পথের দাবী – ১৯

উনিশ

কাল সারারাত্রি ভারতী ঘুমাইতে পায় নাই। দিনের বেলায় তাহার শরীর ও মন দুই-ই খারাপ ছিল, তাই ইচ্ছা করিয়াছিল, আজ একটু সকাল-সকাল খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়া শয্যাগ্রহণ করিবে। এইজন্য সন্ধ্যার প্রাক্কালেই সে রাঁধাবাড়ায় মন দিয়াছিল। এমন সময়ে দলের একজন আসিয়া তাহার হাতে একখানা পত্র দিল। সুমিত্রার লেখা, তিনি একটি ছত্রে শুধু এই বলিয়া আহ্বান করিয়াছেন যে, যে-কোন অবস্থায়, যে-কোন কাজ ফেলিয়া রাখিয়াও সে যেন এই পত্রবাহকের সঙ্গে চলিয়া আসে।

সুমিত্রার আদেশ লঙ্ঘন করিবার জো নাই, কিন্তু ভারতী অত্যন্ত বিস্মিত হইল। জিজ্ঞাসা করিল, তাঁর কি হঠাৎ কোন অসুখ করেছে? উত্তরে পত্রবাহক জানাইল, না। নীচে নামিয়া দেখিল দরজায় দাঁড়াইয়া তাহাদের অত্যন্ত সুপরিচিত ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি, কিন্তু গাড়োয়ান বদল হইয়াছে। ইহাকে দেখিয়া মনে হয় না গাড়ি চালানো ইহার পেশা। তা ছাড়া গাড়ি কেন? সুমিত্রার বাসায় যাইতে ত মিনিট-তিনেকের অধিক সময় লাগে না। অধিকতর বিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, ব্যাপার কি হীরা সিং? সুমিত্রা কোথায়?

এই হীরা সিং লোকটি তাহাদের পথের-দাবীর সভ্য না হইলেও অতিশয় বিশ্বাসী। জাতিতে পাঞ্জাবী শিখ, পূর্বে হংকঙে পুলিশে চাকরি করিত, এখন রেঙ্গুনে টেলিগ্রাফ আফিসে পিয়নের কাজ করে। সে চুপি চুপি কহিল যে, মাইল চার-পাঁচ দূরে অত্যন্ত গোপন এবং অত্যন্ত জরুরি সভা বসিয়াছে, তাঁহার না যাইলেই নয়। ভারতী আর কোন প্রশ্ন না করিয়া সন্ধ্যার অন্ধকারে গাড়ির সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া যাত্রা করিল। এবং হীরা সিং সরকারী পিয়নের পোশাকে সরকারী দু–চাকার গাড়িতে অন্য পথে প্রস্থান করিল। পথে ভারতীর অনেকবার মনে হইল সে গাড়ি ফিরাইয়া তাহার রিভলভার সঙ্গে লইয়া আসে, কিন্তু দেরি হইবার ভয়ে আর ফিরিতে পারিল না, অস্ত্রহীন অরক্ষিতভাবেই তাহাকে অনিশ্চিত স্থানের উদ্দেশে অগ্রসর হইয়া যাইতে হইল। গাড়ি যে অত্যন্ত ঘুর-পথে চলিয়াছে তাহা ভিতরে থাকিয়াও ভারতী বুঝিল, এবং কিছুক্ষণেই পথের অসমতলতা ও অসংস্কৃত দুরবস্থা অনুভব করিয়া বুঝিতে পারিল তাহারা শহর ছাড়াইয়া গেছে, কিন্তু ঠিক কোথায় তাহা জানা কঠিন। সঙ্গে ঘড়ি ছিল না কিন্তু অনুমান রাত্রি দশটার কাছাকাছি গাড়ি গিয়া একটা বাগানে প্রবেশ করিয়া থামিল। হীরা সিং পূর্বেই পৌঁছিয়াছিল, সে গাড়ির দরজা খুলিয়া দিল। মাথার উপরে বড় বড় গাছ মিলিয়া অন্ধকার এমনি দুর্ভেদ্য করিয়াছে যে নিজের হাত পর্যন্ত দেখা যায় না, নীচে দীর্ঘ ও অত্যন্ত ঘন ঘাসের মধ্যে পায়ে-হাঁটা পথের একটা চিহ্নমাত্র আছে, এই ভয়ানক পথে হীরা সিং তাহার দু-চাকার গাড়ির ক্ষুদ্র লণ্ঠনের আলোকে পথ দেখাইয়া আগে আগে চলিতে লাগিল। পথে চলিতে ভারতীর সহস্রবার মনে হইতে লাগিল—সে ভাল করে নাই, ভাল করে নাই। এই ভীষণ স্থানে আসিয়া সে ভাল করে নাই। অনতিকাল পরে তাহারা একটা জীর্ণ ভগ্ন অট্টালিকায় আসিয়া পৌঁছিল, অন্ধকারে তাহার আভাসমাত্র দেখিয়াই ভারতী বুঝিল ইহা বহুদিন-পরিত্যক্ত একটা চাউঙ্‌। কোন্‌ সুদূর অতীতে বৌদ্ধ-শ্রমণগণ এখানে বাস করিতেন সম্ভবতঃ, কোথাও একটা লোকালয় পর্যন্ত ইহার কাছাকাছি নাই।

এতবড় ভাঙ্গা বাড়ি, এতটুকু আলো নাই, মানুষ নাই, মানুষের চিহ্ন পর্যন্ত লুপ্ত হইয়াছে—দরজা-জানালা চোরে চুরি করিয়া লইয়া গেছে,—সুমুখের ঘরে ঢুকিতেই বাদুড় ও চামচিকার ভয়ানক গন্ধে ভারতীর দম আটকাইয়া আসিল,—তাহারই মধ্যে দিয়া পথ, বোধ করি কত যে বিষধর সর্প তথায় আশ্রয় লইয়া আছে তাহার ইয়ত্তা নাই।
মস্ত হল-ঘরের এককোণে উপরে উঠিবার সিঁড়ি। কাঠের সিঁড়ির মাঝে মাঝে কাঠ নাই, এই দিয়া ভারতী হীরার হাত ধরিয়া দ্বিতলে উঠিয়া সুমুখের বারান্দা পার হইয়া এতক্ষণে এত দুঃখের পরে নির্দিষ্ট স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। ঘরের মধ্যে চাটাই পাতা, একধারে গোটা-দুই মোমবাতি জ্বলিতেছে, এবং তাহারই পার্শ্বে সভানেত্রীর আসনে বসিয়া সুমিত্রা। অপর প্রান্তে ডাক্তার বসিয়া ছিলেন, তিনিই সস্নেহ-কণ্ঠে ডাকিয়া কহিলেন, এস ভারতী, আমার কাছে এসে ব’স।

অজানা শঙ্কায় ভারতীর বুকের মধ্যে গুরগুর করিয়া উঠিল, মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না, কিন্তু একটুখানি যেন দ্রুতপদেই সে কাছে গিয়া ডাক্তারের বুক ঘেঁষিয়া বসিয়া পড়িল। তাহার কাঁধের উপর বাঁ হাতখানি রাখিয়া যেন তিনি নিঃশব্দে তাহাকে ভরসা দিলেন। হীরা সিং ঘরে ঢুকিল না; দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল। ভারতী চাহিয়া দেখিল, যাহারা বসিয়া আছে পাঁচ-ছয়জনকে সে একেবারেই চেনে না। পরিচিতের মধ্যে ডাক্তার ও সুমিত্রা ব্যতীত রামদাস তলওয়ারকর ও কৃষ্ণ আইয়ার। একজন ভীষণাকৃতি লোককে সর্বাগ্রেই চোখে পড়ে—পরনে তাহার গেরুয়া রঙের আলখাল্লা এবং মাথায় সুবৃহৎ পাগড়ি। মুখখানা বড় হাঁড়ির মত গোলাকার এবং দেহ গণ্ডারের মত স্থূল, মাংসল ও কর্কশ। ভাঁটার মত চোখের উপর ভ্রূর চিহ্নমাত্র নাই, কঠিন শলার মত গোঁফের রোম বোধ করি দূর হইতে গণিয়া বলা যায়, রঙ তামার মত, লোকটা যে অনার্য মোঙ্গল-জাতীয় দৃষ্টিপাতমাত্র তাহাতে সংশয় থাকে না। এই বীভৎস ভয়ানক লোকটার প্রতি ভারতী চোখ তুলিয়া চাহিতেই পারিল না। মিনিট-দুই সমস্ত ঘরটা একেবারে স্তব্ধ হইয়া রহিল, তখন সুমিত্রা ডাকিয়া কহিলেন, ভারতী, তোমার মনের ভাব আমি জানি, তাই তোমাকে ডেকে এনে দুঃখ দেবার আমার ইচ্ছাই ছিল না, কিন্তু ডাক্তার কিছুতেই হতে দিলেন না। অপূর্ববাবু কি করেছেন জানো?

ভারতীর নিভৃত হৃদয়ে এমনিই কি যেন একটা তাহাকে সারাদিন ধরিয়া বলিতেছিল। তাহার কণ্ঠ শুষ্ক ও মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল, শুধু সে নীরবে ফ্যালফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল।

সুমিত্রা কহিলেন, বোথা কোম্পানী রামদাসকে আজ ডিস্‌মিস্‌ করেছে। অপূর্বরও সেই দশা হতো শুধু পুলিশ কমিশনারের কাছে আমাদের সমস্ত কথা অকপটে ব্যক্ত করেই তাঁর চাকরিটা বেঁচেছে। মাইনে ত কম নয়, বোধ হয় পাঁচ শ।

রামদাস ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ।

সুমিত্রা কহিলেন, শুধু এই নয়। পথের-দাবী যে বিদ্রোহীর দল, এবং আমরা যে লুকিয়ে পিস্তল রিভলভার রাখি সে সংবাদও তিনি গোপন করেন নি। এর শাস্তি কি ভারতী?

সেই ভীষণাকৃতি লোকটা গর্জন করিয়া উঠিল, ডেথ্‌!

এতক্ষণে ভারতী নির্নিমেষ দুই চক্ষু তাহার মুখের প্রতি তুলিয়া স্থির হইয়া রহিল।

রামদাস কহিল, সব্যসাচীই যে ডাক্তার এ খবর তারা জানে। হোটেলের ঘরের মধ্যেই তাঁকে ধরা যেতে পারে অপূর্ববাবু এ কথা জানাতেও ত্রুটি করেন নি। এমন কি, আমি ইতিপূর্বে যে পোলিটিক্যাল অপরাধে বছর-দুই জেল খেটেছি,—তাও।

সুমিত্রা কহিলেন, ভারতী, ডাক্তার ধরা পড়লে তার ফল কি জানো? ফাঁসি। তা যদি না হয়, ট্রান্সপোর্টেশন্‌! জেন্টেলমেন্‌! এ অপরাধের কি শাস্তি আপনারা অনুমোদন করেন?

সকলে সমস্বরে কহিল, ডেথ্‌!

ভারতী তোমার কিছু বলবার আছে?

ভারতী কথা কহিতে পারিল না, শুধু মাথা নাড়িয়া জানাইল তাহার বলিবার কিছু নাই।

সেই ভয়ঙ্কর লোকটা এবার বাংলায় কথা কহিল।
উচ্চারণ শুনিয়া বুঝা গেল সে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মগ। বলিল, এক্‌সিকিউশনের ভার আমি নিলাম। আমি কিন্তু গুলিগোলা, ছুরি-ছোরা বুঝিনে। এই আমার গুলি এবং এই আমার গোলা! এই বলিয়া সে বাঘের মত দুই থাবা মুঠা করিয়া শূন্যে উত্থিত করিল।

কৃষ্ণ আইয়ার দ্বারের দিকে চাহিয়া হীরা সিংকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন, বাগানের উত্তর কোণে একটা শুকনো কুয়া আছে—একটু বেশী মাটি চাপা দিয়ে কিছু শুকনো ডালপালা ফেলে দেওয়া চাই। গন্ধ না বার হয়।

হীরা সিং মাথা নাড়িয়া জানাইল যে, কোনরূপ ত্রুটি হইবে না।

তলওয়ারকর কহিল, বাবুজীকে তাঁর দণ্ডাজ্ঞা শুনিয়ে দেওয়া হোক।

সমবেত জুরির সাহায্যে অপূর্বর অপরাধের বিচার মিনিট-পাঁচেকের মধ্যেই সমাধা হইয়া গেল। বিচারকের রায় যেমন সংক্ষিপ্ত তেমনি স্পষ্ট। না বুঝিবার মত জটিলতা কোথাও নাই। ভারতী সমস্তই শুনিল, কিন্তু তাহার কান ও বুদ্ধির মাঝখানে কোথায় একটা দুর্ভেদ্য প্রাকার দাঁড়াইয়া ছিল, বাহিরের বস্তু যেন কিছুতেই সেটা ভেদ করিয়া আর ভিতরে পৌঁছাইতে পারিতেছিল না। তাই, গোড়া হইতে শেষ পর্যন্ত যে-কেহ কথা কহিতেছিল তাহারই মুখের প্রতি ভারতী ব্যাকুল জিজ্ঞাসু চোখে নির্বোধের মত চাহিয়া দেখিতেছিল। এইটুকু মাত্র সে হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিল, অপূর্ব গুরুতর অপরাধ করিয়াছে, এবং এই লোকগুলি তাহাকে বধ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছে। এদেশে জীবন তাহার সঙ্কটাপন্ন। কিন্তু এ সঙ্কট যে কিরূপ আসন্ন হইয়াছে, সে তাহার কিছুই বুঝে নাই। সুমিত্রার ইঙ্গিতে একজন উঠিয়া বাহির হইয়া গেল এবং মিনিট-দুই পরে যে দৃশ্য ভারতীর চোখে পড়িল তাহা অতি-বড় দুঃস্বপ্নেরও অতীত। সেই লোকটা অপূর্বকে লইয়া ঘরে ঢুকিল। তাহার দুই হাত পিঠের দিকে শক্ত করিয়া দড়ি দিয়া বাঁধা, এবং কোমর হইতে মস্ত ভারী একখণ্ড পাথর ঝুলিতেছে। মুহূর্তের জন্য চৈতন্য হারাইয়া ভারতী ডাক্তারের দেহের উপর ঢলিয়া পড়িল। কিন্তু সকলের দৃষ্টি তখন অপূর্বর প্রতি নিবদ্ধ ছিল বলিয়াই শুধু একজন ভিন্ন এ খবর আর কেহ জানিতে পারিল না।

ভারতী এখানে আসিবার পূর্বেই অপূর্বর এজাহার লওয়া শেষ হইয়া গিয়াছিল। সে অস্বীকার কিছুই করে নাই। আফিসের বড়সাহেব ও পুলিশের বড়সাহেব, এই দুই সাহেবে মিলিয়া তাহার নিকট হইতে সমস্ত তথ্যই জানিয়া লইয়াছে তাহা সে বলিয়াছে, কিন্তু কিসের জন্য যে দলের এবং দেশের এতবড় শত্রুতা সাধন করিল, তাহা সে এখনও জানে না।

আজ বেলা বারোটার মধ্যেই রামদাস এ সংবাদ সুমিত্রার কর্ণগোচর করে। দণ্ড স্থির হইয়া যায়, এবং যে উপায়ে অপূর্বকে হস্তগত করা হইয়াছে তাহা সংক্ষেপে এইরূপ—

আফিসের ছুটির পরে আজ অপূর্ব হাঁটিয়া বাসায় যাইতে সাহস করিবে না তাহা নিশ্চয় অনুমান করিয়া তাহাদের ভাড়াটে গাড়িখানা হীরার সাহায্যে আফিসের গেটের কাছে রাখা হয়। এই ফাঁদে অপূর্ব সহজেই পা দেয়। কিছুদূর আসিয়া গাড়োয়ান জানায় যে, মস্ত একটা রোলার ভাঙ্গিয়া গলির মোড় বন্ধ হইয়া আছে, ঘুরিয়া যাইতে হইবে। অপূর্ব স্বীকার করে। ইহার পরেই বোধ হয় সে অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু ঘণ্টা-খানেক পরে যখন চৈতন্য হয়, তখন হীরা সিং গাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া পিস্তল দেখাইয়া তাহাকে অনায়াসে এখানে লইয়া আসে।

সুমিত্রা ডাকিয়া কহিলেন, অপূর্ববাবু, আমরা আপনাকে ডেথ্‌ সেন্‌টেন্স দিলাম। আর কিছু আপনার বলার আছে?

অপূর্ব ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না। কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া মনে হইল সে কিছুই বুঝে নাই।
ডাক্তার এতক্ষণ কোন কথায় প্রায় বলেন নাই, পিছনে চাহিয়া কহিলেন, হীরা, তোমার পিস্তলটা কৈ?

হীরা সিং ইঙ্গিতে সুমিত্রাকে দেখাইয়া দিল, ডাক্তার হাত বাড়াইয়া বলিলেন, পিস্তলটা দেখি সুমিত্রা!

সুমিত্রা বেল্ট হইতে খুলিয়া ডাক্তারের হাতে দিলেন। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করিলেন, আর কারও কাছে পিস্তল কিংবা রিভলভার আছে?

আর কাহারও কাছে ছিল না তাহা সকলেই জানাইল। তখন সুমিত্রার পিস্তল নিজের পকেটের মধ্যে রাখিয়া ডাক্তার একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, সুমিত্রা, তুমি বললে ডেথ্‌ সেন্‌টেন্স আমরা দিলাম। কিন্তু ভারতী ত দেয়নি!

সুমিত্রা একমুহূর্ত ভারতীর মুখের প্রতি চাহিয়া দৃঢ়কণ্ঠে কহিলেন, ভারতী দিতে পারে না।

ডাক্তার বলিলেন, পারা উচিতও নয়। তাই না ভারতী?

ভারতী কথা কহিল না, এই কঠিনতম প্রশ্নের উত্তরে সে শুধু উপুড় হইয়া পড়িয়া ডাক্তারের ক্রোড়ের মধ্যে মুখ লুকাইল।

ডাক্তার তাহার মাথার উপর একটা হাত রাখিয়া কহিলেন, অপূর্ববাবু যা করে ফেলেছেন সে আর ফিরবে না—তার ফলাফল আমাদের নিতেই হবে। শাস্তি দিলেও হবে, না দিলেও হবে। কিন্তু আমি বলি তাতে কাজ নেই—ভারতী এঁর ভার নিন। এই দুর্বল মানুষটিকে একটু মজবুত করে গড়ে তুলুন। কি বল সুমিত্রা?

সুমিত্রা কহিলেন, না।

সকলে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, না।

সেই কুদর্শন লোকটাই সর্বাপেক্ষা অধিক আস্ফালন করিল। সে তাহার থাবা-যুগল শূন্যে তুলিয়া ভারতীকে ইঙ্গিত করিয়াই কি একটা বলিয়া ফেলিল।

সুমিত্রা কঠিনকণ্ঠে কহিলেন, আমরা সকলে একমত। এতবড় অন্যায় প্রশ্রয়ে আমাদের সমস্ত ভেঙ্গে-চুরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে।

ডাক্তার বলিলেন, যদি যায় ত উপায় কি?

সুমিত্রার সঙ্গে সঙ্গেই পাঁচ-সাতজন গর্জিয়া উঠিল, উপায় কি? দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, আমরা কিছুই মানবো না। আপনার একার কথায় কিছুই হতে পারবে না।

গর্জন থামিলে ডাক্তার উত্তর দিলেন। এবার তাঁহার কণ্ঠস্বর আশ্চর্য রকমের শান্ত ও মৃদু শুনাইল। তাহাতে উৎসাহ বা উত্তেজনার বাষ্পও ছিল না, বলিলেন, সুমিত্রা, বিদ্রোহে প্রশ্রয় দিয়ো না। তোমরা ত জানো, আমার একার মত তোমাদের এক শ’ জনের চেয়েও বেশী কঠিন। সেই ভয়ঙ্কর লোকটাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ব্রজেন্দ্র তোমার ঔদ্ধত্যের জন্য বাটাভিয়াতে একবার আমাকে তুমি শাস্তি দিতে বাধ্য করেছিলে। দ্বিতীয়বার বাধ্য করো না।

ভারতী মুখ তুলে নাই, তখনও তেমনি পড়িয়া ছিল। কিন্তু তাহার সর্বদেহ থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। পিঠের উপর স্নেহস্পর্শ বুলাইয়া তেমনি সহজ গলায় কহিলেন, ভয় নেই ভারতী, অপূর্বকে আমি অভয় দিলাম।

ভারতী মুখ তুলিল না, ভরসাও পাইল না। তাঁহার দক্ষিণ হস্তের সুদীর্ঘ সরু সরু আঙুলগুলা নিজের মুঠার মধ্যে টানিয়া লইয়া চুপি চুপি বলিল, কিন্তু ওঁরা ত অভয় দিলেন না।

ডাক্তার কহিলেন, সহজে দেবেও না। কিন্তু এ কথা ওরা বোঝে যে, আমি যাকে অভয় দিলাম, তাকে স্পর্শ করা যায় না। একটু হাসিয়া বলিলেন, ভাল খেতে পাইনে ভারতী, আধপেটা খেয়েই প্রায় দিন কাটে,—তবুও ওরা জানে এই ক’টা সরু আঙুলের চাপে আজও ব্রজেন্দ্রের অতবড় বাঘের থাবা গুঁড়ো হয়ে যাবে! কি বল ব্রজেন্দ্র?

চট্টগ্রামী মগ মুখ কালো করিয়া নীরব হইয়া রহিল। ডাক্তার কহিলেন, কিন্তু অপূর্ব যেন না আর এখানে থাকে। ও দেশে যাক। অপূর্ব ট্রেটর নয়, স্বদেশকে ও সমস্ত হৃদয় দিয়েই ভালবাসে, কিন্তু অধিকাংশ,—থাক, স্বজাতির নিন্দা আর করব না,—কিন্তু বড় দুর্বল। ওকে মজবুত করবার ভার তোমাকে দিলাম সত্য, কিন্তু আমার ভরসা নেই ভারতী। বাড়ি ফিরে গিয়ে ওর আজকের কথা, তোমার কথা, কোনটা ভুলতেই বেশী সময় লাগবে না। যাক সে পরের কথা।
আপাততঃ, আমরা সভানেত্রীকে অনুরোধ করতে পারি আজকের মত সভা ভঙ্গ করা হোক। এই বলিয়া তিনি সুমিত্রার প্রতি চাহিলেন।

সুমিত্রা তাঁহাকে কখনো তুমি, কখনো আপনি বলিয়া সসম্মানে কথা কহিত, এখন সেইভাবেই কহিল, অধিকাংশের মত যেখানে ব্যক্তিবিশেষের গায়ের জোরে পরাভূত হয়, তাকে আর যাই বলুক সভা বলে না। কিন্তু এই নাটক অভিনয় করাবারই যদি আপনার সঙ্কল্প ছিল পূর্বাহ্ণে জানান নি কেন?

ডাক্তার কহিলেন, না হলেই ছিল ভাল, কিন্তু অবস্থাবিশেষে নাটক যদি হয়েও থাকে সুমিত্রা, অভিনয়টা যে ভাল হয়েছে তা তোমাদের স্বীকার করতে হবে।

রামদাস কহিল, এরকম যে হতে পারে আমার ধারণা ছিল না।

ডাক্তার বলিলেন, বন্ধুত্ব জিনিসটা যে এমনি ক্ষণভঙ্গুর সে ধারণাই কি তোমার ছিল তলওয়ারকর? অথচ, এমন সত্যও জগতে দুর্লভ।

কৃষ্ণ আইয়ার কহিল, বর্মার এ্যাক্‌টিভিটি আমাদের উঠলো। এখন পালাতে হবে।

ডাক্তার বলিলেন, হবে। কিন্তু সময়মত স্থান ত্যাগ করা এবং এ্যাক্‌টিভিটি ত্যাগ করা এক বস্তু নয় আইয়ার। দীর্ঘকাল কোথাও নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে যদি না পাই, তার জন্যে নালিশ করা আমাদের সাজে না। এই বলিয়া তিনি ভারতীকে ইঙ্গিত করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন, হীরা সিং, অপূর্ববাবুর বাঁধন খুলে দাও, চল ভারতী, তোমাদের একটু নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে আসি।

হীরা সিং আদেশ পালন করিতে অগ্রসর হইলে সুমিত্রা কঠিনকণ্ঠে কহিলেন, অভিনয়ের শেষ অঙ্কে আনন্দে হাততালি দিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এ নতুন নয়। ছেলেবেলায় কোথায় একটা উপন্যাসে যেন পড়েছিলাম। কিন্তু একটুখানি যেন বাদ রইল। যুগল-মিলন আমাদের সম্মুখে হয়ে গেলে অভিনয়ে আর কোথাও খুঁত থাকতো না। কি বল ভারতী?

ভারতী লজ্জায় মরিয়া গেল। ডাক্তার কহিলেন, লজ্জা পাবার এতে কিছুই নেই ভারতী। বরঞ্চ আমি কামনা করি অভিনয় সমাপ্ত করবার মালিক যিনি তিনি যেন একদিন কোথাও এর খুঁত না রাখেন। পকেট হইতে সুমিত্রার পিস্তলটা বাহির করিয়া তাহার কাছে রাখিয়া দিয়া বলিলেন, আমি এদের পৌঁছে দিতে চললাম, কিন্তু ভয় নেই, আমার কাছে আর একটা গাদা পিস্তল রইল। ব্রজেন্দ্রের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া সহাস্যে কহিলেন, তোমরা ত সবাই তামাশা করে বলতে, অন্ধকারে আমি প্যাঁচার মত দেখতে পাই—আজ যেন কেউ সে কথা ভুলো না। এই বলিয়া তিনি একটা প্রচ্ছন্ন ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত করিয়া ভারতী ও অপূর্বকে লইয়া বাহির হইতে উদ্যত হইলেন।

সুমিত্রা অকস্মাৎ দাঁড়াইয়া উঠিয়া কহিলেন, ফাঁসির দড়িটা কি নিজের হাতে গলায় না পরলেই হত না ?

ডাক্তার হাসিয়া কহিলেন, সামান্য একটা দড়িকে ভয় করলে চলবে কেন সুমিত্রা?

কোন একটা কার্যের পূর্বে এই মানুষটিকে মৃত্যুর ভয় দেখাইতে যাওয়া যে কত বড় বাহুল্য ব্যাপার তা স্মরণ করিয়া সুমিত্রা নিজেই লজ্জিত হইল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ ব্যাকুলকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, সমস্ত ত ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, কিন্তু আবার কখন দেখা হবে ?
ডাক্তার বলিলেন, প্রয়োজন হলেই হবে।

সে প্রয়োজন কি হয়নি ?

হয়ে থাকলে নিশ্চয়ই দেখা হবে। এই বলিয়া তিনি অপূর্ব-ভারতীকে সঙ্গে করিয়া সাবধানে নীচে নামিয়া গেলেন।

যে গাড়ি ভারতীকে আনিয়াছিল তাহা অপেক্ষা করিতেছিল। সুনিদ্রা হইতে গাড়োয়ান প্রভুকে তুলিয়া ইহাতেই তিনজনে যাত্রা করিলেন। বহুক্ষণের নীরবতা ভঙ্গ করিয়া এইবার ভারতী কথা কহিল। জিজ্ঞাসা করিল, দাদা, আমরা কোথায় যাচ্চি?

অপূর্ববাবুর বাসায়,—এই বলিয়া ডাক্তার গাড়ি হইতে মুখ বাড়াইয়া অন্ধকারে যতদূর দৃষ্টি যায় দেখিয়া লইয়া স্থির হইয়া বসিলেন। মাইল-দুই নিঃশব্দে চলার পরে গাড়ি থামাইয়া ডাক্তার নামিতে উদ্যত হইলে ভারতী আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, এখানে কেন?

ডাক্তার বলিলেন, এইবার ফিরি। ওঁরা অপেক্ষা করে আছেন, একটা বোঝাপড়া হওয়া ত চাই!

বোঝাপড়া? ভারতী আকুল হইয়া তাঁহার হাত চাপিয়া ধরিয়া কহিল, সে কিছুতেই হতে পারবে না। তুমি সঙ্গে চল। কিন্তু কথাটা উচ্চারণ করিয়া সে সুমিত্রার মতই অপ্রতিভ হইল। কারণ, ইঁহার বলা মানেই স্থির করিয়া বলা। এবং সংসারের কোন ভয়ই তাঁহাকে নিরস্ত করিতে পারিবে না। তথাপি ভারতী হাত ছাড়িয়াও দিল না, ধীরে ধীরে কহিল, কিন্তু তোমাকে যে আমার বড় দরকার দাদা!

সে আমি জানি। অপূর্ববাবু, আপনি কি পরশুর জাহাজে বাড়ি যেতে পারবেন না?

অপূর্ব কহিল, পারবো।

ভারতী হঠাৎ অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া উঠিল, কহিল, দাদা, এখনই আমাকে বাসায় যেতে হবে।

ডাক্তার ঘাড় নাড়িয়া জবাব দিলেন, না। তোমার কাগজপত্র, তোমার পথের-দাবীর খাতা, তোমার পিস্তল-টোটা সমস্তই এতক্ষণে নবতারা সরিয়ে নিয়ে গেছে। ভোর নাগাদ খানাতল্লাশী হবে, -আর্টিস্ট স্বয়ং সশরীরে,—তার ধেনো-মদের বোতল, আর তার সেই ভাঙ্গা বেহালাখানা—অপূর্ববাবু, আপনার সে বেহালাটার ওপর একটু দাবী আছে, না? এই বলিয়া একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, এ ছাড়া ভয়ানক কিছু আর পুলিশ সাহেবের হাতে পড়বে না। কাল নটা-দশটা আন্দাজ বাসায় ফিরে রাঁধাবাড়া খাওয়া-দাওয়া সেরে বোধ করি একটুখানি ঘুম দেবারও সময় পাবে ভারতী। রাত্রি দুটো-তিনটে নাগাদ দেখা পাবে—কিছু খাবার-দাবার রেখো।

ভারতী অবাক হইয়া রহিল। মনে মনে বলিল, এমন একান্ত সজাগ না হইলে কি এই মরণ-যজ্ঞে কেহ সঙ্গে আসিতে চাহিত? মুখে কহিল, তোমার চোখে কিছু এড়ায় না, তুমি সকলের ভাল-মন্দই চিন্তা কর। সংসারে আমার আপনার কেউ নেই, তোমার পথের-দাবী থেকে আমাকে বিদায় দিও না দাদা।

অন্ধকারের মধ্যেই ডাক্তার বারংবার মাথা নাড়িয়া কহিলেন, ভগবানের কাজ থেকে বিদায় দেবার অধিকার কারও নেই, কিন্তু এর ধারা তোমাকে বদলে নিতে হবে।

ভারতী কহিল, তুমিই বদলে দিয়ো।

ডাক্তার এ প্রশ্নের উত্তর দিলেন না, সহসা ব্যগ্র হইয়া বলিলেন, ভারতী, আর আমার সময় নেই, আমি চললাম। এই বলিয়া অন্ধকার পথে মুহূর্তে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *