পদ্মজা – ৩৫

৩৫

বাইরে বিকেলের সোনালি রোদ, মন মাতানো বাতাস। লম্বা বারান্দা পেরিয়ে নুরজাহানের ঘরের দিকে যাচ্ছে পদ্মজা। বাতাসের দমকায় সামনের কিছু চুল অবাধ্য হয়ে উড়ছে। এতে সে খুব বিরক্ত বোধ করছে। তার এক হাতে দই অন্য হাতে পিঠা। চুল সরাতেও পারছে না। তখন কোথেকে উড়ে এলো আমির। এক আঙুলে উড়ন্ত চুলগুলো পদ্মজার কানে গুঁজে দিয়ে আবার উড়ে চলে গেল। চমৎকার করে হাসল পদ্মজা। আমিরের চলে যাওয়া দেখে মনে মনে বলল, ‘কী চমৎকার মানুষ আপনি!’

নুরজাহানের ঘরের সামনে এসে দেখে, দরজা ভেজানো। পদ্মজা অনুমতি না নিয়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই এক বিস্ময়কর দৃশ্য দেখে তার চোখের আকৃতি গোল গোল হয়ে যায়। পালঙ্কে ভুরি ভুরি সোনার অলংকার জ্বলজ্বল করছে। চোখ ধাঁধানো দৃশ্য! পদ্মজাকে দেখে নুরজাহান অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। তা পদ্মজার দৃষ্টিগোচর হলো। নুরজাহান ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠেন, ‘তুমি এইনে কেরে আইছো? আমি কইছি আইতে?’

নুরজাহানের ধমকে থতমত খেয়ে গেল পদ্মজা। বিচলিত ভঙ্গিতে দইয়ের মগ, পিঠার থালা টেবিলের উপর রেখে বলল, ‘আম্মা বললেন দই, পিঠা দিয়ে যেতে।’

‘তোমার হউরি কইলেই হইব? আমি কইছি? আমারে না কইয়া আমার ঘরে আওন মানা হেইডা তোমার হউরি জানে না?’

‘মাফ করবেন।’ মাথা নত করে বলল পদ্মজা।

‘যাও, বাড়াইয়া যাও।’

পদ্মজা চঞ্চল পায়ে বেরিয়ে গেল। দরজার বাইরে এসে থমকে দাঁড়াল। সে ভাবছে, ছোটো কারণে এত ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া কেন দেখালেন তিনি? মাথায় ঢুকছে না।

পদ্মজা আনমনে হেঁটে নিজের ঘরে চলে আসে। এই বাড়িতে আসার পর থেকে কী কী হয়েছে সব ভাবছে। প্রথম রাতে কেউ একজন তার ঘরে এসেছিল, নোংরা স্পর্শ করেছে। সেটা যে আমির নয় সে শতভাগ নিশ্চিত 1 এরপর ভোরে রানিকে দেখল চোরের মতো বাড়ির পেছনের জঙ্গলে ঢুকতে। রুম্পা ভাবির সঙ্গে দেখা হলো, তিনি শুরুতে স্বাভাবিক ছিলেন। শেষে গিয়ে পাগলামি শুরু করলেন। দরজার ওপাশে কেউ ছিল। পদ্মজা ভ্রুকুটি করে মুখে ‘চ’ কারান্ত শব্দ করল। সব ঝাপসা লাগছে।

ফরিনা বলেছিলেন দই-পিঠা দিয়েই রান্নাঘরে যেতে। পদ্মজা বেমালুম সে কথা ভুলে গিয়েছে। যখন মনে পড়ল কেটে গিয়েছে অনেকটা সময়। সে দ্রুত আঁচল টেনে মাথা ঘুরে ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে। এসে দেখে ফরিনা ও আমিনা মাছ কাটছেন। পদ্মজা পা টিপে টিপে রান্নাঘরে ঢুকে। ভয়ে বুক কাঁপছে। কখন না কঠিন কথা শোনানো শুরু করে দেন।

‘অহন আওনের সময় হইছে তোমার? আছিলা কই?’ বললেন ফরিনা।

‘ঘরে।’ নতজানু হয়ে বলল পদ্মজা।

‘আমির তো বাইরে বাড়াইয়া গেছে অনেকক্ষণ হইল। তুমি ঘরে কী করতাছিলা? স্বামী বাড়িত থাকলে ঘরে থাহন লাগে। নাইলে বউদের খালি রান্ধাঘরে শোভা পায়। এই কথা কী তোমার মায় কয় নাই?’

চুলার থেকে কিছুটা দূরত্বে কয়েকটা বেগুন পড়ে আছে। এখানে আসার পর থেকে সে দেখছে প্রতিদিন বেগুন ভাজা করা হয়। পদ্মজা দা নিয়ে বসে বেগুন হাতে নিতেই ফরিনা বললেন, ‘বেগুন লইছো কেরে?’

‘আজ ভাজবেন না?’

‘জাফর আর হের বউ তো গেলোই গা। এহন কার লাইগা করাম? আর কেউ বেগুন খায় না।’

পদ্মজা বেগুন রেখে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘কী করব?’

ফরিনা চোখ-মুখ কুঁচকে মাছ কাটছেন। যেন পদ্মজার উপস্থিতি তিনি নিতে পারছেন না। অনেকক্ষণ পর কাঠ কাঠ গলায় পদ্মজার প্রশ্নের জবাব দিলেন, ‘ঘরে গিয়া বইয়া থাহো।’

পদ্মজার চোখ দুটি জলে ছলছল করে ওঠে। ঢোক গিলে বলল, ‘আর হবে না।’

‘তোমারে কইছে না এইহান থাইকা যাইতে? যাও না কেরে? যতদিন আমরা আছি তোমরা বউরা রান্ধাঘরের দায়িত্ব লইতে আইবা না।’ আমিনার কণ্ঠে বিদ্রুপ।

পদ্মজা আমিনার কথায় আহত হলো। সে কখন দায়িত্ব নিতে চেয়েছে? আমিনার কথা শুনে ফরিনা চোখ গরম করে বললেন, ‘আমার ছেড়ার বউরে আমি মারাম, কাটাম, বকাম। তোমরা কোনোদিন হের লগে উঁচু গলায় কথা কইবা না। বউ, তুমি ঘরে যাও।’

পদ্মজার সামনে এভাবে অপমানিত হয়ে আমিনা পাথর হয়ে যান। তিনি সেই শুরু থেকে ফরিনাকে ভয় পান। তাই আর টু শব্দ করলেন না। পদ্মজা ফরিনার দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। মনে হচ্ছে এই মানুষটারও দুই রূপ আছে। এই বাড়ির প্রায় সবাইকে তার মুখোশধারী মনে হচ্ছে। কেউ ভালো, কিন্তু খারাপের অভিনয় করে। আর কেউ আসলে শয়তান, কিন্তু ভালোর অভিনয় করে। কিন্তু কেন? কীসের এত ছলনা!

কে ভালো? আর কে শয়তান?

‘খাড়াইয়া আছো কেন? যাও, ঘরে যাও।’

‘গিয়ে কী করব আম্মা? কোনো সাহায্য লাগলে বলুন না।’ পদ্মজা কাজে সাহায্য করার জন্য রীতিমতো অনুরোধ করছে। কিন্তু ফরিনার এক কথা, ‘তোমারে যাইতে কইছি। যাও তুমি, ঘরে যাও।’

পদ্মজা আর কথা বাড়াল না, ধীর পায়ে জায়গা ত্যাগ করল। এদিক- ওদিক হেঁটে ভাবতে লাগল—কার ঘরে যাবে। লাবণ্যের কথা মনে হতেই এগিয়ে গেল সেদিকে, বিকেলে টিভি দেখে মেয়েটা; নিশ্চয়ই এখনও দেখছে। লাবণ্যের ঘরে ঢুকতেই লিখন শাহর কন্ঠ শ্রবণপথে প্রবেশ করে। পদ্মজা টিভির দিকে তাকাল। লিখন শাহ অভিনীত ছায়াছবি চলছে। পদ্মজা চলে যেতে ঘুরে দাঁড়াল। লাবণ্য ডাকল, ‘ওই ছেমড়ি যাস কই? এইদিকে আয়।’

পদ্মজা লাবণ্যর পাশের পালঙ্কে বসল। লাবণ্য দুই হাতে পদ্মজার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সারাদিন দাভাইয়ের সঙ্গে থাকস কেন? আমার ঘরে একবার উঁকি দিতে পারস না?’

‘তোর দাভাই আমাকে না ছাড়লে আমি কী করব?

‘ঘুসি মেরে সরাইয়া দিবি।’

‘হ্যাঁ, এরপর আমাকে তুলে আছাড় মারবে।’

‘দাভাইকে ডরাস?’

‘একটুও না।’

‘সত্যি?’

‘মিথ্যে বলব কেন?’

‘একদিন রাগ দেখলে এরপর ঠিকই ডরাইবি।’

‘আমি রাগতেই দেব না।’

লাবণ্য হাসল। টিভির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লিখন শাহর মতো মানুষরে ফিরাইয়া দেওনের সাহস খালি তোরই আছে। আমার জীবনেও হইত না।’

পদ্মজা কিছু বলল না। লাবণ্যই বলে যাচ্ছে, ‘এই ছবিটা আমি এহন নিয়া ছয়বার দেখছি। লিখন শাহ তার নায়িকারে অনেক পছন্দ করে। কিন্তু নায়িকা পছন্দ করে অন্য জনরে, তারে বিয়া করে। বিয়ার অনেক বছর পর লিখন শাহর প্রেমে পড়ে নায়িকা। ততদিনে দেরি হয়ে যায়। লিখন শাহ মরে যায়। এই হইলো কাহিনি। আইচ্ছা পদ্মজা, যদি এমন তোর সঙ্গেও হয়?’

পদ্মজা আঁতকে উঠে বলল, ‘যাহ কী বলছিস! বিয়ের আগে ভাবতাম যার সঙ্গে বিয়ে হবে তাকেই ভালোবাসব। কিন্তু এখন আমার তোর ভাইকেই দরকার।’

‘ও বাবা! লাইলি আসছে। যাহ, আমি মজা করছি। আমি কেন চাইব আমার ভাইয়ের বউ অন্যজনরে পছন্দ করুক। লিখন শাহ আমার। শয়নে স্বপনে তার লগে আমি সংসার পাতি।’

পদ্মজা হাসল। লাবণ্যর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘আব্বাকে বল, লিখন শাহকে ধরে এনে তোর গলায় ঝুলিয়ে দিবে।’

‘বিয়া এমনেও দিয়া দিব। কয়দিন পর মেট্রিকের ফল। আমি যে ফেল করাম এই খবর আমি তো জানি, পুরা গেরামও জানে।’

‘কিছু হবে না। পাশ করবি। রানি আপা কোথায়?’

‘কী জানি কই বইয়া রইছে। চুপ থাক এহন। টিভি দেখ। দেখ, কেমনে কানতাছে লিখন শাহ। এই জায়গাটা আমি যতবার দেহি আমার কাঁনতে মনে চায়,’ বলতে বলতে লাবণ্য কাঁদতে শুরু করল। ওড়নার আঁচল দিয়ে তার চোখের জল মুছে দিয়ে টিভির দিকে তাকাল পদ্মজা। দৃশ্যে চলছে, লিখন শাহ ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে। তার ঘোলা সুন্দর চোখ দুটি আরো ঘোলা হয়ে উঠেছে, ভাংচুর করছে ঘরের জিনিসপত্র। তার মা-বোন-ছোটো ভাই ভয়ে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। এক টুকরো কাচ ঢুকে পড়ল লিখন শাহর পায়ে, আর্তনাদ করে ফ্লোরে বসে পড়ল সে। তার মা দৌড়ে এসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে পাগলামি থামাতে বলল। লিখন শাহ আর্তনাদ করে বলছে, ‘তুলির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আম্মা। আমি কী নিয়ে বাঁচব? কেন তুলি আমাকে ভালোবাসল না? আমি তো সত্যি ভালোবেসে ছিলাম।’

পদ্মজা বাকিটা শুনল না। মনোযোগ সরিয়ে নিলো। তার কানে বাজছে, ‘পদ্মজার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আম্মা। আমি কী নিয়ে বাঁচব? কেন পদ্মজা আমাকে ভালোবাসল না? আমি তো সত্যি ভালোবেসেছিলাম।’

চোখের কোনায় অশ্রু জমল পদ্মজার। সে অশ্রু আড়াল করে লাবণ্যকে বলল, ‘তুই দেখ। আমি যাই।’

লাবণ্যের কানে পদ্মজার কথা ঢুকল না। সে টিভি দেখছে আর ঠোঁট ভেঙে কাঁদছে। পদ্মজা আর কিছু না বলে উঠে যায়। দরজার সামনে আমিরকে দেখতে পেয়ে ধক করে উঠল তার বুক। পরে মনে হলো, সে তো কোনো অপরাধ করেনি। তাহলে এত চমকানোর কী আছে? আমির কাগজে মোড়ানো কিছু একটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঘরে, রান্নাঘরে কোথাও পেলাম না। মনে হলো লাবণ্যর ঘরেই আছো। টিভি দেখছিলে নাকি?

৩৬

বাসন্তী ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক মাখছেন। প্রেমা-প্রান্ত বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছে। তারা দুজন বাসন্তীকে মেনে নিয়েছে। বাসন্তীর কথাবার্তা আর চালচলন আলাদা, যা ছোটো দুটি মনকে আনন্দ দেয়। তারা আগ্রহভরে বাসন্তীর কথা শোনে। লিপস্টিক লাগানো শেষ হলে বাসন্তী প্রেমাকে বললেন, ‘তুমি লাগাইবা? ‘

বাসন্তীর আরো কাছে ঘেঁষে বসল প্রেমা। বাসন্তী প্রেমার ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক গাঢ় করে ঘষে দিয়ে প্রান্তকে বললেন, ‘তুমিও লাগাইবা আব্বা?’

‘জি,’ বলল প্রান্ত। প্রেমাকে লিপস্টিকে সুন্দর লাগছে। তাই তারও ইচ্ছে করছে ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে।

বাসন্তী প্রান্তর ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার জন্য উঁবু হোন। পূৰ্ণা বেশ অনেকক্ষণ ধরে এসব দেখছে। এই মহিলাকে সে একটুও সহ্য করতে পারে না। মহিলার উপস্থিতি অসহনীয় যন্ত্রণা দেয়। এক তো সৎ মা, বাপের আরেক বউ। তার ওপর এই বয়সেও এত সাজগোজ করে! প্রান্তকে লিপস্টিক দিচ্ছে দেখে তার গা পিত্তি জ্বলে উঠল। ঘর থেকে দপদপ করে পা ফেলে ছুটে আসে। প্রান্তকে টেনেহিঁচড়ে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘তোর হিজরা সাজার ইচ্ছে হচ্ছে কেন? কতবার বলেছি এই বজ্জাত মহিলার কাছে না ঘেঁষতে?

পূর্ণাকে বাসন্তী ভয় পান। মেয়েটা খিটখিটে, বদমেজাজি। হেমলতা বলেছেন, সেদিনের দুর্ঘটনার পর থেকে পূর্ণা এমন হয়ে গেছে। হুটহাট রেগে যায়, কথা শোনে না। পদ্মজা যাওয়ার পর থেকে আরো বিগড়ে গেছে। এজন্য তিনি যথাসম্ভব পূর্ণাকে এড়িয়ে চলেন। তবুও এসে আক্রমণ করে বসে। গত দুই সপ্তাহে মেয়েটা তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তিনি কাটা কাটা গলায় পূর্ণাকে বললেন, ‘এই ছিক্ষা পাইছ তুমি? গুরুজনদের সঙ্গে এমনে কথা কও!

‘আপনি চুপ থাকেন। খারাপ মহিলা। বুড়া হয়ে গেছে এখনও রং-ঢং করে।’ চোখ-মুখ বিকৃত করে বলে পূর্ণা।

কথা মাটিতে পড়ার আগে তীব্র থাপ্পড়ে মাটিতে উলটে পড়ল সে। চোখের দৃষ্টি গরম করে ফিরে তাকাল, কে মেরেছে দেখার জন্য! দেখল হেমলতাকে! হেমলতা অগ্নি চোখে তাকিয়ে আছেন, চোখের দৃষ্টি দিয়েই পূর্ণাকে পুড়িয়ে ফেলবেন। পূর্ণার চোখ শিথিল হয়ে আসে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হেমলতা বললেন, ‘নিজেকে সংশোধন কর। এখনও সময় আছে।’

পূর্ণা নতজানু অবস্থায় বলল, ‘আমি এই মহিলাকে সহ্য করতে পারি না আম্মা।’

‘করতে হবে। উনার এই বাড়িতে অধিকার আছে।’

‘আমি খুন করব এই মহিলাকে।’ রাগে তার শরীর কাঁপছে।

পূর্ণার অবস্থা দেখে হেমলতা অসহায়বোধ করছেন। পূর্ণা কেন এমন হলো? তিনি কি এক মেয়ের শূন্যতার শোক কাটাতে গিয়ে আরেক মেয়েকে সময় দিচ্ছেন না? বুঝিয়ে-শুনিয়ে পূর্ণাকে আবার আগের মতো করতে হবে। তিনি কণ্ঠ নরম করে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এরপর পূর্ণা যা বলল তাতে তিনি আর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। পূর্ণা বাসন্তীকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বেশ্যার মেয়ে বেশ্যাই হয়। আর বেশ্যার সঙ্গে এক বাড়িতে থাকতে ঘেন্না লাগে আমার।’

এই কথা শুনে রাগে-দুঃখে হেমলতা শরীর কাঁপতে শুরু করে। তিনি ছুটে যান বাঁশ বাগানের দিকে। বাঁশের কঞ্চি নিয়ে ফিরে আসেন। রাগান্বিত হেমলতাকে কঞ্চি হাতে দেখে বাসন্তী দ্রুত পূর্ণাকে আগলে দাঁড়ান। হেমলতাকে অনুরোধ করে বললেন, ‘এত বড়ো ছেড়িডারে মাইরো না। ছোটো মানুছ, বুঝে না।’

‘আপা আপনি সরেন। ও খুব বেড়ে গেছে।’

বাসন্তীর স্পর্শ পূর্ণার ভালো লাগছে না। সে ঠেলে তাকে সরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে পূর্ণার পিঠে বাড়ি দিলেন। পূৰ্ণা আর্তনাদ করে শুয়ে পড়ল। হেমলতা আবার মারার জন্য উদ্যত হতেই বাসন্তী পূর্ণাকে আগলে দাঁড়িয়ে অনুরোধ করে বললেন, ‘যুবতি ছেড়িদের এমনে মারতে নাই। আর মাইরো না। আজকে ছাইড়া দাও।’

প্রেমা-প্রান্ত ভয়ে গুটিয়ে গেছে। হেমলতার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। তিনি বাঁশের কঞ্চি ফেলে লাহাড়ি ঘরে চলে গেলেন। বারান্দায় বসে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মনে মনে মোর্শেদের ওপর ক্ষেপে গেলেন। মোর্শেদ চিৎকার করে বাসন্তীর সম্পর্কে সব বলেছে বলেই তো পূর্ণা জেনেছে। তাই এখন পূর্ণা কারো অতীত নিয়ে আঘাত করার সুযোগ পাচ্ছে। মোড়ল বাড়ির ছোটো সংসারটা কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে!

হেমলতা আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে নিশ্বাস নেন। সব কষ্ট, যন্ত্রণা যদি উড়ে যেত! সব যদি আগের মতো হতো। সব কঠিন মানুষেরাই কী জীবনের এক অংশে এসে এমন দুর্বল হয়ে পড়ে? কোনো দিশা খুঁজে পায় না?

.

আমির বিছানায় বসে উপন্যাস পড়ছে। ছয়দিন পর পদ্মজার মেট্রিকের ফলাফল। এরপরই ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। যদিও ফরিনা বেগম এই সিদ্ধান্তে রাজি নন। কিন্তু আমির মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সে পদ্মজাকে রাজধানীতে নিয়েই যাবে। পদ্মজার কথা মনে হতেই আমির বই রেখে গোসলখানার দরজার দিকে তাকাল। তার ঘরের সঙ্গে আগে গোসলখানা ছিল না। পদ্মজার জন্য করা হয়েছে। সে বই রেখে সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল, তখনি পদ্মজা চিৎকার করে উঠল। আমির দৌড়ে ভেতরে ঢুকল দরজা ঠেলে। পদ্মজা শাড়ি দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছে, কাঁপছে কিছুটা। আমির দ্রুত কাছে এসে বলল, ‘কী হয়েছে?’

‘ওখানে, ওখানে কে যেন ছিল। আ…আমাকে দেখছিল।’

পদ্মজার ইঙ্গিত অনুসরণ করে আমির সেদিকে তাকাল। গোসলখানার ডান দেয়ালের একটা ইট সরানো। সকালে তো সরানো ছিল না! পদ্মজা কাঁদতে থাকল। কাপড় পালটাতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ে দেয়ালে। আর তখনই দুটি চোখ দেখতে পায়। সে তাকাতেই সরে গেল চোখ দুটি! পদ্মজার পিলে চমকে ওঠে। আমির পদ্মজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘শুকনো কাপড় পরে আসো। কেঁদো না।’

কথা শেষ করেই সে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার তাড়া দেখে মনে হলো, অজ্ঞাত আগন্তুক হয়তো আমিরের পরিচিত! সে অবগত মানুষটি সম্পর্কে! পদ্মজা দ্রুত কাপড় পরে আমিরকে খুঁজতে থাকল।

আমির সোজা রিদওয়ানের ঘরের দিকে যায়। রিদওয়ান পানি পান করছিল। আমির গিয়ে রিদওয়ানের বুকের শার্ট খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, ‘তোকে সাবধান করেছিলাম। দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছিলাম।’

‘শার্ট ছাড়।’

‘ছাড়ব না। কী করবি? তুই আমার বউয়ের দিকে কু-নজর দিবি আর আমি ছেড়ে দেব?’

‘প্রমাণ আছে তোর কাছে?’

‘কুত্তার বাচ্চা প্রমাণ লাগবে? আমি জানি না?’

‘আমির মুখ সামলা। গালাগালি করবি না। ‘

‘করব। কী করবি তুই?’

‘আবার বলছি, শার্ট ছাড়।’

রিদওয়ানের নাকে-মুখে ঘুসি মেরে বসল আমির। টাল সামলাতে না পেরে পালঙ্কের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল রিদওয়ান। দুজনের চিৎকার, চেঁচামিচি শুনে বাড়ির সবাই ছুটে এলো রিদওয়ানের ঘরে।

৩৭

পদ্মজা ঘরের চৌকাঠে পা দিয়েছে মাত্র। আমির রিদওয়ানকে টেনে হিঁচড়ে তুলে বলল, ‘তোকে না করেছিলাম। বার বার না করেছি। তবুও শুনলি না।’

রিদওয়ান দুই হাতে আমিরকে ধাক্কা মেরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। আমির আলমারির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আরো হিংস্র হয়ে রিদওয়ানের দিকে তেড়ে আসে। নুরজাহান দৌড়ে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ান। চিৎকার করে বললেন, ‘কী অইছে তোদের? তোরা এমন করতাছস কেন?’

‘দাদু, সরে যাও। মাদা** বাচ্চারে আমি মেরে ফেলব।’

‘তুই কি ভালা মানুষের বাচ্চা?’ তেজ নিয়ে বলল রিদওয়ান।

আমির নুরজাহানকে ডিঙিয়ে রিদওয়ানকে আঘাত করতে প্রস্তুত হয়।

তখন মজিদ হাওলাদারের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘যে যেখানে আছো, সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।’

আমির মজিদ হাওলাদারকে এক নজর দেখে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। পরেই জ্বলে উঠে বলল, ‘আব্বা আপনি জানেন না ও কী করছে? পদ্মজা গোসল করছিল আর ও লুকিয়ে লুকিয়ে সেটা দেখছিল।’ আমিরের কণ্ঠ থেকে যেন আগুন ঝরছে।

ফরিনা, আমিনা, রানিসহ হাওলাদার বাড়িতে কাজ করা দুজন মহিলা ছি ছি করে উঠল। রিদওয়ান সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘তোর কাছে কী প্রমাণ আছে?’

‘প্রমাণ লাগবে? আমি জানি এটা তুই ছিলি। বিয়ের রাতেও তুই পদ্মজার কাছে গেছিলি।’

‘অপবাদ দিবি না।’

‘তুই ভালো করেই জানিস আমি অপবাদ দিচ্ছি না।’

‘তুমি কী করে নিশ্চিত যে, ছেলেটা রিদওয়ানই ছিল? পদ্মজা দেখেছে? নাকি তুমি?’ বললেন মজিদ।

‘কেউ দেখেনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত ওই চরিত্রহীনটা রিদু। কারণ, আমার আগে থেকে ও পদ্মজাকে পছন্দ করত।

পদ্মজা বিস্ময়ে তাকাল। কী হচ্ছে, কী সব শুনছে? ফরিনার দুই ঠোঁট হাঁ হয়ে গেল। মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমিনা বললেন, ‘আপা, আমি আগেই কইছিলাম এই ছেড়ি বিনাশিনী। এই ছেড়ির রূপ আগুনের লাকান। এই ছেড়ির জন্য এখন বাড়ির ছেড়াদের ভেজাল হইতাছে।’

আমির আমিনার কথা শুনেও না শোনার ভান করল। মজিদকে বলল, ‘আব্বা, আপনি এর বিচার করবেন? না আমি ওরে মেরে ফেলব? আর আম্মা, এরপরও বলবা পদ্মজাকে এই বাড়িতে রেখে যেতে? আমাকে তো ফিরতেই হবে ঢাকা। মনে রেখো, পদ্মজাকে রেখে আমি কিছুতেই যাব না। আব্বা, তুমিও কথাটা মনে রেখো, আমি তোমার ব্যবসায় আর নেই…যদি পদ্মজা আমার সঙ্গে ঢাকা না যায়।’

‘তুমি যেখাবে যাবা তোমার বউ তো সেখানেই যাবে। বউ রেখে যাবা কেন? আর রিদওয়ান তুমি আমার সঙ্গে আসো। তোমার সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে।’

মজিদ হাওলাদার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। আমির পদ্মজার হাতে ধরে বলল, ‘কসম, আর কখনো তোমাকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে দেব না।’

খুশিতে পদ্মজার চোখের তারায় অশ্রু জ্বলজ্বল করে উঠে। সে আমিরের এক হাত শক্ত করে ধরে বোঝায়, ‘আমি আপনাকে ভালোবাসি। বিশ্বাস করি।’

.

সন্ধ্যার ঠিক আগমুহূর্ত। এমন সময় হাওলাদার বাড়ির রাতের রান্না করা হয়। মগা এক ব্যাগ মাছ দিয়ে গেছে। লতিফা মাছ কাটছে। লতিফা এই বাড়ির কাজের মেয়ে। সবাই ছোটো করে লুতু ডাকে। ফরিনা ভাত বসিয়েছেন। আর অনবরত বলে চলেছেন, ‘আমি এই বাড়ির বড়ো বান্দি। দাসী আমি। বাবুর বাপ দাসী পুষে রাখছে। দাসী পালে। সারাদিন কাম করি। অন্যরা হাওয়া লাগাইয়া ঘুরে। মরণ হয় না কেন আমার? মরণই আমার একমাত্র শান্তি।’

পদ্মজা গুনগুন করে গান গাচ্ছে আর রান্নাঘরের আশপাশে ঘুরছে। ফরিনার সব কথাই তার কানে আসছে। তার গায়ে লাগছে না। বরং হাসি পাচ্ছে। সে বহুবার রান্নাঘরে গিয়েছে কাজ করার জন্য। ফরিনা তাড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, কাজ করতে হবে না। আর এখন বলছেন, কেউ সাহায্য করে না! পদ্মজা পা টিপে টিপে রান্না ঘরে ঢুকে বলল, ‘আম্মা, আমি সাহায্য করি?’

‘এই ছেড়ি তুমি এত বেয়াদব কেরে? কতবার কইছি তোমার সাহায্য করতে হইব না।’

‘না…মানে আপনি বলছিলেন, কেউ সাহায্য করে না।’

‘তোমারে তো বলি নাই। তোমার গায়ে লাগে কেন?’

‘মেঝে ঝাড়ু দিয়ে দেই?’

‘তোমারে কইছি আমি? তুমি যাও এন থাইকা। যাও কইতাছি।’

অগত্যা পদ্মজা বেরিয়ে যায়। বাসায় লাবণ্য নেই, আমির নেই। কার কাছে যাবে? রানি আছে! রানির কথা মনে হতেই পদ্মজা রানির ঘরের দিকে এগোল। যাওয়ার পথে কানে সন্ধ্যার আজান ভেসে আসে। তাই আর সেদিকে এগোল না, ফিরল নিজের ঘরে। নামাজ আদায় করতে হবে।

প্রার্থনা সম্পন্ন করে সুরা ইয়াসিন পড়ল একবার। জানালা লাগাতে গিয়ে দেখতে পেল রানিকে, সেদিনের মতো জঙ্গলের ভেতর ঢুকছে। আর কিছুক্ষণ পরেই চারিদিক রাতের গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। এমন সময় রানি আপা কী করতে ওখানে যাচ্ছে? এত সাহসই কী করে হয়? পদ্মজা হুড়মুড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়। আজ সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। লাবণ্য সবে মাত্র সদর ঘরে ঢুকেছে।

পদ্মজাকে তাড়াহুড়ো করে কোথাও যেতে দেখে বলল, ‘কী রে, কই যাস?’

পদ্মজা চমকে উঠল। বলল, ‘এই তো…এইখানেই। কোথায় ছিলি? আচ্ছা, পরে কথা বলব। আসি এখন।’

লাবণ্য ঠোঁট উলটে পদ্মজার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ধরে নেয়, পদ্মজা দুই তলা থেকে হয়তো দাভাইকে আসতে দেখেছে তাই এগিয়ে আনতে যাচ্ছে। সে নিজ ঘরের দিকে চলে গেল। পদ্মজা কখনো বাড়ির পেছনের দিকে যায়নি, এই প্রথম। বাড়ির ডান পাশে বিশাল পুকুর। কালো জল। কিন্তু বাড়ির সামনের পুকুরের জল স্বচ্ছ।

দুই মিনিট লাগে শাক-সবজির খেত পার হতে। বাড়ির পেছনে এরকম শাক-সবজির বাগান আছে সে জানত না। এরপর পৌঁছাল জঙ্গলের সামনে। সেখান থেকে অন্দরমহলের দিকে তাকাল। ওই তো তাদের ঘরের জানালা দেখা যাচ্ছে। আরেকটা জানালাও দেখা যাচ্ছে। পদ্মজা কপাল কুঁচকে খেয়াল করল, সেই জানালার গ্রিল ধরে কেউ তাকিয়ে আছে। পদ্মজা ঠাওর করার চেষ্টা করল এটা কার ঘর। মনে হতে বেশি সময় লাগল না—রূম্পা ভাবির! তবে কী তিনিই তাকিয়ে আছেন? পদ্মজা আবার তাকাল। রূম্পা জানালার পর্দা সরিয়ে হাত নাড়াল, মৃদু হেসে পালটা হাত নাড়াল পদ্মজাও। দূর থেকে রুম্পার মুখটা দেখে মনে হচ্ছে, সে কিছু বলতে চায় পদ্মজাকে। তার ভেতর লুকানো আছে কোনো এক রহস্যময় গল্প।

.

‘ভাবি এইনে রাইতের বেলা কী করেন?’

ভূমিকম্পে ভূমি যেভাবে কেঁপে উঠে, পদ্মজা ঠিক সেভাবেই কেঁপে উঠল। তাকিয়ে দেখল মদনকে। সে জঙ্গলের ভেতর থেকে এসেছে। পদ্মজা আমতা আমতা করে বলল, ‘হাঁ…হাঁটতে এসেছিলাম।’

‘এই রাইতের বেলা?’

‘বিকেল থেকেই। এখন ফিরে যাচ্ছিলাম।’

‘চলেন এক সঙ্গে যাই। জায়গাডা ভালা না ভাবি। আপনি হইছেন সুন্দর

মানুষ। জিন, ভূতের আছর পড়ব।’

‘আপনি যান। আমি আসছি।’

‘আর কী করবেন এইহানে?’

পদ্মজা জঙ্গলের দিকে তাকাল। শিরশিরে অনুভূতি হলো একটা! সব জঙ্গল অযত্নে বেড়ে উঠলেও এই জঙ্গল যেন যত্নে বেড়ে ওঠা। সে অন্ধকারে খোঁজার চেষ্টা করল রানিকে। পেল না। এদিকে মদনের সঙ্গে না গেলে সে বাড়িতে যদি বলে দেয়! তাহলে অনেকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। আর একটার পর একটা মিথ্যে বলতে হবে। পদ্মজা মনে মনে পরিকল্পনা করে, মদনের সঙ্গে বাড়ি অবধি গিয়ে আবার চলে আসবে।

৩৮

মদন পদ্মজাকে রেখে কিছুতেই যাচ্ছে না। আবার পদ্মজাও অন্দরমহলের ভেতর ঢুকতে চাইছে না। সে বার বার বলছে, ‘আমি একটু হাঁটব এদিকে। আপনি যান।’

‘রাইতের বেলা একলা থাকবেন! আমার কামই আপনারারে দেইখা রাখা।’

‘এদিকে তো আলো জ্বলছে। উনিও এখন আসবেন। আপনি যান। আর আপনার পা তো কাদায় মাখা। বেশিক্ষণ এভাবে না থেকে ধুয়ে আসুন।’

মদন পায়ের দিকে তাকাল। লুঙ্গি হাঁটু অবধি তুলে বেঁধে রাখা। সে হেসে বলল, ‘আইচ্ছা তাইলে আমি ধুইয়া আইতাছি। বেশিখন (বেশিক্ষণ) লাগব না।’

‘আচ্ছা, আসুন।’

মদন চলে যেতেই পদ্মজা ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। গলার মাঝে যেন এতক্ষণ কাঁটা বিঁধে ছিল। বাড়ির পেছনে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দেখলে পেল আমিরকে। আমির আলগ ঘর পেরিয়ে এদিকেই আসছে। পদ্মজা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারল না, আলগ ঘরের দিকে চেয়ে রইল। পদ্মজাকে দেখতে পেয়ে লম্বা করে হাসল আমির। বলল, ‘পদ্মবতী কী আমার জন্য অপেক্ষা করছে?’

‘বোধহয় করছি।’

আমির ভ্রুকুটি করে বলল, ‘বোধহয় কেন?’

‘ঘরে একা ভালো লাগছিল না। তাই হাঁটতে বের হয়েছিলাম। আপনি

নামাজ পড়েছেন?’

‘এই যে মাথায় টুপি। মসজিদ থেকে আসলাম।’

পদ্মজা আড়চোখে অন্দরমহলের ডান দিকে তাকাল। ভাবছে, রানি আপা কোথায় গেল? উসখুস করতে থাকল সে।

ঠিক তখনই পদ্মজাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল আমির। স্বামীর কাজে পদ্মজা হতভম্ব হয়ে দ্রুত এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, কেউ আছে নাকি! এরপর আমিরের হাতের বাঁধন ছুটানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘ছাড়ুন, কেউ দেখবে।’

‘কেউ দেখবে না। এদিকে কেউ নেই,’ আমিরের কণ্ঠ মোহময়। সে পদ্মজার ঘাড়ে থুতনি রাখল। ওর ঠোঁটের ছোঁয়া লাগাতেই পদ্মজার গা জুড়ে শুরু কাঁপুনি এলো। জোর করে আমিরের হাতের বাঁধন থেকে ছুটে গিয়ে বলল, ‘আপনি ঘরে যান।’

আমির হতাশ ভঙ্গিতে বলল, ‘আচ্ছা চলো।’

‘আপনি যান আমি আসছি।’

‘কেন? তুমি কোথায় যাবে?’

পদ্মজা নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবল। বলল, ‘আলগ ঘরে যাব। আপনি ঘরে যান। নয়তো আম্মা আমাকে খুঁজবে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসব। এরপর সব বলব।’

‘আরে, কী করবে বলবে তো।’

‘আপনি যান না।’

পদ্মজা ঠেলে আমিরকে অন্দরমহলের দিকে পাঠিয়ে দিল। আমির অসহায় মুখ করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমিও থাকি?’

‘আপনি ঘরে গিয়ে বসেন, আমি যাব আর চলে আসব।’

পদ্মজার অনুরোধ ফেলা যাচ্ছে না। আমির না চাইতেও অন্দরমহলে চলে গেল। সেই সুযোগে এক নিশ্বাসে দৌড়ে অন্দরমহলের ডান পাশে চলে এলো পদ্মজা। সঙ্গে সঙ্গে সামনে পড়ল রানি। দুজন দুজনকে হঠাৎ চোখের সামনে দেখে চমকে উঠল, অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। রানিই আগে কথা বলল, ‘রাইতের বেলা এমনে ছুটতাছো কেন?’

পদ্মজার মাথা থেকে ঘোমটা পড়ে গেছে সেই কখন। দৌড়ে আসাতে চুলের খোঁপাও খুলে গেছে। গাছ-গাছালির বাতাসে তিরতির করে তার চুল উড়ছে। তবুও সে ঘামছে। আমতা আমতা করে বলল, ‘আ…আমি তো হাঁটতে বের হয়েছি। জোনাকি দেখলাম এদিকে। তাই নিতে এসেছি।’

‘ওহ। কই জোনাকি। নাই তো।’

‘একটু আগেই ছিল।’

‘এহন তো নাই। রাইতের বেলা একলা থাকবা কেন? আসো ঘরে যাই।’

‘তুমি কোথায় গিয়েছিলে আপা? সন্ধ্যার আগে তোমার ঘরে গেলাম কিন্তু পেলাম না। এদিক দিয়ে কোথাও ছিলে? কিন্তু এদিকে তো ঝোপঝাড়, জঙ্গল।’

পদ্মজার প্রশ্নে রানির মুখ রক্তিম হয়ে উঠল, কেমন অস্বাভাবিক দেখাল তার চাহনি; হাসল অপ্রস্তুতভাবে। কী বলবে খুঁজছে যে তা স্পষ্ট। পদ্মজা অপেক্ষা করছে, রানি কী বলে শোনার জন্য।

পদ্মজা ডাকল, ‘আপা?’

‘আরে আমি ওষুধ খুঁজতে আসছিলাম।’

‘কী ওষুধ?’

‘তুমি চিনবা না। আসো বাড়িত যাই। মেলা রাইত হইয়া গেছে।’

পদ্মজাকে পিছনে রেখেই রানি চলে যাচ্ছে। এটাকে পালিয়ে যাওয়া বলে। পদ্মজা আর থেকে কী করবে! সেও রানির পিছু পিছু অন্দরমহলে চলে আসে।

ঘরে ঢুকতেই আমির হামলা করে, ‘কাহিনি কী বলো তো।’

‘বিশ্বাস করবেন?’

‘তোমার কথা বিশ্বাস করব না, এ হয়?’

‘রানি আপা প্রায় জঙ্গলের ভেতর যায়। আমি জানালা থেকে দেখি। এমন ভাবে যায় যেন চুরি করতে যাচ্ছে।’

আমির শুনে অবাক হলো। চাপা স্বরে প্রশ্ন করল, ‘সত্যি! প্রায়ই যায়?’

‘আমি সত্যি বলছি।’

আমির চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে দুশ্চিন্তা, কপালের চামড়া পর্যন্ত কুঁচকে গেছে। গভীর ভাবনায় বিভোর সে। পদ্মজা বলল, ‘আমি আজ অনুসরণ করে জঙ্গল অবধি গিয়েছিলাম। মদন ভাইয়ার জন্য ভেতরে ঢুকতে পারিনি। এরপর আপনি এলেন। পরে আবার যেতে চেয়েছি। কিন্তু ততক্ষণে রানি আপা চলে এসেছে। সরাসরি প্রশ্নও করেছি, কেন জঙ্গলে গিয়েছিল। বলল, ওষুধ আনতে। মানে কোনো ঔষধি পাতা। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি। প্রায়ই কেন কেউ ঔষধি পাতা আনতে যাবে? তাও আবার ভোরে আর রাতে।’

পদ্মজা এক দমে কথাগুলো বলল। আমির জবাবে বলল, ‘আব্বাকে বলতে হবে।’

‘আগে আমার কথা শুনুন।’

‘বলো?’

‘এখন কাউকে বলবেন না।’

‘বলা উচিত। ব্যাপারটা জটিল মনে হচ্ছে।’

‘আমরা আগে বের করি, কী হয়েছে…আপা কী করতে যায়? এরপর নিজেরা সমাধান করতে পারলে করব। নয়তো বড়োদের বলব। যদিও আমরা নিশ্চিত না কোনো সমস্যা আছে।’

‘অবশ্যই সমস্যা আছে। তুমি জানো, ওদিকে কোনো মহিলা ভয়ে ভুলেও যায় না। অথচ রানি যায়। বড়ো কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে।’

‘সেটা আমরা দুজন মিলে বের করি?’

‘কীভাবে?’

‘আমার মনে হচ্ছে আবার যাবে, কাল-পরশুর মধ্যে। আমরা পিছুপিছু যাব।’

‘খারাপ বলোনি।’

‘কাউকে বলবেন না এখন, অনুরোধ।’

আমির হাসল। পদ্মজার কোমর পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বলব না।’

‘আপনি কারণে-অকারণে ছোঁয়ার বাহানা খুঁজেন।’

‘এতে পাপ তো নেই।’

‘খাওয়ার সময় হয়েছে, চলুন। ঠিক সময়ে না গেলে আম্মা রেগে গিয়ে চেঁচামেচি করবেন।’

‘আম্মারা চেঁচামেচি করেই। তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।’

‘কী?’

‘তোমাকে খয়েরি রঙে বেশি সুন্দর লাগে।’

‘আমি তো খয়েরি শাড়ি পরিনি।’

‘পুরো কথা বলতে দাও।’

‘আচ্ছা, বলুন।’

আমির পদ্মজার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আর কালো রঙে আবেদনময়ী লাগে।’

পদ্মজার কানে-ঘাড়ে আমিরের নিশ্বাস ছিটকে পড়ে। সে ঘুরে আমিরের দিকে তাকাল। আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু আপনি সবসময় আকর্ষণীয়।’

আমির হইহই করে উঠল, ‘সত্যি? কত…কত দিন পর একটু প্রশংসা করলে। ইয়া আল্লাহ!’

পদ্মজা মৃদু আওয়াজ করে হাসল। বলল, ‘প্রশংসা শুনতে খুব ভালোবাসেন?’

‘অবশ্যই। তবে বউয়ের প্রশংসা করতে আরো বেশি ভালোবাসি।’ আমির আরো শক্ত করে পদ্মজার কোমর আঁকড়ে ধরল। আমিরের দুই হাতে ধরে পদ্মজা বলল, ‘আপনি সবসময় এত শক্ত করে ধরেন কেন? গায়ের জোর দেখান?’

‘কেন? ভালো লাগে না?’

‘মোটেও না। আদর করে ধরবেন। ‘

আমির হাতের বাঁধন কোমল করে দিয়ে বলল, ‘লজ্জার ছিটেফোঁটাও গিলে ফেলেছ দেখছি।’

‘বিয়ের এতদিন পরও কোন মানুষটা লজ্জা পায়, তা আমাকে দেখাবেন। আমি অত ভং ধরতে পারব না।’

‘কী ঝাঁঝ কথায়!’

‘এবার ছাড়ুন

‘ইচ্ছে হচ্ছে না।’

‘আবার শক্ত করে ধরেছেন।’

‘যদি দৌড়ে পালাও?’

‘পালিয়ে আর কোথায় যাব?’

আমির পদ্মজাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এক হাতে কোমর চেপে ধরে অন্য হাত গালে রাখল। তখনই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল লতিফা। পদ্মজা, আমির দুজন দুদিকে ছিটকে গেল। আমির ধমকে উঠল, ‘লুতু কতবার বলেছি না বলে ঘরে ঢুকবি না। আমাদের তো নতুন বিয়ে হয়েছে, নাকি?’

পদ্মজা খেয়াল করল আমির কথাগুলো রাগে বলার চেষ্টা করলেও, ঠিক রাগত শোনাল না। হাসি পেল তার। ওদিকে লতিফার মুখের অবস্থা দরজার চিপায় পড়ার মতো। সে আমিরকে ভীষণ ভয় পায়। কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘খালাম্মা খাইতে যাইতে কইছে।’

৩৯

পদ্মজা ভক্তির সঙ্গে নুরজাহানের পা টিপে দিচ্ছে। তার মূল উদ্দেশ্য রুম্পার ঘরে যাওয়া। সকাল থেকে বারংবার রুম্পার ঘরে ঢোকার চেষ্টা করেছে, পারেনি। মদন কিছুতেই ঢুকতে দেয়নি। তার এক কথা, নুরজাহান না বললে ঢুকতে দিবে না। অগত্যা পদ্মজা নিরাশ হয়ে নুরজাহানের ঘরে এসে পা টেপা শুরু করেছে…যদি একটু পটানো যায়। ঘণ্টাখানেক ধরে সে নুরজাহানের পা টিপছে। হাত টনটন করছে ব্যথায়। নুরজাহান আয়েশ করে ঘুমাচ্ছেন। কখন যে ঘুম ভাঙবে! এভাবে কেটে যায় আরো অনেকটা সময়। নুরজাহান চোখ মেলে তাকান। ঘুমকাতুরে কণ্ঠে পদ্মজাকে বললেন, ‘এহনো আছো?’

পদ্মজা মৃদু হাসল। নুরজাহান বললেন, ‘অনেকক্ষণ হইছে। যাও, এহন ঘরে যাও।’

পদ্মজার চোখে মুখে আঁধার নেমে আসে। পরক্ষণেই মিষ্টি করে হেসে বলল, আপনার ভালো ঘুম হয়েছে?’

‘সে হয়েছে।’

‘দাদু একটা প্রশ্ন করি?

‘করো।’

‘রুম্পা ভাবিকে যেদিন দেখেছিলাম অনেক নোংরা দেখাচ্ছিল। উনাকে পরিষ্কার করে রাখার জন্য একটা মেয়ে দরকার। কিন্তু সবসময় মদন ভাইয়া পাহারা দেন।’

‘ষাঁড়ের লাহান শক্তি ওই ছেড়ির। হের লগে ছেড়িরা পারব না। সবাই ডরায়।

‘তাই বলে এভাবে অপরিষ্কার থাকবে সবসময়!’

‘সবাই ডরায়। কেউ যাইব না সাফ কইরা দিতে। তুমি বেহুদা কথা বলতাছো।’

নুরজাহানের কঠিন কণ্ঠের সামনে পদ্মজার আসল কথাটাই মুখে আসছে না। সে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় আমি পারব। ভাবি আমাকে আঘাত করবে না। আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিতেন যদি।’

‘পাগল হইছো ছেড়ি? কেমনে খামচাইয়া ধরছিল মনে নাই? আর কথা কইয়ো না। যাও এন থাইকা।’

পদ্মজা আর কিছু বলার সাহস পেল না। সে ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দুই তলার বারান্দা থেকে আলগ ঘরের সামনের খালি জায়গা দেখা যাচ্ছে। সেখানে গ্রামের মানুষের ভিড়। মজিদ হাওলাদার তার লোকজন নিয়ে গ্রামের মানুষদের সমস্যা শুনছেন। কাউকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করছেন, কাউকে বা ধান দিয়ে। এই ব্যাপারটা প্রায়ই ঘটে। পদ্মজার খুব ভালো লাগে। গর্ব হয়।

.

পূর্ণা ঘাটে বসে আছে। মাদিনী নদীর স্রোতে তার দৃষ্টি স্থির। প্রান্ত-প্রেমা স্কুলে গিয়েছে। সে যায়নি। ইদানীং সে স্কুলে যায় না একদমই। ভালো লাগে না। পদ্মজা যাওয়ার পর থেকে সব থমকে গেছে। পদ্মজার শূন্য জায়গাটা কিছুতেই পূর্ণা মানতে পারছে না। বাড়ির প্রতিটি কোণে সে পদ্মজার স্মৃতি খুঁজে পায়। এই তো এই ঘাটে বসে দুজন কত সময় পার করত, কত গল্প করত; আজ পদ্মজার জায়গা শূন্য। পূর্ণা অনুভব করে, সে তার মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসে পদ্মজাকে। পদ্মজার প্রতিটি কথা কানে বাজে। এতদিন হয়ে গেল তবুও এই শোক, এই শূন্যতা কাটিয়ে উঠতে পারছে না সে। পূর্ণার চোখ দুটি ছলছল করে উঠে। সে নিচের ঠোঁট কামড়ে দুইবার ডাকল, ‘আপা…আপারে।’

বাসন্তী দূর থেকে পূর্ণাকে দেখতে পেলেন। জুতা খুলে পা টিপে হেঁটে এসে পূর্ণার পাশে বসেন। পূর্ণা এক ঝলক বাসন্তীকে দেখে দ্রুত চোখের জল মুছল। এরপর বলল, ‘আপনি এখানে এসেছেন কেন?’

প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে পূর্ণা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বাসন্তীর দিকে তাকাল। দেখতে পায়, বাসন্তীকে আজ অন্যরকম লাগছে। আরেকটু খেয়াল করে বুঝতে পারল অন্যরকম কেন লাগছে। আজ বাসন্তীর ঠোঁটে লিপস্টিক নেই, কপালে টিপ নেই, চোখে গাঢ় কাজল নেই। থুতনির নিচে সবসময় কালো তিনটা ফোঁটা দিতেন সেটাও নেই। পূর্ণা বাসন্তীর হাতের দিকে তাকাল। হাতেও দুই-তিন ডজন চুড়ি নেই। দুই হাতে শুধু দুটো সোনার চিকন চুড়ি।

পূর্বের প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করে পূর্ণা পালটা প্রশ্ন করল, ‘আপনি আজ সাজেননি কেন?’

‘না ছাজলে কি আমারে ভালা লাগে না?’ বেশ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন বাসন্তী।

পূর্ণা বাসন্তীর চোখেমুখে স্নিগ্ধতা খুঁজে পেল। মহিলা মায়াবী চেহারা পেয়েছে! প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। চকচকে গাল। বয়স চল্লিশের উপর মনেই হয় না। কিন্তু মুখে পূর্ণা কিছু বলল না। সে চোখ সরিয়ে নিলো। বাসন্তী বললেন, ‘আমার সঙ্গে গপ করবা?’

‘আমার ঠেকা পড়েনি।’ পূর্ণার ঝাঁঝাল স্বর।

বাসন্তী পূর্ণার পাশ ঘেঁষে বসেন। পূর্ণা বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল। কিছু কঠিন কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হলো সবেমাত্র। তখন বাসন্তী বললেন, ‘আম্মা, আমি তোমার আব্বারে ভালোবাছছিলাম ছত্যি। তবুও ছেছ বয়ছে আইছছা একটা ভুল করে ফেলি। ভুল যখন বুঝতে পারি তোমার আব্বারে বলি। কিন্তু তোমার আব্বা মুখ ফিরাইয়া নেয়। আমার তোমার আব্বা ছাড়া আর গতি ছিল না। তাই গ্রামের মানুছ নিয়া আছছিলাম। আমার এই কাজের জন্য তোমাদের এত বড়ো ক্ষতি হবে জানলে এমন করতাম না। যাক গে ছেছব কথা। তোমার আব্বা আমারে আজও মাইনা নেয় নাই। তাতে আমার দুঃখ নাই। তোমার আম্মার মতো একটা ছোটো বইন পাইছি। তোমার দুইডা ভাই-বইনের মতো ছন্তান পাইছি। আমি নিঃছন্তান। আমার কোনো ছন্তান নেই। কখনো হবেও না। ছন্তানের চূন্যতা আমাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। তোমাদের বাড়িতে আছার পর থেকে সেই দুঃখ ঘুচে গেছে। প্রান্ত-প্রেমা যখন আমারে বড়ো আম্মা কইয়া ডাকে, আমার খুছিতে কান্দন আইছছা পড়ে। ছুধু ভালো লাগে না তোমার গুমট মুখটা। বিছ্‌বাস করো আম্মা, তোমার মারে আমি তাড়াতে আছি নাই। ছে হইছে গিয়া হীরার টুকরা। তার মতো মানুছ হয় না। আমি যা চেয়েছি তার চেয়েও বেছি পাইছি। ছেটা তোমার আম্মা দিছে। আমি চাই না আমার জন্য তুমি কছ্‌ট পাও। আমি তোমারে বলব না আমারে আম্মা ডাকতে। আমি ছুধু চাই তুমি আমারে মাইনা নাও। ভালো থাকো। হাছিখুছি থাকো। আমি তোমার বন্ধু হইতে চাই। তোমরা যেমনে বলবা আমি তেমনেই চলব। এই যে দেখো, তোমার ছাজগোজ পছন্দ না বলে আমি আজ ছাজি নাই। আর কোনোদিনও ছাজব না। আমি কী কম ছুন্দর নাকি যে ছাজতেই হবে!’ শেষ বাক্যটি রসিকতা করে হেসে বললেন তিনি।

বাসন্তীর কথাগুলো পূর্ণার মন ছুঁয়ে যায়। পূর্ণা বরাবরই কোমল মনের। তবুও শক্ত কণ্ঠেই বলল, ‘আমি আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করব না। আপনি আপনার মতো থাকুন প্রেমা-প্রান্তকে নিয়ে। আমি আমার মতো থাকব আমার মাকে নিয়ে। আমার আর কারোর বন্ধুত্বের দরকার নেই। ‘

বাসন্তীর চোখ ছলছল করছে। তবুও তিনি হাসতে কার্পণ্য করলেন না। বললেন, ‘তোমার চুল অনেক চুন্দর আর লম্বা। এখন তো ভরদুপুর। বাইন্ধা রাখো।’

পূর্ণা চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিয়ে বলল, ‘আম্মা এখনও ঘুমে?

‘হ।’

‘আম্মার কী যে হয়েছে! কখনো একদমই ঘুমায় না। আর কখনো ঘুম ছেড়ে উঠতেই পারে না।’

‘পদ্মজার জন্য কান্ধে দেখি। ছরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে। এজন্য ঘুমায়।’

পূর্ণা উঠে দাঁড়াল। বাসন্তী বললেন, ‘আমি রানছি বলে ছকালে খাইলা না। এখন নিয়া আছি ভাত?’

‘পরে খাব।’ বলে পূর্ণা দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল।

মায়ের ঘরে এসে দেখল, তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চুল ছড়িয়ে আছে বালিশে। কেমন শুকিয়ে গেছেন। এতক্ষণ না খেয়ে থাকলে তো আরো শুকাবেন। ডেকে খেতে বলা উচিত। আপা থাকলে কত যত্ন করত!

পূর্ণা ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা।’

হেমলতা সাড়া দিলেন না। পূর্ণা ঝুঁকে হেমলতার গায়ে হাত দিয়ে ডাকল, ‘ও, আম্মা। উঠো এবার। দুপুর হয়ে গেছে। আম্মা…ও আম্মা।’

হেমলতা চোখ খুললেন, চোখের মণি ফ্যাকাসে। তিনি উঠতে চাইলে হুট করে হাত কাঁপতে থাকল।

পূর্ণা উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে আম্মা?’

হেমলতা কিচ্ছুটি বললেন না। পূর্ণা হেমলতাকে ধরে ওঠাল।

হেমলতা পূর্ণার দিকে চেয়ে থেকে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘কে তুমি?’

৪০

হেমলতার এহেন প্রশ্নে চমকে উঠল পূর্ণা। চাপা স্বরে অবাক হয়ে উচ্চারণ করল, ‘আম্মা!’

সেকেন্ড কয়েক পর তার উপর থেকে হেমলতা চোখ সরিয়ে নিলেন। পূর্ণা বলল, ‘আমাকে চিনতে পারছ না?’

হেমলতা বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, ‘ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। তাই এমন হয়েছে। সবার খাওয়াদাওয়া হয়েছে?’

পূর্ণা তখনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। হেমলতা পূর্ণার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী রে? কিছু জিজ্ঞাসা করেছি না?’

‘হয়েছে। দুপুরের আজান পড়বে।’

‘এতক্ষণ ঘুমিয়েছি! আরো আগে ডাকতে পারলি না?’

‘ঘুমাচ্ছিলে আরাম করে। তাই ডাকিনি।’

‘ফজরের নামাজটা পড়া হলো না। এখন কাজা পড়তে হবে। তুই নামাজ পড়েছিলি তো?’

‘পড়েছি।’

‘খেয়েছিস?’

‘না।’

‘এরকম করে আর কতদিন চলবে? যা খেয়ে নে।’

পূর্ণা বাধ্য মেয়ের মতো হেঁটে চলে গেল রান্নাঘরে। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। কতক্ষণ না খেয়ে রাগ করে থাকা যায়? হেমলতা খোলা চুল হাত খোঁপা করে নিয়ে কলপাড়ের দিকে যান। অজু করে ঘরে ঢোকার সময় দেখেন, পূর্ণা খাচ্ছে। তিনি পূর্ণার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘খাওয়া শেষ করে ঘরে আসিস।’

পূর্ণা খেয়েদেয়ে থালা ধুয়ে গুছিয়ে রাখল। রান্নাঘর থেকে বের হয়ে দেখে, চারা গাছ লাগানোর জন্য বাসন্তী উঠানের এক কোণে বসে মাটি খুঁড়ছেন। পূর্ণা দৃষ্টি সরিয়ে হেমলতার ঘরে চলে এলো। এসে দেখে হেমলতা জায়নামাজে অসম্ভব উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন।

পূর্ণা মৃদুকণ্ঠে ডাকল, ‘আম্মা?’

হেমলতা চমকে তাকান। পূর্ণা দ্বিতীয়বারের মতো অবাক হয়। চমকানোর কী এমন হলো? হেমলতা দ্রুত নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে স্বাভাবিক হয়ে জায়নামাজ ভাঁজ করলেন ধীরেসুস্থে। এরপর পূর্ণাকে কাছে এসে বসতে বললেন। পূর্ণা পাশে এসে বসে। হেমলতা ভারি কণ্ঠে বললেন, ‘আপার (বাসন্তী) প্রতি তোর এত রাগ কেন? আম্মাকে বল?’

‘এখন রাগ নেই।’

‘প্রেমা-প্রান্তের মতো মিলেমিশে থাকতে পারবি না? ওরা বড়ো আম্মা ডাকে। তুই শুধু খালাম্মা ডাকবি।’

‘মাত্র উঠলে ঘুম থেকে। আগে খাও। এরপর কথা বলব।’

‘আমি এখনই বলব। কথাগুলো বলব বলব করে বলা হয়নি। দেখ পূৰ্ণা, আপা অন্য পরিবেশে বড়ো হয়েছে, থেকেছে তাই একটু অন্যরকম। তাই বলে মানুষটা তো খারাপ না। আপা সত্যি একটা সংসার চায়। পরিবারের একজন সদস্য ভাবতে দোষ কোথায়? বাকি জীবনটা কাটাক না আমাদের সঙ্গে। আমার কাজকর্মের একজন সঙ্গীও হলো। বয়স তো হচ্ছে, একা সব সামলানো যায়? আপারও বয়স হচ্ছে। কিন্তু দুজনে মিলে তো কাজ করতে পারব। কয়দিন পর তোর বিয়ে হবে, প্রেমার বিয়ে হবে। শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি। তখন আমার একজন সঙ্গী থাকল। আর এমন নয় যে, আপার মনে বিষ আছে। আপারও দরকার ভালো সঙ্গ, ভালো পরিবেশ, ভালো সংসার। আমি দেখেছি, আপা কত সুখে আছে এখানে। প্রেমা-প্রান্তর জন্য জান দিয়ে দিতে প্রস্তুত। নিঃসন্তান বলেই হয়তো এত মায়া বাচ্চাদের জন্য। আপা কিন্তু এখন আমাদের ছাড়া অসহায়। তার মা মারা গেছে। বাবা তো নেই। আত্মীয়-স্বজন নেই। এই বয়সে যাবে কোথায়? আমরা একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারি না? সতিন হলেই সে খারাপ হবে, সৎ মা হলেই সে খারাপ হবে এমন কোনো বাণী আছে?’

পূর্ণা বেশ অনেকক্ষণ চুপ রইল। এরপর বলল, কিন্তু উনি অনেক সাজগোজ করেন। যদিও আমাকে কিছুক্ষণ আগে বলেছেন, আর সাজবেন না। তবে উনার কথার ধরন আমার ভালো লাগে না। স কে ছ উচ্চারণ করেন, শুদ্ধ-অশুদ্ধ মিলিয়ে জগাখিচুড়ি বানিয়ে কথা বলেন।’

হেমলতা পূর্ণার কথায় হাসলেন। পূর্ণা ওড়নার আঁচল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হেমলতা পূর্ণার মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘তোর আপা যদি প্রান্তকে শুদ্ধ ভাষা রপ্ত করিয়ে দিতে পারে। তুই তোর বাসন্তী খালাকে স উচ্চারণ শিখাতে পারবি না?’

‘উনি শিখবেন?’

‘বললে অবশ্যই শিখবেন।

‘সত্যি?’

‘বলেই দেখ।’

‘এখন যাব?’

‘যা।’

‘যাচ্ছি।’

পূর্ণা ছুটে বেরিয়ে গেল। হেমলতা মৃদু হেসে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। সেলাই মেশিনের সামনে বসেন। অনেকগুলো কাপড় জমেছে। সব শেষ করতে হবে।

.

উঠানে বাসন্তীকে পেল না পূর্ণা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকল। বাসন্তী কলপাড় থেকে হাত পা ধুয়ে বেরিয়ে এসেছেন। পূর্ণা কথা বলতে গিয়ে দেখে জড়তা কাজ করছে। দুই-তিনবার ঢোক গিলে ডাকল, ‘শুনুন?’

বাসন্তী দাঁড়ালেন। পূর্ণাকে দেখে হাসলেন। পূর্ণা এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনাকে আমি পড়াব।’

‘কী পড়াইবা?’

‘লাহাড়ি ঘরের বারান্দায় আসেন আগে।’

বাসন্তী কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। তবুও পূর্ণার পিছু পিছু গেলেন। বারান্দার চৌকির উপর পূর্ণা বসল। পূর্ণার সামনে বাসন্তী উৎসুক হয়ে বসলেন। পূর্ণা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আপনাকে আমি দন্ত-স উচ্চারণ শেখাব।’

‘দন্ত-ছ উচ্চারণ তো আমি পারি।’

‘আপনি দন্ত-স না বলে দন্ত-ছ বলেন। শুনতে ভালো লাগে না। বলুন, দন্ত-স।’

বাসন্তী চোখ ছোটো ছোটো করে বললেন, ‘দন্ত-ছ।’

‘হয়নি। বলুন, দন্ত-স।’

‘দন্ত-ছ।’

‘আবারও হয়নি। আচ্ছা বলুন, সংসার।’

‘ছংছার।’

‘স-ং-সা-র।’

‘ছ…সওও-ং-চ…সার।

সংসার উচ্চারণ করতে করতে পূর্ণার মুখের সামনে ঝুঁকে পড়েছেন বাসন্তী। পূর্ণা কপাল কুঁচকে বলল, ‘ওপরে চলে আসছেন কেন? দূরে বসুন। ‘ বাসন্তী দ্রুত সোজা হয়ে বসলেন। পূর্ণা বলল, ‘এবার বলুন, সন্তান।’

‘স…সন্তান।’

‘ফাটাফাটি! হয়ে গেছে। এবার বলুন, আসছে।’

‘আছছে।’

‘আরে, আবার ছ উচ্চারণ করছেন কেন? বলুন, আসছে। আ-স-ছে।’

‘আ-স-ছে।’

‘হয়েছে। এবার বলুন, সাজগোজ।’

‘সাজগোছ।’

.

দুপুরের খাবার খেতে হাওলাদার বাড়ির পুরুষেরা একসঙ্গে বসেছে। আলমগীর, খলিল সবাই আজ উপস্থিত। আমির দুই দিন পর শহরে ফিরবে, তাই চলে এসেছে আলমগীর। অতিরিক্ত গরম পড়েছে। বাড়ির চারপাশে এত গাছপালা তবুও একটু বাতাসের দেখা নেই। আমিনা, লতিফা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে অনবরত। খাবার পরিবেশন করছে পদ্মজা, ফরিনা আর রিনু। পদ্মজা আমিরের থালায় গোশত দিতেই আমির বলল, ‘তুমি কখন খাবে?’

পদ্মজা চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, ‘আম্মার সঙ্গে।’

‘এখন বসো না।’

‘জেদ ধরবেন না। অনুরোধ।’ ফিসফিসিয়ে বলল পদ্মজা।

মাছের তরকারি আনার জন্য রান্না ঘরে গেল সে, বাটিতে করে মাছের ঝোল নিয়ে ফিরে এলো। আমিরের দিকে চোখ পড়তেই আমির চোখ টিপল। ঠোঁট কামড়ে হাসল পদ্মজা। আলমগীরের থালায় মাছের ঝোল দেওয়ার সময় খেয়াল করল, আলমগীর বেশ ফূর্তিতে আছে। বয়স পঁয়ত্রিশ হবে। এসে একবারও রুম্পার কথা জিজ্ঞাসা করল না। বিস্ময়কর! বউয়ের প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া-ভালোবাসা যে নেই তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

রানি, লাবণ্য ছুটে এসে বাপ-চাচার মাঝে বসল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সবাই বিভিন্ন রকম আলোচনা করছে। রানির বিয়ে নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে। খুব দ্রুত রানির বিয়ে দিতে চায় তারা। আচমকা রানি গড়গড় করে বমি করতে আরম্ভ করল। বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল সবাই। প্রতিটি খাবারের থালা নষ্ট হয়ে যায়। আমিনা দ্রুত রানিকে ধরে কলপাড়ে নিয়ে যান। লাবণ্য, পদ্মজা, নুরজাহান, ফরিনা ছুটে গেল পিছু পিছু। বাড়ির পুরুষেরা হাত ধুয়ে উঠে পড়ে। মুহূর্তে একটা হইচই লেগে যায়।

রানি বমি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল কলপাড়েই। আমিনা হায় হুতাশ করে বিলাপ করছেন, ‘আমার ছেড়িড়ার কী হইল? কয়দিন ধইরা খালি বমি করতাছে। জিনের আছড় লাগল নাকি! কতবার কইছি যহন তহন ঘর থাইকা বাইর না হইতে।’

লাবণ্য তথ্য দিল, ‘আপা রাতেও ছটফট করে। ঘুমাতে পারে না।’

আমিনা কেঁদে কূল পাচ্ছেন না। রানির চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। তিনি রানিকে প্রশ্ন করলেন, ‘আর কী কষ্ট হয় তোর? ও আম্মা কবিরাজ ডাকেন। আমার ছেড়িডার কী হইল?’

রানি ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘মাথাডা খালি চক্কর মারে।’

নুরজাহান চোখ দুইটি বড়ো বড়ো করে প্রশ্ন করলেন, ‘এই ছেড়ি তোর শরীর খারাপ শেষ হইছে কবে?’

‘দুই মাস হবে,’ কথাটা বলে রানি চমকে উঠল। সবাই কী ধারণা করছে? সে চোখ তুলে ওপরে তাকাল। সবাই উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন করে তাকিয়ে আছে! রানির শরীর কাঁপতে থাকে। আমিনা মেয়েকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘এমন কিছু হয় নাই, আম্মা। আপনি ভুল বুঝতাছেন। আমার ছেড়ি এমন না।’

‘হেইডা কবিরাজ আইলে কওয়া যাইব। এই ছেড়ির জন্য যদি এই বাড়ির কোনো অসম্মান হয় কাইট্টা গাঙে ভাসায়া দিয়াম। মনে রাইখো বউ।’ নুরজাহানের রাগী স্বর। রানির গলা শুকিয়ে কাঠ! হৃৎপিণ্ড দ্রুত গতিতে চলছে। শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। একসময় মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল আমিনার কাঁধে। আমিনা চিৎকার করে উঠলেন, ‘ও রানি…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *