ছাব্বিশ
আজ শনিবার, শশী ও নবতারার বিবাহের দিন। শশীর সনির্বন্ধ প্রার্থনা এই ছিল যে, রাত্রির অন্ধকারে লুকাইয়া কোন এক সময়ে যেন ডাক্তার ভারতীকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া আজ তাহাদের আশীর্বাদ করিয়া যান। পঞ্চমীর খণ্ডচন্দ্র সেইমাত্র গাছের আড়ালে ঢলিয়া পড়িয়াছে, ভারতী একখানা কালো র্যাপারে সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত করিয়া নিঃশব্দ পদক্ষেপে তাহার সেই জনশূন্য ঘাটের একধারে আসিয়া দাঁড়াইল। ডাক্তার নৌকায় অপেক্ষা করিতেছিলেন, ভারতী আরোহণ করিয়া বলিল, কত-কি যে ভাবতে ভাবতে আসছিলাম তার ঠিকানা নেই। জানি, আমাকে না বলে তুমি কিছুতেই চলে যাবে না, তবু ত ভয় ঘোচে না। ক’দিনই বা, কিন্তু, মনে হচ্ছিল যেন কত যুগ তোমাকে দেখতে পাইনি, দাদা। আমি নিশ্চয় তোমার সঙ্গে চীনেদের দেশে চলে যাবো তা বলে রাখছি।
ডাক্তার সহাস্যে কহিলেন, আমিও বলে রাখচি তুমি নিশ্চয়ই ও-রকম কিছু করবার চেষ্টা করবে না। এই বলিয়া তিনি ভাঁটার টানে নৌকা ছাড়িয়া দিলেন। বলিলেন, এইটুকু ত, বেশ যাওয়া যাবে, কিন্তু বড় নদীতে পড়ে উলটো স্রোত ঠেলে পৌঁছতে আজ আমাদের ঢের দেরি হবে।
ভারতী কহিল, হলই বা। এমনি কি শুভকর্মে যোগ দিতে চলেছ যে সময় বয়ে গেলে ক্ষতি হবে? আমার ত যাবার ইচ্ছেই ছিল না,—শুধু তুমি যাচ্চো বলেই যাওয়া। কি বিশ্রী নোংরা কাণ্ড বলত!
ডাক্তার ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিলেন, শশীর নবতারার সঙ্গে বিয়ে অনেকের সংস্কারে বাধে, হয়ত বা দেশের আইনেও বাধে। কিন্তু সে দোষ ত শশীর নয়, আইন করা-না-করার জন্য দায়ী যারা, অপরাধ তাদের। আমার একমাত্র ক্ষোভ শশী আর কাউকে যদি ভালবাসতো ভারতী!
ভারতী হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, শশীবাবু না হয় আর কাউকে ভালবাসলেন, কিন্তু সে বাসবে কেন? ওঁর মত মানুষকে সজ্ঞানে কোন মেয়েমানুষ ভালবাসতে পারে এ ত আমি ভাবতেই পারিনে। আচ্ছা তুমিই বল, পারে দাদা?
ডাক্তার মুচকিয়া হাসিলেন, বলিলেন, ওকে ভালবাসা শক্ত বৈ কি। তাই ত রয়ে গেলাম তাকে আশীর্বাদ করব বলে। মনে হল, সত্যকার শুভকামনার যদি কোন শক্তি থাকে শশী যেন তার ফল পায়।
তাঁহার কণ্ঠস্বরের আকস্মিক গভীরতায় ভারতী অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, শশীবাবুকে তুমি বাস্তবিক ভালোবাসো, না দাদা?
ডাক্তার বলিলেন, হাঁ।
কেন?
তোমাকেই বা কেন এত ভালবাসি তারই কি কারণ দিতে পারি দিদি? বোধ হয় এমনিই।
ভারতী আদর করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা দাদা, তোমার কাছে কি তবে আমরা দুজনে এক? কিন্তু পরক্ষণেই সহাস্যে বলিল, তবু ত নিজের দামটা এতদিনে টের পেলাম। চল, আমিও তোমার সঙ্গে গিয়ে এখন খুশী হয়ে তাদের আশীর্বাদ—না না, প্রণাম করে আসি গে।
ডাক্তারও হাসিলেন, বলিলেন, চল।
জোয়ারের আশায় নদীর এপারে কোথাও দীর্ঘকাল অপেক্ষা করা নিরাপদ নহে, তাই ভাঁটা ঠেলিয়া কষ্ট করিয়াই চলিতে হইল। খাঁড়ির মুখে একখানা জাপানী জাহাজ কিছুদিন হইতে বাঁধা ছিল, সেই স্থানটা নিঃশব্দে পার হইয়া ভারতী কথা কহিল। বলিল, এই কয়দিন থেকে থেকে কেবলি মনে হতো, দাদা, সমুদ্রের যেমন তল নেই, তোমারও তেমনি তল নেই। স্নেহ বল, ভালবাসা বল, কিছুই তোমাতে ভর দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে না। সবই যেন কোথায় তলিয়ে চলে যায়।
ডাক্তার বলিলেন, প্রথমতঃ, সমুদ্রের তল আছে, সুতরাং, উপমা তোমার এ ক্ষেত্রে অচল।
ভারতী কহিল, এই নিয়ে বোধ হয় তোমাকে এক শ’ বার বললাম যে, তুমি ছাড়া দুনিয়ায় আমার আর আপনার কেউ নেই,—তুমি চলে গেলে আমি দাঁড়াবো কোথায়? কিন্তু এ কথা তোমার কানেই পৌঁছল না। আর পৌঁছবে কি করে দাদা, হৃদয় ত নেই। আমি ঠিক জানি একবার চোখের আড়াল হলে তুমি নিশ্চয় আমাকে ভুলে যাবে।
ডাক্তার বলিলেন, না। তোমাকে নিশ্চয় মনে থাকবে।
ভারতী প্রশ্ন করিল, কি আশ্রয় করে আমি সংসারে থাকবো?
ডাক্তার বলিলেন, ভাগ্যবতী মেয়েরা যা আশ্রয় করে থাকে। স্বামী, ছেলেপুলে, বিষয়-আশয়, ঘরদোর—
ভারতী রাগ করিয়া বলিল, আমি যে অপূর্ববাবুকে একান্তভাবেই ভালবেসেছিলাম এ সত্য তোমার কাছে গোপন করিনি; তাঁকে পেলে একদিন যে আমার সমস্ত জীবন ধন্য হয়ে যেতো এ কথাও তুমি জানো,—তোমার কাছে কিছু লুকানোও যায় না,—কিন্তু তাই বলে আমাকে তুমি অপমান করবে কিসের জন্যে?
ডাক্তার আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, অপমান! অপমান ত তোমাকে আমি এতটুকু করিনি, ভারতী।
সহসা অশ্রু-আভাসে ভারতীর কণ্ঠ ভারী হইয়া উঠিল, কহিল, না, করনি বৈ কি! তুমি জানো কত শত-সহস্র বাধা, তুমি জানো তিনি আমাকে গ্রহণ করতেই পারেন না,—তবুও তুমি এই-সব বলবে!
ডাক্তার ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, এই ত মেয়েদের দোষ। তারা নিজেরা একদিন যা বলে, অপরে তাই আর একদিন উচ্চারণ করলেই তারা তেড়ে মারতে আসে। সেদিন সুমিত্রার কথায় বললে সে কাকে যেন একদিন পায়ের তলায় টেনে এনে ফেলবে, আর আজ আমি তারই পুনরাবৃত্তি করায় কান্নায় গলা তোমার বুঁজে এলো!
ভারতী চোখ মুছিয়া বলিল, না, তুমি কখনো এ-সব কথা আমাকে বলতে পাবে না।
ডাক্তার কহিলেন, বেশ, বলব না। কিন্তু এ যাত্রা বেঁচে যদি ফিরে আসি বোন, এই আমারই পায়ের কাছে গলায় আঁচল দিয়ে স্বীকার করতে হবে,—দাদা, আমার কোটি কোটি অপরাধ হয়েছে,—নিশ্চয় তুমি হাত গুণতে জানো, নইলে সৌভাগ্যের এতবড় সত্যি কথা তখন বলেছিলে কি করে!
ভারতী ইহার উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকিয়া তিনি পুনশ্চ কথা কহিলেন, এবার কোথা দিয়া যেন কণ্ঠস্বরে তাঁহার অপরূপ সুর মিশিল, বলিলেন, সে-রাত্রে সুমিত্রার কথা যখন বলছিলে, ভারতী, আমি জবাব দিতে পারিনি। এ পথের পথিক নই আমি, তবু তোমার মুখের সুমিত্রার কাহিনীতে গায়ে আমার বার বার কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো! দুনিয়া ঘুরে অনেক বস্তুরই হদিস পেয়েছি, পেলাম না শুধু এই নর-নারীর প্রেমের তত্ত্ব! দিদি, অসম্ভব বলে শব্দটা বোধ হয় সংসারে কেবল এদেরই অভিধানে লেখে না।
এ কথায় ভারতী লেশমাত্র ঔৎসুক্য প্রকাশ করিল না। উদাস-নিস্পৃহ স্বরে বলিল, তোমার বাক্যই সত্য হোক, দাদা, ও শব্দটা তোমাদের অভিধান থেকে যেন মুছে যায়। সুমিত্রাদিদির অদৃষ্ট যেন একদিন প্রসন্ন হয়। একটুখানি থামিয়া বলিল, আমি অনেক ভেবে দেখেচি, আমার নিজের কিন্তু ওতে আর আনন্দ নেই, ও আমি আর কামনাও করিনে। এই বলিয়া সে পুনরায় ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া কহিল, অপূর্ববাবুকে আমি যথার্থই ভালবাসি। ভাল হোক, মন্দ হোক, তাঁকে আর আমি ভুলতে পারবো না। কিন্তু তাই বলে তাঁর স্ত্রী হয়ে তাঁর ঘর-সংসার না করতে পেলেই জীবন আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে কিসের জন্যে? এ আমার শোকের কথা নয় দাদা, তোমাকে অকপটে যথার্থই বলচি আমাকে তুমি শান্তমনে আশীর্বাদ করে পথ দেখিয়ে দিয়ে যাও,—তোমার মত আমিও পরের কাজেই এ জন্মটা আমার সার্থক করে তুলব। নাও না দাদা, তোমার নিরাশ্রয় ছোট বোনটিকে সাথী করে!
ডাক্তার নিঃশব্দে তরী বাহিয়া চলিলেন, এতবড় সনির্বন্ধ অনুরোধের উত্তর দিলেন না। অন্ধকারে তাঁহার মুখের চেহারা ভারতী দেখিতে পাইল না, সে এই নীরবতায় আশান্বিতা হইয়া উঠিল। এবার তাহার কণ্ঠস্বরে সস্নেহ-অনুনয়ের নিবিড় বেদনা যেন উপচিয়া পড়িল, বলিল, নেবে দাদা সঙ্গে? তুমি ছাড়া এ আঁধারে যে একফোঁটা আলোও আর কোথাও দেখতে পাইনে!
ডাক্তার ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া কহিলেন, অসম্ভব ভারতী। তোমার কথায় আজ আমার জোয়াকে মনে পড়ে; তোমারই মত তার অমূল্য জীবন অকারণে নষ্ট হয়ে গেছে। ভারতের স্বাধীনতা ছাড়া আমার নিজের আর দ্বিতীয় লক্ষ্য নেই, কিন্তু মানবজীবনে এর চেয়ে বৃহত্তর কাম্য আর নেই এমন ভুলও আমার কোন দিন হয়নি। স্বাধীনতাই স্বাধীনতার শেষ নয়। ধর্ম, শান্তি, কাব্য, আনন্দ—এরা আরও বড়। এদের একান্ত বিকাশের জন্যই ত স্বাধীনতা, নইলে এর মূল্য ছিল কোথা? এর জন্যে তোমাকে আমি হত্যা করতে পারব না বোন, তোমার মধ্যে যে হৃদয় স্নেহে, প্রেমে, করুণায়, মাধুর্যে এমন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, সে আমার প্রয়োজনকে অতিক্রম করে বহু ঊর্ধ্বে চলে গেছে,—তার নাগাল আমি হাত বাড়িয়ে পাবো না।
ভারতীর সর্বাঙ্গ পুলকে কণ্টকিত হইয়া উঠিল। সব্যসাচীর গভীর অন্তরের একটা অপরূপ মূর্তি যে যেন সহসা চক্ষে দেখিতে পাইল। ভক্তি ও আনন্দে বিগলিত হইয়া কহিল, আমিও ত তাই ভাবি দাদা, তোমার অজানা সংসারে কি আছে! আর তাই যদি হলো, কি হেতু তুমি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে আছো? দেশে-বিদেশে গুপ্ত-সমিতি সৃষ্টি করে বেড়ানো তোমার কিসের জন্যে? মানবের চরম কল্যাণ ত কোন দিনই এর মধ্যে থেকে হতে পারবে না।
ডাক্তার বলিলেন, ঠিক তাই। কিন্তু চরম কল্যাণের ভার আমরা বিধাতার হাতে ছেড়ে দিয়ে ক্ষুদ্র মানবের সাধ্যের মধ্যে যে সামান্য কল্যাণ তারই চেষ্টাতে নিযুক্ত আছি। নিজের দেশের মধ্যে স্বাধীনভাবে কথা কওয়া, স্বাধীনভাবে চলে-ফিরে বেড়ানোর অতি তুচ্ছ অধিকার,—এর অধিক সম্প্রতি আর আমরা কিছুই চাইনে, ভারতী।
ভারতী কহিল, সে ত সবাই চায়, দাদা, কিন্তু তার জন্যে নরহত্যার ষড়যন্ত্র কিসের জন্যে বল ত? কি তার প্রয়োজন? কিন্তু কথাটা উচ্চারণ করিয়া ফেলিয়া সে অত্যন্ত লজ্জিত হইল। কারণ এ অভিযোগ শুধু রূঢ় নয়, অসত্য!
তৎক্ষণাৎ অনুতপ্তচিত্তে কহিল, আমাকে মাপ কর দাদা, এ মিথ্যে আমি শুধু রাগের ওপরেই বলে ফেলেছি। আমাকে তুমি ফেলে চলে যাবে—এ যেন আমি ভাবতেই পারচি নে।
ডাক্তার হাসিয়া বলিলেন, তা আমি জানি।
ইহার পরে বহুক্ষণ পর্যন্ত আর কোন কথাবার্তা হইল না। এই সময়ে কিছুদিন হইতে ‘স্বদেশী’ আন্দোলন ভারতবর্ষব্যাপী হইয়া উঠিয়াছিল। ভক্তিভাজন নেতৃবৃন্দ দেশোদ্ধারকল্পে আইন বাঁচাইয়া যে-সকল জ্বালাময়ী বক্তৃতা অবকাশ মত দিয়া বেড়াইতেছিলেন তাহারই সারাংশ সংবাদপত্র-স্তম্ভে মাঝে মাঝে পাঠ করিয়া ভারতী সশ্রদ্ধবিস্ময়ে আপ্লুত হইয়া উঠিত। বিগত রাত্রে এমনি ধারা কি একটা রোমাঞ্চকর রচনা খবরের কাগজে পাঠ করিয়া অবধি তাহার মনের মধ্যে উত্তেজনার তপ্ত বাতাস সারাদিন ধরিয়া আজ বহিয়া ফিরিতেছিল। তাহাই স্মরণ করিয়া কহিল, আমি জানি ইংরাজ রাজত্বে তোমার স্থান নেই। কিন্তু সমস্ত দুনিয়াই ত তাদের নয়! সেখানে গিয়ে তোমরা ত সরল, প্রকাশ্যভাবেই তোমাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির চেষ্টা করতে পারো।
প্রশ্ন করিয়া ভারতী উত্তরের আশায় কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করিয়া বলিল, অন্ধকারে তোমার মুখ দেখতে পাচ্চিনে বটে, কিন্তু বেশ বুঝতে পারচি মনে মনে তুমি হাসচো। কিন্তু, তুমি এবং তোমার বিভিন্ন দলগুলিই ত শুধু নয়, আরও যাঁরা দেশের কাজে,—তাঁরা প্রবীণ, বিজ্ঞ, রাজনীতিতে যাঁরা,—আচ্ছা দাদা, কালকের বাংলা খবরের কাগজটা—
বক্তব্য শেষ হইল না, ডাক্তার হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, রক্ষে কর ভারতী, আমাদের সঙ্গে তুলনা করে পূজনীয়গণের অমর্যাদা করো না।
ভারতী কহিল, বরঞ্চ, তুমিই তাঁদের বিদ্রূপ করচ।
ডাক্তার সবেগে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, মোটে না। তাঁদের আমি ভক্তি করি, এবং তাঁদের দেশোদ্ধারের বক্তৃতা আমাদের চেয়ে সংসারে কেউ বেশী উপভোগ করে না।
ভারতী ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিল, পথ তোমাদের এক না হতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য ত একই।
ডাক্তার ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া বলিলেন, এতক্ষণ হাসছিলাম সত্যি, এবার কিন্তু রাগ করব ভারতী। পথ আমাদের এক নয় এটা জানা কথা, কিন্তু লক্ষ্য যে আমাদের তার চেয়েও অধিক স্বতন্ত্র এ কি তুমিও এতদিন বোঝনি? পৃথিবীর বহুজাতিই স্বাধীন,—তার চেয়ে বড় গৌরব মানব-জন্মের আর নেই, সেই স্বাধীনতার দাবী করা, চেষ্টা করা ত ঢের দূরের কথা, তার কামনা করা, কল্পনা করাও ইংরাজের আইনে ভারতবাসীর রাজদ্রোহ। আমি সেই অপরাধেই অপরাধী! চিরদিন পরাধীন থাকাটাই এ দেশের আইন। সুতরাং, আইনের বাইরে এই-সব প্রবীণ পূজ্য ব্যক্তিরা ত কোন দিন কোন-কিছুই দাবী করেন না। চীনাদের দেশে মাঞ্চু রাজাদের মত এদেশেও যদি ইংরাজ আইন করে দিত—সবাইকে আড়াই হাত টিকি রাখতে হবে, তবে টিকির বিরুদ্ধে এঁরা কোনমতেই বে-আইনী প্রার্থনা করতেন না। এঁরা এই বলে আন্দোলন করতেন যে, আড়াই হাত আইনের দ্বারা দেশের প্রতি অত্যন্ত অবিচার করা হয়েচে, এতে দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে, অতএব, একে সওয়া দু’হাত করে দেওয়া হোক। এই বলিয়া তিনি নিজের রসিকতায় উৎফুল্ল হইয়া অকস্মাৎ অট্টহাস্যে নদীর অন্ধকার নীরবতা বিক্ষুব্ধ করিয়া তুলিলেন।
হাসি থামিলে ভারতী কহিল, তুমি যাই কেন না বল, তাঁরাও যে দেশের নমস্য ন’ন এ কথা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারব না। আমি সকলের কথাই বলচি নে, কিন্তু সত্য সত্যই যাঁরা রাষ্ট্রনীতিবিদ—যথার্থই যাঁরা দেশের শুভাকাঙ্ক্ষী, তাঁদের সকল শ্রমই ব্যর্থশ্রম, এ কথা নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করা কঠিন। মত এবং পথ বিভিন্ন বলেই কাউকে ব্যঙ্গ করা সাজে না।
তাহার কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্য উপলব্ধি করিয়া ডাক্তার চুপ করিলেন। পিছন হইতে একটা স্টিম লঞ্চ যথেষ্ট শব্দ-সাড়া করিয়া তাঁহাদের ক্ষুদ্র তরণীকে রীতিমত দোল দিয়া বাহির হইয়া গেলে সব্যসাচী ধীরে ধীরে বলিলেন, ভারতী, তোমাকে ব্যথা দেওয়াও আমার উদ্দেশ্য নয়, তোমার নমস্যগণকে উপহাস করাও আমার অভিপ্রায় নয়। তাঁদের রাজনীতিবিদ্যার পাণ্ডিত্য সম্বন্ধেও আমার ভক্তি কম নেই, কিন্তু কি জানো দিদি, গৃহস্থ গরুকে যখন খাটো করে বাঁধে, তখন তার সেই ছোট্ট দড়িটুকুর মধ্যে নীতি একটিমাত্রই থাকে। আমি সেইটুকু মাত্রই জানি। গরুর একান্ত নাগালের বাইরে খাদ্যবস্তুর প্রতি প্রাণপণে গলা এবং জিভ বাড়িয়ে লেহন করার চেষ্টার মধ্যে অবৈধতা কিছুমাত্র নেই, এমন কি অত্যন্ত আইনসঙ্গত। উৎসাহ দেবার মত হৃদয় থাকলে দিতেও পারো, রাজার নিষেধ নেই, কিন্তু বৃষের এই আন্তরিক প্রবল উদ্যম বাইরে থেকে যারা দেখে, তাদের পক্ষে হাস্য সংবরণ করা কঠিন।
ভারতী হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, দাদা, তুমি ভারী দুষ্টু। বলিয়াই আপনাকে সংযত করিয়া কহিল, কিন্তু এ আমি ভেবে পাইনে, প্রাণ যার অহর্নিশি সরু সুতোয় ঝুলচে সে কি করে হাসি-তামাশা করে পরের কথা নিয়ে।
ডাক্তার সহজকণ্ঠে বলিলেন, তার কারণ, এ সমস্যার মীমাংসা পূর্বেই হয়ে গেছে ভারতী, যেদিন বিপ্লবের কাজে যোগ দিয়েছি। আর আমার ভাববারও নেই, নালিশ করবারও নেই। আমি জানি, আমাকে হাতে পেয়েও যে রাজশক্তি ছেড়ে দেয়, হয় সে অক্ষম উন্মাদ নয় তার ফাঁসি দেবার দড়িটুকু পর্যন্ত নেই।
ভারতী বলিল, তাইত আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই দাদা। আমি উপস্থিত থাকতে তোমার প্রাণ নিতে পারে সংসারে এমন কেউ নেই। এ আমি কোনমতেই হতে দেব না। বলিতে বলিতেই গলা তাহার চক্ষের পলকে ভারী হইয়া আসিল।
ডাক্তার টের পাইলেন। নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, নৌকায় জোয়ার লেগেছে ভারতী, পৌঁছতে আর আমাদের দেরি হবে না।
প্রত্যুত্তরে ভারতী শুধু কহিল, মরুক গে। কিছুই আমার ভাল লাগচে না। মিনিট-দুই পরে জিজ্ঞাসা করিল, এতবড় রাজশক্তিকে তোমরা গায়ের জোরে টলাতে পারো একি তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর দাদা?
দ্বিধাহীন উত্তর আসিল, করি, এবং সমস্ত মন দিয়ে করি। এতবড় বিশ্বাস না থাকলে এতবড় ব্রত আমার অনেকদিন পূর্বেই ভেঙ্গে যেত।
ভারতী বলিল, তাই বোধ হয় ধীরে ধীরে তোমার কাজ থেকে আমাকে বার করে দিচ্চ,—না দাদা?
ডাক্তার স্মিতহাস্যে বলিলেন, না, তা নয় ভারতী। কিন্তু, বিশ্বাসই ত শক্তি, বিশ্বাস না থাকলে সংশয়ে যে কর্তব্য তোমার পদে পদে ভারাতুর হয়ে উঠবে। সংসারে তোমার অন্য কাজ আছে বোন—কল্যাণকর, শান্তিময় পথ, যা তুমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস কর,—তাই তুমি কর গে।
অপরিসীম স্নেহবশেই যে এই লোকটি তাহার একান্ত বিপদসঙ্কুল বিপ্লব-পন্থা হইতে তাহাকে দূরে অপসারিত করিতে চাহিতেছে তাহা নিঃসন্দেহে উপলব্ধি করিয়া ভারতীর সজল চক্ষু অশ্রুপ্লাবিত হইয়া উঠিল। অলক্ষ্যে, অন্ধকারে ধীরে ধীরে মুছিয়া বলিল, দাদা, আমার কথায় কিন্তু রাগ করতে পাবে না। এতবড় রাজশক্তি, কত সৈন্যবল, কত উপকরণ, যুদ্ধের কত বিচিত্র ভয়ানক আয়োজন, তার কাছে তোমার বিপ্লবী দল কতটুকু? সমুদ্রের কাছে গোষ্পদের চেয়েও ত তোমরা ছোট। এর সঙ্গে তোমরা শক্তি পরীক্ষা করতে চাও কোন্ যুক্তিতে? প্রাণ দিতে চাও দাও গে— কিন্তু এতবড় পাগলামি আমি ত সংসারে আর দ্বিতীয় দেখতে পাইনে। তুমি বলবে, তবে কি দেশের উদ্ধার হবে না? প্রাণের ভয়ে সরে দাঁড়াবো? কিন্তু তা আমি বলিনে। তোমার কাছে থেকে, তোমার চরিত্র হতে জননী জন্মভূমি যে কি সে আমি চিনেছি। তাঁর পদতলে সর্বস্ব দিতে পারার চেয়ে বড় সার্থকতা মানুষের যে আর নেই তোমাকে দেখে এ কথা যদি না আজও শিখতে পেরে থাকি ত আমার চেয়ে অধম নারী জন্মে কেউ জন্মায় নি। কিন্তু নিছক আত্মহত্যা করেই কোন্ দেশ কবে স্বাধীন হয়েছে? কোন মতে তোমার ভারতী যে কেবল বেঁচে থাকতেই চায় এতবড় ভুল ধারণা করেও আমার সম্বন্ধে তুমি রেখো না দাদা।
ডাক্তার নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, তাই ত!
তাইত কি?
তোমার সম্বন্ধে ভুলই হয়েছে বটে। এই বলিয়া ডাক্তার কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া কহিলেন, বিপ্লব মানেই, ভারতী, কাটাকাটি রক্তারক্তি নয়। বিপ্লব মানে অত্যন্ত দ্রুত আমূল পরিবর্তন। সৈন্যবল, বিরাট যুদ্ধোপকরণ, এ সবই আমি জানি। কিন্তু শক্তি পরীক্ষা ত আমাদের লক্ষ্য নয়। আজ যারা শত্রু, কাল তারা বন্ধু হতেও ত পারে। নীলকান্ত শক্তি পরীক্ষা করতে যায়নি, তাদের মিত্র করতে গিয়েই প্রাণ দিয়েছিল। হায় রে নীলকান্ত! কেবা তার নাম জানে!
অন্ধকারেও ভারতী স্পষ্ট বুঝিতে পারিল দেশের বাহিরে, দেশের কাজে, যে ছেলেটি লোকচক্ষুর অগোচরে নিঃশব্দে প্রাণ দিয়াছে তাহাকে স্মরণ করিয়া এই নির্বিকার পরমসংযত মানুষটির গভীর হৃদয় ক্ষণিকের জন্য আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছে। অকস্মাৎ যেন তিনি সোজা হইয়া উঠিয়া বসিলেন, বলিলেন, কি বলছিলে ভারতী, গোষ্পদ? তাই হবে হয়ত। কিন্তু যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জনপদ ভস্মসাৎ করে ফেলে, আয়তনে সে কতটুকু জানো? শহর যখন পোড়ে সে আপনার ইন্ধন আপনি সংগ্রহ করে দগ্ধ হয়। তার ছাই হবার উপকরণ তারই মধ্যে সঞ্চিত থাকে, বিশ্ববিধানের এ নিয়ম কোন রাজশক্তিই কোন দিন ব্যত্যয় করতে পারে না।
ভারতী বলিল, দাদা, তোমার কথা শুনলে গা কাঁপে। রাজশক্তিকে যে তুমি দগ্ধ করতে চাও, তার ইন্ধন ত আমাদেরই দেশের লোক। এতবড় লঙ্কাকাণ্ডের কল্পনায় কি তোমার মনে করুণাও জাগে না?
প্রত্যুত্তরে লেশমাত্র দ্বিধা নাই, ডাক্তার স্বচ্ছন্দে কহিলেন, না। প্রায়শ্চিত্ত কথাটা কি শুধু মুখেরই কথা? পূর্ব-পিতামহগণের যুগান্তসঞ্চিত পাপের অপরিমেয় স্তূপ নিঃশেষ হবে কিসে বলতে পারো? করুণার চেয়ে ন্যায়ধর্ম ঢের বড় বস্তু, ভারতী।
ভারতী ব্যথা পাইয়া বলিল, এ তোমার সেই পুরানো কথা দাদা। ভারতের স্বাধীনতার প্রসঙ্গে তুমি যে কত নিষ্ঠুর হতে পারো তা যেন আমি ভাবতেই পারিনে। রক্তপাত ছাড়া আর কিছু যেন মনে তোমার জাগতেই পায় না। রক্তপাতের জবাব যদি রক্তপাতই হয়, তা হলে তারও ত জবাব রক্তপাত? এবং তারও ত জবাবে এই একই রক্তপাত ছাড়া আর কিছু মেলে না। এ প্রশ্নোত্তর ত সেই আদিম কাল থেকে হয়ে আসচে। তবে কি মানবের সভ্যতা এর চেয়ে বড় উত্তর কোন দিন দিতে পারবে না? দেশ গেছে, কিন্তু তার চেয়েও যে বড় সেই মানুষ ত আজও আছে। মানুষে মানুষে কি হানাহানি না করে কোনমতেই পাশাপাশি বাস করতে পারে না?
ডাক্তার কহিলেন, ইংরাজের একজন বড় কবি বলেছেন, পশ্চিম ও পূর্ব কোনদিনই মিলতে মিশতে পারে না।
ভারতী রুষ্ট হইয়া কহিল, ছাই কবি। বলুক গে সে। তুমি পরম জ্ঞানী, তোমাকে অনেকবার জিজ্ঞেসা করেচি, আজও জিজ্ঞেসা করচি, হোক তারা পশ্চিমের, হোক তারা ইউরোপের মানুষ, কিন্তু তবু ত মানুষ? মানুষের সঙ্গে মানুষে কি কিছুতেই বন্ধুত্ব করতে পারে না? দাদা, আমি ক্রীশ্চান, ইংরাজের কাছে আমি বহু ঋণে ঋণী, তাদের অনেক সদ্গুণ আমি নিজের চোখে দেখেচি,—তাদের এত মন্দ ভাবতে আমার বুকে শূল বেঁধে। কিন্তু আমাকে তুমি ভুল বুঝো না দাদা, আমি বাঙালী ঘরেরই মেয়ে,—তোমারই বোন। বাঙলার মাটি, বাঙলার মানুষকে আমি প্রাণাধিক ভালবাসি। কে জানে, যে জীবন তুমি বেছে নিয়েছ, হয়ত আজই আমাদের শেষ দেখা। আজ আমাকে, তুমি শান্তমনে এই জবাবটি দিয়ে যাও, যেন এরই দিকে চোখ রেখে আমি সারা জীবন মুখ তুলে সোজা চলে যেতে পারি। বলিতে বলিতে শেষের দিকে তাহার কণ্ঠস্বর কান্নার ভারে একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িল।
ডাক্তার নীরবে তরী বাহিতে লাগিলেন। বিলম্ব দেখিয়া ভারতীর মনে হইল, বোধ হয় তিনি ইহার উত্তর দিতে চান না। সে হাত বাড়াইয়া নদীর জলে চোখ-মুখ ধুইয়া ফেলিল, অঞ্চল দিয়া বার বার ভাল করিয়া মুছিয়া পুনরায় কি একটা প্রশ্ন করিতেছিল, ডাক্তার কথা কহিলেন।
স্নিগ্ধ মৃদুকণ্ঠ, কোথাও লেশমাত্র উত্তেজনা বা বিদ্বেষের আভাস নাই,—যেন কাহার কথা কে বলিতেছে এমনি শান্ত সহজ। ভারতীর সেই প্রথম পরিচয়-দিনের স্কুলের নিরীহ নির্বোধ মাস্টার মহাশয়টিকে মনে পড়িল। অশুদ্ধ ইংরাজি উচ্চারণ, ব্যাকরণও তেমনি,—ভারতী কষ্টে হাসি চাপিয়া আলাপ করিয়াছিল। পরে তাই লইয়া রাগ করিয়া সে ডাক্তারকে অনেক দিন অনেক তিরস্কার করিয়াছে। সেই নিরুৎসুক নিঃস্পৃহকণ্ঠে কহিলেন, এক রকমের সাপ আছে, ভারতী, তারা সাপ খেয়েই জীবনধারণ করে। দেখেচ?
ভারতী বলিল, না দেখিনি, শুনেচি।
ডাক্তার বলিলেন, পশুশালায় আছে। এবার কলকাতায় গিয়ে অপূর্বকে হুকুম করো, সে দেখিয়ে আনবে।
বার বার ঠাট্টা করো না দাদা, ভাল হবে না বলচি।
না, ভাল হবে না আমিও তাই বলচি। পাশাপাশি বাস করাটা ঠিক ঘটে ওঠে না বটে, কিন্তু আর ও ঘনিষ্ঠভাবে একজনের জঠরের মধ্যে আর একজন বেশ নিরাপদেই স্থান পায়। বিশ্বাস না হয় জু’র অধ্যক্ষকে জিজ্ঞেসা করে দেখো।
ভারতী চুপ করিয়া রহিল।
ডাক্তার বলিলেন, তুমি তাদের সমধর্মাবলম্বী, তাদের কাছে অশেষ ঋণে ঋণী, তাদের অনেক সদ্গুণ চোখে দেখেচ,—দেখেচ তাদের বিশ্বগ্রাসী বিরাট ক্ষুধার পরিমাণ? এ দেশের মালিক তারা,—মালিকানার তারিখ মনে আছে ত? আজ ব্রিটিশ-সম্পদের তুলনা হয় না। কত জাহাজ, কত কল-কারখানা, কত শত-সহস্র ইমারত। মানুষ মারবার উপকরণ-আয়োজনের আর অন্ত নেই। তার সমস্ত অভাব, সর্বপ্রকার প্রয়োজন মিটিয়েও ইংরেজ ১৮১০ সাল থেকে সত্তর বছরের মধ্যে কেবল বাইরে দিয়েছিল ঋণ তিন হাজার কোটি টাকা! জানো এই বিরাট ঐশ্বর্যের উৎস কোথায়? আপনাকে তুমি বাঙলা দেশের মেয়ে বলছিলে, না? বাঙলার মাটি, বাঙলার জলবায়ু, বাঙলার মানুষ তোমার প্রাণাধিক প্রিয়, না? এই বাঙলার দশ লক্ষ নর-নারী প্রতি বৎসরে শুধু ম্যালেরিয়া জ্বরে মরে। এক-একটা যুদ্ধজাহাজের দাম জানো? এর একটার খরচে কেবল দশ লক্ষ মায়ের চোখের জল চিরদিনের তরে মোছানো যায়। ভেবেছ কখনো এ কথা? দেখেচ কখনো বুকের মধ্যে মায়ের মূর্তি? শিল্প গেল, বাণিজ্য গেল, ধর্ম গেল, জ্ঞান গেল,—নদীর বুক বুজে মরুভূমি হয়ে উঠছে, চাষা পেট পুরে খেতে পায় না, শিল্পী বিদেশীর দুয়ারে মজুরি করে,—দেশে জল নেই, অন্ন নেই, গৃহস্থের সর্বোত্তম সম্পদ সে গোধন নেই,—দুধের অভাবে শিশুদের শুকিয়ে মরতে দেখেচ ভারতী?
ভারতী চীৎকার করিয়া থামাইতে চাহিল, কিন্তু গলা দিয়া তাহার শুধু একটা অস্ফুট শব্দ বাহির হইল মাত্র।
সব্যসাচীর সেই ধীর সংযত কণ্ঠস্বর কোন্ একসময়ে অন্তর্হিত হইয়াছিল, বলিলেন, তুমি ক্রীশ্চান, মনে পড়ে একদিন কৌতূহলবশে ইউরোপের ক্রীশ্চান সভ্যতার স্বরূপ জানতে চেয়েছিলে? সেদিন ব্যথা দেবার ভয়ে বলিনি, কিন্তু আজ তার উত্তর দেব। তোমাদের কেতাবে কি আছে জানিনে, শুনেচি ভাল কথা ঢের আছে, কিন্তু বহুদিন একসঙ্গে বসবাস করে এর সত্যকার চেহারা আর আমার এতটুকু অগোচর নেই। লজ্জাহীন উলঙ্গ স্বার্থ এবং পশু-শক্তির একান্ত প্রাধান্যই এর মূলমন্ত্র। সভ্যতার নাম দিয়ে দুর্বল, অক্ষমের বিরুদ্ধে এতবড় মুষল মানুষের বুদ্ধি আর ইতিপূর্বে আবিষ্কার করেনি। পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে চেয়ে দেখ, ইউরোপের বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধা থেকে কোন দুর্বল জাতিই আজ আর আত্মরক্ষা করতে পারেনি।
দেশের মাটি, দেশের সম্পদ থেকে দেশের ছেলেরা বঞ্চিত হয়েছে কোন্ অপরাধে জানো ভারতী? একমাত্র শক্তিহীনতার অপরাধে। অথচ ন্যায়ধর্মই সকলের বড়, এবং বিজিতের অশেষ কল্যাণের জন্যেই এই অধীনতার শৃঙ্খল তার পায়ে পরিয়ে সেই পঙ্গুর সর্বপ্রকার দায়িত্ব বহন করাই ইউরোপীয় সভ্যতার চরম কর্তব্য,—এই পরম অসত্য লেখায়, বক্তৃতায়, মিশনারির ধর্মপ্রচারে, ছেলেদের পাঠ্যপুস্তকে অবিশ্রান্ত প্রচার করাই তোমাদের ক্রীশ্চান সভ্যতার রাজনীতি।
ভারতী মিশনারির হাতে মানুষ, অনেকের মহৎ-চরিত্র সে যথার্থই চোখে দেখিয়াছে; বিশেষতঃ তাহার ধর্মবিশ্বাসের প্রতি এইরূপ অহেতুক আক্রমণে সে ব্যথা পাইয়া বলিল, দাদা, যে-জন্যেই হোক, তোমার শান্ত-বুদ্ধি আজ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। ক্রীশ্চান-ধর্ম প্রচার করতে যাঁরা এদেশে এসেছেন তাঁদের সম্বন্ধে তোমার চেয়ে আমি ঢের বেশী জানি। তাঁদের প্রতি তুমি আজ নিরপেক্ষ সুবিচার করতে পারছ না। ইউরোপীয় সভ্যতা কি তোমাদের কোন ভাল করেনি? সতীদাহ, গঙ্গাসাগরে সন্তান-বিসর্জন—
ডাক্তার বাধা দিয়া বলিয়া উঠিলেন, চড়কের সময়ে পিঠ-ফোঁড়া, সন্ন্যাসীদের খাঁড়ার ওপর লাফানো, ডাকাতি, ঠগি, বর্গির হাঙ্গামা, গোঁড় ও খাসিয়াদের আষাঢ়ের নরবলি,—আর যে মনে পড়ছে না ভারতী—
ভারতী কথা কহিল না।
ডাক্তার বলিলেন, রসো, আরও দুটো স্মরণ হয়েছে। বাদশাদের আমলে গৃহস্থের বৌ-ঝি ঘরে রাখা যেত না,—নবাবেরা মেয়েদের পেট চিরে ছেলে-মেয়ে দেখত,—হায় রে হায়, এমনি করেই বিদেশীর লেখা ইতিহাস সামান্য এবং তুচ্ছ বস্তুকে বিপুল, বিরাট তৈরি করে দেশের প্রতি দেশের লোকের চিত্ত বিমুখ করে দিয়েছে! মনে আছে আমার ছেলেবেলায় স্কুলের পড়ার বইয়ে একবার পড়েছিলাম, বিলেতে বসে আমাদের কল্যাণ ভেবে ভেবেই কেবল রাজমন্ত্রীর চোখের নিদ্রা এবং মুখের অন্ন বিস্বাদ হয়ে গেছে। এই সত্য ছেলেদের কণ্ঠস্থ করতে হয়, এবং উদরান্নের দায়ে শিক্ষকদের কণ্ঠস্থ করাতে হয়। সভ্য রাজ্যতন্ত্রের এই রাজনীতি ভারতী। আজ অপূর্বকে দোষ দেওয়া বৃথা।
অপূর্বর লাঞ্ছনায় মনে মনে ভারতী লজ্জিত হইল, রুষ্ট হইল। কহিল, তুমি যা বলচ তা সত্য হতে পারে, হয়ত, কোথাও কেউ অতিভক্ত রাজকর্মচারী এমনিই করেছে, কিন্তু এতবড় সাম্রাজ্যের অসত্যই কখনো মূলনীতি হতে পারে না। এর ওপরে ভিত্তি করে এই বিপুল প্রতিষ্ঠান একটা দিনের তরেও স্থির থাকতে পারে না। তুমি বলবে কালের পরিমাণে এ ক’টা দিন? এমনি সাম্রাজ্য ত ইতিপূর্বেও ছিল, সে কি চিরস্থায়ী হয়েছে? তোমার কথা যদি যথার্থ হয়, এও চিরস্থায়ী হবে না। কিন্তু, এই শৃঙ্খলাবদ্ধ, সুনিয়ন্ত্রিত রাজ্য,—যত নিন্দেই কর না কেন,—এর ঐক্য, এর শান্তি থেকে কি কোন শুভ লাভই হয়নি? প্রতীচ্যের সভ্যতার কাছে কৃতজ্ঞ হবার কি কোন হেতুই পাওনি? স্বাধীনতা তোমরা ত বহুদিন হারিয়েছ, ইতিমধ্যে রাজশক্তির পরিবর্তন হয়েছে সত্য, কিন্তু তোমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ত হয়নি। ক্রীশ্চান বলে আমাকে তুমি উলটো বুঝো না দাদা, কিন্তু নিজেদের সমস্ত অপরাধ বিদেশীর মাথায় তুলে দিয়ে গ্লানি করাই যদি তোমার স্বদেশপ্রেমের আদর্শ হয়, সে আদর্শ তোমার হাত থেকেও আমি নিতে পারব না। এত বিদ্বেষ হৃদয়ের মধ্যে পুরে তুমি ইংরাজের ক্ষতি হয়ত করতেও পারো, কিন্তু তাতে ভারতবাসীর কল্যাণ হবে না এ সত্য নিশ্চয় জেনো।
তাহার সহসা উচ্ছ্বসিত তীক্ষ্ণস্বর নিস্তব্ধ নদীবক্ষে আহত হইয়া সব্যসাচীর কানে পশিয়া তাঁহাকে চমকিত করিয়া দিল। ভারতীর এই রূপ অপরিচিত, এ মনোভাব অপ্রত্যাশিত। তথাপি যে ধর্ম-বিশ্বাস ও সভ্যতার ঘনিষ্ঠ প্রভাবের মধ্যে সে বালিকা বয়স হইতে মানুষ হইয়া উঠিয়াছে, তাহারই আঘাতে চঞ্চল ও অসহিষ্ণু হইয়া সে এই যে নির্ভীক প্রতিবাদ করিয়া বসিল, তাহা যত কঠিন ও প্রতিকূল হউক, সব্যসাচীর চক্ষে তাহাকে যেন নব-মর্যাদা দান করিল।
তাঁহাকে নিরুত্তর দেখিয়া ভারতী বলিল, কৈ জবাব দিলে না দাদা? এতবড় হিংসের আগুন বুকের মধ্যে জ্বালিয়ে তুমি আর যাই কর দেশের ভালো করতে পারবে না।
ডাক্তার কহিলেন, তোমাকে ত অনেকবার বলেছি দেশের ভালো যাঁরা করবেন তাঁরা চাঁদা তুলে দিকে দিকে অনাথ-আশ্রম, ব্রহ্মচর্যাশ্রম, বেদান্ত-আশ্রম, দরিদ্র-ভাণ্ডার প্রভৃতি নানা হিতকর কার্য করছেন, মহৎ লোক তাঁরা, আমি তাঁদের ভক্তি করি,—কিন্তু, দেশের ভালো করার ভার আমি নিইনি, আমি স্বাধীন করার ভার নিয়েছি। একটুখানি থামিয়া বলিলেন, আমার বুকের আগুন নেভে শুধু দুটো জিনিস দিয়ে। এক নিজের চিতাভস্মে, আর নেভে যেদিন শুনবো ইউরোপের ধর্ম, সভ্যতা, নীতি, সমুদ্রের অতল গর্ভে ডুবেছে।
ভারতী স্তব্ধ হইয়া রহিল। তিনি বলিতে লাগিলেন, এই বিষকুম্ভের পরিপূর্ণ সওদা নিয়ে সমুদ্র পার হয়ে ইয়োরোপ যখন প্রথম বেসাতি করতে এসেছিল, তখন চিনতে পেরেছিল কেবল জাপান। তাই আজ তার এত সৌভাগ্য, তাই আজ সে ইউরোপের সমকক্ষ সম্ভ্রান্ত মিতা। কিন্তু চিনতে পারেনি ভারত, চিনতে পারেনি চীন। তখন স্পেনের রাজ্য পৃথিবীময়, ক্ষুদ্র জাপান স্পেনের এক নাবিককে জিজ্ঞাসা করে, এত রাজ্য হল তোমাদের কি করে? নাবিক বললে, অতি সহজে, যে দেশ আত্মসাৎ করতে চাই, সেখানে নিয়ে যাই প্রথমে মাল, হাতে পায়ে পড়ে ব্যবসার জন্যে দেশের রাজার কাছে চেয়ে নিই এক-ফোঁটা জমি। তার পরে আনি মিশনারি, তারা যত না করে ক্রীশ্চান, তার বেশী করে সেদেশের ধর্মকে গালিগালাজ। লোকে ক্ষেপে উঠে হঠাৎ ফেলে দু-একটাকে মেরে। তখন আসে আমাদের কামান-বন্দুক, আসে আমাদের সৈন্যসামন্ত। আমাদের সভ্য দেশের মানুষ-মারা কল যে অসভ্য দেশের চেয়ে কত শ্রেষ্ঠ তা অচিরে প্রমাণিত করে দিই। শুনে জাপান বললে, প্রভু! আপনারা তাহলে গা তুলুন, আপনাদের আর ব্যবসাতে কাজ নেই। এই বলে তাদের বিদায় দিয়ে নিজেদের দেশের মধ্যে আইন জারি করে দিলে,—চন্দ্র-সূর্য যত দিন উদয় হবে ক্রীশ্চান যেন না আর আমাদের দেশে পা দেয়। দিলে তার প্রাণদণ্ড।
তাহার ধর্ম ও ধর্মযাজকদের প্রতি এই তীক্ষ্ণ ইঙ্গিত ভারতী বিষণ্ণ হইয়া বলিল, এ কথা তোমার কাছে আমি পূর্বেও শুনেছি, কিন্তু যে জাপানীদের তুমি ভক্তি কর, তারা কি?
ডাক্তার কহিলেন, ভক্তি করি? মিছে কথা। ওদের আমি ঘৃণা করি। কোরিয়ানদের বার বার প্রতিশ্রুতি এবং অভয় দিয়েও বিনা দোষে, মিথ্যা অজুহাতে তাদের রাজাকে বন্দী করে ১৯১০ সালে যখন কোরিয়া রাজ্য আত্মসাৎ করে নিলে, তখন আমি সাংহাইয়ে। সে দিনের সে-সব অমানুষিক অত্যাচার ভোলবার নয়, ভারতী। আর অভয় কি শুধু একা জাপানই দিয়েছিল? ইয়োরোপও দিয়েছিল। শক্তিমানের বিরুদ্ধে ইংরাজ কথা কইলে না, বললে, অ্যাঙ্লো- জাপানী-সন্ধি-সূত্রে আমরা আবদ্ধ।
এবং সেই কথাই আমেরিকা-যুক্তরাজ্যের সভাপতি অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করে বললেন, প্রতিশ্রুতি তা কি! যে অক্ষম, শক্তিহীন জাতি আত্মরক্ষা করতে পারে না তাদের রাজ্য যাবে না ত যাবে কাদের? ঠিকই হয়েছে! এখন আমরা যাবো তাদের উদ্ধার করতে? অসম্ভব! পাগলামি! এই বলিয়া সব্যসাচী একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিলেন, আমিও বলি ভারতী,—অসম্ভব, অসঙ্গত, পাগলামি। প্রবল দুর্বলের সম্পদ কেন ছিনিয়ে নেবে না, এ কথা যে সভ্য ইয়োরোপের নৈতিক-বুদ্ধি ভাবতেই পারে না।
ভারতী নির্বাক হইয়া রহিল। তিনি বলিতে লাগিলেন, আঠারো শতাব্দের শেষের দিকে ব্রিটিশদূত লর্ড ম্যাকার্টনি এলেন চৈনিক দরবারে কিঞ্চিৎ ব্যবসার সুবিধে করে নিতে। মাঞ্চুরাজ শিন্লুঙ ছিলেন তখন সমস্ত চীনের সম্রাট, অত্যন্ত দয়ালু; দূতের বিনীত আবেদনে খুশী হয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, দেখ বাপু, আমাদের স্বর্গীয় সাম্রাজ্যে অভাব কিছুরই নেই, কিন্তু তুমি এসেছ অনেক দূর থেকে, অনেক দুঃখ সয়ে। আচ্ছা, ক্যানটন শহরে ব্যবসা কর, স্থান দিচ্চি, তোমাদের ভাল হবে। রাজ-আশীর্বাদ নিষ্ফল হলো না, ভালই হলো। পঞ্চাশ বছর পেরুল না, চীনের সঙ্গে ইংরাজের প্রথম যুদ্ধ বাধলো।
ভারতী বিস্মিত হইয়া কহিল, কেন দাদা?
ডাক্তার কহিলেন, চীনেরই অন্যায়। বেয়াদপ হঠাৎ বলে বসলো আফিং খেয়ে খেয়ে চোখ-কান আমাদের বুজে গেল, বুদ্ধিশুদ্ধি আর নেই, দয়া করে ও-জিনিসটার আমদানি বন্ধ কর।
তারপরে?
তার পরের ইতিহাস খুব ছোট। বছর-দুয়ের মধ্যে পুনশ্চ আফিং খেতে রাজী হয়ে আরও পাঁচখানা বন্দরে শতকরা পাঁচ টাকা মাত্র শুল্কে বাণিজ্যের মঞ্জুরি-পরোয়ানা দিয়ে এবং সর্বশেষে হংকং বন্দর দক্ষিণা প্রদান করে বেয়াল্লিশ সালে যজ্ঞ সমাধা হল। ঠিকই হয়েছে। এত সস্তায় আফিং পেয়েও যে মূর্খ খেতে আপত্তি করে তার এমনি প্রায়শ্চিত্ত হওয়াই উচিত।
ভারতী বলিল, এ তোমার গল্প।
ডাক্তার কহিলেন, তা হোক, গল্পটা শুনতে ভালো। আর এই না দেখে ফ্রান্সের ফরাসী সভ্যতা বললে, আমার ত আফিং নেই, কিন্তু, খাসা মানুষ-মারা কল আছে। অতএব, যুদ্ধং দেহি। হলো যুদ্ধ। ফরাসী চীন-সাম্রাজ্যের আনাম প্রদেশটা কেড়ে নিলে। আর যুদ্ধের খরচা অধিকতর বাণিজ্যের সুবিধে, ট্রিটিপোর্ট ইত্যাদি ইত্যাদি—এ-সব তুচ্ছ কাহিনী থাক।
ভারতী কহিল, কিন্তু দাদা, তালি কি একহাতে বাজে? চীনের অন্যায় কি কিছু ছিল না?
ডাক্তার বলিলেন, থাকতে পারে। তবে তামাশা এই যে, ইউরোপীয় সভ্যতার অন্যায়বোধটা অপরের ঘর-চড়াও হয়েই হয়, তাঁদের নিজেদের দেশের মধ্য ঘটতে দেখা যায় না।
তারপরে?
বলচি। জার্মান সভ্যতা দেখলেন, বা রে বাঃ, এতো ভারী মজা! আমি যে ফাঁকে পড়ি। তিনি এক জাহাজ মিশনারি এনে লেলিয়ে দিলেন। ৯৭ সালে তাঁরা যখন তোমাদের প্রভু যিশুর মহিমা, শান্তি এবং ন্যায়ধর্ম প্রচারে ব্যাপৃত, তখন একদল চীনে ক্ষেপে উঠে পরম ধার্মিক জন-দুই প্রচারকের মুণ্ডু ফেললে কেটে। অন্যায়! চীনেরই অন্যায়। অতএব, গেল শ্যান্টঙ প্রদেশ জার্মানির উদর-বিবরে।
তারপরে এল বক্সার-বিদ্রোহ। ইয়োরোপের সমস্ত সভ্যতা এক হয়ে তার যে প্রতিশোধ নিলে, হয়ত, কোথাও তার আর তুলনা নেই। তার অপরিমেয় খেসারতের ঋণ কতকালে যে চীনেরা শোধ দেবে তা যিশুখ্রিষ্টই জানেন। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ-সিংহ, জারের ভালুক, জাপানের সূর্যদেব,—কিন্তু আর না বোন, গলা আমার শুকিয়ে আসচে। দুঃখের তুলনায় একা আমরা ছাড়া বোধ হয় এদের আর সঙ্গী নেই। সম্রাট শিন্লুঙের নির্বাণ লাভ হোক, তাঁর আশীর্বাদের বহর আছে!
ভারতী মস্তবড় একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া চুপ করিয়া রহিল।
ভারতী!
কি দাদা?
চুপচাপ যে?
তোমার গল্পের কথাটাই ভাবচি। আচ্ছা দাদা, এই জন্যেই কি চীনেদের দেশে তোমার কার্যক্ষেত্র বেছে নিয়েছ? যারা শত অত্যাচারে জর্জরিত, তাদের উত্তেজিত করে তোলা কঠিন নয়, কিন্তু একটা কথা কি ভেবেচ? এই-সব নিরীহ, অজ্ঞান চাষাভূষোর দুঃখ এমনিই ত যথেষ্ট, তার ওপরে আবার কাটাকাটি রক্তারক্তি বাধিয়ে দিলে ত সে দুঃখের আর অবধি থাকবে না!
ডাক্তার কহিলেন, নিরীহ চাষাভূষোর জন্যে তোমার দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই ভারতী, কোন দেশেই তারা স্বাধীনতার কাজে যোগ দেয় না। বরঞ্চ, বাধা দেয়। তাদের উত্তেজিত করার মত পণ্ডশ্রমের সময় নেই আমার। আমার কারবার শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, ভদ্র-সন্তানদের নিয়ে। কোনদিন যদি আমার কাজে যোগ দিতে চাও ভারতী, এ কথাটা ভুলো না। আইডিয়ার জন্যে প্রাণ দিতে পারার মত প্রাণ, শান্তিপ্রিয়, নির্বিরোধী, নিরীহ কৃষকের কাছে আশা করা বৃথা। তারা স্বাধীনতা চায় না, শান্তি চায়। যে শান্তি অক্ষম, অশক্তের,—সেই পঙ্গুর জড়ত্বই তাদের ঢের বেশী কামনার বস্তু।
ভারতী ব্যাকুল হইয়া উঠিল, আমিও তাই চাই দাদা, আমাদের বরঞ্চ এই জড়ত্বের কাজেই তুমি নিযুক্ত করে দাও, তোমার পথের-দাবীর ষড়যন্ত্রের বাষ্পে নিঃশ্বাস আমার রুদ্ধ হয়ে আসচে।
সব্যসাচী হাসিয়া বলিলেন, আচ্ছা।
ভারতী থামিতে পারিল না, তেমনি ব্যগ্র উচ্ছ্বাসে বলিয়া উঠিল, ঐ একটা আচ্ছার বেশী আর কি তোমার কিছুই বলবার নেই দাদা?
কিন্তু আমরা যে এসে পড়েছি ভারতী, একটুখানি সাবধানে বসো দিদি, যেন আঘাত না লাগে—এই বলিয়া ডাক্তার ক্ষিপ্রহস্তে হাতের দাঁড় দিয়া ধাক্কা মারিয়া তাঁহার ছোট্ট নৌকাখানিকে অন্ধকার তীরের মধ্যে প্রবিষ্ট করাইয়া দিলেন। তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া হাত ধরিয়া তাহাকে নামাইতে নামাইতে বলিলেন, জলকাদা নেই বোন, কাঠ পাতা আছে, পা দাও।
অন্ধকারে অজানা ভূপৃষ্ঠে হঠাৎ পা ফেলিতে ভারতীর দ্বিধা হইল, কিন্তু পা দিয়া সে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল, দাদা, তোমার হাতে আত্মসমর্পণ করার মত নির্বিঘ্ন স্বস্তি আর নেই।
কিন্তু অপর পক্ষ হইতে এ মন্তব্যের উত্তর আসিল না। উভয়ে অন্ধকারে কিছুদূর অগ্রসর হইলে ডাক্তার বিস্ময়ের কণ্ঠে কহিলেন, কিন্তু ব্যাপার কি বলত? এ কি বিয়েবাড়ি? না আছে আলো, না আছে চীৎকার, না শোনা যায় বেহালার সুর,—কোথাও গেল নাকি এরা?
আরও কিছুদূর আসিয়া চোখ পড়িল সিঁড়ির উপরের সেই চিত্র-বিচিত্র কাগজের লণ্ঠন। ভারতী আশ্বস্ত হইয়া কহিল, ঐ যে সেই চীনে-আলো। এর মধ্যেই খরচের হুঁশিয়ারিটা শশী-তারার দেখবার বস্তু, দাদা। এই বলিয়া সে হাসিল।
দু’জনে সিঁড়ি বাহিয়া নিঃশব্দে উপরে উঠতেই খোলা দরজার সম্মুখে প্রথমেই চোখে পড়িল,—শশী মন দিয়া কি একখানা কাগজ পড়িতেছে। ভারতী আনন্দিত কলকণ্ঠে ডাকিয়া উঠিল, শশীবাবু, এই যে আমরা এসে পড়েছি,—খাবার বন্দোবস্ত করুন, নবতারা কৈ? নবতারা! নবতারা!
শশী মুখ তুলিয়া চাহিল, কহিল, আসুন। নবতারা এখানে নেই।
ডাক্তার স্মিতমুখে কহিলেন, গৃহিণীশূন্য গৃহ কিরকম কবি? ডাকো তাকে, আমাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে যাক, নইলে দাঁড়িয়ে থাকবো। হয়ত খাবোও না।
শশী বিষণ্ণমুখে বলিল, নবতারা এখানে নেই ডাক্তার। তারা সব বেড়াতে গেছে।
সহসা তাহার মুখের চেহারায় ভীত হইয়া ভারতী প্রশ্ন করিল, কোথায় বেড়াতে গেলো? আজকের দিনে? কি চমৎকার বিবেচনা!
শশী বলিল, তারা বিয়ের পরে রেঙ্গুনে বেড়াতে গেছে। না না, আমার সঙ্গে নয়,—সেই যে আহমেদ,—ফর্সা মতন,—চমৎকার দেখতে,—কুট সাহেবের মিলের টাইম-কিপার,—দেখেছেন না? আজ দুপুরবেলা তারই সঙ্গে নবতারার বিয়ে হয়েছে। সমস্তই তাদের ঠিক ছিল—আমাকে বলেনি।
আগন্তুক দুইজনে বিস্ময়-বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া রহিলেন,—বল কি শশী?
শশী উঠিয়া গিয়া ঘরের একটা নিভৃত স্থান হইতে একটা ন্যাকড়ার থলি আনিয়া ডাক্তারের পায়ের কাছে রাখিয়া দিয়া কহিল, টাকা পেয়েছি ডাক্তার। নবতারাকে পাঁচ হাজার দেব বলেছিলাম, দিয়ে দিয়েছি। বাকী আছে সাড়ে চার হাজার, পঞ্চাশ টাকা আমি নিলাম, কিন্তু—
ডাক্তার কহিলেন, এই টাকা কি আমাকে দিচ্চ?
শশী কহিল, হাঁ। আমার আর কি হবে? আপনি নিন। কাজে লাগবে।
ভারতী জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু তাকে কবে টাকা দিলেন?
শশী কহিল, কাল টাকা পেয়েই তাকে দিয়ে এসেছি।
নিলে?
শশী মাথা নাড়িয়া বলিল, হাঁ। আমেদ ত মোটে ত্রিশটি টাকা মাইনে পায়। তারা একটা বাড়ি কিনবে।
নিশ্চয়ই কিনবে! এই বলিয়া ডাক্তার সহাস্যে ফিরিয়া দেখিলেন, চোখে আঁচল দিয়া ভারতী বারান্দার একদিকে নিঃশব্দে সরিয়া যাইতেছে।
শশী কহিল, প্রেসিডেন্ট আপনাকে একবার দেখা করতে বলেছেন। তিনি সুরাবায়ায় চলে যাচ্চেন।
ডাক্তার বিস্ময়ে প্রকাশ করিলেন না, তবু প্রশ্ন করিলেন, কবে যাবেন?
শশী কহিল, বললেন ত শীঘ্রই। তাঁকে লোক এসেছে নিতে।
কথা ভারতীর কানে গেল, সে ফিরিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, সুমিত্রাদিদি কি সত্যিই চলে যাবেন বলেছেন শশীবাবু?
শশী বলিল, হাঁ সত্যি। তাঁর মায়ের খুড়োর অগাধ সম্পত্তি। সম্প্রতি মারা গেছেন,— ইনি ছাড়া উত্তরাধিকারী আর কেউ নেই। তাঁর না গেলেই নয়।
ডাক্তার কহিলেন, না গেলেই যখন নয়, তখন যাবেন বৈ কি।
শশী ভারতীর মুখের প্রতি চাহিয়া বলিল, অনেক খাবার আছে, খাবেন কিছু? কিন্তু ভারতীর ইতস্ততঃ করিবার পূর্বেই ডাক্তার সাগ্রহে বলিয়া উঠিলেন, নিশ্চয় নিশ্চয়,— চল, কি আছে দেখি গে। এই বলিয়া তিনি শশীর হাত ধরিয়া একপ্রকার জোর করিয়া তাহাকে ঘরের ভিতরে টানিয়া লইয়া গেলেন। যাবার পথে শশী আস্তে আস্তে বলিল, আর একটা খবর আছে ডাক্তার, অপূর্ববাবু ফিরে এসেছেন।
ডাক্তার বিস্ময়ে থমকিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, সে কি শশি, কে বললে তোমাকে?
শশী কহিল, কাল বেঙ্গল ব্যাঙ্কে একেবারে মুখোমুখি দেখা। তাঁর মা নাকি বড় পীড়িত।
শুনেছি বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে উদ্দেশ্য ক’রে পথের দাবি রচিত উপন্যাসটি রচিত হয়েছে তার খবর কে রেখেছে বলুন।