পত্রাবলি – ১০

পত্রাবলি

পুত্রদ্বয়কে লিখিত পত্র

(১)

১৬ মে ১৯৫৫

বাবা ফিরোজ,

এই বারে তুমি আমাকে দেখেই চিনতে পারলে। এর পূর্বে যতবার তোমাকে দেখতে গিয়েছি তুমি আড় নয়নে তাকিয়েছ, তোমার মায়ের হাঁটুতে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে পেছিয়েছ আর ভেবেছ, এ লোকটা কে?

এবারে চট করে তুমি আমাকে চিনে নিলে।

দু মিনিট যেতে-না-যেতেই বললে, মোটর।

আমি তৎক্ষণাৎ বাক্স খুলে তোমাকে মোটর দিলুম।

 তুমি খুশি হয়ে ভজুকে কাছে নিয়ে মোটর নিয়ে খেলা করলে।

 খানিকক্ষণ পরে আবার এসে বললে, মোটর।

 আমি বললুম, ওই তো ফিরোজ। মোটরটা দেখিয়ে দিলুম।

তুমি বললে না, কঁ-ক-ক, কঁ-ক-ক সেই মোটর।

বুঝতে পারলুম না।

তোমার মা বুঝিয়ে দিলে, তুমি খেলনার মোটর চাও না, তুমি চাও আসল মোটর– যে মোটরে তুমি যখন কটকে এসেছিলে, ঘুরে বেড়াতে।

তোমার ঠিক মনে আছে।
—আব্বু

.

(২)

২৮ মে ১৯৫৫

বাবা ফিরোজ

তুমি যেসব কথা বলো তার মানে কি তুমি বুঝতে পারো? অনেক সময় তুমি না বুঝে আবোল-তাবোল বলে যাচ্ছে, আবার অনেক সময় দেখি যা বলতে চাও ঠিক তাই বলেছ– কথাগুলো আদপেই অর্থহীন নয়।

মাঝে মাঝে তাই ধোঁকা লাগে।

তোমার মা বলছিলেন তুমি নাকি একদিন ঘড়িটাকে নিয়ে বড় ঝুলোঝুলি লাগিয়েছিলে। পাছে তুমি সেটা ভেঙে ফেলো তাই তিনি তোমাকে ওটা কিছুতেই দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। শেষটায় তুমি নাকি হঠাৎ মাটিতে পা মেরে বললে, লাথ মারো দুনিয়াকো।

বলেই গুম গুম করে বেরিয়ে গেলে।

পরে জানা গেল, ওটা নাকি ফিলমি গানার এক লাইন! তুমি তোমার আজীজ ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছ।

—আব্বু

.

(৩)

১২ জুন ১৯৫৫

 বাবা ফিরোজ,

তুমি নাকি একদিন আদর করে ভজুকে জিগ্যেস করলে, ভজু, তোর আলু কোথায়?

আমি তখন ঢাকাতে তোমাদের দেখতে গিয়েছিলুম। তুমি তোমার আব্বকে পেয়ে ভারি খুশি। কিন্তু ভজুকে ভালোবাসো বলে দুশ্চিন্তা হল– আমার তো তাই মনে হয়– এর আব্দু একবারও আসেনি কেন?

—আব্বু

.

(৪)

৪ জুলাই ১৯৫৫
গাড়িতে পাটনা থেকে হৈদ্রাবাদ

 বাবা ফিরোজ,

তুমি বড় হলে আমারই মতো গরমকাতর হবে না প্রার্থনা করি। যদিও জানি গরমকাতর হবেই। কারণ সেপ্টেম্বর মাসেও এক মিনিটের তরে পাখা বন্ধ হলেও তোমার ঘুম ভেঙে যায়।

তাই মনে করি বর্ষা ঋতু তোমার জীবনেও সেই স্থান দখল করবে যেটা সে আমার জীবনে করেছিল।

বর্ষাকালে ফসল হয়, তাই অন্নপ্রাণ মানুষ তাকে ভালোবাসে। যাদের কবিতৃবোধ আছে তারা তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। আমার কাছে তার সর্বাধিক মূল্য তার শৈতল্যে। তুমি বলবে, সে কি, বাবা তার কবি-মনোবৃত্তি নিয়ে এটাকেই সবচেয়ে বেশি দাম দিলে। হ্যাঁ বৎস, তাই।

যৌবনে আমি ১২৬° ভিতর দিয়ে খাইবারপাস পার হয়েছি। কষ্ট পেয়েছি, কাতর হয়ে পড়েছি, কিন্তু তাই বলে ভ্রমণের উৎসাহ কমেনি।

এখন কিন্তু মস্তকে বজ্রাঘাত হয়। এই গরমে কোথায় যাব! বাড়িতেই প্রাণ অতিষ্ঠ।

.

ভোজপুর। (শাহাবাদ Dt)

কচুরিপানা নেই।

আমবনের জমা-জলে গাছের কালো ছায়া। দেখে মনে হয়, গ্রামের কলহ বর্জন করে, গাওবুড়োরা সভায় বসেছেন।

ধান পর্যন্ত ফলাচ্ছে জলে ক্ষেত ভর্তি করে। মাঝে মাঝে পলিমাটি, আমার দেশে ওরকম নেই। বাঁশ!

বর্ষার ঘোলা জলে সন্ন্যাসীর স্নান। গঙ্গা থেকে দূরে, নিশ্চয়ই ইঁদারা নেই। প্লাটফর্ম : বুড়ি সম্পূর্ণ দন্তহীন– হাতে উল্কি বাহারে-পেড়ে শাড়ি বাসন্তী রঙের ওড়না– হাতে বিরাট বিরাট মকর-মুখো রুপোর বালা–সোনালি রেশমি চুড়ি। নাতনি পাশে। সোনালি ওড়না, কিন্তু হাতে সোনা-রুপো নেই, শুধু কাঁচ। নাতনির বয়স ১০-১২ কিন্তু সবসুদ্ধ নিয়ে বুড়িটাই সুন্দরী।

আরেক মেয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে, বস্তার আড়ালে কখনও ঘোমটা টেনে, কখনও মাছি তাড়াতে তাড়াতে আম খাচ্ছে গোগ্রাসে।

(দিলদার নগর)

 হঠাৎ মাঠ কতদূরে চলে যায়, আবার কাছে আসে।

বর্ষা এসে আমার দেশ আর এদেশের তফাত ঘুচিয়ে দিয়েছে সম্পূর্ণ না, অনেকখানি। বিহারের বিখ্যাত আমবাগানের পাশ দিয়ে ছুটে চলেছি।

.

(৫)

১৯.৭.৫৫

ফিরোজকে ট্রেনে

অতএব হাতের লেখা টলটলায়মান

আমার মনে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে তুমি কি আমার মত এত সব দেশ-বিদেশ দেখবে? আজ আমি পাটনা থেকে দানাপুর– আরা– বার হয়ে দিল্লি যাচ্ছি।

কী নিবিড় ঘন বর্ষাই না নেমেছে। আকাশ বাতাস সবই শ্যামল স্নিগ্ধ শীতল। কামরার সব শার্সি ভোলা, তবু সব কিছু ঠাণ্ডা। বাইরের ভুবন ঝাপসা। দূর দিগন্তের সবুজ গ্রাম, তার উপর নীলাকাশের সুনীল মেঘ নেমে এসেছে। বৃষ্টি-কণা সারাক্ষণ তাকে ঝাপসা করে দিচ্ছে। কখনও দেখতে পাই, কখনও পাইনে।

ধরণী যেন সর্বাঙ্গ উন্মোচন করে নববরষণের মুক্তিস্নানে আন্দ্রি আসুপ্ত হয়ে আছেন।

কী সুন্দর দৃশ্য। হয়তো তুমি একদিন দেখবে।

—তোমার আব্বু

.

(৬)

ট্রেনে-টলটলায়মান

২৫.৭.৫৫

বাবা ফিরোজ,

তুমি যখনই গাড়িতে যাও না কেন, মোগলসরাই থেকে দু দিকে চোখ রাখবে। চুনার, বিন্ধ্যাচল অঞ্চল অপূর্ব সুন্দর।

১৯২৬-এ প্রথম এ জায়গা দেখি।

১৯৫৫-য় আজ আবার যাচ্ছি।

সেই সৌন্দর্য।

—আব্বু

.

(৭)

৩ অক্টোবর ৫৫

 বাবা ফিরোজ,

আমার একটা বইয়ের নামদেশে বিদেশে। বাংলায় ইডিয়মদেশ, বিদেশে। অর্থাৎ সর্বত্র অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে। আমি কিন্তু দেশে বিদেশে শব্দার্থে লিখেছি অর্থাৎ এ বইয়েতে কিছুটাদেশের বর্ণনা পাবে যথা পেশাওয়ার ইত্যাদি আর বাকিটা বিদেশের অর্থাৎ এ স্থলে কাবুলের।

দেশ-বিদেশের অন্য অর্থ ধরে।

আমি যদি কখনও দেশ-বিদেশে লিখি তবে তাতে যত্রতত্র সর্বত্রর বর্ণনা পাবে। সে-বই তা হলে বিয়াল্লিশ-ভলুম হবে। তার ফুরসৎ আমার নেই।

রবিঠাকুর লিখেছেন, (রবীন্দ্র রচনাবলী, ২৬ খণ্ড, পৃ. ৩২৪) রানি খুঁজতে বেরিয়েছিলাম দেশে বিদেশে।

তিনি দেশে বিদেশে কী অর্থে ব্যবহার করেছেন। একটু অনুসন্ধান করো তো।

—আব্বু

পুঃ আজ আমি খুব বকবকানিতে আছি। এ চিঠির আগে আরেকটা চিঠি লেখা হয়ে গেছে।

.

(৮)

১৯.১০.৫৫

বাবা ফিরোজ,

তোমরা যখন কটকে এসেছিলে তখন আমার alsatian কুকুর মাস্টারকে বড় ভালোবাসতে। বরঞ্চ বলা উচিত, মাস্টার তোমাদের অনেক বেশি ভালোবাসত। কে কতখানি কাকে ভালোবাসত সে কথা আরেকদিন হবে।

তোমার মা তখন স্থির করলেন, তোমাদের জন্য একটি কুকুর পুষবেন।

আমি যখন এবারে ঢাকায় গেলুম, তখন দেখি, ছোট্ট একটি ফুটফুটে কুকুর। কী সুন্দর। আর কী তেজ! এক লাথি মারলে সে তিন টুকরো হয়ে যাবে। অথচ আমাকে যা তাড়া লাগাল! তিন মিনিটেই কিন্তু দোস্তি হয়ে গেল যখন দেখলে, তোমরা সবাই আমার দিকে হাসি মুখে এগিয়ে আসছ।

ওর নাম কী? জাম্বু। সে কী, এক ফোঁটা পাপীর নাম জাম্বু!

তোমার মা বললেন, গ্যাভেরিয়ায় তোমার মাসিমার যে কুকুর আছে তার নাম জাম্বু। তুমি যখন সেখানে থাকতে তখন ওই জাম্বুর সঙ্গে তোমার খুব ভাব-সাব ছিল বলে ওকে তুমি জাম্বু বলে ডাকতে আরম্ভ করলে। বুঝলাম, তোমার বয়সে কুকুর মানেই জাম্বু।

তার সঙ্গে আমার কী বন্ধুত্বই না জমে উঠেছিল। আমি তাকে আদর করতুম, আর সে ন্যাজটি বর্মি পাখার মতো গোল করে মেলে দিয়ে ফ্যাশানেবল মেয়েদের মতো দোলাতে আরম্ভ করত। যখন ঘুমিয়ে থাকত তখনও মাঝে মাঝে চোখ একটুখানি খুলে দিয়ে মিটমিটিয়ে দেখত আমি তার পাশে বসে আছি তো। তোমরা দু ভায়েতে যখন তার ওপর বড় বেশি চোটপাট করতে তখন সে এসে আমার কাছে আশ্রয় নিত। অবশ্য বেশিক্ষণের জন্য নয়। আবার যেত তোমাদের কাছে। ভজু হামাগুড়ি দিয়ে কাছে এসে ন্যাজে দিত টান, আর তুমি দুই হাতে তার মুখ ফাঁক করে যে রকম উপর-নিচ টানতে তা দেখে পুরাণের কোন এক বকাসুর-বধ না কিসের এক ছবি মনে পড়ত। জাম্বুর তখনকার অবস্থা সত্যই করুণ। মুখ দু দিকে চেরা বলে চিৎকার পর্যন্ত করতে পারছে না। তোমাদেরও ভয়-ডর নেই। বোঝে না যে-কোনও মুহূর্তে ওই একরত্তি কুকুর তোমাদের কুটি-কুটি করে দিতে পারে। কিন্তু সে নিয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। আমার মাস্টার যে কি না তাগড়া অ্যালসেসিয়ান তাকে নিয়েও তোমরা কটকে ওইঅপকর্ম করতে। সে-ও জাম্বুর মতো অকাতরে সইত।

তোমার মা লিখেছেন, সে রাস্তায় বেরিয়ে গিয়ে পাগলা কুকুরের কামড় খেয়ে পাগল হয়ে যায়। তোমাদের স্কুলের চারটি মেয়েকে কামড়েছে। তোমাদের গায়েও নাকি আঁচড় রয়েছে। তোমাদের দু ভাইকে ১০টা ১২টা injection নিতে হয়েছে। ভাবো দেকিনি, কী কাণ্ড। তোমরা দু জনাই আমারই মতো delicate- নাজুক। তোমাদের কী কষ্ট হচ্ছে, তাই আমি ভাবতে ভাবতে

(পত্র অসমাপ্ত;

.

(৯)

৩। ১০। ৫৬
আজ ঢাকাতে এলুম

বাবা ফিরোজ,

আজকাল আমি জলে-ডাঙায় লিখছি। তার ইতিহাস তোমাকে বলি। ১৯৫৩ ইংরেজির শীতের শেষে আমি মৈমনসিং গিয়েছিলুম। তখন আমি অবিশ্বাসের শেষ অধ্যায়গুলো লিখছি। রোজ সকালে বারান্দায় এক কোণে বসে বই লিখি (তুমি তখন বড় জ্বালাতন করতে– তোমার ইচ্ছে, আমি তোমার সঙ্গে খেলাধুলা করি) আর তোমার মা আমাকে মাঝে মাঝে চা দিয়ে যান।

একদিন চুপ করে বসে আছি। তোমার মা জিগ্যেস করলেন, লিখছ না যে।

আমি বললুম, অবিশ্বাস্য শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই বসে বসে ভাবছি অন্য কী বই আরম্ভ করি। তোমার মা এক মুহূর্ত না ভেবেই বললেন, বাচ্চাদের জন্য একখানা বই লেখ।

আমি তদ্দণ্ডেই জলে-ডাঙায় লিখতে বসে গেলুম। এর কয়েকটি instalment আমি ৪৮-৪৯ সনে বসুমতীতে প্রকাশ করেছিলুম বটে কিন্তু তার পর ওটার কথা ভাবিইনি। তাই নতুন উৎসাহে বইটা লিখতে আরম্ভ করলুম।

উৎসাহের কারণ :

(১) তোমার মা বলেছেন,

(২) দেখলুম, তোমার বয়স যখন ১২। ১৪ হবে, তখন আমি তো এ-লোকে থাকব না; তাই তোমার জন্য তোমার ওই বয়সের উপযোগী কিছু লিখে রেখে গেলে তুমি খুশি হবে। উপস্থিত জলে ডাঙায় বসুমতীতে বেরুচ্ছে।

আজ এখানে শেষ বর্ষা যাচ্ছে। এখানে এটাকে হাতিয়া নক্ষত্রের বৃষ্টি বলে। এর পর নাকি এদেশে আর বৃষ্টি হয় না।

চওড়া বারান্দায় বসে শুনছি, ঝিল্লির ঝিলিমিলি, তার সঙ্গে ব্যাঙের কর ক কর কর। সামনের দেয়ালে বেড়ে ওঠা মধুমালতীলতা দুলছে, লাল-সাদায় মেশানো ফুলগুলো কাঁপছে– দাঁড়াও, এই লতাকে যে মধুমালতী বলা হয় তার কোনও হদিস নেই। কারণ এগুলো তো এসেছে রেঙ্গুন থেকে এখনও একশো বছর হয়নি। অথচ মধুমালতী প্রাচীন নাম। ইংরেজিতে একে বলে Rangoon Creepers (ইংরেজিতেশিউলিকে বলে Sorrow Flowers, টগরকে বলে Twister Jasmine, বেলকে বলে wood apple, সজনেভঁাটাকে বলৈ Drum sticks, ব্লাড়শকে বলে Ladys fingers. এগুলো ইংলন্ডে নেই বলে কোনও ইংরেজ এগুলো বুঝবে না, অর্থাৎ এগুলো Anglo-Indian শব্দ)। ঠিক ওই রকম মাধবী কি ফুল কেউ জানে না। গুরুদেব এক নাম-না জানা লতাকে মাধবী নাম দেন। তার পর গান রচেন, হে মাধবী দ্বিধা কেন?পারুলও তাই। কেউ জানে না ওটা কোন ফুল। শান্তিনিকেতনের কাছে যে পারুল বন আছে সেটা গুরুদেবের দেওয়া নাম। এখানকার ফুল সত্যই পারুল কি না, কেউ জানে না।

ভেবেছিলুম বর্ষার মোলায়েম বর্ণনা দিয়ে তোমাকে আজ গল্প বলব। তা আর হল না। পারুল মাধবীর শব্দতত্ত্ব নিয়ে সময় কেটে গেল।

কিন্তু আজ সত্যই মেদুর সন্ধ্যা। আজ সপ্তমী। এখন আটটা বেজেছে। সপ্তমীর চাঁদ কখন ওঠে ঠিক জানিনে। বাইরে অন্ধকারটা জমাট নয়। আকাশ যেন কোনও ঘোর রঙের চশমা পরে তাকিয়ে আছে। বাতাস যেন ভিজে কথা পরে আমার চতুর্দিকে ঘোরাফেরা করছে। দু-এক ফোঁটা জল আমার লেখাকে চুপসে দিচ্ছে। সেক্রেটারিয়েটের ঘড়ি আটটা হাঁকছে। শামাপোকা জোরালো বাতির চতুর্দিকে ঘুরছে। ডানাগুলো আস্বচ্ছ (অস্বচ্ছ নয়), ইংরেজিতে যাকে বলে ডায়েফনাস্।

সমস্ত জীবন কাটল এই রকম একা বসে বসে।

–আব্বু

.

[কনিষ্ঠ পুত্রকে লেখা পত্র]

১৭.১০.৫৫

বাবা ভজু,

তোমাকে নাকি ফিরোজ জিগ্যেস করল– আমি যখন ঢাকায় গিয়ে তোমাদের আদর করছিলুম কবীর, তোর আব্ব কই?

—আব্বু

[উপরের পত্রগুলো যখন সৈয়দ মুজতবা আলী লেখেন, তখন তাঁর পুত্রেরা নিতান্তই শিশু। এ চিঠি তারা বড় হয়ে পড়বে, সেই আশাতেই লেখক লিখেছেন। প্রতি চিঠিতেই প্রবাসী পিতার বুভুক্ষু বাৎসল্য প্রকট। ফিরোজ জ্যেষ্ঠপুত্র সৈয়দ মুশাররফ আলীর ডাকনাম, ভজু কনিষ্ঠ পুত্র সৈয়দ জগলুল আলী।]

.

 শ্রীচারুচন্দ্র চক্রবর্তীকে (জরাসন্ধ) লিখিত পত্র

১.১.৭০

প্রিয়বরেষু,

নববর্ষে আপনার সহি-সালামতের জন্য আল্লার দরগায় দোওয়া মাঙছি। আপনার জরিন কলম হোক, আপনি আরও বহু বহু বৎসর ধরে বাঙালিকে আনন্দ দান করুন, এটা আসল। তৎপর যা করে আসছেন, অর্থাৎঅপরাধ কী, অপরাধী কারে কয়, সে-সম্বন্ধে বাঙালিকে চিন্তা করতে ও সহিষ্ণু হতে শেখান। আল্লার কসম, এগুলো আমার উপদেশ নয়। আমার হৃদয়ের কামনা, প্রার্থনা, আমি ভেবেছিলুম, আপনি আমার খোঁজ নেবেন। তা তো নিলেন না। অবশ্য আমার কসুর অধিকতর। আসলে ব্যাপারটা এই, আমার বয়স ৬৪ (জন্মাষ্টমীর সূর্যাস্তে জন্ম!) এবং তার চেয়ে বেশি অথর্ব। উৎসাহের তোড়ে যদি বা আপনাকে pin down করলুম, তার পর সেটা আর follow up করতে পারলুম না। … ৪।১৭০ আবার রাজশাহী যাচ্ছি, ধর্মপত্নী ও দুই সৈয়দজাদা (যথাক্রমে ১৭ এবং ১৫) সেখানে থাকেন, এটা আমার বাৎসরিকহজ।

পরশুদিন শচীনবাবুর ওখানে গিয়েছিলুম। তার অজানতে দু খানা বই চুরি করে আনি। ন্যায়দণ্ড তথাগল্প লেখা হল না। পড়ে বড় আনন্দ পেয়েছি, বড় আনন্দ পেয়েছি। সে-কথা জানাবার জন্যই এই কার্ড। শেষের বইখানা বাবাজীবনদের জন্য নিয়ে যাব, জানেন বোধহয়, আজকাল কোনও প্রকারের printed matter পাকিস্তানে নিয়ে যেতে দেয় না। ওদিকে বাবাজীবনরা আপনার, রাজশেখরবাবুর ভক্ত। ব্রিামও ওদের ভারি পছন্দ। একদা মনে করত ব্রিাম greatest writer of Bengal. সে এক মজার ব্যাপার, বড় ব্যাটা ফিরোজকে একদিন বলেছিলুম, ব্রিামকে আমি চিনি। তাচ্ছিল্যি করে ব্যাটা বললেন, রেখে দাও! তুমি আবার লেখক। দ্বিামদা তোমার সঙ্গে কথাই কইবে না। আমি মনস্তাপ জানিয়ে ব্রিামকে আদ্যন্ত জানালুম। তার পর ফিরোজ ছুটিতে কলকাতা এলে তাকে ব্রিামের ওখানে নিয়ে গেলুম। সে এক দৃশ্য। ব্রিাম ফ্যালফ্যাল করে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে, আর ফিরোজ মুগ্ধ নয়নে। ব্রিাম বেচারি ফিরোজের জন্য ফুরি থেকে ফেদৃজিনির কেক কিনে এনেছিল। আমিও যে খুব একটা নিরেস লেখক নই সেটা ব্রিাম একবার ফিরোজকে বোঝাতে গেলে সে with one murderous sweep of hands সেটা বন্ধ করে দিলে। …এবারে বলুন, কোন্ সাহসে ফিরোজকে বলি, আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে?

গুণমুগ্ধ
সৈ, মু. আলী

.

(২)

Dec. 6/7/71

শ্ৰদ্ধাস্পদ সুহৃদবরেষু,

আপনার ৬। ৪। ৭০-এর চিঠি আমি পাই সিলেটে। দেশে ফিরে আসা মাত্রই মোকা জুটে যায় জর্মনি যাওয়ার। তারই তদ্বির-(কে যেন বলেছেন একদা বসুন্ধরা ছিলেন বীরভোগ্যা, এখন তদ্বিরভোগ্যা) তদারকির মধ্যিখানে অবশ্য বিছানায় শুয়ে শুয়েই– আপনার সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করব তেমন কিস্মৎ আমার ছিল না। তড়িঘড়ি ফের বিদেশ।

আপনি সহৃদয়। তাই আব্দুর রহমান সে-ও বড়ই দরদী ছিল– আপনার হৃদয়ে সরাসরি ঢুকে গেছে। আপনার মতো কোনও সজ্জন যখনই তার প্রশংসা করেন তখনই আমার মনে বড় বেদনা জাগে, তার সম্বন্ধে তো আরও অনেক অনেক কিছু বলার ছিল, কিন্তু আপনি কৃতী লেখক, বিলক্ষণ অবগত আছেন, কোনও চরিত্র অঙ্কনে একটা অপটিমাম মাত্রা আছে। কিংবা বলতে পারেন, আপনার (আমার না বলে আপনারই বললুম, কারণ সে ছিল আমার দৈনন্দিন জীবনের ডালভাত আর আপনার কাছে সে রস-প্রতিম)। আবদুর রহমান আমার কাব্যের উপেক্ষিতা ঊর্মিলা। কিন্তু থাক। নিজের কথাই সাত কাহন!

বলতে ভুলে গিয়েছি, ওই তিন মাসের সফর অ্যাসন তলিফদেহ হয়েছিল যে মাসাধিককাল অধম দণ্ডবৎ, লাঠ্যাবৎ (বিবেকানন্দ পশ্য) হয়ে শয্যাশায়ী। নয়া-পুরনা বেবাক আলীপুর আমার কাছে বার্লিনের চেয়ে সুদূরতর। মধ্যিখানে নকশলাইট–আমার কাছে most welcome! ড্যাং ড্যাং করে চলে যাব।

আমার দুই ব্যাটা ১৮ এবং ১৬ আপনার লেখার– যাকে বলে Fan-grand admirers. শুধু বড় ব্যাটা শুধোলে, এই জরাসন্ধবাবু (আমার বাচ্চারা তাদের জননীর মতো– [আমো তাই) ঈষৎ Old-fashioned, হিন্দু নামে বাবুটা হরবকৎ জুড়ে দেয়) বললেন, মার্কিন criminologist ওঁকে বললে, এ দেশে born criminal নেই, (অপরাধ নেবেন না, আমার কথাগুলো ঠিক ঠিক মনে নেই; আপনার কেতাবখানাও নেই। বললে পেত্যয় যাবেন না, আপনার তাবৎ কেতাব কভু কড়ি ফেলে, কভু-বা ফোকটে যোগাড় করেছি কিন্তু ধন্যি আমার চেলারা, তেনারা পঙ্গপালের মতো আপনার বেবাক বই গিলে ফ্যালেন– except যেগুলো আমি কোনও গতিকে বাবাজি ও তাদের গর্ভধারিণীর জন্য পাচার করি; জানেন তো পাকিস্তানে আমাদের তাবৎ বই ব্যান্ড়!) তার অর্থটা কী? মা কালীর দোহাই দিয়ে বলেছি, আপনি ভাববেন না, আপনার লেখাতে কোনও এমবিগিটি ঝাপসাপারা ছিল। আপনার রচনা limpid, sparkling, flows like oil from a bottle. আমি বললুম, বাবাজি, যখন কলকাতা আসবে (ভারত-পাক লড়াইয়ের পর ওদের পক্ষে এ দেশে আসা কঠিন হয়ে গিয়েছে) তখন তোমাকে চারুবাবুর কাছে নিয়ে যাব। সেখানে মোকাবেলা করো। চারুবাবু! আমি বলছি জরাসন্ধের কথা। আমি বললুম, ওই! যাহা বাহান্ন তাহা তিরানব্বই। যাহা জরাসন্ধ তাহা চারুচন্দ্র। তখন বলে কী জানেন, ওঁর মতো great writer তোমাকে কি তার বাড়িতে ঢুকতে দেবেন? অর্থাৎ টাপেটোপে বোঝালে I am a very poor writer; great writer আপনি আমাকে পাত্তা দেবেন কেন?

ন্যায়দণ্ড কেন আপনার কুল্লে বই আমার ভালো লেগেছে, লাগে এবং লাগবে। আপনি জনপ্রিয় থাকুন। বিদগ্ধদের জন্য মেলা উত্তম উত্তম লেখক যথা কালিদাস, দান্তে রয়েছেন। আমি বিদগ্ধ নই। আমি (উপস্থিত আপনার এফিডেভিট মাফিক মেনে নিচ্ছি, তর্কস্থলে যে আমি বিদগ্ধ কচড়ু, হাইব্রাও, connoisscur, gourmet, comme its fant, যাবতীয়) আপনার ভাষা ও শৈলী (language & style) অর্থাৎ form, বিষয়বস্তু (content) দুই-ই বড় ভালোবাসি। তদুপরি আপনি a great raconteur = recounter.

৫নং পার্ল রোড
পো, সার্কাস এভিনিউ
কলিকাতা-১৭

—গুণমুগ্ধ
সৈয়দ মু আ—

.

॥ শ্রীগজেন্দ্রকুমার মিত্রকে লিখিত পত্র ॥

(১)

১২। ১২।৬৫

ভাই গজেনদা

কাল বিকেলে তোমার ১১১২-র চিঠি পেয়েছি। (১) পারতপক্ষে PO, Bolpur ছাড়া বাকি ঠিকানাটা আদ্যন্ত বাংলায় লিখবে। (ডক্টরটা কিছুদিনের জন্য নামের পূর্বে জুড়ে দিয়ো। পাড়ায় ডাকঘরে আরেকটু পরিচিত হওয়ার পর drop করবে। কারণ আমাদের পাড়ার পিয়ন অল্পই ইংরেজি জানে। প্রায়ই অন্যলোকের চিঠি পাই, (যদিও typed); তার থেকে knowledge by inference, আমার চিঠিও অন্যের বাড়ি যায়। পরস্ত্রী আমার কাছে আসুক… etc, etc, এই knowledge by inference সংস্কৃতে রসিয়ে দেওয়া আছে।

(ক) দেবদত্ত মোটা

(খ) দেবদত্তকে কেউ কখনও দিনের বেলা খেতে দেখেনি। (অতএব knowledge by inference);

(গ) দেবদত্ত রাত্রে খায়।

(২) অবধূতের কিছু ছাপা হলেই পাঠাবে বুঝেছি, অন্য উপদেশ পরামর্শও বুঝেছি। কিন্তু যতদিন না আসে, বলতে পার, বিষয়বস্তুটা কী? মনে হচ্ছে হিমালয়-ভ্রমণ–তা ছাড়া?

(৩) পৌষ ফাগুনের পালা তুমি খুব সম্ভব আমাকে এযাবত দাওনি। এবারে বিবির ওখানে তালাশ করে দেখলুম যে-কটা একবার দিয়েছিলে সেগুলো তখনই পড়া হয়ে যায়, একপৌষ ফাগুন তার সঞ্চয়নে নেই। অতএব পাঠিয়ে দিলে পড়ব নিশ্চয়ই অবশ্য অবসরমতো দিন পনেরোর ভিতর।

(8) Same applies toসোহাগপুরা।

কিন্তু দাদা, মতামত দিতে আমার বড় বাধো বাধো ঠেকে। তোমার মতো কুতুবমিনারি লেখকের প্রশংসা করা বিড়ম্বনা, তোমার লেখা অপছন্দ করার অর্থ, আমার রুচির অভাব। এক মার্কিন নাকি লন্ডনে Titan-এর ছবি দেখে বউকে বলে, Gee, I dont think I like that one পাশে দাঁড়িয়েছিল একজন গাইড। বললে, Sir, Titan is not being tested; your taste in being tested!

তবেই কও, এই ডিলেমার সলুশন কী? By the way, before I end, যে কোনও দিন abruptly তোমাকে, ভানুকে সবাইকে চিঠি লেখা হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে আমার অনিচ্ছায়। কেন, শুধালে উত্তর বড় দীর্ঘ হবে। তখন চটো না।

—আ

নীচুপট্টি পো,
বোলপুর
বীরভূম।

.

(২)

ভাই গজেনদা,

তোমার বই পড়ছিলুম। বহুকাল পূর্বে (১৯২১) দ্বিজেন্দ্রনাথ বড়বাবু আমাকে বলেন, কথাটা কষ্টে সৃষ্টে নয়; হবে কষ্টে শ্রেষ্ঠে। তিনি কী কী যুক্তি দিয়েছিলেন আজ আর মনে নেই। আমার মনে হয় কষ্টে সৃষ্ট না হয় বোঝা গেল, কিন্তু কষ্টে সৃষ্টেরএকারটা এল কোত্থেকে? তদুপরি by itselfকষ্টে সূষ্টে ঠিক মানে কী ধরে? আমরা আজকাল তো বুঝিঅতিকষ্টে। এবংঅতিকষ্টে সক্ষম হয়েছি অর্থাৎ সৃষ্টি করেছি। তা হলে তো, অতি কষ্টে সৃষ্টে কাজটা করতে পেরেছি অর্থ দাঁড়ায়, অতি কষ্টে সৃষ্ট সৃষ্টি করেছি। ডবল ডবল পুনরাবৃত্তি। অথচ কষ্টে শ্রেষ্ঠে, সুখে দুঃখে, হাসি কান্নায়, তকলিফে বেতকলিফে কাজটা সেরেছি– এটাই তো ভালো।

তাই তোমার বইয়ের (পৌষ-ফাগুনের পালা) p. 524, line4-এ গাঁইয়া উচ্চারণে কষ্টসৃষ্ট নতুন করে প্রশ্নটা মনে তুলল।

তুমি এসব শব্দ সমাস নিয়ে মাথা ঘামাও, তাই আরেকটা বলি : চুল চেরা বোধহয় আসলে ছিল চুন-চেরা –ফারসিতে আছে– ওই একার্থে। কখন? কেন (চেরা)? বলে অযথা সূক্ষ্মতর্ক করা। নটা কি ভুলেল হয়ে গিয়েছে। অবশ্য চুলচেরা by itself সুন্দর image মনের চোখে আনে– কিন্তু সংস্কৃতাদিতে এর নজির নেই!

Happy New Year

—আ ॥

পুনঃ ব্যবহারিক (না ব্যাবহারিক) শব্দকোষ সম্বন্ধে আমার সতর্কবাণী পেয়েছ? উত্তর কই?

.

[ শ্রীনারায়ণ সান্যালকে লিখিত পত্র ॥

৪ঠা ভাদ্র ১৩৭৩

প্রিয়বরেষু,

আজকের ভাষায় যাকেরসোত্তীর্ণ, আপনার সত্যকাম তাই হয়েছে কি না সে বিচার না করে প্রথমেই বলি, এই obscurantism ও revivalism-এর যুগে আপনি এ-পুস্তক লিখে বাঙালি হিন্দুর চোখে জ্ঞানাঞ্জন লাগাবার চেষ্টা করেছেন। সে যদি অঞ্জন মাখতে না চায়– আশা করি ইতোমধ্যে ভট্টপল্লি তথা নবদ্বীপে স্মার্ত সমাজ par excellence আপনাকে হুনো দেননি– তবে সে-দোষ আপনার নয়। এখনও যে দেশে বারেন্দ্র-রাঢ়ী-বৈদিকে সহজে বিয়ে হয় না; পূর্ববঙ্গের শরণাগত গুহ রাঢ়ী ঘোষ-বোস দ্বারা কুলীন বলে স্বীকৃত হয় না, কায়েত মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বামুনবাড়ি গেলে এবং এ ব্যাটাদের তিন পুরুষের কেউ সন্ধ্যাহ্নিক করেনি, কিঞ্চিৎ এ-পুরুষ পঞ্চমকারে আকণ্ঠ নিমগ্ন– খড়মপেটা হওয়ার সম্ভাবনা, বিয়ের মরসুমে যে-সব নিমন্ত্রণপত্র আসে সেগুলো আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, কটা অসবর্ণ বিয়ে হল তার শুমারি, % রাখার চেষ্টা করি। আমার এক অনুজপ্রতিম বারেন্দ্র (আপনারই মতো সান্ন্যাল) মুখুয্যে শাদি করেছে। সে-দেশে সত্যকামের কাহিনী স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রতি ধর্মভীরু দ্বিজের কর্তব্য। আপনি সেই কর্মটি অতি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন। আপনাকে অভিনন্দন জানাই, শতংজীব; সহস্ৰজীব, শঙ্কর আপনাকে জয়যুক্ত করুন।

আপনি আদৌ ভাববেন না, আমি কৌলিক ঐতিহ্য তথা আচার-অনুষ্ঠান বাবদে চার্বাক-পন্থী। কিন্তু সে কাহিনী এখানে তুলব না।

সত্যকাম তথা অন্য বহুবিধ কারণে যেসব ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণের উপনয়ন হয়নি, (অর্থাৎ, বিশেষ করে, যে-সব অব্রাহ্মণকে ব্রাহ্মণ পর্যায়ে তুলতে হবে। তাদের নিয়ে ব্রাত্য–সে তো আপনি আমার চেয়ে ঢের বেশি জানেন। এক জর্মন পণ্ডিত ঝাড়া বিশটি বছর খেটে (কারণ ব্রাত্যদের সম্বন্ধে তথ্য হেথা-হোথা সর্বত্র ছড়ানো) পঁচিশ পাতার কেঁদো কেতাব লেখেন, নাম স্রেফ ব্রাত্য। আমার বড়ই বাসনা ছিল, কেউ বইখানার অনুবাদ করে। হিন্দু উপকৃত হত। দেখত সে একদা কতখানি dynamic, catholic ছিল, শুধু যুক্তি দিয়ে বিচার করত না (আপনার কথায় যে সত্যের পিছনে, শিব সুন্দর নেই– সেটা বেকার) হৃদয়ের logic-ও শুনত, বলত : if tradition (স্মৃতি) help us, good! If not, without it and so much the better! আর আজ!

আপনি সত্যকামের কাহিনী বললেন (আজকাল দিনের লোক উপনিষদ মাথায় থাকুন, রবিঠাকুরও পড়ে না–তাই উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন লাইনগুলো কেতাবের পয়লা বা আখেরে দিলে ভালো করতেন, মায় উপন্যাসটির নাম), রামমোহনও শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে সতীদাহ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন, agnostic বিদ্যেসাগরও শাস্ত্রের দোহাই দেন। তখন বঙ্কিম (for whose religious views I have little understanding, except that possa which is a mervellously written book with a very wrong thesis to prove!) তাঁকে লেখেন, আপনি শাস্ত্রের আশ্রয় নিচ্ছেন কেন? শাস্ত্র কেউ মানে না। মানে লোকাচার। আপনি তাই Humanitarian grounds-এর ওপর নির্ভর করুন। বিদ্যাসাগর খুবসম্ভব কোনও উত্তর দেননি। তিনি জানতেন, শাস্ত্রের বরাত দিলে তবু-বা কিছু হতে পারে। Rational, humanitarian consideration have precious little chance.

অর্থাৎ Voltaire-এর যুগ এই পোড়া বাঙলা দেশে এখনও আসেনি। আমার জানা মতে ১নং চৈতন্য, ২নং বিবেকানন্দ– সাহস যা দেখাবার, to rebel against শাস্ত্র, এঁরাই কিছুটা দেখিয়েছেন।

মুসলমানের ভিতর, গোড়ার দিকে, কিছুটা দেখান আকরম খাঁ। মোল্লাদের হুনো খেয়ে সে-বই আর reprint করেননি। নজরুল ইসলাম গোড়ায় বিদ্রোহী, শেষের দিকে very traditionalist!

এবারে আপনি একটু Voltaire পড়ুন। বিশেষ করে CANDID.

আপনার গল্পের প্লটটি যদ্যপি উপনিষদ থেকে নেওয়া তথাপি ইটিকে সম্পূর্ণ অভিনব না বললে পাপ হবে। Very dexterously managed.

আপনার গল্প বলার ধরনটি চমৎকার। আপনি excellent racounteur.

তবে এ পুস্তকে romantic রাজবাড়ির রোমাঞ্চকর ঘটনায় হঠাৎ ছেদ টেনে স্মার্ত নৈয়ায়িক পরিবারের দীর্ঘ কাহিনী সাধারণ পাঠককে খুশি করবে না। সে ওটা skip করবে। আম্মো করেছিলুম। তবে অন্তত আমার কাছে স্মার্ত যে কী করে নৈয়ায়িক হয়– Contradiction মনে হয় সেটা দেখবার জন্য ফিরে এসে সেটি পড়ি। মন দিয়ে। কারণ এতে আমার personal interest আছে।

আমার যদ্দুর জানা, বৈদেশিক বৌদ্ধ জৈন চার্বাকপন্থীদের বাদ দিন; এক বেদান্ত ছাড়া আমাদের সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, মীমাংসা সবটাই ঈশ্বরকে ignore করে (ন্যায়), প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ (সাংখ্য), বা God-কে special position দেয় না। ন্যায়ের ভিত সাংখ্য ও বৈশেষিকের উপর। আর স্মৃতি তো দর্শন নয়– নিছক theology (মাকড় মারলে ধোকড় হয়। প্রকৃত নৈয়ায়িক স্মৃতিকে বিলকুল উপেক্ষা করে। কারণ স্মৃতি নির্ভর করে entirely on আপ্তবাক্য authority-র ডাণ্ডা। ন্যায়ের প্রথম starting point (১) প্রত্যক্ষ (২) অনুমান (inference e. ৪. ক) দেবদত্ত মোটা খ) দেবদত্ত দিনের বেলা খায়– গ) অতএবঅনুমান (I infer) দেবদত্ত রাত্রেও খায়, (৩) উপমানশব্দ (credible testimony, যেটাকে শাস্ত্রআপ্তবাক্য সংহিতা বলতে পারেন, এবং সেটা স্মৃতির the starting point. (কস্যচিৎ ভাইপোস্য বেনামিতে বিদ্যেসাগরের একটি humorous লেখাতে এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ পাবেন। সেখানে বড় ভাই নৈয়ায়িক, ছোট ভাই স্মার্ত। দু জনাকে নিয়ে রগড়।)। হ্যাঁ, আলবৎ, হিন্দুসমাজে বাস করতে হলে লোকাঁচার মানতে হয় তাই পাড় নৈয়ায়িকও অসবর্ণে বিয়ে দেয় না, সগোত্র বিয়ে করে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু পট্টন্তরী তথা লোকাঁচারের অন্যান্য গোঁড়ামির Care করে না, অর্থাৎ সমাজপতি স্মার্তরা যতক্ষণ না খড়গহস্ত হয়ে তার হুঁকো জল বন্ধ করার ভয় না দেখান। এঁরাই হচ্ছে typical নৈয়ায়িক। আপনি বলবেন, আপনি স্বচক্ষে দেখেছেন, নৈয়ায়িক পাড় স্মার্তের মতো পট্টন্তরী নিয়ে মাথা ফাটাফাটি করছে। আমি বলব, আমম্মা দেখেছি, মেড়ো লন্ডনের খানদানি Dorchester হোটেলে হাত দিয়ে খানা খেয়ে টেবিলক্লথে হাত মুচছে। কিন্তু Dorchester হোটেলের বর্ণনাতে সেটা typical নয়, সেটা accidental– যেমন, প্রেমের trangle সৃষ্টি করে, সমস্যা সমাধান করতে না পেরে লেখক একজনকে মোটর অ্যাকসিডেন্টে মেরে ফেললেন। ব্যস, সমস্যার সমাধান ভেল! আমি বললুম, এটা আবার কী? লেখক গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, কেন, মানুষ মোটর দুর্ঘটনায় মরে না? তুলনাটা টায়টায় মিলল না; মোদ্দা– reality is no criterion for artistic achievement (রসোত্তীর্ণ হওয়া)।

আচার্য গোষ্ঠীকে নবন্যায়ের পণ্ডিত না করে খাঁটি স্মার্ত করলে এ ঝামেলা হত না। আচার্য গৌতম তো নৈয়ায়িক ছিলেন না অবশ্য ন্যায়শাস্ত্রের তখন জন্মই হয়নি।

তা সে থাক! এটা অত্যন্ত বাহ্য। কেন যে আমি উল্লেখ করলুম জানিনে, বোধহয়বিদ্যে ফলাবার জন্য। কিংবা আপন নৈয়ায়িক গুরুর স্মরণে। পথ দিয়ে যেতে যতে সরস্বতী পুজোর বড়ম্বর তথা বাহ্যাড়ম্বর দেখে তিনি মুখ ফিরিয়ে আমাকে বলেন, বর্বর, অনার্য, দ্রাবিড়সস্তৃত। আমি বললুম, স্বয়ং শঙ্করও তো সাকারকে দ্বিতীয়স্থান দিয়েছেন। তিনি বললেন, তাঁর গুরু ছিল বৌদ্ধ আর সে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ। আমি বললুম, তাতে তো আপনার খুশি হওয়ার কথা। ভগবন! আপনিও ভগবানের থোড়াই পরোয়া করেন– বৌদ্ধদের মতো। তিনি বললেন, ওরে মূর্খ! তোর কিছু হবে না। তোের শাস্ত্রচর্চা বন্ধ্যা-গমন, ন দেবায় ন ধর্মায়। সেই দিনই প্রথম শিখি, এস্থলেন ধর্মায় বৌদ্ধধর্মকে refer করে, অর্থাৎ আমার শাস্ত্রচর্চা (হিন্দু)দেবায় কাজে লাগবে না, (বৌদ্ধ ধর্মায়ও না।

আবার বলি এটা অত্যন্ত বাহ্য।

—আলী

নীচু পট্টি,
বোলপুর

.

শ্রীযুক্ত বোপদেব শর্মাকে (জিতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) লিখিত পত্র

(১)

৭।৯।৬২

শ্রদ্ধাস্পদেষু,

যে কোন নিঃশ্বাসে সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে আপনি লিখেছেন, যদি অর্থের সন্ধান কর, রসের সন্ধান কর, আওয়াজের অন্তরালে কোনও ধ্বনি-ব্যঞ্জনার সন্ধান কর, তা হলেই তুমি প্রতিক্রিয়াশীল ফিলিস্টাইন প্রমাণিত হয়ে যাবে।

অতিশয় খাঁটি কথা।

কিছুকাল পূর্বে আমি একখানা বিদেশি জনলে একটি সুচিন্তিত প্রবন্ধ পড়ি। নাম ছিল, বোধহয়, Lady Chatterlys Lovers. Lady Chatterly অশ্লীল কি না সেই সম্পর্কে যে মোকদ্দমা হয় এবং তার পটভূমি নিয়ে তথ্যবহুল, ধীর, সংযত প্রবন্ধটি।

তাতে আছে, আদালত উকিল মক্কেল তাবৎ সজ্জন যখন শ্লীল-অশ্লীলে পার্থক্য করার মতো সংজ্ঞা পেলেন না তখন তারা বলেন, শুধোও সাহিত্যিকদের, তারা কী বলে।

তার পর লেখক বলেছেন, সাহিত্যিকদের বেশিরভাগই সরল চিত্তে স্বীকার করলেন সেরকম কোনও dividing line-এর সংজ্ঞা তারা দিতে অক্ষম।

তার পর লেখক বলেছেন, কিন্তু একদল ঝানু সাহিত্যিক আছেন তারা জানেন, অশ্লীলতম রচনাকেও (যেটা নিয়ে কারও মনে কোনও দ্বিধা থাকার কথা নয়) যদি তারা ঘুণাক্ষরে অশ্লীল বলেন, তবে সঙ্গে সঙ্গে একদল লোক চেঁচিয়ে উঠবে– (এবারে আপনার ভাষাতেই বলি, তুমিপ্রতিক্রিয়াশীল ফিলিস্টাইন– এটা কিন্তু মিনিমামেস্ট!) এরা ফাঁসিস্ট, হিটলেরাইট, ইমপেরিয়ালিস্ট, এবং (হালের বুলি) কলনিয়ালিস্ট। এই দলের পিছনে আছেন কিছু কম্যুনিস্ট এবং কিছু অন্তত আমেরিকার পুস্তক প্রকাশক (এবং বিশেষ করে পর্নাগ্রাফির) সম্প্রদায়।

আঁদ্রে জিদ একবার কম্যুনিস্টদের সমালোচনা করে বেধড়ক মার খান। উপরে বর্ণিত ঝানু সাহিত্যিকরা সেই তত্ত্বটি জানেন, এবং ফ্যাসিস্ট নামে পরিচিত হতে চান না।

Obscurantism-এর বিরুদ্ধে লেখা দুটি প্রবন্ধ আমার জীবনকে richer করেছে। একটি আনাতোল ফ্রাসের Life and Letters-এ আছে, দ্বিতীয়টি Edmand Wilson-এর লেখা এলিয়টের সমালোচনা। ফ্রাসের সেই আপ্তবাক্য পুনরায় স্মরণ করি : I have passed the age when one loves what one does not understand, I love light. নমস্কার জানবেন।

কাগজ খতম।

—গুণমুগ্ধ
সৈ, মু. আলী

শান্তিনিকেতন।

পু. বড়বাবু (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর) বলতেন, to imitate-এর বাংলা অনুকরণ, to ape এর বাংলা হনুকরণ। এ দেশে বিলিতির হনুকরণ হচ্ছে।

.

(২)

২৩।১০।৬২

শ্ৰদ্ধাস্পদে,

আপনার পত্রের সর্বশেষে আছে, আপনাদের প্রতিষ্ঠা কি এতই ঠুনকো জিনিস যে পাঁচজন অর্বাচীনের হাততালি না পেলেই তার বনেদ ধ্বসে যাবে।

এতে প্রথম ইঙ্গিত আছে, আমি সাহিত্যিক (এটা উপস্থিত আমি মেনে নিলুম), (২) আমার প্রতিষ্ঠা আছে, (৩) সেটা বাঁচাবার জন্যে আমি অর্বাচীনদের হাততালি খুঁজে বেড়াই। এই তিন নম্বরের ইঙ্গিতটা হে সৌম্য, ভালো করে না জেনে কি করা উচিত?

এখন বক্তব্য, আপনি চান, সাহিত্যিকেরা স্পষ্ট ভাষায় বলুন যে অধুনা সর্বসাহিত্যে যে Obscurantism চলছে সেটা সাহিত্য নয়, ও পথে চললে সাহিত্যের সর্বনাশ হবে। এই তো? আশা করি আমি আপনার মুখে এমন কোনও কথা চাপাইনি যেটা আপনার বক্তব্য নয়।

অর্থাৎ আপনি চান, সাহিত্যিকরাই সাহিত্যের গতি নির্দেশ করুন।

তা হলে নিবেদন, সাহিত্যে থাকে রস, এবং সেই গোড়ার জিনিস নিয়ে আলোচনা করেন, আলঙ্কারিকেরা। তারা বলে দেন কোটা উত্তম রস, উত্তম সাহিত্য, আর কোন্‌টাই-বা অধম।

আলঙ্কারিক ভরত থেকে আরম্ভ করে অভিনব গুপ্ত ইত্যাদি– এঁরা কি সাহিত্যিক ছিলেন? এঁরা কি কাব্য, নাট্য, আখ্যান, উপাখ্যান, মহাকাব্য ইত্যাদি প্রথম লিখে নিয়ে নাম করে ফেলে তবে সাহিত্যের গতি নির্দেশে হাটে নেমেছিলেন? আমার যতদূর জানা, এঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেননি। (Creative মাল)। অবশ্য এদের কারও কারও লেখা সরস, কিন্তু তবু তাঁদের সাহিত্যিক বলি না, বলি আলঙ্কারিক। সুরেশ সমাজপতি, অতুল গুপ্ত এরা সাহিত্য সৃষ্টি (Creative সাহিত্য) করেছেন বলে জানিনে।

ইয়োরোপীয় সাহিত্যগুলোর ইতিহাস তথা ইউরোপীয় আলঙ্কারিকদের কথা আমি বড় একটা জানিনে (আমি সমস্ত জীবন ধর্ম, দর্শন, শব্দতত্ত্ব নিয়ে কাটিয়েছি)। কিন্তু আপনি বলতে পারবেন, প্লেটো থেকে আরম্ভ করে ক্রোচে পর্যন্ত, এঁদের ক-জন Creative literature সৃষ্টি করে, সাহিত্যিক নামে প্রখ্যাত হওয়ার পর, অর্বাচীনদের হাততালি উপেক্ষা করে সাহিত্যের গতি নির্দেশ করে গেছেন।

আব্দুল করীম খান, ফৈয়াজ খান ইত্যাদি বড় বড় গাওয়াইরা যে ফিলমি গানার বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লেখেন নি, কিংবা বক্তৃতার কেম্পেন করেননি সে কিঅর্বাচীনের হাততালি থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে? পাঠান মোগল আমলেও দেখতে পাই, চিত্র-স্থাপত্য সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন তাদের ইতিহাস-লেখকরা, এরা এমারৎ বানাতেন না।

মাইকেল আঞ্জেলো, রাফায়েল ইত্যাদি বড় বড় ভাস্কর চিত্রকারদের ক-জন বাতলে দিয়েছেন ওইসব কলা কোন্ পথ দিয়ে যাবে। সব যুগেই নিকৃষ্ট আর্ট, নিকৃষ্ট movement in art থাকে। এরা কি তখন পোলেমিক লিখেছিলেন।

এবারে একটি অতি নিকৃষ্ট উদাহরণ দেই– পাঁচক এবং ভোজনরসিক কি একই ব্যক্তি? আমার অগ্রজের মতো ভোজনরসিক (তিনি খান অতি অল্প, বলেন, আমি পেটুক নই- এটা অবশ্য এস্থলে অবান্তর) আমি ত্রিজগতে দেখিনি। তিনি ডিম সেদ্ধ করতেও জানেন না। আমার মা অতিশয় নিপুণা পাচিকা ছিলেন। হালের চপ-কাটলিস, পুডিং-মাডিঙের বিরুদ্ধে তিনি প্রবন্ধ লেখেন নি।

বস্তুত এ সম্বন্ধে আমার কোনও সুস্পষ্ট ধারণা নেই, কারণ পূর্বেই নিবেদন করেছি, সাহিত্যের তথা লিটারারি ক্রিটিসিজম এবং এসথেটিকসের সঙ্গে আমার পরিচয় অতি অল্প। আবছা আবছা মনে হয়; যারা সাহিত্য সৃষ্টি করেন তারা জানা-অজানাতে আপন আপন স্কুলের সমর্থন করে সাহিত্যের গতি নির্দেশ করতে বাধ্য, অর্থাৎ নিরপেক্ষ থাকতে পারবেন না। পক্ষান্তরে যারা সাহিত্য সৃষ্টি করেন না, কিন্তু সাহিত্যরস আস্বাদন করেন তারাই এ-কাজের উপযুক্ত আমার আবছা-আবছা বিশ্বাস ইতিহাসের হেথা-হোথা ব্যত্যয় থাকলেও প্রধানত সাহিত্য-রসিকরাই সাহিত্যের গতি নির্দেশ করার চেষ্টা করেছেন (তাতে কোনও ফল হয়েছে কি না তা-ও জানিনে)। আপনি একটু চিন্তা করে জানাবেন। ইতোমধ্যে অতিশয় অনিচ্ছায় সবিনয় নিবেদন, আল্লা সামনে, আমি সস্তা-দামি কোনও হাততালির জন্য কখনও লিখিনি। তবে একথা নিশ্চয়ই সত্য, আমি পণ্ডিতজনদের জন্য লিখেছি অতি অল্পই। প্রধানত লিখেছি সেই ম্যান ইন দি স্ট্রিটের জন্য, যে হয়তো সামান্য ইংরেজি জানে, বাংলাটা মোটামুটি বুঝতে পারে এবং সিরিয়স বই পড়তে নারাজ। হঠাৎ মনে পড়ল দশম শতাব্দীর কবি আব্দুর রহমান (অদহমান) তাঁর কাব্য, অভ্রংশে লেখা সন্দেশ রাসকে বলেছেন, পণ্ডিতজন কুকবিতার সঙ্গে সম্বন্ধ রাখেন না, আর অজ্ঞজন অজ্ঞতাবশত কবিতায় প্রবেশ করে না। এজন্য যে মূর্খ নয়, এবং পণ্ডিতও নয়, অর্থাৎ মধ্যম শ্রেণির, আমার এ কাব্য তার জন্য।

আপনি যদি এ কাব্যখানা পড়ে না থাকেন তবে দয়া করে জোগাড় করে নেবেন। Quite apart from our present discussion. এরকম উত্তম কাব্য আমি জীবনে কমই পড়েছি। আব্দুর রহমান-কৃত সন্দেশ রাসক edited by হাজারীপ্রসাদ দ্বিবেদী, হিন্দি গ্রহরত্নাকর লিমিটেড, হীরাবাগ, বোম্বাই-৪)।

এবং finally বলুন তো, আমার নিজের প্রতি আমার যা কর্তব্য আছে সেটা পোলেমিকে ঢুকে সফল হবে, না, যেটুকু সময় পাই সেটা সৃষ্টিকর্মে (তা সে ভালো হোক মন্দ হোক) লাগালে। আমাকে আক্রমণ করে এ যাবৎ যেসব incompetent লেখা বেরিয়েছে আমি তো তার একটারও উত্তর দিইনি। তাতে সময় নষ্ট, শক্তিক্ষয় এবং সব বেফায়দা।

আমিও শারীরিক কুশলে নেই। বিশ্বভারতীতে চাকরি নিয়ে আমার সর্বনাশ হয়েছে। আশা করি আপনি কুশলে আছেন। সশ্রদ্ধ নমস্কার জানবেন।

—গুণমুগ্ধ সৈয়দ মুজতবা আলী
শান্তিনিকেতন

.

॥ প্রাণতোষ ঘটককে লিখিত পত্র ॥

Indian Council for Cultural Relations
২১ সেপ্টেম্বর ৫০

প্রিয়বারেষু,

আসবার সময় আপনার সঙ্গে দেখা করে আসতে পারিনি তখন কলকাতায় বড় ডামাডোল। এমনকি হাওড়া হয়েও আসিনি, এসেছিলুম দমদম হয়ে অ্যারোপ্লেনে।

এসে অবধি প্রায়ই ভেবেছি আপনাকে লিখি কিন্তু গোড়ার দিকে কাজে ব্যস্ত ছিলুম এবং শেষের দিকে দিল্লির বাতাবরণের চাপে এমনি নির্জীব হয়ে পড়ি যে আর কোনও কাজে মন যায়নি– সামান্যতম চিঠি লেখাতে পর্যন্ত না।

মৌলানা সাহেব আমাকে কলকাতা থেকে ধরে নিয়ে আসেন উপরের প্রতিষ্ঠানটির সেক্রেটারিরূপে। আমার অপরাধ আমি আরবি, ফারসি এবং ফরাসি জানি। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান (এবং বর্তমানে একমাত্র) কর্ম হচ্ছে আরবি-ফারসি-তুর্কি-ভাষী মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ভারতবর্ষের সংস্কৃতিগত যোগসূত্র স্থাপনা করা। দিল্লির পররাষ্ট্র বিভাগ ভাষা এবং অন্যান্য বিষয়ে অজ্ঞতাবশত এ-কর্মটি করতে পারেননি বলে মৌলানা সাহেবের শরণাপন্ন হন। মৌলানা সাহেবের জন্ম মক্কায়, পড়াশোনা করেন অজহরে কাইরোতে। তিনি মধ্যপ্রাচ্যের সব ভাষাই জানেন এবং অতি উত্তম আরবি লিখতে পারেন।

উপস্থিত আমরা একখানা আরবি ত্রৈমাসিক চালাচ্ছি। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বিশেষ করে মিশর এবং ইরাকের কৌতূহলের অন্ত নেই– আমরা সেই কৌতূহলের ওপর নির্ভর করে ভারতবর্ষের সনাতন বাণী এবং পরবর্তী যুগের কৃষ্টি সামঞ্জস্য এবং বর্তমান যুগের গান্ধী রবীন্দ্রনাথ তাঁদের সম্মুখে পরিবেশন করবার চেষ্টা করছি। সাধারণের মনোরঞ্জন করবার জন্য পঞ্চতন্ত্র অনুবাদ করছি (পঞ্চতন্ত্রের কিয়দংশ একাদশ শতাব্দীতে কালিয়া দিমনি নামে আরবিতে ও ইয়ার-ই-দানিশ নামে ফারসিতে অনূদিত হয় এবং সেই সময় থেকে এই বই মধ্যপ্রাচ্যেআরব্য-রজনীর মতো জনপ্রিয় হয়ে আছে)।

তুর্কিতে সংস্কৃতের অধ্যাপক আছেন, আমরা ইরানে একজন সংস্কৃতের অধ্যাপক পাঠিয়েছি। কাইরো, বাইরুৎ, দমস্কস, বাগদাদেও পাঠাবার বাসনা রাখি।

তা ছাড়া ছাত্র-পাঠানো, বিদেশি ছাত্রের আমন্ত্রণ, ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদ, কলা-নিদর্শনের ফিলম ও ল্যান্টার্ন-স্লাইড, সঙ্গীতের রেকর্ড, বেতার-যোগে যোগাযোগ স্থাপনা-এসব বিস্তর কাজ সামনে পড়ে আছে। ভারতবর্ষের মৌলবি-মাওলানারা আমাদের কাজে সাহায্য করেছেন, পূর্বেই বলেছি, বিদেশ থেকেও কৌতূহলের উৎসাহ পেয়েছি।

আসছে বছর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগ খোলা হবে। তখন কাজ হবে, সিংহল, বর্মা, মালয়, থাই এবং ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনা করা। তার পর ক্রমে ক্রমে চীন-জাপান, পশ্চিম ইয়োরোপ ও আমেরিকা।

ঈষৎ অবান্তর, তবু বলি– ইংলন্ডে কোনও বুদ্ধ, মহাবীর, চৈতন্য, গাঁধী জন্মাননি তবু British Council for Cultural Relations প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে আর আমাদের কর্তারা উপস্থিত একলক্ষ টাকা খরচ করছেন। ওদিকে ইংরেজ দুশো বছর ধরে বিদেশে আমাদের মুখে বিস্তর কলঙ্কপ্রলেপ প্রাণপণপ্রেমসে লেপেছে–তার বিরুদ্ধে লড়তে হলে কত টাকার প্রয়োজন বিবেচনা করুন।

যাক– আপনাকে আর পাঁচালী শোনাব না– পুজোর হিড়িকে নিশ্চয়ই বড্ড ব্যস্ত আছেন।

তবু দিনকাল কী রকম কাটছে জানাবেন। আমি মাসিক দৈনিক বসুমতী বহুকাল হল দেখিনি বাংলা বলতে এখানেদেশআনন্দবাজার আরসত্যযুগের সঙ্গে মাঝে মাঝে ঝলকের তরে দর্শন হয়। আনন্দবাজার ইত্যাদি দৈনিক হাওয়ায় আসে এবং এখানে অপরাহু তিনটের সময় বিলি হয়।

এখানে বাসা পেয়েছি Constitution House-এ। পার্লামেন্টের মহামান্যবর সদস্যরা এখানে সেশনের সময় বাস করেন। এরা M.P; কেউ বলে মহাপুরুষ, কেউ বলে মহাপাপী, কেউ-বা বলেমহা-পাষণ্ড। খোদায় মালুম, কোনটা ঠিক।

আশা করি কুশলে আছেন।

—মুজতবা আলী

102 Constitution House
New Delhi-1

.

(২)

সদন্তঃকরণেষু,

আপনি শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ, আপনি জানেন। কিন্তু উপস্থিত শোকাতুর হয়ে আছেন বলে নিবেদন করছি–

অশৌচ ও শ্রাদ্ধ-শান্তির ব্যবস্থার গূঢ় অর্থ অশৌচের ক-দিন শোক করার পর, শ্রাদ্ধ-শান্তি করে পুনরায়, সাধারণ্যের মধ্যে আপন স্থান গ্রহণ করবে। শোকের অন্ত নেই, তাই পাছে মানুষ ক্রমাগত শোক করে করে তার কর্তব্য অবহেলা করে তাই শাস্ত্রকার ক-দিন পর দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যাবে তার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ব্রাহ্মণ উচ্চবর্ণের অর্থাৎ তার জ্ঞান আছে বলে আশা করা গিয়েছে, সে অল্পদিনেই মন বেঁধে কর্তব্য-কর্মে ফিরে যেতে পারবে তাই তার অশৌচ (period of mourning) সবচেয়ে কম। পাছে না জেনে কেউ তাকে কোনও প্রকারের পীড়া দেয় তাই ওই সময়ে শোকাতুরকে বিশেষ বেশ পুরতে হয়–ইংরেজ যে রকম কালো পোশাক পরে, কিংবা বাহুতে কালো পট্টি বাঁধে।

অতএব, এখন কাজকর্মে মন দিন। কর্তব্য কঠোরতর হল, সাহায্য কমে গেল। কিন্তু দয়াময় চরম সহায়।

আমি কর্মে উপস্থিত থাকার জন্য বৃহস্পতিবার কলকাতা আসার ব্যবস্থা করেছিলুম কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পুনরায় দাঁত নিয়ে শয্যাশায়ী হলুম। কাল শেষ injection নিয়েছি। তবে আশা করি শীঘ্রই দেখা হবে।

—আপনার
সৈয়দ
শান্তিনিকেতন

.

(৩)

২১।২।৫৭

প্রিয়বরেষু,

আপনি-আমি একই সময়ে চিঠি লিখেছি; আশা করি আমারটা পেয়েছেন। সেটাতে বসুমতীতে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করার বাসনা রাখি তার কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত ছিল।

লোহার ব্যবসাতে আপনাকে একদিন যেতে হবে সে-কথা আমি জানতুম কিন্তু এত শীঘ্র, সেটা ভাবিনি। এতে আপনি বিচলিত হবেন না। রবীন্দ্রনাথ যদি পাট্টা কবুলিয়ৎ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কয়লা-বেলচা নিয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে থাকতে পারেন তবে আমরাই-বা এত নিরাশ হব কেন? তবে আপনার এই ব্যবসা থেকে একদিন বেরুনো আপনার পক্ষে হয়তো কঠিন হতে পারে। ভীষ্মদেব শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন, যে ব্যক্তি বৃক্ষের উচ্চ শাখাতে আরোহণ করেছে তাকে অহরহ জাগ্রত থাকতে হয়। কাবুলিরা বলে; এ যেন সিংহের পিঠে চড়ার মতো। ঘুমাবার উপায় নেই। পড়ে গেলেই সিংহ খেয়ে ফেলবে। আমাদের গ্রাম্য কবিও বলেছেন,

এমন অনেক বন্ধু আছে, আশা গাছে দেয় রে তুলে,
ভালবেসে নামায় এসে এমন বন্ধু কজন মেলে?

কিন্তু জগদ্বন্ধু তো আছেন।

বসুমতীর জন্য হয়তো সুদক্ষ একজন কর্মচারীর প্রয়োজন হবে। তৈরি মাল নয়। খানিকটা কাঁচা। যে আপনার নির্দেশ নেবার মতো খানিকটা তালিম পেয়েছে কিন্তু স্বাধিকারপ্রমত্ত নয়। এখন থেকেই এবিষয়ে কিছু কিছু চিন্তা করে এদিক-ওদিক নজর ফেলবেন। সময় এলে আমিও দু-একজনের নাম উল্লেখ করব।

কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা এইবারে নিবেদন করি।

অরবিন্দ ঘোষ জেল থেকে খালাস পেয়ে উত্তরপাড়াতে বলেছিলেন, বিপ্লব কার্যে যুক্ত থাকার সময় প্রায়ই তিনি হৃদয়ঙ্গম করতেন, দেশকে তিনি কোন্ দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, সে সম্বন্ধে তাঁর যেন সুস্পষ্ট ধারণা নেই–পদাতিক নাই-বা জানল তার লক্ষ্য কোথায়, কিন্তু সেনাপতিকে সে বিষয়ে স্থিরনিশ্চয় হতে হয়। অরবিন্দ তার পর বলেন, কিন্তু কাজের চাপে নির্জনে গিয়ে সে-বিষয়ে চিন্তা করার অবকাশ তিনি পাননি। তাই তিনি বাঙলার জনসাধারণ এবং কর্মীদের কাছ থেকে কিছুদিনের জন্য অনুপস্থিতি কামনা করেছিলেন। এ-সব খুব সম্ভব আপনার জানা কথা, এবং এটাও নিশ্চয় জানেন, তার পর চন্দননগর হয়ে পণ্ডিচেরি চলে যান।

লোহাতে ঢুকে আপনাকেও পরিষ্কার জানতে হবে লক্ষ্য আপনার কী। এখন ব্যবসাটির বিস্তৃতি ও পরিমাণ আপনি চিনে নেবেন। পরে কিন্তু আপনাকে একদিন নির্জনে গিয়ে চিন্তা করতে হবে আপনার লক্ষ্য কী, অর্থাৎ ব্যবস্থা সর্বাঙ্গসুন্দর হয় কী প্রকারে, কোন্ দিকে চললে মারের হাত থেকে যথাসম্ভব সুরক্ষিত হওয়া যাবে। কিছুদিন পর কিয়ালের জন্য এই নির্জনের সাধনাটি আপনি অবহেলা করবেন না। আমি আপনাকে কী উপদেশ দেব, কিন্তু আমার যদি দেবার মতো কিছু থাকে তবে এই একটিমাত্র উপদেশ।

বসুমতীতে প্রকাশিত নামের তালিকাতে আমার নাম দেবার প্রয়োজন ছিল না। কারণ আমার সঙ্গে আপনার ঈশুর পিতৃদেবের কোনও লৌকিকতার সম্পর্ক ছিল না। তবে বাদ দিলেও দুশ্চিন্তা হত– আপনারা আমার মনের খবর পেয়েছেন কি না তাই ভেবে।

ওই সময়টা আমি দৈঃ এবং মাঃ উভয় বসুমতীর প্রত্যেকটির ছত্র পড়েছি। যুগান্তর এবংস্টেটসম্যানও। আপনারা শোকাতুর ছিলেন বলে, কোনও জায়গাতেই পিতৃদেবের কোনও পাকা জীবনী বেরোয়নি। তার জন্য মনে মনে ব্যবস্থা করবেন। ইতোমধ্যে তাবৎ কাগজের কাটিং একটা জায়গায় রাখবেন। আমি আসছে বছর একটি ছোট প্রবন্ধ লিখব। (আমার প্রথম ইচ্ছে হয়েছিল, শ্রাদ্ধের দিনই লেখাটি প্রকাশ করার, কিন্তু মন তখন শোকাতুর ছিল, দেহের পীড়াও ছিল– লেখাতে সংযম থাকত না, এবং আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে পাঁচজন অজ্ঞ বলে ভুল বুঝত)। ইতোমধ্যে কলকাতায় এলে কাগজপত্র নিজেই দেখে নেব। নতুবা সময় এলে আপনাকে পাঠিয়ে দেবার জন্য স্মরণ করিয়ে দেব।

আজ এখানে শেষ করি।

আপনার ভ্রাতা এবং ভগ্নীদের আমার প্রীতিসম্ভাষণ জানাবেন।

এ গৃহে শান্তি করুক বিরাজ মন্ত্রবচন-বলে,
পরম ঐক্যে থাকুক সকলে, ঘৃণা যাক দূরে চলে;
 পুত্রে পুত্রে মাতা-দুহিতায় বিরোধ হউক দূর,
 পত্নীপতির মধুর মিলন হোক্ আরো সুমধুর;
 ভায়ে ভায়ে যদি দ্বন্দ্ব থাকে তা হোক আজি অবসান,
 ভগিনী যেন গো ভগিনীর প্রাণে বেদনা না করে দান;
জনে জনে যেন কর্মে বচনে তোষে সকলের প্রাণ,
নানা যন্ত্রের আওয়াজ মিলিয়া উইক একটি গান।

— অথর্ববেদ

শান্তিনিকেতন
 মুজতবা আলী

.

॥ শ্রীঅমলেন্দু সেনকে লিখিত পত্র ॥
 (১৪৯/এ বকুলবাগান রোড, কলিকাতা-২৫)

(১)

২ জুলাই, ৫৩

শ্ৰদ্ধাস্পদেষু,

আমি শব্দতাত্ত্বিক নই, কাজেই আমার সাহায্য নিয়ে অভিধান নির্মাণ করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। বিশেষত আমার কাছে ভালো অভিধান (আরবি, ফারসি, তুর্কি ভাষায়) নেই যে সেগুলো দেখে ত্রুটিবিহীন অভিমত দিতে পারি।

যদি অপরাধ না নেন তবে বলি, কিছুটা ফারসি শিখে নিন, যাতে করে অন্তত সে ভাষার অভিধান কাজে লাগাতে পারেন।

আমি যে অর্থগুলো দিলাম সেগুলো ভাসা ভাসা সাহিত্যিকের জন্য প্রশস্ত, শব্দতাত্ত্বিকের জন্য যথেষ্ট নয়। এগুলো আমার বরাতে ফেলে অভিধানে ব্যবহার অবিচার করা হবে।

শামী-কাবাব- শম (Syria) দেশে প্রচলিত এই অর্থে শামী-কাবাব। মাংস পিষে বড়ার মতো চেপ্টা করে ভাজা কাবাব।

সীনা কলীজহ— পাঁজরের মাংস টুকরো টুকরো করে তার সঙ্গে lever (আস্ত কিংবা টুকরো টুকরো করে মিশিয়ে শুকনো মাংসের ঝোল।

ফালুদা প্রায় ice-cream.

জরীন কলম– সোনার কলম।

জহ্নুধারা– জহ্নমুনির দেহ হইতে নির্গত (ধারা) কণা— জাহ্নবী অর্থে।

চাটিম চাটিম– তবলার বোলের অনুকরণে।

শব্দ– cf. সেতারের পিড়িং পিড়িং। Onomatopoeic.

পেতলে নিয়ে পাতলা করে নিয়ে। পেতলে নিয়ে অচলিত slang.

 কানজোখা– কান পর্যন্ত উঁচু।

 হাঁসুলি বাঁক–হাঁসুলির মতো বাঁকা।

শুদ্ধরণিক– যা ইচ্ছা লিখুন।

আশা করি কুশলে আছেন।

—মুজতবা আলী

.

(২)

১৮।৭।৫৪

 শ্ৰদ্ধাস্পদে,

আপনার প্রথম চিঠির উত্তর তখন ভালো করে দিতে পারিনি। চাকরির চাপ কখন যে জগদ্দল পাথরের মতো নেমে আসে আর কখন যে হঠাৎ হাল্কা হয়ে যায় তার হদিস পাওয়ার চেষ্টা আবহাওয়া দপ্তরের ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো। না হলে তখনই আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানানো উচিত ছিল, আপনি যে অশেষ পরিশ্রম স্বীকার করে আমার বইখানার ভুলত্রুটি ধরে দিয়েছেন তার জন্য। সংস্কৃতের ওপর (কথা যখন উঠল তখন বলি, কোনও ভাষার ওপরই) আমার যথেষ্ট দখল নেই বলে নানা রকমের বালসুলভ ভুল করে থাকি। তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয় আইন করেছেন, মূল ভাষাতে যে রকম বানান থাকবে অর্থাৎ দীর্ঘ হ্রস্ব, স শ– বাংলাতে তার-ই কাছে আসবার চেষ্টা করবে। এরও ব্যত্যয় বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছেন– যদি বানানটি চালু হয়ে গিয়ে থাকে তবে পুরনো বানানই চলবে। আমি এই ব্যত্যয় মেনেই লিখেছিলুম সাবাস। সে দিন হঠাৎ দেখি রবিঠাকুর তাঁর অতি শেষদিকের লেখাতে লিখেছেন শাবাস (কথাটা শাদ [আনন্দ), যার থেকে শাদী, বিয়ে অর্থে ব্যবহার হয়, বাশথাকা–খুব সম্ভব সংস্কৃতবস ধাতু) কিংবা শাহ–রাজা, বাশ থেকে হবে। যা-ই হোক না কেন, শ, স নয়) কাজেই আবার বানান বদলাতে হল। এখন বলুন তো বাংলা লিখি কী প্রকারে।

আরবি, ফারসি, তুর্কি (তুর্কিস্থানের জগতাই তুর্কি ভাষা ও এশিয়া মাইনরের ওসমানলি তুর্কি ভাষাতে তফাত বাংলা অভিধানে এখনও করা হয়নি), উর্দু, সংস্কৃত, পর্তুগিজ আর অনেক ভাষা থেকে শব্দ এসেছে। এসব তাবৎ ভাষা শিখে, তাদের বানানের হ্রস্ব-দীর্ঘ জেনে তবে বাংলা লিখতে হবে। উত্তর হতে পারে অভিধান দেখো। কোন অভিধান? রাজশেখরবাবুর বইখানা অতি উত্তম কিন্তু তিনিও তো ওই কর্মটি করতে অক্ষম। জ্ঞানবাবুর অভিধান আরও বঢ়িয়া কিন্তু তিনি মেলা গ্রাম্য অথচ চালু কথা দেননি, এবং বানানের হ্যাপা সেখানেই তো বেশি। তবে?

ওয়াকিফহাল না লিখে আমিওকিব-হাল লিখেছিলুম, পাছে বাঙালি পাঠক এর ছদ্মবেশ বর্জিত চেহারা চিনতে না পারে। বিশ্বভারতীর পুলিন সেন প্রথম কয়েক অধ্যায় প্রুফ দেখার সময় (সেগুলোর সমাস জোড়া, বানান consistency চমৎকার হয়েছে) ওটাকেওয়াকিফহাল করে দেন। তা হলে হেস্তনেস্তকেহনীস্ত এবং অকুস্থলকেওয়াকেয়াস্থল লিখতে হবে। সুচতুর পাঠক কিংবা/এবং আপনার মতো দিকসুন্দরী-বল্লভ (আমার সরসিকা সবচেয়ে চিংড়ি ছোট-বোন ডিকশনারির নাম দিয়েছেদিকসুন্দরী –অর্থাৎ সে সুন্দরী বানানের গোলকধাঁধায় দিক বাতলে দেন, তার পর ফিক করে হেসে বলেছিল, অবশ্য বাংলাতে ওনারা দিক দেখান না, দিক্‌ করেন বেশি। প্রভাত মুখো দিক্করী–যে দিক করে রমণী অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁর কুচঁশেখর তুখাঞ্জন… এবং খট্টে খট্টে দিক্‌রিগণ পদ্য পড়েছেন কি? অপূর্ব!) পূর্বপর (context –পূর্বপর ঠিক প্রতিশব্দ কি না জানি না আপনাকে চিঠি লেখা এক গব্বযন্তনা) বিবেচনা করে মানে ধরতে পারবে ঠিকই কিন্তু সাধারণ পাঠকের ওপর এই শব্দতত্ত্বের গর্দিশ কাঁপানো নিশ্চয়ই আর্য-আচরণ নয়।

কিন্তু যে প্রশ্ন মনে নিয়ে এ-পত্র লিখতে আরম্ভ করি সেটি আপনার দিকসুন্দরী কতদূর এগুলো? ইতোমধ্যে ওদুদ সাহেবের বইখানা বেরিয়েছে। দেখেছেন নিশ্চয়ই। ওটি কিন্তু অতি সাবধানে ব্যবহার করবেন। (১) শিলওয়ার, শওয়ার ইত্যাদি। জিন্দেগী, জিন্দগী। পশতু, পুশতু। আরবি-ফারসি-উর্দুতে (জগতাই ওসমানলি তুর্কিতে এবং সিন্ধি-মপলা ভাষাতেও– বিবেচনা করি আরবি হরফে লেখা সব ভাষাতেই) vowel points অর্থাৎ জের-জবর-পেশ দেওয়া হয় না। তাই লেখা হবে জন-দ-গী (দীর্ঘ vowel points দেওয়া হয়)। সেই ভাবে প-শ-ত-উ। প্রথম vowel points নিয়েই বেশিরভাগ মতভেদ হয়। তার কারণ ওটা সাধারণত তাড়াতাড়িতে বলা হয়। তাই ওটাকে vague indistict vowel বলা হয়। ইংরেজিতে about, polite, er-এও এই vague indistict vowel. এই vague indistinct থেকে পৃথিবীর যাবতীয় অন্যান্য vowel-এর সৃষ্টি। (Daniel Jones-এর An English Pronouncing Dictionary-র প্রথম পৃষ্ঠায় এর একটি উত্তম ছবি দেওয়া হয়েছে। (আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস প্রাচীন যুগে ঋ-এর উচ্চারণ ছিল এই vague indistinct vowel + a trill)। কাজেই শুনতে পাবেন– যদিও তাড়াতাড়ি বলা হয় বলে ঠিক ধরা যায় না- শিলওয়ার, ও…শ… etc। তাই আরবি ইলম* = জ্ঞান বাংলায় এলেম; তাই ম-হ-অ-ম-দ বাংলায় মুহম্মদ, মোহম্মদ, মহম্মদ, মামদো! (ঋষি আর্য, মহম্মদ মামদো!) অ-হ্সান (আরবি), ফারসি ইহসান, উর্দু– এহসান, বাংলা– আসান (মুশকিল আসান)। ইংরেজ লেখে Peshwar : পাঠান বলে পি, কিংবা পশার।

[*এর থেকে মালুম, তালিম, মুয়াল্লিম।]

কাজেই ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কোনও লাভ নেই।

রুবাইয়াতের অন্ত্যানুপ্রাস aaba হবে। তার একটা দৃষ্টান্ত পাবেন দেশে বিদেশের ৩৭৪ পৃ. সান্‌গে ওতন্ etc-। মাঝে মাঝে a a a a ও হয়।

আরও দু একটা কথা উত্থাপন করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু পেটের অসুখে কাতর হয়ে পড়েছি। বাঙালির birthright আমাশয়।

A. I. R.
কটক

—নমস্কারান্তে
 মুজতবা আলী

পুনশ্চঃ আপনি আমার লেখার যে প্রশংসা করেছেন তার দাওয়াই হিসেবে আপনাকে উষা কাগজের আষাঢ় ১৩৬১-র (33B, Amherst street থেকে প্রকাশিত ) শেষ পাতা পড়তে অনুরোধ করি। লেখকসেন। কে বলে বদ্যিরা বড় ঐক্যবদ্ধ? আপনি বলেন, আমার লেখা আশমানের তারা, উনি বলেন, পিঠের পাঁচড়া (সিলেটি প্রবাদ)।

আপনার রাস্তা Tawnsend না Tawnshend? অভিধান বলেন, দুইটারই উচ্চারণ Taunzend.

.

(৩)

২৩।৭।৫৪

শ্রদ্ধাস্পদেষু,

আপনার চিঠি পেয়েই উত্তর দিচ্ছি। একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলুম।

বাংলা ভাষায় আরবি, ফারসি এবং উর্দুর মূল এবং বানান নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে মোহদী নামক মাসিকে। অথচ সেগুলোর ব্যবহার আজ পর্যন্ত কোনও কোষকার করেননি। রাজশেখরবাবুর অভিধানের প্রথম প্রকাশ ভুলে ভুলে ছয়লাপ ছিল। তার বহু ভুল দেখিয়ে এক বাঘা মৌলবি সায়েব মোহম্মদীতে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত অনেক লেখা ওই মাসিকে বেরিয়েছে। এমনকি গত বত্সর ঢাকা থেকে প্রকাশিত মোহম্মদীতে মৌলনা আক্ৰম (আক্রমণ ) খার অভিধানের (ইটি তিনি শেষ করতে পারেননি) কিছুটা বেরিয়েছে। এইসব back number না দেখলে আপনার অভিধান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কারণ দু-চারটি শব্দের মূল আমাকে রীতিমতো হকচকিয়ে দিয়েছিল।

ছবীকে না হয় ছবি লিখলেন, কিন্তু বুকের মাঝে বাজল যে বিন্ (বীণা) লিখবেন কি?

অথচ আপনিই নজীর লিখেছেন।

কোষকারের অন্যতম প্রধান কাজই তো নিক্তি ধরে মাপা, এটা অচলিত না সুচলিত না অচল। তা না হলে তো সবাই অভিধান লিখত– আমিও লিখতুম। এ যেন কসাই বলছে, বকরির গলা কাটব কী করে, বড় মায়া হয়।

তাই দেখুন Oxford-কে Concise করতে গিয়ে কোষকারকে কতখানি ভাবতে হয়েছে। এ শব্দটি ইংরেজিতে মাত্র একবার ব্যবহৃত হয়েছে–কিন্তু প্রয়োগ করেছেন শেকস্‌পিয়ার দেবো কি দেবো না?

এককালে চলন্তিকায় সৈয়দ শব্দ ছিল না যদিওশেখ ছিল, মোগলপাঠানও ছিল আমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর তিনি সৈয়দ দিলেন– অবশ্য কাকতালীয়ও হতে পারে।

পূর্ব বাংলার ভদ্র সাহিত্যে আজকাল হরবকত, ফজর, জোহর, আসর, মগরিব, এশা এইপঞ্চসন্ধ্যার (পাঁচ নমাজের) উল্লেখ থাকে। আমার মা-ও বলতেন মগরিবের একটু আগে, কিংবা আসর-মগরিবের দরমিয়ান (অর্থাৎ মধ্যে) এবং এই পদ্ধতিতে সময় বোঝাতেন। আপনি এগুলো দেবেন, না দেবেন না? ওই তো আপনার গব্বযন্তনা– আমাদের কাছ থেকে এককণাওহমদরদী পাবেন না। (সহ+অনুভূতি, হম্‌+দর্দ, Sym+Pathos)

ধর্ম জানেন, আমি মস্করা করিনি। আমার এখনও মনে পড়ছে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বেনামিতে লেখা (কস্যচিৎ ভাইপোস্য) ব্রজবিলাস কিংবা তার পরের কোনও বেনামি লেখাতে আমি কট্টর* পেয়েছি। এবং চাটিম চাটিম আঁধারের আলোতে না হলে শ্রীকান্তে পড়েছি। কোনও এক মজলিসে পিয়ারী গাইবেন, তবলচি চাটিম চাটিম বোল তুলছে। আমি সিলেটের খাজা বাঙাল। এসব লবজো আমি তো আর গড়তে পারিনে।

[*‘করতা’ পেয়েছি ফতোয়া অর্থে এবং ওই অর্থেই ‘তৈলবট’।]

সুনীতিবাবুর শব্দগুলো দেখিনি। বলি কী প্রকারে? ওদুদ সায়েবের অভিধান সম্বন্ধে আর কিছু বলতে আমি নারাজ। অপ্রিয় কথা বলতে আমার বড় বাধে।

চট্ট+আর্য-চাটার্জি, বন্দ্যো+আর্য=ব্যানার্জি ইত্যাদি। বড়বাবু (দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর) বলেন চট্ট+উপাধ্যায় ইত্যাদি থেকে নয়। তার প্রবন্ধে এই আলোচনাটি পড়েছেন কি? যতদূর মনে পড়ে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সঙ্গে একমত ছিলেন।

Tawnshend, lawnsend দুটোই ইংরেজিতে আছে। উচ্চারণ একই– Taunzend/ Daniel Jones তাই বলেন। কিন্তু তা হলে অর্থাৎ বাংলায় টাউনজে লিখলে চিঠি মারা যাবে।

নমস্কারান্তে কটক
–মুজতবা আলী

.

(৪)

১২।১০।৫৪

 সদন্তঃকরণেষু,

পূজার পাঁচটা লেখা শেষ হতে না হতেই গৃহিণী দুটি শিশু নিয়ে এখানে উপস্থিত। একটার ২ বছর ৮ মাস, আরেকটার ৯ মাস। তাছাড়া অলসেশিয়ন কুরছানা, রোডেসের মুর্গিমোর্গা, হাঁস, ফুলবাগান সবজিবাগান, বারবিটু পাখি (গাছে, তার বাসার সুব্যবস্থা), পুকুরে পদ্ম– কত বলব? বিরাট ধুন্দুমার! আমি লবদ্বার বন্ধ করে মুর্শিদের নাম জপ করছি। একদম Paradise lost!

অপরাধ নেবেন না কিন্তু আমার মনে হয়, ঢাকার লোক যদি কলকাতায় জন্মায় তবে তার দু কূলই যায়। কুট্টির স্ল্যাঙ সে শেখবার সুযোগ পায় না। আবার সামবাজারীওসেখে না। অবশ্য যদি কেহ শ্যামবাজার অঞ্চলে মানুষ হয় তবে আলাদা কথা। পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আপনি সে অঞ্চলে বড় হননি। না হলেরেতে এবং রান সম্বন্ধে প্রশ্ন শুধাতেন না।

পক্ষান্তরে আমি পনেরো বছর বয়সে সিলেটের যাবতীয় slang শিখে ঘটি দেশে আসি। তার পর বছর দুই শ্যামবাজারের রক্-ক্লাবে বকাটে ছোঁড়াদের সঙ্গে বিস্তর আড্ডা মারি। আমি নিজে বিশৃবকাটে এবং একটি তুখোড় ইয়ার (বিদ্যাসাগর পশ্য)।

অতএব এ বাবদে আপনি আমার কাছে ছোড্ড এড়া পোলাজ। আপনি আমাকে যাবতীয় বিষয়ে ঢিড দিতে পারবেন, কিন্তু দাদা, বাঙাল-ঘটির এ-হেন অপূর্ব মাকালভেরেণ্ডা সংযোগ আপনি পাবেন না। এমনকি কুট্টি গল্প সঞ্চয়ন আমার ভাঁড়ারে যা আছে তা কোনও ঢাকাইয়ারও নেই। কলিকাতায় দেখা হলে আমার চ্যালেঞ্জ রইল।

আমার এই ইয়ার্কিপনা কখনও যায়নি। প্যারিস, ভিয়েনা, বার্লিন, লন্ডন এবং প্রাগে এই কর্মটি আরও মনোযোগ সহকারে করি। আমার জীবনের নীতি, –বই পড়বে গুণীদের, আর মিশবেঅজ্ঞদের সঙ্গে। গুণীদের সঙ্গে মিশে আর লাভ কী? তাঁদের যা বলার তা তো তাদের কেতাবেই রয়েছে। বরঞ্চ তারা often very disappointing. পক্ষান্তরে অজ্ঞদের কোনও pretension নেই। তাই পদে পদে তারা চমক লাগাতে জানে। তাই ইয়োরোপের বহু শহরে আমি সর্বদা দিন কাটিয়েছি লাইব্রেরিতে, রাতটা পাবে-পাবে –তাড়িখানায়। Smutty jokes-এর আমার যা সঞ্চয়িতা (বিধুশেখর শাস্ত্রী যখন রবিবাবুকে বললেন শব্দটা ভুল তখন তিনি কী উত্তর দিয়েছিলেন আজ আর মনে নেই কিন্তু ওটা বর্জন করেননি। সেটি– কী আর বলব, দম্ভ করতে নেই, মুর্শিদের মান– ক্রন্দসী নিয়ে নিশ্চয়ই আমি শেষদিন পর্যন্ত কাজিয়া-কোন্দল করব। যে অর্থটি লোকে নেবে সেইটিই অর্থ, বাকি সব অনর্থ–correct to a point. কিন্তু যে শব্দের অর্থ এখনও জনসমাজে liquid সেখানে আসল অর্থ, অভিধানে যা বলে, কবি যা mean করেছেন সেইটে বাদ দিয়ে এমন অর্থ নেব যেটা ব্যাকরণকে বলাৎকার করে, অভিধানকে অপমান করে এবং অনর্থ বের করে কবিতাটির রসভোগ থেকে বঞ্চিত করে? তা হলে বেগুনকেপ্রাণনাথ বললেই হয়! আশা করি এই সরেস কুট্টি গল্পটি জানেন। নাহলেপঞ্চতন্ত্রেররেডুসিয়ো আড় আসুড়ুম দ্রষ্টব্য।

আপনি ঠিক বলেছেন, কার্তিক কেন কার্তিক হবে?

চাটিম চাটিমে আপনার দ্বন্দ্ব কী বুঝতে পারলুম না। সানাইয়ের পো, সেতারের পিড়িং পিড়িং– ঠিক সেই রকম শরত্যাবু বললেন, তবলার চাটিম চাটিম। পো, পিড়িং পিড়িং-এ যখন প্রশ্ন উঠছে না মিষ্টি না কর্কশ, তখন চাটিম চাটিমের বেলা উঠছে কেন? সব কটাই তো অনমটোপোয়েইক– না কী জানি বলে ইংরেজিতে। তা হলে বাতাসের শনশন, ভ্রমরের গুনগুন মিষ্টি না কর্কশ শুধাতে হয়।

শব্দে আপনি আসল root না দেখিয়ে immediate root দেখানোটা prefer করেন। তার থেকে বুঝতে পারছি, আপনার মন আমার যুক্তিতে সাড়া দেয়নি। পুনরায় নিবেদন করি।

(ক) কোনও অভিধান (একটু বড় সাইজের হলেই) immediate source থেকে শেষ শব্দ পর্যন্ত দেখায়, এবং

(খ) কোনও অভিধান (একটু ছোট সাইজের হলেই) শুধু শেষ শব্দ দেখায়।

আজ পর্যন্ত ত্রিভুবনে আমি কোনও অভিধান দেখিনি যেখানে (গ) শুধু immediate source দেখায়– এক রাজশেখরবাবুর অভিধান ছাড়া।

Inter alia –জোলাপ সম্বন্ধে আমার আরবি অভিধান বলে শব্দটি ফারসি গুলাপ (গুল (ফুল} +আপ (অপূ cognate with sanskrit অপূ = জল থেকে। আরবি ভাষায়গ এবংপ অক্ষর নেই বলেগুলাপ শব্দ জুলাব হয়ে গিয়েছে। সেই আরবি শব্দ পুনরায় ফারসিতে ফিরে আসে জুলাব রূপেই (যে রকম ফারসি গওহর আরবি জওহর তার পর আবার ফারসিতে জওহর এবং গবেষণার ফলে পুনরায় গওহরও চালু হল। বাংলাতেও তাই দুটোই আছে– গৌহর proper noun-ও চালু আছে, আবার জওহর (Prime Minister) (আমাদের PM.-এর নাম অবশ্য জওয়াহির বা জওয়াহর, জওহর-এর বহুবচন। জহুরি, জউরি = jeweller-ও আছে।

যে গুলের (ফুলের) আব (জল) খেলে জোলাপ অর্থাৎ purgative হয় সেটা বোধ হয় আসলে ইসবগুল।

আমার কাছে ১০। ১১ শতাব্দীর এবং পূর্বেকার আভিসেন্নাও অলবিরুনিয় ডাক্তারি বই নেই। থাকলে হয়তো প্রমাণ করা সম্ভব হত যে এঁরা মেক্সিকো আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বেই purgative জুলাব জানতেন। এ বিষয়ে আমি কিন্তু নিঃসন্দেহ যে বাংলা-জোলাপ ইংরেজি থেকে আসেনি। উর্দু-হিন্দিতে জোলাপ রয়েছে, ফারসিতে আছে, আরবিতে আছে, তার থেকে না নিয়ে নিয়েছি ইংরেজি jalap থেকে যে শব্দ ইংরেজিতে আদপেই চালু নেই, সাধারণ ইংরেজি অভিধানেও থাকেই না, ১৭, ১৮ শতাব্দীতে বাঙলা দেশে ইংরেজরা ব্যবহার করত বলে শুনিনি, সেইটে এল ইংরিজি jalap থেকে? উচ্চারণটাও লক্ষ করুন। ফারসিতে পরিষ্কার জোলাব, উর্দুতেও তাই। আর ইংরেজি jalap উচ্চারণ জ্যালাপ! ইংরেজি a-এর hat, fat, cat তো আমরা নিই হ্যাট, ফ্যাট রূপে, কিংবা হেট কেট রূপেহোটকোট রূপে নয়। এই সম্পর্কে oxford-এ julep শব্দটাও দেখে নেবেন।

অবশ্য আরবরা ভুল করে থাকতে পারে। হয়তো তাদের জোলাপ ফারসি গুলাপ থেকে আসেনি। এসেছে স্প্যানিশ jalapa থেকে। তাই-বা কী করে হয়? স্পেনিশে অক্ষরের উচ্চারণ পরিষ্কার আরবীয় (স্কচ loch-এর মতো) তারা কোন্ দুঃখে ওটাকে জ করতে যাবে! আর আপনি যেসব যাবতীয় বেজাতের ফিরিস্তি দিয়েছেন তার মধ্যে একমাত্র স্প্যানিশদের সঙ্গেই আরবদের যোগসূত্র ছিল।

(Inter alia বাংলা লাশ, আমার মতে আরবি থেকে আসেনি। ফারসি লাশ শব্দ এসেছে আবেস্তান–সংস্কৃত নষ্ট থেকেনাশ হয়ে লাশ হয়ে। তুর্কির প্রশ্ন এখানে আদপেই ওঠে না।)

পর্তুগিজ সম্বন্ধে আপনার অবোধ্য কী লিখেছিলুম মনে পড়ছে না। যদি সে চিঠি ছিঁড়ে না ফেলে থাকেন (আমার বিনীত অনুরোধ ছিঁড়ে ফেলবেন; না হলে আমি-আপনি গত হওয়ার পর কোনও গাধা সেগুলো ছাপিয়ে দেবে এবং গুণীরা বলবেন, আমার Philology-তে claim-ও ছিল। আমার নেই; আমি আপনাকে কাঠবেরালির সেবা করছি মাত্র) তবে জানাবেন।

Mary, পর্তুগিজ থেকে, এটা পাবেন মাইরি শব্দের under-এ।

চ্যাটার্জী, ব্যানার্জী আপনার অভিধানে না থাকতে পারে কিন্তু চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি পঞ্চকুলীন ব্রাহ্মণ ঘোষ, বসু ইত্যাদি পাঁচ কায়েত, শেখ সৈয়দ মোগল পাঠান, কৈবর্ত, নমশূদ্র, হাড়ি ঢোম ইত্যাদি থাকবে না এ-ও কি বিশ্বাস্য? এদের নিয়েই তো আপনার বাঙালি জাত। মোহাম্মদীকে লিখে কোনও উত্তর পাবেন না। পেলে পাবেন কলকাতার-ই সাহিত্য পরিষদ কিংবা অন্য কোনও লাইব্রেরিতে।

অবদান তো চলে গেল। তা যাক্। উপায় নেই। আমি একটু মস্করা করে শব্দটা ব্যবহার করে থাকি।

এযাত্রা এই পর্যন্ত। আপনি যে লিখেছেন ৮ পাতা চিঠি শিগগির কারও কাছ থেকে পেয়েছি বলে ইত্যাদি, এতশিগগির কথাটার ব্যবহার আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন মনে হল। আমি শিগগিরের ব্যবহার শুধু ভবিষ্যতের জন্যই দেখেছি। অতীত হলে দেখেছি, হালে, ইদানীং, এদানির, কিছুদিনের মধ্যে ইত্যাদি দেখেছি। এদের কোনওটাই আপনি যে অর্থ দিতে চেয়েছেন সেটি প্রকাশ করে না, কিন্তু তার জন্যশিগগিরের প্রয়োগও দেখিনি। বিবেচনা করে জানাবেন।

বিজয়ার আলিঙ্গন জানবেন।

ভবদীয়
মুজতবা আলী

কটক
পুনশ্চ-১৭।১০।৫৪

আমাদের জিলিপি শব্দটা কোথা থেকে এসেছে জানেন কি? আমি জানিনে। পেটের অসুখের সময় দিল্লিতে গরম জিলিপি ঔষধার্থে খেতে বলা হয়।

.

(৫)

৭।৩।৫৮

 প্রিয়বরেষু,

হরিচরণবাবুর অভিধানে স্বরবর্ণের শেষে আছে। এবং তাতে এক পৃষ্ঠাব্যাপী চন্দ্রবিন্দু সম্বন্ধে আলোচনা আছে। আপনি সেটি পড়েছেন কি? তাতে পাণিনি থেকে কেচ্ছা শুরু।

আমি ১২৩ ৫৮ কলকাতা যাব। তার পর ঢাকা। ২০৪৫৮-এ কলকাতা ফিরে আসব। কলকাতায় কোথায় উঠব জানিনে। ঢাকার ঠিকানা, C/o, Mrs. Ali, Qamrunnesa Hostel, 10 Segun Bagicha, P.O. Ramna, Dacca.

আপনাকে দিয়ে আমার একটা কাজ করিয়ে নেবার বাসনা ছিল অনেক দিন ধরে। ভরসা পেলে বলি।

—সৈ. মু. আ.
Santiniketan

.

শ্রীমতী অর্চনা মিত্রকে (২৯১ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, কলিকাতা-১৯) লিখিত পত্র

(১)

২।৩।৭২

মেহের অর্চনা,

প্রথমে দুটি বড় প্যাকেট, পরে ছোট্ট একটি, সর্বশেষে যে-পত্রিকায় তোমার বনফুল আছে এ-সব পেয়েছি। এ পর্যন্ত মাত্র একটা ভুইফোড় প্রকাশক ভিন্ন এখানে কলেজ স্ট্রিটের কোনও প্রকাশকই পশ্চিম বাংলার কোনও বই বিক্রির ব্যবস্থা করেনি। তুমি একবার ঘুরে যাও না। Permit পেতে তোমার অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। তবে পশুপতি খান পায়নি। অন্তত কেউ একজন নিখোঁজ বা/এবং মারা গেছে না বললে নাকি পারমিট মেলে না। তোমার সেই ঠাকুরমা, যে তোমাকে হামেশা দিক করত, তাকে ঢাকাতে এনে গঙ্গাপ্রাপ্তি করাতে পার না?

এখানকার খাদ্যাদি আক্রা নয়। তবে ওষুধের দাম, বেবিফুড গয়রহ অগ্নিমূল্য। আশু ভবিষ্যতে চালের অভাব হবে কি না বলতে পারিনে। … এখানে যা-সব হয়ে গিয়েছে তার গোর নিত্যি নিত্যি খোঁড়া হচ্ছে। একটা জিনিস আমাকে বড় বিচলিত করেছে। ধর্ষণের ফলে হাজার হাজার কুমারী অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। এদের অনেকের চতুর্দশ কুলে কেউ নেই। সমাজেও এরা স্থান পাবে না, অনেকেই আমাদের শত চেষ্টা সত্ত্বেও। এই যে তার সন্তানটি হতে যাচ্ছে তার প্রতি এর অনুভূতিটা মিত্র। একদিকে কোন পশুর চেয়ে অধম বর্বর পাঠানের সন্তান এটা, অন্যদিকে ত্রিসংসারে ওই তার একমাত্র সম্বল। এবং অনেক ক্ষেত্রে কি আমরা দেখিনি যে বিবাহিত রমণীর আইনত জাত সন্তান বর্বর পশুর মতো সমাজের বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছে– তবু মা তাকে ছাড়তে পারে না!

আশা করি তুমি/তোমরা কুশলে আছ। গণ্ডা দুই সাহিত্যিক এখানে নিমন্ত্রিত হয়ে এল, কিন্তু কোনও লেখিকা স্থান পেল না। তাজ্জব! ১৩৯ F ধানমণ্ডী,

আনকল– আ

১৩৯ F ধানমন্দী
রাস্তা-১, ঢাকা-২ বাংলাদেশ।

.

(২)

খবরদার–!

কলকাতা
৩ আগস্ট ৭০

 আম্মো ছেলেবেলায় একটি হাতের লেখা কাগজ চালাই। অবশ্য দাদার উপদেশ-আদেশের ওপর ভরসা করে। কাগজটার নাম ছিল কুইনিন–ম্যালেরিয়ার সে আমলের দাপট থেকে আজকের দিনের মস্তানরা বিস্তর বহু শিখতে পারবে। আমার বয়স ১৫, দাদার সতেরো। ওই বয়সে সর্ব বালক হয় সবজান্তা (all knowing age, কুকুরছানার যে-রকম ছ মাস বয়সে হয় all growing age, চটিজুতো থেকে সোফার মখমল তাবৎ জিনিস চিবিয়ে কুটি কুটি করে), তদুপরি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে আগাপাশতলা রিফর্ম করার দুর্বার কামনা জাগল আমাদের চিত্তে। তাই কাগজের নাম করা হল কুইনিন–সুন্দুমাত্র তেতো কথাই শোনাব।

বলা বাহুল্য, আমরা অত্যল্পকালের মধ্যেই ঝাঁকে ঝাঁকে দুশমন বানিয়ে ফেললুম। কিন্তু কাগজ বন্ধ হওয়ার আরও একটি কারণ ছিল। আজ না হয় আমার হাতের লেখা বগের ঠ্যাঙ কাগের বাসার মতো চিত্তির-বিত্তির। তখন ছিল রীতিমতো খুশখৎ, বিলকুল বখৎ বাবখদ (বখদ আর বখৎ একই কথা) নয়। অতএব, আমারই ওপর পড়ল তাবৎ পত্রিকার আদ্যন্ত লেখার ভার। লাও ঠ্যালা!

এই দুই কারণে কাগজটি অচিরাৎ তাঁর সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করলেন।

আশীর্বাদ না জানিয়ে হুশিয়ারি জানালুম। সম্পাদকমণ্ডলী অপরাধ নেবেন না। কিমধিকমিতি।

— সৈয়দ মুজতবা আলী

.

॥ শ্ৰীসবিতেন্দ্রনাথ রায়কে (ভানু রায়) লিখিত পত্র ॥

(১)

৯।১।৬৬

ভাই ভানু রায়,

As usual শনির সন্ধ্যায় প্রুফ পেয়েছি। আমার শরীর আরও খারাপ। ম্যাপে একটা অতি নচ্ছার আতসি কাঁচ দিয়ে হিটলারের Russian অভিযানের অজানা-অচেনা জায়গাগুলো Pen down — ঘণ্টা দুই নাগাড়ে– করার দরুন কাল থেকে double image দেখছি তাই একটু সময় লাগবে। তবে স্থির করেছি, যেমন যেমন হবে পাঠিয়ে দেব। ধ্বনি যুদ্ধের তাবৎ material যোগাড় করার পর এই হাল– লিখতে গেলে বেশিক্ষণ একসঙ্গে, হঠাৎ সব blotted out হয়ে যায়। খুব সম্ভব এই সপ্তাহেই কলকাতা গিয়ে nursing home-এ ঢুকব– অবশ্য আমার main trouble-এর জন্য। তখন ডাক্তার যদি outside world-এর সঙ্গে contact না রাখতে দেয়, কিংবা কাজ করতে না দেয় তবে, ভাই তোমাকেই সব করতে হবে– বড়বাবু বাবদে। আমার ছোকরাটির অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আরও দু-একটি প্রাচীন দিনের লেখা– of course after 1949 –পাওয়া গেছে। তোমার যদি মনে হয়, তোমার বইয়ের size যথেষ্ট বড় হচ্ছে না, তবে আমাকে পত্রপাঠ জানিয়ো। কবে কলকাতা যাব জানিনে বলে এ কয়েকটা দিন জরুরি চিঠি বা প্রুফ Regd, পাঠিয়ে। এমনিতেই চিঠি হারায়– redirection-এ risk-টা greater. ধ্বনির উত্তর কবে লিখতে পারব? কে জানে! একটু wait করো please.

–আ

.

(২)

28.02.68

ভ্রাত ভানু,

আমি দুই ব্যাটাকে তাদের বাপপিতেমর ভিটে দেখাতে সিলেট গিয়েছিলুম। ফিরে এসে, তোমার কার্ডদ্বয় পেয়ে আনন্দিত হলুম। বড়বাবু সম্বন্ধে আমি আর নতুন কী বলব!

এবারে তিনশোটি টাকার একখানা চেক শ্রীমোহিত চৌধুরী, Bus Proprietor, Nicha Patti, Bolpur. এই ঠিকানায় রেজিস্ট্রি করে পাঠালে কৃতজ্ঞ থাকব। সঙ্গে সঙ্গে একখানা p.c–তে তাঁকে জানিয়ো, তাঁর নামে চেক গেল এবং টাকাটা আমার বাড়ি চালানোর খরচারূপে। তুমি যে আমার প্রকাশক সে খবরটাও দিয়ো।

বিমল মুখুয্যে (বড়দা)-কে ফোন (473419) করে জানিয়ে আমি মার্চের শেষ সপ্তাহে বা এপ্রিলে দেশে ফিরব। তাকে স্বয়ং পরে লিখব। গজেনদাকে নমস্কার ও তোমাকে শুভ ঈদের আলিঙ্গন।

আশীর্বাদক
সৈয়দ মুজতবা আলী

নিচের ঠিকানায় একখানা “বড়বাবু” পাঠাতে পারো?

Per Regd. Post
Pakistan National Oils Ltd.
A.S. Mahmud Esq.
 Motijheel (মতিঝিল)
Dacca. E. Pak.

 পুন. PC.-তে 07 Paise স্ট্যাম্প লাগিয়ো।

Thanks.

.

॥ শ্রীমতী সুনন্দা সেনকে (লাবান, শিলং) লিখিত পত্র

(১)

৬।১১।৫৮

 বউদি,

তোমার চিঠি পেলুম। আমি একটা জিনিস এ জীবনে কখনও করে উঠতে পারলুম না। আর পারব না বলে পঞ্চাশের পর সে চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছি এবং সর্ব ভুবনের গালাগাল খাই। সেটা balancing of the budget- টাকার নয়। সেটা তো আছেই, কিন্তু তার জন্য গালমন্দ শুনতে হয় না হয় সময়ের। আপন পড়া, তা-ও হতচ্ছাড়া, ছন্নছাড়া, নিয়ে এত বেশি সময় কাটিয়ে দিই যে অন্য কোনও কাজ করে উঠতে পারিনে। বিশ্ব-সংসার চটে যায়, ভাবে হৃদয়হীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন। আমি পড়ে পড়ে গাল খাই। তোমার short hand কি ক্রমেই long hand হচ্ছে পাস করছ কবে? চাকরি নেবে কখন? আমি যা জমিয়েছিলুম তা তো বিলেতে গিয়ে ফুকে দিয়ে এলুম।

যত টাকা জমাইছিলাম
শুঁটকী মৎস্য খাইয়া
সকল টাকা লইয়া গেল
গুলবদনীর মাইয়া।

এবারে নাগাড়ে শুঁটকি মৎস্য খেলেও আর টাকা জমবে না। তবু ভরসা আছে গরমে শিলং আসব। বউবাচ্চা আসবে কি না সে তো বর্তমান পরিস্থিতি থেকে কিছুই ঠাহর করতে পারছিনে। আশা করি তোমরা কুশলে আছ। তোমার কর্তা কিরকম আছেন? বসন্তকালে বিরহ নাকি বড় পীড়াদায়ক– কবিরা বলেন।

— আলী সাহেব
শান্তিনিকেতন।

.

(২)

২৩ নভেম্বর, ১৯৫৮

 বউদি,

আজ তোমার পাঠানো জামাটি পেয়েছি, আমি এই দুপুরের গরমে সেটা পরে উল্লাসে নৃত্য করছি। জানিনে, তুমি আমার একটি গল্প চাচা কাহিনীতে পড়েছ কি না; তাতে বরোদার রাজা আবিসিনিয়ার রাজাকে একখানি লাল কাশ্মীরি শাল উপহার দেওয়াতে তিনি নাকি খুশির তোড়ে, সেই রেড-সির গরমে অঙ্গে শাল জড়িয়ে জাহাজময় উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করে করে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। আমার অবস্থা তাই, সেই বর্ণনা পড়ে নিয়ে আমার হাল মালুম হবে। ইউরোপে পুরনো বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে গল্পগুজোব করেছি আর ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখেছি। এবং ভালো ভালো বর্দো ব্যার্গান্ডি খেয়েছি। তবে অল্প-স্বল্প ও জিনিস বেশি মাত্রায় খেলে সুখ পাওয়া যায় না। সত্যি বলছি বিনয় নয়–আমার লিখতে ভালো লাগে না, ওর ভিতর কেমন যেন একটা দম্ভ আছে। আজ এখানেই থাক, লেখাগুলো নিয়ে নাকের জলে, চোখের জলে।

আলী সাহেব
শান্তিনিকেতন

.

॥ শ্ৰীমনোরঞ্জন চৌধুরীকে (লাবান, শিলং-৪) লিখিত পত্র ॥

[১৯৬৫ সালে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিতপঞ্চতন্ত্র কয়েক পর্যায়েপন্টক শব্দ ব্যবহৃত হয়। পড়ে মনে হল উদ্দিষ্টরা একাধারে অবিজ্ঞ এবং চালাকের ভানকারী। একটু পালটিয়েপণ্ঠক শব্দটি অধিকতর অর্থবাহী হয় কি না বিবেচনা করতে লেখায় যে উত্তর পাই সেই পূর্ণ চিঠিটি এতৎসহ প্রকাশের জন্য পাঠাচ্ছি। চিঠির বয়ানপন্টক শব্দের কৌসুলীর হলেও পরবর্তী এক কিস্তিতে তদীয় পন্টক শব্দ ব্যবহার কালে উল্লেখ করেছিলেন অথবা পণ্ঠক যেমন কোনও পাঠক মনে করেন (হুবহু ভাষাটি মনে নেই) ॥

১৬।১১।৬৫

জনাব চৌধুরী সাহেব,

আপনার নামটি আমার স্পষ্ট মনে আছে, কিন্তু আশ্চর্য, চেহারাটি মনে নেই– (বোধহয় শ্যামবর্ণ ছিপছিপে) সাধারণত উল্টোটাই হয়। নয় কি?

পঞ্চতন্ত্র five days wonder.- ওর স্থায়ী মূল্য নেই। এবং যেই হাল্কাশৈলী ছেড়ে কদিচ কখনও সিরিয়স বিষয় নিয়ে আলোচনা করি অমনি পাঠককুল কড়া কড়া চিঠি লেখেন। আমি ভাড়–ওদের মতে– আমি আবার জ্যাঠামো করতে যাই কেন? আপনি কিন্তু প্রাচীন দিনের আত্মীয়তার স্মরণে দয়া রাখবেন।

পণ্ঠক বলতে আমার কী আপত্তি? কিন্তু ঘটিরা বলে পাটা (পাঁঠা) মাতাব্যথা (মাথাব্যথা) কতা (কথা)! তাই পন্টক। ঘটিরাপাঠা বলে না, বলে পাটা।

তদুপরি পাঁঠা বা পাঁটা বা পন্টক অর্থ গবেট, গাড়ল– সে তো ঠক হতে পারে না– ঠক হতে হলে তো বুদ্ধির প্রয়োজন।

আপনার আশীর্বাদ মাথা (মাতা) পেতে নিলুম।

 শঙ্কর আপনাকে জয়যুক্ত করুন। কিমধিকমিতি ॥

— খাকসার
সিতু
পো, আ, বোলপুর,
পশ্চিমবঙ্গ

পুঃ দয়া করে জনাব সায়েব, ভবদীয় লিখবেন না। আমাকে আগেরই মতো দেখবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *