পটলা ও রামছাগল
হঠাৎ ক’দিন ধরে পটলার পাত্তা নেই ।
পটলা বেপাত্তা হওয়া মানে আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবেরও সমূহ বিপদ। কারণ ক্লাবের তাবৎ খরচা যোগায় ও। আর ওর নিপাত্তা হওয়ার খবরটা তামাম কুলেপাড়ায় চাউর হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যত পাওনাদার যথা ভজন ঝালমুড়িওলা, এতোয়ারি কুলপি মালাইওলা, ফুচকা-আলুকাবলিওয়ালা বুধন এসে হাজির তাদের পাওনার ফর্দ নিয়ে। ওদিকে রাসমণি বাজারের পথও ছাড়তে হয়েছে! ওখানে ওত পেতে আছে মদন কেবিনের মালিক মদন ধাড়া, একেবারে যাচ্ছেতাই লোক ।
সেদিন হোঁৎকাকে ধরে শাসিয়েছে—চা মামলেট এন্তার খেয়ে গেছিস্ তার বাবদ তেরো টাকা ষাট পয়সা না দিলে গলায় গামছা দেবো এবার।
আর ভজন ঝালমুড়িওয়ালা রোজ সন্ধ্যায় খুঁজে পেতে ক্লাবের মাঠে এসে আমাদের শোনায়,—সাত টাকা বাকি না মিটোলে চোখে ঝাললঙ্কা ঠাঁইসা দিব ।
অর্থাৎ ঘরে বাইরে অশান্তি। তবু পটলার দেখা নেই। মাঝে মাঝে ওর মাথায় পোকা নড়ে ওঠে, আর তারপরই এমনি একটা কাণ্ড বাধায় আমাদেরও বিপদে ফেলে।
হোঁৎকা বলে,—আর পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবে থাকুম না। রেজিকন্যাশন দিমু।
ফটিক বলে-তাই দে। আমিও ফলিডল খেয়ে জীবন নাশই করব। উঃ প্রেসওয়ালা ফাংশনের টিকিটের ছাপানোর টাকার জন্যে বাড়ি গিয়ে শাসাচ্ছে।
সামনে ফাংশন—তার জন্যও ইনভেস্ট হয়ে গেছে, ক্লাব ফান্ড ও শূন্য, পাড়ায় টেকা দেয় । হোঁৎকা বলে,–হয় রেজিকনেশন নে, নয় আমাগোরই পটলার মত নিরুদ্দেশ হওয়ার লাগবো।
গোবরাই বলে,—চল, পটলার ঠাকুমা বার বার করে ডেকে পাঠাচ্ছে।
হোঁৎকা জানায়—পটলার কুন কেসে আমি আর নাই। ওগোর পুরা জালি কেস। তবু না গিয়ে পারিনি।
পটলাদের বিরাট বাড়ি, বাগান। ওদিকের ড্রইংরুমে তখন পটলার বাবা-কাকাদের কি জরুরি আলোচনা চলেছে।
ওদিকে না গিয়ে বাগানের পাশে মন্দিরের চাতালেই গেলাম, পটলার ঠাকুমা সন্ধ্যার পর ওখানে বসে মালা জপ করে।
বুড়ি আমাদের সত্যিই ভালোবাসে, কারণ জানে যে পটলার বিপদে আমরাই বহুবার জান দিয়ে লড়ে তাকে উদ্ধার করেছি। ঠাকুমা তাই দায়ে অদায়ে আমাদের ক্লাবকেও বেশ টাকাকড়ি দেয়। বুড়ির নাকি অঢেল টাকা। আর ছেলেরা তো দুহাতে পয়সা রোজগার করে নানান ব্যবসা থেকে।
আমাদের পথ চেয়েই যেন বসেছিল ঠাকুমা। বলেন,—এসেছিস! প্রসাদ নে। তারপর কথা হবে।
লুচি গাওয়া ঘিয়ের হালুয়া আর কালাকাঁদ। বেশি পরিমাণেই দেয়, বেশ আরাম করে খেয়ে জল খেতে দেহে মনে কিছুটা বল-ভরসা আসে। হোঁৎকা বলে,— পটলার পাত্তা পাইলেন ? ফটিক বলে—কোথায় যে গেল?
ঠাকুমা বলেন,—তাই বলার জন্যেই ডেকেছি। পটলার নীতি-বিবেক জাগ্রত করার জন্য আমার ছোট ছেলেই ওর গুরুদেব, কি যেন একশো আট ঘটেশ্বর বাবার আশ্রমে, পাঠিয়েছে তাকে। বেচারা সেখানে পড়ে আছে রে-
অর্থাৎ পটলাকে চালান করা হয়েছে কৌশলে।
হোঁৎকা বলে—সেকি! তা আশ্রম খান্ কোথায় ?
—সে অনেক দূরের পথ। বাসুদেবপুর ইস্টিশানে নেমে বাসে করে চারকোশ পথ গিয়ে কোন নদী, বনের ধারে। শুনেছি সেই সাধুবাবা নাকি বিরাট তান্ত্রিক। মানুষকে ভেড়া, ছাগল করে রাখে। কে জানে পটলাকে কি করে রেখেছে। বাছা আমার সেই যে গেছে আর ফিরল না রে। কেমন আছে কে জানে।
ভাবনার কথা। শোনাই,—একবার গিয়ে খবর আনব?
ঠাকুমা বলে–খবর কি রে, তাকেই আনতে হবে। যা খরচা লাগে নিয়ে যাবি, তোরাই এখন ভরসা রে। একটা ছেলে একটু না হয় বেয়াড়া তাই বলে এই তান্ত্রিকের খপ্পরে পাঠাবে, তাকে বেড়াতে পাঠাবার নাম করে।
ভাবছি আমরা। হোঁৎকার উর্বর মস্তিষ্কে এবার অ্যাকশন শুরু হয়েছে। গোবরার দেহটা বিরাট, সে তো লড়ার জন্য ছটফট করে। হোঁৎকা বলে, হইব ঠাকমা, পটলার ‘রেসকিউ’ মানে ইংরাজিতে যারে কয় ‘উদ্ধার’ তাই কইরা আনুম ।
জোর মিটিং বসেছে ক্লাবে। হোঁৎকা এর মধ্যে ঠাকুমার কাছ থেকে ক্লিন পাঁচশো টাকা এনেছে, তার থেকে ভজন, এতোয়ারি—বুধন মায় মদন কেবিনের মদন ধাড়ার তেরো টাকা ষাট পয়সা কুল্যে বাষট্টি টাকা দেনা ফেলে দিয়ে সদর্পে ঘোষণা করেছে,—পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব কারো এক কানা-কড়িও বাকি রাখে না বুঝলা? যে যার টাকা বুইঝা লও ।
এবার প্ল্যান ভাবা হচ্ছে। ফটিক এর মধ্যে খবর এনেছে ওর মাসিমার বাড়ির কাছেই নাকি একশো আট ঘটেশ্বর বাবার ‘সিদ্ধাশ্রম’, জায়গা দুর্গম—বন নদী এসব ব্যাপারও আছে আর ওই ঘটেশ্বর বাবা নাকি ওই এলাকার একটি বিরাট প্রতাপশালী ব্যক্তি ।
ভয় হয়। বলি,—ওর সঙ্গে টক্কর দিতে পারবি? শেষকালে যদি—
হোঁৎকা গর্জে ওঠে,—কী আর হইব? ছাগল তো তুই হইয়াই আছস! কাওয়ার্ড ! গোবরা বলে, কারেকট! তাই দেখে আসি তাকে। পটলাকে রেসকিউ করবোই। পটলার জন্য কতবার পটল তুলতে তুলতে বেঁচে গেছি। তাই এবারও ওদের চাপে রাজি হতে হল। হোঁৎকা বলে,—কালই বাইর হইতে লাগবো। শুভস্য শীঘ্রম!
বাসুদেবপুর স্টেশনটা নেহাৎই ছোট। স্টেশনঘরের লাগোয়া একটু টিনের শেড। ওটাই যাত্রীদের ওয়েটিং রুম। বেলা এগারোটা বাইশের লোকালে নেমে দেখি রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে, বাসও নেই। স্টেশনের বাইরে মাঠের ধারে একটা বটগাছের নীচে চায়ের দোকান। বাঁশের মাচাটা তখন প্রায় খালি, খদ্দেরপত্র বিশেষ নেই, দোকানদার চায়ের উনুন নিভিয়ে ঘরে যাবে, আমাদের দেখে চাইল। সেইই জানায়,—বাস তো আবার বিকাল চারটেয় ।
গোবরা শুধায়,—ঘটেশ্বর বাবার আশ্রমে যাব, কতদূর পথ ?
লোকটা বলে,তা কোশ চারেক তো নকীপুর হাট, সেখান থেকেও ধরেন কোশটাক। তা বাসে গেলেও সন্ধে রাত, এখন হেঁটে গেলেও তাই।
হোঁৎকা বলে,—হাইটাই চল্। এহানে খাবারও কিছুই মিলবো না।
পটলার জন্যে নয়, পেটের ধান্ধাতেই হাঁটা শুরু করেছি।
নকীপুর হাটতলায় পৌঁছলাম, তখন বিকেল হয় হয়। সারা পথে খাবার দোকান কিছুই নেই, ধু ধু মাঠ আর ছোট্ট জনবসতি।
হাটতলায় একটা দোকানের বেঞ্চে বসে স্রেফ মুড়ি, ঠান্ডা আলুর চপ আর কয়েকটা করে রসগোল্লা খেয়ে তবে ধড়ে প্রাণ আসে।
এবার শুধোই দোকানদারকে,—ঘটেশ্বর বাবার আশ্রম যাব কোনদিকে? দোকানদার ঘুরে তাকায়, কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
চন্দননগর থেকে—গোবরা আসল ব্যাপারটা জানায় না ।
দোকানদার বলে,—তা ওই আশ্রমে বাপু, সন্ধ্যার পর না যাওয়াই ভালো। মানে শ্মশানের কাছে কিনা, আর সাধুবাবা তো ভূত-প্রেত নিয়েই থাকে।
ফটিক বলে,—মন্ত্রের চোটে নাকি মানুষদের ছাগল ভেড়া বানিয়ে দেয় ?
দোকানদার বলে,—ওসব ঠিক জানি না বাপু। তবে লোকে বলে-টলে। তা রাতে ওখানে না যেয়ে এখানে ইস্কুলেই থাকেন। যেতে হয়, সকালেই যাবেন।
হোঁৎকা তবু বলে–মনে হয় কেস গড়বড়। কুইক অ্যাকশনই করনের লাগবো, চল গিয়া । রাত হয়ে গেছে। গ্রামও নিশুতি হয়ে গেছে। গ্রামের বাইরে আরও বেশ খানিকটা ডাঙ্গা, বনখেজুরের ঝোপ, – দু’একটা ছড়ানো ছিটানো মহুয়া শালগাছের জটলা, তারপরই শুরু হয়েছে বনের সীমানা। পথও তেমন কিছু নেই এদিকে।
বলি,-এ কোথায় এলাম রে? এ যে শালবনের শুরু। কোথায় তোর ঘটেশ্বরবাবার আশ্ৰম?
হোঁৎকা বলে-এই তো পথ। চল্।
পিচ ঢালা পথ নয়,—লাল কাঁকর মোরাম বিছানো পথ। পথটা এবার বনের মধ্যে ঢুকেছে, দুদিকে ঘন শালবন–বেশ কিছুটা গিয়ে অজয় নদীর বিস্তার।
ওদিকে অন্ধকারে মাথা তুলে আছে বেশ কয়েকটা বাড়ি, মন্দিরের চুড়োও দেখা যায়। দূরে দু’একটা বাতি জ্বলছে, সামনে একটা শেডমত, লোকজন বিশেষ নেই। অন্ধকারে ঠাওরও হয় না। সকাল থেকে শরীরের উপর ধকলই চলেছে।
বলি,—এই চাতালেই শুয়ে পড়। কাল সকালে দেখা হবে। হোঁৎকা ততক্ষণে টানটান হয়ে শুয়ে পড়েছে।
রাত কত ঠিক জানি না, হঠাৎ একটা ধাক্কায় জেগে উঠলাম, কে যেন কোমরে প্রচণ্ড ধাক্কা কষেছে। অন্ধকারে দেখি, একটা বিরাট ছাগল এসে আমাকে গোঁত্তা মেরে ঠেলে তুলে দিয়ে আমার জায়গাটায় বসে দাড়ি নেড়ে জাবর কাটছে নির্বিকার ঋষির মতই।
ততক্ষণে গোবরা ধড়মড় করে উঠেছে,–এঃ! ভিজিয়ে দিল সর্বাঙ্গ! কি রে? বুঝলাম, হতভাগাটা তার আগে জলত্যাগও করেছে গোবরার গায়ে ।
বলি,—সরে আয় গোবরা, ওকে ঘাঁটাস নে। ব্যাটা গুঁতিয়ে দেবে। যা শিং দেখেছিস?
গোবরা বলে,—উঃ, পটলার জন্যে আর কত সইতে হবে র্যা? পটলাকে পেলে – হঠাৎ দেখি, বিরাট পাঁঠা ছাগলটা উঠে দাড়ি নেড়ে সংস্কৃত স্যারের মত মিহি গলায় সাড়া দেয়, ব্যা-ব্যা –
আর উঠে এসে গোবরার মুখের কাছে সদাড়ি মুখ নিয়ে চাইতে থাকে। গোবরা হঠাৎ চমকে ওঠে,–ওরে সমী এ ছাগল নয়রে ? পটলাই।
ছাগলটা এবারও সাড়া দেয়, ব্যা-ব্যা !
—অর্থাৎ হ্যাঁ-ই বলছে রে!
মনে পড়ে যায়, ঘটেশ্বর বাবা নাকি লোকজনদের মন্ত্র পড়ে ছাগল ভেড়া বানিয়ে রাখে । আর্তনাদ করে উঠি,—পাঁঠার চোখ দুটো দ্যাখ, একদম পটলার চোখ ।
পটলার নাম শুনে ছাগলটাও গদগদ হয়ে সাড়া দেয়,—হ্যাঁ – হ্যাঁ-
গোবরা ঠেলে তোলে হোঁৎকা, ফটিককে। হোঁৎকা ঘুম চোখে বলে,–কি হইছে ? গোবরা বলে, পটলাকে পেয়েছি।
এ্যা,–হোঁৎকা শুধায় : কোথায় পটলা? ওরে ফিনিস্ করুম্।
গোবরা করুণকণ্ঠে বলে,—ওকে ঘটেশ্বরবাবাই ফিনিস্ করেছে রে? ওই তো পটলা! ওকে আস্ত রামছাগল বানিয়েছে দ্যাখ্ ?
পটলার নবরূপ দেখে হোঁৎকা থ।
হোঁৎকা এ হেন আদরে ভেঙে পড়ে ।
-হালায় ঘটেশ্বর, তার ছাগল বানাইল পটলা? ওরে শ্যাষ করুম!
কিন্তু সে তো পরের কথা। এখন ছাগলরূপী পটলাকেই উদ্ধার করতে হবে। শুধোই, —উদ্ধার তো করলি কিন্তু ছাগল থেকে ওকে আবার পটলায় পরিণত করবি কী করে? মন্তর তো জানা নেই।
হুঁ। —হোঁৎকা ভাবিতভাবে বলে : সংস্কৃত স্যার অনেক মন্তর জানেন তেনারেই দেখাবো। তাতে কাম না হয় হালায় দলবল লইয়া আসুম, তর ঘটেশ্বর বাবাকে তুইলা লইয়া যামু।
এ মন্দ যুক্তি নয়। তাই বলি,—তাহলে ভোর হবার আগেই ছাগলটাকে নিয়ে প্রথম পালাতে হবে। রাতারাতি পাঁচ ক্রোশ পথ হেঁটে সকালের গাড়িতেই উঠে কলকাতা যেতে হবে।
তখনও বেশ রাত রয়েছে। চারিদিক নীরব নির্জন ।
আমরা ছাগলটাকে একটা দড়িতে বেঁধে হাঁটছি। গোবরা পথের ধারে কাঁঠালগাছ থেকে বেশ এক বোঝা পাতা ভেঙেছে। ছাগলরূপী পটলা এন্তার পাতা চিবুচ্ছে আর দিব্যি চলেছে আমাদের সঙ্গে ।
হোঁৎকা বলে,—জলদি চল। হালা ঘটেশ্বর জানতি পারলে আমাগোর পঞ্চপাণ্ডবগো পাঁচখান ছাগল বানাইয়া ছাড়ব।
ঊর্ধ্বশ্বাসে চলেছি মাঠ ঘাট ভেঙে স্টেশানের দিকে। যখন ভোর হয় হয়, স্টেশনের ধারে বটতলায় এসে দাঁড়ালাম। চা-ওয়ালা দেখছে আমাদের। কাল দুপুরে খালি হাতে দেখেছিল আমাদের। আজ ভোরে এক রামছাগলসহ দেখে বলে, – কিনলেন ছাগলটা ?
গোবরা বলে,—হ্যাঁ। চা বানাও। কলকাতার গাড়ি কখন আসবে ভাই ?
দোকানদার চায়ের গেলাসে চামচ নাড়তে নাড়তে বলে,—এসে পড়বে এবার। তা ছাগলটার কেজি পনেরো মাংস হবে। কত নিল?
হোঁৎকা অনেক কষ্টে রাগ সামলে বলে, – সত্তর টাকা ।
—একশো টাকা দিব। দ্যান—তাহলে ভাগ্না লাগিয়ে দিই কেটে।
হঠাৎ দেখা যায় ছাগলরূপী পটলা এই ফাঁকে ঝপ্ করে সামনের দু’পা তুলে দোকানীর লেড়ো বিস্কুটের ঠোঙাতেই সদাড়ি মুখ ঢুকিয়েছে। দু-তিনটে বিস্কুট মুখে পুরতেই দোকানদার লাফ দিয়ে তেড়ে আসে ছাগলের দিকে।
আর সঙ্গে সঙ্গে ছাগলরূপী পটলা সামনের দু’পা তুলে হোল্ বডি ওয়েট দিয়ে দোকানদারের হাঁটুতেই এইসা একখান ঝেড়েছে যে বেচারা ছিটকে গিয়ে পড়েছে মাচায় । দোকানদারকে কিছু পয়সা দিয়ে থামালাম, দেখি দূরে ট্রেন আসছে।
ঠাকুমা তখন মন্দিরে বসে মালা জপছিলেন।
হঠাৎ আমাদের ট্যাক্সি নিয়ে বাগান পার হয়ে মন্দিরের সামনে গিয়ে নামতে দেখে বুড়ি চোখ বড় বড় করে আশা ভরে এগিয়ে আসেন। ব্যাকুল কণ্ঠে শুধোন,—পেয়েছিস পটলাকে? হোঁৎকা একদম বিষণ্ণতার পোজ নিয়ে কাঁদ কাঁদ স্বরে বলে,–পাইছি ঠাকুমা। তয় ওই ঘটেশ্বর বাবা ওর সর্বনাশ কইরা ছাড়ছে।
—এ্যাঁ! কেমন আছে আমার পটল?
জানাই—ভালোই আছে ঠাকুমা ?
তবে?—ঠাকুমা আর্তনাদ করে, তবে যে বললি সর্বনাশ! কোথায় সে?
হোঁৎকা বলে,—পটলারে ঘটেশ্বর বাবা ছাগলে ট্রান্সফার করছে ঠাকুমা। ওই যে। দ্যাখেন ওর রূপখান্ ।
এ্যা—চমকে ওঠে ঠাকমা।
আর ছাগলরূপী পটলা ততক্ষণে এসে হাজির হয়েছে ঠাকুমার কাছে, সদাড়ি মুখ তুলে দেখছে ঠামাকে বিস্মিত চাহনি মেলে, আর ঠাকুমাও ততক্ষণে ওর দাড়ি সমেত মুখ দিয়ে দুহাতে নিজের গালে চেপে ধরে হাউ-মাউ করে ওঠেন,—ওরে পটলারে? তোরে একি হাল করেছে রে। ও বাবা সোনার চাঁদ আমার, ওরে কে কোথায় আছিস এসে দ্যাখ্ রে, আমার পটলার এ কি হাল করেছে।
সে এক দৃশ্য। ওনার চিৎকারে পটলার বাবা-মা, মেজকাকাও দৌড়ে আসেন। দারোয়ান পূজারীও এসে পড়ে, পটলার নবকলেবর দেখে ওর মাও চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলেন, অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছি আমরা।
এমন সময় আবার একটা ট্যাক্সি এসে থামল! চমকে উঠলাম, একি? ওকে?
পটলা সশরীরে নামছে, সঙ্গে এক গেরুয়াবসনধারী সাধু। পটলা ঠাকুমাকে ইয়া এক রামপাঁঠাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখে দারুণ অবাক হয়ে একবার সেদিকে একবার আমাদেরকে দেখে।
-ঠাকুমা! মা! এসব কি ?
ঠাকমা পটলাকে দেখে যে বিশ্বাস করতে পারেন না। সেই বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে এবার তার রিয়েল হারানিধিকে বুকে জড়িয়ে ধরেন,—এসেছিস ভাই! তোকে নাকি ছাগলে টেরানসফার করেছে ঘটেশ্বরবাবা।
সাধুমহারাজ হেসে ওঠে, সেকি গো! তাই বলে মানুষ পটলাকে ধরে আনতে গে আশ্রমের রামছাগল পটলারে তুলে আনলে রাতারাতি। কিরে পটল?
রামছাগলটা এবার স্বামীজির কাছে গিয়ে দাঁড়াল দু’পা তুলে।
আমাদের অবস্থা তখন কাহিল। পটলা বলে,—খ্-খুব বুদ্ধি যা হোক ত তোদের? এ্যা—এসব ভাবলি কি করে ব-বলতো? ত্-তোফা আরামে ছিলাম। আশ্রমে, আজ ফিরেছি আর ক-কাল রাতে তোরা যে ছাগল তুলে আনলি আমি ভেবে? এ্যাঁ ।
স্বামীজি দেখছেন আমাদের, হাসছেনও। ঠাকুমাও। হোঁৎকার সব বুদ্ধি যেন বরবাদ হয়ে গেছে। বলে সে,—চল্ গিয়া। ঠাকুমা, পটলারে ছাগল ভাইবা ‘মিসটেক’ করছি। তয় ছাগলের নাম পটলা জানুম ক্যামন কইর্যা ?
গুরুদেব বলে—আর ওই ছাগল পটলকে তোমাদেরই পৌঁছে দিতে হবে, সেইসঙ্গে দুদিন বেড়িয়ে আসবে। ভয় নেই, তোমাদের ছাগলে ট্রান্সফার করব না ।
পটলার মেজকাকা মুখ বেঁকিয়ে বলে ওঠেন,—আর ট্রান্সফার ওদের করবেন কি? ওরা তো অলরেডি ছাগলে ট্রান্সফার হয়েই গেছে। উঃ, কী করে ভাবলি এসব বলত? ধেড়ে ছাগল কোথাকার!