পত্রপত্রিকার আলোকে নজরুল – সুনীল দাস
ভাষাতত্ত্বের প্রখর পন্ডিত নোয়াম চমস্কি প্রায় বছর কয়েক আগের (১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩) এক সাক্ষাৎকারে (কানাডা বেতারে, লিজালা ফ্রেমের সঙ্গে) জানিয়েছিলেন, ‘দেশপ্রেম হয় দু-ধরনের। প্রথম ধরনের দেশপ্রেমিকরা তাঁদের রাজনৈতিক দেশনেতারা যা যা বলেন তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। আর দ্বিতীয় ধরনের দেশপ্রেমিক হলেন তাঁরা যাঁরা আমাদের দেশ, জাতি, গোটা মানব সমাজকে নিয়ে চিন্তা করতে বলেন। এই দ্বিতীয় ধরনের দেশপ্রেমে মানুষের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিয়ে, মানুষের প্রতিবেশীদের নিয়ে ভাবনার আবশ্যিকতার কথা বলে।’ চমস্কির মতে এই দ্বিতীয় ধরনটাই সুস্থ, স্বাভাবিক এবং প্রকৃত দেশপ্রেম।
সম্প্রতি তিনটি বছর জুড়ে ইতিহাসবিদ সুধীরকুমার মিত্রের আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চা-সহ নানা বিষয়কেন্দ্রিক গ্রন্থরাজি, একটির পর একটি পড়তে পড়তে, লেখকের প্রাক জন্মশতবর্ষ, জন্মশতবর্ষ এবং শতবর্ষপূর্তি উদ্যাপন আলোচনা বিচিত্রায় নোয়াম চমস্কির এই সার্থক ‘দেশপ্রেম’কে ফিরে ফিরে উপলব্ধি করি। তাঁর ৮৩তম জন্মদিনে ৫ জানুয়ারি, ১৯৯২ প্রকাশিত পত্রপত্রিকার আলোকে নজরুল শিরোনামে ১০৫ পৃষ্ঠার বইটির মধ্যেও সুধীরকুমার মিত্র তাঁর স্বদেশ থেকে বিশ্বদেশের ভাবনায় নজরুলকেন্দ্রিক অন্বেষণ ও অনুভবমালার সেই সমুজ্জ্বল স্বাক্ষরটি রেখেছেন।
তিনখন্ডে হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ গ্রন্থের রচয়িতা সুধীরকুমার মিত্র তাঁর ‘অগ্নিপুরুষ নজরুল’-এর ‘বহুমুখী ব্যক্তিত্বে’র আস্বাদনে, কবিকে ‘নানান পরিবেশে খুব কাছ থেকে দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য’ প্রসঙ্গে সূচনার নিবেদনেই লিখেছেন ‘হুগলী জেলার সঙ্গে নজরুলের যোগাযোগ ছিল গভীর। এই জেলার ইতিহাস রচনার সূত্রে নজরুলের জনকল্যাণমুখী স্বদেশ চেতনার পরিচয় যা পেয়েছি, তা এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে মনে পড়ছে।’
সুধীরকুমার মিত্র কবি নজরুলের জীবন পর্যবেক্ষণকে বলেছেন, ‘‘আর্টিস্টের দেখা, ধেয়ানীর দেখা, তপস্বীর দেখা। তপস্বী নজরুলের জীবনধারা বিশ্লেষণ করলে এই শিল্পীর মানবতা ও ভগবত প্রেমের আকুতির সন্ধান পাই।’’ পত্রপত্রিকায় নজরুল প্রসঙ্গের সন্ধানে লেখক উল্লেখ করেছেন—ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত মুস্তাফা-নূরউল-ইসলামের গ্রন্থটির সাময়িক পত্রে জীবন ও জনমত (১৯০১—১৯৩৩)-এর।
মোসলেম ভারত নামে কলকাতা থেকে প্রকাশিত, মোজাম্মেল হক সম্পাদিত পত্রিকাটির সঙ্গে প্রথম থেকেই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন নজরুল ইসলাম। তাঁর সম্পাদনায় ৭ প্রতাপ চ্যাটার্জি লেন থেকে প্রকাশিত ধুমকেতু ও দৈনিক বসুমতী, আনন্দবাজার, অমৃতবাজার পত্রিকা থেকে শুরু করে নব যুগ পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় বিচিত্র বিশ্লেষণে নজরুল ইসলামের ‘সমাজ ও যুগ চেতনপ্রসূত পরিচয়’টিকে তুলে ধরতে গিয়ে সুধীরকুমার দেখিয়েছেন, ‘‘প্রকৃতপক্ষে, তাঁর সাংবাদিক জীবনের মূলে জ্বলন্ত দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল।’’ এই প্রসঙ্গে তিনি নজরুলের সাম্যবাদের দীক্ষায় মুজফফর আহমেদ এবং নিবারণচন্দ্র ঘটকের নাম উল্লেখ করেছেন। উদ্ধৃতি দিয়েছেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা যাত্রী থেকে।
১৯২৬ সালের কলকাতার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায় সাম্প্রদায়িকতার আগুন জ্বলে উঠলে নজরুল যে দু-টি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন ‘মন্দির ও মসজিদ’ এবং ‘হিন্দু মুসলমান’ শিরোনামে, সুধীরকুমার মিত্রের লেখায় উদ্ধৃত হয়েছে তার অংশবিশেষ। নজরুলের শ্লেষের তীক্ষ্ণ শরাঘাতটিতে আলো ফেলেছেন লেখক ‘‘হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়। ওটা হয়তো পন্ডিত্ব। তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব। এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এতো চুলোচুলি। আজ যে মারপিটটা বেঁধেছে, সেটাও এই পন্ডিত মোল্লার মারামারি—হিন্দু মুসলমানের মারামারি নয় …।’’
মোট পাঁচটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এই গ্রন্থে এই দ্বিতীয় পরিচ্ছদেই ধূমকেতু পত্রিকার দ্বাদশ সংখ্যায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশ হওয়ার পর কবিকে কারাবাসে শাস্তি দেওয়ার বিষয়ে যাবতীয় তথ্য দেওয়া হয়েছে। ইংরেজ বিচারক মিস্টার সুইনহো নজরুলকে রাজদ্রোহের অপরাধে একবছর সশ্রম কারাদন্ড দিয়েছিলেন। ইংরেজ বিচারক নিজেও কবি ছিলেন এবং তাঁর নামে কলকাতায় একটা রাস্তা রয়েছে। কবি নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে যে জবানবন্দি পেশ করেছিলেন আদালতে সেটি ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’ শিরোনামে ধূমকেতু পত্রিকায় এবং পরে নজরুল রচনা সম্ভার-এর দ্বিতীয় খন্ডে মুদ্রিত হয়েছে। সুধীরকুমার মিত্র জবানবন্দিটির দু-টি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করেছেন নিদর্শন হিসেবে।
জবানবন্দিতে নজরুল লিখেছিলেন :
এমনি বিচার প্রহসন করে যেদিন খ্রিস্টকে ক্রুশে বিদ্ধ করা হল, গান্ধীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হল সেদিন ভগবান এমনি নীরবে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের পশ্চাতে।…
১৯২৩-এর কারাদন্ডে নজরুলকে প্রথমে কিছুদিন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকতে হয়েছিল। তারপর পাঠানো হয়েছিল হুগলি জেলের ৫ নম্বর সেলে। সেখানে জেলসুপারের অমানবিক ব্যবহার পেয়ে নজরুল রবীন্দ্রনাথের গানের প্যারোডি করে অন্যান্য কয়েদিদের সঙ্গে কোরাস গাইতেন, ‘তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে তুমি ধন্য ধন্য হে।’
কাজি নজরুল ইসলাম জেলে অনশন শুরু করার পর দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। আগের বছর নজরুলের অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে নিঃশেষিত হয়েছিল। দিলীপকুমার রায়কে চিঠিতে লিখেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু :
We do not perhaps realise the magnitude or the debt owed by Kazi Nazrul Islam’s verse to the living experience he had of jails.
অনশনরত নজরুল সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের উদ্বেগ এবং লীলা গঙ্গোপাধ্যায়কে শিবপুর থেকে ১৭ মে, ১৯২৩ তারিখে লেখা তাঁর চিঠির ছ-টি বাক্য সুধীরকুমার সংকলিত করেছেন শ্যামসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা শরৎচন্দ্রের চিন্তাজগৎ ও তাঁহার সাহিত্য থেকে।
হুগলী জেলে আমাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম উপোস করিয়া মর মর হইয়াছে। বেলা একটার গাড়িতে যাইতেছি। দেখি যদি দেখা করিতে দেয় ও দিলে আমার অনুরোধে যদি সে আবার খাইতে রাজী হয়। না হইলে আর কোন আশা দেখি না। একজন সত্যকার কবি। রবিবাবু ছাড়া বোধহয় এখন আর কেহ এত বড় কবি নাই।
পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের নজরুলকে পাঠানো টেলিগ্রাম, ‘Give up hunger strike, our literature claims you’। বাক্যটি উদ্ধৃত করে লেখক মন্তব্য করেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল প্রতিভার এই স্বীকৃতি নজরুলের পক্ষে এক দুর্মূল্য সম্পদ। সার্থকতার স্বর্ণকমল।’ ফুটনোটে, ‘পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের কবি স্বীকৃতি স্মৃতিচারণ রবীন্দ্রনাথের নজরুল সম্পর্কে অনেক দুর্লভ স্মৃতি সঞ্চয় করে রেখেছেন’—জানাতে ভোলেননি সুধীরকুমার মিত্র। অনুষঙ্গে আরও লিখেছেন, ‘দুঃখের বিষয় টেলিগ্রামটি নজরুল পেলেন না। নট ফাউণ্ড (Not Found) বলে টেলিগ্রাম ফিরে এলো। সেই সময় কবি তাঁর ‘বসন্ত’ নামক গীতিনাট্য নজরুলকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল—… শ্রীমান কাজী নজরুল ইসলাম—স্নেহভাজনেষু, ১০ই ফাল্গুন ১৩২৯। আর বলেন, ‘‘জাতির জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল, তাই বসন্ত গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি।’’
৩৯ দিন পর নজরুল অনশন ভঙ্গ করেছিলেন রাজনৈতিক বন্দিদের দাবিদাওয়া পূরণ করার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর। জেলে বসে লেখা নজরুলের ‘শিকল পরার গান’-এর ১৮টি চরণও উদ্ধৃত হয়েছে অনিবার্য প্রাসঙ্গিকতায়।
তৃতীয় পরিচ্ছেদের পরবর্তী আলোচনায় এসেছে নজরুল ইসলামের বিবাহ প্রসঙ্গে পত্রপত্রিকা থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিবিশেষের মন্তব্য ও লেখার তথ্যানুপুঙ্ক্ষ।
১৯২৪-এর ২০ এপ্রিল প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে নজরুলের বিয়ের তিন বছর আগে দৌলতপুরের আলি আকবর খানের ভাগনি সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিশের সঙ্গে বিয়ের বন্দোবস্ত হয়েছিল, এমনকী বিয়ের চিঠি দিয়ে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ কলকাতার বন্ধুদের নিমন্ত্রণও করা হয়েছিল। কিন্তু নার্গিশ বেগমকে দৌলতপুরের বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে না এই শর্তে রাজি না হয়ে নজরুল বিয়ের মজলিস থেকে উঠে দৌলতপুর থেকে পায়ে হেঁটে কুমিল্লায় চলে এসেছিলেন। প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে তাই নজরুলকে তাঁর মুসলমান এবং হিন্দু সমাজের বহু পরিচিতজনের প্রতিকুলতা পেতে হয়েছিল। এই সময় বন্ধু মঈনউদ্দীনের প্রভুত সহায়তা পান নজরুল। সুধীরকুমার মিত্র এই প্রসঙ্গে প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের মঈনুদ্দীন হোসায়েন ও নজরুল রচনাটির সাহায্য নিয়েছেন। মুজফফর আহমেদের কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা-র ৪৮ সংখ্যক পৃষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছেন, মন্তব্য করেছেন, ‘‘নজরুলের মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল; রবীন্দ্রনাথ বলতেন সংস্কৃতি হচ্ছে কমলহীরের দ্যুতি। নজরুলের জীবনে সেই দ্যুতি বাঙালীকে এক নতুন পথের সন্ধান দেয়।…’’
এ. ভি. কামারুজ্জমানের ছোলতান-এ প্রকাশিত নজরুলের বিবাহ সংবাদ-সহ অনেক বিরূপ মন্তব্য তুলে ধরেছেন সুধীরকুমার মিত্র। সৈয়দ এমদাদ আলি ছোলতান-এ ‘বঙ্গভাষায় মোছলেম প্রভাব’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখিয়া তিনি আমাদিগকে একেবারেই নিরাশ করিয়াছেন, তাঁর এই কবিতায় দু-একটি মোছলমানী শব্দ থাকিলেও উহার ভিতরের সব জিনিষ হিন্দু মতো।…’’ সমান্তরালে প্রেমেন্দ্র মিত্রের স্মৃতিচারণার উল্লেখ করেছেন সুধীরকুমার, ‘গাইবার গান নয়, চিৎকার করে পড়বার এমন কবিতা এদেশের তরুণেরা এই প্রথম হাতে পেয়েছিল। তাদের উদ্দাম হৃদয়ের অস্থিরতার এ যেন আশ্চর্য প্রতিধ্বনি।’’
ইংরেজ সরকার কাজি নজরুল ইসলামের যে আটটি বই বাজেয়াপ্ত করে—সেই ১. অগ্নিবীণা, ২. বিষের বাঁশী, ৩. ভাঙার গান, ৪. যুগবাণী, ৫. দুর্দিনের যাত্রী, ৬.রুদ্রমঙ্গল, ৭. প্রলয়-শিখা, ৮. চন্দ্রবিন্দু—মোট আটটি বইয়ের নাম লিখে সুধীরকুমার মিত্র দেখিয়েছেন—‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল ছাড়া আর কোনো লেখকের এতগুলি বই কখনো নিষিদ্ধ করা হয়নি। এইসব বইগুলির উপর নজরুল যে আর্থিক নির্ভর ছিল, তা পঙ্গু করাই ছিল সরকারের উদ্দেশ্য।’
এই বইয়ের চতুর্থ পরিচ্ছেদের শেষের দিকে ‘নজরুল সংবর্ধনা’ এবং ‘নজরুলের প্রতিভাষণ’ অংশে লেখক খুঁটিনাটি বহু তথ্যের সমাবেশ করেছেন। এক বছর সশ্রম কারাদন্ডের পরে ১৯২৩-এর ডিসেম্বরে মেদিনীপুরে কবির সংবর্ধনা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম বুলবুল সোসাইটির ১৯২৯-এ মানপত্র দান, তারপর ১৫ ডিসেম্বর ওই ১৯২৯-এই কলকাতার অ্যালবার্ট হলে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রধান অতিথির ভূমিকায় এস. ওয়াজেদ আলি, জলধর সেন, করুণানিধান বন্দ্যোপাধায় প্রমুখের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করে লেখক মন্তব্য করেছেন, ‘‘বলাবাহুল্য, সেই সময় বা তার পূর্বে রবীন্দ্রনাথ বা শরৎচন্দ্রের জন্য কোনোরকম সম্বর্ধনা সভা অনুষ্ঠান হয়নি।’’
পত্রপত্রিকার আলোকে নজরুল বইটির পঞ্চম বা শেষ পরিচ্ছেদে সুধীরকুমার মিত্র সংগ্রহ করেছেন ‘নজরুলের বিপদের সময় তাঁর উপর যে দুর্ব্যবহার করা হয়েছিল—তার একটি নিদর্শন।’ ইসলাম দর্শন পত্রিকায় কবিকে ‘ধর্মদ্রোহী কুলাঙ্গার’ বলে গালিগালাজের পাশাপাশি নজরুলের হুগলি বসবাসের সময় মহাত্মা গান্ধীর হুগলিতে দু-দিনের জন্যে আসা এবং তাঁর সভায় নিজের লেখায় ও সুরে নজরুলের উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশনের কথা আছে। এই প্রসঙ্গ ধরেই বিদ্যা মন্দিরের ১৯২৪-এর বার্ষিক উৎসবে হুগলিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, ত্রিগুণা সেন, হেমচন্দ্র ঘোষ প্রমুখের সভা করার বিবরণ আছে। নজরুল ইসলাম সেই সভায় গান গেয়ে আর আবৃত্তি করে মাতিয়ে ছিলেন। সুধীরকুমার মিত্র সম্পর্কিত আমার অন্য আর একটি লেখায় পশ্চিমীকরণ যাঁদের দেশজ ঐতিহ্য থেকে সরাতে পারেনি এমন চার ব্যক্তিপুরুষ—শ্রীরামকৃষ্ণদেব, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং নজরুল ইসলাম—এই চারজনকে নিয়েই সুধীরকুমার যে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের লেখা লিখেছেন—উল্লেখ করেছি। সুধীরকুমারের রচনাবলির একটা বড়ো বৈশিষ্ট্য হল স্মরণীয় যেসব ব্যক্তিপুরুষদের নিয়ে সুধীরকুমার মিত্র তাঁর চুরাশি বছরের আয়ুষ্কাল জুড়ে যত লেখা লিখেছেন তাঁদের আদর্শ ও জীবনবোধ লেখক তাঁর নিজের জীবনচর্চার সঙ্গে সর্বান্তকরণে একাকার করে নিয়েছেন, নিজের নিরন্তর কর্মসাধনায় তাঁদেরকে জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে দেখেছেন। সুধীরকুমার মিত্রের সাহিত্যসাধনা ও কর্মসাধনা ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। পত্রপত্রিকার আলোকে নজরুল-এ তিনি নজরুলের সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের শ্রদ্ধাস্নেহের সম্পর্কের তথ্যাদিরও যখন পরিবেশন করেছেন তখনও এক প্রকৃত কর্মযোগীকে সাহিত্যের কলম হাতে নিতে দেখেছি। লক্ষ্য করেছি—দেশবন্ধু স্মৃতিতে (১৯৭২) তিনিই লিখছেন ‘কবি চিত্তরঞ্জন’, দেশবন্ধু কলেজ পত্রিকায় লিখছেন, ‘স্ত্রীশিক্ষার গোড়ার কথা’ (১৯৬৮-৬৯), দেশলোকে লিখছেন ‘নজরুলের অধ্যাত্ম সাধনা’-এর ১ম ও ২য় পর্ব (১৯৮৫)। ১৯৫৫-তে তিনিই দেশবন্ধু ও সুভাষচন্দ্রের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘দেশবন্ধু কলেজ ফর গার্লস’, ওই কলেজে দীর্ঘকাল সচিব থেকেছেন, সচিবের ভূমিকা তাঁর ‘দেশবন্ধু বালিকা বিদ্যালয়’ কর্মকৃতিত্বেও। সুধীরকুমার মিত্র ‘দেশবন্ধু শিশু শিক্ষালয়’-এরও সভাপতি ছিলেন।
তাই শুরুতে নোয়াম চমস্কির ‘দেশপ্রেম’ শব্দটির যথার্থ তাৎপর্য বিশ্লেষণে দেশ, জাতি, তথা সমগ্র মানবসমাজ নিয়ে যে প্রসারিত ও গভীরতর অনুধ্যানে কথা উল্লেখ করেছি, সুধীরকুমার মিত্রের রচনা সমগ্রের সঙ্গে অনিবার্যভাবে একাত্ম পত্রপত্রিকার আলোকে নজরুল গ্রন্থেও সেই অনুভবকেই সমুজ্জ্বল দেখি।
আলোচিত গ্রন্থ
পত্রপত্রিকার আলোকে নজরুল