পণ্ডিত ভূতের পাহারায় – শেখর বসু
চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে মনের মতো একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন হরিচরণ সাঁই। কৃপণ বলে ভীষণ বদনাম ছিল ওঁর, কিন্তু বাড়ি বানাবার ব্যাপারে কোনো কার্পণ্য করেননি। দু—হাতে টাকা খরচ করেছেন। বাড়ির প্রতিটি জিনিস সেরা। ছোট্ট দোতলা বাড়ি, সামনে একটা বাগান।
এই গাঁয়ে আরও কয়েকটা দোতলা বাড়ি আছে, কিন্তু সেগুলো দেখতে একটুও ভালো নয়। ইটের পরে ইট গাঁথা মাঠকোঠা। ছোটো—ছোটো জানালা—দরজা। সেই জন্যে ঘরগুলো কেমন যেন অন্ধকার—অন্ধকার। কিন্তু হরিচরণের বাড়ি অন্য নিয়মে বানানো। শহর থেকে বড়ো মিস্তিরি এনেছিলেন। সেই সঙ্গে এনেছিলেন দামি—দামি মালপত্র।
গাঁয়ের লোকে হাঁ করে সেই বাড়ি বানানো দেখত। বাড়ি নয়, যেন ছবি। বড়ো বড়ো জানলা—দরজা। দোতলায় বাহারি রেলিং বসানো ঝুলবারান্দা। বাড়ির দেয়ালের রঙের কী বাহার!
গাঁয়ে কয়েকজন বন্ধু আছেন হরিচরণের। তাঁদের সবার মুখেই এক কথা। বলতেন : হরি তোমার হলটা কী! সারা জীবন তোমার হাত দিয়ে একটা পয়সাও গলেনি। কিপটেমি করে কাটালে। এখন সব জমানো টাকা ঢেলে দিচ্ছ বাড়ি তৈরির পেছনে! বাড়ির দিকে তাকিয়ে কি তোমার পেট ভরবে! চাকরিবাকরি শেষ, জমানো টাকার কিছুটা রেখে না দিলে বাকি জীবনে খাবে কী! তুমি একা নও, বউ আছে। দুটো পেট, খেয়ে—পরে বাঁচতে হবে তো!
হরিচরণ মুচকি হেসে সব বন্ধুকে এক কথা শোনাতেন। বলতেন : ভাই, এইরকম বাড়ি বানানো ছিল আমার সারা জীবনের স্বপ্ন। সেই জন্যই চিরটাকাল অত কষ্টে থেকে টাকাপয়সা জমিয়েছি। কথায় বলে, কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। তা, আমার কেষ্ট এই বাড়িটা। সাত গাঁয়ের লোক বলবে, হ্যাঁ, বাড়ি বটে একখান! শহরের লোকও চমকে যাবে এই বাড়ি দেখে। আর, খাওয়াদাওয়ার কথা বলছ? আমাদের পেট বলতে মাত্র দুটো। ছেলেপুলে নেই। ডাল ভাত খেয়ে বুড়োবুড়ির দিব্যি চলে যাবে।
দোতলা বাড়ি বানাবার পেছনে হরিচরণের আর একটা হিসেব ছিল। সেই হিসেবটা উনি গোড়ার দিকে বন্ধুবান্ধবদের কাছে ভাঙেননি। হিসেবটা পরিষ্কার। এখন গাঁয়ে বেশ কিছু সরকারি কাজকর্ম শুরু হয়েছে। সেই কাজের সুবাদে বাইরের লোকজন আসছে। তাদের থাকার মতো খুব বেশি জায়গা নেই এই গাঁয়ে। হরিচরণ ঠিক করেছিলেন, ওঁদের কারও কাছে এ—বাড়ির একতলাটা ভাড়া দিয়ে দেবেন। নিজেরা থাকবেন দোতলায়। ভাড়ার টাকায় দিব্যি চলে যাবে খাওয়াপরা।
নিখুঁত হিসেব। বাড়ি শেষ হওয়ার মুখ থেকেই বাড়ি ভাড়া নেওয়ার জন্যে ঘুরঘুর করতে শুরু করে দিয়েছিল লোকজন। সবার সঙ্গেই কথা বললেন হরিচরণ। শেষে বেশ মোটা টাকায় ভাড়াটে বসালেন একতলায়। কিন্তু মাস ফুরোবার আগেই সে ভাড়াটে পালাল। তার পরে যে এসেছিল তার আয়ু মাত্র পনেরো দিন। এই ঘটনাই ঘটতে লাগল পরের পর। সাত মাসে আট জন ভাড়াটে পালাল এই বাড়ি থেকে।
বদনাম হয়ে গিয়েছিল বাড়ির। এত সুন্দর বাড়ি, কিন্তু ভাড়াটে আর জুটছিল না। হরিচরণ বাড়ির ভাড়া কিছু কমিয়েও দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাও কেউ এল না। যে আটজন ভাড়াটে এ বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে তাদের সবার মুখেই এক কথা : রাত্তিরে যদি ঘুমোতেই না পারি, সুন্দর বাড়িতে থেকে আমাদের হবেটা কী?
হরিচরণের বন্ধুবান্ধবরা এসে বোঝাতে শুরু করলেন বন্ধুকে। একটু ঘুরিয়ে—ফিরিয়ে সবার মুখেই এক কথা। বললেন : হরি, তোমার এ পাগলামো ছাড়ো। লোকে বাড়ি ভাড়া নেয় কেন? থাকার জন্যে তো? তা, থাকা মানে তো শুধু দিনের বেলায় থাকা নয়। রাত্তিরে ঘুমও দরকার। সেই ঘুমটাই যদি না হয়, এ বাড়িতে থাকার কোনো মানে হয় না।
এসব কথা শুনে চটে উঠতেন হরিচরণ। সব বন্ধুকেই শুনিয়ে দিতেন একই কথা। বলতেন: আমার টাকা পড়ে—পাওয়া টাকা নয়। রক্ত জল করে রোজগার করেছি। নিজের কোনো শখ—টখ মেটাবার দিকে যাইনি কখনো। কষ্ট করে থেকেছি। কেন থেকেছি? না, চাকরিবাকরি শেষ হলে জমানো টাকা দিয়ে মনের মতো একটা বাড়ি বানাব। সে বাড়ি আমি বানিয়েছি শেষপর্যন্ত। বানানো মানেই কিন্তু কাজ শেষ নয়। বাড়ি দেখাশোনা করাও তো কাজের মধ্যে পড়ে। দিনের বেলায় দেখার লোকের অভাব হয় না। কিন্তু রাতে? রাতে কে দেখবে? রাতে দেখা মানে পাহারাদারি করা। আমি সেই পাহারাদারির কাজটুকু করি। বিনি পয়সায় এতবড়ো একটা কাজ করে দেওয়ার জন্যে ভাড়াটেদের তো কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিল আমার কাছে! তা না, উলটে ওরা আমার নিন্দেমন্দ করে বেড়াচ্ছে। বলে কিনা বুড়ো বয়েসে ভীমরতি ধরেছে আমার! দরকার নেই আমার ভাড়াটের। কিন্তু আমার বাড়ি আমি পাহারা দেবই। ঘরের ভেতরের দামি জিনিসপত্রের কথা বাদ দাও, এ বাড়ির জানলা—দরজা, এমনকী দেয়ালেও অনেক দামি—দামি জিনিসপত্র লাগানো আছে। ওগুলো চুরি হয়ে যেতে পারে যেকোনো রাতে। চোররা যাতে সে সুযোগ না পায় তার জন্যে নজরদারি তো আমাকে চালাতে হবেই। কী, অন্যায় কিছু বললাম?
হরিচরণের সঙ্গে তর্কে এঁটে ওঠা কঠিন। তা ছাড়া এ—বাড়িটা ওঁর নিজের বাড়ি। কীভাবে চালাবেন সে—ব্যাপারে ওঁর কথাই শেষ কথা। তবু বন্ধুরা এই বন্ধুটির মতি ফেরাবার চেষ্টা করতেন। কেউ বলতেন, ‘এ গাঁয়ে তো তেমন চুরি হয় না।’
উত্তরে বেশ জোর গলায় বলতেন হরিচরণ, ‘আজ তেমন হচ্ছে না, কিন্তু কাল থেকে তো হতে পারে। কথায় বলে, সাবধানের মার নেই। আমি সাবধানে থাকছি শুধু।’
কেউ বলতেন, ‘ঠিক আছে, তুমি পাহারা দিচ্ছ দাও। পাহারা দেওয়ার ভঙ্গিগুলো শুধু পালটে দাও।’
এই ধরনের কথার জবাবে একটু চটেই যেতেন হরিচরণ। ‘চোর যাতে বাড়িতে না ঢোকে সেই জন্যে তো আমি রাত জেগে পাহারা দিচ্ছি। তা, আমি যে চোর তাড়াবার জন্যে জেগে বসে আছি, এটা চোররা জানবে কীভাবে? ওদের জানান দেওয়ার জন্যে আমি তাই একটু—আধটু কায়দা করি।’
‘কী কায়দা?’
‘সে আছে কয়েকটা।’
‘বলো না।’
‘এর আবার বলাবলির কী আছে! আর পাঁচজনও তো নিজেদের বাড়ি পাহারা দেয়, আমিও দিই। আমার শুধু নিজস্ব কয়েকটা কায়দা আছে।’
‘কী সেই কায়দাগুলো।’
নাছোড় এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে কায়দার কথা ফাঁস করতে বাধ্য হলেন হরিচরণ। ‘আমার একজোড়া মোটা কাঠের খড়ম আছে। কাশীতে গিয়ে কিনেছিলাম অনেক বছর আগে। তোলাই ছিল খড়মজোড়া, এখন একটু—আধটু কাজে লাগাই।’
‘কীরকম?’
‘রাত একটু গভীর হলে এই পাড়াটা একেবারে নিঝুম হয়ে যায়। তখন আমি ওই খড়মজোড়া বার করি। তারপর গায়ে গলিয়ে হেঁটে বেড়াই দোতলার তিনটে ঘরে আর বারান্দায়। ওইটুকু খড়ম, কিন্তু কী তার আওয়াজ! শুনলে মনে হয় আর একটু শুনি।’
‘তোমার ঘরগুলোর নীচেই তো ভাড়াটের ঘর, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘তো, ওই বিকট আওয়াজে তো ওদের ঘুম ভেঙে যেত।’
‘বিকট ভাবলে বিকট, মধুর ভাবলে মধুর।’
তর্কের মধ্যে না ঢুকে বন্ধু বললেন, ‘ভাড়াটেদের ঘুম ভেঙে যেত, এটা তো তুমি মানছ—।’
‘এর আবার মানামানির কী আছে! অনেক কারণেই অনেকের ঘুম ভেঙে যায় রাত্তিরে। কিন্তু ঘুম তো কাচের বাসন নয় যে, জোড়া দেওয়া যাবে না। ফের ঘুমোলেই তো ভাঙা ঘুম জুড়ে যায় আবার।’
‘কিন্তু ঘুম জোড়া দেওয়ার সময় পেত না যে ভাড়াটেরা। সারা রাত খড়ম পায়ে ছাতের ওপরে হেঁটে বেড়ালে কি ঘুমানো যায়? তোমার ঘরের মেঝে মানে ভাড়াটেদের ছাত।’
আপত্তি করার গলায় হরিচরণ বলেছিলেন, ‘আমি তো খড়ম পায়ে সারারাত হাঁটি না। খড়ম পায়ে থাকে শুধু প্রথম রাতে। তারপর আমার কাশি শুরু হয়। আমার একটু কাশির ধাত আছে, জানো তো?’
বন্ধু হেসে বললেন, ‘কাশি যদি পায় কাশবে। কাশি পেলে সবাই কাশে। এটা তো আর দোষের নয়।’
হরিচরণ গম্ভীর মুখে বললেন, ‘না হে, আমার কাশি খুকখুকে কাশি নয়। জোরালো কাশি। রাতের দিকে সেই কাশির জোর আরও বেড়ে যায়। আমার বউ তো এখন একদম কানে শুনতে পায় না। রাম কালা। কিন্তু যখন শুনতে পেত তখন দূরের ওই পুকুরপাড়ে বসেও চমকে উঠত। বলত, তোমার কাশি শুনে মনে হয় বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। লাঠির বাড়ি মেরে টিনের চাল ভাঙছে। তা, কথাটা তখন আমার মন্দ লাগত না। ব্যাটাছেলের কাশি তো এইরকমই হওয়া উচিত। বয়েস বাড়ার জন্যে কাশির জোরও বেড়ে গেছে এখন। তবে আগে কাশির মধ্যে যে বীরত্বের ভাবটা ছিল, এখন তা আর নেই। এখন কাশিটা কেমন যেন? মনে হবে, আওয়াজ মাটির নীচে থেকে এসে কলসির তলা ফুটো করে ঢুকে বিকট হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। একটু শুনবে নাকি?’
বন্ধু আঁতকে উঠে বলল, ‘না—না, থাক।’
হরিচরণ কাপড়ের খুঁট দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন, ‘তা, রাতের দিকে ওই কাশিটা এলে আমি আর ওকে সহজে ছাড়ি না।’
‘সহজে ছাড়ো না মানে?’
‘গলায় কাপড়—টাপড় জড়িয়ে নিলে, কাশির ওষুধ খেলে, আপদ বিদেয় হয়। কিন্তু আমি রাতের বেলায় আমার কাশিকে আপদ ভাবি না। একটু কষ্ট হয় ঠিকই, আমি গলা সাধার কায়দায় কাশিটাকে অনেক দূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাই।’
‘কিন্তু কেন?’
‘একটাই কারণ। বিকট ওই শব্দ শুনে চোর ভাবে গেরস্ত জেগে আছে। লোক জেগে থাকলে চোরেরা কি আর চুরি করতে বাড়িতে ঢোকে?’
‘তা হয়তো ঠিক। কিন্তু তোমার কাশির যে রকমসকম শোনালে, ওই শব্দে তো তোমার একতলার ভাড়াটের ঘুম ভেঙে যেত নির্ঘাত।’
বন্ধুর কথায় একটু বিরক্ত হয়ে হরিচরণ বললেন, ‘তুমি ওদের ঘুম ভেঙে যাওয়াটাই বড়ো করে দেখছ! আমি যে কত কষ্ট করে গোটা বাড়িটা পাহারা দিচ্ছি, সেটা কি কিছুই নয়!’
থতমত খেয়ে গিয়ে বন্ধু বললেন, ‘তা ঠিক, তা ঠিক। তবে তুমি সবার কথা যেভাবে ভাবছ, সবাই তো আর তোমার কথা সেভাবে ভাবছে না। বরং উলটো বুঝছে। দুনিয়াটাই এইরকম। তা, তোমার চেয়ে তাড়াবার আর কি কোনো কায়দা আছে?’
মুচকি হেসে হরিচরণ বললেন, ‘এই কায়দাটা আমার কিন্তু মন্দ লাগে না। ছেলেবেলায় রাসের মেলায় গেলেই আমি বেহালা কিনতাম। খেলনা বেহালা। ওই বেহালায় ছড় টানতে টানতে মনে হত, আমি একদিন ঠিক যাত্রাদলের বাজিয়ে হব। কিন্তু মানুষ যা চায় তা তো আর পায় না বেশিরভাগ সময়। যাত্রাদলের বেহালা বাজিয়ে হওয়া আমার আর হয়ে ওঠেনি। তবে মনের মধ্যে ওই সাধটা এখনও রয়ে গেছে। বেহালার মতো কিছু একটা বাজাবার ভঙ্গি করলে আজও সুখ পাই। আমাদের দোতলায় টানা বারান্দাটা তুমি দেখেছ তো?’
‘দেখেছি, খুবই সুন্দর।’
‘গোটা বারান্দায় লম্বা গ্রিল বসানো। রাতের আবছা আলোয় দেখলে মনে হবে, গ্রিল নয়, বেহালার তার। ঘরে বাহারি একটা ছড়ি আছে, রাতের বেলায় ওটাকেই মনে হয় বেহালার ছড়। ওই ছড় আমি বেহালা বাজাবার কায়দায় গ্রিলের ওপরে টানি। এলোপাথাড়ি টান নয়। টানের মধ্যে বেশ একটা তাল আছে। তালটা কীরকম জানো—ক্রি রিং ক্রি রিং ঘ্যাঙ, ক্রি রিং ক্রি রিং ঘ্যাঙ—।’
আঁতকে উঠে বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আওয়াজ ওঠে কীরকম?’
‘গানবাজনা মানেই তো আওয়াজ। আমার ওই নতুন ধরনের বেহালার আওয়াজ গোটা এলাকার লোকই বোধহয় কমবেশি শুনতে পায়।’
‘তোমার ওই বাজনা চলে কতক্ষণ?’
‘মাঝরাত্তিরের পরেই শুরু করি, আর ভোরের আলো ফুটলেই থামি।’
দু—দিকে দু—হাত ছড়িয়ে বন্ধু হতাশ মুখে বললেন, ‘তা হলে তোমার ভাড়াটেরা তো রাত্তিরের কোনো সময়েই ঘুমোবার সুযোগ পেত না।’
‘কেন পেত না? ইচ্ছে থাকলেই পেতে পারত। গান—বাজনায় ঘুম তো আরও গাঢ় হয়। নিজের মুখে বলা ঠিক নয়, তবু বলছি। আমার সব শব্দের মধ্যে বেশ একটা সুরতাল থাকে। কেউ একটু ভালো লাগাবার চেষ্টা করলেই নির্ঘাত ভালো লাগত। সব সময় অমন পালাই—পালাই করলে হয় না। আমি দেখেছি আজকালকার মানুষজনের ধৈর্য বড়ো কম।’
‘তুমি এক কাজ করবে?’
‘কী?’
‘যারা রাত্তিরে ঘুমোয় না, তাদেরই তুমি এবার ভাড়াটে হিসেবে বসাও।’
সরল মনে হরিচরণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারা কারা?’
মুচকি হেসে বন্ধু বললেন, ‘কারা আবার, চোররা। রাত্তিরে চুরি করতে বেরোবে, সুতরাং তোমার বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে থাকতে কোনো অসুবিধে নেই। চুরি করে ভোরে যখন ফিরবে তখন তো বাড়ি শান্ত ঘুমোতে কোনো অসুবিধে হবে না।’
বন্ধুর ঠাট্টা শুনে হরিচরণ খুব কষ্ট পেলেন, কিন্তু উনি আর তর্কাতর্কির মধ্যে না গিয়ে চুপ করে গেলেন। কিন্তু ঠাট্টার জ্বালা ভুলতে না পেরে সন্ধেবেলায় বউকে বললেন, ‘আচ্ছা, তুমিই বলো, আমি কি কোনো অন্যায় করেছি? এদিকে চোরের উৎপাত এখনও ঠিক সেভাবে শুরু হয়নি, কিন্তু হতে তো পারে যেকোনো দিন। আমি তাই সারারাত জেগে বাড়ি পাহারা দিই। গেরস্ত জেগে থাকলে চোর তো চুরি করতে ঢোকে না। সেই জন্যেই আমার জেগে থাকা। আর নানান ধরনের শব্দটব্দ করে চোরদের জানান দেওয়া যে, আমি জেগে আছি। এখানে সুবিধে হবে না। অন্য বাড়ি দেখো। তুমি বলো, এটা কি অন্যায়? কিন্তু ভাড়াটেরা ভুল বুঝে বাড়ি ছাড়ে। এখন নিন্দেমন্দ করে বেড়াচ্ছে আমার। ব্যাপারটা কত দূর করে আমার সঙ্গে। বলে, তোমার বাড়ি তা হলে চোরদের ভাড়া দিয়ে দাও। এখানে থাকতে চোরদের কোনো অসুবিধে হবে না। কথাটা শুনে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি মনে। কিছুতেই ভুলতে পারছি না সে কষ্ট।’
সব কথা বলা শেষ হলে গিন্নি বললেন, ‘কী আর করবে বলো! তবে এবার থেকে সাবধান হতে হবে। আমাদের বাগানের গেটটা পলকা। একটু চাপ দিলেই খুলে যায়। গেটে ঠেলা দিয়েই গেট খুলে বাগানে ঢুকে বাগান নষ্ট করছে গোরু। তুমি এবার বাগানে একটা লোহার গেট বসিয়ে দাও। ব্যস, তা হলে আর গোরু—ছাগল বাগান নষ্ট করতে পারবে না।’
কী কথার কী উত্তর! হরিচরণ কপাল চাপড়ে বললেন, ‘কালার মরণ! একটা কথা যদি কানে যায়!’ বিরক্ত হয়ে উনি ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।
এইভাবেই দিন গড়াতে লাগল। মাসের পর মাস কেটে গেল, কিন্তু হরিচরণের বাড়িতে আর কোনো ভাড়াটে এল না। তার বদলে যাঁরা এলেন তাঁরা সাধারণত পোড়োবাড়িতে থাকেন। হরিচরণের একতলার ফ্ল্যাটে বিনে ভাড়ার বাসিন্দা হলেন দুজন ভূত। এঁরা আজেবাজে ভূত নন, খুব পণ্ডিত ভূত। ভূতদের সমাজে সবাই এঁদের খুব মান্যিগন্যি করেন। পড়াশুনোর সুবিধের জন্যে এঁরা একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজছিলেন অনেক দিন ধরে। হঠাৎ এই ফাঁকা ফ্ল্যাটটা পেয়ে গিয়ে ওঁদের আনন্দ আর ধরে না।
সাজানো—গোছানো ঘর। প্রতিটি ঘরে দেয়াল—আলমারি। কোণের দিকের একটা ঘর বেছে নিয়ে ভূত দুজন নিজেদের বইপত্তর গুছিয়ে ফেললেন আলমারির মধ্যে। এঁরা খুব একটা দরকারি বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। বিষয়টি হল ‘মানুষদের ভূতের মতো ব্যবহার।’ কিছু মানুষের কাণ্ডকারখানা ঠিক চ্যাংড়া ভূতদের মতো। মানুষগুলো কেন অমন করে? স্বভাব—ভূতুড়ে হয় কেন? এইসব কারণ খুঁজে বার করার চেষ্টা করছেন এই দুই পণ্ডিত ভূত।
রাত একটু গভীর হলে পণ্ডিত ভূত দুজন বসে গেলেন পড়াশুনো করতে। চারদিক অসম্ভব নির্জন। লেখাপড়ার কাজ এগোতে লাগল তরতর করে। হঠাৎ দুজন ভূতই চমকে উঠলেন একসঙ্গে। মাথার ওপর খট—খট—খটাং। কী ব্যাপার! পাড়ার কিছু বাজে ভূত কি বিরক্ত করতে এসেছে ওঁদের!
কিছুক্ষণ মন দিয়ে শব্দটা শোনার পরে ওঁরা বুঝতে পারলেন, এ শব্দ ভূতের নয়। দোতলায় কোনো মানুষ শব্দ করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুত তো!
কোনো শব্দ যদি একভাবে একটানা অনেকক্ষণ ধরে চলে, আস্তে আস্তে সেটা কানে সয়ে যায়। পণ্ডিত দুই ভূত আবার তাঁদের কাজে মন বসালেন কোনোমতে। কিন্তু কাজ বেশিদূর এগোতে পারল না। হঠাৎ খক—খক করে প্রচণ্ড জোরে কাশির শব্দ উঠল। কাশি আর থামতেই চায় না। নিশুতি রাতে বিকট কাশির দমকে গোটা পাড়াটা প্রায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এই শব্দটাও ভেসে আসছে দোতলা থেকে।
এইরকম বিকট শব্দের মধ্যে কি কাজে মন বসানো যায়! কিন্তু বসাতেই হবে। গবেষণার কাজে মন না বসালে চলে না। ভূত দুজন আবার নিজেদের কাগজপত্তরের দিকে ঝুঁকে পড়লেন।
কিছুক্ষণ বাদে ভয়ংকর একটা শব্দে ওঁদের হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠেছিল। হাতের ধাক্কায় দরকারি কাগজপত্তর ছড়িয়ে পড়েছিল মেঝেয়। এটা আবার কীসের শব্দ? ক্রি—রিং—ক্রি—রিং ঘ্যাঙ, ক্রি—রিং ক্রি—রিং ঘ্যাঙ। দোতলার ওই বিদঘুটে শব্দ সারা পাড়া প্রায় কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
এত গোলমালের মধ্যে কাজকর্ম করা তো দূরের কথা, ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকাও অসম্ভব। ব্যাপার কী দেখার জন্যে পণ্ডিত দুই ভূত হাওয়ায় মিশে গিয়ে শাঁ করে দোতলায় চলে এলেন।
এখানে এসে ওঁদের চমকাতে হল আরও একবার। হরিচরণের পরনে খাটো ধুতি, গায়ে ফতুয়া, পায়ে খড়ম; তিনি একমনে ছড়ি টেনে যাচ্ছিলেন বারান্দার গ্রিলে। ওই টানেই বিকট শব্দ উঠছিল।
পণ্ডিত দুই ভূতের মধ্যে একজন মাস্টারমশাই আর একজন ছাত্র। মাস্টারমশাই ফিসফিস করে ছাত্রকে বললেন, ‘আরে! এ লোকটা তো আমাদের গবেষণার কাজে লেগে যাবে। একেই বলে মানুষের ভূতের মতো ব্যবহার। কিন্তু লোকটা এরকম করছে কেন?’
কারণটা জানার জন্য ভূত দুজন মানুষের চেহারা ধরে হরিচরণের সামনে গিয়ে হাজির হলেন। মাঝ রাত্তিরে হঠাৎ ঘরের মধ্যে লোক দেখে হরিচরণ ‘চোর চোর’ বলে চেঁচাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই মাস্টারমশাই ভূত বলে উঠলেন, ‘আমরা চোর নই, ভূত। আপনি শুধু শুধু ভয় পাবেন না।’
হরিচরণ ভূতের চাইতে চোরদের ঢের বেশি ভয় পান। ভূতের কথায় সামান্য বুঝি ভরসা পেলেন। তবে মন থেকে সন্দেহ দূর হচ্ছিল না। চোখ ছোটো করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা যে ভূত, তার প্রমাণ কী? আপনারা কি নিজেদের মাথা নিজেরাই চিবিয়ে খেতে পারেন?’
এই ধরনের বিচ্ছিরি একটা প্রমাণ চাওয়ার জন্য পণ্ডিত ভূত দুজন বেশ কষ্ট পেলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে মাস্টারমশাই ভূত বললেন, ‘আমরা লেখাপড়া নিয়ে থাকি। চ্যাংড়া ভূতদের মতো ওইসব কাণ্ডকারখানা আমাদের পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়। তবে আপনি যখন প্রমাণ চাইছেন, আমরা একটু ভূতের নাচ নেচে দেখাতে পারি। দেখবেন?’
ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে হরিচরণ বললেন, ‘ভূতের নাচ! সে তো শুনেছি দারুণ জিনিস! নিশ্চয়ই দেখব।’
ঘরের মধ্যে নাচ জুড়ে দিলেন দুই পণ্ডিত ভূত। বিশুদ্ধ ভৌতিক নাচ। মাথা নীচে, পা ওপরে। ভূতরা কখনো এপাশে কখনো ওপাশে, কখনো জানলায় কখনো সিলিং—এ।
হরিচরণ আজকাল বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেলামেশা করা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। কালা গিন্নির সঙ্গে কথা বলে সুখ নেই। এই অবস্থায় ভূতের নাচ দেখে খুব মজা পেলেন উনি।
নাচার ফলে দুই পণ্ডিত ভূতই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। লম্বা নিশ্বাস ফেলে মাস্টারমশাই ভূত বললেন, ‘আমরা যে সত্যি সত্যিই ভূত, এবার বিশ্বাস হয়েছে তো?’
হরিচরণ হেসে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ—হ্যাঁ, হয়েছে। এবার বলুন, আপনাদের জন্যে আমি কী করতে পারি?’
পণ্ডিত দুই ভূত ঘোরপ্যাঁচের ভূত নন। সাদা, সরল ভূত। পরিষ্কার ভাষায় মাস্টারমশাই ভূত বললেন, ‘আমরা পড়াশুনো করা ভূত। একটা গবেষণার কাজে হাত দিয়েছি। এখন আপনি যদি আমাদের একটা সাহায্য করেন—।’
‘কী ধরনের সাহায্য?’
‘আপনার একতলায় কোণের ঘরটায় বসে আমরা পড়াশুনো করব। আপনার সঙ্গে মাঝেমধ্যে এসে গল্পও করে যাব। এর বিনিময়ে যা চান তাই দেব আপনাকে।’
হরিচরণ বিষয়ী মানুষ। ভূতের কথা শোনার পরে ওঁর গোঁফের ফাঁকে একটা ধূর্ত হাসি খেলে গিয়েছিল। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আপনারা পণ্ডিত ভূত। পড়াশুনো করবেন, এ তো খুব আনন্দের কথা। আমি খুব একটা লেখাপড়া করার সুযোগ পাইনি, কিন্তু লেখাপড়া ভীষণ ভালোবাসি। তা, কতদিন আপনারা ওই ঘরটায় বসে পড়াশুনো চালাতে চান?’
‘বেশি দিন নয়, মাত্র দশ বছর।’
একটু চমকে উঠে হরিচরণ বললেন, ‘আপনাদের কাছে দশ বছর কিছুই নয়, কিন্তু মানুষের কাছে দশ বছর মানে অনেকখানি। আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। ষাট পেরিয়ে গেছে। অদ্দিন কি আর বাঁচব?’
মাস্টারমশাই ভূত স্নেহের গলায় বললেন, ‘খুব বাঁচবেন। প্রাণে শান্তি থাকলে যে কেউ বহু বছর বেঁচে থাকে। আপনি যাতে শান্তিতে থাকেন, আনন্দে থাকেন, সেটা দেখা আমাদের কর্তব্য।’
কথা শুনে বেশ আশ্বস্ত হলেন হরিচরণ। ওঁর বিষয়বুদ্ধিটাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল আবার। বললেন, ‘তা হলে আপনারা ওই ঘরে আপনাদের পড়াশুনো চালাতে চালাতে আমার যদি একটা ছোট্ট উপকার করেন।’
‘কী উপকার?’
হরিচরণের মুখ দুঃখী মানুষের মতো হয়ে উঠেছিল। বললেন, ‘জানেন তো আমার কষ্টের শেষ নেই। আমি অনেকদিন ধরে রাতে ঘুমোতে পারছি না।’
‘কেন, আপনি কি অনিদ্রা রোগে ভুগছেন?’
‘না—না, রাত হলেই ঘুমে আমার চোখের পাতা ভারী হয়ে যায়। অথচ ঘুমোতে পারি না।’
‘কী দুঃখের কথা! কেন এমন হয় বলুন তো?’
মাস্টারমশাই ভূতের স্নেহমাখানো কথা শুনে কান্না পেয়ে গিয়েছিল হরিচরণের। ঢোক গিলে বললেন, ‘সারা জীবন ধরে তিল—তিল করে জমানো টাকা নিয়ে এত সুন্দর এই বাড়িটা আমি বানিয়েছি। এ বাড়ি তো আমার দেখাশোনা করা দরকার।’
‘নিশ্চয়ই।’
‘পাহারা দেওয়া দরকার।’
‘নিশ্চয়ই।’
আর একবার ঢোক গিলে হরিচরণ বললেন, ‘আমি খবর পেয়েছি আশেপাশের অনেক চোরের নজর আছে এই বাড়ির ওপর। রাতে আমি ঘুমোলেই ওরা হানা দেবে এখানে। বাড়িতে নানারকমের দামি জিনিসপত্র আছে। আমি ঘুমোলেই ওরা সেগুলো চুরি করবে।’
মাস্টারমশাই মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন আপনি। চোর তাড়াবার জন্যেই তা হলে আপনাকে জেগে থাকতে হয়, তাই তো?’
দু—চোখ জলে ভরে উঠেছিল হরিচরণের। বললেন, ‘ঠিক তাই। এখন আপনারা যদি আমার একটা উপকার করেন।’
ছাত্র ভূত তড়াক করে বলে উঠল ‘বুঝতে পেরেছি। চোর তাড়াবার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের। তাই না?’
‘হ্যাঁ, তাই।’
ছাত্র ভূতের বয়েস কম। বুক ফুলিয়ে বলল, ‘ও নিয়ে আপনি একদম ভাববেন না। কেউ এ বাড়িতে চুরি করতে ঢুকলে তার ঘাড় মটকে দেব।’
কথাটা শুনে খুব খুশি হলেন হরিচরণ। তারপর একটু দোনামনা করে বললেন, ‘প্রথমেই ঘাড় মটকাবার দরকার নেই। আগে একটু ভয় দেখালে হয় না? তাতে কাজ না হলে পরে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’
মাস্টারমশাই ভূত ঘাড় নাড়লেন হরিচরণের কথায়। ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। প্রথমে ঘাড় মটকাবার দিকে যাব না আমরা। ভয় দেখালে চোর পালাবে। কেউ—কেউ ভয়ে অজ্ঞানও হয়ে যাবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। এ বাড়িতে ঢুকে চুরি করবার সাধ্য কোনো চোরের হবে না।’
ভূতের কথা শুনে খুশি মনে হরিচরণ বললেন, ‘ঠিক আছে একতলায় কোণের ঘরে আপনারা পড়াশুনোর কাজে লেগে পড়ুন। আমার কোনো আপত্তি নেই।’
মাসখানেক ধরে বিস্তর চেষ্টা করার পরে বাড়িতে আবার ভাড়াটে বসালেন হরিচরণ। একতলার কোণের ঘরটা বাদে বাকি দুই ঘরে ভাড়াটে বসে গেল। ওই ঘরটা তালা দেওয়া থাকে সবসময়। মাঝে মাঝে ওই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কথা বলেন হরিচরণ।
ভাড়াটেরা ভাবে ভীমরতি ধরেছে বুড়োর। তা ধরুক। আগের মতো তো আর সারারাত ধরে বিদঘুটে শব্দ আর করে না। নিশ্চিন্তে এখন রাত কাটে সবার এ—বাড়িতে। সবাই ঘুমোতে পারে।
আসল কথাটা হরিচরণ কিন্তু কারও কাছে ফাঁস করেননি। ভূতটুতে এখন বিশ্বাস করে না অনেকে। বলে, ভূত বলে কিছু নেই। বলুক না, যে যা খুশি বলুক। এ নিয়ে তর্ক করার কোনো মানে হয় না। আসল ব্যাপারটা তিনি তো জানেন।
একতলার কোণের বন্ধ ঘরে দুই পণ্ডিত ভূত গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন পুরো দমে। বিরাট কাজ। এ—কাজ শেষ হতে নাকি কমপক্ষে দশ বছর লেগে যাবে।
হরিচরণ নিশ্চিন্ত। একঘুমে লম্বা—লম্বা রাত কাবার করে দিচ্ছেন। বাড়ি পাহারা দেওয়ার আর দরকার নেই। উনি খুব ভালোভাবে জানেন কোনো পাকা চোরের পক্ষেও এ—বাড়ি থেকে এখন কিছু চুরি করে নিয়ে পালানো অসম্ভব।