পথে বসালেন
ওরে বাবারে বিশ্বকাপ ক্রিকেট এসে গেছে। সারা বিশ্বে এর চেয়ে বড় ঘটনা আর কি আছে! বন্যা, ক্ষরা, পতনমুখী ডলার, ধসেপড়া শেয়ারবাজার, ঊর্ধমুখী, পাউন্ড, বেকার সমস্যা, উধাও সরষের তেল, নিমকহারাম নুন, মহার্ঘ আলু, কোনও কিছুই কিছু নয়। ক্রিকেট।
আমার সাদাকালো টিভি মাঝরাতের একঘণ্টা আগে তিনবার ঝিলিক মেরে একটা চিরুনির মতো চিত্র বুকে ধারণ করে চোখ মারতে লাগল। সবাই এক বাক্যে বললেন, মায়ের ভোগে। পরের দিন মোটর সাইকেল ভটভটিয়ে বদ্যি এলেন। পেছন দিকের কুঁজ খুলে, ইনটেসটাইন পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘পিচকার টিউব খতম হো গিয়া।’
আমি সংশোধন করে দিলুম, ‘পিচকার নেহি, পিকচার।’
তিনি বললেন, ‘ওই হল। সারাদিন রাত যেভাবে পিচকিরির মতো প্রাোগ্রাাম ছিটোয়। কলকাতা হল তো দিল্লি, দিল্লি গেল তো বাংলাদেশ। নিন অনেক টাকার ধাক্কা। কী করতে চান বলুন?’
সঙ্গে সঙ্গে পরিবার পরিজনের উল্লাসের চিৎকার, ‘বলো হ্যারি, বিদেয় করো, বিদেয় করো, লে আও কলার।’
আমাদের বাড়িতে যে মহিলা কাজ করে, সে বললে, ‘ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যে। ওই যে সুনীলবাবুর বাড়িতে করাল এনেছে, কী সুন্দর, হলদে মানুষ, সবুজ মানুষ সব নেচে নেচে বেড়াচ্ছে।’
‘দাম?’
‘নয়, দশ, বারো, পনেরো, বাইশ, চব্বিশ, খুচরোটা আর বললুম না না।’
‘বলতে হবে না, হার্টে যা চোট লাগার লেগে গেছে। বলুন কোনটা কেমন? টিভি কেনা নয় তো, বিয়ে করা। একবারই ঢুকবে। মরে বেরোবে।’
ভদ্রলোক বিভিন্ন পাত্রীর গুণাবলী ব্যাখ্যা করতে লাগলেন। এর একটা স্পিকার। ওর দুটো, ওর চারটে। চতুমুর্খ, চারদিকে শব্দ ছড়াবে। বাথরুমে বসেও চিত্রহার শুনতে শুনতে তালে তালে…।’
‘সমঝ গিয়া, সমঝ গিয়া।’
‘এর মেটাল বডি, ওর মোল্ডেড বডি। শব্দ ভরাট। এটার চ্যাপ্টা, ফ্ল্যাট টিউব, ওর কালো টিউব। এটার সঙ্গে রিমোট কন্ট্রোল, খাটে বসে কন্ট্রোল করতে পারবেন। এর রিমোট কন্ট্রোলের এত শক্তি যে, পাশের বাড়ি থেকে কন্ট্রোল করতে পারবেন। এটার ভেতর মেমারি ফিট করা। হাত-পা লাগানো, নিজে নিজেই, চ্যানেল, রং সব খুঁজে নেবে।’
‘মানুষের মতো?’
‘মানুষের বাবা!’
‘তা ঠিক। পরিবারে টিভিই তো সব। বাপ-মা ভেসে গেছে।’
‘হ্যাঁ, এটার স্ক্রিনে চ্যানেল, কালার প্যাটার্ন নাচানাচি করে।’
ওরই মধ্যে একটিকে তুলে নিয়ে এলুম। সঙ্গে সঙ্গে নাচানে বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীরা এসে বলতে লাগলেন, এ কী করলে, এটা আনলে কেন? ওটা আনা উচিত ছিল, যার বিজ্ঞাপনে কাঁচ ফেটে একটা গিরগিটি মানুষ বেরিয়ে আসে।
তিন রাত ঘুম হল না। দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, মনোবেদনা, হতাশা, আফসোস। ফুলশয্যা হয়ে গেছে, আর উপায় নেই। ফেরত দেওয়া যাবে না। ছ’টা বেড়ালের সবচেয়ে ডাকাবুকোটা একদিন সাহস করে শ্রীদেবীর মুখে আচমকা থাবা মেরে অ্যান্টি প্লেয়ারে স্ক্রিনে ছোট্ট একটা আঁচড় ফেলে দিয়েছে।
হুকুম হল। কালার টিভিতো রংচটা ঘরে থাকতে পারে না। সেই একবার বিয়ের সময় জানলা-দরজা, দেওয়ালে রং পড়েছিল। শেষ কো-অপারেটিভে যে ক’টা টাকা পড়েছিল, তুলে এনে দেওয়ালে অফ হোয়াইট ইমালশান চাপালুম। ওদিকে শ্রীযুক্ত ডালমিয়া, ইডেনের চেহারা ফেরাচ্ছেন। এদিকে আমি আমার ঘরের।
বায়না হল, ‘তিনটে গার্ডেন চেয়ার আনতে হবে। একটায় তুমি, একটায় তোমার বাবা, একটায় আমার বাবা। বেশ হাত-পা খেলিয়ে বসবে। এক-আধ ঘণ্টার ব্যাপার নয় তো। সকাল পৌনে ন’টা থেকে বেলা সাড়ে চারটে। আর জানালায় একটু ভালো জাতের পরদা।’
যা কষ্টেসৃষ্টে জমেছিল, সব শেষ করে, বিশ্বকাপের প্রস্তুতিপর্ব চুকল। একটু গাঁইগুঁই করে বলতে গিয়েছিলুম, মেয়ের বিয়ে, ছেলের এড়ুকেশন। এক দাবড়ানি, ‘মেয়ের বিয়ে তোমাকে দিতে হবে না। প্রেম হবে, প্রেম। ছেলের এডুকেশান, ছেলে নিজেই করে নেবে।’ সেই প্রথম শুনলুম, চেষ্টায় কিছু হয় না, সবই মানুষের ভাগ্য।
দেখতে-দেখতে নিম্নচাপের ঝোড়ো বাতাসের মতো ক্রিকেট-ফিভার, ক্রিকেট-স্টর্ম এসে গেল। পটাপট বই বেরোতে লাগল। খবরের কাগজের ভেতর কাগজ ঢুকল। জ্ঞান বাড়তে লাগল হুহু করে। কাগজ আর ম্যাগাজিনে ছাপা খেলোয়াড়দের ফুলসাইজ প্রিন্ট এ-দেওয়ালে, সে-দেওয়ালে সাঁটা হয়ে গেল। এ-দেওয়ালে হিরো গাওস্কর, ও-দেওয়ালে হিরো ইমরান। পাশের দেওয়ালে কপিল হাঁ। পেছনের দেওয়ালে, ভিভ রিচার্ডস আকাশ দেখছেন। মা দুর্গা, মা কালী, নারায়ণ সব ভেসে গেল। মেয়েরা দেখি সময় পেলেই ইমরানের ছবির দিকে গদগদ দৃষ্টি। ইমরানের মতো রমণীমোহন আর নাকি দ্বিতীয় নেই। জ্যোতিষীরা খেলোয়াড়দের কোষ্ঠী নিয়ে বিচারে বসে গেলেন। গাওস্কর বিদায় নেবেন। ইমরানও ব্যাট ছেড়ে দেবেন। ওই উপমহাদেশেই ক্রিকেটপ্রেমীরা হায় হায় করছেন। রেশনের দোকানে রেপসিডের খোঁজে গেলুম, মালিক তেল ভুলে গাওস্করকে নিয়ে পড়লেন। প্রশ্ন করলেন, ‘গাওস্কর না কি ব্যাঙাচির সঙ্গে কথা বলেন না?’
‘ব্যাঙাচি? সে আবার কে?’
পরে বুঝলুম বেঙ্গসরকারের কথা বলছেন। ডাক্তারবাবু ব্লাডপ্রেসারের যন্ত্রে ফ্যাঁসফ্যাঁস করে প্রেসার তোলেন, আর বলেন, ‘ইন্ডিয়া পারবে?’ প্রেসার ছেড়ে দিয়ে আবার তোলেন, আবার প্রশ্ন করেন, ‘ইংলন্ড শুনলুম ফুল স্ট্রেংথে আসছে না।’ এদিকে রক্ত আটকানো হাত টনটনিয়ে আঙুলে প্যারালিসিস হয়ে যাওয়ার দাখিল। আধ ঘণ্টার ফ্যাঁসফ্যাঁসের পর জিগ্যেস করলুম, ‘প্রেসার কত দেখলেন?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘প্রেসার তো দেবেই। পাকিস্তান ছেড়ে কথা বলবে। এবারের ওয়ার্ল্ডকাপ ওরাই না নিয়ে যায়।’
‘আমি আমার প্রেসারের কথা বলছি। পাকিস্তানের প্রেসার নয়।’
‘আপনার আবার প্রেসার কী? অ আপনার প্রেসার দেখছিলুম না! দাঁড়ান!’
আবার ফ্যাঁসফ্যাঁস শুরু হল।
সেলুনে চুল কাটতে গিয়ে ঘাড়ের খানিকটা কপচে গেল। যিনি চুল কাটছিলেন, ভারতের জয়পরাজয় নিয়ে এত ভেবে পড়লেন যে আমার ঘাড়ে ক্ষুরের এক কোপ বসিয়ে দিলেন না, সেইটাই আমার মহাভাগ্য।
গঙ্গায় স্নান করতে করতে এক বৃদ্ধা বললেন, ‘দেশে আবার সত্যযুগ ফিরে এল।’
‘কেন ঠাকুমা?’
‘ওদিকে টেলিভিশানের রামায়ণ শুরু হয়ে গেছে। সুগ্রীব আর বালির ন্যাজ দেখেছ? অত লড়াই করলে, তাও ধনুকের মতো ওপর দিকে খাড়া হয়েই রইল। খুলে পড়ল না। আর এদিকে কলকাতায় ভীষ্মের নামে কাপ হচ্ছে ভীষ্মকাপ।’
পাড়ার ছেলেরা এসে বললে, ‘দাদা কিছু চাঁদা ছাড়ুন দেশের স্বার্থে।’
‘তার মানে?’
‘ক্রিকেট স্বস্ত্ব্যয়ন যজ্ঞ করব আমরা। উদ্দেশ্যটা গাওস্করকে কিছুক্ষণ পিচে আটকে রাখা দৈববলে। গুরু আমাদের খেলে ভালো, হেভি রেকর্ড; কিন্তু ওই এক দোষ, হয় শূন্য করবে না হয় সেঞ্চুরি। গোটাকতক ক্যাচ ফসকে দিতে পারলেই মার হাব্বা। সেই যে সেঁটে যাবে, চার আর ছয়ের ফুলঝুরি। আর আমাদের গণেশ আর কার্তিক।’
‘সেটা কী?’
‘অ জানেন না বুঝি! গণেশ হলেন কপিলদেব আর শাস্ত্রী হনেল কার্তিক। গণেশের সব ভালো, প্রাোবলেম হল, চল কোদাল চালাই, ভুলে মানের বালাই।’
‘তার মানে?’
‘মানে, ওস্তাদ মাঝে মাঝে ভুলে যায়, এলোপাথাড়ি এমন ব্যাট চালায়, যেন ঝোপে কাটারি চালাচ্ছে। লাগে তুক, না লাগে তাক। ব্যাটে বলে হল তো ছয়, নয়তো মিডেল স্ট্যাম্প উড়ে গেল। আমরা যজ্ঞ করে একটা আকন্দের মূল মাদুলিতে ভরে কপিলদেবের কাছে পাঠিয়ে দেব।’
‘আকন্দের মূল কেন?’
‘আকন্দের আঠা, পিচে একেবারে সেঁটে যাবে। বল একেবারে লাল পান্তুয়ার মতো টপাটপ স্টেডিয়ামে গিয়ে পড়বে। ছয় কেবল ছয়। সব নয়ছয় করে দিয়ে কাপ ঘাড়ে নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসবে। শ্যাম্পেনের ফোয়াররা।’
‘তা কত দিতে হবে?’
‘বেশি চাপ দেব না। একটা হাফ পাত্তি ছেড়ে দিন।’
পঞ্চশ টাকা পকেট পুরে দেশহিতৈষীরা হাওয়া হলেন।
কাগজে খবর বেরোল ওয়ার্ল্ডকাপের খেলা দূরদর্শন নাকি দেখাবে না। ভারত সরকার, পাক সরকার, দূরদর্শন কর্তৃপক্ষে জট পাকিয়ে গেছে। মহা কেলেঙ্কারি! আমার আয়োজন ভেস্তে গেল বুঝি। পরদা, রঙিন টিভি, গোল বাগানচেয়ার। কর্তাব্যক্তিরা কয়েকদিন মাছ খেলানোর মতো আমাদের খেলিয়ে সিদ্ধান্তে এলেন, খেলা দেখানো হবে। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে সত্যনারায়ণ লেগে গেল। পাঁচসের দুধের সিন্নি। লক্ষ্মীর ভাঁড় ভেঙে বাতাসা এসে গেল। লন্ড্রি থেকে কাপড়জামা ডেলিভারি নেওয়া হল না পয়সার অভাবে।
অফিসে একটু অস্বস্তি। ছুটি কীভাবে মিলবে! আমি তো আর মন্ত্রী নই যে টেবিলে টিভি ফেলে দেশসেবা আর ক্রিকেটসেবা একইসঙ্গে চালাব। রথ দেখা কলা বেচার মতো। অফিস স্কুল নয় যে বগলে রসুন চেপে জ্বর নিয়ে আসব। অথচ ইন্ডিয়া অস্ট্রেলিয়ার প্রথম খেলাটা দেখা দরকার। ইন্ডিয়া কি ফর্মে আসছে জানা চাই। অফিসের কেউই তেমন ঝেড়ে কাশছে না। সকলেই সকলের দিকে মিটিমিটি তাকাচ্ছে। পুরো ডিপার্টমেন্ট তো আর খালি করে খেলা দেখা যায় না। একজন বললেন, ‘কেন যায় না, ক্রিকেট আগে না অফিস আগে!’ আমাদের আবার কাগজের অফিস। ‘সবাই ছুটি নিলে কাগজ বেরোবে কী করে?’ সহকর্মী চুপসে গেলেন। টেবিলে আঙুল ঠুকতে থাকলেন, তাল দেখে মনে হল, মনে-মনে গাইছেন, স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে, কে বাঁচিতে চায়। অফিসে অনেকেই চেয়ারে বসে অজ্ঞান হয়ে যান। ডাক্তার এসে বলেন মাইলড স্ট্রোক। একমাস বেড রেস্ট। সন্দেহবাদীরা বলেন, স্ট্রোক নয়, আপওয়ার্ড প্রেসার অফ উইন্ড। আহা, সেইরকমই একটা হোক না আমার। পুরো পৃথিবী থেকে বিদায় নয়, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
আমার এখন উইন্ড চাই। মাদ্রাজি দোকানে গিয়ে দুটো বোম্বাই পোট্যাটো চপ খুব খানিকটা চাটনি দিয়ে খেয়ে এলুম। চড়িয়ে দিলুম দু’গেলাস জল। অপেক্ষা করে করে বিকেল গড়িয়ে গেল। কোথায় কী! পেটটা কিছুক্ষণ বেলুনের মতো ফুলে রইল। সাতটার সময় সব তলিয়ে গেল। মধ্যবিত্তের হার্ট আর লিভার দুটোই বিলিতি মাল, সহজে টসকায় না। ধরলে বাতে ধরবে, না হয় ক্যানসার।
যা থাকে বরাতে। প্রথম দিনের খেলাটা মেরে দিলুম। কালার টিভির উদ্বোধন হল বলা চলে। ঘর একেবারে ভরে গেছে। যে জীবনে ক্রিকেটব্যাট চোখে দেখেনি সেও এসে বসেছে। এক ভীষণভক্ত, তিনি মনে মনে জপ করে চলেছেন। আমার হাতে রিমোট কন্ট্রোল। দুই বৃদ্ধ পাশাপাশি বসেছেন। আমার এক প্রতিবেশী, তিনি পুরোহিত, সামনের সারিতে বসেছেন। আদুর গা। পরনে ধুতি। পইতেতে বাঁধা চাবি। চেয়ারের পাশে দুলছে। একটা বাচ্চা বেড়াল থাবা মেরে মেরে সেটাকে শিকার ভেবে কাবু করার চেষ্টা করছে।
বৃদ্ধরা থেকে থেকে বলছেন, ‘একটু অ্যাডজাস্ট করো, একটু অ্যাডজাস্ট করো। খুব ব্রাইট হয়ে গেছে।’
সঙ্গে সঙ্গে আমার রিমোটকন্ট্রোল সক্রিয়। গাওস্কর বেশ ভালোই পেটাচ্ছেন, তবে শান্তিতে বসার উপায় নেই। অনবরতই সদরে কড়া নড়ে উঠছে। অফিসে না গেলেই বোঝা যায়, সারা দিনে একটা পরিবারে কত ধান্দায় কত লোক আসে। ধূপ নেবেন, বলে এক মহিলা এলেন। স্বামীর কারখানা সাতবছর বন্ধ। ধূপ এখন বাঁচার পথ। সে যেতে না যেতেই এসে গেল বিহারী ফলওয়ালা। পাওনাদার। মা ধারে আপেল আর সিঙ্গাপুরী কলা খেয়েছেন। সে যেতে না যেতেই এসে গেল, ঝ্যাঁটার কাঠি নেবে মা ঝ্যাঁটার কাঠি। তাকে পত্রপাঠ বিদায় করতে না করতেই এসে হাজির হাওড়ার এক আশ্রমের প্রতিনিধি, ‘মা আমাদের প্রতি মাসেই কিছু সাহায্য করেন।’ তাঁর ব্যবস্থা করে চেয়ারে এসে বসতে না বসতেই আবার কড়া। এবার যেন ডাকাত পড়েছে। আমার গুরুজনেরা বললেন, ‘কেন ব্যর্থ চেষ্টা করছ! তোমার বসার উপায় রাখেননি ভগবান। বহুরকমের অশান্তি তৈরি করে রেখেছে। তুমি বরং চেয়ারটা তুলে নিয়ে গিয়ে দেউড়িতেই বোসো। আমাদের একটু শান্তিতে বসতে দাও।’
ভীষণ বিরক্ত হয়ে দরজা খুলতেই দশাসই এক মহিলা। আমার পরিচিতা। একটু বেশি উচ্ছল। ইনস্টলমেন্টে শাড়ি বিক্রি করেন। মাঝেমধ্যে আমিও একটু প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছি। আমাকে প্রায় ঠেলেই ভেতরে চলে এলেন। আজ আবার একটু বেশি সাজের ঘটা। ভদ্রমহিলার সব কিছুই একটু উঁচু, উঁচু। গলা উঁচু, চলার ধরনও উঁচু, শরীরও উঁচু। ঢুকেই বললেন, ‘অব্বাবা, কাজ নেই, কম্ম নেই, একভর লোক বসে বসে ক্রিকেট দেখা হচ্ছে, আর গেল গেল চিৎকার।’ কথা শেষ করেই হাঁক পাড়লেন, ‘বউদি, কই গো কোথায় গেলে!’
বৃদ্ধরা সবাই চোখ ফেরালেন। বিরক্ত হয়ে বললে, ‘হু ইজ শি।’ আর সেই মুহূর্তে কপিল ক্যাচ তুলে বীরের মতো প্যাভেলিয়ানমুখো হলেন। সবাই বলে উঠলেন, ‘হোপলেস। হোপলেস। এই কি একটা ক্যাপ্টেনের খেলা! মাত্র ছ’রানে আউট!’
এক কপিল সমর্থক প্রতিবাদ করলেন, ‘ক্যাপ্টেন হলেই কি সেঞ্চুরি করতে হবে! ক্যাপ্টেনদের মাথায় সবসময় কত দুর্ভাবনা চেপে থাকে জানেন আপনি? এই যে ছয় করেছে, এই আমাদের বাপের ভাগ্যি! লেন হাটন কবার লেমডাক হয়েছেন জানেন? জানেন ব্র্যাডম্যান কবার হেঁচকি তুলেছিলেন। ক্রিকেট ইজ ক্রিকেট। কভী আঁধেরা, কভী উজালা।’
হঠাৎ একজন, পুরোহিমশাইকে লক্ষ্য করে, ফিসফিস করে উঠলে, ‘মহা অপয়া। উনি থাকলে আমাদের হেরে মরতে হবে। মনে আছে, এবছর তিনের পল্লির পূজামণ্ডপে আগুন ধরে গিয়েছিল। আরে উনিই তো ছিলেন পূজারি।’
সঙ্গে সঙ্গে একজন উঠে গিয়ে বললেন, ‘ঠাকুরমশাই, এবার তো আপনার পুজোয় বসার সময় হল!’
‘পুজো? আজ আবার কীসের পুজো! আজ আমার বদলি ঠিক করে এসেছি। আমি সেই লাঞ্চের সময় বাড়ি গিয়ে ঝট করে লাঞ্চ সেরে আসব। আমি আসন করে বসেছি, ডোন্ট ডিস্টার্ব। সেই থেকে ননস্টপ বগলাস্তোত্র আওড়ে চলেছি। তাই তো অতি কষ্টে কপিলের কাছ থেকে ছয় আদায় করতে পেরেছি, নয় তো শূন্যতেই বাবাজীবনকে ফিরতে হত।’
‘ঠাকুরমশাই লাঞ্চের সময় তো পেরিয়ে গেছে। বলুন ডিনার।’
‘ওই হল আমি এখন কুম্ভক করে কালকে স্তব্ধ করে রেখেছি।’
বৃদ্ধদের একজন কাছে ডেকে বললেন, ‘ওই যে ওই।’
‘কে ওই?’ পাশে হাঁটু গেড়ে বসে ফিসফিস।
‘ওই যে, যিনি ঢুকলেন, আধুনিকা, মন্দাক্রান্তা।’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ?’
‘হাটাও, আওট করে দাও। শরীর-লক্ষণ বলছে অশুভ শক্তি। প্রবেশ মাত্রেই কপিল কাত।’
আমি তো তাই চাই। তিনশো টাকার মামলা, আপাতত মুলতুবি করে দিতে পারলে মন্দ কী! আমার তো শোভা পায় না। এক তরুণ ছোকরাকে তাতিয়ে দিলুম। সে গিয়ে ওই ইনস্টলমেন্টেওয়ালিকে আউট করে দিয়ে এল।
কালকে আর কতক্ষণ স্তব্ধ করে রাখবেন, ওভারের পর ওভার এগিয়েই চলল। ভারত মাত্র একটা রানের জন্যে কুপোকাত হয়ে গেল। সবাই যেতে যেতে মন্তব্য করে গেলেন, টিভিটা অপয়া, এর আগের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে ভারত বিশ্বকাপ জিতেছিল। সাংবাদিক সংবাদপত্রের স্তম্ভে লিখলেন, হাউ নট টু উইন। পাকিস্তানের প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। শেষ ওভারের শেষ বলে ছয় মেরে ম্যাচ জেতার স্নায়ু তাঁদেরই আছে। অস্ট্রেলিয়া একটা টিম! তাঁরা তো ‘আন্ডারডগ’। আমাদের হকি তো গেছেই। ক্রিকেটটাও গেল। একটা মেয়ে অলিম্পিকে দৌড়বে বলেছিল, পি টি উষা। তার আবার শির টেনে ধরেছে। ভারতীয় ক্রিকেটবীরেরা এখন বিজ্ঞাপনে দাড়ি কামাবেন, ফলের রস খাবেন, সুদৃশ জামা পরে চলমান সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠবেন।
কপিলদেবের ঠোঁটের কাছে মাইক্রোফোন ধরে প্রশ্ন করা হল, ‘জেতা ম্যাচটা হারলেন কী করে?’
‘ডাঁট মেরে।’ তা অবশ্য বলেননি, বললেন, ‘দিস ইজ অল ইন এ ক্রিকেট। একেই বলে ক্রিকেট। এই তো জীবন। যেদিকে তাকাই। বেয়ারা হুইস্কি লে আও।’
বিনিকে জিগ্যেস করা হল, ‘শূন্যরানে আউট হলেন মশাই। একসময় কী সুন্দর খেলতেন!’
—’সো হোয়াট? প্রেমে, রাজনীতিতে আর ক্রিকেটে অসম্ভব বলে কিছু নেই। কপিদা কী করলেন!’
পরের দিন অফিসে গিয়ে উদ্বিগ্নমুখে একটা ছুটির দরখাস্ত ঠুকে দিলুম, স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ। এখন তখন অবস্থা। আরও চারটে দরখাস্ত পড়ল। ছুটি নেওয়ার ওই একই কারণ, স্ত্রী অসুস্থ। ছুটির দপ্তরের বড়বাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘বিশ্বকাপ কীরকম ভাইরাস দেখেছেন, ঘরে ঘরে স্ত্রী রা পটাপট অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আপনার ডিপার্টমেন্টের এক ভদ্রলোক আমার প্রতিবেশী। সকালে তাঁর স্ত্রী আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন টেলিফোন করতে। হাসলেন, বসলেন, চা খেলেন, তখন কি জানতুম ভদ্রমহিলা অসুখে মরোমরো।’
ওদিকে পাকিস্তানের বিজয়রথ গড়গড়িয়ে চলল। শ্রীলঙ্কা কাত। ইংল্যান্ড ফ্ল্যাট। ভারতকে লাহোরে গিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়তে হবে। কী হবে ভাই, বলে কলেজে মেয়েরা একে অন্যের ঘাড়ে গড়িয়ে পড়লেন। শরীরের ওজন কমছে, কী ব্লাডপ্রেসার কমছে বলে মানুষ যত না ভেবে পড়ল, রানরেট কমছে বলে তার চেয়ে বেশি ভাবনা। বাজারে সাতসকালে দুজনে দেখা। প্রশ্ন, ‘এখন কত যাচ্ছে?’ উত্তর, ‘পঁয়তাল্লিশ টাকা।’
‘ধ্যার মশাই, তেলের দাম কে জিগ্যেস করছে! তেলের রেট নয়, রানরেট কত যাচ্ছে।’
‘পড়েছেন, আপনাদের কপিল গাওস্করকে কীরকম ঝেড়েছে?’
‘ঝেড়েছে না কি! বেশ করেছে। না ব্যাটে, না বলে?’
‘আপনি গাওস্করের কী বোঝেন?’
‘আপনি কপিলের কী বোঝেন? এ আপনার গঙ্গাসাগরের কপিল নয়, হরিয়ানার টাইগার।’
‘বোম্বে ভার্সাস পাঞ্জাব হচ্ছে।’
‘সে খেলা আবার কবে?’
‘কবে আবার কী, ভারতের ক্রিকেটের আসল খেলাটাই তো বোম্বে আর পাঞ্জাবে। দেখা যাক সিদ্ধার্থ রায় কী করেন?’
‘শুনেছি ভালো ব্যাটসম্যান। পশ্চিমবাংলায় যখন চিফ মিনিস্টার ছিলেন, চকোলেট রঙের গেঞ্জি পরে প্রায়ই মাঠে নেমে পড়তেন।’
‘উনি তো এখন খালিস্তানীদের বিরুদ্ধে ব্যাট করছেন; সে তো দীর্ঘ ইনিংস!’
‘কী থেকে কী হয়, কেউ কি বলতে পারে।’
‘বাট গাওস্কর ইজ গাওস্কর। গাওস্কর মানেই রেকর্ড। কপিলের কি রেকর্ড আছে মশাই।’
নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে গাওস্কর রেকর্ড করলেন। গোটা ম্যাচটাই রেকর্ড। পরপর তিনটে উইকেট নিয়ে বোলারের হ্যাটট্রিক। সারাটা জীবনের মতো তাঁর হয়ে গেল। ওই রেকর্ড ভাঙাও আর খাও। ছবি বাঁধাইয়ের দোকানে কাতারে কাতারে গাওস্কর। কার্ডবোর্ড দিয়ে বাঁধালে পঁচাত্তর, প্লেন পঞ্চাশ।
‘লক্ষ্মীবাইন্ডারে’র মালিক বললেন, ‘তোমার বাবার ছবিটা বাঁধাই হয়ে আজ এক বছরের ওপর পড়ে আছে; সেটার আগে ডেলিভারি নাও, তারপর না হয়…?’
‘হেল উইথ ইওর ফাদার। এটাকে আগে চড়িয়ে দিন। ফাইনালের পর মালাটা আমি কোথায় চড়াব?
আমার সহকর্মী, ক্রিকেট-পাগল তানাজির থেকে থেকে ভাবসমাধি হতে লাগল। ঘোরলাগা মানুষের মতো একবার এদিকে যায়, একবার ওদিক যায়। সমবায়িকায় রেপসিড অয়েলের লাইনে দাঁড়িয়ে একবার সামনের ভদ্রলোককে বলে, ‘গাওস্কর কী করলে দেখছেন।’ একবার পেছনের সুন্দরী ভদ্রমহিলাকে বলে, ‘এর নাম গাওস্কর। রেকর্ড। সারা জীবনটাই রেকর্ডের মালা। ওয়ান ডে ক্রিকেটে তিন হাজার রানের রেকর্ড।’ চোখের দিকে তাকালে ভয় করে। ঠেলে যেন বেরিয়ে আসছে। কাজ করবে কী, চেয়ারে চেপে বসানোই যাচ্ছে না। এরই মধ্যে হাজারখানেক টাকার ক্রিকেটের বই কিনেছে। মুড়ি কিনে এনেছিল। ঠোঙায় গাওস্করের ছবি দেখে মুড়ি খাওয়া মাথায় উঠল। সব ফেলে ঠোঙা খুলে ইস্তিরি করতে বসে গেল। দু’দিকে দুটো রেডিও ফিট করে রিলে শোনে। কোনও কমেন্টস যেন মিস না করে। তানাজির পাশে বসেন সিনিয়ার জ্যোতিষদা। তিনি আবার রিলে শুনতে শুনতে কাগজে নোট করেন। রানের সংখ্যা, বলের সংখ্যা, অ্যাভারেজ, আস্কিং রেট। গণিতে পাকা। তাই কোনও কাঁচা কাজ নেই। একদিকে গড়গড় করে প্রুফ দেখছেন, অন্যদিকে খেলার গতি অনুসরণ করছেন।
সারা ভারত জেনে গেল, ভারত আবার ওয়ার্ল্ড কাপ জিতছে। কারুর ক্ষমতা নেই ভারতকে ঠেকায়। ব্যাটে মার আছে। শুধু চার আর ছয়। শরীরে কুলোলে মাঝে মধ্যে খুচরো এক কি দুই। ভারতের বল্লেবাজরা এবারের ওয়ার্ল্ড কাপে আঠাশটা ছয় মেরেছেন। যেখানে ইংল্যান্ডের ব্যাটধারীরা মেরেছেন মাত্র আটটা। ভারতীয় বোলারদের হাতে বল ঘোরে। বল ছোটে। পৃথিবীর সেরা টিম। আর কি, কাপ আমাদের! পাকিস্তান বিদায় নিয়েছে।
টাকে চুল গজাবার মতো, কলকাতার ব্রহ্মতালুর খানিকটা অংশকে খুবসুরত করার খেলা চলেছে। ফুটপাথে রং চড়ছে। এক জায়গায় খানিকটা অশ্বকৃত্য পড়েছিল সেটাও রং হয়ে গেল। আবর্জনা, তার ওপর দিয়েই বুরুশ চলে গেল। সরাবার কী সারাবার আর সময় নেই। এখানে ওখানে তোরণ খাড়া হল। আগেকার বাবুদের যেমন ধুতি আর পাঞ্জাবির সাদা রং মিলত না, অনেকটা সেইরকম। ধুতি লালচে জামা দুধ-সাদা। কলকাতার ভূষণ অনেকটা সেই ধরনেরই হয়ে রইল। তা থাক। প্রচারেই আমরা তিলোত্তমা করে দেব।
‘সুপারসোকার’ বলে একটা সাত লাখ টাকায় যন্ত্র এসেছে। নিমেষে মাঠ শুকিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই অস্ট্রেলিয়ান যন্ত্র। সেই যন্ত্র চেপে এক মন্ত্রী সারা মাঠে ফুরফুর করে হাওয়া খেতে খেতে ঘুরে বেড়ালেন। সাংবাদিকরা ছবি তুললেন। যন্ত্রের সাক্ষাৎকার নেওয়া হল। যন্ত্র অবশ্য কথা বলল না। বললেন প্রতিনিধি। মাঠে দশ বালতি জল ঢেলে যন্ত্র চালানো হল। সঙ্গে সঙ্গে ইস্ত্রি। সবাই ধন্য ধন্য করলেন। অনেকেই চাইলেন বৃষ্টি আসুক। যন্ত্রের মহিমা দেখা যাক।
প্রার্থনা শুনলেন বরুণদেব। একটা নিম্নচাপ ঠেলে দিলেন। আকাশ কালো হয়ে এল। অন্ধ্রে হাজারদশেক বাড়ি ভেঙে পড়ল। প্রাণ হারালেন কুড়িজন। কলকাতার ক্রিকেট ব্যারনরা পড়ে গেলেন মহাফাঁপরে। সাত লাখ টাকা উসুলের জন্যে বৃষ্টি চাই। বৃষ্টি এদিকে দরমা চ্যাটাই আর পিচবোর্ডের তোরণের চাকচিক্য শেষ করে দিলে। রাস্তায় কাদায় পার্ক স্ট্রিটের রঙের জেল্লা ছেতরে গেল। প্রবীণা মহিলাকে কি আর অঙ্গরাগে যৌবন ফিরিয়ে দেওয়া যায়।
দু’লরি খাসা জঞ্জাল চলেছে আলিপুর রোডের দিকে। চালক মাঝে মাঝে জিগ্যেস করছেন, ‘ডালমিয়া সায়েবের বাড়ি কোনটা?’
‘কোন ডালমিয়া?’
‘ওই যে ক্রিকেট-মিয়া।’
‘তিনি তো গোয়েঙ্কা!’
‘ওই হল। দু’লরি মাল ডেলিভারি দিতে হবে।’
‘জঞ্জাল ডেলিভারি!’
‘কেন?’
‘এটা আমাদের পৌর আন্দোলন। হয় টিকিট দাও, না হয় জঞ্জাল নাও।’
টিকিট নিয়ে খাবলাখাবলি শুরু হয়ে গেল। কিছু টিকিট চলে গেল অন্তরালে, চোরা পথে পরে বেরোবে বলে। ক্রিকেট তো শুধু খেলা নয়। বড় ব্যাবসা। বিগ বিজনেস। ধর্মের সঙ্গে মিল আছে। ক্রিকেট ধর্ম। গুরুরা আসছেন ভায়া বোম্বে।
সেমিফাইনাল। ভারত বনাম ইংল্যান্ড। কত রানে যে হারবে ইংল্যান্ড। ভারত যেরকম টপ ফর্মে রয়েছে! মেরে আর ফেলে ফাটিয়ে দেব। গাওস্কর তো কেবল ছয় মারবেন। ছয়ের মাঝে হাইফেনের মতো গোটাকতক চার। শর্ট রান নেওয়ার আর দরকার কি!
প্রতিবেশীর বাড়িতে মাইফেলের মতো ক্রিকেট দেখার আসর বসেছে। ওই বাড়িতে আর এক গাওস্করের কুঁড়ি ধরেছে। বয়সে তরুণ, কেতায় তরুণের বাবা। সে এখন ড্রেস প্র্যাকটিস করছে। পাড়ার মাঠে খেলতে যাওয়ার আগে তার ড্রেসের কী ঘটা। যেন লেন-হাটন নেট-প্র্যাকটিসে চলেছে। ধবধবে সাদা জামাপ্যান্ট। পায়ে লেগ-গার্ড। ক্রিকেট হেলমেট নেই, বদলে স্কুটার হেলমেট। ব্যাটটা যে-কায়দায় দোলায়, সারা জীবনে কত সেঞ্চুরি যে করবে! রাতে ছাদে আলো জ্বেলে, দুটো বাঁশের সঙ্গে বাঁধা আর একটা বাঁশে বল ঝুলিয়ে প্রায় মাঝ রাত পর্যন্ত শ্যাডো-প্র্যাকটিস করে। পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে। অনেক চামচা জুটেছে। দোতলার ঘরে টিভি। তার সামনে জনাচোদ্দো ছেলে। হো হো চিৎকার। কানপাতাই দায়। সে আজ দশ কেজি বুড়িমার চকোলেট বোমা কিনে আসর সাজিয়েছে। ইংল্যান্ডের এক একজন আউট হচ্ছেন আর দোতলা থেকে আশপাশের বাড়িতে বিকট শব্দে বোমা ঝাঁপিয়ে পড়ছে; সঙ্গে ডাকাতে চিৎকার। সেই চিৎকার মনে হয় বোম্বের মাঠের খেলোয়াড়রাও শুনতে পাচ্ছেন; কারণ মাঝে মাঝেই তাঁরা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন।
ভারত মাঠে নামার সঙ্গে সঙ্গে পরপর গোটা ছয়-সাত বোমা ফাটল। ওদের নিজেদের বাড়িরই জানলার কাচ ভেঙে পড়ে গেল। গাওস্কর পোজিশান নিলেন। অপর প্রান্তে বোলার বোলিং রান শুরু করেছেন। বুক ঢিপঢিপ করছে। অনেকেরই ঠোঁট বিড়বিড় করছে। মনে হয় বলছেন, জয় বাবা গাওস্কর। তোমাকে বিশ্বাস নেই বাবা। নেগেটিভ, পজেটিভ দুটো রেকর্ডই তোমার হাতের মুঠোয়। চোখ বুঝিয়ে ছিলুম। ঘরের সবাই চিৎকার করে উঠলেন, ‘পেরেছে। পেরেছে।’
বৃন্দাবনবাবুকে ডাক্তার বলেছেন, একদিনের ক্রিকেটের শেষটা আপনি দেখবেন না। আপনার হার্ট নেবে না। আমারও সেই একই অবস্থা। অধিকাংশ সময় চোখ বুজিয়েই থাকি। হইহই শুনলেই চোখ খুলি। বুঝতে পারি ব্যাটে-বলে হয়েছে। গাওস্করের পরের মারটা দেখার জন্যে সাহস করে চোখ খুলেই রেখেছিলুম। সেই মার যাকে বিদেশি সাংবাদিকরা বলেন, ‘ফ্যান্টাসটিক।’ ‘স্পেকটাক্যুলার’। গাওস্কর ব্যাট তুললেন। বল পায়ের ফাঁক দিয়ে গলে স্ট্যাম্প ছেতরে দিলে। কমেন্টটার চিৎকার করে উঠলেন, ‘আউট, হি ইজ ডেফিনিটলি বোল্ড আউট। বৃন্দাবনবাবুর কলেজে-পড়া মেয়ে, ‘ও গাওস্কর’, বলে গোল গার্ডেন চেয়ার থেকে উলটে মেঝেতে পড়ে গেল।
কে একজন বললেন, ‘বা:, বাপের বদলে মেয়ের স্ট্রোক হয়ে গেল। সানস্ট্রোক, হার্ট স্ট্রোক নয় ক্রিকেট স্ট্রোক!’
তাকে ধরাধরি করে তুলে বিছানায় শোওয়ানো হল।
বৃন্দাবনবাবু চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে দেখাতে লাগলেন গাওস্করের বলটা কী ভাবে খেলা উচিত ছিল, ‘এই পা দুটো সামনে জড়ো করা, তার সামনে ব্যাট ফ্ল্যাট। তারপর টুক করে ঠুক।’
স্ক্রিন আটকে গেছে। সকলের চিৎকার, ‘বসে পড়ুন। বসে পড়ুন।’
বাঙালির রক্তে যে কি নেই। স্লো-মোশান শুরু হয়েছে। আমাদের স্লো-মোশান যেমন হয়। ব্যাটসমান ব্যাট তুললেন। ধীরে বাঁদিকে ঘুরলেন। ক্যামেরা খেলোয়াড়ের পাছায় ফোকাস করে সেইখানেই আটকে রইল। বলের কী হল! কোথায় গেল! কে লুফল, দেখাবার উপায় নেই। গাওস্কর গ্লাভস খুলতে খুলতে প্যাভেলিয়ানে ফিরে আসছেন।
নিতুর হাহাকার, ‘এ কী করলে গুরু। তোমার খেলা দেখব বলে, ছুটি পাওনা নেই, তাও ছুটি নিলুম। ছিছি, গুরু, এ কী করলে!’
‘কপিলকে লাস্ট মোমেন্টে ল্যাং মেরে বেরিয়ে গেল। ছোটবড় অনেক কথা তুমি বলেছিলে ক্যাপ্টেন। এইবার ম্যাও সামলাও।’
‘কিচ্ছু, ভাববার নেই। ভারতের ক্রিকেট, খেলা নির্ভর নয় মশাই, ভাগ্য-নির্ভর, দেখবেন লাস্ট মোমেন্টে একজন সেভিয়ার হয়ে দাঁড়াবে। তা ছাড়া আমাদের কপিলভাই আছে। এসেই বেধড়ক পেটাবে বাঘের বাচ্চার মতো। রানের ভলক্যানো ছুটবে।’
কপিলভাই এলেন। মহিলারা আদর করে বললেন, ‘ওই যে কপলে এসেছে। কপলে। দেখি বাছা শ’খানেক তুলে দিয়ে যাও তো! এবারে তোমার ব্যাটও গেছে, বলও গেছে।’
কপিল ক্রিজে এসে দাঁড়ালেন। হাঁ করে, ফ্যালফ্যালে, ভ্যালভ্যালে মুখে, এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন।
‘কী খুঁজছেন বলুন তো?’
‘স্ট্যাডিয়াম দেখছেন। দেখছেন ক’জন ফিল্মস্টার এসেছেন?’
‘না না, বউকে খুঁজছেন। তাঁর ইশারাতেই তো ছয় আর চার হবে। ইনস্পিরেশান।’
প্রথম বলটা কপিল মেরেছেন। সবাই গানের সুরে গেয়ে উঠলেন, ‘মেরেছে। মেরেছে। পেরেছে। পেরেছে।’ গাওস্কর চলে যাওয়ার পর, দর্শকরা এত হতাশ হয়েছেন, ধরেই নিয়েছেন, এঁরা আসবেন আর যাবেন। কপিল আবার সেই ফ্যালফ্যালে মুখে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছেন। পেন্টের কোমরে আঙুল ঢুকিয়ে টানাটানি করছেন।
‘কী হয়েছে বলুন তো?’
‘অস্বস্তি হচ্ছে! মনে হয় নিম্নবেগ।’
‘ছারপোকাও হতে পারে।’
‘না না। ভীষণ মুডি প্লেয়ার । আজ আর খেলায় তেমন মুড নেই।’
‘মুড নেই! মামার বাড়ি। ভারতকে জেতাতেই হবে। কলকাতা সেজে বসে আছে, আসতেই হবে। পেটাও ভাই পেটাও। একটু হাত খোলো। ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।’
কপিল হাত খুললেন। মার ছককা। বল আকাশে। বাউন্ডারি লাইনের কাছে নামছে। এক জোড়া হাত ধরার জন্যে প্রস্তুত। সবাই মনে মনে বলছেন, মিস, মিস্টার, মিসেস। বিলিতি থাবা। কমেন্টটার চিৎকার করে উঠলেন, ‘আউট। কপিল আউট।’
কপিল ফ্যালফ্যালে মুখে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছেন। আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল। বৃন্দাবনবাবু হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন। তিনি উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘ইনজাংশান, ইনজাংশান।’
‘ইনজাংশান মানে।’
‘এখনও বোম্বে হাইকোর্ট খোলা আছে। সোজা গাড়ি নিয়ে চলে যাও।’ তিনশো তেত্রিশ ধারায় একটা স্টে-অর্ডার নিয়ে এসে খেলা বন্ধ করে দাও। আবার গোড়া থেকে শুরু করো। স্টেডিয়ামে অতগুলো লোক বসে বসে হায়হায় করছে। এই সামান্য বুদ্ধিটুকু মাথায় আসছে না! দেশে আইন-আদালত রয়েছে কীসের জন্যে! দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার। সংবিধানবিরোধী!’
‘বেআইনি তো কিছু করেনি ইংল্যান্ড।’
‘করেছেন আম্পায়ার। এল বি ডব্লু মানেই জোচ্চুরি। কপিলের ক্যাচটা বাউন্ডারির বাইরে। আই অ্যাম সিওর অফ ইট। আজ আমি বোম্বেতে থাকলে খেলা বন্ধ করিয়ে দিতুম। একটা গাড়ি ওই ওয়ানখাড়ে স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আসত। সোজা হাইকোর্ট। ম্যাচের বারোটা।’
ভেবে আর লাভ নেই। এদিকে একে একে নিবিছে দেউটি। ভারতীয় খেলোয়াড়দের অন্য কোথাও বড় ধরনের কোনও অ্যাপার্টমেন্ট আছে মনে হয়। সব এলোমেলো। একে একে আসছেন আর উইকেট ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছেন। কে কত কম রানে আউট হতে পারে তারই যেন কম্পিটিশন চলেছে।
একজন করুণ সুরে বললেন, ‘আর কি কোনও আশা নেই ভাই?’
‘আর ব্যাটসম্যান কোথায়! সবাই তো বোলার!’
‘কেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পাকিস্তান তো পেরেছিল।’
‘সে ভাই পাকিস্তান। তাদের কলজের জোর আছে।’
বৃন্দাবনবাবু বললেন, ‘টিভি বন্ধ করে দাও। এর আর কোনও আশা নেই। হকি গেল। ফুটবল গেল। ক্রিকেটটাও গেল। ফিনিশড। এ টিম আর কোনওদিন উঠতে পারবে না।’
শেষ ওভারের শেষ বল। রিলায়েন্স কাপ থেকে ভারতের বিদায়। কপিলস ডেভিল হয়ে গেল কপিলস ইভিল। সারা পাড়ায় নেমে এল নিস্তব্ধতা। সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে দুম করে একটা বোমা ফাটল কোথায়।
‘কে বোম ফাটায়। চল, চল। দেশের শত্রু। মেরে ক্যালেন্ডার করে দিয়ে আসি।’
প্রবীরবাবুর ছেলে বোম ফাটিয়েছে। ‘বেরিয়ে আয় শালা।’
ছেলেটি বেরিয়ে এসে বললে, ‘এ বোম সে বোম নয়।’
‘তার মানে?’
‘এ হল কালীপুজোর বোম।’
কালীপুজোর বোম। মার শালাকে। মেরে চিত্রকুট করে দে।’
‘ব্যাটাকে বোম মেরে শুয়োর করে দে। ইংল্যান্ডের সাপোর্টার।’
ছেলেটা হাসপাতালে চলে গেল। মোড়ে মোড়ে জটলা। এক এক জটলায় এক এক আলোচনা।
‘ওই বোম্বের টিভি কোম্পানিই এর মূলে। চার মারলে পাঁচশো, ছয় মারলে হাজার।’
‘আর ওই নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে খেলায় গাওস্করের সেঞ্চুরি। কত পেয়েছেন জানিস, ২৫ হাজার।’
‘আর লোগো কেলেঙ্কারির কথাটা বলো। ওটা চেপে গেলে চলবে কেন? লোগোর লড়াইয়ে তো দশজন খেলোয়াড় চুক্তি সই করতে চাইছিলেন না।’
‘আর বিজ্ঞাপনের কথাটাও বলো। গাওস্করকে তুমি সাতটা কোম্পানির বিজ্ঞাপনে দেখতে পাবে। কপিল দেবকে ছ’টায়। রোজগার জানো, প্রত্যেকে দশ লাখ টাকা কামিয়েছেন।’
‘ক্রিকেট আর খেলতে হবে না। বিজ্ঞাপনেই ক্রিকেট খেলতে বলো।’
একটি মেয়ে তার প্রেমিককে বলছে, ‘আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না বিশু। মনে হচ্ছে জলে ডুবে আত্মহত্যা করি।’
‘কোরো না মাইরি। একে আমি ভারতের শোকে মরছি। তুমি মরে গেলে ডবল শোক সহ্য করতে পারব না। ক্রিকেট গেছে যাক, আমি তো আছি মানু। সরে এসো, এই দু:খের দিনে তোমার ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকাই।’
‘ওসব বাহানা ছাড়ো। কারুর সর্বনাশ। কারুর পৌষ মাস।’
‘বাচ্চা কাঁদলে ললিপপ পায়।’
‘আমার ঠোঁটটাকে তোমার ললিপপ হতে দেব না গুরু।’
ডবলডেকার বাসের পেছনে হাতে লেখা বড় বড় পোস্টার পড়ে গেল। ক্রিকেটকন্ট্রোল বোর্ড ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও। কপিল তুমি সরে যাও। তোমাকে চাইছি না, চাইব না। আমার পাশের প্রতিবেশী ভারত ফাইনালে যাবেই জেনে দু’বোতল হুইস্কি মজুত করেছিলেন, আর বউকে দিয়ে দু’কেজি মাংস রাঁধিয়ে ছিলেন। মাংস গেল রাস্তায়। হুইস্কি চলে গেল পেটে। সারা রাত ভদ্রলোকের আর্তনাদ, ‘হায় হায়। ওই অপয়াটার জন্যে আমার সোনার বাংলা শ্মশান হয়ে গেল রে!’ ডুকরে ডুকরে কান্না।
‘কে অপয়া!’
‘আমি গো, আমি। টিভির সামনে থেকে উঠে গেলেই ছয়। এসে বসলেই আউট। বন্ধুগণ। ও বন্ধুগণ আমাকে জুতিয়ে লাশ করে দাও।’
শেষে গান ধরলেন, ‘কী যে করি। উরে বাবারে! কী যে করি! উরে বাবারে!’
সারা রাত মাংস নিয়ে গোটাচারেক কুকুরের চুলোচুলি। বাপের জন্মে ওরকম মাংস খায়নি।
কাতারে কাতারে লোক ছুটছে ইডেনের দিকে। ক্লাব হাউসের সামনে পা ফেলার জায়গা নেই। কাল ফাইনাল। এক প্রবীর বলছেন, ‘জিনিসটা করেছে ভালো। তবে কী জানেন, একেই বলে নেপোয় মারে দই। কার আশায় আসর সাজানো হল; আর আসছে কারা! বেত দিয়ে গেট করেছে দেখছেন! একে বলে শিল্প।’
গাড়ি করে একজন ফিল্মস্টার চলেছেন। সমঝদারের চোখ। সবাই শোক ভুলে হইহই করে উঠলেন। পুলিসের ঘোড়া ছুটে এল। লম্বাচওড়া বিখ্যাত এক লেখক ঢোলা পাজামা আর গেরুয়া পাঞ্জাবি পরে এগিয়ে আসছেন। আলোকিত ইডেন দেখতে এসেছেন। ফ্যানরা ঠিক ধরে ফেলেছে। বাসের টিকিটের পেছনে অটোগ্রাফ দেওয়ার অনুরোধ। ফাইবার গ্লাসের স্বচ্ছ চাঁদোয়া দেখে এক মহিলার কী উল্লাস। টিভি সম্প্রসারণের ঘেরাটোপের বাইরে থেকে কৌতূহলী মানুষের উঁকিঝুঁকি। অনেকেই কলকাতার অভ্যাসবশে চারপাশে ঘুরঘুর করছে যদি একটু করা যায়। তক্কেতক্কে আছেন! চক্ষুলজ্জা বাধা দিচ্ছে।
সূর্য পশ্চিমে তলিয়ে গেল। সুনীল আকাশ। আবহাওয়া ফিরল, ভারতের ভাগ্য ফিরল না। টিকিটের ভাগ্য দিয়ে সবুজ মাঠে সারসার বসে গেছেন লোভীরা। বাণিজ্য করার আশায় টিকিট ধরেছিলেন সব। এখন ভরাডুবি। ভারত নেই। টিকিটের চাহিদাও নেই। পাবলিক এক একজনের কাছে যাচ্ছেন আর উঁকি মেরে বলছেন, ‘দেখি এই দোকানে কি পাওয়া যাচ্ছে।’ বিক্রেতা, ক্লান্ত শুকনো মুখে তাকাচ্ছেন। সামনে ইট চাপা দশখানা, চারশো টাকা দামের টিকিট। চারশো একশোয় নেমেছে, তবু ক্রেতা নেই। নির্জন জায়গায় একটি ছেলে দাঁড়িয়ে। চোখে পুরু লেনসের চশমা। হাতে ধরে আছেন একটি মাত্র টিকিট। সকাল থেকে খাড়া। ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। চুলে ধুলো। পাশে যেতেই বললেন, ‘নেবেন দাদা?’
‘কত দাম?’
‘চারশো।’
‘কমে?’
ছেলেটি কেঁদে ফেলল। ছাত্র। থাকে খড়গপুরে। নতুন সাইকেল বেচে ভারতের বিশ্বজয় দেখবে বলে টিকিট কিনেছিল। খেলা আর দেখতে চায় না। প্রয়োজনীয় সাইকেলটা ফিরে পেতে চায়। পকেটে একটা লজেন্স ছিল, এগিয়ে দিলুম, ‘নাও, মুখে ফেলে দাও। একসময় আমি ক্রিকেট ফ্যান ছিলুম। বৃহস্পতিবার থেকে ড্যাংগুলি ফ্যান।’
পাশ দিয়ে একটি দল যেতে যেতে বললে, ‘ঠিক হয়েছে। সব ব্যাটাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে।’