পথের কাঁটা – ৫

সোমবার সকাল আটটার সময় কৌশিককে ফোন করল জয়দীপ। ছেলেটা খুবই তুখোড়। গোয়েন্দাগিরির কাজটা সে ভালই করছে। তার খবর—গতকাল রাত নয়টার সময় মহেন্দ্র পার্ক হোটেলে এসেছিল। আটত্রিশ নম্বর ঘরে রুদ্ধদ্বার কক্ষে ষড়যন্ত্রকারীরা কী আলোচনা করেছে তা সে জানে না; কিন্তু রাত দশটা দশে মহেন্দ্র হোটেল ছেড়ে চলে যায়। য়ু সিয়াঙ তখন নিচের ডাইনিং রুমে গিয়ে নৈশ আহার সারে। আহারান্তে য়ু সিয়াঙ নিজের ঘরে ফিরে আসে, মালপত্র বেঁধে-ছেঁদে চেক-আউট করে বেরিয়ে যায়!

কৌশিক টেলিফোনে বলেছিল, সে কী! ওকে এত বড় ক’লকাতা শহরে বেপাত্তা হতে দিলেন?

জয়দীপ বলল, আমি অত কাঁচা ছেলে নই। ও যদি ট্যাক্সি নিত তবে ওকে ফলো করতাম; কিন্তু লোকটা ট্যাক্সি ডাকেনি—হোটেলের গাড়িটাই ব্যবহার করেছিল। তাই সামান্য কিছু খরচ করে সহজে জানতে পেরে গেলাম ওকে কোথায় পৌঁছে দিয়ে এল গাড়িটা।

—কোথায় গেল ও?

—আমার থেকে বর্তমানে ফুট আষ্টেক দূরে য়ু সিয়াঙ রয়েছে।

—সে কী! কোথা থেকে ফোন করছেন আপনি?

—দমদম থেকে। ভি. আই. পি. হোটেলের একুশ নম্বর ঘর থেকে। য়ু সিয়াঙ আছে বাইশ নম্বরে। আমিও আজ সকালে পার্ক হোটেল থেকে চেক-আউট করে চলে এসেছি। এবার ঘটনাচক্রে ওর ঠিক পাশের ঘরটাই পেয়েছি।

কৌশিক বলে, আমার মনে হয় মহেন্দ্র ওকে শাসিয়েছে কাল রাত্রে বিদেশে বিভুই-এ য়ু সিয়াঙ বোধহয় একটু ঘাবড়ে গেছে। ক’লকাতা শহরের খুব একটা সুনামও তো নেই বাইরের দুনিয়ায়। তাই রাতারাতি হোটেল বদলে একেবারে দমদমে গিয়ে উঠেছে। যাতে তেমন তেমন অবস্থা হলে সুট করে প্লেনে চেপে বসতে পারে।

জয়দীপ বলল, আমার কিন্তু মনে হয়, লোকটা সহজে পালাবে না। তাহলে এত খরচ করে বর্মা থেকে সে আদৌ আসত না।

—দেখা যাক।

বেলা বারোটা নাগাদ ফোন করল নীলিমা। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতেও শান্তি নেই। কাল বিকালে বাসুসাহেব ঐ যে নাটকীয় ভঙ্গিতে ‘অ্যাটেম্‌প্ট টু মার্ডার’ কথাটা শুনিয়ে এলেন তারপর থেকেই জগদানন্দ কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়েছেন। কাল রাত্রে ওঁর একেবারে ঘুম হয়নি। আজ সকালে আলমারি খুলে ওঁর একটা পুরোনো দিনের হাতিয়ার বার করেছেন। বর্মায় থাকতে শখ করে কিনেছিলেন। গজদন্তের মুঠওয়ালা একটা শৌখিক ছোরা। দেখতে শৌখিন, কাজে দড়—ব্লেডটা তীক্ষ্ণ, আট ইঞ্চি লম্বা। সেটা আর আলমারিতে তোলেননি—বালিশের নিচে রেখে দিয়েছেন। এ-ছাড়া আজ সকালে যোগানন্দবাবুর সঙ্গে তাঁর কী সব কথাবার্তা হয়েছে রুদ্ধদ্বার কক্ষে।

—যোগানন্দবাবুটা কে?—জানতে চেয়েছিল কৌশিক।

নীলিমা বুঝিয়ে দিয়েছিল, যোগানন্দ হচ্ছেন সম্পর্কে ওর ছোট কাকা অর্থাৎ জগদানন্দের ভাইপো–সেই যাঁকে তিনি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছেন উইলে। যোগানন্দ নির্বিরোধী মানুষ। বিপত্নীক—ছেলে-মেয়েও নেই। থাকার মধ্যে আছে যোগানন্দের এক শ্যালিকা-পুত্র-শ্যামল রায়। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স। সেও অবিবাহিত। একটা সওদাগরি অফিসে চাকরি করে। ঐ বাড়িতেই থাকে। উপসংহারে নীলিমা বলল, দাদু আপনাকে একবার সন্ধ্যাবেলা দেখা করতে বলেছেন।

—কেন?

-–কেন, তা বলেননি। তিনি মনে করেন, আমি নাবালিকা। এসব আলোচনায় আমার না থাকাই ভাল।

—কথাটা তো ঠিকই; কুমারী মেয়ে মাত্রেই বাঙালি পরিবারে নাবালিকা-

—তাই বুঝি? বয়সে কিন্তু আমি বোধহয় আপনার চেয়ে বড়।

—হতেই পারে না। কোনো অবিবাহিত মেয়ে আমার চেয়ে বয়সে বড়, এটা আমি কখনই মেনে নিতে পারি না!

বিকাল পাঁচটা নাগাদ কৌশিক গিয়ে হাজিরা দিয়েছিল। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িটায় ঢুকবার মুখে দেখা হয়ে গেল জয়দীপের সঙ্গে। কৌশিক বললে, এ কী! আপনি এখানে? দমদমের চিড়িয়া?

—ভয় নেই, চিড়িয়া আপনার ভাগেনি। শহর দেখতে বেরিয়েছেন।

জয়দীপ কাজের ছেলে। সে খবর রাখে য়ু সিয়াঙে আজ সকালে একটি টুরিস্ট বাসে সারাদিনের জন্য ক’লকাতা শহর দেখতে বেরিয়েছেন। বিকাল সাড়ে পাঁচটায় টুরিস্ট বাসটা ফিরে আসরে এসপ্ল্যান্ডে ইস্টে। জয়দীপ এখন সেখানেই যাচ্ছে। বাস থেকে নামামাত্র সে হারানো সুতোর খেই ফিরে পাবে এবং তারপর আবার আঠার মতো সেঁটে থাকবে তার পিছনে।

কৌশিক বললে, নতুন কোনও খবর নেই?

—কিছু না। লোকটা একাই ছিল ঘরে। কোনো ভিজিটার আসেনি, কোনও টেলিফোনও নয়। আমি ওর মুভমেন্ট সমস্ত লিখে যাচ্ছি আমার ডায়েরিতে।

জয়দীপ ঘড়ি দেখল। বললে, সময় হয়ে গেছে, আমি চলি।

কৌশিক বলে, চিড়িয়া দমদমে ফিরে গেলে ওখান থেকে আমাকে একটা ফোন করে জানাবেন।

—জানাব।

জয়দীপ চলে গেল। কৌশিককে নিয়ে নীলিমা দ্বিতলে উঠে এল। গৃহস্বামী বললেন, কালকে বাসু-সাহেব ঐ কথাটা বলার পর থেকেই আমার মনটা চঞ্চল হয়েছে। উনি ঠিকই বলেছেন,—ঐ মহেন্দ্র আর বিশ্বন্তর না পারে এমন কাজ নেই। অথচ ওদের এখন তাড়াতেও পারছি না। মহেন্দ্র বলেছে, উইলটা রেজিস্ট্রি হয়ে গেলে ওরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে এবং আমার জীবদ্দশায় আর বিরক্ত করতে আসবে না। জানি না, সে তার কথা রাখবে কি না; কিন্তু ঐ য়ু সিয়াঙ এসে পড়ায় অবস্থাটা আবার গুলিয়ে গেছে।

—য়ু সিয়াঙ-এর সঙ্গে আপনি কি পৃথকভাবে বোঝাপড়া করতে চান?

—এখনও মনস্থির করতে পারিনি। যোগানন্দ সেই পরামর্শই দিচ্ছিল।

—যোগানন্দবাবু! তিনি কি সব কথা জানেন?

—এখন তো দেখছি, জানে। অদ্ভুত ভাল ছেলেটা, জানলে

জগদানন্দের কথা থেকে বোঝা গেল নির্বিরোধী মানুষ যোগানন্দ বহুদিন আগে থেকেই এ গোপন রহস্যের সন্ধান রাখেন। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে এটা জানেন, দ্বিতীয় কারও সঙ্গে আলোচনা করেননি—এমনকি জগদানন্দের সঙ্গেও নয়। কী দরকার ওসব গ্লানিকর প্রসঙ্গ আলোচনা করার?—ভাবটা এই। তারপর মহেন্দ্রর আগমন, উইল প্ৰণয়ন সব কিছুরই খবর উনি রাখেন। একতলার ঘরটিতে বসে আপন মনে হুঁকো টানেন আর চতুর্দিকে নজর রাখেন। কাল বিকালে স্যুট-বুট পরা যে ভদ্রলোকটি এসেছিলেন তাঁকে ইতিপূর্বে কখনও দেখেননি যোগানন্দ। তবে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন লোকটা কে। আজ সকালে তিনি দ্বিতলে উঠে এসে জগদানন্দকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, কাকা কাল বিকেলে যে ভদ্রলোক এসেছিলেন তিনিই কি আপনার সেই রেঙ্গুনের ম্যানেজার য়ু সিয়াঙ?

জগদানন্দ চমকে উঠে বলেছিলেন, তুমি কেমন করে জানলে?

—আন্দাজ করছি। আমি একটা কথা বলতে এসেছি কাকা—

—বল। বস ঐ চেয়ারটায়।

যোগানন্দ বসেননি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, এবার নীলুর বিয়েটা আপনি দিয়ে দিন। শ্যামলের সঙ্গে নয়, ঐ জয়দীপ ছেলেটির সঙ্গেই। ওরা দুজনেই দুজনকে—

মাঝপথে থেমে গিয়েছিলেন যোগানন্দ। বৃদ্ধ বলেছিলেন, কিন্তু তুমি তো এতদিন তোমার শালিকাপুত্র ঐ শ্যামলের সঙ্গেই নীলুর বিয়ে দিতে চাইতে। আজ হঠাৎ তোমার মত বদলালো কেন?

—শ্যামল ছেলেটা সত্যই ভালো। কিন্তু দিনকাল পালটে গেছে। এখন আর বাপ-মা-কাকা-জেঠাদের পছন্দ অনুসারে ছেলেমেয়েরা বিয়ে করে না। জয়দীপ আর নীলিমা যখন পরস্পরকে—

এবারও সঙ্কোচে থেমে গিয়েছিলেন উনি

জগদানন্দ বলেন, ঠিক আছে। তোমার কথাটা মনে রাখব। আপাতত একটা ঝামেলায় পড়েছি, সেটা মিটুক।

—সে সম্বন্ধেও আমার কিছু বক্তব্য আছে। আমারও বয়স ষাটের কোঠায়। একা মানুষ, কতদিনই বা বাঁচব? আপনি কেন শুধু শুধু আমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে যাচ্ছেন, কাকা?

জগদানন্দ অবাক হয়ে যান। কী বলবেন ভেবে পান না।

—তার চেয়ে ঐ পঞ্চাশ হাজারের ভিতর থেকে বিশ-পঁচিশ হাজার দিয়ে য়ু সিয়াঙ-এর সঙ্গে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলুন।

জগদানন্দ চমকে উঠে বলেন, তার মানে? কী মেটাব?

মাথা নিচু করে যোগানন্দ বলেন, কাকা, এ বাড়িতে আপনার ছেলের মতই মানুষ হয়েছি। আমি তো সবই জানি। আপনি আমাকে যা দিয়ে যাবেন, আমি মরে গেলে ঐ নীলুই আবার তা পাবে। অথচ আজ যদি সব জানাজানি হয়ে যায় হয়তো জয়দীপ বেঁকে দাঁড়াবে। হয়তো নীলু মনের দুঃখে…না-কাকা, আপনি আর আপত্তি করবেন না—

সব কথা শুনে কৌশিক জানতে চাইল কেন তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। জগদানন্দ বললেন, যে, গতকাল বাসু-সাহেব যে ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন তারপর থেকেই তিনি কেমন যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন! গতকাল তাঁর তিলমাত্র ঘুম হয়নি। জগদানন্দ অনুরোধ করলেন, মহেন্দ্র যতদিন না বিদায় নিচ্ছে—মানে আর দু-তিন দিন হতে পারে—ততদিন কৌশিক বরং এ বাড়িতেই রাত্রিবাস করুক। কাল রেজিস্ট্রেশন হবে—তারপরেই মহেন্দ্ৰ চলে যাবে। তখনই কৌশিকের ছুটি।

কৌশিক রাজি হল। বাড়িতে ফোন করে দিল। স্থির হল, কৌশিক থাকবে দ্বিতলে—জগদানন্দের ঘরের বিপরীতে উত্তর দিকের ঘরে। সে ঘরে এতদিন ছিলেন উকিল বিশম্ভরবাবু, অগত্যা তাঁকে একতলায় নেমে যেতে হল। মহেন্দ্রবাবু তাঁর উকিলের কাছাকাছি থাকতে চান, তাই তিনিও দ্বিতল ছেড়ে একতলায় যোগানন্দের ঘরটি দখল করতে চাইলেন। যোগানন্দের তাতে আপত্তি নেই। ক’রাত্রের জন্য যোগানন্দ দ্বিতলের উত্তর-পশ্চিমের ঘরখানি দখল করলেন, ঠিক সিঁড়ির পাশেই। জগদানন্দ, নীলিমা অথবা শ্যামলের শয়নকক্ষের কোনও পরিবর্তন হল না

রাত সাড়ে দশটা নাগাদ খাওয়া-দাওয়া মিটিয়ে সবাই শুতে যাবে তখন টেলিফোনটা বেজে-উঠল। নীলিমা ফোন ধরল। দমদম থেকে জয়দীপ ফোন করছে। সে সঙ্কেতে জানালো পাখি আবার খাঁচায় ফিরে এসেছে। তার ঘরের আলো এইমাত্র নিবল। পর মুহূর্তেই সে ফোন রেখে দিল।

শুতে যাবার আগে কৌশিক সারা বাড়িটা একবার টহল দিয়ে এল। যে যার ঘরে চলে গেছেন। একতলায় মহেন্দ্র এবং বিশ্বম্ভর শুয়ে পড়েছেন। ঘরের বাতি নেবানো। শ্যামল একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে বই পড়ছে। দোতলায় জগদানন্দের ঘরে আলো জ্বলছে। কৌশিক এসে দরজায় টোকা দিল। জগদানন্দ ভিতর থেকে ‘ল্যাচ-কী’ খুলে দিলেন; কৌশিককে দেখে বললেন, আবার কী হল?

—কিছু না। শুতে যাবার আগে দেখে যাচ্ছি। আপনি কি রাত্রে ভিতর থেকে ঘর বন্ধ করে রাখেন?

—এতদিন রাখতাম না। ইদানীং রাখছি!

কৌশিক লক্ষ্য করে দেখে জগদানন্দের খাটের পাশে রাখা একটি সাইড-টেবিল। তার উপর রাখা আছে ঢাকা দেওয়া এক গ্লাস জল, একটি টর্চ, সিগারেট দেশলাই, ছাইদান। খান-কয়েক বই, একটি টেবিল ল্যাম্প এবং একটি সুদর্শন খাপে ঢাকা হাতির দাঁতের মুঠওয়ালা ছোরা। কৌশিক বলল, আজ আর বইটই পড়বেন না, কাল ঘুম হয়নি, শুয়ে পড়ুন।

শুভরাত্রি জানিয়ে সে বিদায় নিল। ‘ক্রুক’ করে ল্যাচ-কী বন্ধ হবার শব্দ হল। বারান্দায় দেখা হয়ে হল নীলিমার সঙ্গে। মেয়েটি জানতে চায় বেড-টি খাবার অভ্যাস আছে নাকি?

—পেলে খুশি হই। না পেলেও চলে যায়।

—কটা নাগাদ পেলে খুশি হন?

—কাউকে বিরক্ত না করে যদি হয়, তো ধরুন সকাল ছ’টায়

—কেউ বিরক্ত হবে না, কারণ আমি ঐ সময় এক কাপ নিজেই বানিয়ে খাই। ভোররাত্রে কৌশিকের ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন দরজায় টোকা দিচ্ছে। স্বতঃই নজর পড়ল ঘড়িটার দিকে। ভোর পৌনে পাঁচটা। সবে সকাল হচ্ছে। এত সকালে তো সে বেড-টি খেতে চায়নি। কৌশিক উঠে পড়ে। স্লিপারটা পায়ে গলায়। দরজাটা খুলে দিতেই দেখে আধো-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে নীলিমা।

একতলা দোতলা

—কী ব্যাপার? এত ভোরে বেড-টি?

—আপনি একবার বাইরে আসুন তো—

ওর কণ্ঠস্বরে উদ্বেগের আভাস। কৌশিক তৎক্ষণাৎ বার হয়ে আসে। সামনে জগদানন্দের ঘরের দরজাটা খোলা। নীলিমা সে ঘরে প্রবেশ করে। পিছন পিছন কৌশিক। হাত বাড়িয়ে নীলিমা সুইচটা জ্বেলে দেয়। খাটের উপর জগদানন্দ নেই। বিছানাটার চাদর কোঁচকানো। নীলিমা একটা আঙুল নির্দেশ করে কী-যেন দেখায়। বলে, এর মানে কী?

ব্যাপারটা বুঝতে পারে না কৌশিক। প্রশ্ন করে, আপনার দাদু কোথায়?

—দাদু পুজোর ঘরে—পুজো করছেন। কিন্তু এটা কী করে হল?

এক পা এগিয়ে নীলিমা দর্শনীয় বস্তুটার কাছে সরে আসে। এতক্ষণে নজর হয় কৌশিকের। টেবিলের উপর কাল রাত্রে যে কয়টি জিনিস দেখেছিল তার একটা নেই। চামড়ার খাপটা আছে, কিন্তু খাপ থেকে গজদন্তের মুঠটা বার হয়ে নেই; অর্থাৎ ছোরাটা অন্তর্হিত!

ভ্রুকুঞ্চিত করে কৌশিক একটি মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। দ্রুত ঘরের চারদিক দেখে নেয়। তারপর বলে, দাদুকে জিজ্ঞাসা করেছেন?

—না। উনি খুব ভোরে ওঠেন। রোজ এই সময় পুজোয় বসেন। আজও তাই বসেছেন। কিন্তু ওঁর ঘরে ঢুকে হঠাৎ এটা নজরে পড়ল আমার। তাই আপনাকে ডেকে তুলেছি।

—হয়তো ঘর খালি রেখে পুজোর ঘরে যাবার সময় উনি ওটা তুলে রেখে গেছেন।

—সে-ক্ষেত্রে খাপ সমেত ওটা তুলে রাখাই স্বাভাবিক হত না কি?

যুক্তিপূর্ণ কথা। কৌশিক বললে, চলুন, প্রথমেই ওঁকে জিজ্ঞাসা করি।

—পুজোর সময় কেউ ওঁকে ডাকলে উনি বিরক্ত হন।

কৌশিক সে কথায় কর্ণপাত করে না। পুজোর ঘরে গিয়ে হাজির হল ওরা। বৃদ্ধ বিরক্ত হলেন যতটা তার চেয়ে বিস্মিত হলেন বেশি। বললেন, তাই নাকি? খাপটা আছে অথচ ছোরাটা নেই? কই চল তো দেখি।

এ ঘরে আবার ফিরে এলেন ওঁরা। বৃদ্ধ বললেন, তাজ্জব কাণ্ড। আমি তো সকালে ওটাতে হাত দিইনি। সকালে ওদিকে নজরই পড়েনি আমার!

কৌশিক বললে, তা কেমন করে হয়? রাত্রে আপনি যখন ঘরটা বন্ধ করেন তখন আমি স্বচক্ষে দেখেছি—হ্যাঁ স্পষ্ট মনে আছে আমার—হাতির দাঁতের মুঠওয়ালা ছোরাটা ওখানেই ছিল। রাত্রে ঘর তালাবন্ধ ছিল ভিতর থেকে! আপনি কখন ঘর ছেড়ে বেরিয়েছেন?

—ঘড়ি দেখিনি। আধঘণ্টা খানেক আগে।

নীলিমা বললে, দাদু যখন বার হয়েছেন তখন আমি জেগে। দোতলায় তারপর আর কেউ আসেনি। এলে আমার নজরে পড়ত।

চকিতে কৌশিকের মনে হল—জগদানন্দ খুন হতে পারেন এমন একটা আশঙ্কা গতকাল করেছিলেন বাসু-সাহেব; কিন্তু উল্টোটাও তো হতে পারে? কাল রাত্রে জগদানন্দের বদলে যদি মহেন্দ্রবাবু খুন হয়ে থাকেন? কৌশিক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে দেখল জগদানন্দের দিকে। তাঁর মুখ ভাবলেশহীন। কী ভাবছেন তিনি, বোঝার উপায় নেই। স্থির হয়ে বসে আছেন ইজিচেয়ারে। কৌশিক নীলিমাকে বললে, বাড়ির আর সবাই ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আমি এখনই জানতে চাই সবাই সুস্থ আছে কি না। আপনাদের কাছে ঐ ঘরগুলোর ডুপ্লিকেট চাবি আছে?

নীলিমাও বোধ করি আন্দাজ করেছে কৌশিক কী ইঙ্গিত করছে। তার মুখটা সাদা হয়ে যায়। অস্ফুটে বলে, আপনি কী আশঙ্কা করছেন—

তাকে কথাটা শেষ করতে দেয় না কৌশিক, বলে, সে সব আলোচনা পরে। প্রত্যেকেই ঘর ভিতর থেকে বন্ধ করে ঘুমোচ্ছেন। আমি জানতে চাই তাঁদের কাল রাত্রে কোনও বিপদ হয়েছে কি না। আপনাদের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে? তাহলে কাউকে কিছু না জানিয়ে নিঃশব্দে ঘরগুলো দেখে আসতে পারি।

মেয়েটি অনেকটা সামলেছে। তবু সে কাতরভাবে একবার তার দাদুর দিকে তাকায়। তারপর বলে, আমার কাছে ডুপ্লিকেট চাবির থোকা আছে। আসুন এঘরে।

মেয়েটির পিছন পিছন কৌশিক চলে এল তার শয়নকক্ষে। নীলিমা একটা টানা-ড্রয়ার খুলল। তারপর বিহ্বল হয়ে তাকালো কৌশিকের দিকে।

—কী হল?—কৌশিক ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করে।

নীলিমার মুখটা ছাইয়ের মতো সাদা। তার ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল। কথা বার হল না।

—কী হয়েছে বলুন। অমন আমতা করছেন কেন?

—চাবির থোকাটা এখানেই থাকে। সেটা নেই! চুরি গেছে!

কৌশিক দাঁতে দাঁতে চেপে বলে, অর্থাৎ যে সেটা চুরি করেছে তার কাছে কালরাত্রে সব কটা ঘরই ছিল অবারিত দ্বার—খুনির স্বর্গ!

নীলিমা জবাব দিল না। বসে পড়ল তার খাটে।

—এবং বাড়িসুদ্ধ লোককে না জাগিয়ে আমরা কিছু জানতে পারব না।

এবারও নীলিমা জবাব দিল না। দু-হাতে মুখটা ঢেকে সে নির্বাক বসে থাকে।

জগদানন্দ কখন নিঃশব্দে উঠে এসেছেন তা ওরা খেয়াল করেনি। এবার দরজার কাছ থেকে তিনি বলে ওঠেন, না। আমার কাছে একটা ‘মাস্টার-কী’ আছে, তা দিয়ে সবকটা ঘরের দরজা খোলা যায়। তুমি সবগুলো ঘর একবার দেখে এস

হাত বাড়িয়ে একটি চাবি তিনি কৌশিককে দেন। এগিয়ে এসে নীরবে নাতনির মাথায় একটি হাত রাখেন। সে স্নেহস্পর্শে মনোবল ফিরে পায় মেয়েটি। বলে, চলুন, আমিও আপনার সঙ্গে যাব। দাদু তুমি এখানেই অপেক্ষা করো।

তখনও ভাল করে আলো ফোটেনি। কৌশিক আর নীলিমা বার হল তদন্ত করতে। কোশিক বললে, প্রথমেই মহেন্দ্রবাবুর ঘর। তিনিই—

হঠাৎ তার হাতটা চেপে ধরে নীলিমা। বলে, কী বলছেন! তার মানে, দাদু? ঐ আশি বছরের বৃদ্ধ—

কৌশিক দাঁড়িয়ে পড়ে। চাপা আক্রোশে বলে, কেন? শুধু আশি বছরের বৃদ্ধই বা কেন? তাঁর জোয়ান নাতনিটি কি ছিলেন না এ বাড়িতে?

নীলিমার মুঠিটা আলল্গা হয়ে যায়। আর কোনও কথা সে বলে না।

ওরা নেমে আসে একতলায়।

সিঁড়ি দিয়ে নেমেই মহেন্দ্রের ঘরের দরজা। নিঃশব্দে কৌশিক মাস্টার কী-টা লাগিয়ে দেয় চাবির ফুটোয়। ক্লিক করে শব্দ হল। সন্তর্পণে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল কৌশিক। দ্বারপথে দাঁড়িয়ে রইল নীলিমা—একটা হাত মুখে চাপা দিয়ে—যেন একটা অনিবার্য আর্তনাদকে এখনই রুখতে হবে তাকে।

তড়াক করে খাটের উপর উঠে বসল মহেন্দ্র। বলল, এর মানে কী?

ধড়ে প্রাণ এল কৌশিকের। বলল, বেড-টি খাবেন? চা হচ্ছে?

মহেন্দ্ৰ প্রথমেই তোশকের নিচে হাত চালিয়ে কি যেন দেখে নিল। তারপর বললে, ইয়ার্কি করার জায়গা পাননি? চা খাবার জন্যে ডাকতে চান তো দরজায় নক করেননি কেন? দরজা খুললেন কী করে?

কৌশিক বললে, খামকা চেঁচামেচি করবেন না। চা হয়ে গেছে, মুখে চোখে জল দিয়ে নিন।

বলেই দরজাটা বন্ধ করে দিল। বাইরে বেরিয়ে এসে বললে, কুইক, বিশ্বম্ভর উকিল কোন্ ঘরে শুয়েছিল?

নীলিমা আবার কৌশিকের হাতটা ধরে। অস্ফুটে বলে, বিশ্বম্ভরবাবু নয়, চলুন, বরং ছোটকাকুর ঘরটা দেখে আসি।

— ছোটকাকু?

—যোগানন্দ। উইল অনুয়ায়ী যাঁর পঞ্চাশ হাজার টাকা পাওয়ার কথা।

খণ্ড-মুহূর্তের জন্য কৌশিক দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর বলে, ঠিক কথা! নেক্সট প্রবাবিলিটি বোধহয়—যোগানন্দ!

সিঁড়ি বেয়ে ওরা উপরে উঠে আসে। ততক্ষণে ওদিককার ঘর খুলে বিশ্বম্ভর উকিলও বার হয়ে পড়েছেন করিডোরে। সম্ভবতঃ মহেন্দ্রের উচ্চ কণ্ঠস্বর কানে গিয়েছে তাঁর। মহেন্দ্রও দরজা খুলে উঁকি দিল।

কৌশিক আর নীলিমা উঠে এল দোতলায়। পিছন পিছন বিশ্বম্ভর আর মহেন্দ্র। তারা দুজনে নিম্নস্বরে কী যেন বলাবলি করছে। কৌশিক যোগানন্দের ঘরের দরজায় করাঘাত করল। কেউ সাড়া দিল না। সেই অবসরে বিশ্বম্ভর আর মহেন্দ্র এসে উপস্থিত হয়েছেন ঐ রুদ্ধ দ্বারের সামনে। জগদানন্দ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ঘরের দ্বারপথে।

কৌশিক ‘মাস্টার-কী’ দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল। চারজনেই হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল ঘরে। পরমুহূর্তেই নীলিমার আর্ত-চীৎকারে চকিত হয়ে উঠল উষা মুহূর্তটি। কৌশিক ধমক দিয়ে ওঠে, চুপ করুন! কেউ কোনো কিছু স্পর্শ করবেন না। বাইরে, বাইরে আসুন সবাই-

বিশ্বম্ভর দৃশ্যটা পিছন থেকে দেখতে পায়নি। বললে, কেন মশাই? আপনি হুকুম চালাবার কে?

কৌশিক বললে, আপনি একা এ ঘরে থাকতে চান থাকুন; কিন্তু পুলিশ এসে পড়ার আগে আমি ঘরটা তালাবন্ধ রাখতে চাই। বাইরে আসুন মিস্ সেন

নীলিমা আঁচলে মুখ ঢেকে টলতে টলতে বাইরে বেরিয়ে এল। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন জগদানন্দ। তাঁর পাঁজরসর্বস্ব বুকে তিনি টেনে নিলেন নাতনিকে। কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটি।

মহেন্দ্রবাবু কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ঘরের ভিতর। তাকে পিছন থেকে টেনে ধরল বিশ্বম্ভর। বললে, খবরদার! কোনো কিছু ছোঁবেন না। বাইরে বেরিয়ে আসুন। ওরা আমাদের জড়াতে চাইছে। এখনই পুলিসে খবর দেওয়া উচিত।

হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এল মহেন্দ্র আর বিশ্বম্ভর।

জগদানন্দ নাতনিকে বুকে জড়িয়ে দ্বার পথে দাঁড়িয়েছিলেন। এতক্ষণে তাঁর নজর পড়ল ঘরের ভিতর। খাটের উপর উবুড় হয়ে শুয়ে আছে তাঁর নির্বিরোধী ভাইপো–যোগানন্দ। তার পিঠের উপর উঁচু হয়ে জেগে আছে একটা শৌখিন ছোরার মুঠ—চমৎকার হাতির দাঁতের কাজ করা। রক্তে ভেসে গেছে খাট আর মেঝে

পাশের ঘর থেকে তখন শোনা যাচ্ছে কৌশিকের কণ্ঠস্বর, ইস দ্যাট ডবল টু ডবল, ওয়ান ডবল-থ্রি? লালবাজার?…পুট মি টু হোমিসাইড য়ুনিট প্লিজ? হ্যাঁ, খুন হয়েছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *