চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

পত্রের দ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি

পত্রের দ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি

কোনও বৃদ্ধ যদি প্রশ্ন করেন, ‘আজ কি বিয়ের দিন আছে?’ তাহলে কি আমরা মনে করব, তিনি এক বিয়ে পাগলা বুড়ো? আবার টোপর মাথায় পিঁড়িতে বসার জন্যে ছটফট করছেন। না, তা নয়। এই কলকাতায় যাঁরা দীর্ঘকাল বসবাস করছেন, তাঁরা জানেন, এই শহরে কত রকমের বাঁশ আছে। বাস একটি বাঁশ। বিয়ের দিন থাকলেই বিকেলের দিকে বাস, মিনিবাস সব উধাও হয়ে যাবে। সাতটার পর একেবারেই অদৃশ্য। প্রতিটি স্টপেজ থই থই! ক্লান্ত অফিসযাত্রী, ক্ষতবিক্ষত ছাত্রছাত্রী, ফ্যালফেলে মুখে আগমন পথের দিকে তাকিয়ে আছে। ওই বুঝি আসে, ওই বুঝি আসে। তিনি আর আসেন না।

ডেলিপ্যাসেঞ্জারদের পকেটে টাইম টেবল থাকে। শহরের অফিসযাত্রীদের নানারকম টেবল পকেটে অথবা মনে রাখতে হয়। যেমন পঞ্জিকা। বিয়ের দিন আছে কিনা মনে রাখতেই হবে। সেইমতো চারটের আগেই পালাতে হবে। যাঁর বিয়ে তাঁর তো কোনও সমস্যাই নেই। তিনি ফুলেল গাড়ি চেপে ফুরফুর করে চলবেন। সেদিনের ভি আই পি। বরযাত্রীদেরই বা সমস্যা কি? তাঁরা তো আমাদেরই সমস্যা। তাঁরাই তো আমাদের নড়বড়ে পরিবহন ব্যবস্থাকে একেবারে ফ্ল্যাট করে দেন।

যাঁরা চাকরির খোঁজ করছেন, তাঁদের যেমন প্রতিদিন মনোযোগ দিয়ে কাগজ পড়তেই হবে, যাঁরা চাকরি করছেন তাঁদেরও পড়তে হবে প্রাণের দায়ে। খবর তো সেই একই। শ্রীলঙ্কা সাঁতার কাটছে। বিমান ছিনতাই হয়েছে। আগুনে ট্রেন পুড়েছে। ডাকাতে বাস ধরেছে। ক্রিকেটের কোঁদলে ভারত ডিগবাজি খেয়েছে। হয় এটা, না হয় ওটা। শেয়ালের কুমির ছানা দেখানো। যে কারণে কাগজ খোঁজা তা হল, রাজপথে কোন কোন বিক্ষোভ মিছিল বেরোবে। দিবা দ্বিপ্রহরের পর ছোট বড় মিছিল বেরোবেই। বিজ্ঞাপন সংস্থার যেমন বিজ্ঞাপন বের করা কাজ, মিছিল সংস্থার তেমনি মিছিল বের করা কাজ। দাবির শেষ নেই, মিছিলেরও শেষ নেই। অনেকে ইচ্ছে করে মিছিলে যোগ দেন। কার দাবি, কি দাবি, মরগে যা, আমার জানার দরকার নেই। হজমের জন্য আমার হাঁটা দরকার। যে কোনও মিছিলে ঢুকে পড়ি। মিছিলের বেশ একটা ছন্দ আছে, তাল আছে, নির্বিঘ্নে মাইলের পর মাইল হাঁটার সুযোগ আছে। রাতের দিকে চনচনে খিদে হয়। ঘুমটাও ভালো হয়। তাছাড়া সময়টা বেশ ভালো কেটে যায়।

আবহাওয়ার খবরটাও জানতে হয়। একপশলা বৃষ্টি। প্রথমেই বসে যাবে সরকারি বাস। সরকারি বাসের শরীর ভালো নয়। সর্দিকাশির ধাত। পায়ে জল বসলেই সাতদিন আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারবে না। ট্রামের তো কথাই নেই। সেই কুকুরে কামড়াবার পর থেকেই জলাতঙ্ক। প্রাইভেট আর মিনি সাঁতার কাটার সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও কয়েক ইঞ্চি বর্ষণেই স্থলপথ জলপথ হয়ে যায়। কিছু কিছু প্রাণী যেমন উভলিঙ্গ হয়, এই শহরও তেমনি কখনও ডোবা কখনও ডাঙা। উভচয় প্রাণী না হলে চলাফেরার বড়ই অসুবিধে। অনেকেরই আক্ষেপ কেন মানুষ করলে ভগবান? এর চেয়ে ব্যাঙাচি করলে মন্দ হত না। যৌবনে ব্যাঙ। বার্ধক্যে থলথলে কোলা ব্যাঙ। অনায়াস বক্তৃতারও সুবিধে হত। এমন বক্তা জাত তো আর দুটি নেই। তড়াক করে একটা উঁচু জায়গায় লাফিয়ে উঠেই দশগ্যালন বক্তৃতা ঝেড়ে দিল। বন্ধুগণ বলে, ধর-তাই, বন্ধুগণের পাংচুয়েশান। কে যে কার বন্ধু। কথায়-কথায় ব্লেড ক্ষুর চলছে, ছুরি চলছে। এ ওকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, ও একে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

এই এক ঘিনঘিনে পরিবেশে, প্রজাপতি আঁকা চিঠি উড়ে আসে। শুভলগ্নে কুমার গন্ধর্বের সঙ্গে মধুলীনার প্যাঁপোর পোঁ। ডেবি ডামরি ডেকচি হাত ধরাধরি করে নেমে এল পথে। সেন্ট জর্জরিত সেন্ট চর্চিত মায়ের কোলে শিশুর ঘ্যানঘ্যানানি, মা নেউনতন্ন, মা নেউনতন্ন। কত্তা এমন ড্রেস মেরেছেন মনে হচ্ছে তিনিই আর দুর্গা বলে বসে যাবেন। তেড়েফুঁড়ে হয়তো ঢুকেই গেলেন শুভদৃষ্টির চাদরের তলায়। পিঁড়ে বাহনে ঝুলে থাকা ডাগর মেয়ে চোখ খুলে চিৎকার করে উঠল। ‘অ্যায় তুই আবার কে!’

সরি ম্যাডাম, জ্ঞান ছিল না। নেশার ঘোরে চলে এসেছি। ভেটারেন হাজব্যান্ড তো! মার মার। মেরে তাড়া। আবার বরাত ভালো হলে লেগেও যেতে পারে। দ্বোজপক্ষ, দ্বোজপক্ষই সই। যা দিনকাল পড়েছে, পিঁড়েতে পা ঠেকিয়ে ছেলেমেয়ের পিতাকে হয়তো শেষ কাঁচি মারবে, ‘অ্যায় যে মশা, নগদ আরও দশ হাজার ছাড়ুন। আমার এজেন্ট মাল গুণে সিটি মারলে তবে পিঁড়েতে চেপে বসব।’

‘বেয়াই মশাই, ছেলে কী বলে, এমন কথা তো হয়নি। একমাস আগে এগ্রিমেন্ট হয়ে গেল।’

বেয়াই ঘোঁত-ঘোঁত করে হেসে বললেন, ‘খেয়াল করোনি গুরু। লেখা ছিল, সেলসট্যাকস আর সারচার্জ এক্সট্রা।’

আজকালকার আবার পাড়ার ‘যুবনেতারা’ বরবউকে আটক করে রেখে দেয়। শীতলাতলায় বসিয়ে রেখেছে রাতজাগা দুটি প্রাণীকে। কিছু মাল ছাড়ো ওস্তাদ। পাড়া খালি করে আমাদের মেয়ে নিয়ে যাচ্ছ। ঘেরাও করে বসে আছে। ওদিকে ছেলের বাপ ছুটছেন মেয়ের বাপের কাছে। ‘আরে মশাই, হাজারখানেক ছাড়ুন। এমন কথা তো ছিল না। প্যাকিং আর ফরোয়ার্ডিং ইনক্লুসিভ নয়, এক্সক্লুসিভ। টোল ট্যাকস, অকট্রয় ক্লিয়ার করে দিন।’

আজকাল আবার প্রেমের যুগ। প্রেম নেই কৃষ্ণ নেই, রাধা নেই, পেয়ার আছে, মোহব্বত আছে। কে যে কোথায় ফেঁসে বসে আছে। ফাঁস গিয়া দিল। ক্রিকেট সহজে আউট হয় না। পাত্র-পাত্রীর স্তম্ভে লড়ালড়ি করে, সুলক্ষণা, গৃহকর্মে নিপুণার সঙ্গে উচ্চকর্মে রত, ড্রয়িং ফোর ফিগার্সের একটা ব্যবস্থা হল। তারপর শুভদিনে, ‘নেমে আয় ব্যাটা, উঠে আয় আসর থেকে। আসলি বাবাজীবন এসসে গেছে। লাস্ট সেভেন ইয়ারস ধরে সাধনা করছে।’

সে যুগ আর নেই। মডার্ন এজ। ম্যারেজ আর অ্যারেঞ্জ করতে হয় না। হয়েই থাকে। তবে নিমন্ত্রণ পত্রের জলুস সাংঘাতিক খুলেছে। কোনওটা পাটে পাটে সাতপাট। কোনওটা রোল করা ম্যাগনাকার্টা। কোনওটা হাত পাখার মতো, চ্যাটালো আর চওড়া। গ্রীষ্মের দুপুরে, লোডশেডিং-এর রাতে নেড়ে-নেড়ে বাতাস খাও। দাম্পত্য জীবন ওদিকে যতই গরম বাতাস ছাড়ুক, আমরা একটু শীতল থাকি এদিকে। মিষ্টান্ন ইতরেজনা তো হয়ে-ইচে। হজমও হয়ে গেছে। বাতাসটুকুই বা হয় উপরি পাওনা হোক। এরপর হয়তো এমন দিন আসছে, বাড়ির সামনে টেম্পো এসে দাঁড়াল নিমন্ত্রণকারী সামনে। মুখে বিনীত হাসি। সপরিবারে অবশ্যই আসা চাই। তারপর পথের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন ‘উতারো’।

ভীমভবানীর মতো দুটো লোক আসছে, মাথায় আস্ত একটা টিনের চালার মতো বস্তু। জিগ্যেস করছে, ‘কাঁহাঁ উতারেগা জি’?

‘কেয়া বাপ! এ কোন চিজ?’

নিমন্ত্রণকারী বললেন, ‘আজ্ঞে নিমন্ত্রণ পত্র। দেয়ালতক খাড়া কর দিজিয়ে। সামালকে, সামালকে। টিউবলাইট। টিউবলাইট। হুঁসিয়ারিসে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *