পথের ধর্ম, ধর্মের পথ
যদি এমন একটি দৃশ্য-কল্পনা মনে আনা যায়—এক বন্ধু আরেক বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে পথ হাঁটছেন। দুই বন্ধুর বয়সের ব্যবধান অনেক। একজন তরুণ, আরেকজনের বয়সের গাছপাথর নেই। অতি প্রবীণ। তিনি এই পৃথিবীতে অনেক আগে এসেছেন। এই পৃথিবীর গাছপালা, কীটপতঙ্গ, পরিবেশ, প্রাণিজীবন, চালচলন, ধরণধারণ সবই জানেন। ইতিহাস জানেন, বিজ্ঞান জানেন—পরাবিজ্ঞান, অপরাবিজ্ঞান। তিনি ত্রিকালজ্ঞ। তিনি তরুণটির কাঁধে হাত রেখে পথ হাঁটছেন। এই পথচলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতটি কাঁধে রাখবেন। কানে কানে বলবেন, জীবনের পথ ধরে হাঁট বন্ধু। আমি তোমার পাশে আছি। আমি তোমাকে ঘিরে আছি। আমি তোমার বাইরে আছি, আমি তোমার ভিতরে আছি। কখনো আমি আর তুমি এক। “সন্নাপি অসন্নাপি, ভিন্নাপি অভিন্নাপি”। (বিবেকচূড়ামণি, ১০৯)
এই প্রবীণ বন্ধু কল্যাণপথের নির্দেশ দিতে পারেন, দিচ্ছেনও। সে-নির্দেশ পালিত হবে কি হবে না—সেই জানে, যাকে এই নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। সেই নির্দেশ না শুনে, না মেনে যারা বিপথে গিয়ে বিপদে পড়ে, তাকে তার এই প্রবীণ বন্ধু বলেন, দেখলে তো, শুনলে না! তাই তোমার এই বিপদ হলো! আচ্ছা, যা হয়েছে, হয়েছে। ওঠ, আবার চল। আমি আছি। তোমার সঙ্গেই আছি।
একদিন হয়তো লজ্জা আসবে। আমার বেচালে আমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বন্ধুটির কী দশা! কেন আমি তাঁর নির্দেশ, তাঁর পরামর্শ মানছি না! এই লজ্জার নাম ‘বিবেক’। ভগবান জীবের অন্তরে বিবেক হয়ে জেগে ওঠেন।
সাধুর ভগবান, জ্ঞানীর ভগবান, সাধারণ মানুষের ভগবান কি রকম রকম? অবশ্যই নয়। সাধু জগৎ থেকে সরে গিয়ে ঈশ্বরলাভের চেষ্টা করেন। যদি তাঁকে প্রশ্ন করা হয়—কিসের সন্ধানে চলেছেন আপনি? তিনি হয়তো বলবেন, আমি অপূর্ণ। পূর্ণ হতে চাই। অপূর্ণ কোন্ অর্থে? জ্ঞান। আমি অজ্ঞান। আমি আমার ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করছি। তারা যেদিকে ছোটায় সেইদিকে ছুটি। প্রচুর আকাঙ্ক্ষা, প্রবল বাসনা। নিজেকে বড় হীন মনে হয়। আমি আমার গৌরবের স্থলটি খুঁজে পেতে চাই। আতঙ্কের জগতে বসে আমি আনন্দের জগতের অনুসন্ধান করছি। আর শুনেছি—সেই জগৎটি ভগবানের। সংসার যেন ‘বিশালাক্ষীর দ’। ঘুরপাক খাইয়ে গভীরে টেনে নিয়ে যায়। এটুকু বুঝেছি— সংসারে সারবস্তু কিছু নেই, “আমড়া–আঁটি আর চামড়া।” সেই কারণে—
“আর কেন মন—এ সংসারে, যাই চল সেই নগরে।
সেথা দিবানিশি পূর্ণশশী আনন্দে বিরাজ করে।।
পক্ষ ভেদে ক্ষয় উদয় নাইকো চাঁদের সে পুবে।
নাই ক্ষুধা তৃষ্ণা ভোগ পিপাসা, পূর্ণানন্দ বিহরে।।”
জ্ঞানীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার ঈশ্বর? তিনি তুলবেন অনন্ত তর্ক ও বিতর্ক। বলবেন বহুরকমের জটিল শব্দ-সাকার, নিরাকার। তিনি দেহের আত্মা, না আত্মার দেহ? তাঁকে লাভ করতে হলে সংসার ছেড়ে গুহাবাসী হতে হবে? কোন্ নিয়মে সাধন করতে হবে? শিষ্য এইরকম প্রশ্ন করতে পারেন গুরুকে-
“কৃপয়া শয়তাং স্বামিন্ প্রশ্নোহয়ং ক্রিয়তে ময়া।
যদুত্তরমহং শ্রুত্বা কৃতার্থঃ স্যাং ভবন্মুখাৎ।।
কো নাম বন্ধঃ কথমেষ আগতঃ কথং প্রতিষ্ঠাঽস্য কথং বিমোক্ষঃ।
কোঽসাবনাত্মা পরমঃ ক আত্মা তয়োর্বিবেকঃ কথমেতদুচ্যতাম্।।” (ঐ, ৪৮-৪৯)
—প্রভু! আমি যে-প্রশ্ন করছি, কৃপা করে শুনুন। বন্ধন কাকে বলে? বন্ধন আসে কিভাবে? কিভাবে বেঁধে রাখে? কিভাবে বন্ধনমুক্ত হওয়া যায়? অনাত্মা কার নাম, পরমাত্মাই বা কি? আত্মা আর অনাত্মার বিচারই বা কিরূপ?
শঙ্করাচার্য উত্তর দিচ্ছেন। তিনি সেই বন্ধু আমাদের। বলছেন, অবিদ্যাবন্ধন উন্মোচন বা বিমোচন কর। শোন, পিতৃঋণ বিমোচনের জন্য পুত্রাদিরা আছে। শ্রাদ্ধাদি করে মুক্তির পথ করে দেবে; কিন্তু নিজের বন্ধন নিজেকেই খুলতে হবে। তারপর ধর তোমার মাথায় বোঝা, বইতে পারছ না; কেউ এসে তোমাকে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু ধর, তোমার খিদে পেয়েছে, জল তেষ্টা পেয়েছে; তখন তোমাকেই খেতে হবে, পান করতে হবে। অন্য কেউ খেলে হবে কি? যে-রোগী পথ্য ও ঔষধ খায়, তার পীড়া-আরোগ্যরূপ সিদ্ধিলাভ হয়। যে তার বিপরীত আচরণ করে তার আরোগ্যলাভের সম্ভাবনা নেই। এইবার শঙ্করাচার্য যা বললেন সেটি ধর্মপথের অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত—
‘বস্তুস্বরূপং স্ফুটবোধচক্ষুষা স্বেনৈব বেদ্যং ন তু পণ্ডিতেন।
চন্দ্রস্বরূপং নিজচক্ষুষৈব, জ্ঞাতমন্যৈরবগম্যতে কিম্।।” (ঐ, ৫৪)
—নিজের চোখ দিয়ে যেমন চাঁদের স্বরূপ দর্শন হয়, অন্য ইন্দ্রিয় দ্বারা হতে পারে না, সেইরকম জ্ঞানচক্ষু দ্বারাই ব্রহ্মপদার্থের স্বরূপ দর্শন হয়, অন্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা হতে পারে না। একমাত্র জ্ঞান, শুধু শাস্ত্র চটকালে হয় না।
এরপর যদি জিজ্ঞাসা করা হয়—ভগবান সম্পর্কে কি ধারণা? অধিকাংশ মানুষ বলবেন, অতশত জানি না, বিপদে পড়লে ডাক্তারকেও ডাকি, ভগবানকেও ডাকি। অভাবে পড়লে মন্দিরে গিয়ে পুজো চড়াই। যখন দুঃখ আসে, প্রতারিত হই, যখন মৃত্যু এসে প্রিয়জনকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়, যখন অপমানিত হই, বিতাড়িত হই—তখন বুঝতে পারি, “যার কেহ নাই, তুমি আছ তার।”
কে এই ‘তুমি’? সঠিকভাবে বলা যাবে না। একটা কথাই বলা যাবে—আমি নই। যেখানে ‘আমি’ হালে পানি পাবে না, সেইখানেই ‘তুমি’র আবির্ভাব।
বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ্, চণ্ডী, অজস্র টীকা ও ভাষ্যে ধর্মের জ্ঞানভাণ্ডার উপচে পড়ছে। মানুষ সম্ভ্রমে তার সামনে নত। গ্রহণের চেষ্টা আছে, কিন্তু জীবনে ফলিত করার চেষ্টায় অনেক বাধা। তার কারণ, বেঁচে থাকার বহুতর সমস্যার সরাসরি সমাধান পাওয়া যাবে না। যেসব সমাধান আছে সেখানে তা আয়ত্ত করা সহজ কাজ নয়। আমি বেঁচে থাকব, কিন্তু আমার ‘আমি’টা ‘তুমি’ হয়ে যাবে। ওষুধ নয়, অস্ত্রোপচার নয়, ঐকান্তিক ভাবনায় অলৌকিক এক ‘ট্রান্সপ্ল্যান্ট’! বরং একথা সহজেই বোঝা যাবে—পথ দুটি—’প্রবৃত্তি’ আর ‘নিবৃত্তি’। প্রবৃত্তির পথ ধরে গেলে সংসার। ধর্মের কারণে সংসার তো শ্মশান হয়ে যেতে পারে না। ‘মায়া’, ‘মায়া’ বলে ঢাকঢোল বাজালে জগৎজোড়া সংসারের যত আয়োজন সব উবে যাবে—এমনও নয়। মায়া এখন ঘোর মায়া। কত আলো! কত বৈচিত্র্য! কত ভোগের উপকরণ!
সংসার থেকে শ্মশান একটি পথ। শ্মশান শ্মশানই থাকবে। সংসার সংসার। সংসারকে শ্মশান করলে মানুষ আসবে কোথায়! রাজা যুধিষ্ঠিরের সংসার ছিল, শ্রীকৃষ্ণের ছিল, রামচন্দ্রের ছিল, মহাপ্রভুর ছিল, শ্রীরামকৃষ্ণের ছিল। রঘুবীর কোথায় এসে আসন পাতবেন? কোন্ মন্দির আলো করবেন মা ভবতারিণী? মন্দির নির্মাণের অর্থ আসবে কোথা থেকে? শঙ্করাচার্যের চারটি ধাম নির্মাণের সহযোগিতা তো সংসারীকেই করতে হবে।
সংসারকে করতে হবে ধর্মের সংসার, শিবের সংসার। গৃহ আর গৃহীকে বাদ দিলে ধর্মের ভিত টলে যাবে। ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে দাঁড়াতে হবে সকলকেই। সেই স্থানটি বড় পবিত্র, বড় গৌরবের। ধর্মক্ষেত্র কুরক্ষেত্রে যোদ্ধা পাঠাবে সংসার। শ্রীকৃষ্ণ সংসার থেকে শ্মশানে টেনে নিয়ে গিয়ে অর্জুনকে জীবনের মন্ত্র দিলেন না। এমন এক পরিবেশে নিয়ে গেলেন, যেখানে দাঁড়িয়ে তিনটি কালের প্রবাহকে মানসপটে প্রত্যক্ষ করা যায়। থাকা আর না-থাকা, অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের সংযোগস্থল। ধর্মকে বারণ করতে হলে মৃত্যুর আগেই মৃত্যুকে এগিয়ে আনতে হবে। আর তখনি ‘আমি’টা ‘তুমি’ হয়ে যাবে। অর্জুন ভয় পেয়েছেন। সামলে ত্রিকাল। বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছেন। অতীত পড়ে আছে মহাসমারোহে ঘটনার জাল বুনে। অতীত রচনা করেছে বর্তমান। বর্তমানে রয়েছে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। এ কেমন—বর্তমান একটা থালা, অতীত হলো রান্নাঘর, পরিবেশিত হচ্ছে ভবিষ্যৎ। ইংরেজী একটি প্রবাদ—”He that would know what shall be, must consider what has been.
অর্জুন বর্তমানটিকে সমর্পণ করে দিলেন ভগবানের হাতে। পরিস্থিতি অর্জুনকে শেখাতে চাইছে সেই অমোঘ সত্য—
“আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।
বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।।” (কঠ উপনিষদ্, ১।৩।৩)
—জীবাত্মাকে রথের রথী আর শরীরকে রথ বলে জেনো, বুদ্ধি হলো সারথি আর মন হলো বলগা।
উপনিষদের কাছে প্রার্থনা করি। গিরিশচন্দ্রের প্রশ্নটি তুলে ধরি——কে খেলায় আমি খেলি বা কেন’? বুদ্ধদেব এই প্রশ্নের সমাধান দিচ্ছেন গিরিশ-নাটকে—
“নিত্য আমি
নাহি জন্ম নাহিক মরণ
নাহি নাম-ধাম, উপাধিরহিত।”
উপনিষদ্ এই সিদ্ধান্তেই এনে ফেলবেন কয়েক ধাপ বিশ্লেষণের পথে। প্ৰথম বলবেন-
“ইন্দ্রিয়াণি হয়ানাহুবিষয়াংস্তেষু গোচরান্
আত্মেন্দ্রিয়মনোযুক্তং ভোক্তেত্যাহুর্মনীষিণঃ।।” (ঐ, ১।৩।৪)
–আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ হলো অশ্ব, শরীর হলো রথ। রূপ, রস, শব্দ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের বিষয় যেন সেই অশ্বগুলির রাজপথ। দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়যুক্ত আত্মাই স্বয়ং ভোক্তা।
স্বাভাবিক প্রশ্ন—তাহলে কর্তা কে? দেহ, মন অথবা ইন্দ্রিয়? উপনিষদের উত্তর–দেহ, মন আর ইন্দ্রিয়যুক্ত আত্মাই কর্তা। ইনি আবার কোন্ আত্মা? ‘জীব’ বা ‘জীবাত্মা’? প্রকৃত আত্মা হলেন ‘পরমাত্মা’ অথবা ‘শুদ্ধ চৈতন্য’। অতঃপর উপনিষদের কাছে প্রশ্ন-পথের শেষ কোথাও আছে কি? না, রবীন্দ্রনাথের মতো বলব—
“শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?
আঘাত হয়ে দেখা দিল, আগুন হয়ে জ্বলবে।।
সাঙ্গ হলে মেঘের পালা শুরু হবে বৃষ্টি ঢালা,
বরফ-জমা সারা হলে নদী হয়ে গলবে।।
ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে,
অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার যায় চলে আলোকে।
পুরাতনের হৃদয় টুটে আপনি নূতন উঠবে ফুটে,
জীবনে ফুল ফোটা হলে মরণে ফল ফলবে।।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্যিক সুষমায় উপনিষদকেই প্রকাশ করছেন—’ফুরায় যা তা ফুরায় শুধু চোখে’। উপনিষদ্ পথের নির্দেশ দিচ্ছেন—পথের পরিচয় দিচ্ছেন—
“উত্তিষ্ঠত জাগ্ৰত প্ৰাপ্য বরান্নিবোধত।
ক্ষুরস্যধারা নিশিতা দুরত্যয়া দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।” (ঐ, ১।৩।১৪)
—উপযুক্ত আচার্যের শরণ নিতে হবে। তাঁরা পথের নির্দেশ দেবেন। পথ অতি দুর্গম। ক্ষুরের তীক্ষ্ণ ধারের ওপর দিয়ে চলা। আচার্য কৃপা করে সেই পথ দিয়েই নিয়ে যান আত্মস্বরূপে।
“অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ং তথাহরসং নিত্যমগন্ধবচ্চ যৎ।
অনাদ্যনন্তং মহতঃ পরং ধ্রুবং নিচায্য তমৃত্যুমুখাৎ প্রমুচ্যতে।।” (ঐ, ১।৩।১৫)
—মানুষের জীবনের লক্ষ্য আত্মজ্ঞান লাভ করা। সঘোষে জানায় না—আমি শব্দহীন, স্পর্শহীন, রূপহীন, গন্ধহীন, শাশ্বত, অবিনাশী, অনাদি, অনন্ত, হিরণ্যগর্ভের চেয়েও শ্রেষ্ঠ, নিত্যবস্তু আত্মাকে জানতে চাই, প্রতিষ্ঠিত হতে চাই; কিন্তু প্রতি পদে তার স্বগোতক্তি থেকে বোঝা যায়—তার অন্বেষণ হলো এমন কিছু যা সুন্দর, প্রেমময়, উজ্জ্বল, শান্ত, দান্ত, সৌম্য, শিব। মানুষ সঙ্কীর্ণতা থেকে উদারতায় যেতে চায়, অন্ধকার থেকে আলোতে। উপনিষদ্ আরো এক কদম এগিয়ে দিতে চায়—বাইরে নয় ভিতরে-
“অঙ্গুষ্ঠমাত্রঃ পুরুষো মধ্য আত্মনি তিষ্ঠতি
ঈশানো ভূতভব্যস্য ন ততো বিজুগুপ্সতে। এতদ্বৈ তৎ।।” (ঐ, ২।১।১২)
-বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ পুরুষ (ব্রহ্ম) দেহের অভ্যন্তরে বাস করেন। তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করেন। সাধক যখন ব্রহ্মকে জানতে পারেন, তখন তিনি নিজেকে আর গোপন করেন না। জীবাত্মা ও পরমাত্মা এক ও অভিন্ন। ধূমহীন এক অগ্নিশিখা জীবের হৃদয়ে। তিনি পুরুষ। এই পুরুষ কালাধীশ। তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিয়ামক। ইনি সতত বিদ্যমান। সর্বত্র বিদ্যমান।
নচিকেতা যদি স্বামী বিবেকানন্দকে জিজ্ঞেস করতেন—জীবন ভাসতে ভাসতে যায় কোথায়, তাহলে অপূর্ব উত্তরটি পেতেন—
“একখানা মেঘ চাঁদের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, তাতে এই ভ্রমের উৎপত্তি হচ্ছে যে, চাঁদটাই চলেছে। তেমনি প্রকৃতি, দেহ, জড়বস্তু—এইগুলি সচল, গতিশীল; এদের গতিতেই এই ভ্রম উৎপন্ন হচ্ছে যে, আত্মা গতিশীল। সুতরাং অবশেষে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, যে সহজাত জ্ঞান দ্বারা সর্বজাতির উচ্চনীচ সবরকমের লোক, মৃত ব্যক্তিদের অস্তিত্ব নিজেদের কাছেই অনুভব করে এসেছে, যুক্তির দৃষ্টিতেও তা সত্য।
‘প্রত্যেক জীবাত্মাই এক-একটা নক্ষত্রস্বরূপ, আর ঈশ্বররূপ সেই অনন্ত নির্মল নীল আকাশে এই নক্ষত্ররাজি বিন্যস্ত রয়েছে। সেই ঈশ্বরই প্রত্যেক জীবাত্মার মূল স্বরূপ, তিনি প্রত্যেকের যথার্থ স্বরূপ, প্রত্যেকের প্রকৃত ব্যক্তিত্বই তিনি। কতকগুলি জীবাত্মারূপ তারকা—যাঁরা আমাদের দিগন্তের বাইরে চলে গেছেন, তাঁদের সন্ধানেই ধর্ম জিনিসটার আরম্ভ; আর এই অনুসন্ধান সমাপ্ত হলো—যখন তাঁদের সকলকেই ভগবানের মধ্যে পাওয়া গেল এবং আমরা আমাদের নিজেদেরও যখন তাঁর মধ্যে পেলাম।”
পথের শেষ কোথায়? আপাত সহজ দৃষ্টিতে—মৃত্যুতে। থাকতে থাকতে না থাকায়। এই প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের কয়েকটি প্রত্যক্ষ দর্শন উল্লেখের প্রয়োজন আছে। স্বয়ং অবতার মথুরবাবুর হাত ধরেছিলেন। তাঁকে চালাচ্ছিলেন। মথুরবাবু যেদিন নশ্বর দেহ ত্যাগ করবেন, সেদিন ঠাকুর হৃদয়কেও দেখতে পাঠালেন না। কালীঘাটে তাঁর দেহত্যাগের কয়েক ঘণ্টা আগে ঠাকুর দক্ষিণেশ্বরে গভীর ধ্যানমগ্ন হলেন। জ্যোতির্ময় বর্থে দিব্য শরীরে ভক্ত মথুরের শয্যাপার্শ্বে গিয়ে দাঁড়ালেন। তখন বিকেল পাঁচটা! ঠাকুরের কী অপূর্ব দর্শন! আত্মার এক লোক থেকে আরেক লোকে গমনের কী আয়োজন! দিব্যরথ এসেছে। ঠাকুর দেখছেন—”শ্রীশ্রীজগদম্বার সখীগণ মথুরকে সাদরে দিব্যরথে তুলে নিলেন—তার তেজ শ্রীশ্রীদেবীলোকে গমন করল।” পরে ঠাকুর ভক্তদের বলেছিলেন, পুণ্যলোকে গেলেও ওকে আবার আসতে হবে। ভোগবাসনার সম্পূর্ণ ক্ষয় হয়নি।
বৃদ্ধ মণিমোহন পুত্রশোকাতুর। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : “আহা! পুত্রশোকের মতো কি আর জ্বালা আছে? খোলটা (দেহ) থেকে বেরয় কিনা! খোলটার সঙ্গে সম্বন্ধ—যতদিন খোলটা থাকে ততদিন থাকে।” ঠাকুর নিজের ভ্রাতুষ্পুত্র অক্ষয়ের মৃত্যুর কথা তাঁকে বলছেন। নিজে তখন বিমর্ষ গম্ভীর। “অক্ষয় মলো—তখন কিছু হলো না। কেমন করে মানুষ মরে, বেশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলুম। দেখলুম—যেন খাপের ভেতর তলোয়ারখানা ছিল, সেটাকে খাপ থেকে বার করে নিলে; তলোয়ারের কিছু হলো না—যেমন তেমনি থাকল, খাপটা পড়ে রইল! দেখে খুব আনন্দ হলো, খুব গান করলুম, নাচলুম, হাসলুম। তার শরীরটাকে তো পুড়িয়ে-ঝুড়িয়ে দিয়ে এল! তারপর এল শোক।”
প্রশ্ন হলো, জীবন-পথ কি দুটো? ধর্মের পথ, অধর্মের পথ? অবশ্যই নয়। তাহলে পথিক কে? স্বয়ং ভগবান। শৈশবের একটি দৃশ্য মনে আসছে। এক ফেরিওলা। মাথায় তার ঝুড়ি, হাঁকতে হাঁকতে যাচ্ছে—পুতুল নেবে, পুতুল? সেই ঝুড়ি থেকে মুখ বের করে আছে শ্রীরামচন্দ্র, সঙ্কীর্তনানন্দে মহাপ্রভু, গোরা সৈন্য, পেটমোটা ব্রাহ্মণ, লাঠিধারী সিপাই, বাঁদর, ভাল্লুক।
ভগবান মাথায় ঝুড়ি নিয়ে সৃষ্টির পথ ধরে হাঁটছেন। মাথায় ঝুড়ি। এই নাও, গাছে ছেড়ে দিলুম বাঁদর, চিরকাল ঝুলে থাক বানর-বংশ। বনে ঢুকিয়ে দিলুম বাঘ, ছুটিয়ে দিলুম সুন্দরী হরিণ। আর সমস্যাটা তৈরি করে দিলুম চৈতন্যময় মানুষের বিভাগে—এই নাও রাম, রাবণও দিলুম। শ্রীচৈতন্যের সঙ্গে জগাই- মাধাই। পাণ্ডবদের বিপক্ষে হাজির কৌরব। আবার শ্রীকৃষ্ণ উভয় কুলের সখা।
স্বামীজী ঠাকুরের সঙ্গে প্রথম মিলনের দিনে অযোধ্যানাথ পাকড়াশীর যে- গানটি গেয়েছিলেন, সেইটিতেই এই পথের অতুলনীয় প্রকাশ আছে। মনে হয়, সব কথার শেষকথা—
“সত্যপথে মন কর আরোহণ
প্রেমের আলো জ্বালি চল অনুক্ষণ
সঙ্গেতে সম্বল রাখ পুণ্যধন, গোপনে অতি যতনে,
লোভ মোহ আদি পথে দস্যুগণ পথিকের করে সর্বস্ব হরণ
পরম যতনে রাখরে প্রহরী শম দম দুইজনে।”