পদ্মজা – ৪৫

৪৫

ট্রেনের বগি দিয়ে হেঁটে সামনে এগোচ্ছে আমির। তার এক হাতে লাগেজ অন্য হাতে পদ্মজার হাত। শক্ত করে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। পদ্মজার মুখ নিকাবের আড়ালে ঢেকে রাখা। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে আমিরকে প্রশ্ন করল, ‘খালি সিট রেখে আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘কেবিনে।’

ততক্ষণে দুজন ৭৬ নম্বর কেবিনের সামনে চলে এসেছে। আমির দরজা ঠেলে পদ্মজাকে নিয়ে ঢুকল। চারটা বার্থ। চারজনের কেবিন বোঝাই যাচ্ছে। পদ্মজা বলল, ‘বাকি দুজন কখন আসবে? ট্রেন তো ছেড়ে দিচ্ছে।’

‘চার বার্থই আমাদের।’

পদ্মজা ডান পাশের বার্থে বসতে বসতে বলল, ‘অনেক খরচ করেছেন।’

আমির লাগেজ জায়গা মতো রেখে পদ্মজার পাশে বসল। বলল, ‘নিকাব খোলো এবার। কেউ আসছে না।’

পদ্মজা নিকাব খুলল। ঝমঝম শব্দ তুলে ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। আমির জানালা খুলে দিতেই পদ্মজার চুল তিরতির করে উড়তে থাকল। পদ্মজা দ্রুত দুই হাত মুখের সামনে ধরে, বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। আমির বাঁ-পাশের বার্থে বসে হাসল। বলল, ‘হাত সরাও। বউকে একটু দেখি।’

পদ্মজা দুই হাত সরাল। ঠোঁটে বাঁকা হাসি। চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে আছে। চুল অবাধ্য হয়ে উড়ছে। আমির এক হাতের উপর থুতনির ভর দিয়ে বলল, ‘এই হাসির জন্য দুনিয়া এফোঁড়ওফোঁড় করতে রাজি।’

পদ্মজা দাঁত বের করে হাসল, লজ্জায় নামিয়ে নিলো চোখ। আমির পদ্মজার পাশে বসে খোঁপা করে দিল। বলল, ‘এবার বোরকাটাও খুলে ফেল! গরম লাগছে না?’

পদ্মজা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। আমির বলল, ‘কেউ আসবে না। পৌঁছাতে বিকেল হবে। নিশ্চিন্তে শুধু বোরকা খুলতে পারো। আর কিছু খুলতে হবে না।’

পদ্মজার কান রি রি করে উঠে। আমিরের উরুতে কিল দিয়ে বলল, ‘ছি, আপনি যা তা!’

আমির উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। পদ্মজা ভ্রুকুটি করে বোরকা খুলে জানালার ধারে বসে বলল, ‘আমরা যে বাড়িতে যাচ্ছি সেখানে কে কে থাকে?’

‘একজন দারোয়ান আর একজন বুয়া আছে।

‘উনারা বিশ্বস্ত?’

‘নয়তো রেখে এসেছি?’

পদ্মজা কিছু বলল না। আমির পদ্মজার পাশ ঘেঁষে বসল। পদ্মজার কানের দুলে টোকা দিয়ে জড়িয়ে ধরল কোমর। পদ্মজা মেরুদণ্ড সোজা করে বসে। শীতল একটা অনুভূতি সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। চোখ বুজে স্বভাববশত বলে উঠে, ‘কেউ দেখবে!’

আমির ভ্রুকুঞ্চন করে চোখ তুলে তাকাল। পদ্মজা বুঝতে পারে, সে ভুল শব্দ উচ্চারণ করে ফেলেছে। জিহ্বা কামড়ে আড়চোখে আমিরকে দেখে হাসার চেষ্টা করল। আমির বেশ অনেকক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল পদ্মজার দিকে।

এরপর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, পদ্মজার ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে বলল, ‘দেখুক। যার ইচ্ছে দেখুক।’

.

দরজায় টোকা দিচ্ছে কেউ। শব্দে পদ্মজার ঘুম ছুটে গেল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, মনে পড়ছে না। আমিরের কোলে তার মাথা ছিল। মানুষটা এতক্ষণ বসে ছিল তাহলে? পদ্মজাকে এভাবে উঠতে দেখে আমির ইশারায় শান্ত হতে বলে। পদ্মজা দ্রুত নিকাব পরে নেয়। আমির গিয়ে দরজা খুলল। ঝালমুড়ি নিয়ে একজন লম্বা লোক দাঁড়িয়ে আছে, নাকটা মুখের তুলনায় একটু বেশি লম্বা। আমির বলল, ‘এভাবে অনুমতি না নিয়ে টোকা দেয়া অভদ্রতা। আমাদের দরকার পরলে আপনাদের এমনিতেই খুঁজে নিতাম। আর এমন করবেন না। আপনার জন্য আমার বউয়ের ঘুম ভেঙে গেছে। নিন টাকা। ঝালমুড়ি দেন।’

লোকটি বেশ আনন্দ নিয়ে ঝালমুড়ি বানিয়ে দিল। বোধহয় আর বিক্রি হয়নি। হতে পারে আমিরই প্রথম খরিদ্দার। লোকটি চলে গেল। আমির কেবিনে ঢুকে দরজা বন্ধ করে পদ্মজাকে বলল, ‘একজন লোক ঝালমুড়ি বিক্রি করতে এসেছিল। এই নাও খাও। এরপর আবার ঘুমাও।’

দুজনে একসঙ্গে ঝালমুড়ি খেতে খেতে সুখ-দুঃখের গল্প শুরু করে। আমির তার শহুরে জীবনের গতিবিধি বলছে: কখন কখন বাসায় থাকে, কীভাবে ব্যবসায় সময় দেয়। পদ্মজা মন দিয়ে শুনছে। একসময় পদ্মজা বলল, ‘একটা কথা জানার ছিল।’

‘কী কথা?’

‘আমার মনে হচ্ছে, আপনাদের বাড়িতে লুকোনো কোনো ব্যাপার আছে। শুধু মনে হচ্ছে না, একদম নিশ্চিত আমি।’

আমির উৎসুক হয়ে ঝুঁকে বসল। আগ্রহভরে জানতে চাইল, ‘কীরকম?’

পদ্মজা আরো এগিয়ে আসে। আকাশে দুপুরের কড়া রোদ। ছলাৎ করে রোদের ঝিলিক জানালায় গলে কেবিনে ঢুকে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। বাতাস ভ্যাপসা গরম, মাঝে মাঝে শীতল, ঠান্ডাও। সেসব উপেক্ষা করে পদ্মজা তার ভেতরের সন্দেহগুলো বলতে শুরু করল, ‘আমি নিশ্চিত, রুম্পা ভাবিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। কেন বন্দি করে রাখা হয়েছে সেটা দাদু জানেন। উনি সবসময় রুম্পা ভাবির ঘরের দরজায় নজর রাখেন। আমি অনেকবার ঢুকতে চেয়েছি, পারিনি। বাড়ির পেছনের জঙ্গলে কিছু একটা আছে। সেটা ভূত- জিন জাতীয় কিছু না, অন্যকিছু। এমনটা মনে হওয়ার তেমন কারণ নেই। আমার অকারণেই মনে হয়েছে, জঙ্গলটা আপনাআপনি সৃষ্টি হয়নি আর ভয়ংকরও হয়নি। কেউ বা কারা এই জঙ্গলটিকে যত্ন করে তৈরি করেছে। ভয়ংকর করে সাজিয়েছে। এছাড়া, বাড়ির সবাইকে আমার সন্দেহ হয়। এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?’

আমির একটুও অবাক হলো না, মুখের প্রকাশভঙ্গী পালটাল না। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আমি জানি এসব।’

পদ্মজা আমিরের দুই হাত খামচে ধরে এক নিশ্বাসে বলল, ‘আমাকে বলুন। অনুরোধ লাগে, বলুন। আমি শুনতে চাই। অনেকদিন ধরে নিজের ভেতর পুষে রেখেছি।’

আমির অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, ‘আমার ধারণাও তোমার ধারণা অবধিই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে কিছু জানি না। এই রহস্য খুঁজে বের করার ইচ্ছে হওয়া সত্ত্বেও আমি হজম করেছি। আমার ইচ্ছে মাটিচাপা দিয়েছি।’

আমিরের গলাটা কেমন যেন শোনাল। পদ্মজা কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘কেন? কেন দিয়েছেন?’

আমির হাসল। বলল, ‘ধুর! এখন এসব গল্প করার সময়? শুনো, এরপর কী করব…

পদ্মজা কথার মাঝে আটকে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘কথা ঘোরাবেন না। আমি খেয়াল করেছি হাওলাদার বাড়ির প্রতি আপনি উদাসীন। কোনো ব্যাপার পাত্তা দেন না। সবসময় বাড়ির চেয়ে দূরে দূরে থাকেন। কোনো ঘটনায় নিজেকে জড়ান না। কেন নিজেকে গুটিয়ে রাখেন?’

আমিরের দৃষ্টি অস্থির। সে এক হাতে বার্থ খামচে ধরার চেষ্টা করে ঘন ঘন শ্বাস নেয়। পদ্মজা খুব অবাক হয়! আমিরের এত কষ্ট হচ্ছে কেন?

পদ্মজার উৎকণ্ঠা, ‘কী হলো আপনার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?’

‘না! কিছু হয়নি।’ বলেই আবার অদ্ভুতভাবে ডাকল, ‘পদ্মবতী?’

আমির চট করে পদ্মজার দুই হাত শক্ত করে ধরল। তার চোখ দুটিতে ভয়। পদ্মজা আমিরের চোখের দিকে তাকাল। আমির বলল, ‘আমার তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে। অনেকবার বলতে গিয়েও পারিনি। আজ যখন কথা উঠেছে…আচ্ছা পদ্মজা, আমার পরিচয় জেনে আমাকে ছেড়ে যাবে না তো? আমি তোমাকে হারালে একাকীত্বে ধুঁকে ধুঁকে নিঃশেষ হয়ে যাব। আমার জীবনের একমাত্র সুখের আলো তুমি।’

পদ্মজার হৃৎপিণ্ড থমকে গেল। সে পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছে না। আমির উত্তরের আশায় চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে। পদ্মজা ধীর কণ্ঠে বলল, ‘লুকোনো সব কথা বলুন আমাকে। আপনি আমার স্বামী। আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনো ভাবি না আমি। বিশ্বাস করুন!’

আমির নতজানু হয়ে বলল, ‘আমি আমার আব্বার অবৈধ সন্তান। আমার জন্মদাত্রী জন্ম দিয়েই মারা যায়। দিয়ে যায় অভিশপ্ত জীবন।’

পদ্মজা দুই পা কেঁপে উঠে। মাথা ভনভন করে উঠে। শিরদাঁড়া বেয়ে গড়িয়ে যায় ঠান্ডা স্রোত। আমির ঢোক গিলে আবার বলল, ‘আমার জন্মদাত্রী মারা যাওয়ার পর আব্বা আমাকে নিয়ে আসেন। আমার বর্তমান আম্মা আমাকে দেখে খুব রেগে যায়। কিছুতেই আমাকে মানতে চায়নি। তখন ছেলেমেয়ে ছিল না আম্মার। তাই মাস ঘুরাতেই আমাকে মেনে নিলো। ছেলের মতো আদর শুরু করল। এসব দাদুর মুখে পরে শুনেছি। আব্বা আমাকে তুলে এনে জায়গা দিলেও সন্তানের মতো ভালোবাসেননি কখনো। যখন আমার এগারো বছর আমি আর রিদওয়ান একসঙ্গে জানতে পারি, আমি আব্বার অবৈধ সন্তান। আব্বা আবার রিদওয়ানকে খুব আদর করতেন। রিদওয়ান ছোটো থেকেই আমার সঙ্গে ঝামেলা করত, ঝগড়া করত। যখন এমন একটা নোংরা খবর জানতে পারল, তখন ও আরো হিংস্র হয়ে ওঠে। আমি তখন অনেক শুকনো আর রোগা ছিলাম। রিদওয়ান ছিল স্বাস্থ্যবান, তেজি। আব্বার এমন ছেলেই পছন্দ। কেন পছন্দ জানা নেই। উনিশ থেকে বিশ হলেই রিদওয়ান খুব মারত। আব্বার কাছে বিচার দিলে রিদওয়ান আরো দশটা বানিয়ে বলত। তখন আব্বা আমাকে মারতেন।

‘রিদওয়ান একবার আমাকে জঙ্গলে বেঁধে ফেলে রেখেছিল। দেড় দিন পড়ে ছিলাম। রাতে ভয়ে প্যান্টে প্রস্রাব করে দিয়েছি। মুখ বাঁধা ছিল, তাই এত চিত্কার করেছি তবুও কেউ শুনেনি। ভয়ে বুক কাঁপছিল। মনের ভয়ের কারণে কল্পনায় ভয়ংকর ভূত, দানব দেখছিলাম। বাঁচানোর মতো কেউ ছিল না। আমাদের বাড়িতে কাজ করতেন ফকির মিয়া নামে একজন। দেড় দিনের দিন উনি আমাকে জঙ্গলে বাঁধা অবস্থায় পান। বাড়িতে বৈঠক বসে। রিদওয়ানকে দুটো বেতের বাড়ি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। রিদওয়ান এক তো বলিষ্ঠবান তার উপর আমার দুই বছরের বড়ো। কিছুতেই পেরে উঠতাম না। জানো পদ্মবতী, ও…ও পানিতে আমার মাথা জোর করে চেপে ধরে রেখেছে অনেকবার। ও মানসিকভাবে বিকৃত, পশু। ওর জন্য আমার জীবন জাহান্নাম হয়ে ওঠে। আম্মাকে বললেও আম্মা বাঁচাতে পারতেন না। সবসময় নিশ্চুপ থাকতেন। যখন আমার পনেরো বছর বয়স, তখন এক শীতের রাতে পালানোর চেষ্টা করি; শীতে কাঁপতে কাঁপতে খেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। পরেরদিন চোখ খুলে দেখি, আমি হাওলাদার বাড়িতে। আমার সামনে রিদওয়ান, আব্বা, চাচা, আম্মা সবাই। বুঝতে পারি, আমার আর কোনো জায়গা নেই। এখানেই থাকতে হবে। যতই কষ্ট হোক থাকতে হবে। এছাড়া উপায় নেই।’

আমিরের কণ্ঠে স্পষ্ট কান্না। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। পদ্মজা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। আমির অশ্রুসজল চোখ মেলে পদ্মজার দিকে তাকাল। হেসে পদ্মজার দুই চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ‘আরে পাগলি! কাঁদছো কেন? এসব তো পুরনো কথা। আমার পড়াশোনাটা আবার চলছিল ভালোই। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম। এ দিক দিয়ে বুদ্ধিমান ছিলাম। সবসময় ভালো ফলাফল ছিল। এজন্য কদর একটু হলেও পেতাম। যখন আমার আঠারো বয়স বাড়িতে অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করি। রাত করে অদ্ভুত কিছুর শব্দ শুনি। জঙ্গলে আলো দেখতে পাই। চাচাকে প্রায় রাতে জঙ্গলে যেতে দেখি। রিদওয়ান আর চাচা মিলে কিছু একটা নিয়ে সবসময় আলাপ করত। ওদের চোখেমুখে থাকত লুকোচুরি খেলা। আমি একদিন রাতে চাচাকে অনুসরণ করি। প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পর চাচা দেখে ফেলে। এই ভুলের জন্য সেদিন কম মার খেতে হয়নি! তবুও বেহায়ার মতো কয়দিন পর আবার অনুসরণ করি। রিদওয়ান পেছনে ছিল দেখিনি।

‘আব্বা সেদিন অনেক মারলেন। দা পর্যন্ত ছুঁড়ে মারেন। এই যে থুতনির দাগটা, এটা সেই দায়ের আঘাত। একসময় আব্বা আমাকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন। বললেন, আমাকে পড়ালেখার জন্য শহরে পাঠাবেন কোনো ব্যাবসা করতে চাইলে তারও সুযোগ করে দিবেন। আমি এই বাড়ি আর বাড়ির আশপাশ নিয়ে মাথা না ঘামাই। আমি মেনে নিই। রিদওয়ানের সঙ্গে থাকতে হবে না আর। এর চেয়ে আনন্দের কী আছে?

চলে আসি ঢাকা। শুরু হয় নিজের জায়গা শক্ত করার যুদ্ধ। এখানে এসেও অনেক অপমান সহ্য করতে হয়। তবুও থেমে যাইনি। যুদ্ধ করে চলেছি। আমাকে বাঁচতে হবে। মানুষের মতো বাঁচতে হবে। কারো লাথি খেয়ে না। যখন আমার তেইশ বছর, তখন থেকে আমার কদর বেড়ে যায়। ব্যবসায় মোটামুটি সফল হয়ে যাই। ভাগ্য ভালো ছিল আমার। অতিরিক্ত পরিশ্রম আমাকে নিরাশ করেনি। তখন আব্বা আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ রিদওয়ান আগের মতো হাত তোলার সাহস পায় না। সেই আমি আজ এই জায়গায়। এখন আমার যে অবস্থান, হাওলাদার বাড়ির কারোর সাহস নেই আমার চোখের দিকে তাকানোর। আমি চাইলেই শোধ নিতে পারি। কিন্তু নেব না। তারা থাকুক তাদের মতো। রিদওয়ান ছোটোবেলা যা করেছে, মেনে নিয়েছি। এখন তোমার দিকেও নজর দিয়েছে। ওর নজর আমার বাড়িগাড়ি, অফিস-গোডাউনেও আছে। আমি টের পাই, ও পারলে আমাকে খুন করে ফেলত। কিন্তু পারে না। আমার ক্ষমতার ধারেকাছেও ওর জায়গা নেই। এখন আমার নিজের এক বিশাল রাজত্ব আছে, আছে অহংকার করার মতো অনেক কিছু। হাওলাদার বাড়ির কেউ কেউ মিলে আমাকে নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করছে, আমি নিশ্চিত। তাই বাড়িতে আমি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। আম্মা ছাড়া ওই বাড়ির সবার ভালোবাসা মুখোশ মাত্র। আমার দরকার ছিল একজন ভালো মনের সঙ্গিনী। আমি পেয়ে গেছি, আর কিছু দরকার নেই। আমি আমার অর্ধাঙ্গিনীকে তার আসল সংসারে নিয়ে যাচ্ছি। এখন আমার মন শান্ত। কোনো চিন্তা নেই। নিজেকে খুব বেশি সুখী মনে হচ্ছে।’

আমির পদ্মজার হাতে চুমু খেল। পদ্মজা তখনো কাঁদছে। সে আচমকা আমিরকে গভীরভাবে, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমি কখনো আপনাকে কষ্ট দেব না। কোনোদিন না। কেউ আপনাকে ছুঁতে আসলে আমি তার গর্দান নেব। আমি উন্মাদ হয়ে তাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করব।’

‘এখন আর কারো সেই ক্ষমতা নেই। মিছেমিছি ভয় পাচ্ছো।’

পদ্মজা আরো শক্ত করে তাকে ধরার চেষ্টা করে। আমির পদ্মজার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘এই প্রথম আমার বউয়ের গভীর আলিঙ্গন পেলাম। ভালো লাগছে। ছেড়ো না কিন্তু!’

.

রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে হাঁটছে ওরা। আমির পদ্মজার এক হাত ধরে রেখে খুব দ্রুত হাঁটছে। পদ্মজা তাল মেলাতে পারছে না, চেষ্টা করছে যদিও। মোটরগাড়ি নিয়ে একজন কালো চশমা পরা লোক অপেক্ষা করছিল। তার সামনে থামল আমির। লোকটা সালাম দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে ব্যাগ জায়গামতো রাখল। আমির আগে উঠতে বলল পদ্মজাকে। পদ্মজা অবাক হলো। এরকম গাড়ির সঙ্গে সরাসরি পরিচয় নেই তার। কিন্তু প্রকাশ করল না। আমিরের কথামতো গাড়িতে উঠে বসল সে, তারপর উঠল আমির গাড়ি চলতে শুরু করে। আমির পদ্মজাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমাদের নিজস্ব গাড়ি। দুজনে রাত-বিরাতে যখন-তখন ঘুরতে বের হব।’

পদ্মজা কিছু বলল না। সে উপভোগ করছে নতুন জীবন। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গাড়ি একটা বাড়ির সামনে থামল। কালো চশমা পরা লোকটি দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে খুলে দিল আমিরের ডান পাশের দরজা। পদ্মজাকে নিয়ে নামল আমির।

বাড়ি দেখে তো পদ্মজা মুগ্ধ! ডুপ্লেক্স বাড়ি। একজন দারোয়ান দৌড়ে এসে সালাম দিল, পরিচিত হলো পদ্মজার সঙ্গে। এরপর এলো একজন মধ্যবয়স্ক নারী। সে বোধহয় বাড়ির কাজের লোক। সবাই একসঙ্গে বাড়ির ভেতর ঢুকল। পদ্মজা তার নতুন বাড়ি মন দিয়ে দেখছে। পূর্ব দিক থেকে সদর দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল বিশাল বৈঠকখানা উত্তর দক্ষিণে লম্বা। দক্ষিণ পাশে বারান্দা তাতে নানা ধরনের ফুল ফুটে আছে টবের মধ্যে, মনে হচ্ছে একটা ছোটোখাটো বাগান। বৈঠকখানার দক্ষিণ পশ্চিম কোনার দিকে বেশ বড়ো শোবার ঘর। পদ্মজা প্রশ্ন করার আগে আমির বলল, ‘না, এটা আমাদের ঘর না।’

উত্তর পশ্চিম কোনার দিকে রান্নাঘর এবং টয়লেট। আর এই দুয়ের মাঝে মানে বৈঠকখানার পশ্চিম দিকের মাঝখানটায় খাওয়ারঘর। বৈঠকখানার মাথার ওপর দিকে তাকালে সেখানে ঝুলতে থাকা সোনালি রঙের ঝাড়বাতি দেখা যায়। বৈঠকখানার উত্তর দিকে একটা সিড়ি সাপের মতো পেঁচিয়ে ওপরে উঠে গেছে। আমির পদ্মজাকে নিয়ে সেদিকে এগোল। সিঁড়ি পেরুনোর পর হাতের বাঁ দিকে অনেক বড়ো একটা শোবার ঘর। দামি দামি জিনিসে সৌন্দর্য আকাশছোঁয়া। দুজন একসঙ্গে শোবার ঘরটিতে প্রবেশ করল। পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে সবকিছু দেখছে। আমির বলল, ‘গোসল করে নাও?’

পদ্মজা বোরকা খুলে কলপাড় খুঁজতে থাকল। আমির গোসলখানার দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘এই যে এদিকে ‘

দুজন একসঙ্গে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হয়। পদ্মজা দুই তলাটা আরেকটু দেখার জন্য ডানদিকে মোড় নিলো। প্রথমে চোখে পড়ল বড়ো ব্যালকনি। এরপর আরেকটা শোবার ঘর। ব্যালকনিতে লতাপাতার ছোটো ছোটো টব।

বিরাট অট্টালিকায় সুখে কেটে গেল পাঁচ মাস। লাবণ্য দেশ ছেড়েছে দুই মাস হলো। মাস তিনেক হলো বুয়াও কাজ ছেড়ে দিয়েছে। পদ্মজা আর কাজের লোক নিতে দিল না, সে এক হাতেই নাকি সব পারবে। তবুও আমির একটা বারো বছর বয়সি মেয়ে রেখেছে সাহায্যের জন্য। ভোরের নামাজ পরে রান্নাবান্না করে পদ্মজা। এরপর শাড়ি পালটে নেয় কলেজে যাওয়ার জন্য। আমিরকে ব্লেজার, টাই পরতে সাহায্য করে। প্রথম যেদিন আমিরকে ব্লেজার পরতে দেখেছিল সেদিন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এই পোশাকের নাম কী? আপনাকে খুব বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে।’

আমির হেসে জবাব দিয়েছিল, ‘ব্লেজার। বাইরে থেকে আনা।’

এমন অনেক কিছুই পদ্মজার অজানা ছিল। সবকিছু এখন তার চেনাজানা। এই বিলাসবহুল জীবন বেশ ভালো করেই উপভোগ করছে। মানুষটা সারাদিন ব্যস্ত থাকে। তবুও ফাঁকেফাঁকে টেলিফোনে যোগাযোগ করে। পদ্মজাকে নিয়ে গোডাউন দেখিয়েছে, অফিস দেখিয়েছে। সবকিছু সাজানো, গোছানো। গোডাউনে বিভিন্ন ধরনের পণ্য। কত কত রকমের দ্রব্য। পদ্মজা জীবনে ভালোবাসা এবং অর্থ—দুটোই চাওয়ার চেয়েও বেশি পেয়েছে।

সকাল নয়টা বাজে। আমির তাড়াহুড়ো করছে, তার নাকি আজ দরকারি মিটিং আছে। পদ্মজা শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে দৌড়ে দৌড়ে খাবার পরিবেশন করছে। আমির দুই তলা থেকে নেমেই বলল, ‘আমি গিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। কলেজ চলে যেয়ো।’

‘আরে, খেয়ে যাবেন তো।’

‘সময় নেই। আসছি।’

‘খেয়ে যান না।’

‘বলছি তো তাড়া আছে। জোরাজুরি করছো কেন?’

আমির দ্রুত বেরিয়ে যায়। পিছু ডাকতে নেই, তাই পদ্মজা ডাকল না। মনাকে ডেকে বলল, ‘খেয়ে নাও তুমি।’

মনা পদ্মজার সাহায্যকারী। পদ্মজার ছোটোখাটো ফরমায়েশ পালন করে। পদ্মজা বৈঠকখানায় গিয়ে বসল। আজ কলেজে যেতে ইচ্ছা করছে না। ভোরে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম বৃষ্টি, অকারণে বিষণ্নতায় ছেয়ে আছে মন। অকারণেও না বোধহয়! আমির বিরক্ত হয়ে কথা বলেছে, এজন্যই বোধহয় মনের আকাশে বৃষ্টি নেমেছে। পদ্মজা পুরোটা দিন উপন্যাস পড়ে কাটিয়ে দিল। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে কলিং বেল বেজে ওঠে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল পদ্মজা। আমির দাঁড়িয়ে আছে। বাইরে বাতাস হচ্ছে। পদ্মজা বলল, ‘আসুন।’

আমির ভেতরে ঢুকল না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা কপাল কুঁচকাল, ‘কী হলো? আসুন।’

আমির চট করে পদ্মজাকে কোলে তুলে নিলো। পদ্মজা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘কেউ দেখবে।’

আমির মনাকে ডাকল, ‘মনা? কই রে? দেখে যা।’

‘আপনি ওকে ডাকছেন কেন?’

‘এবার কাউকে দেখাবই।

‘উফফ! ছাড়ুন।’

‘মনা? মনা?’

মনা দুই তলা থেকে নেমে আসে। আমির মনাকে নামতে দেখে বলল, ‘এই দেখ তোর আপাকে কোলে নিয়েছি। দাঁড়া, তোর সামনে একটু আদর করি।’

পদ্মজা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে চাপাস্বরে বলল, ‘মনা কী ভাববে! আমি আর বলব না, কেউ দেখবে। এবার ছেড়ে দিন।’

আমির পদ্মজাকে নামিয়ে দিল। মনা কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কী করবে বুঝতে পারছে না। আমির বলল, ‘যা ঘরে যা।’

মনা এইটা শোনার অপেক্ষায় ছিল। সে দৌড়ে চলে যায়। পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। আমিরকে গুরুজনদের মতো বলল, ‘আক্কেলজ্ঞান কখন হবে আপনার? বয়স তো কম হলো না।’

অবিকল পদ্মজার কথার ধরণ অনুসরণ করে আমির বলল, ‘আর কতদিন কেউ দেখবে কথাটা মুখে থাকবে? বিয়ের তো কম দিন হলো না।’

‘আপনি…আপনি কালাচাঁদ না কালামহিষ।’

‘এটা পূৰ্ণা বলত না? হেহ, আমি মোটেও কালো না।’

‘তো কী? এই যে দেখুন, দেখুন…আমার হাত আর আপনার হাত।’

পদ্মজা হাত বাড়িয়ে দেখায়। আমির খপ করে পদ্মজার হাত ধরে চুমু খেয়ে বলল, ‘এই হাতও আমার।’

পদ্মজা বলল, ‘ঠেসে ধরা ছাড়া আর কী পারেন আপনি? ছাড়ুন।’

আমির পদ্মজার হাত ছেড়ে দিয়ে হাসতে থাকল।

৪৬

দেখতে দেখতে চলে এসেছে শীতকাল। সকাল বাজে দশটা তবুও কুয়াশার চাদরে চারিদিক ঢাকা। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা। মনটা কু গাইছে। অজানা একটা ঝড় বইছে বুকে, স্থির হয়ে কোথাও দাঁড়াতে পারছে না। ঢাকা আসার পর থেকে নিয়মিত পূর্ণার লেখা চিঠি পেত। প্রায় চার মাস হলো বাড়ি থেকে কোনো চিঠি আসছে না। পদ্মজা নয়টা চিঠি পাঠিয়েছে। একটারও উত্তর আসেনি। বাড়ির সবার কথা খুব মনে পড়ছে। ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে চলে যায় পদ্মজা। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়। একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখে: হাওলাদার বাড়িতে টেলিফোন এনেছে। পূর্ণা হাওলাদার বাড়িতে এসে পদ্মজার সঙ্গে যোগাযোগ করে। পদ্মজা কথা বলতেই ওপাশ থেকে পূর্ণার উল্লাস ভেসে এলো, ‘আপা? আপা আমি তোমার গলার স্বর শুনতে পাচ্ছো। তুমি শুনছো?’

‘শুনছি। কেমন আছিস? আম্মা কেমন আছে? বাড়ির সবাই ভালো আছে?’

‘সবাই ভালো। তুমি কেমন আছো? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার গলা শুনছি!’

‘আচ্ছা, শোন?’

‘বলো আপা।’

‘আশপাশে কেউ আছে?’

‘খালাম্মা আছে।’

‘এই বাড়িতে আর আসবি না। আমি যতদিন না আসব। মনে রাখবি?’

‘কেন? কেন আপা?’

‘মানা করেছি, শুনবি।’

‘আচ্ছা, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম এবার প্রতিদিন দুলাভাইয়ের বাড়িতে আসব। আর তোমার সঙ্গে কথা বলব। ধুর!’

‘আবার যখন আসব আমাদের বাড়িতে টেলিফোন নিয়ে আসব। এরপর প্রতিদিন আমাদের কথা হবে। এখন আমার মানা শোন।’

‘টাকা কোথায় পাবে?’

‘সেদিন উনি বলেছেন, নিয়ে আসবেন। আমি মানা করেছিলাম। বললেন, তুমি আনন্দে থাকলেই আমার সুখ। তোমার সুখের জন্যই এখন আমার সব। আর কী বলার?’

‘দুলাভাই খুব ভালো তাই না আপা?’

‘হুম। আম্মার শরীর সত্যি ভালো আছে?’

‘আছে। আগের চেয়ে ভালো।’

‘খেয়াল রাখিস আম্মার।’

‘রাখব।’

বাতাসটা বেড়েছে। পদ্মজার গা কাঁটা দিচ্ছে। আচমকাই ঘুমটা ভেঙে চট করে উঠে বসল সে। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল, টেলিফোন নেই। স্বপ্নে মনে হচ্ছিল সবই বাস্তব! পদ্মজা দেয়াল ঘড়িতে দেখে, এগারোটা বাজে। টেলিফোন পুরো দেশে হাতেগোনা কয়জনের বাসায় আছে। সেখানে গ্রামে টেলিফোনে যোগাযোগ করা যাবে ভাবাও হাস্যকর।

পদ্মজা বিছানা ছেড়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলো, কপালে হাত দিয়ে দেখে, গায়ে জ্বর এসেছে। পূর্ণার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রান্নাঘরে যেতে যেতে ডাকল, ‘মনা?’

হঠাৎ মাথায় এলো, মনা তো বাসায় নেই। দুইদিন আগে বাড়িতে গিয়েছে। খুব একা লাগছে তার। সবকিছুই রান্না করা আছে। আর কী রাঁধবে? এক কাপ চা বানিয়ে খাওয়া যায়। পদ্মজা এক কাপ চা নিয়ে বৈঠকখানার জানালার পাশ ঘেঁষে বসল। গ্রামের সোনালি দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। মোর্শেদ প্রথম যেদিন সোয়েটার কিনে দিয়েছিলেন, সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে। সকাল সকাল উঠে খেজুরের রস দিয়ে পিঠা খাওয়া, তিন বোনের একসঙ্গে পড়তে বসা, একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া— স্বর্ণময় দিনগুলো কখনো কী আর ফিরবে?

কলিং বেল বেজে উঠল। অসময়ে কলিং বেল শুনে অবাক হলো পদ্মজা। আমির তো এই সময় আসে না। দুই ঘণ্টা আগেই বের হলো। তাহলে কে এসেছে? গায়ে শাল টেনে নিলো সে। এরপর দরজা খুলল। দরজার সামনে আমির দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘এত দ্রুত?’

‘তৈরি হও, গ্রামে যাব।’

পদ্মজা চোখের পলক ফেলে আবার তাকাল। বলল, ‘গ্রামে মানে অলন্দপুর?’

আমির দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল, ‘হু, দ্রুত যাও। শাড়ি পালটাও।’

পদ্মজার উৎকণ্ঠা, ‘হুট করে যে! কোনো খারাপ খবর?’

আমির হেসে বলল, ‘তেমন কিছুই না। কয়দিন ধরে দেখছি মন খারাপ করে বসে থাকো। তাই হুট করে যাওয়ার কথা ভাবলাম। কলেজে তো শীতের বন্ধ আছেই। আমি এক সপ্তাহর জন্য ম্যানেজারকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আর আলমগীর ভাইয়া এসেছে। কোনো চিন্তা নেই। এবার দ্রুত যাও। ট্রেন বারোটায়। আজকের শেষ ট্রেন কিন্তু এটাই। আমি তৈরি আছি। শুধু লাগেজে দুই তিনটা শার্ট ঢুকিয়ে নিলেই হবে।’

পদ্মজা আর কিছু বলল না। ছুটে গেল দুই তলায়। তার হৃৎপিণ্ড খুশিতে দামামা বাজাচ্ছে। দশ মিনিটের ব্যবধানে শাড়ি পালটে, লাগেজও গুছিয়ে ফেলল। দুজন বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য অলন্দপুর। দীর্ঘ আট মাস পর জন্মস্থান, জন্মদাত্রী, জন্মদাতা, ভাই-বোন সবাইকে দেখতে পাবে। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনা এতটাই কাজ করছে যে, শীতের প্রকোপও টের পাচ্ছে না পদ্মজা।

কেবিনে ঢোকার পর থেকে বার বার এক কথাই বলে চলেছে সে, ‘কতদিন পর যাচ্ছি! আম্মা হুট করে আমাকে দেখে জ্ঞান না হারিয়ে ফেলে! পূর্ণা নিশ্চিত অজ্ঞান হয়ে যাবে।’

আমির হাসল। পদ্মজার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আসো গল্প করি।’

পদ্মজার তাকাল। তার চোখ দুটি হাসছে। চিকমিক করছে। সে প্রশ্ন করল, ‘আলমগীর ভাইয়া আমাদের বাসায় উঠবেন?’

‘না। অফিসেই থাকবে।’

‘রানি আপা ভালো আছে? কিছু বলছে?’

আমির চুল ঠিক করতে করতে ব্যথিত স্বরে বলল, ‘ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। বাচ্চা নষ্ট করতে দিল না। এরপর মৃত বাচ্চা জন্ম দিল। এখন অবস্থা আরো করুণ। ঘরেই বন্দি।’

‘ইস! খারাপ লাগে ভাবলে। মানুষের কপাল এত খারাপ কী করে হয়! মোড়ল বাড়ির সড়ক দেখা যাচ্ছে। পদ্মজা খুশিতে আত্মহারা। দ্রুত হাঁটছে। সে কখনো বাহারি শাড়ি, বোরকা পরে না। আজ পরেছে। শাড়ি বোরকা দুটোতেই ভারি কাজ, চকচক করা ছোটো-বড়ো পাথর। দেখলে মনে হয় হীরাপান্না চিকচিক করছে। সে তার মাকে দেখাতে চায়, সে কতটা সুখী। কোনো কমতি নেই তার জীবনে। মোড়ল বাড়ির গেট ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সব আনন্দ, উল্লাস নিভে যায়। পূর্ণা-প্রেমা দাঁড়িয়ে আছে। দুজনকে চেনা যাচ্ছে না। শুকিয়ে কয়লা হয়ে গেছে।

চোখ ঢুকে গেছে গর্তে। গাল ভাঙা। গায়ে শুধু হাড়। মনে হচ্ছে কতদিন অনাহারে কাটিয়েছে। পূর্ণা পদ্মজাকে দেখেই ‘আপা’ বলে কেঁদে উঠল। ছুটে না এসে দপ করে বসে পড়ল মাটিতে। প্রেমা দৌড়ে এসে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল। পদ্মজা বাকরুদ্ধ। অজানা আশঙ্কায় গলা শুকিয়ে আসছে। চোখ দুটো মাকে খুঁজছে। পদ্মজা আমিরের দিকে তাকাল। আমিরের চোখ অস্থির। পদ্মজা প্রেমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আড়চোখে দেখে, পূর্ণা হাউমাউ করে কাঁদছে। কেন আসছে না ছুটে? কীসের এত কষ্ট তার?

পদ্মজা এগিয়ে আসে। পূর্ণাকে টেনে তুলে ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘এত শুকিয়েছিস কেন? আম্মা…আম্মা ভালো আছে?’

‘আপা…আপারে।’ বলে পদ্মজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল পূর্ণা। পদ্মজা ঘরের ভেতর তাকাল। কয়েকজোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। অজ্ঞাত ভয়ে গলা দিয়ে কথা আসছে না তার। পূর্ণাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে ঘরের ভেতর ঢুকল। সদর ঘরে চেনা অনেকগুলো মুখ। প্রতিবেশী সবাই। আপন মানুষগুলো কোথায়? পদ্মজা আরো দুই পা এগিয়ে আসে।

উঠান থেকে মনজুরার কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘পদ্ম আইছে, পদ্ম…’

সদর ঘরের মধ্যখানে পাটিতে শুয়ে আছেন হেমলতা। গায়ের ওপর কাঁথা। মেরুদণ্ড সোজা করে রাখা। গোলাপজলের ঘ্রাণ চারপাশে। পদ্মজার বুকের হাড়গুলো যেন গুড়োগুড়ো হতে শুরু করল। বুকে এত ব্যথা হচ্ছে! সহ্য করা যাচ্ছে না। সে হেমলতার পাশে বসে নিস্তরঙ্গ গলায় ডাকল, ‘আম্মা? ও আম্মা?’

হেমলতা পিটপিট করে তাকালেন। চোখ দুটি ঘোলা, কোটরে ঢুকে গেছে। গালে মাংস নেই, ভাঙা। তিনি পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। চিনতে পারলেন না। পদ্মজা হেমলতার এক হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু দিল। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে হেমলতার হাতে। তাতেও হেমলতার ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি নিজের মতো ঘরের ছাদে তাকিয়ে আছেন। মনজুরা সদর ঘরে ঢুকেই বিলাপ শুরু করেছেন, পদ্মজা জোরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘চুপ করো। কেউ কাঁদবে না। চুপ করো।’

সবার কান্না থেমে যায়। পদ্মজা হেমলতাকে বলল, ‘ও, আম্মা? কথা বলো? আমি…আমি তোমার পদ্মজা। তোমার আদরের পদ্মজা।’

‘আম্মা চারমাস ধরে কাউকে চিনে না, আপা।’ পূর্ণা ডুকরে কেঁদে উঠল। পদ্মজার চোখ পড়ে সদর ঘরের ঈশান কোণে। মোর্শেদ কপালে হাত দিয়ে বসে আছেন। এই মানুষটাকেও চেনা যাচ্ছে না। পিঠের হাড্ডি ভেসে আছে। সবার এ কী হাল! পদ্মজা বাকহীন হয়ে পড়েছে। কিছু বলবে নাকি কাঁদবে? বুকে নাম না জানা নীল যন্ত্রণা হচ্ছে! শরীরের শক্তি কমে আসছে। পদ্মজা দুই হাতে হেমলতার মাথা তুলে ধরল। হেমলতা তাকালেন। নিষ্প্রাণ চাহনী। হেমলতার মাথা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে পদ্মজা। আকুল ভরা কণ্ঠে বলল, ‘একবার কথা বলো, আম্মা? একবার দুই হাতে জড়িয়ে ধরো।’

হেমলতার হাত দুটো নেতিয়ে আছে মাটির ওপর। পূর্ণা খেয়াল করল—হেমলতার হাত দুটি কাঁপছে। চেষ্টা করছেন পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরার, কিন্তু পারছেন না। তাহলে কী পদ্মজাকে চিনতে পেরেছেন? পদ্মজা কাঁদতে থাকল। অনেকে অনেক কিছু বলছে। কারো কথা কানে ঢুকছে না। শুধু বুঝতে পারছে, এই পৃথিবীর বুক থেকে তার মা হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছেন হেমলতা। হারিয়ে যাচ্ছে তার কল্পনার রাজ্যের রাজরানি। স্বপ্ন তো সব পূরণ হয়নি! এ তো কথা ছিল না। তবে কেন এমন হচ্ছে? পদ্মজার বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় বিষিয়ে উঠছে সারা শরীর। কাঁপা ঠোঁটে হেমলতার পুরো মুখে চুমু খেল সে। ভারি করুণ ভাবে বলল, ‘ও আম্মা? কোথায় হারাল তোমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ঝাঁঝালো কণ্ঠ?’

কেটে গেল অনেকটা মুহূর্ত। কাছের মানুষেরা ছাড়া আর কেউ নেই। রা নেই কারো মুখে। হেমলতার মতোই সবাই বাকহীন, স্তব্ধ। কেউ খায়নি বাসন্তী গুপ্ত ব্যথা নিয়ে রেঁধেছেন। প্রেমা-প্রান্ত, আমির ছাড়া কেউ খেল না। পদ্মজাকে অনেক জোরাজুরি করেছে আমির। কিছুতেই খাওয়াতে পারল না। আমিরও আর ঘাঁটল না। পদ্মজা জানতে পারল, দুই মাস ধরে হেমলতা বিছানায় পড়ে আছেন। মাঝে মাঝে এক দুটো কথা বলেন। চারদিন ধরে তাও বলেন না। গতকাল ভোরে মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়েছে। এমন অবস্থা হয়েছিল যে সবাই ভেবেছিল আত্মাটা বেরিয়েই যাবে। হাওলাদার বাড়ি থেকে সবাই দেখতে আসে। তখন জানা যায়, আলমগীর ঢাকা যাচ্ছে। মোর্শেদ অনুরোধ করে বলে, পদ্মজা আর আমিরকে খবর দিতে। ওরা যেন দ্রুত চলে আসে। রাতের ট্রেনে সকালে গোডাউনে পৌঁছে আমিরকে সব বলে আলমগীর। আমির সব শুনে আর দেরি করেনি। পদ্মজাকে নিয়ে চলে আসে। পথে কান্নাকাটি করবে তাই আগে কিছুই বলেনি। পদ্মজা এতসব জেনেও কিছু বলল না। মনে অভিমানের পাহাড় তৈরি হয়েছে। কারো কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না। সারাক্ষণ চেষ্টা করছে হেমলতার সঙ্গে কথা বলার। হেমলতা কিছুতেই কথা বলছেন না। একটু-আধটু পানি খাচ্ছে, এর বেশি আর কিছুই খাচ্ছেন না। গায়ে মাংস বলতে কিছু নেই। চামড়া ঝুলে গেছে। পদ্মজা হেমলতার পুরো শরীর মুছে দিয়ে কাপড় পালটে দিল। এরপর শোয়া অবস্থায় অজু করাল। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে আরো একবার আকুতি করল, ‘একবার কথা বলো, আম্মা। একবার ডাকো পদ্মজা বলে।’

হেমলতা তাকালেন, কিছু বললেন না। তাকিয়েই রইলেন। মাঝরাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখনো পদ্মজা জাগ্রত। ক্লান্ত হয়ে সবার চোখ দুটি লেগে গেলেও তার চোখ দুটির পলকও পড়ছে না। তার মন বলছে, কে যেন চারপাশে ঘুরছে তার মাকে নিয়ে যেতে। ঝিঁঝিপোকার ডাক, শেয়ালের হাঁক ছাপিয়ে সে যেন কারো পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। অবচেতন মন যেন অনুভব করছে আজরাইলের উপস্থিতি। পদ্মজার বুকে ভয় জেঁকে বসে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কেঁদে অনুরোধ করে, ‘অনুরোধ করছি, আমার মাকে কষ্ট দিয়ো না।’

মুখে হাত চেপে কান্না আটকানোর প্রচেষ্টায় বার বার ব্যর্থ হতে থাকল পদ্মজা। কাঁদতে কাঁদতে কণ্ঠ নিভে এসেছে। ঠান্ডায় শরীর জমে গেছে। চোখটা লেগেছে মাত্র তখন দপ একটা শব্দ ভেসে এলো। চমকে তাকাল পদ্মজা। হেমলতা হাত দিয়ে মাটি থাপড়াচ্ছেন। শরীর কাঁপছে। পদ্মজার নিশ্বাস থেমে যায়। হেমলতার এক হাত শক্ত করে ধরে কেঁদে উঠে বলল, ‘আম্মা, আম্মা যেয়ো না আমাকে ছেড়ে। ও আম্মা, আম্মা…আমার কষ্ট হচ্ছে আম্মা। তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে? আম্মা পায়ে পড়ি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আম্মা…আম্মা।’

দ্রুত হেমলতাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে পদ্মজা। বাড়ির সবার ঘুম ভেঙে যায়। অনেকগুলো করুণ কান্নার স্বরে হাহাকার করে ওঠে মোড়ল বাড়ি। পদ্মজা কাউকে অনুরোধ করে বলল, ‘নিয়েন না আমার আম্মাকে। কষ্ট দিচ্ছেন কেন এত? আমার আম্মার কষ্ট হচ্ছে। আম্মা, ও আম্মা। আম্মা আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।’

পদ্মজা কাঁদতে কাঁদতে সুরা ইয়াসিন পড়া শুরু করল। হেমলতা শেষবারের মতো উচ্চারণ করলেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।’

শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে চোখ বুজে ফেললেন। থেমে গেল শরীরের কাঁপাকাঁপি। দেহটা শুধু পড়ে রইল পরিত্যক্ত বস্ত্রের মতো। পদ্মজা দেহটাকে খামচে জড়িয়ে ধরে আম্মা বলে চিৎকার করে উঠল। মানুষ ছুটে আসে আশপাশের সব বাড়ি থেকে। পূর্ণা কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাল। ফজরের আজান পড়ছে। আমির পদ্মজাকে হেমলতার থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই প্রাণ বিহীন দেহটা পদ্মজা ছাড়তে চাইল না। যেন তার ডাকেই ফিরে আসবেন হেমলতা। কথা বলে উঠবেন, আবার হাঁটবেন। পদ্মজাকে ধমকে বলবেন, ‘চুপ! এত কীসের কান্না? আমার মেয়ে হবে শক্ত আর কঠিন মনের। এত নরম হলে চলবে না।’

তা কী আর হয়?

এটা শুধুই কল্পনা। আত্মা একবার দেহ ছেড়ে দিলে আর ফিরে আসে না। আপন ঠিকানায় ফিরে যায়। হেমলতা নামে মানুষটার আয়ুকাল এতটুকুই ছিল। তিনি উড়াল দিয়েছেন পরকালে, রেখে গেছেন আদরের তিন কন্যাকে। আদরের কন্যাদের ছেড়ে তো কখনো দূরে থাকতে পারতেন না! এবার কীভাবে চলে গেলেন? তিনি নিশ্চয় মৃত্যুর সঙ্গে কঠিন যুদ্ধ করেছেন! থেকে যেতে চেয়েছিলেন আরো কিছুদিন। পেরে ওঠেননি।

ভোরের আলো ফুটতেই পদ্মজা নিজেকে শক্ত করে গোসল করে এসে কোরআন শরীফ নিয়ে বসল। হেমলতা বলতেন, ‘মা-বাবা মারা গেলে কান্নাকাটি না করে লাশের পাশে বসে কোরআন শরীফ পড়া ভালো। এতে করে কবরে আযাব থাকলে কম হয়।’

সে প্রতিটা অক্ষর পড়ছে আর কাঁদছে। জীবনের আকাশের সাতরঙা রংধনু নিভে গেছে। আর কখনো উঠবে না। কোনোদিন না। মোর্শেদ বারবার পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে চোখের জল মুছছেন কিন্তু, আবার ভিজে যাচ্ছে। গোসলের পর হেমলতার মুখটা উজ্জ্বল হয়েছে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে হাসি। পদ্মজা হেমলতার মৃতদেহের সামনে এসে দাঁড়াল। সাদা কাপড়ে মোড়ানো লম্বা দেহটা দেখে হাহাকার করে ওঠে বুক। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি জানি, তোমার রুহ আমার পাশেই আছে। এভাবে কথা না ভাঙলেও পারতে, আম্মা। বলেছিলে, কখনো কিছু লুকোবে না! বেহেশতে ভালো থেকো, আম্মা। আমি পূর্ণা-প্রেমা-প্রান্তকে দেখে রাখব। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি, আম্মা।’

হাঁটু ভেঙে খাঁটিয়ার সামনে বসে পড়ে সে। হেমলতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আল্লাহকে বলে খুব দ্রুত আমাকে নিতে এসো কিন্তু।’

আমির, হিমেলসহ আরো দুইজন খাঁটিয়া কাঁধে তুলে নিলো। কালিমা শাহাদাত বলতে বলতে সামনে এগোলো তারা। পূর্ণাকে তিনজন মহিলা ধরে রেখেছে। সে হাত-পা দিয়ে ঝাঁপিয়ে চেষ্টা করছে ছোটার জন্য। তার ইচ্ছে হচ্ছে মৃত দেহটা রাখতে আঁকড়ে ধরে রাখে। পদ্মজা মাটিতে বসে পড়ল। কী একটা বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে! আম্মা…আম্মা বলে দুই হাতে খামচে ধরে মাটি। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার আম্মাকে কষ্ট দিয়ো না মাটি। একটুও কষ্ট দিয়ো না। আমার আম্মাকে যত্নে রেখ। হীরের টুকরো তোমার বুকে ঘুমাতে যাচ্ছে। কষ্ট দিয়ো না…কষ্ট দিয়ো না।’

.

হাড় কাঁপানো শীতে কাঁপছে পদ্মজা। সন্ধে থেকে খুব ঠান্ডা পড়েছে। এক কাপড়ে মাটিতে মা একা আছে ভেবে পদ্মজার অশান্তি হচ্ছিল। তাই কম্বল নিয়ে রাতের বেলা ছুটে এসেছে মায়ের কবরে। সদ্য হওয়া কবরে কাঁচা মাটির ঘ্রাণ। পদ্মজা কম্বল দিয়ে মায়ের কবর ঢেকে দিল। এরপর দুই হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আম্মা…মনে আছে তোমার? যখন আমি ছোটো অনেক, আব্বা আমার গায়ের কম্বল নিয়ে গিয়েছিল। তখন তুমি তোমার শাড়ির আঁচল দিয়ে সারারাত আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলে? মনে আছে? আমাকে কেন সেই সুযোগ দিলে না? কেন বললে না, তুমি মরণ রোগে আক্রান্ত। আমার জীবনে অভিশপ্ত আক্ষেপ কেন দিয়ে গেলে, আম্মা? কেন পেলাম না আমার মাকে সন্তানের মতো আদর করার সুযোগ? কোন দোষে আমার সঙ্গ তুমি নিলে না? মৃত্যুর আগে নিজের মেয়ের সঙ্গে এত বড়ো অনাচার করে গেলে, আম্মা! বিশ্বাসঘাতকতা করলে। আমি তো তোমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম। কখনো কোনো বিষয়ে জোর করিনি। জোর করে জানতে চাইনি। আমি বিশ্বাস করতাম তুমি সব বলবে আমায়। তুমি নিজে আমাকে বার বার বলেছো, তোমার জীবনের এক বিন্দু অংশ থাকবে না যা আমাকে বলবে না। তবে কেন সেই কথা রাখতে পারলে না? আমার কষ্ট হচ্ছে, আম্মা। তুমি অনুভব করছো? আমি তোমার বুকে শুয়ে অভিযোগ তুলছি, তুমি আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছো! আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছো দশ মাস। তুমি পারতে আমাকে বলতে। তুমি পারতে আমাকে বিয়ে না দিয়ে নিজের কাছে রাখতে। তুমি পারতে আমাকে আরো দশ মাস আমার মায়ের সঙ্গ দিতে। আমি এত আক্ষেপ নিয়ে কী করে বাঁচব, আম্মা?’

কয়েকটা শেয়াল দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝরাতে কবরে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেউ কাঁদতে পারে এমন হয়তো কখনো দেখেনি তারা। পদ্মজা হেমলতার কবরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর অশ্রু বিসর্জন করছে। আত্মহত্যা পাপ না হলে হয়তো এই পথই বেছে নিত সে। মোর্শেদ, আমির টর্চ নিয়ে পদ্মজাকে খুঁজতে খুঁজতে কবরে আসে। হেমলতার কবর দেখে মোর্শেদ দুর্বল হয়ে পড়েন। পদ্মজার সঙ্গে সঙ্গে তিনিও কাঁদতে থাকেন। আমিরের শব্দভাণ্ডারে সান্ত্বনা দেয়ার মতো ভাষা মজুদ নেই। সে সাহস করতে পারল না কথা বলার। কান্না থামিয়ে পদ্মজা সুরা ইয়াসিন পড়তে থাকল। সে চায় না তার মায়ের কবরে বিন্দুমাত্র কষ্ট হোক। সন্তানের আমল নাকি পারে, মৃত মা- বাবার শাস্তি কমাতে। যদি কোনো পাপের শাস্তি হেমলতার আমলনামায় থেকে থাকে, তা যেন মুছে যায় পদ্মজার কণ্ঠের মধুর স্বরে। ধীরে ধীরে পদ্মজার কণ্ঠ কমে আসে। ঠান্ডায় জমে যায়। পালটে যায় চোখের মণির রং। আমির দ্রুত পদ্মজাকে কোলে তুলে নিলো। মোর্শেদকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। হেমলতা মাটির কবরে পড়ে রইলেন একা। শেয়ালগুলি একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। মৃত্যুর মতো সত্য আর নেই।

জন্মালে মৃত্যুর স্বাদ উপভোগ করতেই হবে।

.

হেমলতার ঘরে দরজা বন্ধ করে পদ্মজা আর পূর্ণা বসে আছে। পুরো বিছানা জুড়ে হেমলতার পরনের কাপড়চোপড়। এসবই শেষ স্মৃতি। পূর্ণা দুটো শাড়ি বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে থেমে থেমে কাঁদছে। পদ্মজা মাটিতে বসে আছে। উসকোখুসকো চুল। পূর্ণা আর কাঁদতে পারছে না। বুক ফেটে যাচ্ছে তবুও শব্দ বেরোচ্ছে না। পদ্মজা হেমলতার চুড়ি দুটো হাতে নিয়ে বলল, ‘আম্মা বলে এখন কাকে ডাকব? পূর্ণা রে, আমাদের আম্মা কই গেল?’

পূর্ণা বিছানা থেকে নেমে আসে। পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা স্বরে বলল, ‘আল্লাহ কেন এমন করল, আপা? আমাদের প্রতি একটু দয়া হলো না।’

‘এই ঘরটায় আর আসবে না, আম্মা!’

‘আপা, আম্মা আসে না কেন? আপা…আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আমাকে মেরে ফেলো।’

‘কাঁদিস না বোন। আমাদের আবার পরকালে দেখা হবে। এরপর আর মৃত্যু নেই। অনন্তকাল একসঙ্গে থাকব। ঠিক দেখা হবে।’

পালঙ্কের উপর একটা পুরনো খাতা। পদ্মজা হাত বাড়িয়ে নিলো। পূৰ্ণা এই খাতার প্রতিটি অক্ষর আগেই পড়েছে। তাই আর সেদিকে ফিরল না। সে ক্লান্ত দেহ নিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে। পদ্মজা খাতার পৃষ্ঠা ওল্টায়—

আমার আদরের পদ্মজা,

আজ পনেরো দিন হলো তোর বিয়ের। প্রতিটা রাত আমার নির্ঘুমে কাটে। পুরো বাড়িজুড়ে তোর স্মৃতি। স্মৃতিগুলো আমায় বিষে জর্জরিত করে দেয়। মেয়ে হয়ে জন্মালে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি যেতেই হয়। তবুও মানতে কষ্ট হচ্ছে আমার মেয়ে সারাজীবনের জন্য অন্যের ঘরে চলে গেছে। বলেছিলাম, আমার জীবনের বিন্দুমাত্র অংশ তোর অজানায় রাখব না। সেই কথা রাখতে আমি লিখতে বসেছি। স্বপ্ন ছিল, তোকে অনেক পড়াব। অনেক…অনেকদিন নিজের কাছে রাখব। কিন্তু মানুষের সব স্বপ্ন কী পূরণ হয়? দীর্ঘ দুই বছর আমার শরীরে বাসা বেঁধে ছিল এক রোগ। প্রাথমিক অবস্থায় ছিল। কিন্তু পাত্তা দেইনি। যখন তোর মেট্রিক পরীক্ষার জন্য আকবর ভাইজানের বাড়িতে গেলাম তখন একজন ভালো ডাক্তারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি আকবর ভাইজানের বন্ধু। দেখা করতে এসেছিলেন। তখন তুই পরীক্ষা কেন্দ্রে ছিলি। উনার নাম আসাদুল জামান। বিলেত ফেরত ডাক্তার। কথায় কথায় আমার সমস্যাগুলোর কথা বলি। তিনি খালি চোখে আমাকে দেখে কিছু প্রশ্ন করলেন। উনার ধারণা, আমি পারকিনসন্স ডিজিস নামক প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত, যার আশি ভাগ লক্ষণ আমার সঙ্গে মিলে যায়। তিনি দ্রুত আমাকে পরীক্ষা করতে বলেন। এই রোগের চিকিৎসা তো দূরে থাক দেশে এই রোগ পরীক্ষার কেন্দ্রও তেমন নেই। সেদিনটা আমার জীবনের বড়ো ধাক্কা ছিল। আমি দিকদিশা হারিয়ে ফেলি। আমি মারা গেলে আমার তিন মেয়ের কী হবে? কী করে বাঁচবে? ভয়ানক এই রোগ নিয়ে তোর সামনে হাসতে আমার ভীষণ কষ্ট হতো। তবুও হাসতে হতো। মুহিব খুব ভালো ছেলে। তাই তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেইনি। আমি মারা যাওয়ার আগে তোর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম। বিয়ে ঠিক করে ফিরে আসি গ্রামে। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মুহূর্ত অসহনীয় যন্ত্রণায় কাটতে থাকে। আসাদুল জামান ঢাকার এক হাসপাতালের নাম লিখে দিয়েছিলেন। যেখানে এই রোগের পরীক্ষা করা হয়। শতভাগ ভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য পরীক্ষা করানোটা জরুরি হয়ে পড়ে। তার জন্য কেউ একজনকে দরকার পাশে। তোর আব্বাকে সব বলি। সব শুনে তোর আব্বা হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে! মানুষটাকে এত কাঁদতে কখনো দেখিনি! আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে চলে যাই ঢাকা। আমি তখন হুঁশে ছিলাম না। মৃত্যু আমার পেছনে ধাওয়া করছিল। তাই মাথায় আসেনি আমি না থাকলে আমার মেয়েদের কোনো ক্ষতি হতে পারে। ঢাকা যাওয়ার পথে আল্লাহর কাছে আকুতি করেছি যাতে পরীক্ষায় কিছু ধরা না পড়ে। বিয়েটা ভেঙে দিতে পারি। আর আমার মেয়েদেরকে নিয়ে আরো কয়টা বছর বাঁচতে পারি। কিন্তু আল্লাহ শুনলেন না। তিনি দয়া করলেন না, মা! জানতে পারলাম, আমার হাতে সময় কম। এ রোগের নিরাময় নেই। যেকোনো বছরে যেকোনো মুহূর্তে মারা যেতে পারি। এই কথা শোনা আমার পক্ষে সহজ ছিল না। ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তোদের কথা মনে পড়তেই আবার নিজেকে শক্ত করে নিয়েছি। যতদিন বাঁচব শক্ত হয়ে বাঁচব। তোর জীবন গুছিয়ে দিয়ে যাব। আমি পেরেছি। তোর বিয়ে হয়েছে। ভালো ছেলের সঙ্গে হয়েছে। সুখে আছিস। এই তো শান্তি। আমার ভাবতে কষ্ট হয়, একদিন তোকে, তোদের সবাইকে আমি ভুলে যাব। এখন তো কথা ভুলে যাই। তখন নিজের নাড়ি ছেড়া সন্তানদের মুখও অচেনা হয়ে যাবে। কী নির্মম তাই না মা?

রবিবার।

তুই ঢাকা চলে গিয়েছিস অনেকদিন হলো। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের আর দেখা হবে না। আমার শরীরের অবস্থা ভালো না। আজ নাকি প্রান্তকে চিনতে পারিনি। বেশ অনেক্ষণ ওর চেহারাটা আমার অচেনা লেগেছে। কী অদ্ভুত! ভুলে যেয়ে আবার মনে পড়ে। হাত, পা, মাথা, মুখের থুতনি, চোয়াল মাঝে মাঝে খুব কাঁপে। ধীরে ধীরে শরীরের ভারসাম্য একদম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। লাহাড়ি ঘরে গিয়েছিলাম হুট করে চৌকির উপর থেকে পড়ে গিয়েছি। পূর্ণার সে কী কান্না! মেয়েটা খুব কাঁদতে পারে। একদমই হাঁটতে ইচ্ছে করে না। শক্তি কুলোয় না। তোর কথা খুব মনে পড়ে। মনে সাধ ছিল, বৃদ্ধ হয়ে তোর শরীরে ভর দিয়ে হাঁটব। পেটের চামড়ার ফোসকার মতো কী যেন হয়েছে। চুলকায়, ব্যথা করে। রাতে ঘুম হয় না যন্ত্রণায়। তোর আব্বা আমার অশান্তি দেখে ঘুমাতে পারে না। বাসন্তী আপা সব জানে। মানুষটা অনেক ভালো। ভুল তো সবাই করে। এমন কেউ আছে যে জীবনে ভুল করেনি? বাসন্তী আপার রান্না নাকি অনেক মজার হয়। খুব ভালো ঘ্রাণ হয়। প্রান্ত-প্রেমা সারাক্ষণই বলে। কিন্তু আমি সেই ঘ্রাণ পাই না। ঘ্রাণশক্তিটাও লুপ্ত হয়ে গেছে। কয়দিন ধরে টয়লেটও হচ্ছে না। খাবার গিলতে পারি না। কোন পাপে এমন করুণ দশা হলো আমার? বোধহয়, আর শক্তি পাব না লেখার। সবকিছু ভুলতে আর কতক্ষণ? সব লক্ষণ জেঁকে বসেছে শরীরে। বাকি শুধু দুনিয়াটাকে ভুলে যাওয়া। আজ সারারাত জেগে আরো কিছু কথা লিখতে চাই। সেদিন আমি জলিল আর মজনুর ছেলেকে খুন করেছি। ছইদ তার আগেই খুন হয়ে গিয়েছিল। আটপাড়ার বড়ো বিলের হাওড়ের টিনের ঘরে ওরা তিনজন সবসময় জুয়া খেলে, গাঁজা খায়। সেদিনও গাঁজা খেয়ে পড়েছিল। গিয়ে দেখি ছইদের লাশ এক কোণে পড়ে আছে। দা হাতে দাঁড়িয়ে আছে তোর দেবর রিদওয়ান। ও আমাকে দেখে পালিয়ে যায়। এরকম দৃশ্য দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি তবুও থেমে থাকিনি। ঘুমন্ত জলিল আর মজনুর ছেলেকে বেঁধে—খুনের বর্ণনা লিখতে ইচ্ছে করছে না! শুধু এইটুকু বলব, আমি যখন জলিল আর মজনুর ছেলেকে কোঁপাচ্ছিলাম তখন রিদওয়ান ঘরের এক পাশে লুকিয়ে ছিল। সে সব দেখেছে। আমি বের হতেই সে উলটোদিকে হাঁটা শুরু করে। আজও জানতে পারিনি সে কেন ছইদকে খুন করেছে। তুই ঢাকা চলে গিয়েছিস ভেবে শান্তি লাগছে। রিদওয়ান ভয়ংকর মানুষ। তার খুন করার হাত পাকা। এটা তার প্রথম খুন নয়। সাবধানে থাকবি। আমিরকে সাবধানে রাখবি। তোর শাশুড়িকে বহুবার লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছি। উনাকে আপন করে রাখবি।

আর লেখা যাচ্ছে না। হাত কাঁপছে। কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে চারিদিক। এই খাতাটা প্রান্তের। লুকিয়ে নিয়ে এসেছি। আমার সব শাড়ির সঙ্গে ট্রাঙ্কের ভেতর যত্নে রাখব। আমার অনুপস্থিতিতে যখন পড়বি, কাঁদবি না একদম। জীবনে বড়ো হবি। আমি না থাকলে মৃত্যুর কামনা করবি না। এটাও এক ধরনের পাপ। আল্লাহর যখন ইচ্ছে হবে তখনই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তিনি যে কারণে সৃষ্টি করেছেন তা পূরণ হলেই মৃত্যু ধেয়ে আসবে। শুধু মৃত্যুর কথা স্বরণ রাখবি। কোরআনের পথে চলবি। কোনো পাপে জড়াবি না। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিবি না। আমাদের আবার দেখা হবে। আমার মায়ের সঙ্গে আবার দেখা হবে। তুই তো আমার মা, আমার পদ্মজা। আমার সাত রাজার ধন। আমার তিন কন্যা আমার অহংকার। আমার বেহেশত। ভালো থাকবি, খুব ভালো থাকবি। আম্মা কিন্তু সব দেখব। কান্নাকাটি করতে দেখলে ওপারে আমার শান্তি হবে না। তাই কাঁদবি না। আল্লাহ হাফেজ মা, ভালো থাকিস।’

পড়া শেষ হতেই খাতাটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে হাতপা ছুঁড়ে আম্মা, আম্মা বলে কাঁদতে থাকে পদ্মজা। তার আর্তনাদে চারিদিক স্তব্ধ হয়ে যায়।

৪৭

১৯৯৬ সাল। ঘনকুয়াশার ধবল চাদর সরিয়ে প্রকৃতির ওপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। কাচের জানালার পর্দা সরাতেই এক টুকরো মিষ্টি পেলব রোদ্দুর পদ্মজার সুন্দর মুখশ্রীতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। নিচতলা থেকে মনার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘আপামনি।’

মিষ্টি রোদের কোমল ছোঁয়া ত্যাগ করে ঘুরে দাঁড়াল পদ্মজা। আমির আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে লেপের ওম ছেড়ে উঠে বসেই দরজার বাইরে দেখতে পেল পদ্মজাকে। ধনুকের মতো বাঁকা শরীরে সবুজ সুতি শাড়ি মাথায় লম্বা বেনুনি চওড়া পিঠের ওপরে সাপের মতন দুলছে। পাতলা কোমর উন্মুক্ত।

আমির চমৎকার করে হেসে ডাকল, ‘পদ্মবতী।’

পদ্মজা না তাকিয়েই জবাব দিল, ‘অপেক্ষা করুন, আসছি।’

আমির মুখ গুমট করে বলল, ‘ইদানীং আমাকে একদমই পাত্তা দিচ্ছো না তুমি। বুড়ো হয়ে গেছি তো।’

ওপাশ থেকে আর সাড়া এলো না। আমির অলস শরীর টেনে নিয়ে বারান্দায় গেল। পদ্মজা বৈঠকখানায় এসে দেখে, মনা সোফায় পানের কৌটা নিয়ে বসে আছে। তাকে দেখেই দ্রুত উঠে দাঁড়াল। নয় বছরের মনা এখন চৌদ্ধ বছরের ছটফটে কিশোরী। পদ্মজা গম্ভীর স্বরে বলল, ‘পান খাওয়ার অনুমতির জন্য ডেকেছিস?’

মনা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে মাথা নত অবস্থায় রেখেই চোখ উলটে তাকিয়ে পদ্মজাকে দেখল একবার। এরপর চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘অনেকদিন খাই না। আপামণি, একটা খেতে দাও না?’

মনা চাইলে লুকিয়ে খেতে পারত। কিন্তু সে পদ্মজাকে ডেকে অনুমতি চাইছে। পদ্মজা মনে মনে সন্তুষ্ট হলেও প্রকাশ করল না। সোফায় বসে প্রশ্ন করল, ‘পান কে দিয়েছে? সঙ্গে পানের কৌটাও আছে দেখছি!’

‘আব্বা আসছিল।’ ভীতু কণ্ঠে বলল মনা।

‘কখন?’

‘ভোরবেলা।’

‘বাসায় আসেনি কেন?’

‘কাজে যাচ্ছে তাই।’

‘উনি এমনি এমনি কেন পানের কৌটা নিয়ে আসবেন? তুই স্কুল থেকে ফেরার পথে বস্তিতে গিয়েছিলি?’

মনা জবাব দিল না। তার চুপ থাকা প্রমাণ করছে, পদ্মজার ধারণা সত্য। পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। বলল, ‘একটা পান খাবি। কৌটাসহ বাকি পান, সুপারি রহমত চাচাকে দিয়ে তোদের বস্তিতে পাঠিয়ে দে।’

পদ্মজা চলে যেতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘তুই নাকি গণিতে ফেল করেছিস?’

পদ্মজার প্রশ্নে মনা দৃষ্টি চোরের মতো এদিক-ওদিক চোখের দৌড়াতে থাকল। পদ্মজা ধমকে উঠল, ‘বলছিস না কেন? আমি প্রতিদিন রাতে সময় নিয়ে তোকে গণিত বুঝিয়েছি। তবুও ফেল করলি কী করে?’

মনা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘পরীক্ষার আগের দিন পড়িনি। পরীক্ষায় গিয়ে সব ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ছিল।’

‘কেন পড়িসনি?’ প্রশ্নটি করে থামল পদ্মজা। পরক্ষণেই বলল, ‘সেদিন আমি অসুস্থ ছিলাম। নিচে একবারও আসতে পারিনি। এই সুযোগে পড়া রেখে টিভি দেখেছিলি তাই তো?’

মনা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। পদ্মজা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। বেহায়ার মতো আবার স্বীকারও করছে, পড়া রেখে টিভি দেখেছে! ঢাকা আসার পরের বছরই মনাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল সে। এখন মনা পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মাথায় বুদ্ধি বলতে নেই। সারাক্ষণ টিভি, টিভি আর টিভি! এত পড়ানোর পরও কিছু মাথায় রাখতে পারে না। পদ্মজা বিরক্তি নিয়ে জায়গা ছাড়ল।

শোবার ঘরে ঢুকতেই আমির আক্রমণ করে বসে। পদ্মজার কোমরের খোলা অংশে হাত রাখতেই পদ্মজা, ‘ঠান্ডা!’ বলে ছিটকে সরে যায়। আমির হতভম্ব হয়ে গেল। দুই পা এগোতেই তার ব্যক্তিগত প্রাপ্তবয়স্ক নারীটির রিনরিনে কণ্ঠে ধমক বেরিয়ে এলো, ‘একদম এগোবেন না। এই শীতের মধ্যে ভেজা হাতে ছুঁলেন কীভাবে? আপনি আমার কালো সোয়েটারটা দেখেছেন? পাচ্ছি না। শীতে জমে যাচ্ছি একদম।’

আমির কিছু বলল না। সে পদ্মজার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে তার কালো সোয়েটারটা খুঁজল। হঠাৎ আমিরের দিকে চোখ পড়তেই হেসে বলল, ‘এভাবে সঙের মতো খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

আমির কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তখনই বেজে উঠল টেলিফোন। এই সুযোগে পদ্মজা পাশের ঘরে চলে গেল। কালো সোয়েটারটা যে কোথায় হারাল! এটা খুঁজে বের করতেই হবে। এ সোয়েটারটা পরে সে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমির টেলিফোন রেখে পদ্মজাকে ডেকে জানাল, সে বের হবে। জরুরি দরকার। পদ্মজা সোয়েটার খোঁজা রেখে তাড়াতাড়ি করে খাবার পরিবেশন করে। আমির খাওয়াদাওয়া শেষ করে প্রতিদিনের মতো পদ্মজার কপালে চুমু দিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়! পদ্মজা তৈরি হয় রোকেয়া হলে যাওয়ার জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে রোকেয়া হলের অনেক মেয়েকেই চিনে। আজ মনার স্কুল নেই। সে একাই বাসায় থাকবে। এক ছোটো বোনের সঙ্গে দেখা করার জন্য হলে যেতে হবে। আমিরের তো কখনোই ছুটি নেই, নিজের ব্যাবসা। যখন তখন কাজ পড়ে যায়।

রোকেয়া হলের চারপাশ সবুজ গাছে আবৃত। পদ্মজা গেটের বাইরে গাড়ি রেখে এসেছে। হিম শীতল বাতাসে চোখজোড়া ঠান্ডায় জ্বলছে। তার পরনে বোরকা, মুখে নিকাব। রোকেয়া হলের ‘ক’ ভবনে এসে জানতে পারল যার খুঁজে সে এসেছে সে নেই। চারিদিক নিরিবিলি। প্রায় সবাই ক্যাম্পাসে। নির্জন পরিবেশে এমন ঠান্ডা বাতাস রোমাঞ্চকর অনুভূতি দেয়। রোকেয়া হলে এ নিয়ে অনেকবার এসেছে সে। পদ্মজা ‘ক’ ভবনের নিচ তলার শেষ মাথার কাছাকাছি গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ফিরে যাওয়ার জন্য। তখন অতি সূক্ষ্ম একটা শব্দ কানে ভেসে এলো। পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। দুই পা পিছিয়ে চোখ বুজে শোনার চেষ্টা করল, শব্দটা কীসের! আওয়াজ তীব্র হয়েছে! কাছে কোথাও ধস্তাধস্তি হচ্ছে। পদ্মজার মস্তিষ্ক সচল হয়ে ওঠে। অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকাল। একটা মেয়ের চাপা কান্নার শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই পদ্মজা দ্রুতগামী ঘোড়ার মতো ছুটে এলো শেষ কক্ষের দরজার সামনে। পৌঁছেই দেখতে পেল অর্জুন এবং রাজু একটা মেয়েকে টেনে হিঁচড়ে কক্ষ থেকে বের করতে চাইছে। ক্যাম্পাসের ছাত্রসংগঠনের নেতা এরা। ছয় মাস হলো ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্বে এসেছে। আর এখনই ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেছে!

পদ্মজার উপস্থিতি টের পেয়ে অর্জুন, রাজু ঘুরে তাকাল। মেয়েটা ভয়ে কাঁপছে। পদ্মজাকে দেখে মেয়েটা ছুটে আসতে চাইলে অর্জুন ধরে ফেলে। পদ্মজা বেশ শান্তভাবেই বলল, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করতে নেই। ছেড়ে দাও মেয়েটাকে।’

পদ্মজার কণ্ঠ মেয়েটি চিনতে পেরে অস্ফুটভাবে ডাকল, ‘পদ্ম আপা।’ এরপর বলল, ‘পদ্ম আপা, আমি মিঠি। ওরা আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে বাঁচাও।’

পদ্মজা ভালো করে খেয়াল করে চিনতে পারল মিঠিকে। অর্জুন মিঠির গালে শরীরের সব শক্তি দিয়ে থাপ্পড় মেরে রাজুকে বলল, ‘এরে ঘাড়ে উঠা। এই আপনি সরেন। মাঝে হাত ঢুকাবেন না। বিরক্ত করা একদম পছন্দ না আমার।’

পদ্মজা বাধা হয়ে দাঁড়াল, দেখো, মা জাতিকে এভাবে অপমান করতে নেই। হাতে ক্ষমতা পেয়েছো সৎভাবে চলো। সবার ভালোবাসা পাবে। এভাবে অন্যের ইজ্জত নষ্ট করছো সেই সঙ্গে নিজেদের পাপী করছো।’

‘এই ফুট এখান থেকে। নীতি কথা শোনাতে আসছে!’ অর্জুন পদ্মজাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইল।

পদ্মজা জায়গায় অটল থেকে বলল, ‘ভালোভাবে বলছি, ভেজাল না করে ছেড়ে দাও। নারীকে নারীরূপে থাকতে দাও। শক্ত হতে বাধ্য করো না।’

অর্জুন রাগে দাঁতে দাঁত কামড়ে বলল, ‘আর একটা কথা বললে জামাকাপড় খুলে মাঠে ছেড়ে দেব।’

কথাটা শেষ করে চোখের পলক ফেলতে পারল না। তার আগেই পদ্মজার পাঁচ আঙুলের দাগ বসে যায় অর্জনের ফরসা গালে। অর্জুন রক্তিম চোখে কিড়মিড় করে তাকাল। মিঠিকে ছেড়ে চেপে ধরল পদ্মজার গলা। পদ্মজা সঙ্গে সঙ্গে লাথি বসিয়ে দিল অর্জুনের অণ্ডকোষ বরাবর। কোঁকিয়ে উঠে অণ্ডকোষে দুই হাত রেখে বসে পড়ে অর্জুন। রাজু গালিগালাজ করে পদ্মজার দিকে তেড়ে আসে। পদ্মজা মেঝে থেকে ইট তুলে ছুঁড়ে মারে রাজুর মাথা লক্ষ্য করে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল মিঠি।

রাজুর কপাল ফেটে রক্তের ধারা নামছে। অর্জুন আকস্মিক তেড়ে এসে পদ্মজার নিকাব টেনে খুলল; পদ্মজার ঘোলা চোখের ভয়ংকর চাহনি, রক্তজবার মতো ঠোঁটের কাঁপুনি অর্জুনের অন্তর কাঁপিয়ে তুলে। কিন্তু সে থামল না, প্রস্তুত হলো হামলা করতে। পদ্মজা তার কাঁধের ব্যাগ থেকে ছুরি বের করে টান বসাল অর্জুনের গলায়। এই দৃশ্য দেখে মিঠির শরীর কাঁপতে থাকে। অর্জুন চিৎকার করে বসে পড়ে। গলায় হাত দিয়ে দেখে গলাটা তখনো শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়নি! চামড়া ছিঁড়েছে শুধু। তার হৃৎপিণ্ড মাত্রই যেন মৃত্যুর সাক্ষাৎ পেল। পদ্মজার অভিজ্ঞ হাত তার কলিজা শুকিয়ে দিয়েছে। মেঝেতে বসে হাঁপাচ্ছে সে। পদ্মজা ছুরির রক্ত অর্জুনের গেঞ্জিতে মুছে বলল, ‘তোমাদের ভাগ্য ভালো পদ্মজার হাতে পড়েছো। হেমলতার হাতে পড়োনি।

মিঠিকে প্রশ্ন করল, ‘আমার জানামতে তুমি প্রথম বর্ষে আছো। তোমার অন্য ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকার কথা। এখানে আসলে কী করে?

মিঠির ভয় এখনও পুরোপুরি কাটেনি। সে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি গত কয়দিন অসুস্থ ছিলাম। ক্যাম্পাসে যেতে পারিনি। অর্জুন দাদা নাজমাকে দিয়ে আমাকে ডেকেছিল।’

‘অমনি চলে এসেছো? কয়দিন আগে তৃতীয় বর্ষের একটা মেয়ের কী হাল হয়েছে দেখোনি, শুনোনি? এরপরও এদের ডাকে সাড়া দিলে কেন?’

‘না দিয়েও উপায় নাই।’

পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। মিঠিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কামরা থেকে। নিকাব পরতে পরতে বলল, ‘এসব বেশিদিন সহ্য করা যায় না। মেয়েরা হলে এসে থাকে পড়াশোনার জন্য। এসব নির্যাতনের স্বীকার হওয়ার জন্য নয়! তোমার চেনাজানা যারা এদের নির্যাতনের ভুক্তভোগী তাদের সবার নামের তালিকা আমাকে দিতে পারবে?’

মিঠি জানতে চাইল, ‘কেন?

‘সবাইকে নিয়ে প্রশাসনের কাছে যাব। তাদের নীরবতা আর মেনে নেব না। ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে নেতাদের অপকর্ম দেখছি। থামানোর চেষ্টা করেছি। একজন, দুজন থামে আরো দশজন বাড়ে। এইবার আমাদের আন্দোলন করতে হবে।’

মিঠি মিনমিনিয়ে বলল, ‘কেউ ভয়ে আন্দোলন করতে চায় না। শুনেছি, অনেকবার দিন তারিখ ঠিক হয়েছে। এরপর যাদের আসার কথা ছিল তাদের মধ্যে আশি ভাগই আসত না। অনেককেই বাসায় আক্রমণ করা হয়েছে।’

পদ্মজার বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সমাজে মেয়েরা এত দুর্বল! তাদের দেহের লুকায়িত আকর্ষণীয় ছন্দগুলো না থাকলে হয়তো তারাও সাহসী হতো। ছন্দ হারানোর ভয় থাকত না। কাউকে ভয় পেতে হতো না।

পদ্মজা মিঠিকে বলল, ‘তুমি বরং কয়দিন বাড়ি থেকে ঘুরে আসো। এখানে থাকা তোমার জন্য এখন বিপজ্জনক। আমি আগামীকাল গ্রামে যাচ্ছি। আমার আম্মার মৃত্যুবার্ষিকী। ছোটো বোনের মেট্রিক পরীক্ষা দেড় মাস পর। আরেক বোনের বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছি। দেড়-দুই মাসের মতো গ্রামে থাকব। এরপর এসে এই নেতাদের ব্যবস্থা করব। তোমাদের বর্ষের শিখা আছে না? মেয়েটা বেশ সাহসী। ওর মতো আরো কয়টা মেয়ে পাশে থাকলেই হবে। তুমি যাও এখন। দ্রুত বাড়ি ফেরার চেষ্টা করো। যতক্ষণ এখানে আছো একা চলাফেরা কোরো না। শিখাও তো মনে হয় হলেই থাকে?

‘জি।’

‘ওর সঙ্গে থেকো।’

‘কখনো কথা হয়নি।’

‘এখন তো ক্যাম্পাসে বোধহয়। আচ্ছা বিকেলে আমি আবার আসব। ওর সঙ্গে কথা বলব। আমি আসছি এখন।

‘পদ্ম আপা?’

পদ্মজা তাকাল। মিঠি পদ্মজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। ভেজাকণ্ঠে বলল, ‘অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।’

‘বাঁচার সংগ্রামে ভীতু হলে চলে না, মিঠি।’

‘ভেবেছিলাম জীবনটা শেষ হয়েই গেল বুঝি।

‘কখনো এমন ভাববে না। বিপদে সামর্থ্য মতো যা পারো করবে। শরীরের শক্তি নিশ্চয় কম নয়। মনের জোরটা কম। সেই জোরটা বাড়াবে। মনের জোর বাড়াতে টাকা লাগে না। কঠিন জীবন সহজ করে তোলার দায়িত্ব নিজেরই নিতে হয়।

মিঠি মাথা তুলে তাকাল। একটু সরে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছে বলল, দ্রুত ফিরবে, পদ্ম আপা। আমরা আমাদের নিরাপত্তার যুদ্ধে নামব।’

পদ্মজা হেসে বলল, ‘ফিরব। দ্রুত ফিরব।’

.

গাড়ি বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটছে। বাড়ির নাম আগে ছিল, আমির ভিলা। বছর ঘুরতেই আমির বাড়ির নাম পালটে দিল—পদ্ম নীড়। পদ্মজা জানালার কাচ তুলে বাইরে তাকাল। রাস্তাঘাটে মানুষজন কম। ঠান্ডা বাতাস। সূর্যের আলোয় একদমই তেজ নেই। যেন থুড়থুড়ে বুড়ো হয়ে গেছে। পদ্মজা আকাশপানে তাকিয়ে তিনটা প্রিয় মুখকে খোঁজে। চোখ দুটি টলমল করে ওঠে। কোথায় আছে তারা? আবার কবে হবে দেখা? পদ্মজা কাচ নামিয়ে দিল। রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজল।

.

নিস্তব্ধ বিকেল ঘন কুয়াশায় ঢেকে আছে অলন্দপুরের আটপাড়া। সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় নূপুরধ্বনিতে। পূর্ণার চঞ্চল কাদামাখা দুটি পা দৌড়ে ঢুকে মোড়ল বাড়ি। পায়ের নূপুরজোড়া রিনঝিন রিনঝিন সুর তুলে ছন্দে মেতেছে। পরনে লাল টুকটুকে শাড়ি। আঁচল কোমরে গোঁজা। শাড়ি গোড়ালির অনেক ওপরে পরেছে।

.

বাড়িতে ঢুকেই চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, ‘বড়ো আম্মা। ও বড়ো আম্মা।’

বাসন্তী রান্নাঘর ছেড়ে দৌড়ে আসেন। হাতের চুড়িগুলো ঝনঝন করে ওঠে। মুখে বয়সের কিঞ্চিৎ ছাপ পড়েছে। পূর্ণাকে এভাবে হাঁপাতে দেখে প্ৰশ্ন করলেন, ‘বাড়িতে ডাকাত পড়ছে?’

‘আপার চিঠি।’ পূর্ণা হাতের খামটা দেখিয়ে বলল।

আপার চিঠি শুনে পড়া রেখে প্রেমা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা। ষোড়শী মনে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সবার চেয়ে আলাদা হয়েছে। খুব ভীতু এবং লাজুক সে। পূর্ণা বড়ো বোন হয়ে সারাদিন বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। আর সে ঘরে বসে পড়ে, বাড়ির কাজ করে। স্কুলে যায়। পদ্মজার কথামতো প্রতিদিনের রুটিন অনুসরণ করে। সে বলল, ‘কী বলেছে আপা? চিঠিটা দাও।’

পূর্ণা কপাল কুঁচকে বলল, ‘তোর পড়তে হবে না। বলছে, মাঘ মাসের ১৯ তারিখ আসছে। অনেকদিন থেকে যাবে।’

‘আজ কত তারিখ?’ প্রশ্ন করলেন বাসন্তী।

পূর্ণা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘১৯ মাঘ।’

বাসন্তীর চোখ দুটি যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল।

বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললেন, ‘আজই! বিকেল তো হয়ে গেছে।’

পূর্ণা অস্থির হয়ে বাসন্তীর কাছে দৌড়ে আসে। দুই হাতে ধরে করুণ স্বরে বলল, ‘তাড়াতাড়ি সালোয়ার কামিজ বের করো। এভাবে দেখলে একদম মেরে ফেলবে আপা।’

বাসন্তী আরোও করুণ স্বরে বললেন, ‘মা, আমি আগে আমার রূপ পালটাই। তুমি তোমারটা খুঁজে নাও।’

কথা শেষ করেই বাসন্তী ঘরের দিকে চলে যান। বুক দুরুদুরু কাঁপছে। পরনে ঝিলমিল, ঝিলমিল করছে টিয়া রঙের শাড়ি। দুই হাতে তিন ডজন চুড়ি। কপালে টিপ, ঠোঁটে লিপস্টিক। এ অবস্থায় পদ্মজা দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তিনি সাজগোজ পূর্ণার কথায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। এরপর পূর্ণার কথাতেই দুজন মিলে আবার শুরু করেছেন। পদ্মজা এক-দুই দিনের জন্য প্রতি শীতে বাড়ি আসে তখন সব রং-বেরঙের জিনিস লুকিয়ে রাখা হয়। পূর্ণা চিঠি প্রেমার হাতে দিয়ে ঘরে গেল। ট্রাঙ্ক খুলে সাদা-কালো রঙের সালোয়ার কামিজ বের করে পরে নিলো দ্রুত। হাতের চুড়ি খুলতে গিয়ে ভেঙে গেল কয়েকটা। অন্যবার দুই-তিন দিন আগে চিঠি আসে। আর আজ যেদিন পদ্মজা আসছে সেদিনই চিঠি আসতে হলো! দশ দিন আগে চিঠি পাঠিয়েছে পদ্মজা। ডাকঘর থেকেই দেরি করেছে। পূর্ণা মনে মনে ডাকঘরের কর্মচারীদের গালি দিয়ে চোদ্দোগুষ্ঠি উদ্ধার করে দিচ্ছে। সে দ্রুত জুতা পরে বারান্দায় এসে প্রেমাকে তাড়া দিল, ‘জলদি পানি নিয়ে আয়।’

প্রেমার বেশ লাগছে। সে মনেপ্রাণে দোয়া করছে, বড়ো আপা এখুনি এসে যাক আর দেখুক ছোটো আপার সাজগোজ। কিন্তু প্রকাশ্যে পূর্ণার আদেশ রক্ষার্থে কলসি নিয়ে কলপাড়ের দিকে গেল সে। পূর্ণা মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়ছে! এই বুঝি পদ্মজা এসে গেল! গতবার মার তো খেয়েছেই, তার সঙ্গে পদ্মজা রাগ করে তিন মাস চিঠি লেখেনি। বাতাসের বেগে পাতায় মড়মড় আওয়াজ হচ্ছে। আর পূর্ণার মনে হচ্ছে, এই তো তার রাগী আপা হেঁটে আসছে। নাহ, পানির জন্য অপেক্ষা করা যাবে না। পূর্ণা কলপাড়ে ছুটে যায়। কলসি থেকে পানি নিয়ে পায়ের কাদা, ঠোঁটের লিপস্টিক ধুয়ে ফেলে। কপালের টিপ খুলে লাগিয়ে রাখল কলপাড়ের দেয়ালে। হাতের চুড়ি, গলার হার, কানের বড়ো বড়ো দুল ট্রাঙ্কের ভেতর রেখে এসেছে। পায়ের দিকে আবার চোখ পড়তেই আঁতকে উঠল নূপুরজোড়া হাঁটার সময় অনেক আওয়াজ তোলে। এ রকম নূপুর পরা নাকি ইসলামে নিষেধ। আবার দৌড়ে গেল ঘরে। দৌড়াবার সময় বার বার হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিচ্ছে। নূপুর দুটো খুলে ট্রাঙ্কের ভেতর রেখে ধপ করে মাটিতে বসে লম্বা করে শ্বাস নিলো। বিড়বিড় করে বলল, ‘বাঁচা গেল!’

পরমুহূর্তেই হাঁটুতে থুতনি রেখে মিষ্টি করে হাসল একবার, আজ তার আপা আসবে। তার জীবনের সবচেয়ে দামি এবং ভালোবাসার মানুষটা আসবে। ঈদের আনন্দের চেয়েও বেশি এই আনন্দ।

পূর্ণা মাথায় ঘোমটা টেনে রান্নাঘরে গেল। প্রায় বছরখানেক পর আবার রান্নাঘরে ঢুকেছে সে। বাসন্তী সাদা রঙের শাড়ি পরেছেন। তাড়াহুড়ো করে এটা ওটা রাঁধছেন। পূর্ণা সাহায্য করার জন্য হাত বাড়ালে বাসন্তী বললেন, ‘প্রান্তরে বলো, লাল রঙের দাগ দেয়া রাজহাঁসটা ধরে জবাই করতে।’

পূর্ণা চুলায় লাকড়ি আরেকটা দিয়ে লাহাড়ি ঘরের দিকে এগোয়। প্রান্তকে লাহাড়ি ঘরেই বেশি পাওয়া যায়। প্রেমা বড়ো বোনের জন্য মায়ের ঘরটা গুছাচ্ছে।

৪৮

ইট-পাথরের শহরের সবই কৃত্রিম। কৃত্রিমতা ছেড়ে ছায়ায় ঘেরা মায়ায় ভরা গ্রাম, আঁকা-বাঁকা বয়ে চলা নদীনালা, খাল-বিল, সবুজ শ্যামল মাঠের প্রাকৃতিক রূপ দেখে তৃষ্ণার্ত নয়নের পিপাসা মিটাতে গিয়ে পদ্মজা আবিষ্কার করল, তার চোখে খুশির জল! সবেমাত্র অলন্দপুরের গঞ্জের সামনে ট্রলার পৌঁছেছে। ট্রলারটি হাওলাদার বাড়ির। আলমগীর ও মগা ট্রলার নিয়ে রেলষ্টেশনের ঘাটে অপেক্ষা করছিল। আমির পদ্মজার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াতেই পদ্মজা বলল, ‘ইচ্ছে হচ্ছে জলে ঝাঁপ দেই।’

আমির আঁতকে উঠল, ‘কেন?’

পদ্মজা আমিরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। বলল, ‘অল্পতে ভয় পেয়ে যান কেন? বলতে চেয়েছি, অনেকদিন পর চেনা নদীর জল দেখে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। ডুব দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

আমির এক হাতে পদ্মজার বাহু চেপে ধরে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে বলল, ‘তাই বলো!’

পদ্মজা চোখ তুলে আমিরের দিকে তাকাল। আমিরের গাল ভরতি দাড়ি ঘন হয়েছে। চোখের দৃষ্টি গাঢ়, তীক্ষ্ণ। পঁয়ত্রিশ বছরের পুরুষ! অথচ একটা সন্তান নেই। বাবা ডাক শুনতে পারে না। মানুষটার জন্য দুঃখ হয়। পদ্মজা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। ট্রলার মোড়ল বাড়ির ঘাটে এসে ভিড়ল। বাড়ির দিকে তাকাতেই প্রথমে চোখে পড়ে রাজহাঁসের ছুটে চলা। ঝাঁক ঝাঁক রাজহাঁস দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকছে।

হাঁসের প্যাক প্যাক শব্দে চারিদিক মুখরিত। ট্রলারের শব্দ শুনে পূৰ্ণা- প্রেমা-প্রান্ত ছুটে এলো ঘাটে। প্রথমে এলো পূর্ণা। পদ্মজা প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই পূর্ণা জান ছেড়ে ডেকে উঠল, ‘আপা।’

পূর্ণাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে পদ্মজা ভয় পেয়ে গেল। সাবধান করতে বলল, ‘আস্তে পূৰ্ণা।

বলতে বলতে সিঁড়িতে পা পিছলে গেল পূর্ণার। পদ্মজা দ্রুত তাকে আঁকড়ে ধরে। এখনই অঘটন ঘটে যেত! পদ্মজা পূর্ণাকে ধমক দিতে প্রস্তুত হয়, তখনই পূর্ণা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল পদ্মজাকে। বুকে মাথা রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে উচ্চারণ করল, ‘আপা! আমার আপা!’

বুক বিশুদ্ধ ভালোলাগায় ছেয়ে গেল পদ্মজার। মৃদু হেসে পূর্ণাকে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই প্রেমা-প্রান্ত এসে জড়িয়ে ধরল তাকে। পদ্মজা তিনজনের ভার সামলাতে না পেরে শেষ সিঁড়ি থেকে নদীর জলে পড়েই যাচ্ছিল, ট্রলারের শীর্ষভাগে দাঁড়িয়ে থাকা আমির দুই হাতে দ্রুত পদ্মজাকে আঁকড়ে ধরে তার খুঁটি হলো। পদ্মজা চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। যখন বুঝতে পারল সে পড়েনি, তার ভাইবোনেরাও পড়ে যায়নি—তখন চোখ খুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে স্বামীর মুখ দেখে হাসল। আমির পদ্মজাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহায্য করে। পূর্ণা-প্রেমা হেঁচকি তুলে কাঁদছে! খুশিতে কেউ এভাবে কাঁদতে পারে? পদ্মজার ভালো লাগছে। বাসন্তীকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পদ্মজা তার ভাই-বোনদের বলল, ‘তোরা কী বাড়িতে ঢুকতে দিবি না?’

পূর্ণা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, ‘চলো।’

পদ্মজা সিঁড়ি ভেঙে বাসন্তীর সামনে এসে দাঁড়াল। সাদা রঙের শাড়ি পরে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকা এই মানুষটার প্রতি পদ্মজার অনেক ঋণ। মোর্শেদ স্ত্রী হারানোর শোকে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। হেমলতা মারা যাওয়ার ছয় মাসের মাথায় তিনিও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ফেলে যান দুটি কিশোরী মেয়ে, বউ এবং একমাত্র ছেলেকে। অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিল, সংসার চলে না। আমির সাহায্য করতে চেয়েছিল। পদ্মজার আত্মসম্মানে লাগে। সে কিছুতেই স্বামীর টাকা বাবার বাড়ির সংসারে ঢালবে না। নিজেরও কাজ করার উপায় ছিল না। এমতাবস্থায় বাসন্তী চাইলে ফেলে চলে যেতে পারতেন। তিনি যাননি। এক পড়ন্ত বিকেলে পদ্মজাকে বললেন, ‘নকশিকাঁথা সেলাই করতে পারি আমি। শখে সেলাই করতাম। দুই তিনজন পয়সা দিয়ে কিনতে চাইত। টাকার দরকার ছিল না, তাই বিক্রি করিনি। তুমি বললে আমি নকশিকাঁথা গঞ্জে বেঁচার চেষ্টা করতাম।’

পদ্মজা সেদিন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। সায় পেয়ে বাসন্তী ছুটে ঘরে যান। একটা নকশিকাঁথা এনে পদ্মজাকে দেখান। অসম্ভব সুন্দর হাতের কাজ! আমির নকশিকাঁথাটি দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘বড়ো ভাইয়া যতবার ঢাকা যাবে নকশিকাঁথা দিয়ে দিবেন। শহরে নকশিকাঁথার অনেক চাহিদা রয়েছে। আপনাদের সমস্যা কিছুটা হলেও ঘুচবে। এক কাজ করলেই তো পারেন আরো দুই-তিনজনকে নিয়ে নকশিকাঁথা বানানো শুরু করেন। তাহলে অনেকগুলি হবে। তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে দিবেন। ঢাকা বিক্রির পর দ্বিগুণ টাকা আসবে।’

এ প্রস্তাবে পদ্মজা অমত করল না। সেদিন থেকে বাসন্তী দুই হাতে দিনরাত পরিশ্রম করছেন। পূর্ণাকে মেট্রিক অবধি পড়ালেন। প্রেমা-প্রান্তকে এখনও পড়াচ্ছেন। পূর্ণার যেকোনো আবদার পূরণ করে চলেছেন। বাসন্তীর পা ছুঁয়ে পদ্মজা সালাম করল। বলল, ‘কেমন আছেন আপনি?’

‘ভালো আছি মা। তুমি, জামাইবাবা সবাই ভালো আছোতো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। আগের চেয়ে শুকিয়েছেন। ত্বক ময়লা হয়েছে। নিজের যত্ন নেওয়া কি ভুলে গিয়েছেন?’

বাসন্তী চোখ নামিয়ে হাসলেন। এক হাতে নিজের মুখশ্রী ছুঁয়ে বললেন, ‘সেই বয়স কী আর আছে? বিধবা মানুষ! ‘

‘পূর্ণা খুব জ্বালায় তাই না? বাধ্য করে রঙিন শাড়ি পরতে, সাজতে!’ বাসন্তী চমকে তাকালেন। পদ্মজা হাসছে। পূর্ণা মাথায় ব্যাগ নিয়ে পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াল। আহ্লাদী কণ্ঠে অভিযোগ করল, ‘আপা, তুমি নাকি মুচির সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে এসেছো?’

পদ্মজা হাসি প্রশস্ত হয়। আমিরকে এক পলক দেখে পূর্ণার দিকে তাকাল। বলল, ‘কে বলেছে? তোর ভাইয়া?’

পূর্ণা আমিরকে ভেংচি কেটে পদ্মজাকে বলল, ‘আর কে বলবে? আপা আমি মুচি বিয়ে করব না। আমার ফরসা, চকচকে জামাই চাই।’

মগা পূর্ণাকে রাগানোর জন্য বলল, ‘মেট্রিক ফেল করা ছেড়িরে ধলা জামাই হাঙ্গা করব না।’

পূর্ণা কিড়মিড় করে উঠে। পদ্মজা পূর্ণার গাল টেনে দিয়ে বলল, আচ্ছা, এসব নিয়ে পরে আলোচনা হবে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে চল।

দুই হাতে দুই ভাই-বোনকে জড়িয়ে ধরে বাড়ির উঠানে পা রাখে সে। সতেজ হয়ে জামাকাপড় পালটে নেয়। রাজহাঁস ভুনা আর গরম গরম ভাতের ভোজন হয়। সঙ্গে আলমগীর ও মগা ছিল। আলমগীর বাড়ি ফেরার আগে আমির-পদ্মজাকে বলে যায়, ‘আগের স্মৃতি আর কতদিন বুকে রাখবি? দাদু মরার পথে। চাচি আম্মা আত্মগ্লানি আর তোদের না দেখার শোকে শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে। এবার অন্তত বাড়িতে আসিস। অনুরোধ রইল আমার। পদ্মজা তুমি আমিরকে বোঝোও।’

পদ্মজা আশ্বস্ত করে বলল, ‘এবার বাড়ির সবাইকে গিয়ে দেখে আসব। আপনি নিশ্চিন্তে যান।’

‘অপেক্ষায় থাকব।’

আলমগীর, মগা চলে যেতেই আমির পদ্মজাকে বলল, ‘তুমি গেলে যাও, আমি যাব না।’

‘এবার যাওয়া উচিত। অনেক তো হলো। চার বছর কেটেছে। ওই রাতটা আজীবন বুকে তাজা হয়ে থাকবে। তাই বলে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারি না। ইসলামে সম্পর্ক ছিন্ন করা হারাম।’

‘ওই বাড়িতে গেলে আমার দমবন্ধকর কষ্ট হয়, পদ্মজা।’

‘সে তো আমারও হয়। কিন্তু আম্মার কথা খুব মনে পড়ে। আম্মার তো কোনো দোষ ছিল না। তবুও শাস্তি পাচ্ছেন।’

‘ছিল দোষ।’

‘যে আসল দোষী তার দেখা আজও পেলাম না। যিনি দোষী না তিনি সবার চোখে দোষী।’

‘আম্মা সেদিন কেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? এটাই আম্মার দোষ।’

‘জোর করে ঘুম আটকে রাখা যায়? আমরা আগামীকাল যাচ্ছি, এটাই শেষ কথা।’

‘পদ্ম…’

আমিরের বাকি কথা শুনল না পদ্মজা। সে দ্রুত হেঁটে হেমলতার ঘরের দিকে এগোল। হেমলতার ঘরের দরজা খুলতেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়, বুকের ভেতর বয়ে যায় শিহরণ। ছয় বছর আগের মতোই সব। নেই শুধু আম্মা! পদ্মজা ধীর পায়ে ঘরে ঢুকল। হেমলতার শাড়ি বের করে ঘ্রাণ শুঁকল আলমারি খুলে। বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখল অনেকক্ষণ। গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে, হাউমাউ করে কান্নাটা অনেকদিন ধরে আসে না। কষ্টগুলো চেপে থাকে বুকের ভেতর। পূর্ণা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে, দেখছে তার আপাকে। পদ্মজা বার বার নাক টানছে। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে মায়ের শাড়ি। যেন সে শাড়ি না, তার মাকেই চুমু দিচ্ছে! পূর্ণার মন ব্যথায় ভরে ওঠে। তার কী মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে, নাকি আপার কান্না দেখে?

জানে না পূর্ণা। শুধু উপলব্ধি করছে, তার কান্না পাচ্ছে।

কান্নার শব্দ শুনে পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। পূর্ণাকে কাঁদতে দেখে দ্রুত চোখের জল মুছে হাতের শাড়িটা রেখে দিল আলমারিতে। ডাকল, ‘এদিকে আয়।’

পূর্ণা ফোঁপাতে ফোঁপাতে এগিয়ে আসে। পদ্মজা বিছানায় বসলে, পূর্ণা তার কোলে মাথা রেখে কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে পড়ল। পদ্মজা বলল, ‘বয়স একুশের ঘরে। মনটা তো সেই চৌদ্ধ-পনেরো বছরেই পড়ে আছে।’

পূর্ণা পদ্মজার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আমার খুব কান্না পাচ্ছে।’

‘কাঁদিস না।’

‘ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসছে।’

‘থামানোর চেষ্টা কর।’

‘থামছে না।’

তুই তো আরো কাঁদছিস।’

‘বেড়ে যাচ্ছে তো।’

পদ্মজা ঠাস করে পূর্ণার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল পূর্ণার কান্না। সে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। পদ্মজা আওয়াজ করে হেসে উঠে। পূর্ণা উঠে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে হেসে এমনভাবে, ‘থেমে গেছে বলল যেন বিশ্বজয় করেছে!

আরো বেড়ে গেল পদ্মজার হাসি। মুখে হাত চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছে। হাসতে হাসতে চোখের কার্নিশে জল জমে টইটুম্বুর অবস্থা। পূর্ণা কখনোই কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। থামাতে বললে, আরো বেড়ে যায়। ব্যাপারটা যে কেউ উপভোগ করে।

প্রেমা ঘরে ঢুকে অভিমানী কণ্ঠে শুধাল, ‘আমাকে ছাড়া কী কথা নিয়ে হাসা হচ্ছে?’

পদ্মজা হাসতে হাসতে বলল, ‘পূর্ণা কাঁদছিল। থামাতে পারছিল না।’

প্রেমা হেসে বিছানায় উঠে দুই পা ভাঁজ করে বসে বলল, ‘বড়ো আপা, ছোটো আপা কিন্তু নামাজ পড়ে না।’

পদ্মজা হাসি থামিয়ে পূর্ণার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই নামাজ পড়িস না কেন? চিঠিতে তো বলিস অন্য কথা।’

পূর্ণার ইচ্ছে হচ্ছে প্রেমাকে লবণ-মরিচ দিয়ে ক্যাচ ক্যাচ করে কাঁচা আমের মতো কামড়ে খেতে। ভালো সময়টা কীভাবে নষ্ট করে দিল বজ্জাত মেয়েটা! কিন্তু এখন পরিস্থিতি সামলাতে হবে। সে পদ্মজাকে বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘আপা, বিশ্বাস করো শুধু এক ওয়াক্ত পড়িনি। আর…আর প্রেমাকে আমি আমার…হ্যাঁ আমার চুড়ি দেইনি বলে…’

৩০২ ॥ পদ্মজা

পদ্মজা কথার মাঝে ধমকে উঠল, ‘মিথ্যে বলবি না। কতবার বলেছি, মিথ্যা কথা ছাড়তে। সত্য স্বীকার কর। কীসের কাজ তোর? পড়ালেখা ছেড়েছিস চার বছর হলো। মেট্রিকটা দ্বিতীয় বার দিলি না। বিয়ে করতে চাস না বলে বিয়ের জন্যও জোর করিনি। তার মূল্য কী এভাবে কথা না শুনে দিবি? এমন না এটা আমার আদেশ। যিনি সৃষ্টি করেছেন উনার আদেশ।’

পূর্ণা মাথা নত করে রেখেছে। প্রত্যুত্তরে বলার মতো কিছু নেই। পদ্মজা বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘তোদের সঙ্গে আমি ঘুমাব না।’

প্রেমা আর্তনাদ করে উঠল, ‘আপা, আমার দোষ কী?

পূর্ণা জলদি করে পদ্মজার কোমর জড়িয়ে ধরে। কিছুতেই বোনকে যেতে দিবে না।

পদ্মজা বলল, ‘ছাড় বলছি।’

পূর্ণা আকুতি করে বলল, ‘যেয়ো না। এখন থেকে প্রতিদিন পড়ব। সত্যি বলছি।’

পদ্মজা নরম হলো, ‘সত্যি তো?’

‘সত্যি।’

পদ্মজা এবারের মতো ছেড়ে দেয়। পূর্ণা আড়চোখে প্রেমাকে দেখল। দৃষ্টি দিয়ে যেন হুমকি দিল: আমারও দিন আসবে! সেদিন তোকে বুঝাব মজা!

গ্রামে এলেই আমির প্রান্তর সঙ্গে ঘুমায়। পদ্মজাকে তার বোনদের সঙ্গে ছেড়ে দেয়। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। দুই বোনকে নিয়ে শুয়ে পড়ে পদ্মজা। কত কত গল্প তাদের! পদ্মজা শুধু শুনছে আর হাসছে। প্রেমার মুখ দিয়ে সহজে কথা আসে না, কিন্তু পদ্মজা এলে কথার ঝুড়ি নিয়ে বসে। পূর্ণা নিজের বিয়ে নিয়ে বেশি কথা বলছে, পরিকল্পনা করছে।

তখন প্রেমা ব্যঙ্গ করে বলল, ‘ছোটো আপার লজ্জার লেশমাত্র নেই।’

পূর্ণা খেপে গিয়ে জবাব দিল, ‘তুই যে প্রান্তকে বলছিলি, শহরে গিয়ে সাহসী পুলিশ বিয়ে করবি। আমি কাউকে বলেছি? বলেছি, তোর লজ্জা নাই?’

গোপন কথা ফাঁস হয়ে যাওয়াতে প্রেমা লজ্জায় জবুথবু হয়ে যায়! তার বড়ো আপার সামনে ছোটো আপা কী বলছে! লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোতে থাকে। পদ্মজা হাসল। প্রেমাকে বলল, লজ্জার কিছু নেই। অভিভাবকদের নিজের পছন্দ জানানো উচিত। তোর বিয়ে পুলিশের সঙ্গেই হবে। আর পূর্ণার বিয়ে হবে পূর্ণার পছন্দমতো।’

পদ্মজার কথায় পূর্ণা ভারি খুশি হলো। সে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, ‘নায়কের মতো জামাই চাই। একদম লিখন ভাইয়ার মতো। আপা, জানো লিখন ভাইয়া এক সপ্তাহ হলো এখানে শুটিং করতে এসেছে।’

পদ্মজা জানতে চাইল, ‘কার বাড়ি?’

‘সাতগাঁয়ের হান্নান চাচার বাড়ি। বিশাল বড়ো টিনের বাড়ি।’

পদ্মজা চুপ হয়ে গেল। এই মানুষটা শুধুমাত্র তার স্মৃতি। কিন্তু মানুষটার জীবনের পুরোটা জুড়ে সে। এই তো মাস চারেক আগে, পদ্মজা পত্রিকা পড়তে বসেছিল। তৃতীয় পৃষ্ঠায় লিখন শাহর ছবির সঙ্গে ওপরের শিরোনাম দেখে বেশ অবাক হয়। শিরোনামে লেখা ছিল, লিখন শাহর পদ্ম ফুল। পদ্মজা আগ্রহ নিয়ে প্রতিটি লাইন পড়েছিল। সাংবাদিক লিখনকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ত্রিশ তো পার হয়েছে। বিয়ে করবেন কবে?’

লিখন তখন জানাল, ‘সে যখন আসবে।’

‘আমরা কী জানতে পারি, কে সে? যদি দ্বিধা না থাকে।’

‘জানাতে আমার বাধা নেই। সে পদ্ম ফুল। আমার সাতাশ বছরের কঠিন মনে তোলপাড় তুলে দিয়েছিল। সেই তোলপাড়ের তাণ্ডব বুকের ভেতর আজও হয়। সেই ফুলের সুবাস নাকে আজও লেগে আছে। শুধু আমি তাকে জয় করতে পারিনি।’

লিখন শাহর সাক্ষাৎকারের কথোপকথন বেশ আলোড়ন তুলে দেশে। এরকম একজন সুদর্শন পুরুষকে কোন নারী অবহেলা করেছে? তা নিয়ে মানুষের কত কল্পনা-জল্পনা, আলোচনা-সমালোচনা। পদ্মজার অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়।

পূর্ণা পদ্মজাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকল, ‘ঘুমিয়ে গেলে, আপা?’

‘না। তারপর বল।’ নিস্তরঙ্গ গলায় বলল পদ্মজা।

ঝিঁঝিপোকার ডাক, শিয়ালের হাঁক ভেসে আসছে কানে। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। তবুও কথা শেষ হচ্ছে না পূর্ণা-প্রেমার। পদ্মজাও মানা করছে না। বরং অবাক হচ্ছে, তার বোনেরা কত কথা লুকিয়ে রেখেছে তার জন্য!

কাক ডাকা ভোর। ঘন কুয়াশায় চারপাশ ডুবে আছে। বাতাসের বেগ বেশি। ঠান্ডায় ঠোঁট কাঁপছে। পদ্মজার পরনে দামি, গরম সোয়েটার। ওপরে আবার শালও পরেছে। বাসন্তী সুতি সাদা শাড়ি পরে রান্না করছেন। মাঝে মাঝে কাঁপছেন। পদ্মজা দ্রুত পায়ে রান্না ঘরে ঢুকল। বাসন্তী পদ্মজাকে দেখে হেসে বললেন, ‘কিছু লাগবে?’

পদ্মজা খেয়াল করে দেখল বাসন্তীর মুখটা ফ্যাকাসে। ঠান্ডায় এমন হয়েছে। সে শক্ত করে প্রশ্ন করল, ‘আপনার শীতের কাপড় নেই?’

বাসন্তী হেসে বলল, ‘আছে তো।’

‘তাহলে এভাবে শীতে কাঁপছেন কেন? নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। বয়স হয়েছে তো। যান ঘরে যান।’

‘ভাত বসিয়েছি।’

‘আমি দেখব।’

‘সারারাত তো সজাগ ছিলে, আম্মা। তুমি ঘুমাও। আমি রাতে ঘুমিয়েছি।’

‘তাহলে সোয়েটার পরে আসেন।’

বাসন্তী মাথা নত করে বসে রইলেন। পদ্মজা বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এরপর নিজের গায়ের শাল বাসন্তীর গায়ে দিয়ে বলল, ‘নিজের জন্যও কিছু কেনা উচিত। পূর্ণা বয়সে বেড়েছে, বুদ্ধিতে না। ও পারে না কিছু সামলাতে। শুধু আবদার করতে পারে। যতদিন বেঁচে আছেন নিজের যত্ন নিন। আমি ঘরে যাচ্ছি।’

পদ্মজা রান্নাঘর ছেড়ে বারান্দার গ্রিলে ধরে বাইরে তাকাল। কুয়াশার জন্য বাড়ির গেটও দেখা যাচ্ছে না। সে ঘুরে দাঁড়াল ঘরে ঢোকার জন্য। তখন মনে হলো, উঠানে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা আবার ঘুরে তাকাল। দেখতে পেল তার শাশুড়ি ফরিনাকে। তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে আছেন। শুকিয়েছে খুব বেশি। গায়ে লাল-সাদা রঙের মিশ্রণে শাড়ি। ফরিনার চারপাশে উড়ো কুয়াশা। কুয়াশার দেয়াল ভেদ করে যেন তিনিই শুধু আসতে পেরেছেন। পদ্মজা হন্তদন্ত হয়ে বের হলো। কাছে এসে দাঁড়াতেই বুকটা হু হু করে উঠল। ফরিনা পদ্মজাকে দেখেই কাঁদতে শুরু করলেন। পদ্মজা ফরিনার খুব কাছে এসে দাঁড়াল, সালাম করল পা ছুঁয়ে। ফরিনার ঠান্ডা দুই হাত ধরে বলল, ‘এত সকালে কেন আসতে গেলেন? আমরা তো যেতামই।’

‘এত রাগ তোমার?’

‘না, আম্মা। আপনার প্রতি কোনো রাগ নেই আমার। আট মাস আপনি আমার যে যত্ন নিয়েছেন মায়ের অভাববোধ করিনি। মনে হয়েছিল, আমার মা ছিল আমার পাশে।’

‘তাইলে কেরে যাও না আমার কাছে? আমার ছেড়ায় কেন মুখ ফিরায়া নিছে আমার থাইকা?’

‘উনি পাগল। আম্মা, আপনি কেমন আছেন? দেখে বোঝা যাচ্ছে, ভালো নেই। আম্মা বিশ্বাস করুন, আপনার প্রতি আমাদের রাগ নেই। ওই বাড়িটা দেখলে খুব কষ্ট হয়, আম্মা। খুব যন্ত্রণা হয়। এজন্য যাই না। আপনাকে অনেকবার চিঠি লিখেছি, ঢাকা গিয়ে কয়দিন থেকে আসার জন্য। গেলেন না কেন?’

ফরিনা অবাক হয়ে বললেন, ‘আমার কাছে তো কুনু চিডি আহে নাই।’

‘সে কী! আমি তো এই চার বছরে ছয়টি চিঠি লিখেছি। পাঠিয়েছিও।’

‘আমি তো পাই নাই।’

ফরিনা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পদ্মজা বলল, ‘আচ্ছা এ ব্যাপারে কথা বলব উনার সঙ্গে। আমি যখন আম্মার কবর জিয়ারত করতে আসি তখনো তো এসে আমাকে আর উনাকে দেখে যেতে পারেন।’

‘তোমরা বাড়িত যাও না বইলা, আমি ভাবছি আমারে ঘেন্না করো তোমরা তাই সামনে আইতে পারি নাই। আমার জন্য আমার নাতনিডা… ‘

ফরিনা হু হু করে কেঁদে উঠলেন। পদ্মজার চোখ ছলছল করে উঠল। সে ফরিনাকে বলল, ‘আপনার জন্য কিছু হয়নি। আপনি এভাবে ভাববেন না। কান্না থামান।

যতই বলো মা, কান্না থামাবে না। চার বছর ধরে এভাবেই কাঁদছে।’ মজিদের কণ্ঠস্বর শুনে পদ্মজা দ্রুত ঘোমটা টেনে নিলো। মজিদকে সালাম করে বলল, ‘ভালো আছেন, আব্বা?’

‘এই তো আছি কোনোমতে।’

‘আম্মা, আপনি কান্না থামান। আমার খারাপ লাগছে।’

ফরিনা আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে বললেন, ‘আমার বাবু কই?’

‘ভেতরের ঘরে ঘুমাচ্ছে। ডেকে দিচ্ছি।’

‘না, থাকুক। ঘুমাক। ‘

পদ্মজা শ্বশুর, শাশুড়িকে সদর ঘরে নিয়ে আসে। আস্তে আস্তে ঘুম ভাঙে সবার। আমির যত যাই বলুক, মাকে দেখেই নরম হয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করে। মজিদ ছেলে আর ছেলের বউকে ছাড়া কিছুতেই বাড়ি যাবেন না। কম হলেও চার-পাঁচ দিন থেকে আসতে হবে। অবশেষে আমির রাজি হলো। প্রেমার সামনে পরীক্ষা তাই প্রেমাকে সঙ্গে নিলো না। বাসন্তী, প্রেমা, প্রান্ত বাড়িতে রয়ে গেল। পদ্মজাদের সঙ্গে গেল পূর্ণা।

.

হাওলাদার বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে পা দিতেই পদ্মজার সর্বাঙ্গ অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল। সূর্য ওঠেনি, দমকা বাতাস হচ্ছে। সেই বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে বাজপাখি উড়ে গেল একটা, সেই পাখির ডাক অদ্ভুত হাহাকারের মতো। যেন মনের চেপে রাখা কষ্ট ও ক্ষোভ নিয়ে কেউ আর্তচিৎকার করছে। নাকি এটা নিছকই পদ্মজার ভাবনা? চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের সামনে এসে দাঁড়াল সে। চার বছর পূর্বে তো এখানে, এই জায়গাটায় তার আদরের তিন মাসের কন্যা পারিজার রক্তাক্ত লাশ পড়ে ছিল! পদ্মজার বুক কেমন করে উঠল! ভীষণ ব্যথা হচ্ছে!

বুকে হাত রেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল পদ্মজা। আমির উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল, ‘খারাপ লাগছে?’

পদ্মজা স্বাভাবিক হয়ে বলল, ‘না।’ থেমে নিশ্বাস নিলো। বলল, ‘পূর্ণাকে দেখুন, কেমন পাগল।’

আমির সামনে তাকাল। পূর্ণা মাথার উপর ব্যাগ নিয়ে সবার আগে বরই খেয়ে খেয়ে কোমর দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে! অন্দরমহলের সামনে এবং আলগ ঘরের পেছনে টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। হেমন্তকালে ধান কাটা হয়েছে, তখন কৃষকরা আলগ ঘরে থেকেছে। তাদের জন্যই এই টিউবওয়েল বসানো হয়েছিল। টিউবওয়েলের চারপাশে গোল করে সিমেন্ট দিয়ে মেঝেও করা হয়েছে। সব মিলিয়ে একটি কলপাড়ের রূপ নিয়েছে।

পূর্ণা নারিকেল গাছের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। কলপাড়ে এক সুদর্শন যুবক পিঁড়িতে বসে গোসল করছে। পরনে লুঙ্গি। রানি গামছা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী যেন বলছে। পূর্ণা ব্যাগ রেখে হাঁ করে সেই যুবককে পরখ করে। সুঠাম, সুগঠিত শরীর, মায়াবী, ফরসা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ত্বক। প্রশস্ত বুকে ঘন পশম। চওড়া পিঠ। শক্তপোক্ত দেখতে দুই হাত। ডান হাতে ছোটো কলস নিয়ে মাথায় পানি ঢালছে। সেই জল চুল থেকে কপাল, কপাল থেক ঠোঁট, ঠোঁট থেকে বুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ চুল ঝাঁকি দিয়ে উঠল, জলের ছিটে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। রানি যুবকটিকে বকতে বকতে দূরে সরে দাঁড়াল। যুবকটি আবারও মাথায় পানি ঢেলে চুল ঝাঁকায়। উদ্দেশ্য, রানিকে ভিজিয়ে দেয়া। পূর্ণা মুগ্ধ হয়ে গেল। সে দ্রুত মাটিতে ব্যাগ রেখে ওড়না ঠিক করে, চুলের খোঁপা খুলে দিল। ঠোঁট জুড়ে হাসি ফুটিয়ে কলপাড়ের দিকে হেঁটে গেল। তার চোখের দৃষ্টি দেখলে যে কারো মনে হবে, পূর্ণা অপরিচিত এই যুবকটিকে চোখ দিয়ে পিষে ফেলছে। কলপাড়ের পাশে ভেজা কাদা ছিল। পূর্ণা পা রাখতেই পিছলে পড়ে গেল।

ধপাস শব্দ শুনে যুবকটি লাফিয়ে উঠে ভরাট কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ‘বোয়াল মাছ! বোয়াল মাছ!

৪৯

ঘটনাটি পদ্মজার চোখে পড়তেই সে দৌড়ে আসে। রানি আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব। সে পূর্ণাকে তুলতে দৌড়ে আসতে গিয়ে শাড়ির সঙ্গে পা প্যাঁচ লাগিয়ে পূর্ণার চেয়ে ঠিক এক হাত দূরে আছাড় খেল! এ যেন ধপাস করে পড়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যুবকটি হাসবে, নাকি সাহায্য করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সেকেন্ড দুয়েক ভেবে মনস্থির করল, হাসা ঠিক হবে না। সাহায্য করা উচিত। কলপাড় থেকে এক পা নামাতেই পদ্মজা চলে এসে পূর্ণাকে তোলার চেষ্টা করতে লাগল। যুবকটি রানিকে সাহায্য করে ওঠার জন্য। পদ্মজা উৎকণ্ঠা নিয়ে পূর্ণাকে প্রশ্ন করে, ‘খুব ব্যথা পেয়েছিস?’

পূর্ণার মুখ ঢেকে আছে রেশমি ঘন চুলে। আড়চোখে একবার যুবকটিকে দেখল। মিনমিনিয়ে বলল, ‘না।’

ফরিনা ছুটে এসে বললেন, ‘এইডা কেমনে হইল? এই ছেড়ি এমনে আইলো কেন? ও ছেড়ি, কোনহানে দুঃখ পাইছো?’

পূর্ণা নরম কণ্ঠে বলল, ‘ব্যথা পাইনি।’

‘পাওনি মানে কী? সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছো না। পদ্মজা, ওকে নিয়ে যাও। কাদা মেখে কী অবস্থা!’ বলল আমির।

পদ্মজা আর আমিরকে দেখে রানি প্রচণ্ড অবাক হয়েছে! খুশিতে তার কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।

আমিরের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, ‘দাভাই? তুমি আইছো! পদ্মজা, এতদিনে আমরারে মনে পড়ছে?’

পদ্মজা মৃদু হেসে বলল, ‘তোমাকে সবসময়ই মনে পড়ে, আপা। আমরা পরে অনেক গল্প করব। পূর্ণাকে নিয়ে এখন ভেতরে যাই।’

পদ্মজা আর ফরিনা পূর্ণাকে ধরে ধরে অন্দরমহলে নিয়ে যায়। পিছু পিছু রানিও গেল। যুবকটি আমিরের সামনে এসে দাঁড়াল। হেসে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম আমির ভাই। চিনতে পারতাছেন?’

আমির যুবকটিকে চেনার চেষ্টা করল। বলল, ‘মৃদুল না?’

‘জি ভাই।’

আমিরের হাসি চওড়া হলো। মৃদুলের সঙ্গে করমর্দন করে বলল, ছোটোবেলায় দেখেছি। কত্ত বড়ো হয়ে গেছিস! চেনাই যাচ্ছে না।’

‘আমার ঠিকই আপনারে মনে আছে।’

‘সেই

মৃদুলের বাহুতে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে আমির বলল, ‘ছোটোবেলা তো তুমি করে বলতি। এখন আপনি আপনি বলছিস কেন?’

মৃদুল এক হাতে ঘাড় ম্যাসাজ করে হাসল। এরপর বলল, ‘ষোলো- সতেরো বছর পর দেখা হইছে তো।’

‘তো কী হয়েছে? তুমি বলে সম্বোধন করবি। গোসল করছিলি নাকি?’

‘জি।’

‘কাপড় পালটে আয়, অনেক আলাপ হবে।’

‘আচ্ছা ভাই।’

নারিকেল গাছের পাশে ব্যাগটি পড়ে থাকতে দেখে, এগিয়ে গিয়ে সেটা নিয়ে অন্দরমহলের দিকে গেল আমির।

.

বৈঠকখানায় বসে আছে পদ্মজা। পূর্ণার কোমরে, পায়ে গরম সরিষা তেল মালিশ করে দিয়ে বিশ্রাম নিতে বলেছে। হুমকি দিয়ে এসেছে, ঘর থেকে বের হলে একটা মারও মাটিতে পড়বে না। পূর্ণার মুখ দেখে মনে হয়েছে, আর বের হওয়ার সাহস করবে না। বেশ জোরেই পড়েছে। পা, কোমর লাল হয়ে গেছে। এই বাড়িটা মৃতপ্রায়। আগে তাও মানুষ আছে বলে মনে হতো। এখন মনেই হয় না এই বাড়িতে কেউ থাকে। নির্জীব, স্তব্ধ। রান্নাঘর থেকে বেশ কিছুক্ষণ পর পর টুংটাং শব্দ আসছে। ফরিনা ও আমিনা তাড়াহুড়ো করে রান্না করছেন। আমির বের হয়েছে। বাড়িতে মাত্রই এলো, আর কীসের কাজে বেরিয়েও পড়ল! স্তব্ধতা ভেঙে একটা ছোটো বাচ্চা দৌড়ে আসে পদ্মজার কাছে। বাচ্চাটার কোমরে, গলায় তাবিজ। তাবিজের সঙ্গে ঝনঝন শব্দ তোলা জাতীয় কিছু গলায় ঝুলানো। পদ্মজা বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো। রানি বৈঠকখানায় এসে বাচ্চাটিকে বলল, ‘আলো আম্মা, এদিকে আয়। তোর গায়ে ময়লা। পদ্ম মামির কাপড়ে লাগব।

পদ্মজা আলোর গাল টেনে বলল, ‘কিছু হবে না। থাকুক।’

আলোর গালে চুমু দিল পদ্মজা। আলোর বয়স দুই বছর। রানির মেয়ে হয়েছে শুনেছিল পদ্মজা। কিন্তু দেখতে আসতে পারেনি। এবারই প্রথম দেখা। পদ্মজা বলল, ‘আলো ভাগ্যবতী হবে। দেখতে বাপের মতো হয়েছে।’

বাপের মতো হয়েছে কথাটি শুনে রানির মুখ কালো হয়ে যায়। তার প্রথম বাচ্চা মারা যাওয়ার এক বছরের মাথায় সমাজের নিন্দা থেকে বাঁচাতে খলিল হাওলাদার রানির জন্য পাত্র খুঁজতে থাকলেন। কিন্তু কেউই রানিকে বিয়ে করতে চায়নি। সবাই জেনে গিয়েছিল রানি অবৈধ সন্তান জন্ম দিয়েছে, বাচ্চাটিও মারা গেছে। কোনো পরিবার রানিকে ঘরের বউ করতে চাইছিল না। এদিকে বিয়ে দিতে না পেরে সমাজের তোপে আরো বেশি করে পড়তে হচ্ছিল। খলিল হাওলাদার পিতা হয়ে রানিকে ফাঁস লাগিয়ে মারতে চেয়েছিলেন। তখন মজিদ হাওলাদার মদনকে ধরে আনলেন। মদন, মগার বাবা-মা নেই। দুই ভাই এই বাড়িতেই ছোটো থেকে আছে। এই বাড়ির সেবার কাজে নিযুক্ত। বাধ্য হয়ে মদনের সঙ্গে বাড়ির মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়। মদন কামলা থেকে ঘরজামাই হয়। রানি মন থেকে মদনকে আজও মানতে পারেনি। কখনোও পারবেও না। ঘৃণা হয় তার। মাঝে মাঝে আলোকেও তার সহ্য হয় না। আলোর মুখটা দেখলেই মনে হয়, এই মেয়ে মদনের মেয়ে।

কামলার মেয়ে!

আলো আধোআধো স্বরে বলল, ‘নান্না, নান্না।’

পদ্মজা আদুরে কণ্ঠে বলল, ‘নানুর কাছে যাবে?’

আলো পদ্মজার কোল থেকে নামতে চাইলে পদ্মজা নামিয়ে দিল। আলো দৌড়ে গেল রান্নাঘরে। রানি বলল, ‘আম্মার জন্য পাগল এই ছেড়ি। সারাবেলা আম্মার লগে লেপটায়া থাকে।’

‘তুমি নাকি আলোকে মারধোর করো?’

রানি চমকাল। প্রশ্ন করল, ‘কেলা কইছে?’

‘শুনেছি। আলো একটা নিষ্পাপ পবিত্র ফুল। ওর কী দোষ?’

রানি চুপ করে রইল। পদ্মজা বলল, ‘সব রাগ এইটুকু বাচ্চার ওপর ঝাড়া ঠিক না, আপা।’

‘আমার কষ্টডা বুঝবা না, পদ্মজা।’

‘বুঝি। এতটা অবুঝ না আমি। আলো মদন ভাইয়ার মেয়ে এটা ঠিক কিন্তু তোমারও তো মেয়ে। তোমার গর্ভে ছিল। দশ মাস তোমার রক্ত খেয়েছে।’

‘আমি কী আমার ছেড়িরে ভালোবাসি না? বাসি। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয়। জানো পদ্মজা, আবদুল ভাইয়ের কথা মনে হইলে আমার সব অসহ্য লাগে। একলা একলা কাঁনদি। তহন আলো কানলে…আমি ওরে এক দুইডা থাপ্পড় মারি। পরে আফসোস হয় কেন মানলাম ছেড়িডারে। ও তো আমারই অংশ।’

‘নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করো। নিয়তির উপর কারো হাত নেই। অতীত ভুলতে বলব না। কিছু অতীত ভোলা যায় না। কিন্তু চাইলেই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে বাঁচা যায়। নিজেকে মানিয়ে নাও। আলোর প্রতি যত্নশীল হও। মানুষের মতো মানুষ করো। একটা মেয়েকে নিয়ে সমাজে বাঁচা যুদ্ধের মতো। গোড়া থেকে খেয়াল দাও।’

‘তোমার কথা হুনলে বাঁচার শক্তি পাই, পদ্মজা।’

পদ্মজা হাসল। বৈঠকখানায় আমির প্রবেশ করে। তার পেছনে দেখা যায় মৃদুলকে, ছেলেটাকে দেখে হাসল রানি। পদ্মজাকে দেখিয়ে বলল, ‘এই যে এইডা হইছে, পদ্মজা। তোর ভাবি।’

মৃদুল পদ্মজাকে সালাম করার জন্য ঝুঁকতেই পদ্মজা বলল, ‘না, না। কোনো দরকার নেই। বসুন আপনি।’

মৃদুল বসল। বলল, ‘আপনের কথা কথা অনেক শুনছি। আজ দেখার সৌভাগ্য হইলো।’

আমির পদ্মজাকে বলল, ‘ওর নাম মৃদুল। রানির মামাতো ভাই। ছোটোবেলা আমাদের বাড়িতে কয়দিন পর পর আসত। যখন আট-নয় বছর তখন দূরে চলে যায়। আর দেখা হয়নি। চাইলেই দেখা হতো। কেউ চায়নি। তাই দেখাও হয়নি।

‘কোথায় থাকেন?’ জানতে চাইল পদ্মজা।

‘জি ভাবি, রামপুরা।’

রামপুরার কথা পদ্মজা শুনেছে। তাদের জেলার শহর এলাকার নাম রামপুরা। সবাই চেনে। ছেলেটার চেহারা উজ্জ্বল, চকচকে। হাসিখুশি! আলাপে আলাপে জানতে পারল, মৃদুল পদ্মজার চেয়ে দুই বছরের বড়ো। মেট্রিক ফেল করার পর আর পড়েনি। মিয়া বংশের ছেলে।

কথাবার্তায় শুদ্ধ-অশুদ্ধ দুই রূপই আছে। ভীষণ রসিক মানুষও বটে!

খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার পর পদ্মজা দোতলায় গেল, সঙ্গে রয়েছে আমির। নুরজাহান বেশ কয়েক মাস ধরে অসুস্থ। শরীরের জায়গায় জায়গায় ঘা। চামড়া থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। সারাক্ষণ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করেন নুরজাহানের ঘরে ঢুকতেই নাকে দুর্গন্ধ লাগল, নাকে রুমাল চেপে ধরল পদ্মজা। নুরজাহান বিছানার ওপর শুয়ে আছেন। সময়ের ব্যবধানে একেবারে নেতিয়ে গিয়েছেন তিনি। বয়সটা যেন কয়েক গুণ বেড়েছে, হাড় দেখা যাচ্ছে। লজ্জাস্থান ছাড়া পুরো শরীর উন্মুক্ত। এক পাশে লতিফা দাঁড়িয়ে, আর মাথার কাছে বসে আছেন একজন কবিরাজ। একটা কৌটা থেকে সবুজ তরল কিছু নুরজাহানের ক্ষত স্থানগুলোতে লাগাচ্ছেন। পদ্মজা নুরজাহানের বাঁ-পাশে গিয়ে দাঁড়াল। নাক থেকে রুমাল সরিয়ে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল দুর্গন্ধের সঙ্গে। ডাকল, ‘দাদু? দাদু…শুনছেন।’

নুরজাহান ধীরে ধীরে চোখ খুললেন। পদ্মজা প্রশ্ন করল, ‘দাদু, খুব কি কষ্ট হয়? কোথায় বেশি যন্ত্রণা?’

নুরজাহান শুধু তাকিয়ে রইলেন। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পদ্মজার বুকটা হাহাকার করে উঠল। বয়স্ক মানুষটা কত কষ্ট করছে! লতিফা বলল, ‘দাদু কথা কইতে পারে না। খালি কান্দে’

নুরজাহানের অসহায় চাহনি দেখে পদ্মজার চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। সে নুরজাহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আল্লাহর নাম স্মরণ করেন। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য ধরুন।’ তারপর লতিফাকে বলল, ‘ভালো করে খেয়াল রেখো।’

আমির বেশ অনেকক্ষণ কথা বলল নুরজাহানের সঙ্গে। নুরজাহান জবাব দিলেন না, শুধু উ-আ করলেন। আমিরের দুই চোখ বেয়ে জল পড়ে। পদ্মজার ভালো লাগে না দেখতে। সে আমিরকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাইরে নিয়ে আসে। বারান্দা পেরোনোর পথে রুম্পার ঘরের দরজা খোলা দেখতে পায়। যাওয়ার সময় তো বন্ধই ছিল। পদ্মজা ঘরের ভেতর উঁকি দেয়। কেউ নেই। পালঙ্কও নেই।

সে অবাক হয়ে আমিরকে প্রশ্ন করল, ‘রুম্পা ভাবি কোথায়?’

আমিরও এসে উঁকি দিল। শূন্য ঘর। সে অবাক স্বরে বলল, ‘জানি না তো।’

পদ্মজা চিন্তায় পড়ে গেল। হেমলতা মারা যাওয়ার পর গ্রামে আর থাকেনি। শহরে ফিরে যায়। এক মাসের মাথায় জানতে পারল, সে গর্ভবতী। গর্ভাবস্থার প্রথম পাঁচ মাস খুব খারাপ যায়। প্রতি রাতে হেমলতাকে স্বপ্নে দেখত। ছয় মাস পড়তেই ফরিনা গ্রামে নিয়ে আসেন। এ সময় পদ্মজার একজন মানুষ দরকার। কাছের মানুষদের দরকার। তাই আমিরও নিষেধ করেনি। তার মধ্যে আবার মোর্শেদ মারা গেলেন। পদ্মজা আরো ভেঙে পড়ে। কাছের মানুষদের সহযোগিতায় বাচ্চার কথা ভেবে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করে। তখন পদ্মজা অনেকবার চেষ্টা করেছে রুম্পার সঙ্গে দেখা করার। কিন্তু মদন আর নুরজাহানের নজরের বাইরে গিয়ে কিছুতেই সম্ভব হয়নি।

এরপর কোল আলো করে এলো ফুটফুটে কন্যা। পদ্মজা তারপরও চেষ্টা চালিয়ে গেল। সারাক্ষণ রুম্পাকে নজরবন্দি করে রাখার ব্যাপারটা তার খটকা বাড়িয়ে তোলে। একদিন সুযোগ পেল।

সেদিন রাতে নুরজাহান, মদন, আমির, রিদওয়ান, আলমগীর সবাই যাত্রাপালা দেখতে গিয়েছিল। দুই তলায় ছিল শুধু পদ্মজা, তার মেয়ে পারিজা আর ফরিনা। ফরিনার দায়িত্বে পারিজাকে রেখে রুম্পার ঘরে যায় পদ্মজা। রুম্পা তখন অচেতন হয়ে পড়ে ছিল নিজের প্রস্রাব-পায়খানার ওপর। পদ্মজা নাকে আঁচল চেপে ধরে সব পরিষ্কার করে রুম্পার জ্ঞান ফেরায়। জানতে পারে: তিন দিন ধরে রুম্পাকে খাবার দেয়া হচ্ছে না। পদ্মজা খাবার নিয়ে আসে। রুম্পাকে খাইয়ে দেয়।

তবে কথা বলার সুযোগ হওয়ার আগেই ফরিনার চিৎকার ভেসে আসে কানে। ফরিনার কাছে পারিজা! পদ্মজার বুক ধক করে উঠে। ছুটে বেরিয়ে যায় সে, ঘরে এসে দেখে ফরিনা নেই। তার আর্তনাদ ভেসে আসছে কানে। পদ্মজা সেই আর্তনাদের সঙ্গে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে উলটে পড়ে। তবুও ছুটে যায়। ফরিনার কান্নার চিৎকার অনুসরণ করে অন্দরমহলের বাইরে বেরিয়ে আসে। চাঁদের আলোয় ভেসে উঠে তার তিন মাসের কন্যার রক্তাক্ত দেহ। ফুটফুটে কন্যা! ছোটো ছোটো হাত, পাগুলো নিথর হয়ে পড়ে আছে। সময় থেমে যায়। মনে হতে থাকে, নিশুতি রাতের প্রেতাত্মারা একসঙ্গে, একই স্বরে চিৎকার করে কাঁদছে। পদ্মজার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যায়। কোন পাষাণ মানব তিন মাসের বাচ্চার গলায় ছুরি চালিয়েছে? তার কী হৃদয় নেই? পদ্মজা মেয়ের নাম ধরে ডেকে চিৎকার দিয়ে সেখানেই লুটিয়ে পড়ে।

পুলিশ আসে, তদন্ত হয়। সেদিন ফরিনা দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে যায়। তিনি হাত বাড়িয়ে বুঝতে পারেন পাশে পারিজা নেই। দ্রুত উঠে বসেন। পদ্মজা নিয়ে গেল নাকি? ভাবতে ভাবতে নাতনিকে খুঁজতে থাকেন। বারান্দা থেকে বাইরে চোখ পড়তেই দেখতে পেলেন, একজন মোটা, কালো লম্বা চুলের লোক দৌড়ে পালাচ্ছে। খালি জায়গায় কাঁথায় মোড়ানো কিছু একটা পড়ে আছে। ফরিনা ছুটে বাইরে বেরিয়ে আসেন। নাতনির রক্তাক্ত দেহ দেখে চিৎকার শুরু করেন। পুলিশ কোনো কিনারা খুঁজে পায়নি।

পরের দিনগুলো বিষাক্ত হয়ে উঠে। পদ্মজা মাঝরাতে চিৎকার করে কেঁদে উঠত। খাওয়া-দাওয়া একদমই করত না। মাঝরাতে মেয়ের কবরে ছুটে যেত। আমির পদ্মজাকে নিয়ে হাওলাদার বাড়ি থেকে দূরে সরে আসে। প্রায় এক বছর পদ্মজা মানসিকভাবে বিপর্যন্ত ছিল। তারপর বুকে ব্যথা নিয়েই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, একদিন ফিরবে অলন্দপুর। সেই নিষ্ঠুর খুনিকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিবেই। জানতে চাইবে, কীসের দোষে তার তিন মাসের কন্যা বলি হলো? ছোট্ট শিশুটি কী ক্ষতি করেছিল?

কেউ জানুক আর নাই বা জানুক, পদ্মজা জানে হাওলাদার বাড়িতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য, পারিজার খুনিকে বের করা। সে শতভাগ নিশ্চিত এই বাড়ির কেউ না কেউ জড়িত এই খুনের সঙ্গে। শুধু বের করার পালা। পুরনো কথা মনে হতেই পদ্মজা দুই চোখ বেয়ে জল গড়াতে থাকল। আমির জল মুছে দিয়ে বলল, ‘বোধহয় তিন তলায় রাখা হয়েছে। ‘

পদ্মজা তিন তলার সিঁড়ির দিকে তাকাল। শুনেছে, তিন তলার কাজ নাকি সম্পূর্ণ হয়েছে। নতুন অনেকগুলো ঘর হয়েছে। তবে আর কথা বাড়াল না। এখন গোসল করতে হবে। আজান পড়বে। আজ রাত থেকেই সে নিশাচর হবে। এক মুহূর্তও নষ্ট না করে সব রহস্যের জাল কাটতে হবে। এটাই তার নিজের সঙ্গে নিজের প্রতিজ্ঞা। আমির ডাকল, ‘কী হলো? কী ভাবো?’

পদ্মজা আমিরের দিকে একবার তাকাল। চাহনি অস্থির করে বলল, ‘কিছু না। ঘরে চলুন।’

‘কিছু তো ভাবছিলে।’

‘এতদিনের জন্য গ্রামে এসেছি। চাকরিটা থাকবে তো?’

‘থাকবে না কেন? রফিক কতটা সম্মান করে আমাকে দেখোনি? আর তোমার যোগ্যতার কী কমতি আছে? যেখানে ইচ্ছে সেখানেই চাকরি হবে।’

পদ্মজা থমকে দাঁড়াল। আমিরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘আপনি যেখানে ইচ্ছে সেখানে চাকরি করতে দিবেন?’

আমির হেসে ফেলল। বলল, ‘তা অবশ্য দেব না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *