৫৫
কোনো সাড়া নেই। পদ্মজা পেছনে ফিরে তাকাল। লিখন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। অন্ধকারে তার দিকে চেয়ে কী যে দেখছে! পদ্মজা আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কাটা কাটা গলায় বলল, ‘কিছু বলার নেই, আসি আমি।’
‘ভুলে গেছো আমায়? মনে পড়ে না?’ লিখনের কণ্ঠে ব্যাকুলতা।
পদ্মজার তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ, ‘না ভুলবার মতো কোনো সম্পর্ক কী আমাদের ছিল? ছিল না। আর এভাবে নির্জনে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। আপনি বুঝদার মানুষ, জ্ঞানী মানুষ। এতটুকু নিশ্চয়ই বুঝবেন।’
লিখন ম্লান হেসে বলল, ‘আচ্ছা, আজ আসো।’
‘একটা অনুরোধ ছিল।’
‘কী?’
পদ্মজা ফের তাকাল। সরাসরি লিখনের চোখের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে লিখনের বুক কেঁপে উঠল, সে অপলক চোখে তাকিয়ে রইল। পদ্মজা বলল, ‘নিজেকে এবার গুছিয়ে নিন। মরীচিকার পেছনে অনেক দৌড়েছেন, আর না। এবার নিজের জীবনটা নতুন করে সাজান। আপনার মনের জোর বাড়ান। মানুষ দ্বিতীয় প্রেমেও পড়ে। দ্বিতীয় বার কাউকে ভালোবাসে। মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে। আপনি চেষ্টা করুন। আপনিও পারবেন। কেউ না কেউ আপনার জন্য অবশ্যই আছে।’
‘পদ্ম ফুল।’
পদ্মজা একটু সময়ের জন্য হলেও থমকায়। লিখন বলল, ‘এভাবেই ভালো আছি আমি। তুমিও এভাবেই সারাজীবন ভালো থেকো।’
পদ্মজা কী জবাব দেবে, বুঝে উঠতে পারছে না। এই লিখন শাহ তো এক ধ্যানেই পড়ে আছে। সে আর কথা দীর্ঘ করল না। যে বুঝেও বুঝতে চায় না, তাকে বুঝিয়ে লাভ নেই। সে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘শুভ রাত্রি।’
লিখন পদ্মজার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল, তার চোখ অশ্রুসজল। তবে বুকে প্রশান্তি। জীবনের খরতাপ দহনে মায়াময় পদ্মজার কণ্ঠ, একটু দেওয়া সময় তার বুকে প্রশান্তির ঢেউ তুলেছে। এই…এইটুকু সময়ের স্মৃতি নিয়েই কয়েকটা রাত আরামে ঘুমানো যাবে। সে বিড়বিড় করল, ‘আমি মানতে পারি না তুমি অন্য কারো। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
শেষের শব্দ তিনটে ঘোর লাগা কণ্ঠে ভেঙে ভেঙে বলল।
.
পূর্ণাকে ঘরে এনে পদ্মজা ধমকে বলল, ‘এই ঠান্ডার মধ্যে সোয়েটার না পরে কীভাবে থাকিস? বাইরে বাতাসও হচ্ছে। আমার কোনো কথাবার্তাই কী শুনবি না?’
পূর্ণা অপরাধী স্বরে বলল, ‘আর হবে না, আপা। আগামীকাল সন্ধ্যার আজানের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে চলে আসব।’
‘জি, না। বিকেল থেকেই ঘরে থাকবেন। এমনিতেই এই বাড়ির অবস্থা ভালো না। তুই দুই দিন পর বাড়িতে চলে যাবি।’
‘তুমি যাবে না?’
পদ্মজা আনমনে কিছু ভাবল। বলল, ‘যাব। কয়দিন পর। শোন, রাতে টয়লেটে যেতে ভয় পেলে আমাকে ডাকবি। চেপে রাখবি না।’
‘আচ্ছা।’
পূর্ণা খুক খুক করে কাশতে থাকল। পদ্মজা বিচলিত হয়ে বলল, ‘কাশিও হয়ে গেছে! কত ঠান্ডা বাঁধিয়েছিস। জ্বরও আছে নাকি দেখি।’
পদ্মজা পূর্ণার কপাল ছুঁয়ে তাপমাত্রা অনুমান করে বলল, ‘আছেই তো। তুই কী নিজের যত্ন নেয়া শিখবি না? সারাদিন নতুন শাড়ি পরে, সাজগোজ করে ঘুরে বেড়ালেই নিজের যত্ন নেয়া হয়ে যায়? স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে তো।’
পূর্ণা বাধ্য মেয়ের মতো বলল, ‘আচ্ছা নেব।’
‘তা তো সবসময় বলিস। তুই বস, আমি কুসুম গরম পানি নিয়ে আসছি। গড়গড়া কুলি করে এরপর ঘুমাবি।’
‘আপা–’
—তুই চুপ থাক। চুপচাপ লেপের ভেতর শুয়ে থাক। আমি আসছি।’
পদ্মজা ॥ ৩৪৫
পদ্মজা রান্নাঘরে এসে দেখে বালতিতে পানি নেই। বাড়ির সবাই যার যার ঘরে আছে। হয়তো ঘুমিয়েও গেছে। আমির তো সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। পদ্মজা ছোটো বালতি হাতে নিয়ে কলপাড়ে আসে। চারিদিক নির্জন, থমথমে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। পদ্মজা আশপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিলো। ঝাপসা আলোয় পুরো বাড়িটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। যদিও এই বাড়িতে সবসময়ই রহস্য বিদ্যমান!
পদ্মজা বালতি রেখে কল চাপতে যাবে তখনই কানে একটা ঝনঝন শব্দ আসে। স্টিলের কিছু কাছে কোথাও পড়েছে। পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। কান খাড়া করে বুঝতে পারল, শব্দটা রানির ঘর থেকে আসছে। রানি আপার কোনো বিপদ হলো না তো? পদ্মজা ছুটে আসে রানির ঘরের সামনে। কানে ক্রোধ মেশানো চাপা কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘তোমার লগে কয়বার হুতছি বইললা ভাইবো না সবসময় হুইতে দিয়াম। মাড়িতে যেভাবে এতদিন ছিলা, আজও থাকবা। বিছানাত ওঠার জন্য গাঁইগুঁই করবা না।’
‘মাডিত অনেক ঠান্ডা লাগে। আমারে এক কোনাত জায়গা দাও।’
‘তুমি মাডিত থাকবা মানে মাড়িত থাকবা। কামলা হইয়া মালিকের ছেড়ির লগে হুইবার সাহস আর করবা না।’
‘আমি বিছানাত ঘুমাইয়াম। তুমি আমার বউ লাগো।’
তুমি মাডিত ঘুমাইবা। আমি তোমারে জামাই মানি না।’
‘দেহো, রানি—’
এরপরই একটা আর্তচিৎকার ভেসে আসে। রানি-মদন তর্ক করছে। নিশ্চয় রানি মদনকে ধাক্কা দিয়েছে। মদন ব্যথা পেয়েছে। পদ্মজা একবার ভাবল, দরজায় কড়া নাড়বে। এরপর ভাবল, স্বামী-স্ত্রীর অনেক কথা সে শুনে ফেলেছে। আর না শোনাই ভালো। যেহেতু তারা কারো সামনে ঝগড়া করে না, রাতে নিজ ঘরে সবার অগোচরে ঝগড়া করছে তাহলে ব্যপারটা ব্যক্তিগত। পদ্মজা সরে আসে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। এই দাম্পত্য সংসারে কী ভালোবাসা, সুখ কখনো আসবে না? মদন তো দেখতে খারাপ না। শুধু এতিম আর এই বাড়ির একজন বাধ্য ভৃত্য। এ ছাড়া তো ভীষণ সহজ-সরল। সবার সঙ্গে হেসেখেলে কথা বলে। ঠোঁটে সবসময় লেগে থাকে হাসি।
লিখন আর মৃদুল একই ঘরে, একই বিছানায় শুয়েছে। লিখনের জন্য আলাদা ঘর ছিল বটে, কিন্তু সে মৃদুলের সঙ্গেই শুয়েছে। ছেলেটাকে খুব ভালো লেগেছে তার। সোজাসুজি কথা বলে। মনে কিছু চেপে রাখতে পারে
৩৪৬ ॥ পদ্মজা
না। এতক্ষণ বকবক করেছে। সবেমাত্র অন্যপাশে ফিরে চোখ বুজেছে। বোধহয় ঘুম পেয়েছে। লিখনের মনটা আনচান করছে। ইচ্ছে হচ্ছে, পদ্মজাকে দেখতে যেতে, একসঙ্গে বসে গল্প করতে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। এই বাড়িতে আর আসা যাবে না। পদ্মজার সামনে এলেই মন বেপরোয়া হয়ে যায়। কত-শত ইচ্ছে জেগে ওঠে। লিখনের ব্যক্তিত্ব ভীষণ শক্ত। শুধু এই একটা জায়গাতেই সে দুর্বল। এভাবে চলতে পারে না। নিজের জায়গায় নিজেকে শক্ত থাকতে হবে। লিখন জোরে নিশ্বাস ছাড়ল। মৃদুল ফিরে তাকাল। বলল, ‘ভাইয়ের ঘুম পাইতাছে না?’
‘হু। তুমি ঘুমাও।’
মৃদুল মেরুদণ্ড সোজা করে শুয়ে বলল, ‘আপনি—’
‘আপনি না তুমি। একটু আগেই না আমাদের কথা হলো। তুমি আমাকে তুমি বলবে।’
মৃদুল হাসল। বলল, ‘তুমি যে মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করছো সে মেয়েটা পদ্মজা ভাবি। তাই না?’
লিখন অপ্রস্তুত হয়ে উঠল। পদ্মজা যে বাড়ির বউ সে বাড়ির আত্মীয়র সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলাটা নিশ্চয় অনুচিত! এতে পদ্মজার অসম্মান হবে। সে তো চায় না পদ্মজা কষ্ট পাক, তাকে নিয়ে কেউ দুই লাইন বেশি ভাবুক। পদ্মজা সবসময় ভালো থাকুক। লিখন জোরপূর্বক হাসল। তারপর বলল, ‘কী বলছো! তেমন কিছুই না। ঘুমাও এখন। আমারও অনেক ঘুম পাচ্ছে।’
লিখন অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়ে। মৃদুল হতাশ হয়ে চোখ বুজে।
পদ্মজা অন্ধকারে ধীরে ধীরে হাঁটছে। হাতে কাচের গ্লাস। তাতে কুসুম গরম পানি। সিঁড়িতে পা রাখতেই কারো পায়ের আওয়াজ কানে এলো। পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, আলমগীর চোরের মতো চারপাশ দেখে দেখে সদর দরজার দিকে যাচ্ছে। পদ্মজা দ্রুত সিঁড়ি থেকে নেমে চেয়ারের পেছনে লুকিয়ে পড়ল, গ্লাস রেখে দিল এক পাশে। তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। চোখ দুটি তীক্ষ্ণ হয়ে আলমগীরকে পরখ করছে। আলমগীরের পরনে পাঞ্জাবি। বাড়িতে ভদ্রলোকের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। শান্তশিষ্ট, চুপচাপ। মাঝেমধ্যে দেখা যায়…তবে কথা হয় না। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়। নিজ ইচ্ছায় কথা বলে না।
সদর দরজা পেরিয়ে গেল আলমগীর। পদ্মজাও সাবধানে আলমগীরের পিছু নিলো। পায়ের জুতাগুলো হাঁটার তালে মৃদু শব্দ তুলছে। তাই পদ্মজা
পদ্মজা ॥ ৩৪৭
জুতাজোড়া খুলে দরজার পাশে রেখে দিল। আলমগীর অন্দরমহলের ডান দিকে এগোচ্ছে। ঝিঁঝি পোকার ডাক চারিদিকে। দূরে কোথাও শেয়াল ডাকছে। গা ছমছমে পরিবেশ। এদিক-ওদিক কোনো মৃদু শব্দ হতেই পদ্মজা উৎকর্ণ হয়ে উঠছে। কেমন গা কাঁটা দিচ্ছে। এত রাতে দীর্ঘদেহী এই লোক যাচ্ছে কোথায়? হাঁটতে হাঁটতে তারা বাড়ির পেছনে চলে আসে। আলমগীর অন্দরমহলের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে এটাই তার গন্তব্য। পদ্মজা কলাগাছের পেছনে লুকিয়ে পড়ল। বাতাসে গা কাঁপুনি দিচ্ছে। আলমগীর চারপাশ দেখে নিলো টর্চ জ্বালিয়ে। তারপর মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ করল। কাউকে ইঙ্গিত দিচ্ছে! পদ্মজার রগে রগে দামামা শুরু হয়।
কী হতে চলেছে? আজ কী দেখবে?
বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল পূর্ণা। এতক্ষণ হয়ে গেল তার আপা আসছে না কেন? সে জুতা পরে নেমে এলো নিচ তলায়। রান্নাঘরে যাওয়ার পথে পায়ে কাচের গ্লাস লেগে পড়ে গেল। ভয় পেয়ে গেল পূর্ণা। এখানে গ্লাস কে রাখল? খানিকটা পানি লাগল তার পায়ে। মনে হচ্ছে, পানিটা গরম। এই রাতের বেলা গরম পানি এখানে…কীভাবে?
পূর্ণা ভাবল, তার আপার না পানি গরম করার কথা ছিল? কিন্তু গরম করে এখানে কেন রাখবে? তার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তো! পূৰ্ণা রান্নাঘরে এসে দেখে—পদ্মজা নেই। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। দরজার পাশে পদ্মজার জুতা দেখে ভয়টা আরো বেড়ে যায়। সে দৌড়ে আমিরের ঘরে গেল। গিয়ে দেখল, আমির ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা নেই। পূর্ণা এবার ঘামতে থাকল। সে শুনেছে, এই বাড়িতে ভূত-জিন আছে। এরা মানুষের ক্ষতি করে। বিশেষ করে সুন্দর মানুষদের। তার মানে তার আপার গুরুতর বিপদ! পূর্ণা এক দৌড়ে রান্নাঘরে এসে জ্বালিয়ে নিলো একটা লণ্ঠন। অন্যসময় হলে ভয় কাজ করত। আজ করছে না। সে তার আপাকে জান দিয়ে হলেও বাঁচাবে। সে ভাবছে, কোনো পাজি জিন হয়তো আপার উপর ভর করে পুকুরপাড়ে নিয়ে গেছে।
পূর্ণা ঝটপট বেরিয়ে পড়ে। কাউকে ডাকার বুদ্ধি অবধি মাথায় আসেনি। সে আতঙ্কে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। আয়তুল কুরসি পড়তে পড়তে পুকুরপাড়ের পথ ধরে।
.
পদ্মজাকে চমকে দিয়ে তৃতীয় তলার একটা জানালা হাট করে খুলে যায়। সেখান থেকে একটা মোটা দড়ি ছুঁড়ে দেওয়া হয় আলমগীরের উদ্দেশ্যে। পদ্মজার ওষ্ঠদ্বয় আপনা থেকেই আলাদা হয়ে গেল, দুই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল সেদিকে। আলমগীর সেই দড়ি বেয়ে তৃতীয় তলায় উঠে গেল। দেখে মনে হচ্ছে: এর আগেও বহুবার আলমগীর কাজটা করেছে।
মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেল পদ্মজার। জানালা দিয়ে আলমগীর কার ঘরে গিয়েছে? তৃতীয় তলায় সে একবার গেছে বলে জানেও না, কোন ঘরে কী আছে। ঠান্ডা, শিরশিরে একটা অনুভূতি হচ্ছে পায়ের গোড়ালিতে। পদ্মজা এক হাত দিয়ে ছুঁতেই বুঝতে পারে জোঁকে ধরেছে। জোঁকে তার খুব ভয়। কিন্তু এখন ভয় করছে না। তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে আছে অন্যকাজে। সে জোঁক ছাড়িয়ে নিলো।
অনেকক্ষণ পার হয়ে গেলেও আলমগীরের দেখা নেই। দড়ি তো ঝুলছে! আবার কী নামবে? পদ্মজা কোমরে এক হাত রেখে তাকিয়ে রইল। আচমকা মনে পড়ে গেল—তৃতীয় তলায় রুম্পা আছে। ডান দিকের কোনো এক ঘরে। আর আলমগীর ডান দিকের কোনো ঘরের জানালা দিয়েই ঢুকেছে। মানে কী? রুম্পার কাছে গিয়েছে?
পদ্মজা বারংবার শুধু চমকাচ্ছে। আলমগীর দড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল। তারপর ইশারায় অন্য কাউকে নামতে বলল। কাঙ্ক্ষিত সেই মুখটি দেখে চমকে গেল পদ্মজার পিলে। রূম্পা! শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে দড়ি বেয়ে নামছে। বার বার দড়ি থেকে হাত ছুটে যাচ্ছে তার। আলমগীর দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছে যাতে রুম্পা পড়ে গেলে ধরতে পারে। পদ্মজার বুক দুরুদুরু করছে, যদি রুম্পা পড়ে যায়! এত ঝুঁকি কেন নিচ্ছে?
রুম্পার পা মাটিতে পড়তেই আলমগীর শক্ত করে রুম্পাকে জড়িয়ে ধরল। পরক্ষণেই ভেসে এলো রুম্পার কান্নার সুর। সঙ্গে সঙ্গে রুম্পার মুখ চেপে ধরে কিছু একটা বলল আলমগীর। টর্চের আলো ফেলে চারপাশ দেখে, রুম্পাকে এক হাতে শক্ত করে ধরে হাঁটা শুরু করল সামনে। তখন কোথেকে উদয় হয় একজন অদ্ভুত লোকের। লোকটা কালো, মোটা, লম্বা চুল। এক হাতে রাম-দা, অন্য হাতে লাঠি। অজানা বিপদের আশঙ্কা পেয়ে ভয় হলো পদ্মজার। পা থেকে কিছুটা দূরে থাকা কয়েকটা পাথরের মধ্যে বড়োসড় দেখে একটা পাথর হাতে নিলো, যেন বিপদে কাজে লাগানো যায়। পরক্ষণেই তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল আলমগীর আর অজ্ঞাত লোকটির মধ্যে। একসময় তা হাতাহাতিতে রূপ নিলো। রুম্পা ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গেছে। অজ্ঞাত লোকটি রুম্পাকে ধরতে চাইছে। কিন্তু আলমগীর তা হতে দিচ্ছে না। পদ্মজার মনে হচ্ছে, এখন তার সামনে যাওয়া উচিত। আল্লাহর নাম নিয়ে সে কলাগাছের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটির হাত থেকে রাম-দা নিয়ে দূরে ফেলে দিল, পরক্ষণেই দেখতে পেল পদ্মজাকে। চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘বোন, সাহায্য করো।’
অজ্ঞাত লোকটি পদ্মজাকে দেখে আরো বেশি হিংস্র হয়ে উঠল। ছুটে এসে ছোঁ মেরে রুম্পাকে ধরতে চাইল সে। আলমগীর ঝাঁপিয়ে পড়ল অজ্ঞাত লোকটির ঘাড়ে। দুই হাতে ঝাপটে ধরে রেখে রুম্পাকে বলল, ‘তুমি যাও, রুম্পা।
রুম্পা দৌড়ে পদ্মজার কাছে আসে। সে হাঁপড়ের মতো হাঁপাচ্ছে, ঘামছে ভয়ে। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটিকে আটকে রাখতে পারছে না। সে অনেক কষ্টে অনুরোধ করে, ‘আমার রুম্পাকে ওরা মেরে ফেলবে। তুমি ওরে খালপাড়ে নিয়ে যাও পদ্ম। আমি আজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকব।’
পদ্মজা দুই হাতে আঁকড়ে ধরে রুম্পাকে। আলমগীরের হাত থেকে পড়ে যাওয়া টর্চের আলো অজ্ঞাত লোকটির মুখে পড়তেই পদ্মজার খুব চেনা মনে হয়। পারিজার খুনির বর্ণনাও ঠিক এমনই—ভাবতেই পদ্মজার রক্ত ছলকে ওঠে।
সেই মুহূর্তে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে পূর্ণার। সে পুকুরপাড়ে যাচ্ছিল। টর্চের আলো পেয়ে এদিকে ছুটে এসেছে। অজ্ঞাত লোকটি রুম্পার উদ্দেশ্যে হাতের লাঠি ছুঁড়ে মারে। দ্রুত রুম্পাকে নিয়ে সরে যায় পদ্মজা, লাঠি গিয়ে সোজা পড়ে পূর্ণার কাঁধে। আপা বলে আর্তনাদ করে বসে পড়ে সে।
পদ্মজা দিকদিশা হারিয়ে ফেলল। কী করবে সে? মনে হচ্ছে রুম্পাকে কেউ খুন করতে চাইছে, তাই আলমগীর তাকে নিয়ে পালাচ্ছে। আর এই নাম না জানা লোক রুম্পাকে আঘাত করতে চাইছে কেন? পূর্ণাও আঘাত পেয়েছে। কী করবে পদ্মজা? রুম্পাকে নিয়ে খালের দিকে পৌঁছে দিবে? পূর্ণাকে এই ভয়ংকর পরিবেশ থেকে নিরাপদে নিয়ে যাবে?
নাকি পারিজার খুনি হিসেবে সন্দেহ করা লোকটিকে ধরবে?
৫৬
থেকে থেকে দূরে হুতুম প্যাঁচা ডাকছে, ভুতুড়ে শোনাচ্ছে ডাকটা। গা কাঁপুনি দেবার মতো ঠান্ডা। সময়টা যেন থমকে দাঁড়িয়ে চড়ছে দণ্ড শূলে। পদ্মজা ছুটে এলো পূর্ণার কাছে। পূর্ণা উবু হয়ে শুয়ে পড়েছে। কাঁদছে মা, মা করে। পদ্মজা এক হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে রুম্পাকে। আরেক হাতে পূর্ণার কাঁধে ছুঁয়ে দেখল কোথায় আঘাত পেয়েছে। ঠান্ডায় তার ঠোঁট কাঁপছে। কানে ভেসে আসছে দুজন পুরুষের ধস্তাধস্তির দুপদাপ শব্দ। পদ্মজার ঠান্ডা হাতে পূর্ণার আহত স্থানের রক্ত লাগতেই সে আঁতকে উঠল। রুম্পাকে ছেড়ে জড়িয়ে ধরল পূর্ণাকে। পাশে তাকিয়ে দেখল, যে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে সে লাঠির আগায় কাঁচি বাঁধা। পূর্ণার ঘাড়ের চামড়া ছিঁড়ে গেছে। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পূর্ণার পুরো শরীর। আলমগীর অজ্ঞাত লোকটির সঙ্গে পারছে না। সে আকুতি, মিনতি করে পদ্মজাকে বলছে, ‘পদ্মজা, পদ্মজা, বোন সহায় হও।’
টানাপোড়নে পদ্মজার হাত পা কাঁপতে থাকল। সে পূর্ণাকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। পূর্ণা কিছুতেই উঠতে পারছে না। যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। পূর্ণার কান্না দেখে পদ্মজার বুক ব্যথায় বিষে যাচ্ছে। এই রাত, রাতের আঁধার এত পাষাণ কেন হলো!
আলমগীরের আর্তনাদ ভেসে এলে, পদ্মজা চমকে ফিরে তাকাল। অজ্ঞাত লোকটি আলমগীরের স্পর্শকাতর স্থানে অস্বাভাবিকভাবে আঘাত করেছে। ফলে সে দুর্বল হয়ে আর্তনাদ করে উবু হয়ে ছটফট করছে। অজ্ঞাত লোকটি দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে ছুটে এসে রুম্পাকে ধরতে চাইল। পদ্মজা বাধা হয়ে দাঁড়াল। অজ্ঞাত লোকটি কর্কশ কণ্ঠে পদ্মজাকে হুংকার দিল, ‘আমার কাম আমারে করতে দে।’
একটা মানুষের কণ্ঠস্বর এত ভয়ংকর কী করে হয়! এই কণ্ঠস্বর যে কাউকে কাঁপিয়ে তুলবে। পদ্মজা কিঞ্চিৎ চমকালেও থেমে থাকল না। উত্তুরে হাওয়ায় তার চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে। সে অজ্ঞাত লোকটির মতোই হুংকার দিয়ে বলল, ‘নিজের ভালো চান তো আত্মসমর্পণ করুন।’
পদ্মজার কথা শুনে লোকটি ব্যঙ্গ করে হাসল। খুব কাছ থেকে অজ্ঞাত লোকটির মুখ দেখে কপাল কুঁচকে ফেলল পদ্মজা। লোকটির মুখ থেকে বিশ্রি একটা দুর্গন্ধ আসছে। স্বাস্থ্যবান দেহ, গায়ের রং কুচকুচে কালো। সাদা দাঁতকপাটি আর লাল ভয়ংকর চোখ—দুটিই আগে নজর কাড়ছে। পদ্মজা কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই অজ্ঞাত লোকটি পদ্মজাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। এরপর লাঠি তুলে নিলো হাতে। রুম্পা ছুটে পালাতে চাইল। কিন্তু পারল না। অজ্ঞাত লোকটি তার গলা চেপে ধরল।
পদ্মজা দৌড়ে এসে অজ্ঞাত লোকটির পিঠে কিল-ঘুসি দিল, তাও কাজ হলো না। পদ্মজার গায়ের শক্তি লোকটিকে এক চুলও নাড়াতে পারেনি। রুম্পা গোঙাচ্ছে। পূর্ণা যন্ত্রণায় কাঁদছে, ভয়ে জুবুথুবু হয়ে আছে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। নিশাচর পাখিরা আজ যেন অদ্ভুত স্বরে ডাকাডাকি করছে। কেমন গা কাঁপিয়ে তোলা ডাক! ঝিঁঝিপোকাদের ডাক বেড়েছে, কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বাতাসের বেগ।
অজ্ঞাত লোকটির হিংস্র থাবা রুম্পাকে গ্রাস করে নিয়েছে। লোকটি পা দিয়ে মাটি থেকে লাঠি তুলল। তারপর লাঠির আগা থেকে কাঁচি নিলো হাতে।
আর কিছু মুহূর্ত, তাহলেই সেই ধারাল কাঁচি রুম্পার গলার রগ কেটে ফেলবে। উড়ে যাবে রুম্পার রুহ। আলমগীর নিজের যন্ত্রণা ভুলে ছুটে আসে তার সহধর্মিণীর প্রাণ বাঁচাতে। তার আগেই ঘটে যায় ভয়ংকর এক দৃশ্য। পদ্মজা অজ্ঞাত লোকটির পড়ে থাকা রাম-দা তুলে তার পিঠেই কোপ বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞাত লোকটি লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ফলে রাম-দা ঢুকে গেল আরো গভীরে
জবাইয়ের পর গরু যেভাবে কাতরায়, অজ্ঞাত লোকটি সেভাবে কাতরাতে থাকল। রক্ত ছিটকে পড়ে পদ্মজার শাড়িতে, মুখমণ্ডলে। কাতরাতে থাকা দেহটি ডিঙিয়ে আলমগীর রুম্পার কাছে যায়। তারপর পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজার বুক হাঁপড়ের মতো ওঠানামা করছে, চোখে জ্বলছে ধিকিধিকি আগুন। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যায় দেহটি। নিস্তেজ হয়ে পড়ে পদ্মজাও। সে এলোমেলো পায়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। তার শরীর কিঞ্চিৎ কাঁপছে।
এটা সে কী করেছে! এ যে অচিন্তনীয় কাজ!
সব এলোমেলো লাগছে। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। গুলিয়ে উঠছে গা।
পূর্ণা এই দৃশ্য দেখে নিজের রক্তক্ষরণ ভুলে যায়, ভয়ে কাঁপতে থাকে। নাভি উলটে বমি বেরিয়ে আসে। আলমগীর তাড়াহুড়ো করে পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াল। পদ্মজার বুকে বইছে অপ্রতিরোধ্য তুফান! সে নিষ্কম্প চোখে তাকিয়ে আছে নিথর দেহটির দিকে। আলমগীর একটা চাবি পদ্মজার হাতে গুঁজে দিয়ে এক নিশ্বাসে বলল, ‘ভয় পেয়ো না। এই বাড়িতে দিন-দুপুরে খুন হলেও তা বাইরের কেউ জানবে না। সকালে উঠে দেখবে এখানে বাবলুর লাশও নেই, রক্তও নেই। কেউ না কেউ সরিয়ে দেবে। সব দুঃস্বপ্ন মনে হবে। দ্রুত ঘরে ফিরে যাও। আমার অনেক কথা বলার আছে। তোমার বাপের বাড়ির ঠিকানায় আমি চিঠি লিখব। আসছি।’
রুম্পা দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরল। তার বুকটা হাহাকার করছে। পদ্মজার কথা খুব মনে পড়বে। আলমগীর অস্থির হয়ে চারিদিক দেখছে, আতঙ্কে কাঁপছে, এই বুঝি কেউ এসে পড়ল, আর আবার বন্দি করে নিলো রুম্পাকে। এমন অশান্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। আতঙ্কে যেকোনো মুহূর্তে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
পদ্মজাকে কিছু বলতে চেয়েছিল রুম্পা, আলমগীর বলতে দিল না। তার আগেই টেনে নিয়ে দৌড়াতে থাকল। পদ্মজা তাদের যাওয়ার পানে চেয়ে রইল। ঝিঁঝিপোকাদের আলোর ভিড়ে দুজন হারিয়ে যাচ্ছে। তারা বাঁচার আশায় দৌড়াচ্ছে। না হওয়া সংসার পাতার স্বপ পূরণ করতে দৌড়াচ্ছে। দুজন আড়াল হয়ে যেতেই পদ্মজা নিজের মুখ ছুঁয়ে দুই হাত সামনে এনে দেখল, টকটকে লাল রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে সে বমি করতে থাকল। তারপরপরই সংবিৎ ফিরল। সে পূর্ণাকে খুঁজতে থাকে। একটু দূরে পূর্ণা ঘাসের ওপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। পদ্মজা দৌড়ে যায়। পূর্ণা পিটপিট করে তাকাল। পূর্ণাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে পদ্মজা। একুশ বছর বয়সি একটা মেয়ের শরীর তো কম ভারি নয়। পদ্মজার শক্তিতে কুলোচ্ছে না। সে পূর্ণাকে আকুতি করে বলল, ‘ওঠার চেষ্টা কর বোন।’
পূর্ণার শরীরে ভূমিকম্প বয়ে যাচ্ছে। সে পুরো ভর পদ্মজার উপর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। পদ্মজা শরীরের পুরোটা শক্তি দিয়ে পূর্ণাকে আগলে ধরে সামনে হাঁটা শুরু করে। তার পাজোড়া ঠকঠক করে কাঁপছে। সে জানে না এটা শীতের কাঁপুনি নাকি ভয়ংকর কোনো কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার উত্তেজনা। মনে হচ্ছে ভয়ংকর একটা ঝড় হুট করে শুরু হয়ে হুট করে থেমে গেছে। আর রেখে গেছে নিশ্বাস থামিয়ে দেওয়া নিস্তব্ধতা। পদ্মজা ঘামছে, কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। মনে হচ্ছে, এই বুঝি মৃত বাবলু উঠে দাঁড়াল। অনেক…অ-নে-ক প্রেতাত্মা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল দুই বোনের ওপর!
জঙ্গলের গাছপালা থেকে প্যাঁচাদের দল তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে, সদ্য খুন হওয়া একটা মৃত দেহ পড়ে আছে ঘাসের ওপর। আরেকটু দূরে ছিমছাম গঠনের শাড়ি পরা একটা মেয়ে চুল খোলা রেখে এলোমেলো পায়ে আরেকটা দুর্বল দেহকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির ভেতর! দুজনের গায়ে তাজা লাল রক্ত। এই দৃশ্য রাতের আঁধারের চেয়েও ভয়ংকর! যার স্বাক্ষী হয়ে রইল রাতের আঁধার আর নিশাচর পাখিরা।
.
প্রতিদিনের মতোই ভোরের আলো নিকষকালো রাতকে ঠেলে দূরে সরিয়ে পৃথিবীটাকে আলোকিত করে তুলেছে। পাখিরা কিচিরমিচির করে ডাকছে। নতুন করে শুরু হয়েছে আরেকটা দিন। শুধু পদ্মজার সময়টা থমকে গেছে। সে তার গোসলখানায় বসে আছে। কনকনে ঠান্ডায় গোসল করেছে। এরপর থেকেই উদাসীন হয়ে ভেজাকাপড়ে বসে আছে। অন্য ঘরে ঘুমাচ্ছে পূর্ণা। পদ্মজা রাতে ধীরে-সুস্থে পূর্ণার ক্ষত সামলেছে। বুঝতে দেয়নি, সে মনে মনে কতটা ভেঙে পড়েছে। যখন রাতে তারা দুই বোন দুইতলায় উঠছিল, তখন পেছনে কে যেন ছিল! এত চিৎকার, চেঁচামিচি হয়েছে আর কেউ শোনেনি? অন্দরমহলের রিদওয়ান এবং মজিদের ঘরের মানুষদের তো শোনার কথা ছিল। তাদের ঘর ডান দিকে, আর ডান দিকেই এত বড়ো ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে। পূর্ণা জোরে জোরে কেঁদেছে, আলমগীর চেঁচিয়েছে। বাবলু নামের সেই লোকটি খুন হওয়ার সময় আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করেছিল। দুপদাপ শব্দ তুলে কাতরেছিল। তবুও কেউ আসেনি! কেন? তার কেন মনে হচ্ছে, সবাই শুনেছে…কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। পদ্মজার চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসে। সবকিছু কেমন ওলটপালট লাগছে। কাউকে খুন করার মতো সাহস কী করে হলো? এটা কি ওর মা হেমলতার গুণ? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল পদ্মজা। চোখ পড়ে আলমগীরের দেয়া চাবিটার দিকে। চাবিটা দেখতে অনেক বড়ো। সে অপলক চোখে চাবিটির দিকে তাকিয়ে রইল।
আমির ঘুম থেকে উঠে পদ্মজাকে দেখতে না পেয়ে গোসলখানায় উঁকি দিয়ে পদ্মজাকে দেখে চমকে ওঠে। পদ্মজার শাড়ি হাঁটু অবধি তোলা। আঁচল বুকে নেই। চুল এলোমেলো। গায়ের রং ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। থেমে থেমে কাঁপছে। সেদিকে পদ্মজার ভ্রুক্ষেপ নেই। আমির হন্তদন্ত হয়ে গোসলখানায় প্রবেশ করে। পদ্মজার দুই বাহু দুই হাতে চেপে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল, ‘পদ্মবতী, কী হয়েছে? এ কী অবস্থা তোমার!’
পদ্মজা কিছু বলল না। সে আমিরের চোখের দিকে নিজের দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখল। আমির দ্বিগুণ বিচলিত হয়ে বলল, ‘এই পদ্ম, তুমি কাঁপছো কেন? কী হয়েছে?’
পদ্মজার ঠোঁট দুটি ভেঙে চোখ ছাপিয়ে জল নেমে আসে। আমির অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আচমকা আমিরকে জড়িয়ে ধরল পদ্মজা। আমিরের পুরো শরীর মুহূর্তে ঠান্ডা বরফ হয়ে গেল। পদ্মজা বাঁধভাঙা নদীর মতো কাঁদতে থাকল হু হু করে। আমির শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বলো না, কী হয়েছে? আমার চিন্তা হচ্ছে।’
পদ্মজা আরো শক্ত করে আমিরকে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি…আমি খ…খুন করেছি।’
‘কী…কী বলছো! এই, পদ্মজা।’
পদ্মজা আমিরের পিঠ খামচে ধরে বলল, ‘আ…আমি..এটা কীভাবে করেছি!
আমির পদ্মজাকে নিজের সামনাসামনি বসিয়ে বলল, ‘আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। সব বলো আমাকে! কান্না থামাও।’
পদ্মজা মেঝেতে দৃষ্টি রেখে ফোঁপাতে ফোঁপাতে পুরো ঘটনাটা বলল। সে নিজের কাজে নিজে অবাক। আমির পদ্মজাকে শান্ত করার জন্য বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বলল, ‘কিছু হয়নি। শান্ত হও। কান্না থামাও।’
পদ্মজার কান্না থামে। সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। তার মাথা কাজ করছে না। মস্তিষ্কে কিছুই নেই। আমির তা বেশ বুঝতে পেরেছে। আলমারি থেকে শাড়ি, ব্লাউজ নিয়ে এসে নিজে পরিয়ে দিলো পদ্মজাকে। পদ্মজার পুরো শরীর যেন শরীর না, বরফ। এতই ঠান্ডা! আমির পদ্মজার চুল মুছে দিয়ে বলল, ‘ঘরে চলো। না, থাক। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’
পদ্মজা তরঙ্গহীন স্বরে বলল, ‘তোমার ঘাড়ে টান পড়বে। আমি যেতে পারব।’
আমির পদ্মজাকে ধরে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গায়ে লেপ জড়িয়ে দিল। বলল, ‘আমি থাকতে তোমার কিছু হবে না। ডান দিকে তো?’
পদ্মজা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। আমির সোয়েটার পরে বেরিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এসে বলল, ‘কোথায়? কোথাও তো কিছু পাইনি।’
পদ্মজা বিস্মিত হয়ে দ্রুত উঠে বসল। তারপর চোখ বড়ো বড়ো করে জানতে চাইল, ‘লাশ বা রক্ত কিছুই নেই?’
আমির নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘না তো। তুমি বোধহয় রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছো।’
পদ্মজা বোকা বনে যায়। অস্থির হয়ে পড়ে। এটা কী করে সম্ভব! এই কাকডাকা ভোরে লাশ থাকবে না কেন! আলমগীরের বলা কথাগুলো মনে পড়তেই পদ্মজা সব বুঝতে পারে। ধীরে ধীরে আবার শুয়ে পড়ল সে, চোখ বুঁজে। তার ঠোঁট দুটি তিরতির করে কাঁপছে!
৫৭
অন্ধকার নেমে এসেছে। সন্ধ্যা তার ঝাঁপি থেকে অন্ধকার নিয়ে এসে ঝপ করে রাত নামিয়ে দিল। বিদ্যুৎও চলে গেল। পদ্মজা হারিকেন জ্বালিয়ে প্রেমার ঘরে এলো। প্রেমা পড়ছিল। পূর্ণা শুয়ে আছে। পদ্মজাকে দেখে প্ৰেমা এগিয়ে এসে হারিকেন নিলো। বলল, ‘আপা সন্ধ্যার নামাজ পড়েনি।’
‘তুই পড়। আমি দেখছি।’
পদ্মজা পূর্ণার শিয়রে বসে কাশি দিল পূর্ণার মনোযোগ পেতে। পূর্ণার সাড়া পাওয়া যায়নি। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেদিনের ঘটনার ছয় দিন কেটে গেছে। পূর্ণার স্বাভাবিক হতে দুইদিন লেগেছিল। এই দুইদিন ঘর থেকে বের হয়নি। কিন্তু কাঁধের ক্ষতটা শীতের কারণে পেকেছে। খুব জ্বালাতন করে। আপা, আপা করে কাঁদে। পদ্মজার ভালো লাগে না সেই কান্না শুনতে। কষ্ট হয়। বুক ভারি হয়ে আসে। সে পূর্ণার গায়ে লেপ জড়িয়ে দিয়ে মাথায় কিছুক্ষণ বিলি কাটল। প্রেমাকে প্রশ্ন করল, ‘প্রান্ত কোথায়?’
‘লাহাড়ি ঘরে।’
‘কী করে ওখানে?’
কী হিবিজিবি বানায়। বিজ্ঞানী হয়ে যাবে দেখো।’
‘মজা করে বলছিস কেন? হিবিজিবি বানাতে বানাতেই একদিন চমকে দেয়ার মতো কিছু বানিয়ে ফেলবে। বিরক্ত করিস না। ওকে ওর মতো সময় কাটাতে দিস।’
‘কে যায় ওরে বিরক্ত করতে? আমি আমার পড়া নিয়েই আছি।’ কথা শেষ করেই প্রেমা পড়ায় মনোযোগ দেয়। পদ্মজা মুচকি হাসল। প্রেমাকে খুব ভালো লাগে তার। মেয়েটা শুধু লাজুক নয় ভীষণ বুদ্ধিমতীও বটে। চাল চলন আকর্ষণ করার মতো।
বাসন্তী এই রাতের বেলা হারিকেন জ্বালিয়ে কাঁথা সেলাই করছেন। পদ্মজা রাগী স্বরে বলার চেষ্টা করল, ‘রাতের বেলা কী করছেন আপনি? বিশ্রাম নিন এখন।’
বাসন্তী পদ্মজার দিকে চেয়ে হাসলেন। বললেন, ‘কিছুক্ষণ আগেই তো সন্ধ্যা হলো।’
‘সারাদিন কাজ করেন। এখনও করবেন? বিকেলে এতসব রান্নাও করলেন। যতদিন গ্রামে আছি আমি এই সেলাই-টেলাই যেন আর না দেখি।’
বাসন্তীকে আর কিছু বলতে না দিয়ে পদ্মজা কাঁথা কেড়ে নিলো। বাসন্তীর কোনো কথা শোনেনি। আলমারির ভেতর কাঁথা, সুতা, সুঁই রেখে বলল, ‘যতদিন আমি আছি এগুলো বের করবেন না। বুঝেছেন?’
‘আমার কী আর কিছু বলার আছে?’
পদ্মজা হেসে ফেলল। সঙ্গে বাসন্তীও। আমিরের আগমন ঘটে তখনি। পরনে বেশ দামি জ্যাকেট। পায়ে বুট। সে বাইরে গিয়েছিল হেমলতার মিলাদের ব্যবস্থা করতে। পদ্মজা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, ‘সব ঠিক হয়েছে? আর একদিন পরেই কিন্তু — ‘
‘কোনো চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে গেছে। পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। খেতে দাও।’
বাসন্তী বিছানা থেকে দ্রুত নামলেন, ‘দিতেছি বাবা।’
‘আমি যাচ্ছি তো।’ বলল পদ্মজা।
‘তুমি জামাইকে নিয়ে কলপাড়ে যাও। দেখ, জুতায় কাদা লাগিয়ে আসছে।’
সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজা আমিরের পায়ের দিকে তাকাল। আমিরও তাকাল। পদ্মজা আক্ষেপের সুরে বলল, ‘এত কাদা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন কেন?’
আমির তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। অপরাধী স্বরে বলল, ‘দুঃখিত আমি।’
‘আসুন কলপাড়ে।’
কুয়াশায় চারিদিক ঝাপসা হয়ে আছে। কুয়াশার স্তর এতই ঘন যে পাঁচ- ছয় ফুট দূরের কিছু দেখা যাচ্ছে না। পদ্মজা কল চাপছে,
আমির জুতার কাদা পরিষ্কার করছে। কলের পানি কুসুম গরম। শীতের সময় কল থেকে গরম পানি আসার ব্যাপারটা দারুণ। আমির বলল, ‘পূর্ণা কী ঘুমিয়ে গেছে?
‘হু।’
‘ঘুমাবেই তো। প্রতিদিন সন্ধ্যার আজান পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর ফজরের আজানের আগ থেকে উঠে পকপক শুরু করে। ঘুমাতে পারি না।’
পদ্মজা শব্দ করে হাসল। বলল, ‘ঠিকই তো করে। ফজরে কীসের ঘুম?’
‘বোনের পক্ষই তো নিবে।’
ক্ষণকাল পিনপতন নীরবতা। আমিরের জুতা ধোয়া শেষ। পদ্মজা শুকনো কণ্ঠে বলল, ‘ওই বাড়ির মানুষদের আসতে বলেছেন?’
ওই বাড়ির নাম উঠতেই আমির জ্বলে উঠল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ওই বাড়ির নাম নিতে নিষেধ করেছি।’
‘তবুও…’
‘না বলিনি। আর বলবও না।’
আমির পায়ে গটগট শব্দ তুলে চলে যায়। পদ্মজা আমিরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকল। সে রাতের পর ওই বাড়িতে তারা তিন দিন ছিল। তারপরই আমির চাপ দিতে থাকে, হাওলাদার বাড়ি ছাড়তে। সে সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকে। এভাবে আতঙ্ক নিয়ে বাঁচা যায় না। আমির রাতে ঘুমায় না, ছটফট করে। ভয় পায়, এই বুঝি পদ্মজার কিছু হয়ে গেল। পদ্মজা খেয়াল করেছে, আমির রাতে কপালের ওপর হাত রেখে চুপচাপ শুয়ে থাকে। তাছাড়া এইভাবে লাশ অদৃশ্য হয়ে গেল!
পর পর তিন দিন কেটে যায় তবুও কেউ কিছু বলেনি। কারো মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। ব্যাপারটা ভয়ংকর। পূর্ণার ওখানে থাকা বিপজ্জনক। পদ্মজা বিপদকে ভয় পায় না। কিন্তু পূর্ণার কিছু হলে সে মানতে পারবে না। আবার পূর্ণা একা এই বাড়িতে আসবেও না। তাই বাধ্য হয়ে তিনজন একসঙ্গে চলে এসেছে। তবে পদ্মজা আবার যাবে ওই বাড়িতে। যেতে তাকে হবেই। হাওলাদার বাড়ির প্রতিটি কোনার রহস্য সে নিজের নখদর্পণে আনবেই।
এটা তার শপথ।
অনেক রাত হয়েছে। রাতের খাবারের সময় পূর্ণাকে ডেকে তোলা হয়। একবার ঘুম ভেঙে গেলে পূর্ণা আর ঘুমাতে পারে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যায়। প্রেমা এখনও পড়ছে। পূর্ণা বিরক্তি নিয়ে প্রেমার দিকে তাকাল। মনে মনে বলে, এই মেয়ে কী বিশ্ব জয় করে ফেলবে পড়ে? এত তো আপাও পড়েনি।
‘বাত্তিডা নিভিয়ে এসে ঘুমা। অনেক পড়ছস।’ কিড়মিড় করে বলল পূর্ণা।
প্রেমা গুরুজনদের মতো করে বলল, ‘বাত্তিডা না বাতিটা হবে।’
‘আমাকে কিছু শেখাতে আসলে থাপ্পড় দিয়ে দাঁত গাছে তুলে দেব।’
প্রেমার মুখে আঁধার নেমে আসে। সে থমথমে মুখ নিয়ে বই বন্ধ করে ঝিম মেরে বসে থাকে। পূর্ণা সন্তুষ্ট হয়ে বলল, ‘এবার হারিকেনের আগুন নিভা। এরপর শুয়ে পড়।’
প্রেমা হারিকেনের আগুন নিভাতে প্রস্তুত হতেই, পূর্ণা বলল, ‘না, থাক নিভাতে হবে না। ভয় করে। তুই শুয়ে পড়।
প্রেমা বাধ্যের মতো এসে শুয়ে পড়ে লেপের ভেতর। তার ঠান্ডা পাজোড়া পূর্ণার পায়ে লাগতেই, পূর্ণা হইহই করে উঠে, ‘ও মাগো কী ঠান্ডা! দূরে যা।’
প্রেমা রাগী চোখে তাকাল। পূর্ণা ধমক দিয়ে বলল, ‘কী হইছে? এমনে তাকাস কেন? খেয়ে ফেলবি?’
পূর্ণার সঙ্গে কথা বলে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারতে ইচ্ছে হচ্ছে না প্রেমার। পূর্ণার কথাবার্তাকে পাত্তা দিলে প্রেমার ঘুম নষ্ট হবে, সকালে উঠে নামাজ পড়াও হবে না, বই পড়াও হবে না, এটা ভেবে প্রেমা পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়েও যায়।
পূর্ণা মাথা তুলে দেখে প্রেমা ঘুমাল নাকি। যখন বুঝল ঘুমিয়ে গেছে, তখন লেপ দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিল প্রেমাকে। এরপর জড়িয়ে ধরল। যাতে দ্রুত প্রেমার ঠান্ডা শরীর গরম হয়ে আসে। এই বোনটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। খুব বেশি। শুধু ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে পারে না কেন জানি! প্রেমার ঘুম খুব পাতলা। পূর্ণা তাকে জড়িয়ে ধরতেই তার ঘুম ছুটে যায়। ঠোঁটে ফুটে উঠে মুচকি হাসি। প্রায় এরকম হয়। সে ঘুমালে পূর্ণা তার কপালে চুমু দেয়, চুলে বিলি কেটে দেয়। হাত-পায়ের নখ কেটে দেয়। ভালোবাসার অনেক রূপ হয়! এই দুই বোনের ভালোবাসাটা অন্যরকম। লুকিয়ে একজন আরেকজনকে ভালোবাসে। প্রাণের
প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। দুজনই টের পায়। কিন্ত প্রকাশ্যে সাপে-নেউলে যুদ্ধ চলে!
পূর্ণার কিছুতেই ঘুম আসছে না। হারিকেনের আলো নিভু নিভু। সে উঠে বসে। আবার শুয়ে পড়ে। নিভু নিভু আলোর দিকে চেয়ে মৃদুলের কথা ভাবে। মানুষটার কথা ইদানীং উঠতে বসতে মনে পড়ে তার। কাঁধে আঘাত পাওয়ার পর পূর্ণা দুইদিন ঘর থেকে বের হয়নি। তাই মৃদুল বার বার পূর্ণার ঘরে উঁকি দিত। পদ্মজা সারাক্ষণ থাকত তাই ঢোকার সাহস পায়নি। দুই দিন পর পূর্ণা ছাদে যায়। পিছু পিছু মৃদুলও আসে। পূর্ণার পেছনে দাঁড়িয়ে কাশে। পূর্ণা ফিরে তাকায়। মৃদুলকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখায়। পূর্ণা প্রশ্ন করে, ‘কিছু বলবেন?’
মৃদুল বলল, ‘কেমন আছো? হুনলাম, রাইতে রান্নাঘরে নাকি পইড়া গেছিলা।’
‘হু। ভালো আছি।’
‘তোমার কি ধপাস কইরা পইড়া যাওয়ার ব্যামো আছে?’
পূর্ণা কিছু বলেনি। পদ্মজা নিষেধ করেছে, সেদিনের রাতের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলা যাবে না। মৃদুল দেখল: পূর্ণা কপাল কুঁচকে, কাঁধে হাত বুলাচ্ছে। সে বিচলিত হয়ে জানতে চাইল, ‘বেদনা করে? দায়ের উপর পড়ছো, কত্তটা কাটছে কে জানে! তার ওপরে শীতের দিন এই ঘা সহজে ভালা হইব না। এইখানে তো বাতাস হইতাছে। ঘরে যাও। ঘা বাড়াইও না।’
‘না। এইখানেই থাকব।’
মৃদুল আর জেদ ধরেনি। পূর্ণা যতক্ষণ ছিল, সে-ও ছিল। পরদিন একটু পর পর পূর্ণার খোঁজ নিয়েছে। পূর্ণা খুব সুন্দর একটা অনুভূতির সাক্ষাৎ পেয়েছিল। শুরুতে মৃদুলকে দেখে শুধুই ভালো লাগলেও, আস্তে আস্তে মৃদুলের বিচরণ শুরু হয়েছে তার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। মৃদুলের কথা বলা, দুষ্টুমি, হাসি সব ভালো লাগে। মনের অনুভূতিগুলো হাঁটি হাঁটি পা পা করে গুরুতর সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মৃদুলও যে তার ব্যপারে আগ্রহী, তা পূর্ণা টের পায়। এই বাড়িতে আসার পরদিন মৃদুল আমিরের সঙ্গে দেখা করার অজুহাতে পূর্ণার সঙ্গে দেখা করতে আসে। সবার অগোচরে বলে যায়, তার সঙ্গে পরের দিন দুপুরে উত্তরের ঘাটে দেখা করতে। পূর্ণা বলেছিল যাবে। কিন্তু সে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যায়। তাই আর যাওয়া হয়নি। গতকাল পদ্মজা বের হতেই দিল না।
পূর্ণার মন কেমন কেমন করছে। খুব মনে পড়ছে মৃদুলকে। হারিকেনের আলো নিভে গেল, আর ঠিক তখনই টোকা পড়ল জানালায়। পূর্ণা ভয় পেয়ে গেল। কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। ভূত এলো নাকি! পূর্ণা ধড়ফড়িয়ে বিছানা থেকে নামল। আবারও সেই ডাক ভেসে এলো, কণ্ঠটা পরিচিত পূর্ণা ভ্রুকুঞ্চন করে টিনের দেয়ালে কান পাতে। আবারও ভেসে আসে চেনা স্বর, ‘এই পূর্ণা।’
কণ্ঠটা চেনার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণা জানালা খুলল। দেখা গেল মৃদুলের মুখটা। পূর্ণার বুক ধক করে উঠল। সর্বাঙ্গে একটা উষ্ণ বাতাস ছুঁয়ে যায়। সে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘পাশের ঘরে আপা, ভাইয়া। আপনি ঘাটে যান। আমি আসছি।’
‘আচ্ছা।’
মৃদুল চলে গেলে পূর্ণা তাড়াহুড়ো করে সোয়েটার পরে নিলো। শাল দিয়ে ঢাকল মাথাটা। তারপর হারিকেনে নতুন আগুন জ্বালিয়ে, হারিকেন নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ভালোবাসার কথা বলা হয়নি। কোনো সম্পর্ক নেই দুজনের। তবুও পূর্ণা কোনো এক বশীকরণের জাদুতে ছুটে যাচ্ছে মৃদুলের কাছে। কলপাড় অবধি গিয়ে আবার ছুটে এলো ঘরে। আয়না, কাজল বের করে কাজল দিলো চোখে; তারপর বেরিয়ে পড়ল। ব্যস্ত পায়ে চলে এলো ঘাটে। চারিদিকে জোনাকিপোকা, জ্বলজ্বল করে জ্বলছে; একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে মৃদুল। পূর্ণার হাঁটার গতি কমে গেল, সে অকারণে লজ্জা পাচ্ছে। এগিয়ে এলো মৃদুল, তার গলায় মাফলার; মাথায় টুপি আর পরনে সোয়েটার। শীতল জলোবাতাসে শীত আরো বেশি জেঁকে ধরছে। পূর্ণা মৃদুলের দিকে না তাকিয়ে, বিনিদ্র আরক্ত চোখে হারিকেনের মৃদু আলোয় নদীর অশান্ত জলরাশির দিকে চেয়ে বলল, ‘কেন ডেকেছেন?’
‘কেমন আছো?’
পুরুষালি ভরাট কণ্ঠটি কাঁপিয়ে তুলল পূর্ণাকে। অন্য কখনও তো এমন হয় না। এখন এরকম হওয়ার কারণ কী। রাতের অন্ধকার এবং নির্জনতা?
পূর্ণা বলল, ‘ক্ষতস্থান পেকেছে। তাই একটু যন্ত্রণা হয়। আপনি কেমন আছেন?’
‘ভালো নেই।’ মৃদুলের কণ্ঠটি করুণ শোনায়।
মৃদুলের দিকে চোখ তুলে তাকাল পূর্ণা, চোখাচোখি হলো দুজনের। হারিকেনের আলোয় পূর্ণার কাজল কালো চোখ দুটি তিরের বেগে ঘায়েল করে মৃদুলকে। পূর্ণা সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘কেন?’
‘জানি না।’
‘এত রাতে আসা ঠিক হয়নি।’
‘এত রাইতে আমার ডাকে তুমি কেন সাড়া দিলা?’
‘জানি না।’
দুজনের কেউই কথা খুঁজে পাচ্ছে না। দুজনের কেউই জানে না তারা কেন দেখা করেছে। মৃদুল জানে না সে কেন এত রাতে, তীব্র শীতে এখানে ছুটে এসেছে। পূর্ণা জানে না সে কেন পরপুরুষের ডাকে সাড়া দিল। শুধু এইটুকু জানে, তাদের অশান্ত মন শান্ত হয়েছে। খালি খালি জায়গাটা পূর্ণ হয়েছে। হৃৎস্পন্দন ছন্দ তুলে নৃত্য করছে। পূর্ণার কাঁধের ব্যথা বাড়ছে, তাই বেঁকে গেল তার ভ্রু দুটি। কাঁধে এক হাত রাখল সে। মৃদুল ব্যথিত স্বরে জানতে চাইল, ‘আবার বেদনা করে? দেখি কেমনে কী হইছে।’
মৃদুল দুই পা এগিয়ে আসতেই, পিছিয়ে গেল পূর্ণা। লাজুক ভঙ্গিতে বলল, ‘অবিবাহিত মেয়ের কাঁধ দেখতে চাওয়া অন্যায়।’
‘সে তো দেখা করাও অন্যায়। সব অন্যায় কী মানা যায়?’
‘অনেকে তো মানে।’
‘আমি পারি না।’
‘আপনি অন্যরকম।’
‘ব্যথা কমেছে?’
‘হু, হুট করে ব্যথা বেড়ে যায়। আবার সঙ্গে সঙ্গে কমেও যায়।’
‘পাকলে এরকম হয়।’
‘হু।’
‘ভয় হচ্ছে না?’
পূর্ণা কেমন করে যেন মৃদুলের দিকে তাকাল। মৃদুল থমকে যায়। পূর্ণা বলল, ‘কার ভয়? আপনার?’
‘আমার আর সমাজ—দুইটারই।’
‘আপনাকে ভয় পেলে আসতাম না। আর সমাজের ভয় অনেক আগেই কেটে গেছে।’
উত্তরে বলার মতো কিছু পেল না মৃদুল। ঝিঁঝিপোকারা ডাকছে। আলো দিচ্ছে। কী সুন্দর দেখাচ্ছে। তার মাঝে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী দাঁড়িয়ে আছে বুকে ভালোবাসার উথালপাতাল ঢেউ নিয়ে। অনেকক্ষণ পর মৃদুল বলল, ‘আমি আসতে চাইনি।’
পূর্ণা আবারও সেই মন কেমন করা দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। বলল, ‘তাহলে কেন এসেছেন?’
‘মনে হইতাছে কোনো বশীকরণ তাবিজের জোরে এখানে আইসা পড়ছি।’
পূর্ণা হেসে ফেলল। হারিকেনের মায়াবী আলোয় সে হাসি কী যে ভালো দেখাচ্ছিল। তার প্রশংসা করার মতো যোগ্য শব্দ মৃদুলের ভাষার ভাণ্ডারে মজুদ নেই। সে গাঢ় স্বরে বলল, ‘পিরিতির মায়া বড়ো জ্বালা।’
কপাল ঈষৎ কুঁচকে পূর্ণা প্রশ্ন করল, ‘কার পিরিতের দহনে জ্বলছেন?’
‘তোমারে কইতে হইব?’
‘না।’
‘ঘরে যাও।’
পূর্ণা তার মুখের ধারে হারিকেন ধরে মৃদুলের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি কাজল দিয়েছি।’
পূর্ণা ভেবেছে তার কাজল কালো চোখ মৃদুল দেখেনি। মৃদুল তো শুরুতে দেখেই ঘায়েল হয়েছে। সে হেসে পূর্ণার চোখ, মুখ আবার দেখল। হারিকেনের হলদে আলোয় পূর্ণার তেলতেলে ত্বক চিকচিক করছে। মৃদুল বলল, ‘দেখেছি। ভালো লাগছে।’
মৃদুলের এইটুকু প্রশংসায় পূর্ণার মন নেচে উঠল। সে ঠোঁটে হাসি রেখে বলল, ‘সাবধানে বাড়ি যাবেন।’
৫৮
সুষ্ঠুভাবে হেমলতার মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদ সম্পন্ন হলো। বিকেলে মোড়ল পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে আটপাড়ার মসজিদের সামনে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে বৃদ্ধা মনজুরা আর হিমেলও আছে। মসজিদের কবরস্থানে পাশাপাশি শুয়ে আছেন মোর্শেদ, হেমলতা ও পারিজা। কবরের কাছে আসা নিষেধ বলে মেয়েরা দূর থেকে দুই চোখ ভরে তিনটি কবর দেখছে এবং চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। মৃত্যুর এতগুলি বছর পেরিয়ে গেছে, তবুও কবরের সামনে এসে দাঁড়ালে বুকে এত কষ্ট হয়!
কাছের মানুষের মৃত্যু হচ্ছে ভয়ানক বিষের নাম। এই বিষ যারা পান করেছে তারাই জানে কষ্টের মাত্রা কতটুকু। পূর্ণা ছিঁচকাঁদুনে। সে চোখের জলে স্নান করছে। পদ্মজা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে কবরগুলোর দিকে মা নামক মমতাময়ী মানুষটার ছায়ার অভাববোধ প্রতিটি পদক্ষেপে সহ্য করতে হয়। কত ভালোবাসতেন তিনি। মাথার উপর তার ছায়া ছাড়া নিশ্বাস নেওয়া দায় ছিল। আর আজ এত বছর ধরে পদ্মজা দিব্যি এই মানুষটাকে ছাড়াই বেঁচে আছে। জন্মদাতা পিতা ছোটো থেকে অনেক লাঞ্ছনা-বঞ্চনা করেছেন। কত আকুল হয়ে থাকত পদ্মজা, পিতার ভালোবাসা পেতে। যখন ভালোবাসা পেল, বেশিদিন পৃথিবীতে রইলেন না। মা মরা মেয়েদের রেখে নিজেও পাড়ি জমালেন ওপারে।
তারপর পদ্মজার কোল আলো করে এলো কন্যা পারিজা। পিতা-মাতার মৃত্যুর শোক কিছুটা হলেও লাঘব হয়। কিন্তু এই সুখও বেশিদিন টিকেনি। খুব কম আয়ুকাল নিয়েই জন্মেছিল পারিজা। পদ্মজাকে আঁধারের গহিনে ছুঁড়ে ফেলে এক এক করে চলে যায় সুখতারারা। পদ্মজা বেশিক্ষণ দীর্ঘশ্বাসের ঘূর্ণি বুকের ভেতর চেপে রাখতে পারল না। মুখ এক হাতে চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। বাসন্তী পদ্মজার মাথাটা পরম যত্নে নিজের কাঁধে রাখেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘কেঁদো না, মা। একদিন দেখা হবে। হাশরের ময়দানে।’
সময় তার নিজের গতিতে চলে, কারো জন্য থেমে থাকে না। কেটে যায় আরো তিনটে দিন। এর মাঝে পূর্ণা মৃদুলের সঙ্গে শুটিং দেখতে গিয়েছে একবার। গ্রামের পথে দুজন হেসেখেলে কথা বলেছে। এতেই কানাঘুষা শুরু হয়েছে। এদিকে আমিরের ভীষণ জ্বর। শুকিয়ে গেছে অনেক। ভেতরে ভেতরে কী যেন ভাবে সারাক্ষণ। খাওয়া-দাওয়াও কমে গেছে। সবসময় চিন্তিত থাকে। বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকে না। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। এখন শুয়ে আছে বারান্দার ঘরে। পদ্মজা কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। আমিরের চোখ দুটি বন্ধ। পদ্মজা আদুরে গলায় ডাকল, ‘শুনছেন?’
আমির চোখ বন্ধ রেখেই বলল, ‘হু?’
‘কী এত ভাবেন?’
আমির চোখ খুলে পদ্মজার দিকে তাকাল। তার চোখ দুটি ভয়ংকর লাল। রাতে না ঘুমানোর ফল। সে পদ্মজাকে পালটা প্রশ্ন করল, ‘কী ভাবব?’
‘জানি না। কিছু তো ভাবেনই। চোখ দুটি তার প্রমাণ। আপনি কোনো কিছু নিয়ে কি ভয় পাচ্ছেন?’
আমির বড়ো করে নিশ্বাস ছাড়ল। বলল, ‘তেমন কিছু না।’
‘যেমন কিছুই হউক। বলুন না আমাকে।’
‘আমাদের ঢাকা ফেরা উচিত।’
‘হঠাৎ’
‘জানি না কিছু। আমার প্রায় মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে আজেবাজে স্বপ্ন দেখে। তোমাকে হারাতে পারব না আমি।’
‘আমার কিছু হবে না। আমি কারো কোনো ক্ষতি করিনি যে—’ পদ্মজা থেমে গেল। সে তো একজনকে খুন করেছে! পদ্মজার দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে পড়ে। আমির পদ্মজার দিকে চেয়ে বলল, ‘তুমি কী করে কাউকে খুন করতে পারলে! আমি ভাবতেই পারি না। এরপর থেকেই ভয়টা বেড়ে গেছে। আমার খুব চিন্তা হয়। ঘুম হয় না। রাত জেগে পাহারা দেই যাতে কেউ আমার পদ্মবতীকে ছুঁতে না পারে।’
পদ্মজার দুই চোখ জলে ভরে উঠে। বলল, ‘প্রথম তো বিশ্বাস করেননি, এটাই ভালো ছিল। এখন তো বিশ্বাস করে চিন্তায় পড়ে গেছেন। আর অসুস্থ হয়েও পড়েছেন।’
‘আমি ভেবেছিলাম স্বপ্ন দেখেছো। তাই ঘুম থেকে উঠে আবোলতাবোল বলছো। তারপর সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবেও যখন বললে, অবিশ্বাস কী করে করি?’
‘এত ভালোবাসতে নেই। আমার কপালে সয় না।’
‘ভালোবাসতে না করছো?’
‘মোটেও না। মাত্রা কমাতে বলছি।’
পাশেই অজয়বাবুর আম বাগান। শোঁ শোঁ করে শীতল হাওয়া বইছে। পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে। পূর্ণা মৃদুলের চেয়ে পাঁচ-ছয় হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মস্তক নত। ওড়না বেসামাল হয়ে উড়ছে। মগাকে দিয়ে পূর্ণাকে ডেকে এনেছে মৃদুল। আসার পর থেকেই ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ণা। দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। মৃদুল নীরবতা ভেঙে বলল, ‘আমি আগামীকাল বাড়িত যাইতেছি।’
পূর্ণা চকিতে তাকাল। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কেন?’
মৃদুল মুচকি হেসে বলল, ‘নিজের বাড়িত কেন যায় মানুষ? এইহানে তো বেড়াইতে আইছিলাম।’
‘ওহ।’
পূর্ণা মৃদুলের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টিপাত করে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কান্না পাচ্ছে তার। মৃদুল এক ধ্যানে পূর্ণার দিকে চেয়ে থাকল। বলল, ‘অন্যদিকে চাইয়া রইছো কেন? এদিকে চাও।’
পূর্ণা বাধ্যের মতো মৃদুলের কথা শোনে। তার দুইচোখে জল টলমল করছে। পূর্ণার মেঘাচ্ছন্ন দুটি চোখ দেখে মৃদুলের ভীষণ কষ্ট হয়। সে কেমন একটা ঘোর নিয়ে জানতে চাইল, ‘চলে যাব শুইনা কষ্ট হইতাছে?’
পূর্ণা আবারও দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। অভিমানী স্বরে বলল, ‘মোটেও না। চলে যান।’
‘দুইদিন পরই আসতাছি।’
পূর্ণার চোখেমুখে হাসির ছটা খেলে যায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দুই কদম এগিয়ে এসে বলল, ‘সত্যি?’
‘সত্যি। এবার হাত ধরি?’
মৃদুলের বেশরম আবদারে পূর্ণা লজ্জা পেল। সে দুই কদম পিছিয়ে যায়। দুই হাত পেছনে লুকিয়ে ঠোঁটে হাসি রেখে বলল, ‘বাড়ি থেকে আসার পর।’
পূর্ণা দৌড়ে পালায়। মৃদুল পেছনে ডাকল, ‘এই কই যাও?’
চঞ্চল পূর্ণা না থেমে ফিরে তাকাল। তার লম্বা কেশ হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে উড়ছে। সে মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল, ‘বাড়ি যাই। আপনি সাবধানে যাবেন। জলদি ফিরবেন।’
মৃদুল তার গোলাপি ঠোঁট দাঁত দিয়ে চেপে ধরে হেসে মাথা চুলকাল। কী অপূর্ব দেখাচ্ছে গ্রামের চঞ্চল শ্যামবর্ণের মেয়েটিকে। হাওয়ার তালে মেঠো পথ ধরে ছুটে যাচ্ছে বাড়ির দিকে। চুল আর ওড়না দুটোই হাওয়ার ছন্দে সুর তুলে যেন উড়ছে।
.
সকাল সকাল মগা এসে খবর দিল, রানি মদনের মাথায় আঘাত করেছে। মদন এখন হাসপাতালে ভর্তি। খলিল হাওলাদার রানিকে মেরে আধমরা করে একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছেন। এ কথা শুনে পদ্মজা অস্থির হয়ে পড়ে। খলিল হাওলাদার এতই জঘন্য যে পদ্মজার মনে হয় এই মানুষটা নিজের মেয়েকে যেকোনো মুহূর্তে খুন করে ফেলতে পারে। পদ্মজা আমিরকে চাপ দেয় ওই বাড়িতে নিয়ে যেতে। নয়তো সে একাই চলে যাবে। একপ্রকার জোর করেই আমিরকে নিয়ে আসে হাওলাদার বাড়িতে। হাওলাদার বাড়ির পরিবেশ থমথমে, নির্জন। সবসময়ই এমন থাকে। এ আর নতুন কী! অন্দরমহলে ঢুকতেই আমিনা আমিরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কাকুতি-মিনতি করে বলল, ‘বাপ, আমার মেয়েরে আমার কাছে আইন্যা দেও। নাইলে ওর কাছে আমারে লইয়া যাও। তোমার দুইডা পায়ে ধরি।’
আমির আমিনাকে মেঝে থেকে তুলে আশ্বাস দেয়, ‘আমি দেখছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
খলিলের ঘরের দিকে গেল আমির। ফরিনা এসে বিস্তারিত বললেন, রাইতের বেলা মদনের চিল্লানি হুনি। দৌড়ে সবাই আইয়া দেহি মদন পইড়া আছে। মাথা দিয়া কী যে রক্ত বাইর হইতাছে! আর রানির হাতে এত্ত বড়ো একটা ইট। ছেড়িডারে দেইখা মনে হইতাছিল ওর উপরে জিনে আছর করছে। আরেকটু অইলে এতিম ছেড়াডা মইরা যাইত। বাবুর বাপ আর রিদওয়ান মিইল্যা তাড়াতাড়ি হাসপাতাল লইয়া গেছে। আর এইহানে তোমার চাচা শ্বশুরে রানিরে মাইরা ভর্তা কইরা লাইছে। নাক মুখ দিয়া রক্ত ছুটছে। তবুও থামে নাই। আমরা অনেক চেষ্টা করছিলাম বাঁচাইতে, পারি নাই। আলোডা কী যে কান্দা কানছে! এহন ঘুমাইতাছে।’
আমির চাবি নিয়ে আসে। আমিনা সঙ্গে যেতে চাইলে আমির বলল, ‘আমি আর পদ্ম যাচ্ছি। রানিকে নিচে নিয়ে আসি। পদ্ম, আসো।’
পদ্মজা ছুটে গেল আমিরের পিছু পিছু। ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই রানি তাকাল। রুম্পা যে ঘরে ছিল সেই ঘরেই তাকে রাখা হয়েছে। রানি কাঁদছিল। দরজা খোলার শব্দ শুনে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে চোখমুখের রক্ত শুকিয়ে গেছে। আমির, পদ্মজাকে দেখে রানি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কাউকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে নিজের জীবন নিয়ে সুখী না। পৃথিবীর সব কষ্ট যেন তার বুকে। এসব মারধোর আর গায়ে লাগে না। বাপের কথায় বাড়ির কামলা বিয়ে করল। এটা তার জন্য কতটা অপমানের কেউ বুঝবে না। সে শুধু মানুষ ভেবেই বাড়ির কামলাকে স্বামী মানতে পারেনি। এতটা উদার সে নয়। সে মানে, সে ভালো না। বাপের জোরাজুরিতে নাতনিও দিল। তারপর থেকেই মদন পেয়ে বসে। কারণে- অকারণে তাকে ছুঁতে চায়। মদনের একেকটা ছোঁয়া রানির জন্য কতটা বেদনাদায়ক তাও কেউ জানবে না। গতকাল রাতে মদন জোর-জবরদস্তি করেছিল, তাই রানি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। খালি ড্রামের নিচে থাকা ইট নিয়ে চোখ বন্ধ করে মদনের মাথায় আঘাত করে। এতে সে মোটেও অনুতপ্ত নয়।
পদ্মজা রানির মনের অবস্থা একটু হলেও বুঝতে পারছে। মেয়েটা হাসিখুশি থাকার জন্য বাচ্চাদের সঙ্গে কাবাডি, গোল্লাছুট, কানামাছি কত কী খেলে! তবুও সুখী হতে পারে না। পদ্মজা সাবধানে রানির পাশে এসে বসল। বলল, ‘খুব মেরেছে?’
রানি পদ্মজার দিকে তাকিয়ে তীব্র কটাক্ষ করে বলল, ‘তুমি জাইন্যা কী করবা? মলম লাগাইয়া দেওন ছাড়া আর কী করনের আছে?’
আমির কিছু বলতে চাইলেও, পদ্মজা থামিয়ে দিল। সে চমৎকার করে হেসে রানিকে বলল, ‘মলম লাগানোর মানুষই বা কয়জনের ভাগ্যে জোটে, আপা?’
রানির দৃষ্টি শীতল হয়ে এলো। এই মেয়েটার সঙ্গে রাগ দেখানো যায় না। পদ্মজার মাঝে অদ্ভুত কিছু আছে, যা রাগ দমন করতে পারে। রানি বলল, ‘আমি…আমি ভালা নাই, পদ্মজা। আমি একটু আরাম চাই। সুখ চাই। আর কষ্টের বোঝা টানতে পারতাছি না।’
রানির কথার ধরন এলোমেলো। সে অন্য এক জগতে আছে। বন্দি পাখির মতো ছটফট করছে। মুক্তির আশায় ডানা ঝাঁপটাচ্ছে। পদ্মজার খুব মায়া হলো, ভীষণ অসহায় লাগল নিজেকে। ভালোবাসার মানুষ জীবনে এসে আবার হারিয়ে গিয়ে এভাবেই জীবন এলোমেলো করে দেয়। এত যাতনা কেন প্রেমে
যার শূন্যতা আজও শান্তি দিল না রানিকে। প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। রানির ভেতরটা যে একেবারে শূন্য। সে পিরিতের যন্ত্রণায় আজও কাতর! যদি রানিকে তার উপযুক্ত কোনো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেয়া হতো তবে কী সে তার ভালোবাসাকে ভুলতে পেরে একটু সুখী হতে পারত?
আমির আর পদ্মজা মিলে ধরে ধরে রানিকে নিচ তলায় নিয়ে আসে। সবার এত্ত প্রশ্ন…তবে রানি নিশ্চুপ। কারোর কোনো কথার উত্তর দিল না। সবাই যত্ন আত্তি করল। আমিনা খাইয়ে দেন। পুরো দিন রানি বিছানায় শুয়ে থাকে। আমিনা সারাদিন চেষ্টা করেছেন রানি যাতে কথা বলে। কিন্তু সে পণ করেছে কথা না বলার। অন্যদিকে মদন ভালো আছে। কয়দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে। সেলাই লেগেছে কয়টা। গঞ্জের হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল, এরপর সেখান থেকে শহরে। এ খবর ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে। রানিকে সবাই অনেক খারাপ কথা বলছে, অভিশাপ দিচ্ছে। অনেকে বাড়ি বয়ে এসে কটু কথা বলে গেছে। কেউ নিষেধ করেনি। রানি চুপ করে শুনেছে। বাড়ির অবস্থার কথা ভেবে আমির আর মোড়ল বাড়িতে ফেরার কথা বলেনি।
দিনশেষে রাত আসে। সুন্দর পৃথিবীকে জাপটে ধরে ঘোর অন্ধকার। সেই অন্ধকারে হারিয়ে যায় রানি। সকালে চিঠি পাওয়া যায় তার। তাতে লেখা:
আমার আলোরে দেইখা রাইখো তোমরা।
৫৯
ঘন কুয়াশা বেয়ে শীতের বিকেল নেমেছে ধীরে ধীরে। পদ্মজা আলোকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দুই তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের দৃষ্টি বাড়ির গেটের দিকে। বাড়ির সব পুরুষ সকালে বেরিয়েছে রানির খোঁজে। এখনও ফেরেনি। যে নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে যায়, তাকে কী আর খুঁজে পাওয়া যায়? তবুও পদ্মজা চাইছে রানিকে যেন অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়া যায়। আলো সারাদিন মায়ের জন্য কেঁদেছে। মায়ের আদরের জন্য ছটফট করেছে। আলোর অস্থিরতা দেখে কেঁপেছে পদ্মজার দুই ঠোঁটও, জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছে মায়ের মতো আদর করার। কিন্তু সে তো আলোর মা নয়, মায়ের গন্ধ তার গায়ে নেই। রানি মা হয়ে কী করে পারল আলোকে ছেড়ে যেতে? পৃথিবীর সব মা একরকম হয় না। সব মা সন্তানের জন্য ত্যাগ করতে জানে না। দুঃখ আপন করে নিতে জানে না। পদ্মজা আলোর কপালে চুমু দিল। মেয়েটা চুপ করে আছে। চারিদিক কুয়াশায় ধোঁয়া ধোঁয়া। দিন ডুবিডুবি। স্তব্ধ হয়ে আছে সময়। একতলা থেকে শোনা যাচ্ছে আমিনার বিলাপ। তিনি এত কাঁদতে পারেন! পদ্মজা ঘুরে দাঁড়াল ঘরে যেতে। তখনই সামনে পড়লেন ফরিনা। পদ্মজা হাসার চেষ্টা করে বলল, আম্মা, আপনি!’
‘আলো ঘুমাইছে?’
‘না, জেগে আছে।’ পদ্মজা আলোর কপালে আবার চুমু দিল।
ফরিনা বললেন, ‘রানিরে কি পাওন যাইব?’
‘জানি না আম্মা।’ পদ্মজার নির্বিকার স্বর।
‘আলমগীর রুম্পারে লইয়া কই গেছে জানো তুমি? ওরা ভালো আছে তো?’
‘আপনাকে সেদিনই বলেছি আম্মা, জানি না আমি।’
ফরিনা আর প্রশ্ন করলেন না। তিনি নারিকেল গাছের দিকে চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। পদ্মজা সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে ফরিনাকে দেখল। ফরিনা আগের মতো ছটফটে নেই। নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। আগে মনে হতো তিনি মনে মনে কোনো কঠিন কষ্ট পুঁতে রেখেছেন; কিন্তু এমন কোনো শক্তি আছে যার জন্য তিনি হাসতে পারেন, বেঁচে আছেন। আর এখন দেখে মনে হচ্ছে, সেই শক্তিটা নষ্ট হয়ে গেছে! জীবনের আশার আলো ডুবে গেছে। কথাগুলো ভেবে পদ্মজা চমকে উঠে! সে তো আনমনে নিজের অজান্তে এসব ভেবেছে! কিন্তু সত্যিই কি এমন কিছু হয়েছে? পদ্মজা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আম্মা, আপনি আমাকে কিছু বলতে চান?’
ফরিনা তাকান। পদ্মজা তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে রইল ফরিনার দিকে। ফরিনা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। হঠাৎ যেন পাহাড়ের শক্ত মাটির দেয়াল ভেঙে ঝরনাধারার বাঁধ ভেঙে গেল। পদ্মজা খুব অবাক হলো। ফরিনা আঁচলে মুখ চেপে ধরলেন। উৎকণ্ঠার সঙ্গে জানতে চাইল পদ্মজা, ‘আম্মা, আম্মা আপনি কাঁদছেন কেন? কী হয়েছে? বলুন আমাকে। কী বলতে চান আপনি?
আচমকা ফরিনার কান্নার শব্দে আলো ভয় পেয়ে যায়। সে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। পদ্মজা আলোকে শান্ত করার চেষ্টা করে। বারান্দায় পায়চারি করে আদুরে কণ্ঠে বলল, ‘মা, কাঁদে না, কাঁদে না। কিছু হয়নি তো। মামি আছি তো।’
আলো জান ছেড়ে কাঁদছে, কান্না থামাচ্ছে না। বেশ অনেক্ষণ পর আলো কান্না থামায়। সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজা ফরিনার দিকে এগিয়ে এলো। প্রশ্ন করল, ‘বলুন আম্মা। কী বলতে চান আমাকে?’
‘কিছু না।’ বলেই তড়িঘড়ি করে দোতলা থেকে নেমে যান তিনি। পদ্মজা আশাহত হয়ে অনেকবার ডাকলেও তিনি শোনেননি। পদ্মজা বিরক্তি নিয়ে বাইরে তাকাল। দেখতে পেল মজিদ হাওলাদারকে। তিনি আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে আসছেন। হাঁটছেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। পায়ে ব্যথা পেয়েছেন নাকি! পদ্মজা নিচ তলায় যেতে উদ্যত হলো। তখনই মাথায় এলোঃ কোনোভাবে কী আব্বাকে দেখে আম্মা ভয় পেলেন? আর উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন?
নিশ্চয়ই এমনটা হয়েছে! ঘরের গোপন খবরই দিতে চেয়েছিলেন ফরিনা। কিন্তু ঘরের মানুষ দেখে আর দিতে পারলেন না। আচ্ছা, তিনি এমন হাউমাউ করে কেন কাঁদলেন? পদ্মজার কপালের চামড়া কুঁচকে গেল।
মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল সে। আলোর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবতে লাগল পেছনের সব অদ্ভুত ঘটনা নিয়ে। রুম্পা পাগলের অভিনয় করত, তাকে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছিল অথচ বাড়ির কারও তা নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। রুম্পা দিনের পর দিন না খেয়ে ছিল। পদ্মজা যতটুকু বুঝেছে ফরিনা খুব ভালোবাসেন রুম্পাকে, তাহলে তিনি কেন খাবার নিয়ে যেতেন না? রুম্পার ঘরে লতিফা নজর রাখত। রুম্পা লতিফাকে দেখে ভয় পেয়েছিল। যেদিনই সে জানতে পারে রুম্পা পাগল না, সেদিন রাতেই বাবলু নামের কালো লোকটি রুম্পাকে মারতে চেয়েছিল। এতসব কার নির্দেশে হচ্ছে? কে এই বাড়ির আদেশদাতা? আর আলমগীরই কী করে জানল রুম্পা খুন হতে চলেছে? তারপর একটা খুন হলো, অথচ ভোর হওয়ার আগেই সেই লাশ উধাও হয়ে গেল। কেউ খুনির খোঁজ করল না! রুম্পা বা আলমগীরের কথা রানি আর ফরিনা ছাড়া কেউ জিজ্ঞাসাও করল না! এই বাড়ির মানুষ জীবিত থেকেও মৃত। কী চলছে আড়ালে! আলমগীর তাকে একটা চাবি দিয়েছিল।
চাবিটা কীসের? রুম্পা বলেছিল: পেছনে…উত্তরে…ধ রক্ত। এই কথার মানেই বা কী?
পদ্মজা দ্রুত দুই চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার মাথাব্যথা করছে। দপদপ করছে কপালের রগগুলো। রানির নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। গাঢ় রহস্যের টানে উন্মাদ হয়ে উঠল সে। বাড়িতে খলিল, রিদওয়ান নেই। এই সুযোগে জঙ্গলে তাকে যেতেই হবে।
পরিবেশে অস্পষ্টতা ক্রমে ছড়িয়ে পড়েছে। সন্ধ্যাকে ম্লান আলোয় জড়িয়ে ধরল বিকেল। আজান পড়ছে। পদ্মজা নিচ তলায় এসে আলোকে লতিফার কাছে দিয়ে নিজ ঘরে গিয়ে নামাজ আদায় করে নিলো। তারপর খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল আলোকে। মজিদ পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। তিনি ঘরে শুয়ে আছেন। ফরিনাও ঘরে। বাড়ির বাকি পুরুষরা তখনো ফিরেনি। আমিনা সদর দরজায় বসে আছেন। চুল এলোমেলো। কপালে এক হাত রেখে বাইরে তাকিয়ে রানির অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন। মানুষটার অনেক দোষত্রুটি আছে ঠিক। তবে মেয়ের জন্য পাগল! বাড়ির আরেক কাজের মেয়ে রিনু আলোর সঙ্গে শুয়ে আছে। আলো একা ঘরে কীভাবে থাকবে, তাই পদ্মজাই রিনুকে আলোর সঙ্গে থাকতে বলেছে। লতিফা রান্নাঘরে রান্না করছে। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। মানবতাবোধ থেকেও অন্তত রানির নিখোঁজ হবার শোকে কাতর হওয়া উচিত। কিন্তু পদ্মজা কাতর হতে পারছে না। তাকে চুম্বকের মতো কিছু টানছে উলটোদিক থেকে। পদ্মজা শক্ত করে খোঁপা বাঁধে। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে গায়ে জড়িয়ে নেয় শাল। হাতে নেয় টর্চ আর ছুরি। তারপর অন্দরমহলের দ্বিতীয় দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। এক নিশ্বাসে ছুটে আসে জঙ্গলের সামনে। হাঁপাতে থাকে। চোখের সামনে ঘন জঙ্গল। পেছনে কয়েক হাত দূরে অন্দরমহল। হাড় হিম করা ঠান্ডা। পদ্মজার ঠোঁট কাঁপতে থাকে।
এই জায়গায় সে বহুবার এসেছে, কখনোই জঙ্গলের ভেতর পা রাখতে পারেনি। কেউ না কেউ…অথবা কোনো না কোনো ঘটনা তাকে বাগড়া দিয়েছেই। আজ কিছুতেই সে পিছিয়ে যাবে না। তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে আছে। জঙ্গলের ঘাসে পা রাখতেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে পড়ে। আরো কয়েক পা এগোতেই গা হিম করা অদ্ভুত সরসর শব্দ ভেসে আসে।
পদ্মজার একটু ভয় ভয় করছে। গাঢ় অন্ধকারে এমন এক গভীর জঙ্গলে সে একা! শীতের বাতাসে গাছের পাতাগুলো শব্দ তুলছে আর পদ্মজা উৎকর্ণ হয়ে উঠছে। ভয়-ভীতি নিয়েই সে সামনে এগোতে থাকে। চারিদিকে ঘাস, সরু একটা পথ বাদে। হয়তো এই পথ দিয়ে মানুষ চলাচল করে। পদ্মজা সেই পথ ধরে এগোতে থাকে। সে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশ দেখছে। বড়ো বড়ো গাছ দেখে মনে হচ্ছে কোনো অশরীরী দাঁড়িয়ে আছে! পদ্মজা মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দেয়।
একটা সময় ফুরিয়ে গেল সেই পথ। পদ্মজা টর্চের আলোতে নতুন পথ খুঁজতে থাকে, যেদিকেই তাকায় সেদিকেই বুনো লতাপাতা। যারা এদিকে আসে তারা কী এখানেই থেমে যায়? পদ্মজা ভেবে কুল পায় না। মাথার ওপর ডানা ঝাপটানোর শব্দ শোনা যেতেই ধক করে উঠল পদ্মজার বুক। সে টর্চ ধরল মাথার ওপর। দুটো পাখি উড়ে গেল ঠিক সেই মুহূর্তেই, চোখের সামনে ভেসে উঠল চন্দ্র তারকাহীন ম্লান আকাশ। পদ্মজা লম্বা করে নিশ্বাস নিলো। কী না কী ভেবেছিল! সে সূক্ষ্ম-তীক্ষ্ণ চোখে দেখল চারপাশ। রুম্পা কী বলেছিল মনে পড়তেই সে উত্তরে তাকাল। বেশিদূর দৃষ্টি গেল না। ঝোপঝাড়ে ঢাকা চারপাশ। পদ্মজা মুখে অস্ফুট বিরক্তিকর শব্দ করল।
নিজে নিজে বিড়বিড় করে, ‘কোনদিকে যাব এবার?
ছটফট করার কারণে হাত থেকে ছুরি পড়ে গেল, সামনে ঝুঁকে ছুরি তুলতে গেলে সেই সঙ্গে ঘাস উঠে আসে হাতে। পদ্মজা অবাক হলো। এই বুনো ঘাসের শেকড় কি মাটির নিচে ছিল না? পদ্মজা উত্তর দিকের আরো কতগুলো ঘাস এক হাতে তোলার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে হাতে উঠে এলো ওগুলো। সত্যি মাটির নিচে শেকড় নেই! কে বা কারা পথের চিহ্ন আড়াল করতে নতুন তাজা ঘাস দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে পথ। পথ লুকোতে প্রায়ই এমন করা হয়? তাহলে তো বেশ পরিশ্রম করে! পদ্মজার উত্তেজনা বেড়ে গেল। সে উত্তর দিকের পথ ধরে এগোতে থাকে, থামল প্রায় দশ মিনিটের মতো হাঁটার পর।
এই মুহূর্তে সে চলে এসেছে জঙ্গলের ঠিক মধ্যখানে।
সামনে ঘন ঝোপঝাড়। পরিত্যক্ত ভাব চারিদিকে। ভূতুড়ে পরিবেশ থেকে থেকে পেঁচা ডাকছে কাছে কোথাও। পদ্মজা বিপদ মাথায় নিয়ে ঝোপঝাড় দুই হাতে সরিয়ে অজানা গন্তব্যে হাঁটতে থাকে। কাঁটা লাগে মুখে। চামড়া ছিঁড়ে যায়। পদ্মজা ব্যথায় ‘মা’ বলে আর্তনাদ করে উঠল ব্যথাকে পাত্তা না দিয়ে এগোতে থাকে সে। ঝোপঝাড় ছেড়ে বড়ো বড়ো গাছপালার মাঝে আসতেই পদ্মজার মনে হলো: তার পেছনে কেউ আছে! চট করে ঘুরে দাঁড়াল। কেউ নেই! মনের ভুল ভেবে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে পদ্মজা। আবার মনে হয়, পেছনে কেউ আছে। পদ্মজা থমকে ঘুরে তাকাল। তার মনটা আনচান করছে, কু গাইছে। কেমন যেন ভয়ও করছে। এই গভীর জঙ্গলে সে একা।
কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা হলো। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে গভীর রাত। কোনো অঘটন ঘটে গেলে কেউ জানবে না। পদ্মজার রগে রগে শিরশিরে অনুভব হয়। ভয়টা বেড়ে গেছে। ভেঙে পড়ছে সে! রাতের অন্ধকার তার শক্তি, সাহসিকতা যেন শুষে নিচ্ছে। পদ্মজা আল্লাহকে স্বরণ করে, স্বরণ করে হেমলতাকে। চোখ বুজে হেমলতার অগ্নিমুখ ভাবে। তিনি যেভাবে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেন সেভাবে পদ্মজা তাকাল। কান খাড়া করে চারপাশে যত জীব, প্রাণী আছে সবকিছুর উপস্থিতি টের পাওয়ার চেষ্টা করে। কাছে কোথাও অদ্ভুত একটা কিছু ডাকছে। নিশাচর পাখিদের তীক্ষ্ণ ডাকও শোনা যাচ্ছে। ঝিঁঝিপোকারা ডাকছে এক স্বরে। বাতাস বইছে শোঁ শোঁ শব্দে। এ সবকিছুকে ছাড়িয়ে একটা মানুষের গাঢ় নিশ্বাস তীক্ষ্ণভাবে কানে ঠেকল। খুব কাছে, পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে! নিশ্বাস নিচ্ছে। পদ্মজার হাত দুটো শক্ত হয়ে যায়। অদ্ভুত এক শক্তিতে কেঁপে উঠে সে। চোখের পলকে দুই পা পিছিয়ে লোকটিকে না দেখেই ছুরি দিয়ে আঘাত করে। লোকটি ‘আহ’ করে উঠে। পদ্মজা চোখ খুলে ভালো করে দেখে, মুখটি অন্ধকারের জন্য অস্পষ্ট তবে কণ্ঠটি পরিচিত মনে হলো। পদ্মজার ছুরির আঘাত লোকটির হাতে লেগেছে। পদ্মজা রাগী কিন্তু কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে, ‘কে আপনি?’
লোকটি ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ছুটে এসে চেপে ধরল পদ্মজার গলা। পদ্মজা আকস্মিক ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। লোকটি এত জোরে গলা চেপে ধরেছে যে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথার ওপর আরো কয়েকটি পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে গেল। একটা বলিষ্ঠ হাত গাঢ় অন্ধকারে অপরূপ সুন্দরী এক মেয়ের গলা টিপে ধরে রেখেছে। সুন্দরী মেয়েটি ছটফট করছে! লোকটির মুখ অন্ধকারে ঢাকা। ভয়ংকর এক দৃশ্য!
পদ্মজা তার হাতের ছুরিটা শক্ত করে ধরে, লোকটির পেটে ক্যাঁচ করে টান দিল। আর্তনাদ করে সরে গেল আক্রমণকারী, মাটিতে বসে পড়ে হাঁটুগেড়ে। পদ্মজা আবারও আঘাত করার জন্য এগোতেই উঠে দাঁড়াল লোকটি, যেন নতুন উদ্যমে শক্তি পেয়েছে। লোকটা ঝাঁপিয়ে পড়ল পদ্মজার ওপর, নখের আঁচড় হাতে বসিয়ে কেড়ে নেয় ছুরি।
পদ্মজা ছুরি ছাড়া এমন হিংস্র পুরুষের শক্তির সামনে কিছু না। যেভাবেই হোক, এর হাত থেকে বাঁচতে হবে। পদ্মজা টর্চ দিয়ে লোকটির মাথায় বাড়ি মারল, টাল সামলাতে না পেরে পিছিয়ে গেল আক্রমণকারী। পদ্মজা উলটোদিকে দৌড়াতে থাকে, পিছু ধাওয়া করে লোকটা। দুইবার ছুরির আঘাত, একবার মাথায় টর্চের বাড়ি খাওয়ার পরও ব্যাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়েনি। নিঃসন্দেহে এই রহস্যের পাক্কা খেলোয়ার সে।
পদ্মজার শাল পড়ে যায় গা থেকে। তার খোঁপা খুলে রাতের মাতাল হাওয়ায় চুল উড়তে থাকে। ঝোপঝাড়ের মাঝে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়াচ্ছে সে। কানে আসছে বাতাসের শব্দ শোঁ, শোঁ, শোঁ! দুই হাতে শাড়ি ধরে রেখেছে গোড়ালির ওপর, যাতে পা বেঁধে পড়ে না যায়। জুতা ছিঁড়ে পড়ে থাকে জঙ্গলে। কাঁটা কাঁটায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পাজোড়া। রক্ত বের হয় গলগল করে। তবুও সে থামল না।
এত সহজে মরবে না…
…এই রহস্যের গোড়ায় পৌঁছতে হলে তাকে বাঁচতেই হবে।