পদ্মজা – ১৫

১৫

ভোর বেলার সূর্য উদয়ের সময় চার পাশে ছড়িয়ে পড়ল মৃদু সূর্যালোক। ট্রেনের জানালা দিয়ে সূর্যের আগুনরঙা আলো পদ্মজার মুখশ্রী ছুঁয়ে যাচ্ছে। ফজরের নামাজ পড়ে ট্রেনে উঠেছে তারা। গন্তব্য অলন্দপুর। পদ্মজার মেট্রিক শেষ হলো আজ তিন দিন। হেমলতার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজল পদ্মজা। পুরো দেড় মাস পর পূর্ণা-প্রেমা-প্রান্তর দেখা পাবে। খুশিতে আত্মহারা সে।

মাঝে একটু জিরিয়ে ফের চলছে ট্রেন। হেমলতা জানালার বাইরে তাকিয়ে আকাশ দেখছেন। কারণে-অকারণে তিনি এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। শুষ্ক চক্ষুদ্বয় যখন-তখন সজল হয়ে উঠে। কিছুতেই বারণ মানে না, নীল আকাশের বুকে যেন সেদিন রাতের স্মৃতি আকার নিয়ে ভেসে উঠল। ছেলেটার বয়স তেইশ-চব্বিশ বছর হবে। অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। দেখতে-শুনতে বেশ ভালো। হেমলতা পদ্মজাকে আড়াল করে কঠিন স্বরে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কে তুমি?’

ছেলেটি হেমলতার কথার ধরনে বিব্রতবোধ করল।

ইতস্তত করে বলল, ‘মুহিব, মুহিব হোসেন।’

হেমলতার টনক নড়ল। তিনি সাবধানে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বারেক হোসেন তোমার বাবা?’

মুহিব ভদ্রভাবে বলল, ‘জি।’

হেমলতা কী যেন বলতে চেয়েছিলেন, পারলেন না। তার আগেই মুহিব অপরাধী স্বরে বলল, ‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আমি আসছি।’ এরপরই হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। সেদিন আর রাত জাগা হলো না। ছাদ থেকে নেমে গেল মা-মেয়ে। গোপন বৈঠকে একবার বাধা পড়লে আলোচনা চালিয়ে যেতে আর মন সায় দেয় না। অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যায়।

পরদিন জানা গেল—মুহিব তার পিতার সঙ্গে রাগ করে ঢাকা ছেড়ে চাচার বাড়ি উঠেছে। এখনকার ছেলে-মেয়েদের ক্ষমতা খুব। তারা খুব সহজ কারণে মা-বাবার সঙ্গে রাগ করে দূরে সরে যেতে পারে। হেমলতা অবজ্ঞায় কপাল কুঞ্চিত করতে সঙ্কোচবোধ করলেন না। পরে অবশ্য বুঝেছেন, মুহিব খুবই ভালো ছেলে। নম্র, ভদ্র, জ্ঞানী। মেধাবী ছাত্র, বিএ পড়ছে। সবচেয়ে ভালো গুণ হলো, মুহিবের নজর সৎ। হেমলতা চোখের দৃষ্টি চিনতে ভুল করেন না। ঠিক সতেরো দিন পর বারেক হোসেন ছেলেকে নিতে আসেন। যেদিন আসেন পরদিন রাতেই হেমলতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। মুহিবের বউ হিসেবে পদ্মজাকে নিতে চান। হেমলতা অবাক হোন। মুহিব মনে মনে পদ্মজার প্রতি দুর্বল, অথচ তিনি একটুও বুঝতে পারেননি!

নিঃসন্দেহে মুহিব পাত্র হিসেবে উপযুক্ত। মুহিবের বড়ো দুই ভাই—মুমিন ও রাজীব। দুজনই চাকরিজীবী। মুমিন বিয়ে করে বউকে ডাক্তারি পড়াচ্ছে। বউয়ের পড়াশোনার সমর্থনে আছে পুরো পরিবার। বোঝা যাচ্ছে, পরিবারের প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক, ভাবনা উচ্চ মানের। বারেক হোসেন বিয়ের প্রস্তাবের সঙ্গে এটিও বলেছেন, ‘আমার মেয়ে নেই। ছেলের বউরাই আমার মেয়ে। আপনার মেয়ের যতটুকু ইচ্ছে পড়বে। কোনো বাধা নেই।’

হেমলতা প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন না। তিনি আনন্দ সাথে জবাব দিলেন, ‘পদ্মজা আইএ শেষ করুক। এরপরই না হয়।’

বারেক হোসেন হেসে বললেন, ‘তাহলে এটাই কথা রইল।’

স্মৃতির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন হেমলতা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। গলাটা কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে পানি পান করলেন।

.

অলন্দপুর।

প্রেমা-প্রান্ত বাড়ির বাইরে সড়কে পায়চারি করছে। পূর্ণা গেটের আড়াল থেকে বার বার উঁকি দিয়ে দেখছে দূরের পথ। হেমলতা ও পদ্মজাকে আনতে মোর্শেদ যে সেই কখন গঞ্জে গেলেন, এখনো আসছেন না! পুরো দেড় মাস পর মা-বোনের সাক্ষাৎ পাবে তারা। হৃদপিণ্ড দ্রুতগতিতে চলছে। মিনিট পাঁচেক পর কাঁচা সড়কের মোড়ে মোর্শেদের পাশে কালো বোরখা পরা দুজন মানুষকে দেখা যায়। পূর্ণা লাজলজ্জা ভুলে আগে আগে ছুটতে থাকে। পেছনে প্রান্ত এবং প্রেমা। দৌড়ে গিয়ে মা-বোনকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে প্রবল কণ্ঠে কেঁদে উঠল পূর্ণা। হেমলতা পূর্ণাকে ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। মাঝে মাঝে একটু বাড়াবাড়ি করা দোষের নয়। পদ্মজার চোখ বেয়েও টপটপ করে জল পড়ছে। প্রায় প্রতিটা রাত সে ভাই-বোনদের কথা মনে করেছে। বিশেষ করে পূর্ণাকে মনে পড়েছে বেশি। মনে হচ্ছে, কত শত বছর পর দেখা হলো! পদ্মজাকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পূর্ণা। প্রতিটি দিন সে বাড়ির আনাচে-কানাচে পদ্মজার শূন্যতা অনুভব করেছে। পূর্ণা অশ্রুসিক্ত চোখ মেলে বোনের দিকে তাকাল। এরপর আবার জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আপা, আমার এত আনন্দ হচ্ছে! আগে কখনো এমন হয়নি।

পদ্মজার কোমল হৃদয়, পূর্ণার ভালোবাসা দেখে বিমোহিত হয়ে উঠল সে স্নেহমাখা কণ্ঠে বলল, ‘আমার সোনা বোন। আর কাঁদিস না।’

পূর্ণা দ্রুত চোখের জল মুছে প্রফুল্লচিত্তে বলল, ‘আপা, আমি তোমার পছন্দের চিংড়ি মাছ দিয়ে লতা রেঁধেছি।’

পদ্মজা অবাক চোখে তাকাল। এদিকে এক বোনের প্রতি আরেক বোনের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে হেমলতা প্রশান্তিদায়ক সুখ অনুভব করছেন। আনন্দে বাকহারা হয়ে পূর্ণার দুই গালে চুমো দিল পদ্মজা। মোর্শেদ দৃশ্যটি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন, মানুষজনকে আসতে দেখে তাড়া দিলেন, ‘দেহো মাইয়াডির কারবার। মানুষ আইতাছে। আর হেরা রাস্তায় কান্দাকাটি লাগাইছে। হাঁট, সবাই হাঁট।’

বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে সবাই খেতে বসে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে চার ভাই-বোন আশ্রয় নিলো ঘাটে। এই ঘাট হচ্ছে তাদের বৈঠকখানা। দেড় মাসে কী কী হলো, না হলো সব পূর্ণা বলছে। প্রেমা পূর্ণার নামে বিচার দিল। প্রান্ত প্রেমার নামে বিচার দিল। প্রান্ত কেন বিচার দিল তা নিয়ে আবার বাকবিতণ্ডা লাগিয়ে দিল প্রেমা। সে কী কাণ্ড! তুমুল ঝগড়ায় লিপ্ত হয় দুজন। এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে বিচার নিয়ে ছোটো দুজন গেল হেমলতার কাছে।

তখন পদ্মজা শুষ্ককণ্ঠে পূর্ণাকে বলল, জানিস পূর্ণা, আম্মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’

পূর্ণা ভীষণ চমকাল। চমকিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে? কার সঙ্গে?’

‘যে বাড়িতে ছিলাম ওই বাড়ির ছেলের সঙ্গে। বিএ পড়ছে। আমার আইএ শেষ হলে বিয়ের তারিখ পড়বে।’

‘আপা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আম্মার না ইচ্ছে তোমাকে অনেক পড়াবে। তোমার চাকরি হবে।’

পদ্মজা চুপ থাকল ক্ষণকাল। তারপর বলল, ‘আম্মার কী যেন হয়েছে। পালটে গেছেন।’

‘কী রকম?’

‘আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বেশিরভাগ কথা এড়িয়ে যান। আমার ভবিষ্যত নিয়ে আগের মতো আগ্রহ দেখান না। আমি কথা তুললে এড়িয়ে যান। গল্প করেন না। আম্মা আগের মতো নেই পূর্ণা।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে পদ্মজার গলা কিঞ্চিৎ কাঁপল।

‘কী বলছ!’

‘সত্যি।’

‘কিছু হয়েছে ওখানে?

‘না। আমি যতটুকু জানি তেমন কিছুই হয়নি।’

পূর্ণা সীমাহীন আশ্চর্য হয়ে চিন্তায় ডুবে গেল। পদ্মজা শূন্যে তাকিয়ে রইল। লিখন শাহ নামে মানুষটার কথা মনে পড়ছে। তিনি যখন শুনবেন এই খবর, সহ্য করতে পারবেন? সত্যি ভালোবেসে থাকলে সহ্য করতে কষ্ট হবে নিশ্চয়ই। পূর্ণা দ্বিধাভরে প্রশ্ন করল, ‘আপা, লিখন ভাইয়ের কী হবে?’

পদ্মজা ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকাল। বলল, ‘আমি তাকে বলেই দিয়েছি, আম্মা যা বলবেন তাই হবে।’

পূর্ণার মনজুড়ে নেমে আসে বিষাদের ছায়া। তার আপার মতো সুন্দরীকে শুধুমাত্র লিখন শাহর পাশেই মানায়। লিখন শাহ আর পদ্মজাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখল সে।

সব স্বপ্নে গুড়ো-বালি!

পূর্ণা কাতর কণ্ঠে বলল, ‘লিখন ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে না হলে আমি কষ্ট পাব খুব।’

‘আমি তো আম্মার কথার বাইরে যেতে পারব না।’

পূর্ণা গলার স্বর খাদে এনে বলল, ‘যদি লিখন ভাই রাজি করাতে পারে?’ পদ্মজা অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। সেই দৃষ্টি যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে, হওয়ার নয়! পূর্ণা কপাল কুঁচকে ফেলল। বিরক্তিতে বলে উঠল, ‘ধ্যাত! ভালো লাগছে না।’

.

বাতাসটা গরম ঠেকছে, ক্রমশ বেড়ে চলেছে মাথাব্যথা। এত এত গাছগাছালি চারিদিকে, তবুও এতটুকুও শীতলতা নেই। হেমলতা আলমারির কাপড় গুছিয়ে বিছানার দিকে তাকালেন। মোর্শেদ এই রোদ ফাটা দুপুরে কখন থেকে ঝিম মেরে বিছানায় বসে আছেন। মুখখানা বিমর্ষ, চিন্তিত 1 হেমলতা প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘কী হয়েছে?’

মোর্শেদ তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। হেমলতা তাকিয়ে রইলেন জবাবের আশায়। ক্ষণকাল সময় নিয়ে মোর্শেদ বললেন, ‘বাসন্তী এই বাড়িত থাকবার জন্য আইতে চায়।’

হেমলতার চোখ দুটি ক্রোধে জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল।

তিনি নির্বিকার কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার ইচ্ছে হলে নিয়ে এসো। বাড়ি তো তোমার।’

মোর্শেদ চকিতে তাকালেন। তিনি ভেবেছিলেন হেমলতা রাগারাগি করবে। মোর্শেদের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ রূপ নিলো। কিড়মিড় করে হেমলতাকে বললেন, ‘আমি তারে চাই না।’

হেমলতা ঠাট্টা করে হাসলেন। বললেন, ‘বিশ বছর সংসার করে এখন তাকে চাও না! আমি হলে মামলা ঠুকতাম।’

মোর্শেদ আহত মন নিয়ে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তার চোখ দুটিতে অসহায়ত্ব স্পষ্ট। হেমলতা নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে সেখান থেকে সরে পড়েন। মোর্শেদ তখন কপট রাগ নিয়ে নিজে নিজে আওড়ান, ‘বাসন্তী আমারে ডর দেহায়! মা*ডারে খুন করতে পারলে জীবনে শান্তি পাইতাম।’

হেমলতা দরজার ওপাশ থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে মোর্শেদকে পরখ করছেন। রাগে ছটফট করছেন মোর্শেদ। বাসন্তীর প্রতি তার এত রাগ কেন?

হেমলতা পুনরায় ঘরে এসে বললেন, ‘ভালোবাসার মানুষকে এভাবে গালি দিয়ে ভালোবাসা শব্দটির সম্মান খুইয়ে দিয়ো না।’

‘আমি তারে কোনোকালেও ভালোবাসি নাই। বাসলে তোমারে বাসছি।’ হেমলতা ভীষণ অবাক হয়ে তাকালেন। চোখের তারায় জ্বলজ্বল করে কিছু একটা যেন ছুটতে শুরু করে।

ভোঁতা অনুভূতিগুলো মুহূর্তে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠে। মোর্শেদ অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। তিনি বিছানা থেকে নেমে গটগট পায়ে বেরিয়ে যান। হেমলতা মোর্শেদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকেন ঝাপসা চোখে।

মানুষটার থেকে এই একটি শব্দ শোনার জন্য একসময় কত পাগলামি করেছেন, কত কেঁদেছেন। আকুতি-মিনতি করেছেন। মোর্শেদের মুখে ভালোবাসার সত্য স্বীকারোক্তি শুনে হেমলতার ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। বয়সটা কম হলে আজ তিনি অনেক পাগলামি করতেন, অনেক!

.

পূর্ণার গা কাঁপানো জ্বর। তাই পূর্ণাকে নানাবাড়ি রেখেই পদ্মজা বাড়ি ফিরল সঙ্গে এলো হিমেল-প্রান্ত-প্রেমা। তিন ভাইবোন মিলে বাড়িজুড়ে ছোটাছুটি করে লাউ, শিম, লতা, পুঁইশাক বন্দোবস্ত করল। বাজার থেকে মাছ নিয়ে এলো হিমেল। বাড়িতে শুঁটকি ছিল। আজ হেমলতা আর মোর্শেদ ফিরবেন। তাই এত আয়োজন। দুই দিন আগে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। হেমলতার বড়ো বোন হানির মেজো মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। হানি বলেছেন, হেমলতা না গেলে তিনি বিয়ের তারিখ ঠিক করবেন না। তাই বাধ্য হয়ে হেমলতা গেছেন। তবে পদ্মজার শুরু থেকে খটকা লাগছে। তার মা তাকে রেখে পাশের এলাকায় যেতেও আপত্তি করেন। আর আজ দুই দিন ধরে তিনি মাইলের পর মাইল দূরে পদ্মজাকে ছাড়া রয়েছেন! অবশ্য এসব এখন ভাবার সময় নয়। পদ্মজা যত্ন করে কয়েক পদের রান্নার প্রস্তুতি নিলো। সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। পরিবেশ ঠান্ডা, স্তব্ধ। এ যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। প্রান্ত-প্রেমা উঠান জুড়ে মারবেল খেলছে। হিমেল শুধু দেখছে, মাঝে মাঝে প্রবল কণ্ঠে হেসে হাত তালি দিচ্ছে। রান্না শেষ হলো বিকেলে প্রেমা, প্রান্ত ও হিমেলকে খাবার বেড়ে দেয় পদ্মজা।

খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বলল, ‘মামা, তুমি আর প্রান্ত গিয়ে পূর্ণাকে নিয়ে আসো। সন্ধ্যা হয়ে যাবে একটু পর। আম্মা-আব্বাও চলে আসবে।’

হিমেল-প্রান্ত বের হতেই পেছন পেছন ছুটে গেল প্রেমা। পদ্মজা একা হয়ে গেল। রান্নাঘর গুছিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।

কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ, বাতাস বইছে প্রবলবেগে। বাতাসের দাপটে পদ্মজার চুল ও ওড়না উড়ছে। পরিবেশ অন্ধকার হচ্ছে ধীরে ধীরে। তার মনটা কু গাইতে লাগল। সে এক হাত দিয়ে অন্য হাতের তালু চুলকাতে চুলকাতে গেটের দিকে বারংবার তাকিয়ে দেখছে, কেউ এলো কি না! যতক্ষণ কেউ না আসবে শান্তি মিলবে না। বিকট শব্দ তুলে কাছে কোথাও বজ্রপাত পড়ল। ভয়ে পদ্মজার আত্মা শুকিয়ে যায়। চারিদিক কেমন গাঢ় অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে! ঘোমটা টেনে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। বিকট বজ্রপাত, দমকা হাওয়া সঙ্গে বড়ো বড়ো ফোঁটার বৃষ্টি, যেন প্রলয়ঙ্কারী ঝড় বইছে। লাহাড়ি ঘরের মাথার ওপরে থাকা তাল গাছগুলো অবাধ্য বাতাসের তেজে একবার ডানে আরেকবার বাঁয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। পদ্মজার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল আতঙ্কে, ছুটে গেল নিজের ঘরে। বিছানার উপর কাঁচুমাচু হয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। টিনের চালে ধুমধাম শব্দ হচ্ছে। পদ্মজা অনবরত প্রার্থনা করে যাচ্ছে, যেন বৃষ্টি কমে যায়।

কিন্তু বৃষ্টির বেগ কমার বদলে উলটো বাড়ল! এতসব শব্দ ভেদ করে আরেকটি শব্দ এসে থেমে গেল পদ্মজার কানের কাছে, সদর ঘরে কিছু একটা পড়েছে। ভয় পদ্মজাকে আরো বেশি করে গ্রাস করে ফেলল।

পরক্ষণেই খুশিতে সে আওড়াল, ‘আম্মা এসেছে?’

বিছানা থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে সদর ঘরে যায় পদ্মজা। ঘরটা অন্ধকারে তলিয়ে আছে। জানালা দিয়ে আসা ঈষৎ আলোয় দেখল একজন পুরুষের অবয়ব। সঙ্গে সঙ্গে তার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে পড়ল। জায়গায় স্তব্ধ হয়ে গেল দুটো পা।

পদ্মজা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘কে আপনি? খালি বাড়িতে কেন ঢুকেছেন? কোনো জবাব এলো না। পদ্মজা অনুরোধ করে ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘বলুন না, কে আপনি?’

একটি ম্যাচের কাঠি জ্বলে উঠল। সেই আলোয় দুটি গভীর কালো চোখ বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে রইল পদ্মজার দিকে।

শীতল-স্পষ্ট কণ্ঠে চোখের মালিক বলল, ‘আমির হাওলাদার।’

পুরুষালী কণ্ঠটি শুনে আরো ভড়কে গেল পদ্মজা। রগে-রগে, বরফের মতো ঠান্ডা আর সূক্ষ্ম কিছু একটা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এক হাত দরজায় রেখে, পদ্মজা আকুতি করে বলল, ‘আপনি চলে যান। কেন এসেছেন?’

উত্তরের আশায় না থেকে পদ্মজা দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল, ভেতরে ঢুকেই লাগিয়ে দিল দরজা। তার মস্তিষ্ক জমে গেছে, কাজ করছে না। লোকটা যদি সম্মানে আঘাত করে বা গ্রামের মানুষ যদি দেখে ফেলে খালি বাড়িতে অচেনা পুরুষের সঙ্গে…কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সে আর ভাবতে পারছে না।

করাঘাত শুনে পদ্মজা ঘরের সব আসবাবপত্র ঠেলেঠুলে দরজার কাছে নিয়ে এলো। শরীর কাঁপছে, মাটিতে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল সে। দুই হাত মাথায় রেখে আর্তনাদ করে ডাকল, ‘আম্মা, কোথায় তুমি? আমি খুব একা, আম্মা। আম্মা…।’

১৬

টিনের চালে ঝুম ঝুম শব্দ। বৃষ্টির এই ছন্দ অন্যবেলা বেশ লাগলেও এই মুহূর্তে ভয়ংকর ঠেকছে পদ্মজার কাছে। একেকটা বজ্রপাত আরো বেশি ভয়ানক করে তুলেছে পরিবেশ। সে কাঁচুমাচু হয়ে ফোঁপাচ্ছে।

বৃষ্টির শব্দ একটু কমলে কিছু কথা ভেসে আসে বাতাসে, ‘আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আমাকে ভয় পাবেন না। বিপদে পড়ে এই বাড়িতে উঠেছি। বিশ্বাস করুন।’

পদ্মজা কান্না থামিয়ে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল। দরজার ওপাশ থেকে আমির নামের মানুষটি বলছে, ‘দরজা খুলুন। বিশ্বাস করুন আমাকে। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করতে আসেনি। ভয় পাবেন না।’

পদ্মজা একটু নড়েচড়ে বসল। আমির আবার বলল, ‘শুনছেন?’

ঢোক গিলে কথা বলার চেষ্টা করল পদ্মজা। কী অদ্ভুত, কথা আসছে না! খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করতে চাইল সে। বলল, ‘আ…আমি দরজা খুলব না।’

ক্ষণকাল কোনো উত্তর এলো না, শুধু বৃষ্টির ধ্বনি শোনা গেল। একসময় পুরুষালি কণ্ঠটি বলল, ‘আচ্ছা, খুলতে হবে না। দয়া করে আপনি শুধু ভয় পাবেন না।’

‘আপনি চলে যান।’

বৃষ্টিটুকু থামতে দিন। হঠাৎ বৃষ্টির জন্যই তো আপনার বাড়িতে ওঠা। আমার বৃষ্টিতে সমস্যা হয়।’

আমিরের মুখে স্পষ্ট শুদ্ধ ভাষা শুনে পদ্মজা অনুমান করে নিলো, লোকটি শিক্ষিত। কথাবার্তা শুনে ভালো মানুষ মনে হচ্ছে, তবুও সাবধানের মার নেই। সে দরজা খুলল না, বিছানায় গিয়ে বসল; আগের থেকে ভয় কিছুটা কমেছে।

আমিরের কণ্ঠ শোনা গেল, ‘শুনছেন?’

পদ্মজা জবাব দিল, ‘বলুন।’

‘আপনার নাম কী? ডাকনাম বলুন।’

‘পদ্মজা।’

‘সুন্দর নাম। আমার নাম জিজ্ঞাসা করবেন না?’

‘জানি।’

আমির অবাক হওয়ার ভান ধরে প্রশ্ন করল, ‘কীভাবে? আমাকে চিনেন?’

‘না, কিছুক্ষণ আগেই নাম বললেন।’

‘তখন তো ভয়ে কাঁপছিলেন, নামও শুনেছেন!

আমিরের কণ্ঠে রসিকতা। পদ্মজা মৃদু হাসল, কেন হাসল জানে না। আমির পুনরায় বলল, ‘শুনছেন?’

‘শুনছি।’

‘আপনি কি এরকমই ভীতু?’

‘সাহসিকতা প্রমাণ করানোর জন্য এখন বের হতে বলবেন, তাই তো?’

ওপাশ থেকে গগন কাঁপানো হাসির শব্দ ভেসে আসে। আমির হাসতে হাসতে বলল, ‘বেশ কথা জানেন তো।’

চলমান প্রসঙ্গ এড়িয়ে পদ্মজা বলল, বৃষ্টি কমলেই কিন্তু চলে যাবেন!’

‘তাড়াতে হবে না। বৃষ্টি কমলে নিজে থেকেই চলে যাব।’

কষ্ট নিবেন না। খালি বাড়ি তো, তাই বলছি।’

‘বাকিরা কোথায়? এটা মোর্শেদ কাকার বাড়ি না?’

‘জি।’

‘উনার ধানের মিল তো এখন আমার আব্বার দখলে। ছুটিয়ে নিবেন কবে?’

পদ্মজা অবাক হয়ে দরজার দিকে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘আপনি মাতব্বর কাকার ছেলে?’

‘অবাক হলেন মনে হচ্ছে?’

‘মাতব্বর কাকার ছেলের নাম তো বাবু!’

আমির হেসে বলল, ‘আমার ডাকনাম বাবু। এই নামে আম্মা আর আব্বা ডাকে। ভালো নাম আমির।’

পদ্মজা আর কথা দীর্ঘ করল না। বজ্রপাত থেমেছে, বৃষ্টি রয়ে গেছে। আমির জিজ্ঞাসা করল, ‘বাকিরা কোথায়?’

‘আম্মা-আব্বা ঢাকা। আজ ফেরার কথা ছিল। আর আমার দুই বোন আর ভাই নানাবাড়ি। বোধহয় বৃষ্টির জন্য আসতে পারছে না।’

‘এখনো আমাকে ভয় পাচ্ছেন?’

‘একটু, একটু।’

‘এটা ভালো। অচেনা মানুষকে একেবারেই বিশ্বাস করতে নেই।

.

বাসন্তী ভ্যান থেকে নেমে সামনে এগোলেন। মোর্শেদের বাড়িটা তিনি চেনেন না। তাই কোনদিকে যেতে হবে বুঝে উঠতে পারছেন না। এদিকে আকাশের অবস্থা ভালো না। রাস্তাঘাটেও মানুষ নেই। ঝড়ো হাওয়া বইছে। আরো কিছুটা পথ হাঁটার পর আচমকা ঝড় শুরু হলো। তিনি দৌড়ে একটা বাড়িতে উঠে পড়েন। রমিজ আলি বারান্দায় বসে হুঁকা টানছিল। সিল্কের শাড়ি পরনে, পেট উন্মুক্ত, লম্বা চুলের বেণুনীতে ধবধবে সাদা বাসন্তীকে দেখে সে অবাক হয়ে এগিয়ে এলো। বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘কেডা আপনে? কারে চান?’

বাসন্তী কেঁপে উঠলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে রমিজকে দেখে লম্বা করে হেসে বললেন, ‘হুট কইরা মেঘখান আইয়া পড়ল তো।’

‘তো আপনে কার বাড়িত যাইতেন?’

‘মোর্ছেদের বাড়ি।’

রমিজ আলি বিরক্তি নিয়ে সরে গেল। ঘরের ভেতর থেকে চেয়ার এনে দিয়ে বলল, ‘মোর্শেইদদার কী লাগেন আপনে?’

বাসন্তী চিন্তায় পড়ে যান। গ্রামের মানুষ তো জানে না তার আর মোর্শেদের সম্পর্ক কী! এখন জানানোটা কতটা যুক্তিসংগত হবে? সেকেন্ড কয়েক ভাবার পর যুক্তি মিলল। গ্রামবাসীকে বলা উচিত। নয়তো নিজের অধিকার তিনি কখনো পাবেন না। একমাত্র গ্রামবাসীরাই পারবে তার জায়গাটা শক্ত করে দিতে। বাসন্তী রমিজ আলির চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তার বউ লাগি। পরথম বউ। তার লগে আমার বিছ বছরের ছম্পর্ক।’

রমিজ আলির চক্ষুদ্বয় যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। মোর্শেদের বউ! বারকয়েক চোখ পিটপিট করল সে, ‘কী বললেন? কার বউ?’

‘মোর্ছেদ, মোর্ছেদের বউ।’

মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পাওয়ার মতো আনন্দ হতে থাকে রমিজের। সে প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘হের পরের বউয়ে জানে?’

‘না।’

‘থাহেন কই আপনে?’

‘রাধাপুর।’

‘লুকাইয়া রাখছিল বিয়া কইরা?’

‘হ। এখন মোৰ্ছেদ আমারে তালাক দিতে চায়। আমার সঙ্গে ছংছার করতে চায় না। তাই আমি আমার অধিকার নেয়ার জন্য আইছি। আমি তার বাড়িতে থাকবার চাই। আপনেরা আমারে ছাহায্য করেন। গ্রামবাছী ছাড়া মোর্ছেদ আমারে জায়গা দিব না।’

রমিজ আলি প্রবল বৃষ্টি, আর বজ্রপাতকে হটিয়ে বাহাদুরের মতো বলে উঠল, ‘আপনের জায়গা করে দেওন আমরার কাম। আপনি চিন্তা কইরেন না। মেঘডা কমতে দেন। এরপর খালি দেহেন কী হয়!’

বাসন্তীর চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল। অবশেষে একটা ভরসা পাওয়া গেল। রমিজ আলির প্রতিশোধের নেশা পেয়েছে। মোর্শেদ তাকে কত কটু কথা বলেছে, অবজ্ঞা করেছে, অপমান করেছে। এইবার তার পালা। প্রতিটি অপমান ফিরিয়ে দেয়ার শপথ করেছে সে অনেক আগেই। বাসন্তীকে ভরসা দিয়ে সে বলল, ‘আপনি বইয়া থাহেন। আমি আরো কয়জনরে লইয়া আইতাছি।’

রমিজ আলি খুশিতে গদগদ হয়ে বেরিয়ে গেল লোকবল আনতে। ছইদ, রজব, মালেক, কামরুলকে নিয়ে ফিরে এলো। সবার হাতে হাতে ছাতা। কামরুল আটপাড়া এলাকার মেম্বার। গ্রামে কোনো অনাচার হলে তা দেখার দায়িত্ব তার। তাই তিনি মাথার উপর বজ্রপাত, ঝড় নিয়েই ছুটে এসেছেন।

.

পদ্মজা উসখুস করছে। টয়লেটে যাওয়া প্রয়োজন। প্রস্রাবের বেগ ক্রমাগত বাড়ছে। এভাবে আর কতক্ষণ থাকা যায়। সাহসও পাচ্ছে না বের হওয়ার। ঘরে পায়চারি করল কিছুক্ষণ। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলো। এরপর কাঁচি কোমরে গুঁজে আয়তুল কুরসি পড়ে বুকে ফুঁ দিয়েই দরজা খুলল। আচমকা দরজা খোলার আওয়াজ শুনে আমির চমকে তাকাল। আকাশ থেকে কালো মেঘের ভাব কেটে গেছে অনেকটা। সন্ধ্যার আজান পড়ছে। সালোয়ার, কামিজ পরা পদ্মজাকে দেখে মুহূর্তে হৃদস্পন্দন থমকে গেল তার। পদ্মজা ওড়না টেনে নিলো নাক অবধি। কাঁপা পায়ে আমিরের পাশ কেটে গেল। আমিরের চোখ স্থির। নিশ্বাস এলোমেলো। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। পদ্মজা যখন ফিরছিল ঘরে, আমির ডাকল, ‘পদ্মজা?’

পদ্মজা দাঁড়াল। মানুষটা খারাপ হলে এতক্ষণে আক্রমণ করত। যেহেতু করেনি, মানুষটার উদ্দেশ্য খারাপ না। তাই দাঁড়াল, তবে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল না।

আমিরের গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। শার্ট ভিজে যাওয়াতে বারান্দার দড়িতে রেখেছে, যাতে বাতাসে শুকিয়ে যায়। যেন রূপকথার জগতে হারিয়ে গেছে এমনভাবে আমির বলল, ‘অলন্দপুরে এমন রূপবতী আছে—জানা ছিল না।’

পদ্মজা লজ্জা পাওয়ার পাশাপাশি বিব্রতবোধ করল। বৃষ্টি প্রায় কমে এসেছে। তাই সে বলল, ‘আপনি এবার আসুন। কেউ দেখলে খারাপ ভাববে।’

‘যেতে তো ইচ্ছে করছে না।’

লোকটা বলে কী! এতক্ষণ বলল বৃষ্টি কমলেই চলে যাবে। এখন বলছে, যাবে না। পদ্মজা ঘুরে তাকাল। চোখের দৃষ্টিতে আকুতি ফুটিয়ে বলল, ‘দয়া করে চলে যান।’

আমির কিঞ্চিৎ হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল। না চাইতেও আমির পদ্মজার নজরে পড়ে। শ্যামবর্ণের একজন পুরুষ, থুতনির মাঝে কাটা দাগ। সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলো পদ্মজা। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘বৃষ্টি কমে গেছে। আম্মা-আব্বা চলে আসবে। চলে যান।’

আমির অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে। তার নিস্তব্ধতা পদ্মজাকে বিরক্ত করে তুলল। এত ঘাড়ত্যাড়া, দুই কথার মানুষ কীভাবে হয়? উঠানে পায়ের শব্দ! কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ। বারান্দা থেকে দুজন তাকাল। গ্রামের এতজনকে দেখে পদ্মজার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়ল সে। রমিজ আলি চেঁচিয়ে ডাকল, ‘কইরে মোর্শেইদদা? আকাম কইরা এখন লুকায়া আছস ক্যান? বাইর হ। তোর আকাম ধইরা লইয়া আইছি।’

আমির বারান্দা পেরিয়ে বেরিয়ে আসে।

গম্ভীরমুখে বলল, ‘উনারা বাড়িতে নেই।’

উৎসুক জনতা আমিরকে দেখে অবাক হয়। কামরুল বললেন, ‘আরে আমির। শহর থেকে আইলা কবে?’

‘এই তো চার দিন হলো। আছেন কেমন?’

‘এই তো আছি। তা এইহানে কী করো?’

আমির উত্তর দেয়ার আগে রমিজ আলি প্রশ্ন করলেন, ‘বাড়িত কেউ নাই?’

আমির বেশ সহজ-সরল গলায় বলল, ‘আছে। পদ্মজা আছে।’

উপস্থিতি পাঁচ-ছয়জন তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। সবার দৃষ্টি দেখে আমির বুঝল, সে কত বড়ো ভুল করে ফেলেছে। তাহলে পদ্মজা এটারই ভয় পাচ্ছিল? আমির দড়ি থেকে শার্ট নিয়ে দ্রুত পরল। এরপর কৈফিয়ত দেয়ার স্বরে বলল, ‘আপনারা যা ভাবছেন তা নয়। বাড়ি ফিরছিলাম। বৃষ্টি নামে তাই এই বাড়িতে উঠে পড়ি। বাড়িতে কেউ নাই জানলে…’

আমির কথা শেষ করতে পারল না। রমিজ আলি চেঁচিয়ে আশপাশে বাড়ির সব মানুষদের ডাকা শুরু করল। মাতব্বর তাকে কম অপদস্ত করেনি সমাজ থেকে কোণঠাসা করেছে। মোর্শেদ পথেঘাটে কটু কথা শুনিয়েছে। আজ সেই যন্ত্রণা কমানোর দিন। আমির ভড়কে গেল।

কামরুল আঙুল শাসিয়ে কঠিন স্বরে বললেন, ‘তোমার কাছে এইডা আশা করি নাই। তোমার আব্বারে ডাকাইতাছি। উনি যা করার করবেন।’

আমির বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘আরে আজব! কী শুরু করেছেন আপনারা?’

ছইদ আমিরের কাছাকাছি বয়সের। ব্যক্তিগত শত্রুতা আছে তাদের মধ্যে। ছইদ হুংকার ছেড়ে বলল, ‘চুপ থাক তুই! তোর বাপে মাতব্বর বইলা তোরে ডরাই আমরা? আকাম করবি আর ছাইড়া দিমু?’

রাগে-অপমানে আমিরের চোখ লাল বর্ণ ধারণ করে। রেগে গেলে চোখের রং পালটে যায় তার। কালো মুখশ্রীর সঙ্গে লাল চোখ ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ছইদ ভেতরে ভেতরে ভয় পেল। আমিরের হাতে কম মার সে খায়নি। তবে আজ সুযোগ পেয়েছে। পুরো গ্রামবাসী এক দলে। সে কিছুতেই ছাড়বে না। ঢোক গিলে বলল, ‘চোখ উলডাইয়া লাভ নাই। কুকামের উসুল না তুলে যাইতাছি না।’

আমির রাগে শক্ত হাতে থাপ্পড় বসাল ছইদের কানে। মুহূর্তে ছইদের মাথা ভনভন করে উঠে। ততক্ষণে রমিজের উসকানিতে মানুষ জমে গেছে। সবার হাতে হাতে টর্চ, হারিকেন। রাতের আঁধার নেমে এসেছে। আমির আবারও ছইদকে মারতে গেলে কয়জন এসে তাকে জাপটে ধরল। কামরুল একজন মহিলাকে আদেশের স্বরে বললেন, ‘শিউলির আম্মা, কয়জনরে লইয়া মাইয়াডারে বার কইরা আনো। লুকাইছে নটি। গ্রামডা নটিদের ভিড়ে ধ্বংস হইয়া যাইতাছে।’

পদ্মজা মাটিতে নতজানু হয়ে বসে কাঁপছে, তীব্র কাঁপুনি পা থেকে মাথার চুল অবধি। বাইরের প্রতিটি কথা তার কানে এসেছে। চারপাশ যেন ভনভন করছে।

শিউলির আম্মা পদ্মজার ঘরে আসে। দরজা খোলা ছিল। টর্চ ধরে দেখল পদ্মজা মাটিতে বসে কাঁপছে। পদ্মজাকে খুব পছন্দ করে সে। তাই পদ্মজার মাথায় হাত রেখে বলল, ‘কেন এমন কাম করছস?’

পদ্মজা ঝাপসা চোখ মেলে তাকাল। শিউলির আম্মা পাশের বাড়ির। পদ্মজার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। পদ্মজা শিউলির মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। বলল, ‘ভাবি আমি কোনো খারাপ কাজ করিনি। সবাই ভুল বুঝছে।’

রীনা নামে একজন মহিলা পদ্মজাকে জোর করে টেনে দাঁড় করাল। হেমলতার অনেক বাহাদুরি এই মেয়ে নিয়ে, অনেক অহংকার। সেই অহংকার আজ ভালো করে ভাঙবে। সে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠেছে।

ঘৃণা ভরা কণ্ঠে পদ্মজাকে বলল, ‘ধরা পড়লে সবাই এমনডাই কয়। আয় তুই।’

পদ্মজা আকুতি করে বলল, ‘বিশ্বাস করুন আমি খারাপ কিছু করিনি আম্মা এসব শুনলে মরে যাবে। আপনারা এমন করবেন না।’

কারো কানে পৌঁছাল না পদ্মজার আর্তনাদ, আকুতি। সবাই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দর মনের, সুন্দর পরিবারের সদস্যগুলোকে ধ্বংস করায় মেতে উঠল। পদ্মজাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে বাহিরে। কখনো ঘোমটা ছাড়া কোনো পুরুষের সামনে না যাওয়া মেয়েটার বুকের ওড়না পড়ে রইল ঘরে। তিন-চার জন মহিলা শক্ত করে পদ্মজার বাহু চেপে ধরে রাখে। সবাইকে উপেক্ষা করে পদ্মজা ঘৃণাভরা চোখে তাকাল আমিরের দিকে। আমির চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর, কিছুতেই পারছে না।

পূর্ণা বাড়িতে ঢুকে দেখে কোলাহল। সে ভয় পেয়ে গেল। জ্বরের তোড়ে কাঁপছে পূর্ণা। একটু এগিয়ে দেখল, পদ্মজার বিধ্বস্ত অবস্থা। মুহূর্তে তার জ্বর উবে গেল। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার আপাকে এভাবে ধরেছেন কেন? আপা…এই আপা? কাঁদছ কেন?’

পদ্মজা কেঁদে বলল, ‘পূর্ণা, আম্মা মরে যাবে এসব দেখলে। আমি কিছু করিনি পূর্ণা।’

পূর্ণা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু অনুভব করছে তার বুক পুড়ছে। পুরো শরীর ব্যথায় বিষিয়ে যাচ্ছে। সে রীনাকে বলল, ‘খালা আপনি আমার বোনকে এভাবে ধরেছেন কেন? ছাড়েন।’ ধমকে উঠল পূৰ্ণা।

রীনা কর্কশ কণ্ঠে বলল, ‘তোর বইনের গতরে রস বাইড়া গেছিল। এজন্য খালি বাড়িত ব্যাঠা ছেড়া ডাইকা আইনা রস কমাইছে।’

নোংরা কথাটি শুনে পূর্ণার গা রি রি করে উঠল! তেজ নিয়ে বলল,

‘খারাপ কথা বলবেন না। আমার আপা এমন না।

পাশ থেকে একজন মহিলা পূর্ণার উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোর মা যেমন হের মাইডাও এমন অইছে। নিজেও এমন কিচ্ছা করল। মাইয়াও করল।’

পদ্মজা চমকে তাকাল।

মহিলা বলে যাচ্ছে, ‘বুঝলা তোমরা সবাই…মায় এক বেশ্যা, মাইয়ারে বানাইছে আরেক বেশ্যা।’

পদ্মজা আচমকা রেগে গেল খুব। আক্রোশে তার শরীর কাঁপতে থাকল। রীনা সহ দুজন মহিলাকে ঠেলে সরিয়ে রাগে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আমার মা নিয়ে কিছু বললে আমি খুন করব। মেরে ফেলব একদম। জিভ ছিঁড়ে ফেলব।’

পদ্মজার এহেন রূপে সবাই থতমত খেয়ে যায়। তার লম্বা চুলগুলো খোঁপা থেকে মুক্ত হয়ে পিঠময় ছড়িয়ে পড়েছে। চোখের মণি অন্যরকম হওয়াতে মনে হচ্ছে, কোনো প্রেতাত্মা রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। গ্রামের কিছু মহিলা আবার বিশ্বাস করে, পদ্মজা কোনো পরির মেয়ে। তাই এত সুন্দর। এই মুহূর্তে তারা ভাবছে, পদ্মজার ভেতর কেউ ঢুকেছে। তাই সামনে এগোল না। রীনা একাই এগিয়ে এলো। পদ্মজার চুলের মুঠি ধরে বিশি গালিগালাজ করতে শুরু করল। কামরুলকে বলল, ‘কামরুল ভাই, এই বান্দিরে বাঁন্ধা লাগব।’

পূর্ণা-প্রেমা পদ্মজাকে ছাড়াতে গেলে ছইদসহ আরো তিন চারজন এগিয়ে আসে। অন্ধকারে ভিড়ের মাঝে বাজেভাবে নিগৃহীত হলো পদ্মজা-পূর্ণা- প্রেমা। কয়টা কালো হাত নিজেদের তৃপ্তি মিটিয়ে নিলো খুব সহজে। তিন বোনের কান্না, তাদের আর্তনাদ কারো হৃদয় ছুঁতে পারল না।

হেমলতার অনুপস্থিতিতে তার আদরের তিন কন্যার জীবন্ত কবর হচ্ছিল, বাধা দেয়ার কেউ ছিল না।

১৭

নৌকা ছাড়ার পূর্বে আকাশের কালো মেঘের ঘনঘটা চোখে পড়ল। তার কিছুক্ষণ পর হঠাৎই নেমে এলো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। খোলা নৌকা হওয়াতে চোখের পলকে কাকভেজা হয়ে গেল যাত্রী পাঁচজন। ভিজলেন না হেমলতা, মোর্শেদ ছাতা ধরে রেখেছেন। বজ্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে হেমলতার আত্মা দুলে উঠছে, খচখচ করছে মনটা। তিনি জলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। জলে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার সঙ্গেই বলের মতো একদলা পানি লাফিয়ে উঠছে। তারপর ছোট্ট ছাতার মতো আকৃতি নিয়ে চারপাশে প্রসারিত হয়ে হাওরে মিলিয়ে যাচ্ছে। দেখতে সুন্দর! কিন্তু সেই সৌন্দর্য মনে ধরছে না। অজানা আশঙ্কায় তিক্ত অনুভূতি হচ্ছে। মোর্শেদ গলা খাকারি দিয়ে হেমলতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বললেন, ‘কিছু খাইবা?’

হেমলতা নিরুত্তর। মোর্শেদ শুষ্ক হাসি হেসে বললেন, ‘আর কিছুক্ষণ। আইয়াই পড়ছি।’

হেমলতা কিছু বললেন না। নিরুত্তরে রইলেন। বৃষ্টির স্পর্শ নিয়ে আসা হাওরের হিমেল বাতাসের ছোঁয়া লাগছে চোখেমুখে। হাওরের ঘোর লাগা বৃষ্টি দেখতে দেখতে চোখে এসে ভর করে ঘুম। হেমলতা নিকাব খুলে চোখেমুখে পানি দিয়ে ঘুম কাটান। এরপর ক্লান্ত চোখ দুটি মেলে তাকান মোর্শেদের দিকে। মোর্শেদের হাতে হাত রেখে বললেন, ‘আমার এত খারাপ লাগছে কেন? বুক পোড়া কষ্ট হচ্ছে।’

মোর্শেদ হেমলতার কণ্ঠ শুনে সহসা উত্তর দিতে পারলেন না। চিত্ত ব্যথায় ভরে উঠল। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আইয়া পড়ছি তো। ওই যে বাজারের ঘাট দেহা যাইতাছে।’

হেমলতা মোর্শেদের হাত ছেড়ে দূরে তাকালেন। অলন্দপুরের বাজারটা ছোটো পিঁপড়ার মতো দেখাচ্ছে। নৌকাটা বার বার দুলছে। ঝড় বইছে চারিদিকে, মনেও তো বইছে। তিনি নিজেকে শান্ত করতে চোখ বুজে বার কয়েক প্রাণভরে নিশ্বাস নিলেন। ব্যথাতুর মন আর্তনাদ করে শুধু জানতে চাইছে, আমার মেয়েগুলো কেমন আছে? কী করছে?

রীনা চুল এত শক্ত করে ধরেছে যে পদ্মজার সারা শরীর ব্যথায় বিষিয়ে উঠছে, আকুতি করেও ছাড়া পাচ্ছে না। পূর্ণা-প্রেমা খামচে ধরে রেখেছে পদ্মজাকে। কিছুতেই তারা বোনকে ছাড়বে না।

আমির ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় হয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘কামরুল চাচা এটা ঠিক হচ্ছে না! মেয়েগুলোর অভিশাপে পুড়ে যাবেন।’

আমিরের কথায় ক্ষণকালের জন্য কামরুল হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। রমিজ আলী কামরুলের নরম, নিঃশব্দ, ভয়ার্ত মুখের দিকে চেয়ে ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হলেও তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, ‘বেশ্যাদের শাপে কেউ পুড়ে না।’

জলিল প্রেমাকে সরিয়ে নিয়েছে। দূর থেকে প্রেমার কান্না শোনা যাচ্ছে। বড়ো আপা, বড়ো আপা করে গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। ছইদ অনেক টেনেও পূর্ণাকে সরাতে পারল না, তাই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পূর্ণার বুকে নোংরা হাতের দাগ বসিয়ে দিতে দ্বিধা করল না। পূর্ণা এমন ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কোনো মেয়েই এমন নিচু ঘটনার সাক্ষী হতে চায় না। অকস্মাৎ এই ঘটনা কাটিয়ে ওঠার পূর্বেই একটা শক্ত হাত পায়জামার ফিতা টেনে ধরল। পূর্ণার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। ভয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘আপা…আপা।’

পূর্ণার আর্তনাদ পদ্মজার মস্তিষ্ক প্রখর করে তুলে। পদ্মজা মুখ তুলে পূর্ণার দিকে তাকাল। তার চেয়ে এক হাত দূরে পূর্ণা। পদ্মজার আঙুল শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। কাছে আসতে পারছে না ছইদের জন্য। পূর্ণার কান্না দেখে পদ্মজা আতঙ্কে নীল হয়ে গেল। চারিদিকে কোলাহল। সবাই গালি দিচ্ছে মা- বাপ তুলে। কেউ বলছে না, মেয়েটা ভালো, এরকম করতেই পারে না। পূর্ণা চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কেঁদে মাকে ডাকছে। পদ্মজা এক দৃষ্টে মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।

মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়?

পূর্ণার হাত ছইদ আলগা করতেই সে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল পদ্মজাকে। তার পুরো শরীর কাঁপছে। হৃৎপিণ্ড এত জোরে চলছে যে অনুভব করা যাচ্ছে। পূর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আপা…আপা…কেন মেয়ে হলাম, আপা? এত কষ্ট হচ্ছে, আপা। আপা…’

পদ্মজার দুচোখ বেয়ে টুপ করে দুই ফোঁটা জল পড়ে। এক হাতে শক্ত করে পূর্ণাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে।

রমিজের উসকানিতে কামরুল গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘নটিরে বান ছইদ।’

পূর্ণার কানে কথাটা আসতেই সে আরো জোরে পদ্মজাকে জড়িয়ে ধরল। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকা পদ্মজা হঠাৎ শান্ত হয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘পূৰ্ণা, ছেড়ে দে আমায়।’

রীনা পদ্মজাকে চুলে ধরে টেনে নিয়ে যেতে চাইলেও পদ্মজা জায়গা থেকে এক চুলও নড়ল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। পূর্ণাকে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘বেঁচে থাকলে সব উসুল হবে। ছেড়ে দে।’

পদ্মজার কণ্ঠে মায়ের ছায়া ছিল! পূর্ণা সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে গেল। চোখ তুলে পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজার গাল বেয়ে রক্ত ঝরছে। ছইদ পূর্ণাকে নিতে আসলে একটি দুঃসাহসিক কাজ করে বসল সে, লাথি বসিয়ে দিল ছইদের অণ্ডকোষ বরাবর। ছইদ মাগো বলে কুকিয়ে উঠে। জলিলসহ উপস্থিত তিনজন তেড়ে আসে পদ্মজার দিকে, পূর্ণাকে ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দূরে। অশ্রাব্য গালি দিতে দিতে কেউ পদ্মজাকে থাপ্পড় দিল, কেউ বা দিল লাথি। নির্মম দৃশ্যটি দেখে দুই তিনজন গ্রামবাসীর মনে মায়া উদয় হয়। তারা ছুটে আসে পদ্মজাকে বাঁচাতে। প্রান্ত ভয়ে চুপসে গিয়েছিল। পদ্মজাকে কাদায় ফেলে মারতে দেখে দৌড়ে আসে, জলিলের হাতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে কামড় দেয়। জলিল প্রান্তের কান বরাবর থাপ্পড় বসাতেই প্রান্তের মাথা ভনভন করে উঠল। পরিস্থিতি বিগড়ে যেতে দেখে কামরুল হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। মনে মনে বেশ ভয় পান। কেশে গলা পরিষ্কার করে, দুই হাত তুলে চেঁচিয়ে বললেন, ‘তোমরা থামো, এইডা কি করতাছ? থামো কইতাছি। সবাই সইরা আসো। থামো…!’

সবকিছু থেমে গেল। পদ্মজা কাঁচুমাচু হয়ে পড়ে রইল কাদায়। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নাভির নিচে একটা লাথি পড়েছে বেশ জোরে। চোখ বুজে রেখেছে। দুই হাত বুকের উপর। লম্বা-চুল কাদায় মেখে ছড়িয়ে আছে আশপাশে। যন্ত্রণায় যেন পাঁজরগুলো মড়মড় করে ভেঙে যাচ্ছে। জ্বরের তোপে জ্ঞান হারিয়েছে পূর্ণা। হেমলতার মা মনজুরা বাড়িতে ঢুকে পদ্মজাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠলেন। দৌড়ে এসে পদ্মজাকে তুলতে চাইলে কামরুল হুংকার ছাড়লেন, ‘এই ছেড়িরে ধরন যাইব না। যান এন থাইকা।’

মনজুরা পদ্মজার কামিজ ঠিক করে দিয়ে দুজন লোককে নিয়ে পূর্ণাকে তুলে ঘরে নিয়ে গেলেন। মনজুরার বুক কাঁপছে হেমলতার ভয়ে। হেমলতা বার বার বলেছিল দুই দিন তার মেয়েদের চোখের আড়াল না করতে! আর তিনি একা বাড়িতে ছেড়ে দিয়েছেন! ইচ্ছে হচ্ছে এক ছুটে কোথাও পালিয়ে যেতে। হিমেল নাক টেনে টেনে কাঁদছে। জপ করছে হেমলতার নাম। মনজুরা রেগে ধমকালেন, ‘আহ! থাম তো।’

.

বাপের বাড়িতে কাউকে না পেয়ে হেমলতা চিন্তায় পড়ে যান।

মোর্শেদ হেমলতার দুশ্চিন্তা বুঝতে পেরে বললেন, ‘বাড়িত গিয়া বইয়া রইছে মনে হয়। আও বাড়িত যাই।’

হেমলতা মিনমিনে গলায় বললেন, ‘তাই হবে।

দুজন হেঁটে বাড়ির রাস্তায় উঠে। তখন পাশ কেটে একজন মহিলা হেঁটে যায়। কিছুটা হাঁটার পর মোর্শেদের খটকা লাগল। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান। মহিলাটি অনেক দূর চলে গিয়েছে। মহিলার অবয়ব দেখে মোর্শেদের বাসন্তীর কথা মনে পড়ে যায়। মনে মনে আওড়ান, বাসন্তী আইছে?’ পরপরই নিজের মনকে বুঝ দিলেন, ‘না, না হে আইব কেমনে। আর আইলেও যাইব গা ক্যান?’

তিনি আর মাথা ঘামালেন না। হেমলতার বুক দুরুদুরু করছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। তবুও তিনি অজানা আশঙ্কায় ঘামছেন।

তারা বাড়ির কাছাকাছি এসে মাতব্বরকে দেখতে পেল। মাতব্বরের সঙ্গে আরো দুজন ব্যক্তি। বাড়ির সামনে মানুষের ভিড়ও দেখা যাচ্ছে। হেমলতার হৃৎপিণ্ড থমকে গেল। মেরুদণ্ড বেয়ে বরফের ন্যায় ঠান্ডা কিছু একটা ছুটে গেল। তিনি নিশ্বাস আটকে রেখে ছুটতে থাকেন। পিচ্ছিল পথে পিছলা খেয়ে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেন। হেমলতার দৌড় দেখে মোর্শেদ পিছু নেন, অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি দৌড়তাছ ক্যান?’

হেমলতা প্রশ্নটি শুনলেন না। নিকাব বাতাসের দমকে উড়ে পড়ল দূরে। তিনি ভিড় ঠেলে বাড়িতে ঢুকলেন। সঙ্গে সঙ্গে কোলাহল বেড়ে গেল। এত ভিড়ের মাঝে একটা মেয়েকে কাদায় পড়ে থাকতে দেখে তিনি অবাক হলেন। অন্ধকারে মেয়েটিকে চিনতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে।

তিনি আঙুল তুলে বিড়বিড় করলেন, ‘কে?’

হেমলতার প্রশ্ন কারো কান অবধি গেল না। কোত্থেকে একটি আলো এসে পড়ল পদ্মজার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে হেমলতার চক্ষুদ্বয়ের সামনে পদ্মজার কাদা-রক্তে মাখা মুখটা ভেসে উঠল

হেমলতা গগন কাঁপিয়ে আর্ত চিৎকার করে উঠলেন, ‘পদ্ম…আমার পদ্ম।

পদ্মজার বুক ধড়াস করে উঠল! অস্তিত্ব কেঁপে উঠল। আম্মা এসেছে! তার পৃথিবী! তার শক্তি! পদ্মজা দুর্বল দুই হাতে ভর রেখে উঠে বসার চেষ্টা করল। পারল না। ভাঙা গলার জোর দিয়ে শুধু ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা।’

হেমলতার পৃথিবী থমকে গিয়েছে। বিধ্বস্ত, পর্দাহীন, কাদা, রক্তমাখা পদ্মজাকে দেখে বিশ্বাস হচ্ছে না এটা তার মেয়ে। তিনি দ্রুত নিজের বোরখা খুলে পদ্মজাকে ঢেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। অসহনীয় যন্ত্রণায় যেন কলিজা বেরিয়ে আসছে তার। তার সোনার কন্যার এ কী রূপ! কে করল? কাঁপা কণ্ঠে শুধু বললেন, ‘পদ্ম…আমার পদ্ম। ‘

হেমলতার বুকে মাথা রেখে পদ্মজা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, ‘আম্মা…আম্মা।’

হেমলতা পদ্মজাকে আরো জোরে চেপে ধরলেন বুকের সঙ্গে। দৃষ্টি অস্থির। বুক হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে।

মোর্শেদ বাড়িতে ঢুকে উঁচু গলায় বললেন, ‘এইহানে এত মানুষ ক্যান? মাতব্বর মিয়া আপনে এইনে ক্যান? কী অইছে?’

প্রান্ত-প্রেমা দৌড়ে এসে মোর্শেদকে জড়িয়ে ধরল। দুজন ভয়ে কাঁদছে, কান্নার শব্দ হচ্ছে না। মোর্শেদ বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মাতব্বর মজিদ গম্ভীর কণ্ঠে কামরুলকে প্রশ্ন করলেন, ‘মেয়েটার এই অবস্থা কারা করেছে? এটা কি নিয়মের মধ্যে পড়ে?’

কামরুল মাথা নিচু করে রেখেছেন। মিনমিনে গলায় বললেন, —আমি ছেড়িডারে মারতে কই নাই। জলিল, ছইদ আর মজনুর ছেড়ায় নিজ ইচ্ছায় মারছে।’

‘আপনি আটকালেন না?

‘আটকাইছি বইললাই মাইয়াডা বাঁইচা আছে। আর এমন নটিদের বাঁচার অধিকার নাই।’

‘থামেন মিয়া! কার কী শাস্তি হবে সেটা আমার দায়িত্ব। আপনার না। ছইদ, জলিল আর মজনুর ছেলেকে তো দেখা যাচ্ছে না। আগামীকাল তাদের আমি মাঠে দেখতে চাই।’

কামরুল মাথা নিচু করে রাখলেন। মজিদ হাওলাদার ভারি সৎ এবং নিষ্ঠাবান মানুষ। গ্রামের মানুষদের দুই হাতে আগলে রেখেছেন। পুরো অলন্দপুরের মানুষ মজিদকে ফেরেশতা-সমতুল্য ভাবে। পঁচিশ বছর ধরে অলন্দপুর সামলাচ্ছেন তিনি।

গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে অন্ধকার। হেমলতা কিছুতেই হিসেব মিলাতে পারছেন না। অনেক বছর আগের ঘটনা আর এই ঘটনা হুবহু একরকম কী করে হলো? তিনি নিজের ভেতর একটা হিংস্র পশুর উপস্থিতি অনুভব করছেন। কামরুলের মুখ থেকে শোনা তিনটা নাম মস্তিষ্কে নাড়া দিচ্ছে প্রচণ্ডভাবে!

ছইদ, জলিল আর মজনুর ছেলে!

মজিদ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আগামীকাল সবাই স্কুল মাঠে চলে আসবেন। মিয়া মোর্শেদ, মেয়ে নিয়ে আলো ফুটতেই চলে আসবেন। এই বাড়ি পাহারায় থাকবে মদন আর আলী। আমার ছেলেকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। ঠিক সময়ে সেও উপস্থিত থাকবে।’

১৮

ভিড় কমতেই কানে তালা লাগানোর মতো প্রচণ্ড শব্দে কাছে কোথাও বজ্রপাত হলো। হেমলতা একা পদ্মজাকে তুলতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন মোর্শেদ এগিয়ে এসে দুই হাতে পাঁজকোলা করে তুলে নিলেন পদ্মজাকে। সেই সময় বিজলি চমকায়, সেই আলোয় পদ্মজার মুখটা দেখে মোর্শেদের বুক কেমন করে উঠল! কষ্টে চুরমার হয়ে গেল হৃদয়খানা। জন্মের দিন পদ্মজাকে কোলে নেয়ার পর যে অনুভূতি হয়েছিল ঠিক সেরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে…এর নামই বোধহয় পিতৃত্ব!

প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাস বইছে। তারা ঘরে ঢুকতেই ভারি বর্ষণ শুরু হলো। মুহূর্তে দেখা দিল তাণ্ডবরূপি ঘূর্ণিঝড়; সেই তাণ্ডব ছুঁতে পারল না মোড়ল বাড়ির মানুষদের মন। ঝড়ের তাণ্ডবের চেয়েও বড়ো তাণ্ডবের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেছে তারা। হেমলতা গরম পানি করে পদ্মজাকে গোসল করালেন, পালটে দিলেন জামাকাপড়। পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে নীরবে শুধু কেঁদে গেল, অশ্রু আটকে রাখতে পারছে না কিছুতেই। ইচ্ছে হচ্ছে বাড়ির পেছনের আম গাছটার সঙ্গে ফাঁস লেগে মরে যেতে। হেমলতা পদ্মজার চুল মুছে কপালে চুমু দিলেন। তার চোখ থেকে পদ্মজার নাকে এক ফোঁটা জল পড়ল। পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল মায়ের দিকে।

‘আম্মা আসছে? আম্মা কোথায়? আম্মা আসেনি?’

পাশের ঘর থেকে পূর্ণার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে ছুটে এলো সে, হেমলতাকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল বুকের ওপর। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। পূর্ণার শরীরকে আগ্নেয়গিরি মনে হচ্ছে। এত উত্তাপ! জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। পূর্ণার কান্না দেখে পদ্মজাও ডুকরে কেঁদে উঠল। হেমলতা স্তব্ধ হয়ে দুই মেয়ের কান্না শুনছেন। কাউকেই সামলানোর চেষ্টা করছেন না।

এদিকে মনজুরা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার সামনে।

টিনের চালে ভারি বর্ষণের শব্দ হচ্ছে, জগৎ-সংসার একাকার হয়ে যাচ্ছে সেই শব্দে।

মাঝরাত। বাতাসের বেগ প্রচণ্ড। হেমলতা কালো রংয়ের শাড়ি পরে, একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বাড়ির বাইরে পা বাড়ান। মনজুরা বারান্দার ঘর থেকে উঁচু কণ্ঠে বললেন, ‘রাম-দা ব্যাগে ক্যান ঢুকাইছস? আর কোন কেলাঙ্কারি বাকি?’

হেমলতা বিদ্যুৎবেগে ফিরে দাঁড়ালেন মনজুরার মুখে দিকে এক লহমার জন্য, পরক্ষণেই নিঃশব্দে বর্ষণ মাথায় নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলেন মনজুরা, ছুটে গেলেন পদ্মজার ঘরে। পদ্মজা চুপচাপ শুয়ে আছে। মৃদু ফোঁপানোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। পূর্ণা ঘুমাচ্ছে। তিনি ঘর ছেড়ে দ্রুত বারান্দা-ঘরে এলেন। বড্ড অস্থির লাগছে। জীবনে প্রথমবার সৃষ্টিকর্তার কাছে হেমলতার জীবন ভিক্ষা চেয়ে সেজদায় লুটিয়ে পড়লেন! মেয়েটার যাতে কিছু না হয়।

ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। ধরণী শান্ত যেন কিছুই হয়নি। পদ্মজা ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। গেটের শব্দ পেয়ে উৎসুক হয়ে তাকাল। বিধ্বস্ত অবস্থায় হেমলতা ঢোকেন বাড়ির ভেতর। মনজুরা কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, পদ্মজা টের পায়নি। হেমলতা বাড়িতে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা মুরগির খোঁপে সামনে ছুঁড়ে ফেলেন। অন্ধকারের কারণে তার মুখ স্পষ্ট নয়। হেমলতা বাড়ির পেছনের দিকে চলে গেলেন। পদ্মজার অনুভূতিশূন্য, বিভীষিকাময় সন্ধ্যার স্মৃতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। সে ধীর পায়ে উঠানে এসে দাঁড়াল। পেছন পেছন গেলেন মনজুরা। পায়ের শব্দে চমকে তাকাল পদ্মজা, দেখতে পেল নানিকে। ধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘নানু, আম্মা কোথায় গিয়েছিল?’

মনজুরা ক্ষণকাল নীরব থেকে বললেন, ‘জানি না।’

মনজুরার কণ্ঠে ভয়। পদ্মজা নিজের দুর্বল শরীর ঠেলে নিয়ে এলো বাড়ির পেছনে। দেখতে পেল, হেমলতা নদীতে নেমে গোসল করছেন। তিনি এক মুহূর্তে কয়েকটা ডুব দিলেন।

পদ্মজার মাথায় এবার দুশ্চিন্তা ভর করতে শুরু করে। ব্যস্ত পায়ে ঘাটের কাছে এসে সে ক্ষীণ স্বরে ডাকল, ‘আম্মা।’

হেমলতা ঘুরে তাকালেন। ঝড় শেষে আকাশ সাদা, অন্ধকার কাটার পথে। পদ্মজা বলল, ‘অসময়ে কেন গোসল করছ? ঠান্ডা লাগবে।’

হেমলতা গোসল শেষ করে উঠে এলেন ওপরে। পদ্মজাও আর কিছু বলল না। হেমলতা উঠানে এসে মনজুরাকে আদেশের সুরে বললেন, ‘পূর্ণাকে নিয়ে আসো আম্মা।’

পদ্মজা অবাক হয়ে শুধু দেখছে। পূর্ণা ধীর পায়ে হেঁটে আসে। তার জ্বর অনেকটা কমেছে। মনজুরা দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। হেমলতা মৃদু হেসে পূর্ণাকে বললেন, ‘পদ্মজার পাশে এসে দাঁড়া।’

পূর্ণা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। সে বাধ্যের মতো এসে দাঁড়াল পদ্মজার পাশে। হেমলতা মুরগির খোঁপের পাশ থেকে কালো ব্যাগটা হাতে তুলে নিলেন, ভেতর থেকে বের করলেন একটা রাম-দা আর একটা কৌটা। পূৰ্ণা রাম-দা দেখে চমকে উঠল, চোখাচোখি হলো দুই বোনের।

রক্তেমাখা রাম-দা দুই মেয়ের পায়ের সামনে রাখলেন হেমলতা, শীতল কিন্তু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই পৃথিবীতে সেরা মানুষগুলোরই বাঁচার অধিকার আছে। মানুষরূপী পশুদের না। যখন যেখানে কোনো মেয়েকে অসম্মান হতে দেখবি এক কোপ দিয়ে অমানুষটার আত্মা দেহ থেকে আলাদা করে দিবি। যে তোকে অসম্মান করেছে সে দোষী, তুই না। তার শাস্তি পাওয়া উচিত, তোর না। তাই আত্মহত্যার কথা কখনো ভাববি না। দোষীর আত্মা হত্যা করা উচিত। আর আমি মনে করি, এতে পাপ নেই। বরং পাপীকে বিনাশ না করা পাপ। আর আমার মেয়েরা যেন সেই পাপ কখনো না করে। সেই…’

‘মেয়েদের এসব কী কইতাছস তুই? মাথা খারাপ হইয়া গেছে তোর?’ মনজুরা হইহই করে উঠলেন।

হেমলতা ঢোক গিলে মনজুরার কথা হজম করে নিলেন। আবার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি কখনো ছেলে চাইনি। মেয়ে চেয়েছি। প্রতিবাদী, দুঃসাহসি মেয়ে চেয়েছি। আল্লাহ আমাকে তিনটা মেয়ে দিয়েছেন। এখন সেই মেয়েরা যদি এইটুকুতে দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে কীভাবে হবে? ঠিক আগের মতোই মাথা উঁচু করে বাঁচবি। যতদিন আমি আছি কেউ তোদের অসম্মান করে টিকতে পারবে না। আমি না হয় যতদিন বেঁচে থাকি তাদের শাস্তি দেব, পৃথিবী থেকে মুছে দেব; কিন্তু যখন থাকব না? তখন…তখন কী তারা বেঁচে থাকবে? বেঁচে থাকতে দেয়া ঠিক হবে? অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে নোংরামো করবে না, তার নিশ্চয়তা আছে? নেই। এখন থেকে নিজেদের শক্ত কর। মেয়েদের সাহস মেয়েদেরই হতে হয়। নিজেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিজের। গত রাতের স্মৃতি দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেতে বলব না, মনে রাখ। প্রতিটি মানুষের ভেতর লুকানো হিংস্র শক্তি আছে। সবাই প্রকাশ করতে জানে না। চিনতে পারে না নিজেকে। গত রাতের ঘটনাটি মনে রেখে নিজের ভেতর লুকানো হিংস্র শক্তিটাকে জাগিয়ে হাতের মুঠোয় রাখ। যাতে সঠিক সময়ে হাতের মুঠো খুলে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারিস। আঘাতে, আঘাতে চুরমার করে দিতে পারিস পাপের জগত।’

এইটুকু বলে হেমলতা ক্লান্ত হয়ে দপ করে বসে পড়লেন। পদ্মজা ‘আম্মা’ বলে হেমলতাকে ধরতে চাইলে, হাত উঠিয়ে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে থাক।’ সময় নিয়ে প্রাণ ভরে দম নিলেন তিনি, এরপর কৌটাটা খুলে ঠান্ডা তরল কিছু ঢেলে দিলেন দুই মেয়ের পায়ে। পূর্ণা কেঁপে উঠে দূরে সরে গেল। পদ্মজা আতঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কার রক্ত?’

রক্তের কথা শুনে ঘৃণা আর ভয়ে পূর্ণার সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠল। তার মনে হচ্ছে পায়ে পোকা কিলবিল করছে। টাটকা তাজা লাল রক্ত! বমি গলায় এসে আটকে গেছে। হেমলতা জবাব দিলেন না, শুধু মৃদু হাসলেন। পূৰ্ণা এই ভয়ংকর দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারাল। দুই হাতে বোনকে জাপটে ধরল পদ্মজা। কী আশ্চর্য, এই ভয়ংকর ঘটনা তাকে একটুও বিচলিত করল না! হেমলতার গায়ে ভেজা শাড়ি। তাই তিনি পূর্ণাকে ধরলেন না। মনজুরাকে বললেন, ‘পূর্ণারে ঘরে নিয়ে যাও আম্মা।’

মনজুরা কঠোর চোখে চেয়ে আছেন হেমলতার দিকে। হেমলতা আবারো হাসলেন। ভেজা কণ্ঠে মনজুরাকে বললেন, ‘কালো বলে অবহেলা না করে বুকে আগলে রাখলে আমার জীবনটা, আমার মেয়েদের জীবনটা অন্যরকম হতে পারত আম্মা।’

হেমলতার কথায় মনজুরার সারামুখ বিষণ্ণতা ছেয়ে গেল। তিনি হেমলতার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলেন না, অপরাধবোধে মাথা নুইয়ে ফেললেন। পূর্ণাকে ধরে নিয়ে গেলেন ঘরে। হেমলতা সেখানেই পড়ে রইলেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেললেন। আলো ফুটেছে পুরোপুরি। পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। তিনি পানি দিয়ে উঠানের রক্ত মুছে দিলেন চিরতরে। রাম-দা ধুয়ে লুকিয়ে রাখলেন লাহাড়ি ঘরে। শাড়ি পালটে উঠানে পা রাখতেই মগাকে দেখতে পেলেন। খবর এনেছে সে, বিচার বসবে দুপুরে। রাতের ঘূর্ণিঝড়ে গ্রামের বেশিরভাগ ঘরবাড়ি উড়ে গেছে, ফসল ও পশুপাখিসহ বিভিন্ন ক্ষতি হয়েছে। অনেক মানুষ আহত হয়েছে! এই খবর শুনে হেমলতার চোখ সজল হয়ে উঠল 1 প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। প্রকৃতি কখনো কাউকে ছাড়ে না! গ্রামবাসী অন্যায় দেখেও নিস্তব্ধ থেকেছিল। এ বুঝি তারই শাস্তি!

.

মাথার ওপর সূর্য, তাপদাহও প্রচণ্ড। পূর্ণা, পদ্মজা ও হেমলতা কালো বোরখার আবরণে নিজেদের ঢেকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে অলন্দপুরের মাধ্যমিক স্কুলের উদ্দেশ্যে। খা খা রোদ্দুর, তপ্ত বাতাসের আগুনের হলকা। সবুজ পাতা নেতিয়ে পড়ার দৃশ্য পড়ছে চোখে। মোর্শেদ বাকিদের নিয়ে আসছে। রীনাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে করুণ কান্নার স্বর ভেসে আসে। পদ্মজা চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল, রীনার বাড়ির ছাদ উড়ে গেছে, গাছপালা ভেঙে পড়ে আছে উঠানে। হেমলতা পদ্মজাকে টেনে নিয়ে এগিয়ে যান।

বটের ছায়ায় আশ্রয় নিচ্ছিল এক রাখাল ছেলে। সে হেমলতার মুখ দেখে বুঝে যায়, পেছনের দুটি মেয়ে পদ্মজা আর পূর্ণা।

রাখাল ছেলেটি ছুটে এসে পদ্মজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘পদ্ম আপা, তুমি ডরাইও না। তোমার কিচ্ছু হইব না।’

চারদিকে নিঝুম, নিস্তব্ধ, ঝিমধরা প্রকৃতি। ঘামে দরদর তৃষ্ণার্ত রাখাল হাঁপিয়ে কথা বলছে। স্কুলে যাওয়ার পথে, মাঝে মাঝেই এই পনেরো বছর রাখালের সঙ্গে দেখা হতো পদ্মজার। পদ্মজার জন্য পাগল সে। বড়ো বোনের মতো মান্য করে। পদ্মজা

মৃদু হাসল। তবে মুখের ওপর পাতলা পর্দা আছে বলে, রাখালের চোখে তা পড়ল না। রাখালকে পেছনে ফেলে তিন মা-মেয়ে এগিয়ে চলল।

স্কুল মাঠে অনেক মানুষ জমেছে। রাতের ঘূর্ণিঝড়ের জন্য অলন্দপুরের বেশি অর্ধেক মানুষ আসেনি। তবুও উপস্থিত জনতার সংখ্যা শ-পাঁচেক তো হবেই! ঘটনা ঘটেছে আটপাড়ায়, আর তা ছড়িয়ে পড়েছে সব পাড়ায়! যথাসময়ে বিচার কার্য শুরু হলো। পদ্মজা এবং আমির দুজন দুই দিকে দাঁড়িয়ে আছে।

আমির একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পদ্মজার দিকে, তার দুচোখ ভরতি মুগ্ধতা।

মাতব্বর ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘পদ্মজা-আমিরকে একসঙ্গে কারা কারা দেখেছেন?’

রমিজ আলী, কামরুল, মালেক হাত তুললেন। মজিদ মাতব্বর বললেন, ‘কী দেখেছেন? ব্যাখ্যা করুন।

রমিজ আগে আগে উঁচু কণ্ঠে বললেন, ‘আমি দেখছি ঝড়ের সন্ধ্যায় আপনের পোলারে পদ্মজার ঘর থেকে বাইর হইতে। বাড়িত আর কেউ আছিল না।’

আমির রেগে গিয়ে কিছু বলতে চাইলে মজিদ মাতব্বর হাতের ইশারায় আটকে দিলেন। আমির বাপের বাধ্য সন্তান, তাই থেমে গেল।

মজিদ মাতব্বর বললেন, ‘আপনি আমিরকে পদ্মজার ঘর থেকেই বের হতে দেখেছেন?’

রমিজ আলী দৃষ্টি অস্থির রেখে আমতা আমতা শুরু করলেন। দম নিয়ে বললেন, ‘তারে বারান্দা থাইকা বাইর হইতে দেখছি।’

মজিদ মাতব্বর মুহূর্তখানেক নীরব থেকে বললেন, ‘তাহলে কোন আন্দাজে আপনি বলছেন, তারা নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত ছিল?’

কথাটি শুনে পদ্মজার সর্বাঙ্গ রি রি করে উঠল, চোখ বুজে ফেলল সে। রমিজ আলী থমকে গিয়ে পরপরই হুংকার দিয়ে ওঠে, ‘একটা অচেনা ছেড়া খালি বাড়িত কোনো ছেড়ির কাছে কেন যাইব? আপনার নিজের ছেড়া বলে তার দোষ ঢাকতে পারেন না। আমার ছেড়ির বেলা কিন্তু ছাড়েন নাই।’

মাতব্বর রেগে গেলেন, যুক্তি দিয়ে কথা বলুন। আপনার মেয়েকে হাতেনাতে ধরা হয়েছিল। তার গায়ে কাপড় ছিল না। তারা একসঙ্গে একই ঘরের একই বিছানায় ধরা পড়েছে। আমির আর পদ্মজার বেলা সেটা হয়নি।’

মজিদ মাতব্বরের ক্ষমতা এবং কথার দাপটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে রমিজ আলীর। কামরুল চুপসে গিয়েছেন। সামনে নির্বাচন। মজিদ মাতব্বরকে খেপানো মানে নিজের কপালে দুঃখ বয়ে আনা।

ভিড়ের মাঝ থেকে কেউ একজন বলল, ‘তাহলে আপনার ছেলে একটা মেয়ের কাছে খালি বাড়িতে গেল কেন?’

মজিদ মাতব্বর উঁকি দিয়ে প্রশ্নদাতাকে খুঁজে বের করলেন। তারই প্রতিপক্ষ হারুন রশীদ! মজিদ মাতব্বর আমিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি মোড়ল বাড়িতে কেন গিয়েছিলে?’

আমির সহজ গলায় বলল, ‘বাড়ি ফিরছিলাম হঠাৎ ঝড় শুরু হলো সামনে মোর্শেদ কাকার বাড়ি ছিল। মোর্শেদ কাকা বাড়ি নেই আমার জানা ছিল না। জানলে বৃষ্টিতে ভিজতাম তবুও ওই বাড়ি যেতাম না। এই গ্রামের অনেকেই জানে আমার শ্বাসকষ্ট আছে। বাড়ির সবাই জানে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লেগে যায়, শ্বাসকষ্ট হয়। তাছাড়া পদ্মজাকে এর আগে কখনো দেখিনি আমি। কেউ কী কখনো পদ্মজার সঙ্গে আমাকে দেখেছে?’ আমির জনতার উদ্দেশ্যে বলল, ‘বলেন, কেউ দেখেছেন? আমাদের আগে কখনো দেখাই হয়নি তাহলে সম্পর্ক কী করে হবে?’

হারুন রশীদ বললেন, ‘যখন দেখলা ছেড়িড়া বাড়িত একলা তখন বাইর হইয়া গেলা না ক্যান?’

আমির সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘আমার মাথায় আসেনি এমন কিছু হতে পারে। আর…’

আমির পদ্মজার দিকে তাকাল। পদ্মজা সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলো। আমির বলল, ‘আর…পদ্মজার মতো রূপসী আর একটাও নেই এটা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য। আমি প্রথম দেখে অভিভূত হয়ে পড়ি। তাই মস্তিষ্কে একবারো কোনো বিপদের আশঙ্কা আসেনি। এমন নোংরা কিছু হতে পারে ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি।’

মজিদ মাতব্বর ছেলের দুর্বলতা বুঝতে পেরে অসন্তুষ্ট হলেন। তবুও স্বাভাবিক থেকেই বললেন, ‘গ্রামবাসী কোনো প্রমাণ ছাড়াই লাফিয়েছে। মেয়েটাকে অপদস্থ করেছে। প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে নোংরা অপবাদ দেয়া অপরাধ।’ তিনি কামরুলের দিকে তাকিয়ে তাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ছইদ, মজনুর ছেলে আরেকটা কে জানি? কোথায় তারা?’

কামরুল ধীরভাবে বললেন, ‘খুঁজে পাই নাই। মনে হয় ভয়ে কোনহানে লুকাইছে।’

রমিজ আলী হঠাৎ গমগম করে উঠলেন, ‘এইডা আমি মানি না। পদ্মজা- আমিররে আপনে ছাইড়া দিতে পারেন না। আপনের ক্ষমতা বেশি দেইখা আপনে এমনে নিজের ছেড়ারে ঢাইকা রাখতে পারেন না। আপনি বেইমানি করতাছেন।’

আমির রেগেমেগে রমিজ আলীকে ধরতে এলে, মজিদ গর্জন করে উঠলেন, ‘আমির!’

আমির কিড়মিড় করে রাগ হজম করার চেষ্টা করল। হারুন অতিশয় ধূর্ত লোক। তিনি রসিকতা করে বললেন, ‘সত্য হউক আর মিথ্যাই। বদনাম তো বদনামই।’

মজিদ সবার প্রশ্ন কথা উপেক্ষা করে উপস্থিত গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আপনাদের আমার বিচারের প্রতি বিশ্বাস আছে?’

সবাই আওয়াজ করে বলল, ‘আছে।’

মজিদ মাতব্বর তৃপ্তির সঙ্গে হাসলেন। ক্ষণকাল নীরব থেকে উঠে দাঁড়ালেন। গলার স্বর উঁচু করে বললেন, ‘মোর্শেদের মেয়েদের সঙ্গে খারাপ হয়েছে। পদ্মজার নামে অনেক প্রশংসা শুনেছি। সে খুবই ভালো মেয়ে। আর আমার ছেলেকেও সবাই চিনেন, সে কেমন। যারা যারা দোষ করেছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া হবে। পদ্মজা আর আমির নামে যে পাপের অভিযোগ করা হয়েছে তার যুক্তিগত প্রমাণ নেই। আর প্রমাণ ছাড়া আমি কখনো কাউকে শাস্তি দেইনি। আজও দেব না। তবে আমি আজ সবার সামনে মোর্শেদ আর তার স্ত্রীর কাছে একটা প্রস্তাব রাখব।’

হেমলতা, মোর্শেদ সহ উপস্থিত সবাই কৌতূহল নিয়ে তাকাল। মজিদ মাতব্বর এক নজর আমিরকে দেখে বললেন, ‘পদ্মজাকে আমিরের বউ করে নিয়ে যেতে চাই।’

চারিদিকে কোলাহল বেড়ে গেল। সব কোলাহল সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে স্বপ্নাবিষ্টের মতো শুধু মজিদ মাতব্বরের প্রস্তাবটি পদ্মজার কানে বাজতে থাকল। জীবনের কোন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে সে?

১৯

সূর্যের প্রখর তাপে সমস্ত প্রকৃতি যেন নির্জীব হয়ে ওঠেছে। উপস্থিত সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। রমিজ আলি আর হারুন রশীদ নামক ধূর্ত মানুষগুলোর চোখ ছানাবড়া। মজিদ মাতব্বর ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনারা চাইলে সময় নিতে পারেন। আজ এখানে…’

হেমলতা কথার মাঝে আটকে দিয়ে বললেন, ‘আপনি বিয়ের তারিখ ঠিক করুন।’

মজিদ মাতব্বরের প্রস্তাবের চেয়ে এই প্রস্তাবে হেমলতার রাজি হওয়াটা যেন কোলাহল মুহূর্তে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল। পদ্মজা হতবাক, বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! মোর্শেদ চোখ বড়ো করে হেমলতার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। আশপাশ থেকে ফিসফিসানি ভেসে আসছে। মজিদ মাতব্বর মৃদু হাসলেন। আনন্দের সঙ্গে সবাইকে নিমন্ত্রণ করলেন, ‘আগামী শুক্রবার আমার ছেলের সঙ্গে মোর্শেদের বড়ো মেয়ের বিবাহ। আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ রইল।’ কথা শেষ করে হেমলতার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘দিন তারিখ ঠিক আছে?’

হেমলতা সম্মতি জানালেন। মোর্শেদ অবাকের চরম পর্যায়ে, কোনো কথা আসছে না মুখে। পদ্মজা ঢোক গিলে ব্যাপারটা হজম করে নিলো মুহিবের সঙ্গে যখন তার বিয়ের আলোচনা হলো তখন সে ভারি অবাক হয়েছিল। লিখন শাহ নামে একটা মানুষকে মনে পড়েছিল। এখন তেমন কিছুই হচ্ছে না, অনুভূতিগুলো ভোঁতা। যা হওয়ার হবে। সেসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই।

বিচার সভা ভেঙে গেল। মজিদ মাতব্বর আলাদা করে মোর্শেদের সঙ্গে কথা বললেন। তিনি আগামীকাল নিজ স্ত্রী এবং বাড়ির অন্যান্য বউদের নিয়ে পদ্মজাকে দেখতে আসবেন। মোর্শেদ, হেমলতা সমস্বরে অনুমতি দিলেন বাড়ি ফেরার পথে অনেকের কটু কথা কানে আসে। পদ্মজা আর আমির দুজনেরই চরিত্র খারাপ। এজন্যই বিয়ে হচ্ছে। মাতব্বর ক্ষমতাবান বলে পুরো ব্যাপারটা ঘুরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তলে তলে তো নিজেরা জানে তাদের ছেলেমেয়ে কেমন। তাই তাড়াতাড়ি করে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন খুব বিশ্রীভাবে পদ্মজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কে জানে, মনে কয় তো ছেড়ি পেট বাঁধাইছে। রাইতে বাপ-মারে দিয়া পায়ে ধরাইয়া বিয়া ঠিক করছে।’

পদ্মজার মন তিক্ত হয়ে ওঠে, হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এত নোংরা মন্তব্য সহ্য করা খুব কঠিন। মিথ্যে অপবাদ চারিদিকে। বোরখার আড়ালে পদ্মজার চোখ দুটি ছলছল করছে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।

হেমলতা পদ্মজার একহাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। মানুষদের ছায়া ছেড়ে খেতের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে বললেন, ‘জীবন খুব ছোটো। এই ছোটো জীবনে অনেক ঘটনা ঘটে। যে ভালো তার সঙ্গে যে শুধুই ভালোই হবে তা কিন্তু ঠিক না, উচিতও না। ভালো খারাপে মিলিয়েই জীবন। তাই বলে সেই খারাপকে পাত্তা দিয়ে সময় নষ্ট করতে হবে—তার কোনো মানে নেই। খারাপটাকে পাশে রেখে ভালো মুহূর্ত তৈরি করার চেষ্টা করবি। ভালোটা ভাববি। শুধুমাত্র কয়জনের কথায় কী আসে যায়? পুরো গ্রামবাসী জানে, তুই কেমন। পুরো অলন্দপুরের যত মানুষ আজ এসেছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই মনে মনে তোর গুণগান গেয়েছে। তারা মনে মনে বিশ্বাস করে তুই নির্দোষ। কিন্তু চুপ ছিল। যারা খারাপের দলে তারা সংখ্যায় কম বলে কোলাহল করে নিজেদের দাপট দেখাতে চেয়েছিল। সবার অগোচরে বোঝাতে চেয়েছিল, আমরা অনেকজন। কিন্তু পারেনি। কোলাহল কোনো কিছুর সমাধান নয়। এখন যারা নিন্দা করল তারা নিজেদের নিচু মনের পরিচয় দিয়েছে, সেই সঙ্গে আমলনামায় পাপের সংখ্যা বাড়িয়েছে। তাদের শাস্তি পৃথিবী এবং আখিরাত—দুটোতেই হবে। একদিন এদের শাস্তি হবেই এই কথাটা ভেবে খুশি হ। সব ভুলে যা, বাকি জীবন পড়ে রয়েছে। তা নিয়ে ভাব। চোখের জল অতি আপনজন এবং আল্লাহর জন্য ফেলা উচিত। এদের মতো অমানুষদের জন্য না।’

পদ্মজা হুহু করে কেঁদে উঠল। আচমকা হেমলতাকে মাঝপথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, কান্নামাখা কণ্ঠে বলল, ‘তুমি জাদুকর আম্মা। তুমি জাদু জানো।’

হেমলতা পদ্মজার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। মোর্শেদ পদ্মজাকে কান্না থামাতে বলতে চাইলে হেমলতা ইশারায় চুপ করিয়ে দেন। পাশেই বিস্তীর্ণ ক্ষেত। গ্রীষ্মের দুপুরের রূপ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। মোর্শেদের কপাল বেয়ে ঝরঝর করে ঘাম ঝরছে। তার দৃষ্টি থমকে আছে হেমলতার দিকে। একটা অপ্রিয় সত্য সম্ভাবনার কথা মনে হতেই চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। তিনি দ্রুত চোখ সরিয়ে বড়ো করে নিশ্বাস ফেলেন। জীবনের লীলাখেলায় তিনি নিঃস্ব। পদ্মজার কান্না থামার লক্ষণ নেই। হেমলতা ছদ্ম গাম্ভীর্যের সহিত বললেন, ‘এত কাঁদলে কিন্তু মারব।’

.

আকাশ জুড়ে তারার মেলা। জানালা গলে চাঁদের আলো পদ্মজার মুখশ্রী ছুঁয়ে দিচ্ছে। বারান্দার ঘরে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে সে, বুকটা কেমন কেমন করছে; কাঁপছে অনবরত। হেমলতার উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত উঠে বসল। হেমলতা পদ্মজার দিকে মুহূর্তকাল তাকিয়ে রইলেন।

‘ঘুম আসছে না?’ জানতে চাইলেন তিনি।

পদ্মজা মাথা দুই পাশে নাড়াল। হেমলতা আর কিছু বললেন না। নীরবতা কাটিয়ে বলল, ‘মেজো আপার বিয়ের তারিখ পড়েছে?’

হেমলতা পদ্মজার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলেন। বিছানার ওপর বসে ইশারায় পদ্মজাকে কোলে শুতে বললেন। পদ্মজা শুয়ে পড়ল। মায়ের কোলটা তার এখন ভীষণ দরকার ছিল। হেমলতা পদ্মজার প্রশ্ন এড়িয়ে অন্য কথা তুললেন।

বললেন, ‘জানি না কোনো মা তার মেয়ের সঙ্গে নিজের বিয়ের গল্প করেছে কি না। কিন্তু আমি আমার বিয়ের গল্প তোকে বলতে চাই। শুনবি?’

পদ্মজা সায় দিল। হেমলতা পদ্মজাকে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলার জন্য নিজের অতীতে নিয়ে যান, ‘সেদিন রাতে আব্বা এসে বলল, তিনদিন পর আমার বিয়ে। আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। কষ্ট হয়েছিল। আমি আরো পড়তে চেয়েছিলাম। এরপর শুনলাম—যার সঙ্গে আমার বিয়ে হচ্ছে তার পড়াশোনা নেই, জ্ঞানও যথেষ্ট কম; রাগচটা লোক। এসব তথ্য জেনে রাগ কিংবা মন খারাপ কিছুই হয়নি। ভয় হয়েছিল—না জানি কেমন হবে সংসার!

‘বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। তোর আব্বাকে তখনো আমি দেখিনি। বিয়ের দিন আয়নায় প্রথম দেখি। কালো একটা মুখ। চোখ দুটি গভীর। কখনো না দেখা মানুষটাকে, প্রথম দেখেই মনে হয় আমার সবচেয়ে আপন একজন মানুষ। সব ভয় কেটে গেল। বিদায়ের সময় সবাই বলেছিল দুজনকে খুব মানিয়েছে, রাজযোটক। একজন হিন্দু দিদি বলেছিলেন, সাক্ষাৎ রাম- সীতা। আটপাড়ায় যদি একজন ছয় ফুট লম্বার মানুষ থাকে তবে সেটা তোদের আব্বা ছিল। বিয়ের পর জানতে পারি, তোর আব্বাকে বিয়ে করার জন্য অনেক মেয়েই পাগল ছিল। নিজেকে খুব সৌভাগ্যবতী মনে হতো। অশিক্ষিত ভেবে নাক কুঁচকেছিলাম। সেই আমি তোর আব্বার জন্য দিনকে রাত, রাতকে দিন মানতে রাজি ছিলাম। তোর আব্বার প্রতি এতটাই ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল, যদি ছুরি নিয়ে রক্তের আবদার করত আমি আমার বুক পেতে দিতাম।’

পদ্মজা মাঝপথে আটকে দিয়ে বলল, ‘তাও তো আব্বা তোমাকে ভালোবাসেনি।’

হেমলতার হাসি উজ্জ্বল মুখটা সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল। অপ্রতিভ হয়ে উঠলেন। তিনি এলোমেলো দৃষ্টিতে দূরের দিকে চেয়ে বললেন, ‘তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়েছিল।’

পদ্মজা চুপ করে রইল। হেমলতাও নিশ্চুপ। দরজার পাশে মোর্শেদ বসে বসে বিড়ি ফুঁকছিলেন। হেমলতার প্রতিটি কথা বুড়ো হয়ে যাওয়া মনটাকে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। তিনি বিড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান চৌরাস্তার উদ্দেশ্যে। চৌরাস্তার পাশে একটা বড়ো ব্রিজ আছে, ওখানে দখিনা হাওয়ার তীব্রতা খুব। সেখানেই এসে দাঁড়ান। ফেলে আসা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ চোখ খুঁজে মনে করার চেষ্টা করেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর পদ্মজা বলল, ‘আম্মা, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর প্রশ্ন করব না। তবুও…’

‘বলব একদিন।’

পদ্মজা নিশ্চুপ হয়ে গেল। একমুহূর্ত স্থির থেকে হেমলতা বললেন, ‘পূর্ণা খুব কান্নাকাটি করে দেখলাম। মেয়েটা এত দুর্বল কী করে হলো?’

পদ্মজা হেমলতার এক হাত মুঠোয় নিয়ে আশ্বস্ত করল, ‘আমি আছি আম্মা। সামলে নেব।’

‘ঘরে যা। রাত হয়েছে অনেক।’

পদ্মজা উঠে বসল। ওড়নাটা ভালো করে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। হেমলতা বিছানার শেষ প্রান্ত থেকে বালিশ টেনে নিতে গিয়ে বালিশের তলায় ভাঁজ করা দুটি চিঠি দেখতে পেলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে চিঠি দুটো নিয়ে পদ্মজার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘পদ্মজা, এগুলো কী?’

পদ্মজা ফিরে তাকাল। হেমলতার হাতে লিখনের চিঠি দুটি দেখে সর্বাঙ্গে বৈদ্যুতিক কিছু একটা ছড়িয়ে পড়ে শরীর কাঁপিয়ে দিল। মাটি যেন টেনে ধরল দুই পা। হেমলতা প্রথম চিঠিটির ভাঁজ খুলে প্রথম লাইন পড়ে বেশ অবাক হোন, পদ্মজার দিকে একবার চকিতে তাকান। এরপর এক নিশ্বাসে দুটো চিঠি পড়ে শেষ করলেন।

পড়া শেষে থম মেরে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। ভয়ে পদ্মজার দুই চোখ জ্বলছে। মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে সে। হেমলতা ধীর পায়ে হেঁটে পদ্মজার কাছে এসে দাঁড়ান। দুই ভ্রু প্রসারিত করে, শান্ত অথচ ধারাল কণ্ঠে বললেন, ‘এসব কবে হয়েছে? আমাকে জানাসনি কেন?

পদ্মজা বলল, ‘যখন উনারা শুটিং করতে আসেন।’ ওর মনে হচ্ছে এখুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। মনে মনে প্রার্থনা করছে, যাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। তাহলে এই লজ্জা থেকে বেঁচে যাবে।

হেমলতা পদ্মজাকে পরখ করলেন, পদ্মজা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে; বার বার কামড়ে ধরছে নিচের ঠোঁট।

পদ্মজা হেমলতাকে চুপ থাকতে দেখে বলল, ‘তুমি যা বলবে তাই হবে আম্মা। আমার ওপর রাগ কোরো না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *