পদবি ও নাম
দৈনিক পত্রিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় যেখানে শ্রেণীবদ্ধ বিজ্ঞাপনগুলি মুদ্রিত হয়, সেখানে নাম-পদবি পরিবর্তন নামে একটি কলম আছে। কর্মখালি কিংবা পাত্রপাত্রীর কলমের মতো না হলেও নাম-পদবি পরিবর্তন কলমটির চাহিদাও কিছু কম নয়।
প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজের ওই দ্বিতীয় পৃষ্ঠাতে চোখে পড়বে ‘আমি খাঁদু পাল আলিপুর আদালতে এফিডেবিট করিয়া গত ২৫ অক্টোবর হইতে শ্যামল রায় হইলাম’। অধিকাংশ এফিডেবিট ও বিজ্ঞপ্তিই পদবি পরিবর্তনের। কোনো কারণে পুরনো পৈতৃক পদবিটি আধুনিক যুবকের পছন্দ হচ্ছে না, নগা মাইতি আদালতে এফিডেবিট করে নিজেকে নগেন্দ্র মৈত্র বলে ঘোষণা করছেন। অনেকে পদবি পালটানোর সময় একই খরচে হচ্ছে বলে নামও পালটে ফেলছেন। অনেকে আগের নাম ও পদবির ধারে কাছে থাকছেন, যেমন ওই নগা মাইতি থেকে নগেন্দ্র মৈত্র কিংবা ভ্যাবল সর্দার থেকে ভবলাল সরকার।
একটি দ্বিতীয় দল আছেন যাঁরা খোল নলচে সহ তাঁদের পূর্বপরিচয় পালটে ফেলেছেন। এঁদের মধ্যে আবার কেউ কেউ বিখ্যাত লোকের নাম গ্রহণ করছেন। একটা বিজ্ঞাপন অনেকদিন আগে দেখেছিলাম, আমি নকুড়চন্দ্র হুই হাওড়া আদালতে এফিডেবিট পূর্বক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হইয়াছি।’
এই সব বিজ্ঞাপনদাতাদের মতিগতি, মানসিকতা তবু বোঝা যায়, কিন্তু একটা বিজ্ঞাপন অল্পদিন আগে দেখেছিলাম যেখানে জয়ন্ত দাস বলে এক ব্যক্তি জানিয়েছেন যে তিনি জয়ন্তানুজ রায়চৌধুরী হলেন। সম্ভবত তিনি নিজের নামটিকে ভারী ও জবরদস্ত করতে চাইছেন। এরই বিপরীত আরেকজন, তিনি বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, ‘গত মহালয়া হইতে আমি জাতিভেদমূলক চক্রবর্তী উপাধি পরিত্যাগ করিয়া ‘ভাই’ উপাধি গ্রহণ করিয়াছি। অতঃপর নারায়ণ চক্রবর্তীর স্থলে নারায়ণ ভাই নামে পরিচিত হইব’।
পদবি নিয়ে বিশেষ কিছু লেখা অবশ্য আমার সাজে না। আমার যে রায় পদবি এ নিতান্তই জোলো উপাধি, এর জাত গোত্র বলে কিছু নেই। বহু লোক আমাকে বহুবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন আমরা কী রকম রায়। আমি বলেছি, আমরা ভাল রকম রায়, আমার বাবা-কাকা-জ্যাঠা, আমার বাবার বাবা-কাকা-জ্যাঠা, আমার ছেলের বাবা-কাকা-জ্যাঠা সবাই রায়।
কিন্তু এতে আমার কোনও সুবিধে হয়নি। আমার নাম এবং পদবি দুই-ই নিয়ে আমি বহুবার নানা বিপদে পড়েছি। প্রথম প্রথম যখন পদ্য লেখার চেষ্টা করি, এক সম্পাদক সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন তারাপদ রায় কোনো কবিতা লেখকের নাম হতে পারে না, তিনি বলেছিলেন, ‘এটা নিশ্চয় তোমার ছদ্মনাম’।
আমার যে জীবনে কখনও উপন্যাস লেখা হল না সেও আমার এই নিজের নামের জন্যে। প্রথম যে উপন্যাসটিতে হাত দিয়েছিলাম, তার প্রথম অধ্যায়ে ছিল মাত্র তিনটি চরিত্র। নায়ক, নায়িকা ও নায়কের গৃহভৃত্য। দশপাতা লেখার পর খেয়াল হল কখন নিজের অজ্ঞাতসারেই চাকরের নাম দিয়েছি তারাপদ। নায়িকা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকছেন, ‘এই তারাপদ, এক গেলাস জল নিয়ে আয়’। আমার অবশ্য কোনও দোষ নেই, চারদিকে তারাপদ নামে চাকরের সংখ্যা এত বেশি যে ওই নামটাই আমার কলম ফসকে কাল্পনিক চাকরের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে। ফলে আমার আর উপন্যাস লেখা হয়ে ওঠেনি। এ বিষয়ে আগেও বলেছি, এখনও বলি, স্ত্রী-ভূমিকা বর্জিত নাটক যেমন হয়, তেমনই ভৃত্য-ভূমিকা বর্জিত উপন্যাসের কথা কখনও যদি ভাবতে পারি, দেখা যাবে। না হলে, নিজেকে চাকর বানিয়ে তো আর উপন্যাস লিখতে পারি না। তাতে অবশ্য আমার এই হাস্যকর এবং গ্লানিময় জীবনের কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হবে তা নয়, কিন্তু স্ত্রী-পুত্র জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবেন।
একবার এক সাহিত্যসভায় পদবি সংক্রান্ত একটা ছোট ব্যাপারে এক গোলমেলে লোকের পাল্লায় পড়ে বেশ বেকায়দা হয়েছিলাম। কী কারণে ভদ্রলোকের ধারণা হয়েছিল যে আমি আগে তারাপদ রায়চৌধুরী নামে লিখতাম, বিশেষ কোনও কারণে এখন আর চৌধুরীটুকু লিখি না। যত তাঁকে বোঝাই, ‘না মশাই, আমি রায়চৌধুরী নই, রায়চৌধুরী নামে লিখিনি, আমার সাতপুরুষে কেউ রায়চৌধুরী নয়’, তিনি তত বলেন, ‘রায় আর রায়চৌধুরী একই হল মশায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ও সুকুমার রায় কে’না জানে? আমরা ভুলিনি তারাপদবাবু, আপনার সেই কৃষিবিজ্ঞানের প্রবন্ধগুলি, “নিজের ছাদে নিজের পাট চাষ করুন”, “ড্রইংরুমে কাঁচালঙ্কার ফুল”, আর সেই যে লিখেছিলেন, “কাটোয়ার ডাঁটা, কোথায় লাগে পাঁঠা?”
আমি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে স্বীকার করলাম যে সত্যিই আমি আগে রায়চৌধুরী ছিলাম, রায়চৌধুরী নামে লিখতাম কিন্তু এখন শুধু রায় লিখি। ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা, তবুও জোর করতে লাগলেন, কেন আমি রায়চৌধুরী টাইটেল ব্যবহার করছি না সেটা জানার জন্যে। তখন তাঁকে খুব নরম গলায় বললাম, ‘কী করব বলুন? বিয়ের পর টাইটেল পালটে গেল যে’। তিনি আমার জবাব শুনে রীতিমতো বিচলিত হলেন কিন্তু আর বিশেষ কথা না বাড়িয়ে পশ্চাদপসরণ করলেন।
এবার পদবি সংক্রান্ত একটি আধুনিক সমস্যার কথা ভয়ে ভয়ে আমি উত্থাপন করব। ভয়ে ভয়ে এই কারণে যে আমার নিজের লোকেরা অনেকে এর মধ্যে রয়েছেন এবং এঁদের মধ্যে অনেকেই কৃতবিদ্য ও যশস্বী। সমস্যাটা অবশ্য মধ্যে যতটা প্রকট হয়ে দেখা দিতে যাচ্ছিল, এখন আর ততটা নেই।
সমস্যা হল পদবি যুক্তকরণ নিয়ে। এর সঙ্গে নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নটি রয়েছে। বিয়ের পরে মেয়েদের পদবি কেন পালটে যাবে! বিবাহপূর্ব খ্যাতনাম্নী মহিলা বিয়ের পরেও তাঁর নিজ পদবি রেখে দিয়েছেন এমন নজির বাংলা সাহিত্যে আছে। আবার পিত্রালয় বা শ্বশুরালয়ের কোনো পদবিই ব্যবহার না করে দেবী ব্যবহার করছেন, অন্য দিকে দুই দিকের পদবি একসঙ্গে রয়েছে— এই দু’রকম বিখ্যাত দৃষ্টান্তও চোখের সামনেই রয়েছে।
সমস্যাটা এই পদবির যুগ্নকরণ নিয়ে। ধরা যাক, জয়ন্ত ঘোষের সঙ্গে জয়ন্তী রায়ের বিয়ে হল, তাঁরা দু’জনেই ঘোষরায় হলেন, তাঁদের ছেলের নাম হল বৈজয়ন্ত ঘোষরায়।
মনে করুন, আরেকটি দম্পতি তাঁরাও নারীর সমমর্যাদায় বিশ্বাসী। তাঁদের নাম মাধব চক্রবর্তী এবং মাধবী চ্যাটার্জি। বিয়ের পরে তাঁরা হলেন শ্রী এবং শ্রীমতী চক্রবর্তীচ্যাটার্জি, তাঁদের নয়নের মণি একমাত্র মেয়ের নাম হল সুমাধবী চক্রবর্তীচ্যাটার্জি।
এই বার আসল সমস্যা। কালক্রমে বৈজয়ন্ত এবং সুমাধবী বড় হল এবং তাদের বিয়ে হল। বিয়ের পরে সুমাধবীর সম্পূর্ণ নাম হল শ্রীমতী সুমাধবী ঘোষরায় চক্রবর্তীচ্যাটার্জি।
এখানেই কিন্তু সমস্যার শেষ নয়। আরও এবং আরও সমস্যা গোকুলে বাড়ছে।সেখানে দুটি ছেলে-মেয়ে প্রেমে পড়েছে, তাদের একজনের নাম স্বপন মিত্ৰটেলার, আরেকজনের নাম আয়েষা রহমানসান্যাল। দু’জনেই চমৎকার ছেলেমেয়ে, তাদেরও বিয়ে হল।
এর পর আবার পঁচিশ বছর। কলকাতার মেট্রোরেলের কামরায় প্রতিদিনের যাতায়াতে দুটি যুবক-যুবতীর মধ্যে প্রেম হয়েছে, তাদের একজন হল শ্রীযুক্ত অনির্বাণ ঘোষরায় চক্রবর্তীচ্যাটার্জি, অপরজন হল শ্রীমতী ঝিমকি মিত্ৰটেলার রহমানসান্যাল।
এর পর কী হবে? বিয়ের পর এদের কী পদবি হবে! এদের ছেলেমেয়ের কী পদবি হবে!
এর পরে আরও বাড়বে। এ হল জিওমেট্রিক প্রগ্রেশন, প্রত্যেক পুরুষ ডবল হয়ে যাবে। কারও নাম হবে বত্রিশ পদবিযুক্ত, কারও চৌষট্টি, কারও একশো আটাশ। সে এক ভয়াবহ দুর্দিন। একেকজনের নিজের নাম লিখতেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যাবে। আর মনে রাখাও তো অসম্ভব।
তখন কী হবে, কে জানে!