৫০
পড়ন্ত বিকেলের শীতল বাতাসে শরীর কাঁটা দিচ্ছে। পদ্মজা শাল গায়ে জড়িয়ে নিয়ে পা রাখল নিচতলায়, ফরিনার ঘরে। ফরিনা কাঁথা সেলাই করছিলেন। পদ্মজাকে দেখে দুই পা ভাঁজ করে বসে উল্লাস করে বললেন, ‘তুমি আইছো!
পদ্মজা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘জি, আম্মা। কাঁথা সেলাই করছিলেন নাকি। আমি সাহায্য করি?’
‘না, না তুমি এইসব পারবা না। সুঁই লাগব হাতে।’
‘কিছু হবে না, আম্মা। প্রতিদিনই সেলাই করা হয়।’
ফরিনা অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘তুমি কাঁথা সিলাও?’
পদ্মজা হেসে বলল, ‘ওই একটু।’
‘কেরে? আমরা থাকতে তুমি সিলাও কেরে? তোমার সৎ আম্মায় তো নকশিকাঁথা সিলায়। হে থাকতে তোমার সিলাই করা লাগে কেরে?’
পদ্মজা ফরিনার হাত থেকে সুঁই টেনে নিয়ে বলল, ‘আব্বা মারা যাওয়ার পর দুই বছর আমি কেমন অবস্থা ছিলাম জানেনই তো। সে অবস্থায় আমার পক্ষে আমার পরিবারের জন্য কিছু করা সম্ভব ছিল না। তখন উনি পর হয়েও, সৎ মা হয়েও নিজের ঘাড়ে সব দায়িত্ব তুলে নিলেন। কিন্তু যতটুকু করতেন ততটুকুতে পরিবার চলতে গিয়ে হিমশিম খেত। তাই আমিও চেষ্টা করেছি একটু যদি নকশিকাঁথার পরিমাণটা বাড়ানো যায়!’ পদ্মজার ফুলের পাপড়ির মতো ফোলা ফোলা দুটি ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল, সেই হাসিতে পরমা সুন্দরীর মুখমণ্ডল যেন আলোকিত হয়ে উঠল অল্প আভায়। ফরিনা অবাক হয়ে সেই হাসি দেখলেন।
মন দিয়ে কাঁথায় ফুল তুলছে পদ্মজা। দাঁত দিয়ে সুতা কেটে ফরিনার দিকে তাকাল। পদ্মজার নিখুঁত নাক, নিখুঁত চোখ। ফরিনা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজা ডাকল, ‘আম্মা?’
ফরিনার সংবিৎ ফিরতেই প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি নাকি শহরে কাম করো?
পদ্মজা হাসল, ‘হু, করা হয়। প্রেমা-প্রান্ত দুইজনই পড়াশোনা করে। পড়ালেখার কত খরচ! আর পূর্ণা তো পড়ালেখার চেয়ে বেশি খরচ করে ফেলে শাড়ি-অলংকার কিনতে গিয়ে। আম্মা নেই। বাধা দিতে কষ্ট হয়। আর উনি নিজের সব সঞ্চয় উজার করে দেন আমার তিন ভাই-বোনকে। টাকা তো থাকে না। তাই চাকরি নিতে হলো। দুই বোনের বিয়ে দিতে হবে না? আমার তো ফরজ কাজ বাকি। তার জন্য টাকা জমাতে হচ্ছে। আর উনার নকশিকাঁথার টাকার সঙ্গে বেতনের কিছুটা অংশ মিলিয়ে পাঠিয়ে দেই। বেশ ভালোই চলছে। উনি আছেন বলেই আমার মাথার উপরের চাপটা কমেছে।’
‘হ, বাসন্তী অনেক ভালা। আমি হের চেয়ে চার বছরের বড়ো। মেলা সম্মান করে আমারে। আচ্ছা, আমির তোমারে বাইরে কাম করতে দিছে?’
এ প্রশ্নে পদ্মজা কপাল চাপড়ে বলল, ‘আর বলবেন না, আম্মা! কী যে যুদ্ধ করতে হয়েছে। শেষমেশ রাজি হয়েছেন। কিন্তু উনার অফিসে নাকি চাকরি করতে হবে। উনার অফিসে চাকরি নিলে উনি আমাকে কোনো কাজ করতে দিতেন? টাকা ঠিকই মাস শেষে হাতে গুঁজে দিতেন। ঘুরে-ফিরে, স্বামীর টাকায় বাপের বাড়ি খায় কথাটা আত্মসম্মানের সঙ্গে লেগে যেত। এ নিয়ে তিনদিন আমাদের ঝগড়া ছিল। আলাদা থেকেছি, কেউ কারো সঙ্গে কথা বলিনি।’
ফরিনা বেশ আগ্রহ পাচ্ছেন। উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘এরপরে কী হইলো? কাম করতে দিছে কেমনে?’
‘এরপর… তিন দিন পর এসে বলল, চাকরি পেয়েছে একটা। ছয় ঘণ্টা কাজ। হিসাব রক্ষকের পদ। বেতন ভালো। জানেন আম্মা, আমি ভীষণ অবাক হয়েছি! এত কম সময়ের চাকরি, আবার বেতনও তুলনায় বেশি 1 এরপর জানতে পারি উনার পরিচিত একজনের অফিসে চাকরি বন্দোবস্ত করেছেন। উনি চান না আমি বেশি সময় বাইরে থাকি। আবার জেদ ধরেও বসে ছিলাম। এভাবেই সব ঠিক হয়। ইনশাআল্লাহ আম্মা, পূর্ণার বিয়েটা ধুমধামে হয়ে যাবে। প্রেমার তো দেরি আছে। অনেক পড়বে ও।’
ফরিনা পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আল্লাহ হাজার বছর বাঁচায়া রাখুক।’
‘আম্মা, রুম্পা ভাবি কী তিন তলায়?’
‘হ।’
‘আজ দেখতে যাব ভাবছি। চাবি কার কাছে?’
ফরিনা মুখ গুমট করে বললেন, ‘হেই ঘরে যাওনের দরকার নাই। রিদওয়ান চাবি দিব না। ওরা আর আমারারে দাম দেয় না। যেমনে ইচ্ছা চলে।’
‘দিবে না মানে কী? আপনি গুরুজন আপনাকে দিতে বাধ্য।’
‘চাইছিলাম একবার, যা ইচ্ছা কইয়া দিছে।’ ফরিনার মুখে আঁধার নেমে আসে। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ‘চাবি চাওনের লাইগগা রিদওয়ান হের আম্মারেও মারছে।’
পদ্মজার চোখ দুটি বড়ো বড়ো হয়ে যায়, ‘সে কী! মায়ের গায়ে হাত তুলেছে?
ফরিনা কাঁথা সেলাই করতে করতে বললেন, ‘নিজের মা আর কই থাইকা! এই ছেড়ার মাথা খারাপ। অমানুষ।
‘বাড়ির অন্যরা কিছু বলেনি?’
‘অন্যরা কারা?’
‘আব্বা, চাচা, বড়ো ভাই কেউ কিছু বলেনি?’
‘বাকিদের কথা জানি না। তোমার শ্বশুর তো নিজেই শকুনের বাচ্চা।’ পদ্মজা চমকে তাকাল। ফরিনাও চকিতে চোখ তুলে তাকালেন। তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। দুজন দুজনের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। পদ্মজা প্রশ্ন করার আগে ফরিনা বললেন, ‘পূর্ণায় গাছে উঠছে। সকালে আছাড়ড়া খাইল বিকেল অইতেই গাছে উইট্টা গেছে। ছেড়িডারে কয়ডা মাইর দিয়ো।’
পদ্মজা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে তার শাশুড়ি আগের কথাটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। সে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে পারল না। মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘আমি আসি।’
‘যাও।’
পদ্মজা দরজা অবধি এসে ফিরে তাকাল। ফরিনা দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলেন। পদ্মজা ঘর ছাড়তেই তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। পদ্মজা উদাসীন হয়ে হাঁটছে আর ভাবছে: আম্মা কেন নিজের স্বামীকে শকুনের বাচ্চা বললেন?
পদ্মজা সামলে নিলো নিজেকে। এখন এসব ভাবা যাবে না। রিদওয়ানের কাছ থেকে চাবি নিতে হবে। সে রিদওয়ানের ঘরের সামনে এসে দরজায় শব্দ করতেই ওপাশ থেকে পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘কে?’
পদ্মজা জবাব না দিয়ে আরো জোরে শব্দ করল। রিদওয়ান কপাল কুঁচকে দরজা খুলল। পদ্মজাকে দেখে কপালের ভাঁজ মিলিয়ে যায়। ঠোঁটে ফুটে ওঠে হাসি। মোটা হয়েছে আগের চেয়ে। গালভরতি ঘন দাড়ি। এক- দুটো চুল পেকেছে। সে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘আরে বাপরে, পদ্মজা আমার দুয়ারে এসেছে!’
পদ্মজা সোজাসুজি বলল, ‘রুম্পা ভাবির ঘরের চাবি দিন।
রিদওয়ান দরজা ছেড়ে দাঁড়াল, ‘এতদিন পর এসেছো আবার আমার ঘরের সামনে! ভেতরে আসো, বসো। এরপর কথা বলি।’
‘আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসিনি। দয়া করে চাবিটা দিন।’
‘চাবি তো দেব না।’
‘কী সমস্যা?’
রিদওয়ান পদ্মজার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘আরে, ঘরে আসো তো আগে।’
পদ্মজা এক ঝটকায় রিদওয়ানের হাত সরিয়ে দিল। চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল, ‘চাবি দিন।’
‘চোখ দিয়ে তো আগুন ঝরছে। কিন্তু আমি তো ভয় পাচ্ছি না। চাবি আমি দেব না।’
‘দেবেন না?’
রিদওয়ান আড়মোড়া ভেঙে আয়েশি ভঙ্গিতে বলল, ‘না।’
পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। চলে গেল। রিদওয়ান পিছু ডেকেছে। সে শোনেনি। মগাকে দিয়ে পাথর আনিয়ে সোজা চলে গেল তিন তলায়। মদন একটা ঘরের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে ছিল। তাহলে এই ঘরেই রুম্পা আছে। সে দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই মদন বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘কুনু কাম আছিল ভাবি?’
পদ্মজা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘তালা ভাঙব। মগা, তালা ভাঙ।’
মদন দুই হাত মেলে দরজার সামনে দাঁড়াল, ‘রিদওয়ান ভাইয়ের কাছে চাবি আছে। তার কাছ থাইকা লইয়া আহেন। তালা ভাইঙেন না।’
‘উনি আমাকে চাবি দেননি। তাই আমি তালা ভাঙব। আপনি সরে দাঁড়ান।’
‘না, ভাবি, এইডা হয় না। আমার ওপরে এই ঘরডার ভার দিছে।’
‘আপনি সরে দাঁড়ান।’ পদ্মজা কথাটা বেশ জোরেই বলল। মদন হাওলাদার বাড়ির বউয়ের সামনে আর দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পেল না। দৌড়ে চলে গেল। বাড়ির সবাইকে জানাল, পদ্মজা তালা ভাঙছে।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো খলিল, আলমগীর, আমির, রিদওয়ান, ফরিনা, আমিনা। ততক্ষণে পদ্মজা তালা ভেঙে ফেলেছে। আমির হন্তদন্ত হয়ে এসেই প্রশ্ন করল, ‘তালা ভাঙলে কেন?’
‘আপনার ভাই আমাকে চাবি দেয়নি। আমার রুম্পা ভাবির সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হচ্ছিল তাই ভেঙেছি।’
‘এইডা অসভ্যতা। তোমারে ভালা ভাবছিলাম। ছেড়ি মানুষের এত তেজ, অবাধ্যতা ভালা না।’
পদ্মজা এক নজর খলিলকে দেখল। এরপর ঢুকে গেল রুম্পার ঘরে। রুম্পা ঘরের মাঝে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। লম্বা চুল এখন ঘাড় অবধি! কে কেটে দিয়েছে? যেন চুল না ময়লা ঝাড়ু। পদ্মজা দৌড়ে রুম্পার পাশে এসে বসে। রুম্পার শাড়ি ঠিক করে দিয়ে ডাকল, ‘ভাবি? ভাবি? শুনছো ভাবি?’
রুম্পার সাড়া নেই। গলায়, হাতে, পায়ে মারের দাগ। ফরিনা তাকে দেখে চমকে গেলেন। রুম্পার এক হাত চেপে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ও মা গো, কেলায় মারছে বউডারে? আল্লাহ গো, কেমনে মারছে। রক্ত শুকায়া পাথথর হইয়া গেছে। এর লাইগগা আমরারে রুম্পার কাছে আইতে দেও না তোমরা? বউডা তোমরারে কী করছে? পাগল মানুষ।’ ফরিনা বাড়ির পুরুষদের দিকে ঘৃণার চোখে তাকান। তিনি রূম্পার অবস্থা দেখে কাতর হয়ে উঠেছেন।
আমিনা দূরেই দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বরাবরই অন্যরকম মানুষ। অহংকারী, হিংসুক। অন্যদের ভালো দেখতে পারে না। রানির জীবনটা এভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর আরো বেশি খামখেয়ালি হয়ে উঠেছেন।
পদ্মজা আমিরের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল, ‘আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? অন্যরা পাষাণ। আপনি তো পাষাণ না। ভাবিকে বিছানায় তুলে দিন।’
পদ্মজার কথায় আমির রুম্পাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। আমির আর ফরিনা ছাড়া বাকি সবাই বিরক্তিতে কপাল ভাঁজ করে চলে যায়। তারা অসন্তুষ্ট। খলিল যাওয়ার আগে বিড়বিড় করে পদ্মজাকে অনেক কিছু বললেন। পদ্মজা সেসব কানে নেয়নি। সে শুধু অবাক হচ্ছে। মানুষগুলোর প্রতি ঘৃণা হয়। সে রুম্পার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। আমিরকে বলে, কবিরাজ নিয়ে আসতে। আমির চলে যায়। ফরিনার কাছ থেকে পদ্মজা জানতে পারল, তিনি দুই বছর পর রুম্পাকে দেখছেন! কী অবাক কাণ্ড! কখন চুল কাটা হয়েছে জানেন না। পদ্মজা জানতে চাইল, ‘কেন এত ভয় পান বাড়ির পুরুষদের? একটু শক্ত করে কথা বলে ভাবিকে দেখতে আসতে পারলেন না? ভাবির মা বাপের বাড়ি কোথায়? উনারা মেয়ের খোঁজ নেন না?’
‘রুম্পার মা-বাপ নাই। ভাই আছে দুইডা। ভাইগুলা আগেই খোঁজ নিত না। পাগল হুনার পর থাইকা নামও নেয় নাই।’
‘মানুষ এত স্বার্থপর কী করে হয়, আম্মা?’
ফরিনা রুম্পার শাড়ির ময়লা ঝেড়ে দেন। ঘরদোর পরিষ্কার করেন। রুম্পার জ্ঞান ফেরে ঘণ্টাখানেক পর। কিন্তু কথা বলার শক্তিটুকুও নেই তার। সে ড্যাবড্যাব করে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন পদ্মজার জন্য অপেক্ষায় ছিল। পদ্মজার জন্যই বেঁচে আছে! কিছু বলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। কতদিন ধরে তাকে পানি ছাড়া কিছু দেওয়া হচ্ছে না। ঘরের এক কোণে বালির বস্তা রাখা, ক্ষুধার চোটে কতবার বালি খেয়েছে। পেট খারাপ হয়ে পুরো ঘর নষ্ট করেছে। বমি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গতকাল থেকে সে অজ্ঞান। তবুও কেউ এসে দেখেনি। পদ্মজার চোখের জল আপনাআপনি পড়ছে। রুম্পার কষ্ট তাকে দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে। সে মনে মনে শপথ করে, রুম্পাকে নিয়ে শহরে যাবে। ফরিনা ও পদ্মজা মিলে রুম্পাকে গোসল করাল। নতুন শাড়ি পরিয়ে, গরম গরম ভাত খাওয়াল। চুলে তেল দিয়ে দিল। খাওয়া শেষে রুম্পা বিছানায় নেতিয়ে পড়ে। শরীরের শক্তি আসতে সময় লাগবে। একটু ঘুমালেই পুনরুদ্ধার হবে গায়ের জোরের। পদ্মজা রুম্পার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঘুমাও, ভাবি।’
পদ্মজা টের পেল, রুম্পার দুর্বল দুটি হাত পদ্মজার হাত শক্ত করে ধরতে চাইছে। সে রুম্পার দুই হাত শক্ত করে ধরে বলল, ‘তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।
রুম্পার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পদ্মজা জল মুছে দিল। ফরিনাকে বলল, ‘আম্মা, আমি আমার ঘর থেকে আমার কোরআন শরীফ আর জায়নামাজ নিয়ে আসি। আর উনাকে বলে আসি আপাতত আমি রুম্পা ভাবির সঙ্গে থাকব।’
যাও তুমি। আমি এইহানে আছি।’
পদ্মজা বেরিয়ে গেল। বারান্দা পেরোবার সময় উঠানে চোখে পড়ে। সেখানে পূর্ণা, রানি, বাচ্চাদের নিয়ে গোল্লাছুট খেলছে। পূর্ণার পরনে শাড়ি! মেয়েটা এত দস্যি হলো কী করে? সে চোখ সরিয়ে নিজের ঘরের দিকে গেল। সন্ধ্যার আজান পড়ার বেশি দেরি নেই।
রানি এক দলের নেতা, পূর্ণা অন্য দলের নেতা। দুই দলের নাম শাপলা আর গোলাপ। প্রতি দলে ছয়জন করে। বাচ্চাগুলোর বয়স নয়-দশ।
আলো আলগ ঘরের বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে। মৃদুল আলগ ঘর থেকে বেরিয়ে বলল, ‘এই বাচ্চারা আমিও খেলতাম।’
রানি বলল, ‘না, না। তোরে নিতাম না।’
পূর্ণা মৃদুলকে দেখেই অন্যদিকে চাইল। তার ভীষণ লজ্জা করছে মৃদুলের সামনে পড়তে! মৃদুল আরেকটু এগিয়ে এসে বলল, ‘ডরাইতাছোস? ডরানিরই কথা। এই মৃদুলের সঙ্গে কেউ পারে না। আর তুই তো মুটকি। কেমনে পারবি?’
‘আমি তোর চার মাসের বড়ো। সম্মান দিয়া কথা ক। মাঝখান থাইকা সর। খেলতে দে।’
‘ধুর, তোর ছেড়ির এখন খেলার সময়। আর তুই খেলতাছস। সর। এই এই, বোয়াল মাছ। তোমার দলের একটারে বাদ দিয়া আমারে লও। এই মুটকিরে একশোটা গোল্লা না দিলে আমি বাপের ব্যাঠা না।’
পূর্ণা হাঁ করে তাকাল। তাকে বোয়াল মাছ ডাকা হচ্ছে! তার দিকে তাকিয়ে বাচ্চারাও হাসছে! দেখতে চকচকে সুন্দর হয়ে গেছে বলে কী যা ইচ্ছে ডাকার অধিকার বাঘিনী পূর্ণা দিয়ে দিবে? কখনো না। সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘আমাকে আপনার কোন দিক দিয়ে বোয়াল মাছ মনে হচ্ছে?’
পূর্ণাকে কথা বলতে দেখে মৃদুল হাসল। রসিকতা করে বলল, ‘আরে কালি বেয়াইন দেখি কথা কইতেও পারে।’
পূর্ণা আহত হলো। এক হাতে নিজের গাল ছুঁয়ে ভাবল, আমি কি কালি ডাকার মতো কালো? বাঘিনী রূপটা মুহূর্তে নিভে গেল। তার চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে। যাকে পছন্দ করল সে-ই কালি বলছে। পূর্ণা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। রানি বলল, ‘মৃদুইলল্যা সর কইতাছি। খেলতে দে।’
‘আমিও খেলাম। এই আন্ডা তুই বাদ। তোর বদলে আমি বেয়াইনের দলের হয়ে খেলাম।’
মৃদুলের এক কথায় ন্যাড়া মাথার ছেলেটি সরে দাঁড়াল। মৃদুল খেলার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। পূর্ণাকে বলল, ‘কালি বেয়াইন তুমি আগে যাইবা? নাকি আমি আগে যামু?’
পূর্ণা মিনমিনিয়ে বলল, ‘আমি খেলব না।’
রানি দূর থেকে বলল, ‘দেখছস মৃদুইললা তুই খেলার মাঝে ঢুকছস বইললা পূর্ণা খেলত না। সবসময় কেন খেলা নষ্ট কইরা দেস তুই?’
মৃদুল সেসব কথায় ভ্রুক্ষেপও করল না। সে রসিকতার স্বরেই বলল, ‘আরে বেয়াইনের শক্তি ফুরায়া গেছে। আর খেলতে পারব না। এই আন্ডা তুই আয়। বেয়াইন খেলব না। তুই আইজ হারবিরে আপা।’
রানি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘আমার দলই জিতব।’
‘আগে আগে চাপা মারিস না। আমার মতো দেখায়া দে। এই পেটওয়ালা তুই আগে যা।’
পূর্ণা ব্যথিত মন নিয়ে আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে পা রাখে। সে কালো নিজেও জানে! কিন্তু কেউ কালি বললে তার খুব খারাপ লাগে। আল্লাহ কেন তাকে সৌন্দর্য দিলেন না? একটু ফরসা করে দিলে কী হতো? তার আপার মতো কালো রঙে সবাই সৌন্দর্য কেন খুঁজে পায় না? পূৰ্ণা দুই হাত দিয়ে দুই চোখের জল মুছে। অভিমানী মন থেমে থেমে কাঁদছে। এই শাড়ি তো মৃদুলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই পরেছিল। দরকার নেই এই চকচকে পুরুষ।
কেউ তাকে কালি বললে সে ভীষণ রাগ করে! ভীষণ।
৫১
সুনসান নীরবতা চারিদিকে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। রুম্পা বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে। পদ্মজা তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করছে, কখন রুম্পা চোখ খুলবে। পদ্মজা বসে আছে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। দরজায় কেউ টোকা দিতেই পদ্মজা সাবধান হয়ে গেল। রুম্পার নিরাপত্তা নিয়ে তার মন অস্থির হয়ে আছে। সে গম্ভীরকণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কে, কে ওখানে?’
‘আমি।’
আমিরের কণ্ঠ শুনে পদ্মজা ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। খুলে দিল দরজা। আমিরের চুল এলোমেলো। ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সে পদ্মজাকে দেখে বলল, ‘ঘুম ভেঙে গেল। তোমাকে মনে পড়ছে।’
‘আমি তো এখন যেতে পারব না।’
‘আমি থাকি তাহলে।’ আমিরের নির্বিকার কণ্ঠ।
পদ্মজা চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘শীতের রাতে মেঝেতে থাকবেন? রুম্পা ভাবি বিছানায় ঘুমাচ্ছে। এই ঘরে থাকলে মেঝেতে থাকতে হবে। ঘরে যান।’
‘মেঝেতেই থাকব।’
‘আপনি সবসময় ঘাড়ত্যাড়ামি করেন কেন? আপনাকে তো আমি বলে এসেছি কতটা দরকার রুম্পা ভাবির সঙ্গে থাকা।’
‘গত দিনও বোনদের সঙ্গে ছিলে। আর আজ রুম্পা ভাবির সঙ্গে থাকতে চাইছ!’
‘কয়টা দিনই তো। আজীবন একসঙ্গেই থাকব।’
‘আচ্ছা যাচ্ছি, এখনও ঘুমাওনি কেন?’
পদ্মজা একবার রুম্পাকে দেখে নিয়ে বলল, ‘এই তো ঘুমাব।’
আমির চারপাশ দেখে বলল, ‘সাবধানে থাকবে। রিদওয়ান দোতলায় ঘুরঘুর করছে। ভয় পাবে না। আমি আছি।’
পদ্মজা আমিরের চোখের দিকে তাকাল। বলল, ‘আপনি আমার সঙ্গে থাকতে নয়, দেখতে এসেছেন আমি ঠিক আছি কি না তাই না? একদমই ভয় পাবেন না। আমার কিছু হবে না।’
আমির দুই হাতে পদ্মজার দুই গাল ধরে বলল, ‘আমি তো জানি আমার পদ্মবতী কতটা সাহসী! এজন্যই এই বাড়িতে আসার সাহস করতে পেরেছি।’
‘আহ্লাদ হয়েছে? এবার যান।’
আমির হেসে চলে গেল। পদ্মজা অনেকক্ষণ অন্ধকার বারান্দায় তাকিয়ে রইল। এরপর দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। আমিরকে সে কতটা ভালোবাসে সে নিজেও জানে না! আমিরের প্রতিটি স্পর্শ ও কথার ছন্দে হৃদয় স্পন্দিত হয়। আমিরের পাগলামি, খেয়াল রাখা, দায়িত্ববোধ সবকিছু পদ্মজাকে মুগ্ধ করে। একজন আদর্শ স্বামী বোধহয় একেই বলে। আমিরের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল! ভালোবাসার মানুষদের নিয়ে ভাবা সময়টা জাদুর মতো। চোখের পলকে নির্ঘুম রাত কেটে যায় নয়তো নিজের অজান্তে আবেশে ঘুম চলে আসে।
সকালে উঠেই পূর্ণাকে গিয়ে ডেকে তুলল পদ্মজা। এরপর রুম্পার ঘরে এসে নামাজ পড়ল। কোরআন পড়ল। রুম্পার ঘুম আরো কিছুক্ষণ পর ভাঙে। রুম্পাকে ধরে ধরে টয়লেটে নিয়ে গেল পদ্মজা। তারপর গেল রান্নাঘর থেকে খাবার আনতে। ফরিনা মাত্র চুলা থেকে খিচুড়ি নামিয়েছেন।
‘আম্মা, ভাবির জন্য খিচুড়ি নিয়ে যাই?’ বলল পদ্মজা।
ফরিনা হেসে বললেন, ‘এইডা আবার কওন লাগে। লইয়া যাও। তুমি খাইবা কুনসময়?’
‘ভাবিকে খাইয়ে এসে তারপর উনাকে নিয়ে খাব। আম্মা, রাতের মুরগির গোশত আছে না?
‘হ আছে তো। ওই যে ওই পাতিলডায়।’
পদ্মজা গরম গরম খিচুড়ি মুরগি গোশতের ভুনা দিয়ে নিয়ে যায়। ঘরে ঢুকে দেখে রুম্পা মেঝেতে পড়ে আছে। পদ্মজা থালা বিছানার উপর রেখে রুম্পাকে তোলার চেষ্টা করে।
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ‘ভাবি মেঝেতে পড়লেন কীভাবে?
রুম্পা কিছু বলছে না। সে উদ্ভ্রান্তের মতো ছটফট করছে, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে; পদ্মজাকে দূরে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করছে। পদ্মজা বিস্মিত। রুম্পা এমন করছে কেন? সে রুম্পাকে প্রশ্ন করেই চলেছে, ‘কেউ এসেছিল ঘরে? কে এসেছিল? ভয় দেখিয়েছে? ভাবি… ভাবি বলুন আমাকে। ভাবি…ধাক্কাচ্ছেন কেন? আমি আপনার জন্য খাবার এনেছি।’
খাবারের কথা শুনে রুম্পা থমকে গেল। পদ্মজার দিকে এক নজর তাকিয়ে বিছানার দিকে তাকাল। ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারের ওপর। গরম খাবার গাপুসগুপুস করে খেতে থাকল। পদ্মজা বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে। এমনভাবে রুম্পা খাচ্ছে যেন আর কোনোদিন খাওয়া হবে না। সুযোগ আসবে না। পদ্মজা পানি এগিয়ে দিল। রুম্পা অল্প সময়ের ব্যবধানে পুরো থালার খিচুড়ি ও এক বাটি গোশত খেল।
খাওয়া শেষে পদ্মজা নমনীয় কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘ভাবি আমার সঙ্গে একটু কথা বলবে?’
রুম্পা দূরে সরে যায়। দেয়াল ঘেঁষে বসে। মাথা দুইদিকে নাড়িয়ে ইশারা করে জানাল, সে কথা বলবে না। পদ্মজা তবুও আশা ছাড়ল না। সে রুম্পার পাশে গিয়ে বসল। রুম্পার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে আমার সঙ্গে ঢাকা নিয়ে যাব। যাবে?’
রুম্পা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলো। পদ্মজাকে ধাক্কা মেরে চেঁচিয়ে বলল, ‘বাইর হ আমার ঘর থাইকা। বাইর হ তুই।’
রুম্পার ব্যবহারে পদ্মজা আহত হলো, ‘ভাবি! আমি তোমার ভালো চাই।’
‘বাইর হ কইতাছি। বাইর হ।’
শীতের ঠান্ডা হিম বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকছে। শীতের দাপট বেড়েছে। এবারের শীত বোধহয় মানুষ মারার জন্য এসেছে! এত ঠান্ডা! রুম্পার পরনে শাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। ঠান্ডায় তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে পদ্মজা রুম্পার চোখের দিকে দৃষ্টিপাত করল। রুম্পার চোখ বার বার দরজার দিকে যাচ্ছে। পদ্মজা উঠে স্থির হয়ে দাঁড়াল না, ছুটে গেল দরজার কাছে। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আগন্তুক ছুটে পালাতে চাইল। তবে তার আগেই পদ্মজা জোরাল কণ্ঠে ডেকে উঠল, ‘লুতু বুবু।’
লতিফা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পদ্মজাকে দেখল। এরপর দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে গেল নিচে, তার চোখে ভয়। আচমকা ঝনঝন শব্দ হলো একটা। পদ্মজা চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। রুম্পা পাগলামি শুরু করেছে। মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করতে করতে ঘরের জিনিসপত্র ছুঁড়ছে। রুম্পাকে থামানোর চেষ্টা করল পদ্মজা, বোঝাল অনেক করে। কিছুতেই রুম্পা থামল না। উলটো তার ছোড়া স্টিলের গ্লাস এসে পড়ল পদ্মজার কপালে। ‘আহ’ বলে বসে পড়ল পদ্মজা, সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল রুম্পার পাগলামি। ছুটে এসে পদ্মজার আহত স্থানে হাত রাখে, উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, ‘আমি তোমারে ইচ্ছা কইরা দুঃখ দেই নাই বইন। বেশি বেদনা করতাছে?’
আঞ্চলিক ভাষায় চিকন কণ্ঠ! পদ্মজা দুই চোখ মেলে তাকাল। রুম্পা পদ্মজার কপালের ফোলা অংশে ফুঁ দিচ্ছে। ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে পদ্মজাকে অনেক পছন্দ করে রুম্পা। মুখোশ খুলে বেরিয়ে এসেছে আসল রূপে। সে কঠিন নয়, পাগল নয়। বরং বড্ড নরম, কোমল। পদ্মজা শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কেন পাগলের অভিনয় করো?’
রুম্পার হাত থেমে গেল। সে ধরা পড়ে গেছে!
.
কুয়াশার স্তর ভেদ করে একটা নৌকা ঢুকল খালে, মাঝি মৃদুল। গতকাল যে ছেলেটাকে আন্ডা ডেকেছিল সেই ছেলেটাও নৌকায় আছে। তার ভালো নাম, জাকির। মৃদুলের সঙ্গে বাচ্চাকাচ্চাদের অনেক খাতির। পূর্ণা খালের ঘাটে বসে ছিল। সে ফজরের নামাজ আদায় করে খিচুরি খেয়ে এখানে চলে এসেছে। মন খারাপের সময় ঘাটে বসে থাকতে তার ভালো লাগে। গতকাল রাতে খাওয়ার সময় মৃদুল কম হলেও বিশ বার তাকে কালি ডেকেছে। অন্ধকারে নাকি দেখাই যায় না। এমন অনেক কথা বলেছে। কালো রঙের মেয়ে হওয়া বোধহয় পাপ! আবার পদ্মজাও রাতে তার সঙ্গে থাকেনি। পুরো রাত সে কেঁদেছে। কেউ কেন তাকে কালি বলবে! আবার তার আপা ও তাকে সময় দিল না। শ্বশুরবাড়ির অন্য বউকে নিয়ে ব্যস্ত। পূর্ণার খুব অভিমান হয়েছে। বয়স বিশ পার হলেও রয়ে গেছে সেই ছোট্ট কিশোরী মেয়েটি। মৃদুল নৌকা থামিয়ে পূর্ণাকে ডাকল, ‘কালি বেয়াইন।’
পূর্ণা তাকাল না। মৃদুল আবার ডাকল, ‘বেয়াইন গো।’
তাও পূর্ণা সাড়া দিল না। মৃদুল জাকিরকে বলল, ‘কী রে ব্যাঠা, বুঝছিস কিছু? এই ছেড়িরে ভূতে ধরল নাকি?’
জাকির দাঁত বের করে শুধু হাসল। মৃদুল জোরে বলল, ‘আরে বেয়াইন কী কানে শুনে না? কাল তো ঠিকই শুনছিল। ঠান্ডা কী কানের ভেতরে ঢুইকা গেছে? ও কালি বেয়াইন। বেয়াইন…’
পূর্ণা হুট করে উঠে দাঁড়াল। আঙুল শাসিয়ে মৃদুলকে বলল, ‘আপনার কী মা-বাপ নাই? থাকলেও শিক্ষা দেয়নি যারে তারে যা ইচ্ছে ডাকা উচিত না? অসভ্যতা অন্য জায়গায় করবেন আমার সামনে না। আমি কালো আমি জানি। আপনাকে কালি বলে সেটা মনে করিয়ে দিতে হবে না। আমি আপনাকে অনুমতি দেইনি আমাকে কালি ডাকতে বা বেয়াইন ডাকতে। আমি আপনার বেয়াইনও না। আমার দুলাভাইয়ের আপন ভাই না আপনি। কোথাকার কে আপনি? এই ফরসা চামড়ার দেমাগ দেখান? আরেকবার আমাকে কালি বললে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।’
কথা শেষ করেই পূর্ণা কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যায়। রেখে যায় অপমানে থমথম করা একটা মুখ। মৃদুল ঘোর থেকে বেরোতে পারছে না। তাকে একটা মেয়ে এভাবে বলেছে? তার মতো সুন্দর ছেলের জন্য গ্রামের সবকটি মেয়ে পাগল। আর এই কালো মেয়েটা তাকে এভাবে অপমান করল! মৃদুল রাগে বৈঠা ছুঁড়ে ফেলল খালে। নৌকা থেকে নামতে গেলে তার এক পায়ে ধাক্কা লেগে নিমিষে দূরে চলে যায় নৌকাটি।
নৌকায় থাকা ছেলেটি চিৎকার করল, ‘মৃদুল ভাই। আমি আইয়াম কেমনে? বৈডাডাও ফালায়া দিছো।’
মৃদুল বিরক্তি নিয়ে ফিরে তাকাল। সত্যিই তো নৌকা অনেক দূরে চলে গেছে! এই ঠান্ডার মধ্যে ছোটো বাচ্চাটা সাঁতরে পাড়ে আসবে কীভাবে!
মৃদুল রাগ এক পাশে রেখে বরফের মতো ঠান্ডা জলে ঝাঁপ দিল।
.
রুম্পা থেমে থেমে কাঁদছে। এদিকে অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে পদ্মজা, সে ভীষণ অস্থির। একজোড়া পায়ের শব্দ ভেসে আসতেই রুম্পার কান্না থেমে গেলে। এই পায়ের শব্দগুলো সে চেনে! রুম্পা কাঁপতে থাকল। রুম্পার অবস্থা দেখে পদ্মজার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত গড়িয়ে যায়। রুম্পা পদ্মজার এক হাত ধরে চাপাস্বরে দ্রুত বলল, ‘এহান থাইকা চইলা যাও, বইন। আর আগাইয়ো না। ওরা পিশাচের মতো। ছিঁইড়া খাইয়া ফেলব। ওদের দয়ামায়া নাই। তুমি অনেক ভালা। তোমারে কোনোদিন ভুলতাম না। তুমি এইহানে থাইকো না। তুমি এই বাড়ির কেউয়ের লগে যোগাযোগ রাইখো না।’
‘ওরা কী করেছে? ভাবি, অনুরোধ করছি আমাকে বলুন। ভাবি অনুরোধ করছি।’
রুম্পা সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঢোক গিলছে। পায়ের শব্দটা যত কাছে আসছে তার কাঁপুনি তত বাড়ছে। সে ছলছল চোখে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে কোনোমতে বলল, ‘পেছনে…উত্তরে…ধ রক্ত।’
পরমুহূর্তেই দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে খলিল হাওলাদার। এত জোরে দরজা ধাক্কা দিয়েছেন যে, বিকট শব্দ হয়। হুংকার ছেড়ে পদ্মজাকে বললেন, ‘তুমি এই ঘর থাইকা বাইর হও। অনেক অবাধ্যতা দেখাইছো আর না।’
খলিলের চোখ দুটি দেখে পদ্মজার রক্ত ছলকে উঠে। গাঢ় লাল। সে দুই হাতে রুম্পাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি রুম্পা ভাবির সঙ্গে থাকব।’
‘থাকবা না তুমি।’
‘কেন জানতে পারি?’
‘একটা পাগলের সঙ্গে কীসের থাকন?’
‘রুম্পা ভাবি পা…’ পদ্মজা কথা শেষ করতে পারল না। বুকে মুখ লুকিয়ে রাখা রুম্পা পিঠে চিমটি দিয়ে ভেজাকণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কইও না। আমি পাগল না কইও না। দোহাই লাগে।’
পদ্মজা থেমে গেল। খলিল বললেন, ‘বাড়ায়া যাও, বউ।’
পদ্মজা নাছোড়বান্দা হয়ে বলল, ‘যাব না আমি। রুম্পা ভাবির সঙ্গে থাকব।’
রুম্পা পদ্মজাকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় পাগলামি শুরু করে। খলিল রুম্পাকে আঘাত করার জন্য উদ্যত হতেই পদ্মজা বাধা হয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘নিজের মেয়েকে অমানুষের মারতে পারেন বলে সবার মেয়েকে মারার অধিকার পাবেন না।’
পদ্মজার কথা মাটিতে পড়ার আগে খলিলের শক্ত হাতের থাপ্পড় পদ্মজার গালে পড়ে।
পদ্মজা ব্যথায় ‘মা’ বলে আর্তনাদ করে উঠল।
৫৩
ভোর হয়েছে আর কতক্ষণই হলো! দুই ঘণ্টার মতো। এর মধ্যেই মেঘলা আকাশ বেয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে চারিদিকে। পূর্ণা আলগ ঘরের সামনে থাকা বারান্দার চেয়ারে মুখ ভার করে বসে আছে। তার গায়ে সোয়েটার, সোয়েটারের ওপরে তিন তিনটে কাঁথা। তবুও পাতলা ঠোঁট জোড়া ঠান্ডায় কাঁপছে। বসে থাকতে থাকতে একসময় বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। কোথাও যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। তার চেয়ে বরং আপার সঙ্গে আড্ডা দেয়া যাক। চৌকাঠে পা রাখতেই মৃদুলের কণ্ঠস্বর কানে এলো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সে। মৃদুল কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে আসছে। শরীর ভেজা। রানি আপা, রানি আপা বলে ডাকছে। কিন্তু এখানে তো রানি নেই। মৃদুল বারান্দায় পা রেখেই পূর্ণার মুখটা দেখতে পেল। তার দিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মৃদুলের কপালে ভাঁজ পড়ল। এই মেয়ের জন্যই তো এমন ঘটনা ঘটল। এখন ঠান্ডায় কাঁপতে হচ্ছে। সে দৃষ্টি সরিয়ে দাঁড়াল দূরে। শার্ট খুলে দড়িতে মেলে দিয়ে ডাকল, ‘কইরে রানি আপা। শীতে মইরা যাইতেছি। কাপড় নিয়ে আয়। ভেজা শরীর নিয়া ঘরে কেমনে ঢুকব?’
পূর্ণা কাঠখোট্টা গলায় বলল, ‘রানি আপা এইখানে নেই। অকারণে চেঁচাচ্ছেন।’
মৃদুল পূর্ণার স্বরেই পালটা জবাব দিল, ‘তোমারে কইছি আমার উত্তর দিতে? আমার ইচ্ছে হইলে আমি চেঁচাব। তোমার ভালা না লাগলে কানে ফাত্তর ঢুকায়া রাখো।’
পূর্ণা দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করে তাকিয়ে থাকে। মৃদুল আড়চোখে পূর্ণাকে দেখে চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। বাতাস বেড়েছে। খালি গায়ে কাঁপুনি শুরু হয়। মৃদুলকে এভাবে কাঁপতে দেখে পূর্ণার মায়া হচ্ছে। সে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘আমি আপনার কাপড় নিয়ে আসব?’
মৃদুল চোয়াল শক্ত রেখেই আবারও আড়চোখে তাকাল। কিন্তু উত্তর দিল না। সে সম্পূর্ণভাবে পূর্ণাকে উপেক্ষা করছে। পূর্ণা জবাবের আশায় কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকে, এরপর চলে যায়। পূর্ণা চলে যেতেই মৃদুল শীতের তীব্রতায় মুখ দিয়ে ‘উউউউউউ’ জাতীয় শব্দ করে কাঁপতে থাকল। যতক্ষণ না প্যান্ট শুকাবে ঘরের ভেতর ঢুকতে পারবে না। তার ঘরে যাওয়ার পথে ধান ছড়ানো আছে। এদিক দিয়ে গেলে ধান ভিজে নষ্ট হবে। সহ্য করা ছাড়া আর উপায় নেই। কেউ যদি কাপড় দিয়ে যেত!
আলগ ঘরের পেছনে উত্তর দিকের বারান্দায় গিয়ে মগাকে পেল পূৰ্ণা। মগা ঝিমুচ্ছে। ‘মগা ভাইয়া?’
মগা তাকাল। পূর্ণা বলল, ‘মৃদুল ভাইয়ের ঘর কোনটা?’
মগা আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দিল। পূর্ণা মৃদুলের ঘরে গিয়ে একটা লুঙ্গি আর শার্ট নিয়ে বেরিয়ে আসে। মৃদুল পায়ের শব্দ পেয়ে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা শীতের কাতরতা বন্ধ করে দিল। পূর্ণা মৃদুলের চেয়ে এক হাত দূরে এসে দাঁড়াল। এগিয়ে দিল লুঙ্গি আর শার্ট। মৃদুল ঘুরে তাকাল। আর রাগ দেখানো সম্ভব নয়। রগে রগে ঠান্ডার তীব্রতা ঢুকে গেছে। রক্ত শীতল হয়ে এসেছে। সে পূর্ণার হাত থেকে নিজের কাপড় নিতে নিতে হৃদয় থমকে দেয়ার মতো একটা মায়াবী মুখশ্রী আবিষ্কার করল। টানা টানা চোখ, চোখের পাঁপড়িগুলো এত ঘন যে মনে হচ্ছে কোনো বিশাল বটবৃক্ষ ছায়া ফেলে রেখেছে, পাতলা ফিনফিনে ঠোঁট, ত্বকে তেলতেলে ভাব চকচক করছে। লম্বা এলো চুল বাতাসে উড়ছে। শ্যামবর্ণের মুখ এত আকর্ষণীয় হয়? কিছু সৌন্দর্য বোধহয় এভাবেই খুব কাছে থেকে চিনে নিতে হয়। মৃদুলের দৃষ্টি শীতল হয়ে আসে। সে আগে লুঙ্গি নিলো। পূর্ণা অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘আমি দেখব না। আপনি পালটে ফেলুন।’
মৃদুল মোহময় কোনো টানে আবার ফিরে তাকাল। তবে মুখটা আর দেখতে পেল না। মায়াবী মুখটা অন্যদিকে ফিরে আছে। সে লুঙ্গি পালটে মিনমিনিয়ে বলল, ‘শার্টটা?’
পূর্ণা হেসে শার্ট এগিয়ে দিল। মৃদুলের এলোমেলো দৃষ্টি। হুট করেই বুকে ঝড়ো বাতাস বইছে। কী আশ্চর্য! পূর্ণা গর্বের সঙ্গে বলল, ‘আমাকে কালি বলে কষ্ট দিলেও আমি আপনার কষ্ট দেখতে পারিনি। আমি সবসময় মহৎ।’
অন্যসময় হলে হয়তো মৃদুলও পালটা জবাব দিত। কিন্তু এখন ইচ্ছে হচ্ছে না। মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না। পূর্ণা কিছু না বলে আলগ ঘরে ঢুকে যায়। মৃদুল দ্রুত পায়ে দুই পা এগিয়ে আসে। আবার পিছিয়ে যায়। আজকের দিনটা অন্যরকম লাগছে। আচ্ছা, দিনটা অন্যরকম নাকি অনুভূতি অন্যরকম?
.
নিজেকে ধাতস্থ করার আগেই খলিল পদ্মজাকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দ্রুত দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন। পদ্মজা গালে হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। চোখের জল বিসর্জন হচ্ছে আঘাতের যন্ত্রণায়? নাকি কারো হাতে থাপ্পড় খাওয়ার অপমানে? কে জানে! খলিল কপাল কুঁচকে আরো কী কী যেন বলে চলে গেলেন। পদ্মজা ঠায় সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সে আকস্মিক ঘটনাটি হজম করতে পারছে না। দিকদিশা হারিয়ে ফেলেছে।
ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ পেয়ে সংবিৎ ফিরল পদ্মজা, বন্ধ দরজার দিকে একবার তাকাল। এই মুহূর্তে পরিস্থিতি কীভাবে সামলানো উচিত—তার মাথায় আসছে না। একটু দূরে চোখ পড়তেই দেখতে পেল লতিফাকে। পদ্মজাকে তাকাতে দেখেই লতিফা আড়াল হয়ে যায়। পদ্মজা সে জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকে, তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। এই তীব্র শীতে আবার বৃষ্টি হবে নাকি! ভাবতে ভাবতেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামে। পদ্মজার গা কেঁপে উঠল ঠান্ডার তীব্রতায়।
সাই সাই বাতাস বইছে। সুপারি গাছগুলো একবার ডানে দুলে পড়ছে তো আরেকবার বাঁয়ে। আলগ ঘরের পেছনের বারান্দায় গায়ে কাঁথা মুড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে মগা। পদ্মজা শাড়ির আঁচল ভালো করে টেনে ধরে শীত থেকে বাঁচতে। আবহাওয়ার অবস্থা ভালো না, তার মধ্যে বৃষ্টি আর বাতাস! সামান্য শাড়ির আঁচলে কী ঠান্ডার তীব্রতা আটকানো যায়!
ইচ্ছেও করছে না ঘরে যেতে। সে এদিক-ওদিক চেয়ে এক কোনায় একটা চেয়ার দেখতে পেল। চেয়ারটা আনার জন্য এগোল সে, আর তখনই নাকে একটা বিশ্রি বোটকা গন্ধ ধাক্কা দিল। সজাগ হয়ে উঠল পদ্মজার স্নায়ু। যত এগোচ্ছে গন্ধটা তীব্র হচ্ছে! সে সাবধানে এক পা এক পা করে ফেলছে। এরইমধ্যে আমিরের চেঁচামেচি কানে আসে। পদ্মজা থমকে যায়। উলটো ঘুরে বাইরে উঁকি দেয়। বাইরে ধস্তাধস্তি শুরু হয়েছে। প্রথমে দৃষ্টি কাড়ে আমিরের রাগী মুখশ্রী।
পদ্মজা সবকিছু ভুলে ছুটে নেমে যায় নিচ তলায়। বাইরে এসে দেখে, আমির তার চাচাকে মারছে! যেভাবে পারে কিল-ঘুসি দিচ্ছে। আমির এতটাই রেগে গিয়েছে যে নিজের আপন চাচাকে মারছে! মজিদ হাওলাদার, রিদওয়ান, আমিনা, রানি, সবাই আটকানোর চেষ্টা করছে। কেউ পারছে না। আমির খলিলকে ছেড়ে রিদওয়ানকে ধাক্কা মেরে কাদায় ফেলে দিল। আমিরের আচরণ উন্মাদের মতো। সে বিশ্রি গালিগালাজ করতে করতে রিদওয়ানের পেটে লাথি বসায়। রিদওয়ান কোঁকিয়ে উঠল। আমিনা আমিরকে কিল-থাপ্পড় মারছেন, তাতেও কাজ হচ্ছে না। এমন তো আমির নয়! পদ্মজা দৌড়ে আসে। আমিরকে চিৎকার করে বলল, ‘কী করছেন আপনি? পাগল হয়ে গেছেন? ছাড়ুন।’
আমির পদ্মজার জবাব দিল না, বরঞ্চ থাবা মেরে ধরল খলিলকে। খলিলের নাক বেয়ে রক্ত ঝরছে। সেই অবস্থায়ই শক্ত মুঠো করে মুখে আরেকটা ঘুসি মারল সে। রানি, আমিনা হাউমাউ করে কাঁদছে। মৃদুল, পূর্ণা, মগা, মদন—প্রত্যেকে দৌড়ে আসে। মৃদুল, পদ্মজা দুই হাতে আমিরকে টেনে সরাতে চায়। কেউই পারল না। আমিরের শরীরে যেন দানবের শক্তি ভর করেছে। সে কিছুতেই ক্লান্ত হচ্ছে না। মৃদুল দুই হাতে জাপটে ধরে আমিরকে দূরে সরিয়ে আনে। আমির হিংস্র বাঘের মতো হাত পা ছুড়তে ছুড়তে বলছে, ‘কুত্তার বাচ্চারা অনেক কিছু করেছিস, করতে দিয়েছি। আমার বউয়ের গায়ে হাত দেস কোন সাহসে? মৃদুল ছাড়। আমি ওদের আজরাইলের মুখ দেখিয়ে ছাড়ব। শুয়োরের বাচ্চা…’
মৃদুলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছুটে গিয়ে রিদওয়ানকে ধরল আমির পদ্মজা হতভম্ব হয়ে পড়েছে! রিদওয়ান গতকাল তার কাঁধে হাত দিয়েছিল, আর আজ খলিল থাপ্পড়ে মেরেছে। এসব কে বলেছে আমিরকে? থাপ্পড়টা লতিফা দেখেছিল। তাহলে কী লতিফা বলেছে?
আমিনা পদ্মজার পায়ে লুটিয়ে পড়েন। পদ্মজা দ্রুত সরে যায়, ‘চাচি কী করছেন!’
আমিনা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘থামাও এই কামড়াকামড়ি। আল্লাহর দোহাই লাগে।’
পদ্মজা কী করবে বুঝতে পারছে না। আমির তার কোনো কথাই কানে নিচ্ছে না। এমন রাগ সে আগে কখনো দেখেনি! গুরুজনদের গায়ে হাত তোলার মতো রাগ আমিরের হতে পারে, এটা তার ধারণার বাইরে ছিল! পদ্মজা আমিরের সোয়েটার খামচে ধরে কণ্ঠ কঠিন করে বলল, ‘ছাড়ুন বলছি। ছাড়ুন।’
আমির তাও শুনল না। সে ধাক্কা মেরে পদ্মজাকে সরিয়ে দিল। দুই হাত দূরেই নারিকেল গাছ ছিল। সেখানে পড়লে নিশ্চিত কোনো অঘটন ঘটে যেত, অঘটন ঘটার পূর্বেই দুটো হাত পদ্মজাকে আঁকড়ে ধরে। পদ্মজা কৃতজ্ঞতার নজরে তাকাল। ফরিনাকে দেখতে পেল। ফরিনা এরকম ধস্তাধস্তি দেখেও চুপ করে আছেন, পদ্মজা অবাক হলো! থামানোর চেষ্টা পর্যন্ত করছেন না। পদ্মজা আবার আমিরকে থামানোর চেষ্টা করল, মৃদুল চেষ্টা করল। কিছুতেই কিছু হলো না। আমির খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, অনেক বছরের রাগ একসঙ্গে মিটিয়ে নিচ্ছে। পদ্মজা আমিরকে অনুরোধ করে সরে আসতে। সেই অনুরোধ আমিরের কর্ণকুহর অবধি পৌঁছেছে কি না সন্দেহ!
পদ্মজা অসহায় মুখ করে সরে যাবে, তখনই দুটি শক্তপোক্ত হাত আমিরকে টেনে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে। সেই হাতে খুব দামি ঘড়ি। হাতের মালিককে দেখার জন্য পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। পরক্ষণেই চমকে উঠল মুখটা দেখে! দীর্ঘ সময় পর আবার সেই মানুষটির সঙ্গে দেখা। যে মানুষটি তার প্রথম ভালোবাসা না হলেও, প্রথম আবেগমাখা অনুভূতি ছিল…লিখন শাহ!
দূরে সরে দাঁড়াল পদ্মজা। মৃদুল, লিখন মিলে আমিরকে চেপে ধরে দূরে নিয়ে যেতে চাইল। আমির ছটফট করছে ছুটতে, তবে পারছে না। তীব্র রাগ নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে লিখনকে দেখে তার দৃষ্টি স্থির হলো, তবে থেকে গেল ছটফটানি। লিখন হেসে বলল, ‘এবার থামুন। অনেক শক্তি ফুরিয়েছেন।
আমির কিছু বলতে চাইল বটে, তবে তার আগেই রিদওয়ান ইট দিয়ে আমিরের ঘাড়ে আঘাত করে বসল সবার অগোচরে। আমির আর্তনাদ করে বসে পড়ে। লিখন রিদওয়ানকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। পদ্মজা উৎকর্ণ হয়ে দৌড়ে আসে। আমিনা, রানি খলিল এবং রিদওয়ানকে নিয়ে দ্রুত আলগ ঘরে গয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। মজিদ মগাকে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি গঞ্জে যা। বিপুল ডাক্তাররে নিয়ে আয়। আমার বাড়িতে এসব কী হচ্ছে!’
ফরিনা তখনো দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। এই ঘটনা তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করেনি! বরং এই ঘটনার জন্য তিনি খুশি! কী চলছে তার মনে?
৫৪
ফরিনা তাড়াহুড়ো করে খোশমেজাজে রান্না করছেন। সাহায্য করার মতো পাশে কেউ নেই। একাই দৌড়ে দৌড়ে সব করছেন। হাওলাদার বাড়িতে অতিথি এসে একদিন না থেকে যেতে পারে না, এতে নাকি গৃহস্থ বাড়ির অমঙ্গল হয়। তাই মজিদ লিখনকে থেকে যেতে জোর করেছেন। পদ্মজা নিজের ঘরে স্বামী সেবায় ব্যস্ত। আমিরের ঘাড়ের চামড়া ফুলে গেছে। হাড়ে বিষের মতো যন্ত্রণা। বিপুল ডাক্তার ওষুধপত্র দিয়েছেন। পদ্মজা অশ্রুসজল নয়নে আমিরের মুখের দিকে চেয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ স্বামীর যন্ত্রণা দেখেছে। সহ্য করতে হয়েছে। মাত্রই আমির চোখ বুজেছে। সে মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করছে, দ্রুত যেন আমিরের ব্যথাটা সেরে যায়। নয়তো তাকে দিয়ে দিক। ঘাড়ের আহত অংশে পদ্মজা আলতো করে ছুঁয়ে দিলো, নীল হয়ে আছে। নীরবে পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াল লতিফা। পদ্মজা কারো উপস্থিতি টের পেয়ে জলদি চোখের জল মুছল। তারপর লতিফাকে দেখে বলল, ‘লুতু বুবু!
লতিফা বলল, ‘খাইবা না? খালাম্মা খাইতে ডাকতাছে।’
পদ্মজা গম্ভীরকণ্ঠে বলল, ‘আম্মা নিজের ছেলেকে কেন দেখতে আসেননি?’
‘খালাম্মায় লিখন ভাইজানের লাইগে রানতাছিল।’
পদ্মজা ক্ষিপ্ত হয়, ‘নিজের ছেলেকে না দেখে উনি কীভাবে অতিথির জন্য ভোজ আয়োজন করছেন? আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।’
লতিফা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পদ্মজা অনেকক্ষণ ক্ষিপ্ত নয়নে মেঝেতে চোখ নিবদ্ধ করে রাখল। এরপর আমিরকে এক ঝলক দেখে, লতিফাকে বলল, ‘তুমি যাও, আমি আসছি।’
লতিফা দুই পা এগোতেই পদ্মজা ডেকে উঠল, ‘লুতু বুবু।’
লুতু দাঁড়াল। পদ্মজা বলল, ‘তুমি আমার ওপর নজর রাখছিলে কেন? আর আমাকে জিজ্ঞাসা না করে থাপ্পড়ের কথাই বা কেন উনাকে বলেছো?’
লতিফার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে নত হয়ে, ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা আরো দুই বার প্রশ্ন করেও কোনো জবাব পেল না। তাই বলল, ‘নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?’
এইবার লতিফা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। সে কিছু একটা ভাবছে, মুখ তুলে দেখে পদ্মজা তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। অপ্রতিভ হয়ে লতিফা বলল, ‘আমি যাই। নইলে খালাম্মায় চেতব।’
পদ্মজার উত্তরের আশায় না থেকে তড়িঘড়ি করে চলে গেলে লতিফা। পদ্মজা ভ্রুকুটি করে দরজার বাইরে তাকিয়ে রইল। প্রতিটি প্রশ্ন আলাদা আলাদা। অথচ তার মনে হয় সব প্রশ্নের এক উত্তর, একই সুঁতায় গাঁথা এখন সেসব ভাবার সময় না। আমিরের প্রতি যত্নশীল হওয়া দরকার। পদ্মজা আমিরের কপাল ছুঁয়ে তাপমাত্রা অনুমান করে। ভীষণ গরম। জ্বর উঠছে নাকি!
লিখন আর মৃদুলের আড্ডা জমে উঠেছে। জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে দুজন। লিখনের নায়িকা তিন দিন আগে ঘাট থেকে পিছলে নদীতে পড়ে গেছে। সাঁতার জানে না তাই প্রচুর পানি খেয়েছে। সেই সঙ্গে পা মচকে গেছে। কোমরেও ব্যথা পেয়েছে। এই কথা শুনে মৃদুল হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিল। পূর্ণা দূর থেকে কটমট করে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে আছে। কত অসভ্য এই লোক! মানুষের আঘাতের কথা শুনে হাসে! তার গা জ্বলে যাচ্ছে মৃদুলের হা হা করে হাসা দেখে। লিখন আরো জানাল, সে এবং তার দল গত তিনদিন নায়িকা ছাড়া দৃশ্যগুলোর শুটিং করেছে। বাকি যা দৃশ্য আছে সবকিছুতে নায়িকার উপস্থিতি থাকতেই হবে। তাই আপাতত শুটিং স্থগিত। আশা করা যাচ্ছে, তিন-চার দিনের মধ্যে নায়িকা সুস্থ হয়ে যাবে। পূর্ণাকে দূরে বসে থাকতে দেখে লিখন ডাকল। খুশিতে গদগদ হয়ে দৌড়ে এলো পূর্ণা, ঘণ্টা দুয়েক আগে একটু কথা হয়েছিল; আর হয়নি। লিখন প্ৰশ্ন করল, ‘ভেতরের অবস্থা কেমন? আমির হাওলাদার আগের চেয়ে কিছুটা ভালো অনুভব করছেন?’
‘ঘুমাচ্ছে দেখে এলাম। আপা আছে পাশে।’
‘তোমার আপা পাশে থাকলে আর কী লাগে!’ লিখনের কণ্ঠটা করুণ
শোনায়। পূর্ণা প্রসঙ্গ পালটে বলল, ‘ভাইয়া, আপনি কিন্তু আমাদের বাড়িতে যাবেন। তখন বললাম, কিছুই বললেন না।’
‘যাব।’
‘প্রান্ত অনেক খুশি হবে।’
‘প্রান্ত যেন কে?’
‘আমার ভাই। ওই যে খুন—’
‘মনে পড়ছে। কী যেন নাম ছিল… মুন্না বা মান্না এরকম কিছু নাম ছিল না?’
‘জি ভাইয়া।’
‘সবাই কত বড়ো হয়ে গেছে। পড়াশোনা আর করোনি কেন?’
পূর্ণা বাঁ হাত চুলকাতে চুলকাতে বলল, ‘মেট্রিক ফেল করায় আর পড়তে ইচ্ছে করেনি।
মৃদুল ভূত দেখার মতো চমকে উঠে বলল, ‘তুমিও মেট্রিক ফেল?’
পূর্ণা আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল, ‘কেন? আরো কেউ আছে এখানে?’
মৃদুল মুচকি হেসে চুল ঠিক করতে করতে চমৎকার করে বলল, ‘আমিও মেট্রিক ফেল।’
মৃদুলের কথা শুনে লিখন সশব্দে হেসে উঠল। পূর্ণা সরু চোখে তাকিয়ে আছে মৃদুলের দিকে। মজা করল নাকি সত্য বলল? লিখন ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বলল, ‘মৃদুল মজা করছো, নাকি সত্যি?’
মৃদুল গুরুতর ভঙ্গিতে বলল, ‘মিথ্যা কইতে যামু কেন? এতে আমার লাভডা কী?’
মৃদুলের ভঙ্গি দেখে লিখন চারপাশ কাঁপিয়ে হাসল। সঙ্গে তাল মিলাল পূর্ণা ও মৃদুল। লিখন আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছে। দেখতে কত ভালো দেখাচ্ছে। কী অপূর্ব মুখ। বলিষ্ঠ শরীর। পূর্ণা কেন জানি আজও মনে হচ্ছে, লিখনের পাশেই পদ্মজাকে বেশি মানায়। পরক্ষণেই পূর্ণা নিজেকে শাসাল, ‘চুপ থাক পূর্ণা! আমির ভাইয়ার মতো ভালো মানুষ দুটি নেই। আপার জন্য আমির ভাইয়া সেরা।’
তবুও মন বোঝে না। হয়তো সৌন্দর্যের মিলটার জন্যই লিখন-পদ্মজা দুটি নাম তার ভাবনায় একসঙ্গে জোড়া লেগে যায়। অথচ বিবেক দিয়ে ভাবলে মনে হয় আমিরের জায়গা কেউ নিতে পারবে না। কেউ না। সে অনন্য। তার মতো ভালোবাসতে কেউ পারবে না, লিখনও না।
হাসিখুশি মুহূর্ত উবে যায় খলিলের কর্কশ কণ্ঠে, ‘বেহায়া, বেলাজা ছেড়ি। পর পুরুষের সামনে কেমনে দাঁত মেলায়া হাসতাছে। ঘরে বাপ-মা না থাকলে এমনই হয়। এই ছেড়ি ঘরে যাও।’
লিখন-মৃদুলের সামনে এভাবে কটু কথা শুনে পূর্ণার বুক ফেটে কান্না আসে। সে এক পলক তাদেরকে দেখে আলগ ঘরের ভেতর চলে যায়। এদিকে লিখন, মৃদুলও হতভম্ব। খলিলের মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ। নাকের নিচে চামড়া উঠে গেছে, মাংস দেখা যাচ্ছে। তবুও তেজ কমেনি। তিনি পূর্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘মা ডা মইরা যাওয়ার পর থেকে এই ছেড়ি দস্যি হইয়া গেছে। এত বড়ো ছেড়ি বুড়া হইতাছে। বড়ো বইনে বিয়া দেয় না। কোনদিন কোন কাম ঘটায় আল্লায় জানে। তা, লিখন, দুপুরের খাবার খাইছো?’
লিখনের ইচ্ছে হচ্ছে না এই কুৎসিত ভাবনার লোকটার জবাব দিতে। যেহেতু সে এই বাড়ির অতিথি, তাই মনের কথা শুনতে পারল না। বলল, ‘জি না।’
খলিলকে উপেক্ষা করে আলগ ঘরে চলে গেল মৃদুল। পূর্ণা আলগ ঘরের পেছনের বারান্দায় এসে দাঁড়াল, মৃদুল তার পেছনে। কোমল স্বরে বলল, ‘খালুর কথায় কষ্ট পাইছো?’
পূর্ণা মৃদুলের দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল, ‘আপনি কারো কষ্টের কথা ভাবেন দেখে ভালো লাগল।’
‘সবসময় ত্যাড়া কথা কেন কও? আমি যদি আগে জানতাম তোমারে কালি কইলে তোমার এত্ত কষ্ট হয়, তাইলে কইতাম না।’
পূর্ণা তাকাল। পূর্ণার দৃষ্টি দেখে মৃদুলের মন কেমন করে ওঠে। এ দৃষ্টির নাম বোধহয় মন কেমন করা দৃষ্টি’। পূর্ণা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, মাফ চাইছেন?’
মৃদুলের জোড়া ভ্রু কুঁচকে আসে। দুই পা পিছিয়ে যেয়ে বলল, ‘জীবনেও না।’
.
পদ্মজা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো রান্নাঘরে ঢুকে ফরিনাকে বলল, ‘আম্মা, কী হয়েছে আপনার?’
ফরিনা প্রবল বিস্ময়ে জানতে চাইলেন, ‘কেন? কী হইব আমার?’
ফরিনার ব্যবহারে পদ্মজা অবাক। সে কিঞ্চিৎ হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল। ফরিনা নিশ্চিন্ত মনে চুলা থেকে পাতিল নামালেন। তারপর বললেন, ‘ও পদ্মজা, মগারে একটু কইবা লিখন-মৃদুলরে ডাইকা আনতে। লিখন ছেড়াডা কহন আইছে। এহনও খায় নাই।’
পদ্মজা আর ঘাঁটল না ফরিনাকে। সে বুঝে গেছে কোনো জবাব পাবে না। সদর ঘরে পার হতেই সদর দরজায় মৃদুল এবং লিখনের দেখা পেল। পদ্মজা চট করে আঁচল দিয়ে মাথা ঢেকে নিয়ে বলল, ‘আপনারা এখানে এসে বসুন। আম্মা আপনাদেরই খোঁজ করছিলেন।’
কথা শেষ হতেই পদ্মজা সদর ঘর ছেড়ে রান্নাঘরে চলে গেল। আবিষ্ট হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল লিখন। সেই পুরনো দিনের মতোই তার স্বপ্নের প্রেয়সী এক ছুটে পালিয়ে বেড়ায়। পার্থক্য শুধু—আগে লজ্জায় পালাত, এখন অস্বস্তিতে। লিখন গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পদ্মজাকে এক ঝলক দেখার জন্য এই বাড়িতে সে পা দিয়েছে। যাকে মনপ্রাণ উজার করে ভালোবাসে তার স্বামীর বাড়িতে আসা কতটা কষ্টের তা শুধু তার মতো অভাগারাই জানে। মৃদুল লিখনের দৃষ্টি খেয়াল করে কিছু একটা আন্দাজ করে বলল, ‘পদ্মজা ভাবিকে চিনেন?’
‘চিনব না কেন—’
লিখন থেমে গেল। সে নিজের অজান্তেই কী বলে দিচ্ছিল! হেসে বলল, ‘এতসব জেনে কী হবে? আসো গিয়ে বসি। তারপর বলো, কখনো প্রেমে পড়েছো?’
‘না মনে হয়।’ উদাসীন হয়ে বলল মৃদুল।
‘নিশ্চিত হয়ে বলো।’
মৃদুল ভাবল, কোন নারীর প্রতি তার আকর্ষণ বেশি কাজ করেছে। উত্তর পেয়েও গেল। সকালেই সে পূর্ণার মধ্যে অদ্ভুত কিছু পেয়েছে। অজানা অনুভূতি অনুভব করেছে। এটা কী প্রেম? মৃদুল নিশ্চিত নয়। তাই সে বলল, ‘না, পড়ি নাই।’
‘আচ্ছা, সেসব বাদ। বিয়ে করছো কবে সেটা বলো।’
‘উমম, হুট করে একদিন। আমার ইচ্ছা আমি হুট করে একদিন বিয়ে করে আম্মারে চমকে দেব।’
লিখন সশব্দে হাসল। বলল, মানুষের সব চাওয়া পূরণ হয় না। প্রতিটি মানুষের জীবনের কোনো না কোনো পাশে অপূর্ণতা থাকে।’
‘তাহলে বলছেন আমার এই ইচ্ছে পূরণ হইব না?’
‘না তা বলছি না। হুট করে বিয়ে করে ফেলা আর কেমন অসম্ভব কাজ? মেয়ে রাজি থাকলেই হলো। মেয়ে বেঁকে গেলে কিন্তু কিচ্ছা খতম।’
লিখন আবারও সশব্দে হাসল। মৃদুলও অকারণে তাল মিলিয়ে হাসল। সে ভাবছে, একটা মানুষ এত হাসতে পারে কীভাবে? এত সুখী লিখন শাহ?
সে তো আর জানে না দুঃখীরা পাহাড় সমান কষ্ট লুকোয় হাসির আড়ালে।
.
ধীরে ধীরে বাড়ির সবাই বৈঠকখানায় জমা হলো, আমির ছাড়া। রিদওয়ান, খলিল এত শান্ত আচরণ করছে যে মনেই হচ্ছে না সকালে এত বড়ো ঘটনা ঘটে গেছে। বাড়ির মহিলারা দৌড়ে দৌড়ে খাবার পরিবেশন করছে। পদ্মজা খুব অবাক হয়ে প্রতিটি মানুষকে পর্যবেক্ষণ করছে। লিখনও এতে কম অবাক হয়নি। কত শান্ত পরিবেশ! ঝগড়ার পর মান-অভিমান, তর্ক-বিতর্ক থাকে। সেসব কিছুই নেই। পদ্মজা সবার সামনে আলাদা প্লেটে খাবার নিয়ে ফরিনাকে বলল, ‘আম্মা, আমি উনার জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি। ঘুম ভেঙেছে হয়তো।
পদ্মজা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছে। লিখন সেদিকে আড়চোখে তাকিয়ে রইল। পদ্মজার হাঁটার ছন্দ দৃপ্ত ও সাবলীল। মাথায় শাড়ির আঁচলে ঘোমটা টানা। স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে। এই স্বামীটা কী সে হতে পারত না? এতটাই অযোগ্য ছিল? অযোগ্য নাকি নিয়তির খেলা? কেন ভোলা যায় না এই নারীকে?
লিখনের বোন লিলি আর পদ্মজা একই ক্যাম্পাসের হওয়া সত্ত্বেও লিখন কখনো পদ্মজার সামনে এসে দাঁড়ায়নি, পদ্মজার অস্বস্তি হবে ভেবে। সে পদ্মজার চোখে ভালোবাসা দেখতে চায়, বিব্রতভাব বা অস্বস্তি দেখতে চায় না। এ যে বড়ো যন্ত্রণার। এতদিনেও বুকের ভেতর কীভাবে পুষে আছে এক পাক্ষিক ভালোবাসা? কোনোভাবে কী এই ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে! আসবে কী সেই সুদিন? লিখনের শুষ্ক চক্ষু সজল হয়ে ওঠে। সে ভাবতে পারে না, পদ্মজা বিবাহিত! লিখনের ঠিক সামনেই মৃদুল ছিল, লিখনের প্রতিক্রিয়া দেখে অনেক কিছুই বুঝে নিলো। নিশ্চিত হওয়া যাবে পূর্ণাকে জিজ্ঞাসা করলে। খাওয়াদাওয়া শেষ করে পূর্ণার সঙ্গে কথা বলতে হবে। মৃদুল চারিদিকে চোখ বুলিয়ে কাঙ্খিত রমণীকে খোঁজে।
.
পদ্মজা আমিরকে ধরে ধরে বসাল। ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা। টিকে থাকাই দায়। রাগে কিড়মিড় করছে এখনো। পদ্মজা তাকে শান্ত করে খাইয়ে দিল। খাওয়া শেষে আমির ম্লান হেসে বলল, ‘লিখনের সঙ্গে কথা হয়েছে?’
পদ্মজা নিষ্কম্প স্থির চোখে তাকাল, ‘উনার সঙ্গে কেন কথা হতে যাবে আমার?’
‘উনি তো তোমার জন্যই এসেছেন।’
‘আপনাকে বলেছে? অন্য দরকারেও আসতে পারে।’
আমির হাসল। বলল, ‘সে আজও তোমাকে পছন্দ করে। আশা করে তুমি তার কাছে যাবে।’
‘অসম্ভব। যা তা বলছেন। আপনি এসব বললে আমার খারাপ লাগে।’
পদ্মজা থামল। আমির মৃদু হাসছে। পদ্মজা আমিরের কোলে মাথা রেখে আদুরে কণ্ঠে বলল, আপনি জানেন না আপনাকে কত ভালোবাসি আমি? আমি আপনাকে ছাড়া এক মুহূর্তও ভাবতে পারি না।’
‘তাহলে বাচ্চার জন্য বিয়ে করতে বলো কেন?’
‘বন্ধ্যা নারীর কত যন্ত্রণা, বুঝবেন না।’
‘আমাদের একটা মেয়ে হয়েছিল।’
‘আর হবে না তাই বলি।’
‘হবে, আল্লাহ চাইলে হবে। তাছাড়া আমার কাছে তো ফুটফুটে একটা বউই আছে। আর কী লাগে?
পদ্মজা আমিরের কোল থেকে মাথা তুলে উঠে বসে। চিরুনি দিয়ে আমিরের চুল আঁচড়ে দিতে দিতে বলল, ‘চুলগুলো বড়ো হয়েছে অনেক। ‘
‘হু, এদিকে আসো।’
আমির পদ্মজাকে এক হাতে টান দিতে গিয়ে ঘাড়ে চাপ খেয়ে ‘আহ’ করে উঠল। পদ্মজা ব্যস্ত হয়ে পড়ল, ‘খুব লেগেছে? আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। কেন এমন করেন আপনি!
তেজহীন দুপুরের সূর্যটা একটু একটু দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার ডুবেও যাবে। পূর্ণা লবণ দিয়ে টক বরই খাচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে অমৃত! মৃদুল পূর্ণার পাশে এসে বসতেই পূর্ণা চমকে উঠে। মৃদুলকে দেখে বুকে থুতু দেয়। তারপর বাজখাঁই কণ্ঠে বলল, ‘হুট করে এভাবে কেউ আসে?’
আর কথা কইও না। তোমারে সারা দুনিয়া খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি। মাত্র মগা কইল তুমি নাকি ছাদে।’
‘কেন? আমাকে খুঁজছেন কেন?’
‘এমনে খ্যাট খ্যাট কইরা কথা কইতাছ কেন? একটু ভালো কথা আহে না মুখে?’
পূর্ণা একটু নড়েচড়ে বসল। হেসে বলল, ‘দুঃখিত। এবার বলুন কী দরকার।’
‘ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতাম আর কী!
‘আমার ব্যক্তিগত কোনো তথ্য নেই।’
‘তোমার না, তোমার বড়ো বইনের। পদ্মজা ভাবির।’
পূর্ণা উৎসুক হয়ে তাকাল। মৃদুল উশখুশ করতে করতে বলল, ‘পদ্মজা ভাবি আর লিখন ভাইয়ের মধ্যে কী কোনো সম্পর্ক ছিল?’
পূর্ণা জোরে নিশ্বাস ছাড়ল। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে মৃদুল কোনো ফালতু প্রশ্ন করেছে। নির্বিকার কণ্ঠে বলল, ‘না। তবে লিখন ভাই আপাকে পছন্দ করত। আপার সঙ্গে ভাইয়ার বিয়েটা কীভাবে হয়েছে জানেন?’
‘আমির ভাইয়ের কথা বলছো?’
‘আপার কী আর কোথাও বিয়ে হয়েছে?’
‘সোজা উত্তর দিতে পারো না? তারপর বলো।’
‘ওই ঘটনাটা না হলে হয়তো লিখন ভাইয়ের সঙ্গেই আপার বিয়েটা হতো। কিন্তু হয়নি। এতটুকুই।’
‘লিখন ভাইরে দেখলে মনে হয় তাদের মধ্যে কোনো গভীর সম্পর্ক ছিল। তারপর বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। ভাই অনেক ভালোবাসতে পারে।’
‘হু।’ পূর্ণা বরই খাচ্ছে তৃপ্তি করে।
মৃদুল বিরক্তি নিয়ে অনেকক্ষণ পূর্ণার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর উঠে দাঁড়াল এক পাশে; চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলো চারপাশ। পূর্ণা বাঁকা চোখে মৃদুলকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করে নিলো, মৃদুলের উপস্থিতি তার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়, বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করে। তবে তা প্রকাশ করার সাহস হয় না। পূর্ণা আরেকটা বরই হাতে নিলো। তখন মৃদুল ডাকল, ‘বেয়াইন।’
পূর্ণা তাকাল। মৃদুল ঝুঁকে ছাদের মেঝেতে কিছু দেখছে। পূর্ণা উৎসুক হয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। মৃদুল আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘রক্ত না?
পূর্ণা মৃদুলের মতো ঝুঁকে ভালো করে খেয়াল করল। তারপর বিস্ফোরিত কণ্ঠে বলল, ‘তাই তো।
‘মানুষের রক্ত না পশুর রক্ত, বুঝতাম কেমনে?’
‘পশুর রক্ত এইখানে আসবে কেন?’
‘মানুষের রক্তই বা কেন আসবে?’
‘তাই তো!’
দুইজন চিন্তিত হয়ে ভাবতে থাকল। পূর্ণা বলল, ‘মনে হয় কোনো পাখি শিকার হয়েছে। আর রক্তাক্ত অবস্থায় এখানে এসে পড়েছে।’
‘তাহলে মরা পাখিডা কই?’
‘ধরুন, আহত হয়েছে কিন্তু মরেনি। এরপর চলে গেছে।’
.
সন্ধ্যারাত, জোনাকিপোকারা ছুটে বেড়াচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস। সেই বাতাসে পাতলা শার্ট পরে লিখন দাঁড়িয়ে আছে নারিকেল গাছের নিচে, জোনাকি পোকা দেখছে। মাঝেমধ্যে অন্দরমহলের দিকে তাকিয়ে কাউকে চোখ দুটি খুঁজছে। সেদিন হেমলতা ফিরিয়ে দেয়ার পর, সারা রাত বাড়ি ফেরেনি সে। খেতে বসে ছিল, আকাশ কাঁপিয়ে কেঁদেছে। কেউ শোনেনি। স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার মতো কষ্ট দুটো নেই। স্বপ্নে সাজানো সংসার ভেঙে চুরমার হওয়ার দিন ছিল সেদিন। এক সময় ইচ্ছে হয়েছিল পদ্মজাকে তুলে নিয়ে পালাতে। কিন্তু বিবেক সাড়া দেয়নি। পরদিন সকালে উঠেই মা-বাবাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। প্রতিটা মুহূর্তে আফসোস হয়, শুরুতে কেন হেমলতার কাছে প্রস্তাব দিতে পারল না!
পরবর্তী কয়েকটা মাস ঘোরের মধ্যে কেটেছে। সিনেমা জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। বছরখানেক লেগেছিল জীবনের গতি স্বাভাবিক করতে। কিন্তু মন…মন তো ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। আজও জোড়া লাগেনি। পদ্মজা কী কখনো জানবে, সে ঢাকায় কতবার পদ্মজার পিছু নিয়েছে? জানবে কী তার ভালোবাসার গভীরতা?
লিখন আনমনে হেসে উঠল। চোখে জল ঠোঁটে হাসি! এ হাসি সুখের নয়, যন্ত্রণার। নিজের প্রতি উপহাস!
পূর্ণা অন্দরমহলে আসেনি। পদ্মজা ভীষণ রেগে আছে। আলগ ঘরের বারান্দায় সারাক্ষণ কী করে এই মেয়ে? এর আগেও যখন পারিজা তার পেটে ছিল, পূর্ণা তখন এই বাড়িতে ছিল অনেকদিন। তখনো মাঝরাত অবধি আলগ ঘরের বারান্দায় বসে থাকত। পদ্মজা গায়ে শাল জড়িয়ে বেরিয়ে আসে অন্দরমহল থেকে। সারাদিন পূর্ণার খোঁজ নেয়া হয়নি। এখন ধরে ঘরে নিয়ে যাবে। নির্জন, থমথমে পরিবেশ।
তখন লিখনের কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘পদ্মজা?’
কণ্ঠটি শোনামাত্র ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠে পদ্মজা, অপ্রতিভ হয়ে যায়। একটা মানুষ কেন তাকে এত বছর মনে রাখবে? কেন অনুচিত আশা নিয়ে বসে থাকবে? পদ্মজার রাগ হয়, অস্বস্তি হয়। কষ্টও হয়। প্রার্থনা করে, এই মানুষটার জীবনে কেউ আসুক। এসে তার জীবনটা কানায় কানায় পূর্ণ করে দিক। ভুলিয়ে দিক অতীত। পদ্মজা স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘এভাবে রাতের বেলা ডাকবেন না।’
পদ্মজা লিখনকে উপেক্ষা করে দুই পা এগিয়ে যায়।
‘জীবন থেকে তো সরেই গিয়েছো। আমি তোমাকে বিব্রত করতে চাই না। তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সামনে আসিনি। আজ যখন এসেই পড়েছি, কয়েক হাত দূরে থেকেই একটু কথা বললে কী খুব বড়ো দোষ হয়ে যাবে?’
লিখনের করুণ কণ্ঠ শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে পদ্মজা। হাসল লিখন, সুরগুলি যেন ফিরে এসে প্রাণে মৃদুগুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে। পদ্মজার উপস্থিতি এভাবে কাঁপন ধরাচ্ছে কেন!
আজকের এই সময়টা সুন্দর, ভারী সুন্দর!