পথবর্তী

পথবর্তী

ঘরে আর কেউ নেই।

মালতী জিনিসটা এপিট-ওপিট করে বল্লে, আহা এটা কী দিয়ে তৈরি বলুন তো?

সুব্রত ঢালটি পরীক্ষা করে বললে, নিশ্চয় লোহা।

মালতী খিলখিল করে হেসে উঠল, হাসতে হাসতে বল্লে, মোটেই নয়, তার ধার কাছ দিয়েও নয়। এটা গন্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি। দেখতে ঠিক লোহার মতো মনে হয়, না?

সুব্রত বিস্ময়ের স্বরে বললে, হ্যাঁ, কিন্তু এ দিয়ে গুলি ফেরানো যায়?

-হুঁ খুব যায়। গন্ডারের চামড়া যে খুব শক্ত এটা জানেন না?

-জানি।

—তার চেয়েও শক্ত এটা। জলে ভিজিয়ে রোদে শুকিয়েছে, একেবারে লোহার মতো হয়ে গেছে। এগুলো আগে আরও অনেক ছিল, হাতে হাতে কতকগুলি নিখোঁজ হয়ে গেছে, এখন এই কয়টি মাত্র আছে। মালতী ঢালটি আবার নেড়েচেড়ে বললে, মনে করুন এর মধ্যে কতগুলি এসে লেগেছে, কত লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছে এটা।

সুব্রত বললে, অনেক ক্ষেত্রেই এর প্রাণ বাঁচানোর কোনো অর্থই হয়তো নেই মালতী। ধরো, এখন যারা আত্মরক্ষা করে এটা দিয়ে অথচ নীতি তাদের ভালো নয়, হয়তো পাজি, অত্যাচারী তখন সেই আত্মরক্ষার পক্ষে কী অর্থ হতে পারে?

-মানে তখন ওর কোনো মূল্যই নেই?

-একেবারে ভুল! মালতী হাত নেড়ে বললে, জীবন রক্ষা তা শত্রু-মিত্র যারই হোক, বা যে কোনো রকমের হোক—শেষ পর্যন্ত জীবনের রক্ষাই। সুকৃতি দুষ্কৃতির মূল্য, সেটা মানুষের দাবি, তারই নিজস্ব ব্যাপার, তাতে এই ঢালের কী এসে যাবে। এর যা মূল্য আছে, আছেই। তেমনি মানুষের বেলায়।

মালতী মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে কথা বলে বটে। সুব্রত এতে একটুও আশ্চর্য হল না এবং হেসে বললে, তুমি ভুল করছে। যে একটা খারাপ কাজ করছে তাকে জেনে-শুনে সহায়তা করলে প্রশ্রয় দেয়া হয় জানো?

-হুঁ। তাতে আমার কী এসে যাবে?

-এসে যাবে এই যে, তুমিও তার ফল ভোগ করবে। কারণ, একটা পাপকে প্রশ্রয় দিয়েছো।

মালতী হাঁ করে তার দিকে কতক্ষণ চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল, কিছু বলল না।

বেশি রাত না হলেও চারদিক প্রায় নিস্তব্ধ।

এমন সময় ব্রজকিশোর বাবুর ডাক শোনা গেল। মালতী ব্যস্ত হয়ে বললে, আপনাকে বাবা ডাকছেন চলুন।

একটা বড়ো ঘর। পুরোনো আসবাবপত্রে ভরা। দেয়ালে বড়ো বড়ো ছবি, সোনালি কাজ করা ফ্রেম দিয়ে আটা। বেশির ভাগই রবি বর্মার—আর কয়েকটি বিদেশি চিত্রকরের আঁকা। ছাদের সঙ্গে যুক্ত কয়েকটি অকর্মণ্য ঝাড়। ঘরের আলোটা-তেলের প্রদীপটাও দেয়ালের গায়ে। মেঝেটা আয়নার মতো চকচক করে। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। একপাশে প্রকান্ড পুরোনো দিনের খাট—তাতে খুব পুরু বিছানা—ধবধবে চাদর। সেখানে একটা মোটা তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে ব্রজকিশোরবাবু বসেছিলেন। তাঁর মাথায় চুল বেশি নেই, খুব ছোটো ছোটো করে কাটা, মুখটা বড়ো, বড়ো একজোড়া গোঁফ, শরীরের চামড়া ঢিলে হলেও খুব বলিষ্ঠ। গায়ের রঙ খুব ফর্সা।

তিনি চোখ বুজে বসেছিলেন। সুব্রত যে এসেছে টের পাননি।

সুব্রত বললে, আমাকে ডেকেছিলেন?

ব্রজকিশোর বাবু চোখ মেলে বললেন, হ্যাঁ। একা বসে আছি তাই মনে হল সুব্রতকে ডেকে না হয় কতোক্ষণ গল্প করি। কোনো কাজ ছিল?

–না কাজ আবার কি? এখানে এসেও যদি কাজ থাকে তাহলে তো মুস্কিল। ব্রজকিশোর বাবু হেসে বললেন, কেন ধরো চিঠিপত্র লেখা, পড়াশুনো করা। ও কী–বসো।

সুব্রত বিছানার একপাশে বসল।

ব্রজকিশোর বললেন, পুজো আসছে অথচ এখন মনে হচ্ছে না পুজো বলে কিছু আছে! এমনি দিনকাল। মানুষ কী করবে? আগে খাবার, তারপর তো কাজকর্ম!

সুব্রতও আশ্চর্য হল একথা শুনে। প্রাচীন—বিশেষত যাঁরা ধর্মপ্রাণ তাঁদের মুখে এমন কথা বড়ো শোনা যায় না।

ব্রজকিশোরবাবু বললেন, মানুষের এইসব হৃদয়বৃত্তির মূলে, এটা তো জানো, অনেক শ্রদ্ধা-ইচ্ছা থাকে, কাজেই যখন এগুলোও কোনো অনিবার্য কারণে বন্ধ হয়ে যায় তখন ওপর থেকে কোনো অভিশাপের ভয় নেই—কী বল? অথচ অনেকে এটা বোঝে না। আর এ তো সহজ কথা, যেখানে আমারই বিস্তর প্রয়োজন, অথচ সেই সব অনুষ্ঠান আমাকে বাধ্য হয়ে বন্ধ করতে হল সেখানে তো আমার নিজেরই ক্ষতি। এই বলেও একশ্রেণির লোকদের বোঝানো যায় না। ওরই তো এই দোষ। কত বলি…

সুব্রত বললে, প্রত্যেক মেয়েরই এই দোষ।

—ঠিক বলেছ। এটা যেন তাদের বদ্ধমূল সংস্কার। যদিও আমার কিছু আসে যায় না তাতে। তবে কালের প্রভাবে মানুষের জীবন পদ্ধতি অমনভাবে বদলে যাওয়ায় আমাদের অভ্যস্ত চোখেও ওসব ঠেকে। বিশেষত আমার স্বভাবটাই হচ্ছে তাই। যা নতুন কিছু মঙ্গল আসবে তাকে অবহেলা করি না, বরং প্রসন্ন মনে গ্রহণ করি। বিশ্বাস কর।

-হ্যাঁ। কিন্তু অনেক সময় তখনকার অবস্থানুসারে সব নতুনকেই মঙ্গল বলে মনে হয় না।

-তা ঠিক—ব্রজকিশোরবাবু বাইরের দিকে চাইলেন। এই দৃষ্টির ভিতর দিয়ে যেন কোনো দূরাতীতে তিনি চলে গেলেন। বললেন, তা ঠিক। নইলে মাইকেল যা লিখেছেন তা দিয়ে জীবিতকালে তিনি এতটুকু খ্যাতি বা প্রশংসা পাননি—এবং অনেক কটুক্তি সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু পরে—মরবার পর মানুষ তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধায় স্বীকার করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেনি। অথচ বেঁচে থাকতে খুব কম লোকই তাঁকে বুঝল। আমরা তাঁর কাব্য পড়েছি ছোটোবেলায়। ইস—সে কী ভালোই না লেগেছে। ওই যে কী বলে—

রুষিলা বাসবত্রাস! গম্ভীর যেমতি নিশীথে অম্বরে মন্দ্রে জীমূতেন্দ্র কোপি, কহিলা বীরন্দ্র বলী— চমৎকার না?

–হ্যাঁ।

ব্রজকিশোরবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, কাব্যের কথায় এসে পড়ল কবির কথা। আমার বাবা, জানো, তিনি কবি ছিলেন—অনেক কবিতা লিখেছিলেন। লোককে কত গান বেঁধে দিয়েছেন তিনি। তাঁর প্রায় সব লেখাই আমার কাছে আছে। একদিন দেখো তুমি। তোমাদের যারা লেখে টেখে তাদের অনেকেই এই গুণটি বংশানুক্রমিক পায় শুনি—কিন্তু আমার বেলায় এর ব্যতিক্রম দেখলে, না?

তিনি সুব্রতর মুখের দিকে তাকালেন।

ব্রজকিশোর বাবুকে যারা ভালো জানে, তারা কখনই কথার শেষে তাঁর না-র প্রয়োগ দেখে বিস্মিত হয় না কারণ এটা জানা, তাঁর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে না উক্তি কোনো মতামতের অপেক্ষা না রাখলেও সর্বদা প্রযুক্ত হবে।

সুব্রত বললে, ওটা যে বংশানুক্রমিক সম্পত্তি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তা সত্যি নয়। তাই আপনি যে ব্যতিক্রম হবেন, তাতে–

-তাতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই, এই তো? ব্রজকিশোরবাবু হাসতে লাগলেন। বললেন, ঠিকই, ওটা কখনোই সত্যি নয়, নইলে রামের ছেলে রামই হত। আমার বাবা যা করেছেন তা তোমাদের কাছে রূপকথার মতো মনে হবে। সে এক বিস্ময়কর ইতিহাস। যুগ অনেক রকম হয়, আমাদের সময়ের সঙ্গে তোমাদের সময়ের মিল নেই। তোমরা যা পেয়েছে আবার আমরা তা পাইনি। এ যেন বিকেলের মেঘ, ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে রং। কিন্তু আমার–

সুব্রত সাগ্রহে বললে বলুন।

ব্রজকিশোরবাবু গম্ভীর স্বরে বললেন রাতারাতি অনেক লোক মেরে আবার তা লুকিয়ে চাপা দেবার কাহিনি শুনেছ?

সুব্রত শিউরে উঠল।

—আজকাল একে বলে বর্বরতা, কিন্তু তখনকার দিনে কী বলতো জানো? আভিজাত্য সম্মান। ব্রজকিশোরবাবু এক বিকট হাসি হেসে বললেন, তোমাকে আগেই বলেছি সময়ের সঙ্গে সব কিছু বদলাচ্ছে। একদিন যা নিজের হাতে করতে পেরেছি আজ তা ভাবতেও পারিনে-না, না, পারব না কেন, খুব পারি। জানো, মানুষের দৈহিক আবরণের ভিতর একটা পশু লুকিয়ে আছে। হিংস্রতা আর কাকে বলে!

বিস্ময়ে তাঁর বলিষ্ঠ দেহের দিকে সুব্রত চেয়ে রইল।

-হিংস্র আর কাকে বলে! পদ্মাপারের মানুষ আমরা। সয়েছি ওর চিরক্ষুধার রাগকে। সব বুকে পেতে নিয়েছি। তারপর দিনের পর দিন ওর রাগকে হজম করে একদিন আশ্চর্য হয়ে দেখতে পেলাম, আমার চারদিকে কেবল রক্ত আর রক্ত। ওরে বাবা, সে কী লাল রক্ত! ব্রজকিশোর তাঁর চেহারার এক অদ্ভুত ভঙ্গি করে বললেন, তখনও বাবা ছিলেন বেঁচে। জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কী? উত্তর এল, কাশিমপুরের দাম্ভিক জমিদারের লাঠিয়ালদের মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে—তাইতেই এত লাল—কিন্তু কিছু নয় ব্রজ। কালই এই রক্তরাঙা পথে উড়বে ধুলো, ধূসর বর্ণের রোজকার মতো বইবে মেঠো বাতাস—সেই সঙ্গে যদি চাও শুনতে পাবে বৈরাগীদের আধ্যাত্মিক তত্ত্ব মেশানো গান। কিন্তু পদ্মার গর্জন নয়-কে আর কী করবে বল?

সুব্রত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেবল বললে, তারপর?

—তারপর যা কথা তাই! তোমাকে একদিন দেখাব একাটা জিনিস—

এমন সময় মালতী ঘরে ঢুকে সুব্রতর কাছে এসে বললে, আপনাকে মা ডাকছে।

ব্রজকিশোর বাবু একটু উষ্ণ হয়ে বললেন, একটা আলাপ করছি দেখতে পাচ্ছো-আবার ডাকাডাকি! কেন আর কি সময় নেই!

–খাবার যে তৈরি!

–ও, সুব্রত তুমি খাওনি?

সুব্রত নীরবে হাসল। ব্রজকিশোর বাবু মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, যাও একটু পরে আসবে। বলোগে।

মালতী চলে গেল।

—কত কাহিনি আছে। সে সব বলতে গেলে সময়কে পাওয়া যাবে না খুঁজে —নিজেকে হারিয়ে ফেলতে হবে অতীতের কোঠায়। তুমি অনুভব করবে—তার চেয়ে অনেক বেশি অনুভব করব আমি। সুব্রত, আজ তোমার সাথে বসে আমি গল্প করছি, কিন্তু পনেরো বছর আগে কী এমনিই ছিলাম? আমি যদিও বদলে যাইনি কিন্তু আমার চার দিকে আবহাওয়া বদলেছে।

-আপনার পাওনা আমরা কী করে কেড়ে নিতে পারি?

ব্রজকিশোর হেসে বল্লেন, তা কেমন করে বিশ্বাস করি বল? আর আমাদের মনের কথা তোমরা কী বুঝতে পারবে? কখনো-না।

—আমাদের মনের কথাও আপনারা বুঝতে পারেন না।

-তা কেমন করে পারব হে? তোমাদের সঙ্গে আমরা দৌড়োতে কী পারি? ব্রজকিশোরবাবু আবার খুব হাসতে লাগলেন। হঠাৎ আবার গম্ভীর হয়ে বললেন, তারপর কী বলছিলাম? পনেরো বছর আগের ব্রজকিশোর রায়চৌধুরীর কথা না?

সুব্রত দেখতে পেল, অদূরে উপবিষ্ট ওই মানুষটির মনের দুঃখে চোখ এখন নিজের বিগত আত্ম-ইতিহাসের পাতায়—যেখানে মহিমা উজ্জ্বল পূর্বপুরুষের ছায়া; হয়তো নিষ্ঠুর বর্তমান তাঁকে দিচ্ছে ব্যথা, অপমান।

ব্রজকিশোরবাবু বললেন, সেই পদ্মার কথা না? কী জানো, শহরের এই ইটের স্কুপের আড়ালে বসেও আমি যেন পদ্মার ডাক মাঝে মাঝে শুনি, আমাকে সে ডাকে। তাই একসময় ইচ্ছে হয় সব ফেলে চলে যাই আবার সেখানে। নিজেকে খাপ খাইয়ে নিই, সেখানে গিয়ে নিজেকে অনুভব করি। এখানে বিষাক্ত বাতাস, আমার শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। সব সময় মনে হয় রায়চৌধুরীর মৃত্যু হয়েছে—এ যে একাট সাদা কঙ্কাল!

–তবে আবার সেখানে ফিরে যান না কেন? ব্রজকিশোরবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, সাতবার আমাদের বাড়ি পদ্মা নিয়েছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি চারবার। বাড়িতে সে কত মহল, কত ঘর-দুয়ার! শুনে আশ্চর্য হবে, এক ঘরে বন্দুকের আওয়াজ করলে অন্যদিকের আর একটি ঘরে কিছুই শোনা যেত না। এত ঘর যে অচেনা কাউকে সেখানে ছেড়ে দিলে বার হতে কষ্ট হত। কিন্তু তাতে পদ্মার কী আসে যায়? এবং বড়ড়ার উপর লোভ তার বেশি। অনেক দিনের পরিশ্রমে তৈরি ঐশ্বর্যকে তাই একরাতে টেনে নিলে। সেই রাতটি আমার এখনও মনে আছে।

—তবু তো পদ্মাকে ভালোবাসেন?

—নিশ্চয়। ধ্বংস করতে যার পরিতৃপ্তি—ধ্বংস হতেও যে তার এতটুকু ভয় নেই। জন্ম হতে যার সঙ্গে দিন কাটিয়েছি, যাকে ভেবেছি স্বভাবমিলের বন্ধু—তার দেওয়া ক্ষতি সহ্য করতে পারব না এমন অহংকার আমার নেই। কিন্তু এই দ্যাখো, তুমি যে খেতে যাবে এটা ভুলেই গেছি। যাও—এই বলে ব্রজকিশোর বাবু চুপ করলেন।

সুব্রত ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের বারান্দায় এল। সেখানে গভীর অন্ধকার, নিস্তব্ধতা। চৌধুরীদের সমস্ত প্রতাপ সমৃদ্ধি যেন ওই সীমাবদ্ধ! সুব্রতর হাসি পেল, কিন্তু হাসতে কষ্ট হল।

এই অন্ধকার হেঁটেই গেল। একটি ঘরে আলো জ্বলছে। সে সেখানে গিয়ে দেখতে পেল, ঘরে কেউ নেই। গলা বেশি উঁচু না করেই সে ডাকল—

–মাসিমা–মাসিমা—

–এসো।

স্বর লক্ষ করে সুব্রত খাবার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হল। লীলাবতী তার অপেক্ষায় বসে আছেন। কাছেই মালতী।

-আপনি আমার জন্য অনেকক্ষণ বসে রয়েছেন!

লীলাবতী কোনো উত্তর না দিয়ে একটু হেসে বসতে বললেন।

পিড়িতে বসে সুব্রত বললে, অল্প দেবেন। আমার কিন্তু খিদে নেই।

রাত বেশি হচ্ছে বলে লীলাবতী পঞ্চুর মাকে বিদায় করে দিয়েছেন। বাড়ির মধ্যে ওই একটিমাত্র ঝি। তিনটি প্রাণীর সংসারে এর চেয়ে বেশি লীলাবতী চান না। তা ছাড়া রান্না করা আর খাওয়ানো তাঁর বিশেষ কাজ, নিষ্ঠার তৃপ্তি। সুব্রত তাঁর বাপের বাড়ির গাঁয়ের অতি দূর সম্পর্কের। হয়তো বা আত্মীয়তার চেয়ে অনিষ্টতাতেই সেখানে সম্পর্কের সৃষ্টি—এক বোনের ছেলে। এখন বিদেশে থাকে। অনেক বছর পর এসেছে। বড়ো হয়ে এই প্রথম তার লীলাবতীর সঙ্গে ভালো করে পরিচয়।

এখানে আসবার পর কয়েকটা দিন কেটেছে।

মালতী বললে, সে কী! খোট্টার দেশে ডালরুটি খেয়ে খেয়ে মুখ ফিরিয়ে এখন নিজের দেশে বসে খিদে বরং বাড়বে যে!

সুব্রত মুখ তুলে হেসে বললে, না মালতী। সেখানে বদহজম হয়ে গেছে। তাতে যে খিদে একেবারেই থাকে না।

-তাই হবে।

লীলাবতী এবার মালতীর দিকে চেয়ে বললেন, তুই আবার ওর কথায় সায় দিয়ে বসলি? ওর না-খাওয়ার অজুহাতকে প্রশ্রয় দেয়া হল না?

মালতী অপ্রতিভ হল।

সুব্রত বললে, অজুহাত মোটেই নয়। বিশ্বাস করুন মাসিমা আজ আমার সত্যি খিদে নেই।

–আচ্ছা সে কথা পরে হবে।

–পরে হবে মানে? ব্যাপারটা যে এখনেরই! সুব্রত হেসে উঠল।

লীলাবতীও হেসে বললেন, সুব্রত, ছোটোবেলায় তোমাকে দেখেছি যে উলটো?

–দেখুন মাসিমা ছোটোবেলা এমন একটি বয়েস যার গায়ের রঙ আর কোনো কালের রঙের সঙ্গে মেলে না। শুনেছি তখন কেবল নদীর দিকে ছুটে যেতাম। কিন্তু এখন জল দেখেই ভয় হয়, সাঁতার জানিনে! একেবারে উলটো।

-কি বল? তাহলে একেবারে খোট্টাই হয়ে গেছো দেখছি!

—কতকটা বটে। লীলাবতী একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, তাহলে জলপথে বেড়ানো তোমার পক্ষে ভালো নয়।

–তা বটে।

এরপর কতক্ষণ চুপচাপ। সুব্রত মুখ নীচু করে নিঃশব্দে খেতে লাগল।

মালতী হঠাৎ বললে, ও কথা সব সময় সত্যি নয় মা। আমি এমন অনেক দৃষ্টান্ত দিতে পারি যেখানে খুব ভালো সাঁতার জেনেও জলে পড়ে মরেছে। তোমার

কী মনে নেই মাসেই

-তা জানি। কিন্তু সেটা হল অদৃষ্টের কথা। সাঁতার জানলে একটা আশা অন্তত থাকে তো?

মালতী কোনো উত্তর না দিয়ে অনির্দিষ্টভাবে চেয়ে রইল। তার এমন হয়, মাঝে মাঝেই হয়, পূর্ণ উদ্যমে একটা আলোচনায় যোগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত আর টিকে থাকতে পারে না, ভেঙে পড়ে। কিন্তু সে নিজেও বুঝতে পারে তার এই স্বভাবের দুর্বলতা এবং এটা খুব বেশি দিনের অর্জিত নয়—সুব্রত আসার পর থেকেই। অথচ আলোচনার মাঝে ভেঙে পড়ায় সুব্রতর সঙ্গে যে কী সম্পর্ক সেটাও বিবেচ্য এবং এটা যেন একটা মিষ্টি স্বপ্ন। মালতী দেখে, এই স্বপ্নের রাত সবে শুরু হয়েছে। মালতী একটা কোমল প্রার্থনায় উল্লসিত হয়ে ওঠে : হে ঈশ্বর, এই রাতের উত্তরীয়কে মেলে দাও অশেষের দেহে।

তার আকস্মিক অন্যমনস্কতার কারণ যদি কেউ খোঁজে তবে এখানেই হয় তো একটু আলোর রেখা পাওয়া যেতে পারে, হয়তো পারে না, কারণ এখনও মালতী স্থির নিশ্চয় নয় সে কোনো ভিন্ন পথে চলেছে কি না, সে পথে তার একা চলায় সেই রাতটির সান্নিধ্য আছে তো!

কীসের সেই স্বপ্ন?

মালতীর অন্যমনস্কতা বেড়ে চলে। অথচ কোথায় গিয়ে শেষ হবে তার স্থিরতা নেই। চাইবার নির্দিষ্ট স্থানে সেখানে দৃষ্টির ক্লান্তি আসবে তার অক্লান্ত অন্যমনস্কতায় চোখের কার্যক্ষমতা শতগুণ বেড়ে যাবার কথা, এ ব্যাপারটা ভাববার এবং কাজে লাগাবার অবসর তার আছে। তাই দুপক্ষের গাম্ভীর্যনিবিড় নিস্তব্ধতায় মালতী তার স্বপ্নের পথ দিয়ে এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছোল যা সুব্রতও গভীরভাবে চেয়েছে।

সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। খাওয়ার পর শোবার ঘরে ঢুকবার সময় সুব্রত দেখল অন্ধকার বারান্দায় যে মেয়েটি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, সে মালতী।

সুব্রত কিছুমাত্র আশ্চর্য না হয়ে বললে, তুমি?

-হ্যাঁ।

–আচ্ছা মালতী, একটা কাজ করবে?

–বলুন।

-আমার একটা অভ্যাস—ঘুমুবার আগে বই না পড়লে বা কাছে বসে কেউ গল্প না করলে ঘুম হয় না। আপাতত বই যখন নেই তখন তুমি একটু গল্প করবে?

এ ছাড়া আর উপায় নেই তবু নির্লিপ্তভাবে মালতী বললে, আচ্ছা।

সুব্রত তার হাত ধরল—যদিও হাত ধরার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। এবং দুজনে একসঙ্গে ঘরে ঢুকল। সুব্রত ঘুমুবার চেষ্টা না করে বসল একটা চেয়ারে, মালতী তার বিছানায়।

আগের সহজতা যদি ফিরিয়ে আনা যেত তবে মালতী যে কাউকে মনেপ্রাণে আশীর্বাদ করত। সুব্রত বললে, ছুটি ফুরিয়ে এল। এখন না-যাওয়াকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না।

এইবার মালতীর চমকে ওঠা অস্বাভাবিক নয়, সে বললে, কী বললেন?

–বোধ হয় পরশু চলে যাব। এখানে অনেক দিন রইলাম। জীবনে একটা পরিবর্তন হল। কয়েকটি আপনার মানুষকে চিনতে পারলাম তাদের ভালো লাগল। এখন পশ্চিম মরুভূমিতে ফিরে গিয়ে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়ত আর হবে না—ঠিক সেখানেই মুশকিল। উপায় যদি থাকত তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম।

হঠাৎ এ কথার কী মানে মালতী তা বোঝে। তাই অভ্যাসমতো অনির্দেশ তাকাতে লাগল–দেখল, ওপরের দিকে, ফটোতে, মেঝেতে, চারদিকে। তারপর যখন তার এই অভ্যাসের সাময়িক সমাপ্তি হল সুব্রতর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়ে, তখন সে একপলক হেসে বললে, ঠিক নিয়ে যাবেন তো? তাহলে বাবাকে বলি?

-বলো।

—সেখানে কিছু দেখবার আছে?

—অনেক কিছু। কিন্তু তুমি কী সে সব দেখবে? যেন সেখানে তারা ইতিমধ্যে চলে গেছে এভাবে সুব্রত বললে।

—না।—স্পষ্ট এই বলে মালতী তার কাপড়ের আঁচল এমনি পাকাতে লাগল।

সুব্রত তার হাতের দিকে চেয়ে রইল। সুন্দর, নিটোল, ফর্সা, অনেকগুলি চুড়িতে ভরতি আঙুলগুলো সরু, শীর্ণ-কথার সঙ্গে এঁকে বেঁকে নড়ছে।

সে বললে, ভারী সুন্দর তো! দেখি তোমার হাতখানা। মালতীর চোখে বিস্ময় নেমে এল। ধীরে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ক্ষণেক পরে সে অনুভব করল : একটি আলোর রেখা যেন তার হাতের লোমকূপ দিয়ে প্রবেশ করে শরীরের অণু-পরমাণুতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

এখন বোধ হয় শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্রীকে আক্রমণ করেছে, নইলে শ্বাস ফেলতে কষ্ট হয় কেন? সে স্তব্ধ হয়ে তার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সুব্রত বলেল, তুমি খেয়েছো? যাও—

বিছানার উপর হাত দুটো আরও ছড়িয়ে আরও চেপে বসে মালতী বললে, মার সঙ্গে খাব—আপনার এখন ঘুম আসবে না আমি জানি।

–সেটা তো তোমারই আগে জানবার কথা।

কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে মালতী হেসে বললে, বারে আপনি আবার তা জানলেন কেমন করে?

সুব্রত সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে বললে, মালতী, আমার সত্যি বড়ো ঘুম পাচ্ছে। তুমি এনে দেবে তাতে একটা স্বপ্ন?

হে মালতী!

স্বপ্নাঞ্চল মেলে ধরো আমার চোখেতে!

মালতীর দু-চোখ কী এক স্নিগ্ধতায় নিবিড় হয়ে উঠল। সে একুট ঝুঁকে পড়ল।

কোনো এক অলিখিত কাব্য টুকরো টুকরো হয়ে সেই ঘরের বাতাসে শূন্যতায় গভীরভাবে মিশে গেল।

আলোর রেখাগুলো যেন কাঁপতে লাগল।

–মালতী—ও মালতী–

লীলাবতী এসে ভয়ানক চমকে উঠলেন। মালতী তার রেশমের মতো হালকা, মসৃণ খোলা চুলগুলি খোঁপায় ঠিক করতে করতে মার কাছে এসে মুখ নীচু করে দাঁড়াল।

বাইরের দুরন্ত বাতাস ঘরে এসেও মাতামাতি করছে। সুব্রত একা নিদ্রাহীন বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইল। তার মনে হল : ব্রজকিশোর বাবুর মতো সেও যেন আজ কোন আর এক পদ্মার প্রবল কলোচ্ছ্বাস শুনতে পাচ্ছে।

যখন সে জাগল তখন একটু বেলা হয়ে গেছে। অনেকখানি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে বিছানার। সে ব্রজকিশোরবাবুর উঁচু গলায় স্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণ শুনতে পাচ্ছে।

লীলাবতী গম্ভীর প্রকৃতির মেয়ে। কিন্তু চিরকালই ঠিক এমনি ছিলেন কি না তা অজ্ঞাত। আজ কতোদিন হয় কে জানে—আশ্চর্য ব্যাপার-স্বামীর সঙ্গে তাঁর এতটুকু কথা পর্যন্ত হয় না। ছোটো চৌধুরী পরিবারে এ নিয়ে কোনো অসুবিধে বড়ো দেখা যায়নি। এবং এত সহজ যে, যে কেউ প্রথম এলে তার চোখে এটা ধরা পড়বে না, যে পর্যন্ত না কেউ বলে!

এমনিও দেখা যায়, লীলাবতীর আত্মমর্যাদাবোধ বড়ো প্রখর। বোধ হয় তাতে কোনোদিন কোনো আঘাত লেগেছিল এবং সেইজন্য তিনি তাঁর নিজের স্বামীকেও সইতে পারেননি।

কিন্তু এতদিন সাংসারিক সব কিছু অভাব-অভিযোগ, ত্রুটি একা নিজের মনেই বিচার করে সফল হয়েও আজ সত্যি জটিলতায় পড়ে পথ হারিয়ে ফেললেন, তারপর সারারাত ভেবে কোনো কুলকিনারাই পেলেন না।

এখন অনেক বেলা হয়েছে। লীলাবতী কাজের ফাঁকে কেবল ভাবতে লাগলেন। এরকম মানসিক দ্বন্দ্বে সারাজীবনে আর পড়েননি।

শেষে একটা উপায় স্থির হল।

তখন দুপুরবেলা। বাইরে রৌদ্র খাঁ-খাঁ করছে। চারিদিকে অখন্ড নিস্তব্ধতা।

লীলাবতী যেভাবে সাধারণত থাকেন সেভাবেই ঘোমটা দিয়েই ব্রজ কিশোরবাবুর ঘরে ঢুকলেন। কতোদিন পর এই প্রথম তাঁর এ ঘরে আসা এবং কথা বলা!

কিন্তু ব্রজকিশোর বাবু আশ্চর্য হলেন না। যেন সব সময়েই কথাবার্তা হয় এমন ভাবে অথচ গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, কোনো কথা আছে?

–হ্যাঁ। লীলাবতীর কোনো ভূমিকার প্রয়োজন ছিল না, তিনি সহজভাবেই বললেন, মালতীর বিয়ের তো কিছুই করা হচ্ছে না?

-পেলে তো হবে।

—আমি বলি সুব্রতর সঙ্গে—

ব্রজকিশোর বাবুর চোখদুটি বড়ো হয়ে উঠল।-কী বললে? নলহাটির চৌধুরীদের মেয়ের বিয়ে হবে একটা সামান্য…তোমার আত্মীয় বলে জাত খোয়াতে যাব? অর্থ-অসামর্থ্যের সুযোগ নিচ্ছ? মেয়েকে জলে ভাসিয়ে দিলেও তা হবে না, কক্ষনো না, মরে গেলেও না। অতিথিকে আদরযত্ন করা মানেই কী তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেয়া?

–দেয়ার কারণ ঘটেছে বলেই বলছি।

ব্রজকিশোরবাবু প্রথম একটু আহত হয়ে পরে আবার কঠিন স্বরে বললেন, যা ইচ্ছে ঘটুক, তুমিই একমাত্র সেটা জানো, লোকের মধ্যে রটে গেলে তুমিই সেজন্য দায়ী থাকবে। কিন্তু তাও যদি হয় তবু ওর সঙ্গে আমি মেয়ের বিয়ে দিতে পারব না, দেব না জেনো। রায়চৌধুরী বংশের এমন অপমান করলে পূর্বপুরুষেরা অভিশাপ দেবেন। আমি ঠিক জানি তাঁদের মৃত আত্মা শান্তি পাবে না।

লীলাবতী সেখানে আর এক মুহূর্ত না থেকে নিজের ঘরে এসে দরজা দিলেন। মেয়ের কথা মনে করে আজ অনেক দিন পরে এই প্রথম তাঁর দুচোখ ছাপিয়ে কান্না এল।

পরদিন।

সুব্রত ঠিকই চলে যাচ্ছিল। জিনিসপত্র সঙ্গে তেমন কিছু নেই। যা আছে, ঠিক করা হয়েছে।

বারোটায় গাড়ি।

লীলাবতীর কচিৎ সাক্ষাৎ মিলেছে। আর মালতীর তো একেবারেই নয়। খাওয়া দাওয়ার পর সে ব্রজকিশোর বাবুর ঘরে এল।

তিনি বললেন, এখনও তো সময় আছে। বসো।

সুব্রত বসল।

—আমার ইচ্ছে তুমি পুজো পর্যন্ত থাকো।

-সে তো অনেক দেরি?

-তা হোক না। বাঙালির ছেলে পুজো না দেখতে পারলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্য কী আছে? তা ছাড়া আমরা তোমার পর নই। তুমি থাকলে কত আনন্দ হত। পূর্বপুরুষেরা যা রাজসিকভাবে করেছেন তাই কোনো রকমে চালিয়ে নিই আর কী! তখনকার দিনে যা হত তা শুনলে আশ্চর্য হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হবে না, এখন তো তার শতাংশের একাংশও নয়। আর একটা ব্যাপার শুনলে অবাক হবে–আমার বাবা এবং তাঁর পূর্বপুরুষেরা সকলে নিজেরাই দুর্গাপুজো করেছেন, কোনো বামুন পুরুত লাগেনি, আর এমন মন্ত্র জানতেন যা অনেক সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতেরাও জানেন না। অথচ আমি তাঁরই ছেলে। বংশানুক্রমিক গৌরব অর্জন না করার ধৃষ্টতা আমার আছে!

আরও অনেক কিছু বললেন ব্রজকিশোরবাবু। কতোক্ষণ পরে সুব্রত প্রণাম করে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল।

লীলাবতীকে পাওয়া গেল। কিন্তু কোনো রকমেই মালতীর দেখা পাওয়া গেল না।

সুব্রত স্টেশনে এল। টিকেট করে একটা নির্জন কামরা বেছে নিল। তারপর হুইসল দিয়ে গাড়ি ছাড়ল, শহরের সীমা ক্রমে বিলীন হয়ে গেল।

সুব্রত জানালায় মুখ রেখে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। দু-পাশে তখন মাঝে মাঝে জলচিহ্নাঙ্কিত খোলা মাঠ, ধু ধু করে। আরও দূরে একটানা গাছের সারি, মধ্যে উঁচু তালগাছ।

মাঠ ভরা মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্র ঝিম ঝিম করে।

সে এক টুকরো কাগজ নিয়ে লিখতে বসল। মালতীকে লিখতে লিখতে চোখে জল ভরে এল। সে কাগজটা তুলে জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে ছেড়ে দিল।

প্রবল বাতাসের বেগে সেই চিঠি পড়ল গিয়ে এক বাবলা গাছের ছায়ায়। প্রান্তর পার হয়ে সেখানে গভীর বনানী-অজস্র বুনো ফুলের গন্ধ, তার মাদকতা, বাঁশঝাড়ে কিচ কিচ আওয়াজ, পাখীর ডাকে মুখরিত আকাশ, হিংস্র প্রাণীদের নির্ভয় বিচরণ, আর নির্জনতার গন্ধে ভরপুর।

গাড়ি চলে গেল।

আর মালতীকে লেখা সেই চিঠি বাবলা গাছের ছায়ায় বসে বুনোফুলের গন্ধ শুকতে লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *