পটুয়া নিবারণ
আমাদের নিবারণ কর্মকার ছিলেন আঁকিয়ে মানুষ। লোকে বলত বটে পটুয়া নিবারণ–কিন্তু তাঁর ছবি–টবি কেউ কিছু বুঝত না। সেই অর্থে পট–টট কখনও আঁকেননি নিবারণ কর্মকার। যদিও ঠিক পটুয়া ছিলেন না নিবারণ, তবু তাঁর আঁকার ধরনধারণ ছিল অনেকটা পটুয়াদের মতোই। তুলির টান, রঙের মিশ্রণ–সব কিছুই ছিল সেই পুরোনো ধরনের। শুধু বিষয়বস্তুতেই তাঁর নতুনত্ব কিংবা মতান্তরে নির্বুদ্ধিতা ধরা পড়ত। আমি তাঁর আঁকা একখানা বাঘের ছবি দেখেছিলাম যার পেটটা ছিল কাঁচের মতো স্বচ্ছ, আর সেই পেটের ভিতর দেখা যাচ্ছে একটি গর্ভবতী মেয়ে শুয়ে আছে–বাঘের পাকস্থলীর ওপর তার মাথা, বাঘের হৃৎপিণ্ডের ওপর তার পা, বিরাট ঢাউস পেটটা বাঘের মেরুদণ্ড পর্যন্ত ফুলে আছে, আর মেয়েটির সেই পেটের প্রায় স্বচ্ছ চামড়ার ভিতর দিয়ে কোষবদ্ধ প্রায়–পরিণত জ্বণটিকেও দেখা যাচ্ছে। মেয়েটি ও দ্রুণ এই দুইজনের মুখেই নির্লিপ্ত, নির্বিকার হাসি। সব মিলিয়ে দেখলে কিন্তু বাঘটার জন্যই দুঃখ হয়। তার গোঁফ ঝুলে গেছে। অকালবার্ধক্যে তার চোখ কোটরগত ও হিংস্রতাশূন্য। ছবির নীচে লেখা ‘গর্ভবতী নারীকে ভক্ষণ করিয়াছ, এখন কেমন মজা? ‘।
‘পাপের পরিণাম’ সিরিজে যে ক’খানা ছবি এঁকেছিলেন নিবারণ কর্মকার, বাঘের ছবিটা ছিল তার দ্বিতীয় ছবি। সবগুলো ছবি আমি দেখিনি, কিন্তু যে কয়েকটা দেখেছি তার প্রতিটিই ছিল খানিকটা হিংস্র প্রকৃতির ছবি। যেমন মনে পড়ে একটি ছবিতে একটি অতিকায় বানর একটি কুমারী কন্যার সতীত্ব হরণ করেছে–এমনি একটা বিষয়বস্তু এঁকেছিলেন পটুয়া নিবারণ। নীচে লেখা ‘সুক্ষ্মদেহীর প্রত্যাবর্তন ও নির্বিকার কাম–অভ্যাস।’
আমাদের নিশি দারোগার মেয়ে শেফালীর একবার অসুখ হল। শক্ত ব্যামো। হরি ডাক্তার এসে বলে গেল সর্বনাশ! এ মেয়ে বাঁচলে হয়! অসুখ শরীরের যতটা, মনেও ততটা। মন ভালো রাখা চাই। ওকে কখনও কোনও অভাব দুঃখ কষ্টের কথা বলা বারণ, কোনও মৃত্যুর খবর দেওয়া বারণ। আর ও যা চায় ওকে তাই দিন।’
তাই হল। শেফালীর ঘর থেকে ধুলো ময়লা, কালো স্কুল, পিকাদানি, ইঁদুর, আরশোলা দূর করে দেওয়া হল, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল কালো বেড়ালটাকে। তারপর ডাক পড়ল পটুয়া নিবারণের। মন ভালো থাকে এমন ছবি এঁকে টাঙিয়ে দিতে হবে ঘরের দেয়ালে।
পট এঁকেছিলেন নিবারণ। খুব পরিশ্রম করেই এঁকেছিলেন। একটা ছবিতে ছিল নদীর তীরে একপাল বাচ্চা ছেলেমেয়ে পরস্পরের মুণ্ড খেলাচ্ছলে কেড়ে নিয়ে এর মুণ্ড ওর ঘাড়ে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে; কারও মুণ্ডই যথাস্থানে নেই। এর মুণ্ড ওর হাতে, ওর মুণ্ড এর হাতে রয়েছে; আর সেই কবন্ধ ছেলেমেয়েদের দেহগুলি নিরানন্দ ও কঙ্কালসার। ছবির নাম দেওয়া ছিল ‘একের মুণ্ড অন্যের ঘাড়ে চাপাইবার পরিণাম।’ ‘রাক্ষসীর প্রসব’ নামে আর একটা ছবিতে ছিল এক বিকট দর্শন রাক্ষসী তার সদ্যোজাত সন্তানকে বৃক্ষচ্যুত ফলের মতো স্বহস্তে ধারণ করছে, আশেপাশে ইতস্তত কয়েকটা রাক্ষসশিশুর কঙ্কাল পড়ে আছে। স্পষ্টই বোঝা যায় রাক্ষসী ইতিপূর্বে তার পূর্বজাত সন্তানদের ভক্ষণ করেছে এবং আশু সন্তান–ভক্ষণের আনন্দে তার মুখ লোল, চোখ উজ্জ্বল।
এইসব ছবি দেখার ফলেই হোক কিংবা অন্য কোনও কারণেই হোক হরি ডাক্তারের সমস্ত চেষ্টা বিফল করে নিশি দারোগার মেয়ে শেফালী একদিন টুক করে মরে গেল। যতদূর জানা যায় বিকট ছবি এঁকে দারোগার মেয়ের মনে ভীতি উৎপাদনের অপরাধে গোপনে নিবারণের ওপর কিছু অত্যাচার হয়েছিল।
তাইতেই মনমরা হয়ে গেলেন পটুয়া নিবারণ। কেননা ছবি–আঁকা ছিল তাঁর প্রাণ। ছবিতেই কথা বলতে চাইতেন নিবারণ, সংসারের নানারকম মারকে ছবি দিয়েই ঠেকাতে চাইতেন। ছবি আঁকা ছাড়া আর কিছুই শেখেননি তিনি। নিশি দারোগা তাঁর সেই ছবি–আঁকা প্রায় বন্ধ করে দেওয়ার জোগাড় করলেন। কেননা কথা ছিল শেফালীর ঘরে গাছপালা, লতা, ফুল, পাখির ছবি এঁকে দেবেন নিবারণ, যাতে ঘরে বসেও শেফালীর মনে হবে যে তার চারিদিকে গাছপালা লতা ফুল পাখি মেঘ ও বাতাস রয়েছে প্রকৃতি–টকৃতির ভিতরেই রয়েছে সে এবং এইভাবে এক জটিল মানসিক প্রক্রিয়ায় কিছুকাল প্রকৃতি–ভক্ষণ করলে শেফালীর রোগের উপশম হতে পারত। অন্তত হরি ডাক্তারের এই রকমই ধারণা ছিল।
এদিকে নিবারণের বয়স হয়ে এসেছিল। ছবির দিকেও ভাঁটা পড়ছিল। কেননা জনশ্রুতি শোনা গেল পটুয়া নিবারণের যাবতীয় শিল্পকর্ম তাঁকেই আক্রমণ করতে শুরু করেছে। ভয়ে তিনি ঘরে ঢুকতে পারেন না। স্বপ্নের ভিতরেও তিনি স্বচ্ছ পেটওয়ালা বাঘ, মুণ্ডহীন ছেলেমেয়ে ও রাক্ষসীর সন্তান ভক্ষণ দেখতে শুরু করেছেন। তাঁর ক্রমশ বিশ্বাস হচ্ছিল একদিন এরা সবাই ছবি ছেড়ে বেরিয়ে আসবে এবং রুগ্ন অশক্ত বৃদ্ধ অবস্থার কোনও সুযোগে তাঁকে আক্রমণ করবে। সুতরাং কয়েকদিন তিনি সুন্দর ও স্বাভাবিক কিছু আঁকবার চেষ্টা করে দেখলেন–ছবি ছেড়ে বেরিয়ে এলেও যা তাঁর খুব বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু কিছুই আঁকতে পারলেন না। এই সময়ে তিনি শক্ত সমর্থ একজন সঙ্গী খুঁজছিলেন যে তাঁকে তাঁর শিল্পকর্মের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে। আর ছবি–আঁকা ভুলবার জন্য তিনি অন্যদিকে মন দিলেন। কখনও দেখা যেতে লাগল নিবারণ উঠোনের মাটি কোপাচ্ছেন। নয়তো ছাঁচতলা থেকে কন্টিকারির ঝোঁপ টেনে তুলে সাফ করছেন। যদিও বিয়ে করেননি, তবু মনে হচ্ছিল, সংসারে মন দিয়েছেন পটুয়া নিবারণ। এইবার হয়তো বিয়ে করবেন।
করলেনও।
মিস কে, নন্দীর নামডাক আজকাল আর শোনা যায় না। শোনবার কথাও নয়। তিনি যেসব খেলা দেখাতেন, আজকাল তার তা চলে না। কিন্তু আমাদের আমলে সেইসব খেলা দেখিয়েই দারুণ নাম হয়েছিল মিস কে, নন্দীর। ‘প্রবর্তক সার্কাস’ যখন নানা জায়গায় ঘুরছিল তখনই মুখে-মুখে অমানুষিক শক্তিসম্পন্ন সর্বভুক মহিলা মিস কে. নন্দীর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। মনে পড়ে মিস কে, নন্দীর জন্য প্রবর্তক সার্কাসে একটা আলাদা তাঁবু ছিল–যার চারদিকে সারাদিন ভিড় লেগে থাকত। সার্কাসের খেলা আরম্ভ হলে এই তাঁবু থেকেই একটা চাকাওয়ালা খাঁচায় মিস কে. নন্দীকে নিয়ে আসা হত রিংয়ের পাশে। হই–হই পড়ে যেত চারদিকে। কিন্তু মিস কে. নন্দীকে দেখা যেত না-খাঁচার চারপাশে কালো পরদা ফেলা। ওর ভিতরে বাস্তবিক কে, নন্দী আছেন কি না বা থাকলেও কী করছেন কিছুই বুঝবার উপায় ছিল না। এদিকে ক্রমে ট্রপিজের খেলা, দড়ির ওপর নাচ, ভৌতিক চক্ষু এবং বাঘ সিংহের খেলা শেষ হয়ে আসত। তারপর একজন স্যুট টাই পরা লোক পরদা সরিয়ে একটা গোপন দরজা দিয়ে খাঁচার ভিতরে ঢুকে যেত। কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে বলত ‘অলরাইট’। দু-তিনজন লোক সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার ওপর থেকে পরদা সরিয়ে নিত। হাততালিতে কানপাতা দায় হত তখন। আর তখন দেখা যেত মিস কে, নন্দীকে। প্রকাণ্ড নয়, বরং রোগাই বলা যায় কে. নন্দীকে। রং কালো। পরনে গোলাপি রঙের সার্টিনের হাফ প্যান্ট, বুকে কাঁচুলি–সেও গোলাপি রঙের সাটিনের। মাথার চুল ঝুঁটি করে ওপরে বাঁধা, চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিক, পায়ে গোলাপি মোজা, গোলপি জুতো। কাঠের একখানা ঝকঝকে চেয়ারে নিশ্চল বসে থাকতেন মিস কে. নন্দী–আধবোজা চোখ, মুখে একটু হাসি। হঠাৎ মনে হয় ঘুমিয়ে আছেন, নয়তো সম্মোহিত করে রাখা হয়েছে তাঁকে। একটা মুরগিকে সেই সময়ে ছেড়ে দেওয়া হত খাঁচার ভিতরে কোক্কর কোঁ করে সেটা ডাকতে থাকত। আর, সেই ম্যানেজার গোছের লোকটা মিস কে, নন্দীতে ডাকতে থাকত, উত্তেজিত করত, হাতের লম্বা সরু লাঠিটা দিয়ে সজোরে খোঁচা মারত, কে, নন্দীর পেটে কোমরে। অবশেষে হঠাৎ কে, নন্দী রক্তবর্ণ একজোড়া চোখ খুলতেন, চারিদিকে তাকিয়ে দেখতেন, তারপর আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াতেন। আর একবার হাততালি পড়ত। সম্ভবত ওই শব্দেই খেপে যেতেন মিস কে, নন্দী। মুরগিটার সঙ্গে তার প্রাণপণ লড়াই শুরু হয়ে যেত–সেই প্রাণান্তকর পাখা ঝাঁপটানোর শব্দ, মুরগির অস্ফুট ডাক, আর কে. নন্দীর দাঁত কড়মড় করবার শব্দে আমাদের গায়ের রোমকূপ শিউরে উঠত। মুরগিটা ধরা পড়ত অবশেষে–ততক্ষণ মিস কে. নন্দীর কৌশলে বাঁধা–চুল খুলে পিঠময় মুখময় ছড়িয়ে পড়েছে–ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে তাঁকে। প্রথমেই দুহাতে টেনে মুরগির মুন্ডুটাকে ছিড়তেন কে, নন্দী–মুরগিটার গলা থেকে হঠাৎ–হঠাৎ শ্বাস নির্গত হতে থাকত বলে তখন তার অস্ফুট ডাক শোনা যেত। পট করে ছিঁড়ে যেত গলাটামুণ্ডুটা ছুঁড়ে ফেলে কে. নন্দী ধড়টাকে দুহাতে ধরতেন–কাটা গলাটা মুখের কাছে নিয়ে ডাবের জল খাওয়ার ভঙ্গিতে রক্তপান করতেন মিস কে. নন্দী। তখন কষ বেয়ে, গোলাপি কাঁচুলি বেয়ে, তলপেট থেকে চুঁইয়ে গোলাপি জুতো পর্যন্ত নেমে আসত রক্তের কয়েকটা ধারা। তারপর মুরগিটাকে খেতে শুরু করতেন–দু হাতে পালক ছাড়াচ্ছেন আর ভিতরের মাংসের জঙ্গলে কামড় বসাচ্ছেন–এ দৃশ্যের কোথাও শিল্প ছিল কি না বলতে পারি না।
মুরগি খাওয়া হয়ে গেলে রক্তমাখা দেহে মুরগির পালক, নাড়িভুড়ি ইত্যাদি ভুক্তাবশিষ্টের মধ্যে অস্থিরভাবে পায়চারি করতেন মিস কে. নন্দী। তখনও তাঁর অভিনয় কেউ ধরতে পারত না। এই সময়ে একটা সাপের ঝাঁপি সেই খাঁচার ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। স্যুট পরা ম্যানেজার হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠতেন ‘লেডি গণপতি দেখু–উ–উ–ন–ন–’। তার অবাঙালি টানের কথাটা বিটকেল শোনাত। দেখা যেত ঝাঁপির চারধারে কে. নন্দী লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন আর ম্যানেজার হাতের সরু সাদা লাঠিটা খাঁচার ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে ঝাঁপির ঢাকনাটা খুলে দিতেই ছিটকে উঠত সাপ। পেখমের মতো ফণা মেলে দিয়ে কে. নন্দীর দিকে তাকাত। প্রথমটায় ভয় পাওয়ার ভান করতেন তিনি কয়েক পা পিছিয়ে যেতেন। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে হাত বাড়িয়ে দিতেন সাপের দিকে। সাপ ততক্ষণে ঝাঁপি ছেড়ে খানিকটা নেমে এসেছে–ছোবল দিতেই হাত সরিয়ে নিতেন কে, নন্দী। সারা তাঁবুতে শুধু দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যেত তখন। দ্বিতীয় ছোবলের মুখেই সাপের গলাটা চেপে ধরতেন–আর সারা হাত জুড়ে লিকলিক করে উঠত সাপ, কিলবিল করে জড়িয়ে ধরত তাঁর হাত। অনেকক্ষণ সময় নিতেন কে, নন্দী। খুব আস্তে-আস্তে হাতটাকে মুখের কাছে নিয়ে আসতেন–যেন সাপের ঠোঁটে চুমু খাবেন তিনি। এই সময়ে তাঁর শিল্পকর্ম বোঝা যেত–ভঙ্গিতে পেলবতা ফুটিয়ে তুলতেন, তাঁর চোখে মুখে বন্য হরিণের সরল কৌতূহল ফুটে উঠত। পরমুহূর্তেই প্রকাণ্ড হাঁ করলে তাঁর রক্তাক্ত মুখাভ্যন্তর দেখে বাচ্চা ছেলেরা ভয়ে চিৎকার করে উঠত, আমরা চোখ বুজে ফেলতাম। ওইটুকুই ছিল কৌশল। হয়তো চোখ চেয়ে ঠিক মতো দেখলে দেখা যেত বাস্তবিক সাপের মুন্ডুটাকে খাচ্ছেন না তিনি। পরমুহূর্তেই চোখ চেয়ে দেখা যেত মুণ্ডহীন সাপের দেহ একখণ্ড দড়ির মতো ঝুলছে, আর সাপের মুড়োটা আরামে চিবোচ্ছেন। মিস কে. নন্দী।
বাইরে থেকে দেখে বোঝা যেত না, কিন্তু কে জানে, হয়তো ওই জীবন মিস কে, নন্দীর আর ভালো লাগছিল না। তাঁর খেলার মধ্যে অনেকটাই অভিনয় ছিল সত্য, কিন্তু কেন যেন সন্দেহ হত ম্যানেজারের লাঠির খোঁচাটা ওর মধ্যেই ছিল খাঁটি। কেন না যখন চেয়ারে এলিয়ে না-ঘুম না সম্মোহনের ভিতর থাকতেন কে. নন্দী তখন মনে হত তিনি বড়ই ক্লান্ত। মানুষের স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসে প্রত্যাবর্তন করতে না পারার সেই ক্লান্তিকে দূর করতে যখন কে. নন্দীকে ম্যানেজার সেই সরু লাঠির ডগায় খোঁচা দিতেন, তখন মিস কে. নন্দীর জন্য আমি আমার যৌবনে বড় কষ্ট পেয়েছিলাম।
মিস কে. নন্দীর নামডাক এখন আর থাকবার কথা নয়। কেননা সময় পালটে যাচ্ছিল। মানুষ আর পুরোনো ধরনের খেলা পছন্দ করছিল না। ধীরে-ধীরে প্রবর্তক সার্কাসের অবস্থাও খারাপ হয়ে এল।
অবশেষে একদিন সব গোলমাল করে দিলেন মিস কে, নন্দী। ম্যানেজারের ডাক, অনুনয় লাঠির খোঁচা নিঃশব্দে হজম করে তিনি আধখোলা চোখে নিশ্চল হয়ে বসে রইলেন। মুরগিটা খাঁচার ভিতরে দাপিয়ে বেড়াল। উপায় না দেখে ম্যানেজার সাপের ঝাঁপিটাও ঢুকিয়ে দিলেন। খাঁচার মধ্যে। ঢাকনাটাও খুলে দেওয়া হল। সাপটা ফণা মেলে লাফিয়ে উঠল, মুরগিটা খাঁচার ছাদে পা আটকে রেখে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছিল। আর ঠিক এই সময়ে তাঁবু ভরতি লোককে স্তম্ভিত করে দিয়ে হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন কে, নন্দী। খেলা ভেঙে গেল।
কিন্তু মাত্র একদিনের জন্যই। তারপর থেকে মিস কে, নন্দী আবার খেলা দেখাতে শুরু করলেন। কিন্তু ওই একদিনেই তাঁর বাজার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, লোকে ধরে ফেলেছিল মিস কে, নন্দীকে। আর ভিড় জমল না। কে, নন্দীর খেলা শুরু হওয়ার আগেই তাঁবু ফাঁকা হয়ে যেতে লাগল। অবশেষে সার্কাস থেকে তাঁকে বিদায় দেওয়ার সময় হয়ে এল।
আমাদের পটুয়া নিবারণ এই সময়েই একজন মজবুত সঙ্গী খুঁজছিলেন যে তাঁকে তাঁর শিল্পের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে। প্রবর্তক সার্কাসের ম্যানেজারের কাছে একদিন দরবার করলেন নিবারণ, কিছু টাকাপয়সা দিয়ে কে. নন্দীকে ছাড়িয়ে আনলেন, তারপরে একবারে বিয়ে করে ঘরে তুললেন।
এই সময়ে আমি একদিন নিবারণ কর্মকারের সঙ্গে দেখা করতে যাই। একখানা ছবির সামনে নিবারণ কর্মকার বসেছিলেন। আমাকে দেখে সম্ভবত বিরক্ত হলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। কিছুক্ষণ আমরা মুখোমুখি চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুই বলার ছিল না। নিবারণ তাঁর ডান হাতটা। চোখের সামনে ধরে মনোযোগ দিয়ে কিছু লক্ষ করছিলেন। মনে হল তিনি তাঁর ভাগ্যরেখা ও রবিরেখা মিলিয়ে দেখছেন। অনেকক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আমার দুটো আঙুল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
আমি কিছু না বুঝে প্রশ্ন করলাম, ‘কোন আঙুল!’
উনি ওঁর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনী আমায় দেখালেন ‘কিছু বুঝতে পারছেন?’
আমি বললাম, ‘না।’
‘আমিও বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা। কিন্তু আঙুল দুটো ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে।’
আমি আঙুল দুটো দেখলাম। স্বাভাবিক বলে মনে হল। রোগটা ওঁর মানসিক সন্দেহ করে আমি বললাম। ‘শুনেছিলাম আপনি ছবি আঁকা ছেড়ে দিয়েছেন। আর আঁকছেন না!’
‘ছেড়ে দিইনি। তবে দেব।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নিবারণ, ‘আঙুল দুটোর জন্যেই ছেড়ে দিতে হবে।’
আমি চুপ করে রইলাম। উনি নিজেই বললেন, ‘এখন থেকে খেতখামারের কাজ করব ভাবছি।’
আমি ওঁর সামনের সদ্য–আঁকা ছবিটা দেখছিলাম। পালঙ্কের ওপর মিথুনবদ্ধ নগ্ন নর–নারীর ছবি এঁকেছেন তিনি; আর দেখা যাচ্ছে একটা সাপ পালঙ্কের শিয়রে ফণা তুলে পুরুষটিকে দংশন করতে উদ্যত মেয়েটি সাপটাকে দেখছে–অথচ কিছুই করছে না; তার চোখ সম্পূর্ণ নির্বিকার। কিংবা এও হতে পারে যে মিথুন তখন এমন পর্যায়ে যে বাধা দিলে তার মাধুর্য নষ্ট হয়–তাই মেয়েটি যা নিয়তি তাকে মেনে নিচ্ছে।
হঠাৎ খুকখুক করে হাসলেন নিবারণ। আমি উঠে পড়লাম। চলে আসবার সময় কে. নন্দীকে দেখা গেল–ঘোমটা মাথায় সারা বাড়ি ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছেন। মনে হল সম্মোহন কেটে গেছে–সেই আধোঘুম ও অর্ধস্বপ্ন থেকে ম্যানেজারের লাঠির খোঁচায় জেগে উঠেই অমানুষিক খাদ্যবস্তুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে না বলে তিনি বোধহয় সুখী। কিংবা কে জানে–আমার দেখার ভিতরে ভুলও থাকতে পারে।
গ্রামে জনশ্রুতি ছিল, নানারকম গল্প প্রচলিত হচ্ছিল। কিন্তু সার্কাসের সর্বভুক মহিলার সঙ্গে পটুয়ার যৌথ জীবন ঠিক কোন পর্যায়ে এসে দাঁড়াল তা বোঝা যাচ্ছিল না। কেন না, নিবারণ আমাদের আর ডাকতেন না, গেলে বিরক্ত হতেন। কে, নন্দীও পাঁচজনের সামনে কদাচিৎ বের হতেন। ক্রমশ বাইরের জগৎ থেকে দুজনেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন। এরকম ভাবে তাঁরা আর পাঁচজনের মনোযোগ থেকে আত্মরক্ষা করে রইলেন।
দীর্ঘদিন পর আমাকে আর একবার ডেকে পাঠালেন নিবারণ। গিয়ে দেখি আঁকবার ঘরে চুপচাপ বসে আছেন নিবারণ। আমি যেতেই প্রশ্ন করলেন, ‘আমার স্ত্রীকে আপনি চিনতেন?
থতমত খেয়ে উত্তর দিলাম, ঠিক কী বলছেন বুঝতে পারছি না। তবে মিস কে. নন্দীকে আমরা অনেকেই দেখেছি।’
‘আপনি কি বিশ্বাস করেন যে উনি ডাকিনী কিংবা পিশাচ–সিদ্ধ?’
‘না।’
‘তবে?’
‘তবে কী?
খুব চিন্তিত দেখাল নিবারণকে। কুঞ্চিত কপালে ছোট চোখে উনি ওঁর চারদিকে স্থূপাকৃতি পটগুলোর দিকে চেয়ে দেখছিলেন। সেই চেয়ে দেখার ভিতর খানিকটা ভয়ের ভাব ছিল। শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে উনি বললেন, ‘কুসুম সার্কাসে যা করত তাকে লোকে কী বলে! সেটা শিল্প, না খেলা?’
‘কে কুসুম?’ আমি জিগ্যেস করলাম।
‘কুসুম মানে–’হতচকিত হয়ে উত্তর দিলেন নিবারণ–’আমার স্ত্রী।’
‘কে. নন্দী?’
‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়লেন নিবারণ, ‘আমার সন্দেহ ছিল কাঁচা মুরগি ও সাপের মাথা খাওয়ার ভিতর কোনও শিল্প নেই; আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এখন আমার মনে হয় ধারণাটা ভুল।’
আমি কিছু না বুঝে চুপ করে রইলাম।
নিবারণ বললেন, সার্কাসে আপনারা কুসুমকে দেখেছেন, আমি দেখিনি। আমি ওর কথা শুনেছিলাম, ওকে বলা হত পিশাচ–মহিলা।’ আবার ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন নিবারণ, ‘কিন্তু আমার কী মনে হয় জানেন?’
‘কী?’
হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন নিবারণ। আর কোনও কথা বললেন না। দেখলাম উনি স্থির দৃষ্টিতে নিজের ডান হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ বললেন, ‘আমি কুসুমকে বুঝবার চেষ্টা করছি।’ একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, ‘হয়তো একটা জীবন–সময় অনেক কিছুর জন্যই যথেষ্ট নয়।’
নিবারণ কর্মকার সামান্য পটুয়া–তাঁর চিন্তায় কিছু উদ্ভট ব্যাপার ছিল–এইটুকুই আমরা জানতাম। সব মিলিয়ে মানুষটা আমাদের কাছে ছিল মজার। কিন্তু এখন কেমন সন্দেহ হল–নিবারণের গলার স্বরে, চোখের চাউনিতে অন্যরকম কিছু প্রকাশ পাচ্ছে। হঠাৎ উঠে গেলেন নিবারণ, দরজার বাইরে মুখ বার করে কী দেখে নিলেন, ফিরে এসে নিজের ডান হাতের দিকে পূর্ববৎ চেয়ে থেকে নীচু গলায় বললেন, ‘কিছুদিন আগে এক দুপুরবেলা দেখি কুসুম ছাঁচবেড়ার ওপর এসে বসা একটা মোরগের দিকে স্থির চোখে চেয়ে আছে। আমি ওকে ডাকলাম, সাড়া দিল না।’ একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আপনার কী মনে হয়?
আমি মাথা নাড়লাম–জানি না।
নিবারণ বললেন, ‘আমার মনে হয় স্বাভাবিক মানুষ যা খায়–তা খেয়ে কুসুমের তৃপ্তি হয় না। এ ব্যাপারে আপনি কিছু বলতে পারেন?
আমি আবার মাথা নাড়লাম–না। আমার গা শিউরে উঠছিল।
নিবারণ বললেন, ‘একদিন আমি ওর খেলা দেখতে চাইলাম। ও প্রথমে রাজি হল না। বলল –সার্কাসে যা দেখাত তার সবটাই ছিল কৌশল। কিন্তু আমার সন্দেহ ছিল। অবশেষে একদিন আমার সাধ্য–সাধনায় রাজি হল। গভীর রাত্রে আমার সামনে একটা কাঁচা মুরগি খেল ও। সে দৃশ্য বড় ভয়ঙ্কর।’ বললেন নিবারণ কর্মকার-তাঁর মুখচোখে ভয় ফুটে উঠছিল–যেন চোখের সামনে গভীর রাত্রে একা এক পিশাচ–মহিলার সামনে বসে থাকার সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে এখনও তাড়া করছে। একটু দম নিয়ে বললেন, ‘কল্পনা করুন ঘরের বউ যাকে খুব চিনি জানি বলে মনে হয় হঠাৎ গভীর রাতে তার চেহারা ও স্বভাব বদলে যেতে দেখলে কী মনে হয়!’
আমার কিছুই বলার ছিল না। চুপ করে রইলাম।
নিবারণ বলল , ‘কিন্তু ভেবে দেখলে এ ব্যাপারে বোধহয় ভয়ঙ্কর কিছু নেই।’ বলেই খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন নিবারণ, তারপর প্রায় আপন মনে বললেন, ‘ছবি আঁকার সঙ্গে এর তফাত কী? আমি ভেবে দেখেছি–অভ্যাস না কৌশল না অসুখ–কোনটা?’ দীর্ঘশ্বাস ছড়ালেন নিবারণ, আবার নিজের ডান হাতের সন্দেহজনক দুটো আঙুলের দিকে চেয়ে রইলেন। হঠাৎ বললেন, ‘আপনার কি মনে হয় না যে এ ব্যাপারে ওর কিছু করার নেই?’
‘কী রকম?’ আমি প্রশ্ন করি।
হাসলেন নিবারণ কর্মকার ‘যেমন ছবির ব্যাপারে আমার কিছুই করবার ছিল না। নিশি দারোগার মেয়ের ব্যাপারটা ভেবে দেখুন।’
‘দেখব।’ বললাম। কেমন সন্দেহ হল নিবারণের মাথায় কোনও অদ্ভুত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কেন না হঠাৎ এক সময়ে বললেন, ‘আমার আঙুলগুলো তো নষ্টই হয়ে যাচ্ছে’–একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘কুসুমকে বলে দেখব, যদি ও আমার ছবি–আঁকার আঙুল দুটো খেয়ে ফেলতে পারে। বলেই পুরোনো ধরনের খিকখিক হাসি হাসলেন নিবারণ। হঠাৎ গলা নামিয়ে বললেন, ‘আপনারা কুসুমকে ভয় করেন, না?’
আমি তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। পাগল আর কাকে বলে! যখন চলে আসি তখনও নিবারণ বিড়বিড় করে যা বলছিলেন তার অর্থ–ওঁর ছবি আঁকার আঙুলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! আমরা ভেবেছিলাম মিস কে. নন্দী দেবী চৌধুরানীর মতো প্রফুল্ল রূপান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু ব্যাপারটা যা বোঝা যাচ্ছে তাতে মনে হয় কোথাও কোনও গোলমাল থেকে গেল।
এদিকে গাঁয়ের লোকেরা কে. নন্দী কিংবা নিবারণ কারুরই এই গাঁয়ে থাকা পছন্দ করছিল। তারা বলে বেড়াচ্ছিল কে, নন্দী এবার তাঁর শেষ খেলা দেখাবেন। তিনি বড়ই উচ্চাকাঙ্ক্ষাসম্পন্না মহিলা–সাপ মুরগির পর এবার তিনি আরও বড় কিছুর জন্য হাঁ করেছেন। নিবারণের বিপদ ঘনিয়ে এল বলে। মনে হচ্ছিল কে, নন্দীর সেই শেষ খেলাটা দেখার জন্য অনেকেই অপেক্ষা করছে।
ছবি–আঁকা ছেড়েই দিলেন নিবারণ। ঘর থেকে বড় একটা বেরোতেন না। কিন্তু তাঁর ভিতরে যে একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে, একদিন তা প্রমাণ পাওয়া গেল। গাজনের বাজনা শুনে হঠাৎ খেপে গিয়ে ওঁর ঘর ছেড়ে বেরোলেন তিনি। ডেকে উঠলেন–হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করলেন এবং এইসব ব্যাপারে সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত রক্তাক্ত শরীরে অবশেষে বুড়ো শিবতলার বটগাছের নীচে লুটিয়ে পড়লেন। কে, নন্দীর সেবা–যত্নে তাঁর শরীর ক্রমশ সুস্থ হল, কিন্তু রোখ কমল না। পথে পথে ঘুরে বেড়ান আর বুড়ো বাচ্চা সকলকেই ডেকে তাঁর ডানহাতটা দেখান ‘দ্যাখো তো, আমার আঙুলগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কেন?’
এই সময়ে একদিন রাস্তায় আমার সঙ্গে দেখা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কষ্টে চিনতে পারলেন আমায়। বললেন, ‘শুনেছেন কিছু? নিশি দারোগা বলে পাঠিয়েছে যে কুসুমকে ত্যাগ করতে হবে। আশ্চর্য!’
আমি কিছু বললাম না। নিবারণের পিঠে হাত রাখলাম। নিবারণ নিজেই বলে চললেন, ‘কুসুম চলে গেলে আমার আঁকার কী হবে!’
‘আপনি আবার আঁকছেন?’
‘না।’ মাথা নাড়লেন নিবারণ, ‘আমার আঙুলগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।’ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বললেন, ‘কিন্তু কুসুমকে আপনারা ভয় পান কেন? আমি তো দেখছি কুসুম সার্কাসে যা করত তাও একটা খেলা। ছবি আঁকা যেমন খেলা, ঠিক তেমনি। কিন্তু মুশকিল–আমরা কেউই অভ্যাস ছাড়তে পারছি না।’ বলেই হঠাৎ হা হা করে হাসলেন নিবারণ ‘কয়েকদিন আগে আমি একটা পায়রা মারলাম। তারপর ঘাড় মটকে সেটার গলার নলীর দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলাম।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘মুখ দিতে প্রবৃত্তি হল না। কিন্তু দেখবেন, চেষ্টার অসাধ্য কিছু নেই।’
কয়েকদিন পর নিবারণকে বাস্তবিক দেখা গেল বনডুবির মাঠে–একপাল ছেলেপুলে ঘিরে ধরেছে তাঁক, আর মাঝখানে নিবারণ একটা আধমরা কবুতরের পালক দু’হাতে পটপট করে ছিঁড়ছেন, কাঁচা মাংসের জঙ্গলে ব্যগ্র কামড় বসাচ্ছেন। তাঁর মুখের বিস্বাদ, বমনোদ্রেক সব কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
এরপর প্রায় সব কিছুই ভক্ষণ করবার জন্য ব্যগ্র হয়ে পড়লেন নিবারণ। মাঝে মাঝে জ্যান্ত পাঁঠা–ছাগল কামড়ে ধরেন, কুকুরকে তাড়া করে ফেরেন। দু’বার গাঁয়ের লোক তাঁকে বাঁশ পেটা করে আধমরা করল। লোকে নিবারণের নামের আগে ‘পাগলা’ কথাটা জুড়ে দিল।
আমার মনে হয় নিবারণ ঠিক পাগল হয়ে যাননি। কে, নন্দী সার্কাসে যখন মুরগি এবং সাপ ভক্ষণ করতেন–তখন কেউ তাঁকে পাগল বলেনি, বরং অনেক দূর থেকে পয়সা খরচ করে দেখতে গেছে। নিবারণ সম্পর্কে আমার এই মনে হয় যে তিনি তাঁর শিল্পের অভ্যাস পরিবর্তিত করতে চাইছিলেন মাত্র। মনে হয়েছিল ছবি ছেড়ে বাস্তবিক তাঁর শিল্পগুলি এইবার তাঁকে আক্রমণ করতে শুরু করেছিল। তাই শিপান্তরে যেতে চাইছিলেন মাত্র।
এর কিছুদিন পরে একদল বেদে এল আমাদের গাঁয়ে। নানারকম খেলা দেখাল, ওষুধপত্র শিকড়বাকড় বিক্রি করল। তারপর একদিন ছাউনি গুটিয়ে চলে গেল।
দু-একদিন পর নিবারণ আমার কাছে এসে বললেন, ‘আমার স্ত্রী কুসুমকে আপনি চিনতেন?’
আমি মাথা নাড়ালাম–হ্যাঁ।
হঠাৎ খিকখিক করে হেসে উঠলেন নিবারণ, বললেন, ‘কুসুমের সার্কাসের খেলাগুলো কিন্তু তেমন সাংঘাতিক কিছু ছিল না। ওর চেয়ে সাংঘাতিক খেলা আমিই আপনাকে দেখাতে পারি।’
আমি নিবারণকে দেখছিলাম–আগেকার মতোই আছেন নিবারণ। লক্ষ করলাম তিনি আর। তাঁর ডানহাতের দিকে চাইছেন না এবং তাঁর বগলে মোড়কের মধ্যে কয়েকটা ছবি রয়েছে বলে মনে হল। আমি জিগ্যেস করলাম, ‘কী ব্যাপার?’
খিকখিক করে হাসলেন নিবারণ ‘কুসুমের সেই খেলাটার কথা বলছিলাম। সেই খেলাগুলো আমিই কুসুমকে দেখাতে শুরু করলাম। কুসুম কিন্তু ভয় পেয়ে গেল। খেলা দেখাত কুসুম, কিন্তু ওই খেলা নিজে কখনও দেখেনি সে।’ একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘আমার মতোই অবস্থা হল কুসুমের। তার শিল্পও তাকে আক্রমণ শুরু করল।’
আমি চেয়ে ছিলাম। খানিকটা আন্দাজ করে বিস্মিত না হয়ে আমি প্রশ্ন করলাম, ‘কে. নন্দী কোথায়?’
‘ঠিক জানি না। একদল বেদে এসেছিল লক্ষ করেছেন?’ আমি বুঝলাম। চুপ করে থেকে হঠাৎ জিগ্যেস করলাম, ‘আপনার আঙুল?’
নিবারণ উত্তর দিলেন না। আস্তে-আস্তে ছবিগুলোর মোড়ক খুলে আমার সামনে পেতে দিলেন। প্রথম ছবিটাতে ছিল দুটো ভয়ঙ্কর কালসাপ পরস্পকে জড়িয়ে ধরেছে। আমি আর ছবিগুলো দেখলাম না। দেখবার দরকারও ছিল না।
বুঝলাম, পটুয়া নিবারণকে এবার ঠেকানো মুশকিল হবে। কেন না, তিনি বুঝতে পেরেছেন তাঁর অস্তিত্বের অপরাংশ তাঁর শিল্পকর্মের বিদ্রোহী যাবতীয় ভয়ঙ্করতা ও হিংস্রতাকে ভক্ষণ করতে সক্ষম।