পদবীর সামাজিক চিত্র
জনৈক পাঠক প্রশ্ন করেছেন তাঁর ‘পুষিলাল’ পদবীর উৎস কি, কেনই বা তাঁর এই বিচিত্র পদবী! উত্তরে জানাতে হয় পদবীটিকে এখন অপরিচিত ঠেকছে, কিন্তু এটি ব্রাহ্মণদের আদি গাঞি পদবী। পুষিলাল, কাঞ্জিলাল, কুন্দলাল, মতিলাল ব্রাহ্মণ পদবী। তবে প্রথম তিনটি গাঞি, মতিলালের উৎস সঠিক জানা নেই। শচীন দাস মতিলাল নামটি গানের জগতে সুপরিচিত। শোনা যায় শচীন দাস তাঁর নাম, মতিলাল ছিল ডাক নাম। পরে সেটিও নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পদবী হয়ে যায়। কিন্তু কাঞ্জিলাল বা পুষিলাল বা কুন্দলাল পদবীর মত পূর্বকালেও মতিলাল পদবী প্রচলিত ছিল, যদিও গাঞি নাম হিসেবে নয়। পুষিলাল এসেছে পুষলী গাঞি থেকে। প্রাচীন নাম পোষল্, জেলা বর্ধমান, এখন পোষলা।
আলোচনাসূত্রে বারংবার যে গাঞি শব্দটি ব্যবহার করছি তা গ্রাম্য শব্দের অপভ্রংশ এবং ‘গাঁয়ী’ (অর্থাৎ গাঁয়ের) শব্দের পুরোনো রীতির বানান থেকে এসেছে। আদিতে গ্রাম শব্দের অর্থ ছিল চলমান আর্য- ভাষীদের সাময়িক বসতি, সামরিক বসতিও বলা চলে। প্রায় ফৌজী ক্যাম্প। গ্রাম থেকেই সংগ্রাম। চলমান দুটি গ্রাম মুখোমুখি হলেই অবধারিত ছিল সংগ্রাম। এই ‘সংগ্রাম’ আবার বাঙালীর পদবীও।
বংশানুক্রমিক দারিদ্রে বা সমাজপতিদের তাচ্ছিল্যে অনেক পদবীর পূর্বগৌরব আজ বিস্মৃত। পদবীর অধিকারী কৃষিনির্ভর অল্পবিত্ত হলেই তার পদবীটিকে প্রচলিত পরিচিত ফল মূল শাকসব্জির নামের সঙ্গে একাত্ম করে দেওয়ার মধ্যে উচ্চবিত্তরা আনন্দ পেয়ে এসেছেন। এভাবেই এসেছে কাঁঠাল বা আলু ও পটল।
কাঁঠাল বা কাঁটাল এসেছে কাটাল থেকে। সম্ভবত দীঘি বা পুষ্করিণী কাটানোর ভারপ্রাপ্ত ওভারসিয়ার। আলু এবং পটলকে এখন আর অবহেলা করা যায় না, মূল্যবৃদ্ধির দরুণ তারাও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে, মন্ত্রীদের সুখনিদ্রা কেড়ে নেয়। পদবীর হাটে আলু এবং পটলের কিন্তু সুদিন ছিল। পটোল তোলা বলতে মৃত্যু বোঝাতো কেন, তা একবার এই সুযোগে ভেবে দেখা যাক। ফল তুলে নিলেই লতাটি মারা যায় বলে? অথবা চোখ কপালে তোলা মৃত্যুর ইঙ্গিত দেয় অর্থে। পটলরোগ বলতে চক্ষুরোগ বা চোখের ছানিও বোঝায়।
আলু ও পটল পদবী দুটি উচ্চারিত হলেই আমরা তাদের খুঁজতে যাই হাটে-বাজারে। অথচ পটল এসেছে হিন্দুযুগের পট্টকিল উপাধি থেকে, ওপ্রান্তে যার অপভ্রংশ পাতিল (প্যাটেল)। এপ্রান্তে এসে কোন পট্টকিল নানা দুর্দশার মধ্যে দিয়ে পটল হয়ে গেছেন। ইংরেজ আগমনের সময় যেমন অনেকেই কপাল ফিরিয়ে জমিদার বনেছিলেন, পটল পদবীর কেউ তেমন প্রসিদ্ধ জমিদার থাকলে এই বক্তব্য সহজেই বিশ্বাসযোগ্য হত। সাম্প্রতিক দু’তিন পুরুষের উত্থানকে আমরা দু’তিন হাজার বছরের বনেদীয়ানা দিতে প্রস্তুত, কিন্তু ভাগ্যহতকে নয়। আলু, এবং পটলকে আমরাই পাশাপাশি বসিয়েছি, যদিও হাটেবাজারে তারা পাশা- পাশি অধিষ্ঠান করে না। আলু এসেছে আলাপী শব্দ থেকে। রাজারা তৎকালে মহিলা গাল্পিকও নিয়োগ করতেন, যাদের নাম ছিল ‘আলাপনী’। গল্প বলার বৃত্তি থেকে, অথবা অর্থবানের আড্ডায় বেতনভুক সঙ্গী আলাপী থেকে আলু পদবী। বিস্মৃত আলাপীই এখন চালান হয়ে গেছে কোল্ডস্টোরেজে অর্থাৎ হিমঘরে। অনতি সাম্প্রতিক কালেও এই বৃত্তি ছিল। গাল্পিক বা গল্পী থেকেই গোপ্পী। যেমন গল্প থেকে গপ্পো। এই সূত্রে সংবাদ: কাশ্মীরে চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগেও বাজারের এক- প্রান্তে গল্প বলিয়ের আসর বসতো, একটি করে পয়সার বিনিময়ে সমবেত লোকদের যিনি গল্প শোনাতেন তাঁকে বলা হত কহ্নিক, সম্ভবত কাহিনীকার। কহ্নি একটি শালেরও নাম।
শব্দ কি ভাবে বদলে যায় বা বিকৃত হয় তার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। গোয়ালিয়রের একটি মন্দিরকে ইতিহাসে চিহ্নিত করা আছে সহস্র- বাহু, মন্দির নামে। কিন্তু অনেকেই এই মন্দিরটিকে খুঁজে পাবেন না। পরিবর্তে পাবেন সাসবহু, নামে দুটি মন্দির। একটি ছোট, একটি বড়। জনপ্রবাদ অনুযায়ী শাশুড়ী ও বউ অর্থাৎ সাস ও বহুর মন্দিরের গল্পও শোনা যাবে। বড়টিকে বলা হয় সাস, ছোটটি বহু। অর্থাৎ মূল শব্দ সহস্রবাহু, অপভ্রংশিত হবার কালে পরিচিত দেশজ শব্দের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় এবং তখন অর্থও বদলে যায়। কাছাকাছি দুটি মন্দির পাওয়ার ফলে মানুষের কল্পনা একটিকে বানায় সাস, অন্যটিকে বহু, শাশুড়ী- বউয়ের যে সম্পর্ক ভারতীয় সমাজে চিরদুঃখের কাহিনী। উপরন্তু সেই বিকৃত শব্দকেও প্রতিষ্ঠিত করা হয় জনপ্ৰবাদ মারফৎ। সেজন্যই ভাষা- তত্ত্বের নিয়মেই শব্দ অপভ্রংশিত হয় না। আলাপী ও পট্টকিলের মত আরো বহু, শব্দ এভাবেই আলু পটলই নয়, ঢাক ঢোল ঢেঁকি চাকি ইত্যাদিতেও রূপান্তরিত হয়েছে।
‘গুপী গায়েন বাঘা বায়েন’ উপেন্দ্রকিশোরের কল্পনার সৃষ্টি নয়। গায়েন ও বায়েন সত্যই পদবী, এবং কয়েক শতাব্দী আগে যে তারা উচ্চ- শিক্ষিত এবং অর্থবান ছিল তার প্রমাণ মেলে পুঁথিপত্রে।
ঘোড়ুই বা ঘড়াই সম্ভবত একই। ঘরামি বৃত্তি থেকে?
পদবীর হাটে একই ধ্বনিচিত্রের পদবী কম নেই। সিমলাই আছে, পিপলাই আছে। দুটিই ব্রাহ্মণ পদবী। আবার গলুই আছে, দলুই আছে। গলুই নৌকোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা জানা নেই। তবে দলুই হলো দলপতি। আরেকটি পদবী ফুরাই। বোধ করি পুরাই বা পুরাইত থেকে। ইনিও পুরবিৎ হতে পারেন। অর্থ নগরবিদ্। স্মর্তব্য পুরকায়স্থ পদবীর চলতি রূপ পুরকাইত। পূরণ থেকেই ফুরণ, চুণকামের মিস্ত্রির কাছে ফুরনের রেট জানতে চাওয়ার অর্থ পূরণের শর্ত। সে ভাবেই পুরাই থেকে ফুরাই হয়েছে। কিন্তু হাইত? এবং হুইত? গাঁতাইত, গুছাইত, হুতাইত আগেই বলেছি।
ঝাঝ বা ঝাঁজ পদবী কি ঝাজ অর্থাৎ ঝা-জ, ঝা-জাত? অথবা অন্য অর্থ?
দিকপতি কোন সীমানা অঞ্চলের রক্ষক বা অধিকর্তা। দিক বলতে অঞ্চল বা প্রদেশও বোঝায়। আবার ইন্দ্র অগ্নি যম নির্ঋতি বরুণ বায়ু কুবের ঈশান ব্রহ্মা অনন্ত (নারায়ণ) এই দশজন হলেন দশ দিকের দিকপতি বা দিকপাল।
দিগর? অজ্ঞাত।
বসাক অবশ্যই বস্—বস্ত্র সম্পর্কিত। বসক থেকে?
রাণা তো রাজপুত ইতিহাসে সুবিখ্যাত, একদা জাতীয়তায় তাঁদের কাহিনী আমাদের উদ্দীপনা জোগাতো। কিন্তু এটি তাঁদের পদবী ছিল না, নামের আগে বীর বা রাজা অর্থে ব্যবহৃত হত। নেপালে ব্যবহৃত হয় নামের শেষে। প্রায় পদবীই। একটি অবাঙালী পদবীও আছে রায়না। রাণা ৫ম—৭ম শতাব্দীর রাণক অধস্তন রাজপদ থেকেও এসে থাকতে পারে। কিন্তু রাণার প্রথম দর্শন মেলে রাজপুতানায়। রাণ শব্দের অর্থ মরুভূমি। গুজরাতি ও রাজস্থানী ভাষায়। সুতরাং রাণ থেকেই হয়তো রাণক ও রাণা।
লাড়ুলি একটি ব্রাহ্মণ পদবী।
রাণা কখনো রাণক ছিলেন কিনা বলা দুরূহ, তবে বড় জমিদার বংশে ওই পদবী থাকলে সহজেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতো সাধারণ পাঠকের কাছে। কারণ জমিদার সপর্কেই অনেকের ধারণা খুব অস্পষ্ট। জমিদার বলতে মোগলযুগে বোঝাতে ক্ষুদ্র অঞ্চলের শাসক, এবং তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। বৌদ্ধযুগে যাঁরা ছিলেন মণ্ডল মহত্তর পট্টকিল, অর্থাৎ পালি ভাষায় যাঁদের উপাধিগুলির পতন ঘটেছিল, হিন্দুযুগে তাঁরা আরো নীচে নামলেন। মোগলযুগে তাঁদের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে নেমে এলেন হিন্দুযুগের নব্যশাসকরাও। অর্থনৈতিক দিক থেকেও। কিন্তু ইংরেজ যুগে হিন্দুরা আবার জমিদার হলেন। কার্যক্ষেত্রে এঁরা কিন্তু জামিনদার। এই জমিদারী প্রথার বয়স মাত্র দেড়শো বছর। পলাশির যুদ্ধের সময়েও কোন বিশিষ্ট বাঙালী হিন্দুর দেখা মেলে না। পরে যে বাঙালীরা কোলকাতায় ছুটে এলেন, তাঁদের মধ্যে যেমন ব্রাহ্মণ-কায়স্থ ছিল, তেমনই ছিল অন্যান্য জাতি। সে সময় তন্তুবায় এবং বণিকরাই ছিল ধনী। প্রথমে তন্তুবায়দের প্রবঞ্চনা ও শোষণের শিকার হতে হয়, পরে বিলাতী যন্ত্রশিল্পে উৎপাদিত বস্ত্র আমদানির ফলে তাদের আর্থিক তথা সামাজিক পতন ঘটে। এই সময়ে ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করে ব্যবসা করে, নানা ভাবে তাদের উপকার করে, দোভাষী হয়ে জাহাজ- ঘাটায় মাল নামানোর কুলি সংগ্রহ করে দিয়ে অনেকেই কপাল ফেরালেন। এঁদের মধ্যে ধনীরা জমিদারী কিনলেন ইংরেজের কাছ থেকে। কিন্তু সে-জমিদারী আসলে খাজনা আদায়ের ঠিকাদারী। তবু দু’তিন পুরুষেই তাঁরা বনেদী বনে গেলেন।
যে কোন পদবীর উৎস সন্ধানের সময় এই কথাগুলি মনে রাখা প্রয়োজন।
সাবুই ও সাঁপুই হয়তো একই বৃক্ষের দুটি ফল। সাক্ষীসাবুদের সাবুদ থেকে এসেছে। সাবুদ শব্দের অর্থও সাক্ষী। দোল দয়াল থেকে। দালাল কিন্তু বৃত্তিজাত। পাইকও। মালাকারও হয়তো তাই। মালাকার জাতিনামও আছে। বরাট, বাঁশুলি, শাহী, মাল, (মালো নয়), বাউল, বিন্দু ইত্যাদির মধ্যে বাঁশুলি হয়তো এসেছে যে স্থানে বাশুলি পূজা হত তার অধিবাসী অর্থে। যারা সাপ ধরতো তাদের সেকালে বলতো মাল। মাল পদবীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নাও থাকতে পারে। শাহী কি বাদশাহী কর্মে নিযুক্ত? রাউল পদবী হয়তো অবাঙালীর রাওয়াল পদবীর সঙ্গে যুক্ত।
সরখেল, হালুই, হোড়, প্রধান, এখন সকলেরই পরিচিত।
মনে রাখতে হবে, অপরিচিত, উদ্ভট পদবী বর্ণহিন্দুরও। আবার তথাকথিত নীচুতলার মধ্যে ব্যবহৃত হলেই পদবীর পাতিত্য ঘটে না। মণ্ডল পদবী বর্ণহিন্দুরও।
আরো কত সহস্র পদবী যে বাঙালীর আছে তার ইয়ত্তা নেই। কারো ইতিহাস আছে, কোনটি বা ব্যঙ্গবিদ্রুপ থেকে। আমরা তো শ্রদ্ধেয়কেও নুলো পঞ্চানন বা কানাকেষ্ট বলেছি।
বর্ণের প্রতিপত্তি, জাতির মর্যাদা, কৌলীন্য, পদবীর সাংস্কৃতিক মান, সবকিছুর পিছনেই আছে আর্থিক তথা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা। রাজবদান্যতা এবং রাজরোষই ছিল সমাজের নিয়ামক। নলিনীকান্ত ভট্টশালী কৌলীন্য সম্পর্কে তাঁর মতামতে জানিয়েছিলেন যে বল্লল- সেন প্রায় খামখেয়ালীপনায় সমস্ত ব্রাহ্মণদের দানের লোভ দেখিয়ে নিমন্ত্রণ জানান। যাঁরা দিনান্তে এসে পৌঁছন তাঁদের নির্লোভ মনে করে কুলীন শ্রেণীতে উন্নীত করেন। অন্যদের উপস্থিতির কাল অনুযায়ী ভঙ্গ, বংশজ ও শ্রোত্রীয়। উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত ডিভাইড অ্যান্ড রুল। ব্রাহ্মণরা নিজেদের অজ্ঞাতেই তার শিকার হয়ে পড়েন।
জনপ্রবাদ ও কুলপঞ্জিকার মতে কান্যকুব্জাধিপতি যে-পাঁচজন বাক্- সিদ্ধ বেদজ্ঞ সাগ্নিক ব্রাহ্মণকে পাঠিয়েছিলেন তাদের বেশভূষার জন্য আদিশূর তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। দক্ষিণী আদিশূরের পক্ষে তা খুবই স্বাভাবিক। তবে কৌলীন্যের ভট্টশালী-কাহিনী বিশ্বাস না করলেও এ-কথা স্বীকার করা চলে যে বল্লালসেন নামক ব্ৰহ্ম-ক্ষত্রিয় মহারাজাই ব্রাহ্মণদের কৌলীন্য দিয়েছিলেন। অর্থাৎ ব্রাহ্মণত্বের বিচারক ছিলেন দ্রাবিড়দেশাগত রাজা। এবং পরেও রাজা কর্তৃক ভূমি বা গ্ৰামদানকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতি ও রাজনীতিই এখানে প্রধান নিয়ামক।
সমাজের সমস্ত উত্থান পতন ও পরিবর্তনের পিছনে এই নিয়ামক শক্তিই আজো ক্রিয়াশীল। রাষ্ট্রশক্তিই অবহেলিত গোষ্ঠীর উন্নয়ন ঘটাতে পারে; রাষ্ট্রশক্তির অবহেলা আবার উন্নীত গোষ্ঠীর অবনয়ন ঘটাতে পারে। এই রাষ্ট্রশক্তির অর্থ, অর্থানুকূল্য।
কোন কোন পদবী পুর্তুগীজদের কাছ থেকেও এসে থাকতে পারে। পূর্ববঙ্গে কৃষ্ণবর্ণ পুর্তুগীজ সম্প্রদায় ছিল, তারা পর্তুগীজদের বংশধর এমন দাবীও করতো। পরন্তু পর্তুগীজরা শুধুই বোম্বেটে দস্যু হলে এত রকম ফল মূল শাকসব্জি চাষের প্রচলন করলে কি উপায়ে? হিন্দু বাঙালীদের সঙ্গে তাদের সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানও ঘটেছিল, ছিল আদানপ্রদান। স্থায়ী সম্পর্ক না থাকলে আমাদের খাদ্যতালিকায় এবং ব্যবহারিক বস্তুর তালিকায় এত পর্তুগীজ শব্দের দেখা মিলতো না। পর্তুগীজ সম্পর্কও একসময়ে আভিজাত্য দান করতো।
যে কোন মানুষের, জাতির বা শ্রেণীর বর্তমান সাফল্য এবং স্বীকৃতি নিয়ে গৌরবান্বিত হবার অধিকার আছে এবং তা স্বাভাবিক। কিন্তু অতীত বিষয়ে গর্ব করতে গেলে সেই অতীত কাহিনী কতখানি সত্য তার যুক্তিনির্ভর বিচার প্রয়োজন। আবার শুধুমাত্র ঈর্ষা থেকে কোন জাতি বা গোষ্ঠীর প্রতি অপবাদ দেওয়াও উচিত নয়। কিন্তু ইতিহাসে তা বারংবার ঘটেছে।
মানুষ পৃথিবীতে কিভাবে উদ্ভূত হল তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে মাত্র তিনটি। ১। ডারুইনবাদ অনুযায়ী মানুষ ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে, অন্য সব প্রাণীর মতই। ২। ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন। ৩। দানিকেনীয় কল্পনা অনুযায়ী ভিন্নগ্রহের দেবতারা এসে বুদ্ধিমান মানুষের বীজ রোপন করে গিয়েছিলেন।
কিন্তু ভিন্নগ্রহের উন্নত মানুষ বা দেবতা কিভাবে সৃষ্ট হল তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ঈশ্বর কিভাবে সৃষ্ট হলেন সে দার্শনিক প্রশ্নেও প্রয়োজন নেই। মনুর মতে ‘সেই প্রভু আপনার দেহকে দ্বিধা বিভক্ত করিয়া অর্দ্ধাংশে নারী ও অর্দ্ধাংশে পুরুষ হইলেন এবং সেই নারীতে বিরাট নামক পুরুষকে উৎপাদন করিলেন।’ অন্যদিকে বিজ্ঞানে স্বীকৃত ব্যাখ্যা হল বিবর্তনবাদ। বিবর্তিত মানব পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, পরিবেশ ও অন্যান্য কার্যকারণে পৃথক পৃথক চেহারা নেয়।
এদের মধ্যে আর্য হল একটি উপশাখা, ঐতিহাসিকদের মতে যারা ছিল একটি যাযাবর ট্রাইব। মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে মিশরের আদি সভ্যতা, সুমের সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা ও প্রাচীন চৈনিক সভ্যতা যারা গড়ে তুলেছিল তারা কেউই আর্য ছিল না, কিন্তু বিস্ময়কর উন্নত সভতা গড়ে তোলার মত মস্তিষ্ক তাদের ছিল। এসিরিয়ায় লোহা ব্যবহারের তার্থাৎ লৌহনির্মিত তীর ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া গেছে (খ্রীষ্টপূর্ব ১১২০) একটি শিলালেখে, কিন্তু চীনে লোহার উল্লেখ পাওয়া গেছে তারও সাত-আটশো বছর আগে। আর্য সম্পর্কেও এখন স্বীকৃত তথ্য যে আর্য কোন বিশেষ রক্তধারা নয়, আর্যভাষীদেরই আর্য বলা হত। সাম্প্রতিক সংবাদ: হিমাচলের পার্বত্য অঞ্চলে এমন একটি ‘অনুন্নত’ গোষ্ঠীর অস্তিত্ব জানা গেছে যারা বৈদিক ভাষার কাছাকাছি একটি ভাষায় আজও কথোপকথন করে। আবার হিমালয়ের উত্তর পূর্বে পার্বত্য অরুণোচলে বাংরু বা বাফলা প্রভৃতি মনিব জাতির ক্রীতদাস (?) যারা, সেই সংলঘুদের চেহারা আমাদের কল্পনার আর্যসদৃশ। অতএব দেখা যাচ্ছে বাহুবল, রাষ্ট্রশক্তি বা আর্থিক সম্পদ না থাকলে আর্যভাষা বা তথাকথিত আর্য রক্তধারা কোন অলৌকিক সভ্যতা সৃষ্টি করতে পারে না।
কিন্তু ব্রাহ্মণ্য বিশ্বাস অনুযায়ী সেই আদি পুরুষ বা ব্রহ্মার মুখ থেকে জন্ম নিলো ব্রাহ্মণ, দুই বাহু, থেকে রাজন্য বা ক্ষত্রিয়, ঊরুদেশ থেকে বৈশ্য, পদযুগল থেকে শুদ্র।
একদিকের বিশ্বাস সেই গোত্রপ্রবর্তক ঋষি থেকে একটি বিশুদ্ধ রক্তধারা চলে এসেছে ব্রাহ্মণদের মধ্যে। অন্যদিকে ঐতিহাসিকের বিশ্লেষণী সিদ্ধান্ত “ভারতে যদি কোন সময় বিশুদ্ধ আর্য জাতি থেকেও থাকে, তাহলে তাদের ‘বিশুদ্ধতা’ বেশিদিন টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা সুদূর- পরাহত।” রোমিলা থাপারের মতে “ভাষাতত্ত্ববিদেরা এক্ষেত্রে যে ভুল করেছিলেন তা হল ‘ভাষা’ ও ‘জাতি’কে অভিন্ন করে দেখা। ম্যাক্সমূলারের শেষের দিকের রচনায় এই ভুলের স্বীকৃতি দেখা যায়, কিন্তু ততদিনে আর্য-জাতিতত্ত্ব দৃঢ়মূল হয়ে গেছে।”
ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র বিশ্বাস করলে বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ ব্যতিরেকে কায়স্থ বৈদ্য ও অন্যান্য সমস্ত জাতি সংকর ও শুদ্র। এবং পঞ্চ ব্রাহ্মণরা কান্যকুব্জ থেকে আগত। মহর্ষি ভট্টনারায়ণ (৭০ বৎসর বয়সে,) মহর্ষি শ্রীহর্ষ (৯০ বৎসর বয়সে,) মহর্ষি দক্ষ (৭০ বৎসর বয়সে,) মহর্ষি ছান্দর (৩০ বৎসর বয়সে) এবং মহর্ষি বেদগর্ভ (৪০ বৎসর বয়সে) বঙ্গদেশে পদার্পণ করেন। কুলমিশ্রের মতে তাঁরা এসেছিলেন ভৃত্য সমভিব্যাহারে। যাঁরা সঙ্গে এসেছিলেন তাঁরা হলেন মরকন্দ ঘোষ, বিরাট গুহ, দশরথ বসু, পুরুষোত্তম দত্ত ও কালিদাস মিত্র।
শ্লোকটি হল:
আয়াতঃ পঞ্চবিপ্রশ্চ
কান্যকুব্জপ্ৰদেশতঃ।
সস্ত্রীকা সহ পুত্রৈশ্চ
সহভৃত্যৈশ্চ তে তথা।
শাস্ত্রবাক্য এবং কুলজী বিশ্বাস করতে হলে সামগ্রিকভাবে সেগুলিকে গ্রহণ করতে হবে এবং তার প্রতিপাদ্যও। যথা, উত্তরপ্রদেশের হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণরাই শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ। বিদ্যায় বুদ্ধিতে জ্ঞানেও। কারণ রক্তধারার সঙ্গে নৈকট্য ছাড়াও তাঁর ব্রাহ্মণ ঐতিহ্য আচারও রক্ষা করে এসেছেন, মাংস- মৎস্য ভোজন করেন না। তাঁরা অধিকাংশই এখনো নিত্য-আচার পালন করেন। কায়স্থ যদি পদবীর মূল এখানেই খোঁজেন তা হলে স্বীকার করতে হবে ‘সহভৃত্যৈশ্চ তে তথা’। উপরন্তু প্রশ্ন থাকে ঘোষ বসু, মিত্র উত্তরভারতে কায়স্থের পদবী নয় কেন? আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে কান্যকুব্জ-কাহিনীকেই ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় অসত্য বলেছেন, এবং ঘোষ মিত্র দত্ত ইত্যাদি পদবী যে নামান্ত থেকে এসেছে তা নীহাররঞ্জন রায় ‘বাঙালীর ইতিহাসে’ উল্লেখ করেছেন।
নীহাররঞ্জন রায়ের মতে ‘কায়স্থ এবং অন্যান্য বর্ণেরও কুলজী- ইতিহাস পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলি কিছুতেই সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের আগেকার রচনা বলিয়া মনে হয় না।’
দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে ‘এই কিংবদন্তী-সমূহ যে আদিশূরের বহুকাল পরে লিপিবদ্ধ হয়েছিল, তার আর এক প্রমাণ এই যে, খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্বে বাংলা ও বিহারে শকাব্দের ব্যবহার সুপ্রচলিত ছিল না।…আদিশূরের কাহিনীটি সেনযুগে তামিলনাড়ু থেকে বাংলা- দেশে আমদানি করা হয়েছিল। বাংলার কুলপঞ্জিকার বিবরণ যোড়শ- শতাব্দী অপেক্ষা প্রাচীন নয়। কিন্তু এতে যেমন পঞ্চ কুলীনব্রাহ্মণ এবং তাঁদের কায়স্থজাতীয় শূদ্র পরিচারকদের আনবার কথা আছে, ঠিক তেমনি দক্ষিণ ভারতীয় কিংবদন্দীতে অর্ন্তবেদি অর্থাৎ কনৌজ অঞ্চল থেকে সদব্রাহ্মণ ও তাঁদের ছত্র ও পাদুকাবাহী শূদ্রভৃত্য তামিলনাড়ুতে নেওয়ার কাহিনী দেখা যায়। আদিশূরের পরিবর্তে এই দক্ষিণী কাহিনীর নায়ক হচ্ছেন চোলরাজ অরিন্দম।’
এই সূত্রে জানিয়ে রাখা ভাল যে গোপালভট্ট ও আনন্দভট্ট রচিত দু’খানি বল্লালচরিতের প্রথমটি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন জাল, দ্বিতীয়টিকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন জাল।
বর্তমানে যুক্তিবাদীদের সিদ্ধান্ত হল জাতি গড়ে উঠেছে বৃত্তি- সংগঠনের মধ্য দিয়ে, জাতি বৃত্তি স্থিতিশীল ছিল না, পদবী এসেছে নামান্ত বা গ্রামের নাম বা বৃত্তি, উপাধি, রাজকর্মচারীর পদ অথবা গ্রাম- শিরোমণি ও অর্থবানদের দেওয়া পদবী থেকে।
কিন্তু সেইসব উপাধি বা বৃত্তিপদ বা রাজকর্মচারীর পদ পেয়ে- ছিলেন বংশের কোন একজন। দেশজ অপভ্রংশিত পদবীর লুপ্ত অর্থ বের করে সামাজিক ইতিহাসের ছবিটাই মেলে। পদবীর একদা গৌরব থাকলেও, বর্তমানে পরমহট্টারিক বা মহত্তর, পট্টকিল বা মহামাণ্ডলিক গাথাবিৎ বা গল্পীর কাছে তা মূল্যহীন, কারণ তিনি জানেন, উচ্চশিক্ষিত অতিযোগ্য ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার বৈজ্ঞানিক হওয়ার পথে দেশজ পদবী উচ্চ- কোটিতে কোন বাধা সৃষ্টি না করলেও নিম্নকোটির সমাজে কেরাণী থেকে খাটো অফিসার অবধি চাকুরিতে এইসব বর্ণহিন্দু, পদবীও মন স্তাত্ত্বিক বাধা সৃষ্টি করে। সমাজেও। জনৈক পাঠকের চিঠির অংশ: ‘যদি আপনি—পদবীর প্রতি আলোকপাত করেন তবে অন্তত পদবী পরিবর্তন করার কথা মাথায় আসে না। বিশেষত কলকাতায় এসব পদবী বললেই সবাই অবাক হয়, অন্ত্যজ বা তপশীলী ভাবে, তাই সব সময় নিজের নাম বলি না।’ আরেকজনের চিঠি: ‘আমার পদবী— এম টেক-এ ফাস্ট ক্লাশ পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাই, বিদেশী ডিগ্রিী নিয়ে এসে বেসরকারী ফার্মে চাকুরী পাই। এখন উচ্চপদে আছি। সম্প্রতি আবিষ্কার করলাম, অধস্তনদের ধারণা তপশীল বলেই উচ্চপদে আছি। আমার জাতি—, বর্ণহিন্দু। তপশীলীদের জন্যে রিজার্ভেশনও যে শুধু, সরকারী চাকুরিতেই সে খবরও কেউ রাখে না।’
উপাধি কিংবা রাজসরকারের পদ থেকে কোন কোন পদবীর উৎপত্তি শুনে চমকিত হবার কিছু নেই। সম্রাট, এমন কি সার্বভৌম রাজার সংখ্যাই ইতিহাসে নগণ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিতান্তই বশ্য শাসক, ছোট- মাপের রাজা কিংবা ক্ষুদে ভূইঞা এই সব উপাধি বা বেতনভুক পদ দিতেন। তাঁরা নিজেরাই তেমন সমৃদ্ধ ছিলেন না। কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় চাকুরির পদ বা উপাধিবাচক শব্দগুলি প্রায় সারা ভারতেই ছিল এক। শব্দদৈর্ঘ্য ও ধ্বনিপ্রাবল্যের ফলে ডেসিগনেশন ছিল বিশাল, কিন্তু আসলে গ্রামের চৌকিদার হয়তো ছিল চৌরোদ্ধরণিক, কনস্টেবল ছিল দণ্ডপাশিক, কোট্টপাল তো কোটাল, খণ্ডের জ্যেষ্ঠকায়স্থ বড়জোড় এস ডি ও। বড় রাষ্ট্রে রাণক বা রাজনকের নীচে মহাসামন্ত বা মহামাণ্ডলিক। তার নিচে সামন্ত বা মাণ্ডলিক, এরও অধস্তন মহামহত্তর, তাঁর নীচে মহত্তর। ‘অষ্টম-শতকপূর্ব লিপিগুলির জ্যেষ্ঠকায়স্থ বা প্রথম কায়স্থ… যে পাঁচজন মিলিয়া স্থানীয় অধিকরণ গঠন করেন, তিনি তাঁহাদের একজন।’ অর্থাৎ পঞ্চায়েতের সদস্য। বাণিজ্যে যে লক্ষ্মীর বাস তদর্দ্ধং রাজসেবায়াং অসম্ভব ছিল, যদি না বেতনের সঙ্গে উৎকোচ যুক্ত করা হয়। তবে রাজাকে রাজসেবায় তৃপ্ত করলে তাঁরা পদ অনুযায়ী ভূমি- দান পেতেন পেনশন হিসেবে।
আগেই বলেছি, সমস্ত জমিদারিত্ব মাত্র দেড়শো দুশো বছরের। বহু জমিদারই ইংরেজ আগমনের আগে নিতান্তই নগণ্য ব্যক্তি। ইংরেজ- বদান্যতায় অনেকেরই কপাল ফিরলো। ইংরেজ শাসকদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রজাদের মতিগতি বিশ্বাস ইত্যাদি ঠিকমত অনুধাবন করা ও হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী যথাসম্ভব ঐতিহ্যপন্থী নিয়মে শাসনকার্য ও বিচার প্রবর্তন করা। শাসকদের মধ্যে দু’চারজন পণ্ডিত ব্যক্তির অবশ্য অনু- সন্ধিৎসা ও আদর্শও ছিল। কিন্তু মূলতঃ শাসনকার্যের প্রয়োজনেই বেতনের বিনিময়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতও নিয়োগ করলেন তাঁরা, সংস্কৃত শিক্ষার জন্য, অথবা সংস্কৃত থেকে অনুবাদের জন্য। ফলে কারও অভাব ও দৈন্য ঘুচলো, কেউ অর্থবান হয়ে উঠলেন। পাশাপাশি পতনও ঘটলো অনেকের। আগেই বলেছি, তন্তুবায়দের। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধেও কোলকাতায় বিশিষ্ট ভদ্রলোক পরিবার মাত্র ষাটটি। এরা দু’এক প্রজন্মের মধ্যেই সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হলেন। কায়স্থ ৩৪, ব্রাহ্মণ ১১, বাকী পনেরোটির মধ্যে সুবর্ণবণিক ৬, তাঁতী ১, কংসকার ১, বৈদ্য ১, এবং সদ্গোপ, তিলি, কৈবর্তও। তন্তুবায়দের তখন আর্থিক পতন ঘটলেও সাংস্কৃতিক পতন ঘটেনি। ১৮৩৯-এ মেডিকেল কলেজের পঞ্চাশজন ছাত্রের মধ্যে বৈদ্য ছিল তিনজন, তাঁতী ছ’জন, কায়স্থ পনেরোজন। বাংলার তাঁতবস্ত্র রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় এবং বিদেশী কলের তৈরি বস্ত্র আমদানি শুরু হওয়ায় তাঁতিদের পতন হল, সঙ্গে সঙ্গে তন্তুবায়দের যে উপরতলা বাণিজ্যের ফলে অর্থবান ও সে-কারণে শিক্ষিত ছিল, তাদেরও অবনয়ন ঘটলো। বিদেশী বস্ত্রের ব্যবসা করে অর্থবান হল উচ্চজাতির অনেকে।
১৮২৯ সালেই বোধহয় প্রথম মধ্যবিত্ত শব্দটি ছাপার অক্ষরে দেখা যায়। সেই প্রথম নাগরিক ভদ্রলোক তৈরির যুগ। ‘ভদ্রলোক’ শব্দটিও মধ্যবিত্তের মতই অর্বাচীন। গ্রামের সকলেই ছিলেন কৃষিজীবী, এমন কি শাস্ত্রপণ্ডিতরাও। নীচুতলায় কৃষক বা কারুজীবী। ভদ্রলোকের পরিবর্তে ‘সম্পন্ন গৃহস্থ’ ব্যবহৃত হয়েছে প্রথম পর্বের বাংলা উপন্যাসেও। কিন্তু সেকালের গ্রামীণ চিত্রটি পাওয়া যাবে পদবীগুলিতে।
একটি পদবী হল লাটুয়া। পূর্বপুরুষের কেউ নট বা নাটুয়া ছিলেন, তা থেকেই কি? হয়তো ভাল অভিনয়ের জন্য গ্রাম-সমাজে এই নাম দেওয়া হয়। অবশ্য লাট বা জমির নামকরণ থেকেও আসতে পারে। আরো দুটি পদবী; লাটা, নাট।
অনেকেই জানেন কৃষ্ণনগরের মহারাজা বিশাল রাজ্যের অধিপতি ছিলেন না, তিনি দিয়েছিলেন গুণাকর উপাধি। সেজন্যই কোন কোন উপাধি বা নামকরণে বিশেষ সমতা পাওয়া যায় না, দু’চারটি পরিবারের মধ্যেই তা আবদ্ধ। আবার গ্রামসমাজও উপাধি দিতো। যেমন মাণ্ডলিক থেকে মণ্ডল পদবী বর্ণহিন্দুর থাকলেও তপশীলীদের মধ্যেও আছে। অনেক সময় গ্রামজন প্রতিবেশীর রসপূর্ণ মোড়ল সম্বোধনকেও কেউ কেউ মণ্ডল পদবী বানিয়ে নিয়েছেন। মোড়ল মণ্ডলেরই অপভ্রংশ। মণ্ডল বহু জাতির পদবী। সুবর্ণবণিকদেরও মণ্ডল পদবী ছিল। রেভারেণ্ড লালবিহারী দে’র পিতা ‘দে মণ্ডল’ পদবী ব্যবহার করতেন। আবার তিলি (তৌলিক) ও মাহিষ্যদের মধ্যেও মণ্ডল আছে। এরা সকলেই বর্ণহিন্দু।
উপর তলার হিন্দুরা কোন কোন পদবীকে প্রাচীন রাজাদের সঙ্গে যুক্ত করে আত্মসন্তোষ লাভ করেন, এবং উপাধি বা রাজপদবাচক পদবী নীচু তলায় দেখতে পেলে বিস্মিত হন। অতীত নিয়ে গর্ব করতে গেলে প্রথমেই মনে রাখতে হবে পৌন্ড্র পাল কৈবৰ্ত্তরাই কিন্তু দীর্ঘকাল রাজত্ব করে গেছে এই বাংলাদেশে, বাদবাকী সব রাজারাই ভোট-তিব্বত, অথবা অন্ধ্র বা কর্ণটি থেকে আগত।
জানা শব্দটির সঙ্গে জনৌ বা উপবীত অথবা জৈন শব্দের যোগ আছে, কিন্তু পদবীটির উৎস কি জানা যায় না।
গোল বা কোয়েলটা পদবীর অর্থ কি? শব্দার্থই বা কি? বর একটি পদবী, অবশ্যই বরকনের বর নয়। নৌকোর সঙ্গে সম্পৃক্ত বলেই মনে হয়। নায়ক ও নায়েক একই পদবীর দুই রুপ, অথবা একজন অভিনেতা, অন্যজন সামরিক ল্যান্স নায়েক? শিকদার পাইক নায়েকই শুধু, পদবী নয়, পদবীর রাজ্যেও আছে সংগ্রাম। শিকদার ও সিকদার একই পদবী। স্মরণীয় হয়ে আছেন রাধানাথ সিকদার, যিনি এভারেস্টকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিসেবে। (শিকদার আসলে দারোগা।) কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণে রাধানাথ সিকদার স্মরণীয়, কারণ প্যারীচাঁদ মিত্র ও তিনি ১৮৫৪ সালে ‘মাসিক পত্রিকা’ বের করেন দেশী সহজ বাংলা গদ্য ভাষা প্রচলনের উদ্দেশ্যে। রাউত অবশ্যই রাজপুত, বহির্বঙ্গেও আছে, তবে এটি রাজপুত্র শব্দ থেকেও এসে থাকতে পারে। একদা আমাদের দেশে অসংখ্য রাজা ছিলেন, রাজপুত্রও। এই প্রসঙ্গে জানা প্রয়োজন যে ‘রাজপুত’ নামে একটি বাঙালী জাতি আছে, বর্ণহিন্দু জাতি। এরা কিন্তু ষোল-আনা বাঙালী। বৃহদ্ধর্ম- পুরাণেও ‘রাজপুত্র’ নামে বাঙালীর জাতি রূপে তার উল্লেখ আছে। অর্থাৎ আটশো বছর আগেও বাংলাদেশে এই জাতিনাম ছিল।
প্রামাণিক পদবীর মধ্যেই প্রমাণপত্র উপস্থিত। অর্থাৎ সাক্ষী। বিবাহ থেকে শুরু করে যে-কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সামাজিক সাক্ষ্য রাখা হত, কারণ লেখালিখির ব্যাপারটা ছিল সীমিত। আমাদের বিবাহ অনুষ্ঠানে পুরোহিত ও পরামাণিক থেকে নিমন্ত্রিত ইতরজন অবধি সকলেই সাক্ষী। বৌভাত ব্যাপারটি হল বধূ-স্পর্শিত অন্ন গ্রহণের মধ্য দিয়ে সমাজের স্বীকৃতি।
একটি ব্রাহ্মণ পদবী হল পাহাড়ী। অতীতে ধনী তন্তুবায়দের মধ্যে পদবী ছিল কতমা, অর্থ জানা নেই।
পাত্র কি মহাপাত্রেরই শেষার্দ্ধ? অথবা তলাপাত্রের? তলাপাত্রের অর্থ? ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কর্তা হতে পারে।
একটি পদবী খাঁকারী বা খানকারী।
পানিগ্রাহী সন্নিগ্রাহী পদবী মনে হয় উৎকল থেকে আগত। ষন্নিগ্রাহী বানানও প্রচলিত। ‘ষড়রিপূ নিগ্রহকারক’ এই অর্থ বোধ করি কিঞ্চিৎ কষ্টকল্পিত।
নীচুতলার লোকদের গ্রামশিরোমণিরা একালেও ‘দাস’ পদবী দান করেন।
কিন্তু এই দাস শব্দটি ভৃত্যবাচক হয়ে উঠলো কি ভাবে? প্রাগার্য দাসরা নিজেদের দাস নামেই হয়তো পরিচয় দিতো। ঋগ্বেদে দিবোদাস নাম পাওয়া যায়। তৎকালের আরেকটি নাম সুদাস! অর্থাৎ এই জন- গোষ্ঠী হয়তো নিজেদের দেবতার দাস হিসেবে পরিচয় দিতে। কিন্তু আর্যভাষীরা তাদের আজ্ঞাবহতে পরিণত করেছিল বলেই দাস শব্দটিরই অর্থ হয় ভৃত্য বা ক্রীতদাসোপম। ঠিক এই ধরনের একটি দৃষ্টান্ত হল স্লেভ শব্দটি। হিট্টাইটরা স্লাভদের যুন্ধে বন্দী করে এনে ক্রীতদাসে পরিণত করে, ফলে স্লেভ শব্দের অর্থ দাঁড়ায় ক্রীতদাস। বিনয়বশত নিজেকে ‘আমি আপনার দাস’ বলা থেকেও ‘দাস’ নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব যুগের দাস শব্দ অবশ্য অন্য ব্যঞ্জনা করে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে মালাই ভাষায় এই জাতীয় বিনয় দেখানো হয় ‘সায়া’ শব্দে, যা এসেছে ‘সহায়’ শব্দ থেকে। অর্থাৎ ‘আমি আপনার সহায়’।
বাঙালীর পদবীর হাটেও সহায় এবং বন্ধু, অপ্রাপ্য নয়।
হোম কি সোম পদবীর রূপান্তর? অথবা হোত্রীর মত যজ্ঞার্থে হোমক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত! আগেই বলেছি, ‘তা’ এসেছে হোতা অর্থাৎ হোত্রী থেকে। হোতা পদবীও আছে। ‘তা’ বর্ণহিন্দু পদবী।
ব্যতিক্রমের কথা বাদ দিলে বৌদ্ধযুগের অভিজাতরা তলিয়ে যায় হিন্দুযুগে, হিন্দুযুগের অভিজাতরা মর্যাদা হারায় মোগল আমলে। আবার মোগল আমলের উচ্চকোটির মুসলমান প্রথম অধ্যায়ে ইংরেজের হাতে বিপর্যস্ত হয়, অভ্যুদয় হয় হিন্দু, নগণ্যদের। ইংরেজ শাসনের একশো বছর পরেও কোলকাতায় নব্য অভিজাত ও ‘ভদ্রলোক’দের মধ্যে জাতিভেদ তেমন স্পষ্ট নয়। কারণ কেউই তারা বনেদী নয়, নিতান্তই হঠাৎ-ধনী। আর কৌলীন্যও তখন সম্পদকেন্দ্রিক। ক্রমে ভদ্রলোকত্বের পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় ইংরেজী শিক্ষা, ইংরেজের চাকুরি, ইংরেজের দেওয়া উপাধি। যাই হোক্, এককালে বৌদ্ধ জৈন বা অন্যান্য ধর্ম ছেড়ে যে যত তাড়াতাড়ি বর্ণাশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিল সে যেমন তত উচ্চাসন পেয়েছে জাতিবিন্যাসে, তেমনই যে জাতিগুলি ইংরেজশাসনের সুযোগ সর্বপ্রথম গ্রহণ করতে পেরেছে তাদের উন্নতি হয়েছে তত বেশি, জাতিবিন্যাসেও তারা বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। নব্য বেনিয়ানদের প্রাধান্যে সুবর্ণবণিক তার প্রাধান্য হারায়, বিদেশী বস্ত্র আমদানির ফলে তন্তুবায়। শিক্ষা ও চাকুরির ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়ে। জনপ্রবাদই নয়, মেডিকেল কলেজ ও আইনব্যবসায়ীদের সেকালীন তালিকাও সাক্ষ্য দেয় যে দুটি ক্ষেত্রই দুটি জাতির কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। শুধু, আত্মীয়পোষণের জন্যই নয়, জাতি-সাম্প্রদায়িকতার জন্যও। ফলে, চাকুরির ক্ষেত্রও। অন্যান্যদের অবস্থা কি দাঁড়ায়, পদবীই তার প্রমাণপত্র।
অনেকের কাছেই বিস্ময়কর ঠেকবে যে প্রথম যে বাঙালী ডাক্তার বিলেত গিয়ে এম আর সি এস পরীক্ষা পাশ করেন তাঁর নাম গোপালচন্দ্র শীল। ১৮৩৯-এ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের মধ্যে তাঁতী ৬ জন, কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে অনুচ্চ জাতির জন্য অলিখিত ‘প্রবেশ নিষেধ’ টাঙানো হয়ে গেছে।
পায়রা পদবীটি কিন্তু কবুতর নয়। এটির ভিন্ন রূপ পয়রা ও পয়ড়্যা। একদা অনেকেই হয়তো কোলকাতার অলিগলিতে পয়রা গুড়ের ডাক শুনেছেন। শীতের প্রথমেই তার বড়ই কদর। খেজুর গাছের রস থেকে গুড় বানাতে হলে, গাছটির গুড়ি খানিকটা কেটে কলসী ঝুলিয়ে দিতে হয়তো অনেকেই দেখেছেন। রীতি হল তিন দিন পরপর কাটা যাবে ও রসগ্রহণ চলবে। তারপর তিন দিন বিশ্রাম। এই বিশ্রামের পর প্রথম যেদিন আবার কাটা হয়, তার রস থেকেই পয়রা গুড় তৈরি হয়। অর্থাৎ পহেলা বা পয়লা শব্দ থেকেই পয়রা, পরে পয়ড়া বা পায়রা। অর্থ অনুমেয়। পদবীর রাজ্যে আরো আছে: কখিল্যা, মেইকাপ।
মেইকাপ কি সাম্প্রতিক পদবী: একশো বছরের মধ্যে এসে থাকলে অবশ্যই মেকআপ ম্যান। থিয়েটারে বা যাত্রায়।
খাটিক শুধু, খাটাখাটি থেকে আসতে পারে, খাটিয়ে অর্থে। আবার ঘরবাড়ি তৈরি করতো যারা, তারা ছিল কোটক।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও শাসক পরিবর্তনের সুযোগ গ্রহণ করে আর্থিক উন্নতি ঘটানোর মধ্যেই আভিজাত্য গড়ে ওঠে। ইংরেজি শিক্ষায় অন্যান্য জাতির যে অক্ষমতা ছিল না, স্বাধীনতার পর তা প্রমাণিত হয়েছে। ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিজ্ঞানে বর্ণহিন্দু, তিরিশটি জাতিই এখন সমান প্রাগ্রসরমান। এই সব পরীক্ষায় বিশেষ গ্রেস মার্কের সুযোগ না থাকলেও তপশীলীরাও প্রভূত সংখ্যায় উত্তীর্ণ হচ্ছেন। এবং ভারতের বাইরে চাকুরিক্ষেত্রে তাঁদের প্রাধান্য স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কারণ বহির্বিশ্বে জাতিগত বা পদবীগত কোন অসুবিধা নেই।
বিভিন্ন শাস্ত্রে ও পুরাণে বিভিন্ন বর্ণ ও জাতির যে-ভাবে স্থান নির্দেশ করা হয়েছিল তার মধ্যে প্রভূত পরস্পরবিরোধিতা থেকে প্রমাণ হয় যে বর্ণভেদ ও জাতিভেদ বিষয়ে শাস্ত্রকার ব্রাহ্মণদের স্থানীয় সৎ বা অসৎ ইচ্ছা বা কামনাই প্রকাশ পেয়েছে, প্রকৃতক্ষেত্রে সমাজে তার প্রভাব কিন্তু বিশেষ ছিল না। এমন কি ইংরেজ আগমনের প্রথম যুগে ও কোলকাতা শহর পত্তনের পরবর্তীকালে বাঙালী সমাজে জাতিভেদ তেমন প্রখর ছিল না। পুরোহিত সম্প্রদায় হওয়ার ফলে শ্রেণীবিশেষের ব্রাহ্মণরা পার্থক্য বজায় রাখলেও কায়স্থাদি অবশিষ্ট সমাজ ব্রাহ্মণের দৃষ্টিতেই নয়, সামাজিক ব্যবহারেও এক গোত্রভুক্ত ছিল। উচ্চনীচ ভেদাভেদ তখনো স্পষ্ট চেহারা নেয় নি। কারণ ইংরেজী শিক্ষা ও ইংরেজের চাকরি পাওয়ার আগে অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্রাহ্মণ সহ সব জাতিই ছিল এক পর্যায়ভুক্ত।
নামের সঙ্গে পদবীর বদলে বা পদবীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে জাতি- পরিচয়টি ব্যবহৃত হওয়ার রীতি ছিল সেকালে। নামের সঙ্গে জাতি- পরিচয় প্রকাশ করা কেবলমাত্র তথাকথিত অনুচ্চবর্ণ বা উপান্তবর্তী জাতির বিশেষত্ব ছিল না। বড়ু চণ্ডীদাস বা দ্বিজ চণ্ডীদাস যেমন বর্ণ বহন করেছেন, পদবীর সঙ্গে বা পদবী ব্যতিরেকেও ‘কায়েত’ শব্দও তেমনই পদবীর স্থানে উল্লিখিত হয়েছে, বৈদ্য তো অবশ্যই, এবং বৈদ্য এখনো পদবী হিসেবেও পাওয়া যায়।
সেকালে পদবীর স্থানে অন্যান্য জাতিনামের মতই ধোপা ধূপী ধাবক ও রজক শব্দের চল ছিল জাতিবিশেষের মধ্যে। ধোপা বলতে আমরা আজকাল যে বৃত্তি মনে করি, আদিতে তাদের সে বৃত্তি ছিল না বলেই মনে হয়। বৃহদ্ধর্মপুরাণে ‘রজক’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও চণ্ডীদাস-কাহিনীতে রামীকে কাপড় কাচতে দেখানো হয়েছে এবং কাপড় কাচার উল্লেখ করে গানও রামীর নামে প্রচলিত, তবু প্রশ্ন জাগে ইংরেজ আগমনের আগে গ্রামসমাজে বাঙালী যে দুরবস্থার মধ্যে ছিল এবং যখন আট হাত শাড়ি আর পেট ভরা ভাত কামনা করতো, এবং যে-যুগে জমিদার ছিল না, সেই যুগে বৃত্তি হিসেবে আধুনিক অর্থে রজকের কাজ কেউ গ্রহণ করতো কিনা। কারণ তার চাহিদা ছিল অত্যন্ত অল্প।
আসলে রজক শব্দটি এসেছে বোধহয় রঞ্জক থেকে। কাপড় রঙ করতো তারা। রংরেজ বলতে যা বোঝায়। সাধারণত নতুন কাপড় রঙ করার কাজে তন্তুবায়দের সাহায্য করতো তারা, এবং কিছু, সম্ভ্রান্ত পরিবারের শাড়ি রঙ করে দিতো। পুরনো দিনের কিছু কিছু আত্ম- জীবনীতে দেখা যাচ্ছে এক শতক আগেও ধনী গৃহিণীরা ধোপর কাছ থেকে শাড়ি কিনছেন। অবশ্যই নতুন শাড়ি। মনে হয় কার্পাসতাঁতী বা রেশমতাঁতিদের কাছ থেকে কাপড় নিয়ে তারা রঙ করতো বা রঙ ছাপ দিতো। রঞ্জক থেকে রজক কি করে ধোপা হল, প্রশ্ন উঠতে পারে। মধ্যযুগের কবি ধোয়ী। ধোয়া বোঝাতে ধোয়ী। ধোয়ী ধোবী হয়ে ধোপী ও ধোপায় পৌঁছলো। কাপড় ধোয়ার কাজটাও ছিল একালের ব্লিচিং। এরা সম্ভবত তাঁতিদের কাছ থেকে কোড়া কাপড় নিয়ে প্রথমে ধুয়ে সাদা করতো ও পরে তাকে রঙে ছোপাতো। পরে রঙের কাজ কমে গিয় শুধু শাড়ি ধুয়ে সাদা করে দিতো। এদের আর্থিক অবনতি ঘটলো তন্তুবায়দের সঙ্গে সঙ্গে, বিদেশী বস্ত্র আমদানির ফলে। তখন গৃহস্থের ব্যবহার করা বস্ত্র ধুয়ে পরিষ্কার করাই বৃত্তি দাঁড়ালো। সে- কারণেই বৃহদ্ধর্মপুরাণে বা ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে রজকের স্থান খুব একটা নীচে নয়। তবে মোগলযুগে মুসলমান অভিজাতরাই অর্থবান ও সভ্রান্ত ছিল, এবং তার প্রকৃষ্ট বিলাসীও ছিল। রজকরা তাদের সংস্পর্শে এসেছিল। কাপড় ধোয়ার কাজের জন্য। পরবর্তীকালে তাদের আসন নির্দেশ সে-কারণেও হতে পারে।
যাই হোক্, প্রাচীন পুথিপত্রে পদবীর স্থানে ধোপা ধূপী ধাবক ও রজক শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। ‘চাষাধোবা’ কিন্তু তপশীলভুক্ত জাতি নয়।
পুরনো দিনের পুথিপত্রে যে সামাজিক ছবি পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা যায় রজক ধাবক তাঁতি ময়রা অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে উন্নত। অন্যদিকে দুস্থ অথচ শিক্ষিত লিপিকার, যাঁরা পুথি নকল করছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছে সেন, দে, ধুপী, বৈদ্য, দত্ত, মজুমদার, কর্মকার, পট্টনায়েক।
যে অর্থবান পাঠকরা পুথি নকল করিয়েছেন তাঁদের মধ্যে কয়েকটি নাম: লক্ষীনারায়ণ রজক, বিপ্রচরণ ধাবক, বোষ্টমচরণ তাঁতি, আত্মারাম হাসি তাঁতি, গদাইচন্দ্র ময়রা, যজ্ঞেশ্বর সূত্রধর, যদু লাই, মথুর সরদার, দীনদয়াল পড়া, রামচন্দ্র যুগী, গোরাচাঁদ লো, হিরু মাঝি, নিমু কলু সীতারাম বারিক, রঘুনাথ সু শক্তিরাম বাগদী প্রভৃতি।
দুঃখ লিপিকার, যাঁরা পুথি নকল করে দিয়ে দু’ আনা চার আনা পয়সা পেতেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছে মহানন্দ রায়, নবদ্বীপচন্দ্র সেন, বাঞ্ছারাম দে, কানাই সরকার, পঞ্চানন দাস বৈদ্য, গুরুচরণ দত্ত, রামধন দত্ত, অর্জুনদাস পণ্ডিত কর্মকার, দুর্গাচরণ পরামাণিক, রঘুনাথ ভূঞা- মালি, মথুরামোহন হাজরা, পরশুরাম ঘোষ, তিলকরাম নন্দী, মধুসূদন দেঘুরা, পতিত পট্টনায়েক প্রভৃতি।
এই চিত্রটি দেখে পুনরায় প্রমাণিত হয় যে ইংরেজ আসার আগে, মাতৃভাষা বাংলা যখন ছিল পঠনপাঠনের মাধ্যম, তখন সমাজের সর্বস্তরেই শিক্ষার প্রচলন ছিল। জাতি হিসেবে কেউ নিরক্ষর ছিল না। এবং এও প্রমাণিত হয় যে তথাকথিত নিম্নজাতিও ছিল অর্থবান। সুতরাং তাদের ঐসব পদবীর মর্যাদাও তখন ছিল। অন্যদিকে রায় সেন দে দত্ত দাসবৈদ্য মজুমদার ঘোষ নন্দী প্রভৃতি নকলকারদের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না।
ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ নিয়ে, ইংরেজের পৃষ্ঠপোষকতায় ইংরেজের চাকরি পেয়ে একদিকে কোন কোন জাতির, সামাজিক উন্নতি ঘটলো, বাদবাকি সমাজ ইংরেজি শিক্ষা পেল না, উপরন্তু মাতৃভাষা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ায় তার চর্চা ছেড়ে দিয়ে নিরক্ষর হয়ে গেল। আর্থিক অবনতির ফলে সাংস্কৃতিক অবনতিও ঘটে গেল। পার্থক্য রচিত হল জাতিতে জাতিতে, উচ্চনীচ ভেদ শুরু হল, এবং জাতি-সাম্প্রদায়িকতা। আমরা মনে করতে শুরু করলাম যেন বর্তমানের চিত্রটিই চিরন্তন বাঙালী সমাজের চিত্র।
আপাতত এই পুরুষপ্রধান আলোচনার উপসংহারে একবার অপাঙ্গে দৃষ্টিপাত করা যাক সেকালীন রমণীরত্নদের দিকে।
ঋগ্বেদে দেবপত্নীরা সমষ্টি হিসেবে উপস্থিত হন। ব্যক্তিবিবাহ এবং ব্যক্তিগত পরিবার সিন্ধুসভ্যতায় ছিল, কিন্তু প্রথমপর্বে আর্য দেবপত্নীদের গোষ্ঠীপত্নী রূপেই পরিচয় ছিল কিনা নিঃসন্দেহে বলা যায় না। দেবতাদের পত্নীরা দেবী হয়েছেন যথাসময়ে। এবং দাস স্ত্রীলোকরা আর্যপত্নী হলেও কখনো কখনো দাসী, যে-হেতু বারংবার ঋষিদের দাসী- পুত্র বলে অবজ্ঞাও করা হয়েছে। বর্তমানে যেমন মেয়েরা প্রথমে পিতার পদবী পায়, বিবাহের পর স্বামীর, অনেকে তো পূর্ব পদবীই রক্ষা করেন, কিছুকাল আগেও কিন্তু মেয়েদের কোন পদবী থাকতো না। ব্রাহ্মণ মেয়েদের উপনয়নতুল্য কোন দ্বিজত্বপ্রাপ্তির অনুষ্ঠানও ছিল না। আর্যপত্নীরা আর্য ছিলেন না বলে? অথবা নারী অমল্য, অতএব মূল্য- হীন বলে? অথবা বিবাহই নারীর দ্বিতীয় জন্ম, এই ধারণায়?
লক্ষ্য করার বিষয় যে আর্য, দেব এবং ব্রাহ্মণ এক সময়ে সমার্থক হয়ে দাঁড়ালেও রাজা ও সম্রাটরা প্রায় ক্ষেত্রেই দেব শব্দটি কোন না কোন ভাবে নামের সঙ্গে যুক্ত রাখতেন। রানীদের নামেও পাওয়া যায় দেবী। চতুর্থ শতাব্দীর উদয়কালেও চন্দ্রগুপ্ত (মৌর্য নন) লিচ্ছবি ট্রাইবের রাজকন্যা কুমারীদেবীকে বিবাহ করেন, এবং মুদ্রায় কুমারীদেবী নামটিও উৎকীর্ণ। এমন দৃষ্টান্ত আরো অনেক পাওয়া যাবে। আর্যরা তো ছিলেন যোদ্ধাজাতি, এবং তাঁরাই দেবগোষ্ঠী। সুতরাং রাজা বা তাঁর পত্নীর দেবীত্বে অধিকার স্বাভাবিক। আদিতে দেব ব্রাহ্মণ বলতে বোঝাতো রাজা এবং ব্রাহ্মণ। প্রজাকে রাজার বশীভূত করার কাজে ব্রাহ্মণের দান ছিল অপরিসীম। পরিবর্তে ব্রাহ্মণও অপরিসীম অর্থ ও ভূমিদান পেতেন। মাঝে মাঝে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ শক্তিপরীক্ষায় নামলেও সাধারণ- ভাবে পরস্পর ছিল পরস্পরের পরিপূরক।
কিন্তু পরে দেব ও ব্রাহ্মণ কিভাবে সমার্থক হয়ে দাঁড়ালো গবেষণার বিষয়। আর সেজন্যই ব্রাহ্মণপত্নীদের উপাধি-পদবী হল দেবী।
ব্রাহ্মণরা বাংলাদেশে অন্য সমস্ত জাতিকে শূদ্র ও সংকর অভিধা দিয়ে তাদের স্ত্রীদের পদবী দেন দাসী। শতবর্ষ আগেও অব্রাহ্মণ বহু বিখ্যাতা রমণীর নামের শেষে পদবী দাসী, যদিও বর্তমানে তা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। সেকালে কায়স্থ জাতির বিবাহিত রমণীরাও ছিলেন দাসী। পঞ্চাশ বছর আগেও বহু বিখ্যাত কায়থ রমণী নামের শেষে দাসী লিখতেন।
দেবী ও দাসী রমণীদের প্রায় পদবীই ছিল বলা যায়। আবার ইতিহাসে দেখি ‘রক্ষিতা’ও নারীর নামের সঙ্গে যুক্ত, অবশ্যই বর্তমান অর্থে নয়। তিষ্যরক্ষিতা নামটি সকলেরই পরিচিত, বিশেষ করে সম্রাট অশোকের পুত্র কুণাল-কাহিনীর জন্য। কিন্তু তিনি সম্রাটের প্রধান্য না হলেও মহিষীই ছিলেন। সিংহলী পঞ্জীতে তিষ্য নামে এক রাজার উল্লেখ আছে, এবং সেখানে বলা হয়েছে সিংহলরাজ তিষ্য অশোকের বশ্যতা স্বীকার করেন। তিষ্যরক্ষিতা হয়তো তাঁরই কন্যা বা ভগিনী। সিংহল- রাজ তিষ্য বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে নাম গ্রহণ করেন দেবানামপিয় তিষ্য। পিয়দসী সম্রাট অশোকও দেবানামপিয় অর্থাৎ দেবতার প্রিয়। যাই হোক, অনুমান করা যায় প্রধানা মহিষী বা পাটরানী ছাড়া ঐ সময়ে অন্য রাজপত্নীদের পদবী হত ভিন্ন। তবে এ ধরনের আরো কিছু দৃষ্টান্ত পাওয়া না গেলে এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। যদিচ মনে রাখা দরকার, তিষ্যরক্ষিতার সন্তানও সম্রাট অশোকের সাম্রাজ্যে অংশবিশেষের উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন। বৌদ্ধসাহিত্যের ‘মহাবস্তু’ রাজা ওক্কস অর্থাৎ ইক্ষাকুর দ্বিতীয় স্ত্রীকে রক্ষিত বলেছে। সম্ভবত অভিষেক- প্রাপ্তা রানী ব্যতীত অন্যেরা তৎকালে-সম্মানজনক রক্ষিতা পদবী বা নামান্ত ব্যবহার করতেন।
বঙ্গদেশে শেষ অবধি দেবী ও দাসী টিকে থাকে। কিন্তু বর্তমানে দাসী সম্পূর্ণ লুপ্ত। এখন সকলেই দেবী।
এছাড়া কিছু পুরাতনী সাক্ষ্য আছে বিবাহিতা নারীদের দেবী বা দাসীর পরিবর্তে গুপ্তা ব্যবহারের। তেমনই অপ্রাচীন, সম্ভবত অর্বাচীন সাক্ষ্য আছে চৌধুরাণী বা দেবী চৌধুরাণী ব্যবহারের। প্রাচীন ঐতিহ্য অনুযায়ী ভূস্বামীরা নিজেদের দেব ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলেন, অতএব জমিদারগৃহিণীরা দেবী চৌধুরাণী হবেন না কেন! যদিও মোগলযুগের কর্মচারী কর আদায় করে মোগল শাসকের হাতে তুলে দিতেন, ইংরেজ আমলের জমিদাররা দিতেন ইংরেজ শাসকদের হাতে। আর এই দেবী চৌধুরাণী পদবীর সঙ্গে পাল্লা দেবার জন্যই ‘রায়বাঘিনী’ শব্দটি সৃষ্টি হয়, কৌতুক হিসেবেই, পদবী হিসেবে কদাপি নয়। লৌকিক দেবতার নাম থেকে এটির উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। যাই হোক বর্তমানে নারী মানেই দেবী। এবং পুরুষ মানেই দেব, অন্তত স্ত্রীদের কাছে। সাক্ষ্য: পতিদেবতা। বর্তমানে অবশ্য দেবীও প্রায় লুপ্ত, কদাচিৎ তাঁদের দেখা মেলে। এখন পিতা বা পতির পদবীর দ্বারাই মেয়েরা চিহ্নিত, যদিও কেউ কেউ পিতা ও পতির উভয় পদবীকেই যুক্ত করে বসুগুপ্ত, কর- মজুমদার, দাসগুহ ইত্যাদি পরিচয় বহন করতে আগ্রহী।
অতএব উপসংহারে বলা যায়, বাঙালীর পদবী নানা বিচিত্র পথে সৃষ্ট হয়েছে, তার কোন সরলীকরণ সম্ভব নয়। হয়তো একই গোষ্ঠীর মানুষ স্থানান্তরে গিয়ে বৃত্তি বদল করে বিভিন্ন জাতির মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে, জাতির মধ্যে সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন শ্রেণী, প্রতিযোগিতায় যে শ্রেণী আর্থিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে উন্নত হয়েছে তারাই হয়ে দাঁড়িয়েছে কুলীন। পুরাতন পদবী ছাড়েনি বলেই বিভিন্ন জাতির মধ্যে সেই একই পদবীর উপস্থিতি। কয়েক পুরুষ আর্থিক আরোহণ ঘটলে পদবীকে সংস্কৃত রূপ দেওয়া হয়েছে বা কেউ সাংস্কৃতিক মানের পদবী গ্রহণ করেছেন। আর্থিক অবরোহণ তাঁকে সমাজের নীচে নামিয়ে দিলে তাঁর সুসংস্কৃত বা অর্থপূণ পদবী অপভ্রংশিত হয়ে অর্থহীন দেশজ চেহারা নিয়েছে। কোন কোন পদবীর অধিকারী পুরুষানুক্রমে সম্পদ- শালী এবং সংস্কৃতিবান হয়ে উঠলেও পুরাতন পদবীর সঙ্গে কোন গ্রাম ও অঞ্চলের অতীত প্রতিপত্তি প্রায় প্রবাদতুল্য রয়ে গেছে বলেও তাঁরা সেই পদবীটিকেই রক্ষা করে আসছেন। আবার অনেক পদবী হয়তো ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এসেছে। বাঙালীর ইতিহাসই তো বহিরাগতের সঙ্গে দেশজ মানুষের মহামিলনের ইতিহাস। যুদ্ধে, আক্রমণে, উপার্জনের আশায়, কুশলী কারুশিল্পী হিসেবে. বাণিজ্যের প্রয়োজনে, রাজার আমন্ত্রণে, ভারতের এবং বিদেশের বহু গোষ্ঠীর মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে বাংলার মাটিতে চিরস্থায়ী হয়েছে। বাংলায় ভোট-তিব্বত বা কর্ণাট অন্ধ্র থেকে সসৈন্যে রাজারা এসে তিনটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছেন, রাজত্ব করেছেন কয়েক শতক ধরে, তাঁদের সৈন্যরা সকলেই কি সদাচারী ছিল? যারা বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে, ভাষা দিয়েছে এবং ভাষা নিয়েছে, তার মধ্যে শক হুন দল পাঠান মোগল ছিল, উত্তর-পূর্বের পার্বত্য মানুষ ছিল, দক্ষিণের ভাগ্যান্বেষী ছিল, আদিশূর বল্লালসেনও তো দক্ষিণের, ছিল বোম্বেটে পর্তুগীজ, বণিক ওলন্দাজ ডাচ, ফরাসী ও ইংরেজ। যদি কোথাও কোন আদি বিশুদ্ধ অকৃত্রিম শোণিতস্রোত থাকতো, তাও এত রক্ত ও হানাহানি, ধর্ষণ ও গোপন প্রেম, দারিদ্র ও অভাবের কেনাবেচায়, শরীরের ক্ষুধায় মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। কুলদোষ মেলবন্ধনে তার ইঙ্গিতটুকুই পাওয়া যায়, সামগ্রিক ছবিটা ফুটে ওঠে না। সমস্ত বর্ণ ও জাতির ইতিহাস একই।
তাই সব শেষে এটুকুই মনে রাখা প্রয়োজন, কোন পদবীরই চির- স্থায়ী কৌলীন্য নেই, কোন পদবীই সাংস্কৃতিক দিক থেকে অন্ত্যজ নয়। পদবীর কোন জাতি নেই। আমরা শুধুই একটি দেশভাগ দেখেছি। লক্ষ লক্ষ মানুষ ছিন্নমূল হয়ে একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এসেছে। ইতিহাসে এমন বিপর্যয় ঘন ঘন ঘটেছে, এক রাজার অত্যাচারে আরেক রাজার কাছে আশ্রয় নিয়েছে শত সহস্র মানুষ। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ছুটে পালিয়ে এসেছে, কখনো বর্গীর অত্যাচারে, কখনো মোগল সৈন্যের ভয়ে, কখনো পর্তুগীজ বোম্বেটে কিংবা বাঙালী ভুইঞাদের অত্যাচারে। বর্মী মগ থেকে সারা পূর্বোত্তর পাবত্য এলাকা, ভোট ও নেপালও আমাদের শরীরে রক্ত মিশিয়েছে, দিয়েছে বর্ণও। দ্রাবিড় ও এ প্রান্তের উপজাতিদের কাছেও আমরা ঋণী। মিলেমিশে উত্তর ভারতের সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে ত্রিবেণী সঙ্গম, আমাদের এই বাংলাদেশেই। দারিদ্র্য ও অভাবে বিস্মত-যুগে এত পার্থক্য এত প্রাচীর ছিল না। আজ এমন কোন মাইক্রোস্কোপ নেই যা মানুষের রক্তমিশ্রণ খুজে বের করতে পারে, এমন কোন ভাষা-চার্চিক নেই যিনি নিঃসন্দেহে ভাষার ইতিহাস খুঁজে বের করে পদবীর পদাধিকার প্রতিপন্ন করতে পারবেন। তার চেয়ে সব পদবীকে স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। কারণ, আমরা তো জানি না রাষ্ট্রীয় শক্তি ও ধনতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা কাকে উচ্চকোটিতে তুলে দেবে। আমরা জানি না অপাঙক্তেয় কোন পদবী আগামীকাল বিজ্ঞানের কোন ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে বাঙালীকে সম্মানের শিরোপা এনে দিয়ে পদবীটিকেও বিশ্ববরেণ্য করে দেবে কিনা। তৎকালে বাঙালীর বহু কুলীন পদবী থাকা সত্ত্বেও একটি মাত্র পিরালী পরিবারের ঠাকুর পদবীর জন্য বাঙালী আজ বিশ্বসভায় গর্বিত।
মানুষের প্রধান পরিচয় অতীত নয়, বর্তমান।