পদ্মজা – ১

দরদর করে ঘামছে ফাহিমা। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়ার উপক্রম। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম হাতের তালু দিয়ে মুছে শীর্ণ পায়ে হেঁটে একটা চেয়ার টেনে বসতেই তার হাত থেকে লাঠি পড়ে মেঝেতে মৃদু শব্দ তুলল। লাঠি তোলার আগ্রহ কিংবা শক্তি কোনোটাই পেল না সে, চেয়ারে ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল।

ফাহিমার অত্যন্ত দক্ষ হাত, শক্তিশালী বাহু। পুরুষের মতো উচ্চতা তার। জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব পালনে সে শতভাগ সফল। আসামির মুখ থেকে কথা বের করতে যেকোনো কিছু করতে বদ্ধপরিকর সে। বড় বড় রাঘব বোয়ালরাও তার সামনে টিকতে পারে না। অপরাধীরা তার হাত থেকে বাঁচার জন্য ভেতরের সব কথা উগড়ে দেয়নি এমন ঘটনা কখনো ঘটেনি। অথচ আজ পাঁচদিন দিন যাবৎ এক অল্প বয়সী মেয়ে তার হেফাজতে থাকা সত্ত্বেও মুখ দিয়ে টু শব্দটিও করেনি। শারীরিক, মানসিক-কোনো নির্যাতন বাকি রাখা হয়নি তবুও তার আর্তনাদ কেউ শুনতে পায়নি! যেন একটা পাথরকে লাগাতার পেটানো হচ্ছে, যার জীবন নেই, ব্যথা নেই; একটি জড়বস্তু মাত্র! এই পাথরের রক্ত ঝরে, কিন্তু জবান খোলে না।

ফাহিমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চাপা আক্রোশ নিয়ে মেয়েটিকে শাসাল, ‘শেষবারের মতো বলছি, মুখ খোল।’

মেয়েটি তার থেকে দুই হাত দূরে চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় ঝিমুচ্ছে। এক মিনিট… দুই মিনিট করে দশ মিনিট পার হয়ে গেল কিন্তু মেয়েটির থেকে কোনো জবাব এলো না। ফাহিমা হতাশাবোধ করছে। চারপাশে থমথমে নীরবতা, মেয়েটি কি নিঃশ্বাসও নেয় না?

নীরবতা ভেঙে যায় বুটের ঠকঠক শব্দে। উপস্থিত হয় ইন্সপেক্টর তুষার। তাকে দেখেই ফাহিমা উঠে দাঁড়ায়, স্যালুট করে।

তুষার পেশাদারী কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘কী অবস্থা?’

ফাহিমা নিজের ব্যর্থতা প্রকাশ করার সঙ্গে চারদিনের বর্ণনা দেয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। তুষার বহুদর্শী চোখে মেয়েটিকে দেখল তার চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে ফাহিমাকে বলল, ‘আপনি আসুন।’

রিমান্ডে আসামিকে বিভিন্ন নির্যাতনের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যাপারটা ফাহিমার কাছে ভীষণ উপভোগ্য। কিন্তু এই প্রথম সে কোনো দায়িত্ব থেকে পালাতে চাচ্ছে। ফাহিমা হাঁফ ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

তুষার একটি চেয়ার টেনে মেয়েটির সম্মুখ বরাবর বসে। ঠান্ডা গলায় বলে, ‘আজই আমাদের প্রথম দেখা।’

সামনের মানুষটা যেভাবে ছিল সেভাবেই রইল। কিছু বলল না, তাকালও না।

তুষার বলল, ‘মা-বাবাকে মনে পড়ে?’

মা-বাবা শব্দ দুটি যেন নিস্তব্ধ তীড়ে সমুদ্রের ঢেউ নিয়ে আসে। মেয়েটি নড়ে উঠে, চোখ তুলে তাকায়। তার অপূর্ব গায়ের রং, ঘোলাটে চোখ। কাটা ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছে। চোখের চারপাশে গাঢ় কালো দাগ। এ নতুন নয়, মুখের এমন দশা রিমান্ডে আসা সব আসামিরই হয়।

তুষার মুখের প্রকাশভঙ্গী আগের অবস্থানে রেখে পুনরায় প্রশ্ন করল, ‘মা-বাবাকে মনে পড়ে?’

মেয়েটি বাধ্যের মতো মাথা নাড়ায়। মনে পড়ে। তুষার কিছুটা ঝুঁকে এলো।

মেয়েটির দৃষ্টিজুড়ে নীলচে যন্ত্রণা। তুষার তার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘নাম কী?’

মেয়েটির নাম সহ খুঁটিনাটি সবই জানে তুষার, তবুও জিজ্ঞাসা করল। তার মনে হচ্ছে, অপর পক্ষ থেকে উত্তর আসবে।

তার ধারণাকে সত্য প্রমাণ করতে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে মেয়েটি নিজের নাম উচ্চারণ করল, ‘পদ্ম…আমি…আমি পদ্মজা।’

পদ্মজা চৈতন্য হারিয়ে হেলে পড়ে তুষারের ওপর। তুষার দ্রুত তাকে বাহুডোরে আটকে ফেলল। উঁচু কণ্ঠে ফাহিমাকে ডাকল, ‘ফাহিমা, দ্রুত আসুন।’

.

১৯৮৯ সাল।

সকাল সকাল রশিদ ঘটকের আগমনে হেমলতা বিরক্ত হোন। তিনি বহুবার পইপই করে বলেছেন, ‘পদ্মর বিয়ে আমি এখনি দেব না। পদ্মকে অনেক পড়াব।’

তবুও রশিদউদ্দিন প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন প্রস্তাব নিয়ে আসে। হেমলতার কথা হচ্ছে, মেয়ের বয়স আর কতই হলো? মাত্র ষোল। শামসুল আলমের মেয়ের বিয়ে হয়েছে চব্বিশ বছর বয়সে। পদ্মর বিয়েও তখনি হবে, ওর পছন্দমতো।

হেমলতা রশিদকে দেখেও না দেখার ভান ধরে মুরগির খোয়াড়ের দরজা খুলে দিলেন। রশিদ এক দলা থুথু উঠানে ফেলে হেমলতার উদ্দেশ্যে বলল, ‘বুঝছ পদ্মর মা, এইবার যে পাত্র আনছি এক্কেরে খাঁটি হীরা।’

হেমলতা বিরক্ত ভরা কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘আমি কি আমার মেয়ের জন্য আপনার কাছে পাত্র চেয়েছি? তবুও বার বার কেন এসে বিরক্ত করেন?

রশিদউদ্দিন হার মানার লোক নয়, সে হেমলতাকে বুঝানোর চেষ্টা করল, যুবতী মাইয়া ঘরে রাহন ভালা না। কখন কী হইয়া যাইব টের পাইবা না।’

‘মেয়েটা তো আমার। আমাকেই বুঝতে দেন?’ রশিদউদ্দিনের উপস্থিতি যে তিনি নিতে পারছেন না তা স্পষ্ট। তবুও রশিদ নির্লজ্জের মতো নানা কথায় তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করল কিন্তু সুবিধা করতে পারল না। ব্যর্থ থমথমে মুখ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

প্রতিদিন কোনো না কোনো পাত্রপক্ষ এসে হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলবে, ‘মোর্শেদের বড় ছেড়িডারে চাই।’

সব পাত্র যদি এই এক মেয়েকেই চায় তাহলে তার কী করার? তাকেও তো টাকাপয়সা কামাতে হবে!

রশিদ গজগজ করতে করতে আওড়ায়, ‘গেরামে কি আর ছেড়ি নাই? একটা ছেড়িরেই ক্যান সবার চোক্ষে পড়তে হইব?’ কথা শেষ করেই সে এ দলা থুতু ফেলল সড়কে।

রোদ উঠতে না উঠতেই মেঘে মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ, কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি হবে। বছরের এই সময়ে এভাবেই রোদ-বৃষ্টির খেলা চলে। বর্ষায় একদম স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না পূর্ণার। শুধু মারের ভয়ে যেতে হয়। সে মুখ কালো করে স্কুলের জামা পরে পদ্মজাকে ডাকল, ‘আপা? এই আপা? স্কুলে যাবা না? আপারে।’

পদ্মজা পিটপিট করে চোখ খুলে কোনোমতে বলল, ‘না। যাব না।’ পর পরই চোখ বুজে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে। পূর্ণা নিরাশ হয়ে হেমলতার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মা, আপা কি স্কুলে যাইব না?’

হেমলতা বিছানা ঝাড়ছিলেন। হাত থামিয়ে পূর্ণার দিকে কড়াচোখে তাকিয়ে বললেন, ‘যাইব কি? যাবে বলবি। বল, যাবে।’

পূর্ণা মাথা নত করে বলল, ‘যাবে।’

হেমলতা বললেন, ‘তোদের পড়াশোনা করাচ্ছি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলার জন্য নয়। বইয়ের ভাষায় কথা বলবি।’ পূর্ণা মাথা নত করে রেখেছে। তা দেখে হেমলতা সন্তুষ্ট হোন। তার মেয়েগুলো মায়ের খুবই অনুগত।

তিনি পুনরায় বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, পদ্মর শরীর ভালো না। সারারাত পেটে ব্যাথায় কেঁদেছে। থাকুক, আজ ঘুমাক।’

পূর্ণার সদ্য পা দেয়া কিশোরী মন চট করে বুঝে যায় পদ্মজা কীসের ব্যাথায় কেঁদেছে। সে গতকাল রাতে নানাবাড়ি ছিল বলে জানত না। ভোরেই চলে এসেছে। নানাবাড়ি কাছে, হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিটও লাগে না।

পূর্ণাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেমলতা বললেন, ‘তুই যা। মাথা নিচু করে যাবি মাথা নিচু করে আসবি। কোনো অভিযোগ যেন না শুনি।’

‘আচ্ছা আম্মা।’

পূর্ণা ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। সবাই বলে তার চুল নাকি খুব সুন্দর। কিন্তু সে নিজেকে পুরোটাই সুন্দর মনে করে। গায়ের রং কালো হতে পারে তবে সে কখনোই সেজন্য নিজেকে অসুন্দরভাবে না। পূর্ণার ইদানীং খুব সাজতে ইচ্ছে করে। কিন্তু হেমলতা সাজগোজ পছন্দ করেন না। তাই সে সতর্ক দৃষ্টিতে মায়ের উপস্থিতি একবার দেখে নিলো। আশপাশে নেই! পূর্ণা দ্রুত গত মাসে মেলা থেকে আনা লাল লিপস্টিক গাঢ় করে ঠোঁটে মাখল। এখন হেমলতা দেখার আগে এক ছুটে বেরিয়ে যাবে।

ঘড়ির কাঁটায় সকাল দশটা বাজল। এখনো পদ্মজা ওঠেনি। হেমলতা শব্দহীন পায়ে মেয়েদের ঘরে প্রবেশ করেন। বিশাল বড় বিছানায় পদ্মজা দুই হাত ভাঁজ করে ঘুমাচ্ছে। জানালার পর্দা ভেদ করে আসা আলতো পেলব রোদ্দুরের স্পর্শে পদ্মজার মসৃণ পাতলা ঠোঁট, ফরসা ত্বক চিকচিক করছে। হেমলতা বিসমিল্লাহ বলে দ্রুত পদ্মজার গায়ে তিনবার ফুঁ দিলেন। গুরুজনরা বলে, মায়ের নজর ভালো না। এতে সন্তানের ক্ষতি হয়। তাই সঙ্গে সঙ্গে নজর কাটাতে বিসমিল্লাহ বলে ফুঁ দিয়ে দিলেন

হেমলতার মায়া লাগছে পদ্মজার ঘুম ভাঙাতে।

তবুও আদুরে গলায় ডাকলেন, ‘পদ্ম। এই পদ্ম।’

পদ্মজা চোখ খুলে মাকে দেখে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। যেদিন ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয় সেদিনই তাকে হেমলতা ডেকে তুলেন। পদ্মজা অপরাধী কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘বেশি দেরি হয়ে গেছে আম্মা?’

হেমলতা হেসে বললেন, ‘না, মুখ ধুয়ে খেতে আয়।’

পদ্মজা দ্রুত কলপাড়ে গিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে নিল। হেমলতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তার বাবা ছিল হাই স্কুলের শিক্ষক। তাই তার মধ্যে নিয়ম-নীতির প্রভাব বেশি। মেয়েদের শক্তপোক্ত নিয়মে বড় করছেন। নিয়মের মধ্যে সবকিছু হওয়া চাই।

পদ্মজা রান্নাঘরে ঢুকে দেখে স্টিলের প্লেটে খাবার সাজানো। হেমলতা রান্নাঘরে ঢুকতেই পদ্মজা দ্রুত ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে নিল।

এটি হেমলতার দেওয়া আরেকটি আদেশ, খাওয়ার সময় মাথা ঢেকে খেতে হবে। পদ্মজা খেতে বসতেই হেমলতা মেয়েকে সরল কণ্ঠে বললেন, মুখ ধুতে গিয়ে চুল ভিজিয়ে এসেছিস। খেয়ে রোদে বসে চুলটা শুকিয়ে নিস।’

‘আচ্ছা আম্মা।’ পরক্ষণেই বলল, ‘আম্মা, পূর্ণা, প্রেমা আসেনি?’

‘পূর্ণা স্কুলে। প্রেমা দুপুরে আসবে।’

‘আর আব্বা…আব্বা কবে আসবেন?’ মিনমিন করে বলল পদ্মজা।

এই প্রশ্নে হেমলতা থমকে দাঁড়ালেন। শুকনো গলায় জবাব দিলেন, ‘খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই।

পদ্মজার চোখ দুটি জ্বলতে শুরু করে। তার জীবনে জন্মদাতা আছে কিন্তু জন্মদাতার আদর নেই। সে জানে না তার দোষটা কোথায়? কেন নিজের বাবা বাকি বোনদের আদর করলেও তাকে করে না? কথা অবধিও বলেন না। পদ্মজা বহুবার হেমলতাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমি কি তোমাদের সত্যিকারের মেয়ে আম্মা? নাকি সন্তান হয় না বলে কি দত্তক এনেছিলে? আব্বা কেন আমাকে এত অবহেলা করে? ও আম্মা…আম্মা বলো না?’

হেমলতা নিশ্চুপ থেকে অনেকক্ষণ পর জবাব দেন, ‘তুই আমার গর্ভের সন্তান। আর তোর বাবারই মেয়ে। এখন যা, পড়তে বস। অনেক পড়তে হবে তোর।’

ব্যাস এইটুকুই! যতবার প্রশ্ন করেছে একই উত্তর পেয়েছে। কখনো কোনো শব্দের নড়চড় হয়নি।

‘এত কী ভাবছিস? তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠ।’

হেমলতার কথায় পদ্মজার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। সে দ্রুত খাওয়া শেষ করে। হঠাৎ তার মনে পড়ে, আজ বড়ই আচার বানানোর কথা ছিল।

সন্ধ্যার পরপরই বিদ্যুৎ চলে যায়। কয়েক মাস হলো গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। আট গ্রাম মিলিয়ে অলন্দপুর। তাদের গ্রামের নাম আটপাড়া। প্রতিদিন নিয়ম করে সন্ধ্যারাত থেকে তিন ঘণ্টা অন্ধকারে তলিয়ে থাকে গ্রাম। সারাদিন তো বিদ্যুৎ এর নামগন্ধও থাকে না। তাহলে বিদ্যুৎ দিয়ে লাভটা কী হলো? পদ্মজা, পূর্ণা, প্রেমা তিন বোন একসঙ্গে পড়তে বসে। হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতেই মোড়ল বাড়ি অন্ধকারে তলিয়ে যায়। নয় বছরের প্রেমা খামচে ধরে পদ্মজার ওড়না। পদ্মজা মৃদু স্বরে ডাকল, ‘আম্মা…আম্মা।’

হেমলতা ভেতরের ঘর থেকে বললেন, ‘টর্চ নিয়ে যা।’

হেমলতার ডাকে পদ্মজা উঠে দাঁড়ায়। প্রেমা অন্ধকার খুব ভয় পায়। বড় বোনের ওড়না ছেড়ে পূর্ণার হাত চেপে ধরে। টর্চ নিয়ে ঘরে ঢোকার মুহূর্তে পদ্মজা গেইট খোলার আওয়াজ পায়। উঁকি দিয়ে দেখে হানিফ এসেছে। লোকটা সম্পর্কে তার সৎ মামা। হানিফকে দেখেই সে দৌড়ে ঘরে ঢুকে পড়ে।

হানিফ চেঁচিয়ে বলে, ‘বুবু, বাড়ি আন্ধার ক্যান! বাত্তি-টাত্তি জ্বালাও।’

‘হানিফ নাকি?’ হেমলতা হারিকেন হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। হানিফ দাঁত বের করে হাসল। বলল, ‘হ, আমি।’

‘আয়, ভেতরে আয়।’

হানিফ বারান্দা পেরিয়ে বড় ঘরে ঢুকে বলল, ‘তোমার ছেড়িগুলা কই?’

‘ঘরেই আছে, পড়াশোনা করে।’

‘এই আন্ধারেও পড়ে!’ অবাক হয়ে বলল হানিফ।

হেমলতা কিছু বললেন না। হানিফ এই বাড়িতে আসলে কোনো কারণ ছাড়াই অস্বস্তি হয় তার

তিনি প্রসঙ্গ এড়াতে বললেন, ‘ওদের খাওয়ার সময় হয়েছে। তুইও খেয়ে নে।

‘এইহানেই খামু? না তোমার সরাইখানাত যাইতে হইব?’

তার উচ্চারিত শেষ বাক্যে রসিকতা ছিল। গ্রামে থেকেও হেমলতা খাবারের জন্য আলাদা ঘর রেখেছে সেটা হানিফের কাছে রসিকতাই বটে!

হেমলতার স্বাভাবিক সুরে বললেন, ‘খেতে চাইলে খেতে আয়।’

পদ্মজা কিছুতেই রাতের খাবার খেতে আসল না। কেমন জড়োসড়ো হয়ে আছে। মনে হচ্ছে, হানিফকে ভয় পাচ্ছে বা কোনো কারণে অবহেলা করছে। হানিফ ছয় বছর সৌদিতে ছিল। তিন মাস হলো দেশে ফিরেছে। তিন মাসে যতবার হানিফ এই বাড়িতে পা রেখেছে ততবারই পদ্মজা অজুহাত দিয়ে দূরে দূরে থেকেছে। হেমলতার বিচক্ষণ, সন্দেহবাতিক মস্তিষ্ক মুহূর্তে ভেবে নিল অনেক কিছু। আজই এই লুকোচুরির ফয়সালা করবেন তিনি। হানিফ পদ্মজাকে দেখার জন্য অনেক ছলচাতুরী করেও সুযোগ পেল না। বিদ্যুৎ আসার ঘণ্টাখানেক পর হানিফ চলে যায়। পূর্ণা, প্রেমা ঘরে ঢুকতেই পদ্মজা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর। রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলে, ‘কতবার না করেছি? লোকটার পাশে বেশিক্ষণ না থাকতে? তোরা কেনো শুনিস না আমার কথা?’

পূর্ণা, প্রেমা বিস্ময়ে হতবিহ্বল। পদ্মজা কখনো কিছু নিয়ে এভাবে নিষেধ করে না। তাহলে এখন কেন এমন করছে? হেমলতা রুমে ঢুকতেই পদ্মজা চুপসে গেল।

‘পদ্ম আমার ঘরে আয়।’

মায়ের এমন কাঠকাঠ আদেশ শুনে পদ্মজার কলিজা শুকিয়ে একটুখানি হয়ে যায়। পূর্ণা-প্রেমা নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে। পদ্মজা ধুকধুকানি হৃদস্পন্দর নিয়ে হেমলতার ঘরের দিকে গেল।

হেমলতা মেয়ের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজা পায়ের আঙুল খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে! সুন্দরীরা ভীতু আর বোকা হয় তার দৃষ্টান্ত প্ৰমাণ পদ্মজা। তাকে ছাড়া পদ্মজা কীভাবে চলবে?

পদ্মজার সঙ্গে উঁচুকণ্ঠে কথা বলতে হেমলতার খুব মায়া হয়। কিন্তু আজ বলতেই হবে। আবেগ লুকিয়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘কী লুকোচ্ছিস আমার থেকে? হানিফ কী করেছে?’

পদ্মজা ফোঁপাতে থাকে। হেমলতা সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। কণ্ঠ নরম করে বললেন, ‘হানিফ ধড়িবাজ লোক! সৎ ভাই বলে বলছি না। আমি জানি সে কতটা খারাপ। তার ব্যাপারে যেকোনো কথা আমি বিশ্বাস করব। তুই আমাকে বল কী লুকোচ্ছিস? কী করেছে হানিফ?’

মায়ের আদুরে কণ্ঠ শুনে পদ্মজা বাঁধ ভাঙা নদীর মতো হু হু করে কেঁদে উঠল। লুটিয়ে পড়ল মায়ের পায়ে।

বাড়িটি মোড়ল বাড়ি নামে পরিচিত। পদ্মজার দাদার নাম ছিল মিয়াফর মোড়ল। তিনি গ্রামের একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। চার পুত্রের জন্মের পর তাদের জন্য ছয় কাঠা জমির ওপর টিনের বিশাল বড় বাড়ি বানিয়েছিলেন। টগবগে দুই পুত্র ষোলো বছর আগে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিহত হয়। ছোট ছেলে আট বছর বয়সে কলেরা রোগে মারা যায়। বাকি থাকে বড় ছেলে মোর্শেদ মোড়ল। বর্তমানে এই বাড়ির উত্তরাধিকার মোর্শেদ। যদিও তিনি সবসময় বাড়িতে থাকেন না, বাউন্ডুলে জীবন তার। স্ত্রী-সন্তানের অধীনেই এখন মোড়ল বাড়ি, তারাই বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ করে। পুরো বাড়ির চারপাশ জুড়ে গাছগাছালি। বাড়ির পিছনে টলটলে জলের স্রোতস্বিনী। অন্ধকার গাঢ় হতেই পরিবেশ নিশুতি রাতের রূপ ধারণ করে।

রাতের এই নির্জন প্রান্তর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে ছেয়ে গেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার সঙ্গে পদ্মজার ভাঙা কান্না মিলেমিশে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মনে হচ্ছে কোনো আত্মা তার ইহজীবনের না পাওয়া কোনো বস্তুর শোকে এমন মরা সুর ধরেছে। হেমলতা পদ্মজাকে টেনে পাশে বসালেন। পদ্মজা ডান হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে হেমলতাকে বলতে শুরু করল, ‘মামা সৌদিতে যাওয়ার আগের দিন ওই বাড়িতে খালামণি, ভাই, আফা সবাই এসেছিল। সেদিন ঢাকা থেকে যাত্রাপালার লোকও এসেছিল তাই…’

হেমলতা শিকারি পাখির মতো চেয়ে আছে। পদ্মজা কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না। হাত-পা কাঁপছে, তাকে ভীত দেখাচ্ছে। হেমলতা মেয়ের হাত চেপে ধরেন উৎসাহ দিতে ঠিক তখনই উঠোনে ধপ করে একটা আওয়াজ হয়। পদ্মজা কেঁপে উঠল। পূর্ণা, প্রেমা কথা শোনার জন্য দরজায় কান পেতে রেখেছিল। হুট করে কিছু পতনের আওয়াজ হওয়াতে দুজন ভয় পেয়ে দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। হেমলতা গোপন বৈঠক ভেঙে দ্রুত পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। উঠানে বিদ্যুৎ নেই। পিছনে তিন মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। হেমলতা গলা উঁচিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘কে? কে ওখানে?

ভাঙা গলায় কেউ খুব কষ্টে উচ্চারণ করল, ‘আমি।’

চির পরিচিত কণ্ঠটি চিনতে বিড়ম্বনা হলো না তার। তিনি দ্রুত পায়ে উঠানে ছুটে যান। গেইটের পাশে নিথরের মতো পড়ে আছে মোর্শেদ মোড়ল। তার গায়ে শীতের চাদর। হাঁপড়ের মতো উঠা-নামা করছে বুক যেন দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। হেমলতা চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগ। তিনি দুই হাতে মোর্শেদকে আঁকড়ে ধরেন। পদ্মজা, পূর্ণা, দৌড়ে এলো সাহায্য করতে। মোর্শেদের এমফাইসিমা রোগ আছে। এই রোগে অল্প চলাফেরাতেই শ্বাসটানের উপক্রম হয় এবং দম ফুরিয়ে যায়। শ্বাস নেবার সময় গলার শিরা ভরে যায়। তিন মা-মেয়ে মোর্শেদকে ধরে ঘরে নিয়ে যায়।

মোর্শেদ হুট করে বাড়ি ছাড়ে, হুট করেই বাড়ি ফেরে। কখনো কাকডাকা ভোরে, কখনো নিশুতি রাতে, কখনো কাঠফাটা রোদে তার মনে পড়ে নিজ আলয়ের কথা; ফিরে আসে ক্ষিপ্ত ঘোড়ার মতো।

মোর্শেদের এমফাইসিমা রোগটা ধরা পড়ে সাত বছর আগে। তার অ্যাজমা ছিল আবার ধূমপানেও আসক্ত। ফলে ফুসফুসের এই রোগটি খুব দ্রুত আক্রমণ করে বসে।

মোর্শেদ খানিকটা সুস্থ হয়ে রাত একটার দিকে ঘুমিয়ে পড়েন। পূৰ্ণা, প্রেমা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। পদ্মজা বারান্দার ঘরে ঝিম মেরে বসে আছে। তার চোখের দৃষ্টি জানালার বাইরে। জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে! কি সুন্দর দৃশ্য! সেই দৃশ্যের দিকে অপলক নয়নে চেয়ে থেকে পদ্মজা ভাবছে, আম্মা এখনো আসছে না কেন?

সে আজ সব বলতে চায়, হৃদয়ের ক্ষত বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণের মধ্যে দরজার পাশে এসে দাঁড়ান হেমলতা। হাতে থাকা হারিকেনের তীব্র আলোয় পদ্মজা গুটিয়ে যায়।

হেমলতা হারিকেনের আগুন নিভিয়ে পদ্মজার পাশে গিয়ে বসেন। পদ্মজা সবকিছু বলার জন্য তৈরি ছিল তবুও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে।

পদ্মজা তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। বয়স আর কত হবে, নয় কী দশ। খুব কম বয়সেই তাকে স্কুলে পাঠানো শুরু করেছিলেন হেমলতা। হানিফের সৌদি চলে যাবার উপলক্ষ্যে রবিবারের এক সকালে নানাবাড়িতে সবার দাওয়াত পড়ে। স্কুল মাঠেও সেদিন নাচ-গান অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। দুপুরের দিকে বাড়ির সবাই সেখানে চলে যায়। বাড়িতে রয়ে যায় শুধু পদ্মজা, পদ্মজার বৃদ্ধ নানা, আর হানিফ। পদ্মজা ঘুমে ছিল তাই বাকিদের সঙ্গে যেতে পারেনি যখন ঘুম ভাঙল আবিষ্কার করল বাড়িতে কেউ নেই। সেদিন মোর্শেদ হঠাৎ করে অসুস্থ হওয়াতে হেমলতা বাপের বাড়িতে ছিলেন না।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার উপক্রম হতেই কানে আসে হানিফের ডাক, ‘পদ্ম নাকি?’

পদ্মজা মিষ্টি করে হেসে মাথা নাড়ায়। হানিফের লোলুপ দৃষ্টি তখন পদ্মজার সারা শরীর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওইটুকু মেয়ের ফরসা চামড়া বিকৃত মস্তিষ্কের হানিফকে বড্ড টানে! উপেক্ষা করতে পারে না।

মিষ্টি সুরে হানিফ বলল, ‘আয়, আমার ঘরে আয়।’

সহজ সরল শিশুসুলভ পদ্মজা মামার ডাকে সাড়া দেয়। সে শুনেছে, মামা-ভাগনে যেখানে আপদ নেই সেখানে। অথচ, সেদিন সে মামাকেই ঘোর বিপদ হিসেবে জানল।

পদ্মজা রুমে ঢুকতেই হানিফ চট করে দরজা বন্ধ করে দিল। তার অদ্ভুত চাহনি আর দরজা লাগানোর গতি দেখে পদ্মজার মন কেমন করে ওঠে। হানিফ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে। পদ্মজার দেখতে খুব খারাপ লাগছে, গা ঝিমঝিম করছে, ভয় হচ্ছে!

হানিফ বিছানায় বসে পদ্মজাকে কাছে ডাকে, ‘এদিকে আয় তোর লগে গল্প করি।’

পদ্মজা কাছে যেতে সংকোচ বোধ করছে। হানিফ পদ্মজার ডান হাতে ধরে টেনে কোলে বসায়। পদ্মজার বাহুতে গভীরভাবে স্পর্শ করে বলে, ‘তুই জানোস তুই যে সবার থাইকা বেশি সুন্দর?’

হানিফের প্রশ্ন পদ্মজার কানে ঢুকেনি। সে মোচড়াতে থাকে কোল থেকে নামার জন্য। আপত্তিকর স্পর্শগুলো পদ্মজাকে খারাপ অনুভূতি দিচ্ছে। তার কান্না পাচ্ছে, মাথা ভনভন করছে। হানিফ গলার জোর বাড়িয়ে মিষ্টি করে বলল, ‘মোছড়াস ক্যান রে ছেড়ি। শান্তিমত বইয়া থাক। মামা মেলা থাইকা সাজনের জিনিষ কিইন্যা দিমু।’

হানিফ দুই হাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে পদ্মজাকে। পদ্মজা কিছুতেই কোল থেকে নামতে পারছে না। সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘মামা আমি চলে যাব।’

‘কই যাবি? মামার ধারে থাক।’ বলল হানিফ।

হানিফের শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শগুলো শুধু অস্বস্তি দিচ্ছে না, স্পর্শকাতর জায়গাগুলো ব্যাথায় বিষিয়ে তুলছে। পদ্মজা কান্না আটকে রাখতে পারল না, হঠাৎ কেঁদে ওঠল। বলল, ‘ব্যাথা পাচ্ছি মামা। বাড়ি যাব আমি।’

হানিফ হাতের বাঁধন নরম করে আদুরে গলায় বলল, ‘আচ্ছা আর ব্যাথা দিতাম না। কান্দিস না।’

বাঁধন হালকা হতেই পদ্মজা কোল থেকে নেমে পড়ে। হানিফকে তার আজরাইলের মতো লাগছে। মায়ের কাছে সে আজরাইলের অনেক গল্প শুনেছে। আজরাইল যখন জান নিতে আসবে তখন শরীরে খুব কষ্ট অনুভব হবে। এই মুহূর্তে যেন ঠিক তেমনই অনুভূতি হলো। তাহলে তার হানিফ মামাই আজরাইল? পদ্মজা দরজার দিকে তাকায়, অনেক উঁচুতে ছিটকিনি উচ্চতা কম হওয়াতে সে দরজা খুলতে পারবে না। তাই হানিফকে ভীতকণ্ঠে অনুরোধ করল, ‘মামা দরজা খুলে দাও।’

ধমকে উঠল হানিফ, ‘ক্যান? আমি তোরে যাইতে কইছি?’ তার কর্কশ কণ্ঠের ধমকে পদ্মজা ভয়ে কেঁপে ওঠল। তার চোখে নহর বইছে। হানিফ পদ্মজাকে জোর করে কোলে তুলে নেয়। পদ্মজা কাঁদছে। বার বার বলছে, ‘মামা আমি বাড়ি যাব।’

হানিফের তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। বাড়িতে কেউ নেই। বৃদ্ধ সৎ বাবা বধির, কানে শুনে না। পদ্মজা হানিফকে কিল, ঘুষি দিতে থাকে। ভয়ে জোরে জোরে কান্না শুরু করেছে। এভাবে কাঁদলে পাশের বাড়ির যে কেউ চলে আসবে। হানিফের রক্ত টগবগ করছে উত্তেজনায়। সে দ্রুত ওড়না দিয়ে পদ্মজার হাত, পা, মুখ বেঁধে ফেলল। পদ্মজার দুই চোখের পানি হানিফের হৃদয়কে ছুঁতে পারছে না। সে ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। পৈশাচিক উল্লাসে ভেসে যাচ্ছে। হানিফ সিগারেট জ্বালায়। খুব আনন্দ হলে তার সিগারেট টানতে ইচ্ছে হয়। সিগারেট টানতে গিয়ে মাথায় এলো নৃশংস বাসনা। তাৎক্ষণিক নাক, মুখ দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে সিগারেটটি দুই আঙুলের মাঝে রেখে পদ্মজার বাম পায়ের তালুতে জ্বলন্ত সিগারেটটি চেপে ধরল।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে পদ্মজা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। হেমলতা দুই হাতে শক্ত করে মেয়েকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরেন। পদ্মজা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আম্মা, তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার দমটা বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমি তোমাকে খুব ডেকেছি আম্মা। তুমি আসোনি।’

পদ্মজার কথাগুলো হেমলতার বুকে ঝড় তুলে দিয়েছে। লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা। এ যেন ১৯৭১ সালের পাকিস্তানিদের নৃশংসতা। নিজের চোখে তিনি দেখেছেন পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতা। হানিফ আর তার দেখা অত্যাচারী পাকিস্তানিদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই হেমলতা নির্বাক, বাকরুদ্ধ। শুধু অনুভব হচ্ছে তার বুকে পড়ে আদরের পদ্মজা হাউমাউ করে কাঁদছে। হেমলতার সর্বাঙ্গ জ্বলছে। হানিফকে ক্ষত- বিক্ষত করে দিতে হাত নিশপিশ করছে। সেদিন একটুর জন্য পদ্মজা ধর্ষিতা হয়নি। পোড়া স্থানের যন্ত্রণা আর মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে চৈতন্য হারায়। তখনই বাড়িতে সবাই ফিরে আসে।

বাকিটুকু আর পদ্মজাকে বলতে হয়নি, হেমলতা জানেন। পদ্মজার গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল সেদিন। একুশ দিন বিছানায় ছিল। ততদিনে হানিফ দেশ ছেড়ে চলে যায়। পদ্মজা ভয়ে, লজ্জায় ঘটনাটি কাউকে বলেনি। পায়ের পোড়া দাগ দেখে যখন হেমলতা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘পা এমনভাবে পুড়ল কী করে?’

পদ্মজা সহজভাবে জবাব দিয়েছিল, ‘চুলার কাছে গিয়েছিলাম। লাকড়ির আগায় পা লেগে পুড়ে গেছে।’

কথাটা পদ্মজা সাজিয়েই রেখেছিল। সঙ্গে অনেক যুক্তি। তাই মিথ্যে বলতে একটুও কাঁপেনি। পুরো ঘটনাটা পদ্মজার বুকে দগদগে ক্ষত হয়ে রয়ে যায়। এই ছয় বছরে লুকিয়ে কতবার কেঁদেছে সে। মনে হলেই চুপ করে কোথাও বসে থাকে। হেমলতা মেয়ের নিশ্চুপতা দেখে মাথা ঘামাননি কখনো। পদ্মজা ছোট থেকেই চুপচাপ ছিল। কিন্তু আজ হেমলতার খুব আফসোস হচ্ছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তিনি ভেবেছিলেন, তার তিনটা মেয়েই তার কাছে খোলা বইয়ের মতো। চাইলেই পড়া যায়। পদ্মজাকে বাড়ির পিছনের নদীর বুক দিয়ে তরতর করে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ টলটলে পানির মতো মনে হতো। যার জীবনে অস্বচ্ছ বলতে কিছু নেই। সবই সাদামাটা, সহজ সরল। অথচ পদ্মজার জীবনেই কত বড় দাগ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে! কতবড় ঘটনা লুকিয়ে ছিল! মেয়েরা কথা লুকিয়ে রাখার সীমাহীন ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। কথাটি নিজের মেয়েদের ক্ষেত্রে মাথায় আসেনি।

অনেকক্ষণ মায়ের বুকে থাকার পর পদ্মজা শান্ত হয়। তখন হেমলতা ধীর কণ্ঠে বললেন, ‘পা টা দেখি।’

পদ্মজা বাঁ পা বিছানায় তুলল। হেমলতা পদ্মজার পা কোলে নিয়ে পোড়া দাগটা দেখলেন মনোযোগ দিয়ে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়, রক্ত টগবগ করে ওঠে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুরু হয় প্রতিশোধের স্লোগান। তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এই পোড়া দাগ হানিফের রক্ত দিয়ে মুছব।’

কথাটি কত সহজ করে বলেছেন হেমলতা। কিন্তু পদ্মজার হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। কী যেন ছিল কথাটিতে! তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেমলতা বলেন, ‘এখন যা ঘুমিয়ে পড়। কাল স্কুল আছে।’

পদ্মজাকে ঘরে পাঠিয়ে রান্নাঘর থেকে রামদা, ছুরি হাতে নিয়ে উঠানে গিয়ে বসেন হেমলতা। উঠানের এক পাশে একটা বড় পাথর আছে। তিনি সেখানে গিয়ে পাথরটির পাশে বসে ছুরিটি পাথরে ঘষতে থাকলেন। ঘষতে ঘষতে পাথর গরম হয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখা দেয়। ধার হয়ে গেছে। পদ্মজা ঘর থেকে লুকিয়ে দেখছে। অজানা আশঙ্কায় তার বুক কাঁপছে। হেমলতা বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে তখন পদ্মজা উৎকণ্ঠিত গলায় ডাকল, ‘আম্মা!’

পদ্মজা কিছু বলার পূর্বেই হেমলতা বললেন, ‘আন্নার চাচার বড় মেয়ে বহুবছর আগে নিখোঁজ হয়েছে শুনেছিস তো? সেই মেয়ের ধর্ষক হানিফ ধর্ষণের পর মেয়েটাকে পুঁতে ফেলেছে। অলন্দপুরের এই একটা মানুষই এতটা বর্বর। আমি তখন ঢাকা পড়তাম। বাড়ি এসে ঘটনাটি শুনি। আম্মার অনুরোধ আর কান্নায় আমি সেদিন মুখ খুলিনি। এত বড় পাপ চেপে যাই। সেই শাস্তি আমি ধীরে ধীরে পাচ্ছিলাম। আজ পুরোপুরি পেয়ে গেলাম। আমার পাপের শাস্তি শেষ হয়েছে।’

হেমলতার মুখ দিয়ে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে! তিনি কথা শেষ করে জায়গা ত্যাগ করলেন। পদ্মজার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে।

‘এই আপা, স্কুলে যাবা না?’

‘যাব।’

‘তাড়াতাড়ি করো।’

তাড়া দিয়ে পূর্ণা বাড়ির ভেতর চলে গেল। পদ্মজা বাড়ির পেছনের নদীর ঘাটে উদাসীন হয়ে বসে আছে। এ নদীর নাম—মাদিনী। জলে কানায় কানায় ভরে উঠেছে মাদিনী। জলের একটানা স্রোত বয়ে যায় সাগরের দিকে। উজান থেকে ভেসে আসছে ঘন সবুজ কচুরিপানা। পদ্মজার এই দৃশ্য দেখতে বেশ লাগছে, নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে মাদিনীর স্বচ্ছ জলের দিকে। একটা লঞ্চ জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে মাদিনীর বুকের ওপর দিয়ে। লঞ্চ দেখে এক মাস আগেকার ঘটনা মনে পড়ে গেল তার।

সেই রাতে হেমলতা ছুরি ধার দিয়ে নিজ ঘরে চলে যান। পদ্মজা অজানা আশঙ্কায় সেদিন ঘুমোতে পারেনি। চুপচাপ অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকে। শেষরাতে চোখ লেগে আসে। ভোর হতেই হিমেলের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায়। হিমেল তার ছোটো মামা, প্রতিবন্ধী। এক পা বাঁকিয়ে হাঁটে। খুব সরল মনের মানুষ। বয়স বাইশ হলেও, এখনো শিশুদের মতো আচরণ করে; কথায় কথায় খুব কাঁদে।

পদ্মজা ওড়না গায়ে জড়িয়ে দৌড়ে বের হয়। পদ্মজাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে হিমেল, ‘এই পদ্ম, আপা কই? আপা…আপা।’

পদ্মজা উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে মামা? এমন করছ কেন?’ পদ্মজার প্রশ্ন উপেক্ষা করে হিমেল হেমলতাকে ডাকছে, ‘আপা, এই আপা।’

হেমলতা বাড়ির পেছন থেকে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে এলেন। ‘কী হয়েছে?’

হেমলতাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল হিমেল।

‘আপা, ভাইজান খুন হইছে। রাইতে কে জানি মাইরা ফেলছেরে আপা…’

হিমেল কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। পদ্মজা তাৎক্ষণিক সন্দিহান চোখে মায়ের দিকে তাকাল। হেমলতাকে দেখে মনে হচ্ছে, তিনি চমকে গিয়েছেন। অথচ, তার চমকানোর কথা ছিল না। নাকি হিমেলের সামনে অভিনয় করলেন?

হেমলতা দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘পূৰ্ণা- প্রেমাকে ওদিক যেতে দিস না, পদ্ম। আমি আসছি।’

হেমলতার পিছু পিছু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যায় হিমেল।

পদ্মজা রাতেই ভেবেছিল, এমন ঘটনা ঘটতে পারে। সে তার মাকে সবচেয়ে ভালো জানে। তবুও এখন ভয় পাচ্ছে। পুলিশ কি এসেছে? মাকে ধরে নিয়ে যাবে না তো? ভাবতে গিয়ে ধক করে উঠল পদ্মজার বুক। গ্রামের কাছেই শহর, থানা। পুলিশ নিশ্চয় চলে এসেছে। পদ্ম ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। সে ঘামছে, নাক-মুখ-গলা ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

খুনের কথা শুনে ভীষণ ভয় পেয়েছে পূর্ণা। আতঙ্কে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সে পদ্মজার পাশে এসে হাত চেপে ধরে। পদ্মজা মৃদু কাঁপছে। চোখে ভাসছে, হেমলতাকে পুলিশ শিকল দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। তার খুব কান্না পাচ্ছে। সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি করে মাথায় ওড়নার আঁচল টেনে নিয়ে পূর্ণার উদ্দেশ্যে বলল, ‘প্রেমাকে দেখে রাখিস।’

বাড়ি ভরতি মানুষ। মানুষ আসছে ঠেলেঠুলে। হেমলতা হানিফের লাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ফরসা রঙের দুজন মহিলা ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। আকস্মিক আক্রমণে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন হেমলতা। খেয়াল করে দেখেন, মহিলা দুজন তার মা আর বোন। তারা হাউমাউ করে কাঁদছে। কিন্তু হেমলতার তো কান্না পাচ্ছে না! ব্যাপারটা লোকচক্ষু ঠেকছে? একটু কী কান্নার অভিনয় করা উচিত? হানিফের মৃতদেহ দেখে মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছেমতো কুপিয়েছে। হেমলতার দেখে শান্তি লাগছে! এমন শান্তি অনেকদিন পাওয়া হয়নি। পদ্মজাও সেখানে উপস্থিত হয়। হেমলতার নজরে পড়ে। ভীতু চোখে মায়ের চোখের দিকে তাকাল পদ্মজা। হেমলতা ভ্রু কুঞ্চিত করে আবার স্বাভাবিক করে নিলেন। পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে দেখছে পুলিশ এসেছে কি না! চারিদিকে এত মানুষ। পদ্মজাকে এদিক-ওদিক উঁকি দিতে দেখে হেমলতা মেয়ের দিকে তেড়ে যান। চোখ রাঙিয়ে পদ্মজার মাথা ঢেকে দিলেন ওড়না দিয়ে। পদ্মজা দ্রুত ওড়নার আঁচল মুখে চেপে ধরে গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ে। তার মা চায় না সে কখনো এত মানুষের সামনে থাকুক।

হেমলতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন, পদ্মজা গোয়ালঘর থেকে উঁকি দিয়ে বাইরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশের দল আসে। সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে হানিফের লাশ নিয়ে যায়। লোকমুখে শোনা যায়, হানিফ খুন হয়েছে শেষ রাতে। সকালে লঞ্চ ঘাটে লাশ ভেসে ওঠে!

হেমলতাকে পুলিশ নিয়ে যায়নি বলে পদ্মজা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। মানুষের ভিড়ও কমে গেছে। হেমলতার মা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে উঠোনের এক কোণে বসে আছেন। পদ্মজা গুটিপায়ে গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে আসে। পদ্মজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন হেমলতা। সেই হাসি দৃষ্টিগোচর হয় হেমলতার মা মনজুরার। তিনি কিছু একটা ভেবে নিয়ে হেমলতার কাছে এসে কিড়মিড় করে বললে, ‘তুই খুন করছস?’

সঙ্গে সঙ্গে হেমলতা জবাব দিলেন, ‘তোমার এমন মনে হচ্ছে কেন?’

হেমলতার কণ্ঠ স্বাভাবিক। পদ্মজা এই প্রশ্ন শুনে ভয় পেয়ে গেছে।

যদি নানু পুলিশকে বলে দেয়? পুলিশ তো তার মাকে নিয়ে যাবে!

‘কাইল রাইতে তুই আইছিলি হানিফের ঘরে। আমি দেহি নাই?’ রাগে কাঁপছেন মনজুরা।

‘হুম এসেছি।’ হেমলতার নির্বিকার স্বীকারোক্তি।

‘কেন মারলি আমার ছেড়ারে? তোর কী ক্ষতি করছে?’

‘আসছি বলেই আমি খুন করেছি?’

‘এত রাইতে তুই তার কাছে আর কী দরকারে আইবি?’

‘আমি তাকে মারতেই যাব কেন?’

মনজুরা আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন হেমলতার দিকে। হেমলতার চোখ মুখ শক্ত। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে মনজুরা চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘পুলিশের কাছে যামু আমি।’

পদ্মজা কেঁদে উঠল। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল, ‘নানু, এমন করো না।’ হেমলতা নিচু স্বরে কঠিন করে বললেন, ‘আমার মেয়েদের থেকে আমাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করো না, আম্মা। ফল খুব খারাপ হবে।’

পদ্মজার মনে হলো মনজুরা ভয় পেয়ে গেছেন। তার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়েছে শঙ্কা। তিনি সবসময়ই হেমলতাকে ভয় পেয়ে চুপসে থাকেন। পদ্মজা বুঝে উঠতে পারে না, নানু কেন ভয় পায় মাকে? মায়ের অতীতে কী ঘটেছে? কেন তিনি এমন কাঠখোট্টা? ছেলের খুনিকে কোনো মা ছেড়ে দেয়? নানু কেন ছাড়লেন? মেয়ে বলে? নাকি অন্য কারণ আছে? কোনো উত্তর নেই। এসব ভাবলে ভীষণ মাথা ব্যথা হয়। অন্য আট-দশটা পরিবারের মতো তারা নয় কেন? নাকি গোপনে সব পরিবারেই এমন জটিলতা আছে?

প্রশ্ন হাজারটা!!

উত্তর কোথায়?

সেদিন রাতে খাওয়ার সময় হেমলতা নিম্নস্বরে পদ্মজাকে ডাকেন, ‘পদ্ম?’

‘জি, আম্মা।’

‘আমি হানিফকে খুন করিনি। কারা করেছে তাও জানি না।

কথাটি শুনে পদ্মজা অবাক হয়। তার মা মিথ্যে বলে না। তাহলে কারা খুন করল? পদ্মজা প্রশ্ন করল, তাহলে শেষ রাতে মামার কাছে কেন গিয়েছিলে আম্মা?’

হেমলতা জবাব না দিয়ে খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন।

পদ্মজার ভাবনার সুতো কাটল কারো পায়ের আওয়াজ শুনে। ঘাড় ঘুরিয়ে মোর্শেদকে দেখতে পেল। মোর্শেদ পদ্মজাকে ঘাটে বসে থাকতে দেখে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললেন, ‘এই ছেড়ি, যা এন থাইকা।’

জন্মদাতার এমন দূর দূর ব্যবহারে পদ্মজার কান্না পায়। নিঃশব্দে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে, তা আড়াল করে ব্যস্ত পায়ে বাড়ির ভেতর চলে যায় সে।

কয়েক মাস পর পদ্মজার মেট্রিক পরীক্ষা। নিয়মিত স্কুলে যেতে হয়। তিন বোন বই নিয়ে সড়কে ওঠে। পদ্মজার কোমর অবধি ওড়না দিয়ে ঢাকা। পূর্ণা একনাগাড়ে বকবক করে যাচ্ছে। স্কুলে যাওয়া অবধি কথা বন্ধ হবে না, মাঝে মাঝে জোরে জোরে হাসছেও! মেয়েটার হাসির রোগ আছে বোধহয়। একবার হাসি শুরু করলে আর থামে না। পদ্মজা বার বার বলেছে, ‘আম্মা

রাস্তায় কথা বলতে আর হাসতে মানা করছে। চুপ কর

তবুও পূর্ণা হাসছে। বাড়ির বাইরে এসে সে মুক্ত পাখির মতো আচরণ করে। তাকে দেখে মনে হয়, খাঁচা থেকে মুক্ত হয়েছে।

‘পদ্ম…ওই, পদ্ম। খাড়া।’

পদ্মজা ক্ষেতের দিকে তাকাল। ক্ষেতের আইল ভেঙে দৌড়ে আসছে লাবণ্য। একই সঙ্গে পড়ে দুজন। কাছে এসে হাঁপাতে লাগল লাবণ্য। শান্ত হওয়ার পর চারজন মিলে স্কুলের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে।

‘বাংলা পড়া শিখে এসেছিস বলল পদ্মজা?’

তার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে লাবণ্য বলল, ‘আরে ছেড়ি, বাড়িত শুদ্ধ ভাষায় কথা কইলে বাইরেও কইতে হইব নাকি?’

‘আমি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারি না।’

লাবণ্য অসন্তোষ প্রকাশ করল। সে অলন্দপুরের মাতব্বর বাড়ির মেয়ে। তাদের বাড়ির সবাই শিক্ষিত। তবুও তারা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে, পরিবারের দুই-তিন জন সদস্য ছাড়া। আর পদ্মজার চৌদ্দ গুষ্ঠি মূর্খ, দুই- তিন জন ছাড়া…তবুও এমন ভাব করে! আঞ্চলিক ভাষা নাকি পারে না!

‘সত্যি আমি পারি না। ছোটো থেকে আম্মা শুদ্ধ ভাষা শিখিয়েছেন। উনিও এই ভাষাতেই কথা বলেন। তাই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেই আরাম পাই।’

‘পূর্ণা তো পারে।’

‘আমার চেষ্টা করতে ইচ্ছে হয় না।’

‘আইচ্ছা বাদ দে। শুন, কাইল আমরার বাড়িত নায়ক-নায়িকারা আইব।’

পূর্ণা বিগলিত হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কেন আসবে? কোন নায়ক?

‘শুটিং করতে। ছবির শুটিং।’

পদ্মজা এসবে কোনো আগ্রহ পাচ্ছে না। পূর্ণা খুব আগ্রহবোধ করছে। সপ্তাহে একদিন সুমিদের বাড়িতে গিয়ে সাদাকালো টিভিতে ছায়াছবি দেখে, তাই অভিনয় শিল্পীদের প্রতি তার আগ্রহ আকাশছোঁয়া। পূর্ণা গদগদ হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘কোন নায়ক নায়িকা? বলো না লাবণ্য আপা!’

‘দাঁড়া! মনে করি।’

পূর্ণা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করল। এরপর মনে হতেই বলল, ‘লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী।’

‘তুমি আমার ছবির নায়ক-নায়িকা?’

‘হ।’

স্কুলের যাওয়ার পুরোটা পথ লাবণ্য আর পূর্ণা ছায়াছবি নিয়ে আলোচনা করল। মূল বক্তব্যে ছিল সুদর্শন অভিনেতা—লিখন শাহ।

দিনটিকে বড়ো অলক্ষুণে মনে হচ্ছে পদ্মজার। সকালে উঠে দেখে লাল মুরগিটার একটা বাচ্চা নেই। নিশ্চয় শিয়ালের কারবার! রাতে মুরগির খোপের দরজা লাগানো হয়নি। আর এখন চোখে পড়ল, দেয়াল ঘড়িটার কাঁটা ঘুরছে না। ঘড়িটা রাজধানী থেকে হানি খালামণি দিয়েছিলেন। গ্রামে খুব কম লোকই হাতঘড়ি পরে। দেয়াল ঘড়ি হাতেগোনা দুই-তিনজনের বাড়িতে আছে। পদ্মজা সূর্যের দিকে চেয়ে সময়ের আন্দাজ করার চেষ্টা করল। পূর্ণা-প্রেমা দুপুরের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আম্মা…পদ্মজা পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে হেমলতা মনোযোগ সহকারে সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করছেন। আটপাড়ায় একমাত্র তিনিই সেলাই কাজ করেন। প্রতিটি ঘরের কারো না কারো পরনে তার সেলাই করা জামা আছে।

‘লুকিয়ে দেখছিস কেন? ঘরে আয়, হঠাৎ বললেন হেমলতা। পদ্মজা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘না, আম্মা। কাজ আছে।’

হেমলতা জগ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘পানি ভরে নিয়ে আয়।’

জগ হাতে নিয়ে পদ্মজা বলল, ‘ছদকা কোন মুরগিটা দেব?’

হেমলতা গতকাল স্বপ্নে দেখেছেন, বাড়িতে আগুন লেগেছে। তাই ছদকা দিবেন বলে মনস্থির করেছেন। দুঃস্বপ্ন দেখলেই তিনি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েন, গরিব-দুঃখীদের ছদকা দেয়ার পরই স্বস্তি পান। তার পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস, গরিব-মিসকিনদের দান করলে তাদের দোয়ায় বিপদ কেটে যায়।

‘সাদা মোরগটা। মুন্না এসেছে?’

‘না। প্রতিদিন বিকেলবেলা পানি নিতে আসে। একটু পরই আসবে।’ হেমলতা আর কথা বাড়ালেন না। পদ্মজা কলপাড় থেকে পানি নিয়ে আসে। আছরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে মোড়ল বাড়ির কল থেকে পানি নিতে আসে মুন্না। গ্রামে সচ্ছল পরিবার নেই বললেই চলে। হাতেগোনা যে কয়টা পরিবারে সচ্ছলতা বিদ্যমান শুধু তাদের বাড়িতেই টিউবওয়েল আছে। পুরো আটপাড়াতে টিউবওয়েল মাত্র পাঁচটা। পদ্মজাদের টিউবওয়েল থেকে পানি নিতে প্রতিদিন অনেকেই আসে। তার মধ্যে একজন মুন্না; বয়স বেশি নয়, মাত্র দশ। মা হারা ছেলেটির পঙ্গু বাবা সদরে বসে ভিক্ষা করে। মুন্নাকে দেখে রাখার বা যত্ন করার কেউ নেই। এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়, কারো মায়া হলে একবেলা নিয়ে দুমুঠো খেতে দেয়।

পদ্মজা মোরগ নিয়ে কলপাড়ে এসে দেখে—মুন্না নেই। একটু সামনে হেঁটে যেতেই ঘাটে দেখতে পেল ছেলেটিকে। ডাকল, ‘এই, মুন্না।’

মুন্না ফিরে তাকাল, পদ্মজার হাতে সাদা মোরগ দেখে খুশিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে তার চোখ-মুখ। পদ্মজা না বললেও সে বুঝে গেল—আজ ছদকা পাবে। দাঁত কেলিয়ে হেসে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এরো মুন্না।

‘হাসছিস কেন? এই নে মোরগ। তোর আব্বাকে নিয়ে খাবি।

মুন্না খুশিতে গদগদ হয়ে মোরগটিকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। কী সুন্দর মুন্নার হাসি! তার খুশিতে পদ্মজাও খুশি হলো। বলল, ‘খুব খুশি?’

‘হ’

‘আমাদের জন্য দোয়া করবি।’

‘করবাম, আপা।’

‘আচার খাবি?’

‘হ, খাইবাম।’ কোনো খাবারে ছেলেটার ‘না’ নেই। সে সব খায়।

পদ্মজা আবার হাসল। খাওয়ার কথা শুনলেই পেটুক মুন্নার চোখ চকচক করে ওঠে। আচার নিয়ে আসে পদ্মজা, মুন্নার সঙ্গে ঘাটের সিঁড়িতে বসে আরাম করে দুজন আচার খায়। মুন্না একটু একটু করে খেতে খেতে বলল, ‘আপা, তুমি খুব ভালা।’

‘তাই?’

‘হ। বড়ো হইয়া আমি তোমারে বিয়া করবাম।’

পদ্মজা বিষম খেল। দ্রুত এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, কেউ শুনল নাকি। বিয়ে তার কাছে খুব লজ্জাজনক শব্দ। শব্দটি শুনলেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে, অন্তর কাঁপে। ফিসফিসিয়ে মুন্নাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বিয়ের কথা কোথায় শিখলি?’

‘আব্বা কইছে।’

‘আর বলবি না এসব। যা, বাড়িতে যা।’

পদ্মজা তড়িঘড়ি করে বাড়ির ভেতর চলে যায়।

রান্নাঘরে ঢুকে দেখে, হেমলতা রাতের রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ থাকে না। হারিকেন জ্বালিয়ে রান্না করতে হয়। প্রতিদিন ঘরে একটা, আবার রান্নাঘরে আরেককটা হারিকেন জ্বালানো অনেক খরচের ব্যাপার। তাই বিকেলে রাতের রান্না সেড়ে ফেলেন তিনি।

পদ্মজা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মা, আমি রাঁধি?’

লাগবে না। সাহায্য কর শুধু।

পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগল, কী কাজ করা যায়! কিন্তু এমন কিছু পেল না যেটা করা যায়, কোনো সাহায্যের প্রয়োজনই তো নেই-ই! হেমলতা বললেন, ‘লাউ নিয়ে আয়।’

‘লাহাড়ি ঘর থেকে?’

‘লাহাড়ি ঘরে নেই। ছিঁড়ে নিয়ে আয়।’

পদ্মজা এমনভাবে ছুটে যায় যেন মায়ের আদেশ নয়, চাঁদ পেয়েছে!

লাউ, বরবটি, ঢেঁড়স, কাঁকরোল, করলা, চিচিঙ্গা, পটল, ঝিঙাসহ নানা ধরনের সবজির মেলা বাড়ির চারপাশে। পদ্মজা সাবধানে ঘাসের ওপর দিয়ে লাউ গাছের দিকে এগোয়। বর্ষাকাল হওয়াতে জোঁকের উপদ্রব বেড়েছে। অবশ্য জোঁকের ভয় তার নেই।

পদ্মজার গমনপথের দিকে ঝিম মেরে কতক্ষণ চেয়ে রইলেন হেমলতা। মেয়েটাকে দেখলে মাঝেমধ্যে মন বিষণ্নতায় ভরে ওঠে, বুকের ভেতর কীসের যেন অস্থিরতা অনুভব হয়; যুক্তিহীন কিছু চিন্তা ঘুরে বেড়ায় মস্তিষ্ক জুড়ে। পদ্মজার চুল দেখলে মনে হয়, এই সুন্দর ঘন কালো রেশমি চুল পদ্মজার একেকটা কাল রাত। পদ্মজার ছিমছাম গড়নের দুধে-আলতা দেহের অবয়ব দেখলে মন বলে—এই দেহ পদ্মজার যন্ত্রণা। পদ্মজার ওষ্ঠদ্বয়ের নিম্নে স্থির হয়ে থাকা কালো সূক্ষ্ম তিল দেখলে যেন পদ্মজার এক জীবনের কান্নার কারণ। হেমলতা পদ্মজার রূপের বাহার নিতে পারেন না। কেন কৃষ্ণকলির ঘরে ভুবন মোহিনী রূপসীর জন্ম হলো? জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে…এই তিনের ওপর কারো হাত থাকে না। যদি থাকত, হেমলতা মোর্শেদকে বিয়ে করতেন না…কিংবা পদ্মজার মতো রূপসীর জন্মও দিতেন না। ভুলেও আল্লাহর কাছে রূপসী মেয়ে চাইতেন না। হেমলতার বুক চিরে ভারি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

আজ শুক্রবার। স্কুল নেই। ফজরের নামাজ আদায় করে তিন বোন পড়তে বসেছে। প্রেমা নামাজ পড়তে চায় না, ঘুমাতে চায়। হেমলতার মারের ভয়ে পড়ে। সে ঝিমুচ্ছে আর পড়ছে। তা দেখে পদ্মজা আর পূর্ণা ঠোঁট টিপে হাসছে। হেমলতা বিরক্ত হোন। প্রেমার তো পড়া হচ্ছেই না…সেই সঙ্গে পদ্মজা আর পূর্ণার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। তিনি কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন, ‘প্রেমা, ঘুমাচ্ছিস কেন? ঠিক হয়ে পড়।’

আচম্বিত ধমকে চমকে উঠল প্রেমা, তাড়াতাড়ি পড়া শুরু করল চোখ খুলে। হেমলতা কিছুক্ষণ প্রেমাকে পর্যবেক্ষণ করে স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘পড়তে হবে না। ঘরে গিয়ে ঘুমা।’

প্রেমা একটু অবাক হয়। পরমুহূর্তেই খুশি হয়ে ছুটে যায় ঘরে। পূর্ণা মুখ ভার করে ফেলল। তারও তো পড়তে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু মা কখনো তাকে ছাড় দেন না। হয়তো ছোটোবেলা ছাড় দিতেন, মনে নেই। সে আবার সব কিছু খুব দ্রুতই ভুলে যায়। ব্রেন ভালো প্রেমার, যা পড়ে মনে থাকে। পদ্মজার অবশ্য সবকিছুই স্বাভাবিক…

…শুধু রূপ বাদে।

.

সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হাতে ঝাকি জাল আর বড়শি নিয়ে মোর্শেদ বাড়িতে ঢুকলেন, কাঁধে পাটের ব্যাগ ঝুলানো। ভোরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। তিনি বাড়ি ফিরলে পূর্ণা ও প্রেমা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়। মাছ খেতে পারে অনেক! অর্থসংকটের জন্য হেমলতা খুব কম মাছ কেনেন। মোর্শেদ যতদিন বাড়িতে থাকেন, ততদিন মাছের অভাব হয় না। মোর্শেদ কিছু বলার আগেই পূর্ণা

ও প্রেমা গামলা নিয়ে ছুটে আসে উঠানে। তিনি কাঁধের ব্যাগ উলটে ধরলেন গামলার ওপর। পুঁটি, ট্যাংড়া, পাবদা, চিংড়ি মাছের ছড়াছড়ি লেগে যায়।

হেমলতা মনে মনে ভারি খুশি হোন। পদ্মজা লতা দিয়ে চিংড়ি খেতে খুব পছন্দ করে। আর প্রেমা-পূর্ণা পছন্দ করে পাবদা মাছের ভুনা। আড়াল থেকে পদ্মজা দেখছে, তার ঠোঁটেও হাসি। মেয়েগুলো খুব খুশি হয়েছে মাছ দেখে। মোর্শেদ বাড়ি থেকে বের হতেই লতা আনতে বাড়ির পেছনে ছুটে যাবে পদ্মজা।

প্রেমার মাথায় হাত বুলিয়ে হেমলতাকে উদ্দেশ্য করে মোর্শেদ বললেন, হুনো লতা। আমার আম্মারারে পাবদা ভুনা কইরা দিবা। সবজি-টবজি দিয়া রানবা না।’

‘আব্বা, আপনি বাড়িতে থাকবেন? তাইলে তো প্রতিদিনই মাছ খেতে পারি,’ বলল পূর্ণা।

মোর্শেদ আড়চোখে আড়ালে লুকিয়ে থাকা পদ্মজাকে একবার দেখে তীক্ষ্ণ চোখে হেমলতার দিকে তাকিয়ে পূর্ণাকে জবাব দিলেন, ‘কোনো রহম অশান্তি না হইলে তো থাকবামই।’

গামছা নিয়ে কলপাড়ে চলে যান তিনি। জন্মদাতার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে পদ্মজার মুখটা ছোটো হয়ে যায়। প্রতিবার বাড়ি ছাড়ার আগে মোর্শেদ পদ্মজাকে কটুকথা শোনান। তখন হেমলতা রেগে গিয়ে জবাব দিলে তর্কা- তর্কি করে তিনি বাড়ি ছাড়েন।

‘মোর্শেদ নাকি? বাড়ি ফিরলা কোনদিন?’

মোর্শেদ গোসল সেরে সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছিলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে রশিদ ঘটককে দেখে হেসে বললেন, ‘আরে, মিয়া চাচা। আহেন, আহেন। পূর্ণারে চেয়ার আইননা দে। খবর কী?’

পূর্ণা চেয়ার নিয়ে আসে। রশিদ এক দলা থুতু উঠানে ফেলে চেয়ারে বসল আরাম করে। প্রেমাকে উঠানে খেলতে দেখে খসখসে গলায় ফরমায়েশ দিল, ‘এই মাইয়া, যা পানি লইয়া আয়। অনেকক্ষণ ধইরা দমডা আটকাইয়া আছে।’

প্রেমা রান্নাঘর থেকে পানি এনে দেয়। রশিদ পানি খেয়ে মোর্শেদকে বলল, ‘খবর তো ভালাই। তো বাবা ছেড়িডারে কী বিয়া দিবা না?’

‘দুই বছর যাক। পড়তাছে যহন মেট্রিকটা পাশ করুক। কী কন?’

‘মেজোডা না। বড়োড়া। তোমার বউ তো মরিচের লাহান। কোনোবায় ও রাজি অয় না। তুমি বোঝাও। পাত্র খাঁড়ি হীরা। বাপ-দাদার জমিদারি আছে।’

মোর্শেদ আড়চোখে হেমলতা এবং পদ্মজার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেন— নেই ওরা। তিনি জানেন পদ্মজার উপর কোনোরকম জোরজবরদস্তি তিনি করতে পারবেন না। হেমলতা তা হতে দেবে না। এসব তো আর বাইরের মানুষের সামনে বলা যায় না। মোর্শেদ রশিদ ঘটককে নরম গলায় বললেন, ‘থাকুক না, পড়ুক। মায়ে যহন চায় ছেড়ি পড়ুক তাইলে পড়ুক।’

রশিদ নিরাশ হয়ে তাকিয়ে রইল। ভেবেছিল, মোর্শেদ হয়তো রাজি হবে। রশিদ এতদিন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ছিল। এরপর বড়ো অসুখে পড়ে। তাই মোর্শেদ বাড়ি ফিরেছে শুনেও আসতে পারেনি। আজ একটু আরামবোধ হতেই ছুটে এসেছে অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু মোর্শেদের জবানবন্দিতে সে আশাহত হলো। কটমটে গলায় বলল, ‘যুবতী ঘরে রাহন ভালা না। যহন বংশে কালি পড়ব তহন বুঝবা। হুনো মোর্শেদ, এই বয়সি মাইয়াদের স্বভাব চরিত্র বেশিদিন ভালা থাহে না। পাপ কাম এদের চারপাশে ঘুরঘুর কর। বেলা থাকতে জামাই ধরাইয়া দেওন লাগে। বুঝছ? তোমার বউরে বোঝাও।’

পাত্রের অনেক প্রশংসা করল রশিদ; জমিজমা, বাড়িঘর—সবকিছুর বাড়াবাড়ি রকমের বর্ণনা দিল। রশিদ ঘটক যেতেই মোর্শেদ হেমলতার পাশে গিয়ে বসেন, পদ্মজার বিয়ের কথা তুলেন ইনিয়েবিনিয়ে। হেমলতা সাফ নাকচ করে জানিয়ে দিলেন—কিছুতেই এখন মেয়ের বিয়ে দিবেন না। আর মোর্শেদকে পদ্মজার ব্যাপারে নাক গলাতেও মানা করে দেন। শেষ কথাটা বেশ কঠিন করেই বললেন, ‘আগে বাপ হও। পরে বাপের কাজ করতে এসো।’

মোর্শেদের তিরিক্ষি মেজাজ। রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান তিনি। রগে রগে তার রাগ টগবগ করছে। পদ্মজাকে বারান্দায় দেখে তিনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, ‘ছেড়ি যহন রূপ দিয়া নটি হইব, তহন আমার ঠ্যাংও পাইবা না। এই ছেড়ি মজা বুঝাইব।’

কথাটি শুনে পদ্মজার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। হেমলতা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসেন মোর্শেদকে কিছু কঠিন কথা শোনাতে। পদ্মজা তখন দৌড়ে আসে। হেমলতার হাতে ধরে রান্নাঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। মোর্শেদ যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, তারও ততক্ষণ খুব ভালো লাগে। পূর্ণা-প্রেমা কত খুশি হয়। বাড়িটা পরিপূর্ণ লাগে। সে চায় না বাবা ঝগড়া করে রাগ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাক। হেমলতা রাগে এক ঝটকায় মেয়ের হাত সরিয়ে দেন। তার সহ্য হয় না মোর্শেদকে। মানুষের কথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া বদমেজাজি একজন মানুষ মোর্শেদ। ভালোটা কখনো বোঝে না, মানুষের কথায় নাচে। সারাক্ষণ একটা বাক্যই যেন জপ করে, ‘লোকে কী বলবে?’

.

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মাথার ওপর বৃষ্টি নিয়ে মোর্শেদ বাড়ি ফেরেন। মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি খুব খুশি। হেমলতাকে ডেকে বললেন, ‘এক মাসের লাইগগা ঘরটা ছাইড়া লাহাড়ি ঘরে উইঠঠা পড়ো।’

হেমলতা কিছু বললেন না। তার প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে মোর্শেদ বললেন, ‘শুটিং করার লাইগগা মাতব্বর বাড়িত যারা আইছে হেরার নাকি শুটিংয়ের জন্যি আমার বাড়ি পছন্দ হইছে। বিরাট অংকের টেকা দিব কইছে। আমিও কথা দিয়া আইছি।’

হেমলতা রেগে যেতে গিয়েও পারলেন না। সত্যি, টাকা খুব দরকার। পদ্মজার সামনে মেট্রিক পরীক্ষা। কত খরচ! কলেজে পড়াতে ঢাকা পাঠাতে হবে। পদ্মজা যখন ছোটো ছিল তখনো একবার এই বাড়িতে শুটিং হয়েছিল। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘টাকার কথা আমার সঙ্গে আলোচনা করতে বলো। নয়তো জায়গা হবে না।’

‘আরে..বলামনে। এখন সব গুছাও। ওরা কালই আইব।’

পূর্ণা আড়াল থেকে সবটা শুনেছে। সাত দিন হয়েছে লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী অলন্দপুরে এসেছে। অথচ, সে দেখতে পারল না! হেমলতা যেতে অনুমতি দেননি। পূর্ণা নামাজের পর দোয়ায় খুব অনুনয় করে আল্লাহকে বলেছে, যেন লিখন শাহ আর চিত্রা দেবীকে স্বচক্ষে দেখতে পারে। আর এখন শুনছে তাদের বাড়িতেই নাকি আসছে ওরা! পূর্ণার মনে হচ্ছে খুশিতে সে মারা যাবে! বুকের ভেতর দম আটকে আসছে…

…পানি লাগবে…পানি।

.

‘এই, মগা আমাকে এক কাপ চা দাও তো।’

মগা ঝড়ের গতিতে চা নিয়ে আসে। চিত্রার পাশের চেয়ারটা টেনে তাতে বসল লিখন। এরপর মগাকে বলল, ‘দারুণ চা করো তো তুমি! ‘

কাঁচুমাচু হয়ে হাসল মগা। ভাবে বোঝা গেল, প্রশংসা শুনে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। এদিকে মগার ভাবভঙ্গি দেখে হেসে উঠল চিত্রা। চিত্রার হাসির সেই দৃশ্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে মগা। মাতব্বর বাড়ির কামলা সে, চিত্রনায়ক লিখন শাহ এবং চিত্র নায়িকা চিত্রা দেবীর সেবা করার দায়িত্ব তাকে দেয়া হয়েছে। চিত্রার সুন্দর মুখশ্রীর সামনে সবসময় থাকতে পারবে ভেবে মগা ভীষণ খুশি। চিত্রা বলল, ‘তোমার ভাইয়ের নামটা যেন কী?’

চার ফুট উচ্চতার মগা উৎসাহ নিয়ে জবাব দিল, ‘মদন।’

চিত্রার হাসি পায়। অনেক কষ্টে চেপে রাখল।

মগা-মদন…এসবও কারো নাম হয়?

শুটিংয়ের মাঝে হুট করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। তাই আপাতত শুটিং স্থগিত আছে। বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছে সবাই, প্রত্যেকের হাতে রং চা। ডিরেক্টর আবুল জাহেদের খিচুড়ির স্বাদ অতুলনীয়। তিনি আজ খিচুড়ি রান্না করছেন, বৃষ্টি দেখেই ঢুকে পড়েছেন রান্নাঘরে।

চিত্রা লাহাড়ি ঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, এই বাড়ির দুইটা মেয়ে কোথায়? আসার পর একবার এসেছিল। এরপর তো আর এলো না।

মগা বলল, ‘ওই যে লাহাড়ি ঘর। ওইডাত আছে।’

‘লাহাড়ি ঘর…সেটা কী?’

মগার বদলে লিখন জবাব দিল, ‘যে ঘরের অর্ধেক জুড়ে ধান রাখা হয়, আর অর্ধেক জায়গায় চৌকি থাকে কামলাদের জন্য—ওই ঘরকে এখানে লাহাড়ি ঘর বলে। বোঝা গেছে?

চিত্রা চমৎকার করে হাসল, ‘বোঝা গেছে। এই মগা, বৃষ্টি কমলে লাহাড়ি ঘরে যাব। ঠিক আছে?’

চিত্রার ‘এই মগা’ ডাক যেন মুহূর্তে মগার জগৎ-সংসারকে স্বর্গ করে তোলে। সে বাধ্যের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আইচ্ছা, আপা।’

চিত্রা লিখনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি যাবা? ওই তো সামনেই আলসেমি করো না।’

মগা হইহই করে উঠল, ‘না না, বেঠা লইয়া যাওন যাইত না। বাড়ির মালিকের মানা আছে।

মগার না করার তীব্রতা দেখে ভীষণ অবাক হলো সবাই। চিত্রা প্রশ্ন করল, ‘মানা কেন?’

‘বাড়ির বড়ো ছেড়িডারে তো আপনেরা দেহেন নাই। আগুন সুন্দরী। এই লিখন ভাইয়ের লাহান বিলাই চোখা। ছেড়িডারে স্কুল ছাড়া আর কোনোহানো যাইতে দেয় না। বাড়ি দিবার আগে কইয়া রাখছে—লাহাড়ি ঘরে বেঠামানুষ না যাইতে। এই ছেড়ি লইয়া বহুত্তা কিচ্ছা আছে।’

চিত্রা বেশ কৌতূহল বোধ করল। লিখন তীক্ষ্ণ ঘোলা চোখে লাহাড়ি ঘরের দিকে তাকাল। দেড় দিন হলো এখানে এসেছে। উঠানের শেষ মাথায় থাকা লাহাড়ি ঘরটা একবারো মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়নি।

সামনের দরজাটা বন্ধ। দুটো ছোটো মেয়ে এসেছিল ঘরটার ডান পাশ দিয়ে। ঘরটার ডানে-বাঁয়ে-পেছনে গাছপালা। বাড়িটা পুরনো হলেও দারুণ।

তবে এই মুহূর্তে তার অন্যকিছুর প্রতি তীব্র কৌতূহল কাজ করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *