পটোদিদি
পটোদিদিকে শেষ বয়সে দেখেছি শ্যামলা রং, মোটা শরীর, কথা বলার বিরাম নেই। কিন্তু ওই কাটা-কাটা নাক-মুখ আর ঈগল-পাখির চাহনি নিয়ে এক কালে যে সুন্দরী ছিলেন, সে বিষয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। ভারী স্বাধীন ও স্বাবলম্বী মানুষটি। বিয়ের সময় বাপ যেসব টাকাকড়ি, বাড়ি-ঘর দিয়েছিলেন, সে সমস্তই কোন কালে একে-ওকে ইত্যাদিকে বিলিয়ে, কিচ্ছু না দিয়েই জীবনের শেষ কটা বছর দিব্য কাটিয়ে দিলেন।
নিজের আনাড়ি হাতে জোড়াতালি দেওয়া জামা আর সরু পাড়ের মিলের মোটা কাপড় পরনে; পায়ে সবুজ ক্যাম্বিসের জুতো, ভাইপোর বাড়ির দরজা-জানালায় সবুজ রং হবার সময় টিনে যেটুকু তলানি পড়েছিল, তাই দিয়ে স্বহস্তে রঞ্জিত।
আমাকে বললেন, ‘কেন, সবুজ কি খারাপ রং, তা হলে আর গাছপালা সবুজ হত না। তা ছাড়া কত সুবিধা ভেবে দ্যাখ, ময়লা হলেও টের পাবার জো নেই। অথচ এক পয়সা খরচ নেই।— আচ্ছা ওই মন্দির-প্যাটার্নের বড় বড়িগুলোকে আলাদা টুকরিতে ভরে লগেজ বাড়াচ্ছিস কেন?’
মধুপুরের পাট তোলা হচ্ছিল। আমি কর্মী, পটোদিদি উৎসাহী দর্শক। বলতে ভুলে গেছি যে তিনি আমার মায়ের বয়সি ননদিনী।
আমি বললাম, ‘তা না হলে কীভাবে নেব? ভেঙে যাবে যে। এত কষ্ট করে তৈরি করা।’
পটোদিদি বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে? বিছানার ভেতর প্যাক্ করে নিবি। কষ্ট করে করা হলেও, জাপানি চিনেমাটির চায়ের সেটের চেয়ে তো আর দামি নয়। জানিস, আমার মেয়ে টেপু ওর জাপানি চায়ের-সেট হোল্ড-অলে ভরে কলকাতা থেকে দিল্লি নিয়ে গেছিল!’
শুনে আমি এমনি প্রভাবিত হয়ে পড়লাম যে বড়ি প্যাক করা বন্ধ করে, বললাম, ‘তাপ্পর কী হল?’
পটোদিদি উঠে পড়লেন, ‘কী আবার হবে? সব ভেঙে গেছিল নিশ্চয়!’
এইরকম ছিলেন আমার পটোদিদি। তিনি কিন্তু আমার মনগড়া গল্পের বইয়ের চরিত্র নন, সত্যিকার মানুষ। ভারতের প্রথম মহিলা অঙ্কে গ্র্যাজুয়েট। নাম ছিল স্নেহলতা মৈত্র। হয়তো ১৮৮৩ সালে জন্মেছিলেন। সাংসারিক দিক থেকে খুব একটা সুখী ছিলেন না। তবে দুঃখ-টুঃখ তাঁর গায়ে আঁচড় কাটতে পারত না। সম্পূর্ণ নিজের হাতে তৈরি এক অদৃশ্য জগতে বাস করতেন।
বগলে একটা পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে বাঁধা পুঁটলি থাকত আর একটা তালিমারা কালো পুরুষদের ছাতা। বলতেন ওই পুঁটলিতে যা আছে তাই দিয়ে সংসারের যাবতীয় প্রয়োজন মেটানো যায়। ঐহিক এবং পারত্রিক। দুটো লেবু, গুটিচারেক মিইয়ে যাওয়া বিস্কুট, একটা রুদ্রাক্ষের মালা, পরমহংসদেবের ছোট্ট একটা ছবি। ব্যস আর কী চাই! পরমহংসদেব নাকি ছোটবেলায় ওঁকে কোলে করেছিলেন, তাই আজ পর্যন্ত কেউ তাঁর এতটুকু অনিষ্ট করতে পারেনি।
পাঁচ ভূতে যে তাঁর বাপের দেওয়া যথাসর্বস্ব খসিয়ে নিয়েছে, তাকে তো আর সত্যিকার ক্ষতি বলা যায় না। একবার একটা স্কুলের পুরস্কার বিতরণসভায় পুঁটলি বগলে পটোদিদিকে দেখেছি, সেকালে লাটমেম লেডি উইলিংডনের সঙ্গে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে গল্প করছেন। মেম আহ্লাদে আটখানা। না জানি কী রসের গল্পই বলেছিলেন পটোদিদি।
মাথাখানা অঙ্কে ঠাসা ছিল। বাস্তবিক এমনি অঙ্কের মাথা আমি আর কোনও মেয়ের দেখিনি, যদিও আমি নিজে অঙ্কে একশোতে একশো পেতাম। পঞ্চাশ বছর আগে যা যা শিখেছিলেন তার এক বর্ণ ভোলেননি, না অঙ্ক, না সংস্কৃত। চর্চার অভাব তাঁর কিছু করতে পারত না। একটা টুল টেনে নিয়ে অমনি বিএ ক্লাসের ছেলেমেয়েদের অঙ্ক বোঝাতে বসে গেছেন। অমনি যত রাজ্যের জটিল সমস্যা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যেত।
আর শুধু অঙ্কের কেন? সক্কলের সব সমস্যা মেটাবার আশ্চর্য সব উপায় ঠাওরাতে পারতেন। একদিন বললেন, ‘ধোপার, বাড়ির কাপড়ের সঙ্গে বাড়িতে ছারপোকা এসেছে তো কী হয়েছে? ছারপোকার জায়গায় একটু ঝোলাগুড় মাখা। তারপর শিশিতে ভরে কিছু লাল পিঁপড়ে এনে ছেড়ে দে। সব ছারপোকা খেয়ে তো শেষ করবেই, তোদেরও কামড়াবে!’
আমরা শিউরে উঠলাম। ‘কী সব্বনাশ! তারপর লাল পিঁপড়ে যাবে কীসে?’ পটোদিদি তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, ‘তারও নিশ্চয় সহজ উপায় আছে, খোঁজ করে দ্যাখ্।’
আরেক দিন বললেন, ‘মধুপুরের এই গরমে ছাদ গরম হবে না তো কী হবে? তার তো সহজ ওষুধ-ই আছে। নর্দমার সব ময়লা জল ছাদে ফেলবি। ঘর কেমন ঠান্ডা না হয় দেখব! তা গন্ধ একটু হবেই। কিন্তু ময়লাগুলো শুকিয়ে কী চমৎকার সার হবে বল দিকিনি!’
সেকালে রেফ্রিজারেটর ছিল না কারও বাড়িতে; মধুপুরে সহজে বরফ-ও কিনতে পাওয়া যেত না। পটোদিদি বললেন, ‘সে কী! জল ঠান্ডা করতেও জানিস না? এক কলসি জলের চারদিকে সপ্সপে ভিজে তোয়ালে জড়িয়ে, চড়চড়ে রোদে বসিয়ে রাখ্ ঘণ্টাখানেক। বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাবে!’ বাস্তবিক তাই। করে দেখেছি। তোয়ালেও শুকোল, জল-ও হিম।
আরেকবার বলেছিলেন, ‘লঙ্কার গন্ধ চাই, কিন্তু ঝাল হলে চলবে না? সে আর এমনকী শক্ত! রান্না হয়ে গেলে, কড়াইসুদ্ধ ঝোল নামিয়ে, ওই টগবগে গরম ঝোলে গোটা বারো বোঁটাসুদ্ধ ঝাল কঁচালঙ্কা ছেড়ে, ঢাকা দিয়ে দিবি। ৫ মিনিট বাদে লঙ্কাগুলো তুলে ফেলে, তরকারি ঢেকে রাখিস। সুগন্ধে ভুরভুর করবে।’ এ-ও করে দেখেছি, অব্যর্থ।
একদিন পটোদিদি হঠাৎ বললেন, ‘দ্যাখ্, একবার আমার মাথাটার কী যেন হল। খালি মনে হতে লাগল আমি আমি নই। আমি আমার ছোট বোন বুড়ু। এ তো মহা গেরো! বুড়ুই যদি হলাম, তবে আমি এবাড়িতে কেন? আমার তো বুড়ুর বাড়িতে চলে যাওয়া উচিত। আচ্ছা, আমি সত্যি বুড়ু তো? আয়নার কাছে গিয়ে দেখতাম, হ্যাঁ, এ যে বুড়ু তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ওই তো বুড়ুর নাক-মাথা পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
‘কিন্তু হুট্ করে তার বাড়িতে গিয়ে না উঠে, একবার পরখ করে দেখাই ভালো, আমি আমি, না আমি বুড়ু।
‘সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগনোমেট্রির বইখানা নামিয়ে খুব খটমট দেখে একটা বুদ্ধির অঙ্ক কষে ফেললাম। তারপর যেই না পাতা উলটে দেখলাম এক্কেবারে ঠিক হয়েছে, কোথাও এতটুকু খুঁত নেই, তখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। নাঃ! ও অঙ্ক কয়া বুড়ুর কম্ম নয়। তা হলে আমি নিশ্চয় আমিই!’
এইরকম ছিলেন আমার পটোদিদি। ১৯৬০ সালে স্বর্গে গিয়ে কী করছেন কে জানে।