পথিকৃৎ
সুনীতিকুমারের মননের আর একটি বড় দিক হল সর্বমানবে সমদৃষ্টি; তাঁর মনোজগতে মানুষ ছোট বা বড় শুধু মনুষ্যত্বে, চরিত্রে ও জ্ঞানবুদ্ধিতে। অন্যথা সকলে সমান। সাহিত্য অকাদেমির সঙ্গে যুক্ত থাকা কালে তিনি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ভাষা, যারা ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃতি পায়নি, তাদের সাহিত্যিক ঐশ্বর্যের ভিত্তিকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে কোঙ্কনি ভাষাও সাহিত্য অকাদেমির স্বীকৃত ভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত হয়, একান্ত ভাবে সুনীতিকুমারের যুক্তিতে এবং আগ্রহে। নানা ভাষাগোষ্ঠী এ কারণে সুনীতিকুমারের কাছে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ। ভাষার ভিতর দিয়ে মানবগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটবে, সমৃদ্ধি ঘটবে— এই বিশ্বাস থেকেই তিনি এ সব কাজে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। মানবপ্রীতিই তাঁকে ভাষা স্বীকৃতিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
বাংলা ভাষার ব্যাকরণ তিন বারে রচনা করেন সুনীতিকুমার। প্রথম ভাষা-প্ৰকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ ১৯৩৯ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুদ্রিত। দ্বিতীয় সংক্ষিপ্ত ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ ও তৃতীয় সরল ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। সুনীতিকুমার এ কাজে হাত দেওয়ার পূর্বে প্রায় আড়াইশো বাংলা ব্যাকরণ ছিল। এগুলি সম্বন্ধে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশায় বলেন, বাংলা যে একটা স্বতন্ত্র ভাষা বা সংস্কৃত, মাগধী, অর্ধ মাগধী, পালি, পার্শি, ইংরেজি, ইত্যাদি নানা ভাষার মিশ্রণে উৎপন্ন এ কথা ওই আড়াইশো ব্যাকরণকারের মনে একেবারেই স্থান পায়নি। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী মশায়ও বলেন ‘বাংলা ব্যাকরণ এখন যাকে বলে তা বাংলা ব্যাকরণই নয়, সংস্কৃতের কাছে বাংলা ভাষার যে অংশ ঋণী শুধু সেই অংশেরই ব্যাকরণ এগুলি।’ যা ধার করা নয়, যে অংশে বাংলা খাঁটি বাংলাই তার কোনও ব্যাকরণ নেই— সেই পরিপ্রেক্ষিতে সুনীতিকুমারের বাংলা ভাষার ব্যাকরণ নানা পর্যায়ে, খাঁটি বাংলা ভাষারই ব্যাকরণ। এতে বাংলার নিজস্ব বাগধারা, বানান, উচ্চারণভঙ্গি, ঋণ-শব্দ, স্বরাঘাত, ছন্দ সমস্তই প্রথমবার স্থান পেল; অর্থাৎ এই প্রথম বাংলা ভাষা একটি নিজস্ব ভাষার স্বীকৃতি পেল এবং সেই সঙ্গে পেল নিজস্ব একটি ব্যাকরণ; কাজেই এ ব্যাপারে সুনীতিকুমার পথিকৃৎ।
তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি দি অরিজিন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গওয়েজ, বহুল পরিচয়ে যাকে সংক্ষেপে ‘ও-ডি-বি-এল’ বলা হয়। সে গ্রন্থখানি এগারোশো পৃষ্ঠারও বেশি, দু’ খণ্ডে এটি যে একটি গবেষণাগ্রন্থ, তা সহসা স্মরণেই থাকে না। ১৯৭১ সালে অবশ্য তিনি নিজেই এর কিছু সংশোধন করেন ও একটি তৃতীয় খণ্ডের সংযোজন করেন। এ গ্রন্থের নানা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হল এটি ভারতীয় এবং অ-ভারতীয় কিছু পণ্ডিতকে ওই আদর্শে অন্যান্য ভাষার বিশ্লেষণাত্মক ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাস রচনা করতে উৎসাহ দিয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখ করা যায়, গুজরাতি, আবধি, অসমিয়া, কোঙ্কনি, মৈথিলি, ভোজপুরি এবং ওড়িয়ার। এই সাতটি ভাষার মধ্যে তিনটি ভাষার সাহিত্যিক স্বীকৃতির পিছনে সুনীতিকুমারের সক্রিয় সহযোগিতা ছিল; এদের চর্চার পক্ষে এই ধরনের বিশ্লেষণাত্মক ভাষাগত ইতিহাস রচনা বিশেষ সহায়ক হয়েছিল এবং তা সম্ভব হয়েছিল সুনীতিকুমারের যুগান্তকারী গবেষণাগ্রন্থটি প্রকাশের পর। অধ্যাপক মিচেল একদা লীডসের এক পণ্ডিত সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘যে ভারতবর্ষে যাস্ক, পাণিনির উদ্ভব, আজও সেখানে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আছেন, সে দেশের ছেলেমেয়েরা ভাষাতত্ত্ব শিখতে কেন যে বিদেশে আসে তা আমি বুঝতে পারি না।’ প্রসঙ্গত, অন্যান্য বিদেশি পণ্ডিতরাও যাস্ক, পাণিনি ও সুনীতিকুমারের নাম পর পর উচ্চারণ করেন, কারণ শেষোক্তের গ্রন্থটিও একটি ভারতীয় ভাষাকে আদ্যন্ত জানবার পথ খুলে দেয়, যেমনটা দিয়েছিল নিরুক্ত ও অষ্টাধ্যায়ী— ভিন্ন ভাবে।
তাঁর এই গবেষণাগ্রন্থটি নামে বাংলা ভাষার বিবর্তনের বিবরণ, কিন্তু প্রসঙ্গত ভারতবর্ষের সব প্রদেশের ভাষা থেকে এত প্রচুর উদাহরণ দেওয়া হয়েছে যে কার্যত এটি নব্যভারতীয় ভাষাগোষ্ঠীর বিবর্তনের ইতিবৃত্তে পর্যবসিত হয়েছে। এত সম্পূর্ণাঙ্গ ভাষার ইতিহাস পূর্বে বা পরে কোনও ভাষাকে অবলম্বন করেই রচিত হয়নি। শিক্ষক ঝু্যুল ব্লখের আদর্শ সামনে রেখে এটি রচিত। কিন্তু সে আদর্শকে বহুদূর অতিক্রম করে গেছে সুনীতিকুমারের গ্রন্থ। কোনও ভাষার ইতিহাসেই লিপির বিবর্তনের উল্লেখ থাকে না। এ গ্রন্থে তা আছে। বাংলা ভাষার পরিপোষক যে সব ভাষা যেমন দ্রাবিড়, অভি-অস্ট্রিক, কোল, মুন্ডা, সাঁওতালি, এগুলিও এতে উল্লিখিত ও আলোচিত। এতে আরও আছে ছন্দের আলোচনা, ধ্বনিতত্ত্বের পক্ষে স্বরাঘাতের বিবর্তনের দিক থেকে যা অত্যাবশ্যক; কিন্তু কোনও ভাষার ইতিবৃত্তে এ আলোচনা থাকে না। পণ্ডিত গ্রিমও এ-সম্বন্ধে নীরব ছিলেন, সুনীতিকুমারই প্রথম এ সম্বন্ধে আলোচনা করলেন। একটিমাত্র গ্রন্থের পরিসরে একটি ভাষার স্বরূপ সম্যক ভাবে বোঝবার জন্যে যা কিছু জানা প্রয়োন তা সবই এতে স্থান পেল এবং একটি ভাষাকে সম্যক ভাবে জানার জন্যে আনুষঙ্গিক কী কী জানার প্রয়োজন তারও প্রথম সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়ে গেল এ গ্রন্থে। এতগুলি কারণে এবং এতে বিধৃত তথ্যের অবিশ্বাস্য সম্ভারে এ গ্রন্থটি এখনও পৃথিবীর ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে অনন্য রয়ে গেছে।