পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

পটলার সুমতি

পটলার সুমতি

আমাদের পটলা বেশ কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর আবার উসখুসিয়ে উঠেছে। সে মাঝে মাঝেই এমন একটা কাণ্ডকারখানা করে বসে বার হ্যাপা সামলাতে গিয়ে আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের সদস্যদের হয় নাজেহাল অবস্থা। হোঁত্তা তো মাঝে মাঝেই ঘোষণা করে—এই ক্লাবথনে রেজিকনেশনই দিয়া ইলেভেন বুলেটে জয়েন করুম। তরা থাক্ পটলারে লই । আমি আর নাই।

কিন্তু ওই পর্যন্তই। পটলাকে ছেড়ে, এই পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব ছেড়ে যেতে পারে না। অবশ্য তার কারণও পটলাই। এই অঞ্চলের বনেদি ধনী পরিবার ওরা। বিশাল বাগান-পুকুর সমেত বাড়ি। ওদিকে বড় রাস্তার ধারে একটা বাজারও ওর ঠাকুমার নামে। বাবা-কাকাদেরও নানা ব্যবসা, কারখানা রয়েছে। বিরাট কাঠগোলা, আরও কত কী! পটলাই তাঁদের একমাত্র কুল-প্রদীপ। ঠাকমার কাছে নাতিই সব। ঠাকমা নাতির খামখেয়ালিপনায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেও পটলার সব খেয়াল মেটাতেই দু’হাতে টাকা দেন। আর আমরা হলাম পটলার অতন্দ্র প্রহরী। তাই ঠাকমার সেই স্নেহের অংশীদার হয়েছি। ক্লাবের সব খরচা জোগান ঠাকমা। টিফিনের ব্যবস্থাও ভালো। ঠাকমা বলেন, তোদের ভরসাতেই আমি থাকি রে! পটলাকে তোরাই সামলা।

কিন্তু পটলাকে সামলানোই দায়। কখন যে ওর মাথায় কোনো পোকা নড়ে উঠবে কে জানে!

এবার পটলার খেয়াল হয়েছে সে কিশোরদের নিয়ে একটা সিরিয়াল করবে টিভি চ্যানেলে। ধেড়েদের নিয়েই সবাই ছবি-টিভি সিরিয়াল করে। কিশোরদের কথা কেউ ভাবে না। এবার পটলা বলে, কিশোরদের নিয়েই টিভি সিরিয়াল করব।

হোঁৎকা বলে, ওসব টিভি সিরিয়াল কইর‍্যা কী হইব? ফুটবল টিমকে এবার ভালো কইর্যা করতে হবে।

ফটিক আমাদের মধ্যে সঙ্গীতচর্চা করে। এখন সে স্বপ্ন দেখছে টিভিতে মিউজিক ডিরেকটার হবে। তাই ফটিক বলে, ফুটবল টিম তো আছেই! ক্লাব থেকে টিভি সিরিয়াল হবে কিশোরদের। আমরাও পার্ট করব।

পটলা বলে, হোঁৎকার তো বাঙাল ভাষার টান আছে। ভানু বাঁড়ুয্যে নেই। এখন হোঁৎকা যদি বাঙাল ভাষায় কমিক্ করতে পারে, ওর দিন বদলে যাবে। আর সমীর, তুই লিখবি চিত্রনাট্য।

আমি বলি, আমি রচনা লিখতে পারি। তাই বলে চিত্রনাট্য?

পটলা বলে, এস. গুপী তোকে শিখিয়ে দেবে। ফটিক, তুই হবি মিউজিক ডিরেকটার। আর গোবরা-

গোবরা চাইল। ওর মামার হোলসেল কুমড়োর ব্যবসা। সারা বাংলার বহু জায়গা থেকে নানা সাইজের কুমড়ো-চালকুমড়ো আসে ট্রাকবন্দি হয়ে। খালধারে ওদের গুদামে টাল করা থাকে কুমড়ো। গোবর্ধন ওর মামার কুমড়োর ব্যবসা দেখে। পটলা বলে, হিসাব-টিসাব বুঝিস তুই। তুই হবি আমাদের প্রোডাকশন কন্ট্রোলার।

অর্থাৎ পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব এবার এই অঞ্চলের সব ক্লাবকে টেক্কা দিয়ে টিভি সিরিয়াল করতে চলেছে।

তার মানে পটলার ঘাড়ের পেতনিটা বেশ জাগ্রত হয়ে উঠেছে। আর এই ব্যাপারে প্রধান উদ্যোক্তা গ্যাসপ্রদানকারী শ্রী গুপীনাথ সরখেল, অর্থাৎ পটলার এস. গুপী। সেই ব্যাটাকেও দেখলাম ।

অবশ্য ঠাকমা বলেন, পটলা কোত্থেকে ওই লোকটাকে জুটিয়েছে, ওই গুপীই ওর মাথায় এসব ঢুকিয়েছে। না হলে এ বাড়িতে এসব কেউ করেনি। ওর বাবা-কাকারা তো ব্যবসা করছে।

আমরাও এসব জগতের খবর জানি না। টিভি দেখতে হয় দেখি। তার পিছনে কী করে কী হয় জানি না। তবে ছবি নিয়ে স্বপ্ন একটা আছে সকলের।

ঠাকমা বলেন, এত করে ধরেছে পটলা, ক’দিন তো ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়াও করেনি। শেষে আমিই রাজি হয়েছি টাকা দিতে। তবে কোথায় যায় পটলা, কারা সঙ্গে থাকে, দ্যাখ যাতে কাজটা ঠিকঠাক হয়। তাই আমরাও রাজি হয়েছি। ঠাকমা বললে না করতে পারি না।

পটলা এখন খুবই ব্যস্ত। সেদিন পটলা বলে, তোরা সবাই সন্ধ্যায় আসবি। গুপীদা আসবেন। জরুরি মিটিং আছে।

আমরা সেইমতো পটলার বাড়িতে এসেছি। নীচের গেটের বাঁদিকের বড় ঘরটাকে পটলা এর মধ্যে তার অফিস কাম রিহার্সাল রুম করেছে। চেয়ার-টেবিলও আছে। আর ওদিকের মেঝেতে কার্পেট পাতা। দেওয়ালে বেশ কিছু নামিদামি শিল্পীদের ছবি। উত্তমকুমারের একটা বড় ছবিতে মালা পরানো। পটলা এখন নিজেই হিরো হবার স্বপ্ন দেখছে। তাই দু’বেলাই উত্তমকুমারের ছবিতে মাথা ঠুকছে। বলে, ওঁর আশীর্বাদ থাকলে আমিও বড় অভিনেতা হব।

হোঁৎকা বলে, তুই তো তর গুরুদেবের ছবি পাইছিস। শোন, ভানু বাঁড়ুয্যের একখান ছবিও খাটাইয়া থুইবি। অর আশীর্বাদও আমারে লইতে হইব।

ওদিকে মিটিং-এর আয়োজন চলছে। পটলা এর মধ্যে একটা লম্বা খাতায় গল্পও লিখে ফেলেছে। বলে, দারুণ একটা কিশোর অ্যাডভেঞ্চারের গল্প। একটা কুকুরও চাই। ওটারও বড় রোল আছে।

হোঁৎকা বলে, অর জন্য ভাবিস না। আমাদের কাল্লুরে লই আনুম ।

কাল্লু হোঁৎকার বেশ ট্রেনড্ ডগ। জাতে অবশ্য ওটা খাঁটি নেড়ে। ওর বাপ-কাকারা রাসমণি বাজারে মাছের আড়তে থাকে। হোঁৎকা বাচ্চাটাকে বেশ নাদুস-নুদুস দেখে তুলে এনে পুষেছে।

কুকুরের প্রবলেম এত সহজে সমাধান হতে দেখে পটলা খুশি হয়। তবু আমি ভারি চিত্রনাট্যকার। তাই জিজ্ঞাসা করি, হ্যাঁরে, তোর কাল্লু পারবে তো সিরিয়ালে অভিনয় করতে?

হোঁৎকা বলে, পটলা যদি উত্তমকুমার হইতে পারে, আমি যদি ভানু বাঁড়ুয্যে হইতে পারি তাইলে কাল্লুও ঠিক পারব।

গোবরা বলে, তা না হয় হল, কিন্তু তোর গুপীদা কইরে, পটলা? ডিরেকটারই নেই!

হঠাৎ দেখা যায় পটলদের গাড়িটা এসে থামে বাগানের ওদিকে। একটা লম্বা লগার মত লোক কেলো ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গাড়ি থেকে নেমে সজোরে গাড়ির দরজা বন্ধ করে আমাদের দেখে হাত নাড়ে—হাই এভরিবডি, গুড ইভনিং। আমি এসে গেছি। কামিং—লম্বা পা ফেলে এগোতে যাবে লোকটা। তারপরই ঘটল কাণ্ডটা। কায়দা করে গাড়ির দরজা সজোরে বন্ধ করেছে আর তখনই ধুতির খানিকটা দরজায় আটকে গেছে। গুপীনাথ স্রেফ আন্ডারপ্যান্ট পরা অবস্থায় লিকলিকে ঠ্যাং বের করে এগিয়ে আসে। ধুতি রয়ে গেছে গাড়িতে। প্রথমে খেয়াল করেনি গুপীনাথ। তারপরই চমকে ওঠে—আমার ধুতি?

কোনোরকমে গাড়ির দরজা খুলে ধুতি বের করে আবার পরতে থাকে আর গজগজ করে, এর জন্যই বিলেতে থাকতে ধুতি ত্যাগ করেছি। এখানে এসে এইসব ডেঞ্জারাস পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে! রাবিশ! ধুতির বাপ-বাপান্ত করে ফিরে এল গুপীনাথ ।

এর মধ্যে পটলা খাতাখানা এগিয়ে দেয়। গুপীনাথ বলে, কী, হিসটোরি লেখা হয়েছে? হিসটোরিই হচ্ছে ছবির লাইফ। বুঝলে? ‘ফোর ইডিয়ট’ ছবি আমার লাইফ নিয়ে।

আমি ওই হিসটোরি শুনে বলি, গল্প মানে স্টোরির কথা বলছেন? গুপীনাথ খাতার পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলে, ওই হল আর কি। আমাকে যেন পাত্তাই দিতে চায় না। পড়ার ভান করে সে। তারপর খানিক পাতা উলটে বলে, হুঁ! হয়েছে। তবে একটু ফাইট বাড়াতে হবে। ফুল অ্যাকশন। ভয় নেই। আমি ওইসব ফিট করে দেব। কত হিসটোরি ফিট করে দিয়েছি বোম্বাই-এ। অমিতাভ, মানে তোমাদের ওই অমিতাভ বচ্চন তো আমাকে ফ্লোরে দেখলে সায়লেন্ট হয়ে যায়। আর আমীর খান বলত—আমার ইসকিরিপ—

আমি বাধা দিয়ে বলি, চিত্রনাট্য! ওর চিত্রনাট্য ?

গুপীনাথ বলে, ওর লাগান, তারে জমিন—এসব ছবির হিসটোরি আমিই ফিট করে দিয়েছি। পটলা চেপে ধরল, তাই মুম্বাই থেকে ফ্লাইটে চলে এলাম ওর কাজ করে দেবার জন্য ! পটলা বলে, এ সমীর। এই-ই আমাদের চিত্রনাট্য লিখবে।

গুপীদা আমাকে আপাদমস্তক দেখে যেন দয়া পরম ধর্ম হয়েই বলে, তুমি লিখবে? ও কে! ভয় নেই, আমিই সব লাইন আপ্ করে দেব।

এর মধ্যে ফটিক সিরিয়ালের জন্য টাইটেল সঙ লিখতে শুরু করে দিয়েছে। সে ক্লাব থেকে হারমোনিয়ামও এনেছে। গুপীবাবুকে গানটা শোনানো হবে। গুপীবাবুই আপাতত অল ইন অল। তাই ওকে চটানো যাবে না। ওর স্বীকৃতি আগে দরকার। ফটিক গান শুরু করেছে। বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে চাঁদ-ফুল-পাখি-দক্ষিণা বাতাস এরকম বেশ কিছু উপমা-টুপমা দিয়ে গানটাকে বানিয়েছে। গুপীদা গানটা শুনে বলে, মোটামুটি ঠিকই আছে, তবে সুরটা একটু তুলতে হবে । ওসব আমি তুলে দেব। তোমাদের ওই যে রহমান, ওই যে এখন মুম্বাইতে সুর চুরি করে মিউজিক করছে-

পটলা বলে, এ. আর. রহমান?

হ্যাঁ-হ্যাঁ। পুরো নামটা মনে থাকে না। ওকে আমি রহমান বলেই ডাকি। ও সুর করে প্রথমেই আমাকে শোনাত। আমি ওর কত সুর ঠিক করে দিয়েছি।

ফটিক বলে, রহমান সাহেবকে চেনেন তাহলে ?

গুপীদা বলে, চিনব না? ওদের সারে গা মা শেখালাম আর চিনব না? দেখা হলে ও আজও সেলাম করে।

আমরা অবাক হয়ে দেখছি ওকে। পটলা বলে, টিভি কোম্পানি আপনার নাম শুনে বলে, ওকে সিরিয়ালটা বানাতে বলো। আমরা চালাব।

এর মধ্যে হোঁৎকা-গোবরা দুজনে এলাকার নামি রেস্তোরাঁ থেকে পটলার টাকায় ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন, চিকেন মাঞ্চুরিয়ান এনেছে। পটলা এসব ব্যাপারে ভালো টাকা খরচা করে। হোঁৎকা এমনিতে ভোজনরসিক। ও বাকি কাজটা করে। ওদের সঙ্গে মাংসের গন্ধ পেয়ে হোঁৎকার সেই কাল্লুও ল্যাজ নাড়তে নাড়তে এসে হাজির হয়েছে।

পটলার বাবা-কাকারা গোঁড়া বৈষ্ণব। তাঁদের বাড়িতে মাছটা চলে কোনোমতে। তাঁদের বাড়ির সঙ্গেই রয়েছে বড় মন্দির। পটলার বাবা বেশ সাত্ত্বিক ধরনের লোক। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। গলায় কণ্ঠি। কপালে তিলকও কাটেন। ওঁদের গুরুদেব এলে বাড়িতে নামকীর্তন হয়। তখন মাছও বন্ধ। পটলা অবশ্য বাইরে মুরগি-মাংস চালায়। তাই নিয়ে অশান্তিও হয়। বাবা বলেন, সাত্ত্বিক আহার করবি। তিন বেলা নামজপ করবি। এবার গুরুদেবকে বলে তোকে দীক্ষা দেবার ব্যবস্থা করব।

পটলার কাছে বাড়ির এই পরিবেশ, গুরুদেব, তার দীক্ষা, নানান অসুবিধা। তবু মানিয়ে নেয়। কিন্তু হবিষ্যি খেয়ে থাকতে পারবে না সে। ঠাকমাই বলেন, এই তো ওর বাড়ন্ত বয়েস, এখন থেকে দীক্ষা নিয়ে কী হবে? আরও কিছুদিন যেতে দে। ঠাকমাই যেন পটলাকে ওই কঠিন নির্মম গুরুদেবের আক্রমণ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সে তাই সিরিয়াল করার স্বপ্ন দেখছে গুপীনাথকে নিয়ে।

গুপীনাথ বলে, পটলা, তোর সিরিয়ালের শুটিং শুরু করতে হবে। এই কাজটা শেষ করেই আমাকে মুম্বাই যেতে হবে। ওদিকে যশ ফোন করছে। ওর ছবির চিত্রনাট্যটা দেখে দিতে হবে। ডিরেকটার নিয়ে পরামর্শ করতে চায় ।

পটলা বলে, যশ?

আরে যশ, যশ চোপড়া! ও তো সব ছবি শুরু করার আগে আমার থেকে অ্যাডভান্স নেয় ৷ আমি বলি, অ্যাডভান্স না, অ্যাডভাইস ?

ওই হল। ও আমার কনসাল ছাড়া কাজই করে না।

আমি শুধরে দেবার চেষ্টা করি-কনসাল্ট।

গুপী চিকেন মাঞ্চুরিয়ান চিবোতে চিবোতে বলে, আরে বাবা, পুরো ইংরাজি বলতে সময় লাগে। তাই শট্ করে নিতে হয়। এটা এখানকার এসটাইল। তোমরা বুঝবে না ।

তারপরই গুপীদা অন্য প্রসঙ্গে গিয়ে বলে, না, ফ্রায়েড রাইসটা মন্দ করেনি। তবে বিরিয়ানি খেয়েছিলাম হায়দ্রাবাদে নিজামের পার্টিতে।

কলকাতাতেও নিজাম রেস্তোরাঁ আছে। গোবরা বলে।

গুপী বলে, সে নিজাম নামেই। আমি বলছি আমার জিগরদোস্ত খোদ হায়দ্রাবাদের নিজাম উল্ মহম্মদের কথা। সে বিরিয়ানি তোমরা চোখেই দেখোনি। এক চামচ খেলে দিল খুশ ! আমি বলি, তাহলে কালই চিত্রনাট্যটা শুনে নিন। শুটিং যদি শুরু করেন।

পটলাও চায় তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করতে। বলে সে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কালই বসা যাক। নিন গুপীদা, চিলি চিকেনটা টেস্ট করুন।

গুপীনাথ গব গব করে খাচ্ছে। ওই লগার মত দেহে এত সব মাল কোথায় যাচ্ছে কে জানে! পটলাও খুশি। খাওয়ার পর গুপীদা বলে, পটলা, কালই ক্যামেরাম্যান আর অন্যদের বুক করতে হবে। আর সেট হবে তোমাদের বাগানেই। অন্য জায়গায় গেলে দু’হাজার টাকা ভাড়া নেবে।

হোঁৎকা বলে, হই ভালো, পটলা! এহানে বেশ মন দিয়া কাজ করা যাইব।

গুপীনাথ বলে, গুড! তাহলে হাজার দশেক টাকা দাও। ওদের অ্যাডভান্স করে দিই। সব টেকনিশিয়ানদের এখন থেকে বুক না করলে পাওয়া যাবে না ।

পটলার ঠাকমার মত জোগানদার থাকতে টাকার অভাব নেই। গুপীনাথ দুটো নোটের বাণ্ডিল পকেটে পুরে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন মাঞ্চুরিয়ানের ঢেকুর তুলে যাবার আগে বলে গেল, কালই চিত্রনাট্য ফাইনাল করে দেব। ব্যস, কাজ শুরু হয়ে যাবে।

আমরাও স্বপ্ন দেখছি এবার আমরা এক-একজন উত্তমকুমার, ভানু বাঁড়ুয্যে, এ. আর. রহমান হয়ে যাব। আমি তো ভাবছি এবার থেকে চিত্রনাট্যই লিখব।

কিন্তু পরদিনই ঝামেলাটা বেধে যায়। কাল রাতে গুপীনাথ এন্তার খেয়েছে। আমরা তার প্রসাদ কিছু পেয়েছি। আর মুরগির হাড়গুলো প্যাক করে বাগানে ফেলেছি। রাতের অন্ধকারে হোঁৎকার কাল্লু সেগুলো তুলে নিয়ে মন্দির চাতালে বসে চিবিয়েছে আর যত্রতত্র ছড়িয়েছে। পরদিন সকালে পটলার বাবা স্নান সেরে মন্দিরে ঢুকতে গিয়েই দেখেন চারিদিকে হাড় ছড়ানো। বোধহয় মাড়িয়েও ফেলেছিলেন কিছুটা। শীতের দিন। একবার স্নান করেছেন । আবার স্নান করতে হবে। আর মন্দিরের চাতালে যত্রতত্র ছড়ানো ওই সব নিষিদ্ধ বস্তু। বাবার হাঁকডাকে দারোয়ান পুরুতঠাকুর-কাকাবাবু সকলেই ছুটে এসেছে। ওদের কাছেই শুনেছেন তিনি কাল রাতে পটলার ওই ছবি-করিয়ের দল এসব করেছে। শুনে পটলার বাবা গর্জে ওঠেন, ডাক পটলাকে! ছবি করাচ্ছি ওর!

পটলা তখন স্বপ্ন দেখছে তার ছবি চলছে টিভিতে। সারা এলাকায় তার নাম নিয়ে ফাটাফাটি। এবার সে সিনেমার হিরোই হবে। উত্তমকুমার যেন তাকে আশীর্বাদ করছেন। হঠাৎ কাকার ডাকে ঘুম ভাঙে। ধড়মড় করে ওঠে পটলা। ওদিক থেকে বাবার গর্জন ভেসে আসে, ডাক পটলাকে! হিরো হওয়াচ্ছি ওর। এইসব অনাচার আমি সইব না। গুরুদেবকে খবর দে, এ বাড়িতে আসুন ওকে দীক্ষা দেবার জন্য। কিংবা নিয়ে যান আশ্রমে। তিনমাস ব্রহ্মচর্য পালন করে শুদ্ধ হয়ে আসুক দীক্ষা নিয়ে। ডাক পটলাকে—

পটলাও ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারে না। তবে কাকুর কাছে শোনে, ওরা নাকি কাল মন্দিরে বসে মাংস খেয়েছে। পটলা বলে, না কাকাবাবু !

কাকাবাবু বলেন, ওসব জানি না। দাদা ডাকছে চল। গুরুদেবকে খবর দেবে বলেছে। এমন সময় এসে পড়েন বিপদতারিণী ঠাকমা। পটলা বলে, বাঁচাও ঠাকমা।

শেষ অবধি ঠাকমাই সেই যাত্রা রক্ষা করেন পটলাকে। ঠাকমা বলেন পটলার বাবাকে, নির্ঘাত বাইরে থেকে কুকুর-বিড়ালে এসব এখানে এনে ফেলেছে। পটলা কী করবে? খামোখাই তুই ওকে দোষ দিচ্ছিস। দারোয়ানদের বল রাতে না ঘুমিয়ে যেন কুকুর-বেড়াল তাড়ায়। শুধু শুধু ছেলেটাকে দোষ দিচ্ছিস। ঠাকমা নিজেই দারোয়ানদের শাসান–কী করিস তোরা? রাতের বেলায় যত রাস্তার কুকুর-বিড়াল এসে জোটে।

কোনোরকমে ব্যাপারটা চাপা পড়ে। ঠাকমা বলেন, তোরা ব্যবসা-বাণিজ্য করিস। মা লক্ষ্মীর দয়া আছে তোদের উপর। ছেলেটা মা সরস্বতীর পূজা করে তাতেও আপত্তি? ছবি করাও তো একটা ব্যবসা ।

কাকাবাবু বলেন, তা সত্যি! আমার পরিচিত মদনজি তো ছবির ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছে।

ঠাকমা বলেন, শোন শরৎ। পটলা ঠিক কাজই করছে। এ ব্যবসাতে নাম-যশ-টাকা সবই আছে। দেশজোড়া নাম হয়, টাকাও।

পটলার বাবা চুপ করে যান। ঠাকমা ততক্ষণে লোক লাগিয়ে মন্দির সাফসুতরো করে গঙ্গাজল দিয়ে ধুইয়েছেন। ব্যাপারটা তখনকার মত চাপা পড়ে। পটলাও ঠাকমার সাপোর্ট পেয়ে নতুন উদ্যমে নেমে পড়ে।

সেদিন সন্ধ্যায় পটলা আমাদের সব কথা বলতে আমরাও বুঝি কোনো কুকুরই এ কাজ করেছে। আসলে এসব যে কাল্লুর কাজ তা ভাবিনি। কারণ কাল্লু এখন নেড়ি কুত্তা হলেও টিভি এসটার। সিনেমার পর্দায় তাকে দেখাবে। সে এসব কাজ করতেই পারে না। তবুও আমরা আজ হাড়-গোড় সব প্যাকেটবন্দি করে বাইরের ড্রেনে ফেলে দিয়ে আসি। আজ চিত্রনাট্য পড়া হয়ে গেছে। গুপীদা বলে, কিছু ফাইট ফিট করে দেব। আর কিছু গরম গরম ডায়ালগ—ব্যস । ওই যে মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে টাইপের। পাবলিক খুব খাবে। ভাবিস না পটলা, হাজার দশেক টাকা ছাড়–দেখবি ডায়ালগের তুফান বয়ে যাবে।

পটলা বলে, প্রতি সিনে যেন কেলাপ আসে গুপীদা, টাকা তুমি পাবে। আমার কথার হবে না খেলাপ। চাই প্রতি সিনে কেলাপ ।

গুপীদা হাততালি দিয়ে বলে, শাবাশ পটলা! তোমার হবে। এর সঙ্গে দেব অ্যাকশন–তোমার হবে অ্যাকটর থেকে প্রমোশন। তোমার বিজয়রথ চলবে শনশন। তবে ওই দশ হাজার চাই ডোনেশন। হোঁৎকা, তুমিও তৈরি হও—অ্যাকশন। যা ফাইট কম্পোজ করব। হিরো আর তোমার –

ফটিক বলে, তা ভালো। আমি যা ব্যাকগ্রাউন্ড কম্পোজ করব, একেবারে ফাটাফাটি।

রিহার্সাল শুরু হল। আমরা সবাই যেন এক-একজন স্টার হয়ে গেছি। ওদিকে গুপীদা তখন পটলাকে দোহন করছে। সিরিয়াল শুরু হবার আগে তার বাজারও রেডি করছে গুপীদা। বলে সে, টিভিতে এ সিরিয়াল চালু হবার সঙ্গে সঙ্গেই শ্রাবণের বৃষ্টির মত টাকা আসবে, পটল। দু-তিনটে ছবির কাজ আমিই তোকে দিয়ে দেব। হিরোর রোল।

হোঁৎকা বলে, ভিলেনের রোলে আমার চান্স হইব না?

গুপীদা বলে, দেখছি। নাও শুরু করো। ওদিকে মুম্বাই থেকে অক্ষয়কুমার ফোন করেছিল। বলেছি দশদিন ওয়েট করো, অক্ষয়।

পটলা বলে, অক্ষয় কে?

আরে তোদের অক্ষয়কুমার। আমি গ্রিন সিগন্যাল না দিলে ও কোনো রোল নেয়ই না! আমি এসপুরুভ করব, তারপর—

আমি বলি, এসপুরুভ নয়—অ্যাপ্রুভ—

গুপীদা বলে, বড্ড ফোড়ন কাটো হে তুমি। চুপ করে বসো না। নে পটলা-হোঁৎকা ফাইটের সিন-

ফাইটের সিন করার আগেই হোঁৎকা কাল্লুকে ঘর থেকে বের করে দরজা বন্ধ করে দেয়। ওর ওই কাল্লুর একটা বিশেষ রোল আছে। হোঁৎকার হাতটা সহজেই চলে। ও এমনিতে মারকুটে ধরনের অন্যায় দেখতে পারে না। তাই কেউ অন্যায় করলে হোঁৎকা তার প্রতিবাদ করে। আর ওর প্রতিবাদ শুরু হয় হাত দিয়ে। এটা ওর অভ্যেস—ওর কাল্লু তা জানে। তাই সে প্রথম থেকে মালিককে থামাবার চেষ্টা করে। ঘেউ ঘেউ করে। মারপিট শুরু হলে কাল্লুও তার মালিকের হয়েই ফাইট শুরু করে দেয়। হোঁৎকা দেখেছে এই লড়াই-এর প্রতিপক্ষ কাল্লুর আঁচড়-কামড় খেয়েছে। তাই নিয়ে বেশ গোলমালও হয়েছে দু-একবার। তাই ওসব ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্যই হোঁৎকা তার ফাইট সিন শুরু হবার আগেই কাল্লুকে বের করে দেয়। তারপর ফাইট সিনের রিহার্সাল শুরু হয়।

ওয়ার্কশপও শেষ। পটলার বাজেটও বের হয়ে এসেছে। এবার শুটিং শুরু হবে। ওই বাগানে সেট পড়েছে। এর মধ্যে ক’দিন শুটিংও হয়। এক এলাহি ব্যাপার। পটলাদের বাগানে শুটিং হচ্ছে। চারদিক থেকে আলো জ্বেলে বাগানের এই অংশটাকে আলোকিত করা হয়েছে। এখানে হিরো গাড়ি থেকে নেমে বাগানে লুকিয়ে থাকা ভিলেনদের ধরবে। দু-দলের মধ্যে দারুণ ফাইট শুরু হবে। তাতে বোমা ফাটবে। দু-চারটে গুলিও চলবে। হিরো শেষ অবধি ভিলেনরূপী হোঁৎকাকে ধরে ফেলবে। এটাই কাহিনির ক্লাইম্যাক্স। তাই গুপীদা বলে, পটলা, গুলির লড়াই-এর পর হাতাহাতি ফাইট শুরু হবে। লড়াই থামালে চলবে না। ভিলেনকে যত নির্দয়ভাবে মারবে দর্শক তত কেলাপ দেবে। পটলাও চায় ছবি সুপারহিট করতে। তাই সেও রাজি হয়ে যায়।

এরপর মনিটর নিয়ে সব শুরু হবে। হোঁৎকাকে মার খেতে হবে। বোমা ফাটবে—গুলি চলবে। ধোঁয়ায় ধোঁয়া। তারপর পটলা আর হোঁৎকার ফাইট। পিছনে যাত্রার দলের যুদ্ধের বাজনা বাজাবে ফটিকের দল। সবটা ঠিক মনঃপূত হচ্ছে না গুপীদার। সেই-ই ডিরেক্টার। একটা নড়বড়ে ফুলফ্যান্ট পরেছে সে। লম্বা ঝুলঝাড়ুর মত চেহারা আর গায়ে একটা গোয়া প্রিন্টের শার্ট। গুপীদা ওদের দুজনের ফাইট দেখে বলে, হোপলেস! পটলা-হোঁৎকা ফাইট করতেও জানো না! ফাইটের একটা ছন্দ আছে—অংক আছে। অক্ষয়কুমারকে আমিই ফাইট শেখাই। পটলা, তুমি দ্যাখো আমি হোঁৎকাকে কীভাবে মারছি। হোঁৎকা নেহাত ছবির খাতিরে এমন অসম লড়াই লড়ছে। এবার ক্যামেরা জোনে এগিয়ে আসে গুপীনাথ স্বয়ং। শীর্ণ দেহ নিয়ে গাঁটাগোট্টা হোঁৎকার উপর চড়াও হয়। আর হোঁৎকাও ছবির খাতিরে ওর মার খাচ্ছে।

এমন সময় কাণ্ডটা ঘটে যায়। এতক্ষণ ওরা কাল্লুকে আটকে রেখেছিল। হঠাৎ সে এসে পড়ে এই জোনে। গুপীনাথ তখন বীরবিক্রমে হোঁৎকাকে মারার দৃশ্য অভিনয় করে দেখাচ্ছে। মার খাচ্ছে হোঁৎকা। হোঁৎকা সইলেও কাল্লু এই দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত নয়। তারই সামনে তার বসকে এইভাবে কেউ হেনস্থা করবে কাল্লু তা দেখতে চায় না। রাগে গরগর করছে কুকুরটা। তারপর হঠাৎ বাগানের ঘেরা লাফ দিয়ে টপকে পিছন থেকে গুপীর ঘাড়েই এসে পড়েছে। গুপীদাও অতর্কিত আক্রমণে ছিটকে পড়েছে। কাল্লু গুপীদার প্যান্টটা কামড়ে ধরেছে তার তীক্ষ্ণ ক্যানাইন দাঁত দিয়ে। একটানে গুপীদা নিজেকে মুক্ত করে প্রাণভয়ে দৌড়োচ্ছে—পিছনে ঘেউ ঘেউ করতে করতে কাল্লু। ঘটনাটা চকিতের মধ্যেই ঘটে গেছে। আমরা সকলেই হতবাক। হোঁৎকাও ভাবতে পারেনি যে কাল্লু এই কাণ্ড করবে। হৈচৈ পড়ে গেছে। গুপীদা লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। পিছনে সমানে তাড়া করেছে কাল্লু। হোঁৎকাও দৌড়োচ্ছে—কাল্লু, অ্যাই কাল্লু–

কাল্লু তখন ছুটছে গুপীনাথের পিছনে। গুপীনাথ সামনে মন্দির দেখে তার চাতালে উঠে পড়ে। কাল্লুও উঠেছে মন্দির চাতালে। গুপীদা আর্তনাদ করে শেষরক্ষার জন্য মন্দিরেই ঢুকে পড়েছে। কাল্লু মন্দিরে ঢুকতে যাবে এর মধ্যে মন্দিরের পুরোহিত-দারোয়ানরা ছুটে আসে। পটলার বাবা নিজে মন্দিরে তখন পূজায় ব্যস্ত। ঝড়ের মত ঢোকে গুপীদা। ওই ঝুলঝাড়ুর মত চেহারায় ছোড়া জামাপ্যান্ট দেখে মনে হয়, আমরা দোল খেলার পর নিজেদের জামা ছিঁড়ে সেগুলো যেমন লাইটপোস্টে ঝুলিয়ে দিই, তেমনি ল্যাম্পপোস্টে যেন কেউ ছেঁড়া জামা ঝুলিয়ে দিয়েছে। পটলার বাবা এহেন চেহারা দেখে চমকে ওঠেন। আর দেখেন মন্দিরের প্রায় ভিতরেই ঢুকে পড়েছে কুকুরটা। গুপীনাথ ভিতরে ঢুকে কুকুরটাকে দেখে বিচিত্রভাবে লাফাচ্ছে। কাল্লু তখনও গলার স্বর পঞ্চমে তুলে চিৎকার করছে—ঘেউ-ঘেউ—

পটলার বাবার ধ্যান ভেঙে গেছে। দেখছেন মন্দিরের মধ্যে এই ব্যাপার ।

ওদিকে তখন পুরোহিত চিৎকার করছে, সর্বনাশ হয়ে গেল! বিগ্রহকে অপবিত্র করেছে। এবার ঘোর অকল্যাণ হবে। বাইরে এসে ভিড় করেছে শুটিং পার্টির দল। হোঁৎকাও এসে পড়ে কোনোমতে কাল্লুকে টেনে বাইরে নিয়ে যায়। আর বিপদমুক্ত হয়ে গুপীনাথও বের হয়ে আসে। গর্জাচ্ছে সে, ইস্টুপিট কুকুর! গুলি করে ফিনিশ করব ওটাকে। উঃ আছাড় খেয়ে হাঁটুতে যা লেগেছে! শুটিং প্যাক আপ

এবার পটলার বাবাই মন্দির থেকে বের হয়ে আসেন। রাগে কাঁপছে তাঁর শরীর। ম্যানেজার সরকার আরও লোক ছুটে আসে। বলেন পটলার বাবা, প্যাক আপ তুমি করবে কি! আমিই তোমাদের শুটিং চিরকালের জন্য প্যাক আপ করে দেব। কী হচ্ছে এটা? শুটিং না বাঁদরামি! ম্যানেজার, সব ক’টাকে বের করে দাও। দূর করে দাও এই আপদগুলোকে ।

পটলা বলে, বাবা, আর একটা দিন শুটিং করলেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।

শেষ করতে হবে না। তোমার অত্যাচার আর আমি সইব না! এবার তোমার ব্যবস্থা আমিই করব!

ঠাকমাও এসে পড়েছেন। তিনি কী বলতে যাবেন, বাবা বলেন, তুমি কোনো কথা বলবে না, মা। আদর দিয়ে তুমিই ওকে বাঁদর করেছ। এবার যা করার আমিই করব! দারোয়ান, শুটিং বন্ধ। ওদের সবকটাকে তাড়াও। আভি! এরা সবকিছুকে অপবিত্র করেছে! কী সর্বনাশ যে হবে! আগে তাড়াও ওদের! পরে এর বিহিত করা হবে!

গুপীদা বেশ অপমানিত বোধ করে। সে বলে, আমি কালই মুম্বাই চলে যাচ্ছি। এখানে আর থাকছি না। আমার বাকি টাকা মিটিয়ে দাও। শুটিং যা হয়েছে তা জুড়ে নিলে তোমার ছবি হয়ে যাবে। আমার আর দরকার হবে না ।

ওদিকে টেকনিশিয়ানরাও বলে, আমাদের টাকাও মিটিয়ে দিন!

ক্যামেরাওয়ালা, আলোওয়ালা, অন্যান্য সব টেকনিশিয়ানরা নিজেদের জিনিস সব গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। যাবার সময় দেখা যায় ক্যামেরাম্যানকে। আমরা তার কাছে ক্যাসেট চাই । সে বলে তার কাছে কোনো ক্যাসেট নেই। আমরা অবাক হই। পটলা হাঁক পাড়ে—গুপীদা –

গুপীদা তার মালকড়ি নিয়ে আগেই সরে গেছে। দেখা যায় ক্যামেরাতে কোনো ক্যাসেটই নেই। এ ক’দিন এভাবেই ঘুরেছে। কোনো ছবি না তুলে শুটিং করার ভান করে সেই টাকাও হজম করেছে গুপীদা। তারপর গায়েব হয়ে গেছে। অর্থাৎ এতদিন ধরে গুপীনাথ আমাদের সঙ সাজিয়ে নাচিয়েছে মাত্র। হোঁৎকা বলে, তর ছবি হইব না। শয়তানডা টুপি দিই গেছে আমাদের। পটলা, তুই একখান ইডিয়ট।

ফটিক হাহাকার করে, এত সুন্দর মিউজিক করলাম! সব ফক্কা। এতদিনের এত পরিশ্রম, এত স্বপ্ন সব শেষ হয়ে গেল।

গোবরা বলে, ব্যাড লাক। হোঁৎকা, তোর কাল্লুই এসবের মূল। ব্যাটা তাড়া করে নিয়ে ঢুকে পড়ল মন্দিরে। কী হবে এখন?

কী হবে তা ভেবেও পাই না। ক্লাবের মাঠে হতাশ হয়ে হাত-পা ছেড়ে বসে আছি সন্ধেবেলায়। এদিকে আমাদের ছবির কেলেঙ্কারির কথা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। এইভাবে বোকা বানিয়ে যাবে আমাদের ওই সিঁটকে গুপীনাথ তা ভাবিনি।

এমন সময় পটলা কাঁপ-ছেঁড়া ভো-কাট্টা ঘুড়ির মত এসে পড়ে আমাদের মাঝে। আমি শুধোই, কী রে, গুপীনাথের কোনো খবর পেলি?

পটলা বলে, ওর খবরে আর দরকার নেই। বাড়িতে দারুণ কাণ্ড ঘটে গেছে। বাবা আজ গুরুদেবকে আসতে লিখেছেন। মন্দিরের প্রায়শ্চিত্ত হবে। তারপর আমারও ব্যবস্থা হবে। বাড়িতে আর আমাকে রাখবে না। আমাকে দীক্ষা দেবার জন্য হিমালয়ের কোনো গুহায় পাঠিয়ে দেবে। বেশ কয়েকমাস থাকতে হবে সেখানে।

আমি বলি, হিমালয়ে যাবি? দারুণ জায়গা !

পটলা বলে, বেড়াতে যায় লোকে তা সত্যি! ওই গুরুদেবের আশ্রম তো নয় পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্পের চেয়ে কঠিন ব্যাপার ওখানে! মাথার চুল কেটে ন্যাড়া হতে হবে। ভোর চারটের সময় উঠতে হবে এই শীতে। স্নান করতে হবে বরফগলা জলে। তারপর মঙ্গল আরতির পর ধ্যান করতে হবে। এ ছাড়া আশ্রমের গোয়ালে কাজ করতে হবে। গোবর-ময়লা সাফ-সুতরো করে জলখাবার স্রেফ ছোলা ভেজানো আর একটু গুড়! তারপর যেতে হবে বনে কাঠ আনতে। কুড়ুল দিয়ে কাঠ কেটে মাথায় করে আনতে হবে। আর খাবার তো হবিষ্যি। নো মটন—নো চিকেন—নো আন্ডা! ঠান্ডায় জলখাবারে-রাতে দুখানা করে পোড়া রুটি।

ওর ফর্দ শুনে আমাদের হাড়মাস হিম হয়ে যায় – বলিস কী রে!

পটলা হিরো হবার জন্য মাথায় বেশ মিঠুন মার্কা চুল রেখেছে। ও এমনিতেই শৌখিন। আর ভোজনরসিক। তার এই কাহিনি শুনে বলি, তাহলে তো সত্যি তুই প্রবলেমে পড়েছিস, পটলা !

পটলা বলে, গুরুদেব তো নয়, একটা কসাই, কী হবে আমার !

ওর যা হবার হবে, সেই সঙ্গে আমাদের ক্লাবও ডকে উঠবে। আমাদেরও ঠাটবাট, সিনেমা দেখা, খাওয়া-দাওয়া সব উঠে যাবে।

হোঁৎকা বলে, তখনই তরে কইছিলাম, ও সব টিভি সিরিয়াল-ফিরিয়ালে গিয়া কাম নাই । শুনলি না। এহন কী হইব?

পটলা বলে, দ্যাখ, যদি কিছু করতে পারিস।

হোঁৎকার মাথায় মাঝে মাঝে বিচিত্র আইডিয়া উদয় হয়। আর প্রবলেমও সলভ হয়। হোঁৎকা বলে, গুরুদেব কবে আইত্যাছে?

দু-একদিনের মধ্যেই এসে পড়বে। ও তো আমাকে নিয়ে গিয়ে ওর দলে ভেড়াবার জন্য ছটফট করছে।

হোঁৎকা বলে, ভাবতে দে।

পটলার বাবার গুরুদেব শ্রীশ্রী একশো আট ভোলানন্দ বেশ হিসাবি লোক। হৃষীকেশের গঙ্গার ওপারে ওঁর আশ্রম।

আমরা সব ক্লাবের মাঠে বসে আছি। বড় আশা করেছিলাম ছবিটা রিলিজ করলে আমরা পাড়ার কেউকেটা হয়ে যাব। ফটিক তো ভেবেছিল সে এবার নামি মিউজিক ডিরেক্টার হবে। পটলা-হোঁৎকারা তো পরের ছবির স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু সব স্বপ্ন ভণ্ডুল হয়ে গেল। পটলা বলে, ওই গুপীনাথই ডুবিয়ে দিল। ছবির শুটিং করেছে আর ক্যামেরায় ফিল্ম-ক্যাসেটই ভরেনি। অথচ কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে গেছে।

গোবরা গেছে গুপীনাথকে ধরে আনার জন্য। কিন্তু সেও ফিরে এসে সাইকেলটা মাঠে ফেলে আমাদের কাছে এসে বলে, তোর গুপীদা পুরো ফলস্ দিয়েছে রে! ওই ঠিকানায় কেউ থাকে না। কেটে পড়েছে ব্যাটা ফোর টোয়েন্টি-

গুপী উধাও। এবার নাকি পটলার সাক্ষাৎ যম সেই গুরুদেব আসছেন। পটলার বাবা চান পটলাকে দীক্ষা দিয়ে তাঁর কাঠগোলায়-কারখানায় ব্যবসার কাজে লাগাতে। তাই ওকে মাসকয়েক গুরুদেবের আশ্রমে রেখে কঠোর ব্রহ্মচর্য সাধন করতে হবে। পটলাকে হারাতে হবে আমাদের। আর পটলাও ভাবতেই পারে না কী ভাবে সে ওই গুরুদেবের জেলখানায় থাকবে!

পটলা কাতর গলায় বলে, একটা কিছু কর !

হোঁৎকা বলে, গুরুদেবকে আসতে দে। দেখি অর হালচাল। তারপর অ্যাকশন লইতে হইব ভেবেচিন্তে।

পটলা বলে, তদ্দিনে বাবা ওই মালের সঙ্গে পাঠিয়েই না দেয় আমাকে !

পটলাদের বাড়িতে বেশ হৈচৈ শুরু হয়েছে। যেন কোনো মহোৎসব। ম্যানেজার সব দিক তদারকি করছে। মন্দিরের সামনে প্যান্ডেল টাঙানো হয়েছে। বাগানের দিকে কয়েকটা ঘর এবং বসার ঘরে আসবাবপত্র আনা হয়েছে। গুরুদেব এখানেই থাকবেন। তাঁর শুভাগমন উপলক্ষে অষ্টপ্রহর নামকীর্তন চলবে। ওদিকে তৈরি হয়েছে ভোগ বিতরণ কেন্দ্র। গুরুদেব যে ক’দিন থাকবেন সে ক’দিন ওখানে অন্নসত্র চলবে। যে আসবে সেই-ই প্রসাদ পাবে। ভক্তদের সমাবেশ হবে ভালোই। ওদের পৌষমাস আর পটলার সর্বনাশ। হোঁৎকা-গোবরা আমাদের নিয়ে আসে পটলার বাবার কাছে। ঠাকমাও রয়েছেন। সামনে এখন বিরাট কাজ। পটলার দীক্ষা—বাড়িতে উৎসব। হোঁৎকা বলে, মেসোমশাই-ঠাকমা, আপনারা ভাববেন না।

পটলার দীক্ষা হইব। আমাদের ক্লাবের হক্কলেরে লইয়া এখানের সব কাম কইর‍্যা দিমু। ওসব খাওয়া-দাওয়ার ঝামেলা, গুরুদেবের সেবার কাজ সব কইর‍্যা দিমু।

অবশ্য পাড়ার পুজোর কাজ—অন্যসব কাজে আমাদের ক্লাবের ছেলেরাই এসে পড়ে। পটলার বাবা-কাকারাও জানেন যে এসব কাজে আমাদের ক্লাবের ছেলেদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। ঠাকমা তো আমাদের উপরই নির্ভর করে আছেন। ঠাকমা বলেন, তাই কর তোরা। পটলার দীক্ষা, তোদের বন্ধু। তাকে উদ্ধার তো তোরাই করবি।

পটলার বাবা বলেন, বিরাট ব্যাপার! এদিকে এত লোকের সমাগম হবে, ওদিকে গুরুদেবের সেবার কাজ! পারবি তো?

গোবরা বলে, সিওর! ও নিয়ে ভাববেন না !

ঠাকমা বলেন, পারবে রে পারবে। ওরা খুব কাজের ছেলে।

পটলা ক্লাবে আসে সন্ধ্যায়। সে আমাদের ওভাবে ওর বাবা-কাকার দলে মিশে ওই সব কাজের ভার নিতে দেখে খুশি হয়নি। পটলা বলে, তোরা বাধা দিবি তা নয়, ওদের দলে মিশে আমাকে গুরুদেবের জেলখানায় পাঠাতে চাস! এত বেইমানি করবি? আমাকে বাঁচাবি তা নয় একেবারে লাইন ক্লিয়ার করে দিবি?

হোঁৎকা বলে, তুই চইল্যা যাবি, ঠাকমা আর তর বাবাকে হাতে না রাখলে যে ক্লাব ডকে উইঠ্যা যাইব !

পটলা চটে ওঠে, আমি মরি ক্ষতি নেই, তোদের কাছে ক্লাবই হল সব! ঠিক আছে! দুনিয়াটাই সেলফিশ! স্বার্থপর রে!

গুরুদেব এসে গেছেন সদলবলে। তাঁর জন্যই হোঁৎকা এদিক-ওদিকের কলোনি থেকে তিন-চারজনকে ম্যানেজ করেছে। তারা কেউ দিনমজুরি করে, কেউ ভ্যানরিকশা চালায়। কেউ বাজারে সবজি বিক্রি করে। কেউ বা অন্য কিছু করে। তারাই এখন তিলক কেটে খোল-করতাল নিয়ে সার দিয়ে বসে আছে। নামকীর্তন করছে। ওই দলে পকেটমার বিশু ও আছে। ক’দিনের জন্য পকেটমারির কাজ ছেড়ে গেরুয়া পরে সে ভক্ত বনে গেছে।

গাড়ি থেকে নামছেন বেঁটে-গোলগাল চেহারার গুরুদেব। ন্যাড়া মাথা। পরনে সিল্কের গেরুয়া। সঙ্গে বেশ কিছু লটবহর নিয়ে ভক্তের দল। সকলেই ন্যাড়া। গুরুদেব শান্ত ঘূর্ণায়মান চোখে এ বাড়ির প্রাচুর্য-সম্পদ গাড়ির সংখ্যা দেখছেন। পটলার বাবা-ঠাকমা মা-কাকিমারা প্রণাম করেন। গুরুদেবও জানেন এদের বিচার। পটলাকে তাঁর শিষ্য বানিয়ে এদের এই বাগানের পরিবেশে আশ্রম করে জমিয়ে বসা যাবে। পটলা এদের একমাত্র বংশধর। ওটাকে শিষ্যের দলে ভেড়াতে পারলে গুরুদেব সমস্ত সম্পদ হাতে পাবেন। ওদিকে পটলা দাঁড়িয়ে আছে। ওর পরনে দামি পাঞ্জাবি-ধুতি। মাথায় বেশ হিরো মার্কা চুল। বাবা বলেন গুরুদেবকে, বাবা, এই আমার পটলা। একেই উদ্ধার করতে হবে।

গুরুদেব দেখছেন পটলাকে। আমরা তখন ওদিকে ওঁদের অভ্যর্থনার আয়োজনে ব্যস্ত । হোঁৎকা সানাই পার্টি এনেছে। তারা সানাই বাজাচ্ছে। ওদিকে চলেছে পকেটমার বিশুর নামকীর্তন। আমরা শিষ্যদের থাকার ব্যবস্থা করেছি। এবার হবে ওঁদের জলযোগ। গুরুদেব চারদিক নিরীক্ষণ করে বলেন, ওহে মনু, এ তো বেশ কঠিন কাজ হে!

পটলার বাবা বলেন, দয়া করুন বাবা। উদ্ধার করুন!

গুরুদেব বলেন, হুঁ! তুমি যখন বলছ তখন এর সংস্কার করতেই হবে। পাপী-তাপীদের উদ্ধার করাই তো আমার কাজ! জয় ভোলানাথ।

বাবা বলেন, পটলা, প্রণাম কর বাবাকে !

পটলা নিজের বাবাকে প্রণাম করতে যাবে, ওর বাবা ধমকে ওঠেন, আমাকে নয়, গুরুদেব বাবাকে প্রণাম কর ৷

পটলা প্রণাম করতে যায় গুরুদেবকে। তিনি বলেন, সাষ্টাঙ্গ প্রণাম কর। পটলা সেভাবেই শুয়ে গুরুদেবের শ্রীচরণে মাথা ঠুকে প্রণাম করে। নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছিল। কে গুরুদেবের পা ধুয়ে দিয়েছিল। সেই কাদা তার পাঞ্জাবিতে লেগে গেছে। এর মধ্যে একটা ছোট বাটিতে জল আনা হয়েছে। গুরুদেব তাঁর পায়ের বুড়ো আঙুল ডুবিয়ে দেন। বাবা বলেন, গুরুদেবের চরণামৃত পান কর।

পটলা দেখছে বাটিটা। ওই পায়ের আঙুল ডোবা জলটা খেতে হবে? মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঠাকুমা বলেন, পটলা, গুরুদেবের চরণামৃত পান কর ভাই, পবিত্র জিনিস, খা।

গুরুদেব দেখছেন পটলার অনীহা, বলেন তিনি, শ্রদ্ধাভক্তি ওর উদয় হয় নাই। ভয় নেই, ওর জ্ঞানচক্ষু আমিই উন্মোচিত করে দেব আশ্রমে নিয়ে গিয়ে।

পটলা এবার বাবার ধমকে কোনোমতে জলটা গিলে নিয়ে চলে যায়। তারপর বাগানে একটা গাছের আড়ালে গিয়ে বমি করে সেই চরণামৃত বের করছে। আমরাও গিয়ে জুটেছি। হোঁৎকা বলে, চরণামৃত প্যাটে থাকলেই জ্ঞান উদয় হইত।

পটলা গর্জে ওঠে, তাহলে তুইও খা গিয়ে ওই চরণামৃত। তোর জ্ঞান উদয় হওয়ার দরকার । তাহলে আমার একটা পথ হত। তা নয় তোরাও দলে ভিড়ে গেলি।

গোবরা বলে, মা সারদামণি বলেছেন যখন যেমন, তখন তেমন। এই ভাবেই চলতে দে। এইসব আমায় সইতে হবে, পটলা ফুঁসে ওঠে।

আমি বললাম, যে সয়, সেই রয়। সহ্য করে থাক, সব ঠিক হয়ে যাবে ।

ম্যানেজার আমাদের মধ্যে পটলাকে দেখে বলে, বাবা তোমাকে খুঁজছেন, ছোটবাবু। কোন বাবা? পটলা বলে ওঠে। এখানে তো দেখি বাবারও বাবা এসে জুটেছেন। ম্যানেজার বলেন, ওই গুরুদেব বাবা ওঁর ঘরে তোমাকে যেতে বলেছেন। আর হোঁৎকা, তুমিও চলো। বাবার চ্যালাদের জলযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।

দু’জায়গায় দুরকম রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। বাগানের মাঠে উনুন তৈরি করে সর্বজনের জন্য ঢালাও রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। আর নাটমন্দিরের চাতালে চলছে গুরুদেব আর তাঁর চ্যালাদের জন্য এলাহি ভোজনের ব্যবস্থা ।

জলযোগের পর গুরুদেবের থালায় পড়ে আছে লুচি, পরমান্ন, এটা-সেটা। গুরুদেব পটলাকে দেখে বলেন, প্রসাদ নাও, বাবা পটল। তারপর একটু পদসেবা করো। চিত্তকে গুরুমুখী-ঈশ্বরমুখী করতে হবে। তাই এখন তোমাকে সাধুসঙ্গে থাকতে হবে।

চরণামৃত খেয়ে পটলা একবার বমি করেছে, এবার আবার প্রসাদের নামে ওই এঁটো খেতে হবে! কিন্তু বাবা রয়েছেন কঠিন প্রহরায়। তিনি বলেন, পটলা, প্রসাদ নিয়ে গুরুদেব যা আদেশ করেছেন তাই করো।

গুরুদেব আসনে বসে আছেন। ওদিকে তাঁর চ্যালারা এর মধ্যেই এই ঘরে বাবা মহাদেবের একটা ছবি রেখেছে। ত্রিশূল হাতে মহাদেবের দণ্ডায়মান একটা ছবি। ধূপ-ধুনো জ্বলছে আর সেই পকেটমার বিশু, রিকশাআলা মদনারা খোল-করতাল বাজিয়ে তারস্বরে নামকীর্তন করছে। গুরুদেব দুটো পা মেলে বসে আছেন। পটলা তাঁর শ্রীচরণে শ্রীঅঙ্গে ঘি মালিশ করছে। হোঁৎকা-গোবরা তখন গুরুদেবের জলযোগপর্ব শেষ করে নিজেরা খেতে বসেছে।

পটলা দেখছে ওদের খাবার। আজ ওর একাদশী। এখন থেকে ওকে একাদশীও করতে হবে। রাতে ও পাবে শুধু গুরুদেবের প্রসাদ। রাগে গজগজ করছে পটলা।

সন্ধ্যার পর গুরুদেবের ধর্মসভা বসে। বহু ভক্ত সমাগম হয়। গুরুদেব সিল্কের লুঙ্গি পরে বিবেকানন্দের স্টাইলে পাগড়ি বেঁধে বচনামৃত দান করেন। আর প্রণামীর থালায় কত কী পড়ল তা দেখে নেন আড়চোখে। চ্যালারা যে তাঁকে ঠিকঠাক হিসাব দেয় না তা জানেন গুরুদেব। তবু বেশি যাতে না মারে তাই নিজেও নজর রাখেন।

গুরুদেব অবশ্য প্ল্যানটা অনেকদিন আগে থেকেই করেছেন। এদের বেশ কিছুটা জায়গা সমেত একটা বাড়ি ওঁকে হাতাতেই হবে। তার জন্য দানপত্রও তৈরি করে এনেছেন। সেটা কোনোমতে সই করাতে পারলেই এইসব জায়গা, একটা কারখানার তিনি দখল পাবেন। আর পটলাকে যদি হাতে আনতে পারেন বাকি সবই চলে আসবে তাঁর হাতে।

সন্ধ্যায় আমাদের ছুটি। ডিউটি শুরু হবে আবার রাত নটায়। তখন রাতের ভোজনপর্ব হবে। ক্লাবে এখন ভালোই আমদানি হচ্ছে। তবে চিন্তা পটলাকে নিয়ে। পটলা বলে, তোরা কিছু কর। না হলে এবার আমি সুইসাইড করব।

আমরা চমকে উঠলাম। হোঁৎকা এখন মহোৎসবে ভক্তদের কর্তা। ক্যাশকড়ি ভালোই আছে। গোবরাকে বলে, সাইকেল লয়ে ন্যাপার দোকানে যা। মটন বিরিয়ানি আর চিকেন মাঞ্চুরিয়ান লয়ে আয়।

পটলা বলে, সত্যি! হোঁৎকা বলে, এই দিয়া তুই এহন একাদশী কর। বাড়ি যাইয়া সাবু-টাবু অন্ধকারে ফেইলা দিবি।

পটলা বলে, আজ না হয় হল, কিন্তু গুরুদেব যদি সত্যি ন্যাড়া করে হিমালয়ে নিয়ে যায় ? আমি বলি, পটলা, গুরুদেব লোকটা কিন্তু সুবিধের নয়। ওর ঝুলিতে কী মতলব আছে কে জানে?

ফটিক বলে, ওই মহারাজ আর দুই চ্যালা সবসময় গুজগুজ করে। নিশ্চয়ই বদ মতলব আছে। পটলাকে ওদের সঙ্গে নিয়ে যেতে দেব না। কিছু একটা কর হোঁৎকা

এর মধ্যে গোবরা বেশ কয়েক প্যাকেট বিরিয়ানি আর মাঞ্চুরিয়ান নিয়ে এসেছে। পটলা তাই দিয়ে একাদশী সম্পন্ন করে। তারপর পটলা বলে, আমি চলি। তোরা আয়।

সেদিন সন্ধ্যায় গুরুদেব পটলার বাবাকে তাঁর ঘরে ডেকে বলেন, মনু, আমাদের আশ্রমের ট্রাস্টিবোর্ডে তোমাকে চাই। দেবসেবার পুণ্যকর্মে তুমিও ব্রতী হও, পটলাকে আমার শিষ্য করে নেব। চিরজয়ী হবে সে।

পটলার বাবা গুরুদেবের কথায় বলেন, তাই হবে।

এবার গুরুদেব তাঁর শিষ্যকে বলেন, তাহলে ট্রাস্টিবোর্ডের কাগজপত্র সব দেখেশুনে সই করিয়ে নাও। পটলার বাবাকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সবাই সই করেছেন, এরপর

তুমি ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্য হবে।

পটলার বাবার সামনে বেশ কিছু কাগজপত্র এগিয়ে দেন তিনি। পটলার বাবা বলেন, প্রভু, আপনার সেবক হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব, দিন সই করে দিচ্ছি।

গুরুদেব দেখছেন পটলার বাবা সব ঠিকঠাক কাগজে সই করছেন। গুরুদেব বলেন, জয় শিবশম্ভু! তাহলে কালই পটলাকে দীক্ষা দিয়ে ওকে নিয়ে চলে যাব আমার আশ্রমে। কাল মস্তক মুণ্ডন হবে পটল বাবাজির।

পটলার বাবা বলেন, তাই হবে, গুরুদেব ।

পটলা সব শুনে কেঁদে বলে, কাল আমার জন্মদিন, কাল আমি ন্যাড়া হব না।

ঠাকমা বলেন, সত্যিই তো, কাল ওর জন্মদিনে ওইসব হবে? গুরুদেব বলেন, ঠিক আছে। মঙ্গলবার অমাবস্যা। শুভদিন। ওই দিনই মস্তক মুণ্ডন, দীক্ষা হবে। আর মনু, ওইদিনই পটলাকে নিয়ে হিমালয়ে যাত্রা করব। তুমি যাবার ব্যবস্থা করে দাও।

বাবা বলেন, তাই হবে, গুরুদেব।

গুরুদেব আজ খুশি। ওঁর শিষ্যদের নিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে ধ্যানে বসেছেন। সারারাত ওঁরা নাকি তপস্যা করবেন। ফটিক-গোবরারা ওৎ পেতে ছিল। রাতে ওরা জানলা দিয়ে দেখে গুরুদেব তাঁর দুই চ্যালাকে নিয়ে গাঁজা টানছেন। গুরুদেব বলেন, নিয়ে চল ছোঁড়াটাকে, তারপর এদের ভিটেমাটি দখল করে নেব। জয় বাবা শিবশম্ভু! সব হাতে এনে দাও বাবা । এখানেই তোমার মন্দির বানাব।

আমরা জানলার বাইরে থেকে শুনে চমকে উঠি।

সকালে আমরা সবাই ক্লাবে এসেছি। পটলা বলে, আমি চলে যাচ্ছি কালই সকালে। আমরা শুধোই, কোথায় ?

পটলা আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, ওপরে।

হোঁৎকা বলে, গোবরা, ন্যাপারে গিয়া ক, মাংসের হাড়গোড় যা বাঁচবে তা যেন না ফেলে সব রেখে দেয় ৷

আমি বলি, হাড়গোড় দিয়ে কী করবি?

হোঁৎকা বলে, দেখ না আমার খেল। তগো শুধু যা যা কমু সেই মত কাজ করবি।

গুরুদেব বেশ খুশি। তাঁর সব প্ল্যান ঠিকঠিক মত কাজ করেছে। রেলের টিকিটও কাটা হয়ে গেছে। গুরুদেব জানেন, পটলার বাবাকে দিয়ে দানপত্রও সই করে নিয়েছেন। এবার সব সম্পত্তি তিনি হাতের মুঠোয় আনতে পারবেন। আজ রাতভোর গুরুদেব শিবসাধনা করবেন তাঁর চ্যালাদের নিয়ে। তাঁর প্রধান চ্যালা উৎকৃষ্ট নেপালি গাঁজাও নিয়ে এসেছে, সঙ্গে রয়েছে উৎকৃষ্ট রাবড়ি।

গুরুদেব তাঁর ঘরে হোম শুরু করেছেন। সারাঘর ধোঁয়ায় ধোঁয়া। হঠাৎ মহাদেবের ছবিটা যেন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বের হয়েছেন জটাধারী স্বয়ং ভোলানাথ। বাঘছাল পরা বিভূতি মাখা হাতে ত্রিশূল। সঙ্গে ভীষণদর্শন দুই চ্যালা। ঘর ভরে ওঠে ওঁদের হুংকারে। আমি এসেছি শীতলানন্দ। সঙ্গে নন্দী-ভিরিঙ্গিকে এনেছি। তোর প্রার্থনায় সাড়া দিতে। তোদের মত ভক্তকে এবার উদ্ধারই করব। শিবলোকে নিয়ে যাব তোদের তিনটেকে।

ত্রিশূল নাচাচ্ছেন শিব। আর তাঁর দুই চ্যালা এবার গুরুদেবের দুই চ্যালাকে পেটাচ্ছেন। ওঁরা ভয়ে কাঠ হয়ে গেছেন। স্বয়ং শিব এসেছেন, ওদের শিবলোকে নিয়ে যাবেন সেটা ওঁরা ভাবেননি। এত সম্পদ-প্রাচুর্য ফেলে ওঁদের শিবলোকে যেতে হবে? ওঁরা কাতর আর্তনাদ করে ওঠেন কিন্তু শিব নাছোড়বান্দা। এবার শিব এবং নন্দী-ভৃঙ্গী ওঁদের তিনজনের হাত-পা বেঁধে ফেলে। ওঁরা তখন নেশার ঘোরে আর্তনাদ করছেন। বাড়ির সব লোক, অন্যান্য ভক্তরাও এসে জোটে। আমরাও পটলার ঘরেই ছিলাম, এসে পড়ি। দেখি গুরুদেব মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন আর আর্তনাদ করছেন, বাবা মহাদেব নিজে এসেছিলেন। মনু, পটলকে বাবা নিজে দয়া করেছেন। জয় বাবা ।

ওদিকে ঝুলি থেকে সেই কাগজপত্র ছিটকে পড়েছে। হোঁৎকাই দানপত্রখানা পটলার বাবার হাতে তুলে দিয়ে বলে, এসব কী কাগজ, মেসোমশাই ?

দানপত্রে নিজের সই করা দেখে পটলার বাবাও চমকে ওঠেন।

—এ কী! এ যে আমাদের সর্বস্ব দান করা দলিল। এ মিথ্যে দলিল, কেউ কৌশলে আমাকে দিয়ে সই করিয়েছে।

ঠাকমা বলেন, এসব কী?

দেখা যায় খাটের নীচে বিরিয়ানি আর মটনষার অবশিষ্ট হাড়গোড়। ঠাকমা নিরাপদ দূরত্বে সরে এসে নাকচাপা দিয়ে বলেন, এসব কী অনাছিষ্টি কাণ্ড! গুরুদেব মানুষ এসব অখাদ্য খায়? ভণ্ড—ধান্দাবাজ—জোচ্চুরি করে সব দখল করতে চায়!

পটলার কাকা বলেন, ডেঞ্জারাস লোক। দাদা ওর ঝুলি তল্লাশি করো। আরও অনেক কিছু বেরোতে পারে ।

এবার দেখা যায় ঝুলির মধ্যে লাল কাপড়ে মোড়া বেশ কিছু সোনার গহনা। ঠাকমা চমকে ওঠেন, সাধুর ঝোলায় এত গহনা? নির্ঘাৎ ডাকাতির মাল। পুলিশকে ফোন কর। হাতকড়ি পরিয়ে নিয়ে যাক।

এর মধ্যে ভক্তরাও এসে গেছে, পুলিশও এসে পড়ে। ওরা গুরুদেব আর তাঁর কয়েকজন চ্যালাকে থানায় ধরে নিয়ে যায় মালপত্র সমেত। পরে জানা যায় যে ওরা এসব গহনা কোন ভক্তের সিন্দুক ভেঙে বের করেছে।

পটলাকে আমরা ক্লাবের মধ্যমণি করে মাঠে এনে বসেছি। গুরুদেবের হাত থেকে পটলাকে মুক্ত করতে পেরে আমরাও খুশি। হোঁৎকাই সেদিন স্বয়ং মহাদেব সেজে বিশু আর মদনাকে নিয়ে গুরুদেবকে ভয় দেখিয়েছে। তাই আজ পটলার মিঠুন মার্কা চুলটাও বজায় রয়েছে। তবে তার মাথা থেকে সিরিয়ালের ভূতটা আমরা নামাতে পেরেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *