পথিকের বন্ধু

পথিকের বন্ধু

মহকুমার টাউন থেকে বেরুলাম যখন, তখনই বেলা যায় যায়।

কলকাতা থেকে আসছিলাম বরিশাল এক্সপ্রেসে। বারাসাত স্টেশনে নিতান্ত অকারণে (অবশ্য যাত্রীদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী) উক্ত বরিশাল এক্সপ্রেস চল্লিশ মিনিট কেন যে দাঁড়িয়ে রইল দারুব্রহ্মবৎ অনড় অবস্থায় তা কেউ বলতে পারলে না। গন্তব্যস্থান বনগাঁয়ে পৌঁছে দেখি রানাঘাট লাইনের গাড়ি চলে গিয়েচে।

বেলার দিকে চাইলাম। বেশ উঁচুতেই সূর্যদেব, লিচুতলা ক্লাবে খানিকটা বসে আড্ডা দিয়ে চা খেয়ে ধীরেসুস্থে হেঁটে গেলেও এই পাঁচ মাইল পথ সন্ধ্যার আগেই অতিক্রম করতে পারা কঠিন হবে না।

রামবাবু, শ্যামবাবু, যদু ও মধুবাবু সবাই বেলা পাঁচটার সময় ক্লাবে বসে গল্প করছিলেন। আমায় দেখে বললেন— এই যে বিভূতি, এসময় কোত্থেকে?

—কলকাতা থেকে।

—বাড়ি যাবে? ট্রেনে গেলে না?

—ট্রেনটা ফেল হয়ে গেল, বরিশাল এক্সপ্রেস চল্লিশ মিনিট লেট।

—এসো, খুব ভালো হয়েছে এক্সপ্রেস লেট হয়ে। বোসো, চা খাও।

তারপর গল্পগুজবে (যার বারো আনা পরনিন্দা) সময় হু হু করে কেটে গিয়ে কখন যে গোধূলির পূর্বমুহূর্ত উপস্থিত হয়েচে, তা কিছু বলতে পারি নে। যেতে হবে এখনও অনেকটা রাস্তা, আর দেরি করলে পথেই অন্ধকার হয়ে যাবে, বৃষ্টিও আসতে পারে, কারণ বর্ষাকাল, শ্রাবণ মাস। বড়োরাস্তায় উঠে সত্যিই দেখলাম আড্ডা দিতে গিয়ে সময়ের আন্দাজ বুঝতে পারিনি। তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলাম, পশ্চিম আকাশে মেঘ করে আসচে।

চাঁপাবেড়ে ছাড়িয়েচি, রাস্তায় জনমানব নেই, পথের দু-পাশে ঘন জঙ্গলে পটপটির ফুল ফুটেচে, গন্ধ ভেসে আসছে জোলো বাতাসে, শেয়াল খস শব্দ করে চলে গেল পাতার ওপর দিয়ে, বিলিতি চটকা গাছের ডাল বেয়ে ঝুলে পড়েচে মাকাললতা। কলকাতা থেকে হঠাৎ এসে বেশ লাগচে এই নির্জনতা।

চাঁপাবেড়ের পুল ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়েচি, এমন সময় দেখি একটি লোক কাঁধে বাঁক নিয়ে আমার আগে আগে যাচ্চে।

আমার পায়ের শব্দে সে চমকে পিছন ফিরে আমার দিকে চাইল।

ওকে এপথে একা দেখে একটু আশ্চর্য হয়েচি। এই বনপথে এসময় কেউ একা বড়ো একটা হাঁটে না।

বললাম— কোথায় যাবি?

—আজ্ঞে? গোপালনগরে।

—বাঁকে কী রে?

—দই আছে।

—এত দই কী হবে?

—নিবারণ ময়রার বাড়ি বায়না আছে। তেনাদের বাড়ি আজ খাওয়ান-দাওয়ান।

—তোদের বাড়ি কোথায়? দই আনচিস কোথা থেকে?

—আজ্ঞে, বেনাপোল থেকে।

—বলিস কীরে, এই দশ মাইল দূর থেকে দই আনচিস! তা এত দেরি করে ফেললি কেন?

লোকটার কণ্ঠস্বরে মনে হয়েছিল ও আমাকে সঙ্গী হিসেবে পেয়ে বাঁচল এই সন্দেবেলা। একা যেতে ওর নিশ্চয় ভয় করছিল।

আমার প্রশ্নের উত্তরে সে গল্প জুড়ে দিলে কেন তার দেরি হল দই নিয়ে রওনা হতে। ওদের একটা গোরু হারিয়ে গিয়েছিল আজ পাঁচদিন। খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে গিয়েছিল। আজ দুপুরের পর হিজলতলার বাঁওড়ে সেই গোরুকে চরতে দেখা গেল। তারপর ওরা দল বেঁধে বেরুল গোরু আনতে। গিয়ে দেখে বাঁওড়ের ধারে একটা লোক বসে আছে, তার কাছেই ছ-টা গোরু একসঙ্গে চরছে। সবগুলোই বিভিন্ন গ্রামের হারানো গোরু, ক্রমে জানা গেল। লোকটা তো ওদের দেখেই দৌড়— ইত্যাদি।

এইবার বেশ সন্দে হয়ে এসেচে।

বাঁশ-আমবনের ভেতরে ভেতরে ঘুলি ঘুলি অন্ধকার।

সামনে একখানা শুকনো কাঠ উঁচু চটকা গাছের মাথা থেকে ভেঙে পড়তেই ও চমকে উঠে বলল— ও কী? আমি হাসি চেপে বললাম— চটকা গাছের ডাল। লোকটা আশ্বস্ত হয়ে বললে— ও।

—তোমার নাম কী?

—নিধিরাম।

—বাড়ি?

—কটক জিলা।

—সত্যি? তুমি তো বেশ বাঙালির মতো কথাবার্তা বলচ।

—তা হবে না বাবু? বেনাপোলোর কাছে কাসুন্দিয়াতে আমার পনেরো বছর কেটে গেল। ওখানে আমার গোরুর বাথান। কুড়িটা গাই গোরু, পনেরো, ষোলোটা বকনা বাছুর, মস্ত বাথান। রোজ আধ মণ দুধ হয়। এঁড়ে বাছুর আমরা রাখিনে, শুধু বকনা বাছুর রেখে দিই। এঁড়ে বিক্রি করে ফেলি বাবু—

লোকাট একটু বেশি বকে। আমাকে পেয়ে ওর বকুনি আর থামতে চায় না। একা যাচ্ছিল, আমায় পেয়ে ও ভারি খুশি হয়েচে, ভরসা পেয়েচে, এই সন্দেবেলা।

বললে— বৃষ্টি আর হল না বাবু, কি বলেন?

—সেইরকমই তো দেখচি।

—এবার বড়ো দুব্বচ্ছর। আমন ধানের রোয়া হল কই? বীজপোতা ছিল দু-কাঠা ভুঁই। সে-বীজ লালচে হয়ে আসচে। ওই দেখুন, কেমন মেঘ করে আসছিল, আবার ফর্সা হয়ে এল। এবার আমাদের এদিকে খুব কম বৃষ্টি হয়েচে। আমন ধানের রোয়া হয়নি, চাষামহলে হাহাকার পড়ে গিয়েচে, ধানের দর ছিল চার টাকা মণ। এখন উঠেচে সাত টাকা মণ। গরিব দুঃখী লোকেরা এর মধ্যে উপোস শুরু করে দিয়েচে।

আমায় আবার বললে— গোরুগুলো অনেক কষ্ট করে মানুষ করা। এবার বিচুলি অভাবে মারা পড়বে বাবু।

—কাঁচা ঘাস কেটে খাওয়াবে। বর্ষাকালে কোন গোরু বিচুলি খায়? সবই কাঁচা ঘাস খেয়ে বাঁচে।

—বেতনা নদীর ধারে আগে আগে কত কাঁচা ঘাস পাওয়া যেত, এখন সব আঁটি বেঁধে এনে বনগাঁ শহরে বিক্রি করে। শহুরে বাবুরা চার আনা চোদ্দো পয়সা এক আঁটি কিনছে। আমাদের গোরুর ঘাস নিয়েই মুশকিল। ওটা কী বাবু?

এইবার লোকটা চমকে উঠে যেন আমার গা ঘেঁষে এসে থমকে দাঁড়ালো।

আমি বললাম— কই, কী?

—ওই যে সাদা মতো?

চেয়ে দেখলাম, কিছুই না। মাকাললতার মোটা সাদা লতা গাছের ডাল থেকে ঝুলে দুলচে অন্ধকারে। লোকটা দেখচি বিষম ভীতু।

হঠাৎ আমার মনে একটা দুষ্ট বুদ্ধি জাগল।

আমায় ও বললে— বাবু, আপনি কোথায় যাবেন?

—আমি একটু এগিয়ে ডান দিকের রাস্তায় নেমে যাব। ওখানেই আমার গাঁ।

—গোপালনগর এখন কত দূর আছে?

—তা দেড় মাইল।

—পথে কোনো ভয়-টয় নেই তো?

আমি জোরে ঘাড় নেড়ে বললাম— না, ভয় কীসের? এ অঞ্চলে বাঘ-টাঘ নেই। বুনো শুয়োরও নেই। সে বললে— আমি বাঘের কথা বলিনি বাবু— বলি এই— সন্দেবেলা আবার নাম করতে নেই— সেই তাঁদের—

—ও, ভূতপ্রেতের?

—ও নাম করবেন না সন্দেবেলা। রাম রাম রাম রাম! ও নাম কি করতে আছে এ সময়? রাম রাম রাম—

আমি অতি কষ্টে হাসি চেপে বললাম— ও, বুঝেচি। তবে একটা কথা, যখন তুমি বিদেশি লোক, তখন তোমাকে সব খুলে বলাই ভালো।

—কী বাবু?

—দাঁড়াও এখানে। আমি তো এখুনি নেমে যাব, তুমি একা যাচ্চ এতটা পথ— অন্ধকারে— পথে জনপ্রাণী নেই—। আমার বর্ণনার বহর শুনে লোকটা আরও আমার দিকে ঘেঁষে দাঁড়ায়। আমার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে বললে— তারপর বাবু?

—তারপর আর কী, তোমাকে বলা আমার উচিত নয়, কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করলে তখন না বলাটাও তো ঠিক নয়। বিশেষ করে একা যখন যাচ্চ। সঙ্গে নেই লোক। ওই যে একটা সাঁকো আছে রাস্তার ওপর বনের পাশে, ওই সাঁকোটা বড়ো খারাপ জায়গা।

—কেন বাবু?

—ও জায়গাটাতে ভূত— মানে ওঁরা সব আছেন কিনা। পাশে যে বড়ো বাগান, ওটার নাম গয়াল-দড়ের আমবাগান। বড্ড খারাপ জায়গা। অনেকদিন আগে তখন আমি ছেলেমানুষ, একবার একজন এই তোমার মতো বিদেশি লোক একটা যাচ্ছিল গোপালনগরে, সন্দের পর। তার পরদিন সকাল বেলা দেখা গেল কীসে তার ঘাড়টা ভেঙে মেরে ফেলে রেকেচে সাঁকোর তলায়। এ আমার নিজের চোখে দেখা। কথাটা তোমায় বলা উচিত নয়, তবে যখন জিজ্ঞেস করলে, তখন চেপে রাখাও তো উচিত নয়। একটা বিপদ হতে দেরি লাগে না, তখন তুমি বলতে পারো— বাবু, আপনি জেনেশুনেও আমায় বলেননি কেন? সন্দের পর কেউ ও পথে যায় না। প্রাণ হাতে করে যেতে হয়। আজ বছর দুই আগে এক রাখাল ছোঁড়া দিনদুপুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল সাঁকোর তলায়। যাক, সে তুমি রাম রাম বলতে বলতে চলে যাও, কোনো ভয় নেই।

—বাবু, আপনি কি নেমে যাবেন?

—হ্যাঁ, আগে আমার গাঁয়ের রাস্তা নেমে গেল। আমি এইবার চলে যাব।

—তাই তো বাবু, একা আমি কী করে যাব?

—রাখে কেষ্ট মারে কে? মারে কেষ্ট রাখে কে? কপালে মৃত্যু থাকলে কেউ সামলাতে পারে না। না থাকলে কেউ মারতে পারে না। রাম রাম বলতে বলতে চলে যাও। দাঁড়াও, আজ আবার তিথিটা কী? চতুর্দশী। তিথিটা ভালো নয়। অমাবস্যে, চতুর্দশী, প্রতিপদ এই তিথিগুলো খারাপ।

—কেন, কেন বাবু?

—সে আর তোমাকে বলে কী হবে? তুমি সন্দের অন্ধকারে এক রাস্তার ওপর— যেতে হবে এখনও তোমায় এক ক্রোশ পথ। ক্রমশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আসচে। তবে তোমায় বলা আমার উচিত— বিদেশি লোক, তোমায় সব কথা খুলে না বলাটাও ঠিক নয়। একটা বিপদ হতে কতক্ষণ? তখন তুমি আমায় দোষ দিতে পারো। এইসব তিথিতেই ভূত প্রেত-পিশাচ ব্রহ্মদত্যি—

লোকটা বলে উঠল— রাম রাম রাম রাম— ওসব নাম করবেন না বাবু—

—মানে ওঁরা সব বার হয়ে থাকেন কিনা—

—তাই নাকি? তবে তো—

—আবার কী জানো, এই চতুর্দশী তিথিতে গলায় দড়ি দিয়ে অপমৃত্যু ঘটেছে এমন ভূতেরা বার হয়। আমি একবার বড়ো বিপদে পড়েছিলুম—

লোকটা আড়ষ্ট সুরে বললে— কী বাবু?

একটা শ্মশানের ধার দিয়ে সেবার যাচ্ছিলাম। সেও এক ভূতচতুর্দশী তিথি। দেখি যে অন্ধকারে গাছের ডাল থেকে কী-একটা যেন ঝুলচে— কাছে গিয়ে দেখি একটা মেয়েমানুষ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে আর হিঃ হিঃ করে হাসচে—

লোকটা আঁতকে উঠে বললে— কী সর্বনাশ!

—যাক, ওই আমার রাস্তা নেমে গেল। আমি চললাম এবার। যাও তুমি, একটু সাবধানে যাও, সাবধানের মার নেই।

কথা শেষ না করেই আমি আমাদের গ্রামের পথে নেমে পড়লাম।

ও কাঁদো কাঁদো সুরে বললে— বাবু, আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে সাঁকোটা পার করে দেন যদি—

আমি শিউরে বলে উঠি— আমি? আমার কম্ম নয়। আমাকে তারপর এগিয়ে দেবে কে? বাবা রে, প্রাণ হাতে করে যাওয়া ওসব জায়গায়। একে আজ ভূতচতুর্দশী—

—রাম রাম রাম রাম!

—তুমি চলে যাও একটু জোর পায়ে। আবার রাস্তাও তো কম নয়, তোমাকে যেতেও হবে এক মাইল দেড় মাইল রাস্তা— আর এই অন্ধকার। আচ্ছা চলি— তুমি বিদেশি লোক, জিজ্ঞেস করলে তাই এত কথা বলা। নইলে কী দরকার?

আমাদের রাস্তায় নেমে কয়েক পা মাত্র এগিয়েচি, লোকটা দেখি ডাকচে— বাবু, বাবু, একটা কথা শুনুন— ও বাবু—

পিছন ফিরে দেখি কাঁধের বাঁকটা একটি শিশুগাছের তলায় নামিয়ে দাঁড়িয়েচে।

বললাম— কী?

—দইগুলো নিয়ে আমি এখন কী করি বাবু?

—কী আর করবে? বায়না রয়েচে, একমুঠো টাকা। দিয়ে এসো। রাত হয়ে গিয়েচে, ওদের খাওয়ানো-দাওয়ানোর সময় হল। রাম বলে এগিয়ে পড়ো— সাবধানে যেয়ো—। আর কোনো কথা না বলে আমি হন হন করে হাঁটতে আরম্ভ করলাম।

ও শুনলাম আবার ডাকচে— ও বাবু, ও বাবু— শুনে যান— একটা কথা, ও বাবু—! দূর থেকে ওর গলার সুরটা যেন আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছিল।

1 Comment
Collapse Comments

দইওলার জন্য সত্যিই খারাপ লাগলো। বিভূতিভূষণ এমন একটি গল্প লিখেছেন আমার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। গল্পের শেষ টা সুন্দর হতে পারতো ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *