পথের যাত্রায় দিনের সূচনা
আর্থিক অনটনে দিনগুলো আবার ধূসর হয়ে গেলো। শ্বশুর ইলাহি বখশ খান ইন্তেকাল করার ফলে মাথার ওপর থেকে ছায়া সরে গেছে। নওয়াবের কাছ থেকে প্রাপ্য ভাতা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। ঠিক করলেন কলকাতায় গিয়ে পেনসন বিষয়ক মামলার সুরাহা করবেন।
টাকা-পয়সা নেই বলে নিজের অভ্যাস বদলে ফেলে একটা পথ বের করবেন সেটা আর হবে না। বরং টাকার সন্ধান করাই হবে উত্তম। তিনি বন্ধ করতে পারবেন না ফরাসি মদ খাওয়া। বন্ধ করতে পারবেন না জুয়া খেলা। আর তাওয়াফদের কাছে তো যাবেনই। তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় না করলে নেশা জমে না। স্রোতের মতো বেরিয়ে যায় কড়ি। আঙুলে গুণে হিসাব করা তাঁর স্বভাবে নেই। নিজেকেই শোনালেন শের :
‘আমার এই অশান্ত স্বভাবের ওপর
নিজের কোনোই নিয়ন্ত্রণ নেই।
আসলে গলার মুক্তাহারে
জৌলুসের যে তরঙ্গ
তা আমাকে অস্থির করে তোলে।’
পায়চারি করতে করতে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন নওয়াব আহমদ বখশের ওপর। তিনি তাঁর চাচা নসরুল্লাহ বেগের শ্বশুর। তাঁরই ছোট ভাই ইলাহি বখশ খানের মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছেন। তাঁরা তাঁর দিল্লিতে বাস করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশদের দেয়া ভাতার হিসাব করতে বসে তিনি দেখলেন বড় ধরনের গরমিল আছে। ব্রিটিশরা যে টাকা দিয়েছিল তা বরাদ্দ করেছিলেন আহমদ বখশ খান। তিনি গালিবকে তাঁর বরাদ্দ দশ হাজার টাকা না দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর ছোট ভাই ইউসুফকেও বঞ্চিত করেছেন আহমদ বখশ। এই টাকার ভাগীদার হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন খাওয়াজা হাজি নামে একজনকে। এই লোক কোনো দিক থেকেই তাঁর চাচার আত্মীয় নন। আহমদ বখশের এই নোংরা আচরণকে তিনি সংযমের সঙ্গেই মোকাবিলা করেছেন। কারণ তিনি তাঁর মুরুব্বি। এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে সরকারের কাছে কোনো নালিশ করেননি। যে অবিচার তিনি করে যাচ্ছেন সেটা গালিব বিনা প্রতিবাদে মেনে যাচ্ছেন।
কিন্তু কতদিন মানবেন?
দিন গড়ালো। আহমদ বখশ খান আরেকটি কাজ করলেন যেটি গালিবের পক্ষে গেলো না। তিনি তাঁর বড় ছেলে শামসউদ্দিন খানকে অংশীদারী দিয়ে নিজের স্বত্ব ছেড়ে দেন। শামসউদ্দিনের সঙ্গে গালিবের ভালো সম্পর্ক নেই। গালিবের বেশি বন্ধুত্ব শামসউদ্দিনের সৎ ভাই আমিনউদ্দিন আর জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে। তাই শামসউদ্দিন গালিবকে তাঁর ভাতার ব্যাপারে ভোগাতে লাগলেন, ন্যায্য পাওনা তো দিলেনই না। অন্যদিকে ইলাহি বখশ মারা গেলে গালিব ওদেরকে প্রতিহত করার জোরটিও অনেকটা হারালেন।
একদিন গালিব আহমদ বখশকে বলেছেন, আমাকে অনুমতি দিন। আমি সরকারের কাছে আর্জি জানাই।
আহমদ বখশ তাঁর সামনে কাঁদলেন। বললেন, আমি মাত্র অসুখ থেকে উঠেছি। আলোয়ারের মোক্তারিও আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। তুমি শুধু আমার সন্তানের মতোই নও। তুমি আমার চোখের আলো আসাদ। তুমি দেখছো যে আমি আমার নিজের পাওনা থেকেও প্রতারিত হয়েছি। শরীরও ভেঙে পড়েছে। তাছাড়া জেনারেল অখটারলোনির সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক নেই। তুমি ধৈর্য ধর। তোমার পাওনা টাকা পাওয়ার একটা ব্যবস্থা হবে।
কয়েক মাসের মধ্যে মারা গেলেন অখটারলোনি। ক্ষমতায় এলেন চার্লস মেটকাফ। মেটকাফ তখন ভরতপুরের প্রশাসক।
আহমদ বখশ গালিবকে বললেন, আশা করি মেটকাফ আমাদের পক্ষে একটি নতুন সনদ ঘোষণা করবেন। আমি মেটকাফের সঙ্গে দেখা করতে ভরতপুর যাবো। তুমিও যাবে। ঠিক তো?
হ্যাঁ যাবো। গালিব সানন্দে রাজি হলেন।
ভরতপুরে গিয়ে তিনি দেখলেন, তাঁর বঞ্চনার ব্যাপারটি আহমদ বখশ মেটকাফের সামনে তুললেনই না। ভীষণ মন খারাপ হলো। ক্রোধও বাড়লো। ঠিক করলেন বিষয়টি নিয়ে নিজেই তদবির করবেন। সেখানে বসে শুনলেন যে গভর্নর জেনারেল আসছেন। তাকে আনার জন্য কানপুর যাচ্ছেন মেটকাফ। তিনি ঠিক করলেন কানপুরে গিয়ে মেটকাফের সঙ্গে দেখা করবেন। গভর্নর জেনারেলের কাছেও আর্জি পেশ করবেন।
তারপরে কলকাতা যাবেন।
শুরু হলো তাঁর পথের যাত্রা।
ঘোড়ায় চড়ে বসার পরে ভাবলেন, ঘোড়াতো যেতেই থাকবে। ঘোড়ার খুরের শব্দ তিনি দু’কান ভরে শুনবেন। শুনতে শুনতে তাঁর ঢুলুনি আসবে। অনেকদিন অনেক রাত কাটাতে হবে পথে। কখনো সরাইখানায় আশ্রয় নেবেন, কখনো শহরে বন্ধু পেলে তার বাসায় থাকবেন। তারপরও যাত্রা স্বস্তিরই হবে, এই বিশ্বাস নিয়ে তিনি আনন্দ লাভ করার চেষ্টা করলেন।
পথে নদী পড়লে পার হলেন নৌকায়। নদীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ সখ্য তাঁর। নদীর পানিতে হাত ভিজিয়ে কপোলে লাগালেন শীতল স্পর্শ। বললেন, তুমি আমার প্রিয়তমা। কিন্তু তারপরও পথের ক্লান্তি তাঁকে ছাড়লো না। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত হয়ে পৌঁছালেন কানপুরে। বুঝলেন, বিশ্রাম না নিলে শরীর আর চলবে না। বিশ্রাম নেয়ার কথা ভাবলেন। অন্তত সাত-দশ দিনতো থাকতেই হবে। আজমকে বোঁচকা-কুঁচকি খুলতে বললেন। ঘুমুলেন সারা দিন। খানিকটা সতেজ হয়ে ভাবলেন, রাস্তায় যখন বেরিয়ে পড়েছেনই তবে কবিতার শহর লক্ষ্ণৌতে যাবেন না কেন? কানপুর থেকে লক্ষ্ণৌ বেশি দূরে নয়। যদিও কলকাতা যাওয়ার জন্য লক্ষ্ণৌ যেতে হবে না, তারপরও। লক্ষ্ণৌর জন্য খুব টান অনুভব করলেন। লক্ষ্ণৌ অযোধ্যা রাজ্যের রাজধানী। এখানে বাস করে কবিতার গুণীজনেরা। তিনি নিজেকে শোনালেন নিজের শের :
‘লক্ষ বাসনা এমন যে বাঁচব না একটিও দেয় যদি ফাঁকি
মিটেছে অনেক সাধ, তবু সবই যেন রয়ে গেল বাকি।’
শেরটি দু-তিনবার নিজেকে শোনানোর পরে নিজেকে বললেন, হ্যাঁ এখনো অনেক সাধ বাকি। বড় বেশি অস্থির লাগে। অপূর্ণতার পূর্ণতার জন্য বুকে হাহাকার। লক্ষ্ণৌতে মীর তকী আছেন, কবি সওদা আছেন। একটা গজল ভেবে উৎফুল্ল হন। পরক্ষণে দিল্লির কথা মনে হয়। তাঁর জন্মের আগে মুঘল শাসকরা আর আগের শাসকদের অবস্থায় ছিলেন না। বারবারই বাইরের আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছে দিল্লি। আক্রমণ করেছে পারস্যের নাদির শাহ, আফগানের আহমদ শাহ আবদালী। মারাঠা ও জাঠদের আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে নগরীর সৌন্দর্য এবং মানুষের প্রতিদিনের জীবন। কবি সওদা ও মীর তকী মীরের মতো কবিরা ছেড়ে এসেছেন দিল্লি। ঠাঁই নিয়েছিলেন লক্ষ্ণৌতে। মীর তকীর একটি শের তিনি মনে করলেন :
‘আজ উজাড় হয়ে গেলো এ মহানগর
নইলে প্রতি পদক্ষেপেই এখানে বসতি ছিল।’
দিল্লির এমন অবস্থা তাঁর চোখের সামনে দেখতে হলেও তিনি দিল্লি ছাড়বেন না। শহরের কারণে মরে যেতে হলে মরে যাবেন। তারপরও তো ওই শহরের মাটির নিচে থাকবেন। সেটাও তো ছেড়ে যাওয়া হবে না। এই ভেবে স্বস্তি পেলেন। বিছানা থেকে উঠে পানি খেলেন। বুঝলেন শরীর ঠিক নেই। মাথা ঘুরছে। অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সুস্থ হতে হতে সাত দিন পার হয়ে গেলো। ফলে মেটকাফের সঙ্গে দেখা করতে পারলেন না। গভর্নরের কাছেও আর্জি পেশ করা হলো না।
আজম বললো, হুজুর আপনার কাজ তো হলো না?
চিন্তার কিছু নেই কলকাতায় গিয়ে আর্জি পেশ করবো।
আজম ভাবলো, হুজুরের সেটাই করতে হবে।
গালিব কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে কানপুর ছাড়লেন।
সঙ্গে সুরা যা ছিল তা শেষ হয়ে এসেছে। আবার কিনতে হবে। কার কাছ থেকে ধার পাবেন সেই চিন্তা করলেন। যাতায়াতের খরচ যোগাড় করলেন একজনের কাছ থেকে। শর্ত হলো এই যে টাকা পেলেই তিনি শোধ করে দেবেন। দেবেনই তো। নিজেকে বললেন—
‘গালিবের গায়ে কালি লাগবে না
কারণ দ্বিচারিতার দোষে সে দুষ্ট নয়
তার তাপ্পি মারা এই আলখাল্লাটি খুবই পরিচ্ছন্ন
কারণ প্রতিদিন ওটি মদ দিয়েই ধোওয়া হয়।’
লক্ষ্ণৌর পথে যেতে যেতে ভাবলেন, লক্ষ্ণৌর গুণীজনের কাছে তাঁর কবিতার খ্যাতি পৌঁছে গেছে। তিনি মীর তকীর কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছিলেন। নিশ্চয়ই দরবারেও তাঁর জায়গা তৈরি হয়েছে। দিল্লি ছেড়ে চলে যাওয়া কবিদের লক্ষ্ণৌর দরবার সম্মান দেখিয়েছিলেন। কবি সওদাকে দরবারি কবির আসন দেয়া হয়েছিল। মীর তকী মীরও রাজার আনুকূল্য পেয়েছিলেন তাঁর ভাগ্যেও এমন কিছু ঘটতে পারে। নওয়াব আসফাউদ্দৌলা কাব্যপ্রেমিক। শিল্প-সঙ্গীতপিপাসু মানুষ। তাঁর স্ত্রী শামস-উন্নিসা একজন শায়র। নাম করেছেন। এত যে শহরের জেল্লাই সে শহরে কবি গালিবের সমাদর তো হবেই। তিনি পুলক বোধ করলেন। ঘোড়ার খুরের শব্দ তাঁর কানে সঙ্গীতের মতো বাজতে থাকে। সে ধ্বনি যে কোনো দূরালোক থেকে ভেসে আসছে অলৌকিক মাধুর্য নিয়ে। তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।
লক্ষ্ণৌ শহরে পৌছে বুকভরে শ্বাস টানেন। দুদিন বিশ্রাম নিলেন। বেশ ঝরঝরে লাগছে শরীর। ভাবলেন, কবিতার শহর লক্ষ্ণৌতে আসতে পারার আনন্দে উৎফুল্ল মনের সঙ্গে সাড়া দিয়েছে শরীর। আসার পরে বিভিন্ন কবির সঙ্গে দেখা হলো। মুশায়রায় যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। কিন্তু মনে মনে খুব আশাহত হলেন এটা জেনে যে দরবারে এখন আর আসফউদ্দৌলা নেই। এখন আছেন নওয়াব গাজিউদ্দিন হায়দার। কবি সওদাকে আসফউদ্দৌলা নিজে দরবারে ডেকে নিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান নওয়াবের নিয়ম ভিন্ন। এখন তার কাছে সাক্ষাতের জন্য মন্ত্রী বা তার সচিবের কাছ থেকে ভেতরে যাওয়ার ছাড়পত্র নিতে হয়। হতাশ হয়ে মন খারাপ করে বসে রইলেন কয়দিন। বুঝলেন কিছু ভুল হয়ে গেছে তাঁর।
ন্যায্য মর্যাদার যে দাবি তিনি পেশ করেছিলেন তা নওয়াবের পছন্দ হয়নি। সেজন্যই বোধহয় সাক্ষাৎকার দেননি। তাছাড়া প্রথামতো নওয়াবের কাসিদা রচনা করেননি। প্রশংসাপত্র না পেয়ে তিনি খুশি হননি। শুধু কবিতা দিলে নওয়াব খুশি হন না। যাহোক, যা করার করেছেন। প্রশস্তিপত্র রচনা করার ক্ষেত্রে তাঁর ভেতরে নানা দ্বিধা কাজ করে। অনেক সময় নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ায় সমঝোতা করতে পারেন না। কবির সম্মান নিচে নামানো কি বড় কবির পক্ষে সম্ভব!
তারপর একদিন মন্ত্রীর সচিবের কাছে গেলেন। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। দরবারের আনুকূল্য পেলেন না, পথের খরচও না। শুধু পেলেন মুশায়রার আনন্দ। বিভিন্ন কবির সঙ্গে খোশগল্প করলেন। কাব্যচর্চার জন্য দিল্লির মান বেশি না কি লক্ষ্ণৌ এসব বিতর্কেও অংশ নিলেন। এদিক থেকে ভালোই সময় কেটে গেলো। কিন্তু কবিতায় লিখলেন যে লক্ষ্ণৌতে আসা ব্যর্থ হলো। মাথার ভেতরে পেনসনের চিন্তা। অর্থভাবনায় অশান্ত হয়ে থাকলেন। কিছুদিন পরে রওনা করলেন কলকাতার পথে। এদিকে গড়িয়ে গেছে কয়েক মাস। কলকাতা ঢোকার আগে পথে পড়বে বারানসি। এই শহরের প্রশংসা শুনেছেন অনেকের কাছে, কিন্তু নিজের কখনো আসা হয়নি। ভাবলেন, অর্থ না জুটুক মনের খোরাক তো পাবেন। লক্ষ্ণৌতে তাঁর গজলের খ্যাতি পেয়েছেন। শহরের সঙ্গীত ভীষণ আনন্দ দিয়েছে। তাওয়াফদের সৌন্দর্যে পিয়াস মিটিয়েছেন। কবির জন্য এটিও অনেক বড় জায়গায়। নিজেকে উৎফুল্ল রাখলেন এসব ভাবনায়।
লক্ষ্ণৌ ছাড়লেন। তাঁকে যেতে হবে বান্দা হয়ে। আবার পথের খরচের জন্য দেনা করলেন তাঁর পরিচিত নওয়াব জুলফিকার আলির কাছ থেকে। ক্রমাগত দেনার বোঝা বাড়ছে। ভাবলেন, বাড়ুক। শোধ হবেই। ঘোড়ায় চড়ে এবং গরুর গাড়ির যাত্রায় পৌঁছালেন এলাহাবাদ। শহরটি বেশি ভালো লাগলো না। মাসখানেক থেকে তিনি আবার রওনা করলেন। বুঝলেন দীর্ঘ কয়েক মাসে শারীরিক কষ্টে তিনি কাবু হয়ে পড়েছেন। কানপুরে অসুস্থ হয়েছিলেন। সেখানে ভালো হাকিম-বৈদ্য ছিল না। তাই লক্ষ্ণৌতে কয়েক মাস বিশ্রাম নিলেন। তারপরও শরীর যেন চলে না। কষ্ট হয়। এদিকে পথের শ্রম, অন্যদিকে কোনো কাজে সুরাহা না পাওয়ার হতাশা। অপরদিকে ক্রমাগত ঋণ করা।
তারপরও পথের ক্লান্তি পেয়ে বসে, কেন তিনি কলকাতা যাচ্ছেন এই ভাবনায়। মাঝে মাঝে আজম তাঁকে পানি এগিয়ে দিয়ে বলে, হুজুর পানি খান।
পানি? পানি খাবো কেন? গালিব বিরক্ত বোধ করেন।
হুজুর আপনার মুখ শুকিয়ে গেছে।
আচ্ছা দাও। তিনি গ্লাস টেনে নিয়ে একটানে শেষ করেন। ভাবেন, সত্যি তাঁর বুক শুকিয়ে গিয়েছিল। তিনি তৃষ্ণার্ত ছিলেন। তবে ভুলে গেলেন কি করে? কারণ মাথার মধ্যে নওয়াব আহমদ বখশের হঠকারিতার রেখা পড়েছে। বিষয়টি তাঁকে খুব পীড়িত করছে। তাঁর ছেলে শামসউদ্দিন তো তাঁকে সহ্যই করে না।
আজম আবার তাঁকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় এবং তিনি ঢকঢকিয়ে পানি খান। মনে হয় এক জীবনের তৃষ্ণা জমে আছে তাঁর বুকের ভেতর। এখন দরকার সুরা। কিন্তু নেই। নিজেকে শান্ত করলেন চুমুক চুমুক পানি খেয়ে।
বারানসি পৌঁছালেন সন্ধ্যার সময়। মন্দিরে মন্দিরে প্রজ্বলিত আলোর শিখা তাঁকে মুগ্ধ করলো। যে ভগ্ন হৃদয় নিয়ে তিনি এতটা পথ এসেছেন সে হৃদয়ের ক্ষতে প্রলেপ পড়লো। তিনি দেখলেন নদীর জলে আলোর ছায়া পড়ে নদী মায়াবী হয়ে উঠেছে। তিনি ঘাটে বসে রইলেন। ভাবলেন লক্ষ্ণৌ থেকে তিনি দরবারের সহযোগিতা পাননি। কিন্তু শহরের সৌন্দর্য তাঁর বাকি অভাব পূরণ করে দিয়েছিল। তিনি নদীর ধারে বসে আবারও বললেন, লক্ষ্ণৌ হিন্দুস্থানের বাগদাদ। কোনো শব্দই লক্ষ্ণৌর সৌন্দর্য বর্ণনা করার উপযোগী নয়। এবার বারানসি দেখার পালা। একটি শহর থেকে অন্যটির কত যে পার্থক্য। দিল্লির বাইরে এসে নতুন নতুন জায়গা দর্শনের অভিজ্ঞতায় তিনি নিজের আবেগ সামলাতে পারছেন না। বারানসিকে নিয়ে কবিতা লিখে নাম দিলেন ‘মন্দিরের বাতি।’ এই শহরে এসে বসবাস করার ইচ্ছাও হলো তাঁর একবার। যে তিনজন পরিচারক তাঁর সঙ্গে এসেছে তারাও খুব খুশি। বলে, হুজুর বারানসি কত সুন্দর শহর। একদম আমাদের দিল্লির মতো।
দিল্লির মতো? নাকি দিল্লির চেয়ে বেশি সুন্দর?
তিনজনে একসঙ্গে বলে, দিল্লির চেয়ে বেশি সুন্দর।
গালিব মৃদু হেসে বলেন, তোমরা যে আমাকে খুশি করার জন্য দিল্লির কথা বলেছো তা আমি বুঝতে পেরেছি। তাহলে আমরা থেকে যাই এখানে?
না, না হুজুর। তিনজনে আঁতকে ওঠে। দিল্লি ছেড়ে আসার এগারো মাস হয়ে গেছে হুজুর। আপনি কলকাতা পৌঁছাতে পৌঁছাতে বছর পূর্ণ হবে। দিল্লি ফেরার জন্য আমাদের মনে টান লেগেছে।
সওগত এমনভাবে কথাগুলো বলে যে গালিব নিজেও থমকে যান। ভাবেন, অনেকদিন হলো তিনি বাড়ি থেকে বের হয়েছেন। এবার তো ফেরা দরকার। এতদিনে উমরাও বেগমের কথা ভাবলেন।
পরিচারকদের বললেন, আমরা কালকে কলকাতা রওনা দেবো। অনেকদিন হয়ে গেল এই শহরে।
তারপর গোলাপজল মিশিয়ে গ্লাসে সুরা ঢাললেন। আজম শামী কাবাব নিয়ে এলো। এক চুমুক খেয়ে এক লাইন শের আওড়ান। তারপর এক সময় একটির পর একটি বলতে থাকেন-
‘কোন পাপী মদপান থেকে
আনন্দ করবার আশা রাখে?
সব সময়তেই আমি সেই
নিসর্গের মধ্যে ডুবে থাকতে চাই।’
আবার বলেন,
‘আঘাতের ক্ষরণ বয়ে বেড়ায় হৃদয়
মদ্যপানই সেখানে একমাত্র শুশ্রূষা
তাদের ক্ষেত্রে আইনি বা বে-আইনির কী বিচার।’
গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে বিছানায় এলেন। ঘুমুবার আগে আবৃত্তি করলেন:
‘কালকের কথা ভেবে
মদের ব্যাপারে, আজকে যেন
কার্পণ্য করো না–
কারণ স্বর্গীয় সাকীর প্রতি
তা হবে অবমাননাকর।’
শেরটি শেষ করে তুতাকে লেখা চিঠির কথা স্মরণ করলেন—একবার এক বন্ধু তাঁকে একশো টাকা পাঠিয়েছিলেন। পুরো টাকাটা শেষ করেছিলেন ইংরেজদের মদের দোকানের ধার শোধ করে। হাঃ, গালিব এই তোমার নিয়তি। তাঁর দুচোখে ঘুম জড়িয়ে এলো।
গালিব যখন কলকাতায় পৌঁছালেন তখন দিল্লি ছাড়ার প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। ক্লান্ত হয়ে নতুন শহরে পৌঁছালেন। ক্লান্তির সঙ্গে আনন্দও ছিল। ভাবলেন এখানে বসে প্রাপ্য ভাতার একটা ফয়সালা হবে। এই শহরে তাঁর কবিখ্যাতি পৌঁছে গেছে। গুণীজনেরা তাঁকে চেনে। তিনি আনন্দ পেলেন এই ভেবে যে, এখানে মুশায়রার আসর জমাতে পারবেন।
তাঁর জন্য খারাপ খবর এই যে মুর্শিদাবাদে পৌঁছানোর পরে আহমদ বখশ খানের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলেন যা কিছু করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। কলকাতায় বাস করার খরচ পাঠিয়ে দিয়েছেন বান্দার নওয়াব। একটি পালকি এবং পালকির বেহারা পাঠিয়ে দিয়েছেন। যানবাহনের সুবিধার কারণে তাঁর যোগাযোগের সুবিধা হলো। তিনি প্রথমে দেখা করলেন সচিব অ্যান্ড্রু স্টারলিং এবং সহসচিব সাইমন ফ্রেজারের সঙ্গে। তাঁর ভাতার বিষয়টি গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলের কাছে পেশ করা হলো। নিয়মানুযায়ী বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে দিল্লির ব্রিটিশ প্রতিনিধির মারফত। প্রশাসনিক ব্যবস্থা গালিবকে তো মানতেই হবে। তিনি নিজে ডাকঘরে গিয়ে মোক্তারনামা ও দরকারি কাগজপত্র দিল্লিতে পাঠিয়ে দিলেন। সেখান থেকে উত্তর আসার অপেক্ষা করতে লাগলেন। আশাবাদী হয়ে থাকলেন। খরচের সুরাহা করার জন্য সওগতকে বললেন, মাসের খরচের জন্য পঞ্চাশ টাকা ঠিক করলাম। এর বেশি খরচ করবে না কিন্তু।
সওগত মাথা নাড়ে, জ্বী হুজুর।
আর শোনো, আমার ঘোড়াটি বিক্রি করে দেবো। ক্রেতা দেখো
ঘোড়াটি আপনার শখের
এসব কথা থাক। আগে সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে তো। খেয়েপরে বেঁচে নেই। তারপরে ঘোড়া।
মন খারাপ করে সরে গেলো সওগত। কয়েকদিনের মধ্যে দেড়শো টাকায় বিক্রি হয়ে গেলো ঘোড়াটি।
গালিব তাঁর কাজ পরিচালনা করার জন্য একজন উকিল নিযুক্ত করলেন। মুনশী নাসিরউদ্দিন। তিনি গালিবকে বিভিন্ন মুসাবিদা করে দিতেন। তিনি গালিবের জন্য একটি মুসাবিদা দাঁড় করালেন। প্রথমে লিখলেন (ক) মরহুম নসরুল্লাহ খানের পরিবারের সদস্যের ভরণপোষণের জন্য বার্ষিক দশ হাজার টাকা মঞ্জুর করেছিলেন লর্ড লেক ১৮০৬ সালের মে মাসে। এই দশ হাজার টাকা প্রদান না করে পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হয়ে আসছে এখন পর্যন্ত। সুতরাং আগের মঞ্জুর করা দশ হাজার টাকা ভাতার ব্যবস্থা করা হোক। (খ) এই টাকাটা দেয়া হয়েছিল মরহুম নসরুল্লাহ বেগ খানের পরিবারের সদস্যদের। কিন্তু পরিবারের সদস্যের বাইরের এক খাওয়াজা হাজিকে এই ভাতার অংশীদার করে দেয়া হয়। এই ব্যক্তির মৃত্যুর পরে তার দুই পুত্রকে পিতার প্রাপ্য অংশের অংশীদার করা হয়েছে। এটা বন্ধ করা হোক। (গ) মঞ্জুর করা দশ হাজার টাকার পরিবর্তে পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে। যে টাকা দেয়া হয়নি তা বকেয়া হিসেবে পরিবারকে প্রদান করা হোক। খাওয়াজা হাজিকে ভুল করে যে টাকা দেয়া হয়েছে সেটাও যেন এই হিসাবে ধরা হয়। এতদিন পর্যন্ত এই টাকা ফিরোজপুর ঝিরকা রাজ্য থেকে দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে যেন এই টাকা ব্রিটিশ ট্রেজারি থেকে দেয়া হয়।
মামলার বিরোধীপক্ষ নওয়াব শামসউদ্দিন। গালিবকে তিনি পছন্দ করেন না। মুসাবিদাটি দরখাস্ত হিসেবে পেশ করা হলে শামসউদ্দিন লর্ড লেকের সংশোধিত আদেশটি জমা দিলেন। মুনশী নাসিরুদ্দীন গালিবের অভিযোগপত্র তৈরি করে দিলেন। লিখলেন, সংশোধিত আদেশটি ঠিক নয়, বানোয়াট। এই আদেশামার কোনো নকল দিল্লি বা কলকাতার সরকারি মহাফেজখানায় নেই। ফারসিতে লেখা আদেশপত্রে প্রথা অনুযায়ী লর্ড লেক বা তাঁর সচিবের স্বাক্ষর নেই। তিনি আরো লিখলেন দ্বিতীয় আদেশপত্রটি প্রথম আদেশপত্রটিকে বাতিল করতে পারে না। কারণ প্রথমটি লর্ড লেক স্বাক্ষর করেছেন এবং গভর্নর জেনারেল অনুমোদন করেছেন। এর একটি কপি কলকাতার অফিসে রক্ষিত আছে।
গালিব বেশ স্বস্তি বোধ করেন এই ভেবে যে, এতসব প্রমাণের বিরুদ্ধে শামসউদ্দিনের পেশ করা আদেশটি কার্যকর হবে না। বেশ উৎফুল্ল মনে তিনি বিভিন্ন মুশায়রায় অংশগ্রহণ করেন। কলকাতায় প্রতি রোববার মুশায়রার আসর বসে। জড়ো হন কবিতাপ্রেমিকরা। এখানে এসে তিনি পেয়েছেন ফারসি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র—মিরাত-উল-অখবার। সম্পাদনা করেন রাজা রামমোহন রায়। দিল্লিতে এখন পর্যন্ত সংবাদপত্র ছাপা হয় না। মিরাত-উল-অখবার বা সংবাদপত্র পড়ে তিনি বেশ আনন্দ পাচ্ছেন। নতুন নতুন বিষয়ের সম্পর্কে জানা হচ্ছে। এই সংবাদপত্র পড়ে তিনি নানা কিছুর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। সময় ভালোই কাটছে আর গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন তাঁর পেনসনের বিষয়টি ফয়সালা হওয়ার জন্য। কিছুদিনের মধ্যে ভালো খবর পেলেন তিনি। সরকারের মুখ্য সচিব গালিবের যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে করলেন। তিনি গালিবকে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন।
গালিব কলকাতায় বেশি আনন্দ পাচ্ছেন জমজমাট মুশায়রার আসরে। যে আগাম ঋণ পেয়েছেন সে টাকা দিয়ে শরাব পানে টান পড়েনি। খাওয়া-দাওয়া ভালো চলছে। বেশ কেটে যাচ্ছে দিন।
হট্টগোল বাধালেন এক মুশায়রার আসরে। আসরে নিজের ফারসি গজল পড়ার পরে উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে ফারসিনবিশ কয়েকজন কবিতার ভাষা নিয়ে সমালোচনা করলেন। তাঁকে তুলনা করলেন আরেকজন ফারসি ভাষার কবি কতিলের সঙ্গে। কতিলের কাবিতার সঙ্গে তুলনা করে গালিবকে হেয় করে কথা বললেন।
ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন গালিব। বললেন, কাতিলকে আমি ফারসি ভাষার কবিদের মধ্যে গণ্যই করি না। তিনি পাত্তা দেয়ার মতো কবিই নন।
যারা আপত্তি জানিয়েছিলেন তাঁরা কাতিলের ভক্ত। তাঁরা ততক্ষণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। গালিব উত্তেজিত কণ্ঠে আবার বললেন, উনি হলেন ফরিদাবাদের ক্ষত্রী দিলওয়ালি সিং।
তাঁর ভক্তরা উঠে দাঁড়ালেন, ব্যস থামেন।
থামবো কেন? ফারসি ভাষায় আমার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ নেই। আমি বহু বছর ফারসি শিক্ষকদের কাছে এই ভাষা শিখেছি। পড়াশোনা করে দক্ষতা অর্জন করেছি।
হইচই বেধে যায় মুশায়রার আসরে। ক্ষত্রী দিলওয়ালি সিং ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হন। কাতিল নাম গ্রহণ করেন। তিনি শুধু কবি নন, একজন পণ্ডিতও। সেই দিন তিনি সেই আসরে ছিলেন না। উত্তেজনা-হইচইয়ে আসর ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। গালিবের আক্রমণাত্মক কথাবার্তায় এক সময় কাতিলকে প্যাচার সন্তান বলা হয়ে যায়। যারা তাঁর ভক্ত তাদেরকে বলেন, ভারতীয় খোজা। বাদ-প্রতিবাদ তুঙ্গে ওঠে। ভেঙে যায় আসর।
বাদ-প্রতিবাদ কিছুদিন ধরে চলতে থাকে। গালিবের নাম উচ্চারিত হতে থাকে কলকাতার সুধীসমাজে। তিনি কাতিল-ভক্তদের রাগ কমানোর জন্য চেষ্টা করেন। লিখতে থাকেন শরাব, রসাল ফল, কলকাতার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নারীবিষয়ক কবিতা। তাঁর সময় ভালো-মন্দে কেটে যায়।
শেষ পর্যন্ত পেনসনের যে বিষয়ের সমাধান তিনি আশা করেছিলেন তা পূরণ হলো না। তিনি সচিব জর্জ সুইনটনের কাছ থেকে জানতে পারলেন যে, ছোটলাট স্যার জন ম্যালকম দ্বিতীয় আদেশপত্রটি গ্রহণ করেননি। ওটি ফেরত পাঠানো হয়েছে। তিনি মতামত দিয়েছেন এই বলে যে, আহমদ বখশ খান একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি ব্রিটিশদের আস্থাভাজনও বটে। তিনি কোনো আদেশপত্র জাল করার মতো হীন কাজ করতে পারেন না। আদেশপত্রটি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ নেই। অতএব এতদিন ধরে যেটা চলে আসছে সেটিই বহাল থাকবে।
গালিবের মনে হলো তাঁর সামনে সবকিছু ধসে পড়ে গেলো। কলকাতা এক অচেনা শহর। এখানকার যা কিছু তাঁর স্মৃতিতে থাকবে তা শুধুই কবিতা। থাকবে এখানকার খবরের কাগজ। সুধীজন। আর অসাধারণ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। মর্মাহত গালিব ফিরে যাচ্ছেন দিল্লিতে। আর কোনোদিন হয়তো কলকাতায় আসা হবে না। রেখে যাচ্ছেন তাঁর গজল। নিয়ে যাচ্ছেন চল্লিশ হাজার টাকার ঋণের বোঝা। সঙ্গে নেই প্রিয় ঘোড়াটি। যেটার পিঠে চড়ে তিনি অনেক পথ পার হয়েছেন। একই সঙ্গে নেই ঘোড়ার খুরের শব্দ, যে ধ্বনি অনেক সময় তাঁর ক্লান্তি দূর করেছিল। সঙ্গীতের মতো বেজেছিল তাঁর কানে।
বাড়িতে ফিরে এসেও শান্তি নেই। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত গালিবের দিকে তাকিয়ে উমরাও বেগম বললেন, আমি সব শুনেছি। আমার ভাই নওয়াব শামসউদ্দিন মুখিয়ে আছে তোমাকে হেনস্থা করার জন্য। তাঁর কাছ থেকে আমিও টিটকারি শুনেছি।
গালিব শুধু বললেন, আমাকে পানি দাও বিবি। এক গ্লাসে হবে না। সুরাই ভরা পানি চাই।
উমরাও বেগম কিছু বলার আগেই কাল্লু পানি আনতে গেলো। তিনি বারান্দায় রাখা বালতির পানি দিয়ে মুখ-হাত ধুতে শুরু করলেন। খানিকটুকু শীতল হলো শরীর। পানি খেয়ে বিছানায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুজে এলো চোখ। তারপরও ভাবলেন, তিনি তো পরাজিতই হয়েছেন। নওয়াব শামসউদ্দিন তাঁর আর কি করবেন? দু-চার কথা শুনাবেন, এই তো? তাতে আর কি এসে যায়। তিনি গভীর ঘুমে তলিয়ে যান।
ঘুম কখন ভাঙে তা তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না। কালে সাহেবের বাড়িতে থাকতে মাঝে মাঝে গ্লানি বোধ করেন। কিন্তু না থেকেও উপায় নেই। এই দুঃসময়ে যাবেন কোথায়? তিনি বিছানা ছেড়ে ওঠেন না। কোথাও বের হন না। মাঝে মাঝে চিঠি লেখেন বিভিন্নজনকে। আর বকেয়া পেনসন না পাওয়ার কারণে ব্রিটিশদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে লিখলেন কবিতা—
‘আমি বলতে চাই যে কারা এই চাঁদপানা মানুষ।
তো, নারী বললো,
এই সুন্দর পুরুষেরা লন্ডনের রাজশক্তির বলয় থেকে আগত।
আমি বললাম,
তাদের হৃদয় বলে কিছু কি আছে?
তো নারী বললো,
তাদের কিন্তু লৌহদণ্ড আছে।’
লিখে নিজেই দু-একবার পড়লেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ এভাবেই ওদেরকে চিত্রিত করা উচিত। ওরা এমনই মানুষ।
একদিন নওয়াব শামসউদ্দিন এলেন। বোনের জন্য কাপড় চোপড়, মণ্ডা- মিঠাই, ফল-মূল নিয়ে এলেন। হা হা হাসিতে বাড়ি মাতালেন। যাওয়ার সময় গালিবকে খোঁচা দিয়ে বললেন, পেনসন বাড়ানোর জন্য অনেক দৌড়ঝাঁপ করলেন কিন্তু পুরনো বরাদ্দ ৬২.৫০ পয়সা থেকে বের হতে পারলেন না মির্জা সাহেব। এখন পাওনাদার সামলান।
গালিব সঙ্গে সঙ্গেই বললেন-
‘মৃত্যুর আশায় যে বেঁচে রয়েছে
তার হতাশা দেখবার মতন।’
শামসউদ্দিন কড়া দৃষ্টি ফেলে বেরিয়ে যান। উমরাও বেগম বলেন, আমার ভাই আপনার শের পছন্দ করেননি।
তিনি আমাকে টিটকারি দিতে এসেছেন বিবি। তিনি তো ভালো করেই জানেন যে তাঁর আব্বাজান আমাকে ন্যায্য পাওনা থেকে ঠকিয়েছেন।
উমরাও বেগম উত্তর না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। গালিব পায়চারি করেন। ভাবেন, একজন বন্ধু পেলে সময় ঝর্নার মতো গড়িয়ে পড়তো। তার আশাই পূর্ণ হলো।
অল্পক্ষণের মধ্যে তকীয়ুল্লাহ এলেন।
আমি তো তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম বন্ধু।
আমি আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে এসেছি। আমার সঙ্গে যাবেন? পালকি আছে।
কোথায়? গালিব ভুরু কুঁচকে তাকান।
আমার আত্মীয়া তর্ক, কবিতা লেখেন। তাঁর খুব ইচ্ছা আপনাকে কবিতা শোনাবে। আপনি কি দয়া করে আমার সঙ্গে যাবেন?
তর্ক, আপনার আত্মীয়া। ওহ, আমি তো যাবোই। কবি আর কবিতার কাছে তো আমি যাবোই।
তিনি বেশ দ্রুত পোশাক বদলালেন। তাঁর সবচেয়ে দামি পোশাকটি পরলেন। সুগন্ধী মাখলেন। নিজের যৌবনের দিনগুলো তাঁকে খুব তাড়িত করলো। তকীয়ুল্লাহকে শুনিয়েই বললেন,
‘প্রতি বসন্তে সঙ্গিনী নতুন আনো
নতুন বছরে পুরনো দিনপঞ্জী কেন?’
তকীয়ুল্লাহ মৃদু হেসে বললেন, তিনি অভিজাত বংশীয়া। পর্দানশীন। বুখারা থেকে এসেছে তাঁর পূর্বপুরুষ।
গালিব গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, আমি জানি আমার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হবে না। কথা হবে তো?
তিনি চিকের আড়াল থেকে দু-চারটে কথা বলতে পারেন।
কবিতা পড়বেন তো?
পড়বেন। তবে এরপর থেকে তাঁর কবিতা তিনি আমাকে দেবেন। আমি আপনাকে দেবো পরিমার্জনার জন্য।
গালিব গম্ভীর হয়ে বললেন, চলো।
বেশিক্ষণ সময় সেই বাড়িতে থাকা গেলো না। কবি তর্ক পর্দার আড়াল থেকে কবিতা পড়লেন। গালিব চোখ বুজে শুনলেন। অনন্তকালের বিস্তার ঘটলো তাঁর হৃদয়ে। তিনি বুঝলেন, বড় কষ্ট হচ্ছে নিজেকে সামলাতে। যদি শুধু একবার তাঁকে দেখা যেতো! যদি দেখা যেতো হাতের একটি আঙুল কিংবা পায়ের! মুগ্ধ হয়ে ফিরে এলেন বাড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে লিখলেন :
‘দেখো তার কথার ইন্দ্রজাল, সে যা বললো
আমার মনে হলো এও তো আমার হৃদয়ে ছিলো।’
কতক্ষণ ধরে লিখলেন, কাটলেন। কোমরে বাঁধা আলখাল্লার ফিতায় গিট্টু দিলেন অনেক। কবিতা লেখার সময় যখন কিছু ভাবেন তখন এভাবেই গিট্টু দিতে থাকেন। উমরাও বেগম ঘরে ঢুকলে খেয়াল করলেন না। উমরাও বেগম ডাকলে বললেন, বিরক্ত করো না। খাবেন না? না, আজ খাবো না। কি হয়েছে আপনার? গালিব চোখ গরম করে তাকালেন, যেন স্ত্রীর অপরাধের মাত্রার সীমা নেই।
সেদিন থেকে গালিব নতুন ঘোরে প্রবেশ করলেন। রাত-দিনের জাহান্নামে ফুল ফোটালেন। নিজেকেই শোনালেন, বড় অল্প বয়সে তিনি বিধবা হয়েছেন। ওহ, বিধবা!
এভাবে তাঁর নতুন যাত্রার বাঁক বদল হলো।
একদিন কবি মোমিনের একটি শের শুনে তিনি প্রবলভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। বললেন, তোমার এই শেরটি আমাকে দিও দাও বন্ধু। এর বদলে আমি তোমাকে আমার পুরো দিওয়ান দিয়ে দেবো।
মোমিনের দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়। বলেন, সত্যি? এত ভালো লেগেছে তোমার?
বন্ধু এই ভালোলাগা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। তারপর তিনি মোমিনের শের আবৃত্তি করতে থাকেন :
‘তুম মেরে পাস হোতে হো গোয়া
যব কোঈ দুসরা নহী হোতা।
মনে হয় যেন আমার পাশে থাকো তুমি
যখন আর কেউ থাকবে না।’
কিশোর বয়স থেকেই দুজনের বন্ধুত্ব। কবি মোমিনের পরিবার ইউনানী পেশার সঙ্গে যুক্ত। তিনিও পেশায় হাকিম। চিকিৎসার কারণে কোনো কোনো পর্দানশীনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ভালো লাগার মুগ্ধতায় তাঁদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন। এই প্রথম মোমিনের মিষ্টি প্রেমের কবিতায় এমন উচ্ছ্বসিত গালিব।
মোমিন মৃদু হেসে বলেন, বন্ধু কবে পাবো দিওয়ান?
পাবে, পাবে। আর একটি প্রেমের শের শুনি।
মোমিন একটু থেমে চোখ বুজে বলেন,
‘কাঁদবেন আপনি প্রহরে প্রহরে আমার মতো
হৃদয় যদি বাঁধা পড়ে কোথাও, আমারই মতো।’
গালিব তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আহ শান্তি!
মন এমন উচাটন হয়েছে কেন বন্ধু?
গালিব মৃদু হেসে কবিতায় উত্তর দিলেন :
‘অকারণে আত্মহারা হইনি গালিব;
কিছু তো আছে গোপন, নইলে এত ঢাকাঢাকি কিসের ॥’
দুবন্ধু অনেকক্ষণ পরস্পরের হাত জড়িয়ে ধরে রাখলেন। কিন্তু গালিবের বুকের ভেতরে কবি মোমিনের কবিতার শিহরণ – হৃদয় যদি বাঁধা পড়ে কোথাও, আমারই মতো।
দিন আপন নিয়মে গড়ায়।
একদিন উমরাও বেগমের প্রবল ইচ্ছায় তাঁর বোনের ছেলে জাইনুলকে দত্তক নিলেন। জাইনুলের কবিতা লেখার ঝোঁক আছে। আরিফ ছদ্মনামে লেখেন। গালিব তাকে স্নেহ করেন। ভালো কবিতা লেখার জন্য গালিবের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। গালিব আরিফের সঙ্গ উপভোগ করেন। মিয়া কালে সাহেবের বাড়িতে এখনো আছেন। ভাবছেন, এরপর বাড়ি ভাড়া করে অন্য কোথাও উঠে যাবেন। একজনের আতিথ্য বেশিদিন গ্রহণ করা উচিত নয়। এখানে আসার পরে একজন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কালে সাহেব জেলখানা থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে তাঁকে তাঁর এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। যিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন তিনি তাঁকে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। গালিব তাঁকে বলেছিলেন, কে বলেছে আমি জেল থেকে মুক্তি পেয়েছি। প্রথমে ছিলাম গোরাদের জেলখানায়, এখন আছি মিয়া কালের জেলখানায়।
কালে সাহেব তাঁর পাশেই বসে হাসছিলেন। বলেছিলেন, আপনার এই রসিকতা আমরা খুব উপভোগ করি মির্জা সাহেব। আপনি বিচক্ষণ বুদ্ধিমান মেধাবী লোক।
গালিব এর উত্তরে নিজের শের বললেন :
‘অর্থ বুঝবার যোগ্যতা যদি না-ও হয় কোনোদিন,
তবু রূপের বর্ণবৈচিত্র্য দেখার শক্তিটুকু বেঁচে থাকে ॥’
জাইনুল খুবই উৎসাহিত কবি। বিভিন্ন মুশায়রায় অংশ নিতে ভালোবাসে। একদিন মাহবকে নিয়ে এসে গালিবকে মুশায়রায় যেতে বলেন। গালিবের মন ভালো নেই। নতুন গজল লেখা নেই। কিন্তু তরুণ কবিরা নাছোড়বান্দা। বললেন, মনে যে গজল আছে সেটা আবৃত্তি করলেই হবে। আপনাকে যেতেই হবে। আমাদের সঙ্গে হাতি আছে। আপনি হাতিতে করেই যাবেন।
ওদের জোরাজুরিতে যেতে হলো তাঁকে। সেই আসরে পেলেন কবি আজুরদাকে। তাঁর মন প্রফুল্ল হয়ে গেলো। আজুরদাকে তিনি খুবই পছন্দ করেন। আজুরদা মৃদু হেসে বলেন, কেমন আছ মির্জা?
গালিব নিম্নকণ্ঠে বলেন, সেদিন তোমাকে বলেছিলাম আমার আবার নবজন্ম হবে।
আজুরদা তাঁর হাত শক্ত করে ধরে বললেন, নবজন্ম হয়েছি কি?
মনে তো করি হয়েছে। নতুনভাবে জেগে উঠেছি। আজ সারা দিন খুব বিষণ্ণ ছিলাম। তোমাকে দেখে বিষণ্ণতা উধাও হয়ে গেছে।
তোমার কথায় বুঝতে পারছি স্মৃতি আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকে। সেদিন আমি আদালতে বিচারকের আসনে। তোমাকে বলেছিলাম আত্মপক্ষ সমর্থনে তোমার কোনো বক্তব্য আছে? তুমি বলেছিলে-
তাঁকে থামিয়ে দিয়ে গালিব বলেন—
‘ধার করে মদ্যপান করেছি এ কথা যেমন সত্য
তেমন এত আরেক সত্য যে
আমার ব্যয় বাহুল্যের জন্যই
আজকের দারিদ্র্য থেকেই
আমার আবার নবজন্ম হবে।’
দুজনে মৃদু হাসলেন। অল্পক্ষণে মুশায়রার আসর জমে উঠলে তাঁরা মজে গেলেন কবিতায়। উবে গেলো দুঃখবোধ। অভাবের চিন্তা। দিনযাপনের গ্লানি। সময় ভালোই কাটে। পেনসন ঠিকমতো পাচ্ছেন। আরিফ তাঁর সময়কে ভরিয়ে রাখেন। তিনি আরিফকে বলেন, তুমি আমার ঘরে মোমবাতির শিখা।
উমরাও বেগম আনন্দে আপ্লুত হয়ে বলেন, ও আমার বোনের ছেলে। আমার সন্তানের মতো। ও তো আমাদের ঘরের প্রদীপের শিখা হবেই।
একদিন ও বড় কবি হবে বিবি। ও চমৎকার লেখে।
আপনি ওকে দোয়া করেন। উমরাও বেগম স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন আরিফের দিকে। এভাবে পরিবারে বাড়তি আনন্দে তিনিও ভীষণ আনন্দিত। কিন্তু থমকে দাঁড়ালো তাঁর সময়, যেদিন খুন হলেন দিল্লির রেসিডেন্ট উইলিয়াম ফ্রেজার। কিষাণগড়ের রাজার নিমন্ত্রণ রক্ষা করে ফিরে আসার সময় তিনি নিহত হন। ফ্রেজার গালিবের বন্ধু। তিনি খুব দুঃখ পেলেন। কয়েকদিন পরে ধরা পড়লো ফ্রেজারের হত্যাকারী করিম খান। করিম তার স্বীকারোক্তিতে বললো যে, সে নওয়াব শামসউদ্দিনের ভাড়াটে খুনি হিসেবে ফ্রেজারকে হত্যা করেছে।
গালিব প্রবল মানসিক চাপে পড়লেন। উমরাও বেগমের কান্না ফুরোয় না। বারবার তাঁকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি জানেন এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে?
আমি? আমি কি জানবো?
আমার ভাই তো আপনার শত্রু। আপনি কি কোনো চক্রান্ত করেছেন?
ওহ, বিবি, তুমি এসব কি বলছো?
আমি বলবো কেন? আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বলছে। ফ্রেজার আমিন ও জিয়া ভাইয়ের পক্ষে ছিলেন, সেজন্য শামসউদ্দিন ভাই-
থামো বিবি, থামো।
গালিব মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন। এ কি হলো? ধীরে ধীরে তিনি দেখতে পেলেন দিল্লির লোকেরা বলাবলি করছে যে শামসউদ্দিন চক্রান্তের শিকার হয়েছেন। লোকে তাকে দুষছে। আদালতের রায়ে শামসউদ্দিনের ফাঁসির আদেশ হলো। রায় কার্যকর করতে সময় লাগলো না। ২২ মার্চ খুন হলেন ফ্রেজার, ২৬ আগস্ট ফাঁসিতে ঝোলানো হলো শামসউদ্দিনকে।
তোলপাড় হয়ে গেলো শহর। গালিব নিজেকে ঘরে আটকালেন। ঘরকুনো হয়ে গেলেন তিনি। ঘরের বাইরে একটি শহর আছে সে কথা মনেই আনলেন না। একদিন উমরাও বেগম জানালেন, শামসউদ্দিন ভাইয়ের জমিদারি ইংরেজরা বাজেয়াপ্ত করেছে।
গালিব কথা বললেন না। তাঁর দিকে তাকালেন না। নির্বাক বসে রইলেন। তিনি জানেন, চারপাশের লোকেরা বলছে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে গালিবও একজন। শামসউদ্দিনের লোকেরা তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে গালাগাল করে। অভিশাপ দেয়। তাঁদের ঘৃণার কথা চিৎকার করে বলে। তিনি চুপচাপ বসে থাকেন। নইলে বন্ধুদের চিঠি লিখেন। কিংবা গজল লেখায় মনোনিবেশ করেন। একা একা চৌসর খেলেন।
আবার দিন গড়ায়। মাস কেটে যায়। বছরও যায়।
উমরাও বেগম জাইনুলের বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। বিয়ের পরে জাইনুল স্ত্রীসহ তাঁদের সঙ্গে থাকছেন। বাড়িতে নতুন অতিথি। আবার আনন্দের জোয়ার চারদিকে। গালিব বুকের ভেতর শক্তি অনুভব করেন। বাইরে বের হওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। রমজান মাস শুরু হয়েছে। জামা মসজিদে মুসল্লিদের ভিড় বাড়ে। তিনি একদিন একা একা চৌসর খেলছিলেন সে সময় বন্ধু আজুরদা এসে ঢোকেন। অবাক বিস্ময়ে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ান। গালিব তাকিয়ে বলেন, এসো।
আজুরদা দুপা এগিয়ে মুখোমুখি বসে বলেন, হাদিসে পড়েছি মির্জা যে পবিত্র রমজান মাসে শয়তানকে আটকে রাখা হয়, কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে যে ঠিক পড়েছি কি না—
গালিব উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, ঠিকই পড়েছ বন্ধু, শয়তানকে যে ঘরে আটকে রাখা হয় সেটা তো এই ঘরই।
আজুরদা হাসতে হাসতে বলেন, আপনার রসিকতা অতুলনীয়। মুহূর্তের মধ্যে বলে ফেলতে পার। পার কি করে?
এটা তো আমারও প্রশ্ন। পারি কি করে?
আজুরদা মাখা নেড়ে অন্য প্রসঙ্গে গেলেন। বললেন, তোমার উর্দু দিওয়ান তো খুব জনপ্রিয় হয়েছে। লোকের মুখে তারিফ শুনছি। কতগুলো শের আছে? এগারশো শের দিয়েছি। বন্ধু ফজল হক আমাকে সাহায্য করেছেন বইটি সংকলনের ব্যাপারে। তিনি না হলে দিওয়ান এত গোছানো হতো? শেরগুলো বাছাইয়ের কাজও তিনি করে দিয়েছেন।
আজুরদা নিশ্বাস ফেলে বলেন, আমরা একজন ভালো বন্ধু হারিয়েছি।
ফজল হক দিল্লিতে থাকেন না, এটা ভাবলে আমার বুক ভেঙে যায়।
অন্যদিকে মোমিন খান মারা গেলেন।
হায় মোমনি খান, হায়! গালিবের চোখ জলে ভরে যায়।
ওর প্রেমের কবিতা আমাদের মুগ্ধ করতো। ভারি মিষ্টি হাত ছিল।
গালিব ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আজুরদার দিকে তাকান। বলেন, এই শহরে কবিদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
ভয় নেই বন্ধু। নতুন কবিদের জন্ম হবে।
হ্যাঁ, ইতিহাস এমনই
গালিব দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেন। আজুরদা ওঠে দাঁড়ান। বলেন, যাই। মন খারাপ লাগছে। গালিব মাথা নাড়েন। থাকার অনুরোধ করেন না। আবার তিনি একা হয়ে পড়েন। চৌসর খেলাতেও মন বসে না। বন্ধু শইফতার কথা মনে হয়। শইফতা আছে বলে ওর ওখানে আড্ডা হয়। আড্ডার কথা মনে হতেই আলিমর্দানের খালটির কথা মনে হয়। শুকিয়ে যাওয়া খালটিকে নতুন জীবন দিয়েছে চার্লস মেটকাফ। এখন চাঁদনি চকের ভেতর দিয়ে বয়ে যায় পানি। স্রোতের মৃদু শব্দ কানে এসে বাজে। চাঁদনি চকের মধ্য দিয়ে নজফগড় থেকে ফতেপুরী মসজিদ হয়ে লালকেল্লা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে জলের স্রোত। গালিব এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে কুঠুরি থেকে নামেন। জলের ধারে যাবেন। জলের ছায়ায় নিজের ছায়া দেখবেন। খুঁজবেন বন্ধুদের মুখ। যদি দেখা হয় শইফতার সঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন তাঁর প্রেমিকা রামজুর কথা। সবাই জানে রামজুর সঙ্গে তাঁর প্রেমের খবর। এ ব্যাপারে শইফতা খুব সৌখিন। তাঁর বিলাসে কোনো জড়তা নেই। গালিব খালের ধারে এসে দাঁড়ান। তখন আকাশে মেঘের ছায়া। বাতাসে তাপের স্পর্শ নেই। জলের স্নিগ্ধতা আবেশে ভরিয়ে দেয় তাঁকে। তিনি ভাবেন যা কিছু ঘাটতি তা তলিয়ে যায় জীবনের পূর্ণ অনুভবের কাছে। চাঁদনি চকের জলের স্রোতে হাত ডোবালে মাথায় জেগে ওঠে গজলের পঙ্ক্তি।
কয়েক মাস পরে আরিফের স্ত্রী পুত্রসন্তানের জন্ম দিলো। বাড়িতে খুশির হাওয়া বয়ে গেলো। গালিব নিজে মণ্ডা-মিঠাই কিনলেন। তিনি নানা হয়েছেন এই পরিতৃপ্তি তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আরিফের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগছে? তুমি পিতা হয়েছো।
খুবই খুশি। মনে হচ্ছে যেন একটি নতুন কবিতা লিখেছি।
বাহবা, বাহবা। সাবাস। গালিব উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন। আরিফ লাজুক মুখে সরে যায়।
আকিকা দিয়ে ছেলের নাম রাখা হয় বাকির আলি। গালিব ওকে উঁচু করে তুলে ধরে বলেন, যমুনার তীরে বড় হও! দেখো সূর্যের আলো।
চারদিকে জানান দিয়ে শিশুটি কেঁদে ওঠে 1
আবার তাঁর দিন গড়াতে শুরু করে। মুঘল সম্রাট এখন বাহাদুর শাহ জাফর। তিনি নিজে কবি। শিল্পপ্রেমী মানুষ। তাঁর দরবার জমজমাট থাকে। মুশায়রার আসর বসে নিয়মিত। একদিন কালে সাহেব এসে বললেন, আপনার উর্দু দিওয়ান আবার ছাপা হয়েছে। আমি বাদশাহর চিকিৎসক আইসানউল্লাহ খানের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আপনার ফারসি কবিতার ভক্ত। আপনার দিওয়ান বাদশাহর কাছে পৌঁছে দেবেন। আরো বলেছেন দরবারে আপনার একটি কাজের ব্যবস্থা করবেন।
গালিব সোজা হয়ে বসেন। নিঃসন্দেহে এটি তাঁর জন্য বড় খবর। পাশাপাশি তিনি এটাও জানেন যে তাঁর উর্দু কবিতার জন্যই তিনি অনেক বেশি জনপ্রিয়। যদিও তিনি ফারসি কবি বেদিলের অনেক বেশি ভক্ত। কালে সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলেন, এখন মনে হচ্ছে কালে সাহেবের হাজতে বন্দি থাকাই আমার জন্য উত্তম জায়গা।
কালে সাহেব দরাজকণ্ঠে বলেন, যিনি হাজত থেকে বাদশাহর দরবারে পৌছাতে পারেন তিনিই উত্তম ব্যক্তি। আমার বিশ্বাস আমি আপনাকে দরবারে পৌঁছে দিতে পারবো।
গালিব মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন। কালে সাহেব চলে গেলেন। তিনি কাগজ টেনে লিখতে বসলেন। এক মুহূর্ত ভাবলেন। তিনি জানেন দিল্লি শহরের অভিজাতেরা সকলে বড় বড় বাড়ি ও জমির মালিক। তাঁদের ধনের কোনো হিসাব নাই। তাঁদের দুজনের অসংখ্য প্রাসাদ আর জমি এক করলে তার সীমানা একটি শহরের প্রায় সমান হয়ে যায়। ওদের সভাগৃহ বা বসবাসের প্রাসাদ হচ্ছে একেকটি এলাকার কেন্দ্রবিন্দু। তবে এসব অভিজাত পরিবারের মধ্যে কারো কারো ধনদৌলত কমে গিয়ে তারা দরিদ্র হয়ে পড়ছে। গালিবের কলম কাগজের ওপর সচল হয়ে ওঠে। তিনি লিখতে থাকেন, এই শহরে দুজন গালিব আছে। একজন অভিজাত তুর্ক। তাঁর ওঠাবসা বাদশাহর সঙ্গে। অন্যজন অপমানিত, ঋণগ্রস্ত, প্রায় ভিখারি। সেজন্য দিল্লিবাসীর কেউ কেউ নিজেদের নাম উল্লেখ না করে পত্রিকায় লিখেছে, সহস্র তালিমারা জুতা পরে দণ্ডি হাতে হতদরিদ্র গালিব বেরিয়েছে দিল্লি ভ্রমণে। এটুকু লিখে তিনি থামলেন। তাঁর চিন্তা ঘুরপাক খায় আরো নানা বিষয় নিয়ে। যারা নতুন নওয়াব হয়েছেন তাঁদের কথাও তিনি ভোলেন না। চাঁদনি চক তাঁর প্রিয় জায়গা। এর মাঝ দিয়ে যে খালটি চলে গেছে। তার দুপাশে আছে সবুজ গাছ আর তার ছায়া। তিনি কতদিন সেসব গাছের ছায়ায় বসে সময় কাটিয়েছেন। তখন তিনি লিখতে শুরু করলেন কবিতা :
‘বেঁচে থাকবার আশ্রয় ও রসদ
কোথা থেকে পাবো।
আরামের কত প্রয়োজনীয় আয়োজন
কোথা থেকে পাবো।
রোজা এবং উপবাসে আমার বিশ্বাস আছে
কিন্তু খসখসে টাঙানো ঠাণ্ডা ঘর
আর বরফশীতল জল
হায়! কোথা থেকে পাবো।’
কবিতাটি লিখে তিনি কুঠুরি থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তাকিয়ে থাকলেন তাঁর প্রিয় দিল্লির দিকে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর জন্য দরবারে কাজের ব্যবস্থা হলো। ফারসি ভাষায় তাঁকে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস লিখতে হবে। এর জন্য বছরে ছয়শো টাকা সম্মানী পাবেন।
কাজের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়ার জন্য দরবারে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো।
তাঁকে দরবারি পোশাক দেয়া হলো।
রাজকীয় খেতাবেও ভূষিত করা হলো— নজম-উদ-দৌল্লা, দবীর-উল- মুলক-নিজাম জঙ্গ। অর্থাৎ তিনি হলেন সাম্রাজ্যের তারকা, ইতিহাসের রচনাকার, যুদ্ধের নায়ক। তিনি এই সম্মানে অভিভূত হলেন। বাড়ি ফেরার পথে লালকেল্লার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ফারসি ভাষা তিনি ভালোভাবে জানেন এই নিয়ে তাঁর অহঙ্কার আছে। যদিও তাঁর উর্দু কবিতা অনেক বেশি জনপ্রিয় তারপরও তিনি চান ফারসি ভাষার অন্যতম কবি হিসেবে পরিচিত হতে।
বাড়ি ফিরলে উমরাও বেগম সব শুনে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করলেন। বললেন, আমাদের কষ্টের দিন বোধহয় ফুরালো।
গালিব কিছু বললেন না। তিনি তো জানেন ভবিষ্যৎ কত অনিশ্চিত। কবিতার পাশাপাশি ইতিহাস লিখতে হবে এটাও বুকের ভেতর খোঁচার মতো লাগছে।
উঠে যাওয়ার আগে উমরাও বেগম বললেন, বাদশাহ আপনাকে সম্মান দিয়েছেন সেজন্য আমি খুব খুশি।
আমিও খুশি বিবি।
আমাদের আরেকটি খুশির খবর আছে।
কি, বলো কি?
আমাদের আরিফের আরেকটি বাচ্চা হবে।
মাশাল্লাহ। আল্লাহ মেহেরবান।
পকেট থেকে একমুঠো টাকা বের করে উমরাও বেগমকে দিয়ে বললেন, মণ্ডা-মিঠাই আনাও। প্রতিবেশীদের জানিয়ে দাও যে আমরা আরেকটি শিশুর নানা-নানী হতে যাচ্ছি।
অনেকদিন পরে উমরাও বেগমের বুকের ভেতরে খুশির জোয়ার বয়। ঘরে একটি শিশু বড় হচ্ছে। প্রতিদিন একটি শিশুর বড় হতে দেখাও তাঁর জন্য আল্লাহর রহমত। তিনি নামাজ পড়ে দোয়া করেন।
গালিব মুঘল ইতিহাস লেখার পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে তিনি দেখলেন এক খণ্ডে এই বিশাল সময়কে ধরা সম্ভব নয়। তিনি দুই খণ্ডে ইতিহাস রচনার পরিসর ঠিক করলেন। প্রথম খণ্ডে থাকবে তৈমুর লঙ থেকে হুমায়ুন পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় খণ্ডে থাকবে সম্রাট আকবর থেকে বর্তমান বাদশাহ বাহাদুর শাহ পর্যন্ত। প্রথম খণ্ডের নাম রাখবেন ‘মিহর-ই- নিমরোজ’ অর্থাৎ ‘মধ্যদিনের সূর্য।’ দ্বিতীয় খণ্ডের নাম রাখবেন ‘মাহ-ই- নিমমাহ’ অর্থাৎ ‘মধ্য মাসের চাঁদ’। পুরো বইটির নাম হবে ‘পরতারি স্তান’ অর্থাৎ ‘আলোর রাজ্য’।
ইতিহাস লেখার নানা আয়োজন সম্পন্ন করার পরে তিনি একবার খুশি হলেন। আবার মন খারাপ করলেন। তাঁর মনে হলো তিনি তো কবি। কবিতার বাদশাহ। কাব্যের স্রষ্টা। সাম্রাজ্যের বাদশাহর উচিত কবিকে পরিচর্যা করা। আপনি তো জানেন গালিব আগুন। তাঁর গজলে আগুনের শক্তি আছে। সৌন্দর্য আছে।
পর মুহূর্তে দমে যান আবার। তাঁর মনে হয় বাদশাহ থেকে শুরু করে দরবারের অন্যরা তাঁর কবিত্বশক্তির মূল্যায়ন করতে পারছেন না। তিনি এমন এক শক্তিশালী কবি যার জন্য সম্রাট গর্বিত হতে পারেন। কিন্তু না, সেখানেও তিনি কোনো আশার জায়গা দেখতে পান না। তিনি একলা ঘরে চিৎকার করে বলেন :
‘দুনিয়ায় আরো অনেক শক্তিশালী কবি আছেন,
কিন্তু গালিবের কলমটাই অন্যরকম।’
নিজের শের বলতে বলতে বারান্দায় আসেন। দুচোখ ভরে দেখেন দিল্লির আকাশ।
তারপরও সব দুঃখবোধ একপাশে রেখে ইতিহাস রচনার কাজ করলেন। ভালোই এগিয়েছে লেখা। আশা করছেন এভাবে কাজ করলে সময় মতো শেষ করতে পারবেন। ছয় মাস পরে পারিশ্রমিকের একটা থোক টাকা পাবেন। সেটা এখনো পাননি। এদিকে আরিফের দ্বিতীয় পুত্রটির জন্ম হয়েছে। নাম রাখা হয়েছে হুসেন আলি।
এক সকালে উমরাও বেগম বললেন, আরিফ অসুস্থ। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে।
গালিব থ হয়ে রইলেন। ভগ্নকণ্ঠে বললেন, কাল্লু মিয়াকে পাঠাও। হাকিমকে ডেকে নিয়ে আসুক।
পাঠিয়েছি। এখুনি হয়তো এসে যাবে।
উমরাও বেগম দোপাট্টা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বললেন, ওর বিবি ও তিনমাস ধরে জ্বরে ভুগছে। কাশছে। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।
মাথা ঠাণ্ডা করো বিবি
আমি আপনার কথা ভাবছি। আপনি বাদশাহর দরবারে এত বড় কাজ পেয়েছেন। মাথা ঠাণ্ডা করে কাজটা তো করতে হবে।
গালিব আবারও ভগ্নকণ্ঠে বলেন, বিবি আমাদের নসীবই এমন। আমাদের নসীবে সুখ নাই।
উমরাও বেগম দোপাট্টায় মুখ ঢাকলেন।
দুজনের সামনে কঠিন দিন ঘনিয়ে এলো। যক্ষ্মায় মারা গেলেন আরিফ। মারা গেলেন তাঁর স্ত্রীও।
স্তব্ধ হয়ে থাকলেন গালিব। উমরাও বেগমের মুখে কথা নেই। সারা দিন দুবাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত। বাকিরের বয়স পাঁচ। হুসেনের দুই। এতিম বাচ্চাদের দায় তাঁরা নিলেন। লালকুয়ায় কালে সাহেবের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে তাঁরা বল্লিমারোতে একটি বাড়ি ভাড়া করে উঠে এলেন। দুটি শিশু নিয়ে শুরু হলো নতুন জীবন। একদিন বাকির গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো, নানা আমার আম্মা-আব্বা কোথায় চলে গেলেন?
ওই আকাশে।
ওই আকাশে কি ওঁদের বাড়ি আছে?
গালিব কথা বললেন না। বাকিরকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বাকির বুকের ভেতর থেকে মাথা তুলে বললো, আব্বা-আম্মা আমাদেরকে নিয়ে গেলেন না কেন? আমরা কি বেশি দুষ্টামি করতাম?
গালিব আকুল হয়ে কাঁদলেন। নিজেকে সামলাতে তাঁর অনেকক্ষণ সময় লাগলো। তিনি কবি আরিফের মধ্যে নিজের যৌবন দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। কি করে ভুলবেন আরিফকে?
বছরখানেকের মধ্যে তাঁর জীবনে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটলো। ১৮৫৪- তিনি নিজের লেখার খাতায় বড় করে লিখলেন সালটি। এই বছরে প্রকাশিত হলো ইতিহাসের বই ‘মিহর-ই-ইমরোজ। লক্ষ্ণৌর দরবার থেকে তাঁর জন্য বার্ষিক অনুদান মঞ্জুর করা হয়েছে। বাদশাহর সভাকবি মহম্মদ ইব্রাহিম জওক মৃত্যুবরণ করেন। সভাকবি হিসেবে বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের দরবারে অভিষিক্ত হলেন গালিব।
লালকেল্লার বাইরে দাঁড়িয়ে দিল্লির আকাশ দেখেন। ভাবেন, সূর্য, গ্রহরাজি, চন্দ্ৰ, নক্ষত্র তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তিনিই তো সেই কবি যাঁকে ছুঁয়ে থাকবে সূর্যের আলো, চাঁদনি রাত। তিনিই তো সেই কবি যাঁর মাথার ওপর নেমে আসবে আকাশ।
লালকেল্লা তুমি যদি একদিন হারিয়ে যাও ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে, থাকবে গালিব। থাকবে গালিবের গজল। সাক্ষী থাকো লালকেল্লা।
তিনি পালকিতে ওঠেন। দেখতে পান বেহারাদের উজ্জ্বল দৃষ্টি চকচক করছে। ওরা বুঝি এক অন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তিনি ওদের দিকে তাকিয়ে বলেন, আমি সাম্রাজ্যের বাদশাহ নই, কবিতার বাদশাহ। আমাকে মনে রাখবে আমার এই শহর—আমার দিল্লি।
চলতে শুরু করে পালকি। তিনি দুচোখ মেলে তাকিয়ে থাকেন শহরের পথঘাটের দিকে।