পদবীর রাজনীতি ও অর্থনীতি
ভারতে তিন হাজারেরও বেশি জাতি আছে। শুধু, ব্রাহ্মণদেরই শ্রেণীর (জাতির ?) সংখ্যা প্রায় তিনশো। নতুন নতুন জাতি কিন্তু এখনো গড়ে উঠছে। দেখা যায় যে-জাতির জনসংখ্যা বেশি, সেই জাতির উপরতলা যদি আর্থিক কৌলীন্যবশত শিক্ষিত হয়ে ওঠে এবং সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সেই সমগ্র জাতির সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদা উন্নত হয়। যে-সব জাতির জনসংখ্যা খুবই কম, সীমিত পদবী ব্যবহারের ফলে তারাও সহজেই চিহ্নিত হয়।
কোশাম্বী বলেছেন:
The relative status of the small local castes depends always upon the extent of, and the castes economic position in the common market
সারা ভারতেই একথা সত্য। আদি পদবী ত্যাগ করে সীমিত সংখ্যক জাতিসূচক পদবী ব্যবহারের প্রবণতা সম্ভবত সেকারণেই। তার সূচনাও হয় কয়েক শতাব্দী আগেই। এর আড়ালে ছিল সামাজিক মর্যাদা আদায়ের জন্য বিভিন্ন বর্ণ বা জাতির মধ্যে প্রতিযোগিতা। কিংবা বর্ণ বা জাতির বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে প্রতিযোগিতা।
লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে বিশ্বাস ও ভৌমিক বর্তমানে প্রায় জাতি-বাচক পদবী হয়ে ওঠার দিকে। যদিও বিশ্বাস কায়স্থেরও পদবী।
সাধারণভাবে ব্রাহ্মণরা নিজের বর্ণের পরিচয় দেন, কখনো শ্রেণী কিংবা জাতিবাচক শব্দটিও বর্ণজ্ঞাপক ব্রাহ্মণ শব্দের সঙ্গে যুক্ত করেন। উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয়রাও এই রীতি অনুসরণ করেন। জাতিনাম গড়ে ওঠে বৃত্তি থেকে, কিন্তু উপাধ্যায়, ভট্টাচার্য, ঘটক, পাঠক ইত্যাদি শুধু পদবীতে পরিণত হয়েছে, এগুলি জাতিনাম হয়ে ওঠেনি। কারণ বর্ণ- জ্ঞাপনের মধ্যে কিছু কিছু সামাজিক সুবিধা ছিল। ব্রাহ্মণদের প্রত্যেক শ্রেণীই নিজেদের অপরাপর ব্রাহ্মণ শ্রেণী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। কিন্তু দেখা যায় আর্থিক কৌলীন্য বা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ফলে, অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ফলে এক এক যুগে এক এক শ্রেণী সমাজের কাছে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পেয়েছে। এক সময়ে যে-শ্রেণীর ব্রাহ্মণ সামাজিক বা রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সাত্ত্বিক উচ্চাসন পেয়েছে, অন্য সময়ে সেই পৃষ্ঠ-পোষকতার অভাবে তার স্থান নেমে এসেছে। প্রাচীন ইতিহাসেই দেখা যায় বিভিন্ন শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের মধ্যে উচ্চাসন পাওয়ার প্রতিযোগিতা অব্যাহত ছিল। অন্যান্য বর্ণ ও জাতির ক্ষেত্রেও তা সমান সত্য। ইংরেজ পণ্ডিতরাও তা লক্ষ্য করেছিলেন। তার জন্য সৃষ্টি হয়েছে নানা জনপ্রবাদ, কুলজী-গ্রন্থ, এমন কি শাস্ত্র পুরাণাদিও লেখানো হয়েছিল। প্রভূত পরস্পর বিরোধিতা থেকেই তা অনুমান করা যায়।
অনেক সময় ধ্বনিগত মিলকেই প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত করা হয়। কিন্তু স্মরণীয় গুজরাটের মৈত্রক রাজবংশের সঙ্গে মৈত্র পদবীর যোগ নেই। যেমন গুজরাটের মধ্যযুগীয় স্থান নাম হাজিরার সঙ্গে হাজরা পদবীর যোগ নেই। আগেই বলেছি হাজরা মনসবদারী উপাধি, রায় চৌধুরী সরকার মজুমদার খাঁর মতই। সে-কারণেই এগুলির মত হাজরা ব্রাহ্মণ কায়স্থাদি বহু জাতিরই পদবী।
আবার একই ধাঁচের শব্দও বিভ্রম ঘটায়। একালের ফেরিওলার ‘ওলা’ যেমন বহু শব্দেই যোগ করা হয়, মোগল যুগে তেমনই ‘—দার’। কিন্তু খরিদদার বাজনদার পাওনাদার ইত্যাদি চাকলাদার দফাদার তপাদার-এর মত পদবী নয়।
এখন পূর্ব কথায় ফিরে আসা যাক। গোয়া এবং কানাড়াতেও এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ দাবী করে যে তারা উত্তর ভারত (কান্যকুব্জ) থেকে এসেছিল এবং সে-কারণেই তারা অন্যান্য স্থানীয় ব্রাহ্মণদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। স্কন্দ-পুরাণে তার উল্লেখও আছে। তুলনীয়—বাংলাদেশে পঞ্চব্রাহ্মণ কাহিনী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী তার সংখ্যা বর্তমানে কোন্ অঙ্কে পৌঁছতে পারে উপস্থিত তার হিসেব উপেক্ষা করা যাক।
কোন্ দেশ থেকে পঞ্চব্রাহ্মণের আগমন ঘটে সে-বিষয়েও মতদ্বৈধ আছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বিস্তৃতভাবে তার আলোচনা করে গেছেন। হরিমিশ্রর মতে ‘কোলাঞ্চ’ দেশ থেকে তাদের আগমন, বারেন্দ্র- কুলপঞ্জিকায় আছে ‘কান্যকুব্জ’। ‘প্রাচীন কোন কোষগ্রন্থে অথবা শিলা-লিপি বা তাম্রশাসনে কান্যকুব্জের নামান্তর যে কোলাঞ্চ সে প্রসঙ্গ আদৌ নেই।’ বামন শিবরাম আপ্তে এবং মনিয়র উইলিয়মের মতে ‘কোলাঞ্চ’ কলিঙ্গদেশ। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে “কোলাঞ্চল বা কোলাচল শব্দই সংক্ষেপে প্রাচীন কুলগ্ৰন্থসমূহে ‘কোলাঞ্চ’রূপে ব্যবহৃত হইয়াছে। যেখানে কোলগণের বাস, তাহাই কোলাঞ্চ। কোলাঞ্চ ভাগবতে কোল্লক (৫। ১৯। ১৬) এবং মহাভারতে কোল্লগিরি (২। ৩১। ৬৮) কোল্লগিরেয় (১৪। ৮৩। ১১) নামে উল্লিখিত হইয়াছে।” সেকালে নগেন্দ্রনাথ বসুর বক্তব্য অপ্রমাণ করে রাখালদাস লিখেছেন, “বসুজ মহাশয় যখন স্পষ্ট স্বীকার করিয়া লইয়াছেন যে কোলাঞ্চ কান্যকুব্জ নহে, তখন কান্যকুব্জ হইতে ব্রাহ্মণ আগমন কিরূপে স্বীকার করা যাইতে পারে ?” অন্যত্র তিনি লিখেছেন: “বর্তমান সময়ে কুলশাস্ত্রসমূহে রাশি রাশি ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু নূতন ঐতিহাসিক আবিষ্কারের আলোকে তৎসমুদয় প্রক্ষিপ্ত প্রমাণ হইতেছে।” তাঁর সিদ্ধান্ত : “সাধারণতঃ কুলশাস্ত্রের প্রমাণগুলি অসত্য বলিয়া বোধ হয়। অনুমান হয় যে প্রাচীন জনপ্রবাদ লইয়া কুলশাস্ত্র রচিত হইয়াছিল।”
কান্যকুব্জ বিষয়ে আধুনিক ঐতিহাসিকদের কোন সিদ্ধান্ত আমার চোখে পড়েনি। তবে জনপ্রবাদকে একেবারে ভিত্তিহীন মনে করারও কারণ নেই। তবে পূর্বে উল্লিখিত কোলাঞ্চ বা কোল্লগিরি কলিঙ্গে বা কোলদিগের বাসস্থানে নির্দেশ করার পূর্বে স্মরণ রাখা কর্ত্তব্য যে কপিলাবস্তুতে শাক্যদের বিবদমান প্রতিবেশী হিসেবে যে কোলীয় ট্রাইবের বাস ছিল তারাই সম্ভবত কোল বা কোল্ল। সেক্ষেত্রে হিমালয়ের ঐ অংশ ছিল কোলাঞ্চ বা কোল্লগিরি।
রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘জীবনের স্মৃতিদীপে’ গ্রন্থটিতে লিখেছেন: ‘আমাদের দেশে কুলজীগ্রন্থে আছে যে মহারাজা আদিশূরই সর্বপ্রথম বাংলাদেশে যে কয়জন ব্রাহ্মণ এবং কায়স্থদের নিয়ে আসেন তাঁদের বংশ-ধরেরাই পরে কুলীন ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের মর্যাদা পান। অক্ষয়বাবু (মৈত্র), রমাপ্রসাদবাবু (চন্দ্র) এবং রাখালবাবু (বন্দ্যোপাধ্যায়) এই কিংবদন্তী বিশ্বাস করতেন না। এমন কি রাজা আদিশূরের অস্তিত্ব পর্যন্ত তাঁরা অস্বীকার করতেন।’ হরি মিশ্রের কারিকা ও এড়ু মিশ্রের কারিকায় আদিশূরের উল্লেখ দেখেছেন এই দাবীর পক্ষে নগেন্দ্রনাথ বসু যে শ্লোক উদ্ধত করেন, ‘দেখা গেল ঐ পুথিঁতে নগেন্দ্রবাবু, কথিত অনেক শ্লোকই আছে। কিন্তু আদিশূর সম্পর্কে শ্লোককয়টি একেবারেই নেই। রাখালদাস বলতেন এবং অনেকেরই বিশ্বাস ছিল যে নগেন্দ্রবাবু পুথিঁ জাল করতেন।’ ‘জাল’: শব্দটির প্রয়োগ এখানে অবশ্য অনুচিত।
সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিই পঞ্চব্রাহ্মণ কাহিনীর উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপের উদ্দেশ্য ছিল কিনা সে বিচার-বিশ্লেষণে প্রয়োজন নেই। কিন্তু সারা ভারতের প্রত্যেক অঞ্চলেই এক এক’শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবী স্বীকৃত হয়েছে নানাবিধ কাহিনীর উপর নির্ভর করে। পুরাকালে রাজা ও সম্রাটদের মধ্যেও এই প্রবণতা ছিল, ক্ষত্রিয়দের মধ্যে এক বিশেষ শ্রেণীর ক্ষত্রিয় হবার জন্য অথবা ভিন্ন বর্ণ থেকে ক্ষত্রিয়ে উত্তীর্ণ হবার জন্য। আধুনিক কালেও বৈদ্য জাতি ব্রাহ্মণত্ব দাবী করেছেন, সেনসাস রিপোর্টকেও বৈদ্য নামের সঙ্গে ‘বৈদ্য ব্রাহ্মণ’ ও ‘ব্রাহ্মণ বৈদ্য’ নামকরণের স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল। কায়স্থ জাতি (করণ) মনুর মতে ব্রাত্যক্ষত্রিয় হলেও তার দাবী ছিল শুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের। ব্রাত্য শব্দের আদি অর্থ ছিল, মনে হয় ব্রতপরায়ণ, সুতরাং যজ্ঞবিরোধী। সেজন্যই আর্য দৃষ্টিতে তার অর্থ দাঁড়ায় ‘পতিত’। শাস্ত্রমতে অব্রাহ্মণ বাঙালী মাত্রেই শূদ্র। অবশ্য বহু জাতি ক্ষত্রিয়ত্ব দাবী করে। কিন্তু সমুদয় দাবীর পিছনে কোন যুক্তি নাই। মনুর মতে ও বৃহদ্ধর্মপুরাণে উগ্রক্ষত্রিয় জাতি ক্ষত্রিয় পিতার সন্তান। প্রখ্যাত নৃতাত্ত্বিক রিজলি বাঙালীদের মধ্যে একমাত্র উগ্ৰক্ষত্রিয় জাতিকেই ক্ষত্রিয়ের আসন দিয়েছিলেন, কিন্তু সব শ্রেণীর উগ্রক্ষত্রিয়ের এই ক্ষত্রিয়ত্ব স্বীকার্য নয়। এই জাতির জনসংখ্যা মুষ্টিমেয়, কিন্তু ব্রাহ্মণদের মতই তার বহু অন্তর্বিভাগ ও শ্রেণী, এবং সেই সব শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্বিবাহ নিষিদ্ধ বা অস্বীকৃত। পদবীর দ্বারাও শ্রেণীগুলি চিহ্নিত নয়। একই জাতিভুক্ত বিভিন্ন শ্রেণী যেমন একে অন্যকে অপাঙক্তেয় মনে করে, তেমনই একই পর্যায়ভুক্ত বিভিন্ন জাতি অন্যান্য জাতি অপেক্ষা নিজেকে শ্রেয় প্রতিপন্ন করার প্রয়াসেও অক্লান্ত। দাবী- গুলি সর্বথা অযৌক্তিকও নয়।
কায়স্থদের মধ্যেও অনেকগুলি শ্রেণী পাওয়া যায়, যথা, দক্ষিণ রাঢ়ী, উত্তর রাঢ়ী, বারেন্দ্র, বঙ্গজ, বাহাত্তর ঘর, করণ-কায়স্থ প্রভৃতি। বৈদ্যদের মধ্যেও চারটি মতান্তরে পাঁচটি শ্রেণী আছে। অনেকে মনে করেন কায়স্থ-দের আদিবাস ছিল মেদিনীপুর জেলায়, সেখান থেকে তারা বিভিন্ন অংশে নিজেদের বিস্তৃত করে।
উগ্রক্ষত্রিয়দের মধ্যেও বহু শ্রেণী, যদিও তাদের জনসংখ্যা বৈদ্যদের তুলনাতেও মুষ্টিমেয়। এই জাতির শতকরা আশিভাগের বসতি রাঢ় অঞ্চলে। আবার একদা ঐ-সব অঞ্চলের ভূমি, বাণিজ্য এবং কয়লাখনি ও অভ্রখনিরও আশিভাগেই ছিল এই জাতির আধিপত্য। উগ্ৰক্ষত্রিয় জাতির মধ্যেও সংখ্যাল্পতা সত্ত্বেও অনেকগুলি শ্রেণী, এবং তাদের মধ্যে অন্ত-বির্বাহ ছিল না। শ্রেণীগুলির পরিচয়ও বিভিন্ন, যথা, ১) বৈদিক ক্ষত্রিয় ২) রাঢ়ী ক্ষত্রিয় ৩) জনৌ (উপবীত) শ্রেণী ৪) শ্রোত্রীয় বা শ্ৰুত শ্রেণী ৫) আগ্রহরী বা আগুরির মধ্যে জানা শ্রেণী ও সুত শ্রেণী ৬) আসানসোলী। এখানেও কৌলীন্য বা আসন নির্দেশে কুলজী অপেক্ষা অর্থনৈতিক কারণই প্রধান। শ্রেণীবিন্যাস এক্ষেত্রেও পদবীর দ্বারা চিহ্নিত নয়। মনুসংহিতা ও বৃহদ্ধর্মপুরাণের নৃতাত্ত্বিক নাম উগ্রক্ষত্রিয় পরে বৃত্তিনাম পায় আগ্রহরিক, তা থেকে দেশজ উচ্চারণে অপভ্রংশিত হয়ে আগ্রহরী ও পরে আগরি থেকে আগুরি। ময়ূরভট্টের ধর্মপুরাণে আছে উগ্ৰক্ষেত্ৰী। যাঁরা সম্রাট বা রাজার কাছ থেকে অগ্রহার ভূমি লাভ করতেন তাঁদের বলা হত অগ্রহারীণ। আগ্রহরী বৃত্তিনাম থেকে আগুরি। যেমন নৃতাত্ত্বিক নাম ‘করণ’, পরে বৃত্তিনাম কায়স্থ, অপভ্রংশ কায়েত। বৃহদ্ধর্মপুরাণে সমস্ত জাতিগুলির পরিচয় দেওয়া হয়েছে বৃত্তিজাতি হিসেবে। কেবল করণ অম্বষ্ট উগ্রক্ষত্রিয় নৃতাত্ত্বিক নামে চিহ্নিত ছিল, পরে বৃত্তিজাতি রূপে এই জাতিগুলিরও নামকরণ হয় কায়স্থ, বৈদ্য আগ্রহরিক-তা থেকে চলতি নাম কায়েত, বদ্যি, আগুরি। ।
ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে আর্থিক কৌলীন্য ও শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতির উত্থান এবং তার অভাবে জাতির অবনয়ন ঘটে। অর্থাৎ জাতির স্থান নির্দিষ্ট বা স্থির নয়, নানাবিধ শাস্ত্রপুরাণের সাক্ষ্য সত্ত্বেও। আবার কোন বর্ণহিন্দু, জাতিই উন্নত বা অবনত নয়। প্রত্যেক জাতির মধ্যেই একটি উন্নত শ্রেণী আছে, আর্থিক দিক থেকে, শিক্ষা-দীক্ষায়, রুচিতে। যে জাতির জনসংখ্যা যত বেশি তার উন্নত শ্রেণীও তত পরিপুষ্ট এবং সংখ্যায় অধিক। যে জাতির জনসংখ্যা কম তার উন্নত শ্রেণীর সংখ্যা কম। কিন্তু ব্রাহ্মণ কায়স্থাদি সমস্ত জাতিরই শতকরা আশি ভাগ নিম্নমধ্যবিত্ত বা দরিদ্র, অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত অন্যান্য জাতির সেই অংশের সমপর্যায়ভুক্ত। কুড়ি লক্ষ ব্রাহ্মণ ও আঠারো লক্ষ কায়স্থের মধ্যে বড় জোর একচতুর্থাংশকে পদবী মারফৎ চিহ্নিত করে শিক্ষিত সমাজে আমরা দেখতে পাই, কিন্তু তিন-চতুর্থাংশই এখনো দারিদ্র্যবশত তিমিরাচ্ছন্ন। অন্যান্য সমস্ত জাতিরই প্রায় সমপরিমাণ অংশ উন্নত ও অবনত। সমুদ্রপোতের দৃশ্যগোচর অংশের মত এই উন্নত শ্রেণীই ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের বা অন্যান্য বর্ণহিন্দু, জাতির প্রকৃত পরিচয় নয়, একথা অনুন্নত তপশীলভুক্ত জাতিগুলির স্মরণ রাখা উচিত।
কৌলীন্যও দেখা যাবে আর্থিক উন্নতির উপর নির্ভরশীল।
এক এক যুগে কোন কোন জাতি বা বর্ণের মুষ্টিমেয় ব্যক্তি বা পরিবার রাষ্ট্রের বা সমাজের অর্থানুকুল্য লাভ করে, ভূমিদান, রাজকর্ম বা বাণিজ্য-অধিকার থেকে। ফলে তাদের রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বাড়ে, শিক্ষা উন্নত হবার সুযোগ আসে, রুচি পরিবর্তিত হয়। তখন সেই সমগ্র জাতি বা বর্ণের পদোন্নতি ঘটে, এবং সেই মুষ্টিমেয় পরিবার নিয়ে যে শ্রেণী গঠিত হয়, তারাই হয়ে দাঁড়ায় কুলীন। রাষ্ট্রক্ষমতা বা অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পতন ঘটে, প্রতিপত্তি বাড়ে অন্য শ্রেণীর। কৌলীন্যর হাত বদল হয়। [ প্রাসঙ্গিক: বৈদিক ব্রাহ্মণ, রাঢ়ী ব্রাহ্মণ ]
ঋগ্বেদের সাক্ষ্য থেকে অনুমান করা হয়েছে যে, সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টারা ছিলেন পণি ও দসি। এই পণি থেকে পণ ও পণ্য। পণ পরবর্তী কালে মুদ্রারও নাম। পণি এই ঋগ্বেদীয় নামকরণ হয়তো আসলে দ্রাবিড় বা অস্ট্রিকভাষীদের দেওয়া আত্মপরিচয়। পণি পরবতীকালে বণিক। (ফিনিসীয়দের গ্রীক ভাষায় বলা হত ফনিক।) এই বণিকরাই ছিল সিন্ধু সমাজের সর্বোচ্চ জাতি বা শ্রেণী। সিন্ধুজন পণিরা বাণিজ্য করতো। পরে দেখা যায় সিন্ধুপ্রদেশ, মারোয়াড় ও গুজরাট অঞ্চলের ‘বেনিয়া’ সম্প্রদায় ভারতে ও ভারতের বাইরেও বাণিজ্যিক প্রাধান্য বজায় রেখেছিল। যে-সব পার্শিরা পারস্য থেকে ধর্মান্তরের ভয়ে চলে আসে, এই অঞ্চলে তারাও বাণিজ্যে বিখ্যাত। কেউ কেউ অনুমান করেন এই অঞ্চলের বণিকরা সিন্ধু পণিদের বংশধর। এবং পারস্য বণিকদের সঙ্গে তাদের ঐতিহ্যগত যোগাযোগের জন্যই পার্সীরা ধর্মান্তরিত হওয়ার ভয়ে এই অঞ্চলে পালিয়ে আসে।
বৌদ্ধযুগেও দেখা গেছে ক্ষত্রিয় ও বণিকদের আধিপত্য ও মর্যাদা, ব্রাহ্মণের তখন নিম্নাসন। বেহুলা লখীন্দরের গল্পে দেখি, চাঁদ বেণের পূজা পাওয়ার জন্যই মনসার কামনা ও ক্রোধ, কোন ক্ষত্রিয় রাজা বা ব্রাহ্মণ পুরোহিতের নয়। অর্থাৎ বণিকের স্বীকৃতিই সমাজের স্বীকৃতি।
স্মৃতি শ্ৰুতি শাস্ত্র ব্যক্তিমত বা সংকলন, যা বহু পরবর্তীকালে লিখিত রূপ নেয়। বেদ উপনিষদ সম্পর্কেও অনেক ভুল ধারণা সাধারণের মধ্যে প্রচলিত। মনুসংহিতার তো একটি মাত্র পুঁথি ইংরেজরা উদ্ধার করেন দক্ষিণভারত থেকে, তাও সেটি খুব প্রাচীন নয়। শাস্ত্র্যবাক্য কন্ঠস্থ থাকতো বলেই আঞ্চলিক প্রভাবে কেউ কেউ দু’ চারটি শ্লোক যে প্রক্ষিপ্ত করেন নি এমন মনে করার হেতুও নেই।
প্রচলিত ধারণাও কত ভুল হয় তার একটি দৃষ্টান্ত হল ‘সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্’। এই উক্তিটিকে অনেকেই মনে করেন উপনিষদের বাণী। অথচ এটি প্রকৃতপক্ষে ফরাসী দার্শনিক কুঁজার উক্তি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এটিকে ঐ ভাবে অনুবাদ করেন। এটি আদৌ প্রাচীন ভারতীয় উদ্ভাবন নয়।
সাম্প্রতিক কালেই যদি এই বিভ্রম ঘটে থাকে, তা হ’লে প্রাচীনকালে তা আরো স্বাভাবিক ছিল।
জাতি বা পদবীর ক্ষেত্রেও সুতরাং অনেক মরীচিকা আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারে, আমাদের ইতিহাসচেতনার অভাবে।
যাই হোক্, পদবীর কথায় ফিরে আসা যাক।
বাংলাদেশে যে পদবীগুলি নামের শেষাংশ থেকে গড়ে উঠেছে, যেমন ঘোষ বসু মিত্র দেব কর গুপ্ত নাগ পাল সেন চন্দ্র প্রভৃতি, সেগুলি সবই কায়স্থ ও অন্যান্য বর্ণহিন্দু, জাতির পদবী। ব্রাহ্মণের পদবী নয়। অথচ ভাণ্ডারকার দেখিয়েছেন যে, ‘পশ্চিম ভারতে নাগর ব্রাহ্মণগণের মধ্যেও ঠিক অনুরূপ পদবীর প্রচলন আছে।’ এই নাগর ব্রাহ্মণদের একটি শাখা সম্ভবত বাংলাদেশেও এসেছিল। কালক্রমে, তারা পদবী লুপ্ত করে ব্রাহ্মণের মধ্যে অথবা পদবী রক্ষা করে কায়স্থাদি জাতির মধ্যে বিলীন হয়।
একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য এই ইঙ্গিতগুলি লক্ষ্যণীয় যে, পদবীর শুধু, জাত্যান্তরই নয়, বর্ণান্তরও ঘটেছে। শুধুই পদবীগুলির, না কি পদবীর অধিকারীদেরও?
অতীশ দীপঙ্কর এক হাজার বছর আগে জন্মেছিলেন। এই বৌদ্ধ পণ্ডিতের সঙ্গীদের মধ্যে পাওয়া যায় পরহিতভদ্র নাম। তৎকালীন অন্যান্য বৌদ্ধ নাম শান্তরক্ষিত, কমলশীল, বিমলমিত্র, বুদ্ধগুহ, বিশুদ্ধ-সিংহ, কল্যাণমিত্র, ধনগুপ্ত, জগৎমিত্র। এঁরা সকলেই বৌদ্ধ। এগুলি তখনো পদবী হয়ে ওঠেনি বলেই মনে হয়। কারণ পিতা-পুত্রের নামের শেষাংশ অনেকক্ষেত্রেই এক নয়।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নামের দুটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে শেষাংশ থেকে বহু পদবী সৃষ্টি হয়েছে। আরো কিছু ঐতিহাসিক নাম বিশ্লেষণ করলেই তা বোঝা যাবে। কারণ সেই সব নামের দুটি অংশই, কখনো তিনটি অংশই বর্তমানে পদবীরূপে দেখতে পাওয়া যায়। যেমন আদিত্যসেনগুপ্ত। আদিত্য, সেন, গুপ্ত তিনটিই পদবী। এই ধরনের নাম বসুমিত্র, যশবর্মণ (যশ ও বর্মণ), দেবরায়, নাগসেন, চন্দ্রগুপ্ত, দেব-গুপ্ত, রুদ্রসেন প্রভৃতি। এর প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক রাজাদের নাম। প্রত্যেকটির দুটি অংশই বর্তমানে বাঙালীর পদবী। যে ব্রাহ্মণ সেনাপতি পুষ্যমিত্র শেষ মৌর্য রাজা বৃহদ্রথকে হত্যা করে নিজেই রাজা হয়েছিলেন এবং বৌদ্ধধর্মের উচ্ছেদ সাধনান্তে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ফিরিয়ে আনেন, তাঁর পুত্র অগ্নিমিত্র, পৌত্র বসুমিত্র। বসু ও মিত্র উভয়েই পদবী। এই বসু-মিত্রের পিতা অগ্নিমিত্রকে বিখ্যাত করে গেছেন মহাকবি কালিদাস, তাঁর মালবিকাগ্নিমিত্র নাটকে।
আপাতদৃষ্টে বাংলাদেশে জাতিকেই প্রধান সামাজিক বিভাগ মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে জাতি অপেক্ষা জাতির শাখা উপশাখাই প্রধান। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ কায়স্থ ইত্যাদি পরিচয়গুলি অর্থহীন। মূল তাৎপর্য শাখা ও উপশাখার, যার সঙ্গে পদবীগুলিও সংশ্লিষ্ট। সেই কারণে কৌলীন্য গড়ে উঠেছে পদবীকে ঘিরে। প্রাচীনপন্থীরা যদিও বিবাহে শাস্ত্রীয় কৌলীন্য মেনে চলেন, বৃহত্তর সমাজে কিন্তু কৌলীন্যের বিচার আর্থিক তথা পদবীকেন্দ্রিক। লক্ষ্যণীয়, যে-কোন জাতির কুলীন শ্রেণীর আর্থিক অবস্থা সাধারণভাবে উন্নত, আবার স্বীকৃত পদবীগুলি তাদেরই।
কায়স্থের মধ্যে বহু শ্রেণী আছে। দক্ষিণ রাঢ়ী, উত্তর রাঢ়ী, বঙ্গজ ও বারেন্দ্র কায়স্থ ছাড়াও করণ-কায়স্থ, বাহাত্তর ঘর, রাজু-কায়স্থ প্রভৃতি অসংখ্য শ্রেণীর কায়স্থ আছে। বৈদ্যদের মধ্যে, সংখ্যাল্প হলেও একটি বিশিষ্ট শ্রেণী শ্রীখণ্ড বৈদ্য। এরাঁ বৈষ্ণব ও সাত্ত্বিক ভাবাপন্ন হওয়ার ফলে বৈদ্য ‘জাতি’ হিসেবেই একদা মর্যাদা পায়, পরে ইংরেজ আমলে অন্যশ্রেণীর বৈদ্যদের আর্থিক ও অন্যান্য উন্নয়ন ঘটে। সামাজিক মর্যাদাও। বৈদ্যদের মধ্যেও চারটি মতান্তরে পাঁচটি শ্রেণী আছে।
অব্রাহ্মণের চোখে সব ব্রাহ্মণই ব্রাহ্মণ। কিন্তু ব্রাহ্মণদের শ্রেণীভেদ অসংখ্য। তেমনই ব্রাহ্মণের চোখে যে কোন জাতির সকলেই এক শ্রেণী-ভুক্ত। কিন্তু ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল।
আবার ব্রাহ্মণ সমস্ত ব্রাহ্মণকেই সমান মর্যাদা দেয় না। অন্তর্বিভাগই তার কাছে বড়। সেকালের কৌলীন্যও এভাবেই গড়ে উঠেছিল।
“দালান গোত্র পুস্করিণী গাঞি
ইহা ছাড়া কুলীন নাই।।
যদি থাকে দুই এক ঘর
লোহার সিন্দুক আর টিনের ঘর ।।”
সুদূর অতীতের কথা বাদ দিলে, ইংরেজ আগমনের আগে বাঙালীর ধনদৌলতের পরিচয় বলতে কি বোঝাতো তাও এই ছড়াটির মধ্যেই পাওয়া যায়। রাজা কর্তৃক ভূমিদানের স্বর্ণযুগ তখন বিস্মৃত। সম্ভ্রান্ত পরিবারের পরিচয় দাঁড়িয়েছে, বিশেষ করে ব্রাহ্মণদের, এই গ্রাম্য ‘দালান’ বা গৃহ, পুষ্করিণী, সিন্দুক, টিনের ঘর। এগুলি যে সামান্য কয়েকটি গাঞি ও গোত্রের ব্রাহ্মণদের ছিল সেই গাঞি গোত্রেরই মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বিত্তে বা অর্থে নানা জাতির মধ্যে অত্যন্ত সম্পদশালী মানুষ সে-যুগেও ছিল, তাদের প্রতিপত্তি ছিল না এমন নয়, কিন্তু অল্পবিত্ত মানুষের স্বাভাবিক ঈর্ষা তাদের সামাজিক অবরোহণ ঘটায়। এই শ্রেণী-বিদ্বেষ বর্তমানেও বর্তমান।
কৌলীন্য সম্পর্কে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর বক্তব্য পরে বলা যাবে।
আগেই বলেছি ভারতবর্ষে তিন শতাধিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ আছে। এক এক অঞ্চলে এক এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণের উচ্চাসন। গোত্রও ভিন্ন ভিন্ন। অঞ্চলভেদে ভারতের ব্রাহ্মণদের গোত্রসপ্তকও ভিন্ন ভিন্ন। সর্বত্র এক নয়।
গোত্র প্রবর্তকের বা প্রবরের নাম থেকেও বহু পদবীর সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের অন্যত্র তার প্রচলনও আছে। যথা : কাশ্যপ, বাৎস্য, দেবল, চ্যবন, ভার্গব, বশিষ্ঠ, কৌশিক, গর্গ প্রভৃতি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বাঙালীর কোন কোন দেশজ পদবী এই সব গোত্র নামেরই অপভ্রংশ। অব্রাহ্মণদের মধ্যে তার প্রচলনের কারণ গোত্র সব জাতির মধ্যেই আছে। এ বিষয়ে আলোচনা উপস্থিত মুলতুবি থাক।
মনুসংহিতায় ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য তিন বর্ণেরই উপবীত গ্রহণের নির্দেশ আছে। ব্রাহ্মণের কোন শ্রেণীভেদের কথা নেই।
বাঙালী ব্রাহ্মণদের শাখা উপশাখা প্রচুর। পদবীও অসংখ্য। কান্য-কুব্জ বা কনৌজী ব্রাহ্মণদের পদবী পাঁড়ে, দুবে, তেওয়ারী, চৌবে, সুকুল, দীক্ষিত, মিশির, পাঠক, ওঝা, বাজপেয়ী বা তার দশটি শুদ্ধ রূপ। তা থেকে কাঞ্চনী সিনাসী, লোকনাথ, গোবর্ধন, নয়াপুরা, রাম-পুরা, মধুবানী, বৈশী, তিপতি, নাট, কাকরী, গবাট প্রভৃতি পদবীর সৃষ্টি হয়। এইসব পদবী এখনো কিছু কিছু বাঙালী ব্রাহ্মণদের মধ্যেও পাওয়া যায়। ওঝা, ঝা, তেওয়ারী, চৌবে বাঙালীরও পদবী। ওঝা বা ঝার মূল উৎস উপাধ্যায়।
“কনৌজ ব্রাহ্মণদের মধ্যে কুড়ি প্রকার নিম্নশ্রেণীর ব্রাহ্মণেরও উল্লেখ পাওয়া যায়।”
গৌড়ীয় ব্রাহ্মণদের মধ্যে আছে সপ্তশতী, কনৌজী (রাঢ়ী ও বারেন্দ্র), বৈদিক, মধ্যশ্রেণী, শাকম্বীপী প্রভৃতি। রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের মধ্যে আবার কুলীন, ভঙ্গ, বংশজ, শ্রোত্রীয় প্রভৃতি উপশ্রেণী। বারেন্দ্রের মধ্যে কুলীন, কাপ, শ্রোত্রীয় প্রভৃতি।
এত বেশি অন্তর্বিভাগ না থাকলেও অন্যান্য, এমন কি মুষ্টিমেয় জনসংখ্যার, জাতিগুলির মধ্যেও বহু, অন্তর্বিভাগ আছে। তপশীলী জাতির মধ্যেও। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেইসব জাতির বিত্তবান অংশটিই কৌলীন্যের অধিকারী, অথবা বলা যেতে পারে কৌলীন্যপ্রাপ্ত অংশটিই বিত্তবান।
এই বিত্ত-আত্মীয়তার সঙ্গে পদবী-আত্মীয়তাও গড়ে উঠেছে। সে-কারণেই সীমিত পদবীর মধ্যে আশ্রয় গ্রহণের প্রবণতা।
ব্রাহ্মণদের ঘটক পাঠক উপাধ্যায় ভট্ট ইত্যাদি পদবী বৃত্তিবাচক। শ্ৰুতসংবাদ পার্সীদের জাতিভেদ নেই, কিন্তু ওঁদের পদবীগুলিও বৃত্তিগত, দারুওয়ালা, চানাওয়ালা তৎপরে ইংরেজী পদবী ইঞ্জিনিয়ার, পেন্টার, ডক্টর। বৃত্তি বা পেশার এও এক ধরনের রূপভেদ কালভেদ। আমাদের গাড়োয়ান, কোচোয়ান, ড্রাইভার, প্লেনের পাইলট পদবী হয়ে ওঠে নি। কিন্তু এদের বৃত্তি একই, শ্রেণীপার্থক্য দুস্তর। শিক্ষিত উচ্চজাতি গোলদারির বা চাল-ডালের দোকান খুললে তখন আর তাকে মুদি অভিধা দেওয়া হয় না।
রাজা মহারাজা থেকে শুরু করে নানাবিধ উপাধির ছড়াছড়ি ছিল সর্বযুগেই। একসময়ে তো রাজা মহারাজা উপাধি তাঁরা নিজেরাই নিয়ে নিতেন, পরে এটি ইংরেজ সরকার প্রদত্ত উপাধি হয়। রাজত্বহীন রাজা মহারাজাও ইংরেজরা বানিয়ে গেছেন। কখনো বড় জমিদার, কখনো ধনাঢ্য ব্যক্তিকে, কখনো বা রাজকীয় ব্যক্তিত্ব বোঝাতে। আবার শুধুই লোকমুখে কেউ প্রিন্স হয়ে গেছেন।
এছাড়া বিদ্যাসূচক উপাধিও আছে প্রচুর। তার মধ্যে পাই স্মৃতি-তীর্থজ্যোতিভূষণ, মীমাংসাতর্কতীর্থ, পঞ্চতীর্থ, স্মৃতিতীর্থ, তর্কতীর্থ ইত্যাদি। এগুলির কোনটি সংস্কৃতবিদ্যার পরীক্ষালব্ধ, কোনটি গুণী-জনসম্বর্ধনা উপাধি। প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব প্রভৃতি উপাধি কোন্ কোন্ পণ্ডিতসভা দিতেন সে-বিষয়ে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। ঈশ্বরচন্দ্র ছড়িও কেউ কেউ বিদ্যাসাগর উপাধি পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনিই বিদ্যাসাগর হয়ে রইলেন, কিংবা বলা যায় উপাধিটিকে তিনিই অলঙ্কৃত করে গেছেন। তবে এগুলির মধ্যে স্মৃতিতীর্থতর্কমীমাংসা বাচক উপাধি-গুলি দেখা যায় মূল পদবীকে স্থানচ্যুত করে দিয়ে পদবীর জায়গায় আসীন হয়। যদিও এগুলি পদবী হয়ে ওঠেনি। এই জাতীয় পদবী দেখলেই তাঁকে ব্রাহ্মণ মনে করা ভুল। কোন কোন বিখ্যাত পণ্ডিতের এই উপাধি থাকলেও তাঁরা শূদ্র।
ব্রাহ্মণদের বর্তমান পদবীগুলি কিভাবে এসেছে আগেই আলোচিত হয়েছে। কিন্তু বাড়ব গ্রাম থেকে বন্দ্যঘটি রূপান্তর কিভাবে হয়েছে জানা দুষ্কর। অনেকের দাবী অবশ্য বন্দ্যঘটিই গ্রামের নাম।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছেন ‘চাটু গ্রামের হিন্দি জী বা জীউ থেকে চাটুর-জীয়া, চাটুর্জ্যা, চাটুর্জ্যে, চাটুজ্যে। ১৭৬০ সালের পর ইংরিজি রূপ দাঁড়ায় চ্যাটার্জি। ১৭৫০-এর পর পণ্ডিতি বা সংস্কৃত রূপ হয় চট্টোপাধ্যায়।’ তাঁর মতে ‘মুখটি’ বা ‘মুখড়া’ গ্রাম থেকে মুখুজ্যে। ‘বন্ডউরী’, বাঁড়রি, বাঁড়রি গাঁই থেকে বাঁড়ুজ্যে। সুনীতিবাবুর মতে শাণ্ডিল্য গোত্রের বাঁড়ুরি গাঁইদের আরেকটি নিবাস ‘বন্দি-ঘটি’ থেকে বন্দ শব্দ নিয়ে আধুনিক সংস্কৃত রূপ বন্দ্যোপাধ্যায়। তেমনি ‘গঙ্গকুলিক’ থেকে গাঙ্গৌলি, গাঙ্গুলি—সংস্কৃতকরণ গঙ্গোপাধ্যায়।
সুনীতিবাবুর মত গ্রহণ করলে স্বীকার করতে হয় বাঁড়ুজ্যে চাটুজ্যেরা আদৌ ওঝা বা উপাধ্যায় ছিলেন না। হিন্দি জী যুক্ত হয়ে বাঁড়ুজ্যে চাটুজ্যে মুখুজ্যেরা মাত্র ১৭৫০ সালের পর ভেবেছেন তাঁরা ওঝা ছিলেন, এবং সেই ধারণা থেকে উপাধ্যায় যুক্ত হয়েছেন। ইংরেজ আগমনের পর।
বটব্যাল ও বড়াল একই পদবী, এসেছে বোড়া গ্রাম থেকে। কুশারী কুশো গ্রাম থেকে, কিন্তু কুশারী সারস্বত ব্রাহ্মণদের মধ্যেও আছে। ঘোষাল এসেছে ঘোষ বা ঘোষল গাঞি থেকে। গড়গড়ে থেকে গড়গড়ি। বাঁকুড়ার মুকটি থেকে মুখটি। চাটুতি থেকে চট্ট। পাকুর বা পর্কট থেকে পাকড়াশি। অম্বুল থেকে অম্বুলি। পলশা থেকে পলসাঁয়ী। পোষলা থেকে পুষালী। পোড়াবাড়ি থেকে পোড়ারি। এসব নামের ঈষৎ তারতম্যও দেখা যায়।
গাঞিনাম অনুসন্ধান করলে দেখা যায় বাইশটি গ্রাম বর্ধমান জেলায়, বন্দ্য চট্ট গঙ্গ এই জেলার। বাঁকুড়ায় চারটি। মুখটি বাঁকুড়ার। বীরভূমে ন’টি। মুর্শিদাবাদে ন’টি। মানভূমে একটি। হুগলীতে পাঁচটি। সাতটির উৎস জানা যায় না।
রাঢ়ী ব্রাহ্মণরা ছিলেন রাঢ় অঞ্চলের বাসিন্দা। পরে পূর্ববঙ্গেও ছড়িয়ে পড়েন। সর্বাধিক ব্রাহ্মণ গাঞি বর্ধমান জেলায় অবস্থিত ছিল, সুতরাং অনুমান করা যেতে পারে সেখান থেকেই রাঢ়ী ব্রাহ্মণরা চতুর্দিকে নিজেদের বিস্তার করেন। ফুটবলের মাঠ থেকে সর্বক্ষেত্রে যে ঘটি-বাঙাল মানসিকতা অধুনা সকলেরই চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের এই ঘটি নামকরণ কিভাবে হলো তার একটি কল্পনাপ্রবণ অনুমান শুনেছি: বন্দ্যঘটি ব্রাহ্মণরা যখন পূর্ববঙ্গে যান, তখন রাঢ়াগত বন্দ্যঘটিদের ঘটি শব্দটি হয়তো বঙ্গজ মানুষদের কাছে বিচিত্র বোধ হয়েছিল। সেইসব সাত্ত্বিক পুরোহিতরা পূজার্চনার ‘ঘট’ নিজেরাই নারায়ণশিলার সঙ্গে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন বলেও ঘটিরূপে চিহ্নিত হয়ে থাকতে পারেন। পরে সেটি পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কেই প্রযুক্ত হয়। ঘটে যে আম্রশাখাটি আজও দেওয়ার রীতি, তা মনে হয়, আম্রবৃক্ষেরই প্রতীক। আমগাছ যাদের টোটেম ছিল তাদেরই সাংস্কৃতিক দান এর মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারে। এই কল্পনাপ্রবণ অনুমান দুটি পণ্ডিতদের বিবেচ্য। টোটেম শব্দটি সর্বত্র উদার অর্থে গ্রহণ করেছি, পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের সংকীর্ণ অর্থে নয়।
আগেই বলেছি ব্রাহ্মণদের অন্তর্বিভাগের মতই কায়স্থাদি অন্যান্য জাতিরও প্রচুর শাখা-উপশাখা আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অন্তর্বিবাহ নিষিদ্ধ। এই শাখা-উপশাখা অন্যান্য জাতির চোখে একই জাতি মনে হলেও তাদের পারস্পরিক নৈকট্য বরং অন্য জাতির সমবিত্ত-শ্রেণীর সঙ্গে, সমজাতির অসমবিত্তশ্রেণীর সঙ্গে নয়। আবার সব জাতির বিত্তবান বা অর্থ-শিক্ষা-রুচির নাগরিক শ্রেণীর পদবী কয়েকটি স্বীকৃত পদবীর মধ্যেই সীমিত। সুতরাং আমরা পদবীকে নাগরিক এবং গ্রামীণ এই দুইভাগে ভাগ করতে পারি। গ্রামীণ পদবীগুলির আঞ্চলিক পরিচিতিই নয়, বহুক্ষেত্রেই সেগুলির সঙ্গে স্থানবিশেষের অতীত প্রতিপত্তি বা মর্যাদা জড়িত থাকায় তাঁরা পদবীটিকে গর্বিত উত্তরাধিকার মনে করেন। গ্রামসমাজে সমস্ত পদবীই গ্রামের নামের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। এই গ্রাম সম্পর্কিত গৌরব প্রকৃতপক্ষে অর্থনৈতিক গৌরবেরই কথা। অর্থাৎ ঐ গ্রামে ঐ পদবীর অধিকারীরা সম্পদশালী ছিলেন। উদাহরণ: বালিয়ার শী, মাধবকাটির মান্না, ধানঘড়ার ঢোল, মালীবনার বাগ, শরবেড়্যার বেরা।
ব্রাহ্মণদের গাঞিপদবীও রাজবদান্যতা, অতএব সম্পদের কথাই ব্যক্ত করে। ভূমির সঙ্গে যোগ বিছিন্ন হওয়ার পর শিকড়হীন নাগরিকতার সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক উন্নয়ন ঘটলে সেকালে অনেকেই পদবী মার্জিত করতেন, সংস্কৃত শব্দে তাকে রূপান্তরিত করে। এটি নাগরিক শিক্ষা ও রুচির প্রকাশ। মুসলমান আমলে আবার এভাবেই মোগল উপাধিগুলি এবং বৃত্তিনামগুলি পদবী হয়ে দাঁড়ায়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ইংরেজ আগমনের পর একই কারণে পদবীর ইংরেজীয়ানা ফ্যাশন হয়ে উঠেছিল।
এই সাহেবী ঢঙ আনার ফলেই সেকালে লাহা হয়েছিলেন Law, সাহা Shaw, পাল হয়েছিলেন Paul, দাঁ যদিও মূলতঃ ছিলেন দাম, কিন্তু ড্যাম হওয়ার আতঙ্কে তিনি হলেন Dawn, বসু বোস হলেন, কিংবা উচ্চারণে বাসু, পদমর্যাদা বাড়লে একালেও সিংহ হয়ে যান সিন্হা, দত্ত হন ডাট। সেকালেই চন্দ্র হয়েছিলেন চন্দার, মিত্র মিটার, অবশ্য ইলিকট্রিকের মিটার থেকে তিনি ভিন্ন, সেন্টিমিটার থেকেও। রায়কে এখনো রয় দেখি, কিংবা সাহেবের মুখে রে, ঠাকুর তো সকলেই জানি ট্যাগোর হয়েছিলেন। ব্যানার্জি, চ্যাটার্জি, মুখার্জি তো স্থায়ী রূপ পেয়ে গেছে, প্রায় পরিত্যক্ত হয়েছে ওঝা থেকে পরিবর্তিত উপাধ্যায়যুক্ত পদবীগুলি। তাদের দেখা মেলে শুধুই সাহিত্যের ক্ষেত্রে কিংবা নিমন্ত্রণ-পত্রে। আসলে চাটুয্যা বাঁড়ুয্যা থেকে চাটুজ্যে বাঁড়ুজ্যে ইংরেজের মুখেই হয়তো চ্যাটার্জি ব্যানার্জি হয়ে যায়। চতুষ্পার্শ্বে জী হুজুর দেখতে দেখতে; বাঈজী থেকে বাবুজী সর্বত্রই জী, অতএব প্রভুরা হয়তো ভেবে বসেছিলেন বাঁড়ুজ্যে মুখুজ্যেরাও জী। সুনীতিবাবুর মতও তাই।