পদ্মজা – ৪০

৪১

রানির অবস্থা বেগতিক। খলিল হাওলাদার দরজা বন্ধ করে এলোপাথাড়ি মেরেছেন। কারো কথা শোনেননি। রিদওয়ান বাড়ির কাজের মানুষদের হুমকি দিয়েছে, রানি গর্ভবতী এই খবর বাইরে বের হলে সব কয়টাকে খুন করবে। মগা, মদন, লতিফা, রিনু ভয়ে আধমরা। তারা নিশ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছে। কেউ যদি বাইরে এই খবর বের করে, নিশ্চিত সবাই তাদেরই ভুল বুঝবে। রানি মারের চোটে অজ্ঞান হয়ে গেছে। সারা গায়ে মারের দাগ। ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে। আমিনা রানিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন। খলিল হাওলাদারকে বার বার পাষাণ বাপ বলে আখ্যায়িত করছেন। পদ্মজা পরিষ্কার কাপড়, পানি এনে ফরিনার হাতে দিল। ফরিনা রানির মুখে পানি ছিটিয়ে দেন। রানি কিছুতেই চোখ খুলছে না। লাবণ্য ফুঁপিয়ে কাঁদছে। রানির সঙ্গে তার সবসময় ঝগড়া হয় ঠিক, তবে ভালোও তো বাসে। দরজার বাইরে থেকে রানির চিৎকার শুনেছে। রানি চিৎকার করে ডাকছিল, ‘আম্মা, দাভাই, লাবণ্য কই তোমরা? আব্বা মাইরা ফেলতাছে। বাঁচাও তোমরা আমারে। লাবণ্য, কই তুই? আম্মা…।’

দরজায় সবাই মিলে অনেক ধাক্কা দিয়েছে, ডেকেছে…খলিল হাওলাদার সাড়া দেননি। এক নিশ্বাসে মেয়েকে এলোপাতাড়ি মেরে গেছেন। রানিকে মাটিতে ফেলে জোরে জোরে লাথি মেরেছেন। রাগের বশে রানির তলপেটে বেশি আঘাত করেছেন। রানি আকাশ কাঁপিয়ে কেঁদেছে। কেউ পারেনি ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে। পদ্মজা আমিরের পাঞ্জাবি দুই হাতে খামচে ধরে কান্নামাখা কণ্ঠে বারংবার অনুরোধ করেছে, ‘আল্লাহর দোহাই লাগে আপনি এসব থামান। একটু চেষ্টা করুন।’

আমির অনেক চেষ্টা করেছে দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করার জন্য, পারেনি। যখন করাত আনার জন্য প্রস্তুত হয় তখন খলিল হাওলাদার ক্লান্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছেন। রানির গলার স্বর থেমে যায়, শোনা যাচ্ছে না। সবাই ভেতরে প্রবেশ করে দেখে, রানি উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শরীর রক্তাক্ত। আমিনা ‘রানি’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। ছুটে যান রানির কাছে। মগাকে পুনরায় কবিরাজকে নিয়ে আসতে পাঠানো হয়েছে। এত কিছু হয়ে যাচ্ছে, নুরজাহান একবারও নিচে নেমে আসেননি। রানি গর্ভবতী শুনে সেই যে ওপরে গিয়েছেন তো গিয়েছেনই! আর আসার নাম নেই। এত চেঁচামিচি শুনেও কী আসতে ইচ্ছে হয়নি?

এতই কঠিন মন!

কবিরাজ আসার অনেকক্ষণ পর রানি চোখ খুলল। ফরিনা আমিনাকে বললেন, ‘ছেড়ির বিয়া দিতে কইছিলাম। দিলি না। ছেড়ির কথা হুনছিলি তোরা। এহন তো মজা বুঝতেই হইব। বিশ বছরের যুবতী ছেড়ি বাপের ঘরে থাহে? না লাংয়ের ঘরে?’

আমিনা কিছু বলতে পারলেন না। আঁচলে মুখ লুকিয়ে শুধু কাঁদছেন। মজিদ ঘরে প্রবেশ করে ফরিনাকে বললেন, ‘তোমাদের মেয়েকে জিজ্ঞাসা করো, এই আকাম কে করেছে! বেজন্মাটা কে?’

পদ্মজা ধীরপায়ে পালঙ্কের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মাথায় ঘোমটা টানা। ফরিনা রানিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাচ্চার বাপ কেডায়?’

রানি কিছু বলছে না। ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে। চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে। ফরিনা তেজ নিয়ে বললেন, ‘কী রে ছেড়ি? এহন কথা আয় না কেন? বাচ্চার বাপের নাম ক? কইবি তো। বিয়া তো দেওন লাগব।’

তবুও রানি চুপ। তার কান্নার বেগ বেড়ে গে ওন লাগব মজিদ হাওলাদার লাবণ্যকে ডাক দিলেন, ‘লাবণ্য?’

লাবণ্য কেঁপে উঠল। মজিদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর তো জানার কথা। একসঙ্গে থাকিস। কার সঙ্গে রানির সম্পর্ক ছিল?’

লাবণ্য মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। আড়চোখে রানিকে দেখে। রানি অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য বুঝে উঠতে পারছে না, তার কি বলা উচিত? মজিদ ধমকে উঠলেন, ‘লাবণ্য, সত্য বল। কিছু লুকানোর চেষ্টা করবি না। তাহলে তোরও এই দশা হবে।’

লাবণ্য ভয়ের চোটে গড়গড় করে বলতে থাকল, ‘আপার সঙ্গে আবদুল ভাইয়ের প্রেম আছে। দুইজনে প্রায়ই দেখা করে বাড়ির পেছনে। খালের পাড়ে। অনেক বছর হইছে প্রেমের।’

রানির কান্নার শব্দ বেড়ে যায়। ফরিনা ঝাঁঝালো কণ্ঠে রানিকে বললেন, ‘এই ছেড়ি চুপ কর! এহন মেলাইতাছস কেরে? কুকাম করার সময় মনে আছিল না? আমরারে কইতে পারলি না তোর আবদুলরে পছন্দ। আর আবদুলই কেমন ধাঁচের বেড়া মানুষ হইল? প্রস্তাব লইয়া আইতে পারে নাই? তোরে ডাইকা লইয়া কুকাম কইরা বেড়াইছে।’

নিজের বাড়ি বানায়া প্রস্তাব লইয়া আইব কইছিল।’ রানি কাঁদতে কাঁদতে বলল। ফরিনা পালটা বললেন, ‘কয়দিন তর সয় নাই? শরীর গরম হইয়া গেছিল বেশি? খারাপ ছেড়ি কোনহানের।’

আমির ঘরে ঢুকতেই মজিদ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আবদুলরে ধরে নিয়ে আয়।

আমির অবাক হয়ে বলল, ‘আবদুল করছে এই কাজ? ও তো এমন না।’

‘মুখ দেখে বোঝা যায়, কে কেমন?’

আমির উত্তরে কিছু বলল না। রানি আহত, দুর্বল শরীর নিয়ে দ্রুত বিছানা থেকে নামে। আমির ঘর থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়িয়েছে মাত্র—রানি আমিরের পায়ে ধরে বসে আকুতি করে বলল, ‘দাভাই, উনারে কিছু কইরো না। উনারে মাইরো না। আমি তোমার পায়ে পড়ি। ও কাকা, আমারে মারো। উনারে মাইরো না।’

‘কী পাগলামি করছিস? পা ছাড়।’ বলল আমির।

‘দাভাই, দোহাই লাগে।’

আমির রানিকে দুই হাতে তুলে দাঁড় করাল। কোমল কণ্ঠে বলল, ‘কিছু করব না। শুধু নিয়ে আসব। বিয়ে পরিয়ে দেব।’

‘সত্যি, দাভাই?’

‘সত্যি।’

হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছল রানি, আমির বেরিয়ে গেল। মজিদ চোখ-মুখ কঠিন অবস্থানে রেখে ঘর ছাড়েন। রানি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে নিলেই পদ্মজা ধরে ফেলে। আমিনা, ফরিনা এগিয়ে আসেন। সবাই মিলে রানিকে ধরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। বিয়ে হবে শুনে ভেতরে ভেতরে রানির খুব আনন্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগের সব মার, ব্যথা তুচ্ছ মনে হচ্ছে। রানি আবদুলকে এত বেশি ভালোবাসে যে, আবদুলের এক কথায় সে বিয়ের আগে ঘনিষ্ঠ হতে রাজি হয়ে গিয়েছে। যখন যেখানে যেতে বলেছে, তখন সেখানেই গিয়েছে; দ্বিতীয়বার ভাবেনি। অন্ধভাবে ভালোবেসেছে। কতদিনের স্বপ্ন! কত আশা! পূরণ হবে অবশেষে। রানি নিজের অজান্তে হাসে। তৃপ্তির হাসি! কিছু পাওয়ার হাসি!

উপস্থিত আর কেউ খেয়াল না করলেও, সেই হাসি পদ্মজা খেয়াল করল। এই হাসি বেশিক্ষণ থাকল না। বিকেলবেলা আমির দুঃসংবাদ নিয়ে ফিরল। আবদুল খুন হয়েছে গত রাতে! মাদিনী নদীতে লাশ পাওয়া গেছে। আবদুলের বাড়িতে পুলিশের ভিড়! রানির কানে কথাটা আসতেই গগন কাঁপানো চিৎকার দিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে, নিভে গেল জীবনের সুখের আলো…নিভে গেল স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছের প্রদীপ।

পদ্মজা এই খবর শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিটা মৃতদেহ নদীতেই কেন পাওয়া যায়? এতে কি প্রমাণ পানির সঙ্গে ধুয়ে যায়? আগের খুনগুলোর খুনি কি এই আবদুলের খুনি? পদ্মজা চেয়ার টেনে বসল। মাথা ব্যথা করছে খুব। রগ দপদপ করে কাঁপছে। চোখ বন্ধ করে ভাবল, এই অলন্দপুরে পাপের সাম্রাজ্য কারা তৈরি করেছে? ভাবতে গেলে শরীর কেমন করে! শূন্য হাত নিয়ে ভাবনা থেকে বের হতে হয়। কূল-কিনারা পাওয়া যায় না।

৪২

সূর্যমামার ঘুম ভাঙতে তখনো বাকি তবে পাখিরা ডাকাডাকি করে সবার ঘুম ভাঙানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। পদ্মজা স্বামীর বুকের ওম ছেড়ে অজু করে এলো। এসে দেখে, তার সোহাগের স্বামী এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! তাকে ডেকে তুলে দুজন একসঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলো। নামাজ শেষ করেই ঘুমিয়ে পড়ল আমির। পদ্মজা রান্নাঘরে চলে গেল। ফরিনা বেগম এখনও আসেননি। আজ মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পাবে। উত্তেজনায় পদ্মজার ভেতর কাঁপছে। সে পায়চারি করতে করতে লাবণ্যর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলা। পদ্মজা বাইরে থেকে উঁকি দেয়, রানি মেঝেতে বসে উদাস হয়ে কিছু ভাবছে। সেদিনের পর থেকে রাতে ঘুমায় না। নিজের মতো জগৎ করে নিয়েছে। খাবার রেখে যাওয়া হয়, যখন ইচ্ছে হয় খায়। পদ্মজা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জায়গা ত্যাগ করল। রানি নিজের ঘরে লাবণ্যকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখলে খুব রেগে যায়। তাই এই ভোরবেলা তার সামনে না যাওয়াই মঙ্গল। পদ্মজা সদর ঘরে পায়চারি করছে। ফরিনা বেগম তাসবিহ পড়তে পড়তে সদর ঘরে প্রবেশ করলেন। পদ্মজাকে দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘উইট্টা পড়ছ! চুলায় আগুন ধরাইছো?’

পদ্মজা অপরাধীর মতো মাথা নত করে ‘না’ উচ্চারণ করল। ফরিনা এ নিয়ে কথা বাড়ালেন না। মৃদু কণ্ঠে আদেশ করলেন, ‘লাবণ্যরে গিয়া ডাইককা তুলো। ছেড়িডা আইজও মানুষ হইল না। ভোরের আলো ফুইটা গেছে। হে এহনও ঘুমায়।’

পদ্মজা বাধ্য বউয়ের মতো বলল, ‘আচ্ছা আম্মা।’

পদ্মজা আবার লাবণ্যর ঘরের সামনে গেল। এবার আর বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে চলে যায়নি। ভেতরে ঢুকল। পদ্মজা আওয়াজ করে দরজা খুলে। তাও রানির ভাবান্তর হলো না। সে যেভাবে মেঝেতে বসে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল, সেভাবেই রয়ে গেল। রানির দিকে দৃষ্টি খেয়াল করে পালঙ্কের পাশে গিয়ে দাঁড়াল পদ্মজা। লাবণ্যকে ডাকল, ‘এই লাবণ্য। লাবণ্য?’

লাবণ্য আড়মোড়া ভেঙে পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, ‘উ?’

‘আজ ফলাফল। আর তুই ঘুমাচ্ছিস!’

পদ্মজার কথা বুঝতে লাবণ্যর অনেক সময় লাগল। যখন বুঝতে পারল লাফিয়ে উঠে বসল। বুকে হাত রেখে, হাসফাঁস করতে করতে বলল, ‘কী বললি এটা! দেখ কলিজাডা কেমনে লাফাইতাছে! কী ভয়ানক কথা মনে করায়া দিলি, উফ!’

পদ্মজা হাসল। বলল, ‘কলিজা লাফায় না, বুক ধুকপুক করে।’

ওইটাই…ওইটাই। আমি ফেল করব। রানি আপার মতো মাইর খাব দেখিস। আমার শ্বাস কষ্ট হইতাছে।’ লাবণ্য ভয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে। রাতে দুশ্চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়েছে, ঘুম ভেঙেও সেই আতঙ্ক! এই চিন্তায় রাতে ঘুমাতে ঘুমাতে মাঝরাত হয়ে গেছে। লাবণ্যর ছটফটানি দেখে ভয় পেয়ে গেল পদ্মজাও। সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘এমন কিছুই হবে না, দেখিস। অকারণে চিন্তা করছিস। সূর্য উঠে যাবে। নামাজ পড় জলদি। আল্লাহর কাছে দোয়া কর।’

লাবণ্য হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে কলপাড়ে ছুটে গেল। এইবার হেসে ফেলল পদ্মজা, রানির দিকে চোখ পড়তেই মিলিয়ে গেল হাসি। রানি কাঁদছে। পদ্মজা দুই পা রানির দিকে এগিয়ে আবার পিছিয়ে এলো।

শেষমেষ সাহস জুগিয়ে এগিয়ে এসে মৃদু কণ্ঠে ডাকল, ‘আপা?’

চোখ ভরতি অশ্রু নিয়ে তাকাল রানি। পৃথিবীর সব কষ্টরা বুঝি এক জোট হয়ে রানির চোখে ভিড় জমিয়েছে! রানি পদ্মজাকে অবাক করে দিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘প্রিয় মানুষ হারানোর কষ্ট

এতডা যন্ত্রণা কেন দেয়, পদ্মজা? তুমি তো অনেক জ্ঞানী। সবাই তোমারে বুদ্ধিমতী কয়। তুমি একটা বুদ্ধি দেও না। এই কষ্টের পাহাড় কমানোর বুদ্ধি। আমারে দেখায়া দিবা শান্তির পথ?’

মানুষের কতটা কষ্ট হলে এভাবে শান্তি খুঁজে? পদ্মজার চোখ টলমটল করে উঠল। সে ঢোক গিলে বলল, ‘পুরনো স্মৃতি মুছে সামনের কথা ভাবো। নামাজ পড়ো, হাদিস পড়ো, কোরআন পড়ো। একদিন ঠিক শান্তি খুঁজে পাবে।’

‘আমার মতো পাপীরে আল্লাহ কবুল করব?’

আল্লাহ তায়ালার মতো দয়াবান, উদার আর কেউ নেই। পাপ মোছার জন্য অনুতপ্ত হয়ে সেজদা দিয়েই দেখো না, আপা। ক্ষমা চেয়ে দেখো। আল্লাহ ঠিক তোমার জীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনবেন। সেদিন বুঝবে, আল্লাহ তোমার সেজদা কবুল করেছেন।’

রানি জানালার বাইরে তাকাল। আমগাছের ডালে চোখ রেখে বলল, ‘কেন এমনডা হইল আমার লগে?’

‘ব্যভিচার করেছ, আপা। বিয়ের আগে এভাবে…! আপা, এসব ভেবো না আর। যা হওয়ার হয়েছে।’

‘দুনিয়াত আর চাওনের-পাওনের কিচ্ছু নাই আমার।’

‘এবার আখিরাতের জন্য সম্পদ জমাও।’

রানি অন্যরকম দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। পদ্মজা সবসময় মাথায় সোজা সিঁথি করে। এক অংশ সিঁথি দেখা যাচ্ছে। বাকিটুকু শাড়ির আঁচলে ঢাকা। মেয়েটা এত স্নিগ্ধ, এত সুন্দর, এত পবিত্র দেখতে! দেখলেই মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।

পদ্মজা বলল, ‘আখিরাতের সম্পদ ইবাদত, খাঁটি ইবাদত।’

তুমি খুব ভালা, পদ্মজা।’ মৃদু হেসে বলল রানি। তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল জল। পদ্মজা অপ্রস্তুত হয়ে হাসল। বলল, ‘এখন নামাজ পড়তে পারবে? তাহলে পড়ে নাও। মনে শান্তি আসবে।’

‘ওইদিনের পর আর গোসল করি নাই।’

‘আজ করবে কিন্তু।’

‘করব।’

‘আসি?’

‘আসো।’

পদ্মজা বেরিয়ে যায়। দরজার বাইরে পা রাখতেই রানির কান্নার স্বর কানে এলো। থমকে দাঁড়াল পদ্মজা, পেছন ফিরে দেখে নিলো একবার। রানি হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। পদ্মজা মনে মনে প্রার্থনা করল: আল্লাহ, ক্ষমা করে দাও রানি আপাকে। শান্তির পথে ফিরে আসার রহমত দাও।

.

বাড়ির সবাই মেট্রিক পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আমির বের হয়েছে সেই সকাল দশটায়। এখন বাজে দুপুর তিনটা। লাবণ্য মিনিটে মিনিটে গ্লাস ভরে পানি খাচ্ছে। আর বার বার টয়লেটে যাচ্ছে। পদ্মজা ঝিম মেরে বসে আছে। হেমলতা সবসময় পদ্মজাকে বলতেন, মেট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন পেতে হবে। পদ্মজার একবার মনে হচ্ছে সে ফার্স্ট ডিভিশন পাবে, আরেকবার মনে হচ্ছে সেকেন্ড ডিভিশনে চলে যাবে! সে এক হাতের আঙুল দিয়ে অন্য হাতের তালু চুলকাচ্ছে। এই মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে মাকে, কতদিন হলো দেখা হয় না। প্রথম প্রথম মায়ের জন্য প্রায় কাঁদত সে। এখন অবশ্য মানিয়ে নিয়েছে।

আছরের আজান পড়ছে। এখনও ফেরেনি আমির। পদ্মজা নামাজ পড়তে চলে গেল। নামাজ পড়ে এসে দাঁড়াল বারান্দায়। এরপর যা দেখল, খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ল। আমিরের সঙ্গে হেমলতা, পূৰ্ণা এসেছে। দুজনের পরনে কালো বোরখা। তিনজন আলগ ঘর পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে আসছে। মাথার ওপর কড়া রোদ নিয়ে মরুভূমিতে সারাদিন হাঁটার পর পথিক তৃষ্ণার্ত হয়ে পানির দেখা পেলে যেমন আনন্দ হয়, ঠিক তেমন আনন্দ হচ্ছে পদ্মজার। ইচ্ছে হচ্ছে দুই তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে নেমে যেতে। কিন্তু তা তো সম্ভব নয়। পদ্মজা উন্মাদের মতো দৌড়াতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় উলটে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো, কিন্তু দৌড় থামল না। সদর ঘরের সবাইকে তোয়াক্কা না করে বাড়ির বউ ছুটে বেরিয়ে যায়। হেমলতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার নয়নের মণি ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকের ওপর। পদ্মজার ছোঁয়ায় চারিদিকে যেন বসন্ত শুরু হয়। পূর্ণা পদ্মজাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে ফোঁপাতে থাকল। হেমলতার বুকে মাথা রেখে পূর্ণাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো হয়ে পদ্মজা বলল, ‘এতদিনে তোমাদের আমার কথা মনে পড়ল? এভাবে পর করে দিলে, আম্মা? আর পূর্ণা, তুই তো আসতে পারিস। বোনকে মনে পড়ে না?

শাড়ির আঁচল টেনে পদ্মজার মাথার চুল ঢেকে দিলেন হেমলতা। বললেন, ‘মেয়ের শ্বশুরবাড়ি আসা কী এতই সোজা?’

‘তাহলে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর কী দরকার? যদি মা-বাবা সহজে না আসতে পারে!’

‘আপা…আমার তোমাকে খুব মনে পড়ে।’ পূর্ণা বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। পদ্মজা পূর্ণার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ‘আমারও মনে পড়ে।’ হেমলতা পদ্মজার চোখের জল মুছে দিয়ে উচ্ছ্বাস নিয়ে বললেন, ‘সাতশো পঞ্চাশ মার্ক পেয়েছিস। স্টার মার্ক। ফার্স্ট ডিভিশন। এই খুশিতে আর কাঁদিস না।’

পদ্মজার চোখে জল। গাল, ঠোঁট চোখের জলে ভেজা। এমতাবস্থায় সে হাসল। তাকে মায়াবী ভোরের শিশিরের মতো দেখাচ্ছে। হেমলতা অন্দরমহলের সদর দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেন, হাওলাদার বাড়ির বাকিরা তাকিয়ে আছে। তিনি পদ্মজাকে সরিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যান। ফরিনা বেগমের মুখ দেখে পদ্মজার ভয় হচ্ছে। উনার মুখ আগে আগে ছোটে। আম্মাকে কিছু বলবেন না তো?

হেমলতা সবাইকে সালাম দিয়ে বললেন, ‘আমির ধরে নিয়ে এলো।’

মজিদ হাওলাদার বিনীত স্বরে বললেন, ‘এই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছেন। আগে জানলে, গরু জবাই করে রাখতাম।’

হেমলতা হাসলেন, ‘বলেছেন, এই অনেক।’

‘বললেই হবে না। করতে হবে। কয়দিন কিন্তু থেকে যাবেন।’

‘এটা বলবেন না। আজই ফিরতে হবে আমার। কিছুক্ষণ থেকেই চলে যাব।’

‘প্রথম বার আসলেন আর কিছুক্ষণ থেকেই চলে যাবেন?

‘আবার আসব। অনেকদিন থেকে যাব।’

‘আজকের রাতটা থেকে যান।’

‘আম্মা, আজ আমার সঙ্গে থেকে যাও।’ পদ্মজা অনুরোধ করে বলল। হেমলতা হেসে সম্মতি দিলেন। ফরিনা কিছু বলছেন না। ভ্রুকুটি করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হেমলতাকে ভেতরে ভেতরে ভয় পান। কেমন ধারাল চোখের দৃষ্টি, যেন একবার তাকিয়েই ভেতরের সব দেখে ফেলতে পারে। আর চোখমুখের ভাব দেখলে মনে হয়, কোন দেশের রাজরানি! তার উপর আমির দরদ দেখিয়ে শাশুড়ি নিয়ে এসেছে। ফরিনা বিরক্ত হচ্ছেন। হেমলতা ফরিনার দিকে তাকাতেই ফরিনা চোখ সরিয়ে নিলেন। হেমলতা ফরিনাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপা, কথা বলছেন না যে? আমার উপস্থিতি বিরক্ত করেছে খুব?’

হেমলতার কথার ফরিনাসহ উপস্থিত সবাই অস্বস্তিতে পড়ে যায়। ফরিনা হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, ‘কী বলছেন, আপা? বিরক্ত হইতাম কেরে? এই পরথম আইছেন। খুশিই হইছি।’

‘তাই বলুন।’

‘দরজায় দাঁড়ায়া গপ আর কতক্ষণ হইব? ঘরে আহেন।’ ফরিনা দ্রুত সটকে পড়েন। সদর ঘরে আগে আগে হেঁটে চলে যান। তিনি হাঁপাচ্ছেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘মহিলা এত্ত চালাক! সত্যি সত্যি সব বুইঝা ফেলে।’

হেমলতা সবার আড়ালে শাড়ির আঁচল মুখে চেপে সেকেন্ড দুয়েক হাসলেন। হেমলতাকে হাসতে দেখে, পদ্মজাও হাসল। সবাই সদর ঘরে এসে বসে। লাবণ্য ও পদ্মজার ফলাফল দেওয়ার উপলক্ষে শিরিন, শাহানাকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। তারা এখন হাওলাদার বাড়িতেই আছে। দুই বোন নাস্তা তৈরি করতে রান্নাঘরে গেল। লাবণ্য দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে আছে। আমির এখনও লাবণ্যর ফলাফল কাউকে বলেনি। সে সদর ঘর থেকে লাবণ্যকে ডাকল, ‘লাবণ্য? এই লাবণ্য? শুনছিস? এদিকে আয়। আজ তোর খবর আছে।’

আমিরের কথা শুনে লাবণ্যর বুকের ধুকপুকানি থেমে যায়। এখুনি নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে অবস্থা। নিশ্চিত ফেল করেছে! লাবণ্য চিত হয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, কখন সে মারা যাবে। আমির আবার ডাকল, ‘বেরিয়ে আয় বলছি। নয়তো দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকব। তখন কিন্তু গায়ে মার বেশি পড়বে।’

লাবণ্য তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামে। গায়ের ওড়না ঠিক করে সদর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে নামাজের সব সুরা পড়তে থাকে।

আমির চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াতেই লাবণ্য কেঁপে উঠল। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল ‘আগামী বছর মেট্রিকে পাশ করাম। আল্লাহর কসম কইরা কইতেছি

‘এই বছরই তো পাশ করেছিস! তাহলে আগামী বছর আবার মেট্রিক দিবি কেন?’

লাবণ্য চকিতে তাকাল। তার মুখটা হাঁ হয়ে যায়। লাবণ্যর মুখের ভঙ্গি দেখে সবাই হাসল। লাবণ্য খুশিতে কেঁদে দিল। আমির লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আরেকটুর জন্য ফেল করিসনি।’

লাবণ্য হাসতে হাসতে কাঁদছে। লাবণ্যর পাগলামি দেখে আমিরও হাসছে। তখন সদর ঘরে প্রবেশ করল রিদওয়ান হাওলাদার। হেমলতা রিদওয়ানের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকান। হেমলতার চোখে চোখ পড়তেই রিদওয়ান বিব্রত হয়ে উঠল, সরিয়ে নিলো চোখ। একটু পর আড়চোখে তাকিয়ে দেখে,

দেখে, হেমলতা তখনো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছেন। রিদওয়ান ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

এ যেন সাপুড়ে ও সাপের খেলা!

৪৩

নৈশভোজ শেষ হয়েছে মাত্র। পদ্মজা ও লাবণ্যকে পেয়ে পুলকিত পূর্ণা। আনন্দ বয়ে যাচ্ছে মনে। একটু পর পর উচ্চস্বরে হাসছে। হেমলতা একবার ভাবলেন, মেয়েকে এত জোরে হাসতে নিষেধ করবেন। পরমুহূর্তে কী ভেবে আর করলেন না। তিনি নিজেও বাড়ির বড়োদের সঙ্গে প্রফুল্লচিত্তে কথা বলছেন।

আমির সবার মনোযোগ পাওয়ার জন্য বলল, ‘আমার একটা কথা ছিল।’

সবাই আমিরের দিকে তাকাল। আমির নির্দ্বিধায় বলল, ‘ আমি আগামীকাল ফিরব।’

হেমলতা বললেন, ‘ঢাকায়?’

‘জি। পদ্মজাকে নিয়ে যাব। সঙ্গে লাবণ্যও যাবে। দুজনকে কলেজে ভর্তি করে দেব।’

পূর্ণার পাশ থেকে উঠে আমিরের পাশে দাঁড়াল লাবণ্য। আবদার করে বলল, ‘দাভাই, তুমি কইছিলা পাশ করলে আমারে দেশের বাইরে পড়তে পাঠাইবা।’

‘ছেড়ি মানুষ বাইরে যাইতি কেন? কইলজাডা বড়ো হইয়া গেছে?’ রেগে বললেন ফরিনা।

লাবণ্য মায়ের কথা অগ্রাহ্য করে আমিরকে বলল, ‘কথা রাখতে হইব তোমার।’

আমিরে একবার মজিদকে দেখল। এরপর লাবণ্যকে বলল, ‘সত্যি যেতে চাস?’

‘হ।’

লাবণ্যর মাথায় গাট্টা মারল ‘আমির। বলল, ‘আগে শুদ্ধ ভাষাটা শিখ। এরপর দেশের বাইরে পড়তে যাবি।’

লাবণ্য আহ্লাদিত হয়ে বলল, ‘পদ্মজা শিখায়া দিব। এইডা কোনো ব্যাপার না, দাভাই।’

‘আপাতত ঢাকা চল। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে অভ্যস্ত হ। এরপর সত্যি পাঠাব।’

‘তুই পাগল হইয়া গেছস, বাবু? এই ছেড়িরে একা বাইরে পাড়াইয়া দিবি?’

‘জাফর ভাই আছে, ভাবি আছে। সমস্যা নেই, আম্মা। একটাই তো বোন। নিজের মতো পড়াশোনা করুক।’

ফরিনা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলেন। মেয়েমানুষ…এখন বিয়ে দেয়ার সময়, কিন্তু সবাই পড়াতে চাচ্ছে। এখন নাকি আবার বিলেতে পাঠাবে! মজিদ কথা বলছেন না। মানে তিনিও আমিরের দলে। তাহলে আর কথা বলে কী হবে? এই সংসারে এমনিতেও তার দাম নেই। নিজের মতোই বকবক করে যান, কেউই তার কথা শোনে না। ফরিনা রাগ করে বললেন, ‘তোদের যা ইচ্ছে কর।’ বলেই চলে যান।

হেমলতা বললেন, ‘কালই চলে যেতে হবে? দুই-তিন দিন পর হলে হবে না?’

আমির নম্র কণ্ঠে বলল, ‘না, আম্মা। আমি আট বছর হলো ঢাকা গিয়েছি। এর মধ্যে এই প্রথম তিন মাসের ওপর গ্রামে থেকেছি। ব্যাবসা ফেলে এসেছি। আমার অনুপস্থিতিতে আলমগীর ভাইয়া সামলাচ্ছে। এখন তো ভাইয়াও চলে এসেছে। আর আমার ব্যাবসা আমারই সামলানো উচিত। যত দ্রুত সম্ভব যেতে চাই। আপত্তি করবেন না।’

হেমলতা পদ্মজার দিকে চেয়ে বললেন, ‘তাহলে আগামীকালই যাচ্ছো?’

‘জি। আব্বা, আম্মাকে তো অনেক আগেই বলেছি। পদ্মজাও জানে। কিন্তু পদ্ম ভাবেনি সত্যি সত্যি যাব। দেখুন, কেমন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কাল চলে যাব বলেই আজ আপনাকে নিয়ে এসেছি। আজ রাতটা মেয়ের সঙ্গে থাকুন। আবার কবে না কবে দেখা হয়!’

হেমলতা বেশ অনেকক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার কীসের ব্যাবসা আজও জানলাম না।’

মজিদ অবাক হয়ে বললেন, ‘আত্মীয় হলেন এতদিন এখনও জানেন না মেয়ের জামাই কীসের ব্যাবসা করে! বাবু, এটা তো বলা উচিত ছিল?’

‘আমি তো ভেবেছি জানেন হয়তো। তাই বলিনি। আম্মা, আমাদের এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের বিজনেস। মানে মালামাল বিভিন্ন দেশে আমদানি- রপ্তানি করে থাকি। এ কাজে আব্বা, রিদওয়ান, ভাইয়া, চাচা আছে। তাছাড়া, অনুন্নত দেশগুলো থেকে কম দামে পণ্য এনে উন্নত দেশগুলোতে বেশি মূল্যে বিক্রি করি। সব পণ্য গোডাউনে রাখা হয়। আমাদের অফিসও আছে। গোডাউন আর অফিসের সব কাজ আমাকে সামলাতে হয়। বলতে পারেন, আমারই সব ‘

‘অনেক বড়ো ব্যাপার।’ হাসলেন হেমলতা। তিনি জানতেন না আমির এতটা বিত্তশালী। এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট বিজনেস কম কথা নয়। এ সম্পর্কে মোটামুটি তিনি জানেন। কলেজ থাকাকালীন অনেক ব্যাবসা সম্পর্কেই জেনেছেন।

পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে পূর্ণা।

পদ্মজা বলল, ‘কথা বলছিস না কেন?’

‘কাল চলে যাবা, আপা?’

‘তাই তো কথা হচ্ছে।’

‘আমার খুব মনে পড়ে তোমাকে।’

‘কাঁদছিস কেন? আসব তো আমি।’

‘সে তো অনেক মাস পর পর।’ পূর্ণার গলা কাঁপছে

পদ্মজা কিছু বলতে পারল না। আমির ও মজিদের সঙ্গে কথা বলছেন হেমলতা। খলিল, আলমগীর নীরব দর্শক হয়ে বসে আছে। বিকেল থেকে রিদওয়ানের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মজা হেমলতার উপর চোখ রেখে পূর্ণাকে প্রশ্ন করল, ‘আম্মা খুব শুকিয়েছে। খাওয়াদাওয়া করে না?’

‘না। মাঝে মাঝে সারাদিন পার হয়ে যায় তবুও খায় না।’

‘জোর করে খাওয়াতে পারিস না?’

‘জোর করলে ধমক দেয়। আমাদের কথা শুনে না।’

‘আম্মা ঘাড়ত্যাড়া।’

‘ঠিক বলেছ।’

‘পূর্ণা, উনি কেমন? আম্মার সঙ্গে ঝগড়া করে?

‘উনিটা কে?’

‘আব্বার প্রথম বউ।’

‘তুমি তো দেখতেও যাওনি।’

শ্বশুরবাড়ি থেকে চাইলেই যাওয়া যায় না। বল না, কেমন? আদর করে তোদের?’

‘ভালো খুব। সহজ-সরল। আম্মাকে খুব মানে। প্রেমা-প্রান্তকে অনেক আদর করে। দেখতেও খুব সুন্দর। আগে সাপুড়ের বউদের মতো সাজত। আমার পছন্দ না বলে এখন আর সাজে না।’

‘তুই নাকি খুব খারাপ ব্যবহার করিস?’

‘এখন করি না। তুমি কাকে দিয়ে এত খোঁজ রাখো?’

‘সে তোর জানতে হবে না। তাহলে উনি ভালো তাই তো?’

‘হুম।’

‘তাহলে মিলেমিশে থাকিস।’

‘ঢাকা যাওয়ার আগে দেখে যাও একবার।’

‘বাপের প্রথম বউকে আমার দেখার ইচ্ছে নেই।’ পদ্মজা থমথমে স্বরে বলল।

পূর্ণা বলল, ‘আচ্ছা। আমি আজ তোমার সঙ্গে ঘুমাব।’

‘হু, ঘুমাবি। আম্মার খেয়াল রাখবি। আম্মাকে দেখে মনে হচ্ছে, কোনো বিষয় নিয়ে খুব চিন্তা করে। তুই কথা বলবি, সময় দিবি। আম্মাকে একা ছাড়বি না।’

‘আমি তোমার মতো সব সামলাতে পারি না।’

‘চেষ্টা করবি। আব্বা আর প্রেমা-প্রান্তকে নিয়ে আসতে ভোরে মগা ভাইয়াকে পাঠাব। সবাইকে চোখের দেখা দেখে যাব।’

পূর্ণা পদ্মজাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। কত দূরে চলে যাবে আপা! পদ্মজা অনুভব করে পূর্ণার ভেতরের আর্তনাদ। সে পূর্ণার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘খুব দ্রুত আসব।’

পদ্মজা মাঝে শুয়েছে। তার দুই পাশে হেমলতা আর পূর্ণা। পূর্ণা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাকে। আর পদ্মজা শক্ত করে ধরে রেখেছে মায়ের এক হাত। হেমলতা নীরবতা ভেঙে পদ্মজাকে বললেন, ‘পদ্ম?’

‘হু, আম্মা?’

‘শহরে নিজেকে মানিয়ে নিবি। শক্ত হয়ে থাকবি। আর মনে রাখবি, কেউ কারোর না। সবাই একা। সবসময় নিজের ওপর বিশ্বাস রাখবি, নিজের ওপর আস্থা রাখবি। সৎ পথে থাকবি। কখনো কারো ওপর নির্ভরশীল হবি না। যদি তুই অন্য কারো ওপর নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব দিয়ে দিস, কখনো ভালো থাকবি না। নিজের ভালো থাকার দায়িত্ব নিজেরই নিতে হয়। নিজেকে কখনো একা ভাববি না। যেখানেই থাকি আমি, আমার প্রতিটা কথা তোর সঙ্গে মিশে থাকবে। ছায়া হয়ে থাকবে। আল্লাহ সবাইকে কোনো না কোনো উদেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। সেই উদ্দেশ্য সফল হলে আর বেঁচে থাকার মানে থাকে না। মৃত্যুতে ঢলে পড়ে। আমার ইদানীং মনে হয়, আমার দায়িত্ব ছিল তোকে জন্ম দেয়া, বড়ো করে তুলে বিয়ে দেয়া। সেই দায়িত্ব কতটুকু রাখতে পেরেছি জানি না। কিন্তু তোর দায়িত্ব অনেক বড়ো কিছু!’

পদ্মজা চাপা স্বরে বলল, ‘কী সেটা?’

‘জানি না।’

‘তুমি এত কী ভাবো, আম্মা? মুখটা এরকম ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে কেন? খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করবে। আমি পরেরবার এসে যেন দেখি মোটা হয়েছো।’

হেমলতা হাসলেন। তার সাদা ধবধবে দাঁত ঝিলিক দেয়। তিনি পদ্মজাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘পরেরবার যখন আসবি একদম অন্য রকম দেখবি।’

‘কথা দিচ্ছো?’

‘দিচ্ছি।’

পদ্মজা হাসল। পূর্ণা বলল, ‘আমাকে জড়িয়ে ধরো, আপা।’

পদ্মজা পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে। হেমলতা দুই মেয়েকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘অনেক রাত হয়েছে, এবার চুপচাপ ঘুমা দুজন। আর কোনো কথা না।’

.

মাঝরাতে হেমলতার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি চোখ খুলে কান খাড়া করে শুনতে পেলেন, দরজার বাইরে কেউ হাঁটছে। গা থেকে কাঁথা সরিয়ে ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লেন। পায়ের শব্দটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে গিয়ে সাদা পাঞ্জাবি পরা একটা পুরুষ অবয়ব দেখতে পান।

তিনি তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকলেন, ‘রিদওয়ান?’

রিদওয়ান কেঁপে উঠে পেছনে ফিরল। বড়ো বড়ো হয়ে গেল তার চোখ দুটি। সে যে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

হেমলতা প্রশ্ন করলেন, ‘এত রাতে এখানে কী করছো?’

‘জ…জি হাঁটছিলাম।’

‘এত রাতে?’

‘প্রায়ই হাঁটি। অন্যদের জিজ্ঞাসা করতে পারেন।’

হেমলতা রিদওয়ানকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করে নিয়ে বললেন, ‘কোনোভাবে আমাকে খুন করতে এসেছো কী?’

রিদওয়ান থতমত খেয়ে গেল। বলল, ‘ন…না না! আপনাকে কেন খ…খুন করতে যাব? কী বলছেন!

‘প্রমাণ সরাতে।’ হেমলতার সহজ উক্তি।

রিদওয়ান হঠাৎই অন্যরকম স্বরে কথা বলল, ‘সে তো আমিও একজন প্রমাণ। স্বচক্ষে দেখা জ্বলজ্বলন্ত প্রমাণ। আপনি আমাকেও খুন করে প্রমাণ সরাতে পারেন। যেহেতু দুজনই একই পথের। কাউকে কারোর খুন করার প্রয়োজন নেই। আমি এখানে অন্য কাজে এসেছি।

হেমলতা কঠিন চোখে তাকালেন। পরপরই চোখ শীতল করে নিয়ে বললেন, ‘শুভ রাত্রি।’

রিদওয়ান হেসে হেলে-দুলে হেঁটে চলে গেল। হেমলতা ঘরে ঢোকার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন। কিন্তু কদম ফেলার পূর্বেই পড়ে গেলেন শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে। ভাগ্যিস আওয়াজ হয়নি! তিনি হাতে ভর দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলেন। বাঁ-হাতের মাংস পেশি শক্ত হয়ে আছে। হাত নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। ভর দিয়ে ওঠা আরো কষ্টদায়ক। তিনি ওভাবেই বসে থাকলেন অনেকক্ষণ।

৪৪

প্রতিদিনের মতো পাখিদের কলতানে পদ্মজার ঘুম ভাঙল। জানালার ফাঁক গলে আসা দিনের আলো বিছানায় লুটোপুটি খাচ্ছে। সে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। অন্যদিন ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে। আজ দেরি হয়ে গেল!

‘পূর্ণাকে তুলে নিয়ে যা। একসঙ্গে অজু করে নামাজ পড়তে বস।’

হেমলতার কণ্ঠ শুনে পদ্মজা ঘুরে তাকাল। তিনি কোরআন শরীফ পূর্বের জায়গায় রেখে বললেন, ‘পূর্ণাকে একটু বুঝাস, নামাজ পড়তে চায় না।’

‘আচ্ছা, আম্মা।’

পদ্মজা পূর্ণাকে ডেকে নিয়ে কলপাড়ে যায়। এরপর দুই বোন একসঙ্গে জায়নামাজে দাঁড়াল। নামাজ শেষ করে হেমলতার সামনে এসে দাঁড়াল পদ্মজা। হেমলতা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজা হেমলতার চোখ দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, ‘আম্মা, তোমার চোখ এমন লাল হলো কেন?’

হেমলতা দুই চোখে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘রাতে ঘুমাইনি তাই।’

 পুনরায় পদ্মজার উৎকণ্ঠা, ‘কেন? কেন ঘুম হয়নি? কেমন দেখাচ্ছে তোমাকে! বিছানায় পড়াটাই শুধু বাকি।’

কিছু চুল পদ্মজার মুখের ওপর চলে এসেছে। হেমলতা তা কানে গুঁজে দিয়ে আদরমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘আজ আমার মেয়ে চলে যাবে। তাই আমি সারারাত জেগে আমার আদরের মেয়েকে দেখেছি।

হেমলতার কথা শুনে পদ্মজা আবেগী হয়ে উঠে। হেমলতাকে জড়িয়ে ধরে কান্নামাখা কণ্ঠে বলল, ‘আমার খুব মনে পড়ে তোমাকে। চলো আমার সঙ্গে। একসঙ্গে থাকব। তোমার না ইচ্ছে ছিল, আমাকে নিয়ে শহরে থাকার।

‘পাগল হয়ে গেছিস! মেয়ের জামাইর বাড়িতে কেউ গিয়ে থাকে? দুই- তিন দিন হলে যেমন তেমন।’

হেমলতার শরীরের উষ্ণতা পদ্মজাকে ওম দিচ্ছে। মায়ের উষ্ণতায় কী অদ্ভুত শান্তি! পদ্মজা কান্না করে দিল। হেমলতা পদ্মজার মুখ তুলে বললেন, ‘সকাল সকাল কেউ কাঁদে? বাড়ির বউ তুই, শাশুড়ি কী করছে আগে দেখে আয়, যা।’

পদ্মজা আরো কাঁদতে থাকল। কাঁদতে কাঁদতে যতবার চোখের জল মোছে ততবারই আবার ভিজে যাচ্ছে। বুকটা হাহাকার করছে। মা-বাবা- বোনদের রেখে কত দূরে চলে যাবে সে!

কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল পদ্মজা। পেছন থেকে শোনা গেল হেমলতা কথা, ‘বাচ্চাদের মতো করছিস কিন্তু।’

পদ্মজা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিলো। ঢোক গিলে নিজেকে শক্ত করে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। পদ্মজা ঘর ছাড়তেই হেমলতার চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তিনি দ্রুত জল মুছে নিলেন। পালঙ্কের দিকে চেয়ে দেখেন, পূর্ণা চিত হয়ে ঘুমাচ্ছে। এ বাবা! এ মেয়ে কখন ঘুমাল? হাসি পেল হেমলতার। তিনি কাঁথা দিয়ে পূর্ণাকে ঢেকে দিলেন।

পদ্মজা রান্নাঘরে ঢুকতেই ফরিনা মুখ ঝামটালেন, ‘আইছো ক্যান? যাও ঘুমাও গিয়া।

‘কখন এত দেরি হয়ে গেল বুঝিনি।’ মিনমিন করে বলল পদ্মজা।

‘বুঝবা কেন? মা আইছে তো। হউরির লগে তো আর মায়ের মতো মিশতে মন চায় না।’

পদ্মজা অবাক হয়ে তাকাল। আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি তো মিশতেই চাই। আপনি সবসময় রেগে থাকেন।’

মুখের উপরে কথা কইবা না। যাও এহন।’

পদ্মজা ঘুরে দাঁড়াল চলে যাওয়ার জন্য। ফরিনা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, ‘কইতেই যাইবাগা নাকি? জোর কইরা তো কাম করা উচিত। এই বুদ্ধিডা নাই?’

পদ্মজা স্তব্ধ হয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিদিন সে কাজ করার জন্য জোরাজুরি করে, কিন্তু ফরিনা করতে দেন না। এজন্যই সে এক কথায় চলে যাচ্ছিল। আর এখন কী বলছেন! সে ব্যাপারটা হজম করে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল। ফরিনা গলার স্বর পূর্বের অবস্থানে রেখেই বললেন, ‘হইছে, কাম করতে হইব না। এরপর তোমার মায়ে কইবো দিনরাত কাম করাই তার ছেড়িরে। যাও। বারায়া যাও।’

পদ্মজা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লতিফা ঠোঁট চেপে হাসছে। ফরিনার এমন ব্যবহারের সঙ্গে সে অভ্যস্ত।

বেশ অনেকক্ষণ পর পদ্মজা বলল, ‘আম্মা, আমি করবটা কী?’

পদ্মজা মাথা থেকে ঘোমটা সরে গেছে। মুখটা দেখার মতো হয়েছে। ফরিনা পদ্মজার মুখ দেখে হেসে ফেললেন, দ্রুত হাসি লুকিয়েও ফেললেন। এই মেয়েটাকে তিনি অনেক আগেই ভালোবেসে ফেলেছেন। এত শান্ত, এত নম্র-ভদ্র মেয়ে দুটো দেখেননি। হেমলতাকে হিংসে হয়…হেমলতার গর্ভকে হিংসে হয়! পদ্মজার ঢাকা যাওয়া নিয়ে প্রথম প্রথম ঘোর আপত্তি ছিল ফরিনার। কিন্তু এখন নেই। ওপর থেকে যাই বলুন না কেন, তিনি মনে মনে চান পদ্মজা পড়তে যাক। অনেক পড়ুক, অনেক বেশি পড়ুক। এই মেয়ের জন্ম রান্নাঘরে রাঁধার জন্য নয়, রানির আসনে থাকার জন্য। পদ্মজা ফরিনার দুই সেকেন্ডের মৃদু হাসি খেয়াল করেছে। সে সাহস পেল। ফরিনার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।

ফরিনা চোখ-মুখ কুঁচকে প্রশ্ন করলেন, ‘ঘেঁষতাছো কেন?’

পদ্মজা শিমুল তুলোর ন্যায় নরম স্বরে বলল, ‘আমার খুব মনে পড়বে আপনাকে, আপনার বকাগুলোকে। আপনি খুব ভালো।’

ফরিনা তরকারিতে মশলা দিচ্ছিলেন। পদ্মজার কথা শুনে হাত থেমে যায়। পদ্মজার দিকে তাকান। পদ্মজা বলল, ‘আমি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরব, আম্মা?’

ফরিনা কিছু বলতে পারলেন না। এই মেয়েটা এত ভালো কেন? তিনি পদ্মজার চোখের দিকে তাকাতেই অনুভব করলেন, কয়েক বছরের লুকোনো ক্ষত জ্বলে উঠছে। ক্ষতরা পদ্মজার সামনে উন্মোচন হতে চাইছে। কোনোভাবে কী যন্ত্রণাদায়ক এই ক্ষত সারাতে পারবে পদ্মজা? ভরসা করা যায়? পদ্মজার মায়ামাখা দুটি চোখ দেখে বুকে এমন তোলপাড় শুরু হলো কেন? বত্রিশ বছর আগের সেই কালো রাত্রির কথা কেন মনে পড়ে গেল? যে কালো রাত্রির জন্য আজও এই সংসার, এই বাড়িকে তিনি আপন ভাবতে পারেন না। প্রতিটি মানুষের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেন। সেই যন্ত্রণা কেন বুক খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে?

উত্তরের আশায় না থেকে পদ্মজা জড়িয়ে ধরল ফরিনাকে। ফরিনা মৃদু কেঁপে উঠলেন। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। পদ্মজা ফরিনার বুকে মাথা রাখতেই টের পেল, ফরিনার বুক ধুকধুক করছে।

.

হাওলাদার বাড়ি থেকে ডানে, দুই মিনিট হাঁটার পর ঝাওড়া নামের একটি খালের দেখা পাওয়া যায়। খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে হাওলাদার বাড়ির সবাই। ট্রলার নিয়ে মাঝি অপেক্ষা করছে। ট্রলারটি হাওলাদার বাড়ির। পদ্মজার পরনে কালো বোরকা। লাবণ্য যাবে না। সকাল থেকে তার ডায়রিয়া শুরু হয়েছে। তিন-চার দিন পর আলমগীর ঢাকা নিয়ে যাবে। আজ আমির আর পদ্মজা যাচ্ছে। প্রেমা, প্রান্ত, মোর্শেদ, বাসন্তী সবাই সকালেই এসেছে। সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। পূর্ণা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। হেমলতা পদ্মজার দুই হাত মুঠোয় নিয়ে চুমু দিয়ে বললেন, ‘ঠিক মতো পড়বি, খাবি। স্বামীর খেয়াল রাখবি। কাঁদবি না কিন্তু। একদম কাঁদবি না।’

তুমি কাঁদছো কেন, আম্মা?’

‘না, না, কাঁদছি না,’ বলেও হেমলতা কেঁদে ফেললেন। পদ্মজার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। বোরকা ভিজে একাকার। একদিকে মা অন্যদিকে তিন ভাই-বোন কেঁদেই চলেছে। হেমলতা নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন, পারছেন না। পদ্মজা বলল, ‘আর কেঁদো না, আম্মা। তুমি অসুস্থ।’

হেমলতা কান্না আটকাতে ঢোক গিলেন। বললেন, ‘কাঁদব না। সাবধানে যাবি। দেরি হচ্ছে তো। আমির, নিয়ে যাও আমার মেয়েকে। যা, মা, সাবধানে যাবি। নিয়মিত নামাজ পড়বি।’

পদ্মজা হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। পদ্মজার দেখাদেখি আমিরও করল। বাড়ির সব গুরুজনদের সালাম করে ট্রলারে পা রাখতেই হেমলতার কণ্ঠে উচ্চারিত শব্দমালা ভেসে আসে, ‘আমার প্রতিটা কথা মনে রাখবি। কখনো ভুলবি না। আমার মেয়ে যেন অন্য সবার চেয়ে গুণেও আলাদা হয়। শিক্ষায় কালি যেন না লাগে।’

পদ্মজা ফিরে চেয়ে বলল, ‘ভুলব না, আম্মা। কখনো না। তুমি চোখের জল মোছ। আমাদের আবার দেখা হবে।’

হেমলতা তৃতীয় বারের মতো চোখের জল মুছে হাত নেড়ে বিদায় জানান। ট্রলারের ইঞ্জিন চালু হয়।

মা-মেয়ে একে অপরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

দুজনের চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় বর্ষণ হচ্ছে।

.

কাঁদছেন মোর্শেদ। তবে পদ্মজার জন্য কম, হেমলতার জন্য বেশি। হেমলতার দিনগুলো এখন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। কাঁদছেন ফরিনাও। প্রতিদিন বাড়িজুড়ে একটা সুন্দর মুখ, সুন্দর মনের জীবন্ত পুতুল মাথায় ঘোমটা দিয়ে আর হেঁটে বেড়াবে না। আবারও মরে যাবে তার দিনগুলো। হারিয়ে যাবে সাদা-কালোর ভিড়ে।

মাদিনী নদীর ঠান্ডা আর্দ্রতা বাতাসে মিশে ছুঁয়ে দিচ্ছে পদ্মজার মুখ। চোখের জল শুকাতে শুকাতে আবার ভিজে যাচ্ছে। আমির পদ্মজার কোমর এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এবার তো থামো।’

আমিরের আলতো ছোঁয়ায় পদ্মজা আরো আবেগী হয়ে উঠল। আমির বলল, ‘এ তো আরো বেড়ে গেছে! থামো না। আমি আছি তো। আমরা ছয় মাস পর পর আসব। অনেকদিন থেকে যাব।’

‘সত্যি তো? কাজের বাহানা দেখাবেন না?’

‘মোটেও না।’ আমির পদ্মজার চোখের জল মুছে দিল। চোখের পাতায় চুমু খেল। পদ্মজা নুয়ে যায়। বলল, ‘নদীর পাড় থেকে কেউ দেখবে।

‘কেউ দেখবে, কেউ দেখবে, কেউ দেখবে! এই কথাটা ছাড়া আর কোনো কথা পারে আমার বউ?’

পদ্মজা আমিরের দিকে একবার তাকাল। চোখের দৃষ্টি সরিয়ে বলল, ‘আমরা ট্রলার দিয়ে ঢাকা যাব?’

‘সেটা সম্ভব না। কিছুক্ষণ পরই ট্রেনে উঠে যাব। ‘

আমির পদ্মজার গাল ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়াতেই, আমিরকে হতবাক করে দিয়ে পদ্মজা ট্রলারের ভেতর ঢুকে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *