পণ্ডিত নেহরুর দৃষ্টিতে গান্ধীজী – জওহরলাল নেহরু

পণ্ডিত নেহরুর দৃষ্টিতে গান্ধীজী – জওহরলাল নেহরু

গান্ধীজী মূলতঃ ধর্ম্মপরায়ণ ছিলেন। তিনি খাঁটি হিন্দু ছিলেন বটে, কিন্তু ধর্ম্মসম্বন্ধে তাঁর কোনও গোঁড়ামি ছিল না। তাঁর ধর্ম্মের সঙ্গে কোন নির্দ্দিষ্ট বা সংস্কারের সম্পর্ক ছিল না। ১৯২৮ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ফেড়ারেশন অফ ইনটারন্যাশানাল ফেলোশিণ্টের বৈঠকে বলেন: ”সুদীর্ঘ গবেষণা ও অভিজ্ঞতার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, সকল ধর্ম্মই সত্য, সকল ধর্ম্মেই কিছু ভুল—ভ্রান্তি আছে, সকল ধর্ম্মই আমার কাছে হিন্দুধর্ম্মের মতই প্রিয়।”

ধর্ম্ম—বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল সত্য। নৈতিক ভিত্তির সঙ্গে না মিললে কোন কোন চিরাচরিত প্রথাই তিনি মানতেন না। এজন্য কর্ম্মক্ষেত্রে তিনি যা ভাল মনে করতেন, সেই পথ অবলম্বনে তাঁর কোনও অসুবিধা হয় না। রাজনীতি ক্ষেত্রে এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধারণ লোকের এতে অসুবিধা হতে পারে, কিন্তু কোনো অসুবিধাই তাঁকে সত্য পথ থেকে টলাতে পারত না। তিনি প্রত্যেক বিষয়ে নিজের উপর দিয়ে পরীক্ষা করতেন।

ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাঁর পরিকল্পনা ছিল এইরূপঃ ”আমি এমন একটি ভারতবর্ষ গঠনের জন্য কাজ করব, যেখানে দরিদ্রতম ব্যক্তিরাও মনে করবে যে, এটা তাদের নিজের নেশ, যে দেশ গঠনে তাদের হাত থাকবে, এই ভারতবর্ষে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে প্রভেদ থাকবে না, সকল সম্প্রদায় পরম ঐক্যের মধ্যে বাস করবে,—যে দেশে অস্পৃশ্যতা ও পানদোষ থাকবে না ….. নারী পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করবে….ইহাই আমার স্বপ্নের ভারত।” হিন্দুধর্ম্মকে তিনি একটি বিশ্বজনীন রূপ দেবার চেষ্টা করেছিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সংস্কৃতিকে তিনি সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ বলে মনে করতে পারেননি। তিনি লিখেছেনঃ ”ভারতীয় সংস্কৃতি—হিন্দুও নয়, ইসলামীয়ও নয়, কারও নিজস্ব নয়। ভারতীয় সংস্কৃতি এ সকলের মিলনের ফল।”

তিনি জাতির আত্ম্যাত্মিক ঐক্যকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত অল্প কয়েক জন ধনী ও দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে যে বিরাট ব্যবধান, তিনি তা ভাঙতে চেয়েছিলেন। তিনি জনগণকে তাদের তন্দ্রা দূর করে জাগতিক করবার চেষ্টা করেছিলেন। এই পদদলিত জনগণকে উন্নত করবার ইচ্ছাকে তিনি ধর্ম্মের উপরেও স্থান দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেনঃ ‘অর্দ্ধাহারী জাতির কোন ধর্ম্ম, কলা বা প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে না। আমি এমন কলা ও সাহিত্য চাই যা লক্ষ লক্ষ জনগণ উপলব্ধি করতে পারে।” ভারতের লক্ষ লক্ষ নিঃস্বের জন্য তাঁর মন সর্ব্বদাই উদ্বিগ্ন থাকত। তাঁর যত কিছু কাজ ছিল, এদের ঘিরেই। তাঁর আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রত্যেকের চোখের জল মুছে দেওয়া।

কাজেরই এমন কোন লোক যে ভারতের জনগণকে আকৃষ্ট করবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কেবল জনগণই নয়, শিক্ষিত সম্প্রাদ্রদয়ের মনেও তিনি এক বিরাট বিপ্লব এনে দিয়েছেন। এমন কি, তাঁর বিরোধীদের মনেও।

তিনি যখন প্রথম কংগ্রেসে প্রবেশ করেন, তখন কংগ্রেসের কাজ ছিল উচ্চ শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তিনি কংগ্রেসকে একটি গণতান্ত্রিক ও গণ—প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, বৃটিশ—শাসনের প্রধান খুঁটী, হল ভয়, মর্য্যাদা বোধ ও সহযোগিতা। তাই তিনি এই সকল ভিত্তিকে প্রথম আক্রমণ করেন। আমাদের তিনি বলেনঃ ”তোমরা, যারা কৃষক ও শ্রমিকদের শোষণ করে থাকো, তোমরা তাদের মুক্তি দাও। যে প্রথার ফলে দারিদ্র্য ও দুর্দ্দশার সৃষ্টি হয়, সেই প্রথা দূর কর।” তিনি আমাদের যে সকল উপদেশ দেন, আমরা সে সকল প্রস্তাব মাত্র আংশিক ভাবেই গ্রহণ করেছি এবং কখন কখনও মোটেই গ্রহণ করিনি। তাঁর শিক্ষার মূল কথা—সত্য ও নির্ভীকতা এবং কাজ। এই কাজ করবার সময়, সর্ব্বদাই দৃষ্টি রাখতে হবে জনগণের মঙ্গলের দিকে। বৃটিশশাসনের সময় ভারতবাসীর মনকে আচ্ছন্ন করেছিল ভয়। সেই ভয় তিনি জনসাধারণের মন থেকে দূরে করে দেন।

আমাদের দেশে জাতিভেদ দূর করবার জন্য অনেক আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু কেবল মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে। এ আন্দোলন করেছেন জনগণকে নিয়ে। তিনি জাতিভেদ প্রথার মূলে আঘাত করেছেন। তিনি বলেছেন, হিন্দুধর্ম্ম ও ভারতকে যদি বেঁচে থাকতে হয় তাহলে এই প্রথা, এই অস্পৃশ্যতা অবশ্যই দূর করতে হবে।

গান্ধীজী পর্দ্দা—প্রথার প্রবল বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন যে, এই প্রথমা অতি জঘন্য নৃশংস। এই প্রথা নারী সমাজকে অনুন্নত করে রেখেছে। তিনি বলেছেন যে, এই বর্ব্বর প্রথা প্রথমে যে উপকারেই লেগে থাকুক না কেন, এখন দেশের অশেষ ক্ষতি করেছে, তিনি বলেছেন যে, নারীকে পুরুষের সমান স্বাধীনতা ও আত্ম—উন্নয়নের সুযোগ দিতে হবে।

গান্ধীজী ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য—ত্যাগের প্রতীক। তিনি মনে করতেন যে, তাঁর বাণী কেবল ভারতের জন্যই নয়, উপরন্তু বিশ্বের জন্যও। বিশ্ব—শান্তি তাঁর একান্ত কাম্য। তিনি জাতীয়তাবাদী ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁহার মধ্যে কোন উগ্র ভাব ছিল না। ভারতের স্বাধীনতা কামনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের একটি ফেডারেশনই একমাত্র সঠিক পথ। সমগ্র মানব সমাজের কল্যাণ তাঁহার ছিল প্রধান কাম্য। সমগ্র মানব সমাজের কল্যাণকে তিনি দেশের কল্যাণের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিলেন। তাঁর জাতীয়তাবাদ এই ধরনের।

বিগত মহাযুদ্ধ ভারতে সামনে এনে দিয়েছিল বহু অভাব—অভিযোগ। এবং সেই সময়ে প্রতিষ্ঠিত ২।১টি বড় বড় শিল্প যখন কুটির—শিল্পের মূলে কুঠারাঘাত করতে লাগল, তখন গান্ধীজী গুজরাটের প্রসিদ্ধ বণিকবংশভূত হয়েও ভারতের জীর্ণ কঙ্কাল দেখে শিউরে উঠলেন। ভারতের জনসাধারণের জীবন ধারনের হারের সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশের লোকের জীবন ধারের তুলনা করে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি দিব্যদৃষ্টিতে বুঝতে পারলেন—দেশের অর্থনৈতিক চেহারা বদলাতে হলে কিরূপ শিল্প ভারতের মত গরীব দেশে প্রযোজ্য হবে। তিনি ছিলেন গ্রাম্য কুটীর—শিল্পের পক্ষপাতী। এতে বেকার সমস্যা যত শীঘ্র দূর করা যাবে, বড় বড় শিল্পের দ্বারা তা সম্ভব হবে না। বড় বড় শিল্প—চালনার শক্তিকে মানুষের বড় কেটা কাজে লাগানো হবে না।—যন্ত্রণাই হবে সে শিল্পের প্রধান শক্তি। তিনি বলতেন, একটি যন্ত্র হাজার হাজার শ্রমিকের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে পারে। তিনি আজীবন ভারতবাসীকে দীক্ষা দিয়ে গেছেন যাতে তারা ঘরে—ঘরে কুটীর—শিল্প গড়ে তোলে এবং অবসর সময়ে তাঁরা যেন চরকা হতে হাতে—কাটা সূতা প্রস্তুত করেন। এই পথ ভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক চেহারা বদলাতে হলে দেশের সামনে বাধা আসবে অনেক।

—‘‘Discovery of India’’ থেকে

সম্পাদকীয় স্তম্ভ।

মাসিক বসুমতী, গান্ধীসংখ্যা, মাঘ ১৩৬৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *