৫
মধ্যখানে চাদর টানিয়ে দুই ভাগ করা হয়েছে লাহাড়ি ঘরকে। একপাশের চৌকিতে হেমলতা এবং মোর্শেদ থাকেন। অন্যপাশেরটা পদ্মজা, পূর্ণা ও প্রেমার দখলে। লাহাড়ি ঘরের পেছনের দরজাটি আপাতত প্রধান দরজা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ঘরের পেছনে অসংখ্য কচু গাছ ছিল। হেমলতা মোর্শেদকে নিয়ে সব কচু কেটে জায়গা খালি করে সেখানে তৈরি করেছেন মাটির চুলা। বড়ো সড়কে ওঠার জন্য ঝোপঝাড় কেটে সরু করে পথ করা হয়েছে। এতে অবশ্য মোর্শেদের মত ছিল না। সড়কে ওঠার একটা পথ থাকতে আরেকটা পথ তৈরি করার বিপক্ষে তিনি। হেমলতা দুই মেয়েকে নিয়ে সব ঝোপঝাড় সাফ করেছেন। শুটিং দলে অনেক পুরুষ। পদ্মজাকে ভুলেও তাদের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করতে দেওয়া যাবে না। হেমলতার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, পদ্মজার মুখ পুড়িয়ে দিতে। পরক্ষণেই নিজের ওপর ঘৃণা হয়। একজন মায়ের মনে কী করে নিজের মেয়েকে নিয়ে এমন ভাবনা আসতে পারে? পদ্মজার হাতে সূচ ফুটলে তার মনে হয় নিজের শরীরে আঘাত লেগেছে। কেন এত টান পদ্মজার প্রতি? ভেতরে ভেতরে এই প্রশ্নের উত্তর তিনি জানেন। শুধু প্রকাশ পায় না, না জানার ভান ধরে থাকেন।
থাকতে হয় তাকে।
‘আম্মা, আজ আমি রাঁধি?’
পদ্মজার প্রতিদিনকার প্রশ্ন! হেমলতা রাঁধতে দেবেন না জানা সত্ত্বেও পদ্মজা প্রতিদিন অনুরোধ করে। হেমলতা বিপদ-আপদ ছাড়া পদ্মজাকে রান্নাঘরে পাঠান না। সোনার শরীরে পাতিলের কালি লাগুক চান না তিনি। হেমলতা হাসেন, পদ্মজা মুগ্ধ হয়ে দেখে। হেমলতার বয়স ছয়ত্রিশ। শ্যামলা চেহারা, দাঁতগুলো ধবধবে সাদা; চোখের মণি অন্যদের তুলনার বড়ো এবং কালো, চোখ দুটিকে পদ্মজার গভীর পুকুর মনে হয়। ছিমছাম গড়ন। পূৰ্ণা যেনো মায়েরই কিশোরী শরীর। তবে তারা তিন বোনই মায়ের মতো চিকন আর লম্বা হয়েছে।
হেমলতা সম্মতি দিয়ে বললেন, ‘আজ তুই রাঁধবি।’
পদ্মজা ভাবেনি অনুমতি পাবে। সে আদুরে উল্লাসে প্রশ্ন করল, সত্যি আম্মা?’
‘সত্যি। আছরের আজান সেই কবে পড়েছে! দ্রুত যা।’
পদ্মজা রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্ণা-প্রেমা হিজল গাছের নিচে পাটি বিছিয়ে লুডু খেলছে। প্রেমা বার বার বাটপারি করায় এ নিয়ে কিছুকক্ষণ পর পর তর্কও হচ্ছে তাদের মাঝে।
সকালে বৃষ্টি হয়েছিল। রান্না করতে গিয়ে পদ্মজা ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ পেল। মাটির ঘ্রাণ তাকে খুব টানে।
মোর্শেদ বাড়ি ফিরে পদ্মজাকে রাঁধতে দেখে কপাল কুঁচকে ফেলেন। ঘরে ঢুকে হেমলতাকে মেজাজ দেখিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘এই ছেড়ি রান্ধে ক্যান?’
হেমলতা নির্লিপ্তভাবে জবাব দেন, ‘আমি বলেছি।’
‘কতদিন কইছি—এই ছেড়ির হাতের রান্ধন আমারে না খাওয়াইতে?’
মোর্শেদের কঠিন স্বর পদ্মজার কানে আসে। মায়ের অনুমতি পাওয়ার খুশিটুকু মুহূর্তে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। সে জানে এখন ঝগড়া শুরু হবে। তার আম্মা, আব্বার অনুচিত কথাবার্তা মাটিতে পড়তে দেন না। তার আগেই জবাব ছুঁড়ে দেন।
‘খেতে ইচ্ছে না হলে খাবা না।’
রাইতবেলা না খাইয়া থাকবাম আমি?’
‘খাবার রেখেও যদি না খেতে চাও সেটা তোমার সমস্যা। আমি বা আমার মেয়ে কেউই না করিনি।’
মোর্শেদ কিছু নোংরা কথা শোনাতে প্রস্তুত হোন। হেমলতা সেলাই মেশিন রেখে উঠে দাঁড়ান। তিনি বুঝে গিয়েছেন মোর্শেদ কী বলবেন। আঙুল তুলে শাসিয়ে মোর্শেদকে বললেন, ‘একটা নোংরা কথা উচ্চারণ করলে আমি আজ তোমাকে ছাড় দেব না। পদ্ম তোমার মেয়ে। আল্লাহ সইবে না। নিজের মেয়ে সম্পর্কে এত নোংরা কথা কোনো বাবা বলে না।’
মোর্শেদ নোংরা কথাগুলো হজম করে নিলেন। তবে কিড়মিড় করে বললেন, ‘পদ্ম আমার ছেড়ি না।’
‘পদ্ম তোমার মেয়ে। আর একটা কথাও না। বাড়িতে অনেক মানুষ। নিজের বিকৃত রূপ লুকিয়ে রাখ।’
মোর্শেদ দমে যান। চৌকিতে বসে বড়ো করে নিশ্বাস ছাড়েন। চোখের দৃষ্টি অস্থির। পদ্মজার জন্মের পর থেকেই হেমলতার রূপ পালটে গেছে। কিছুতেই এই নারীর সঙ্গে পারা যায় না। অথচ, একসময় হেমলতাকে কত মেরেছেন! হেমলতার পিঠে, উরুতে, ঘাড়ে এখনো মারের দাগ আছে। সময় কোন যাদুবলে হেমলতাকে পালটে দিল, জানা নেই মোর্শেদের।
.
রাতের একটা শুট করে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছিল। চিত্রা তখন কথায় কথায় জানাল, ‘মগা যে মেয়েটার কথা বলেছিল, তাকে দেখতে লাহাড়ি ঘরে গিয়েছিলাম।’
চিত্রার কথায় লিখন আগ্রহ পেল না। মেয়েটা কখনো কোনো মেয়ের প্রশংসা করে না। খুঁত খুঁজে বের করে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে তার ভীষণ আগ্রহ। নিজেকে সে খুঁতহীন সেরা সুন্দরী মনে করে। ‘মেয়েটার নাম পদ্মজা। মগা, পুরো নামটা যেন কী?’
চিত্রা ওর সঙ্গে কথা বললে, মগা খুব লজ্জা পায়। এখনো পেল। লাজুক ভঙ্গিতে জবাব দিল, ‘উম্মে পদ্মজা।’
‘হ্যাঁ, উম্মে পদ্মজা।’
চিত্রার পাশ থেকে সেলিনা পারভীন প্রশ্ন করলেন, ‘কী নিয়ে আলাপ হচ্ছে?’
সেলিনা পারভীন চলমান চলচ্চিত্রে চিত্রার মায়ের অভিনয় করছেন। চিত্রা বলল, ‘এই বাড়ির মালিক যিনি, উনার বড়ো মেয়ের কথা বলছি। এমন সুন্দর মুখ আমি দুটি দেখিনি। মেয়েটার মুখ দেখলেই বুকের ভেতর নিকষিত, বিশুদ্ধ ভালো লাগার জন্ম হবে। ভগবান এত শ্রী দিয়েছেন মেয়েটাকে!
হতবাক হয়ে গেল লিখনসহ উপস্থিত প্রত্যেকে। চিত্রার মুখে অন্য নারীর প্রশংসা! অবিশ্বাস্য! সবাইকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে বিব্রতবোধ করল চিত্রা। গলার জোর বাড়িয়ে বলল, ‘সত্যি বলছি! সন্ন্যাসী ছাড়া কোনো পুরুষ এই মেয়েকে উপেক্ষা করতে পারবে না।’
পদ্মজাকে নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ আলোচনা চলল তাদের মাঝে। আগ্রহ বেশি দেখাল লিখন। কিন্তু যখন শুনল পদ্মজার ষোলো বছর, তখন দমে গেল। ছোটো মেয়ে! হয়তো এমন বয়সি বেশিরভাগ মেয়েরা স্বামীর ঘরে থাকে, তবুও লিখনের পদ্মজাকে খুব ছোটো মনে হচ্ছে। তার একটা বোন আছে, ষোলো বছরের। এখনো দুই বেণি করে স্কুলে যায়, কত ছোটো দেখতে! নিজের ক্ষণ-সময়ের অভিলাষের কথা ভেবে আনমনে হেসে উঠল লিখন। চিত্রা তখনো পদ্মজার রূপের প্রশংসা করছিল।
.
হিজল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা। রাতের জোনাকি পোকা চারিদিকে। পদ্মজা প্রায় রাতে মুগ্ধ হয়ে দেখে জোনাকি পোকাদের। মনে হয় দল বেঁধে হারিকেন নিয়ে নাচছে তারা! তবে এই মুহূর্তে রাতের সৌন্দর্যটুকু পদ্মজার মনে দাগ কাটতে পারছে না। ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে সে, খুব জ্বলছে চোখ দুটো। রান্না খারাপ হওয়ার অজুহাতে থালা ভরতি ভাত-তরকারি তার মুখে ছুঁড়ে দিয়েছেন মোর্শেদ। চোখে ঝোল পড়েছে, তা নিয়ে হেমলতার সে কী রাগ! মোর্শেদ অবশ্য চুপ ছিলেন। তিনি তো রাগ মিটিয়েই ফেলেছেন। আর তর্ক করে কী হবে?
পেছনে এসে হেমলতা দাঁড়ালেন। ডাকলেন, ‘পদ্ম?’
পদ্মজা তাকাল।
হেমলতা ভেজা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘খুব জ্বলছে?’
পদ্মজা জবাব দিতে পারল না। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠল। মা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই তার। মা বাদে আর কারো আদরও পাওয়া হয়নি। সবাই তার দোষ খোঁজে। হেমলতার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোল। পদ্মজা ছিঁচকাঁদুনে। ছোটো থেকে বাবার অনাদর আর অপমানে বিদ্ধ হয়ে কেঁদে চলেছে তবুও চোখের জল ফুরোয় না, মন শক্ত হয় না। এমন হলে তো চলবে না!
পদ্মজার কান্নার বেগ বাড়ল। হেমলতা সদ্য কাটা বড়ো গাছটির গুঁড়িতে বসে, চুপ করে পদ্মজার ফোঁপানো শুনছেন। একটিবারের জন্যও কান্না থামানোর চেষ্টা করলেন না। যখন চাঁদ মাথার উপরে চলে এলো তখন ক্লান্ত হয়ে পদ্মজা নিজেই থেমে গেল। শান্ত হয়ে বসল মায়ের পাশে। হেমলতা উদাস গলায় বললেন, ‘এভাবে চলবে না পদ্ম।
পদ্মজা মায়ের দিকে তাকাল। হেমলতা বললেন, ‘শোন পদ্ম, কেউ আঘাত করলে কাঁদতে নেই। কারণ মানুষ আঘাত করে কাঁদানোর জন্যই। যখন উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায় তখন তারা শান্তি পায়। যে তোকে আঘাত করল তাকে কেন তুই শান্তি দিবি? শক্ত থাকবি। বুঝিয়ে দিবি তুই এত দুর্বল না। যাকে তাকে পাত্তা দিস না। হাজার কষ্টেও কাঁদবি না। কান্না সাময়িক সময়ের জন্য মন হালকা করে। পুরোপুরি নয়। যে তোকে আঘাত করবে তাকে তুই তোর চাল-চলন দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিবি। তখন তার মুখটা দেখে তোর যে শান্তিটা হবে সেটা কান্না করার পর হবে না। এই শান্তি স্থায়ী!’
হেমলতার কথা পদ্মজার ওপর প্রভাব ফেলল না। সে করুণ স্বরে বলল, ‘কিন্তু আব্বার ব্যবহার আমার সহ্য হয় না আম্মা। আমার সঙ্গে কেন এমন করে আব্বা?
‘তাকে কখনো সামনাসামনি আব্বা ডাকার সুযোগ পেয়েছিস? পাসনি! তবুও কেন আব্বা-আব্বা করিস? তুইও তাকে পাত্তা দিবি না।’
‘তুমি খুব কঠিন আম্মা।’
‘তোকেও হতে হবে।’
‘আব্বা কেন এমন করে, আম্মা? আমি কি আব্বার মেয়ে না? আব্বা কেন বার বার বলেন, আমি তার মেয়ে না।’
এহেন প্রশ্নে হেমলতা চোখ সরিয়ে নিলেন। পদ্মজা জানে এই জবাব সে পাবে না। সে দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল।
হেমলতা পরম স্নেহে একহাত পদ্মজার মাথায় রেখে বললেন, ‘কাঁদিস না আর। মায়ের রং না হয় পাসনি। মায়ের মতো শক্ত হওয়ার তো চেষ্টা করতেই পারিস।’
পদ্মজা নির্লজ্জ হয়ে আবার প্রশ্ন করল, ‘আম্মা, আমি কি আব্বার মেয়ে না? বলো না আম্মা।’
পদ্মজার চোখ বেয়ে জল পড়ছে। মায়া হচ্ছে হেমলতার, বুক ভারি হয়ে আসছে। তিনি আবেগ লুকিয়ে কণ্ঠ কঠিন করার চেষ্টা করলেন, ‘মার খাবি, পদ্ম। কতবার বলব, তুই আমার আর তোর আব্বার মেয়ে!’
‘কী নাম আমার আব্বার?’
কী শান্ত কণ্ঠ পদ্মজার! হেমলতা চমকালেন, তবে তা প্রকাশ করলেন না। মেয়েদের সামনে তিনি কখনো দুর্বল হতে চান না। পদ্মজার দিকে ঝুঁকে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন, ‘তোর আব্বার নাম, মোর্শেদ মোড়ল।’
পদ্মজা হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মার ওপর বিরক্তি জন্মাছে, খুব কঠিন করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, যাও এখান থেকে। আমার কাছে আর আসবে না। কখনো না।’
কিন্তু এমন ব্যবহার কখনো করতে পারবে না সে…কক্ষনো না। রাতের বাতাসে ভেসে আসছে হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণ, আকাশে থালার মতো চাঁদ; ঝিরিঝিরি মোলায়েম বাতাস চারিদিকে। পদ্মজার চোখের জল শুকিয়ে যায়। হেমলতা ঝিম মেরে বসে আছেন। মা-মেয়ে পাশাপাশি বসে থেকেও যেন কত দূরে! নিজেদের মতো ভেবে যাচ্ছে এটা-সেটা নিয়ে। হঠাৎ নিস্তব্ধতা কাটিয়ে একটা অসহায় কণ্ঠ ভেসে এলো: ‘মায়েরা তাদের জীবনের গোপন গল্প সন্তানদের বলতে পারে নারে পদ্ম।’
পদ্মজা তাকাল। হেমলতা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। এই মানুষটাকে এত নরম রূপে মানায় না।
মাকে আশ্বস্ত করে পদ্মজা বলল, ‘আমি আর কখনো জানতে চাইব না আম্মা।’
শুটিং দলের একজনও বাড়িতে নেই। সবাই স্কুল মাঠে গেছে। কয়দিন ধরে নদীর ঘাটে যেতে না পেরে তৃষ্ণার্থ হয়ে উঠেছে পদ্মজা। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। হেমলতার অনুমতি নিয়ে সে ঘাটে চলে যায়, সিঁড়িতে বসে আয়েশ করে। কয়েক মুহূর্ত পর শুনতে পায়, গান বাজছে কোথাও। পদ্মজা গানের সুর অনুসরণ করে নিচের দিকে নামে। ঘাটের বাঁ- পাশে বাঁধা নৌকায় একজন পুরুষ বসে আছে, হাতে রেডিয়ো। গানের উৎস তাহলে এখানেই। পদ্মজা বিব্রতবোধ করে। দ্রুত উলটো দিকে ঘুরে ব্যস্ত পায়ে চলে আসে লাহাড়ি ঘরে। তাকে এত দ্রুত ফিরতে দেখে হেমলতা প্ৰশ্ন করলেন, ‘কেউ ছিল?’
পদ্মজা ওপর-নিচে মাথা নাড়াল। হেমলতা চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কিছু বলেছে? দেখতে কেমন?’
‘না, আম্মা, কিছু বলেনি। আমাকে দেখেনি। মাথার চুল ঝাঁকড়া। মুখ খেয়াল করিনি।’
পূর্ণা অংক করছিল। পদ্মজার মুখে আগন্তুকের বর্ণনা শুনে হই হই করে উঠল, ‘এইটাই তো লিখন শাহ, নায়ক।’
হেমলতা আড়চোখে মেয়ের দিকে তাকান। নায়ক-নায়িকাদের প্রতি পূর্ণার যে তীব্র আগ্রহ, তা ভালো লাগে না তার। পূর্ণা মায়ের চাহনি দেখে দমে যায়।
সারাক্ষণ শুটিং দলের আশপাশে ঘুরঘুর করে মেয়েটা। হেমলতা বিরক্ত হয়ে তাকে কড়া নিষেধ দিয়েছেন, আর যেন না যায়; যদি যায়…মার একটাও মাটিতে পড়বে না। পূর্ণা ভয় পেয়েছে। কিন্তু লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী জুটিটা এত ভালো লাগে তার যে শুটিং না দেখলে দম বন্ধ হয়ে আসে। তাই সে চুপিসারে টিনে একটা ছিদ্র করেছে। হেমলতা সেলাই মেশিন রেখেছেন লাহাড়ি ঘরের পেছনের বারান্দায়, সারাক্ষণ সেখানেই থাকেন। সেই সময় পূর্ণা ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিয়ে শুটিং দেখে।
পূর্ণার এই আচরণ দেখতে দেখতে একদিন পদ্মজারও আগ্রহ জন্মাল। সাত-পাঁচ ভেবে একদিন উঁকি দিয়ে বসল সে-ও।
ঝাঁকড়া চুলের মানুষটি একজন অতি সুন্দরী মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছে। মানুষটির দৃষ্টি মোহময়। বাড়ি জুড়ে গানের সুরধ্বনি। কেউ কেউ ক্যামেরা ধরে রেখেছে। গানের শুটিং চলছে বোধহয়! অদ্ভুত ঠেকছে পদ্মজার, লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিলো সে।
৬
রাতে ঝড় উঠেছিল। লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে বহু গাছপালা। লাহাড়ি ঘরের পেছনে তৈরি পথ বন্ধ হয়ে গেছে গাছের ভাঙা ডালপালা পড়ে। মোর্শেদ রাতে বাড়ি ফেরেননি। হেমলতার একার পক্ষে সম্ভব নয় ডালপালা সরানো। তাই পদ্মজা আর পূর্ণা স্কুল থেকে ফিরছিল বাড়ির সামনের পথ দিয়ে। উঠোনে শুটিং দলের সবাই উপস্থিত। পদ্মজার মাথা নত, ঘোমটা টানা লম্বা করে। এত মানুষের সামনে দিয়ে যেতে তার হাঁটু কাঁপছে। আজ যেন পথ শেষই হচ্ছে না। উপস্থিত অনেকের নজরে চলে এলো পদ্মজা। মিলন নামে একজন পূর্ণাকে ডাকল, ‘এই পূৰ্ণা!’
পূর্ণা দাঁড়াল, সঙ্গে পদ্মজা; যদিও মেয়েটা শুটিং দলটির দিকে তাকাচ্ছে না। মিলন পদ্মজার দিকে চোখ স্থির রেখে পূর্ণাকে প্রশ্ন করল, ‘পাশের মেয়েটা কে? প্রথম দেখছি।’
‘আমার বড়ো আপা।’
‘আপন?’
মিলন আশ্চর্য হয়ে বলল। দশ দিন হলো তারা এখানে এসেছে, কখনো পূর্ণা-প্রেমা ছাড়া কোনো মেয়েকে চোখে পড়েনি, কণ্ঠও শোনা যায়নি। তাই বড়ো বোন বলাতে সে খুব অবাক হলো। পূর্ণা হেসে বলল, ‘হুম। আপন। ‘
মিলন বিড়বিড় করে বলল, ‘চেহারায় তো মিল নেই।’
‘সবাই বলে।’
‘আচ্ছা, যাও।’
দুই বোন লাহাড়ি ঘরে চলে যায়, হাঁফ ছেড়ে বাঁচে পদ্মজা। ভেতরটা এত কাঁপছিল! সে অনেক মানুষের পা দেখেছে, তবে চোখ তুলে তাদের মুখ দেখার সাহস হয়নি। কিন্তু হ্যাঁ…ইচ্ছে হয়েছিল বটে! সিনেমায় যারা অভিনয় করে, তারা দেখতে কেমন? সাধারণ মানুষের মতোই?
নাকি অন্যরকম?
.
বিকেলে হাজেরা নামক এক মহিলা আসে মোড়ল বাড়িতে, সে সবুর মিয়ার স্ত্রী। সবুর দিনরাত গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে, বউ-বাচ্চাদের খোঁজ রাখে না। হাজেরা এর-ওর বাড়ি গিয়ে এটা-ওটা চেয়ে নেয়, খায় দুই বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে। পদ্মজার খুব মায়া হয় হাজেরার জন্য। মহিলা আসতেই হেমলতা পদ্মজাকে প্রশ্ন করলেন, ‘গাছে কয়টা লাউ আছে?’
‘নয়টা, আম্মা।’
‘পূর্ণা কোথায়? ওরে বল দুইটা লাউ হাজেরাকে দিয়ে দিতে। কাঁচামরিচও দিতে বলবি।’
পদ্মজার নীরবতা দেখে হেমলতা বুঝতে পারেন পূর্ণা বাড়িতে নেই। ‘পূর্ণা কী টিভি দেখতে গেছে?’
পদ্মজাকে দ্বিধাগ্রস্ত হতে দেখা গেল। বিব্রতভাবে বলল, ‘আম্মা, আমাকে ব…বলে গেছে।’
‘তুই ওর অভিভাবক? একটু শরীরটা খারাপ লাগছিল বলে শুয়েছিলাম। ওমনি সুযোগ লুফে নিয়েছে!
‘আম্মা, আমার দোষ। পূর্ণাকে কিছু বোলো না।
পদ্মজার ভেজা কণ্ঠ হেমলতার রাগ উড়িয়ে দিল। তিনি অন্য দিকে মুখ করে শুয়ে বললেন, ‘হাজেরাকে নিয়ে যা। ঘোমটা টেনে যাবি। বেগুন বেশি থাকলে কয়টা দিয়ে দিস।’
পদ্মজার মন ভরে গেল। তার মা এত বেশি উদার! কখনো কাউকে ফিরিয়ে দেন না। সামর্থ্যের মধ্যে আরো বেশি কিছু দেওয়ার মতো থাকলে, তিনি কখনো কার্পণ্য করেন না। তবে হাজেরার স্বভাব অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে, চুরি করার প্রবণতা আছে তার মাঝে। তাই পদ্মজাকে সঙ্গে যেতে বলেছেন।
উঠোনের এক কোণে, লাহাড়ি ঘরের ডান পাশে লাউয়ের মাচা। নয়টা লাউ ঝুলছে তাতে। চোখের সামনে শুধু তরতাজা, টাটকা সবুজ পাতা। পদ্মজা বাড়ির দিকে তাকাল না। একটা লাউ হাজেরার হাতে দিয়ে বলল, ‘কী দিয়ে রান্না হবে?’
‘জানি না গো পদ্ম। গিয়া দেহি মাছ মিলানো যায়নি।’
‘তোমার ছোটো ছেলের ঠান্ডা কমেছে?’
পদ্মজা কাঁচামরিচ ছিঁড়ে হাজেরার আঁচল ভরে দিল। হাজেরা গুঞ্জন করে কাঁদছে আর বলছে, ‘ছেড়াডা সারাদিন মাডিত পইড়া থাহে একলা একলা। রাইত হইলে জ্বরে কাঁপে। দম ফালাইতে পারে না।’
‘ডাক্তার দেখাচ্ছ না কেন?’
‘টেহা লাগব না? কই পামু?’
‘তুমি মাতব্বর বাড়িতে যাও। শুনছি, উনারা খুব দান-খয়রাত করেন।’
হাজেরা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। বেগুন গাছ বাড়ির পেছনে। সাবধানে বাড়ির পেছনে গেল পদ্মজা। সে মনে মনে ভাবছে—হাজেরার ছেলে সুস্থই আছে। সকালেই দেখেছে ছেলেটাকে, দিব্যি খেলাধুলা করছিল। দেখে যে কেউ বলবে: সুস্থ। হাজেরা মিথ্যা বলছে।
মানুষের খুব অভাব পড়লে বুঝি এমনই হয়?
‘এতো সবজি আছে! টমেটো নেই? পাওয়া যাবে?
পরিষ্কার সহজ গলায় বলা পুরুষালী কণ্ঠটা পদ্মজাকে মৃদু কাঁপিয়ে তুলল। ঘুরে তাকাল সে, ব্রিত বোধ করল লিখনকে দেখে। কারো সামনে নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করা উচিত না—কথাটি হেমলতা বলেছেন। পদ্মজা হাসার চেষ্টা করে জবাব দিল, ‘এই বর্ষাকালে টমেটো কোথায় পাবেন?
‘বর্ষাকালে টমেটো চাষ হয় না?’
‘টমেটো শীতকালীন ফসল।’
‘গ্রীষ্ম-বর্ষাতেও তো পাওয়া যায়।’
পদ্মজা অস্বস্তি লুকিয়ে রাখতে পারছে না। স্কুলের শিক্ষক আর খুব আপন মানুষগুলো ছাড়া কোনো পর-পুরুষের সঙ্গে তার কখনো কথা হয়নি। লিখনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জবান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে চুপচাপ বেগুন বুঝিয়ে দিল হাজেরাকে। লিখন বলল, ‘আমি তো গতবার বর্ষাকালেও টমেটোর সালাদ তৈরি করেছি!’
‘হয়তো টমেটোর জাত আলাদা ছিল। আমাদের এখানে সাধারণত শীতকালেই টমেটো হয়।’
দ্রুত জবাব দিয়ে লাহাড়ি ঘরে ফিরল পদ্মজা। মনে হচ্ছে পর-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে ঘোর পাপ করে ফেলেছে, পাপ মোচন করতে হবে। ঘরে ঢুকে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেল। হেমলতা ঘুমাচ্ছেন। নয়তো পদ্মজার মুখ দেখে নির্ঘাত বুঝে যেতেন, কিছু একটা ঘটেছে। পদ্মজা ভক্তি নিয়ে আল্লাহ তায়ালার প্রতি শুকরিয়া আদায় করল।
.
হেমলতা সালোয়ার-কামিজ সেলাই করছিলেন। তখন বারান্দার সামনে একজন পুরুষ লোক এসে দাঁড়াল। শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে নিলেন হেমলতা, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালেন লোকটা দিকে। লোকটি হেসে বলল, ‘আমি শুটিং দলের মিলন।’
হেমলতা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলেন। আড়চোখে তাকালেন ঘরের দরজার দিকে। পদ্মজা ঘুমাচ্ছে, দরজাটা লাগানো দরকার। তিনি সোজা প্রশ্নে চলে যান, ‘কোনো দরকার?’
‘না, এমনি দেখতে আসলাম। কতদিন হলো আপনাদের বাড়িতে উঠলাম। এদিকটায় আসা হয়নি।’
হেমলতা পেঁচিয়ে কথা বলা পছন্দ করেন না। সরাসরি বলে উঠলেন, ‘এদিকে আসা নিষেধ। আপনাদের বলা হয়নি?’
মিলনের জ্বলজ্বল করা চোখেমুখে ছায়া নেমে আসে, অপমানিত বোধ করল সে। আমতা আমতা করে বলল, ‘ইয়ে…আচ্ছা, আসছি।’
মিলন স্থান ত্যাগ করল। তবে যাওয়ার পূর্বে তার তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি হেমলতার নজর এড়াতে পারল না। হেমলতা চোখ বুজে জীবনের হিসেব কষেন, নরম দৃষ্টিতে তাকান ঘুমন্ত পদ্মজার দিকে। তিনি নিশ্চিত, এই লোক পদ্মজাকেই দেখতে এসেছিল।
এখন পূর্ণার চেয়ে পদ্মজার বেশি আগ্রহ শুটিং দেখার। টিনের ছিদ্র আরো দুটো করেছে। লিখন শাহকে দেখলে তার ঠান্ডা, কোমল অনুভূতি হয়। এই অনুভূতির নাম সে জানে না। শুটিংয়ে লিখন শাহ কত ভালোবাসেন চিত্রা দেবীকে, পদ্মজার দেখতে খুব ভালো লাগে।
পূর্ণা তেলের বোতল নিয়ে বলল, ‘আপা, তেল দিয়ে দাও না।’
‘সোনা বোন, একটু দাঁড়া।’
পদ্মজা ছিদ্র দিয়ে লিখন শাহর হাসি, কথা বলার ভঙ্গী দেখছে। লজ্জাও পাচ্ছে। সময়টাকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।
‘এই আপা। পরেও তো দেখতে পারবে। দিয়ে দাও না।’
‘আরেকটু। শুটিং শুরু হচ্ছে। একটু…’
পূর্ণার রাগ হয় খুব। কিন্তু সে আপাকে কিছু বলবে না। তার সব ইচ্ছের সঙ্গী, সব গোপন কথার স্বাক্ষী তার আপা। আপাকে খুব ভালোবাসে সে। মাঝে মাঝে মনে হয়…সেই ভালোবাসাটুকু যেন মায়ের প্রতি ভালোবাসার চাইতেও বেশি…কিংবা হয়তো না। পদ্মজা মিটিমিটি হাসছে। পূর্ণা তেল রেখে ছিদ্র দিয়ে উঁকি দিল।
নাহ! তার এখন ভালো লাগছে না এসব দেখতে। চোখ সরিয়ে নিলো সে।
‘কী রে পদ্ম? কী দেখছিস?’
হেমলতার কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল পদ্মজা। আরক্ত হয়ে উঠল তার গাল। ডাকাতি করতে গিয়ে বাড়ির মালিকের কাছে ধরা পড়লে যেমন অনুভূতি হয়, তেমন অনুভূতি হচ্ছে তার। উহু, এই অনুভূতি আরও বেশি ভয়ংকর! হেমলতার দৃষ্টি গেল টিনের ছিদ্রের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে পদ্মজা অনুভব করল, তঁর পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। পূর্ণা ভয়ার্ত চোখে একবার মাকে একবার বোনকে দেখছে।
ছিদ্রের গুরু তো সে! মারও সে খাবে।
৭
হেমলতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুই মেয়েকে দেখছেন। টিনের গায়ে তৈরি ছিদ্র তিনটের দিকে চোখ রেখে প্রশ্ন করলেন, ‘শুটিং দেখছিলি?’
পদ্মজা বাধ্যের মতো মাথা ঝাঁকায়। হেমলতা চোখ দুটি হঠাৎ শীতল হয়ে এলো।
তিনি চৌকিতে বসে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘ছিদ্রের বুদ্ধি পূর্ণার?
প্রশ্নটা শুনে পূর্ণার গলা শুকিয়ে যায়। এক ফোঁটা পানি দরকার, নয়তো দম বেরিয়ে যাবে। পদ্মজা চকিতে চোখ তুলে তাকাল। অসহায় কণ্ঠে বলল, ‘আম্মা, আর হবে না। পূর্ণাকে কিছু বলো না। ওর দোষ নেই। আমি…’
হেমলতা পদ্মজাকে কথা শেষ করতে দিলেন না। প্রেমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রেমা, তোর আব্বা কোথায়?’
‘উঠানে আম্মা।’
‘গিয়ে বল, আমি ডাকছি।’
প্রেমা একছুটে গিয়ে আবার একছুটে ফিরে এলো। হেমলতা বারান্দা পেরিয়ে চুলার কাছে গিয়ে বসেন। তখন মোর্শেদ এসে জানতে চাইলেন, ‘কী হইছে? ডাক ক্যারে?’
‘মেয়েদের চৌকির পাশে একটা জানালা করে দাও। মুরগির খোপের কাছে কাঠ আছে।’
‘কেন?’
‘আমি চেয়েছি তাই, না পারলে না করো; অন্য কাউকে ডাকব।’
‘ত্যাড়া কথা কওন ছাড়ো।’
‘তোমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে ভালো লাগে না।’
‘লাগব ক্যারে? তোমার তো আমারে পছন্দ না। তোমার পছন্দ বিলাই চোখা ব্যাটা ছ্যাড়ারে।’
‘অহেতুক কথা বোলো না। মাসের পর মাস কোথায় থাকো, তা আমার অজানা নয়। রোগে ধরলেই লতার কথা মনে পড়ে।’
মোর্শেদ মিনিটখানেক রাগ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন।
.
মোর্শেদ ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে দুই ফুট উচ্চতার একটি জানালা তৈরি করে দিলেন। পদ্মজা-পূর্ণা হতবাক, সেই সঙ্গে খুশিও। হেমলতা জানালায় ছোটো পর্দা টানিয়ে দিলেন। রুম থেকে বাইরের দৃশ্য দেখা যায়, কিন্তু জানালার ওপাশে কে আছে তা বাহির থেকে বোঝা যায় না।
সন্ধ্যায় শুটিং শুরু হলো। পদ্মজা-পূর্ণা-প্রেমা চৌকিতে বসল চিড়া নিয়ে তাদের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। হেমলতা মৃদু হাসলেন। বড়ো মেয়ে দুটো কখনো মুখ ফুটে শখ-আহ্লাদের কথা বলে না। না বলা সত্ত্বেও অনেকবার তিনি দুই বোনের ইচ্ছে পূরণ করেছেন। আর কিছু ইচ্ছে বুঝতে পারলেও পূরণের সামর্থ্য হয়নি তার। যতটুকু পারেন ততটুকুই করেন।
হেমলতা ঘরের বাইরে যেতেই পূর্ণা বলল, ‘আমাদের মায়ের মতো সেরা মা আর কেউ না। তাই না আপা?’
‘মায়ের মতো কেউ হয় না। সবার কাছে সবার মা সেরা। আমাদের মা আমাদের কাছে সেরা। লাবণ্যর মা লাবণ্যর কাছে সেরা। মনির মা মনির কাছে সেরা।’
‘ওরা বলেছে?’
‘দূর বোকা! এসব বলতে হয় না।’
‘না, আমাদের আম্মাই সবচেয়ে ভালো মা। এমন মা আর একটাও নেই।’
হেমলতার কর্ণকুহরে প্রতিটি কথা আসে। পূর্ণা সবার অনুভূতি অনুভব করতে জানে না। পদ্মজা জানে।
পদ্মজা হেসে বলল, ‘আমাদের আম্মা সত্যি সেরা। আলাদা।’
পূর্ণা জানালার বাইরে চোখ রেখে প্রশ্ন করল, ‘আপা, চিত্রা দিদিকে কেমন লাগে?’
পদ্মজা চিত্রার দিকে তাকাল। ছাইরঙা শাড়ি পরা, হাতে কালো রঙের ঘড়ি। ফুলহাতা ব্লাউজ; শালীন, তবে সর্বাঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া। নাকে সাদা পাথরের নাকফুল, লম্বা চুল বেণি করে রেখেছে; মুখে খুব মায়া। স্নিগ্ধ একটা মুখ, যেন শরতের শুভ্র এক টুকরো মেঘ। পদ্মজা বলল, ‘আমার দেখা দ্বিতীয় সুন্দর মেয়েমানুষ চিত্ৰা দিদি।’
পূর্ণা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, ‘প্রথম কে?’
পদ্মজা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে মোহময় কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের আম্মা।’
সঙ্গে সঙ্গে হেমলতার বুক শীতল, কোমল অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। পদ্মজা এত সুন্দর করে ‘আমাদের আম্মা’ বলেছে! হেমলতা প্রথম…এই প্রথম শুনলেন, তিনি সুন্দর! ভূবন মোহিনী রূপসীর মুখে শুনলেন। এই আনন্দ কোথায় রাখবেন? কেন ছেলেমানুষি অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছেন তিনি! প্ৰেমা অবাক স্বরে বলল, ‘আম্মা তো কালো। চিত্রা দিদির চেয়ে সুন্দর কীভাবে?’
‘এভাবে বলছিস কেন প্রেমা? তুই ফরসা হয়ে গেছিস বলে কালোকে ভালো মনে হয় না?’ পূর্ণা গমগম করে উঠল। বোনের কথা শুনে ভয় পেল প্ৰেমা।
পদ্মজা বলল, ‘বকছিস কেন? প্রেমা কত ছোটো। ও কী সুন্দরের গভীরতা বুঝে? ও খালি চোখে কালো-সাদার তফাৎ দেখে।’
‘সুন্দরের গভীরতা তো আমিও বুঝি না।’
পূর্ণার কণ্ঠ ভারী নিষ্পাপ শোনাল। পদ্মজা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলো হেমলতার উপস্থিতি। এরপর বলল, ‘আম্মার রং কালো। কিন্তু সৌন্দর্যের কমতি নেই। আম্মাকে কখনো এক মনে দেখিস, বুঝবি। আমাদের আম্মার চোখ দুটি গভীর, বড়ো-বড়ো; পাতলা, মসৃণ ঠোঁট আম্মার ঘন চুলের খোঁপায় এক আকাশ কালো মেঘ। আম্মার শাড়ির কুঁচির ভাজে আভিজাত্য লুকানো। আম্মা যখন তীক্ষ্ণ চোখে আমাদের দিকে তাকান, তখন মনে হয়: প্রকাণ্ড কোনো রাজ্যের রানি তার পূর্বপুরুষের ক্ষমতা প্রকাশ করছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে। এতকিছু থাকা সত্ত্বেও কি আম্মা আমাদের দেখা প্রথম সুন্দর মানুষ হতে পারেন না?’
পদ্মজার প্রতিটি কথা পূর্ণার ওপর ভীষণ ভাবে প্রভাব ফেলে। ওদিকে প্রেমা চোখ পিটপিট করে কিছু ভাবছে।
পূর্ণা উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, ‘কাল থেকে আমি আম্মাকে মন দিয়ে দেখব।’
‘আমিও,’ প্রেমাও পূর্ণার দলে যোগ দিল।
আবেগের সাইক্লোনে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল হেমলতার চোখ বেয়ে, কিছুতেই আটকে রাখতে পারলেন না। এই কালো রঙের জন্য ছোটো থেকে সমাজের তুচ্ছতাচ্ছিল্য পেয়ে এসেছেন! লুকিয়ে কত কেঁদেছেন। কত করে চেয়েছেন, কেউ তাকে সুন্দর বলুক। কিন্তু সেই কপাল কখনো হয়নি। আর আজ, এই বয়সে এসে শুনলেন—তিনি কুৎসিত নন। তার মাঝেও সৌন্দর্য আছে! জন্মদাত্রী মা গায়ের কালো রঙের জন্য গরম চামচ দিয়ে ঘাড়ে পোড়া দাগ বসিয়ে দিয়েছিলেন। আর আজ গর্ভের সন্তান সেই অনুচিত কাজের জবাব দিল! আল্লাহর সৃষ্টি কেউ অসুন্দর নয়। সবার মধ্যেই সৌন্দর্য আছে…
…যা ধরা পড়ে শুধুমাত্র সুন্দর একজোড়া চোখে…পদ্মজার সুন্দর চোখে!
.
নিশুতি রাত। চারিদিকে ঝিঁঝিপোকার ডাক। হুট করে হেমলতার ঘুম ভেঙে গেল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ইঙ্গিতে জানান দিচ্ছে ষড়যন্ত্রের। লাহাড়ি ঘরের ডান পাশে দুইজোড়া পায়ের আওয়াজ। হেমলতার বুক কেঁপে উঠল। দ্রুত উঠে বসলেন তিনি, দুই চৌকির মাঝের পর্দা সরিয়ে দেখে নিলেন পদ্মজার অবস্থান। পদ্মজাকে ঘুমাতে দেখে স্বস্তি পেলেন, ছাড়লেন আটকে যাওয়া নিশ্বাস। পায়ের আওয়াজ খুব কাছে শোনা যাচ্ছে। হেমলতা ডান পাশে তাকালেন। গাঢ় অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবুও তিনি তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে, টিনের ওপাশে থাকা অদৃশ্য গোপন শত্রুকে তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন।
‘কে ওখানে?’
হেমলতার ঝাঁঝালো কণ্ঠে পায়ের আওয়াজ থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড পর ছুটে পালাল দুইজোড়া পা।
৮
ভোর, বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সেই সঙ্গে সুন্দর ঠান্ডা একটা হাওয়া বইছে। বৃষ্টি পড়ার কারণে আকাশ মেঘলা, চারপাশটা একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন। হালকা আলোতেই মেঝেতে শীতল পাটি বিছিয়ে তিন বোন পড়ছে। ঝমঝম করে বৃষ্টি হয়েছে রাতভর, বর্ষা-স্নানে প্রকৃতি স্নিগ্ধ। এমন সকালে কেউ কেউ ঘুমাতে চায়, আর কেউ-বা বই পড়তে পছন্দ করে…অথবা পছন্দের অন্য যেকোনো কাজ করে। পূর্ণার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে, পড়া একদমই সহ্য হচ্ছে না। পদ্মজাকে বলল, ‘আর কতক্ষণ? ঘুমাতে চাই আপা।’
পদ্মজা নিচু গলায় বলল, ‘এইটুকু শেষ করে ঘুমিয়ে পড়িস।’
‘আম্মা তো আরো পড়তে বলল।’
‘কিছু হবে না। এই যে…’ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘এইটুকু পড় ভালো করে, তাহলেই আম্মা ছুটি দিবে।’
পূর্ণা মনের বিরুদ্ধে গিয়েই পড়া শেষ করল। হেমলতা প্রথমে ছুটি দিতে না চাইলেও পদ্মজার অনুরোধে ছেড়ে দিলেন। ছুটি পেয়ে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল পূর্ণা, সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।
কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থেমে রোদ উঠল। স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে পূর্ণাকে অনেক ডাকল পদ্মজা, সাড়া পেল না। এদিকে স্কুলে যাওয়ার সময় হয়েছে। হেমলতা বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘পূর্ণা ঘুমে?’
‘জি, আম্মা।’
‘সে জানে না স্কুল আছে? তবুও কোন আক্কেলে ঘুমাল?’
মায়ের রাগের ফলাফল ভেবে পদ্মজা শঙ্কিত। আজ পূর্ণা নির্ঘাত মার খাবে। সে হেমলতাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘তুমি যাও আম্মা। পূর্ণা কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে।’
হেমলতা জানেন, পূর্ণা এত সহজে ঘুম থেকে উঠবে না। প্রায়ই এমন হয়। যতই আদর করে ডাকা হোক না কেন, বৃষ্টিমাখা সকালে তার ঘুম ভাঙানো যুদ্ধের সমান। বাঁশের কঞ্চিকে পূর্ণা ভীষণ ভয় পায়, অথচ কঞ্চির বাড়ি না খাওয়া অবধি ঘুম তাকে কিছুতেই ছাড়ে না! এ যেন ভূত তাড়ানো। হেমলতা বাঁশের কঞ্চি আনতে বাঁশ বাগানের দিকে চলে যান। এদিকে পদ্মজা ডেকেই যাচ্ছে, ‘পূর্ণা? ওঠ। মারটা খাওয়ার আগে ওঠ। এই পূর্ণা। পূর্ণা রে…পূর্ণা, উঠ।’
পূর্ণা পিটপিট করে চোখ খুলে আবার ঘুমিয়ে যাচ্ছে। প্রেমা এই ব্যাপারটা খুব উপভোগ করে। একটা মানুষ এত ডাকাডাকির পরও কী করে ঘুমিয়ে থাকতে পারে? সে নিষ্কম্প স্থির চোখে তাকিয়ে আছে বড়ো দুই বোনের দিকে। হেমলতা হাতে বাঁশের কঞ্চি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তা দেখে পদ্মজা পূর্ণাকে জোরে চিমটি কাটে, কিন্তু মুখে বিরক্তিকর আওয়াজ তুলে আবার ঘুমে তলিয়ে যায় পূর্ণা।
তুই সর পদ্ম। ও মারের যোগ্য। পিটিয়ে ওর ঘুম ছুটাতে হবে, হেমলতার রাগান্বিত স্বর।
পদ্মজা মায়ের কথার ওপর কিছু বলার সাহস পেল না, দূরে গিয়ে দাঁড়াল। হেমলতা পূর্ণার পায়ের গোড়ালিতে কঞ্চি দিয়ে বাড়ি দিতেই একটা আওয়াজ হলো প্যাঁচ করে। ভয়ে চোখ বুজে ফেলল পদ্মজা। ইস! পায়ের চামড়া ছিঁড়ে গেছে বোধহয়। ঘুমন্ত পূর্ণার মস্তিষ্ক জানান দেয়, আম্মা এসেছেন এবং তিনি আঘাত করছেন। সে চোখ খোলার আগেই দ্রুত উঠে বসল। চোখ খুলতে খুলতে যদি দেরি হয়ে যায়! বোকাসোকা মুখ করে মায়ের দিকে তাকাল পরিস্থিতি বুঝতে। পদ্মজা ঠোঁট টিপে হাসছে, প্রেমা জোরে হেসে উঠল। হেমলতা কড়া চোখে তাকাতেই থেমে গেল দুই বোনের হাসি। পূর্ণা ভীতু কণ্ঠে বলল, ‘আর হবে না আম্মা।’
‘সে তো প্রতিদিনই বলিস।’
‘আজই শেষ। আম্মা…আম্মা মেরো না।’ সে লাফিয়ে উঠে চৌকির কোণে গিয়ে বসে।
এমন সময় ঘন মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল, শোনা গেল বজ্রপাতের আওয়াজ। মনে মনে পূর্ণা-প্রেমা খুশি হলো। আজ আর স্কুলে যেতে হবে না। বাড়ি থেকে দুই ক্রোশ দূরে স্কুল। আম্মা নিশ্চয় যেতে না করবেন। পূৰ্ণা খুশি লুকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘মেঘ আসবে মনে হয়। যাব স্কুলে?’
‘মেঘ তোর কী সমস্যা করল? এখনি যাবি স্কুলে। তৈরি হ।
হেমলতা চলে যেতেই পূর্ণা ভ্রুকুঞ্চন করে থম মেরে বসে রইল।
পদ্মজা তাড়া দেয়, ‘বসে আছিস কেন? জলদি কর। নয়তো আবার মার খাবি।’
পূর্ণা তীব্র বিরক্তি নিয়ে স্কুলের জন্য প্রস্তুত হয়।
বর্ষাকাল চলছে। রাতে বিরতিহীনভাবে বৃষ্টি হওয়ায়, কাদা জমেছে রাস্তায়। পথ চলা কষ্টকর।
তিন বোন হাতে জুতা নিয়ে পা টিপে হাঁটছে। তাদের মনে কাজ করছে পিছলে পড়ে বই খাতা নষ্ট হওয়ার ভয়। অর্ধেক পথ যেতে না যেতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। পথের পাশ থেকে বড়ো তিনটে কচু পাতা ছিঁড়ল পদ্মজা। পূর্ণা-প্রেমার হাতে দুটো দিয়ে নিজের মাথায় ধরল তৃতীয়টি, তবে তাতে লাভ হলো না। মাথা না ভিজলেও, শরীর ও বই-খাতা ভিজে একাকার হয়ে গেল।
পূর্ণা বিরক্তি প্রকাশ করল, ‘ধ্যাত! ভিজে স্কুলে গিয়ে লাভ কী আপা? দেখো, হাঁটু অবধি পায়জামা কাদা আর বৃষ্টির পানি দিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।’
পদ্মজা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘বুঝতে পারছি না কী করব! স্কুলে যাব? নাকি বাড়ি ফিরব।’
‘আপা, বাড়ি যাই।’ বলল প্রেমা।
পদ্মজা একটু ভাবল। এরপর দুই বোনকে বলল, ‘ভিজে তো কতবারই গেলাম। আজও যাই। সমস্যা কী?’
অগত্যা স্কুলেই যেতে হলো। পদ্মজা সম্মতি না দিলে বাড়িতে গিয়েও উঠতে পারবে না তারা। স্কুল ছুটির আগেও বৃষ্টি পুরোপুরি থামেনি। তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই বাড়ি ফেরার পথ ধরল দুই বোন। প্রেমার এক ঘণ্টা আগে ছুটি হয়েছে। পদ্মজা নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্কুলে আব্বা এসেছিলেন?’
‘হুম। প্রেমাকে নিয়ে গেছে।’
‘তোর সঙ্গেও তো দেখা হলো।’
পদ্মজার গলাটা করুণ শোনায়। পূর্ণার মন খারাপ হয়। আব্বা কেন তার এত ভালো আপাকে ভালোবাসে না?
বৃষ্টির পানি ও মাটি মিশে কাদায় একাকার হয়ে গেছে পুরো পথ। কাদামাটিতে হাঁটার মতো ভোগান্তি আর নেই। পূর্ণা যেভাবে হেলেদুলে হাঁটছে তাতে পদ্মজার ভয় হচ্ছে, পড়ে না যায়। সে বোনকে ডেকে বলল, ‘পূর্ণা, সাবধানে হাঁট। পড়ে যাবি।’
তার সাবধানী বাণী শেষ হতেই ধপাস করে কাদামাটিতে পড়ে গেল পূর্ণা। আঁতকে উঠে পদ্মজা। পূর্ণার পা নিমিষে ব্যথায় টনটন করে ওঠে। পদ্মজা দুই হাতে আঁকড়ে তোলার চেষ্টা করে। পূর্ণা কিছুতেই ওঠাতে পারছে না। পা যেন ব্যথায় অবশ হয়ে গেল।
কাঁদো কাঁদো হয়ে পদ্মজাকে বলল, ‘আপা, পা ভেঙে গেল মনে হয়। ইস…এত ব্যথা করছে!’
‘মচকেছে বোধহয়। ঠিক হয়ে যাবে। ওঠার চেষ্টা কর। আমার গলা ধরে ওঠ।
গ্রামের পথ, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে বলে পথে কেউ নেই। গৃহস্থরা ভাতঘুম দিয়েছে। সামনের বিলে থইথই জল, তার পাশে খেত; ডানে-বাঁয়ে কাদামাটির পথ, পেছনে ঝোপঝাড়। পদ্মজা সাহায্য করার মতো আশপাশে কাউকে দেখতে পেল না। এদিকে পা সোজা করার শক্তি পাচ্ছে না পূৰ্ণা, প্রচণ্ড ব্যথা! ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে সে। পদ্মজা না পারছে পূর্ণাকে তুলতে, আর না পারছে পূর্ণার কান্না সহ্য করতে। সে মনে মনে আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে, ‘আল্লাহ, কিছু করো। সাহায্য করো।’ একটু পর পূর্ণাকে বলল, ‘বোন আমার, একটু চেষ্টা কর উঠতে।’
পদ্মজার উৎসাহে পূর্ণা পায়ের পাতা মাটিতে ফেলল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ব্যথার বিজলি চমকে ওঠল তার পুরো শরীরে। ‘ও মা! আপা রে, পারছি না। আমার পা শেষ। মরে যাব আমি।’
‘এসব বলিস না। পায়ের ব্যথায় কেউ মরে!’
অল্পক্ষণের মাঝেই আহত পা ফুলে দুই ইঞ্চি উঁচু হয়ে গেছে! তা দেখে আতঙ্কে চোখ-মুখ নীল হয়ে গেল পদ্মজার, কান্না পাচ্ছে তার। পদ্মজা আলতো করে চাপ দিতেই পায়ের ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল পূর্ণা।
‘একটু সাবধানে হাঁটলে কী হতো? ইশ, এখন কী কষ্টটা হচ্ছে।’ পদ্মজার চোখ জলে ভরে উঠেছে।
‘আপা…আপা, ব্যথায় মরে যাচ্ছি।’
পদ্মজা খুব কাছে পায়ের শব্দ পেল। চকিতে চোখ তুলে তাকাল সে খেতের দিকে; পরমুহূর্তে হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। সে উচ্ছ্বাসে চেঁচিয়ে উঠল, ‘পূর্ণা রে, আম্মা আসছে!’
হেমলতাকে দেখে পূর্ণা কলিজায় পানি প্রায়, মাকে দেখেই যেন ব্যথা অনেকটা কমে গেছে। হেমলতা ছুটে আসেন। পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কিছু হয়নি। এসব সামান্য ব্যাপার।
এরপর পদ্মজাকে বললেন, ‘তুই বইগুলো নে।’
হেমলতা এদিকে সেলাই করা কাপড় দিতে এসেছিলেন। যার কাপড় ছিল, সে অসুস্থ। তাই যেতে পারছিল না। বাড়িতেও কোনো কাজে মন টিকছিল না। তাই ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ঘরে চুপচাপ বসে থাকার চেয়ে একটা মানুষকে সাহায্য করা ভালো। ফেরার পথে তিনি দূর থেকে দুটো বিপর্যস্ত মেয়েকে দেখতে পেলেন। একটা মেয়ে পথে বসে আছে, আরেকটা মেয়ে তাকে তোলার চেষ্টা করছে। মেয়ে দুটিকে চিনতে পেরে বুক কেঁপে ওঠে তার। পথ দিয়ে আসলে দেরি হবে বলে তিনি খেতের ভেতর দিয়েই ছুটে এসেছেন।
পূর্ণা ব্যথায় যেন নিশ্বাস নেয়ার শক্তি পাচ্ছে না। একটা ভ্যান পাওয়া গেলে খুব উপকার হতো। আশ্চর্যভাবে দুই মিনিটের মাথায় দেখা মিলল ভ্যানের! ভ্যানে চিত্রা, লিখনসহ আরো দুজন, তারা মাতব্বর বাড়িতে গিয়েছিল। আরেকটু এগোতেই পদ্মজা আর তার মা-বোনকে দেখতে পেল চিত্রা, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে ভ্যানচালককে বলল, ‘চাচা, ভ্যান থামান।’
চিত্রার দৃষ্টি অনুসরণ করে লিখনের নজরে ব্যাপারটা আসতেই সে তাড়াহুড়ো করে ভ্যান থেকে নেমে আসে, চিত্রাও বসে নেই। চোখে-মুখে ভয় নিয়ে জানতে চাইল, ‘কী হয়েছে? পূর্ণার কী হয়েছে?
পদ্মজা বলল, ‘কাদায় পড়ে পা মচকে গেছে।’
হেমলতা, চিত্রা, পদ্মজা এবং পূর্ণাকে ভ্যানে তুলে দিয়ে লিখনসহ বাকি দুজন সহকর্মী ভ্যান ছেড়ে দিল। তারা মোড়ল বাড়িতে হেঁটেই ফিরবে।
.
অনেকটা কমেছে পা ব্যথা, দুটি বালিশের ওপর রাখা হয়েছে পা। ব্রেস নেই বলে ব্রেসের মতো কাপড় বেঁধে দিয়েছেন হেমলতা। যে ব্যথা পেয়েছে, তাতে কয়দিন স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতেও পারবে না। হেমলতা মেয়েকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘এবার খুশি? স্কুলে যেতে হবে না। কাজ করতে হবে না। সকালে উঠে পড়তে বসতে হবে না।
পূর্ণা রাজ্যের দুঃখ নিয়ে বলল, ‘সবই ঠিক আছে। কিন্তু এখন টিভি দেখতে যাব কীভাবে?’
সাড়া না পেয়ে পূর্ণা বুঝতে পারল, সে মুখ ফসকে ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। বিব্রত হয়ে উঠল ও, ঢোক গিলল। এরপর কাঁচুমাচু হয়ে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল, ‘মোটেও খুশি হইনি।’
পূর্ণার অগোচরে হেমলতা ঠোঁট চেপে হাসেন। আড়াল থেকে তা দেখে পদ্মজাও হাসল।
তখন দিনের শেষভাগ। সূর্য মামা আকাশ গাঢ় লাল আভায় রাঙিয়ে বিদায় নিতে চলেছেন। আকাশের সঙ্গে মিশে রয়েছে ঘন মেঘ, সেই মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে দিনান্তের শেষ আলো। ঠিক তখন মগা এসে জানাল, মুন্নার বাপ খুন হয়েছে। কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সবার মাথায় যেন আছড়ে পড়ল বজ্র। পঙ্গু, ভিক্ষুক অসহায় মানুষটাকে আবার কে মারল? এমন মানুষের শত্রু থাকে? তাও আবার এমনই যে একেবারে মেরে ফেলল! হেমলতা শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘কখনকার ঘটনা?’
মগা জানাল, দুপুরের কথা। দুপুর দুটো কি তিনটায় গ্রামবাসী জানতে পারে ঘটনাটি। আস্তে আস্তে সব গ্রামে খবর যাচ্ছে। লাশ নোয়াপাড়ার ধানখেতে পাওয়া গেছে। সবাই মিলে মুন্নার বাপকে দেখতে যায়। বাড়িতে রয়ে যায় শুধু পদ্মজা, প্রেমা ও পূর্ণা।
পুলিশ লাশ নিয়ে যাওয়ার পর সবাই মুন্নাকে নিয়ে বিপাকে পড়ে। আত্মীয় বলতে তার কেউ নেই। দুঃসম্পর্কের যারা আছে তারা মুন্নার দায়িত্ব নিতে চাইল না। মাতব্বর মুন্নার ভার নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুন্না জানাল, সে থাকলে পদ্মজাদের বাড়িতে থাকবে। হেমলতা মাতব্বরের অনুমতি নিয়ে সানন্দে মুন্নাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন। এখন থেকে মুন্না এই বাড়ির ছেলে। পদ্মজা-পূর্ণা খুব খুশি হয়। খুশি হলো না শুধু প্রেমা। মুন্না ও প্রেমা সমবয়সি। প্রেমা ভাবছে, তার আদর এখন ভাগাভাগি হয়ে যাবে।
হেমলতা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পদ্মজাকে বললেন, ‘প্রেমার বোধহয় মুন্নাকে পছন্দ হচ্ছে না। দুজনের মধ্যে সখ্যতা করে দিস, যাতে একজন আরেকজনকে আপন চোখে দেখে।’
পদ্মজা আশ্বস্ত করে বলল, ‘কয়দিন গেলেই মিশবে
মুন্না বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। হেমলতা তাকে ঘরে এনেই গরম গরম ভাত খাইয়ে দিয়েছিলেন। খেয়েই ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ে। রাত তো কম হলো না! মা-বোনের বৈঠক দেখে পূর্ণা বলল, ‘আম্মা, মুন্নার নতুন নাম রাখা উচিত।’
‘কেন?’
‘এখন থেকে মুন্না আমাদের ভাই। আমাদের নাম প দিয়ে। তাইলে ওর নাম-ও প দিয়ে হবে। তাই না আপা?’
হেমলতা হেসে বললেন, ‘তুই নাম রাখ তাহলে।’
‘রেখেছি তো। প্রান্ত মোড়ল।’
‘মুন্নাকে আগে ওর নতুন নাম সম্পর্কে জানা, যদি রাজি হয় তখন সবাই এই নামে ডাকব। ওরও তো পছন্দ আছে।’
‘রাজি হবে না মানে? পিটিয়ে রাজি করাব
মেয়ের কথায় হেমলতা হাসলেন। পূর্ণা বলল, শ্বশুরবাড়ি থেকে গিয়ে আনার মতো একটা ভাই হলো আমাদের। আপাকে যখন বিয়ে দেব, আমি আর প্রান্ত গিয়ে আপাকে নিয়ে আসব তাই না আম্মা?’
অসুস্থ হলে খুব কথা বলে পূর্ণা। মুখ বন্ধ রাখতেই পারে না। অনেক বছর আগের ঘটনা, বা কয়েক বছর পর কী হবে তা নিয়ে অনবরত কথা বলতে থাকে।
.
গহিন অন্ধকার। আজ বোধহয় অমাবস্যা। হেমলতা কালো চাদরের আবরণে ঘাপটি মেরে বারান্দায় বসে আছেন। হাতের কাছে ছুরি, লাঠি। গত তিন দিন ধরে ঘরের পাশে পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তখন ঘরে মোর্শেদ ছিলেন, আর যাই হোক—পুরুষ তো, তাই সাহসও ছিল বুকে। আজ মোর্শেদ নেই। মুন্নাকে দত্তক নিয়ে বাড়িতে আনায় তিনি ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়েছেন। কবে ফিরবেন ঠিক নেই! আজ কিছুতেই ঘুমানো যাবে না। হাতেনাতে সন্দেহকারীকে ধরে এই বিপদ থেকে মুক্ত হতে হবে। কিন্তু অনেকক্ষণ হলো কেউ আসছে না। চোখ বুজে আসছে হেমলতার। সারাদিন অনেক খাটুনি গেল।
কাদামাটিতে ছপছপ শব্দ তুলে কেউ আসছে। হেমলতা সতর্ক হয়ে ওঠেন, শক্ত করে ধরলেন লাঠি-ছুরি। পায়ের শব্দটা কাছে আসতেই তিনি বেরিয়ে আসেন। অন্ধকারে মুখ পরিষ্কার নয়। আন্দাজে ছুঁড়ে মারেন হাতের লাঠি। লাঠিটা বেশ ভালোভাবেই পড়ল সামনে থাকা ছায়াটির ওপর, হতভাগা আর্তনাদ করে বসে পড়ল মাটিতে; ততক্ষণে পেছনের ছায়াটি দৌড়ে পালাল! প্রথমজনও পালানোর চেষ্টা করল, হেমলতার জন্য পেরে উঠল না। তিনি আরেকটা লাঠি দিয়ে আবার আঘাত করে বসেন, তার দৃষ্টি থেকে যেন আগুন স্ফুরিত হচ্ছে।
আহত ব্যক্তির আর্তচিৎকার শুনে বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে আসে সবাই। টর্চের আলোতে চারদিক আলোকিত হয়ে ওঠে। হেমলতা স্বাভাবিক ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি যেন জানতেন এই ছায়াটিরই আসার কথা ছিল। আজই শুটিং দলকে বাড়ি থেকে বের করবেন। তবেই শান্তি! হই- হুল্লোড় শুনে পদ্মজা, প্রেমা, মুন্না বেরিয়ে আসে। পূর্ণা ঘরেই রইল।
চোখের সামনে ডিরেক্টর আবুল জাহেদকে দেখে চমকে গেল পদ্মজা!
আর ঠিক তখনই কোত্থেকে যেন আগমন ঘটল মোর্শেদের!
৯
আবুল জাহেদকে আহত অবস্থায় দেখে সবাই চমকে গেল। তার কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে।
ফার্স্ট এইড বক্স আনতে একজন দৌড়ে যায় বাড়ির ভেতর। লিখন কিছু সময়ের জন্য থমকাল। আবুল জাহেদের ক্ষতটা ব্যান্ডেজ করার পর তাকে একটা চেয়ারে বসতে দেয়া হয়। হেমলতা একহাতে লাঠিতে ভর দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন।
লিখন বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছিল? আপনি উনাকে আঘাত করেছেন কেন?’
হেমলতা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, ‘এই অসভ্য লোক আজ চারদিন ধরে মাঝরাতে এখানে ঘুরঘুর করে। তার উদ্দেশ্য খারাপ।’
লিখন চোখের কোণ দিয়ে পদ্মজাকে দেখে আবুল জাহেদকে প্রশ্ন করল, ‘উনি যা বলছেন, সত্যি?’
আবুল জাহেদ গমগম করে উঠল, ‘এখানে আমি আজই প্রথম এসেছি। ঘুম আসছিল না তাই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি। বলা নেই, কওয়া নেই হুট করেই উনি আক্রমণ করে বসলেন। কী ব্যথা!’ কপালে হাত রাখল সে।
হেমলতা প্রতিবাদ করলেন দৃঢ় স্বরে, ভুলেও মিথ্যে বলবেন না।’
আবুল জাহেদ কিছুতেই তার উদ্দেশ্য স্বীকার করল না। তর্কে-তর্কে ভোরের আলো ফুটল। হেমলতা কঠিন করে জানিয়ে দিয়েছেন, আজই এই বাড়ি ছাড়তে হবে। হেমলতার সিদ্ধান্ত শুনে দলটির মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তীরে এসে নৌকা ডুববে নাকি! সিনেমার শেষ অংশটুকু এখনো বাকি। শর্ত অনুযায়ী আরো দশদিন সময় আছে। দলের একজন বয়স্ক অভিনেতা এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলে হেমলতা জবাব দিলেন, ‘আমার তিনটা মেয়ের নিরাপত্তা দিতে পারবেন? একটা পুরুষ মানুষ রাতের আঁধারে যুবতী মেয়েদের ঘরের পাশ দিয়ে ঘুরঘুর কেন করবে? কীসের ভিত্তিতে?’
কাউকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সবাইকে এড়িয়ে লাহাড়ি ঘরে চলে গেলেন হেমলতা। এদের সঙ্গে তর্ক করে শুধু সময়ই নষ্ট হবে। আবুল জাহেদের ধূর্ত চাহনি তার নজরে এসেছে বারংবার। প্রথম রাতে পায়ের আওয়াজ শুনে চিনতে পারেননি। পরদিন সন্দেহ তালিকায় থাকা চার-পাঁচ জনকে অনুসরণ করে তিনি নিশ্চিত হোন: রাতে কে লাহাড়ি ঘরের পাশে হেঁটেছিল। ঘরের ডান পাশে পলিথিন কাগজ দিয়ে ঢাকা তুষের স্তূপ রাখা আছে। অসাবধানতায় আবুল জাহেদের কাদা-মাখা জুতা তুষের স্তূপে পড়ে যায়, তাই তুষ লেগে যায় জুতায়। হেমলতা বাড়ির বারান্দায় সেই জুতাজোড়া দেখতে পান। তুষ বাড়ির আর কোথাও নেই, তাই ব্যস্ত হয়ে তুষের স্তূপের কাছে এসে দেখেন; একজোড়া জুতার ছাপ! সেই জুতা যখন আবুল জাহেদ পরল তখন তিনি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হলেন, শেয়ালটা আসলে কে!
শুটিং দলটার মধ্যে একটা হাহাকার লেগে গেছে। বেশ কিছুকক্ষণ তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা চলল। হেমলতাকে কিছু বলে লাভ নেই, তা প্রত্যেকে বুঝে গেছে; তাই সবাই মোর্শেদকে ধরল। বিনিময়ে তারা আরো টাকা দিতে রাজি আছে। হেমলতার ধমকের ভারে তখন চুপ হয়ে গেলেও, টাকার কথা শুনে মোর্শেদের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে ওঠে। ঘরে এসে হেমলতার সঙ্গে ধুন্ধুমার ঝগড়া লাগিয়ে দেন। হেমলতা প্রথমে কিছুতেই রাজি হোননি। তবে শেষ অবধি নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকতে পারলেন না। দলের কিছু ভালো মানুষের অনুরোধ ফেলতে বেশ অস্বস্তিবোধ করছিলেন। দশদিনের বদলে পাঁচ দিনের সময় দিলেন। যতক্ষণ এরা বাড়ি না ছাড়বে তিনি শান্তি পাবেন না। তবে একটা স্বস্তির নিশ্বাসও ফেললেন।
ভাগ্যিস কোনো ঘটনা ঘটার আগে ব্যাপারটা সামলানো গেছে।
বেশ গরম পড়েছে আজ। পদ্মজা পাটিতে বসে মনোযোগ দিয়ে মুন্নাকে শেখাচ্ছে; কাকে কী ডাকতে হবে।
‘আমায় ডাকবি বড়ো আপা। পূর্ণাকে ছোটো আপা। আর প্রেমা তো তোর সমান। তাই প্রেমা ডাকবি। দুজন মিলেমিশে থাকবি। বুঝেছিস?’
‘হ, বুঝছি।’
‘আম্মাকে তুইও আম্মা ডাকবি। আমাদের আম্মা-আব্বা এখন থেকে তোরও আম্মা-আব্বা, বুঝেছিস?
মুন্না বিজ্ঞ স্বরে বলল, ‘হ, বুঝছি।’
হেমলতা রান্না রেখে উঠে আসেন। মুন্নাকে বললেন, ‘শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবি। তোর পদ্ম আপা যেভাবে বলে।’
মুন্নার সরল স্বীকারোক্তি, ‘কইয়ামনে।’
পদ্মজা বলল, কইয়ামনে না। বল, আচ্ছা বলব।’
মুন্না বাধ্য ছেলের মতো হেসে বলল, ‘আচ্ছা, বলব।’
হেমলতা হেসে চলে যান। পূর্ণা রুম থেকে মুন্নাকে ডাকল, ‘মুন্না রে?’
‘হ, ছুডু আপা।’
পদ্মজা মুন্নার গালে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে বলল, বল—জি, ছোটো আপা।’
মুন্না পদ্মজার মতো করেই বলল, ‘জি ছোটো আপা।’
পদ্মজা হাসল। পূর্ণা বলল, ‘তোর নাম পালটাতে হবে। আমি তোর নতুন নাম রেখেছি।
‘কেরে? নাম পালডাইতাম কেরে?’ পদ্মজা কিছু বলার আগে মুন্না প্ৰশ্ন করল, ‘আইচ্ছা এই কথাডা কেমনে কইতাম?’
পদ্মজা হেসে কপাল চাপড়ায়, এই ছেলে তো আঞ্চলিক ভাষায় বুঁদ হয়ে আছে। পূর্ণা বলল, ‘তুই এখন আমাদের ভাই। আমাদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তোর নাম রাখা উচিত। উচিত না?’
মুন্না দাঁত কেলিয়ে হেসে সায় দিল, ‘হ।’
‘এজন্যই তোর নাম পালটাতে হবে। আজ থেকে তোর নাম প্রান্ত মোড়ল। সবাইকে বলবি এটা। মনে থাকবে?’
‘হ, মনে রাহাম।’
‘বল, আচ্ছা মনে রাখব।’
‘আচ্ছা, মনে রাখব।’
দুপুর গড়াতেই হাজেরা এলো। সঙ্গে নিয়ে এসেছে বানোয়াট গল্প আর বিলাপ। ইশারা-ইঙ্গিতে সে লাউ চাইছে। মোর্শেদ গতকাল সব লাউ বাজারে তুলেছেন, গাছে আর একটা ছিল। এদিকে ঘরে চিংড়ি মাছ আছে, প্ৰান্ত লাউ দিয়ে চিংড়ি খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে বলে হেমলতা ছেলের ইচ্ছে পূরণ করতে হাসিমুখে শেষ লাউটা ছিঁড়ে এনে ঘরে রেখেছেন। এখন আবার হাজেরারও লাউ চাই! কেউ কিছু চাইলে হাতে থাকা সত্ত্বেও হেমলতা ফিরিয়ে দেননি। আজও দিলেন না। তিনি হাজেরাকে হাসিমুখে লাউ দিয়ে দিলেন। হাজেরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে চলে গেল। পদ্মজা মায়ের দিকে অসহায় চোখে তাকাল। প্রান্ত এই বাড়িতে এসে প্রথম যা চাইল, তাই পেল না। মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না তো! হেমলতা পদ্মজার দৃষ্টি বুঝেও কিছু বললেন না। প্রান্তকে ডেকে কোলে বসালেন। ছেলেটাকে দেখতে বেশ লাগছে। দুপুরে তিনি গোসল করিয়েছেন। মনে হচ্ছিল, কোনো ময়লার স্তূপ পরিষ্কার করা হচ্ছে। জন্মদাতার মৃত্যু প্রান্তের উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলল না। এজন্য কেউই অবাক হয়নি। বাপ-ছেলের শুধু রাতেই একসঙ্গে থাকা হতো। অনেক রাত প্রান্ত একা থেকেছে। এইটুকু ছেলে কত রাত ভয় নিয়ে কাটিয়েছে! হেমলতা আদুরে কণ্ঠে বললেন, ‘একটা গল্প শোনাই। শুনবি?’
‘হুনাও।’
পদ্মজা প্রান্তের ভাষার ভুল ধরিয়ে দিল, ‘হুনাও না। বল, শোনাও, আম্মা।’
প্রান্ত মাথা কাত করে হেমলতাকে বলল, ‘শোনাও, আম্মা।’
আম্মা ডাকটা শুনে হেমলতা বুক বিশুদ্ধ ভালোলাগায় ছেয়ে গেল। তিনি কণ্ঠে ভালোবাসা ঢেলে বললেন, ‘আমাদের একদিন মরতে হবে জানিস তো?’
‘হ।’
‘জান্নাত-জাহান্নামের কথা কখনো কেউ বলেছে?’
প্রান্ত মাথা দুই পাশে নাড়াল, কেউ শোনায়নি। হেমলতা এমনটাই সন্দেহ করেছিলেন। প্রান্ত এ সম্পর্কে জানে না। তিনি ধৈর্য নিয়ে সুন্দর করে জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা দিলেন। জান্নাতের বর্ণনা শুনে প্রান্তের চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠল। প্রশ্ন করল হাজারটা। হেমলতাকে জানাল, সে জান্নাতে যেতে চায়; জাহান্নামে যেতে চায় না। হেমলতা বললেন, ‘আচ্ছা, এখন গল্পটা বলি। মন দিয়ে শুনবি।’
প্রান্ত মাথা কাত করে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিল। হেমলতা বলতে শুরু করলেন, ‘একজন মহিলা একা থাকত বাড়িতে। না, দুটি ছেলেমেয়ে থাকত তার সঙ্গে, খুব ছোটো ছোটো; খুব অভাব তাদের। ছোটো একটা জায়গায় মাটির ঘর। ঘরের সামনে শখ করে একটা লাউ-চারা লাগায়। লাউ গাছ বড়ো হয়, পাতা হয় অনেক। এই লাউ পাতা দিয়ে দিন চলে তাদের। কখনো সিদ্ধ করে খায়। নুন-মরিচ পেলে শাক রেঁধে খায়। তো একদিন একজন ভিক্ষুক এলো। ভিক্ষুকটি খায় না দুই দিন ধরে। লাউ গাছে পাতা দেখে তার ভীষণ খেতে ইচ্ছে করে। লাউ গাছের মালিককে ভিক্ষুক বলে, লাউ পাতা দিতে, রেঁধে খাবে। খুব অনুনয় করে বলে। মহিলাটির মায়া হয়। ভিক্ষুক মহিলাকে কথা শোনাতে শোনাতে কয়েকটা লাউ পাতা ছিঁড়ে দেয়। তার কয়দিন পর লাউ গাছের মালিক মারা গেল। গ্রামবাসীসহ মসজিদের ইমাম মিলে দাফন করে তাকে। বুঝতে পেরেছিস প্রান্ত?’
‘হ।’
প্রান্ত মনোযোগ দিয়ে শুনছে, মনোযোগী শ্রোতা সে। হেমলতা বাকিটা শুরু করলেন, ‘গ্রামের ইমাম একদিন স্বপ্ন দেখেন, যে মহিলাটিকে তিনি দাফন করেছেন তার চারপাশে আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। কিন্তু তার গায়ে আঁচ অবধি লাগছে না। মহিলাটিকে ঘিরে রেখেছে লাউ পাতা! তাই আগুন কাছে ঘেঁষতে পারছে না। ওই যে সে এক ভিক্ষুককে নিজের একবেলা খাবারের লাউ পাতা দান করেছিল? সেই লাউ পাতা এখন তাকে কবরের শাস্তি থেকে বাঁচাচ্ছে। জাহান্নাম থেকে বাঁচতে আমাদের অনেক ইবাদত করা উচিত। তার মধ্যে একটি হলো দান। সামর্থ্য অনুযায়ী দান করা উচিত। কাউকে ফিরিয়ে দেয়া উচিত না। বোঝা গেছে?’
‘হ, বুঝছি। আমিও অনেক দান করাম।’
‘হুম। করবি। অনেক বড়ো হবি জীবনে। আর অনেক দান-খয়রাত করবি। আচ্ছা, প্রান্ত এখন যদি কোনো অভাবী এসে বলে, তোর লাউটা দিতে। তুই কী করবি?’
প্রান্ত গম্ভীর হয়ে ভেবে বলল, ‘দিয়া দিয়াম।’
‘একটু আগে একজন মহিলা এসেছিল, দেখেছিস?’
‘হ, দেখছি।’
‘সে খুব গরিব। বাড়িতে ছোটো ছোটো বাচ্চা আছে। এসে বলল, লাউ দিতে। তাই তোর লাউটা দিয়েছি। এজন্য কী এখন তোর মন খারাপ হবে?’
‘লাউড়া তো তুমি দিছো। তাইলে তোমারে আগুন থাইকা বাঁচাইব লাউডা?’
‘লাউটা আমি দিলেও, তোর জন্য ছিল। তুই এখন খুশি মনে মেনে নিলে লাউটা তোকে আগুন থেকে বাঁচাবে।’
হেমলতার কথায় প্রান্তর চোখেমুখে দীপ্তি ছড়ায়। পরপরই মুখ গম্ভীর করে প্রশ্ন করল, ‘একটা লাউ কেমনে বাঁচাইব আমারে?’
প্রান্তর নিষ্পাপ কণ্ঠে প্রশ্নটা শুনে হেমলতা-পদ্মজা-পূর্ণা হেসে উঠল পদ্মজা বলল, ‘কয়টা পাতা অনেকগুলো হয়ে মহিলাটাকে বাঁচিয়েছিল। তেমন একটা লাউ অনেকগুলো হয়ে তোকে বাঁচাবে।’
প্রান্ত একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। হেমলতা হেসে হেসে তার উত্তর দিচ্ছেন। পদ্মজার হুট করেই প্রান্তের থেকে চোখ সরে হেমলতার ওপর পড়ে।
মা হাসলে সন্তানদের বুকে যে আনন্দের ঢেউ উঠে তা কী মায়েরা জানেন? পদ্মজার আদর্শ তার মা। সে তার মায়ের মতো হতে চায়। হুবহু মায়ের মতো!
পাঁচদিন শেষ। শুটিং দলের মধ্যে খুব ব্যস্ততা। সবকিছু গোছানো হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে পাঁচ দিনে শেষ করা হয়েছে শুট। লিখন উঠানে চেয়ার নিয়ে বসে আছে। চিত্রা এসে তার পাশে বসল, কাশির মতো শব্দ করল লিখনের মনোযোগ পেতে। তাকাল লিখন, ম্লানমুখে প্রশ্ন করল, ‘সব গোছানো শেষ?’
হুম, শেষ। তুমি তো কিছুই গুছাওনি!’
‘বিকেলে রওনা দেব। আমার আর কী আছে গোছানোর? দুপুরেই শেষ করে ফেলব।’
‘মন খারাপ?’
লিখন কিছু বলল না, তাকাল লাহাড়ি ঘরের দিকে; দৃষ্টিতে শূন্যতা, কিছু ফেলে যাওয়ার বেদনা। বুকের বাঁ পাশে চিনচিন করা ব্যথাটা আর সহ্য হচ্ছে না। চিত্রা হাতঘড়ি পরতে পরতে বলল, ‘ছোটো বোনের সমান বলে ঠোঁট বাঁকিয়ে ছিলে। এখন তার প্রেমেই পড়লে।’
লিখন কিছু বলল না, তবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একটা। চিত্রা বলল, ‘পদ্মজা কিন্তু অনেক বড়োই। শুনেছি, আগামী মাসে ওর সতেরো হবে। এই গ্রামে সতেরো বছর বয়সি অবিবাহিত মেয়ে হাতেগোনা কয়টা। পদ্মজার নব্বই ভাগ সহপাঠী বিবাহিত। তাছাড়া খুব কম মেয়েই স্কুলে পড়ে।’
চিত্রার কথা অগ্রাহ্য করে লিখন বলল, ‘তোমার বিয়েটা কবে হচ্ছে?’
‘ভগবান চাইলে বছরের শেষ দিকে।’
কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই ঢাকা রওনা দেবে। হেমলতা-মোর্শেদ বিদায় দিতে এসেছেন। দলটার তিন-চার জনের চরিত্রে সমস্যা থাকলেও, বাকিরা খুব ভালো। তারা হেমলতার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। নিজের বাড়ি মনে করে থেকেছে, বাড়ির দেখাশোনা করেছে। লিখন হেমলতার আড়ালে একটি সাহসিকতার কাজ করে ফেলল। ব্যস্ত পায়ে চলে গেল লাহাড়ি ঘরের দিকে
বারান্দায় বসেছিল পদ্মজা। লিখনকে দেখে ভয়ে কেঁপে উঠল তার বুক। পদ্মজাকে কিছু বলতে দিল না লিখন। সে দ্রুত বারান্দায় উঠে পদ্মজার হাতে একটা চিঠি গুঁজে দিয়ে জায়গা ত্যাগ করল।
প্রবলভাবে কাঁপছে পদ্মজা। এমনকি পূর্ণাও চৌকি থেকে ব্যাপারটা খেয়াল করে হতভম্ব। খোঁড়ার মতো ধীর পায়ে হেঁটে এলো সে। ততক্ষণে পদ্মজার সারা শরীর বেয়ে ঘাম ছুটছে, হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে। হাত থেকে পড়ে গেল চিঠি, সেই চিঠিটি দ্রুত কুড়িয়ে নিলো পূর্ণা।
পদ্মজার মনে হচ্ছে—এখনই সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে! হেমলতা এসে দেখেন পদ্মজা হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বসে আছে। কেমন দেখাচ্ছে যেন। তিনি উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘পদ্ম? শরীর খারাপ?
মায়ের কণ্ঠ শুনে পদ্মজা ভয় পেল। বাতাসে অস্বস্তি, নিশ্বাসে অস্বস্তি; চোখ দুটি স্থির রাখা যাচ্ছে না, নিশ্বাস এলোমেলো। পূর্ণা পরিস্থিতি সামলাতে বলল, ‘আম্মা, আপার মাথাব্যথা।’
‘হুট করে এমন মাথাব্যথা উঠল কেন? পদ্ম রে, খুব ব্যথা?’
পদ্মজা অসহায় চোখে পূর্ণার দিকে তাকাল। আকস্মিক ঘটনায় সে ভেঙে পড়েছে। ডান হাত কাঁপছে অনবরত। হেমলতা চোখ ঘুরিয়ে দুই মেয়েকে দেখলেন। এদের হাবভাব হঠাৎ সন্দেহজনক লাগছে। তিনি কঠিন স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘কী লুকোচ্ছিস দুজন? কেউ এসেছিল?’
মায়ের প্রশ্নে পদ্মজার চেয়ে পূর্ণা বেশি ভয় পেল। হাতের চিঠিটা আরো শক্ত করে চেপে ধরল সে।
কী লেখা আছে না পড়ে এই চিঠি হাতছাড়া করবে না সে।