পথ ও পথিক
জীবনে একটা কিছু ধরতে না পারলে বড় ফাঁকা, নির্জন, নিঃসঙ্গ। এখন প্ৰশ্ন হলো, কী ধরা? কাকে ধরা? শেখভের ‘বোরিং স্টোরি’র সেই নায়ককে মনে পড়ছে। মেডিসিনের বিখ্যাত অধ্যাপক। যৌবনে যখন ক্লাস নিতেন তখন ছাত্ররা উদগ্রীব হয়ে অধ্যাপকের প্রতিটি কথা শুনত। ক্লাসে পিন পড়ার শব্দ শোনা যেত। বক্তৃতার এমনি আকর্ষণ। অধ্যাপকের সুন্দরী স্ত্রী। একমাত্র সুন্দরী কন্যা। যশ, খ্যাতি, অর্থ, বিত্ত। অভাব নেই কোনকিছুর। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ল। সংসার সরে গেল দূরে। অধ্যাপনায় জড়তা এল। ছাত্রদের ওপর আর সেই আকর্ষণী ক্ষমতা নেই। অধ্যাপকের জীবনের শেষ হাহাকার—’আমি কি নিয়ে বাঁচব! কি ধরে বাঁচব! ধরার মতো একটা মজবুত বিশ্বাসও তৈরি করতে পারিনি।’
ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই। ধর্মকর্ম! সাবেকি ব্যাপার। নিউক্লিয়ার যুগে অচল। ঠিক আছে, ধার্মিক হবারও প্রয়োজন নেই। যাহা চায় প্রাণ, তাই না হয় করা গেল। তারপর! সকলেই আমরা চলছি। চলার অভ্যাসেই চলা। আমাদের কৃতকর্মের ফসল তুলতে তুলতে সময়ও আসছে পিছু পিছু। গড়ে উঠছে ইতিহাস। শতাব্দীর অধ্যায়ে সব জমা পড়ছে। গৌরব, অগৌরব সবই তোলা থাকছে উত্তরকালের জন্যে। আমাদের হয়তো কোন প্রশ্ন নেই! প্রয়োজন নেই জানার—যাচ্ছি কোথায়? একবারও ভাবব না, After follows before অথবা which is today, tomorrow will be yesterday; কিন্তু মানবধারায় যারা আমাদের পিছনে আসছে তারা যখন দেখবে অনুসরণের ফল হলো, ওয়াইল- ডারনেসে মুক্তি, তখন মৃত্যুর পরেও চিত্রপটের গলায়, ফুলের বদলে জুতোর মালা ঝুলবে। “অন্ধেনৈব নীয়মানাঃ যথান্ধাঃ।”
ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাক, বেঁচে থাকায় মনে হয় সকলেরই বিশ্বাস আছে। তা নাহলে মরতে আমরা এত ভয় পাই কেন? বাঁচতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন পরিবারের, প্রয়োজন সমাজের, প্রয়োজন সামাজিক শৃঙ্খলার। এসবই হলো জীবনের বাইরের ব্যাপার। এইবার পেট যেমন আহার চায়, দেহ যেমন পুষ্টি চায়, জিভ যেমন স্বাদ চায়, চোখ যেমন সুন্দর দৃশ্য দেখতে চায়, কান যেমন সুর খোঁজে, দেহ যেমন সুখ খোঁজে, মন তেমনি জানতে চায়। মনও আহার খোঁজে। শিক্ষা চাই, সংস্কৃতি চাই। ভোগের জন্যে চাই বিজ্ঞান। প্রকৃতির ওপর প্রভুত্বের বাসনা। এই স্বাভাবিক প্রবণতা আছে বলেই সভ্যতার জন্ম। ঈশ্বর মন্দিরে নেই। তিনি আছেন আমাদের মনে। তাই সুন্দরের প্রতি আমাদের এত আকর্ষণ! স্বত-উৎসারিত বাঃ উক্তি।
সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্ম, সংস্কার—সবই মানুষের তৈরি। কিছু বাঁচার প্রয়োজনে, কিছু অন্তরের তাগিদে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন : “কাজলের ঘরে থাকলে গায়ে একটু কালি লাগবেই।” পৃথিবীতে এলে, সে যখন যেসময়েই আসি না কেন, বেঁচে থাকার একটা অভিজ্ঞতা হবেই। আর সেই অভিজ্ঞতা একটা জীবনদর্শন তৈরি করবে। কিছু একান্ত ব্যক্তিগত, পরিবেশ- নির্ভর, কিছু ইউনিভার্সাল। যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকার আপামর অভিজ্ঞতা উদ্ভূত। যেমন আদি মানব, হাজার হাজার বছর আগে, সেই ম্লান আলোর পৃথিবীতে বসে লিখতেন, যা লিখলেন তার ইংরেজী—
“Sky and earth are everlasting,
Men must die
Old age is a thing of evil
Charge and die!“
হাজার হাজার বছর পরে এই একই কথা, অন্য ভাষায়, অন্যভাবে লিখলেন কবীর, চলতি চাক্কি—আকাশ আর মাটি, এই যাঁতার মাঝখানে নিয়ত পেষাই হচ্ছে মানবরূপী শস্যদানা। আর এই পেষাইয়ের ফলেই নির্গত হচ্ছে জীবনরস। ‘যেতে হবে’–এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। যত দার্শনিকতা সবই এই ‘যেতে হবে’র চিন্তা থেকে। আদি মানব লিখলেন—
“The odor of death,
I discern the odor of death
In the front of my body.“
আসামাত্রই মায়ার জালে জড়িয়ে পড়া। জীবনের প্রেমে আচ্ছন্ন হওয়া। জীবন যেমনই হোক, তাকে ভালবেসে নাকানি-চোবানি খাওয়া। রোগ, শোক, জরা, ব্যাধি। মৃত্যু ছায়া ফেলে জীবনের মধ্যপর্বে। প্রথম দিকে নেশা। প্রথম দিকে ঘোর। মৃত্যুই মানুষকে দার্শনিক করে তোলে। জীবনের অসংলগ্নতা, স্বার্থপরতা, নীচতা ধুয়ে বের করে দেয়। জোহার সেই কারণে বলছেন, ধার্মিক কে? Who are the pious?
“Those who consider each day
as their last on earth.“
জীবনের প্রতিটি দিনকে ভাব আজই আমার শেষ দিন। কাল আমি থাকতেও পারি নাও পারি। আধুনিক মানুষ ঈশ্বরের নামে, ধর্মের নামে বড় বিব্রত বোধ করেন। বিজ্ঞানী তাঁরা। ধর্ম নাকি কুসংস্কার। বেশ তাই হোক। পরমেশ্বরকে না মানি, মৃত্যুকে তো মানতেই হয়। অহরহ চারপাশে ঘটছে। এই ছিল এই নেই। এত বড় সত্যকে তো অস্বীকার করা যায় না। অরণ্যচারী মানুষ, বিজ্ঞান যাদের জীবনের আলো ফেলেনি, তারা মৃত্যুকে বললে, the great River Man Death। বললে :
“I feel no fear
When the Great River Man
Death speaks of.”
কতকাল পরে রবীন্দ্রনাথ বললেন : “মরণ রে; তুঁহুঁ মম শ্যাম সমান।” নিউজিল্যান্ডের প্রাচীন একটি মাওরি কবিতায় কবি লিখছেন—
“The tide of life glides swiftly past
And mingles all in one great eddying foam.”
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখালেন। অর্জুন অবাক হয়ে দেখছেন—
“যথা নদীনাং বহুবোহম্বুবেগাঃ
সমুদ্রমেবাভিমুখা দ্রবন্তি।
তথা তবামী নরলোকবীরা
বিশন্তি বক্তৃাণ্যভিবিজ্বলন্ত।।”
কবি নবীনচন্দ্রের অনুবাদ—
“যথা নদীদের বহু অম্বুবেগ
সিন্ধু-অভিমুখী, প্রবেশ সাগরে,
তথা এই নরলোক বীরগণ
পশিছে জ্বলন্ত বদন নিকরে।।”
পতঙ্গের মতো জীবন-মৃত্যুর আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে।
“যথা প্রদীপ্তং জ্বলনং পতঙ্গা
বিশন্তি নাশায় সমৃদ্ধবেগাঃ।
তথৈব নাশায় বিশন্তি লোকা
স্তবাপি বক্ত্রাণি সমৃদ্ধবেগাঃ।।”
“যেমতি প্রদীপ্ত অনলে পতঙ্গ
পশে দ্রুতবেগে মরিবার তরে,
পশিছে নাশার্থ তথা প্রাণিগণ
দ্রুতবেগে তব বদন-বিবরে।।”
সভ্যতার উন্মেষকালে কবি লিখলেন :
“Water does not refuse to dissolve
Even a large Crystal of Salt.”
জীবনের দানা যত বড়ই হোক মৃত্যু-সাগরে লীন তাকে হতেই হবে। আর এই মৃত্যুই হলো মানুষের শুভ কর্মপ্রেরণা। Each day the last day যার আর পর নেই। যা করার আজই সারো। সব গোছগাছ কর। ভিতর সাফা করে ফেল। অহং ছেঁটে ফেল। Inaction থেকে action-এ এস। অর্জুনের মতো গাণ্ডীব তুলে নাও হাতে,
“আমি বৃদ্ধ-কাল লোক-সংহারক,
লোক সংহারেতে প্ৰবৃত্ত এখন।”
“কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো
লোকান্ সমাহর্তুমিহ প্রবৃত্তঃ।”
“অতএব উঠ! লভ তুমি যশ!
তস্মাত্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব।”
ভোগী, যোগী, জ্ঞানী, বিজ্ঞানী, ত্যাগী, আত্মসাৎকারী—সকলেই ছুটছেন মৃত্যুর খাঁচায়। ওরে ছাদটা ঢালাই করে ফেল, মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা কর, মামলার দিনটা ফেলুন। সেরে ফেল, সেরে ফেল।
“Not twice this day
Inch time foot gem
This day will not come again
Each minute is worth a priceless gem.”
—যে দিন গেল, সে দিন আর ফিরবে না। সময়ের ইঞ্চি, ফুট, রত্ন বিশেষ। দিন যায় আর আসে না। প্রতিটি মিনিট এক একটি মূল্যবান রত্ন।
এসবই তো মানুষের ভাবনা। মানুষেরই লেখনী-নিঃসৃত ভাব, ভাবনারাজি। কে ভাবছে? ভাবাচ্ছেই বা কে? ধ্বংসের শক্তি তো কম নয়, তাহলে গড়ে উঠছে কি করে! দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী নতুন হলো কার হাতে?
ঠাকুর রামকৃষ্ণের সেই সুন্দর গল্প—সাধু গিয়েছিলেন ভিক্ষা চাইতে। জমিদারের পেয়াদা পিটিয়ে অজ্ঞান করে পথে ফেলে দিলে। খবর পেয়ে অন্যান্য সাধুরা ছুটে এলেন। মুখে জল-টল দেবার পর চেতনা এল। তখন সাধুরা জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমায় মেরেছে? প্রহৃত সন্ন্যাসীর উত্তর—যিনি এখন আমাকে জল দিচ্ছেন, সেবা করছেন, তিনিই আমাকে একটু আগে প্রহার করেছেন।
সেই ইজরায়েলী সন্ন্যাসীর অদ্ভুত অভিজ্ঞতা স্মরণে আসছে। পর্যটনের পথে সেই রাব্বি দেখলেন, এক বৃদ্ধ পথের পাশে একটি ক্যারব গাছের চারা রোপণ করছেন। সন্ন্যাসী প্রশ্ন করলেন : “কত বছর পরে ফল দেবে?” বৃদ্ধ বললেন : “সত্তর বছর পরে।“
“সত্তর বছর? এত মেহনত করে গাছ পুঁতছেন, ফল খাবার জন্যে সত্তর বছর বাঁচবেন আপনি?” বৃদ্ধ বললেন : “পৃথিবীতে আমি যখন প্রবেশ করলুম, কৈ পৃথিবীকে আমি শূন্য দেখিনি তো! আমার পিতা আমার জন্যে সব ব্যবস্থা করে রেখে গিয়েছিলেন। ফুল, ফল, বৃক্ষ। আমিও তাই করে রেখে যাচ্ছি। যারা আসছে আমার পিছনে তারা এর ফল ভোগ করবে।”
ঈশ্বরকে মানার প্রয়োজন নেই। ধর্ম বাতিল। নীতি—খাও, দাও আর ফুর্তি কর। কিন্তু কোথায়? এই পৃথিবীতেই নিশ্চয়। তাহলে বাসোপযোগী পৃথিবীর প্রয়োজন আছে। তাহলে অথর্ববেদের ঋষি কি খারাপ বলেছিলেন! অন্যায় কি বলেছিলেন?
“পৃথিবী শান্তিরন্তরিক্ষং শান্তিদৌঃ শান্তিরাপঃ শান্তি
রোষধয়ঃ শান্তির্বনস্পতয়ঃ শান্তির্বিশ্বে মে দেবাঃ শান্তিঃ
সর্বে মে দেবাঃ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিভিঃ।
তাভিঃ শান্তিভিঃ সর্বশান্তিভিঃ শময়াম্যহং যদিহ
ঘোরং যদিহ ক্রূরং যদিহ পাপং তচ্ছান্তং তচ্ছিবং
সর্বমেব শমস্ত নঃ।।”
—পৃথিবী শান্তি, অন্তরীক্ষ শান্তি, দ্যুলোক শান্তি, জলসমূহ শান্তি, ওষধিসমূহ শান্তি, বনস্পতিগণ শান্তি, বিশ্বদেবগণ শান্তি, সমস্ত দেবতারা শান্তি, শান্তি, শান্তি। সেইসব শান্তি দ্বারা যা এখানে ঘোর, যা এখানে ক্রূর, যা এখানে পাপ তা আমরা শান্ত করি; তা শান্ত হোক, তা কল্যাণময় হোক, সমস্তই আমাদের শুভ হোক।
কে চায় অশান্তি, অরাজকতা, নীতিহীনতা! কে চায় পরিবার, সমাজ, দেশ খুলে খুলে, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পড়ে যাক? প্রতি মুহূর্তের আতঙ্ক কে চায়! আমরা ভালবাসার পৃথিবীতে বাঁচতে চাই। যতই আমরা স্বার্থপর হই না কেন, পরিবারের বাইরে, সমাজ থেকে দূরে আমরা বাঁচতে পারব না। তা যদি পারা যেত তাহলে আমরা সকলেই সন্ন্যাসী হয়ে যেতুম। সেই অরণ্যের কাল থেকেই যুথবদ্ধ হবার চেতনা আমাদের রক্তে সঞ্চারিত হয়ে গেছে। সভ্যতার উন্মেষকালে আমাদের অরণ্যচারী পূর্বপুরুষগণ মানুষের শ্রেষ্ঠ আচরণবিধির যে নির্দেশ রেখে গেছে, তা আমরা ফেলে দিতে পারি। তবে দুঃখের সঙ্গে ফেলতে হবে। এই জেনে ফেলতে হবে, আমরা পথ ভুলেছি। কি ছিল সেই নির্দেশ :
১। সবসময় ভাল হাওয়াই ভাল।
২। প্রেম ছাড়া জীবনে আর কি আছে? ৩। প্রাণ-সংহারে কি লাভ?
৪। অন্যের সাহায্যে আসার চেষ্টা কর।
রাব্বি জেরেমিয়া এই একই কথা বলেছিলেন দীর্ঘকাল পরে, আজ থেকে দীর্ঘকাল আগে :
“সম্প্রদায়ের বিপদকালে কখনো বলো না, ‘আমি বাড়ি চললুম, খাই দাই, আমার আত্মা, তুমি শান্তিতে থাক।’ মানুষের ধর্ম হলো অন্যের বিপদে সামিল হওয়া, যেমন মোজেস হতেন। বিপদে যে অংশ নিতে জানে, সে নিজের শান্তি সহজে খুঁজে পায়। সে-ই প্রকৃত মানব।”
৫। নিজের স্ত্রীকে গালাগাল দিও না। দুর্ব্যবহার করো না। নারীজাতি বড় পবিত্র।
স্বামীজী কি বলেছিলেন! চণ্ডী কি বলছেন—”স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু।”
৬। সৎ কাজের প্রতিদান অন্যের ভালবাসা।
৭। শিশুদের প্রতি অন্যায় আচরণ করো না।
৮। জুয়া খেলো না।
৯। অসহায় বৃদ্ধের সাহায্যে এগিয়ে এস।
১০। গৃহে অতিথির আগমন হলে সাধ্যানুযায়ী সৎকার কর। যে খাদ্য তাকে দিলে না, সেই খাদ্য গ্রহণে তোমার মৃত্যু হতে পারে।
১১। নিজের কাজের ফিরিস্তি দেবার সময় সাবধান। যা করনি তা করেছ বলে বাহাদুরি নেবার চেষ্টা কর না। অসত্য ভাষণ তোমার মৃত্যুকে কাছে এগিয়ে আনতে পারে। সত্যই হলো ধর্ম। সত্যই জীবন। যা করেছ তার চেয়ে কম বলাই ভাল। প্রবীণরা বলেন, সেই আচরণই প্রমাণ করবে, তুমি জ্ঞানী।
১২। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখ। তাহলে প্রেমের দুনিয়ায় বসবাস করতে পারবে।
১৩। বিবাহবন্ধনে একজনের সঙ্গেই আবদ্ধ হবে।
১৪। স্বামীকে মেজাজ দেখিও না। ভাল ব্যবহারের প্রতিদান ভাল ব্যবহার
১৫। ভালবাসি, ভালবাসি, মুখে বললেই সন্তানদের ভালবাসা হলো না। আচরণে প্রকাশ কর।
১৬। লোকদেখানো ভালবাসায় ভালবাসা নেই। অন্তরে তা প্রকাশ কর।
১৭। জীবনের পথে চলতে চলতে সহযাত্রীদের সুখী করার চেষ্টা কর। কোন মহিলাকে নির্জনে একা পেয়ে ভয় দেখাবার চেষ্টা করো না। কোন ক্ষতিও করো না।
১৮। তোমার [মহিলা] উপস্থিতিতে পরিবারের কেউ অন্যের কাছে কিছু চাইলে, মনে করবে তোমার কাছেই চাইছেন। কিছু করার থাকলে বলার আগেই করে ফেল। বলার অপেক্ষায় থেকো না।
অরণ্যের যুগ থেকে চড়া সভ্যতায় এসে আমরা সব শিখলুম, ভুলে গেলুম একটি জিনিস, একটি বিদ্যা চলে গেল আয়ত্তের বাইরে, সেটি হলো বেঁচে থাকার সুস্থ কৌশল। বাঁচাটাই আমরা ভুলে গেলুম। সোস্যালিজম, ইজমের ছড়াছড়ি, অথচ সুখী মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমছে। সংসার ভাঙছে, সমাজ ভাঙছে। সুইট হোম নামেই। ভিতরে ধিকিধিকি আগুন। বিবাহ-বিচ্ছেদ, শিশু অপরাধ-প্রবণতা, আত্মহত্যা, হত্যা, উন্মাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অধিকাংশ মানুষই অস্বাভাবিক। নিষ্ঠুর, আত্মকেন্দ্রিক, লোভী। নড়বড়ে রাষ্ট্রযন্ত্র। একদিকে প্রবল ভোগের দুনিয়া, আরেক দিকে সীমাহীন দুর্ভোগ। মাঝে মিথ্যা আশ্বাসের সমুদ্র। সেতু নেই। কথা আছে, কাজ নেই। ব্যস্ত দিন, ভয়াবহ রাত। ধ্বংসের ইঙ্গিত। মহাভারতকার বলে গেছেন—
“যদিদং দৃশ্যতে কিঞ্চিদ্ ভূতং স্থাবরজঙ্গমম্।
পুনঃ সংক্ষিপ্যতে সর্বং জগৎপ্রাপ্তে যুগক্ষয়ে।।”
—প্রলয়কালে স্থাবর জঙ্গম সবই আবার লয় পাবে। যেমন ঋতু। আসার আগে জানান দেয়। সেইরকম যুগারম্ভও টের পাওয়া যায়। যুগশেষেরও লক্ষণ ফোটে।
“যথর্তাবৃতুলিঙ্গানি নানারূপাণি পর্যয়ে।
দৃশ্যন্তে তানি তান্যেব তথা ভাবাযুগাদিষু।।”
আমরাও হয়তো যুগ-সন্ধিতে এসে পড়েছি। লক্ষণসমূহ বড় স্পষ্ট। সমস্ত বস্তু তার স্বধর্ম হারিয়ে ফেলেছে। বিভ্রান্তি বিস্রস্তি আমাদের ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। সুখের চাবিকাঠি হারিয়ে ফেলেছি। সবই আছে, নেই সুখ। দেহকে সুখে জরজর করে রাখলেও মন যদি সুখী না হয় তাহলে সুখ মায়ামৃগ হয়েই থাকে। ধৰ্ম্মপদে গৌতম বুদ্ধ বলছেন, আজ আমরা যা, তা হয়েছে পূর্বের চিন্তা থেকে। What we are today comes from our thoughts of yesterday. আজকের চিন্তা তৈরি করবে আগামীকালের জীবন। মনই তৈরি করে জীবন। Our life is the creation of our mind.
আজকের মন দেখলে আগামীকালের জীবনের চেহারা কি দাঁড়াবে বোঝা যায়। আশঙ্কা হয়। এক ‘জেন’-শিক্ষক বলেছিলেন : “আমার বুকের কাছটা আগুনের মতো জ্বলছে; কিন্তু আমার চোখ দুটি শীতল, পোড়া ছাইয়ের মতো।” আধুনিক মানুষের জন্যে তিনি কিছু নির্দেশ রেখে গেছেন। আমরা পালন করে দেখতে পারি। হৃদয়ের জ্বালা জুড়োয় কিনা! মৃত চোখে জীবনের জ্যোতি ফিরে আসে কিনা।
।। নিৰ্দেশ।।
প্রাতে একটি ধূপ জ্বেলে সামান্য ধ্যান।
বিশ্রাম প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে।
নির্দিষ্ট সময়ে বারে বারে অল্প অল্প খাদ্য গ্রহণ।
গুরু আহার বর্জনীয়।
নিজের তৈরি নির্জনতায় বসবাস। মনে, বনে, কোণে। সঙ্গেও নিঃসঙ্গ। যা বলছি তার দিকে লক্ষ্য রাখা। যা বলছি তা পালন করা।
সুযোগ হাতছাড়া না করা। অথচ কিছু করার আগে দুবার চিন্তা করা।
অতীতের জন্যে অনুশোচনা নয়। ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলা।
বীরের মতো নির্ভীক অথচ শিশুর মতো প্রেমিক হৃদয়ের অধিকারী হওয়া।
বিশ্রামের সময় এমন নিদ্রা, মনে হবে এই আমার শেষ নিদ্রা।
নিদ্রাশেষে শয্যা সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ। আর ফিরেও তাকাবে না, ছিন্ন পাদুকার মতো পরিত্যাগ।
একাল আমাদের সবই শেখাবে। ধন-বিজ্ঞান, জীব-বিজ্ঞান, ভূ-বিজ্ঞান, শেখাবে না জীবন-বিজ্ঞান। সদ্গুরুর আশ্রয় ছাড়া এ-শিক্ষা আসবে কোথা থেকে—
“গুরোস্ত মৌনং ব্যাখ্যানং শিষ্যাস্ত ছিন্নসংশয়াঃ।”