পদ্মজা – ২৫

২৫

বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পদ্মজা। তার পরনে শাড়ি রয়ে গেছে। আকাশের বুকে থালার মতো একখান চাঁদ। চাঁদের আলোয় চারদিক ঝিকমিক করছে। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিপোকার ডাক।

‘পদ্ম…’

পদ্মজা কেঁপে উঠে পেছনে ফিরে তাকাল। মোর্শেদকে দেখতে পেয়ে হাঁফ ছাড়ল গোপনে। মোর্শেদ বললেন, ‘তোর মায়ে কী আর উডে নাই?’

‘না, আব্বা।’

মোর্শেদ চিন্তিত ভঙ্গিতে কিছু ভাবলেন। বললেন, ‘তুই হজাগ ক্যান? যা ঘরে গিয়া ঘুমা। আমি ঘাটে যাইতাছি।’

‘আচ্ছা, আব্বা।’

মোর্শেদের যাওয়ার পানে পদ্মজা তাকিয়ে রইল। সে ভাবছে…কিন্তু কী ভাবছে তা নিজেই ধরতে পারছে না। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে উদাসীনতা কেটে গেল। শাড়ির আঁচল টেনে সাবধানে হেঁটে ঢুকল সদর ঘরে, ওখানে পাটি বিছিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা আত্মীয়রা ঘুমাচ্ছে। তাদের ডিঙিয়ে পদ্মজা হেমলতার ঘরে এলো। হেমলতা ঘুমাচ্ছেন বেঘোরে। শুনেছিল, লিখন শাহকে নিয়ে মা নিজ ঘরে এসেছিলেন। এরপর কী হলো কে জানে! সন্ধ্যার পর পূর্ণা জানাল, আম্মা ঘুমাচ্ছে। হেমলতা কখনো সন্ধ্যা সময় ঘুমান না। তাই পদ্মজা ঘোমটা টেনে হেমলতার ঘরে ছুটে আসে। মাকে এত শান্তিতে ঘুমাতে কখনো দেখেনি পদ্মজা। তাই আর ডাকেনি। কেউ ডাকতে আসলে তাড়িয়ে দিয়েছে। ঘুমাচ্ছে যখন, ঘুমাক নাহয়। এখন মধ্য রাত। হেমলতার মুখের সামনে মাটিতে বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে মাকে দেখছে পদ্মজা, তার গলা কাঁপছে।

শ্বশুর বাড়ি কীভাবে থাকবে সে! মাকে ছাড়া দুইদিন থাকতে গিয়ে এত বড়ো ঝড় বয়ে গেল। আর এখন কিনা সারাজীবনের জন্য মায়ের ছায়া ছেড়ে দিতে হবে! এই মুখটা না দেখলে তার দিন কাটে না…এই মানুষটার আদুরে শাসন ছাড়া দিন সম্পূর্ণ হয় না। পদ্মজা বিছানায় মাথা ঠুকে ফুঁপিয়ে উঠল। অস্ফুট করে ডাকল, ‘আম্মা।’

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা চোখ খুললেন। পদ্মজা খেয়াল করল না। সে কাঁদতে কাঁদতে চাপা স্বরে বলছে, ‘তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকব আম্মা! বিয়ে করাটা কী খুব দরকার ছিল?’

‘ছিল।’

পদ্মজা চমকে গিয়ে মাথা তুলল। গলার স্বর আগের অবস্থানে রেখে বলল, ‘কেন আম্মা?’

‘সব জানতে নেই, মা।’

পদ্মজা মাথা নত করে নাক টানছে। হেমলতা বললেন, ‘বিয়ে হতেই হবে। বর বদল হলে সমস্যা নেই। তোর কী আর কাউকে পছন্দ?

প্রশ্নটি শুনে পদ্মজা বিব্রত হয়ে গেল। হেমলতাও প্রশ্নটা করতে গিয়ে অস্বস্তি বোধ করছিলেন। পদ্মজা মাথা দুই পাশে নাড়িয়ে জানাল, তার আলাদা করে কাউকে পছন্দ নেই। হেমলতা উঠে বসেন। চুল খোঁপা করতে করতে প্রশ্ন করলেন, ‘রাত কী খুব হয়েছে? কারো সাড়া নেই যে।’

‘মাঝ রাত।’

‘আর তুই জেগে থেকে কাঁদছিস?’ মৃদু ধমকের স্বরে বললেন।

পদ্মজা নিরুত্তর। হেমলতা জানালার বাইরে চেয়ে দেখলেন চাঁদের আলোয় চারিদিক উজ্জ্বল। আজ জ্যোৎস্না রাত। চাঁদের আলো গলে ঘরের মেঝেতে এসে পড়ছে। তিনি বিছানা থেকে নামতে নামতে পদ্মজাকে তাড়া দিয়ে বললেন, ‘শাড়ি পালটে সালোয়ার-কামিজ পরে নে।’

‘কেন আম্মা?’

‘যা বলছি কর।’

পদ্মজা ঘরে গিয়ে শাড়ি পালটে নিলো। উঠানে এসে দেখে হেমলতার হাতে বৈঠা। পদ্মজা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘হাতে বৈঠা কেন?’

‘পূর্ণাকে নেব? নেওয়া উচিত। যা ওকে ডেকে নিয়ে আয়। প্রান্ত-প্ৰেমা যেন টের না পায়।’

পদ্মজা অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। হেমলতা তাড়া দিলেন, ‘যা তো!’

হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল পদ্মজা, কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিরল পূর্ণাকে নিয়ে; বেচারি ঘুমে ঢুলছে। হেমলতা ঘাটে এসে দেখেন মোর্শেদ নৌকায় বসে বিড়ি ফুঁকছেন

‘নৌকা ছাড়ো।’

মোর্শেদ দুই মেয়ে আর বউকে দেখে হকচকিয়ে গিয়েছেন। তার মধ্যে হেমলতা যেভাবে বললেন, নৌকা ছাড়ো—তা শুনে আরো ভড়কে গেলেন। চোখ বড়ো বড়ো করে প্রশ্ন করলেন, ‘ক্যান? কী অইলো?’

মোর্শেদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পদ্মজা-পূর্ণাকে নিয়ে হেমলতা নৌকায় উঠে স্থির হয়ে বসলেন। বৈঠা মোর্শেদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন, ‘জ্যোৎস্না রাতের নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছি আমরা। তুমি এখন আমাদের মাঝি।’ হেমলতা থামলেন। এরপর আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘লও, মাঝি, বৈঠা লও। ছাড়ো তোমার নৌকা। যত সিকি চাইবা তুমি ততই পাইবা।’

একসঙ্গে চারটা দুঃখী মানুষ হেসে উঠে। মোর্শেদ বৈঠা হাতে নিয়ে নৌকা ছাড়লেন। হুট করেই যেন অনুভব হচ্ছে, যুবক কালের রক্ত শরীরে টগবগ করছে।

এই তো তার সংসার, এই তো তার আনন্দ।

.

রাতের নির্মল বাতাস বইছে। মাদিনী নদীর স্বচ্ছ জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি। কচুরিপানারা ভেসে যাচ্ছে। সবকিছু সুন্দর, মুগ্ধকর। পূর্ণার বুকের ভারটা খুব হালকা লাগছে। পদ্মজা প্রাণভরে নিশ্বাস নিলো, রগে রগে যেন বয়ে গেল শান্তি। আল্লাহ তায়ালা যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যে যেকোনো দুঃখী মানুষকে সুখী অনুভব করানোর মন্ত্র ঢেলে দিয়েছেন।

‘মোর্শেদ নাকি গো?’ হিন্দুপাড়া থেকে কেউ একজন চেঁচিয়ে ডাকল।

মোর্শেদ এক হাত তুলে জবাব দিলেন, ‘হ দাদা, আমি।’

রাইতের বেলা যাইতাছ কই?’

‘মেয়ে-বউ লইয়া জ্যোৎস্না পোহাইতে বাইর হইছি দাদা।’

‘তোমাদেরই দিন মিয়া।

মোর্শেদ আর কিছু বললেন না, হাসলেন। ওপাশ থেকেও আর কারো কথা শোনা গেল না। নৌকা আটপাড়া ছেড়ে হাওড়ে ঢুকে পড়েছে। সা সা করে বাতাস বইছে। গায়ের কাপড় উড়ছে। হেমলতা দুই মেয়ের মাঝে এসে বসলেন, চাদর নিয়ে এসেছেন। দুই মেয়েকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে ঢেকে দিলেন চাদরে। বাতাসে চাদর উড়ে প্যাতপ্যাত আওয়াজ তুলছে। চাঁদটা একদম মাথার ওপর। তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে! মোর্শেদ মনের সুখে গান ধরলেন—

লোকে বলে বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার
কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার।।
ভালা কইরা ঘর বানাইয়া
কয়দিন থাকমু আর
আমি কয়দিন থাকমু আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি
পাকনা চুল আমার।

পাকনা চুল আমার বলতেই পূর্ণা ফিক করে হেসে ফেলল। পদ্মজাকে ফিসফিসিয়ে বলল, আব্বা বোধহয় এখনো জোয়ান থাকতে চায়।’

পদ্মজা হেসে চাপা স্বরে বলল, ‘চুপ থাক। আব্বা কী সুন্দর গায়!’

মোর্শেদ গেয়ে যাচ্ছেন —

এ ভাবিয়া হাসন রাজা
হায়রে, ঘর-দুয়ার না বান্ধে
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায়
তাই ভাবিয়া কান্দে।।
লোকে বলে ও বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার।।
জানত যদি হাসন রাজা
হায়রে, বাঁচব কতদিন
বানাইত দালান-কোঠা
করিয়া রঙিন।।
লোকে বলে ও বলেরে
ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার।

মোর্শেদ থামলেন। তিন মা-মেয়ে একসঙ্গে হাতের তালি দিল, সেই আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠল চারপাশ। এত সুন্দর রাত বার বার ফিরে আসুক। মোর্শেদ হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন সামনে থাকা তিনটা মানুষের দিকে। তাদের চোখেমুখে খুশি ঝিলিক মারছে। অথচ তিনি জানেন একেকজন কতটা দুঃখী। মোর্শেদ ঢোক গিলে লুকায়িত এক সত্যের কষ্ট পুনরায় লুকিয়ে যান। হেমলতা আর তিনি ছাড়া এই কলিজা ছেঁড়া কষ্ট কেউ জানে না। মোর্শেদ হেসে বললেন, ‘এই অভাগা মাঝিকে কী আপনারা আপনাদের মাঝে জায়গা দেবেন?’

মোর্শেদের কণ্ঠে শুদ্ধ ভাষায় মিষ্টি আবদার শুনে পদ্মজা পুলকিত হয়ে উঠল। আজ সব কিছু কত সুন্দর! পূর্ণা বলল, ‘দেব। এক শর্তে, নৌকা চালানোর বিনিময়ে সিকি যদি না নেন।’

মোর্শেদ মেয়ের রসিকতা শুনে হা হা করে হাসেন। সেই হাসি বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে কানে। তিনি বৈঠা রেখে হেমলতার সামনে এসে বসেন। নৌকা নিজের মতো যেদিকে ইচ্ছে ছুটে চলছে।

মোর্শেদ হেমলতাকে বললেন, ‘দুইডা ছেড়িরে খালি তুমি ধইরা রাখবা? ছাড়ো তো এইবার। আয় রে, তোরা আমারে ধারে আইয়া ব।’

পদ্মজা অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। হেমলতা যেতে বললেন। পদ্মজা মোর্শেদের ডান পাশে বসল, আর পূর্ণা বাঁ-পাশে। মোর্শেদ পূর্ণাকে এক হাতে, পদ্মজাকে আরেক হাতে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠেন 1 অপরাধী স্বরে বললেন, ‘আমি বাপ হইয়া পারি নাই আমার ছেড়িদের বেইজ্জতির হাত থাইকা রক্ষা করতে। আমারে মাফ কইরা দিস তোরা।’

মোর্শেদ কখনো এত আদর করে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরেননি। এই প্রথম ধরেছেন, আবার কাঁদছেনও! পদ্মজার চোখ দুটি জলে ভরে ওঠে। হেমলতা মোর্শেদের পায়ের কাছে বসলেন। মোর্শেদের হাঁটুতে মাথা রেখে, দুই মেয়ের হাত চেপে ধরলেন। কেটে যায় অনেকগুলো মুহূর্ত। নৌকা হাওড়ের পানির স্রোতে একবার এদিক, তো আরেকবার ওদিক যাচ্ছে। বাতাসে চারজনের চোখের জল শুকিয়ে মিশে গেছে ত্বকের সঙ্গে।

নিস্তব্ধতা ভেঙে পদ্মজা বলল, ‘আজ আমি বুঝলাম জীবনে সুখ বা দুঃখ—কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়। দুঃখে মর্মাহত না হয়ে সুখের সময়টা তৈরি করে নিতে হয়। তাহলেই জীবনে সুখকর মুহূর্ত আসে। আবার সুখ সর্বক্ষণ সঙ্গে থাকে না। দুনিয়ার লীলাখেলার শর্তে দুঃখ বার বার ফিরে আসে।’

হেমলতা পদ্মজার দিকে না তাকিয়ে পদ্মজার ডান হাতে পরম মমতায় চুমু খেলেন। চাঁদটা অর্ধেক হয়ে এসেছে। খুব তাড়াতাড়ি আকাশে মিলিয়ে যাবে।

২৬

হাওরে বিশাল জলরাশি। কখনো ঢেউয়ে উথাল-পাতাল, আবার কখনো মৃদু বাতাসে জলের ওপর চাঁদের প্রতিচ্ছবির খেলা। নৌকা বাজারের দিকে যাওয়ার পথ ধরেছে। তাই মোর্শেদ নিস্তব্ধ বৈঠক ভেঙে বৈঠা নিয়ে বসেন, নৌকা নিয়ন্ত্রণে এনে যেতে থাকেন রাধাপুর হাওড়ের দিকে। ওড়নার ঘোমটার আড়ালে কখন খোঁপা খুলে গেছে, পদ্মজা খেয়াল করেনি। হেমলতা দেখেন পদ্মজার চুল হাওড়ের জলে ডুবে আছে। তিনি মৃদু স্বরে পদ্মজাকে বললেন, ‘চুল ভিজে যাচ্ছে পদ্ম।’

পদ্মজা দ্রুত সামলে নিলো। খোঁপা করে ঘোমটা টেনে নিয়ে বলল, কখন খুলে গেছে খেয়াল করিনি।’

অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না। হেমলতা চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছেন একমনে।

পদ্মজা ডাকল, ‘আম্মা?’

হেমলতা অশ্রুভরা চোখে তাকালেন। পদ্মজা কিছু বলার আগে তিনি বললেন, ‘পূর্ণা গল্প শুনবি?’

পূর্ণা গল্প বলতে পাগল, শুনতে খুব ভালোবাসে। খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলল, ‘শুনব।’

‘কষ্টের গল্প কিন্তু।’

‘গল্প হলেই হলো।’

হেমলতা হাসলেন। পদ্মজা নড়েচড়ে বসল। সে আন্দাজ করতে পারছে তার মা কোন গল্প বলবে। হেমলতা দুই হাতে জল নিয়ে মুখ ধুয়ে নিয়ে একবার মোর্শেদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। পেছন ঘুরে বসে প্রশ্ন করলেন ‘মুখ না দেখে গল্প শুনতে ভালো লাগবে?’

পূর্ণা মুখ গোমড়া করে না বলতে যাচ্ছিল। পদ্মজা এক হাতে খপ করে ধরে আটকে দিল। মাকে বলল, ‘যেভাবে ইচ্ছে বলো।’

হেমলতা বড়ো করে দম নিয়ে বলা শুরু করলেন, আব্বার প্রথম স্ত্রী মারা যায় অল্প বয়সে। আব্বা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন; একজন বুদ্ধিমান, উদার মনের মানুষ। অন্যদিকে আম্মাকে যৌতুকের জন্য মুখে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল তার প্রথম স্বামী। বাপের সংসারে এসে সমাজের তোপে পড়তে হয় আম্মাকে। আব্বার উদার মন ছিল, তাই তিনি অবলা-অসহায় আম্মাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। আমার নানার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। নানা সানন্দে রাজি হয়ে যান। রাজি হবেনই না কেন? স্বামীর বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া বিবাহিত নারীকে কে-ই বা বিয়ে করতে চায়? আম্মা-আব্বার বিয়ের বছর দেড়েক হতেই হানি আপার জন্ম হয়। তার দুই বছরের মাথায় আমার আগমন ঘটে।’

কথার মাঝে পদ্মজা পুলকিত হয়ে বলল, ‘সেদিন নিশ্চয় গাছে গাছে ফুল মাঝে ফুটেছে?’

হেমলতা ম্লান হেসে বললেন, ‘শুনেছি আমার গায়ের রং দেখে আম্মা নাক কুঁচকেছিল। আমার বয়স যখন তিন মাস, তখন আম্মার আগের স্বামী আম্মাকে ফিরিয়ে নিতে আসে। আব্বার তখন আর্থিক সমস্যা ছিল। দিনে দুইবেলা খাওয়াতেও হিমশিম খেতেন।

‘তাই বিপদে পাশে থাকা আব্বাকেসহ আমাদের দুই বোনকে ছেড়ে স্বার্থপর মা পালিয়ে যায় তার প্রথম স্বামীর কাছে। আব্বা ছোটো ছোটো দুই মেয়েকে নিয়ে মাঝ নদীতে পড়েন। কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন। আব্বার ফুফু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, চলে আসেন আমাদের কাছে; আপা আর আমার দায়িত্ব নেন। হুট করেই আব্বার আর্থিক অবস্থা উন্নত হতে থাকে। গৃহস্থিতে রহমত ঝরে পড়ে। পাঁচ বছর পর আম্মা ফিরে আসে। বিধ্বস্ত অবস্থা, ফরসা মুখ মারের চোটে দাগে দাগে বিশ্রি হয়ে গেছে। তবে একা আসেনি, দুই বছরের এক ছেলে নিয়ে ফিরে এসেছে। তখন আমাদের কুঁড়ে ঘরের বদলে বিশাল বাড়ি হয়েছে। আব্বা প্রথম মানেননি। আম্মা আব্বার পায়ে পড়ে কাঁদে, ক্ষমা চায়। আব্বা আবার আগের ভুল করেন। মেনে নেন আম্মাকে। আম্মার ছেলের নাম বিনোধ ছিল, আব্বা নতুন নাম দেন হানিফ। আম্মা আমাকে সহ্য করতে পারত না। কিন্তু আব্বার চোখের মণি ছিলাম। আব্বার আড়ালে আম্মার দ্বারা নির্যাতিত হয়েছি প্রতিদিন। ছয় বছর হতেই স্কুলে ভরতি করে দেন আব্বা। হানি আপা তখন স্কুলে পড়ে। আমি…’

‘থামলে কেন, আম্মা?’ অধৈর্য হয়ে বলল পদ্মজা।

হেমলতা ভ্রুকুটি করে বললেন, ‘আম্মার ব্যাপারে আর বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। সে এখন অনুতপ্ত। আফসোস করে, কাঁদে। বলতে ভালো লাগছে না।’

শীতল বাতাসে সবার শরীর কাঁটা দিচ্ছে। চাঁদটা ছোটো হয়ে গেছে অনেক। মোর্শেদ এক ধ্যানে বৈঠা দিয়ে জল ঠেলে নৌকা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে। হেমলতা আবার বলতে শুরু করলেন, ‘মেট্রিক দেয়ার পর আম্মা পড়াতে চাচ্ছিল না। আব্বার জন্য ঢাকার কলেজে পড়ার সুযোগ পাই হোটেলে উঠি। আব্বা নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। জানিস পদ্ম, কলেজে আমি সবার ছোটো ছিলাম। সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকত। শাড়ি পরতাম বলে একটু বড়ো লাগত অবশ্য। সবসময় সুতি শাড়ি পরে বেণী বেঁধে রাখতাম। কারো সঙ্গে মিশতাম না। ভীষণ ভীতু ছিলাম। রিমঝিম নামে খ্রিষ্টান এক মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। মেয়েটা এত সুন্দর ছিল দেখতে, ঠিক তোর মতো সুন্দর। চোখের মণি ছিল ঘোলা। তার নাকি শ্যামলা মানুষ ভালো লাগে; তাই নিজে যেচে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। কয়েকদিনের ব্যবধানে আমরা খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি। ইংলিশে যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ড। রিমঝিমের সঙ্গে মাঝে মাঝে ওর বড়ো ভাই আসত। নাম ছিল—যিশু

যিশু একদম রিমঝিমের আরেক রূপ। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ছিল দুই ভাই-বোনের। যিশু ভাইয়া বলে ডাকতাম তাকে। যিশু ভাইয়া মজা করে বলতেন, ধর্ম এক হলে হেমলতাকেই বিয়ে করতাম। পদ্মজা-পূর্ণা খারাপ লাগছে শুনতে?’

‘না, আম্মা, এক স্বরে বলল দুজন।

পদ্মজা বলল, ‘পরে কী হলো?’

‘তখন অলন্দপুর থেকে রাজধানীতে চিঠি পৌঁছাতে দুই সপ্তাহ লাগত। একদিন কলেজ ছুটির পথে হানি আপার চিঠি পেলাম। পাশে রিমঝিম ছিল যিশু ভাই সবেমাত্র এসেছেন রিমঝিমকে নিয়ে যেতে। চিঠি পড়ে জানতে পারি, আব্বা হাওড়ে গিয়েছিলেন মাছ ধরতে। আব্বার নৌকার চেয়ে কয়েক হাত দূরের নৌকায় সুজন নামে এক ছেলে ছিল। তখন ভারি বর্ষণ হচ্ছিল। বজ্রপাত হচ্ছিল একটার পর একটা। একটা বজ্রপাত সুজনের ওপর পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটা ঝলসে যায়। আব্বা ছিটকে পড়েন জলে। দূর থেকে এক দল জেলে ঘটনাটি দেখতে পায়। তারা আব্বাকে তুলে নিয়ে যায় বাড়িতে। এরপর থেকেই আব্বা কানে শুনতে পান না, ঠিক করে হাঁটতে পারেন না; মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়ে। এই খবর শোনার পর হাউমাউ করে কান্না শুরু করি। কখনো একা অলন্দপুর আসিনি, আব্বা গিয়ে আনতেন। খুব অসহায় হয়ে পড়ি, কী করে বাড়ি যাব? যিশু ভাই সব শুনে, আমার কান্না দেখে বললেন, বিকেলের ট্রেনে অলন্দপুর নিয়ে যাবেন। আমি তখনো কাঁদছিলাম। একবার শুধু অলন্দপুর যেতে চাই। আব্বাকে দেখতে চাই। যদিও জানতাম, অনেকদিন হয়ে গেছে এই দুর্ঘটনার।

‘আটপাড়া পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যায়। বাড়ি এসে দেখি সদর ঘরের দরজায় তালা মারা, কেউ নেই বাড়িতে। মুরগি আর গরু-ছাগল ছাড়া। বারান্দার ঘরে দরজা ছিল না। শুধু একটা চৌকি ছিল। বড্ড ক্লান্ত ছিলাম। চৌকিতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙে আম্মার চেঁচামেচিতে। যিশু ভাইও নিজের অজান্তে আমার পাশে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি। দীর্ঘ যাত্রার কারণে আমার মতোই তিনি ক্লান্ত ছিলেন। আমার জন্মদাত্রী মা গ্রামবাসী ডেকে চেঁচাতে থাকেন, যেন হাতেনাতে চোর ধরেছেন। অবস্থা বেগতিক দেখে ভড়কে যাই। কিছু বলতে পারিনি। যিশু ভাই সবাইকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে, কেউ বুঝেনি। তখন নিয়ম খুব কঠিন ছিল। যিশু ভাই খ্রিষ্টান শুনে সবাই আরো ক্ষেপে যায়। আব্বার সামনে গ্রামবাসী আমাদের দুজনের মাথা ন্যাড়া করে দিল। কোমর সমান চুল ছিল আমার। মাথা ন্যাড়া করতে গিয়ে মাথার চামড়া ছিঁড়ে ফেলে। রক্ত বের হতে থাকে গলগল করে। আমার করুণ অবস্থা দেখে আম্মার তখন হুঁশ আসে। গ্রামবাসীর হাত থেকে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি। গায়ের রং কালো, তার ওপর রক্তাক্ত ন্যাড়া মাথা। কী যে বিশ্রি রূপ হয়েছিল!

‘আমি আমার একমাত্র ভরসার আব্বাকে চিৎকার করে ডেকে কেঁদেছিলাম। আব্বা শোনেননি, আমার দিকে শুধু হাঁ করে তাকিয়েছিলেন। কিছু লোক যিশু ভাইকে অনেক মারধর করে। সেদিন রাতেই উনাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ছুঁড়ে ফেলে আসে নদীর পাড়ে। গরুর ঘরে গোবরের ওপর বেঁধে রাখে আমাকে। দূরদূরান্তরের মানুষ দেখতে আসে। আমি তখন নিশ্বাসে নিশ্বাসে নিজের মৃত্যু কামনা করেছি। একবার বাঁধনছাড়া হতে পারলে আত্মহত্যা করব বলে পণ করি। হাত বাঁধা ছিল, তাই দাঁত দিয়ে নিজের হাঁটুতে বোকার মতো কামড় দিতে থাকি একটার পর একটা…যাতে মরে যাই। যেই দেখতে আসত সেই বিশ্রি গালি দিয়ে যেত। কেউ কেউ লাথি দিয়েছে। রাধাপুরের হারুন রশীদ আছে না? উনার আব্বা তখন অলন্দপুরের মাতব্বর ছিলেন। উনার গোয়ালঘরেই বন্দি ছিলাম। দুই দিন পর আমাকে ছাড়ে। ছাড়া পেয়েই ইচ্ছে হচ্ছিল, গলায় কলসি বেঁধে ছুটে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেই। কিন্তু পারিনি। শরীরে একটুও শক্তি ছিল না। দৌড়ে পালাতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ি গোয়ালঘরের বাইরে। ধারাল কিছু একটা ছিল মাটিতে। মাটিতে পড়তেই হাতের বাহু ছিঁড়ে গলগল করে নামে রক্তের ধারা। এই যে আমার বাহুর দাগটা, এটা সেদিনই হয়েছে।’

হেমলতা মেয়েদের দাগটা দেখানোর জন্য ঘুরে তাকান। দেখেন তার দুই মেয়ে মুখে হাত চেপে কাঁদছে।

হেমলতা হাসার চেষ্টা করে বললেন, ‘তোরা মরাকান্না শুরু করেছিস কেন?’

হেমলতার কথা শেষ হতেই ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুই মেয়ে ছুটে আসে তার দিকে। নৌকা দুলে ওঠে। হেমলতা চমকে গিয়ে দ্রুত নৌকা ধরে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করলেন। চিৎকার করে ওঠেন, ‘আরে…’

কথা শেষ করার পূর্বেই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুই মেয়ে। জড়িয়ে ধরেই আম্মা আম্মা বলে কাঁদতে থাকে। দুই মেয়ে এত শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে যে হেমলতার মনে হচ্ছে এখনি দম বেরিয়ে যাবে। তাদের কান্না থামার কোনো লক্ষণ নেই। হেমলতা দুজনের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেন। কিছুতেই কিছু হলো না।

তারা কেঁদেই চলেছে।

হেমলতা কঠিন স্বরের ভান করে মোর্শেদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘নৌকা ঘুরাও। এদের আর কিছু বলব না।’

পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলল, ‘আর কাঁদব না। পূর্ণা আর কাঁদিস না। তোমাকে শুধু জড়িয়ে রাখি?’

হেমলতা পদ্মজার মাথায় চুমু দিয়ে বললেন, ‘রাখ।’

পূর্ণা নাক টানছে। হেমলতা বলছেন, ‘আমাদের এক ঘরে করে দেওয়া হলো। বাজারে ভেষজ উপায়ে আব্বার চিকিৎসা চলছিল। সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। কেউ পরিবারের মুখও দেখতে চায় না। দেখলেই এটা-ওটা ছুঁড়ে দিত। বলা হয়নি, সেদিন রাতে আব্বা-আম্মা মামার বাড়ি ছিল। ওই বাড়ির পাশে এক ডাক্তার থাকত, আব্বাকে দেখাতে গিয়েছিল। হানি আপার বিয়ে দেয়ার জন্য আম্মা উঠেপড়ে লাগে। তখন হিমেল আম্মার পেটে, সাত মাস চলে। আমার ওপর আম্মার মার প্রতিদিন চলতেই থাকে। আমার জন্য পরিবারের এত ক্ষতি হলো…হানিফ স্কুলে যেতে পারে না…সবাই দূর দূর করে…হানি আপার বিয়ে হয় না…আব্বার চিকিৎসা হয় না… বিপদ-আপদে কেউ পাশে আসে না…ওদিকে হিমেল আসার সময় ঘনিয়ে এসেছে…কোনো দাত্রী আসেনি।

‘আম্মা একা যুদ্ধ করে হিমেলকে জন্ম দেয়। সব মিলিয়ে আমাদের জীবন নরক হয়ে ওঠে। বছর দুয়েকের মধ্যে আব্বা কিছুটা সুস্থ হন আল্লাহর রহমতে, হাঁটাচলা করতে পারেন…আগের মতো সবকিছু না বুঝলেও মোটামুটি বুঝতেন। হানি আপার বিয়ে ঠিক হলো। বনেদি ঘর থেকে প্রস্তাব এসেছিল। শর্ত একটাই—পাঁচ বিঘা জমি দিতে হবে। আমাদের জমি ছিল সাড়ে পাঁচ বিঘা। আম্মা পাঁচ বিঘা জমি দিয়েই হানি আপার বিয়ে দিলেন। সবকিছু স্বাভাবিক হলো। যদিও মাঝে মাঝে অনেকে কথা শুনিয়েছে। একসময় আমার বিয়ের প্রস্তাবও এলো। তোদের আব্বার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যে জানতে পারি তোদের আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী আমি।’

শেষ কথাটা হেমলতা মোর্শেদের দিকে তাকিয়ে বললেন। মোর্শেদ চোখের দৃষ্টি নত করে ফেলেন। পূর্ণা খুব অবাক হয়ে তাকাল মোর্শেদের দিকে। হেমলতা পূর্ণাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘তোর আব্বাকে ভুল বুঝিস না মা। ভালোবাসার ওপর কিছু নেই। সে তার প্রেমিকাকে ভালোবেসে লুকিয়ে বিয়ে করেছিল। কাউকে জানতে দেয়নি আমাকে তার পছন্দ ছিল না। একসময় বিরক্ত হয়ে অনেক মারধোর করে। ভীষণ বদমেজাজি আর জেদি ছিল তোদের আব্বা। জোর করে তোদের দাদা বিয়ে করিয়েছিলেন, তাই রাগ মেটাত আমার উপর। বাদ সেসব কথা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। জান বাঁচানোর তাগিদে মানুষ যেদিকে পারে পালাতে থাকে। অলন্দপুরে পাকিস্তানি ক্যাম্প তৈরি হয়। শহর থেকে একটা দল আসে, যারা যুদ্ধ করতে চায় তাদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে। তোদের আব্বা তার প্রথম স্ত্রীর কাছে বেশি থাকত। আবার তোর দুই চাচা যুদ্ধে চলে যায়। আমি একা ছিলাম খালি বাড়িতে। চারিদিকে অত্যাচার, জুলুম। ইচ্ছে করে দেশের জন্য কিছু করতে। মনে সাহস নিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি কমান্ডার আবুল কালামের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। প্রধান শিক্ষক গোপনে গ্রামের যুবক-যুবতীদের অনুপ্রেরণা দিতেন যুদ্ধের জন্য। এ খবর একসময় পাকিস্তানিরা পেয়ে গেল। তিনি শহিদ হলেন।

‘ট্রেনিং-এ অংশ নিয়ে হয়ে উঠলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রথম অপারেশনে আমরা সফল হই, উড়িয়ে দিই অলন্দপুরের ক্যাম্প। এরপর চলে যাই আরেক এলাকায়। হাতে রাইফেল নিয়ে পরবর্তী অপারেশনে নামি। তখন ধরা পড়ে যাই পাকিস্তানিদের হাতে। বন্দি করে কারাগারে। স্বচক্ষে দেখি ধর্ষণ, শারিরীক অত্যাচার। কী বর্বরতা তাদের! রড দিয়ে পিটিয়েছে। পিঠের দাগগুলো এখনো আছে। আরো কয়দিন থাকলে হয়তো আমিও ধর্ষিত হতাম। তার আগেই আবুল কালামের বুদ্ধির কাছে হেরে গেল তারা। ফেরার আগে চোখ বন্ধ করে এক নিশ্বাসে দুইজনকে ছুরি দিয়ে হত্যা করে আসি।

‘দেশ স্বাধীন হয়। চারিদিকে স্বাধীনতার উল্লাস। আমি তখন হাসপাতালে, চিকিৎসাধীন। আরো অনেকে ছিল। সেই হাসপাতালেই যিশু ভাইয়েরও চিকিৎসা চলছিল। তিনিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। রিমঝিমের সঙ্গে ফের দেখা হলো। এক মাস লাগল সুস্থ হতে। ফেরার সময় সঙ্গে আসে রিমঝিম আর যিশু ভাই। পথে বার বার করে বললাম, তোমাদের মতো দেখতে যেন আমার একটা মেয়ে হয়। অলন্দপুরের বাজারে নামিয়ে দিয়ে ওরা আর আসেনি, ফের যদি গ্রামের লোক দেখে ফেলে। কিন্তু আমার আশঙ্কাই ঠিক হলো। অনেকে যিশু ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে দেখে ফেলে। বাড়িতে ফিরে দেখি তোদের আব্বা এসেছে। তিন মাস পর জানতে পারি আমি মা হব। মনে প্রাণে একটা সুন্দর মেয়ে চাইতে থাকি আল্লাহর কাছে। ঘুমালে স্বপ্ন দেখি রিমঝিমকে। আমার মন খুব চাইত রিমঝিমের মতো সুন্দর মেয়ে। ঠিক তাই হলো।

‘কিন্তু রটে গেল বদনাম। অনেকে বলে তারা যিশুর সঙ্গে আমাকে দেখেছে, এতদিন যিশুর কাছে ছিলাম; তারই সন্তান পদ্মজা। সেজন্যই এত সুন্দর। আর এত মিল! তোদের আব্বাও বিশ্বাস করল। আল্লাহ চাইলে সব পারে কেউ বিশ্বাস করল না। কিন্তু জানিস, পদ্ম? তোর জন্মের পর থেকেই আমি অলৌকিকভাবে খুব শক্ত আর কঠিন হয়ে পড়ি। কেউ কিছু বললে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়ে দেই। তোর সম্পর্কে কেউ কিছু বলতে আসলে দা নিয়ে তেড়ে যাই। এ খবর ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। তার মধ্যে কমান্ডার আবুল কালাম আসেন অলন্দপুরে। গ্রামের অনেকে যুদ্ধে গিয়েছিল। আমি ছাড়া আর একজন ফিরেছিল, বদর উদ্দিন নাম। বদর উদ্দিন এবং আবুল কালামের কাছ থেকে গ্রামবাসী জানতে পারে আমিও যুদ্ধ করেছি। হেমলতা একজন মুক্তিযোদ্ধা। এ খবর শোনার পর থেকে সবাই মোটামুটি সমীহ করে চলতে থাকে। একটা শক্ত জায়গা দখল করে বাঁচতে থাকি। প্রতিটি ঘটনা আমাকে ভেতরে ভেতরে শক্ত করেছে। তুই জন্মের পর বুঝেছি, আমি অনেক কিছু পারি। একা চলতে পারি।’

কথা শেষ করে হেমলতা হাঁফ ছাড়েন। চাঁদ ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগে। কিছুক্ষণের মধ্যে ফজরের আজান পড়বে। পদ্মজা-পূর্ণা স্তব্ধ।

‘এই দুনিয়ায় বাঁচার দুটি পথ—চুপ থাকো, নয় প্রতিবাদ করো। কিন্তু আমার নিয়ম বলে, সামনে চুপ থেকে আড়ালে আবর্জনাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দাও। যাতে এই আবর্জনার প্রভাবে আর কিছু না পঁচে।’

হেমলতার শেষ কথাগুলো পদ্মজার রগে রগে শিহরণ জাগাল। সে দূরে চোখ রেখে কিছু ভাবতে থাকে। মানুষের জীবনে কত গল্প! কত যন্ত্ৰণা! হেমলতা নৌকা ঘোরাতে বললেন। মোর্শেদ তাই করলেন, বাড়ি ফিরতে হবে। আজ পদ্মজার গায়ে হলুদ। নৌকা চলছে ঢেউয়ের তালে তালে। আগের উত্তেজনাটা আর কাজ করছে না। একটা ইঞ্জিন ট্রলারের শব্দ পাওয়া গেল। চারজন চকিতে তাকাল সেদিকে। ট্রলারে একজন লোক, একজন ভেতর থেকে সাদা কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা নিয়ে বেরিয়ে এলো। আবছা আলোয় সাদা কাপড়ে মোড়ানো বস্তুটি দেখে পিলে চমকে উঠল পূর্ণার। মানুষ মরার পর সাদা কাপড়ে যেভাবে মোড়ানো হয়, ঠিক তেমন। এক মুহূর্তে পরেই লোক দুটি মোড়ানো বস্তুটি ছুঁড়ে ফেলে পানিতে।

মোর্শেদ চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘কে রে?’

লোক দুটি একবার মোর্শেদের নৌকাটির দিকে দৃষ্টিপাত করে দ্রুত ট্রলারের ভেতর চলে গেল। মোর্শেদ তড়িঘড়ি করে বৈঠা চালিয়েও তাদের ধরতে পারল না। ট্রলারটি চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে গেল। যেখানে সাদা কাপড়ে মোড়ানো বস্তুটি ফেলা হয়েছে, সেখানে মোর্শেদের নৌকাটি পৌঁছাতেই হুট করে হেমলতা ঝাঁপিয়ে পড়েন পানিতে।

পদ্মজা আকস্মিক ঘটনায় চমকে গেল। আতঙ্ক নিয়ে ডাকল, ‘আম্মা!’

হেমলতার দেখা নেই। পদ্মজা নৌকা থেকে ঝাঁপ দিতে যাবে তখনি হেমলতা ভেসে উঠলেন। হাতে সাদা কাপড়ে মোড়ানো বস্তুটি। হেমলতা মুখ তুলে মোর্শেদ ও মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘লাশ।’

পূর্ণা লাশ শুনেই কাঁপতে থাকে। অথচ পদ্মজা স্থির, ঠান্ডা।

অন্যদিকে হেমলতা এই শেষ রাত্রিরে নদীর জলে ভেসে আছেন দুই হাতে মৃত মানুষ জড়িয়ে ধরে!

২৭

লাশটি নৌকায় তুলতেই পূর্ণা ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে মোর্শেদের পাশ ঘেঁষে বসল। তার মনে হচ্ছে চারিদিক থেকে প্রেতাত্মারা তাকিয়ে আছে, যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড় মটকে দেবে। ঘাড় মটকানোর কথা ভাবতেই পূর্ণার ঘাড় শিরশির করে উঠল। ‘ভূত, ভূত’ বলে চেঁচিয়ে উঠল সে। হঠাৎ পূর্ণার চিৎকার শুনে মোর্শেদ ভয় পেয়ে যান। এমনিতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে লাশ দেখে।

তিনি পূর্ণাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কোনহানে ভূত? ডরাইস না।’

মাথার কাছে বাঁধা দড়িটা খুলে কাপড় সরাতেই একটা মৃত মেয়ের মুখ দেখা গেল। হেমলতা আর পদ্মজা দুজনই ভেতরে ভেতরে চমকে উঠল। হেমলতা এদিক-ওদিক তাকিয়ে মানুষের উপস্থিতি দেখে নিলেন। এরপর কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলেন, ‘চিনি না তো। তুই চিনিস?’

পদ্মজা মাথা নাড়িয়ে জানাল, সে চেনে না। পরপরই মোর্শেদকে ডাকল পদ্মজা, ‘আব্বা, দেখেন তো আপনি চিনেন নাকি?

মোর্শেদ উঠে আসতে চাইলে পূর্ণা ধরে রাখে। মোর্শেদ পূর্ণাকে নিয়েই এগিয়ে আসেন। মৃত মেয়েটার মুখ দেখে বললেন, ‘না, এরে চিনি না।’

হেমলতা চিন্তায় পড়ে যান, শরীরের পশম কাঁটা দিচ্ছে। চারিদিক অন্ধকারে ঢাকা, হীমশীতল বাতাস; আর সামনে সাদা কাপড়ে মোড়ানো এক মেয়ের লাশ।

তিনি ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, ‘কোন মায়ের বুক খালি হলো কে জানে!’

পদ্মজা বিড়বিড় করে, ট্রলারের এক জনকে চেনা চেনা লাগছিল আম্মা।

হেমলতা ধৈর্যহারা হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কে? চিনেছিস? নাম কী? জানিস?’

পদ্মজা ভাবছে। গভীর ভাবনায় ডুবে কিছু ভাবছে। হেমলতার প্রশ্নের জবাবে বলল, ‘নাম জানি না। দাঁড়াও, আমি বলি লোকটা কেমন!

পদ্মজা চোখ খুঁজে ফিরে গেল কিছুক্ষণ আগের মুহূর্তে। চোখ বোজা অবস্থাতেই বলল, ‘আব্বা যখন বলল, কে রে? তখন একটা লোক আমাদের দিকে তাকিয়েছিল। লোকটার চোখগুলো ভীষণ লাল। অনেক মোটা, খুব কালো। মাথার চুল ঝুটি বাঁধা ছিল। এমন একজন লোক আমি স্কুল থেকে ফেরার পথে অনেকবার দেখেছি।’ কথা শেষ করেই পদ্মজা চোখ খুলে খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘লোকটার দেখা পেলে আমি ঠিক চিনে ফেলব আম্মা।’

‘চিনে কী হবে? প্রমাণ তো নেই। আর মেয়েটা মারা গেছে নাকি খুন সেটা তো জানি না।’

‘প্রমাণ নেই তা ঠিক। কিন্তু মেয়েটা খুন হয়েছে, আম্মা। এই দেখো, মেয়েটার গলায় ক

দাগ। আর পেটের কাছে দেখো রক্তের দাগ। নদীর পানি পুরোটা রক্ত মুছে দিতে পারেনি।’

হেমলতা অবাক হয়ে পদ্মজার কথামতো খেয়াল করে দেখেন। সত্যি তো! তিনি বিস্ময় নিয়ে বললেন, ‘একটার পর একটা খুন! হানিফের পর প্রান্তর বাপ…এরপর এই মেয়ে। আমি বুঝতে পারছি না, কে বা কারা এমন করছে।’

‘ওই লোকটার দেখা যদি আরেকবার পাই—আমি ঠিক এর রহস্য বের করব,’ বলল পদ্মজা।

মৃত মেয়েটার মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে দিলেন হেমলতা। এরপর দড়ি দিয়ে আগের মতো বেঁধে মোর্শেদকে বললেন, ‘কলাপাড়ার দিকে যাও।’

‘ওখানে কিয়ের কাম?’ বললেন মোর্শেদ।

হেমলতা শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘কলা গাছের ভেলা বানিয়ে লাশ ভাসিয়ে দেব। পানিতে ফেললে কেউ পাবে না। ভাসিয়ে দিলে কেউ না কেউ পাবে। হয়তো মেয়েটার পরিবারও খুঁজে পাবে! আমাদের বাড়িতে এখন লাশ নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। অনেক মানুষ আছে। সবাই ভয় পাবে। বিয়ের আমেজটা চলে যাবে। তাড়াতাড়ি যাও, কলাপাড়ার দিকে নৌকা ঘুরাও।’

.

সকাল সকাল গায়ে হলুদ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বউ এখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। বাড়ি ভরতি মানুষ। কলাগাছের ছাদ বানিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে নতুন বউয়ের জন্য। হেমলতা কিছুতেই পদ্মজাকে ডাকতে দিচ্ছেন না। দুপুরের আজান পড়তেই পদ্মজা চোখ খোলে। যখন মনে পড়ল আজ তার গায়ে হলুদ তখন সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। সেই কাকডাকা ভোরে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়েছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই। বালিশের পাশে হলুদ শাড়ি রাখা। পদ্মজা দ্রুত শাড়িটি পরে নিয়ে ডাকল পূর্ণাকে। বাইরের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। পদ্মজা দরজা খুলতেই নয় বছর বয়সি একটা মেয়ে চেঁচিয়ে বাইরে খবর দিল, ‘পদ্ম আপার ঘুম ভাঙছে।’

হেমলতা রান্নাঘরের সামনে বসে মুরগি কাটছিলেন।

হানি উঠান থেকে হনহনিয়ে হেঁটে এসে হেমলতাকে শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বললেন, ‘এবার তোর চাঁদকে নিয়ে যেতে পারি?’

হেমলতা হেসে অনুমতি দিলেন, ‘যাও।’

হানি, মনজুরাসহ সম্পর্কে ভাবি হয় এমন আরো দুজন পদ্মজাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। গান গাওয়ার জন্য ‘গীত গাওনি’ মহিলাদের খুব সমাদর করে আনা হয়েছে।

গ্রামের মহিলারা মিলে গোলাকার হয়ে বসে গানের জলসা তৈরি করেছে। যারা যারা গান গাইতে পারে, তারা চারপাশে ঘুরে ঘুরে গাইছে।

পদ্মজাকে দেখে সবার মনোযোগ তার দিকে চলে গেল। গায়ে হলুদের স্থান বাড়ির পেছনে। মোর্শেদ পথ আটকে গামছা কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বললেন, ‘আমার ছেড়িরে আমি লইয়া যামু।’

কথা শেষ করে মোর্শেদ পদ্মজাকে পাঁজকোলা করে তুলে নিলেন। হানি চেঁচিয়ে উঠে বললেন, ‘আরে মিয়া করেন কী! দুলাভাইরা কোলে নেয় তো।’

‘বাপ নিলে বিয়া অশুদ্ধ হইয়া যাইব না।’

পদ্মজা লজ্জায় শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। অজানা অনুভূতিতে তার হাত পা কাঁপছে। উপস্থিত মানুষের উচ্ছ্বাস দ্বিগুণ বেড়ে যায়। প্রেমা-প্রান্ত অন্যান্য শিশুদের নিয়ে খুশিতে লাফাচ্ছে, একজন আরেকজনকে রং মাখিয়ে দিচ্ছে। কলা গাছের ছাদের নিচে খাটের ছোটো চৌকি রাখা। সেখানে পদ্মজাকে দাঁড় করিয়ে দেন মোর্শেদ। সামনে সাতটি বদনা, দশটি কলসি ভরতি পানি। একটি কুলোয় রাখা দূর্বা, ধান, হলুদ বাটা, হলুদ শাড়ি, ব্লাউজ, তোয়ালে ও সাবান।

গীত গাওনিরা নেচে নেচে গীত গাইছে। শোনা যাচ্ছে—

‘কালা বাইগুনের (বেগুনের) ধলা ফুল
 রুমালে গাঁথিয়া তুল
কইনা লো তোর দয়াল বাবাজির মায়া তুল।
বরির (বরইয়ের) গাছে কুমড়ার ফুল
রুমালে গাঁথিয়া তুল
কইনা লো তোর দয়া চাচাজির মায়া তুল।’

‘কন্যা ডাক দেও তোর জননী না মাইরে
মাও দিয়া যাওক সোনা মুখে হলদিরে
হলুদা, ডাক দেও তোর জনমদাতা বাপেরে
বাবা দিয়ে যাউক তোর সোনা মুখে হলদিরে।’

গীতের তালে তালে ছেলেমেয়েরা একজন আরেকজনকে জোর করে ধরে হলুদ মাখিয়ে দিচ্ছে। পদ্মজার জন্য রাখা হলুদ অনেকেই নেয়ার জন্য ওঁত পেতে আছে, হানির জন্য পারছে না। হানি পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলে অনন্ত এসে হলুদ চাইলে হানি মার দেবেন বলে তাড়িয়ে দিলেন। হেমলতা ভিড় কমিয়ে চারিদিক পর্দা দিয়ে ঘিরে ফেলেন। মানুষে গিজগিজ করছে বাড়ি, অথচ দিন কয়েক আগে এরাই পদ্মজার সম্মান লুটে নিতে দেখেছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এই গ্রামবাসীর প্রতি কোনো সহানুভূতি নেই তার। ছয়-সাত জন মহিলাকে নিয়ে হলুদের গোসল শেষ করলেন। অন্যান্য মহিলাদের না নেয়াতে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল! গায়ে হলুদ করতে হয় সবাইকে নিয়ে, সবার সামনে…আনন্দ করতে করতে। হেমলতা কেন শুধুমাত্র ছয়-সাত জন নিয়ে করছেন? তিনি অবশ্য কারো কোনো কথার জবাবই দিলেন না।

গোসল শেষ করে পদ্মজাকে হলুদ মসলিন শাড়ি পরানো হলো। কানের কাছে মনজুরা গুনগুন করে কাঁদছেন। পদ্মজার শুনতে ভালো লাগছে না। বিয়ে হলে নাকি এক সপ্তাহ আগে থেকে কান্নাকাটি শুরু হয়। গায়ে হলুদের দিন আত্মীয়রা কাদায় গড়াগড়ি করে কাঁদে। অথচ পদ্মজা, হেমলতা শান্ত!

পদ্মজাকে গায়ে হলুদের খাবার দেয়া হলো। বিশাল এক থালা; তাতে কয়েক রকমের পিঠা, আস্ত একটি মুরগি, পোলাও, শাকসহ নানা পদ। পদ্মজা খা আগে অন্যরা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। লোক সমাগম কমতেই হেমলতা আলাদা করে প্লেটে করে ভাত আর মুরগির মাংস নিয়ে আসেন, নিজ হাতে খাইয়ে দেন মেয়েকে।

খাওয়ার মাঝে পদ্মজার মনে পড়ে মনজুরা তখন বলেছিলেন, ‘বিয়ের পর মেয়েরা পর হয়ে যায়। মা-বাবা পর হয়ে যায়। স্বামী আর স্বামীর বাড়িই সব। মা-বাপের সঙ্গে দেখা করতেও তাদের অনুমতি লাগে।’

পদ্মজা হেমলতার দিকে তাকিয়ে ভাত চিবোয়। হেমলতা খেয়াল করে দেখেন, পদ্মজা তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক ফেলছে না। চোখজুড়ে চিকচিক করছে জল।

তিনি শান্ত স্বরে বললেন, ‘খাওয়ার সময় কাঁদতে নেই।’

আকস্মিক পদ্মজা ফোঁপাতে শুরু করল। হেমলতা সান্ত্বনা পর্যন্ত দিলেন না, পরবর্তী লোকমা মুখে তুলে দিলেন। ফোঁপাতে ফোঁপাতে খাবার শেষ করল পদ্মজা। চোখের জলে বুক ভিজে একাকার। হেমলতা মেয়ের সামনে শক্ত থাকলেও, ঘরের বাইরে এসে হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগলেন। কী যে যন্ত্রণা হচ্ছে বুকে! কাঁদতে পারলে বোধহয় ভালো হতো। কিন্তু কাঁদার সময় কোথায়? সবার সামনে তো আর কাঁদতে পারেন না। ভিড় কমলে কাঁদবেন, অনেক কাঁদবেন, জীবনে শেষ বারের মতো কাঁদবেন। এরপর আর কখনো কাঁদবেন না …

…কোনোদিনও না।

পদ্মজার দুই হাতে গাছের মেহেদি লাগানো হচ্ছে। উঠানে বড়ো চৌকি পেতে তার চারিদিকে রঙিন পর্দা টাঙানো হয়েছে। কাগজের ফুল মাথার উপর ঝোলানো। চারিদিকে ঘিরে রয়েছে মেয়েরা। সামনের খালি জায়গায় চলছে নাচ।

ঠিক তখনই সেখানে উপস্থিত হলো হাওলাদার পরিবার—লাবণ্য, রানি এবং তাদের আত্মীয়স্বজন; সঙ্গে নিয়ে এসেছে বউয়ের বেনারসি, গহনা। হানি ছুটে এসে সবার আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। সবার শেষে বাড়িতে ঢুকল আমির। বিয়ের আগের দিন রাতে বরের আগমন সবাইকে খুব হাসাল। কেউ কেউ বলল, এত সুন্দর বউ দূরে রাখার আর তর সইছে না তাই চলে এসেছে। আমির সেসব পাত্তা দিল না। সোজা হেমলতার কাছে গেল। গিয়ে বলল, ‘আম্মা, পদ্মজার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।’

আমিরের অকপট অনুরোধ। হেমলতা ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এমন ছেলে তিনি দুটো দেখেননি।

আমির আবার বলল, ‘বেশিক্ষণ না, একটু সময় চাইছি।’ আমিরের কণ্ঠ পরিষ্কার। মাথা নিচু। পরিবারের ভালো শিক্ষাই পেয়েছে। তবে লাজলজ্জা একদমই নেই।

হেমলতা মৃদু হেসে বললেন, ‘ঘরে গিয়ে বসো। পদ্ম আসছে।’

আমির হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করে পদ্মজার ঘরের দিকে চলে গেল। হেমলতা পদ্মজাকে ডেকে নিয়ে এসে বললেন, আমির কথা বলতে চায়। ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু, কিন্তু না তো করা যায় না। কোনো বিশেষ দরকার হয়তো।’

পদ্মজা ঘরের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। পেছন ফিরে তাকাতেই হেমলতা ইশারায় যেতে বললেন। পদ্মজা ঘরে ঢুকে ডাগর ডাগর চোখ মেলে আমিরের দিকে তাকাল। আমিরকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত। আমির পদ্মজাকে দেখেই হাসল। বলল, ‘বসো।’

পদ্মজা বিছানার এক পাশে বসে। অন্য পাশে আমির বসে প্রশ্ন করে, ‘যা প্রশ্ন করি সত্যি বলবে।’

পদ্মজা দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘আমি মিথ্যে বলি না।’

আমির অসহায়ের মতো বলল, ‘তুমি কি মন থেকে এই বিয়েতে রাজি?’

পদ্মজা চকিতে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘আম্মা যখন যা করেছেন তাই আমি মন থেকে মেনে নিতে পেরেছি।’

আমির বলল, ‘লিখন শাহ তো তোমাকে পছন্দ করে।’

‘জানি। আর আপনি জানেন সেটাও জানি।’

আমি আমাদের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর জেনেছি। তুমি…তুমি মনে কিছু নিয়ো না, বলতে চাইছি, যদি তোমার আমাকে অপছন্দ হয় আর লিখন শাহকে ভালোবেসে থাকো বলতে পারো। আমি বিয়ে ভেঙে দেব।’

পদ্মজা অপমানে লাল হয়ে গেল। থমথমে গলায় বলল, ‘অবিশ্বাস থাকলে বিয়ে না হওয়াই ভালো। আপনি ভেঙে দিতে পারেন।’

আমিরের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। পদ্মজা ধারালো স্বরেও কথা বলতে পারে! আমির ইতস্তত করে বলল, ‘আমার কোনো অবিশ্বাস নেই। তোমার মনে কেউ না থাকলে বিয়ে আমার সঙ্গেই হবে। আর কারোর সঙ্গে হতে দেব না।’

পদ্মজা কিছু বলল না। উঠে যেতে চাইলে আমির অনুনয়ের সঙ্গে বলল, ‘একবার হাত ধরা যাবে?’

‘আজ নয়, আগামীকাল।’ বলার সময় পদ্মজার ঠোঁটে দেখা গেল হাসির রেখা।

আমির সেটা খেয়াল করে মুগ্ধস্বরে বলে উঠল, ‘সুবহানআল্লাহ।’

.

বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। পদ্মজা বধূ সেজে বসে আছে। দুই পাশে বসে আছে পূর্ণা ও প্রেমা। কাজী বিয়ে পড়াচ্ছেন। অনেকক্ষণ ধরে পদ্মজাকে কবুল বলতে বলছেন। পদ্মজা কিছুতেই বলছে না। সে একমনে হেমলতাকে খুঁজছে। বউ কবুল বলছে না শুনে অনেকে ভিড় জমিয়েছে। হেমলতা সেই ভিড় ভেঙে ঘরে ঢুকলেন। হেমলতাকে দেখে পদ্মজার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল, ছলছল চোখ নিয়ে তিনবার কবুল বলল সে। হেমলতার দুই চোখে পানি, ঠোঁটে হাসি। পদ্মজাকে বধূ সাজাবার পর এই প্রথম দেখলেন তিনি। লাল বেনারসিতে পদ্মজার রূপ যেন গলে গলে পড়ছে। পাশের ঘরে কে যেন কাঁদছে! হেমলতা দেখতে গেলেন।

আয়না দেখানো পর্ব শুরু হয়। আয়নায় তাকাতেই আমির চোখ টিপল। পদ্মজা লজ্জা পেয়ে সরিয়ে নিলো দৃষ্টি। আমির সবার চোখের আড়ালে খপ করে ধরে ফেলল পদ্মজার এক হাত। স্বামীর অধিকার নিয়ে ধরা প্রথম স্পর্শে কেঁপে উঠে পদ্মজা। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে তলিয়ে যেতে থাকে সে।

আমির ফিসফিস করে বলল, ‘এই যে ধরলাম, মৃত্যুর আগে ছাড়ছি না।’ বিয়ে বাড়ির কোলাহল কমে গেছে। বিদায়ের পালা চলছে। করুণ কান্নার স্বরে চারিদিক হাহাকার করছে। মনজুরা, হানি কেঁদে কুল পাচ্ছে না। মোর্শেদ নদীর ঘাটে বসে গোপনে চোখের জল ফেলছেন। পূর্ণা পদ্মজার গলা জড়িয়ে সেই যে কান্না শুরু করেছে থামছেই না। কাঁদছে প্রেমা ও প্রান্ত। একটা মেয়ের বিয়ের বিদায় পর্ব কতটা কষ্টের তা শুধু সেই মেয়ে আর তার পরিবার জানে। পদ্মজা পূর্ণার মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বার বার বলছে, ‘বোন, বোন আমার। মন খারাপ করে থাকবি না কিন্তু। একদম কাঁদবি না। আমি আসব। তুইও যাবি। আমার খুব কষ্ট হবে রে বোন। আর কাঁদিস না। এভাবে কাঁদলে অসুস্থ হয়ে যাবি।

একজন তাড়া দেয়, সন্ধে হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি করুন।’

পদ্মজা আকুল হয়ে কেঁদে ডাকল, ‘আম্মা…আমার আম্মা কোথায়? আম্মা, ও আম্মা।’

হেমলতা লাহাড়ি ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পদ্মজার ডাকে সাড়া দিতে সামনে এগোতে থাকেন। প্রতি কদমে কদমে বুক ব্যথায় চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তবুও হাসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারছেন না। যে মেয়ের জন্য তিনি নতুন করে জীবনের অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন সেই মেয়ের আজ বিদায়! সারাজীবনের জন্য অন্যের ঘরে চলে যাবে। হেমলতাকে দেখেই পদ্মজা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। হেমলতা দ্রুত চোখের জল মুছে, পদ্মজাকে আদুরে কণ্ঠে বললেন, ‘এভাবে কাঁদতে নেই মা। বিয়ে তো হবারই কথা ছিল।’

‘আম্মা, তোমাকে ছাড়া কেমন করে থাকব?’

‘সবাইকেই থাকতে হয়। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে মা।

হেমলতা পদ্মজার চোখেমুখে কপালে চুমু খেয়ে, দুই চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, শ্বশুর বাড়ির সবার সঙ্গে মিলেমিশে থাকবি। নিজের খেয়াল রাখবি।’

পদ্মজা হাউমাউ করে কাঁদছে। হেমলতাকে জোরে চেপে ধরে বলল, ‘আম্মা আমি যাব না। আম্মা যাব না আমি।’

হেমলতা পদ্মজার মুখের দিকে চাইতে পারছেন না। ভাঙা গলায় আমিরকে ডেকে বললেন, ‘বাবা, নিয়ে যাও আমার মেয়েকে। ওর খেয়াল রেখো। ওর আব্বা ঘাটে বসে আছে। ডাকতে হবে না, একা থাকুক। তোমরা পদ্মকে নিয়ে যাও। সন্ধে হয়ে যাচ্ছে।’

আমির নম্রকণ্ঠে বলল, ‘পদ্মজাকে সারাজীবন আগলে রাখব। আপনি চিন্তা করবেন না।

হেমলতা কৃতজ্ঞচিত্তে তাকিয়ে রইলেন শুধু কিছু বলতে পারলেন না। চোখ বেয়ে টুপটুপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে মাটিতে পদ্মজার বেনারসিতে।

আমির পদ্মজাকে পাঁজকোলা করে নেয়। পদ্মজা আকুতিভরা কণ্ঠে হেমলতাকে ডেকে অনুরোধ করে, ‘আম্মা আমাকে ধরো। ওরা নিয়ে যাচ্ছে, আম্মা…’

হেমলতা মুখ ঘুরিয়ে নেন। পূর্ণা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পদ্মজাকে পালকিতে বসিয়ে তার গালে দুই হাত রেখে আমির বলল, ‘কেঁদো না আর। একদিন পরই আসব আমরা।’

পদ্মজা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠে। সব কিছু শূন্য লাগছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেছে। পালকি ছুটে চলছে শ্বশুরবাড়ি।

পূর্ণা হেমলতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আম্মা কেন বিয়ে দিলে আপার? তোমার কি কষ্ট হচ্ছে না?’

হেমলতা হাঁটুভেঙে মাটিতে বসে পড়েন। পূর্ণাকে জড়িয়ে ধরে গগন কাঁপিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। উপস্থিত সবার কান্না থেমে যায়। তিনি বলেন, ‘আমি যদি পারতাম তাহলে আমার পদ্মর বিয়ে দিতাম না পূর্ণা। ও যে আমার সাত রাজার ধনের চেয়েও বেশি।’

হানি বরাবরই কাঁদুক স্বভাবের। হেমলতা কখনো কাঁদে না। সেই হেমলতাকে এভাবে কাঁদতে দেখে তিনি নিজেও কান্না লুকিয়ে রাখতে পারলেন না।

হেমলতার মাথা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে ভেজা কণ্ঠে বললেন, ‘এটাই তো নিয়ম। কেঁদে আর কী হবে?’

হেমলতা মুহূর্তে ছোটো বাচ্চা হয়ে গেলেন। হানিকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, ‘আপা, আপা ওরা আমার মেয়ে নেয়নি। আমার কলিজা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আপা, কেন বিয়ে দিতে হলো আমার পদ্মর?’

মনজুরা হেমলতার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেন, ‘দেখিস পদ্ম খুব ভালো থাকবে। ও খুব ভালো মেয়ে।’

হেমলতা হানিকে ছেড়ে মনজুরাকে জড়িয়ে ধরলেন। হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আম্মা, আম্মা তুমি কখনো আমাকে কিছু দাওনি এইবার আমার এই মরণ কষ্টটা কমিয়ে দাও। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আম্মা, আমার পদ্মকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকব?

মনজুরার বুক ধুকপুক করছে। জন্মের পর হেমলতা কী কখনো এভাবে কেঁদেছে? মনে পড়ছে না। তিনি পারেননি হেমলতার এই কষ্ট কমাতে। শুধু বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখলেন। এভাবে যদি ছোটো থেকে আগলে রাখতেন, হেমলতার জীবনটা এত কষ্টের হতো না।

.

পদ্মজা ছটফট করছে। কিছু ভালো লাগছে না। ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে যেতে মায়ের কাছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। এখুনি মারা যাবে হয়তো। পদ্মজা হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ‘থামো তোমরা, থামো। আল্লাহর দোহাই লাগে থামো।’

পদ্মজার চিৎকার শুনে আমির ভড়কে যায়, বেয়াড়াদের দ্রুত থামতে বলে। পালকি থেমে যায়। পদ্মজা পালকি থেকে মাটিতে পা রেখেই মোড়ল বাড়ির দিকে ছুটতে থাকল। কেউ আটকে রাখতে পারল না। সবাইকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ঠেলে ছুটে চলেছে সে মায়ের বুকে। আমির শুধু চেয়ে রইল। সন্ধ্যা নামার পূর্ব মুহূর্তে একটা লাল বেনারসি পরা অপরূপ সুন্দরী মেয়ে ছুটছে। দেখতেও ভালো লাগছে।

২৮

‘আম্মা…’

পদ্মজার কণ্ঠে আম্মা ডাকটি হেমলতার অস্তিত্ব মাড়িয়ে দিয়ে যায়। হেমলতা থমকে গিয়ে ঘুরে তাকান। উঠে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত হতেই পদ্মজা ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে। হেমলতা টাল সামলাতে না পেরে আবার মাটিতে বসে পড়েন। পদ্মজা নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাঁদতে থাকল। হেমলতা সীমাহীন আশ্চর্য হয়ে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। নির্বাক, স্তব্ধ থেকে শুধু পদ্মজার কান্না অনুভব করছেন। কান্নার দমকে পদ্মজার শরীর ঝাঁকি দিচ্ছে বারংবার।

পূর্ণা পদ্মজাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা… আর যেয়ো না।’

পদ্মজা অনুরোধ স্বরে হেমলতাকে বলল, ‘আম্মা আমি যাব না।’

হেমলতার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। প্রতি ফোঁটা জল পদ্মজার বুকে সাইক্লোন, টর্নেডোসহ সব ধরনের দুর্যোগ বইয়ে দিচ্ছে। হেমলতা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন পদ্মজাকে। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘কোথাও যেতে হবে না তোর।’

হেমলতার এহেন কথা শুনে হানি, মনজুরার মাথায় বাজ পড়ল। সে কী কথা! হেমলতা একবার যখন বলেছে তাহলে সত্যি যেতে দিবে না। তাহলে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিল! হানি শক্ত কিছু কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয়। তখনই হেমলতা পদ্মজাকে সরিয়ে দেন নিজের কাছ থেকে। চোখে মুখ শক্ত করে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললেন, ‘এটা ঠিক করিসনি পদ্ম! এভাবে চলে আসা মোটেও ভদ্রতা নয়। আবেগকে এত প্রশ্রয় দিতে নেই। বিয়ে দিয়েছি এবার শ্বশুর বাড়ি যেতেই হবে। ওই তো আমির এসেছে।’

হেমলতা হাত ঝেড়ে মাটি থেকে উঠে দাঁড়ান। হঠাৎ মায়ের রূপ পালটে যাওয়াতে পদ্মজা স্তব্ধ হয়ে যায়। হাঁ করে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে, চোখের পলকে আম্মা পালটে গেল কেন? এই তো মাত্রই কাঁদছিল!

.

পদ্মজা নিজের চুলে আঙুল পেঁচাতে পেঁচাতে হাসছে। তুষার রয়ে সয়ে প্রশ্ন করল, ‘হাসছেন কেন?’

পদ্মজা নাটকীয়ভাবে ব্যথিত স্বরে বলল, ‘আপনি কাঁদছেন তাই।’

তুষার দ্রুত চোখের জল মুছল। মৃদু হেসে বলল, ‘কাঁদছি নাকি!’

পদ্মজা হঠাৎ গুনগুনিয়ে কাঁদতে শুরু করল। তুষার জানতে চাইল, ‘আপনি কাঁদছেন কেন?’

মুহূর্তে পদ্মজা দাঁত কেলিয়ে হেসে উঠে। চোখে জল ঠোঁটে হাসি নিয়ে বলল, ‘মনে চাইল তাই। আম্মা বলতেন, যখন যা ইচ্ছে হয় করে ফেলতে। তাতে কারো ক্ষতি বা নিজের কোনো ক্ষতি না হলেই হলো।’

‘আপনার মায়ের খবরটা গতকাল শুনলাম। জানেন সারারাত ঘুমাতে পারিনি।’

‘আপনার মনটা খুব নরম, স্যার। কিন্তু কঠিন ভাব নিয়ে থাকেন, আমার আম্মার মতো।’

‘তারপর কী হলো?’

পদ্মজা চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে বসে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে বলল, ‘আর তো বলব না।’

তুষার শ্বাসরূদ্ধকর কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কেন?’

পদ্মজা ঘাড়ে এক হাত রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘এমনি।’

‘হেয়ালি করবেন না, পদ্মজা। আপনি ছাড়া এই রহস্যের কিনারা অসম্ভব। আপনার পুরো গ্রাম আপনার বিপক্ষে। খুনের কারণ ও কেউ বলতে পারছে না। আমরা তদন্ত করেও কুল পাচ্ছি না।’

পদ্মজা চোখ গরম করে তাকাল। কটমট করে বলল, ‘বলব না মানে বলব না।’

তুষার দ্বিগুণ গলা উঁচিয়ে বলল, ‘তাহলে এতটুকু কেন বললেন?’

‘আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।’

‘আপনার ইচ্ছায় সব হবে না।’

‘যা খুশি করে নিতে পারেন।’

পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলাতে তুষার দুই হাতে মুখ ঢেকে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। এরপর ধীরেসুস্থে বলল, ‘দেখুন যদি সব খুলে না বলেন, তাহলে আমি আপনাকে আইনের হাত থেকে বাঁচাতে পারব না। নির্দোষ প্রমাণ করতে পারব না। আর আমার মন বলছে, আপনি দোষ করতে পারেন না।’

‘সবসময় মন সঠিক কথা বলে না।’

‘তাহলে বলছেন, আপনি নির্দোষ না?’

পদ্মজা চোখ সরিয়ে নিলো। হাসল। কী যন্ত্রণা! কত কষ্ট সেই হাসিতে! চোখ ভরতি জল নিয়ে আবার তাকাল তুষারের দিকে। বলল, ‘আমি খুন করেছি। একই রাতে, একই প্রহরে, একই জায়গায় একসঙ্গে পাঁচ জনকে। আপনার আইন যা শাস্তি দেয়—তা আমি মাথা পেতে নেব।’

তুষার অধৈর্য হয়ে বলল, ‘আপনার ফাঁসির রায় হবে—পদ্মজা। আপনি বুঝতে পারছেন না। আমার আপনাকে বাঁচাতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

‘ওপারে যাওয়া আমার জরুরি। আমি সব রায় মেনে নেব।’

‘আমি মানতে পারব না,’ তুষারের অকপট স্বীকারোক্তি। কথাটা মুখ থেকে বের হওয়ার পর তুষার বুঝল সে অচেনা এবং ভয়ংকর অনুভূতি নিয়ে খেলছে। পদ্মজার দিকে চেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। পদ্মজা তুষারকে পরখ করে নিয়ে হাসল। শান্ত ভঙ্গিতে বলল, এত ব্যকুল কেন হচ্ছেন? আমার প্রেমে পড়ে যাননি তো?

তুষার থতমত খেয়ে গেল, বেশ অনেকক্ষণ বসে রইল গাঁট হয়ে। ওপর থেকে আদেশ এসেছে—পদ্মজা কেন এতগুলি খুন করেছে, সেই রহস্য উদঘটন করতে। না পারলে চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

চাকরি চলে যাক সমস্যা নেই, নিজের শান্তির আর আত্মতৃপ্তির জন্য হলেও পদ্মজার পেছনের ছয়টি বছরের গল্প জানতেই হবে। এই কেস হাতে পাওয়ার পর থেকে তার ঘুম হচ্ছে না রাতে। সারাক্ষণ মস্তিষ্ক কিলবিল করে। এত জটিল কেস কখনো ফেস করতে হয়নি। অলন্দপুর পুরোটা ঘেঁটেও কিছু জানা যায়নি। যারা খুন হয়েছে তারা আর পদ্মজা ছাড়া হয়তো কেউ জানেও না। তুষার আবার বলল, ‘আপনার বিরুদ্ধে সব প্রমাণ। আপনার বিরুদ্ধে সবাই সাক্ষী দিচ্ছে। আপনি কী…’

কথার মাঝপথে তুষারকে থামিয়ে দিয়ে পদ্মজা বলল, ‘খুনগুলো তো সত্যি আমি করেছি। তাহলে প্রমাণ আমার বিরুদ্ধেই তো থাকবে।’

তুষারের মন বিরক্তে তেঁতো হয়ে যায়। পদ্মজার সামনে কয়েকবার পায়চারি করে বেরিয়ে গেল সে, সিগারেট ফুঁকে মাথা ঠান্ডা করল। চা নিয়ে এলো ফাহিমা। তুষার শুধাল, ‘মেয়েটাকে তোমার অপরাধী মনে হয়?

‘আমি কিছু ভাবতে পারছি না, স্যার। মেয়েটাকে দেখলে আমার হাত- পা অবশ হয়ে পড়ে। এত মেরেছি কিছুতেই ঢুঁ শব্দটাও করেনি! এরপর থেকে আমি রাতে ভয়ংকর স্বপ্ন দেখি।’

‘পৃথিবীটা রহস্যে ঘেরা, ফাহিমা। একজন নারী পাঁচ জনকে কীভাবে খুন করতে পারে? আবার একসঙ্গে? সেই সাহস কী করে পেল?’

‘সেটা আমিও ভাবছি, স্যার। কীভাবে খুন করেছে সেটা ধারণা করা যাচ্ছে। কিন্তু এত সাহস, ধৈর্য কীভাবে কোনো নারীর থাকতে পারে!

‘নারীরা চাইলে সব পারে কথাটা শুনে এসেছি। এবার স্বচক্ষে দেখছি।’

‘জি, স্যার।’

‘কত আসামি পায়ে পড়ে জীবন ভিক্ষা চেয়েছে। কিছুতেই মন গলেনি। মন কাঁদেনি। এই মেয়েটা জীবন চায় না; তবুও আমার ইচ্ছে হচ্ছে নতুন একটা জীবন পাবার সুযোগ করে দিতে, নির্দোষ প্রমাণ করতে।’

ফাহিমা অবাক হয়ে তাকাল তুষারের দিকে। তুষার কখনও হু, হ্যাঁ-এর বাইরে কিছু বলে না। খুব কঠিন, কাঠখোট্টা একটা মানুষ। অনুভূতি বলতে কিছু নেই। তার মুখে এই ধরনের আবেগী কথাবার্তা শুনে অবাক হচ্ছে ফাহিমা।

‘পরিস্থিতি হাতের বাইরে। পদ্মজার ফাঁসি দেখার জন্য দেশ উতলা হয়ে আছে।

‘কেন এমন হচ্ছে, ফাহিমা?’

‘আজ যদি হেমলতা উপস্থিত থাকতেন গল্পটা অন্যরকম হতো, স্যার।’ তুষার আবার ফিরে এসে পদ্মজার সামনের চেয়ারে বসল। ধীরকণ্ঠে বলল, ‘আজই শেষ দিন। এরপর আর আমাদের সাক্ষাৎ হবে না।’

পদ্মজা চমকে তাকাল। দ্রুত তুষারের পায়ের কাছে বসে বলল, ‘আপনার আম্মা কি আপনাকে বিয়ের জন্য খুব চাপ দেয়?’

‘আপনি কী করে জানলেন?’

‘সেদিন দেখলাম ফোনে কাউকে আম্মা ডেকে রেগে বিয়ে না করার কথা বলছিলেন।’

‘আমি তো অনেক দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। আপনার শ্রবণ শক্তি তো প্রখর,’ তুষার বলল। লম্বা নিশ্বাস নিয়ে আবার যোগ করল, ‘কোন কথাটা লুকিয়ে আপনার মা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন?’

‘আপনি জানলেন কী করে?’

‘কিছু তথ্য পেয়েছি গতকাল। এইটুকুর জন্য বিশ্বাসঘাতক অপবাদ দিতে পারেন না। উনি আপনার ভালোর জন্যই…’

পদ্মজা চুপ থেকে হুট করে ফোঁস করে জ্বলে উঠে বলল, ‘আপনি বুঝবেন না আমার কষ্ট। না পাওয়া দামি সময়টাকে আমি কতবার মনে করে বুক ভাসিয়ে কেঁদেছি—বুঝবেন না আপনি।’

পদ্মজা কাঁদতে কাঁদতে হেসে উঠল। আবার পরক্ষণেই কান্না শুরু করল করুণস্বরে, গা কাঁপিয়ে তোলার মতো কান্না। মনে হয় কোনো অশরীরী কাঁদছে। কী বিশ্রি, ভয়ংকর সেই কান্নার ছন্দ।

তুষারের কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। চিন্তায় মাথার রগ দপদপ করছে। আগামীকাল ভোরে পদ্মজাকে কোর্টে তোলা হবে, রায় হবে। পদ্মজার ফাঁসি চাই বলে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল হচ্ছে, রেডিয়োতে চলছে আন্দোলন। কিন্তু তুষারের মন যে কিছুতেই মানতে পারছে না। এমন নিষ্পাপ মনের, অপরূপ সুন্দরীর বিরুদ্ধে পুরো পৃথিবী!

কী আশ্চর্য!

বাঁকা রাস্তা পেরিয়ে পালকি চলছে ধীরে ধীরে। সন্ধ্যার আজান পড়েছে কিছুক্ষণ আগে। দিনের আলো কিছুটা এখনও রয়ে গেছে। দক্ষিণ দিক থেকে ধেয়ে আসছে হাওয়া। শীতল, নির্মল পরিবেশ। পদ্মজার বুক ধুকপুক করছে। নতুন মানুষ নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারবে তো! একবার সে হাওলাদার বাড়ি গিয়েছিল। অন্দরমহল নামে এক বিশাল বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে মেয়ে-বউরা থাকে। এখন কী সেও থাকবে? পদ্মজা পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে বাইরে চোখ মেলে তাকাল। আমির হাতে পাগড়ি নিয়ে তার বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করছে। চোখেমুখে উপচে পড়ছে খুশি। পদ্মজা চোখ সরিয়ে নিলো। মায়ের কথা, পূর্ণার কথা খুব মনে পড়ছে।

অন্দরমহলে মেয়েরা অপেক্ষা করছে নতুন বউয়ের জন্য। আমির গেটের সামনেই পালকি থামিয়ে দিয়েছে। জাফর বিরক্তিতে ‘চ’-এর মতো শব্দ করে বলল, ‘এইখানে আবার থামালি কেন?’

আমির পাগড়ি রিদওয়ানের হাতে দিয়ে বলল, ‘আমার বউ আমার কোলে চড়ে অন্দরমহলে যাবে।’

পদ্মজা কথাটা শুনেই কাঁচুমাচু হয়ে চুপসে গেল। আমির পালকির পর্দা সরিয়ে হাত বাড়িয়ে নামতে ইশারা করল। পদ্মজার নাক অবধি টানানো ঘোমটা। আমির সরাতে গিয়েও সরাল না। মুখে বলল, ‘কী হলো? নেমে আসো।’

পদ্মজা লজ্জায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। সে গাঁট হয়ে বসে রইল। আমির হেসে নিজের কপাল চাপড়াল এক হাতে, এরপর নিজেই টেনে নামাল পদ্মজাকে। তখনো পদ্মজার নাক অবধি ঘোমটা। আমির চট করে তাকে পাঁজকোলা করে নেয়। কুঁকড়ে গেল পদ্মজা, ভয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরল আমিরের গলা। আমির যত এগোচ্ছে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার গায়ের উষ্ণতা পদ্মজার শাড়ি ভেদ করে সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে। অচেনা, অজানা অনুভূতিরা যেন জেঁকে বসেছে চারিদিকে।

মরণ প্রেমের সূত্রপাত এখান থেকেই শুরু হয়!

২৯

অন্দরমহলের সদর দরজায় গ্রামের মেয়েদের ভিড় জমেছে, সবাই দেখতে এসেছে নতুন বউকে। আমিরের কোলে পদ্মজাকে দেখে মিটিমিটি হাসছে। ফিসফিসিয়ে একজন আরেকজনকে কিছু বলছে। ফরিনা ধমক দিয়ে কোলাহল থামিয়ে দিলেন। আমির দরজার সামনে উপস্থিত হতেই আনিসা বলল, ‘এইবার বউকে নামান ছোটো ভাই। বড়ো আম্মার পা ছুঁয়ে সালাম করে এরপর ঘরে ঢুকেন।’

আনিসা আমিরের চাচাতো ভাইয়ের বউ, জাফরের স্ত্রী। দেশের বাইরে থাকে। ঢাকার স্বনামধন্য এক ভার্সিটির প্রফেসরের মেয়ে আনিসা। বিয়ের পরপরই স্বামী নিয়ে দূর-দূরান্তে পাড়ি জমিয়েছিল। দুই সপ্তাহ আগে ছুটি কাটাতে শ্বশুরবাড়ি এসেছে। আনিসার কথামতো আমির পদ্মজাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। এরপর দুজন নত হয়ে সালাম করল ফরিনাকে। ফরিনা হেসে ছেলে এবং ছেলের বউকে চুমু খেলেন। আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন, ‘সুখী হ, বাবা। বউয়ের খেদমতে জীবনভর ভালা থাক। আমার কইলাম বছরের মধ্যেই নাতি চাই।’

লাবণ্য ফোড়ন কাটল, ‘পদ্ম আমার লগে শহরে যাইব আম্মা। আমরা একলগে কলেজে পড়াম। নাতি-টাতি পরে পাইবা।’

ফরিনা ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো তেড়ে এসে লাবণ্যর গালে চড় বসিয়ে দিয়ে উঁচু কণ্ঠে বললেন, ‘আমার কথার পিছে কথা কওনের সাহস দেখাবি না।’

আকস্মিক ঘটনায় সবাই হকচকিয়ে যায়। পদ্মজা অবাক চোখে তাকাল। সামান্য কথার জন্য কোনো মা এত মানুষের সামনে যুবতী মেয়েকে মারে? লাবণ্য লজ্জায়-অপমানে কাঁপতে লাগল, চোখে টলমল জল নিয়ে পালিয়েই গেল একরকম। ফরিনার চোখেমুখে কাঠিন্য ফুটে আছে। পদ্মজা ভয়ে চোখের দৃষ্টি মাটিতে রাখে। ফরিনা পদ্মজার হাতে ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘মুখে মুখে কথা কইবা না কুনুদিন। যা কই মাইন্যা চলবা। শ্বশুর বাড়ির সব মানুষ হইতাছে গিয়া দেবতার লাহান। তাগোরে সেবা করলেই জান্নাত পাওন যাইব। নইলে কুনুদিন জান্নাতে পাও দিতে পারবা না। হুনছি তো তুমি হইছো গিয়া অনেক বাধ্য ছেড়ি। কামে-কাজেও হেইডা দেখাইবা। আমার কথা গুলান মনে রাখবা।’

পদ্মজা মাথা নাড়ায়। মুসলমানদের দেবতার সঙ্গে তুলনা করাটা পদ্মজার ভালো লাগেনি। কিছু কথা গলায় এসেও আটকে গেছে। বলার সাহস পাচ্ছে না।

ফরিনা আবার বললেন, ‘হুনো বউ, স্বামীর উপরে কিচ্ছু নাই। স্বামীরেই দুনিয়া ভাববা, মা-বাপ, ভাই-বোন হইছে গিয়া পর। স্বামী আপন। স্বামীর বাইরে কিছু ভাববা না। স্বামী যা কয় তাই মানবা। নিজের হাতে স্বামীর পা ধুইয়া দিবা। স্বামী বইতে কইলে বইবা, উঠতে কইলে উঠবা, হুত্তে কইলে হুইবা। স্বামী যহন কাছে ডাকব না করবা না। আল্লাহ বেজার হইব। ফেরেশতারা অভিশাপ দিব। দুনিয়াত স্বামীর আদরের থাইকা মধুর আর কিছু নাই।’

পদ্মজা অপ্রতিভ হয়ে উঠেছে। লজ্জায়, আড়ষ্টতায় সারা শরীর ঘামছে। আনিসা ফরিনাকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বড়ো আম্মা, অনেক মানুষ আছে তো। এসব পরেও বলতে পারতেন।’

আনিসার কথা পুরোপুরি উপেক্ষা করলেন ফরিনা। তিনি পদ্মজাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন, ‘খালি স্বামী লইয়াও পইড়া থাহন যাইব না। তোমার শ্বশুর-শাশুড়ি জীবিত আছে। তাগোর সেবা করবা। যহন যা করতে কই, করবা। না পারলে কইবা, শিখাইয়া দিয়াম। হত্তিদিন ভোরে উঠবা। নামাজ পইড়া রান্ধাঘরে যাইবা। তহন বাকিসব ভুইলা রান্ধনে মন দিবা।’

আমির কপালের চামড়া কুঁচকে মায়ের কথা শুনছিল। এবার সে ধৈর্যহারা হয়ে বলল, ‘রান্নাবান্না করার জন্য অনেক মানুষ আছে আম্মা। পদ্মজা রাঁধতে হবে না। আর আমার এত সেবাও লাগবে না। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ভিড় কমাও। আর নিয়মনীতি শেষ করো। এরপর আমার বউ আমার ঘরে ছেড়ে দাও।’

আমিরের কথা শেষ হতেই হাসির রোল পড়ে যায়। পদ্মজা ঠোঁট টিপে হাসি আটকায়। ফরিনা কিছু কঠিন কথা বলতে প্রস্তুত হোন।

আনিসা রসিকতা করে বলল, ‘আজ তো একসঙ্গে থাকা যাবে না। আরো একদিন ধৈর্য ধরুন।’

আমির প্রবল বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন? বিয়ে তো হয়ে গেছে।’

কেউ আমিরের জবাব দিল না। উলটো সবাই হাসতে থাকল।

‘আইজ কাইলরাত্রিরে হতচ্ছাড়া!’ বলল শাহানা। জাফরের বড়ো বোন। আমিরের বিয়ে উপলক্ষে বাপের বাড়ি এসেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে পুরো শ্বশুরবাড়ি। আমির শাহানাকে প্রশ্ন করল, ‘কালরাত্রি তো হিন্দুদের নিয়ম। আমি মানি না। আমার বউ আমার ঘরে দিয়ে আসা হোক।’

‘সবসময় ত্যাড়ামি করিস কেন? আমরাও তো নিয়ম মেনেছি,’ বলল জাফর। কণ্ঠে তার গাম্ভীর্য। তাতেও লাভ হলো না। আমির কিছুতেই এই নিয়ম মানবে না। ফরিনা, শাহানা, শিরিন, আনিসা, আমিনাসহ অনেকে আমিরকে মানানোর চেষ্টা করল। কারো কথা আমিরের কর্ণগোচর হলো না। এর মধ্যে রিদওয়ান আমিরের সঙ্গে তাল দিয়ে বলল, ‘কালরাত্রি-টাত্রি বাদ। এসব নিয়ম মেনে লাভটা হবে কী? যার বউ তাকে তার বউ দিয়ে দেও।’

‘তুই চুপ থাক। আগুনে ঘি ঢালবি না,’ বললেন আমিনা।

রিদওয়ান চুপসে গেল। থামলো না শুধু আমির। ফরিনাও জেদ ধরে বসে আছেন। তিনি আমির-পদ্মজাকে আজ কিছুতেই একসঙ্গে থাকতে দিবেন না। যেমন মা তেমন তার ছেলে। মজিদ হাওলাদার অনেকক্ষণ যাবৎ এসব দেখছেন। চেঁচামিচি আর নেয়া যাচ্ছে না। তিনি ওপর থেকে নেমে আসেন। অন্দরমহলটি তিন তলা নিয়ে তৈরি। তৃতীয় তলায় কেউ থাকে না। শুধু ছাদ আছে। ঘর বানানো হয়নি। অসমাপ্ত ইটের পুরনো বাড়ি। চিন্তাভাবনা চলছে তৃতীয় তলাটা থাকার জন্য উপযুক্ত করার। মজিদকে দেখে সবাই থেমে গেল। তিনি পদ্মজার পাশে চেয়ার নিয়ে বসেন। পদ্মজা একটু নড়েচড়ে বসে। মজিদ পদ্মজাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুর্কি কী চাও মা? আজ শাশুড়ির সঙ্গে থাকবে? নাকি আমার পাগল ছেলের সঙ্গে? ভেবে বলো। তুমি যা বলবে তাই হবে।

পদ্মজা উসখুস করতে করতে বলল, ‘জি, আম..আম্মার সঙ্গে থাকব।’

ফরিনার ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি ফুটে উঠে। তিনি আমিরের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে হাসেন। পরপরই পদ্মজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। চুমুতে চুমুতে পদ্মজা গাল ভরিয়ে দেন।

একবার আড়চোখে আমিরকে দেখল পদ্মজা। আমির তাকিয়েই ছিল। পদ্মজা তাকাতেই আমির চোখ রাঙানি দিয়ে হুমকি দিল। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো পদ্মজা। বিয়ের বাকি সব নিয়ম শুরু হলো, ওপর থেকে নেমে এলেন নুরজাহান। তিনি এই বাড়ির প্রধান কর্ত্রী, মজিদ হাওলাদারের জন্মদাত্রী। তিনি হইহই করে নামলেন, ‘কইরে…কইরে আমার নাত বউডা কই?’ বলতে বলতে ছুটে আসেন তিনি। উপস্থিত সবাই দৃষ্টি ঘুরিয়ে নুরজাহানের দিকে তাকাল। নুরজাহান পদ্মজার সামনে এসে বসলেন। পদ্মজার মুখখানা দুই হাতে ধরে দেখে মুগ্ধ হয়ে বললেন, ‘বাবু দেহি চাঁদ লইয়া আইছে! এই ছেড়ি তোর জন্যি আমার জামাই তো এহন আমার দিকে চাইবোই না।’

নুরজাহান কেন এ কথা বললেন, পদ্মজা ঠাওর করতে পারল না। আমির যখন হেসে বলল, ‘আরে বুড়ি, তুমি তো আমার প্রথম বউ। ভুলি কীভাবে?’ তখন পদ্মজা নুরজাহানের কথার মানে বুঝতে পেরে ঠোঁট চেপে হাসল। নুরজাহান আমিরের থুতনিতে চিমটি দিয়ে ধরে বললেন, ‘আমার চান্দের টুকরা। বউরে আদর কইরো ভাই। বকাঝকা কইরো না। ছেড়িড়া জন্ম ঘর ছাইড়া আইছে। তুমি এখন সব। তুমি যেমনে রাখবা তেমনেই থাকব। স্বামী হাত ছাইড়া দিলে শ্বশুরবাড়ির আর কেউই বউদের আপন হয় না। বুঝছো ভাই?’

আমির নুরজাহানের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, ‘বুঝছি জান।’

নুরজাহান মন খারাপের নাটক করে বললেন, ‘এইডা ঠিক না ভাই।’

‘কোনটা?’

‘এহন থাইকা জান ডাকবা বউরে। আমি হইলাম দুধভাত।’

আমির একটু জোরেই হাসল। সঙ্গে আরো অনেকে হাসল। পদ্মজা নত হয় নুরজাহানের পা ছুঁয়ে সালাম করার জন্য। নুরজাহান দ্রুত পদ্মজাকে আটকালেন। জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, ‘রূপে যেমন গুণেও তেমন থাইকো বইন।’

‘রাইত বাড়তাছে। সব নিয়ম তো শেষ। যাও যের ঘরে যাও। এই তোরা বাড়িত যাইতে পারবি? রাইতের বেলা আইছিলি কেন? বউ তো কাইলও দেহন যাইত। জাফর ছেড়িগুলারে দিয়া আইতে পারবি? মদন কই? মগা কই? কামের বেলা দুইডারে পাওন যায় না,’ কথাগুলো একনাগাড়ে বললেন ফরিনা বেগম। তিনি নুরজাহানের উপস্থিতি যেন উপেক্ষা করতে চাইছেন। মদন ছুটে আসে বাইরে থেকে। মাথা নত করে ফরিনাকে বলল, ‘আইছি, খালাম্মা।’

‘থাহস কই? যা এদের দিয়া আয়। আমরার বাড়িত যহন আইছে এরা এহন আমরার দায়িত্বে। সুন্দর কইরা বাড়িত দিয়া আইবি।’

‘আচ্ছা খালাম্মা। আপারা চলেন!’

মেয়েগুলো সারাক্ষণ হাসছিল। যাওয়ার সময়ও হাসতে হাসতে গেল। মেয়েগুলোর উদ্দেশ্যে রানি ঠোঁট বাঁকাল, তা খেয়াল করে রিদওয়ান রানির মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল, ‘সারাক্ষণ মুখ মুরাস কেন? একদিন দেখবি আর মুখ সোজা হচ্ছে না। বিয়েও হবে না।’

‘না হলে নাই। ছেড়িগুলারে দেখছ বড়ো ভাই? কেমনে হে হে কইরা হাসতাছিল।’

‘তাতে তোর কী?’

নুরজাহান পদ্মজাকে বললেন, ‘ই মেলা রাইত হইছে। আইয়ো বনু আমার ঘরে আইয়ো। আইজ আমার লগে থাকবা।’

‘আপনার লগে ক্যান? পদ্মজায় আমার লগে আমার ঘরে থাকব। হেইডাই তো কথা হইছে। পদ্মজায়ও এইডাই চায়।’

‘দেহো বউ তর্ক কইরো না। নাত বউ আমার পছন্দ হইছে। আমি আমার লগে রাখুম।’

‘এই পদ্মজা তুমি কার লগে থাকবা?’ ফরিনা কিঞ্চিৎ রাগান্বিত স্বরে প্রশ্ন করলেন। পদ্মজার অবস্থা দরজার চাপায় পড়ার মতো। এ কোন জগতে এসে পড়ল সে! পদ্মজা গোপনে ঢোক গিলল। নুরজাহান আমিরকে আদেশ করলেন, ‘খাড়ায়া রইছস কেন? বউরে কোলে লইয়া আমার ঘরে দিয়া যা।’

আমির পদ্মজাকে কোলে তুলতে গেলে ফরিনা বললেন, ‘বাবু আমি তোর মা। তোরে জন্ম দিছি আমি। আমার কথাই শেষ কথা। আমার ছেড়ার বউ আমার ঘরে থাকব। আমার কথা অমান্য করলে জান্নাত পাইবি না।’

নুরজাহান পদ্মজাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, ‘দেখছোনি বনু? এমন কইলজা বড়ো বউ কেউ ঘরে রাহে? আমি মানুষ ভালা বইলা এই বউরে বাইর কইরা দেই নাই। সহ্য কইরা কইরা এহন মরার পথে আছি।’

‘তোমাদের কারোর সঙ্গে থাকতে হবে না। আমার বউ আমার ঘরেই চলুক,’ বলল আমির। কণ্ঠে তার খুশির মেলা। সুযোগ বুঝে নিজের জিনিস নিজে বুঝে নিতে চাইছে। ফরিনা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে আমিরের দিকে তাকিয়ে নুরজাহানকে বললেন, ‘আপনার ঘরেই লইয়া যান।’

ফরিনার কথা শুনে আমিরের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। নুরজাহান বিজয়ের হাসি হেসে বললেন, ‘ভাই, বউরে কোলে লও। লইয়া আও আমার ঘরে।’

পদ্মজা দ্রুত মিনমিনিয়ে বলল, ‘আমি হেঁটে যেতে পারব।’

‘আইচ্ছা তাইলে হাঁটো। ধরো আমার হাত ধরো, নুরজাহান হাত বাড়িয়ে দেন। পদ্মজা নুরজাহানের হাত শক্ত করে ধরে মৃদু করে হাসল। তাদের পিছু নিলো আমির। সে দাদির ঘর অবধি যাবে।

পদ্মজাকে তার মোটেও ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।

.

নুরজাহানের ঘরে যাওয়ার পথে পদ্মজা কান্নার সুর শুনতে পেল। কে কাঁদছে? কী করুণ সেই কান্নার স্বর! এদিক-ওদিক দৃষ্টি মেলে তাকাল সে। আরেকটু এগোতেই খুব কাছে জোরে একটা আওয়াজ হলো, কেঁপে উঠে দ্রুত সেদিকে তাকাল পদ্মজা। মাত্র দুই হাত দূরে একটা দরজা। ভেতর থেকে কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে আর কাঁদছে। পদ্মজাকে ভয় পেতে দেখে আমির বলল, ‘ভয় পাচ্ছো?’

পদ্মজা ভয়ে ভরা ব্যথিত কণ্ঠে বলল, ‘কে ওখানে? এভাবে কাঁদছে কেন? দরজাটা খুলে দিন না!

তার কথায় আমির বা নুরজাহান কারো কোনো ভাবান্তর হলো না। পদ্মজাকে নিয়ে পাশ কেটে চলে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *