১২
—শেষ পর্যন্ত জয়দীপ? এ যে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি—বললে কৌশিক!
শ্যামল বললে, আমিও না। জয়দীপ দাদুর ছোরা দিয়ে মেসোকে খুন করবে এ যেন ভাবাই যায় না। বাসু-সাহেব বলেন, তোমাদের কোথায় ভুল হচ্ছিল জান? খুন করার পূর্বমুহূর্তে জয়দীপ জানত—সে মহেন্দ্রকেই খুন করছে, যোগানন্দকে নয়। ওরা যে ঘর বদলেছে সে কথা সবাই জানত—জানত না তিনজন— সিয়াঙ, আমি আর জয়দীপ। দ্বিতীয় কথা, জয়দীপের খুন করার আসল উদ্দেশ্য শুধু মহেন্দ্রকে হত্যা করা নয়, মহেন্দ্রের বালিশের নিচে যে উইলটা আছে সেটা হস্তগত করা এবং ঐ সঙ্গে জগদানন্দকে ফাঁসিতে ঝোলানো। একটা কথা নিশ্চয় স্বীকার করবে—যোগানন্দের বদলে মহেন্দ্র খুন হলে—ঐ ছোরায় খুন হলে—জগদানন্দ জামিন পেতেন না। বর্তমান মামলায় জগদানন্দের খুন করার কোনো মোটিভ খুঁজে পাওয়া যায়নি। জোড়াতালি দিয়ে পুলিশ যে কেসটা সাজিয়েছে সেটা ধোপে টিকল না, টেকার কথাও নয়—কিন্তু যোগানন্দের বদলে মহেন্দ্র খুন হলে জগদানন্দকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব হত।
কৌশিক প্রশ্ন করে, তাহলে জয়দীপ পার্ক হোটেল থেকে এসে খুন করার পর রাত বারোটা চল্লিশে দমদমে ফোন করল কেন?
—ধাপে ধাপে ভেবে দেখ। প্রথমত জয়দীপের প্রথম পরিকল্পনাটা কী ছিল? মহেন্দ্ৰ নিহত হবে জগদানন্দের ছোরায়। মহেন্দ্রের বিছানার তলা থেকে উইলটা চুরি যাবে এবং জগদানন্দ ফাঁসিতে ঝুলবেন। উইল না থাকায় সমস্ত সম্পত্তির মালিক হবে তার স্ত্রী—অর্থাৎ সে নিজে। কিন্তু খুন করেই সে নিজের ভুলটা বুঝতে পারল। হয়তো টর্চের আলোয় সে দেখেছিল খুন হয়ে গেল যোগানন্দ। তখন আর কিছু করার নেই। মহেন্দ্ৰ কোন ঘরে শুয়েছে তা সে জানে না। ফলে দ্বিতীয় খুন করবার মতো সাহস তার তখন নেই। সে পালিয়ে গেল পার্ক হোটেলে। পার্ক হোটেলের ঘরটা সে ছাড়েনি, যদিও দমদমের হোটেলেও স্বনামে একটা ঘর নিয়েছিল।
খুব সম্ভব একটা অ্যাটাচি কেস নিয়ে এসেছিল, তার ভিতর রক্তাক্ত গায়ের চাদরটা সে লুকিয়ে নিয়ে যায়। সর্বাঙ্গ চাদরমুড়ি থাকায় তার গায়ে বা জামা-কাপড়ে রক্ত লাগেনি। পার্ক হোটেলে পৌঁছে তার মনে হল, জগদানন্দের পক্ষে যোগানন্দকে হত্যা করার কোনো হেতু খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখনও যোগানন্দের পক্ষে ব্ল্যাকমেলিং করার আষাঢ়ে পরিকল্পনাটা পুলিশ করেনি। ও স্থির করল, ওকে দুটো জিনিস তখনই করতে হবে। প্রথমত নিজের জন্য একটা মোক্ষম অ্যালেবাই তৈরি করা। দ্বিতীয়ত সন্দেহটা মহেন্দ্র-বিশ্বম্ভর পার্টির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। তারই ফলশ্রুতি ঐ টেলিফোন। পার্ক হোটেল থেকে সে দমদমে ফোন করে য় সিয়াঙের জবাবগুলো লিখে রাখে! আমাদের বলে, সে দমদমে হোটেলে পাশের ঘর থেকে ঐ জবাবগুলো শুনে শুনে লিখেছে।
কৌশিক বলল, তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আপনি ওকে কেমন করে সন্দেহ করলেন?
—ঐ টেলিফোন কলটা থেকেই। কে ওটা করতে পারে?
—কেন, বিশ্বম্ভরবাবু? মহেন্দ্র? যদি ওঁরাই এটা করে থাকেন।
ভুল বলছ কৌশিক। তা কী সম্ভব? প্রথম কথা, ওরাই যদি খুন করে থাকে তবে সেটা ওরা মধ্যরাত্রে কেন জানাতে যাবে য়ু সিয়াঙকে? কাজের কথা তো কিছু ছিল না—একমাত্র সকালবেলা একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছাড়া? তার জন্য ঐ মাঝরাতে ওরা ঐ ভাষায় টেলিফোনে কথা বলবে? ঐ ‘পথের’ কাঁটা’ দূর করার কথা? দ্বিতীয়ত রাত বারোটায় খুন করে, তার চল্লিশ মিনিট পরে কোথা থেকে ওরা ফোন করল? বাড়ির ফোন নিশ্চয়ই ব্যবহার করবে না। ফোনটা আছে বৈঠকখানায়—তার সামনেই শ্যামল শুয়ে আছে। বলতে পার, ওদের কাছে সদর দরজার ডুপ্লিকেট চাবি আছে। তাতেই বা কী? অত রাত্রে পাবলিক টেলিফোন বুথ পাবে কোথায়? কোনও পেট্রোল স্টেশন বা ওষুধের দোকান থেকে অমন ভাষায় ফোন কি ওরা করতে পারে?
—ঠিক কথা। এভাবে আমরা ভাবিনি।
—ফলে ফোন করার উদ্দেশ্য আর কিছু। আমার স্বতঃই মনে হল জয়দীপ ঐভাবে প্রমাণ রাখতে চেয়েছে যে, সে রাতে বারোটা চল্লিশে দমদমের হোটেলে ছিল। জয়দীপ বুদ্ধিটা করেছিল ভালই—কিন্তু সে একটিমাত্র ভুল করে ধরা পড়ে গেল।
—কী ভুল?
—আমাকে সে চিনতে পারেনি! সে স্বপ্নেও ভাবেনি যে, পার্ক হোটেলে গিয়ে আমি রেজিস্টার দেখে আসব।
নীলিমা বলে, কিন্তু আপনি আমাদের বিয়ের কথাটা কেমন করে জানলেন? আমি তো বলিনি।
—না, তুমি বলনি। বলেছিল জয়দীপই। সেটাও তার একটা চালে ভুল হয়েছিল।
.
বাসু-সাহেব চলে আসবার আগে নীলিমা তাঁকে জনান্তিকে পাকড়াও করল। বলে, একটা কথা ব্যারিস্টার-সাহেব। আপনি বলেছিলেন—আদালতে আমি প্রচণ্ড একটা লোকসানের মধ্যে পড়ব। ওটা আপনারও ভুল হয়েছিল। প্রেমে আমি এমন কিছু অন্ধ হয়ে যাইনি যে, খুনি জেনেও জয়দীপকে আমি ক্ষমা করব।
বাসু বললেন, সেই বিষয়েই আমার সন্দেহ ছিল নীলিমা। যতই আধুনিকা হও, তোমার রক্তে যে ভারতীয় নারীর ট্র্যাডিশন।
—ওটাও আপনার ভুল হয়েছে ব্যারিস্টার-সাহেব। দস্যু-রত্নাকরের সহধর্মিণীও ভারতীয় নারী। জয়দীপ যদি উত্তেজনার বশে খুন করে বসত তাহলে আমি…কিন্তু সে তা করেছিল ঠান্ডা মাথায়। সুপরিকল্পিত ভাবে। সে আমার ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য ছিল কি? বাসু বললেন, থ্যাংকস্ নীলিমা। বাই দ্য ওয়ে, তুমি ‘শেষের কবিতা’ পড়েছ?
—হঠাৎ এ প্রশ্ন?
—শেষের কবিতার শেষ কবিতার মোদ্দা কথাটা কী বলো তো?
—’পরশুরামে’র মতে—’উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে, সেই ধন্য করিবে আমাকে!’
—ঠিক কথা! ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি—অতঃপর তোমাদের জীবন শ্যামলে শ্যামল’ এবং ‘নীলিমায় নীল’ হয়ে উঠুক!