পড়াশোনা

পড়াশোনা

বাংলা শব্দের মজার দ্বৈততা বিষয়ে আগেও লিখেছি। এখন আরেকবার–পড়ার সঙ্গে শোনা। যেন শোনাও পড়ারই অংশ।

আমরা যেভাবে পডি সেভাবে কি শুনি? সবাই চায় অন্যকে শোনাতে। নিজে শুনতে চায় না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমি নিজে। বৃদ্ধ বোকা সংঘের আসরে অন্য কেউ কথা বললেই বিরক্তি লাগে। শুধু আমি মনের আনন্দে বকবক করে যাই। তখন আমার বিরক্তি লাগে না। ক্লাসে বক্তৃতা দেওয়ার আনন্দ পাই।

একটা বয়স পার হলে মানুষ ‘কথা বলা রোগ’-এ আক্রান্ত হয়। এই বয়সটা একেকজনের জন্যে একেক রকম। সাধারণভাবে ধরা হয় ষাট। কারণ এই বয়সেই মানুষের কর্মহীন সময়ের শুরু। ষাট থেকে সত্তর এই দশ বছর সব মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ নাকি এই দশ বছর অর্থপূর্ণ কথা বলে। তারপর থেকেই কথা থেকে সারবস্তু চলে যায়। বাহাত্তরে পা দিলে তো সর্বনাশ।

প্রাচীন ভারতে বিদ্যাদানের কাজটা গুরুরা করতেন এই দশ বছর। পুরো বিদ্যাদানের প্রক্রিয়া ছিল কথানির্ভর। গুরু কথা বলতেন শিষ্য শুনত। বিদ্যাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘসময় লাগত। একসময় গুরু বলতেন, আমার বিদ্যা যা ছিল সব শেখানো হয়েছে। এখন যাও স্নান করে এসো। শিষ্য স্নান করে ফিরতেন। এই স্নান থেকেই এসেছে ‘স্নাতক’ শব্দ। শিষ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েছে।

পাঠক আবার ভেবে বসবেন না যে শিষ্য দীর্ঘ পাঠগ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালে স্নান করে নি। অবশ্যই স্নান করেছে, তবে শেষদিনের স্নান হলো স্নাতক হওয়ার স্নান।

আমাদের শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনো শোনানির্ভর। বিজ্ঞানের প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছাড়া ছাত্রদের শুধু শুনে যেতে হয়।

ধর্মপ্রচারকরাও শিষ্যদের সঙ্গে কথা বলতেন। শিষ্যরা গভীর আবেগে ধর্মগুরুর কথা শুনত।

নবিজীকে (দঃ) আল্লাহর বাণী শোনানো হলো কথায়–’পড়ো! তোমার প্রভুর নামে…’

তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? শোনাটা পড়ার চেয়ে জরুরি? আগে শোনা তারপর পড়া। অর্থাৎ পড়াশোনা না, শোনাপড়া।

আমার আত্মীয়স্বজনরা মাঝে মাঝে বেশ আয়োজন করে আমার কথা শুনতে আসেন। তাদের ধারণা আমার কাছ থেকে শোনা কথাগুলি নাকি ‘অতি উত্তম’। তাদেরকে কথা শোনানো কঠিন কর্মের মধ্যে পড়ে, কারণ তারা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আসেন যে ‘অতি উত্তম’ কথা শুনবেন। মানসিক প্রস্তুতি থাকা মানেই আশাভঙ্গের সম্ভাবনা। তারা আবার ফরমাশ করেন–হুমায়ূণ, ঐ ফকিরের গল্পটা আরেকবার বলো। ফকিরের গল্প মনে নেই, তারাই মনে করিয়ে দেন।

লেখকরা গুছিয়ে কথা বলবেন–এটা নিপাতনে সিদ্ধের মধ্যে পড়ে না। বেশির ভাগ লেখক কথা বলতেই পছন্দ করেন না। এই শ্রেণীর লেখকরা আবার কথা শুনতেও পছন্দ করেন না। আমার অতি প্রিয় লেখক এডগার এলেন পো কারও সঙ্গেই কথা বলতেন না। কেউ কথা বলতে এলেও মহা বিরক্ত হতেন।

উল্টোদিকে আছেন চার্লস ডিকেন্স। শুধুমাত্র তার মুখের গল্প শোনার জন্যে টিকিট কেটে মানুষ হল ভর্তি করে ফেলত।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর গ্রান্ডমাস্টার আইজাক অ্যাসিমভকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট লেকচার দেওয়ার জন্যে নিয়ে যেত। তিনি বক্তৃতার জন্যে প্রচুর টাকা নিতেন। এক ঘণ্টা কথা বলতেন, এই এক ঘণ্টা দর্শক মুগ্ধ হয়ে থাকত।

আচ্ছা আমি কি গল্প সুন্দর করে বলতে পারি? মনে হয় পারি। কেন বিনয়ের ধারেকাছে না গিয়ে পারি বলে ফেললাম সেটা ব্যাখ্যা করি। আমি লক্ষ করেছি, গল্প যখন শুরু করি সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। অনেকেই অতি বিনয়ের সঙ্গে বলে, আমি একবার আপনার আজ্ঞায় এসেছিলাম। আরেকদিন কি আসতে পারি? দূরে এক কোনায় বসে থাকব।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক রচনা পড়তে গিয়ে দেখি তিনি লিখেছেন–

‘হুমায়ূন আহমেদ আড্ডায় বসে যেসব চমৎকার গল্প করেন সেগুলি রেকর্ড করে রাখা উচিত।…’

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই লেখা পড়েই মনে হয় অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক মাজহার উৎসাহিত হলো (সে অতি দ্রুত উৎসাহী হওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। একদিন আড্ডায় গল্প করছি, হঠাৎ দেখি আমার বাঁ-পাশে কালো মতো ছোট্ট একটা কী। সেখান থেকে জোনাকিপোকার মতো থেমে থেমে আলো আসছে। আমি বললাম, এটা কী?

মাজহার বলল, স্যার ভয়েস রেকর্ডার।

ভয়েস রেকর্ডার কেন?

এখন থেকে ঠিক করেছি আমাদের আড্ডার পুরো সময়টা রেকর্ড করা থাকবে।

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, এই বস্তু নিয়ে যাও এবং তুমি নিজেও আগামী সাত দিন আড্ডায় আসবে না। আমি এমন কোনো বাণী দেই না যা রেকর্ড করে রাখতে হবে।

শুরু করেছিলাম পড়াশোনা নিয়ে। চলে এসেছি আড্ডার গল্পে এবং নিজেকে বিরাট কথক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। পাঠক, সরি। তবে ফাউনটেনপেন যেহেতু আত্মজৈবনিক লেখা, নিজের কথা বলা যেতে পারে। যদিও নিজের প্রশংসা নিজেই করার মতো তুচ্ছ কিছু হতে পারে না। অন্যের নিন্দা করা যত দোষ নিজের প্রশংসা করা তারচেয়েও দোষ। কেউ যখন নিজের প্রশংসা নিজেই শুরু করেন তখন আমার গা চিড়বিড় করতে থাকে। সেখানে আমি কী করে বলছি, আমি ভালো কথক? থুকু ফিরিয়ে নিলাম।

নিজের প্রশংসা নিজে করার সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ ইমদাদুল হক মিলন। গত বইমেলা বিষয়ে তার একটা লেখা কালের কণ্ঠের সাহিত্যপাতায় ছাপা হয়েছে। সে লিখেছে…

তখন আমার একটা বই বাংলা একাডেমী বেস্ট সেলার ঘোষণা করেছে। পাঠক-পাঠিকা বইটির জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। প্রকাশক চাহিদামতো বই যোগান দিতে পারছে না। বইটির জন্যে বইমেলার অনেক জায়গায় কাটাকাটি মারামারি হচ্ছে…

কালের কণ্ঠের সাহিত্যপাতা মিলন দেখে। আমার ‘ফাউনটেনপেন’ তার হাত দিয়েই যাবে। আজকের লেখাটা পড়ে তার মুখের ভাব কী রকম হবে কল্পনা করেই মজা পাচ্ছি। হা হা হা। মিলন, সরি। তুমি তোমার কোনো একটি লেখায় আমাকে তুলোধোনা করে দিয়ো। আমি কিছু বলব না।

.

যখন লেখালেখি করি না, আড্ডা দিতে বসি না, তখন কী করে সময় কাটাই? এই প্রশ্ন কিছুদিন আগে টেলিফোনে এক সাংবাদিক করলেন। আমি বললাম, তখন আমি একটা কাচি নিয়ে বসি। কাঁচি দিয়ে কেটে সময় কাটাই।

সাংবাদিক আমার কথায় আহত হয়ে টেলিফোন রেখে দিলেন। তাঁর জানার জন্যে এবং পাঠকদের জানার জন্যে বলি–তখন আমি সিনেমা দেখি এবং পড়ি। আমার কাছে মোটা একটা বই আছে। বইয়ের নাম ‘One thousand one film that you must see before you die. ‘এক হাজার একটি ছবি যা মৃত্যুর আগে তোমাকে দেখতেই হবে। বই দেখে দেখে ভিডিওর দোকান থেকে ফিল্ম আনি। ছবি দেখার পর বই থেকে নামটা কেটে দেই। বইয়ে নাম নেই এমন ছবিও দেখা হয়। যেমন, সম্প্রতি দেখেছি Avater, Time traveller’s wife. ‘এভেটার’ ছবি। দেখে আনন্দ পেয়েছি।

বলতে ভুলে গেছি, আমি নিজে এক হাজার একটি বইয়ের তালিকা প্রস্তুত করছি। যে বইগুলি মৃত্যুর আগে অবশ্যই পড়া উচিত। একটা বই পড়তে তিন দিন লাগলে ১০০১টি বই পড়তে লাগবে মাত্র দশ বছর।

লেখকদের নানান দোষ থাকে, তার প্রায় সবগুলিই আমার মধ্যে আছে। তবে একটা গুণও আছে। আমিও লেখকদের মতো প্রচুর বই পড়ি। একসময় গল্প উপন্যাস পড়তাম। এখন জানি না কেন, গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে না।

বই সবচেয়ে বেশি পড়ি যখন দেশের বাইরে যাই। বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে আমার দু’টা স্যুটকেস গোছানো হয়। একটায় থাকে কাপড়চোপড়! এটা শাওন গোছায়। আরেকটায় থাকে ‘Reading Material’, বাংলায় ‘পাঠবস্তু। এই স্যুটকেস আমি গোছই। দুমাস আগে মিশরের পিরামিড দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যাওয়া বাতিল হয়েছে। ‘Reading Material’-এর স্যুটকেস গোছানোই আছে।

সেখানে কী কী বই নেওয়া হয়েছে তার তালিকা দিচ্ছি–

১. একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশান। আগরতলা বইমেলা থেকে একগাদা সায়েন্স ফিকশান কিনেছিলাম। একটাও পড়া হয় নি। যখনই বাইরে যাই একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশনের বই নিয়ে যাই। কেন জানি কখনো পড়া হয় না।

Ambassador Without Credentials
Sergei Snegov (Raduga Publishers)

২. The Travels of Marcoplo

এই বইটি আমি আগে একবার পড়েছি। আবারও সঙ্গে নিচ্ছি, কারণ মার্কোপোলোর গাঁজাখুরি ভ্রমণকাহিনী পড়তে ভালো লাগে।

সচেতন পাঠক নিশ্চয় ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। মার্কোপোলোর ভ্রমণকাহিনীকে আমি গাঁজাখুরি বলছি। কারণ ব্যাখ্যা করি। তিনি ভারতবর্ষে (বর্ণনা শুনে মনে হয় বাংলাদেশ) একদল মানুষ দেখেছেন যাদের মুখ কুকুরের মতো। এরা কুকুরের মতোই ডাকে।

মার্কোপোলো বাংলাদেশেই আরেকদল মানুষ দেখেছেন যারা প্রকাশ্যে যৌনসঙ্গম করে। এতে কোনো লজ্জা বোধ করে না।

তিনি চীন ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু গ্রেট চায়নীজ ওয়াল তাঁর চোখে পড়ে নি।

৩. The End of Time

এটি বিজ্ঞানের বই। সময় কী তা ব্যাখ্যা করা। সহজপাঠ্য।

8. The Demon Hanunted World

Carl Sagan

কার্ল সেগান আমার অতি পছন্দের লেখকদের একজন। তার লেখা Cosmos বইটির আমি একসঙ্গে দুটি কপি কিনেছিলাম যাতে একটি হারিয়ে গেলে অন্যটি থাকে। হায় খোদা, দুটাই হারিয়েছে!

৫. বাংলা একাডেমীর প্রকাশনা বাবরনামা। এই বইটিও আগে ইংরেজিতে পড়া। আবারও পড়ছি, কারণ একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার বাসনা আছে। সম্রাট হুমায়ূনকে নিয়ে উপন্যাস। নাম দেব ‘বাদশাহ নামদার’। হুমায়ূন প্রসঙ্গে যেখানে যা পাচ্ছি পড়ে ফেলছি। বাবরনামাকে world classic বলা হয়। আমি পড়তে গিয়ে ধাক্কার মতো খেয়েছি। পাতায় পাতায় তার মদ খাওয়ার বর্ণনা। ভোরবেলায় একবার, আসর এবং মাগরেবের নামাজের সময় একবার। এশার নামাজের পর আরেকবার। যখন মদ খাচ্ছেন না তখন ভাং-এর নেশা করছেন।

মানুষ হত্যার নির্বিকার বর্ণনা আছে। যেমন, আমি কয়েকজনকে শূলে চড়ালাম। বাকিদের নাক কেটে দিলাম। তারা কাটা নাক নিয়ে আমার তাঁবুর চারপাশে ঘুরতে লাগল। এরকমই নির্দেশ।

আরেক জায়গায় আছে, আমি দুর্গ দখল করলাম। দুর্গের নারী এবং শিশুদের বাদ দিয়ে সমস্ত পুরুষকে হত্যার নির্দেশ দিলাম।

এই বাবুর মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। এবং তাঁর কালের একজন বড় কবি। কিছুই হিসাব মিলাতে পারি না। তার একটা কবিতা (তুর্কি ভাষায়)–

“গোলাপ কুঁড়ির মতো আমার হৃদয়
তার দলের উপর রক্তের ছাপ,
লক্ষ বসন্ত ও আমার সে হৃদয়ের ফুল
কুঁড়ি ফুটাতে পারে না।”

কী আশ্চর্য! একের পর এক বইয়ের নাম লিখে যাচ্ছি কেন? আমি স্যুটকেসে কী সব বই ভরেছি তা পাঠকদের জানানোর প্রয়োজন কি আছে?

কোনোই প্রয়োজন নেই। কী ধরনের বই আমি পড়তে পছন্দ করি, কেন করি–তা জানানো অর্থহীন। পাঠাভ্যাসের রুচি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়।

এখন অন্য প্রসঙ্গ। আমি নানা ধর্মগ্রন্থ ঘেvছ একটা বিষয় জানার জন্যে বেহেশত বা স্বর্গে কি কোনো লাইব্রেরি থাকবে? সুখাদ্যের বর্ণনা আছে, অপূর্ব দালানের কথা আছে, উৎকৃষ্ট মদ্যের কথা আছে, রূপবতী তরুণীর কথা আছে, বহুমূল্য পোপাশাকের কথা আছে, সঙ্গীতের কথা আছে। লাইব্রেরির কথা নেই।

লাইব্রেরি হচ্ছে মানুষের চিন্তা এবং জ্ঞানের ফসল। বেহেশতে হয়তো মানুষের চিন্তা এবং জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। সেখানকার চিন্তা অন্য, জ্ঞান অন্য। বিশুদ্ধ চিন্তা, বিশুদ্ধ জ্ঞান।

অবশ্যপাঠ্য বইয়ের প্রথম তালিকা। প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণকে দিয়ে শুরু।

লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

লেখা–১. পথের পাঁচালি ২. দৃষ্টি-প্রদীপ ৩. আরণ্যক ৪. ইছামতি ৫. দেবযান

.

পাদটিকা

Books are a delightful society. If you go into a room filled with books, even without taking them down from their shelves, they seem to speak to you, to welcome you.

-William F Gladstone

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *