পদ্মজা – ২০

২০

আজ যেন শুধু মোড়ল বাড়ির মাথার ওপরেই সূর্য উঠেছে। সকাল থেকে আত্মীয় আপ্যায়নের প্রস্তুতির তোড়জোড় চলছে। সবাই ঘেমে একাকার। বাড়ির প্রতিটি মানুষ ব্যস্ত। মোর্শেদ হিমেল ও প্রান্তকে নিয়ে বাজার করে ফিরেছেন সূর্য ওঠার মাথায়। লাহাড়ি ঘরের পাশে বড়ো উনুন করা হয়েছে। সাধারণ চালের পরিবর্তে সুগন্ধি, সিদ্ধ চালের ভাত রান্না করা হয়েছে; সেই সঙ্গে রাজহাঁস আর দেশি মুরগি। বাড়িজুড়ে রমরমা ব্যাপার। একদিন আগের ঘটনা ধামাচাপা পড়েছে পঁচানব্বই ভাগ। ছোটো ছোটো দরিদ্র ছেলেমেয়েরা খাবারের ঘ্রাণ পেয়ে ছুটে এসেছে মোড়ল বাড়ি। সবার মধ্যেই নতুন উত্তেজনা, নতুন অনুভূতি। শুধু পূর্ণা এখনো সেদিনের ঘটনা থেকে বেরোতে পারছে না, চিত হয়ে শুয়ে আছে ঘরে। মনজুরা আর শিউলির মাকে কাজে সাহায্য করছিল পদ্মজা। হেমলতা ধমকে ঘরে পাঠিয়ে দেন। পদ্মজা ঘামে ভেজা কপাল মুছতে মুছতে ঘরে প্রবেশ করে। পূর্ণার দুচোখ জলে নদী যেন! পদ্মজা বিছানার ওপর পা তুলে বসে। বোনের উপস্থিতি টের পেয়ে, হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছল পূর্ণা।

পদ্মজা কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলল, ‘চোখের জল কী শেষ হয় না?’

পূর্ণা নিরুত্তর। পদ্মজা অভিজ্ঞ স্বরে বলল, ‘দেখ পূর্ণা, এসব মনে রাখলে তোরই ক্ষতি। দেখছিস না, আমি অল্প সময়ের ব্যবধানে সব ভুলে হবু শ্বশুরবাড়ির মানুষদের জন্য রান্নাবান্না করছি। তুইও ভুলে যা। তোর বন্ধুরা আসছে। তুই নাকি তাদের ধমকে দিয়েছিস? এটা কিন্তু ঠিক না। ‘

পূর্ণা পদ্মজার দিকে তাকাল। দৃষ্টি ভীষণ শীতল। পদ্মজাকে বলল, ‘সত্যি ভুলতে পেরেছ আপা?’

পদ্মজা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘ভুলিনি। কিন্তু সহ্য করতে পেরেছি। তোর মতো চোখের জল অপাত্রে ঢালছি না।’

পূর্ণা উঠে বসে, একটা বালিশ বুকে জড়িয়ে ধরে দায়সারাভাবে বলল, ‘তুমি অনেক শক্ত আপা। আমি খুব দুর্বল, ভুলতে পারছি না।’

পদ্মজা আর কথা বাড়াল না। পূর্ণার গাঁ ঘেঁষে বসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘গতকাল রাতে কী হয়েছে জানিস?’

‘কী হয়েছে?’

পদ্মজা চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘তোর নায়ক ভাইয়ের চিঠি আম্মার হাতে পড়েছে।’

পূর্ণা আঁতকে উঠে বলল, ‘সে-কী! কখন? কীভাবে?’

‘আর বলিস না! সেদিন তুই নানাবাড়ি ছিলি। তখন চিঠি দুইটা বের করেছিলাম। বারান্দার ঘরে বালিশের নিচে রেখে দিই। আর মনে নেই 1 এরপরেই অঘটন ঘটে। এরপর দিন বিচার বসল। চিঠির কথা ভুলেই গেলাম। বারান্দার ঘরে ছিলাম রাতে তবুও মনে পড়েনি। আর আম্মা পেয়ে গেল।’

উত্তেজনা-ভয়ে পূর্ণার গলা শুকিয়ে গেছে। প্রশ্ন করল, ‘আম্মা কী বলছে?’

পদ্মজা ঠোঁট দুটি উলটে কী যেন ভাবে। এরপর ব্যথিত স্বরে বলল, ‘তেমন কিছুই না। এজন্যই আরো ভয় হচ্ছে।’

‘কিছুই না?’

‘কখন হলো এসব—জিজ্ঞাসা করেছে। আমি বললাম, তুমি যা বলবে তাই হবে। এরপর আম্মা অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল।’

‘তারপর?’

‘বলল, ঘুমা গিয়ে। শেষ।’

দুই বোন একসঙ্গে চিন্তায় পড়ে গেল। কপাল ভাঁজ করে কিছু ভাবতে শুরু করে। পূর্ণা বলল, ‘আম্মা তোমার মুখ দেখে বুঝে গেছে তুমি লিখন ভাইকে ভালোবাস না।’

পদ্মজা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, ‘মনে হয়।

পূর্ণা খুব বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘লিখন ভাই এত সুন্দর, তোমাকে এত ভালোবাসে তবুও কেন ভালোবাসোনি আপা? লিখন ভাইয়ের চিঠি তো ঠিকই সময় করে করে পড়তে। বিয়ে করতে কী সমস্যা?’

‘আম্মা দিলে তো করবই। সমস্যা নেই।’

‘তোমার এই ন্যাকার কথা আমার ভালো লাগে না আপা।’

পূর্ণার রেগে কথা বলা দেখে পদ্মজা হেসে ফেলল।

পদ্মজা পূর্ণার এক হাত মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘গতকাল রাতে আম্মা আব্বাকে কতটা ভালোবাসে আমাকে বলেছে। প্রথম দেখেই নাকি আপন- আপন লেগেছিল। আব্বার জন্য আম্মা দিনকে রাত, রাতকে দিন মানতেও রাজি ছিলো। এতটা ভালোবাসত! আমার তেমন কোনো অনুভূতি হয়নি তোর নায়ক ভাইয়ের জন্য। প্রথম প্রথম কোনো পুরুষের চিঠি পেয়েছিলাম, সবকিছু নতুন ছিল। তাই একটা ঘোরে গিয়ে নতুন অনুভূতির সাক্ষাৎ পাচ্ছিলাম। আম্মার ভালোবাসার কথা শোনার পর থেকে মনে হচ্ছে আমি উনাকে ভালোবাসিনি। সবটা মোহ ছিল। দূরে যেতেই উবে গেছে। তবে উনি খুব অসাধারণ একজন মানুষ। আম্মা উনার হাতে আমাকে তুলে দিলে কোনো ভুল হবে না। কিন্তু এটা এখন কল্পনাতীত। পরিস্থিতি পালটে গেছে। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’

পদ্মজার এত কথা উপেক্ষা করে পূর্ণা কটমট করে বলল, ‘তোমার কী কালাচাঁদরে দেখলে আপন আপন লাগে?’

পদ্মজা চোখ ছোটো ছোটো করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কালাচাঁদ কে?

পূর্ণা মিনমিনিয়ে বলল, ‘তোমার হবু জামাই,’ তারপরই গলা উঁচিয়ে বলল, ‘আমিও কালা। কিন্তু আপা, তোমার জন্য লিখন ভাইয়ের মতো সুন্দর জামাই দরকার।’

পদ্মজা এক হাতে কপাল চাপড়ে বলল, ‘এখনও লিখন ভাই! যা তোর সঙ্গে তোর নায়কের বিয়ে দিয়ে দেব। এখন আয়, ঘর থেকে বের হ। মুক্তা, সোনামণি, রোজিনা এসেছে। তোর সঙ্গে কথা বলবে। আয় বলছি…আয়।’

পূর্ণাকে টেনে নিয়ে বন্ধুদের মাঝে বসিয়ে দিল পদ্মজা। ঘরে এসে আয়নায় নিজেকে দেখে থমকে দাঁড়াল, ছুঁয়ে দেখল গালের দাগটা। সে কী সত্যি নির্মম, নিষ্ঠুর মুহূর্তটি সহ্য করে নিয়েছে? না, করেনি। বুকের ভেতরটা খুব জ্বলে। এই অপমান মেনে নিতে গিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে মরে যাচ্ছে সে। কিন্তু আম্মা বা পূর্ণাকে সেটা বুঝতে দেয়া যাবে না। পদ্মজা দ্রুত চোখের জল মুছে একা হাসার চেষ্টা করল।

সূর্য মামার রাগ কমেছে। তাই মোড়ল বাড়ির মাথার ওপর থেকে সরে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সদর ঘর ভরতি মানুষ। হাওলাদার বাড়ির মহিলারা এসেছে। যদিও তাদের আরো আগে আসার কথা ছিল। নানা কারণে তারিখ পিছিয়ে দিতে হয়েছে। হাওলাদার বাড়ির বউদের গ্রামবাসী শেষবার তাদের বিয়েতেই দেখেছে। আবার দেখার সুযোগ হওয়াতে দল বেঁধে মানুষ এসেছে। লোকমুখে শোনা যায়, হাওলাদার বাড়ির মেয়ে-বউদের সারা অঙ্গে সোনার অলংকার ঝলমল করে। মগা-মদনসহ আরো দুজন ভৃত্য মোড়ল বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। পদ্মজাকে শাড়ি পরাচ্ছেন হেমলতা। পদ্মজা এর আগে কখনো শাড়ি পরেনি। পূর্ণা-প্রেমা ছোটো হয়েও পরেছে। পদ্মজার কখনো ইচ্ছে করেনি। তাই সে হেমলতাকে বলল, ‘প্রথম শাড়ি তুমি পরাবে।’

শাড়ি পরানো শেষে, চোখে কাজল এঁকে দেন হেমলতা। ঠোঁটে লিপিস্টিক দিতে গিয়েও দিলেন না। মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করে চুল খোঁপা করতেই, পূর্ণা ছুটে আসে। হাতে শিউলি ফুলের মালা।

হেমলতা মৃদু ধমকের স্বরে বললেন, ‘এতক্ষণ লাগল!’

হেমলতার কথা বোধহয় পূর্ণার কানে গেল না।

পূর্ণা চাপা উত্তেজনা নিয়ে

তা আপাকে কী সুন্দর লাগছে!’

পদ্মজা লজ্জা পেল, চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ল লাল আভা। হেমলতা পদ্মজার খোঁপায় ফুলের মালা লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘শুধু রূপে চারিদিক আলোকিত করলে হবে না, গুণেও তেমন হতে হবে।’

পদ্মজা বাধ্যের মতো মাথা নাড়াল। তখন হুড়মুড়িয়ে সেখানে উপস্থিত হয় লাবণ্য। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে জাপটে ধরে। এক নিশ্বাসে বলে উঠে, ‘আল্লাহ, পদ্ম তুই আমার ভাবি হবি। আমার বিশ্বাসই হইতাছে না। মনে হইতাছে স্বপ্ন দেখতাছি। ইয়া…মাবুদ, শাড়িতে তোরে পরি লাগতাছে। তোর রূপ দেখে বাড়ির সবাই অজ্ঞান হয়ে যাবে দেহিস।’

পদ্মজা কী বলবে ভেবে পেল না, শুধু হাসল। হেমলতা পদ্মজার মাথার ঘোমটা টেনে দিয়ে লাবণ্যকে বললেন, ‘তোমার সইকে নিয়ে যাও।’

পদ্মজা হেমলতার হাতে হাত রেখে অনুরোধ করে বলল, ‘আম্মা, তুমিও এসো।’

হেমলতা হেসে পদ্মজার মাথায় এক হাত রেখে বললেন, ‘কয়দিন পর থেকে এরাই তোর আপন। মা পাশে থাকবে না।’

পদ্মজার চোখ দুটি সজল হয়ে ওঠে। ছলছল চোখ নিয়ে সে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। পদ্মজাকে নতুন বউ রূপে দেখে হেমলতার বুকে ঝড় বইছে। মেয়েটা কয়দিন পর আলাদা হয়ে যাবে। দুই মাস আগে হলে তিনি সাত রাজার ধনের বিনিময়েও মেয়ের বিয়ে দিতেন না। তিনি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে বললেন, ‘আমি আসছি। লাবণ্য যাও তো নিয়ে যাও। পূর্ণা তুইও যা।’

লাবণ্য পদ্মজাকে নিয়ে যায়। পদ্মজার বুক ধড়ফড় করছে। মায়ের যেন কী হয়েছে! সে পেছন ফিরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা অন্য দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে, তিনি দ্রুত তা মুছে ফেললেন।

সদর ঘর কোলাহলময় ছিল। পদ্মজা ঢুকতেই সব চুপ হয়ে গেল। লাবণ্য পদ্মজাকে ছেড়ে ভারী আনন্দ নিয়ে বলল, ‘আম্মা, কাকিম্মা, ভাবি, আপারা—এই যে পদ্মজা। আমার নতুন ভাবি।’

পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। অলংকারে জ্বলজ্বল করা পাঁচ জন নারীকে দেখে যেন চোখ ঝলসে গেল। সবাই তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। পদ্মজা চোখ নামিয়ে ফেলল। তখন কোত্থেকে আবির্ভাব হলো আমিরের সদর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল পদ্মজা, হবু বউকে দেখে থমকে গেল সে। পদ্মজার পরনে খয়েরি রংয়ের জামদানি শাড়ি। শাড়িতে কোনো মেয়েকে এত সুন্দর মনে হতে পারে এর আগে কখনো অনুভব করেনি আমির। আমিরের লজ্জা খুব কম। সে উপস্থিত গুরুজনদের উপেক্ষা করে পদ্মজাকে বলল, ‘মাশাআল্লাহ। দিনের বেলা চাঁদ উঠে গেছে।’

লজ্জায় পদ্মজার রগে রগে কাঁপন ধরে। এত লজ্জাহীন মানুষ কী করে হয়! আমিরের মা ফরিনা ধমকের স্বরে বললেন, ‘বাবু, এইনে বয় আইসসা।’

আমির পদ্মজার ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে মায়ের পাশে গিয়ে বসল। হেমলতা সদর ঘরে প্রবেশ করতেই আমির ধড়ফড়িয়ে উঠল। ছুটে এসে হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। হবু শাশুড়ির প্রতি আমিরের এত দরদ দেখে ফরিনা খুব বিরক্ত হলেন। পাশ থেকে ফরিনার জা আমিনা ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘মেয়ের রূপ আগুনের হলকা। বাবু এইবার হাত ছাড়া হইলো বলে।’

আমিনার মন্ত্র ফরিনার মগজ ধোলাই করতে পারল না। পদ্মজার রূপে তিনি মুগ্ধ। আমির কালো বলে তিনি ছোটো থেকেই আমিরকে বলতেন, ‘বাবু, তোর জন্যি চান্দের লাহান বউ আনাম।’

সেই কথা রক্ষার পথে। তিনি শুধু পছন্দ করছেন না শাশুড়ির প্রতি আমিরের এত দরদ! কী দরকার ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়ে ধরে সালাম করার? আমির হেমলতাকে ভক্তির সঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘ভালো আছেন?’

হেমলতা মিষ্টি করে হেসে বললেন, ‘ভালো আছি। যাও গিয়ে বসো।’

আমির বাধ্যের মতো মায়ের পাশে গিয়ে বসল। মজিদ মাতব্বর, মোর্শেদের সঙ্গে বাইরে আলোচনা করছেন। আর কোনো পুরুষ আসেনি বাড়িতে। তারা বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত। মুহূর্তে পদ্মজার সারা অঙ্গ সোনার অলংকারে পূর্ণ হয়ে উঠল। রূপ বেড়ে গেল লক্ষ গুণ, যার কোনো সীমা নেই। যার সঙ্গেই পদ্মজা কথা বলেছে, সেই এগিয়ে এসে বালা নয়তো হার পরিয়ে দিচ্ছে।

কী অবাক কাণ্ড!

সবাই আড্ডা দিচ্ছে। তবে চুপ করে বসে আছে পদ্মজা। কেউ প্রশ্ন করলে জবাব দিচ্ছে। লাবণ্য একজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘রানি আপা, বাড়ির পেছনে যাইবা?’

রানি খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, ‘যাব।’

তার খুশির কারণ লাবণ্য কিছুটা ধরতে পেরেছে। রানির একজন প্ৰেমিক আছে। তাই শুধু সুযোগ খোঁজে দেখা করার। যেখানেই দাওয়াত পড়ে সেখানেই তার প্রেমিক উপস্থিত হয়। লাবণ্য সবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পদ্মজা-পূর্ণা, রানিকে নিয়ে বাড়ির পেছনে যায়। রানি বাড়ির পেছনে এসেই ছুটে যায় ঘাটের দিকে, সেই মুহূর্তেই একটা নৌকা এসে ভেরে সেখানে। নৌকায় কে ছিল দেখা যাচ্ছে না। রানি নৌকায় উঠে পড়ে। শোনা যায়, কারো সঙ্গে সে বিরতিহীন ভাবে কথা বলছে। পূর্ণা লাবণ্যকে প্রশ্ন করল, ‘লাবণ্য আপা, রানি আপা কার সঙ্গে কথা বলে?’

‘আবদুল ভাইয়ের সঙ্গে।’

‘কোন আবদুল?’

‘যার কথা ভাবছিস।’ কথা শেষ করে লাবণ্য চোখ টিপল। পূর্ণা অবাক হয়ে বলল, ‘মাস্টারের সঙ্গে!’

লাবণ্য হাসে। রানি এগিয়ে আসে। লাবণ্য বলল, ‘কথা শেষ?’

‘হ, চইলা গেছে।’

রানি পদ্মজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মাশাআল্লাহ, তুমি এত সুন্দর। আমার কোলে নিয়া আদর করতে মন চাইতাছে।

পদ্মজা মুচকি হেসে বলল, ‘আপনি খুব শুকনো। আমাকে কোলে নিতে পারবেন না।’

‘শুকনা হইতে পারি। শক্তি আছে।’

রানির কথা বলার ঢংয়ে সবাই হেসে উঠল। পূর্ণা পেছনে ফিরে দেখে আমির আসছে। সে তাৎক্ষণিক পদ্মজার কানে কানে বলল, ‘আপা তোমার কালাচাঁদ আসছে।’

পদ্মজা পূর্ণাকে চোখ রাঙিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কীসব কথা! উনার বোনরা আছে।’

আমির সেখানে এসেই বোনদের আদেশ করল, ‘লাবণ্য-রানি যা এখান থেকে।’

আমিরের আদেশ শুনে রানি-লাবণ্য খুব বিরক্ত হলো। রানি কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, ‘দাভাই, থাকি না।’

আমির চোখ রাঙিয়ে ধমকের স্বরে বলল, ‘যেতে বলছি যা।’

লাবণ্য বিরক্তিতে, ইস বলে পদ্মজাকে বলল, ‘আয় অন্যখানে যাই।’

‘পদ্মজা থাকুক। তোরা যা।’

আমিরের কথা শুনে বেশি চমকাল পদ্মজা। লাবণ্য ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, ‘কেন? কেন?’

পদ্মজা-পূর্ণা অন্যদিকে ফিরে আছে। আমির দৃষ্টি কঠোর করতেই লাবণ্য-রানি চলে যায়। পূর্ণা চলে যেতে চাইলে পদ্মজা পূর্ণার হাত চেপে ধরে। পূর্ণা পদ্মজার হাত ছাড়িয়ে, ধীরকণ্ঠে বলল, ‘একা থেকে তোমার কালাচাঁদের ভালোবাসা খাও।’

‘ছি।’

পূর্ণা ছুটে চলে গেল। আমির পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়াতেই পদ্মজা বলল, ‘বিয়ের আগে গুরুজনদের না জানিয়ে এভাবে একা কথা বলা ঠিক নয়।’

‘কী হবে?’

পদ্মজা কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, ‘কলঙ্ক লাগবে।’

‘আর কী বাকি আছে?’

‘পরিমাণ না বাড়ানোই ভালো।’

পদ্মজার কথা বলতে একটুও গলা কাঁপেনি। বাড়ির ভেতর চলে আসার জন্য পা বাড়াতেই আমির পদ্মজার এক হাত থাবা দিয়ে ধরে আবার ছেড়ে দিল। পদ্মজা ছিটকে সরে গেল দূরে।

আমির বলল, ‘তুমি সত্যি একটা পদ্ম ফুল, পদ্মবতী। এজন্যই লিখন শাহর মতো সুদর্শন যুবক তোমার প্রেমে পড়েছে।’

দেখা হওয়ার পর এই প্রথম পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। পরপরই চোখের দৃষ্টি সরিয়ে ছুটে বাড়ির ভেতর চলে গেল। আমির অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। এবার আত্মীয় বিদায়ের পালা। যাওয়ার পূর্বে লাবণ্য একটা কাগজ পদ্মজার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘দাভাই দিছে।’

ঘুমাবার আগে পদ্মজা কাঁপা হাতে কাগজটির ভাঁজটি খুলল। কাগজটিতে যত্ন করে লেখা—

সারা অঙ্গ কলঙ্কে ঝলসে যাক
তুই বন্ধু শুধু আমার থাক।

২১

বাড়ির সব কাজ শেষ করে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে ঘরে ঢুকলেন হেমলতা। মোর্শেদ সবেমাত্র শুয়েছেন। হেমলতা বিছানার এক পাশে কাত হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলেন।

মোর্শেদ হেমলতার দিকে ফিরে ধীরকণ্ঠে বললেন, ‘ধানের মিলটা পাইয়া যাইতাছি।’ গলা দুর্বল হলেও খুশিতে চোখ চকচক করছে।

হেমলতা মৃদু হেসে বললেন, ‘মাতব্বর কী যৌতুক দিচ্ছেন?’

মোর্শেদ হেসে বললেন, ‘সে কইতে পারো। সে আমারে কী কইছে জানো?’

‘কী?’

‘কইল, শুনো মোর্শেদ…আইচ্ছা আগে হুনো আমি কিন্তু শহুরে ভাষায় কইতে পারুম না। আমি আমার গেরামের ভাষায় কইতাছি।’

মোর্শেদের কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেমলতা আওয়াজ করে হাসলেন। বললেন, ‘যেভাবে ইচ্ছে বলো।’

মোর্শেদ খ্যাক করে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘কইল, হুনো মোর্শেদ, তোমার এই মোড়ল বাড়ি হইতাছে একটা বিল। যে বিলে একটাই পদ্ম ফুল আছে। এই পদ্ম ফুলডার জন্যই এই বিলটা এত সুন্দর। আর আমি সেই পদ্ম ফুলডারে তুইললা নিয়া যাইতাছি। এই বিলে পদ্ম ফুলডার চেয়ে দামি সুন্দর আর কিছু নাই। তাই আমার আর কিছু লাগব না। বিনিময়ে আমি এই খালি বিলডারে ধানের মিল দিয়ে দিলাম। বুঝলা লতা? মাতব্বর মানুষটা সাক্ষাৎ ফেরেশতা। মন দয়ার সাগর।’

হেমলতা ছোটো করে বললেন, ‘হুম।’

পরমুহূর্তেই বললেন, ‘একটা প্রশ্ন করার ছিল।’

মোর্শেদ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান। হেমলতা উঠে বসে বললেন, ‘লিখনকে মনে আছে? সে কি তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল?’

মোর্শেদ লেশমাত্র অবাক হলেন না। দায়সারাভাবে বললেন, ‘এতদিনে জানলা? আমি মনে করছি কবেই জাইন্যা ফালাইছ।’

‘আমি তো আর সবজান্তা নই। আমাকে বলোনি কেন?’

‘বইললা কী হইত? ছেড়ি বিয়া দিতা? আর ছেড়াড়া নায়ক। কত ছেড়ির লগে ঘষাঘষি করে। ছেড়িগুলাও নষ্টা। নষ্টাদের সঙ্গে চলে এই ছেড়ায়।’

মুখ খারাপ করো না। ছেলেটার মধ্যে আমি তেমন কিছু দেখিনি। তুমি আমাকে জানাতে পারতে। নিশ্চিন্তে ছেলেটা সুপাত্র। বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে, সে মা-বাবা নিয়ে আসলে আমি ফিরিয়ে দিতাম না। থাক…এসব কথা। এখন বলেও লাভ নেই। পদ্মজার মন স্থির আছে। পরিস্থিতি আর ভাগ্য সেখানে নিয়ে যাচ্ছে সেখানেই গা ভাসিয়ে চলুক। ঘুমাও এখন। ভোরে উঠে গোলাপ ভাইয়ের বাড়িতে যেয়ো। কত কাজ বাকি! বাড়ির বড়ো মেয়ের বিয়ে কী সামান্য কথা!

হেমলতা কথা বলতে বলতে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়েন, ঘুমিয়েও পড়লেন কিছুক্ষণের মাঝে।

.

সকাল থেকে পূর্ণার দেখা নেই। তাকে খুঁজতে খুঁজতে ঘাটে চলে গেল পদ্মজা। পূর্ণা সিঁড়িঘাটে বসে উদাস হয়ে কিছু ভাবছে। পদ্মজা পা টিপে হেঁটে এলো। পূর্ণা তখনো বোনের উপস্থিতি টের পায়নি। পদ্মজা পাশে বসে, তাও পূর্ণা টের পেল না। পদ্মজা ধাক্কা দিতেই, পূর্ণা চমকে তাকাল।

বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, ‘ভয় পেয়েছি আপা।’

‘উদাস হয়ে কী ভাবছিস?’

‘কিছু না।’

‘আবার ওইসব ভাবছিস! কতবার না করলে শুনবি বল তো?’

পূর্ণা নতজানু হয়ে রইল। ক্ষণকাল পার হওয়ার পর ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘নিজের ইচ্ছায় মনে করে কষ্ট পেতে আমার ইচ্ছে করে না। কিন্তু মনে পড়ে যায়।’

‘চেষ্টা তো করবি। আর ভুলতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই 1 অমানুষগুলোও তাদের শাস্তি পেয়েছে। একটু নিজেকে ভালো রাখার চেষ্টা কর।’

পূর্ণা চোখের জল মুছে আগ্রহ নিয়ে বলল, ‘আম্মা তিনজনকে কী করে মারল আপা? আমাদের আম্মা খুনি?’

পূর্ণার মুখ চেপে ধরল পদ্মজা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আর কখনো এটা বলবি না।’

‘কিন্তু আমি জানতে চাই, কী করে আম্মা খুন করল?’

‘জানি না।’

‘আম্মাকে জিজ্ঞাসা করবে?’

পদ্মজা ভাবল। এরপর বলল, ‘করব। তবে আজ না অন্য একদিন।’

‘বিয়ে করে তো চলেই যাবে।’

পদ্মজা অভিমানী চোখে তাকাল পূর্ণার দিকে। বলল, ‘আর কী আসব না? ফিরে যাত্রা আছে। আবার কয়দিন পর পর এমনিতেও আসব।’

‘তাহলে কালাচাঁদের সঙ্গে বিয়েটা সত্যিই হচ্ছে?’

‘তুই কী মিথ্যে ভাবছিস?’

পূর্ণা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেলল। বলল, ‘লিখন ভাইয়ের জন্য কষ্ট হচ্ছে।’

লিখন নামটা শুনে পদ্মজা অপ্রতিভ হয়ে উঠল। নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে। এই অনুভূতির কোনো মানে নেই, সে কোনো অপরাধ করেনি…তবুও ভাবলেই কী যেন হয় ভেতরে!

পদ্মজা প্রসঙ্গ পালটাতে বলল, উনাকে…মানে মাতব্বরের ছেলেকে পছন্দ না তাই কালা বলিস, ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু চাঁদ কেন বলিস বুঝলাম না!’

পূর্ণা আড়চোখে পদ্মজার দিকে তাকাল। যান্ত্রিক স্বরে জানাল, ‘পাতিলের তলার মতো কালা হয়ে আমার চাঁদের মতো সুন্দর বোনকে বিয়ে করবে বলেই কালাচাঁদ ডাকি। নয়তো কালা পাতিল ডাকতাম। আবার দরদ দেখিয়ে বলো না, উনি তো এত কালা না, শ্যামলা।’ কথা শেষ করে পূর্ণা ঠোঁট বাঁকাল।

পদ্মজা শব্দ করে হাসতে শুরু করল। কিছুতেই তার হাসি থামছে না। পূর্ণা পদ্মজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তুমি খুব কঠিন আপা। খুব ধৈর্য তোমার, ঠিক আম্মার মতো।’

পদ্মজা হাসি থামিয়ে পূর্ণার দিকে তাকাল। সময়টা শুধু দুই বোনের পদ্মজা স্নেহার্দ্র কণ্ঠে শুধাল, ‘আর তুই ঠিক আম্মার বাহ্যিক রূপের জোড়া পৰ্ব।’

প্রান্ত-প্রেমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে নদীর ঘাটে। পদ্মজার উদ্দেশ্যে বলল, ‘বড়ো আপা, দুলাভাই আসছে।’

আমির আসার সংবাদ পেয়েই খিড়কি দিয়ে পদ্মজা নিজের ঘরে চলে গেল। এই লোকটা এত বেহায়া আর নির্লজ্জ! গতকাল নাকি সকাল-বিকাল বাড়ির সামনে ঘুর ঘুর করেছে। আজ একেবারে বাড়িতে! বিয়ের তো আর মাত্র তিন দিন বাকি। এতটুকু সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না?

পদ্মজা কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করে, ‘এ কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আল্লাহ!’ উঠানে হেমলতা ছিলেন। আমির বাড়ির ভেতর ঢুকেই হেমলতার পা ছুঁয়ে সালাম করল। নতজানু হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, ‘কেমন আছেন আম্মা?’

হেমলতার চক্ষু চড়কগাছ! আমিরের সঙ্গে মগা এসেছে। মগার হাতে মাছের ব্যাগ, মাথায় ঝুড়ি। তাতে মশলাপাতি সঙ্গে শাকসবজি। বিয়ের আগে এত বাজার আবার আম্মা ডাকা হচ্ছে! অপ্রত্যাশিত ব্যাপার স্যাপার! হেমলতা ঢোক গিলে ব্যাপারটা হজম করে নিলেন। ধীরেসুস্থে বললেন, ‘ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? বাড়ির সবাই ভালো আছে?’

‘জি, জি। সবাই ভালো।’

আমির মগাকে ইশারা করতেই মগা বারান্দায় মাছের ব্যাগ, মাথার ঝুড়ি রেখে দিল।

হেমলতা ঠোঁটে হাসি ধরে রেখে বললেন, ‘এতসব বিয়ের আগে আনার কী দরকার ছিল? পাগল ছেলে।’

আমির হেসে নতজানু অবস্থায় ইতস্ততভাবে বলল, ‘এমনি।’

‘যাও, ঘরে গিয়ে বসো।’

‘আম্মা…’

হেমলতা চলে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমির দ্রুত বলল, ‘আম্মা, ক্ষমা করবেন। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে হবে।’

হেমলতা বুঝতে পারছেন না, ছেলেটা কী চাচ্ছে! তিনি আগ্রহান্বিত হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কোনো দরকার ছিল?’

‘আ…আসলে আম্মা। পদ্মজার সঙ্গে একটু কথা ছিল।’

আমির উসখুস করছে। হাত-পা নাড়াচ্ছে এদিক-ওদিক, কিন্তু চোখ মাটিতে স্থির। হেমলতা আমিরকে ভালো করে পরখ করে নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা যাও, পদ্মজা ঘরে আছে নয়তো ঘাটে।’

অনুমতি পেয়ে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে ঘরের দিকে চলে গেল আমির। হেমলতা তার যাওয়ার পানে চেয়ে থেকে ভাবছেন, ‘ছেলেটার সঙ্গে এখনও চোখাচোখি হয়নি। সবসময় মাথা নত করে রাখে। কিন্তু কথাবার্তায় তো মনে হচ্ছে, এই ছেলে মোটেও লাজুক নয়, তিনি কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে রাখলেন। পরে ভাবলেন: হয়তো গুরুজনদের সামনে মাথা নিচু করে রাখা ছোটোবেলার স্বভাব। ভালো অভ্যাস!

হেমলতা মুচকি হেসে লাহাড়ি ঘরের দিকে এগিয়ে যান।

পদ্মজার ঘরের শেষ প্রান্তে একটি বারান্দা আছে। বারান্দা পেরোলেই বাড়ির পেছনের দরজা। আমির আসছে শুনে ঘর আর বারান্দার মাঝ বরাবর দরজায় পর্দা টানিয়ে দিল পদ্মজা। আমির হন্তদন্ত হয়ে ঘরের দিকে, পর্দার অন্যপাশে দাঁড়াল। পদ্মজা দাঁড়াল বারান্দার দিকে। পর্দার কাপড় পাতলা ও মসৃণ। তাই পদ্মজার অবয়ব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আমির। তিরতির করে বাতাস বইছে। সেই বাতাসে পদ্মজার কপালে ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো অবাধ্য হয়ে উড়ছে।

আমির ডাকল, ‘পদ্মজা?’

‘হু?’ পদ্মজা লজ্জায় কথা বলতে পারছে না।

‘কেমন আছো?’

‘ভালো। আপনি?’

‘ভালো।’

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। পদ্মজা বলল, ‘কী বলবেন বলুন।’

সঙ্গে সঙ্গে আমির বলল, ‘মায়াভরা চোখগুলো দেখার সৌভাগ্য কী হবে?’ আমিরের কণ্ঠে আকুতি! তৃষ্ণা! পদ্মজার পীড়া লাগছে। বেহায়া মানুষ বড়োই বিপজ্জনক। সে পালানোর জন্য পা বাড়াতেই আমির হই হই করে উঠল, কসম লাগে পালাবে না।’

পদ্মজা মাথার ওড়না টেনে নিয়ে বলল, ‘প্রয়োজনীয় কথা থাকলে বলে চলে যান।’

‘তাড়িয়ে দিচ্ছো?’

‘ছি, না।’

‘তোমায় না দেখলে আজ আর প্রাণে বাঁচব না। রাতেই ইন্না লিল্লাহ…’

‘রসিকতা করবেন না। কাউকে না দেখে কেউ মরে না।’

‘পদ্মবতীর রূপ যে পুরুষ একবার দেখেছে সে যদি বার বার না দেখার আগ্রহ দেখায় তাহলে সে কোনো জাতেরই পুরুষ না। একবার দেখা দাও। কসম লাগে…’

‘বার বার কসম দিয়ে ঠিক করছেন না।’

‘আচ্ছা, কসম আর কসম দেব না। একবার দেখা দাও।’

পদ্মজার দুই ঠোঁট হাঁ হয়ে গেল। কী বলে মানুষটা! কসম করেই বলছে আর কসম দিবে না। আমির ধৈর্যহারা হয়ে বলল, ‘পদ্মবতী অনুরোধ রাখো…’

‘এভাবে বলবেন না। নিজেকে ছোটো লাগে।’

‘পর্দা সরাব?’

পদ্মজা ঘামছে। বাতাসে অস্বস্তি, নিশ্বাসে অস্বস্তি। তবুও সায় দিল 1 আমির পর্দা সরিয়ে খুব কাছ থেকে পদ্মজাকে দেখতে পেল। কালো রঙের সালোয়ার কামিজ পরেছে। সিঁথির মাঝ অবধি ঘোমটা টেনে রাখা।

পদ্মজা চোখ তুলে তাকাতেই আমির বলল, ‘জীবন ধন্য।’

আমিরের কথা বলার ভঙ্গি দেখে পদ্মজা হাসি সামলাতে পারল না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসল। আমির বলল, ‘এ মুখ প্রতিদিন ভোরে দেখব। আর প্রতিদিনই জীবন ধন্য হবে। এমন কপাল কয়জনের হয়!

পদ্মজা কিছু বলল না। আমির আবেগে আপ্লুত হয়ে বলল, আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার হাতে খুন হয়ে যাই।’

পদ্মজা চমকে উঠল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘আপনি পাগল।’

আমির কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তোমার উপস্থিতি আমার নিশ্বাসের তীব্রতা কতটা বাড়িয়ে দিয়েছে টের পাচ্ছো?’

পদ্মজা দূরে সরে গেল। মনে মনে বলল, ‘আল্লাহ আমি পাগল হয়ে যাব। এ কার পাল্লায় পড়লাম। জ্ঞানবুদ্ধি, লাজলজ্জা কিছু নেই।’

অথচ মুখে বলল, ‘পেয়েছি। এবার আসি।

আমিরকে কিছু বলতে না দিয়ে পদ্মজা বারান্দা ছাড়ল।

বাড়ির পেছনে মগাকে পেয়ে তার পথ আটকে বলল, ‘মগা ভাই।’

মগা সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘জে, ভাবিজান।’

মগার মুখে ভাবি ডাক শুনে পদ্মজা বিরক্ত হলেও প্রকাশ করল না। বিরক্তি লুকিয়ে বলল, ‘লিখন শাহর কথা আপনি উনাকে বলেছেন?’

‘উনিটা কে?’

‘আপনার আমির ভাই।

‘জে, ভাবিজান।’

মগার অকপট স্বীকারোক্তি! পদ্মজা এ নিয়ে আর কথা বাড়াল না। মগাকে পাশ কেটে চলে গেল। মগা দৌড়ে এসে পদ্মজার পথ রোধ করে দাঁড়ায়, ফিসফিসিয়ে গোপন তথ্য দিল: আগামী দুই দিনের মধ্যে লিখন শাহ আসছে। তার বাবা-মাকে নিয়ে। খবরটা মগা গত সপ্তাহ পেয়েছে।

সংবাদটি পেয়ে পদ্মজার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। ঢোক গিলে নিজেকে আশ্বস্ত করল: আমি তো কথা দেইনি বিয়ে করার। কখনো চিঠিও দিইনি। লিখন শাহ নিরাশ হলে এটা তার দোষ নয়, লিখন শাহর ভাগ্য। তবুও পদ্মজার খারাপ লাগছে। অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।

জীবনে আবার কি নতুন কিছু ঘটতে চলেছে? বুক ধড়ফড় করছে।

ঘাটের সিঁড়িতে ঝিম মেরে বসে রইল পদ্মজা।

২৩

মোড়ল বাড়ির আনাচে-কানাচে আত্মীয়স্বজনদের উচ্চরব। পদ্মজা বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসে আছে। ঘরে দুষ্টু রমণী আছে কয়েকজন নিজেদের মধ্যে রসিকতা করছে, উচ্চস্বরে হাসছে। অথচ এরাই বিপদের সময় পাশে ছিল না। ভীষণ গরম পড়েছে। পদ্মজার পরনে সুতার কাজ করা সুতি শাড়ি। গরমে শুধু ঘামছে না, বমিও পাচ্ছে। প্রেমা পদ্মজার পাশে বসে ছিল।

প্রেমাকে ফিসফিসিয়ে বলল পদ্মজা, ‘এই বনু? আম্মাকে গিয়ে বলবি লেবুর শরবত দিতে?’

প্রেমা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল শরবত আনতে। হেমলতা রান্নাঘরে ছিলেন। প্রেমা লেবুর শরবতের কথা বললে তিনি বললেন, ‘তুই যা আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

লেবু গাছ থেকে সবেমাত্র ছিঁড়ে আনা পাকা লেবুর শরবত বানিয়ে পদ্মজার ঘরের দিকে গেলেন তিনি। গিয়ে দেখেন, পদ্মজা বিছানার এক পাশে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ছটফট করছে।

ঘরভরতি অনেক মানুষ। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘সবাই অন্য ঘরে যাও। পদ্মজাকে একা ছাড়ো।’

হেমলতার এমন আদেশে অনেকের রাগ হলেও চুপচাপ বেরিয়ে গেল। তিনি দরজা বন্ধ করে শরবতের গ্লাস পদ্মজার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, ‘সবসময় মুখ বন্ধ রাখা ভালো না। যারা বিপদে পাশে থাকে না, তাদের জন্য বিন্দুমাত্র অসুবিধার মুখোমুখি হবি না। গরমে তো শেষ হয়ে যাচ্ছিস। জানালার পাশটাও অন্যরা ভরাট করে রেখেছিল। ভালো করেই সরতে বলতি।’

পদ্মজা মায়ের কথার জবাব না দিয়ে এক নিশ্বাসে লেবুর শরবত শেষ করল। এবার একটু আরাম লাগছে। আলনার কাপড়গুলো অগোছালো। সকালেই তো ঠিক ছিল। নিশ্চয় মেয়েগুলোর কাজ। হেমলতা আলনার কাপড় ঠিক করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী নিয়ে এত চিন্তা করছিস?’

পদ্মজা কিছু না বলে বিছানায় আঙুল দিয়ে আঁকিবুকি করতে থাকল। পদ্মজার অস্বাভাবিকতা দেখে হেমলতা চিন্তায় পড়ে যান, ‘বলবি তো?’ পদ্মজা বিচলিত হয়ে বলল, ‘আম্মা উনি বোধহয় আজ আসবেন।’

‘উনি? উনি কে? আমির?’

না আম্মা। লিখন শাহ যে, উনি।’

হেমলতা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘কপালে যা আছে তাই তো হবে। ভাবিস না। আমি আছি, সব সামলে নেব। লিখনকে আমি বুঝাব।’

হেমলতার কথা শেষ হতেই পদ্মজা ভেজা কণ্ঠে বলল, উনি খুব কষ্ট পাবেন আম্মা।’

হেমলতা অবাক হয়ে তাকালেন পদ্মজার দিকে। পদ্মজা এত ব্যাকুল কেন হচ্ছে? তিনি কী পদ্মজার অনুভূতি চিনতে ভুল করেছেন? নাকি শুধুমাত্র কারো মন ভাঙবে ভেবে পদ্মজার এত ব্যাকুলতা? হেমলতা দোটানায় পড়ে গেলেন। পদ্মজার জীবনে এ কেমন টানাপোড়নের আবির্ভাব হলো! এই মুহূর্তে পদ্মজাকে বুঝতে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। ওদিকে হানি ডাকছে। হেমলতার বড়ো বোন হানি, গতকাল ঢাকা থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে এসেছে। হেমলতা দরজার দিকে পা বাড়ানোর আগে বলে গেলেন, আমার নোংরা অতীত আজ তোকে শুনাব। বাকি সিদ্ধান্ত তোর। যা চাইবি তাই হবে। মনে রাখিস, যা চাইবি তাই পাবি।’

পদ্মজা কিছু বলার পূর্বেই হেমলতা চলে গেলেন। পদ্মজার বুকের ভেতর অপ্রতিরোধ্য তুফান শুরু হয়। মায়ের অতীত জানার জন্য কত অপেক্ষা করেছে সে। আজ যখন সেই সুযোগ এলো…তার ভয় হচ্ছে খুব। কেন হচ্ছে জানে না; কিন্তু হচ্ছে। হাত-পায়ের রগে রগে শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে।

.

ভ্যানগাড়িতে চড়ে অলন্দপুরের আটপাড়ায় ঢুকল লিখন শাহ। সঙ্গে বাবা-মা এবং বোন। বাবা শব্দর আলী, মা ফাতিমা বেগম এবং বোন লিলি।

শব্দর আলী চশমার গ্লাস দিয়ে গ্রামের খেত দেখছেন আর বার বার বলছেন, ‘এই তো আমার দেশ। এই তো আমার বাংলাদেশ।’

ফাতিমা ভীষণ বিরক্ত ভ্যানে চড়ে। উনার ইচ্ছে ছিল কোনো মন্ত্রীর মেয়েকে ঘরের বউ করে আনবেন। অথচ পুত্রের নাকি পাত্রী পছন্দ হয়েছে গ্রামে। লিখনের জেদের কাছে হেরে গ্রামে আসতেই হলো।

লিখনের পরনে ছাইরঙা শার্ট। চোখে সানগ্লাস। উত্তেজনায় রীতিমতো তার হাত-পা কাঁপছে। এমন একটা দিন নেই, যেদিন পদ্মজার কথা ভেবে শুরু হয়নি। এমন একটা রাত নেই, যে রাতে পদ্মজাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা হয়নি। সময়ের ব্যবধানে পদ্মজাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে। প্রায়ই স্বপ্নে দেখে, পদ্মজা গৃহবধূর মতো তার ঘরে কোমরে আঁচল গুঁজে কাজ করছে।

কখনো বা অপরূপ সুন্দরী পদ্মজাকে ঘুমের ঘোরে ঠিক বিছানার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কল্পনার পদ্মজাকে নিয়ে সে সংসার পেতেছে। এবার হয়তো সত্যিই সেই সংসার হতে চলেছে। লিখন আনমনে হেসে উঠল। মনে

পড়ে যায় পদ্মজাকে প্রথম দেখার কথা। সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে অদ্ভুত ঝড় শুরু হয়। কী মায়াবী, কী স্নিগ্ধ একটা মুখ! তার চেয়েও সুন্দর পদ্মজার ভয় পাওয়া, লজ্জায় পালানোর চেষ্টা করা, পরপুরুষের ভয়ে আতঙ্কে থাকা। লিখন আওয়াজ করে হেসে উঠল। ফাতিমা আর শব্দর অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। লিলির এসবে খেয়াল নেই। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছে। লিখন মা-বাবাকে এভাবে থাকাতে দেখে খুক খুক করে কাশল। বলল, ‘সুন্দর না গ্রামটা? বুঝছো আব্বু, এই গ্রামটা এত সুন্দর যে আগামী বছর আবার আরেকটা সিনেমার জন্য এখানে আসতে হবে।’

শব্দর আলী প্রবল আনন্দের সঙ্গে বললেন, ‘সে ঠিক বলেছিস। মন জুড়িয়ে যাচ্ছে দেখে। চারিদিকে গাছপালা-নদী, পথঘাটও খুব সুন্দর, সাজানো। এখানে একটা বাড়ি বানালে কেমন হয়?’

লিখন গোপনে দীর্ঘশ্বাস লুকাল। তার বাবা যখন যেখানে যান, তখন সেখানেই বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দেখেন। কখনোই বানানো হয় না। ফাতিমা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তা আমরা উঠছি কার বাড়ি? তোর পছন্দ করা মেয়ের বাড়ি নাকি অন্য কোথাও?’

মায়ের চোখেমুখে বিরক্তি দেখে লিখনের হাসি পেল। বলল, ‘তোমাকে রাগলে এত ভালো লাগে আম্মু।’

ফাতিমা আড়চোখে ছেলের দিকে তাকান। প্রশংসা শুনতে তিনি বেশ পছন্দ করেন। লিখনের মুখে প্রশংসা শুনে একটু নিভলেন, ‘হয়েছে, আর কতক্ষণ?’

‘পাঁচ মিনিট। অলন্দপুরের মাতব্বর বড়ো মনের মানুষ। আমাকে নিজের সন্তানের দৃষ্টিতে দেখেন। যতদিন ছিলাম প্রতিদিন খোঁজ নিয়েছেন। নিজের একজন লোককে আমার সহায়ক হিসেবেও দিয়েছিলেন! উনার বাড়িতেই উঠব।’

লিলি চোখ-মুখ বিকৃত করে বলল, ‘অন্যের বাড়িতে উঠব! উফ।’

‘মারব ধরে। অন্যের বাড়ি তোর কাছে, আমার কাছে না। মজিদ চাচার বউ ফরিনা চাচি এত ভালো রাঁধেন! আমাকে নিজের হাতে বেশ কয়েকবার খাইয়ে দিয়েছেন। উনার একটাই ছেলে। ঢাকায় ব্যাবসা সামলাচ্ছে। তার সঙ্গে অবশ্য সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু ফরিনা চাচি সারাক্ষণ ছেলে-ছেলে করতেন। আমাকে পেয়ে ছেলের সব ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছিলেন। তাই ওই বাড়ি আমার কাছে আপন না লাগুক, পরও লাগে না। আর বিশাল বাড়ি। উনারা বিব্রত হবেন না। তিন-চার দিনেরই তো ব্যাপার।’

লিখনের এত বড়ো বক্তব্যের পার লিলি আর কিছু বলার মতো পেল না।

হাওলাদার বাড়ির সামনে এসে ভ্যান থামল। বাড়ির চারপাশ সাজানো দেখে বেশ অবাক হলো লিখন। লিলি চারপাশ দেখতে দেখতে বলল, ‘দাদাভাই, তুমি যে বিয়ে করতে এসেছো—এই খবর উনারা বোধহয় পেয়েছেন। তাই আগে থেকেই এত আয়োজন।’

লিখন লিলির মাথায় গাঁট্টা মেরে বলল, ‘বাড়িতে দুটো মেয়ে আছে। তাদের কারো বিয়ে হবে হয়তো। চল।’

ইটের বড়ো প্রাচীর চারদিকে। মাঝে বড়ো গেট। প্রাচীরের উচ্চতা ১৫ ফুট, আর গেটের বারো। পাশেই দুজন দাঁড়িয়ে ছিল, তারা লিখনকে চিনে। তাই বাড়ির ভেতর ঢুকতে দিল।

গেট পার হলেই খোলা জায়গা, প্রচুর গাছপালা। বেশ অনেকগুলো সুপারি গাছ এবং তালগাছ। সবকিছু সুন্দর! দুই মিনিট হাঁটার পর রং করা টিনের একটা বড়ো ঘর। তার সামনে সিঁড়ি। সিঁড়ির দুই পাশে সিমেন্টের তৈরি বসার বেঞ্চি। এই ঘরটাকে গ্রামে আলগ ঘর বলা হয়, কেউ কেউ আলগা ঘর বলে থাকে। অতিথিরা এসে বিশ্রাম নেয়, রাত্রিযাপন করে। ভেতরে ইট সিমেন্টের তৈরি দুতালা অন্দরমহল। আলগ ঘরের বারান্দায় বসে ছিলেন মজিদ মাতব্বর, ফরিনা ও রিদওয়ান। লিখনকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে উনারা অবাক হোন, সেই সঙ্গে খুশিও। শহরের চারজন মানুষ হেঁটে আসছে। সর্বাঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া। দেখতেও ভালো লাগে। লিখন বারান্দায় পা রাখতেই মজিদ মাতব্বর হেসে বললেন, ‘আজকের দিনটা সত্যি খুব সুন্দর।’

লিখন হেসে ফরিনা এবং মজিদ মাতব্বরকে সালাম করে বলল, ‘এই হচ্ছেন আমার বাবা-মা আর বোন। আর আম্মু-আব্বু…উনি হচ্ছেন মজিদ চাচা। আর ইনি ফরিনা চাচি। আর ওই যে বড়ো বড়ো গোঁফদাড়ি, উনি হচ্ছেন রিদওয়ান ভাইয়া। এই বাড়িরই আরেক ছেলে।’

মজিদ মাতব্বর একজনকে ডেকে বললেন চেয়ার দিয়ে যেতে আর অন্দরমহলে খবর পাঠাতে মেহমান এসেছে। তাৎক্ষণিক চেয়ার ও ঠান্ডা শরবত চলে এলো। পরিচিয় পর্ব শেষ হতেই লিখন প্রশ্ন করল, ‘বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান চলছে নাকি?’

‘সে চলছে। আমার ছেলেটার বিয়ে। একমাত্র ছেলে।’

লিখন হাসল। চোখ পড়ে আলগ ঘরের ডান পাশে। কয়েকটা মেয়ে উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে। লিখন আনমনে হেসে উঠল। কোনো মেয়ে যখন তাকে দেখে খুব তৃপ্তিদায়ক অনুভূতি হয়। নায়ক কী এমনি এমনি হওয়া! শব্দর আলী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাই নাকি? তাহলে তো ঠিক সময়েই এসেছি। আমরাও আমাদের একমাত্র ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এই গ্রামে এসেছি।’

মজিদ মাতব্বর আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘মেয়ে কে? কার মেয়ে? আমাকে বলুন। এখনি বিয়ে করতে চাইলে এখনি হবে।’

শব্দর আলী লিখনকে প্রশ্ন করলেন, ‘মেয়ের পরিচয় বল।’

লিখন কথা বলার পূর্বেই ফরিনা গেটের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘এই তো আমার ছেড়ায় আইয়া পড়ছে। আমির এইহানে আয়। দেইখা যা কারা আইছে।’

ফরিনার দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই পেছনে তাকাল। আমির চুল ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসছে। হাঁটার গতিতে বোঝা যাচ্ছে, বেশ চঞ্চল একটা ছেলে। আমির ঘেমে একাকার। কয়েক ফুটের দূরত্ব থাকা অবস্থায় লিখনকে দেখেই সে চিনে ফেলল। মগার কাছে লিখনের বর্ণনা শুনেছে। এছাড়া লিখন একজন নামকরা অভিনেতা। তার অভিনীত ছায়াছবি সে দেখেছে। হাঁটার গতি কমিয়ে দিল আমির। কাছে এলে লিখন উঠে দাঁড়াল। হেসে আমিরের সঙ্গে করমর্দন করে বলল, ‘আমি লিখন শাহ।’

আমির বলল, ‘আমির হাওলাদার। বসুন আপনি।’

লিখন পূর্বের চেয়ারে বসে। আমির তার থেকে একটু দূরত্ব রেখে দূরে বসল। মজিদ মাতব্বর আমিরকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘কোথায় থাকিস সারাদিন? বলেছিলাম না, লিখন শাহ এসেছিল? এই যে ইনি।’

আমির শুষ্কমুখে বলল, ‘চিনি আমি। উনার অনেক কাজ আমার দেখা।’

শব্দর আলী, ফাতিমা, লিলি, লিখন সবাই একসঙ্গে মৃদু হাসল। কেউ চেনে বললে আনন্দ হবারই কথা। রিদওয়ান আমিরকে বলল, ‘লিখনও বিয়ে করতে এসেছে।’

আমির কিছু বলল না। ফরিনা জানতে চাইলেন, ‘পাত্রী কে? কইলা না তো?’

লিখন বুক ভরা ভালোবাসা নিয়ে বলল, ‘পদ্মজা। মোড়ল বাড়ির বড়ো মেয়ে।’

লিখনের কথা শুনে মুহূর্তে হাওলাদার বাড়ির সব মানুষের মুখ কালো হয়ে গেল। থেমে গেল আলগ ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলির কোলাহল; চারিদিক স্তব্ধ, শান্ত। লিখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কী হলো সবার! লিখন মা-বাবার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। মজিদ মাতব্বর শান্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল?’

মজিদ মাতব্বরের কথা বলার ধরন পালটে যাওয়াতে লিখন আহত হয়, ‘না। আজ প্রস্তাব নিয়ে যাব।’

মজিদ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘পরশু আমির-পদ্মজার বিয়ে।’

লিখন চকিতে চোখ তুলে তাকাল। বুক পোড়ার মতো অসহনীয় যন্ত্রণা কামড়ে ধরে তার সর্বাঙ্গে। হাড়ে হাড়ে বরফের ন্যায় ঠান্ডা কিছু ছুটতে শুরু করে দিয়েছে…

…যেন এখুনি সব রগ ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে আসবে।

২৪

ফাতিমা কাতর চোখে লিখনের দিকে তাকালেন। চোখে চোখ পড়তেই লিখন হাসার চেষ্টা করল। তার দৃষ্টি এলোমেলো। কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। আমির চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ‘আব্বা আসছি,’ বলে জায়গা ত্যাগ করল। শব্দর আলী হতভম্ব হয়ে গেছেন।

তিনি মজিদ মাতব্বরকে প্রশ্ন করলেন, ‘মজা করছেন?’

মজিদ মাতব্বর শব্দর আলীর চোখে চোখ রেখে জবাব দিলেন, ‘প্রথম পরিচয়ে মজা করার মতো মানুষ আমি না ভাইসাহেব।’

লিলি এক হাত লিখনের পিঠের ওপর রেখে ডাকল, ‘ভাইয়া।

লিখন লিলির হাতটা মুঠোয় নিয়ে ঢোক গিলল। বলল, ‘বিয়ে হবে না তো কী? বলেছি যখন দেখাবোই।’

‘ভাইয়া তোর চোখে জল,’ লিলির গলা ভেঙে আসছে।

লিখন দ্রুত হাতের উলটোপাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। পরিবেশ থম মেরে গেছে। কেউ কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না। লিলি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তার ভাইয়ের দিকে। পদ্মজা নামের মেয়েটাকে নিয়ে কত গল্প শুনেছে সে। মেয়েটা তার বয়সি শুনে লিলি খুব হেসেছিল। তার ভাইয়া এত ছোটো মেয়ের প্রেমে পড়েছে! দিনগুলো কত যে সুন্দর ছিল! মেট্রিক পরীক্ষার সময় বার বার খোঁজ নিয়েছে কবে শেষ হবে পরীক্ষা। যেদিন শেষ হলো সেদিন থেকেই শুটিং শুরু হলো। কথা ছিল এক সপ্তাহ পর থেকে শুরু হবে। কিছু জরুরি কারণে আগে শুরু হয়ে গেল। তাই আসতে কয়েকদিন দেরি হয়েছে।

মজিদ মাতব্বর স্তব্ধতা কাটিয়ে বললেন, ‘বিয়েটা একটা দুর্ঘটনার জন্য খুব দ্রুত ঠিক হয়েছে।’

লিখন উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী দুর্ঘটনা?’

ফরিনা সন্দিহান গলায় বললেন, ‘তার আগে তুমি কও তো, পদ্মজার লগে কী তোমার প্রেম-ট্ৰেম আছিল?’

লিখন ফরিনার প্রশ্নে বিব্রতবোধ করল। ধীরকণ্ঠে জবাব দিল, ‘না। শুধু আমার পক্ষ থেকেই।’

লিখনের উত্তরে ফরিনা সন্তুষ্ট হলেন। শব্দর আলী কী দুর্ঘটনা ঘটেছিল জানতে চাইলেন। মজিদ মাতব্বর সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সব বললেন। সব শুনে লিখন আশার আলো দেখতে পায়। ভাবে, এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে বলে অন্য কেউ বিয়ে করবে না—এমনটা ভেবেই হয়তো পদ্মজার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সে যদি এখনি পদ্মজাকে বিয়ে করতে রাজি থাকে, তাহলে তাকে ফিরিয়ে না-ও দেওয়া হতে পারে। আর পদ্মজা কী বিন্দুমাত্র ভালোবাসে না তাকে? বাসে, নিশ্চয় বাসে। লিখন নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেয়।

শব্দর আলী আফসোস নিয়ে বললেন, ‘কী আর করার! পরিস্থিতি এখন হাতের বাইরে।’

‘আপনারা কিন্তু বিয়ে শেষ করে তবেই যাবেন,’ বললেন মজিদ মাতব্বর।

ফাতিমা মতামত জানালেন দৃঢ়ভাবে, ‘না, না আজই চলে যাব। এই গ্রামে আর এক মুহূর্ত না। ‘

শব্দর আলী মৃদু করে ধমকালেন, ‘কী বলছ? কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা। এখন ট্রেন পাবে কোথায়? কাল ভোরে নাহয় চলে যাব।’

রিদওয়ান অনুরোধ করে বলল, ‘বিয়েটা শেষ হওয়া অবধি থেকে যান। দেখুন, মেহমান হয়ে এসেই অপ্রত্যাশিত খবর শুনলেন। এজন্য খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু তো করার নেই। মেয়েটা জলে ভাসবে বিয়েটা না হলে।

লিখন সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলল, ‘পদ্মজাকে ফেলনা ভাবছেন কেন? কেউ অপবাদ দিলেই কী সে পঁচে যায়?’

রিদওয়ান কিছু বলতে গেলে মজিদ মাতব্বর কড়া চোখে তাকিয়ে থামতে ইশারা করেন। কাজের মেয়েকে ডেকে বললেন, ‘উনাদের ঘরে নিয়ে যাও। আর আপনারা না করবেন না। আমি আপনাদের অবস্থা বুঝতে পারছি। বিয়ে অবধি না থাকুন, রাতটা থেকে যান।’

বাধ্য হয়ে ফাতিমা থাকতে রাজি হলেন। তিনি রাগে ফোঁসফোঁস করছেন। সব রাগ হাওলাদার বাড়ির ওপর। মনে মনে এই বাড়ির বিনাশ চাইছেন তিনি। মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। লিখন তার চোখের মণি। নয়তো কী গ্রামের মেয়ে নিতে আসতেন! আর সেই ছেলের মন এভাবে ভাঙল! ঘরে ঢুকেই বিছানায় চোখের চশমা ছুঁড়ে ফেলেন। কটমট করে শব্দর আলীকে বললেন, ‘তোমার না এক বন্ধু আছে মেজর? তাকে কল করে বলো মেয়েটাকে তুলে এনে লিখনের সঙ্গে বিয়ে দিতে। আমার ছেলেকে হারতে দেখতে পারব না।’

‘আহ! চুপ করো তো। সব জায়গায় ক্ষমতা চলে না। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করো।

‘কীসের পরিস্থিতি? তুমি জানো, তোমার ছেলের ব্যক্তিগত ডায়রিতে আগে শুধু আমার নাম ছিল। সেখানে এখন বেশি পদ্মজা নামটা লেখা। কতটা পাগল এই মেয়ের জন্য। এখন মেয়েটাকে ছেড়ে শহরে চলে গেলে,

চলে গেলে, ছেলের দেবদাস রূপ দেখতে হবে। আর আমি তা পারব না।’

শব্দর আলী পায়ের মোজা খুলতে খুলতে অসন্তুষ্টি নিয়ে বললেন, ‘তোমার যা ইচ্ছে করো। আমি পারব না। ক্লান্ত আমি। শান্তি দাও।’

ফাতিমা কড়া কিছু কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। লিলি ঘরে ঢুকেছে। লিখন আসেনি। আমেনা লিলিকে বললেন, ‘লিখন কোথায়?’

‘কী জানি! ভাইয়া ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে বেরিয়ে গেল।’

.

রোদের কঠিন রূপ শীতল হয়ে এসেছে। মৃদু বাতাস বইছে। তবুও লিখন ঘামছে। পদ্মজার বাড়ির দিকে যাচ্ছে সে। আতঙ্কে তার ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। মাথায় শুধু কয়টা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘আমি কী পাগলামি করছি? এত আয়োজন ভেঙে ওর বাবা-মা কী আমার হাতে তুলে দিবে পদ্মজাকে? পদ্মজা আমাকে দেখলে কী কাঁদবে? ও কী আমাকে একটুও ভালোবাসেনি? মায়া নিশ্চয় জমেছে?’

লিখন আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আল্লাহর কাছে অনুরোধ করে, ‘আল্লাহ, সব যেন ভালো হয়

পূর্ণা বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে আছে। বয়স্ক কিছু মহিলা বাড়ির পেছনে গীত গাইছে। সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচছে দুই বুড়িসহ ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা। পুরো বাড়ি সাজানো হচ্ছে রঙিন কাগজ দিয়ে। উঠানের এক কোণে একটি লাল বড়ো গরু বাঁধা, বিয়ে উপলক্ষে জবাই করা হবে। চারিদিকের এত আনন্দ পূর্ণার মন ছুঁতে পারছে না। প্রথমত, সে স মানসিকভাবে বিপর্যস্ত! কিছুতেই স্থির হতে পারছে না। দ্বিতীয়ত, পদ্মজার জন্য লিখন শাহ ছাড়া অন্য কাউকে তার পছন্দ হচ্ছে না। সব মিলিয়ে সে উদাসীন। চোখ ছোটো করে বাচ্চাদের খেলা দেখছে। হুট করে চোখের তারায় ভেসে উঠে লিখন শাহ। পূর্ণা দ্রুত চোখ কচলে আবার তাকাল। সত্যি তাই! খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ল সে, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল পদ্মজার ঘরে। পদ্মজার কানে কানে গিয়ে বলল, ‘লিখন ভাই এসেছে। তুমি কিন্তু পালিয়ে যাবে আপা। এই বিয়ে কিছুতেই করবে না।’

কথা শেষ করে খুশিতে আবার ছুটে গেল বারান্দায়। এমন দিনে লিখনের উপস্থিতি পদ্মজাকে অপ্রস্তুত করে তুলল। গলা শুকিয়ে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

লিখন বাড়িতে ঢুকে হয়ে সব দেখে। কত আয়োজন! কত মানুষ! তার স্বপ্নের রানি পদ্মজার বিয়ে। কিন্তু তার সঙ্গে না! ভাবতেই লিখনের বুক ছ্যাঁত করে উঠল। মেয়েরা খুব আগ্রহ নিয়ে সুদর্শন লিখনকে দেখছে। লিখন পূর্ণাকে বারান্দায় দেখে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল, ‘কেমন আছো-পূর্ণা?’

পূর্ণা খুশিতে উচ্চকণ্ঠে জবাব দেয়, ভালো, খুব ভালো। ভাইয়া আপনি…’

পূর্ণা থেমে গেল। অনেকে তার উচ্চ গলার স্বর শুনে তাকিয়ে আছে, তাই চুপসে গেল। আস্তে আস্তে বলল, ‘এত দেরিতে আসলেন কেন? আপার তো বিয়ে। আপনি আপাকে নিয়ে পালিয়ে যান।’

পূর্ণার এমন কথায় লিখন হাসল। আদুরে কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘আন্টি কোথায়?’

পূর্ণা ঝটপট করে বলল, ‘আপনি আসুন ঘরে। আমি আম্মাকে নিয়ে আসছি।’

লিখনকে সদর ঘরে বসিয়ে পূর্ণা ছুটে গেল রান্নাঘরে। হেমলতা রান্না করছিলেন। পাশে অনেকে আছে। পূর্ণা ইশারায় বাইরে আসতে বললে, হেমলতা তাই করলেন। পূর্ণা ফিসফিসিয়ে জানাল, ‘লিখন ভাই এসেছে।’

‘কোথায়? বসতে দিয়েছিস?’

‘হ্যাঁ, দিয়েছি। তুমি আসো।’

হেমলতা ব্যস্ত পায়ে হেঁটে সদর ঘরে যান। এসে দেখেন দুজন বয়স্ক মহিলা অনবরত লিখনকে প্রশ্ন করে যাচ্ছে: সে কোত্থেকে এসেছে? এই বাড়ির কী হয়? পদ্মজার মতো চোখ কেন? পদ্মজার আসল বাপের ছেলে নাকি। এমন আরো যুক্তিহীন কথাবার্তা। হেমলতা সবাইকে উপেক্ষা করে লিখনকে বললেন, ‘লিখন, তুমি আমার ঘরে এসো।’

লিখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হেমলতার পিছু পিছু চলে গেল, তা অনেকের নজরেই পড়ল। একজন আরেকজনের সঙ্গে আলোচনা করতে থাকল লিখন শাহকে নিয়ে। সবাই ভেবে নিয়েছে—পদ্মজা যার সন্তান, এই ছেলেও তার সন্তান। এজন্যই সবার মাঝ থেকে তুলে নিয়েছে হেমলতা, নয়তো কথায় কথায় ধরা পড়ে যাবে।

লিখনকে মোড়ায় বসতে দিলেন হেমলতা। লিখন কীভাবে কী শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। হেমলতা শুরু করলেন, ‘আমি জানি তুমি কী বলবে। তোমার দুটো চিঠি আমি পড়েছি।’

লিখন লজ্জা পেল। তবে স্বাভাবিক হয়ে গেল পরক্ষণেই। হেমলতা বললেন, ‘দেখো লিখন পরিস্থিতি আর হাতে নেই। অন্য সময় হলে আমি পদ্মজাকে তোমার হাতে তুলে দিতাম। তুমি নম্র-ভদ্র বুদ্ধিমান ছেলে। কমতি নেই কিছুতেই। কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়। তবুও পদ্মজা তোমাকে নিজের মুখে যদি চায়, আমি তাৎক্ষণিক তাকে তোমার হাতে তুলে দেব। কিন্তু সে চাইবে না। কারণ, সে তোমাকে ভালোবাসে না। আমার কথাগুলো শুনে কষ্ট পেয়ো না। আমি সরাসরি কথা বলি। পদ্মজার দৃষ্টি, অনুভূতি আমার চেনা। সে তোমাকে ভালোবাসেনি কখনো। শুধু তোমার মন ভাঙবে ভেবে মায়া হচ্ছে, কষ্ট পাচ্ছে। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। কষ্ট হবে ভেবেই বলছি, ফিরে যাও।’

লিখন কয়েক সেকেন্ড চুপ রইল। তার চোখের দৃষ্টি রাখা মাটিতে। তারপর বলল, ‘আন্টি মেয়ের ভালোবাসা দেখছেন, অন্যের সন্তানেরটা দেখবেন না?’

‘অন্যের অনেক সন্তানই আমার মেয়েকে ভালোবাসে। সবার কথা ভাবা কী সম্ভব?’

হেমলতার কথায় ভীষণ আহত হয় লিখন। তার মনে হচ্ছে সে কঠিন পাথরের সঙ্গে কথা বলছে। দুই চোখ জ্বলছে ভীষণ। এখনি কান্নারা ঠেলেঠুলে বেরিয়ে আসবে। ছেলে হয়ে কাঁদা ভীষণ লজ্জার ব্যাপার। লিখন নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল। হেমলতা কঠিন স্বরে বললেন, ‘তুমি পদ্মজার রূপের প্রেমে পড়েছো।’

লিখন সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে তাকাল। বলল, ‘আন্টি ক্ষমা করবেন কিছু কথা বলি। পৃথিবীতে যে কয়টা সফল প্রেমের গল্প আছে তার মধ্যে নিরানব্বই ভাগ সৌন্দর্যের টানেই শুরু হয়। এরপর আস্তে আস্তে ভালোবাসা গভীর হয়। মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে, স্বপ্ন দেখতে গিয়ে ভালোবাসাটা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। সময়ের ব্যবধানে সে মানুষটা শিরা-উপশিরায় বিরাজ করতে শুরু করে। তখন তার অন্যান্য গুণ চোখে ভাসে। ভালোবাসা আরো বাড়ে। কারো কারো তো দোষও ভালো লেগে যায়। অবস্থা এরকম হয় যে, রূপ নষ্ট হয়ে গেলেও মানুষটাকে আমার চাই। এজন্যই বুড়ো বয়সেও কুঁচকে যাওয়া মানুষটাকেও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। অথচ শুরুটা হয় সৌন্দর্য দিয়ে। আন্টি, আমি পদ্মজার রূপে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম এটা সত্যি। কিন্তু গত কয়েক মাসে সারাক্ষণ পদ্মজাকে ভাবতে গিয়ে আমি সত্যি সত্যি পদ্মজাকে ভালোবেসে ফেলেছি। পদ্মজার রূপ আগুনে ঝলসে গেলেও এমন করেই বাসব। প্লিজ আন্টি, কথাগুলো শুটিংয়ের ডায়লগ ভেবে উড়িয়ে দিবেন না। বাস্তব জীবনে মুখস্থ ডায়লগ আমি আওড়াই না।’

লিখনের কণ্ঠ গম্ভীর, অথচ চোখে জল ছলছল করছে। হেমলতা স্তব্ধ হয়ে যান। এখন কী জবাব দিবেন? ভালোবাসার বিরুদ্ধে কোন শক্তি কাজে আসে? আদৌ কি ভালোবাসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায়? তিনি সময় নিয়ে বললেন, ‘আমার পদ্মজা তোমার কাছে খুব ভালো থাকত লিখন। কিন্তু সমাজের কিছু সীমা আছে, যার মুখোমুখি আমি হয়েছি। জেনেশুনে আমার মেয়েকে সেসবের মুখোমুখি কী করে হতে দেই?’

লিখন হাতজোড় করে বলল, ‘প্লিজ আন্টি! ‘

হেমলতা একদৃষ্টে লিখনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। এমন তো কখনো হয় না। পদ্মজার জন্মের পর সিদ্ধান্তহীনতায় কখনো ভোগেননি। যেকোনো একটা পথ বেছে নিয়েছেন, আর তাতেই পদ্মজার মঙ্গল হয়েছে। এবার কেন এমন হচ্ছে? কেন তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরে যাচ্ছেন? পদ্মজার জীবন নিয়ে যেন ভেসে আছেন মাঝ নদীতে। চারদিকে স্রোত; মাঝি নেই, বৈঠা নেই। আমির না লিখন? কার কাছে ভালো থাকবে পদ্মজা? হেমলতার শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে। তিনি দুর্বল কণ্ঠে বললেন, ‘এত বোঝো যখন, তখন নিজেকেও সামলাতে পারবে। বাড়ি ফিরে যাও।’

‘আন্টি, আমার বেঁচে থাকতে কষ্ট হবে।’

‘পদ্মজার সঙ্গে যা হয়েছে তবুও সে বেঁচে আছে। আর তুমি এইটুকু মানিয়ে নিতে পারবে না?

লিখন আর কথা খুঁজে পেল না। আহত মন নিয়ে উঠে দাঁড়াল। চলে যেতে ঘুরতেই হেমলতা দাঁড়াতে বললেন। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে, তবুও হেঁটে লিখনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নিজেকে শক্ত রেখো। তোমার এখনও অনেক পথ যাওয়া বাকি। কারো জন্য কারো জীবন থেমে থাকে না! ভাগ্যে যা থাকে, তাই হয়। সব যেহেতু আয়োজন হয়ে গেছে, তাই আর ভেবে লাভ নেই। তবে কবুল বলার আগেও যদি পদ্মজা বলে, তার তোমাকেই চাই…আমি সব ভেঙেচুরে পদ্মজাকে নিয়ে তোমার বাড়ি ছুটে যাব। আমি আমার মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসি, বাবা। এই মেয়েটার সুখের জন্য আমি স্বার্থপর হয়েছি। অন্যের সন্তানের কষ্ট চোখে ভেসেও ভাসছে না। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো।’

হেমলতার চোখে জলের ভিড়। লিখন ভীষণ অবাক হয়ে দেখতে থাকল এই কঠিন মানুষটাকে। হেমলতা নিজের দুর্বলতা, নিজের কান্না কেন দেখালেন লিখনকে? জবাব খুঁজে পেল না লিখন। শুধু এইটুকু বুঝতে পারল যে হেমলতার কাছে জীবন মানেই পদ্মজা।

লিখন ভাঙা গলায় ‘আসি’ বলে চলে যায়। হেমলতা সব কাজ ভুলে গুটিসুটি মেরে বিছানায় শুয়ে পড়েন। চোখ বেয়ে দুই ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে। মনের শক্তি কমে গেছে। দুর্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। নিজের উপর আস্থা কিংবা বিশ্বাস পাচ্ছেন না। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাটুকু যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *