পথে পথে কবিতা
কলকাতাকে অনেক সময় কবিতার শহর বলা হয়। বিশেষ করে পঁচিশে বৈশাখের আগে ও পরে বেশ কয়েকদিন রবীন্দ্রসদন ও আশেপাশে কবির হাট বসে যায়, কবিতার মেলা।
কলকাতার মতো এত কবি বোধহয় পৃথিবীর আর কোনও শহরে নেই। পঁচিশে বৈশাখে বা পুজোর সময় শহর ও শহরতলি থেকে যে পরিমাণ কবিতার কাগজ বের হয়, বইমেলার সময় যে সংখ্যক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় অন্যান্য ভাষার কবিবৃন্দ তা শুনলে অবাক হয়ে যান, এসব তাঁদের কল্পনার অতীত।
অবশ্য প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় কবিতা উৎসবে ঢাকা শহর যেভাবে মেতে ওঠে তার কোনও তুলনা হয় না। কবিতা উৎসবের অব্যবহিত পরে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে আমজনতা যেভাবে অংশগ্রহণ করে, কবিতার ছন্দে-তালে-লয়ে একটা প্রাচীন নগরী যে রকম আলোকিত হয়, পৃথিবীতে কোথাও সম্ভবত তার তুলনা নেই।
তবে কবিতার ব্যাপারে একদিক থেকে মেক্সিকো শহর সারা পৃথিবীকে টেক্কা দিয়েছে।
আমরা ইংরেজি বানান দেখে বলি মেক্সিকো। মেক্সিকো দেশের রাজধানী মেক্সিকো নগর। পৃথিবীর বৃহত্তম নগরগুলির প্রথম সারিতে মেক্সিকো।
মেক্সিকোর লোকেরা কিন্তু তাদের দেশ বা শহরকে মেক্সিকো বলে না। স্থানীয় উচ্চারণে মেক্সিকো হল মেহিকো। মার্কিনিরাও দেখলাম মেক্সিকানদের বলে মেহিকান।
সে যা হোক, মেহিকো বা মেহিকান নয়, আমরা মেক্সিকো বা মেক্সিকান বলব।
মেক্সিকোর লোকেরাও কিন্তু ঠিক আমাদের কলকাতা বা ঢাকা শহরের মতো ভাবেন যে তাদের শহরও কবিতার শহর।
মেক্সিকোর কবি অক্তাভিয়ো পাজ সাহিত্যে নোবেল জয়ী। তিনি একদা ভারতে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
কিন্তু এ রকম নোবেলজয়ী বা তদনুরূপ জগৎ বিখ্যাত কবি জগৎ সংসারের বহু শহরেই আছেন। তার জন্য নয়, আসলে কবিতা ছড়িয়ে আছে মেক্সিকোর রাস্তায় রাস্তায়, এই শহরের রাজপথগুলির নামকরণে।
মেক্সিকোর পাশেই মার্কিন দেশ। সেখানে নিউইয়র্ক শহরের প্রধান অঞ্চলে রাস্তার নামকরণ নম্বর দিয়ে পুব থেকে পশ্চিমে ইস্ট এবং ওয়েস্ট স্ট্রিট। আর উত্তর দক্ষিণে অ্যাভিনিউ তৃতীয় অ্যাভিনিউ পঞ্চম অ্যাভিনিউ ইত্যাদি। দুয়েকটি অ্যাভিনিউয়ের সঙ্গে লোকনায়ক, সেনাপতি, বিখ্যাত ব্যক্তি এদের নাম জড়িত, যেমন ম্যাডিসন অ্যাভিনিউ, লেক্সিংটন অ্যাভিনিউ। আমি একবার ডোরালস ইন নামে একটা হোটেলে ছিলাম, ঠিকানা ছিল ফরটি নাইনথ অন লেক্সিংটন, অর্থাৎ ঊনপঞ্চাশ নম্বর রাস্তা এবং লেক্সিংটন অ্যাভিনিউয়ের মোড়।
মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটনেও রাস্তার নাম অনেক অংশেই নম্বর দিয়ে। আমাদের সল্টলেক উপনগরীতেও সম্প্রতি নম্বর দিয়ে নামকরণ চালু হয়েছে।
এবার মেক্সিকোর রাস্তার নামকরণে আসি। এই শহরটি বাড়ছে তো বাড়ছেই, কলকাতার মতো ক্রমাগত ছড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ শতকের গোড়ায় মেক্সিকো নগরে অধিবাসী ছিল লাখ দশেক। এখন অধিবাসী সংখ্যা প্রায় দু’ কোটি।
নতুন জনপদ, নতুন শহরতলি বাড়ছে। বাড়ছে রাস্তা। এতসব রাস্তার নতুন নাম দেওয়া সোজা কাজ নয়। সেনাপতিদের নাম, রাষ্ট্রনায়কদের নাম, মহাপুরুষ বা গণ্যমান্যদের তালিকা সব ফুরিয়ে গেছে। ফলে এখন রাস্তার নাম রাখতে গিয়ে পুর কর্তৃপক্ষকে অন্যরকম ভাবতে হচ্ছে।
মেক্সিকোর নাগরিকরা এখন যেসব রাস্তায় বসবাস করেন, কাজকর্ম করেন, বাজারহাট করেন তার অনেকগুলির নাম এইরকম:
আলোর অরণ্য, জলের আয়না, স্মৃতির উদ্যান, স্বপনের সমুদ্র।
এইরকম অসংখ্য সব নাম। রহস্য বনানী এবং অলৌকিক অরণ্য কাছাকাছি দুটি রাস্তা। আশাপথ গিয়ে শেষ হয়েছে সৌভাগ্য সরণিতে।
শুধু এই নয়।
পৃথিবীর মানচিত্র একাকার হয়ে গেছে মেক্সিকোর রাজপথে। হিমালয় পর্বত নেমেছে আল্পস পাহাড়ে। রাশিয়ার ভলগা নদী মিশে গেছে মিশরের নীলনদে।
কাব্য ও কল্পনার, বাস্তব ও অলৌকিকের সমাহার ঘটেছে এইসব রাস্তার নামকরণে।
যতরকম ফুল আছে, পাখি আছে, বিচিত্র উদ্ভিদ আছে, রাশি-নক্ষত্রেরা আছে, রূপকথার উপকথার চরিত্রেরা আছে—কে নেই মেক্সিকোর রাস্তায়।
আছেন কালজয়ী লেখক এবং কবিবৃন্দ, দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিকেরা। ভিক্টর হুগো স্ট্রিটকে কেটে বেরিয়ে গেছে শেক্সপিয়ার সরণি। বেটোফেন গিয়ে পড়েছে বাখে।
আছেন টলস্টয় এবং দান্তে, ডিকেনস এবং মলেয়ার, সক্রেটিস এবং ডারউইন।
এর পরেও আছে বছরের প্রত্যেকটি মাসের নামে একেকটি রাস্তা, জানুয়ারি মার্গ থেকে ডিসেম্বর মার্গ।
এত সবের পরেও যখন জনাকীর্ণ একটি আধুনিক শহরের রাজপথে পৌঁছে দেখি রাস্তার নাম ‘ধানের খেত’ কিংবা ‘গমের পথ’, একটু থামতে হয় বইকি। কারণ একটু সামনেই কবুতর সরণিতে আমার বাল্যবন্ধু ইয়াসিন থাকে, শালিকডাঙার হোটেল থেকে তার ওখানেই যাচ্ছি নৈশ আহারে।