পড়শি

পড়শি

জবা এখনও কাজে আসেনি। সৌম্য অফিস বেরিয়ে যাওয়ার পর খেয়াল হল ইন্দ্রাণীর। সকাল ন’টা। এত দেরি অন্য দিন করে না। সাড়ে আটটার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এই লেটটুকুর জন্য ইন্দ্রাণীর সংসার যে অচল হয়ে যাবে, তা নয়। পদোন্নতির পর থেকে ফলের রস খেয়ে অফিস যায় সৌম্য। লাঞ্চ করে ক্যান্টিনে। বাগবাজারের বাড়ির মতো ইন্দ্রাণীকে সকাল থেকে উঠে অফিসের ভাতের জোগাড় করতে হয় না। তিন্নির মর্নিং স্কুল। মেয়েকে রেডি করে বাসে তুলে দেওয়ার পর বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে ইন্দ্রাণীর সকালটা বড় আয়েশি হয়ে যায়। এ বাড়িতে কাজে আসার টাইমটা জবা নিজের সিডিউল অনুযায়ী অ্যাডজাস্ট করেছে। ছ’টা বাড়িতে ঠিকে কাজ করে। ভীষণ পাংচুয়াল। ডুব প্রায় মারেই না। ছুটির দরকার থাকলে, আগে থেকে বলে রাখে। কিন্তু আজ এত দেরি করছে কেন?

ঘর অগোছালো হয়ে আছে। লিভিং-এর বিছানা তোলা হয়নি এখনও। সৌম্য, তিন্নির ছেড়ে রাখা জামা-কাপড় পড়ে আছে এদিক ওদিক। গোছাতে শুরু করে ইন্দ্রাণী। আর একটু অপেক্ষা করে জবার কাজে হাত দিতে হবে। ঘর ঝাড়-পৌঁছ, বাসন মাজা, ওয়াশিং মেশিনে কাপড় কাচা, কুটনো কোটা, এই হল জবার কাজ। দু’বেলা আসে। সকালে দেড় ঘণ্টা, বিকেলে এক ঘণ্টা। টিফিন করে ইন্দ্রাণীর কাছে। সকালের কাজ শেষ হতে হতে তিন্নির স্কুলবাস অ্যাপার্টমেন্টের গেটে এসে থামে। তিন্নির গাল টিপে আদর করে বেরিয়ে যায় জবা। বিকেলেও তিন্নির সঙ্গে খুনসুটি করার জন্য বরাদ্দ রাখে পনেরো মিনিট। রোজ এক রুটিন। জবা লাস্ট কবে ডুব মেরেছে মনে করতে পারে না ইন্দ্রাণী। গত তিন মাস তো নয়ই। এক দুপুরে টিভিতে ‘কাজের লোক’ বিষয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। ওদের সপ্তাহে একদিন ছুটি দেওয়া যায় কি না, আলোচনাটা জমে ছিল সেই পয়েন্টে এসে। সঞ্চালক ছাড়া চারজন বিশিষ্ট মহিলা ছিলেন। ক্লিপিংস দেখানো হচ্ছিল গৃহবধূ এবং চাকুরিরতাদের মতামতের। কাজের লোকদেরও বাইট ছিল। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী মহিলাদের মধ্যে প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ জানালেন, সপ্তাহে একদিন ছুটি কাজের লোকের প্রাপ্য। তবে সেটা রবিবার না অন্য দিন, তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেল। ইন্দ্রাণী জানে, টিভি ক্যামেরার সামনে ছুটির পক্ষে মত দিলেও, বেশির ভাগ মহিলাই বাস্তবে তা মানবেন না। অপেক্ষা করবেন বড় কোনও আন্দোলনের। এমনকী ক্যামেরার সামনে যে সব কাজের লোক ছুটির দাবি করল, তারাও সেই পাওনার কথা তুলবে না মালিকের কাছে। টিভির সময় ভরানো ছাড়া আর কোনও কাজেই লাগবে না অনুষ্ঠানটা। বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকার জন্য ইন্দ্রাণী কিন্তু বিষয়টা সিরিয়াসলি নেয়। পরের দিনই জবাকে বলেছিল, তুই তো সপ্তাহে একদিন ছুটি

নিতে পারিস। অফিসে যেমন থাকে। এই নিয়ে কাল টিভিতে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিল। জবা হেসে বলে, একটা দিন ছুটি হলে তো ভালই হয়। তবে আমি তোমাদের বাড়িতে রোজ আসব।

কেন? বিস্ময় মিশিয়ে জানতে চেয়েছিল ইন্দ্ৰাণী।

তিন্নিটাকে আদর না করলে আমার দিন ভাল যায় না।

কথাটা বলার সময় অকৃত্রিম খুশি ছড়িয়ে পড়েছিল জবার মুখে। ফলে যা হয়, প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেল ওখানেই। বিষয়টা ফিরে এল রাতে। সৌম্য তুলল। সকালে সৌম্যর উপস্থিতিতে জবাকে ছুটির প্রস্তাবটা দিয়েছিল ইন্দ্রাণী। উদ্দেশ্য, সৌম্যকে সিদ্ধান্তটা জানিয়ে রাখা। রাতে সৌম্য ভিন্নমত পোষণ করল। বলল, দেখো, যে কাজের যা সিস্টেম। আমি একসময় আট ঘণ্টা ডিউটি করেছি, প্রমোশনের পর ডিউটির ধরাবাঁধা কোনও টাইম নেই। মেনে নিতে হয়েছে। এই পোস্টে আমার কাজের ধরনটাই এরকম।

তোমার টাকাও তো বেড়েছে। গাড়ি দিয়েছে কোম্পানি। বলেছিল ইন্দ্ৰাণী।

সৌম্য বলে, তুমি জবার টাকা বাড়িয়ে দাও। কিন্তু ডিউটিটা বদলানোর চেষ্টা কোরো না। তোমার কাছে ছুটি পেলেও, পাবে না অন্য বাড়িতে। মন কষাকষি শুরু হবে সেখানে। তোমার থেকে পাওয়া সপ্তাহের মাঝে ওই ঘণ্টা দু’-আড়াইয়ের ছুটি ওর কোনও কাজেই লাগবে না।

যায়নি। একই সঙ্গে জবার টাকা বাড়ানোর ইচ্ছেও তার নেই। বালিগঞ্জের এই এলাকাটায় কাজের লোকের মাইনে বড্ড বেশি। মাসে ছ’শো টাকা দিতে হয় জবাকে। বাগবাজারে এই কাজই হাসতে হাসতে তিনশো টাকায় উঠে যেত। সৌম্যকে একবার বলেছিল ইন্দ্রাণী, এই তো কাজ, জবা সকালে আসুক। বিকেলেরটা আমি সামলে নেব। ও বাড়ি থাকতে এ সব তো করেছি।

সৌম্যর কথায় যুক্তি আছে। ইন্দ্রাণী তর্কে

সেখানে সৌম্যর লজিক, একবেলার টাকা পেলে জবা আসবে না। লাম্পসাম পায় বলেই আসে। এ অঞ্চলে ওদের কাজের অভাব নেই। তোমার আবার জবা ছাড়া চলবে না।

একশো ভাগ সত্যি। জবার মতো কাজের মেয়ে বিরল। কোনও ফাঁকি নেই। বলতে হয় না, খাটের নীচ থেকে ধুলো নে। সোফার তলাটায় ন্যাতা পৌঁছোয়নি। বাসন চকচকে করে রাখে। সব সময় হাসিমুখ। অনর্গল কথা বলে। এ পাড়ার সমস্ত খবর ওর কণ্ঠস্থ। ঘরে বসেই এলাকার আলো-অন্ধকার, খানা-খন্দ দেখতে পায় ইন্দ্রাণী। জবা অত্যন্ত বিশ্বাসী। ওকে ঘরে রেখে পাশের ফ্ল্যাটে যাওয়া, কম্পাউন্ডের বাইরে টুকটাক কেনাকাটা নির্দ্বিধায় করা যায়। কুটোটি হাপিস করবে না। এরকম কাজের লোক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। জবাকে কোনও মতেই মিস করতে চায় না ইন্দ্ৰাণী।

ঘর গোছানো মোটামুটি হয়ে গেছে। এবার কি জবার কাজে হাত দেবে? এখনও যখন এল না আর আসবে বলে মনে হয় না। নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ কারণে আটকে গেছে। হয়তো শরীর খারাপ। হতেই পারে। একটা-দুটো দিন ওর কাজ করে নেওয়াই যায়। জবার না আসা নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই। এখানে এসে চিন্তা হোঁচট খায় ইন্দ্রাণীর, তা হলে আমি ভাবছি কেন?

অবচেতন থেকে উঠে আসে উত্তর। বুক ফাঁকা হয়ে যায় ইন্দ্রাণীর। কথাটা অনেক আগেই মনে পড়া উচিত ছিল, একটা অপরাধবোধ ইন্দ্রাণীর মনের গভীরে লুকিয়ে রেখেছিল বিষয়টাকে। গতকাল জবাকে সোনার লকেট দেওয়া দু’ছড়ার মুক্তোর হার পরতে দিয়েছিল ইন্দ্রাণী। লকেটের ওপর সাদা পাথরের সুন্দর ডিজাইন। জবা আজ ডুব। তা হলে কি…

সৌম্যর কাছে নিজেকে লুকোনো গেল না। রাতে খাওয়ার টেবিলে সৌম্য বলল, তোমার কিছু একটা হয়েছে, কেমন যেন অ্যাবসেন্ট লাগছে।

মনের ভেতর চমকে উঠল ইন্দ্রাণী। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে কপট অনুরাগে বলে, তবু ভাল, বউয়ের ওপর নজর পড়েছে…

সুরে সুর মেলায় না সৌম্য। কেজো উদ্বেগে জানতে চায়, এনিথিং রং? তিন্নির স্কুলে কিছু হয়েছে?

না। কিছুই হয়নি। সব ঠিকঠাক আছে। আসলে তুমি তো বেশির ভাগ সময় অফিসের চিন্তা নিয়ে থাকো, মনের কোথাও একটু গিলটি ফিল হচ্ছে, বউকে পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না একদম! তাই আমাকে এরকম দেখছ।

হতে পারে। অল্প হেসে কাঁধ শ্রাগ করল সৌম্য। মন দিল খাওয়ায়।

আজও আসেনি জবা। সৌম্যকে জানায়নি ইন্দ্রাণী। তিন্নিও জানে না। স্কুল থেকে ফিরে খোঁজ করছিল, মা, জবামাসি কোথায়?

একটু আগে চলে গেল। আজ তাড়া ছিল ওর।

তিন্নি সামান্য বিমর্ষ হলেও, খানিক বাদেই কাটিয়ে ওঠে। সৌম্যর বেলায় তা হবে না। জবা ডুব মেরেছে শুনলে ব্যস্ত হয়ে উঠবে, বউয়ের খাটনি পড়ে যাচ্ছে। বিয়ের পর চারটে বছর বাগবাজারে শ্বশুরের সংসারে থাকতে হয়েছে, তখন অনেক কাজ করতে হত ইন্দ্রাণীকে। আক্ষেপ করত সৌম্য। বলত, আমি যে র‍্যাঙ্কে কাজ করি, আমার বউয়ের এত খাটনি মানায় না। কলিগরা দেখলে গালাগাল দেবে আমায়। একটা প্রমোশন ওয়েট করো, তারপর দেখবে, গ্রেট লিভিং কাকে বলে।

কথা রেখেছে সৌম্য। প্রমোশনের পর বাগবাজারের পুরনো আমলের বাড়ি, বাবা, মা, ভাইকে ছেড়ে চলে এসেছে সদ্য নির্মিত দক্ষিণ কলকাতার হাউজিং-এ। ও বাড়িতে বলা হয়েছে, অফিস দিচ্ছে ফ্ল্যাট। না নিলে পুরো লস।

বিশ্বাস করেছে সবাই। ওরাই প্রায় তোড়জোড় করে পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে। ও বাড়ির সঙ্গে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। মাসে এক-দু’বার যাওয়া হয়। দেওর তো হামেশাই আসে। শ্বশুর শাশুড়িও এসেছেন বেশ কয়েক বার। কোনও মান-অভিমান, অশান্তি কিচ্ছু নেই। ম্যানেজমেন্টের মেধাবী ছাত্র সৌম্য, সমস্ত ব্যাপারটাই নিখুঁতভাবে ম্যানেজ করেছে।

দুই

কিন্তু জবার হঠাৎ দু’দিনের ডুবটাই ইন্দ্রাণীর সংসারে অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়াল। কালও যদি না আসে জবা, সৌম্যর খেয়াল পড়বেই। খোঁজ নিতে যাবে জবার, তখন যদি মুক্তোর হারের খোঁজ পেয়ে যায়।

ঘুম আসছে না ইন্দ্রাণীর। ডিনারের পর সৌম্য রোজকার মতো কম পাওয়ারের নার্ভ রিল্যাক্সের ওষুধ খেয়ে শুয়েছে। এখন ওর দিক থেকে আর কোনও প্রশ্ন আসার চান্স নেই। ইন্দ্রাণী তাই ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা পাড়া ঘুমোচ্ছে। বাধ্য প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে জ্বলন্ত ল্যাম্পপোস্ট। পাড়ার পেছনে গাঢ় অন্ধকার। ওখানে রেললাইন। ধার ঘেঁষে বস্তি। ওখানেই জবাদের বাড়ি। ইন্দ্রাণী কোনওদিন যায়নি। রিকশায় চেপে বস্তির পাশ দিয়ে অন্য কাজে গেছে। ওখানকার ঝগড়াঝাঁটি, শাঁখের আওয়াজ দুটোই দিব্যি শোনা যায় ইন্দ্রাণীদের ফ্ল্যাট থেকে। হিসেবমতো জবা রয়েছে নাগালের মধ্যে। তবু হার উদ্ধার করা বেশ কঠিন। সৌম্য এবং পুলিশ কাউকেই জানানো যাবে না হারটার কথা। ওটা দিয়েছে অতনু। ইন্দ্রাণীর প্রাক্তন প্রেমিক। বাপের বাড়ির পাড়ায় থাকত। দাদার বন্ধু। এক বিয়েবাড়িতে সৌম্যর মা ইন্দ্রাণীকে দেখেন। ওদের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসতেই, অতনু পরম সুহৃদের মতো সরে দাঁড়াল। কেননা সে তখন কাঠবেকার। সৌম্যর মতো কোম্পানি সেক্রেটারির সঙ্গে পাল্লা টানা যে অসম্ভব, এই বাস্তব জ্ঞানটা ছিল। বিয়ের পর অতনু আর কোনও যোগাযোগ রাখেনি। চ্যাপ্টার ক্লোজড ধরেই নিয়েছিল ইন্দ্রাণী। বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে আসার কিছুদিন বাদে হঠাৎ ফোন আসে অতনুর। অবাক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা উচ্ছ্বাস দেখিয়ে ফেলেছিল ইন্দ্রাণী। কারণ, সদ্য যৌথ সংসারের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসা ইন্দ্রাণী ডানার আড়ষ্টতা কাটাতে চাইছিল। যথেষ্ট বিবেচনা না করেই অতনুর সঙ্গে ‘ডেট’ করে বসে। সে দিন গঙ্গার ধারে অনেকক্ষণ ধরে হেঁটেছিল ওরা। সৌম্যর সঙ্গে এতটা হাঁটা এখন কল্পনাই করা যায় না। গাড়ি ছাড়া বেরোতে চায় না আজকাল। অতনুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ইন্দ্ৰাণী জিজ্ঞেস করেছিল, এতদিন যোগাযোগ করোনি কেন?

অতনু বলে, বাগবাজারের বাড়িতে কত লোকজন, ফোন করতে ভয় লাগত। কে ধরবে, কী মনে করবে…

পরের দেখায় ইন্দ্রাণী বুঝেছিল, আগের কথাটা মিথ্যে অজুহাত। অতনু এখন নিজেকে প্রেজেন্ট করার মতো জায়গায় এসেছে বলেই ‘মিট’ করেছে। চাকরি করছে দামি। জৌলুস এসেছে চেহারায়। দেরিতে হলেও রেসে দৌড়োতে শুরু করেছে অতনু। তবে স্বভাবটা আগের মতোই বিনীত। ইন্দ্রাণীর সঙ্গে থাকাকালীন কোনও অন্যায় আবদার করে না। বলে না, সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসো। শারীরিক সম্পর্কের স্মৃতি রোমন্থন করিয়ে ঘনিষ্ঠতা পাতাতেও চায় না। স্রেফ বন্ধুর মতোই গঙ্গার ধার, রেস্টুরেন্ট, নলবন, শপিং মলে ঘুরেছে অতনু। তাও হয়তো কুড়ি-পঁচিশ দিন অন্তর। ইন্দ্রাণী ইতিমধ্যে অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে, বিয়ে করোনি কেন?

প্রশ্নটা এড়িয়ে যায় অতনু। চাপাচাপি করলে বলে, করব রে বাবা, করব। এখনও বুড়ো হতে অনেক দেরি। আর একটু অপেক্ষা করাই যায়।

কার জন্য অপেক্ষা। কী কারণে অপেক্ষা? জানতে সাহস হয়নি ইন্দ্রাণীর। নিরাপদ

দূরত্বটা সে উপভোগ করত। গত পরশু অতনু যা ঘটাল, যথেষ্ট বিব্রত হয়ে পড়ে ইন্দ্রাণী। বিকেলের দিকে ফোন করে মাত্র আধ ঘণ্টার সময় চেয়েছিল অতনু। গড়িয়াহাটার এক চাইনিজ রেস্টোরেন্টে যেতে হবে। ইন্দ্রাণী প্রথমে রাজি হয়নি। অতনু বারবার অনুরোধ করতে থাকে। জবা তখন ফ্ল্যাটে, দ্বিতীয় দফার কাজে ব্যস্ত। তিন্নিকে ওর হেফাজতে রেখে ইন্দ্রাণী বেরোয়। রেস্টোরেন্টে বসে অতনু মুক্তোর হারটা তুলে দেয় ইন্দ্রাণীর হাতে। বলে, তোমার হয়তো মনে নেই, বারো বছর আগে এই দিনে আমি তোমায় প্রপোজ করেছিলাম। সাড়া দিয়েছিলে তুমি।

সত্যিই মনে ছিল না ইন্দ্রাণীর। হারটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। ব্র্যান্ডেড কোম্পানির গয়না। দাম আন্দাজ সাত-আট হাজার টাকা হবে। ইন্দ্রাণী অতনুকে বলে, জিনিসটা দামি। কিন্তু আমাদের সম্পর্কের মধ্যে এখন কি এটার কোনও মূল্য আছে? এটা নিয়ে আমি কী করব?

পরবে।

কখন পরব? সৌম্য যদি জিজ্ঞেস করে, কে দিয়েছে?

ওর সামনে পোরো না।

তার মানে তোমার সামনে শুধু পরতে হবে? মজার

অনুনয়ের সুরে অতনু বলে, অন্তত একদিন।

ঢঙে বলেছিল ইন্দ্রাণী।

কিন্তু এটা আমি রাখব কোথায়?

কেন, বাড়িতে তোমার নিজস্ব কোনও জায়গা নেই?

তা আছে। বলে, চুপ করে গিয়েছিল ইন্দ্রাণী। নিজের সংসারে নিজেকেই গোপন করার মতো সিচুয়েশান এতদিন আসেনি। তাই স্থান নির্বাচন করে রাখেনি সে। ঘরের কোন জায়গায় সৌম্য কোনও দিনই পৌঁছোবে না, ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরেছিল ইন্দ্রাণী। হারটা ছিল গলাতেই। রেস্টোরেন্টেই একবার পরে দেখাতে হয়েছিল অতনুকে। সৌম্য অফিসে। তখনই লুকোনোর কোনও প্রয়োজন ছিল না। বাড়ির আয়নায় একবার নিজেকে দেখে নিয়ে জিনিসটা তুলে রাখবে ঠিক করেছিল। তার আগেই চোখে পড়ে গেল জবার, ওঃ মা, হারটা কী সুন্দর গো বউদি! আমাকে একদিন পরতে দেবে?

সম্ভবত জিনিসটার দাম আন্দাজ করতে না পেরে কথাটা বলেছিল জবা। ব্র্যান্ডেড কোম্পানিকে বাদ দিলে, ঝুটো মুক্তোর অনেক ধরনের হার বাজারে পাওয়া যায়। জবা ভেবেছিল সেরকমই কিছু। ইন্দ্রাণীর কী হল, হয়তো লুকোনোর টেনশান থেকে বাঁচতে জবাকে বলেছিল, তোর ভাল লেগেছে, পরবি?— হারটা খুলে জবাকে দিয়েছিল ইন্দ্রাণী।

আজকেই পরব? অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল জবা।

ইচ্ছে হলে পর। অসুবিধের কী আছে!

জবা বলেছিল, ভালই হল। আজ মিতার ছেলের জন্মদিন। সন্ধেবেলা নেমন্তন্ন করেছে। এটা পরেই যাব। কালই ফেরত দেব তোমাকে।

পরের দিনই এল না মানে, জবা বোধহয় হারটার আসল দাম পরখ করে নিয়েছে। আর কোনও দিনই কাজে আসবে না জবা। অতনু হারটা একদিন পরে আসতে বলেছিল, কী

করবে ইন্দ্রাণী? একটা চাওয়া ইন্দ্রাণীর মিটেছে, সৌম্যর চোখের আড়াল হয়েছে হারটা। তবে এভাবে উধাও হয়ে যাক, ইন্দ্রাণী সেটা চায়নি।

নীচের রাস্তায় পরপর চারটে গাড়ি গেল। দুটো মনে হল পুলিশের জিপ। রেলবস্তিতে নিশ্চয়ই কোনও গন্ডগোল হয়েছে, হামেশাই হয়। ঘরে ঢুকে আসে ইন্দ্রাণী। রাত প্রায় দুটো। এক ফোঁটা ঘুম নেই চোখে। না ঘুমোলে কাল সারাটা দিন অস্বস্তিতে কাটবে। ওষুধের ব্যাগ খুলে সৌম্যর ঘুমের একটা ট্যাবলেট নেয় ইন্দ্ৰাণী।

না, আজ সকালেও এল না সে। সৌম্য অফিস বেরিয়েছে ঘণ্টা খানেক হল। মেয়েটাকে চোর ভাবতে খারাপ লাগছে ইন্দ্রাণীর। সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল জবার সঙ্গে। এত ভাল স্বভাব, আন্তরিক ব্যবহার, এ সবই তা হলে ভড়ং। হাতে দামি জিনিসটা যেতেই আসল রূপ বেরিয়ে পড়ল। ওর কি থানা-পুলিশের ভয় নেই? ওদের ঘরের মেয়েগুলো বোধহয় এরকমই সব। এখন ক’টা দিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকবে। পুলিশও ওদের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড নয়, টাকা-পয়সা দেওয়ার ক্ষমতা নেই ওই সব ফ্যামিলির। পুলিশ বরং ইন্দ্রাণীদের বলতে পারে, ভাল করে খোঁজখবর না নিয়ে, কেন যে কাজে রাখেন এদের…। যদিও এই চুরির ক্ষেত্রে পুলিশকে জানানোর কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু অতনুকে কী অজুহাত দেবে ইন্দ্রাণী। সত্যিটা বললে, গোড়াতেই খেপে যাবে। বলবে, আমার দেওয়া উপহার, তুমি কাজের মেয়েকে পরতে দিয়ে দিলে।… কথাটা বলার সময় অতনুর মুখটা কেমন হবে, ভাবতে গিয়ে হাসি পায় ইন্দ্রাণীর। মনটা অন্য দিকে নিয়ে যেতে, রিমোট টিপে টিভি অন করে ইন্দ্রাণী। চ্যানেল সার্ফ করতে করতে বাংলা নিউজ-এ এসে থামে। ব্রেকিং নিউজ। উত্তেজিত কণ্ঠে খবর বলছে অ্যাঙ্কার, কোথায় যেন ভোররাতে বস্তি উচ্ছেদ হয়েছে। বস্তিবাসীরা বাধা দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারেনি। খবরের সঙ্গে ইনসেটে দেখাচ্ছে উচ্ছেদ পর্ব। আধো-অন্ধকারে দুটো বুলডোজার মড়মড় করে ভেঙে দিচ্ছে চালার ঘর। হাতে বেতের ঢাল, মাথায় হেলমেট পরা পুলিশ গোটা এলাকাটা ঘিরে রেখেছে। ঘর থেকে বাসিন্দারা বেরিয়ে পড়েছে আগেই। দিকভ্রান্তের মতো এ দিক ও দিক দৌড়োচ্ছে। অনেকের হাতেই পোঁটলাপুঁটলি। এক মাকে দেখা গেল, যার কোলের বাচ্চাটা এখনও ঘুমোচ্ছে। দৃশ্যের মর্মান্তিকতায় প্রবেশ করতে না করতেই, রিপিট হতে লাগল নিউজ। তখনই বস্তিটার নাম জানতে পারল ইন্দ্রাণী। শিরদাড়া সোজা হয়ে গেল। জবাদের রেলবস্তির কথা বলছে। এ কী সর্বনাশ। ছিঃ ছিঃ, মেয়েটার সম্বন্ধে কত খারাপ কথাই না ভাবছিল ইন্দ্রাণী। বেচারি এখন কী অবস্থায় আছে, কে জানে।

টিভি অফ করে সোফা ছাড়ে ইন্দ্রাণী। শাড়ি চেঞ্জ করে একবার যেতে হবে ওদের এলাকায়।

রিকশা পাওয়া গেল না। কম্পাউন্ডের উলটো দিকের দোকানি বলল, রিকশা আজ পাবেন

তিন

না বউদি। রেলবস্তি ভেঙে দিয়েছে পুলিশ। বেশির ভাগ রিকশাওলাই তো ওই বস্তির। ওরা ঘর-বাড়ি সামলাবে, না কাজ করবে।

অগত্যা হাঁটা। মিনিট পনেরোর পথ। রাস্তা-ঘাট কেমন যেন থমথমে। পৌঁছে গেল ইন্দ্রাণী। জায়গাটা প্রথমে চিনতেই পারছিল না। একটা মাঠ রেললাইনে যেন কাটা পড়েছে। কেউ কোথাও নেই। দূরে কিছু পুলিশ টহল দিচ্ছে। গোটা বস্তিটা উধাও। এরকমও সম্ভব! এত ক’টা লোক গেল কোথায়? সার সার কুঁড়েঘর, সারাক্ষণ চেঁচামেচি, রেললাইনের ওপর চুল শুকোতে বসা মহিলা, রাস্তায় হামাগুড়ি দেওয়া বাচ্চা, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পাড়ার কুকুর, চালাঘরে অ্যান্টেনা, তাতে আটকে থাকা ছেঁড়া ঘুড়ি। সব কী করে এক রাতে মুছে গেল। যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছিল ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো। উপড়ে নিয়ে গেছে গোটা বস্তিটাই। যার সঙ্গে লোপাট হয়েছে ইন্দ্রাণীর সেই হার।

ফিরতে থাকে ইন্দ্রাণী। এ দিকে তেমন দোকানপাট নেই। বস্তিটা না থাকার জন্য এলাকাটা হঠাৎ ভীষণ নির্জন হয়ে গেছে। রাস্তায় এক-দু’জন চলাচল করছে। তারা গম্ভীর না বিমর্ষ, ধরতে পারছে না ইন্দ্রাণী। এরা বস্তির বাসিন্দা নয়। এলাকাটার দিকে তাকাচ্ছেও না। পাকাবাড়ি থেকে বেরিয়ে ব্যস্ত পায়ে অফিস বা অন্য কাজে চলে যাচ্ছে। জবারা এখন কোথায়, এদের জিজ্ঞেস করা বৃথা।

অফিস থেকে ফিরল সৌম্য। ভ্রূ দুটো কাছাকাছি। জুতো খুলতে খুলতে বলল, জবা তিন দিন আসেনি, আমায় বলোনি তো।

ওত পেতে থাকা ভয়টা খামচে ধরে ইন্দ্রাণীর বুক। ভাবতে থাকে, কী উত্তর দেবে। বাবার গলা পেয়ে লিভিংরুম থেকে বেরিয়ে এল তিন্নি। রোজের মতো বাপ-মেয়ে আদর বিনিময় হল। ভ্রূ স্বাভাবিক হল না সৌম্যর। তিন্নিকে বলল, যাও মা, হোমওয়ার্কগুলো সেরে রাখো। একটু পরেই তো ঘুম পেয়ে যাবে তোমার।

মেয়ে ফিরে গেল ঘরে। সৌম্য ফের বলে, জবার ব্যাপারটা চেপে গেলে কেন? নিজেকে সহজ রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় ইন্দ্রাণী জানতে চায়, তুমি কী করে বুঝলে?

সোফায় গা ছেড়ে সৌম্য বলে, কলিগরা বস্তি উচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা করছিল। তখনই জানলাম। টিভিতেও দেখলাম খবরটা। খেয়াল হল গত দু’-তিন দিন অফিস বেরোনোর সময় জবাকে দেখিনি।

ইন্দ্রাণী ফ্রিজ খুলে জল এনে দিল সৌম্যকে। জলটা খেয়ে সৌম্য বলে, আমাকে বলা উচিত ছিল তোমার।

বললে কী করতে, ঠেকাতে পারতে বস্তি উচ্ছেদ?

অ্যাবসার্ড কথা বোলো না। বলে, সোফা ছেড়ে উঠল সৌম্য। অফিসের পোশাক ছাড়তে ছাড়তে বলে, মেয়েটা এখন কোথায়, কবে কাজে আসতে পারবে, জানতে যেতাম। তোমার পক্ষে তো রোজ রোজ ওর কাজ করা সম্ভব নয়। নতুন লোক যদি দেখতে হয়, তার জন্যেও তো একটা সময়…

আর কোনও কথা ঢুকছে না ইন্দ্রাণীর মাথায়। সৌম্য যদি দেখা করতে যায় জবার সঙ্গে,

ইন্দ্রাণীর মতো ফাঁকা মাঠ দেখে ফেরত আসবে না। খোঁজ নিয়ে ঠিক পৌঁছে যাবে ওদের অস্থায়ী আস্তানায়। তখন যদি জবা হারটা দিয়ে বলে, দাদাবাবু, এটা বউদিকে দিয়ে দেবেন। আমি ক’দিন কাজে যেতে পারব না। হারটার ব্যাপারে সৌম্যকে কী উত্তর দেবে ইন্দ্রাণী? বলতে পারে, আমি কিনেছি। কিনতেই পারে। এটুকু স্বাধীনতা তার আছে। সৌম্যর রাগ করার কিছু নেই। তবে ও বলতে পারে, এত দামি এবং সুন্দর জিনিসটা কিনলে, আমাকে না দেখিয়েই পরতে দিয়ে দিলে ওকে!

আর-একটা কথাও বলতে পারে, টাকা কোথায় পেলে? ব্যাঙ্কের খাতায় তো অ্যামাউন্ট যে কে সেই আছে। ইন্দ্রাণী তখন বলবে, লক্ষ্মীর ভাঁড়ে কয়েন জমিয়ে ছিলাম। তাতেও যদি সন্দেহ থেকে যায় সৌম্যর, বলবে, সঙ্গে দুটো দুল কিনলে না কেন? সেট কমপ্লিট হয়ে যেত। চলো, সেই দোকানে আবার যাই। ক্যাশমেমোটা আছে? এর থেকেও দামি সেট নিতে পারি।

পুরো ফল্স পজিশনে পড়ে যাবে ইন্দ্রাণী। তার থেকে গোড়াতেই বলে দেওয়া ভাল, দাদা দিয়েছে। তখন আবার দাদাকে সাক্ষী হিসেবে তৈরি রাখতে হবে। কপালে ভাঁজ পড়বে দাদার, বোনের দাম্পত্যে এত লুকোছাপা কেন? ও কি সুখে নেই?… পাজামা টাওয়েল নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেছে সৌম্য। এইটুকু সময়ের মধ্যে সাজাতে হবে হার পাওয়ার ব্যাপারে মিথ্যে যুক্তি। সব গুলিয়ে পাকিয়ে যাচ্ছে ইন্দ্রাণীর। কী বলবে…

নিঃশব্দেই খুলে গেল বাথরুমের দরজা। তবু ধড়াস করে উঠল ইন্দ্রাণীর বুক। পাপোশে পা ঘষছে সৌম্য। অনেকটা বাঘেদের মতন। এক্ষুনি হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়ে জানতে চাইবে, তুমি আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছ, কী গোপন করতে চাইছ বলো? এখনই বলো।

না, সেরকম কিছু ঘটল না। কিন্তু সৌম্য ড্রয়িং স্পেসে এসে যা বলল, তাও কম মারাত্মক বাড়ি ঢোকার আগে গাড়ি নিয়ে ওদের এলাকায় গিয়েছিলাম। দেখা হল জবার নয়, সঙ্গে।

‘কী কথা হল’ জানার মতো শক্তি নেই ইন্দ্রাণীর। নিথর হয়ে বসে থাকে। ভাগ্যিস মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না সৌম্য। নইলে জানতে চাইত, শরীর খারাপ কি না? সৌম্য চলে গেছে ড্রেসিং আয়নার সামনে। আধভেজা চুল ব্রাশ করতে করতে বলছে, শুনলাম, সকালের দিকে বস্তির লোকগুলোকে এলাকা ছাড়া করেছিল পুলিশ। সন্ধেবেলা ছোটখাটো নেতাদের ধরে ফেরত এসেছে। প্রতিবাদ চলছে প্ল্যাকার্ড নিয়ে। খুব একটা কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না। এলাকাটা খুবই ছোট। টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা অবশ্য পৌঁছে গেছে। আছে পুলিশও। তাদের ভূমিকা আপাতত নীরব। জেনারেল পাবলিকের ভিড় একেবারেই নেই। প্রতিবাদীদের মধ্যে জবাও ছিল। আমার গাড়ি চিনে এগিয়ে এল। বলল, দাদাবাবু, বুঝতেই তো পারছেন কী অবস্থায় আছি। তাই ক’দিন যেতে পারিনি কাজে। বউদিকে বলবেন, কাল একবার যাব।

কথা শেষ করে লিভিং রুমে ঢুকে গেল সৌম্য, আর এক প্রস্ত আদর করবে মেয়েকে। ঠান্ডা কুয়াশার মতো স্বস্তি নেমে আসে ইন্দ্রাণীর শরীরে। সোফায় বসে মুখে হাত চাপা দিতেই টের পায়, কপাল জুড়ে কখন যেন এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে।

চার

পরের দিন জবা এল সন্ধেবেলা। চেহারায় ঝড়ো ভাব। তিন্নি গেছে পাশের ফ্ল্যাটে। প্রথমেই ওর খোঁজ নিল জবা। তারপর বলল, সবই তো শুনেছেন বউদি। উচ্ছেদের নোটিশ দু’বছর আগেই দিয়েছিল। আমরা গা করিনি। বড় গোছের নেতা ধরা ছিল না। লাস্ট যে দিন আপনাদের বাড়ি কাজে এসেছিলাম, বাড়ি গিয়ে শুনলাম, আবার নোটিশ এসেছে। এবার নাকি তুলেই ছাড়বে। দু’দিন পেরিয়ে গেল পার্টির লোকদের ধরতে। কাল ভোর হওয়ার আগেই গুঁড়িয়ে দিল সব। এরকম হবে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।

চুপ করে গেল জবা। কী ভাবছে, কে জানে। হয়তো মনে পড়ছে ওর আগের সেই ঘরদোরের কথা। ইন্দ্রাণী জবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। হারের কথাটা তোলা এ সময় অসম্ভব। কিন্তু কী আশ্চর্য, আঁচলের গিঁট খুলে জবা হারটা এগিয়ে ধরল ইন্দ্রাণীর দিকে। বলল, এটা দিতে পারছিলাম না বলে খুব খারাপ লাগছিল আমার।

মুক্তোর হারটা হাতে নেয় ইন্দ্রাণী। জবা চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। একটা প্রশ্ন তোলপাড় করছে ইন্দ্রাণীর মাথায়। জিজ্ঞেস করেই বসে, এটা তোর দাদাবাবুর হাতে দিয়ে দিতে পারতিস। এত ঝামেলার মাঝে কষ্ট করে আবার আসতে গেলি কেন?

ঘন মেঘলা তিনটে দিন উপেক্ষা করে জবা হাসে। ওর সেই পেটেন্ট হাসি। কাজের ফাঁকে ফাজলামি করে যেমন হাসত। এখন বলে, এটা আপনাকে কে দিয়েছে, আমি জানি। সে দিন বেরোনোর সময় গলায় এটা ছিল না। তার আগে ফোন এসেছিল একটা। ফোনটা মাঝে মাঝে আসে। আপনি দৌড়ে গিয়ে ধরেন।— চুপ করে গিয়ে মাথা নিচু করে জবা। ওই অবস্থাতেই বলে, কিছু মনে করবেন না, আমি একদিন আড়াল থেকে আপনার ফোনে বলা কথাগুলো শুনেছি। উনি আপনার বিয়ের আগে থেকে চেনা। অবশ্য আন্দাজ সব ভুলও হতে পারে। তবু দাদাবাবুর হাতে হারটা তুলে দিতে আমার ভয় করছিল, কী জানি বাবা, এটার জন্যই যদি ঘর ভাঙে আপনার।

জবা চলে যাচ্ছে। কথা সরছে না ইন্দ্রাণীর মুখ থেকে। একটা আশ্রয়হীন মেয়ের অন্য সংসারের প্রতি কী আন্তরিক উদ্বেগ, আশ্চর্য মমতা।

শারদীয়া আনন্দবাজার, ২০০৭

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *