১০
হেমলতার ধারাল দৃষ্টি তিরের ফলার মতো পদ্মজার গায়ে বিঁধছে। সে কাঁপা স্বরে জানিয়ে দিল, ‘শুটিং দলের একজন এসেছিল।’
হেমলতার ঠোঁট দুটো ফুলে উঠল প্রচণ্ড আক্রোশে। পদ্মজা সবাইকে চেনে না। তাই তিনি পূর্ণাকে প্রশ্ন করলেন, ‘পূর্ণা, কে এসেছিল?’
পূর্ণা দুই সেকেন্ড ভাবল। এরপর নতমুখে বলল, ‘কালো দেখতে যে… মিলন।’
পদ্মজা আড়চোখে পূর্ণার দিকে তাকাল। তার ভয় হচ্ছে: মা যদি এখন বলে, মিলন তো তার সামনেই ছিল…তাহলে কী হবে? পূর্ণা মিথ্যে বলল কেন! সত্য বললেই পারত। হেমলতা বিশ্বাস করেছেন নাকি করেননি সেটা দৃষ্টি দেখে বোঝা গেল না। পূর্ণা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল অপরাধীর মতো। হেমলতা বারান্দা অবধি এসে আবার ঘুরে তাকালেন। মনটা খচখচ করছে। মনে হচ্ছে, ঘাপলা আছে। নাকি তার সন্দেহবাতিক মনের ভুল ভাবনা? কে জানে!
.
রাতে পদ্মজা খেতে চাইল না। বিকেলের ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে ঘোরে রেখেছে। চিঠিটা পড়তে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না। তবুও কেমন-কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। অচেনা, অজানা অনুভূতি। পদ্মজার হাব-ভাব হেমলতার বিচক্ষণ দৃষ্টি এড়াতে পারল না, তিনি ঠিকই খেয়াল করেছেন। কিন্তু মেয়েরা স্বয়ং আল্লাহ ছাড়া অন্য সবার থেকে কথা লুকোনোর ক্ষমতা নিয়ে যে জন্মায় তা তো অস্বীকার করা যায় না। যেমন তিনি এই ক্ষমতা ভালো করেই রপ্ত করতে পেরেছেন। পদ্মজাকে জোর করে খাইয়ে দিলেন। কোনো প্রশ্ন করলেন না।
রাতের মধ্যভাগে মোর্শেদ হেমলতাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে হেমলতা এক ঝটকায় সরিয়ে দেন। চাপা স্বরে ক্রোধ নিয়ে বললেন, ‘তোমার বাসন্তীর কী হয়েছে? সে কী তোমাকে ত্যাগ করেছে? সেদিন ফিরে এলে কেন?’
মোর্শেদ চমকালেন, অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন যেন। হেমলতা বাসন্তীকে চিনল কী করে? এই নাম তার গোপন অধ্যায়। অবশ্য হেমলতার মতো মহিলা না জানলেই বোধহয় বেমানান লাগত। মোর্শেদ বিব্রত কণ্ঠে বললেন, ‘হে আমারে কী ত্যাগ করব। আমি হেরে ছাইড়া দিছি।’
হেমলতা বাঁকা হাসলেন। অন্ধকারে তা নজরে এলো না মোর্শেদের।
‘বিশ বছরের সংসার এমন আচমকা ভেঙে গেল যে!’
হেমলতার কণ্ঠে ঠাট্টা স্পষ্ট, তবে চাপা দীর্ঘশ্বাস রয়ে গেল গোপনে। মোর্শেদের শরীরের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে। এ খবরও হেমলতা জানে? এতকিছু…কীভাবে? হেমলতার চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠেছে, তিনি চাদর গায়ে দিয়ে চলে গেলেন বারান্দায়। রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে মোর্শেদের কোনো কৈফিয়ত তিনি শুনতে চান না। তাই বারান্দার ঘরে এসে বসলেন।
কতদিন পর রাতের আঁধারে বারান্দার ঘরে এসেছেন! বিয়ের এক বছর পরই জানতে পেরেছিলেন, মোর্শেদ তাকে বিয়ে করার ছয় মাস আগে বাসন্তী নামে এক অপরূপ সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করেছেন। স্বামীর ঘর ছাড়া আর পথ ছিল না বলে এত বড়ো সত্য হজম করে নিয়েছিলেন।
বাসন্তীর মা বারনারী। আর একজন বারনারীর মেয়েকে সমাজ কিছুতেই মানবে না। মোর্শেদের বাবা মিয়াফর মোড়ল টাকার বিনিময়ে দেহ বিলিয়ে দেওয়া একজন বারনারীর মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে মানতে আপত্তি করেন। ততদিনে মোর্শেদ বিয়ে করে ফেলেছে, যদিও সে খবর মিয়াফর মোড়ল পাননি। তিনি মোর্শেদের মন ফেরাতে শিক্ষিত এবং ঠান্ডা স্বভাবের হেমলতাকে বেছে নিলেন। কুরবান হলো হেমলতার! তখন কলেজে ওঠার সাত মাস চলছিল! এরপর পড়াটাও আর এগোল না। জীবনের মোড় করুণ- রূপে পালটে গেল।
.
পরদিন সকাল সকাল স্কুলে রওনা হলো দুই বোন। পূর্ণা পথে চিঠিটা পড়ার পরিকল্পনা করেছিল। পদ্মজা হতে দিল না। সেয়ানা দুইটা মেয়ের হাতে কেউ চিঠি দেখে ফেললে? ইজ্জত যাবে। পদ্মজার প্রতি বিরক্তবোধ করছে পূর্ণা। চিঠিটা তার কাছে। পথে নতুন করে পরিকল্পনা করল সে, ক্লাসে বইয়ের চিপায় রেখে চিঠি পড়বে। কিন্তু তাও হলো না। পর পর দুই দিন কেটে গেল। সুযোগ পেলেও পড়তে দিতে চাইত না পদ্মজা, সারাক্ষণ যেন হাতে জান নিয়ে থাকে। এই বুঝি মা এলো! দুই দিন পর পূর্ণা মোক্ষম সুযোগ পেল। প্রান্ত ও প্রেমাকে নিয়ে হেমলতা বাপের বাড়ি গিয়েছেন। যদিও কয়েক মিনিটের পথ, দ্রুতই ফিরবেন।
চিঠি পড়ায় পদ্মজার চেয়ে পূর্ণার আগ্রহ বেশি। সে চিঠি খোলার অপেক্ষায় ছিল। আজ খুলতে গিয়ে মনে হলো, যার চিঠি তার খোলা উচিত এবং আগে তারই পড়া উচিত। তাই পদ্মজার দিকে বাড়িয়ে দিল চিঠিটা I
পদ্মজা চিঠি খুলতে দেরি করছিল বলে পূর্ণা তাড়া দিল, ‘এই আপা, খোলো না। লজ্জা পাচ্ছো কেন? জিনিসটা চিঠি, কারো গায়ের কাপড় না।’
পদ্মজা বিস্মিত নয়নে তাকাল, যেন পূর্ণা কাউকে খুন করার কথা বলেছে। বলল, ‘কীসব বলছিস পূর্ণা?’
আচ্ছা, মাফ চাই। আর বলব না।’
পদ্মজা ভাঁজ করা সাদা কাগজটা মেলে ধরল চোখের সামনে। প্রথমেই বড়ো করে লেখা ‘প্রিয় পদ্ম ফুল’।
পূর্ণা পাশে এসে বসল। চিঠিতে দুজনের পূর্ণ মনোযোগ:
প্রিয় পদ্ম ফুল,
আমি কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না, অনুগ্রহ করে এই চিঠিটি একবার পড়ো। জানো পদ্ম, হঠাৎ করে নিজেকে চিনতে পারছি না। আমার হৃদয়-মস্তিষ্ক যেন অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে। আজ চলে যাব ভাবতেই বুকের ভেতর তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। তার কারণ—তুমি। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি, থমকে গিয়েছিল আমার নিশ্বাস ও কণ্ঠনালী। এতটুকুও মিথ্যে বলিনি। সেদিন শুটিংয়ে সংলাপ বলতে গিয়ে ভুল করেছি বারংবার। না চাইতেও বার বার চোখ ছুটে যাচ্ছিল লাহাড়ি ঘরের দিকে। বুকে থাকা হৃদপিণ্ডটায় শিরশিরে অনুভূতি শুরু হয় সেই প্রথম দেখা থেকেই। তোমাকে দ্বিতীয় বার দেখার আশায় প্রতিটা ক্ষণ গুণেছি। দ্বিতীয় বার দেখা পাই যখন বেগুন নিতে আসো। সেদিন কথা বলার লোভ সামলাতে পারিনি। টমেটোর অজুহাতে শ্রবণ করি পদ্ম ফুলের কণ্ঠ। মনে হচ্ছিল, এমন রিনরিনে গলার স্বর এই ইহজীবনে আর কখনো শুনিনি। রাতের ঘুম আড়ি করে বসে। তোমায় প্রতিনিয়ত দেখার একমাত্র পন্থা তোমার স্কুল। সবার অগোচরে কতবার তোমার পিছু নিয়েছি। তুমি বোকা, ধরতে পারোনি একবারও। সুন্দরীরা বোকা হয় আবার প্রমাণ হলো। এই, বোকা বলেছি বলে রাগ কোরো না যেন।
এরই মধ্যে জানতে পারি, তোমার মায়ের ইচ্ছে তুমি অনেক পড়বে। তোমার জন্য অনেক উঁচু বংশ থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। তাও তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেখানে আমি অতি সামান্য, অযোগ্য পাত্র। তবুও সাহস করে তোমার বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। পদ্ম ফুলটাকে যে আমার চাই। তিনি রাজি হয়নি। সিনেমায় অভিনয় করা নায়কের সঙ্গে আত্মীয়তা নাকি করবেন না। এটাও বললেন, তোমার অনেক পড়া বাকি। তোমার মা কিছুতেই রাজি হবেন না। আহত মনে দু-পা পিছিয়ে আসি। ভেবেছি, তোমার কলেজ পড়া শেষ হলে পরিবার সঙ্গে করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসব। তোমার মা সম্পর্কে যা জেনেছি- বুঝেছি, তাতে এতটুকু বিশ্বাস আছে, তিনি অভিনেতা বলে আমাকে এড়াবেন না। তিনি বিচক্ষণ মানুষ।
সময় নেই আর। যা এতদিন বলতে চেয়েছি কিন্তু সুযোগ পাইনি আজ বলতে চাই—আমি তোমায় ভালোবাসি পদ্ম ফুল। আমার ভালোবাসা বর্ণনা করার জন্য শব্দগুলো কম হতে পারে তবুও আমি বলছি, যদি আমি আকাশ হই তুমি সেই সূর্যের রশ্মি, যে রশ্মি থেকে নতুন করে আলোকিত হয়েছি আমি।
ইতি
লিখন শাহ্
পদ্মজার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। পূর্ণা হাসছে। ভ্রু উঁচিয়ে পদ্মজাকে বলল, ‘আপা রে, লিখন ভাইয়ার সঙ্গে তোমাকে যা মানাবে! কী সুন্দর করে লিখেছে।’
পদ্মজা লজ্জায় চোখ তুলতে পারছে না। পূর্ণা বলল, ‘আল্লাহ! একদম বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিয়েছে! আপা, তুমি কিন্তু বিয়ে করলে লিখন ভাইয়াকেই করবে।’
‘আর কিছু বলিস না।’ পদ্মজা মিনমিনে গলায় বলল।
পূর্ণা শুনল না। সে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে, ‘আমার ভাবতেই কী যে খুশি লাগছে আপা। নায়ক লিখন শাহ আমার বোনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে! একদিন বিয়ে হবে।’
‘চুপ কর না।’
‘এই আপা, লিখন ভাইয়াকে ফেরত চিঠি দিবে না?’
পদ্মজা চোখ বড়ো করে তাকাল। অবাক স্বরে বলল, ‘কীভাবে? ঠিকানা কোথায় পাব? আর আম্মা জানলে? না, না।’
পূর্ণা আর কিছু বলতে পারল না। হেমলতার উপস্তিতি টের পেয়ে চুপ হয়ে গেল। পদ্মজা দ্রুত চিঠিটা ভাঁজ করে বালিশের তলায় রাখল…
…বুক ধুকপুক করছে।
১১
মাঘ মাস চলছে। কেটে গেছে চার মাস। শুষ্ক চেহারা আর হিমশীতল মন নিয়ে পদ্মজা বসে আছে নদীর ঘাটে, গুনে গুনে তিন নম্বর সিঁড়িতে। নাকের ডগায় মেট্রিক পরীক্ষা, দিনরাত পড়তে হচ্ছে। সে নিয়ম করে প্রতিদিন ভোরে পড়া শেষ করে ঘাটে এসে বসে, নিজের অনুভূতিদের সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য। কখনো উদাস হয়ে আবার কখনো লাজুক মুখশ্রী নিয়ে ভাবে কারো কথা। সেই যে চিঠি দিয়ে হারাল, আর সাক্ষাৎ মিলল না তার। কখনো কি মিলবে? তিনি কি আসবেন? এক চিঠি প্রতিদিন নিয়ম করে পড়ে পদ্মজা। ধীরে ধীরে অনুভব করে তার মধ্যে আছে অন্য আরেক সত্তা…যে সত্তা প্রতিটি মেয়ের অন্তঃসালের গভীরে জেঁকে বসে থাকে ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে। পূর্ণা শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে পদ্মজাকে খুঁজছে। দুই দিন আগে তার অষ্টম শ্রেণির চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হয়েছে। হিমেল হাওয়ার হাড় কাঁপানো শীতে থেমে থেমে কাঁপছে সে।
পদ্মজাকে ঘাটে বসে থাকতে দেখে পেছন থেকে ডাকল, ‘আপা?’
পদ্মজা তাকাল। বলল, ‘কী?’ পরপরই উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘আম্মা আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে?’
পূর্ণা পদ্মজার পাশ ঘেঁষে বলল, ‘না, আম্মার কিছু হয়নি।’
পদ্মজা হাঁফ ছেড়ে বলল, ‘আম্মা সারাদিন সেলাই কাজ করে। একদিকে তাকিয়ে থাকে, এক জায়গায় বসে থাকে। এজন্যই শরীরে এত অশান্তি। দুর্বল হয়ে পড়েছে। আব্বাকে বলিস, আম্মারে নিয়ে সদরে যেতে। আমার কথা তো শুনবে না।
‘আচ্ছা।’
দুজন নদীর ওপারে তাকাল। অতিথি পাখির মেলা সেখানে। রোমাঞ্চকর আকর্ষণ। এত পাখি দেখে মন ভরে গেল। পাখিদের কলকাকলিতে এলাকা মুখরিত। এপার থেকেও শোনা যাচ্ছে। কোত্থেকে দৌড়ে আসে প্রান্ত। সে চার মাসে শুদ্ধ ভাষা রপ্ত করে নিয়েছে ভালোভাবে। এসেই বলল, ‘আপারা, কী করো?’
পূর্ণা বলল, ‘পাখি দেখি। আয়, তুইও দেখ।’
প্রান্ত দূরে চোখ রাখল। সকালের ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা নদীর ওপার। পাখিদের ভালো করে চোখে ভাসছে না। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব। তাই পাখির কলকাকলি শোনা যাচ্ছে দারুণভাবে। প্রান্ত বলল, ‘বড়ো আপা, একটা ধরে আনি?’
‘একদম না। পাখি ধরা ভালো না। অতিথি পাখিদের তো ভুলেও ধরা উচিত না। ওরা আমাদের দেশে অতিথি হয়ে এসেছে।’
প্রান্ত চুপসে গেল। ঠোঁট উলটে বলল, ‘আচ্ছা।’
‘তোরা এইহানে কী করস?’
মোর্শেদের কণ্ঠস্বর শুনে তিনজন ঘুরে তাকাল। প্রান্ত হাসিমুখে ছুটে এসে বলল, ‘আব্বা, আমি আজ তোমার সঙ্গে মাছ ধরতে যাব।’
মোর্শেদ প্রান্তকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘তোর মায় আমার লগে কাইজ্জা করব।’
‘আম্মাকে আমি বলব।’
‘আইচ্ছা যা, তুই রাজি করাইতে পারলে লইয়া যামু।’
মোর্শেদ গত দুই মাস ধরে প্রান্তকে চোখে চোখে রাখছেন। ছেলে নেই বলেই হয়তো! প্রতিটা বাবা-মায়েরই একটি ছেলের আশা থাকে।
হেমলতা পর পর তিনটা মেয়ে জন্ম দিলেন। এ নিয়ে মোর্শেদ কখনো অভিযোগ করেননি। তবে মনে মনে খুব করে একটা ছেলে চাইতেন। প্রান্তকে যখন প্রথম আনা হলো, ভিক্ষুকের ছেলে বলে তার খুব রাগ হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রান্তকে চোখের সামনে ঝাঁপাতে-লাফাতে দেখে ছেলের জন্য রাখা মনের শূন্যস্থানটা নাড়া দিয়ে ওঠে। মোর্শেদ দুই হাত বাড়িয়ে দেন অনাথ ছেলেটির দিকে। এখন দেখে আর বোঝার উপায় নেই, মোর্শেদ আর প্রান্তের মধ্যে রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। মোর্শেদ কাঠখোট্টা গলায় দুই মেয়েকে বললেন, ‘সদরে যাইয়াম। তোদের দুজনের লাইগা চাদর আনতাম না সুইডার?’
কথাটি শুনে পদ্মজা দারুণভাবে চমকাল। অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পেলে মানুষ কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। পদ্মজার অবস্থাও তাই হলো। খুশি প্রকাশ করার মতো পথ খুঁজে পাচ্ছে না, স্নায়ু কোষ থমকে গেছে। শীতের তাণ্ডবে প্রকৃতি বিবর্ণ, অথচ তার মনে হচ্ছে, বসন্তকাল চলছে। ঢোক গিলে ঝটপট উত্তর দিল, ‘আব্বা, তোমার যা পছন্দ তাই এনো।’
খুশিতে পদ্মজার গলা কাঁপছে। মোর্শেদ অনুভব করলেন সেই কাঁপা গলা। গত সপ্তাহের ঘটনা, মধ্যরাতে রমিজের মেয়ে এক ছেলের সঙ্গে ধরা পড়ে। অলন্দপুরে সে কী তুলকালাম তাণ্ডব! ছেলেটিকে ন্যাড়া করে জুতার মালা পরিয়ে পুরো অলন্দপুর ঘুরানো হয়েছে। আর মেয়ের পরিবারকে মাতব্বর সমাজ থেকে বিচ্যুত করেছেন। পদ্মজা অপূর্ব সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও আজও কোনো চারিত্রিক দোষ কেউ দিতে পারেনি। মেয়েটার দ্বারা কোনো অনৈতিক কাজ হয়নি। তার ঘরে যেন সত্যি একটা পদ্মফুলের বাস! ইদানীং মোর্শেদ পদ্মজাকে নিয়ে দোটানায় ভোগেন। খারাপ ব্যবহারটা আগের মতো আসে না। তিনি দ্রুত জায়গা ছেড়ে চলে যান।
সকাল সকাল কলস ভরে খেজুরের মিষ্টি রস নিয়ে এলেন মোর্শেদ প্রেমা খেজুরের রস দেখেই বলল, ‘আম্মা, পায়েস খাব।
হেমলতা সমর্থন করলেন, ‘আচ্ছা, খাবি।’
সূর্য অনেক দেরিতে উঠল। প্রকৃতির ওপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আলোতে তেজ নেই। চার ভাই-বোন কাঁচা খেজুরের রস নিয়ে উঠানে বসল পাটি বিছিয়ে। খেজুরের কাঁচা রস রোদে বসে খাওয়াটাই যেন একটা আলাদা স্বাদ, আলাদা আনন্দের। পায়েসের জন্য তো নারিকেল দরকার তাই মোর্শেদ নারিকেল গাছে উঠেছেন।
আচমকা পদ্মজা প্রশ্ন করল, ‘আজ কী সোমবার?’
পূর্ণা কথা বলার পূর্বে হেমলতা বারান্দা থেকে বললেন, ‘আজ তো সোমবারই। কেন?’
পদ্মজা খেজুরের বাটি রেখে ছুটে যায় বারান্দায়।
‘আজ স্কুলে যাওয়ার কথা ছিল আম্মা। ঝুমা ম্যাডাম বলেছিলেন, গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। সবাইকে যেতে বলেছেন।’
‘আমায় বলে রাখতি। সামনে পরীক্ষা। গুরুত্বপূর্ণ দেখে পড়া দিবে বোধহয়, এজন্যই ডেকেছে। তাড়াতাড়ি যা। এই পূর্ণা, তুইও যা।’
দুই বোন তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে দ্রুত বের হয়। সূর্য উঠলেও কনকনে শীতটা রয়ে গেছে। দুজনের গায়ে মোর্শেদের আনা নতুন সোয়েটার। পদ্মজা যখন মোর্শেদের হাত থেকে সোয়েটার পেল তখন আর আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারেনি। মোর্শেদের সামনেই হাউমাউ কেঁদে দিল! তার কান্না মোর্শেদের হৃদয় স্পর্শ করে। কিন্তু মোর্শেদ নিজের অহংবোধের তাড়নায় দুর্বলতা প্রকাশ করেন না, পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, ফেরেন অনেক রাতে। পূর্ণা হাঁটার মাঝে বলল, ‘আব্বার পছন্দ ভালো তাই না আপা?’
‘কীসের পছন্দ?’
‘সোয়েটারগুলো কী সুন্দর।’
ধান
পদ্মজা হাসতেই সামনের দাঁতগুলো ঝিলিক দিল। হাতের ডান পাশে ধানখেত। ধান গাছের ডগায় থাকা বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশির রোদের আলোয় ঝিকমিক করছে। অনেকে হাতে কাঁচি নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে ধ কাটার। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ। হঠাৎ পূর্ণা চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপারে, লিখন ভাই।’
পদ্মজার নিশ্বাস এলোমেলো হয়ে পড়ে। মুহূর্তে বুকের মাঝে তাণ্ডব শুরু হয়। পূর্ণার দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকাল সে। লিখন ব্যস্ত পায়ে এদিকেই আসছে। তার পাশে চার ফুট উচ্চতার মগা।
পদ্মজা অজানা আশঙ্কায় চোখ ফিরিয়ে নিলো। রুদ্ধশ্বাসে পূর্ণাকে বলল, ‘এখানে আর এক মুহূর্তও না।
কথা শেষ করেই সে স্কুলের দিকে হাঁটা শুরু করে। পূর্ণা অবাক হয়। কিন্তু, এ নিয়ে রা করল না। লিখন পেছন পেছন আসছে। পদ্মজার বুক কাঁপছে বিরতিহীন ভাবে। তার চাহনি বিক্ষিপ্ত, হৃদয় অশান্ত।
১২
বট গাছের সামনে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে লিখন। শীতের শুষ্কতায় বটগাছের অধিকাংশ পাতা ঝরে পড়েছে। লিখনের কাছে শীতকাল খুবই অপছন্দের ঋতু। শীত চরম শুষ্কতার রূপ নিয়ে প্রকৃতির ওপর জেঁকে বসে থাকে যা সহ্য হয় না লিখনের। ঠান্ডা লেগেই থাকে। ছোটো থেকে কয়েকবার নিউমোনিয়ায় ভুগেছে। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে রুক্ষতা, তিক্ততা ও বিষাদের প্রতিমূর্তি শীতকাল।
লিখন এক হাতের তালু দিয়ে আরেক হাতের তালু ঘষে উত্তপ্ততা সৃষ্টি করে। ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। তখন পদ্মজা এত দ্রুত হাঁটছিল যে মনে হচ্ছিল, সে পালাতে চাইছে। লিখন আর এগোয়নি। পালাতে দিল পদ্মজাকে। মগা বলেছে, পদ্মজার লোকসমাজের ভয় খুব। তাই লিখন এই নির্জন মাঠের পাশে বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজা এ পথ দিয়েই বাড়ি ফিরবে। তখন যদি একটু কথা বলা যায়।
পদ্মজা জড়োসড়ো হয়ে হাঁটছে। ভয়ে ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। বার বার জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে।
পদ্মজা মিনমিনে গলায় পূর্ণাকে ডাকল, ‘পূর্ণা রে…’
পূর্ণা তাকাল। পদ্মজা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভয় হচ্ছে। উনি মাঝপথে দাঁড়িয়ে নেই তো?’
পূর্ণা চরম বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘থাকলে কী হয়েছে? খেয়ে ফেলবে?’
পদ্মজা আর কথা বলল না। পূর্ণার সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। তখন লিখন শাহকে পাত্তা না দেয়ার জন্য পূর্ণার খুব রাগ হয়েছে। পদ্মজা বরাবরই মাথা নিচু করে হাঁটে। তাই লিখন শাহকে দেখতে পেল না। পূর্ণা দূর থেকে দেখতে পায়। কিন্তু এইবার আর পদ্মজাকে আগে থেকে বলল না। সে উত্তেজিত হয়ে ভাবছে, লিখন শাহ্ যখন আপার সামনে এসে দাঁড়াবে কী যে হবে!
.
লিখন-পদ্মজার দূরত্ব মাত্র কয়েক হাত…তখন পদ্মজা আবিষ্কার করল লিখনের উপস্থিতি। সে দ্রুত ওড়নার ঘোমটা চোখ অবধি টেনে নিলো। ভয়ে- লজ্জায় তার সর্বাঙ্গে কাঁপন ধরে গেছে। লিখনের পাশ কাটার সময় পুরুষালি কণ্ঠটি ডেকে উঠল, ‘পদ্ম।’
পদ্মজা দাঁড়াতে চায়নি। তবুও কেন যেন দাঁড়িয়ে গেল। লিখন দুয়েক পা এগিয়ে আসে। পূর্ণা ঠোঁট টিপে সেই দৃশ্য গিলছে। লিখন উসখুস করতে শুরু করে, কথা গুলিয়ে ফেলেছে। পদ্মজা লিখনকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। লিখন হতভম্ব হয়ে অবাক চোখে শুধু চেয়ে রইল।
পূর্ণা বলল, ‘আমাকে বলুন, আমি বলে দেব।’
লিখন পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে অনুরোধ স্বরে বলল, দয়া করে, তোমার বোনকে দিয়ো। আমি কাল বিকেলে ঢাকা চলে যাব।’
পূর্ণা হাসিমুখে চিঠিটি হাতে নিয়ে বলল, ‘আপা আপনার আগের চিঠিটা প্রতিদিন পড়ে।’
কথাটি শুনে লিখনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। পূর্ণা চিঠি নিয়ে দৌড়ে ছুটে যায় পদ্মজার দিকে। লিখন আর পিছু নিলো না। পূর্ণা আসতেই পদ্মজা ধমকে উঠল, ‘কী কথা বলছিলি এত? কেউ দেখলে কী হতো? তুই আম্মার কথা কেন ভাবছিস না?’
পদ্মজার কাঁদো-কাঁদো স্বরে পূর্ণা চুপসে গেল। সত্যি কী সে বেশি করে ফেলল? পূর্ণা আশপাশে তাকিয়ে দেখে, কেউ আছে নাকি। সত্যি কেউ দেখে থাকলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। পূর্ণা চোখ নামিয়ে চুপচাপ হেঁটে বাড়ি চলে আসে। হঠাৎ সৃষ্টি আতঙ্কের কারণে চিঠির কথা আর পদ্মজাকে বলা হয়ে উঠে না।
.
গোধূলি বিকেল। হেমলতা পদ্মজাকে ফরমায়েশ দেন, ‘পদ্ম, কয়টা টমেটো নিয়ে আয়।
‘আচ্ছা, আম্মা।’
পদ্মজা লাহাড়ি ঘরের ডান দিকে যায়। দুমাস আগে মোর্শেদ এদিকের সব ঝোপজঙ্গল সাফ করে টমেটোর ছোটোখাটো খেত করেছেন। লাল টকটকে টমেটো। হেমলতা রান্নার ফাঁকে বারান্দার দিকে উঁকি দিলেন। মোর্শেদ আর প্রান্ত কিছু নিয়ে বৈঠক করছেন।
হেমলতা ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লেন। বাসন্তী নামক মানুষটিকে কী কারণে ত্যাগ করলেন মোর্শেদ? জানতে ইচ্ছে করলেও হেমলতা এই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না। তবু এতটুকু বুঝেছেন মোর্শেদের বাইরের ঘোর কেটে গেছে, যার ফলস্বরূপ সংসারে তার মন পড়েছে। হেমলতাকে খুব সমীহ করে চলেন। তবে হেমলতা জানেন, মোর্শেদ পদ্মজাকে নিজের মেয়ে হিসেবে এখনো মেনে নেননি। তা নিয়ে মাঝেমধ্যেই খোঁচা দেন। এত অবিশ্বাস মানুষটার!
পদ্মজা সাবধানে খেতের মধ্যখানে গেল। টমেটো ছিঁড়তে গিয়ে মনে পড়ে গেল তার লিখনের কথা। মনে মনে ভাবল, কেন এসেছেন উনি? কী-ই বা বলতে চেয়েছিলেন?
জানার জন্য ব্যকুল হয়ে হয়ে ওঠে পদ্মজার মনটা 1
‘আপা, একটা কথা বলি?’
পদ্মজা চমকে পেছনে তাকাল, হঠাৎ পূর্ণার আগমনে ভয় পেয়েছে। বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, ‘বল।’
রাগ করবে না তো?’
পদ্মজা চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল। বলল, ‘করব না।’
পূর্ণা লিখনের দেয়া চিঠিটি দেখিয়ে বলল, ‘লিখন ভাইয়ার চিঠি।’
পদ্মজা ছোঁ মেরে চিঠিটি নিলো। তার এহেন ব্যবহারে পূর্ণা অবাক হলো বটে, সেই সঙ্গে মনে মনে খুশি হলো বোনের আকুলতা দেখে। পদ্মজা দ্রুত চিঠির ভাঁজ খুলল। পূর্ণা বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে, কেউ আসছে নাকি পদ্মজা পড়া শুরু করল।
প্রিয় পদ্ম ফুল,
চার মাস কেটে গেল। চার মাসে একটুও অবসর মেলেনি। কিন্তু মনে ছিল এক আকাশ ছটফটানি। তোমার মনের কথা তো জানাই হলো না। তোমাদের অলন্দপুরের প্রায় প্রতিটি বাড়ির ছেলের স্বপ্ন তোমাকে ঘরে তোলার। তাই সারাক্ষণ ভয়ে ছিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে কেউ তুলে নেয়নি তো! তিন দিনের সময় নিয়ে চলে এসেছি। শুধু একবার দেখতে আর জানতে, তুমি কি আমার জন্য অপেক্ষা করবে? মেট্রিক পরীক্ষা অবধি অপেক্ষা করলেই হবে। এরপর আমি মা আর বাবাকে নিয়ে তোমার মায়ের কাছে আসব। উনার কাছে অনুরোধ করব, তোমার পড়া শেষ হলে যেন আমার সঙ্গেই বিয়ে দেন। উনি কথা দিলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পারব। এখন অনিশ্চয়তায় ভুগছি। আমি গুছিয়ে লিখতে পারছি না আজ। কয়েকটা চিঠি লিখেছি। একটাও মনমতো হয়নি। অনুগ্রহ করে তুমি মানিয়ে নিয়ো। ভুলত্রুটি মার্জনা কোরো।
ইতি
লিখন শাহ্
বাড়ির সবাই ঘুমে। পদ্মজা চুপিচুপি উঠে বসে পড়ার টেবিলে। রাত অনেক, গাছের পাতায় নিশ্চয় শিশির বিন্দু জমছে। এরপর ভোররাতে টিনের চালে শিশিরকণা বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টির মতো ঝরবে। গাঁ হিম করা ঠান্ডা, তা উপেক্ষা করে পদ্মজা হাতে কলম তুলে নিলো। সাদা কাগজে লিখল, অপেক্ষা করব। এরপর কাগজটা ভাঁজ করে বালিশের তলায় রেখে শুয়ে পড়ল।
ফজরের নামাজ আদায় করে চার ভাইবোন পড়তে বসে। পড়ায় মন টিকছে না পদ্মজার। বই আনার ছুতোয় পদ্মজা ঘরের ভেতর চলে গেল। রাতের লেখা কাগজটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলে দিল জানালার বাইরে। এরপর আবার নতুন করে লিখল: আমার আম্মা যা চান তাই হবে।
পড়াশেষে অভ্যাসবশত ঘাটে যায় পদ্মজা। হাতের মুঠোয় তিনটে চিঠি—দুটো লিখনের, একটা তার লেখা। পূর্ণাও পাশে। প্রেমা- প্ৰান্ত বাড়িজুড়ে ছুটাছুটি করছে। সামনের কোনোকিছু ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। সবকিছুই অস্পষ্ট। কুয়াশার স্তর এত ঘন যে, দেখে মনে হচ্ছে সামনে কুয়াশার পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। সেই পাহাড় ভেদ করে একটা নৌকা এসে ঘাটে ভেরে। নৌকায় লিখন আর মগা। আকস্মিক ঘটনায় পিলে চমকে উঠল পদ্মজার। পালানোর মতো শক্তিটুকু পেল না।
লিখন মায়াভরা কণ্ঠে পদ্মজার উদ্দেশ্যে বলল, ‘আমি বাধ্য হয়ে এসেছি। আজ বিকেলে চলে যাব। মগা বলল, প্রতিদিন সকালে নাকি তুমি ঘাটে বসো। তাই এসেছি।’
পদ্মজা মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ছে। ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে। মা দেখে ফেললে কী হবে? বা অন্য কেউ? একটু সাহস জড়ো হতেই নিজের লেখা চিঠি সিঁড়িতে রেখে পদ্মজা ছুটে চলে গেল বাড়ির ভেতর। পূর্ণা বড়ো বড়ো চোখে শুধু দেখল। লিখন নৌকা থেকে নেমে চিঠিটা হাতে তুলে নেয়। ভাঁজ খুলে একটা লাইন পেল শুধু। বিষাদের ছায়া নেমে আসে লিখনের মুখে।
পূর্ণার কৌতূহল হলো চিঠিতে কী আছে জানার জন্য। তবে তা প্রকাশ বল না। শুধু বলল, ‘আপা আপনার কথা প্রতিদিন ভাবে।’
.
১৯৯৬ সাল। পদ্মজা থেমে থেমে কাঁপছে। মুখ লুকিয়ে রেখেছে হাঁটুর ওপর। তুষার কালো চাদর টেনে দিল তার গায়ে। পদ্মজা চোখ তুলে তাকাল। বিষাদভরা কণ্ঠে বলল, ‘সেদিন আমার লেখা প্রথম চিঠিটা কুটিকুটি কেন করেছি জানি না। ইচ্ছে হয়েছিল তাই করেছি। তবে জানেন, আমি একদম ঠিক করেছিলাম। সেদিন যদি আমি কথা দিয়ে দিতাম। আমার কথা ভঙ্গ হতো।’
পদ্মজা হাসল। তুষার একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল পদ্মজার দিকে।
বলল, ‘লিখনের সঙ্গে আর দেখা হয়নি?’
পদ্মজা হাতের কাটা জায়গায় ফুঁ দিয়ে বলল, ‘হয়েছিল।’
‘তাহলে কথা ভঙ্গ হতো কেন বললেন?’
তুষারের দিকে তাকাল পদ্মজা, এরপর হাঁটুতে মুখ লুকালো। এক মিনিট, দুই মিনিট, তিন মিনিট করে…কেটে গেল দশ মিনিট। পদ্মজার সাড়া নেই। তুষার ডাকল, ‘পদ্মজা? শুনতে পাচ্ছেন?’
‘পাচ্ছি।’
‘আপনার কী কষ্ট হচ্ছে?’
‘হচ্ছে।’
‘মুখ তুলে তাকান।’
পদ্মজা ছলছল চোখে তাকাল। তুষার উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, ‘কোনো সমস্যা হচ্ছে?’
তুষারের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে পদ্মজা ভেজা কণ্ঠে বলল, ‘আমার আম্মা আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা কেন করল?’
তুষার ভেতরে ভেতরে চমকাল। হেমলতা নামে মানুষটার সম্পর্কে যা জানে এবং জানল, তাতে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা শব্দটা যায় না পরপরই নিজেকে সামলে নিলো।
ভালো মানুষের খারাপ রূপ—এমন কেইস শত শত আছে।
তুষার সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘কী করেছেন তিনি?’
পদ্মজা উত্তর দিল না। মেঝেতে শুয়ে চোখ বুজল। তুষার গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পদ্মজা এখন আর কিছু বলবে না, সে ক্লান্ত; অতীত হাতড়াতে গিয়ে মনের অসুস্থতা বেড়ে গেছে। তুষার তাকাল মেয়েটার মুখের দিকে। আঁচল সরে গেছে তার বুকের ওপর থেকে, চাদরের অংশ পড়ে আছে মেঝেতে। তুষার চাদরটা টেনে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করল, পদ্মজার গলায় কালো-খয়েরি মিশ্রণে কয়টা দাগ। কেউ শক্ত হাতে চেপে ধরেছিল গলা! হুংকার ছাড়ল সে, ‘ফাহিমা?’
ফাহিমা কাছেই ছিল, তাই ছুটে এলো। তুষার বলল, আপনি আসামির গলা টিপে ধরেছেন?’
ফাহিমা চট করে বলল, ‘না, স্যার। প্রথম থেকেই গলায় দাগগুলো দেখছি। প্রশ্নও করেছি। মেয়েটা উত্তর দিল না।’
কপাল ভাঁজ করে ফেলল তুষার। হাজারটা প্রশ্ন মাথায় ভনভন করছে, মস্তিষ্ক শূন্য প্রায়। পদ্মজা যতটুকু বলেছে, তার পরের সাত বছরের কাহিনি জানা পর্যন্ত শান্তি মিলবে না। মাথা কাজ না করলে তুষার সিগারেট টানে। তাই সে বেরিয়ে গেল।
১৩
বাড়ির গিন্নির মতো কোমরে ওড়নার আঁচল গুঁজে রান্নাবান্না করছে পদ্মজা। হেমলতার কোমরে ব্যথা। তিনি রান্না করতে চাইলেও পদ্মজা রাঁধতে দিল না। মোর্শেদও বললেন, ‘বেদনা লইয়া রান্ধা লাগব না। তোমার মাইয়া যহন রানতে পারে তে হেই রান্ধক।’
শেষ অবধি হেমলতা হার মানলেন। পদ্মজা মাটির চুলায় মুরগি গোশত রান্না করছে। খড়ি বা লাকড়ি হিসেবে আছে বাঁশের মুড়ো। আগুনের শিখার রং নীলচে। শীতের মাঝে রান্নার করার শান্তি আলাদা। মুরগি গোশত রান্না হওয়ার কারণ—আজ এতিম-মিসকিন খাওয়ানো হবে। হেমলতা বলেন, সামর্থ্য থাকলে মাসে একবার হলেও এতিম-মিসকিনদের খাওয়ানো উচিত, নয়তো ঘরে রহমত থাকে না। রান্না শেষ করে পদ্মজা হেমলতার কাছে এলো। বলল, ‘আম্মা রান্না শেষ।’
হেমলতা দৌর্বল্যমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘তোর আব্বারে গিয়ে বল—আলী, মুমিন, আর ময়নাকে নিয়ে আসতে।’
পদ্মজা কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেলল। মোর্শেদের সঙ্গে আগবাড়িয়ে কথা বলতে তার ভয় হয়। অনেকদিন বাজে ব্যবহার করেন না। হুট করে যদি করে ফেলেন তো খুব কষ্ট হবে। হেমলতা মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘কিছু বলবে না। যা তুই।’
পদ্মজা ধীর কণ্ঠে বলল, ‘সত্যি যাব?’
হেমলতা সামনে-পেছনে মাথা ঝাকিয়ে ইঙ্গিত করলেন যেতে। পদ্মজা মোর্শেদকে উঠানেই পেল, চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছেন। পদ্মজা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে গেল। আব্বা ডাকতে গিয়ে গলা ধরে আসছে তার। ঢোক গিলে ডাকল, ‘আব্বা?’
মোর্শেদ ঘাড় ঘুরাতেই পদ্মজার মনে হলো বুকে কিছু ধপাস করে পড়ল। পদ্মজা দৃষ্টি অস্থির রেখে মিনমিনে গলায় বলল, ‘আম্মা বলেছে আলীদের নিয়ে আসতে।’
‘রান্ধন শেষ?’
‘জি, আব্বা।’
মোর্শেদ গলায় গামছা বেঁধে বেরিয়ে যান। পদ্মজা মোর্শেদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। অনুভূতিগুলো থমকে গেছে, ঝাপসা হয়ে আসছে পদ্মজার চোখ দুটো। অল্পতেই তার কান্না চলে আসে। সে তাড়াতাড়ি ডান হাতের উলটো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছল। গাছ থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ আসছে। পদ্মজা সেদিকে তাকাল। তখনি হেমলতা ডাকলেন, ‘পদ্ম।’
পদ্মজা ছুটে যায়, ‘কিছু লাগবে আম্মা?’
‘না। পূর্ণারা কোথায় গেল?
‘ঘাটে।’
‘কী করে?’
‘মাছ ধরে।’
‘বড়শি দিয়ে?’
‘জালি দিয়ে।’
‘এত বড়ো মেয়ে নদীতে নেমে জাল দিয়ে মাছ ধরে!’ কী মনে করে যেন আবার মেনে নিলেন, ‘আচ্ছা, থাক। তুই আয়। বস আমার পাশে।’
পদ্মজা হেমলতার পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত দিল টিপে দেওয়ার জন্য। হেমলতা পা সরিয়ে নিতে নিতে বললেন, ‘লাগবে না।’ শাড়ির আঁচল দিয়ে পদ্মজার কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বললেন, ‘কোমরের ব্যথাটা কমেছে চিন্তা করিস না। তোর আব্বা কিছু বলেছে?’
‘না, আম্মা। আচ্ছা আম্মা, আব্বা এত পালটাল কীভাবে?’ পদ্মজা নিজের আগ্রহ দমে রাখতে পারল না।
হেমলতা মৃদু হাসলেন। উদাস হয়ে টিনের দেয়ালে তাকিয়ে বললেন, ‘শুনেছিলাম তোর বাপ ভালো মানুষ। কিন্তু বিয়ের পর তার ভালোমানুষি ভুলেও দেখিনি। কারণ, তার কানে-মগজে মন্ত্র দেয়ার মানুষ ছিল। অন্যের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন আর কেউ নিয়ন্ত্রণ করে না তাই পালটাচ্ছে। তোর বাপের ব্যক্তিত্ব নেই। নিজস্ব স্বকীয়তা নাই। অন্যের কথায় নাচে ভালো।’
শেষ কথাটা হেমলতা হেসে বললেন। পদ্মজা কিছু বলল না। হেমলতা শুয়ে পড়লেন। আজ সারাদিন বিশ্রাম নিবেন। আগামীকাল অনেক কাজ। অনেকগুলো কাপড় জমেছে।
‘রূপ ক্ষণিকের, গুণ চিরস্থায়ী। এটা আব্বা শেষ বয়েসে এসে বুঝেছে।’
পদ্মজার শীতল কণ্ঠ এবং কথার তিরে হেমলতা ভীষণভাবে বিস্মিত হলেন। তিনি সেকেন্ড কয়েক কথা বলতে পারলেন না। পদ্মজা চলে যাওয়ার জন্য উঠতেই, হেমলতা অবিশ্বাস্য স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘এই খবর তুই কোথায় পেলি?’
পদ্মজা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি তো তোমারই মেয়ে, আম্মা। তোমার এত বড়ো দুঃখ আমি জানব না?’
পদ্মজা চলে গেল। পেছনে রেখে গেল হেমলতার অবিশ্বাস্য চাহনি।
.
বিকেলবেলা হেমলতা ঘর থেকে বের হলেন। শরীরে কিছুটা আরাম এসেছে। পূর্ণা বরই ভর্তা করছে, পাশে প্রেমা। পদ্মজাকে দেখা গেল না। নিশ্চয়ই ঘাটে বসে আছে। প্রান্তও তো নেই।
তিনি পূর্ণাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রান্ত কোথায়?’
পূর্ণা কয়েক সেকেন্ড ভাবল কী উত্তর দিবে। এরপর ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, ‘জানি না, আম্মা।’
‘জানিস না কী?’ তিনি এবার প্রেমাকে ধরলেন, ‘প্রান্ত কোথায় রে প্রেমা?’ প্রেমা সহজ স্বরে বলল, ‘আমরা সবাই ঘাটে ছিলাম। প্রান্ত উঠানে ছিল। এরপর এসে দেখি নেই।’
হেমলতা গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘কোন মুখে বলছিস জানি না? একসঙ্গে নিয়ে থাকতে পারিস না। একা ছাড়িস কেন? কোথায় গেছে ছেলেটা।’
হেমলতার ধমক ঘাট অবধি পৌঁছে যায়। পদ্মজা বাড়ির পেছন থেকে ছুটে এসে প্রশ্ন করে, ‘কী হয়েছে আম্মা?’
‘প্রান্ত বাড়ি নেই সেটা আমাকে কেউ বলল না! দেখ দুটোকে, বসে বসে বরই ভর্তা গিলছে। দিন দিন অবাধ্য হচ্ছে মেয়েগুলো।’
পূর্ণা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। প্রেমা হেমলতার ধমকে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু অতটা না। হেমলতার মন কু গাইছে।
তিনি নিজ ঘরে যেতে যেতে পদ্মজাকে বললেন, ‘বের হচ্ছি আমি। সাবধানে থাকবি।
তখন দুজন লোক প্রান্তকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। প্রান্তর কপাল বেয়ে রক্ত ঝরছে। পদ্মজা উদগ্রীব হয়ে হেমলতাকে ডাকল, ‘আম্মা।’ এরপর দৌড়ে গেল উঠানে। প্রান্ত কাঁদছে। হেমলতা ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে আসেন। প্রান্তকে আহত অবস্থায় দেখে ভড়কে যান। বুকটা হাহাকার করে উঠে তার। ছুটে গিয়ে প্রান্তকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে লোক দুটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার ছেলের কী হয়েছে?’
একজন লোক বলল, ‘পলাশ মিয়ার ছেড়ার লগে মাইর লাগছিল। হেই ছেড়ায় পাথথর দিয়া ইডা মারছে কপালে আর ফাইট্টা গেছে।’
মোর্শেদ লাহাড়ি ঘরের সামনে গাছ কাটছিলেন। চেঁচামেচি শুনে চলে আসেন। প্রান্তকে এমতাবস্থায় দেখে লোক দুটিকে তেজ নিয়ে বললেন, ‘কোন কুত্তার বাচ্চায় আমার ছেড়ারে মারছে? কোন বান্দির ছেড়ার এত বড়ো সাহস?’
মোর্শেদ উত্তরের অপেক্ষা করলেন না। প্রান্তকে নিয়ে ছুটে চলে যান বাজারে। হেমলতা রয়ে গেলেন বাড়িতে। বাজারে আজ হাট বসেছে। মোর্শেদ হেমলতাকে নিষেধ করেছেন সঙ্গে যেতে। বাড়িতে থেকে হেমলতা হাঁসফাঁস করছেন। প্রান্ত একা বড়ো হয়েছে। কতবার কতরকম আঘাত পেয়েছে, দেখার কেউ ছিল না; সবসময় মিনমিনিয়ে কেঁদেছে। এমন বাচ্চা ছেলের এত বড়ো আঘাত পেয়ে চেঁচিয়ে কাঁদার কথা। কষ্ট তো আর কম পায়নি! দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে। হেমলতার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। পদ্মজা ঘরে লুকিয়ে কাঁদছে। পূর্ণা-প্রেমা বাড়ির বাইরে বার বার উঁকি দিয়ে দেখছে, তাদের আব্বা প্রান্তকে নিয়ে ফিরল কি না!
.
দেখতে দেখতে চলে এসেছে মেট্রিক পরীক্ষা। কেন্দ্র শহরে, যেতে লাগে ছয় ঘণ্টা। বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দেয়া সম্ভব না। এদিকে কেন্দ্রের পাশেই মোর্শেদের মামা বাড়ি; মামা নেই, তবে মামাতো ভাইয়েরা আছে। কথাবার্তা বলে সেখানেই দেড় মাসের জন্য হেমলতা আর পদ্মজা উঠল। মোর্শেদ বাকি দুই মেয়ে আর প্রান্তকে নিয়ে বাড়িতে রয়ে গেছেন। হেমলতা পদ্মজাকে নিয়ে আসার পূর্বে নিজে এসে দেখে গেছেন, পরিবেশ কেমন। মোর্শেদের দুই মামাতো ভাইয়ের মধ্যে একজন রাজধানীতে থাকে। আরেকজনের বয়স হয়েছে অনেক। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে একাই থাকেন। ছেলেরা শহরে চাকরি করে। পদ্মজার জন্য উপযুক্ত স্থান। তাই আর অমত করলেন না।
মোর্শেদের যে ভাইটি বাড়িতে আছেন তার নাম—আকবর হোসেন। বয়স ষাটের বেশি হবে। তবে আকবর হোসেনের স্ত্রী জয়নবের বয়স খুব কম, হেমলতার বয়সি। হেমলতা আকবর হোসেনকে ভাইজান বলে সম্বোধন করেন। দালান বাড়ি, বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকে। ফলে পদ্মজা মন দিয়ে পড়তে পারছে। পরীক্ষাও ভালো করে দিচ্ছে।
হেমলতা অবশ্য আকবর হোসেনকে চোখে চোখে রেখেছেন। শীতল প্রকৃতির লোক, তবে বিশ্বাসী। রাতের খাবার আকবর হোসেনের সঙ্গেই খেতে হয়। হেমলতা দেড় মাসের খাওয়ার খরচ নিয়ে এসেছেন। আকবর হোসেন কিছুতেই আলাদা রাঁধতে দিচ্ছেন না। এভাবে অন্যের বোঝা হয়ে থাকতে হেমলতার আত্মসম্মানে লাগে। তিনি কথায় কথায় জানতে পারলেন, আকবর হোসেন এবং জয়নবের নকশিকাঁথা খুব পছন্দ। তাই তিনি কিছুদিন যাবৎ নকশিকাঁথা সেলাই করছেন। যতক্ষণ পদ্মজা পরীক্ষা দেয়, ততক্ষণ হেমলতা কেন্দ্রের বাইরে কোথাও বসে বা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন।
অনেক রাত অবধি পদ্মজা পড়ে, আজ অনেকক্ষণ ধরে কী যেন ভাবছে। হেমলতা ব্যাপারটা খেয়াল করে পদ্মজার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ভাবছিস?’
পদ্মজা এক নজর হেমলতাকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। হেমলতা তাকিয়ে রইলেন জানার জন্য। পদ্মজা দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘রাগ করবে না তো?’
হেমলতা পদ্মজাকে পরখ করে নিলেন। বললেন, ‘কী জানতে চাস?’
পদ্মজা এদিক-ওদিক চোখ বুলায়। কীভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। দুই মিনিট পর নীরবতা ভেঙে বলল, ‘দুপুর থেকে আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, হানিফ মামাকে কে মারল? তোমার সঙ্গে মামার কী কথা হয়েছিল? হানিফ মামাকে… মানে তুমি তো অন্য কারণে গিয়েছিলে কিন্তু ফিরে এলে। খুনও হলো। আমি সবসময় এটা ভাবি। কখনো উত্তর পাই না। মনে মনে অনেক যুক্তি সাজাই। কিন্তু যুক্তিগুলো মিলে না। সব যুক্তিই খাপছাড়া, এলোমেলো।’
‘কাল পরীক্ষা। আর আজ এসব ভেবে সময় নষ্ট করছিস!’
হেমলতার কণ্ঠ স্বাভাবিক। তবুও পদ্মজা ভয় পেয়ে গেল। তবে কিঞ্চিৎ আশা মনে ভীষণভাবে উঁকি দিচ্ছে।
১৪
কিছুটা দূরেই রেলস্টেশন। সেখান থেকে হুইসেলের শব্দ ভেসে আসছে। গভীর রাতের ট্রেন ছুটে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যের দিকে। কাছে কোথাও নেড়ি কুকুরের দল ঘেউঘেউ করছে। হেমলতা জানালাগুলো বন্ধ করে দিলেন যাতে কুকুরের ডাকাডাকির আওয়াজে পদ্মজার পড়াশোনায় সমস্যা না হয়।
পদ্মজা ইংরেজি বইয়ের দিকে চোখ রেখে মিনমিনে স্বরে বলল, ‘পরীক্ষা তো পরশু।
হেমলতা খোলা চুল মুঠোয় নিয়ে হাত খোঁপা করে বললেন, ‘কাল আর পরশুর মাঝে তো খুব একটা পার্থক্য নেই।’
পদ্মজা কিছু বলল না। বইয়ের দিকে তাকিয়ে এমন ভান ধরল যেন পড়ায় তার ভীষণ একাগ্ৰতা।
হেমলতা চোখ ছোটো ছোটো করে পদ্মজাকে দেখছেন। মেয়েটা পড়ায় মনোযোগ দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু সফল হতে পারছে না। বার বার নিচের ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তিনি হঠাৎই বললেন, ‘ছাদে যাবি?’
এহেন প্রস্তাবে পদ্মজা বিস্মিত হলো, নাকের পাটা হয়ে গেল লাল। যদিও এই কথাই নাক লাল কেন হলো, তা জানা নেই। সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। হেমলতা আবার বললেন, ‘যাবি?’
পদ্মজা প্রফুল্লচিত্তে বলল, ‘যাব…যাব আম্মা।’
আকবর হোসেনের বাড়িটির নাম সিংহাসনকুঞ্জ। এই অদ্ভুত নামের হেতু ছাদে উঠলেই জানা যায়। মা-মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে উঠছে। তাদের পায়ের শব্দ মোহময় ছন্দ তুলে হারিয়ে যাচ্ছে গহিন অন্ধকারে। ছাদের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল সিংহাসন। তা দেখে পদ্মজার চক্ষু চড়কগাছ!
বিষ্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘আম্মা! এই সিংহাসন কার?’
হেমলতা পদ্মজার মুখের ভাব দেখে বেশ আনন্দ পাচ্ছেন। তিনি নিজেও দুইদিন আগে সিংহাসনটি দেখে খুব অবাক হয়ে আকবর হোসেনের কাছে একই ভাবে করেছিলেন প্রশ্নটা। তাই আকবর হোসেনের উত্তর পুনরাবৃত্তি করলেন, ‘তোর আকবর কাকার বাবা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। উনার ইচ্ছে ছিল নিজের বাড়ির ছাদে একটা সিংহাসন তৈরি করার। শেষ বয়সে এসে নিজের মনের ইচ্ছে পূরণ করেছেন। দিনরাত নাকি রাজকীয় ভঙ্গীতে সিংহাসনে বসে থাকতেন। মৃত্যুও হয় এই সিংহাসনে, ঘুমানো অবস্থায়।’
পদ্মজা হাঁ করে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সিংহাসনটি—ময়ূর সিংহাসন! ইট-সিমেন্টের তৈরি আসনটি যেন পেখম মেলে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক বড়ো, দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট বা আরো বেশি হবে। পদ্মজা প্রশ্ন করল, ‘আম্মা, এটা মোঘল সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসনের মতো না?’
হেমলতা বললেন, ‘অনেকটাই তেমন। সম্রাট শাহজাহানের সিংহাসনের মতো করে বানানোর স্বপ্নই বোধহয় তিনি দেখতেন। অর্থের জন্য পারেননি।’ পদ্মজা ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল। অনুরোধ করে বলল, ‘আম্মা তুমি সিংহাসনে বসো।’
‘আমাকে মানাবে না। তুই বস, তোকে রাজরানি লাগবে।’
‘তুমি আগে বসো। আম্মা একটু বসো…একটু?’
পদ্মজার অনুরোধে হেমলতা সিংহাসনে বসলেন। পদ্মজাকে ডেকে
বললেন, ‘তুইও আয়, পাশে বস।’
পদ্মজা এলো না। দূর থেকে বলল, ‘মাঝে বসো আম্মা।’
‘কী শুরু করেছিস!’
‘বসো না।’
হেমলতা কপাল কুঁচকে সিংহাসনের মাঝে বসেন। পদ্মজার ঠোঁটে হাসি ফুটে আবার হারিয়ে গেল। বলল, ‘আরেকটু বাকি।’
‘কী বাকি?’
বাঁ-পায়ের উপর ডান পা তুলে রানিদের মতো বসো।’
হেমলতা বিরক্তি নিয়ে উঠে পড়েন। পদ্মজাকে বললেন, ‘পাগলের প্রলাপ শুরু করেছিস!’
পদ্মজা নাছোড়বান্দা হয়ে দৃঢ়ভাবে বলল, ‘আম্মা, বসো। নয়তো আমি কাঁদব।’
পদ্মজার ছেলেমানুষি দেখে হেমলতা হাসবেন না রাগবেন—ঠাওর করতে পারলেন না।
রাতের সৌন্দর্য আর তার মায়াবী রূপকে, প্রতিটি মানুষের ভেতরের আহ্লাদ-ইচ্ছে-কষ্টকে ঠেলেঠুলে বের করে আনার ক্ষমতা বোধহয় আল্লাহ নিজ হাতে দিয়েছেন। তাই হেমলতা তার নিজের শক্ত খোলসে ফিরতে পারলেন না। পদ্মজার পাগলামোর সুরে সুর মিলিয়ে তিনি সিংহাসনে রাজকীয় ভঙ্গীতে বসলেন। পদ্মজার কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়, বুকের ভেতর ঝিরিঝিরি কাঁপন। এই তো তার কল্পনার রাজ্যের রাজরানি—হেমলতা…এবং তার কন্যা সে পদ্মজা। চোখের মণিকোঠায় ভেসে উঠল একটি অসাধারণ দৃশ্য। হেমলতার সর্বাঙ্গে হীরামণি-মুক্তার অলংকার। অসম্ভব সুন্দর শ্যামবর্ণের এই সাহসী নারীকে দেখতে কতশত দেশ থেকে মানুষ ভিড় জমিয়েছে। আর সে হেমলতার পাশে বসে আছে। চারিদিকে ঢাকঢোল পিটানো হচ্ছে। হাতিশাল থেকে হাতির হুংকার আসছে। তারাও যেন খুশি এমন রানি পেয়ে।
‘তোর পাগলামি শেষ হয়েছে?
পদ্মজা জবাব না দিয়ে হেমলতার পাশে এসে বসল। কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আক্ষেপের স্বরে বলল, ‘আম্মা, তুমি রানি আর আমি রাজকন্যা কেন হলাম না? সবাই আমাদের ভালোবাসত। সম্মান করত। মুগ্ধ হয়ে দেখত।
হেমলতার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সমাজ কেন তার প্রতিকূলে থাকল? কেন পদ্মজা ছোটো থেকে সমাজের অন্য কারো মেয়ের সঙ্গে মেশার অধিকার পেল না? তিনি বললেন, ‘জন্ম যেভাবেই হোক। জীবনে সফলতা না এনে মৃত্যুতে ঢলে পড়া ব্যক্তির ব্যর্থতা। তুই এমন জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা কর যাতে মানুষ সম্মান করে। সম্মান করতে বাধ্য হয়। চোখ তুলে তাকাতেও যেন ভয় করে। যারা দূরছাই করেছে তাদের যেন বিবেকে বাঁধে।’
‘পারব আমি?’
‘কেনো পারবি না? পুরো জীবন তো দুঃখে-অবহেলায় যায় না।’
‘তোমার জীবনের অনেকগুলো বছর দুঃখ আর অবহেলাতেই তো গেছে। কিছুই পাওনি।’
হেমলতা তাৎক্ষণিক পালটা জবাব দিতে পারলেন না। তিনি দুঃখকষ্ট- অবহেলা-অপমান আর একাকীত্ব ছাড়া জীবনে কী পেয়েছেন? উত্তরটাও চট করে পেয়ে গেলেন।
পদ্মজাকে বললেন, ‘তিনটে মেয়ে পেয়েছি। আমার মেয়েরা আমার সফলতা। আমার অহংকার। প্রেমা তো ছোটো। তোরা দুইজন নিজেদের মতো থাকিস, পড়িস; কোনো দুর্নাম নাই। যখন মানুষ বলে—এই যে, এরা হচ্ছে হেমলতার মেয়ে…তখন আমার অনেক কিছু পাওয়া হয়ে যায়। গর্বে বুকটা ভরে উঠে।’
পদ্মজা আশ্বস্ত করে বলল, ‘কখনো ভুল কাজ করব না। তোমার সম্মান আমাদের জন্য একটুও নষ্ট হতে দেব না।’
হেমলতা পদ্মজার ডান হাত নিয়ে তার উলটোপাশে চুমু দিয়ে বললেন, ‘আমি জানি পদ্ম। আমার মেয়েরা কখনো আমার অসম্মান হতে দিবে না।’
নিস্তব্ধতা ভেঙে ভেঙে মাঝে মাঝে পাতার ফাঁকে ফাঁকে পাখ-পাখালির ডানা নাড়ার শব্দ ভেসে আসছে। পদ্মজা চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে একটা চাঁদ, অগণিত তারা। আকাশকে তারায় পরিপূর্ণ একটি কালো গালিচার মতো লাগছে। হেমলতা বিভ্রম নিয়ে বললেন, ‘গায়ের কালো রংয়ের দোষে সমাজের সঙ্গে আমার সখ্যতা কখনো হয়ে উঠেনি। প্রকৃতির মতিগতি অবস্থা দেখে দেখে আমার সময় কাটত। আব্বা শিক্ষক ছিলেন বলে কালো হয়েও পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। অবশ্য আব্বার সামর্থ্যও ছিল। আমাদের সব ভাই-বোনকে পড়িয়েছেন। আম্মা আমাকে পড়ানোতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। রং কালো, কেউ বিয়ে করবে না। একটু পড়ালেখা থাকলে হয়তো করবে সেই আশায়। যখন আমি তোর বয়সি ছিলাম, তখন বড়ো আপার মেয়ে হয়। মেয়েটার গায়ের রং কালো। শ্বশুর বাড়িতে তুলকালাম কাণ্ড। বংশের সবাই ফরসা। বাচ্চা কেন কালো হলো। আপাকে বের করে দিল! বাড়ি ফিরল আপা, সমাজের কত কটুক্তি হজম করেছে! তখন আমি নামাজের দোয়ায় আকুতি করে চাইতাম একটা সুন্দর মেয়ের। আমার বিয়ে হলে মেয়েটা যেন পরির মতো সুন্দর হয়, আমার মতো অবহেলার পাত্রী যেন না হয়; বড়ো আপার মতো কালো মেয়ে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হতে যেন না হয়। তুই যখন পেটে তখন নফল নামাজ-রোজা বাড়িয়ে দেই। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বাদে সময় পেলেই সেজদায় লুটিয়ে আল্লাহকে একই কথা বলতাম। আমার পরির মতো মেয়ে চাই। দোয়াও কবুল হয়ে গেল। তোর যেদিন জন্ম হয়, সবাই অবাক হয়ে শুধু তাকিয়েই ছিল। আমি তো খুশিতে কেঁদেই দিয়েছিলাম। এত সুন্দর বাচ্চা এই গ্রামে কেন, পুরো দেশেও বোধহয় ছিল না। চোখের পাপড়ি যেন ভ্রুতে এসে ঠেকছিল। ঠোঁট এত লাল ছিল যেন ঠোঁট বেয়ে রক্ত ঝরছে। সদ্য জন্মানো শিশুর মাথা ভরতি ঘন কালো রেশমি চুল। অলন্দপুরের সবার কাছে ছড়িয়ে পড়ে এই কথা। দল বেঁধে দেখতে আসে। এক সপ্তাহ বেশ তোড়জোড় চলে। কী খুশি ছিলাম আমি! সারাক্ষণ তোকে চুমো খেতাম। রাতেও ঘুমাতে ইচ্ছে করত না। মনে হতো, এই বুঝি আমার পরির মতো মেয়ে চুরি হয়ে গেল! তোর আব্বা সারাক্ষণ খুশিতে বাকবাকম করত। বাইরে থেকে এসে গোসল ছাড়া কোলে নিত না। যখন কোলে নিত বার বার আমাকে বলত, ‘ও লতা। ছেড়িড়া মানুষ না শিমুল তুলা।’
হেমলতা থামলেন। তার চোখের তারায় জল ছলছল করছে। পদ্মজা আগ্রহ নিয়ে শুনছিল। সে বলল, তারপর?
‘কেউ বা কারা রটিয়ে দিল তুই তোর বাপের মেয়ে না। যুক্তি দাঁড় করাল: বাপ-মা কালো মেয়ে এত সুন্দর হয় কী করে? গ্রামের প্রায় সব মানুষ অশিক্ষিত, কুসংস্কারে বিশ্বাসী। তাই বিবেচনা ছাড়াই বিশ্বাস করে নিলো।’
হেমলতা থামলেন। পদ্মজার মনে হতে থাকে, হেমলতা কিছু একটা লুকিয়েছেন। শুধু গ্রামের মানুষ বললেই এত বড়ো দাগ লেগে যায় না। অন্য কোনো কারণ আছে, যা যুক্তি হিসেবে শক্ত ছিল। হেমলতা দম নিয়ে বললেন, ‘আমায় একা করে দিয়ে তোর বাপ সরে গেল। সমাজ সরে গেল। আঁতুড়ঘরে তোকে নিয়ে একা পড়ে রইলাম। তোকে দেখলেই মনে হতো, আল্লাহ কোনো মূল্যবান সম্পদ আমাকে দেখে রাখতে দিয়েছেন। তোকে দেখে রাখা আর বড়ো করাটাই জীবনের লক্ষ্য মনে হতে থাকে। নিজেকে শক্ত করে আমি অন্য-আমি হয়ে যাই, খোলসটা পালটে যেতে থাকে; রাত জেগে স্বপ্ন সাজাই। তোর সঙ্গে ফুল কুড়ানোর স্বপ্ন দেখে ফুল গাছ লাগাই। যখন তোর চার বছর হয় বাড়ি ভরে যায় ফুলগাছে। ছোটো শাড়ি পরিয়ে প্রতিদিন মা-মেয়ে মিলে ফুল তুলে মালা গাঁথতাম। নিশুতি রাতে পাকা ছাদে জোছনা পোহানোর স্বপ্ন ছিল। আজ পূরণ হলো। আর দুইটা ইচ্ছে বাকি, সাগর জলে মা-মেয়ে পা ডুবিয়ে পুরো একটা বিকেল কাটাব। আর, শেষ বয়সে নাতি-নাতনিদের নিয়ে তাদের মায়ের জীবনী বলব।’
পদ্মজা দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হেমলতার কোমর। তিনি টের পান পদ্মজা ফোপাচ্ছে।
উৎকণ্ঠা নিয়ে বললেন, ‘পদ্ম… কাঁদছিস কেন?
পদ্মজা বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমাকে কখনো একা থাকতে দিয়ো না আম্মা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। তোমার মতো কেউ হয় না।’
‘এজন্য কাঁদতে হয়? আমি সবসময় তোর সঙ্গে আছি। কান্না থামা। কী মেয়ে হয়েছে দেখো! কেমন করে কাঁদছে। পদ্ম, চুপ…আর না…মারব এবার…পদ্ম।’
পদ্মজা থামল। কিন্তু ভেতরের ছটফটানি পীড়া দিচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে জানে না, কিন্তু হচ্ছে; কান্না পাচ্ছে। ভয় হচ্ছে আকাশ ভরা রাতের দিকে তাকিয়ে। একটু আগেই সুন্দর লাগছিল এই আকাশ। আচমকা ভয়ংকর মনে হচ্ছে। মায়ের কোল ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, চারিদিকে অশরীরীদের ভিড়। তাদের কোলাহলে মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে। পদ্মজা মায়ের কোলে মুখ লুকাল। মেয়েকে অনেকক্ষণ কথা বলতে না দেখে হেমলতা বললেন, ‘পদ্ম, ঘুমিয়ে পড়েছিস?’
‘না আম্মা।’
হেমলতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সেদিন মাঝ রাত্রিরে ছুরি নিয়ে বের হয়েছিলাম। হানিফের ঘরটা আব্বা-আম্মার ঘর থেকে দূরে হওয়াতে সুবিধা ছিল। ঘরের পাশে গিয়ে দেখি, মদনও ঘরে। আমার পক্ষে দুজন পুরুষকে সামলানো সম্ভব না। তাই মদনের চলে যাবার অপেক্ষা করতে থাকি। এরপর আরেকজন লোক আসে। একটু দূরে সরে যাই, গোয়ালঘরের পেছনে। মিনিট কয়েক পর উঁকি দিয়ে দেখি দরজা লাগানো, সাড়াশব্দ নেই। সাবধানে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখি হানিফ নেই। তখন হয়তো আম্মা দেখেছে। তাই ভাবছে আমি খুন করেছি।’
‘নানু কেন এমন ভাবল? হানিফ মামা তো তোমারই ভাই।’
হেমলতা তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন না। সময় নিয়ে একটা গোপন সত্যি বললেন, ‘আমি তোর নানুর ভাইকে খুন করেছি। তাই তিনি আমাকে ঘৃণা করেন, ভয় পান; সন্দেহ করেন।’
হেমলতার কণ্ঠ স্বাভাবিক। পদ্মজা চমকে উঠে বসল। মুখখানা হাঁ অবস্থায় স্থির হয়ে গেল তার, দৃষ্টি গেল থমকে। পদ্মজা যাতে নিজেকে সামলে নিতে পারে সেই সময়টুকু দিতে হেমলতা দূরের আকাশে চোখ রাখেন। পদ্মজা নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বলল, ‘তিনি কি হানিফ মামার মতো ছিলেন?’
হেমলতা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন। সিঁড়িতে কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
হেমলতা সাবধান হয়ে পদ্মজাকে আড়াল করে দাঁড়ান। সেকেন্ড কয়েক পর একটা ছেলের দেখা মিলল, অচেনা মুখ। হেমলতা আগে কখনো দেখেননি। ছেলেটিও তাদের দেখে ভড়কে গেল।