ধারা, নিস্তেজ হয়ে পড়ল শরীরটা। পদ্মজা হিংস্র বাঘিনীর মতো হাঁপাতে থাকে। মিনিট দুয়েক পর শাড়ির আঁচল মেঝে থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিলো, হুট করেই যেন শান্ত সমুদ্র গর্জন তুলে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে চারপাশ।

৬৩

ফরিনা পদ্মজার ঘরে প্রবেশ করে ঘাবড়ে গেলেন। বিছানায় রক্তাক্ত দীর্ঘদেহী একজন পুরুষ সংজ্ঞাহারা হয়ে পড়ে আছে। নাকি মরে গেছে? ফরিনা শিউরে ওঠেন। পদ্মজা ফরিনাকে এক নজর দেখে জগ থেকে গ্লাসে জল নিয়ে ঢকঢক করে পান করল। ফরিনার মনে হচ্ছে বিছানায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত পুরুষ মানুষটি রিদওয়ান! যখন শতভাগ নিশ্চিত হলেন এটা রিদওয়ানই, তখন মনে তীব্র একটা ভয় জেঁকে বসল। তিনি নিশ্বাস আটকে পদ্মজার কাছে ছুটে গিয়ে চাপা স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘রিদু কী মইরা গেছে?’

পদ্মজা তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারলো না। সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে বলল, ‘মরেনি বোধহয়। তবে বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে মরে যাবে।’

পদ্মজার তরঙ্গহীন গলার স্বর ফরিনার ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিল। তিনি পদ্মজাকে আচমকা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। থতমত খেয়ে গেল পদ্মজা। ফরিনার হৃৎপিণ্ডের কাঁপুনি টের পেল সে। ফরিনা অস্থির হয়ে বললেন, ‘ও মা—’

পদ্মজা ফরিনার বুক থেকে মাথা তুলে বলল, ‘কী হয়েছে, আম্মা?’

ফরিনার চোখের দৃষ্টি অস্থির। তিনি ঢোক গিলে বললেন, ‘তুমি পলাইয়া যাও। আর আইবা না। রুম্পার মতো চইলা যাও।’

‘আম্মা, ওরা আমাকে মারবে না। রিদওয়ান ভাইয়াই বলেছে।’

‘মিছা কথা… মিছা কথা কইছে।’

‘আম্মা, আপনি এমন করছেন কেন?’

ফরিনা দ্রুত সংজ্ঞাহীন রিদওয়ানকে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। তারপর বললেন, ‘তুমি পলায়া যাও। তোমার আব্বা, ওই শকুনের বাইচ্ছা আমার নিষ্পাপ কলিজার টুকরা বাবুরে মাইরা ফেলছে কিন্তু…’

জুতার ছপছপ আওয়াজ শুনে ফরিনা থমকে যান। এরকম আওয়াজ মজিদের জুতোয় হয়। মনে হয় জুতায় পানি নিয়ে হাঁটছে। তিনি আতঙ্কে চোখ দুটি বড়ো বড়ো করে তাকালেন। মজিদ তো ঘরে ছিলেন না! কখন চলে এলেন? আর যতক্ষণ মজিদ ঘরে থাকেন, ততক্ষণ ফরিনাকেও ঘরে থাকতে হয়। তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত মজিদ এখন পদ্মজার ঘরে আসবেন। রিদওয়ানকে দেখে ফেলবেন! তিনি পদ্মজার আলমারি খুলে তালা-চাবি বের করলেন। একটা ঝড় থামতেই যেন আরেকটা ঝড় শুরু হয়েছে। পদ্মজা ফরিনাকে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আম্মা, কিন্তু কী? বাবু মানে উনাকে মেরে ফেলেছে মানে? আপনি কীভাবে জানেন? আম্মা…’

ফরিনা নিজের এক হাতে পদ্মজার এক হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। তারপর দৌড়ে বেরোলেন ঘর থেকে। বারান্দায় পা রাখতেই মজিদের সঙ্গে দেখা। ফরিনা মজিদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে পদ্মজাকে টেনে নিয়ে গেলেন তিন তলায়। মজিদ হতভম্ব হয়ে দেখলেন ঘটনাটা। পদ্মজা বার বার জিজ্ঞাসা করছে ফরিনাকে, ‘আম্মা, আপনি এটা কী বললেন! আমার বুক কাঁপছে। আম্মা, কোথায় যাচ্ছেন?’

মজিদ পদ্মজার ঘরে উঁকি দিলেন। তার চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। বিছানার ওপর রিদওয়ানকে দেখতে না পেলেও রিদওয়ানের পাজোড়া চোখে পড়ে গেল। হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন তিনি, আঁতকে উঠলেন চাদর সরিয়ে রিদওয়ানকে দেখে। এদিকে, ফরিনা পদ্মজাকে ঠেলে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, ঘরের দরজাটি লোহার। পদ্মজা ধাক্কা খেয়ে ঘরের মধ্যিখানে পড়ে। সে মেঝে থেকে উঠতে উঠতে ফরিনা বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। পদ্মজা আচমকার ঘটনায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। তার মাথায় বার বার বাজছে, ‘তোমার আব্বা, ওই শকুনের বাইচ্ছা আমার নিষ্পাপ কইলজার টুকরা বাবুরে মাইরা ফেলছে!

পদ্মজা দুই হাতে মুখ চেপে ধরে। মনে হচ্ছে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখনই মারা যাবে। বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ফরিনা বলেছিলেন, সম্পত্তির জন্য হলেও আমিরকে ওরা জানে মারবে না! এজন্যই পদ্মজা ধৈর্য ধরে পাঁচটি দিন কাটাতে পেরেছে। ভেবেছিল, শরীরে একটু শক্তি জমিয়ে তারপর সে তার স্বামীকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু একটু আগে ফরিনা যা বললেন তাতে পদ্মজার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। রিদওয়ান শর্ত দিয়েছিল, পদ্মজা ঢাকা চলে গেলে আমিরকে ছেড়ে দিবে। পদ্মজা তাই মানত। শুধু না করে আরেকটু কথা বের করতে চেয়েছিল। তার আগেই রিদওয়ান আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। আর পদ্মজাও আঘাত করে বসে। পাঁচ দিনের সব ধৈর্য, পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে গেল ফরিনার এক কথায়। পদ্মজা দরজায় থাপ্পড় দিয়ে ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা কেন আটকালেন আমাকে? দরজা খুলুন। আম্মা আপনার ছেলের কী হয়েছে? কী বললেন? আম্মা…’

ফরিনা হাতের চাবিটা দূরে ছুঁড়ে ফেললেন। সিঁড়িতে শব্দ হচ্ছে দপদপ! তিনি নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখেন, অস্বাভাবিকভাবে হাত কাঁপছে। কাঁপছে পা। মজিদ, খলিল একসঙ্গে উঠে এসে ফরিনার সামনে এসে দাঁড়াল। ফরিনা ভয়ে জমে গেছেন। মজিদের চেহারা ক্ষুদ্ধ। তিনি রাগে গজগজ করতে করতে প্রশ্ন করলেন, রিদওয়ানকে পদ্মজা আঘাত করেছে?’

ফরিনা কিছু বললেন না। মজিদের গলার স্বর শুনে পদ্মজা চুপ হয়ে যায়। ফরিনা এলোমেলো দৃষ্টি নিয়ে কাঁপছেন। খলিল বলল, ‘ভাবিরে জিগাও কেন? ওই ছেড়ি ছাড়া আর কার এত সাহস আছে? ওই ছেড়ি এই ঘরের ভিতরে?’

ফরিনা দরজার সঙ্গে লেপটে দাঁড়িয়ে আছেন। খলিলের প্রশ্ন শুনে আরো শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। মজিদ ফরিনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেখেন, দরজায় তালা! তখনই পদ্মজা দরজায় থাপ্পড় দিয়ে ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা দরজা খুলুন। কী হচ্ছে ওখানে?’

মজিদের ক্ষুদ্ধ চেহারা আরো ভয়ংকর হয়ে উঠে। তিনি ফরিনার কাছে চাবি চাইলেন, ‘চাবি দাও। কী বলছি, কানে যায় না? চাবি দাও।’

ফরিনা আমতা আমতা করে বললেন, ‘ন…না-ই।’

মজিদ ফরিনার মুখ চেপে ধরে চাপা স্বরে বললেন, ‘চাবি দাও।’

ফরিনা তাও বললেন, চাবি নেই। মজিদ আরো একবার বললেন, ‘চাবি দাও বলছি। শাড়ির কোন ভাঁজে লুকিয়ে রেখেছো?’

‘চাবি নাই। চাবি নাই আমার কাছে।’ গলা উঁচিয়ে বললেন ফরিনা।

খলিল দরজায় জোরে কয়টা লাথি মারল, চেষ্টা করলেন তালা ভাঙার। দুপদাপ শব্দ হচ্ছে! সেই সঙ্গে পদ্মজাকে উদ্দেশ্য করে নোংরা গালি। খলিলের মুখের ভাষা শুনে পদ্মজার কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। চোখ-মুখ কুঁচকে গেল ঘৃণায়। ফরিনার উঁচুবাক্য শুনে মজিদ হাওলাদার রাগে কাঁপতে থাকলেন। ফরিনার এত সাহস কবে হলো! তিনি ফরিনার শরীর হাতড়ে চাবি খুঁজতে খুঁজতে বললেন, ‘চাবি কোথায় রাখছো? জলদি বলো। নয়তো এরপর যা হবে ভালো হবে না।’

ফরিনার শরীর কাঁপছে ভয়ে। তিনি জানেন, এই মুহূর্তে তিনি খুন হয়ে যেতেও পারেন। তবুও চাবি দিবেন না। নয়তো ওরা পদ্মজাকে খুন করে ফেলবে। ওরা পারে না এমন কিছু নেই! মজিদের নিকৃষ্ট অনেক কাজের সাক্ষী তিনি। এই মানুষটা তার জীবনের নরক। মজিদ রাগে হুঁশজ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। ফরিনা কিছুতেই কথা মানছে না বলে, ছোটো ভাইয়ের সামনে ফরিনার শাড়ি টেনে খুলে ফেললেন তিনি। বললেন, ‘চাবি কোন চিপায় রাখছো? বলো, নয়তো মেরে পুঁতে ফেলব।’

ফরিনা টু শব্দও করলেন না। খলিলের সামনে যুবতীকালে তাকে বিবস্ত্ৰ করেও মজিদ মেরেছে! সম্মান-ইজ্জত কবেই হারিয়ে গেছে। নতুন করে হারানোর কিছু নেই। বয়সও অনেক হয়েছে! তবে এদের শিকার পদ্মজাকে হতে দিবেন না কিছুতেই। মজিদ কোনোভাবেই ফরিনার কাছ থেকে চাবি উদ্ধার করতে পারেননি। এদিকে রিদওয়ানের অবস্থা খারাপের দিকে। খলিল দ্রুত নিচে চলে গেল। মজিদ ফরিনাকে মেঝেতে ফেলে ইচ্ছেমত লাথি, থাপ্পড় দিলেন; সঙ্গে বিশ্রি গালিগালাজ। চারপাশ ফরিনার কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে। ফরিনার কান্নার স্বর পদ্মজার কানে আসতেই সে চিৎকার করে বলল, ‘আব্বা, আম্মাকে মারবেন না। আব্বা…দোহাই লাগে। আম্মা লাশের মতো হয়ে গেছে। আব্বা, আম্মাকে মারবেন না। আমাকে মারেন, আব্বা। আম্মা, আপনি দরজা খুলুন। আম্মাকে এভাবে কেন মারছেন, আব্বা? আপনি তো অলন্দপুরের ফেরেশতা ছিলেন, আব্বা। আপনার এমন রূপ কেন? আম্মা, দরজা খুলুন। আব্বা, আম্মা খুব কষ্ট পাচ্ছে। অনুরোধ করছি, আর মারবেন না।’

বাইরে ফরিনার কান্না, ঘরের ভেতর পদ্মজার কান্না। আর দরজায় এলোপাথাড়ি থাপ্পড়ের আওয়াজ। সব মিলিয়ে চারপাশ যেন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। খলিলের ডাক শুনে মজিদ চলে গেলেন। কিন্তু যাওয়ার পূর্বে ফরিনার পেটে বড়ো একটা লাথি বসিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফরিনার মুখ দিয়ে বমি বেরিয়ে আসে। মজিদ চলে যাওয়ার মিনিট দুয়েক পর দৌড়ে আসে লতিফা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সে দুইবার হোঁচট খেল। ফরিনার মাথা নিজের কোলে নিয়ে কেঁদে বলল, ‘খালাম্মা, আপনি কেন খালুর বিরুদ্ধে গেলেন। ও খালাম্মা কথা কন। খালাম্মা?’

লতিফার ব্যকুল কণ্ঠস্বর শুনে পদ্মজা আরো জোরে থাপ্পড় দিল দরজায়। বলল, ‘লুতু বুবু আম্মার কী হয়েছে? লুতু বুবু দরজা খুলো। ও লুতু বুবু।’

ফরিনা অস্পষ্ট স্বরে লতিফাকে বললেন, ‘তোর খালু চইলা গেছে?’

‘হ, গেছে।’

‘বাড়ি থেইকা বাইর হইছে?’ ফরিনার কণ্ঠ নিভে আসছে।

লতিফা ফরিনার মাথাটা সাবধানে মেঝেতে রেখে বারান্দা থেকে বাইরে উঁকি দিল। মজিদ, খলিল, মদন আর বাড়ির দারোয়ান মিলে গরু গাড়ি দিয়ে রিদওয়ানকে নিয়ে যাচ্ছে। গেটের কাছাকাছি চলে গেছে। সে ফরিনাকে এসে বলল, ‘বাইর হইয়া গেছে, খালাম্মা।’

পদ্মজা দরজায় এলোপাথাড়ি থাপ্পড় দিচ্ছে। বিকট শব্দ হচ্ছে! ফরিনা আঙুলের ইশারায় ডান দিকটা দেখিয়ে বললেন, ‘ওইহানে খুঁইজা দেখ, চাবি পাবি একটা। দরজাডা খুইলা দে।’

লতিফা ফরিনার কথামতো চাবি খুঁজল। পেয়েও গেল। তারপর দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে বেরোল পদ্মজা। ফরিনাকে দেখে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। গায়ে শাড়ি নেই। পেটিকোট হাঁটু অবধি তোলা। মিষ্টি রঙের ব্লাউজে রক্তের দাগ। নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। ফুলে গেছে দুই চোখ। হাতে-পায়ে জখম। বয়স্ক মানুষটাকেও ওরা ছাড়েনি! পদ্মজা হাঁটুগেড়ে বসে ফরিনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল, ‘আম্মা, আপনি কেন চাবিটা দিলেন না? এরা মানুষ? নিজের বউকে কেউ এভাবে মারে? লুতু বুবু, আম্মাকে ধরো।’

লতিফা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘পদ্মজা, তুমি কিছু জানো না। খালু এমনেই মারে।’

‘ধরো আম্মাকে।’

লতিফা আর পদ্মজা মিলে ফরিনাকে ধরে ধরে তিন তলার আরেকটি ঘরে নিয়ে এলো, যে ঘরটিতে প্রথম রুম্পা ছিল; তারপর রানি। নিচতলায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ফরিনা মেঝেতে পা সোজা করে ফেলতে পারছেন না। চোখ দুটি বার বার খুঁজে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে পদ্মজার যেমনটা তার মায়ের মৃত্যুর আগে হয়েছিল। পদ্মজার গা কেঁপে উঠে। চোখ ছাপিয়ে নামে জল। মনে মনে কেঁদে বলল: আল্লাহ! কেন আমার সঙ্গে এমন হচ্ছে! কীসের পরীক্ষা নিচ্ছো তুমি? আমার চারপাশ এত নির্মম কেন? কোথায় আছো আম্মা? কোথায় আছেন, পারিজার আব্বু? আমি ভীষণ একা। ভীষণ।

পদ্মজার হেঁচকি উঠে গেল। সে ঢোক গিলে নিজেকে সামলায়। ফরিনার যত্ন নিতে হবে। ফরিনাকে বিছানায় শুইয়ে দিতেই তিনি থেমে থেমে বললেন, ‘আমার কই মাছের জান। আমি মরতাম না। তুমি, তুমি পলায়া যাও।

‘আম্মা, আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। লুতু বুবু, হালকা গরম পানি নিয়ে আসো। আমার ঘরের আলমারির ডান পাশের ড্রয়ার থেকে স্যাভলন আর তুলাও এনো।’

পদ্মজার আদেশ পাওয়া মাত্র লতিফা বেরিয়ে গেল। ফরিনা করুণ চোখে পদ্মজার দিকে চেয়ে বললেন, ‘কান্দো কেরে? কাইন্দো না।’

পদ্মজার সুন্দর দুটি চোখে জলের পুকুর। বিরতিহীনভাবে পানি গড়িয়ে পড়ছে গলায়, বুকে। সে ফরিনার এক হাতে কপাল ঠেকিয়ে ব্যর্থ কণ্ঠে বলল, ‘আম্মা, আমি কী করব? যখনই ভাবি এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। তখনই ভয়ংকর সব ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়। আমি আর পারছি না। এত খারাপ পরিবেশ আমি আর নিতে পারছি না আম্মা। নিজেকে কিছুক্ষণ আগেও শক্তিশালী মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, আমি চাইলে সব পারব। কিন্তু এখন খুব দুর্বল মনে হচ্ছে। আমি ওদের বিরুদ্ধে পেরে উঠছি না। আপনি ভালো হয়ে উঠুন। আপনার ছেলে কি সত্যি— ‘

পদ্মজা তাকিয়ে দেখল, ফরিনার চোখ বন্ধ অবস্থায়। ছ্যাঁত করে উঠল বুকটা। সে ফরিনার নাকের কাছে হাত নিয়ে পরীক্ষা করল, নিশ্বাস নিচ্ছেন নাকি। নিচ্ছেন! সেই সময় লতিফা স্যাভলন, তুলা আর হালকা গরম পানি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।

ফরিনা ঘুমাচ্ছেন। কথা বলার অবস্থায় নেই। পদ্মজার পায়ে ঘা হয়েছে। পাঁচদিনে কি ছেঁড়াকাঁটা ভালো হয়? শীতের কারণে উলটো আরো কষ্ট বাড়ে। পায়ের অবস্থা যা তা! তাতে অবশ্য যায় আসে না পদ্মজার। সে অস্থির হয়ে আছে। বুকে এক ফোঁটাও শান্তি নেই। রিদওয়ান দুপুরে জঙ্গল থেকে ফিরেছিল। পদ্মজার ধারণা আমির জঙ্গলের কোথাও বন্দি আছে। অথবা লাশটা হলেও আছে! ভাবনাটা পদ্মজার মাথায় আসতেই সে দ্রুত মাথা চেপে ধরে বিড়বিড় করে, ‘না! আমি কী ভাবছি! কিছু হয়নি। কারো কিছু হয়নি। সবাই ভালো আছে।’

লতিফার দায়িত্বে ফরিনাকে রেখে নিচতলায় নেমে এলো সে। সঙ্গে ছুরি, রাম-দা নিয়েছে। আজ খোঁপা করেনি, বেণী করেছে। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই। সব হাসপাতালে। ওরা ফিরলে সে আর আস্তো থাকবে না। তার আগেই আমিরকে বের করতে হবে। সেই সঙ্গে লুকোনো গুপ্ত রহস্য। সদর ঘরে আমিনা ছিলেন। তিনি আলোকে খিচুরি খাওয়াচ্ছেন। নির্বিকার ভঙ্গি! কোনো তাড়া নেই, চিন্তা নেই! রিদওয়ানের অবস্থা কী দেখেনি? এই মানুষটা শুধু রানির জন্যই কাঁদেন। আর কারোর জন্য না! কিন্তু কেন? পরিবারের সবার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখেন। কথা বললেও তাতে মিশে থাকে অহংকার আর বিদ্রুপ।

পদ্মজা বেরিয়ে পড়ল, সন্ধ্যার নামাজ পড়েই বেরিয়েছে। আজ জঙ্গলে মরবে…নয়তো আগামীকাল এই বাড়ির পুরুষগুলোর হাতে! সে মনে মনে মৃত্যু মেনে নিয়েছে। ধীর পায়ে হেঁটে ঢুকল জঙ্গলে। বোনদের কথা খুব মনে পড়ছে। সে মারা গেলে, ওদের কী হবে? খুব কী কাঁদবে? কাঁদতে কাঁদতে জ্বর উঠে যাবে! পূর্ণার তো খুব কান্নার পর জ্বর হয়। প্রেমা নিজেকে সামলাতে পারবে।

এসব ভাবতে ভাবতে একসময় পদ্মজা মানুষের উপস্থিতি টের পেল। ফিসফিসিয়ে কাছেই কথা বলছে কেউ। পদ্মজা এখনও ভালো করে জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করেনি। হিজল গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল সে। আস্তে আস্তে দুটি মানুষ চোখের পর্দায় ভেসে উঠে। তারা জঙ্গলের পশ্চিম দিক থেকে এসেছে। অস্পষ্ট তাদের মুখ। জঙ্গল থেকে বেরিয়ে অন্দরমহলের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল তারা। একটা মুখ চিনতে পারে পদ্মজা। মৃদুল! মৃদুলের হাতে টর্চ। সেই টর্চের আলোতে পাশের জনের হাত ভেসে উঠে। এক হাতে লাল তাজা রক্ত, অন্য হাতে রাম-দা। শিউরে উঠল পদ্মজা, ঘামছে অনবরত। উত্তেজনায় তার হৃৎপিণ্ড ফেটে যাওয়ার উপক্রম। গলা শুকিয়ে কাঠ। মৃদুল কিছু একটা বলল, উত্তরে অচেনা লোকটাও বলল একটা কিছু। ঝাপসা আলোয় মৃদুলের সঙ্গের লোকটার দেহ আর চুল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে: লম্বা শরীর, মাথায় ঝাঁকড়া চুল।

চারপাশটা যেন স্থির হয়ে গেল। পদ্মজার শরীর বেয়ে মুহূর্তে ছুটে গেল শীতল কিছু একটা…

…বিস্ময়ের ঘোর ও কিছুতেই কাটাতে পারছে না।

৬৪

চন্দ্র-তারকাহীন ম্লান আকাশের কারণে চারপাশ অদ্ভুত ভয়ংকর হয়ে আছে। পদ্মজার মুখ ঘেঁষে একটা পাতা মাটিতে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল দুই পা। যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারল, তখন নিজের ভয় পাওয়া দেখে নিজের ওপরই বিরক্ত হলো খুব। দুই পা এগিয়ে এসে অন্দরমহলের দিকে তাকাল আবার। আধো অন্ধকারে আবিষ্কার করল, মৃদুল এবং আগন্তুক নেই! চোখের পলকে মুহূর্তেই ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে! সাবধান হয়ে উঠল পদ্মজার মস্তিষ্ক। মৃদুলের মধ্যে ঘাপলা আছে—ভাবতেই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সে সবকিছু ভাবতে পারে। সবকিছু!

পরিকল্পিত পথ ধরে হাঁটা শুরু করল পদ্মজা। মনে মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে: মৃদুল জঙ্গলের ভেতরে ঢোকেনি তো? আর দীর্ঘদেহী, ঝাঁকড়া চুলের আগন্তুকও কি সঙ্গে রয়েছে? পদ্মজা এক হাতে ছুরি নিলো, অন্য হাতে রাম- দা। তার চোখের দৃষ্টি প্রখর। চারপাশে চোখ বুলিয়ে সাবধানে এক-পা এক- পা করে এগোচ্ছে। নিশ্বাস যেন আটকে আছে। এই বুঝি কেউ আক্রমণ করে বসল! সেদিন যতটুকু এসেছিল সে, ঠাওর করে করে নিরাপদভাবে ঠিক ততটুকুই চলে আসে। সামনে বড়ো বড়ো গাছপালা ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। ভূতুড়ে পরিবেশ। পদ্মজা কেন জানি নিশ্চিত, আজও কেউ থাকবে এখানে, অজানা রহস্যজাল পাহারা দেয়ার জন্য। আর আশপাশেই আছে সেই গুপ্ত রহস্যজাল। পদ্মজার শিরায়, শিরায় প্রবল উত্তেজনা বয়ে গেল। কয়েকটা গাছ পেরিয়ে থমকে দাঁড়াল সে। একটা শব্দ ভেসে আসছে কানে। পদ্মজা দুরু দুরু বুকে শব্দের উৎসের দিকে তাকাল। কিছুটা দূরে একজন লোক উবু হয়ে বসে আছে, সম্ভবত প্রস্রাব করছে। পদ্মজা প্রস্তুত হয় লোকটিকে পেছন থেকে আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু জানে না কেন, কেঁপে উঠল তার হাত। সে কাউকে প্রাণে মারতে পারবে না, সেই সাহস হচ্ছে না। একটা খুন করেছে ভাবলেই তার গাঁ কেঁপে ওঠে। সেদিনের খুনটা তার নিজের অজান্তেই হয়ে গিয়েছে। সে যেন ছিল অন্য এক পদ্মজা। সেই পদ্মজাকে সে নিজেও চিনত না।

আচমকা উঠে দাঁড়াল লোকটা। পদ্মজাও দ্রুত একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে—রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে। লোকটির মুখ অস্পষ্ট। অবয়ব শুধু স্পষ্ট। দুলকি চালে এদিকেই এগিয়ে আসছে। পরনে লুঙ্গি ও সোয়েটার পরা। মাথায় টুপিও রয়েছে। লোকটার হাঁটা দেখে মনে হচ্ছে না, সে টের পেয়েছে অন্য কারো উপস্থিতি। তবুও পদ্মজার নিশ্বাস আটকে যায়। সে রাম-দা শক্ত করে ধরল। লোকটি তার কাছে আসতেই সে শরীরের সবটুকু জোর দিয়ে মাথায় আঘাত করে। লোহার রাম-দার এক পাশের আঘাতে লোকটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। গোঙানির শব্দ করে, হাত পা ধাপড়াতে থাকল। সেকেন্ড কয়েক পরই দেহটি নিস্তেজ হয়ে গেল। পদ্মজার বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো নিশ্বাস। তবে লোকটাকে কাঁচা খেলোয়ার মনে হলো! এক আঘাতেই কুপোকাত!

পদ্মজা একবার ভাবল—টর্চের আলোয় লোকটার মুখ দেখবে। তারপর মাথায় এলো টর্চের আলো দেখে যদি ওঁত পাতা বিপদ তার উপস্থিতি টের পেয়ে এগিয়ে আসে! তাই আর টর্চ জ্বালাল না। সে নিথর দেহটিকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, ঝিঁঝিপোকার ডাক, অশরীরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা আর রাতের অন্ধকার বার বার পদ্মজার গা হিম করে দিচ্ছে। পদ্মজা প্রমাদ গুণে নিজের মধ্যে সাহস জোগানোর চেষ্টা করছে। বড়ো বড়ো গাছপালা ফেলে সে খোলা জায়গা এসে দাঁড়াল। সামনে কোনো বড়ো গাছ নেই।

জঙ্গলের মাঝে এরকম খোলা জায়গা কেন? এতে কি কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে! একদমই খোলা তাও নয়। জংলি লতাপাতা রয়েছে। তবে একটু অন্যরকম। লতাপাতার মাঝে জোঁক বা কোনো বিষাক্ত জীব থাকতে পারে। বিপদের কথা ভেবেও পদ্মজা ঝুঁকি নিলো। সে পা বাড়াল সামনে। কয়েক কদম এগোতেই জুতা ভেদ করে পায়ে ফুটল একটা কাঁটা! আঘাতে আবার আঘাত লেগেছে। ব্যথায় পদ্মজার কলিজা ছেঁড়ার যন্ত্রণা অনুভব হয়। সে কাঁটা বের করার চেষ্টা করে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল বেরোয়।

রক্তজবা ঠোঁট দুটি ভিজে যায় জলে।

.

মৃদুল এদিক-ওদিক দেখে বলল, ‘লিখন ভাই, চলো চইলা যাই।’

অসহনীয় যন্ত্রণায় লিখনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সেসবকে তোয়াক্কা করে সে বলল, ‘পদ্মজার খোঁজ নিতে হবে আগে।’

মৃদুল বুঝতে পারছে না সে কী করবে! লিখনের হাত থেকে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। দুপুরে সে পূর্ণার সঙ্গে দেখা করতে মোড়ল বাড়িতে গিয়েছিল। পূর্ণা চোখ-মুখ ফুলে যা তা অবস্থা। অনেক কান্নাকাটি করে পদ্মজার জন্য। পূর্ণা আশঙ্কা করছে তার বোন ভালো নেই। মৃদুলেরও তাই মনে হয়। সে যেতেই পূর্ণা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকল। তখন লিখন শাহ আসে। তার শুটিং শেষের দিকে, সপ্তাহখানেক পর ঢাকা ফিরবে। তাই পূর্ণাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। পূর্ণাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে লিখন বিচলিত হয়ে পড়ে। তারপর প্রশ্ন করে বিস্তারিত জানতে পারে।

লিখন হাওলাদার বাড়িতে আসতে চাইলে মৃদুল না করল। সে বলল, ঢুকতে দেবে না। লিখন মৃদুলের কথা শুনে…চলে এলো হাওলাদার বাড়িতে। পিছু পিছু এলো মৃদুলও। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দারোয়ান গেটের ভেতরেই ঢুকতে দিল না লিখনকে। তখন মৃদুল লিখনের সঙ্গে পরিকল্পনা করে, তারা বাড়ির পেছনের ভাঙা প্রাচীর পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকবে। লিখন প্রথম রাজি না হলেও, পরে রাজি হয়। সে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। পদ্মজার খোঁজ নেই কথাটা সে ভাবতেই পারছে না! এত বয়সে এসেও সে একটা মেয়ের জন্য এত ব্যকুল হয়ে পড়ছে! তাও বিবাহিত মেয়ে! এমন মেয়েকে ভালোবেসে ব্যকুল হওয়া তো সমাজের চোখে খারাপ। এই সমাজের জন্যই সে পদ্মজার থেকে নিজের এত দূরত্ব রাখে। যাতে কোনো খারাপ কথা, কোনো দুর্নাম পদ্মজাকে ছুঁতে না পারে। পদ্মজা যেন অসুখী না হয়। সেই পদ্মজার নাকি চারদিন ধরে খোঁজ নেই! মৃদুল দেখা করতে চাইলে তাও করতে দেয়া হচ্ছে না! লিখনের মাথার রগরগ দপদপ করতে থাকে।

আঁধার নামতেই দুজনে হাওলাদার বাড়ির পেছনের ভাঙা প্রাচীর দিয়ে বাড়ির সীমানায় ঢুকে পড়ে। বাড়ির পেছনে যে জঙ্গল, সেই জঙ্গলসহ পুরো বাড়ির সীমানা মিলিয়ে চারিদিকে গোল করে প্রাচীর দেয়া। তাই পেছনের প্রাচীর দিয়ে তারা আগে পশ্চিম দিকের জঙ্গলে পা রাখে। মৃদুল একবার মদনের সঙ্গে পশ্চিম দিকে এসেছিল, একটা ঔষধি পাতা নিতে। তাই সে জানত, এদিকে বড়ো বড়ো কাঁটা আছে। এজন্য সে রাম-দা নিয়ে এসেছে, লিখনের হাতে ছিল সেটা। লিখন অসাবধানবশত কাঁটার লতাপাতা কাটতে গিয়ে নিজের হাতে আঘাত করে বসে, ফলে ক্ষত সৃষ্টি হয়ে। গলগল করে বেরিয়ে আসে রক্ত। রক্তাক্ত হাত নিয়ে বেরিয়ে আসে জঙ্গল থেকে। মৃদুল চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘ভাই, রক্ত তো বন্ধই হইতাছে না।’

‘কী করা যায়, বলো তো?’

‘আসো চইলা যাই। বাজারে যাইবা। নয়তো ডাক্তারের বাড়িতে নিয়া যাব।’

‘ব্যস্ত হয়ো না, মৃদুল।’

লিখন এক জায়গায় বসল। তারা অন্দরমহলের বাঁদিকে আছে। মৃদুলের হাত থেকে টর্চ নিয়ে লিখন চার পাশটা দেখে নিলো। তারপর বলল, ‘ওই যে দেখা যাচ্ছে, ওই পাতাটা নিয়ে এসো।’

‘আচ্ছা, ভাই।’

মৃদুল লিখনের দেখানো কয়েকটা পাতা নিয়ে আসে। তারপর কচলে নরম করে লিখনের ক্ষতস্থানে লাগায়। লিখন বলল, ‘হয়েছে এবার। রক্তপড়া বন্ধ হয়ে যাবে। ‘

‘আমরা চইলা যাইলেই পারতাম।’

‘পদ্মজার খোঁজ না নিয়ে কীভাবে যাই?’

‘পদ্মজা ভাবিরে এত ভালোবাসো ভাই, অবাক করে আমারে।’

লিখন মুচকি হেসে বলল, ‘এসব বলো না, মৃদুল। এসব বলতে নেই।’

‘সত্যি কথা কইতে ডর কীসের?

লিখন ঠোঁটে হাসি রেখেই উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘বিবাহিত নারী নিয়ে এসব বলতে নেই। সমাজ ভালো চোখে দেখে না।’

‘সমাজরে আমি জুতা মারি।’

‘তোমার বয়স বেড়েছে ঠিকই, জ্ঞান হয়নি।’ বলতে বলতে লিখন অন্দরমহলের পেছনে এসে দাঁড়াল। গা হিম করা ঠান্ডা বইছে। তার পরনে শীতবস্ত্র নেই। ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে সে। মৃদুল বলল, ‘এই কথা আমার আম্মাও বলে।’

‘এসব কথা বাদ দাও এখন। শুনো, আমরা বাড়ির সামনে যাব নাকি পিছন থেকেই কিছু করব?’

লিখনের ভাবগতি বোঝা যাচ্ছে না। মৃদুল লিখনের দৃষ্টি অনুকরণ করে অন্দরমহলের দুই তলায় তাকাল। পদ্মজার ঘরের জানালার দিকে। প্রশ্ন করল, ‘পেছনে কী করার আছে?’

‘পদ্মজার ঘরের জানালার পাশে রেইনট্রি গাছটা দেখেছো? গাছে উঠে উঁকি দিলেই পদ্মজাকে দেখা যাবে। কথা বলাও যাবে।’

‘উঠতে পারো গাছে?’

‘আরে পুরুষ মানুষ হয়েছি কী জন্য?’

‘তাইলে গাছে উঠমু আমরা?’

‘একবার সামনে দিয়ে চেষ্টা করা উচিত। তুমি যাও, গিয়ে দেখো ঢুকতে দেয় নাকি।’

মৃদুল মুখ কালো করে বলল, ‘দিবে না। আবার অপমান হতে ইচ্ছা করতাছে না।’

‘তাহলে চলো গাছে উঠি।’

মৃদুল চুল ঠিক করতে করতে গুরুতর ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি যহন কইছো, আমি যাব।’

লিখন হাসল। পূর্ণার মতোই মৃদুলের স্বভাব। পূর্ণাকে যে কারণে ভালো লাগে, ঠিক একই কারণে মৃদুলকেও ভালো লাগে। মৃদুল চলে যায়। লিখনের মাথাটা ব্যথা করছে। সে দুহাতে কপালের দুপাশ চেপে ধরে পদ্মজার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবে, একজন জনপ্রিয় অভিনেতা হয়ে এভাবে প্রাচীর ডিঙিয়ে, লুকিয়ে এক পাক্ষিক ভালোবাসার মানুষের খোঁজ নিতে আসাটাকে হয়তো কারো চোখে পাগলামি মনে হবে। কিন্তু তার চোখে সেটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব! নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব! পদ্মজা ভালো আছে ভেবেই সে মানসিকভাবে ভালো থাকে। এ কথা ঠিক, পদ্মজার সঙ্গে আমিরের এত সুখ দেখে তার বুকে চিনচিন ব্যথা হয়। তবে এটাও ঠিক পদ্মজার সুখ দেখে সে শান্তিও পায়! বেঁচে থাকার মানসিক মনোবল পায়। আশা থাকে মনে, আছে! বেঁচে আছে পদ্মফুল! চাইলেই দূর থেকে দেখা যাবে। চাইলে কথা বলাও যাবে। কিন্তু যদি নাই বা থাকে? তবে—

মৃদুল এসে জানাল, শালার ব্যাটা দুলাভাই নাই। কেউই নাই দরজার সামনে।’

লিখন বলল, ‘তাহলে চলো। সামনে দিয়েই যাই। আমারও কেমন লাগছিল, এভাবে লুকিয়ে বাড়ির পিছন দিয়ে…’ লিখন হাসল। ম্লান হাসি। সে এগিয়ে গেল। সঙ্গে মৃদুল। দুজন অন্দরমহলে প্রবেশ করল নির্বিঘ্নে। কোনো বাধা আসেনি।

আমিনা সদর ঘরে বসে ছিলেন। তিনি লিখনকে দেখে বললেন, ‘তুমি এইহানে কেরে আইছো?’

মৃদুল ঘরে ঢুকে বলল, ‘ফুফুআম্মা, পদ্মজা ভাবি কই?’

আমিনা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। মৃদুলের কাছে এসে আদুরে গলায় বললেন, ‘কই আছিলি, বাপ? তোর ফুপায় বকছে বইলা চইলা যাবি কেন? আমি তোর ফুফুআম্মা আছি না? তুই এইহানেই থাকবি। যতদিন ইচ্ছা থাকবি।’

মৃদুল কপালে ভাঁজ সৃষ্টি করে বলল, ‘ধুর! বাদ দেও এসব কথা। তোমার জামাই একটা ইবলিশ। ইবলিশের ধারেকাছে মানুষদের থাকতে নাই।’

আমিনা মৃদুলের মুখ ছুঁয়ে বললেন, ‘এমন কয় না বাপ।’

‘আদর পরে কইরো। এখন কও তো পদ্মজা ভাবি কই?’

‘ঘরেই আছে।’

ভাবির কি শরীর ভালা আছে?’

আমিনা ক্ষণমুহূর্ত সময় নিয়ে লিখনকে দেখলেন। বললেন, ‘হ ভালা।’

‘আচ্ছা, ফুফুআম্মা আমরা ওপরে যাইতাছি।’

আমিনা লিখনের দিকে আঙুল তাক করে তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, ‘এই ছেড়াও যাইব?’

লিখন চোখের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। পরপুরুষ হয়ে পদ্মজার মতো মেয়েকে দেখতে যাওয়া ঠিক হবে না বোধহয়। মৃদুল তো এই বাড়ির আত্মীয়। সে গেলে সমস্যা নেই। মৃদুল কিছু বলার পূর্বে লিখন বলল, —আমি এখানে বসি। তুমি যাও।’

‘না ভাই, তুমি আইয়ো।’

‘আরে, মৃদুল যাও তো।’

মৃদুল সিঁড়িতে পা রাখল। আমিনা ভাবছেন, পদ্মজা তো ঘরেই আছে। বাড়িতে কোনো পুরুষ নেই। এরকম সময়ে যদি পদ্মজার নিচে নেমে আসে? লিখনের সঙ্গে কথা বলে! আর এ খবর কোনোভাবে খলিল হাওলাদারের কানে যায়। তবে তার রক্ষে নেই। তিনি উঁচুকণ্ঠে ডাকলেন, ‘মৃদুলরে?’

মৃদুল তাকাল। আমিনা জানেন না, পদ্মজা সত্যি যে ঘরে নেই। তিনি মিথ্যে ভেবে বললেন, ‘পদ্মজায় তো ঘরে নাই।’

লিখন উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কেন? কোথায় গিয়েছে?

আমিনা নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, ‘আমি কিতা কইতাম? গেছে কোনো কামে।’

মৃদুল সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলো, ‘ভাবি একলা গেছে?’

আমিনা আরেকটা মিথ্যা বললেন, ‘না, একলা যায় নাই। আমিরের লগে গেছে।’

মৃদুল উৎসুক হয়ে জানতে চাইল, ‘আমির ভাই বাড়িত আছিল? আমি যে দেহি নাই। ভাবছি জরুরি কোনো কামে ঢাকাত গেছে। আচ্ছা, ফুফুআম্মা অন্দরমহল নজরবন্দিতে আছিল কেন? আমারে ঢুকতে দেয় নাই কেন?’

আমিনা তৃতীয়বারের মতো মিথ্যে বললেন, ‘আমির তো ঢাকাতই গেছিল। কাইল রাইতে আইছে। আমির নাই এজন্য পদ্মজার —

লিখন কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। সিকিউরিটি মানে নিরাপত্তা দিয়ে গিয়েছিল। আমি আছি তো গ্রামে! আমির হাওলাদার খুব ভালোবাসেন পদ্মজাকে!’ শেষ শব্দ তিনটি লিখন জোরপূর্বক হেসে বলল। তার চোখের মণি চিকচিক করছে। মৃদুল আফসোস করে বলল, ‘ধুর, দেখা হইল না।’

‘আসি চাচি।’ বলল লিখন।

মৃদুল, লিখন বেরিয়ে আসে। মৃদুল বলল, ‘পদ্মজা ভাবির চিঠি দেখে তো মনে হয় নাই এত সহজ ব্যপার।’

‘হু। পদ্মজা একটা রহস্যময়ী, মায়াময়ী। তাই বোধহয় রহস্য রেখে চিঠি লিখেছে। আমির হাওলাদার যেহেতু এখন সঙ্গে আছে নিশ্চয় পদ্মজা ভালো আছে।

মৃদুল গভীর মগ্ন হয়ে কিছু ভাবছে। সে লিখনের কথার জবাবে বলল, ‘উমম।’

‘তবুও, আগামীকাল পদ্মজা পূর্ণার সঙ্গে যোগাযোগ না করলে আমরা আবার আসব না হয়।’

মৃদুল লাফিয়ে উঠে বলল, ‘এটাই ভাবছিলাম।’

লিখনের হাতের রক্তপড়া বন্ধ হলেও ব্যথা তীব্র। তা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মৃদুল বলল, ‘ভাই, সাইকেল নিয়া আসি। এ অবস্থায় হেঁটে যাওয়া ঠিক হইব না।’

লিখনও সায় দিল। মৃদুল আলগ ঘর থেকে সাইকেল নিয়ে আসে। মৃদুল সামনে, লিখন পেছনে বসল। তাদেরকে দারোয়ান দেখে অবাক হয়। তবে বেশিকিছু বলতে পারেনি, মৃদুল হুমকি-ধামকি দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাতের স্নিগ্ধ বাতাসে লিখন অনুভব করল, তার বুকের সূক্ষ্ম ব্যথাটা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। সে একবার ঘুরে তাকাল হাওলাদার বাড়ির গেটের দিকে! খ্যাতিমান, সুদর্শন, ধনী লিখন শাহ, যে সবসময় ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে রাখে, তাকে দেখে সবাই কত সুখী মনে করে! কত যুবক স্বপ্ন দেখে লিখন শাহর অবস্থানে আসার! কিন্তু তারা কী কখনো জানবে, লিখন শাহ সর্বক্ষণ বুকের ভেতর বিষাক্ত সূচ নিয়ে হাসে…

…যে সূচের তীব্রতা তাকে এক মুহূর্তও শান্তি দেয় না।

.

পদ্মজা চারিদিকে নজর ফেলে হাঁটছে। কিন্তু চোখে পড়ার মতো কিছু পাচ্ছে না। কী এমন আছে এখানে, যা পাহারা দেয়ার জন্য কেউ না কেউ থাকে? কিছুই তো নজরে আসছে না। পদ্মজা জংলি লতাপাতার উপর হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে এলো। শিশিরের জলে পায়ের তালু থেকে হাঁটু অবধি ভিজে গিয়েছে। পাজোড়া ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম। থেকে থেকে কাছে কোথাও শেয়াল ডাকছে। পদ্মজার বুক ধুকপুক, ধুকপুক করছে। মনে হচ্ছে, কয়েকজোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ করে বসবে। ছিঁড়ে খাবে দেহ! ভাবতেই পদ্মজার গা শিউরে উঠল সে ঢোক গিলল। তারপর আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিল। আয়তুল কুরসি যতবার সে পড়ে ততবার নিজের মধ্যে একটা শক্তি অনুভব করে, ভরসা পায়। এই মুহূর্তেও তার ব্যক্তিক্রম হয়নি।

সামনে এগোতে এগোতে একসময় আবিষ্কার করল, তার পায়ের নিচে মাটির বদলে অন্যকিছু আছে! চকিতে পদ্মজার মস্তিষ্ক চারগুণ গতিতে সচল হয়ে উঠল। সে পায়ের নিচের লতাপাতা সরাতে গিয়ে দেখে, এই লতাপাতাগুলোর শেকড় নেই! পদ্মজা দ্রুতগতিতে সব লতাপাতা সরাল। তখনই আবছা আলোয় চোখে ভেসে উঠল লোহার মেঝে! পদ্মজার মুখে একটি গাঢ় বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠে, উত্তেজনা বেড়ে যায়। শীতল শরীর উত্তেজনায় ঘামতে শুরু করেছে। লোহার মেঝেটা খুব একটা বড়ো নয়। পদ্মজা টর্চ জ্বালিয়ে খুঁটিয়ে, খুঁটিয়ে দেখে নিলো একবার। এক পাশে ছিদ্র রয়েছে। এখানে হয়তো চাবি ব্যবহৃত হয়! চকিতে পদ্মজার মাথায় এলো আলমগীরের দেয়া চাবিটার কথা। সে দ্রুত পেটিকোটের দুই ভাঁজ থেকে চাবিটি বের করল। প্রবল উত্তেজনায় তার হাত মৃদু কাঁপছে। বিসমিল্লাহ বলে, ছিদ্রে প্রবেশ করাল চাবি।

কাজ করল চাবিটা! পদ্মজা বিস্ময়ে বাকহারা হয়ে পড়ে! কী হতে চলেছে? সে লোহার এই অংশটি দুই হাতে তোলার চেষ্টা করে। যতটা ভারি ভেবেছিল, ততটা নয়! দেখে লোহার মনে হলেও, বোধহয় আসলে লোহার না। ধীরে ধীরে পদ্মজা আবিষ্কার করল, এটি একটা দরজা, গুপ্ত কোনো ঘরের দরজা। আতঙ্কে হিম হয়ে গেল সে। নিচের দিকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। পদ্মজা তার কাঁপতে থাকা পা এগিয়ে দিল ভেতরে। ভয় যে একেবারে পাচ্ছে না, তা না! খুব ভয় হচ্ছে। এমন আচানক ঘটনার সম্মুখীন তো আগে হয়নি। সিঁড়ি ভেঙে অনেক দূর নেমে এলো সে। ভীষণ ঠান্ডা এদিকে। মনে হচ্ছে সব স্বপ্ন! কোনো রূপকথার গল্পের রাক্ষসপুরীতে চলে এসেছে! চোখের সামনে ভেসে উঠে আরেকটি দরজা। এই দরজাটি অদ্ভুত ধরনের। তাদের ঢাকার বাড়িতে হুবহু একইরকম দরজা আছে! এই দরজার আড়ালে যাই হোক না কেন, বাইরে শব্দ আসে না! পদ্মজা অস্পষ্ট একটা সন্দেহে বিভোর হয়ে ওঠে I

এই দরজাটা খুলতেও কাজে এলো আলমগীরের দেয়া চাবিটা! চাবিতে চুমু খেল পদ্মজা। এত গুরুত্বপূর্ণ চাবি আলমগীর তাকে দিল কেন? এসব ভাবার সময় এখন নয়। বাকিটুকুও তাকে দেখতে হবে। দরজা খুলে অন্য একটি অংশে প্রবেশ করতেই মুখে তীব্র আলো ধাক্কা খেল। পদ্মজা কপাল কুঁচকে দুই হাত সামনে বাড়িয়ে আলোর গতিবেগ রোধ করে মুখে অস্ফুট বিরক্তিসূচক শব্দ করল। তারপর ধীরে ধীরে তাকাল চোখ পিটপিট করে। চারিদিকে রং-বেরঙের বাতি জ্বলছে। এই বাতিগুলোও তার চেনা। তাদের বাড়িতে আছে। যখন বিদ্যুত থাকে না, ব্যাটারিচালিত এই বাতিগুলো পুরো বাড়ি আলোয় আলোয় ভরিয়ে তোলে! দুইদিকে আরো দুটো দরজা। প্রথম দরজাটিতে লেখা ‘স্বাগতম’। দ্বিতীয়টিতে লেখা ‘ধ-রক্ত।’

রুম্পা তো এমন কিছুই বলেছিল!

পদ্মজা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দ্বিতীয় দরজাটির দিকে এগিয়ে গেল। এটার তালা নেই। তাহলে খুলবে কী করে? ধাক্কা দিল পদ্মজা, সঙ্গে সঙ্গে খুলেও গেল দরজা। পদ্মজার মুখ হাঁ হয়ে যায়, ঠোঁট বার বার শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কোথায় এসেছে সে! আর কি ফিরতে পারবে নিজের ঘরে? আচমকা পদ্মজার কানে ভেসে আসে মেয়েদের কান্নার চিৎকার! পদ্মজার রক্ত হিম হয়ে যায়। এরকম একটা জায়গায় এতগুলো মেয়ে কেন কাঁদছে? কত কষ্ট, যন্ত্রণা সেই কান্নায়! কান্নার বেগ বাড়ছে। যেন বিরতিহীনভাবে আঘাত করছে কেউ। পদ্মজা দুই হাতে ছুরি আর রাম-দা শক্ত করে ধরল। তারপর সেই কান্না অনুসরণ করে এগিয়ে গেল সামনে।

যত এগুচ্ছে কান্নাগুলো তীব্র ধাক্কা দিচ্ছে বুকে। নিশ্বাস আটকে আছে পদ্মজার। সে চলে এসেছে খুব কাছে। চোখের সামনে আরেকটা ঘরের দরজা, একটু খোলা ওটা। সে সাবধানে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর তাকাল। আর ঠিক তখনই তার পায়ের পাতা থেকে মাথার তালু অবধি শিরশির করে উঠল। চোখের সামনে দেখা দৃশ্যটা দুঃস্বপ্ন বলে মনে হতে লাগল। মনে হচ্ছে জায়গায় জমে গেছে সে!

বিবস্ত্র অবস্থায় পাঁচ-ছয়টি মেয়ে হাতজোড় করে কাঁপছে, কাঁদছে। তাদের শরীর রক্তাক্ত। আর সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা লম্বা শ্যামবর্ণের দেহ। গায়ে শার্ট নেই। প্যান্ট নেমে এসেছে নাভির অনেক নিচ অবধি। তার হাতে বেল্ট! সম্ভবত বেল্ট দিয়েই মেয়েগুলোকে আঘাত করছিল! প্রশস্ত ও হৃষ্টপুষ্ট শরীরের গড়নের মানুষটিকে চিনতে পেরে পদ্মজার বুকের পাঁজর টনটন করে উঠল। তার হাত থেকে পড়ে যায় ছুরি ও রাম-দা। বিকট শব্দ হলো একটা। সেই শব্দ অনুসরণ করে উপস্থিত মানুষগুলোর চোখ ছুটে গেল দরজার দিকে। পদ্মজা ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে। শরীরের সবটুকু শক্তি নিমিষেই কে যেন শুষে নিয়েছে!

পদ্মজাকে দেখে মানুষটির চোখ হিংস্র জন্তুর মতো জ্বলজ্বল করে উঠল কপালের শিরা ভেসে ওঠে, হিংস্র চাহনিটা যেন মূহূর্তে হয়ে উঠল আরো ভয়ংকর। সে ভাবতেই পারছে না, পদ্মজা এত দূর চলে এসেছে! পদ্মজা বিস্ময়ভরা ছলছল চোখ দুটি সেই মানুষটার দিকে তাক করে অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘ছি!’

(দ্বিতীয় খণ্ডে সমাপ্য)

2 Comments
Collapse Comments

Next plz

ফারহান ইশরাক ইফতি July 6, 2024 at 2:03 am

Next plz plz plz

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *