পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

পটলার ভ্রমণ

পটলার ভ্রমণ

এবারও সেই পটলাকে নিয়েই শুরু হয়েছে প্রবলেম। অবশ্য আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের ইতিহাস অনেকেরই জানা, কারণ পটলাকে নিয়ে এর আগেও অনেক রকম প্রবলেম হয়েছে, সে সব তোমরাও জেনেছ, তাই পটলার পরিচয়টাও তোমাদের জানা ।

তবু দু-চার কথায় পটলা আর আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের কথা মনে করিয়ে দিই। কামধেনু জানো? মুনিঋষিদের আশ্রমে সেকালে দু-একটা গরু থাকত। দুধের যখনই দরকার পড়ত, দুধ দিত সেই গরু। শুধু দুধই নয়—যা চাইবে, তাই দেবে ওই গরু।

পটলাও পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের তেমনি কামধেনু। ক্লাব ফান্ড ‘নিল, ঝালমুড়ি, ফুচকা কি কুলপি মালাই বা চা, টোস্ট চাই, পটলা আছে। ক্লাবের ফাংশন? নো ফান্ড, পটলাকে ধরো। মাল এসে যাবে। পয়সার অভাবে ফুটবল টিম নামানো যাচ্ছে না, পটলাকে ধরো। ও ঠিক ম্যানেজ করে দেবে।

অবশ্য পটলার বাবা-কাকাদের সকলেরই চালু ব্যবসা করাতকল, কাঠগোলা, সিমেন্ট লোহার আড়ত, ঢালাই কারখানা বাজারে বড় ওষুধের দোকান, কী নেই? আর সারাবাড়ির মধ্যে পটলাই ‘ওলি সন্’—অর্থাৎ সবে ধন নীলমণি !

পটলার ঠাকুমা বাজারের অর্ধেকটার মালকিন, বেশ কয়েকটা বাড়িও রয়েছে এখানে ওখানে। আর তার আয়ও মন্দ নয় ৷

এককথায়—পটলাই আমাদের বল, ভরসা।

কিন্তু দোষ ওই একটাই। মাঝে মাঝে ওর মাথায় যেন ঘুণপোকা নড়ে ওঠে। বেশ আছে—ওই পোকা নড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় পটলার এক একটা কাণ্ড। তা নিয়ে সে নিজে তো বিপদে পড়েই, আর নাকানি-চোবানি খেতে হয় আমাদেরও ।

তবু পটলার জন্যে এসব করতেই হয়।

আমাদের দলের সবচেয়ে বেশি বুদ্ধি ধরে হোঁৎকা আর গায়ের জোর সবচেয়ে বেশি গোবর্ধনের।

হোঁৎকা এবার বলে দেয়, তর পটলার ‘কেসে’ আর নাই! বেঘোরে জানটা দিতি পারুম না। কস তো কেলাবে রেজিকনেশনই দিমু। ‘ব্লু ফক্স’ কেলাব কত কইরা কইছে ।

হোঁৎকা আমাদের ক্লাবের সেক্রেটারি। পটলা বলে, ঠি-ঠিক আছে। আর অ্যা-অ্যাডভেঞ্চার করব না। ক-কথা দিলাম।

গোবর্ধনের মামা বাজারের বিরাট কুমড়োর মহাজন। খালধারে বিশাল শেডে টাল করা নানা সাইজের কুমড়ো। ছোট-বড়-মাঝারি, পাকা-ডাঁসা সব কিসিমের কুমড়োই সেখানে ছাদ অবধি টাল দেওয়া। গোবর্ধন কানে পেনসিল গুঁজে কুমড়োর টালের হিসাব রাখে।

আর অন্যতম ফটিকচন্দ্র কালোয়াতি গানের সাধনায় মত্ত। তিনবছর আগে সে একখানা গান নিয়ে কালোয়াতি শুরু করেছিল, এখনও সেই দুটো লাইন নিয়েই পড়ে আছে।

সব ঠিকঠাকই চলছিল।

পটলা যাবে ওর মামার ওখানে বেড়াতে। ওর মামার বিরাট কাঠের গোলা, করাতকল। বিহার মধ্যপ্রদেশের সীমান্তের সারাঙ্গার গহন বন পাহাড়ে পটলার মামার কাঠ কাটাই হচ্ছে। বিশাল সেগুন-শাল-গামার-রোজউড নানা দামি কাঠ আসে ওদিক থেকে। ঐ লাইনের শেষ প্রান্তে গহন বনপাহাড়ের মধ্যে ছোট টাউনশিপে ওর মামার সুন্দর বাংলো ।

ওদিকে শুধু বনের কাঠই নয়, পাহাড়ের মধ্যে পাওয়া গেছে প্রচুর লোহা পাথর, যাকে বলে ‘আয়রন ওর’ আর ‘ম্যাঙ্গনিজ ওর’। দুর্গাপুর-ভিলাই-রাউরকেল্লা, বোকারো, বার্নপুর প্রভৃতি জায়গার লোহা কারখানায় ওইসব ‘ওর’ চালান যায় মালগাড়িতে। ফলে ওই গহন বনের মধ্যেই এখন ছোট-বড় আধুনিক কারখানা, টাউনশিপ সবই গড়ে উঠেছে।

পটলার মামাবাবু এখন ওই বনপাহাড়ে কাঠের ব্যবসা ছাড়াও আয়রন ওর’-এর বেশ বড়-সড় ঠিকাদারির কাজ করে দু’হাতে পয়সা কামাচ্ছেন।

পটলা বলে,—এবার ওই সারাঙ্গাতেই চল্ বেড়িয়ে আসি। দে-দেশভ্রমণ ক-করলে জ্ঞান ট্যান বাড়ে।

পটলার বাবা-কাকাদের ঝোঁক টাকা রোজগারের দিকে। কিন্তু পটলার ঝোঁক জ্ঞান অর্জনের দিকে। তাই দেশভ্রমণে যেতে চায় ও।

হোঁৎকা বলে, দেশভ্রমণে যাবি তো চল গিয়া দিল্লি-দেরাদুন, কাশী, নিদেনপক্ষে দার্জিলিং-টিং-তা নয় যাবি গিয়া ওই বন পর্বতে? হেই পাহাড় আর বন–কি দেখুম কি? গোবর্ধনও সায় দেয়,—তা সত্যি। আবার বনজঙ্গলে খাবারও তেমন মিলবে না । সেই কুমড়োই ভরসা।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে,–তর মামারে ক ওখানে কুমড়ো সাপ্লাই দিব। হালায় কুমড়ার নাম করল্যা তরে মার্ডার করুম গোবরা, হঃ।

প্রতি বছর ক্লাব থেকে আমরা এমন ভ্রমণে যাই, এবার প্ল্যান ছিল দার্জিলিং যাওয়া হবে। কিন্তু পটলাকে ওই নাম না জানা বন পাহাড়ের প্রোগ্রাম করতে দেখে হোঁৎকা বলে দেয়, যামু না। তগোর কেলাবে রেজিকনেশনই দিমু। ইলেভেন বুলেটস্ দার্জিলিং যাইত্যাছে। ওগোর লগেই যামু।

ফটিক বলে,—কিন্তু চাঁদা লাগবে রে একশো টাকা করে।

টাকার কথায় হোঁৎকা একটু মিইয়ে যায়। শেষ অবধি আমি বলি, খাওয়া দাওয়া জব্বরই হবে হোঁৎকা !

পটলাও সায় দেয়, মামার নিজের মিনি পোলট্রি মুরগির ডিম, দুধেরও অভাব নেই । বুনো মুরগি, হরিণের মাংসও মেলে।

এর মধ্যে ফটিক ‘ঝালমুড়ি আর পাতে ছানার মালপোর ব্যবস্থা করে এসেছে নিধিরামের দোকান থেকে।

পটলা বলে,—তাহলে হোঁৎকা ফদ-টদগুলো ক্-করে নে। বিস্কুট-কেক-ড্রাই ফ্রুট্স-স্ন্যাক্স এসব বে বে-শি করেই নিবি।

ফটিক নিচু গলায় বলে,–আর ইয়ে কিছু কালোয়াতি গানের ক্যাসেটও—হোঁৎকা মুহূর্তে খেপে ওঠে, তয় আমি নাই।

ফটিকও বলে ওঠে—কালোয়াতি গানের কি বুঝিবিরে বাঙ্গাল?

-আর বুইঝা কাম নাই। তর ব্যা ব্যা শুইনাই ঢের বুঝছি।

যাবার মুখেই এ কি অশান্তি! তাই বলি,—একটু অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে। থামবি তোরা ?

পটলা বলে,–সে-সেই ক-কথাটা বোঝা ওদের। নে লিস্টি কর-।

এর মধ্যে আমাদের তো সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। এর মধ্যে হোঁৎকার নেতৃত্বে পটলা বাদে আমরা গিয়ে হাজির হয়েছি পটলার ঠাকুমার কাছে।

আমাদের পকেট তো গড়ের মাঠ। বাড়ি থেকে দশ বিশ টাকা মিলতে পারে, বাকি সবই ম্যানেজ হবে, পটলার ঘাড়ে—না হয় মামার ঘাড়ে। কিন্তু তাই বলে পকেটে কিছু ‘মানি’ না নিয়ে তো জার্নি করা যায় না।

ঠাকুমা নাটমন্দিরে বসে মালা জপ করছে। আমরা দেবতাকে ভক্তিভরে প্রণাম করে ঠাকুমাকে প্রণাম করতে উনি বলেন, বসো-বসো! তারপর এসময় হঠাৎ!

হোঁৎকা এবার প্যাচ কষে : আসতে হল ঠাকুমা, পটলা যাইত্যাছে কোন্ বন পাহাড়ে— ঠাকুমা শুধোয়—তোমরা? তোমরা যাবে তো?

আমরা কিছু বলার আগেই হোঁৎকা বলে,—যাবার ইচ্ছা তো ছিল, কিন্তু ক্লাবের ফাংশন সামনের মাসে—টিমও গড়তি পারি নাই। চাঁদা তোলার জন্য আমাগোর থাকতি হইব। এবার যাওয়া হইব না। পটলাই যাউক গিয়া।

ঠাকুমা তার অনলি নাতিকে একা ছাড়তে নারাজ। তাই বলে,—চাঁদার জন্যে ভাবতে হবে না।

হোঁৎকা বলে—কিন্তু টিম করতি হইব, কমপক্ষে পাঁচ হাজার।

পটলার ঠাকুমা বলে সরকারকে ডেকে দে।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা ক্লাবের দরমার ঘরে এসে হাঁফ ছাড়ি। হাতে ক্যাস পাঁচ হাজার টাকার একটা বাণ্ডিল। হোঁৎকা বলে,–এর থেকে তিন হাজার ব্যাঙ্কে জমা দিই আয়। আর দু’হাজার সঙ্গে নিতি লাগব। এটি পকেটে ট্যুর হয় না, বোঝস?

এবার বুঝি, হোঁৎকা কেন আমাদের লিডার।

রাতের গাড়ির চালচলনই আলাদা, ট্রেনটা অন্ধকার ফুঁড়ে চলেছে চাকার শব্দ তুলে আর দুলছেও তেমনি। দুলতে দুলতে যেন লাইন থেকে ছিটকে পড়বে।

বাঙ্কে আমরা পাঁচজন। পরপর বাঙ্ক পাইনি। একটা ক্যুপে পেয়েছি তিনখানা, বাকি দুটো ওদিকে।

আর পাশের বাঙ্কে চলেছে বিরাট দশাসই একটা লোক, মাথাটা নতুন হাঁড়ির মত চকচকে—তেলপানা। ন্যাড়া না টাক, রাতের আবছা অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারিনি। তার সঙ্গী দুজনও বিচিত্রই। একজন বেঁটে আর বেশ মোটা কালোব্যাঙ মার্কা চেহারা, অন্যজন ঠিক তার বিপরীত। লম্বা লগার মত শীর্ণ দেহ।

ওরা ওদিকের আলো জ্বেলে তখন খাবারের আয়োজন করছে। ট্রেন ছেড়েছে রাত ন’টার পর হাওড়া থেকে। এর মধ্যে যাত্রীরা খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়েছে। কামরায় এখানে-ওখানে ডিম্ লাইট জ্বলছে।

আমরাও খাওয়া-দাওয়া সেরে এবার শোবার উপক্রম করছি, হঠাৎ আলো দুটো জ্বেলে ওই টাক মাথা বিশাল চেহারার লোকটা বলে,—খানা লাগা—চঙ্গু, মঙ্গু ! অর্থাৎ ওই কোলা ব্যাঙ আর ওই লম্বুর নাম যথাক্রমে চঙ্গু আর মঙ্গুই।

লোকটার সিট পড়েছে আমার বাঙ্কের উপরই। তখনও উপরে ওঠেনি। রাত এগারোটা বাজে—আমার বাঙ্কেই ওরা খাবার সাজিয়ে বসল। কয়েকটা নান রুটি, তন্দুরি ওদিকে ইয়া একটা হট বক্স থেকে বের হলো একগাদা চিকেন কারি, ফিশ ফ্রাই, চিলি চিকেন, মাটন চাপ ।

ওদিকে হোঁৎকা তখনও ঘুমোয়নি, সে দেখছে ওই বিচিত্র খাদ্যসম্ভার। আমাদের যা কিছু তা আজ সবই নিরামিষ, সন্দেশ কালাকান্দ। ও তাই এদিকে রকমারি ওই লোভনীয় খাদ্য দেখে হোঁৎকার চোখ চিকচিক করে ওঠে।

ওই তিনমূর্তি গিলছেও তেমনি। হঠাৎ ওই টাকওয়ালা লোকটা হোঁৎকাকে দেখে বলে, -আরে এ ছোকরা, আও, বৈঠো। থোড়া টেস্ট করো। আসলি বিরিয়ানি-চাপ-চিলি চিকেন।

হোঁৎকার পেট অভর-ওর খিদে কখনও কমে না। যদিও কমে তা ক্ষণিকের জন্য। একটু আগেই ট্রেনে উঠে দিস্তেখানেক লুচি –খান চারেক বেগুনভাজা-এতটা আলু কপির তরকারি আর ছ’টা প্রমাণ সাইজের জলভরা তালশাঁস, চারটে সলিড কালাকান্দ সেঁটেছে। এখন আবার ওদের ওই মুরগি মাটন দেখে উসখুস শুরু করে।

আমি বলি,–এই তো খেয়েছিস।

হোঁৎকা বলে ওঠে—বেশি খামু না। ওনারা কইছেন, না খাই ওগোর ইনসাল্ট করা হইব! বলতে বলতে হোঁৎকা গিয়ে বসে পড়ল আমাকে ঠেলে। আমাকে বলে,—সমী তুই গিয়া আমার বাঙ্কে শুইয়া পড়। আমি তর সিটেই রইলাম।

অর্থাৎ খেয়ে-দেয়ে এখানেই গড়ান দেবে হোঁৎকা !

ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। দেখি সব শুনশান। কামরায় সবাই ঘুমোচ্ছে। আর ট্রেন ছুটে

চলেছে রাতের অন্ধকারে।

ঘাটশিলা পার হয়ে যেতে দু-চারজন যাত্রী জেগে ওঠে। আলোও জ্বলেও ওঠে। অনেকেই টাটানগরে নামবে।

আমাদেরও ওইখানে নামতে হবে।

পটলা ওদিকে গভীর ঘুমে মগ্ন। হোঁৎকা ট্রেনে আমাদের সজাগ প্রহরী। এমনিতেই ওর ঘুম খুব পাতলা, আর এযাবৎ আমাদের ভ্রমণের ব্যাপারে সেই-ই ম্যানেজার। আজ দেখি ওর ঘুমই ভাঙেনি।

ওদিকের বার্থ তিনটে খালি। টাকমাথা আর তার দুই সহকারী, চঙ্গু, মঙ্গুর পাত্তা নাই। ওরা মাঝপথে কোনো স্টেশনে নেমে গেছে।

আমার হাঁকডাকে গোবরা, ফটিক ধড়মড় করে ওঠে।

পটলাও উঠে পড়েছে। ট্রেন টাটানগরে ঢুকছে। হোঁৎকার ঘুম ভাঙার কোনো লক্ষণই নেই।

ট্রেন প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ায়। হোঁৎকা তখনও ঢুলছে। মালপত্র নামিয়ে এবার ওকে ঠেলেঠুলে নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দু’জন কুলিকে ঠিক করি, তারা হোঁৎকাকে লাগেজের মত নামিয়ে প্লাটফর্মে শুইয়ে দেয়। এবার হোঁৎকার ঘুম পুরোপুরি ভাঙে।

চমকে উঠে বসে সে,—অ্যাঁ, টাটানগর আইসা পড়ছি। ডাকবি তো ? বলি,—ডাকবি মানে, ডেকে ডেকে বেদম হয়ে পড়েছি! যা ঘুম তোর !

হোঁৎকা মাথা নাড়ে,—কি খাওয়াইছে ব্যাটারা কে জানে, তহন হতে ঘুমই আইত্যাছে। চমকে উঠি, ওই ব্যাটা টেকো মালের কীর্তি। হোঁৎকাকে ধরাধরি করে পাশের প্লাটফর্মে গুয়া যাবার জন্যে অপেক্ষমান ট্রেনে তুলে মালপত্র তুলে নিজেরাও বসি। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনটা ছেড়ে দেয়।

শাখা লাইনের ট্রেন—স্টেশনগুলো দূরে দূরে। তখন সবে দু-চারজন যাত্রী উঠেছে ট্রেনে। তারাই বলে ওঠে,–এ তো গুয়ার ট্রেন লয় বটে, ই টেরেন যাবেক বাদাম পাহাড়।

আবার চমকে উঠি। একদিকে যেতে গিয়ে পথ ভুলে চলেছি অন্যদিকে। আর পটলা হঠাৎ বলে,—আমার সাইড ব্যাগটা পাচ্ছিনা-স্ সাইড ব্যাগ? ওর মধ্যে পটলার নিজের কিছু জামাপ্যান্ট আর দরকারি বই কাগজপত্র ছিল। সেটা নেই।

এবার হোঁৎকাও তার পকেট হাতড়ে বলে,—আমার টাকা! শ’তিনেক টাকা রাখছিলাম, টিকিটসমেত গায়েব।

রাগে গা পিত্তি জ্বলে যায়, যা মাংস খা গে—চেনা নেই জানা নেই, খাবার দেখলে হামলে পড়িস !

পটলা বলে,—ও-ওই ব্যাগে মামাবাবু একখানা জরুরি চিঠি, ম্যাপ পাঠিয়েছিল; সেটাও গেছে।

এবার জান-প্রাণ না যায়!—গোবরা মন্তব্য করে : ওদের মতলব ভালো না ।

আমারও তাই মনে হয়। ওরা কাজ সেরে নিঃশব্দে মাঝপথে কোথাও নেমে গেছে। আর হয়তো তার দলেরই একজন টাটানগরে আমাদের এই ভুল ট্রেনে তুলে অন্যদিকে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছে।

লোকগুলো কারা? তাদের পরিচয়ও জানতে পারিনি, এখন গুয়া যাই কি করে? আবার কি টাটানগরে ফিরে যেতে হবে ?

পাহাড় বনের মধ্যে দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে ওই শালবনের মধ্যে দু-একটা ছোট স্টেশন মত পড়ছে, দু-দশজন আদিবাসী যাত্রীরা ওঠানামা করছে।

ওদেরই একজনকে দেখে মনে হয় লেখাপড়া জানে। আমাদের জিজ্ঞাসার জবাবে সেই-ই বলে—সামনে একটা জংশন স্টেশন পড়বে। ওখান থেকে গুয়া স্টেশনে অনেক খালি মালগাড়ি যায় ‘আয়রন ওর’ আনতে। গার্ডকে বলে ম্যানেজ করতে পারলে ওই মালগাড়িতে সোজা গুয়া স্টেশনে যেতে পারবে বিকেল নাগাদ ।

এবার একটু আশার আলো দেখতে পাই। সদলবলে নেমে পড়ি জংশনে।

কানার মধ্যে ঝাপসা যাকে বলা হয় সেই স্টেশনটা তেমনি। তবু একটা চায়ের স্টল আছে, লোকজনের মুখ দেখা যায়। তবে চতুর্দিকে পাহাড়। তার বুক বেশ গভীর বনে ঢাকা। স্টেশনে যাত্রী চলাচল বিশেষ করে না। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে, বড় বড় মালগাড়ি ইঞ্জিনে টেনে নিয়ে চলেছে, ওইসব ওয়াগানে চলেছে লালচে মাটি মাখা এখানের বিখ্যাত আয়রন ওর। দুর্গাপুর-বার্নপুর বোকারো-ভিলাই-রাউরকেল্লার লোহা। কারখানাতে যাচ্ছে এত মাল। আর বেশ কিছু খালি মালগাড়িও গুয়া মাইনস্ বা অন্য মাইনস্-এর দিকে যাচ্ছে।

তেমনি এক মালগাড়ির গার্ডসাহেবকে খুঁজে বের করলাম।

গার্ডসাহেব-এর সঙ্গে তার এক বন্ধুও চলেছে। বেলা তখন প্রায় এগারোটা। গার্ডসাহেব ওই স্টেশনে গাড়ি থামিয়ে তখন লাঞ্চ সারতে ব্যস্ত। সেই বন্ধুও রয়েছে।

মেনু দেখে মনে হল পান্তা ভাত—সঙ্গে চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি আর পিঁয়াজ তৎসহ কাঁচালঙ্কা ।

খেতে খেতে সে আমাদের দিকে চেয়ে বলে,—গুয়া যাবে? পাঁচজন? ঠিক আছে। এই কমপার্টমেন্টেই চলো। তবে ফাইভ ইন্টু ফাইভ-টোয়েনটি ফাইভ রুপিজ দিতে হবে। শেষ অবধি রফা হল কুড়ি টাকায় ৷

আমাদেরই গরজ, তাই ওতেই রাজি হয়ে মালগাড়িতে উঠলাম। ট্রেনও ছাড়ল। ওমা! দেখি, মাঝে মাঝেই গাড়ি থামছে, আর মালগাড়িতে উঠছে দেহাতি আদিবাসীর দল, কোথায় হাট বসবে—হাটে চলেছে তারা আনাজপত্র, শালপাতার বোঝা, খেজুরপাতার চাটাইয়ের স্তূপ নিয়ে। ছাগল-মুরগির দলও রয়েছে সঙ্গে।

আমাদের করার কিছুই নেই। খিদেও পেয়েছে। সঙ্গের খাবার কখন শেষ হয়ে গেছে। পথের ধারে স্টেশন মেলে শুধুমাত্র জাম, আর বনের কেঁদপাকা। ওই খেয়েই চলেছি।

ট্রেনটা এবার পাহাড় আর বনের গভীরে ঢুকে পড়েছে। আর মালগাড়িটা যেন ওই গাওঁ মিঃ গোমসের বাপের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। এ পথে ওই ভাবেই চলেছি।

খিদেতে পেট জ্বলছে। মন মেজাজও ভালো নেই, হোঁৎকা গুম হয়ে আছে। ওর ভুলের জন্যই আমাদের এই অবস্থা।

পটলা বলে, আর দেরি নাই, এর পরের ইস্টিশনই গু-গু-1

হোঁৎকা বলে,—ওসবে কাম নাই—চুপ মাইরা বস তো! এহন তোর মামার বাড়ি যাতি না বনে?

আমি বলি,–তা সত্যি, বনভ্রমণের পারমিট আর ডরমেটরিতে থাকার চিঠিখানা অবশ্য আছে। কিন্তু বনে যাবার জিপ ভাড়ার টাকা, সেখানে ক’জনের থাকা খাওয়া, ফেরার ভাড়া এবারের মত যথেষ্ট টাকা তো নেই। সব টাকা তো ওই বদমাইস সাফ করে দিয়েছে।

হোঁৎকার মুখে এতক্ষণে হাসি ফোটে,—মাল কিছু সরাইয়া রাখছি। হোঁৎকারে এত বুদ্ধু ভাবস ক্যান?

এই বলে হোঁৎকা এবার নিজের পায়ের মোজাটা খুলে তার ভিতর থেকে বেশ কিছু টাকা বের করে।

আমাদের পকেটে এখান ওখানে কুড়িয়ে কাড়িয়ে সাড়ে তিনশো। আরও দুশোর মত বের হয়। হোঁৎকা এবার বলে,—চ, বনেই যাই গিয়া। সস্তায় বনে যাবার কোন ব্যবস্থা হইব মনে হয়। তাইলে বনে ক’দিন থাইকা বের হবার মুখে পটলার মামার লগে দেখা’ কইরা দরকার হয় কিছু ক্যাশ লইয়া কলকাতা ফিরুম।

কথাটা আমাদের মনে ধরে। পটলাই ভেবেচিন্তে বলে,—তা মন্দ বলিস নি হোঁৎকা। বনে ঢোকার আগে ম-মামার বাড়ি গেলে মামা যা লোক, তাতে আর বনে যেতেই দেবে না। তার চেয়ে আগেই ব-বনে চল।

ট্রেন ঘন বনপাহাড়ের বুক চিরে এবার এই লাইনের শেষ ইস্টিশনের দিকে ছুটে চলেছে।

ট্রেন থেকে নেমেছি, চারিদিকে গভীর বনে ঢাকা পাহাড়, বিশেষ করে তিন দিকে যাবার পথ নেই। এক দিকে বেশ খানিকটা উপত্যকা-কিছু সারবন্দি পাতা বাড়ি। ওদিকে একটা ছোট্ট ঝোরা, পাহাড় থেকে জলধারা বুকে নিয়ে আপন খুশিতে ছুটে চলেছে।

ওই ঝোরার ধারে চোখে পড়ে একটা ধাবা। স্টেশনের বাইরে এসে এবার খিদেটা চাগিয়ে ওঠে। বেলা প্রায় একটা বাজে। এখান থেকে বনের গভীরে সেই থলকোবাদ বাংলোয় যাবার চেষ্টা করতে হবে ।

ঝোরার ধারে ধাবায় এসে দোকানদারের কাছে রুটি তড়কার অর্ডার দিয়ে এবার ওই ঝোরার জলেই ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে খাটিয়ায় এসে বসলাম ।

দোকানদার কি ভেবে বলে,—রূপসিংকে দেখলাম বটে ট্রাকে মাল নিয়ে এসেছে ! দোকানের ছেলেটা বলে,—ওই তো—ঝোরার ধারে ওর ট্রাক ধোলাই হচ্ছে।

খিদের মুখে ওই পোড়া মকাই বাজরা মেশানো ফাটা ফাটা রুটি আর ঝাল ঝাল তড়কাই যেন অমৃত লাগছে। বেশ কয়েকখানা করে খেয়ে ঢঢক্ করে জল গিলে যেন দম ফিরে পেলাম। এবার মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে থাকি—কী করা যায়?

এমন সময় দশাসই একটা লোক, মুখ যেন চাষ দেওয়া জমির মত কর্কশ, পরনে ঢিলে পায়জামা আর পাঞ্জাবি, পায়ে নাগরা, ধাবায় এসে লাথি মেরে একটা খাটিয়াকে সরিয়ে দিয়ে ওপাশের খাটিয়ায় বসল। বসেই হুঙ্কার ছাড়ল, আবে লৌন্ডা, রোটি, এক প্লেস মাংস—সাথমে আন্ডা তড়কা লানা ফটাফট।

ওর পিছনে চামচিকের মত শীর্ণ একটা লোকও রয়েছে। নির্ঘাত চামচা। সেও এবার মেজাজ নিয়েই শীর্ণ গলায় হাঁক দেয়,–আবে শুনা, জলদি খানা লাগা ।

ধাবামালিক এসে বলে—ওই রূপসিং, জঙ্গলের কনট্রাকটারের ড্রাইভার। খুব কামকা আদমি। উস্‌কো বলো—ও যদি লিয়ে যায় ।

ক্যা? থলকোবাদ বাংলোমে যায়েগা? রূপসিং, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমাদের দেখল। তারপর ঠা ঠা করে হেসে ওঠে। বলে : ক্যা বনবাংলোমে নৌটঙ্গি হোগা? নাচা-গানা-বাজনা?

অর্থাৎ ও আমাদের দেশওয়ালী নাচগানের দলই ভেবেছে, জানাই,—না। এইসে ঘুমনে যায়েগা। জঙ্গলমে যানেকা পারমিট, বাংলোকা ডরমেটারিমে রহনে কা পারমিট ভি হ্যায় সাথমে।

সব শুনে এবার বলে সে, – ঠিক হ্যায়। ট্রাকমে লে যায়েগা বাংলোমে। ফি আদমিকে লিয়ে দশ রুপিয়া ।

ওই চামচিকের মত স্যাঙাতটা সঙ্গে সঙ্গে গলা মিলোয়। এক পয়সা কম হলে নেহি চলেগা, হ্যায় তো নিকালো, ফটাফট!

ট্রেনেও বেশ কিছু টাকা গার্ডকে গচ্ছা দিতে হয়েছে ভুল ট্রেনে চাপার জন্য। আবার এখানেও পঞ্চাশ টাকা! পুঁজিও কম, তারপর ফেরার খরচা আছে—সেখানে থাকা খাওয়ার খরচও কম নয়, অথচ টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে, ওই দূরের স্টেশনে ফেরার শেষ ট্রেনটা তখনও রয়েছে।

বলি—চলরে, ফিরেই যাই। পয়সার অবস্থা করুণ। ঢের হয়েছে, চল ফিরে যাই। হোঁৎকাই এবারের সর্বনাশের জন্য দায়ী—সেই-ই বলে—নারে আসছি যহন, ফিইরা যামু না। টাকা যেমন কইরা হোক জুটাইমু, কিরে গোবরা, বল!

ঠিক আছে।—রূপসিংকে বলি,—সর্দারজি, চল্লিশ টাকা নাও, কৃপা করকে।

চারখানা কড়কড়ে দশটাকার নোট দেখে সর্দারজি কি ভেবে বলে, – ঠিক হ্যায়, যাও, ট্রাকমে ওঠো। আরে এ পটকা, জলদি কর

সেই চামচিকের মত ওর হেল্পারের নাম তাহলে পটকা।

পটকা ট্রাকের ডালাটা খুলে দিতে আমরা একে একে উঠছি ট্রাকে। পটকা বলে,—হামকো পাঁচ রুপেয়া, কমিশন !

ট্রাকটা তখনও ছাড়েনি, হঠাৎ একটা জিপের শব্দে চাইলাম। লাল ধুলো উড়িয়ে চড়াই ভেঙে জিপটা ঠেলে উঠছে। হুডখোলা ।

ওই জিপের সামনের সিটে বসা লোকটাকে দেখে চমকে উঠলাম।

গত রাতে ট্রেনের সেই লোকটা, জিপের পিছনে তার দুটো সেই চ্যালাও মজুত আছে। হোঁৎকার চোখ জ্বলে ওঠে—হেই হালায় দেহি, ওইতো খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ দিইয়া কাল বিবাক লই গেছে গিয়া, হালায়,

—ওকে থামাই, বলি,—এখন বীরত্ব দেখিয়ে লাভ নেই, চুপ কর।

লোকটা রূপসিংকে কি সব বলে জিপ নিয়ে চলে গেল। রূপসিং ওকে নমস্কার জানাল। মনে হল রূপসিং ওর কর্মচারীও হতে পারে ।

চামচে পটকা বলে, – শেঠজি বহুত বড় ব্যাপারী আছে। কাঠগোলা-স মিল, ট্রাক-বহুৎ সা ধান্দা।

অর্থাৎ লোকটা যা করেছে তা প্ল্যান করেই করেছে। পটলার মামার দেওয়া এই দামি ম্যাপটাও নিয়ে গেছে বিশেষ মতলবে। বনে ঢুকে কি বিপদে পড়ব কে জানে!

কিন্তু ওসব ভাবার উপায় বা সময় কোনটাই নেই। ট্রাক চলতে শুরু করেছে বনের দিকে। বেশ কিছুটা এসে ফরেস্ট গেট। দেখা গেল, ওই রূপসিং এদের খুবই চেনা। তাই ট্রাক আসতেই গেট কিপার গেটের বাঁশটা তুলে ধরল। রূপসিং ওই গেটকিপারকে একটা কাগজে মোড়া বোতলের মত কি বস্তু দিল। লোকটাও একগাল হেসে মাথা নাড়ল।

দু’পাশে গভীর গহন বন—তার বুক চিরে মোরাম ঢালা সরু রাস্তাটা লাল সিঁথির মত চলে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। কখনও পাহাড়ের ঢালুতে নেমে যাচ্ছে, কখনও চড়াই। এরপরই আসল খেলা শুরু হয়।

ঝড়ঝড়ে ট্রাকটা নীচে নেমে একটা ঝোরায় আটকে গেছে। চাকাটা বসেছে মাটিতে। ইঞ্জিন গর্জন করে গাড়ি এগোয় ।

রূপসিং চিৎকার করে,—আরে এ পটকা–লৌন্ডা লোগকে উতারকে ট্রাক ঠেলনে বোল্ জলদি। নেহি তো চাক্কা আউর দাব যায়েগা, গাড়ি নেহি চলেগি !

অর্থাৎ এই গহন বনে হাড় কাঁপানো শীতের রাতে এখানেই পড়ে থাকতে হবে।

তাই প্রাণভয়ে আমরাও নামলাম, ঠেলছি প্রাণপণে ট্রাকটাকে, ওদিকে রূপসিংও ইঞ্জিনের সব শক্তি প্রয়োগ করে গাড়িটাকে তুলতে চাইছে। চাকাটা খানিকটা উঠেছে এবার…বোঁ বোঁ করে ঘুরছে আর তার থেকে নরম লাল লাল কাদামাটি মেশা জল ছিটিয়ে পড়ছে। হোঁৎকা আর গোবরা ছিল ওদিকে, ওদের দুজন মুহূর্তে অচেনা হয়ে গেল। নরম লাল মাটির কাদা স্প্রে করে ওদের দুজনকে যেন কেষ্টনগরের মাটির কোন কিম্ভূত মূর্তি বানিয়ে দিয়েছে। ট্রাকটা কোনমতে উঠল। আমরাও ধুলোকাদা মাখা অবস্থায় ট্রাকে উঠলাম, চালু হল ট্রাক। কিন্তু এবার শুরু হল অন্য উৎপাত। শুকনো পথে এসেও ইঞ্জিন প্রায়ই বন্ধ হয়, আর রূপসিং চেঁচায়,—আবে পটকা, ছোকরালোকো বোলো ঠেলনে হোগা। উত্তরে হোঁৎকা গর্জে ওঠে হালায় পয়সা লইছে দশ টাকা, আবার ঠেইল্যা দিতি হবে? ঠ্যালার মজুরি দাও !

রূপসিংও চেঁচায়, তব্ পড়ে, রহে জঙ্গলমে। রাতমে হাতি আয়েগা, খেল খতম! ঠেলরে ছোকরা, জাদা বাত মৎ কর।

আমরা চুপ করে যাই। ওই ড্রাইভার এখন তার নিজের জগতে এসে পৌঁছেছে। ডাঁট তো দেখাবেই। আমাদের করার কিছুই নেই ।

বনের মধ্যে এবার সমতল মত। তবে অরণ্য এখানেও গভীর।

হঠাৎ ট্রাকটা আবার থেমে গেল। পাশে ওদিক থেকে একটা জিপও এসে দাঁড়াল। রূপসিং ট্রাক থেকে নেমে গিয়ে লোকটাকে সেলাম করে।

মাঝবয়সি একটি বলিষ্ঠ লোক, পরনে দামি চামড়ার জ্যাকেট, চোখে গগল্স। রূপসিং এগিয়ে গিয়ে ওর হাতে একটা ব্রিফ কেস তুলে দিয়ে বলে, পঞ্চাশ হাজার দিয়া শেঠজি। আরও কিছু দামি লগ, আর হাতির দাঁত চেয়েছে, ভালো দামই দেবে সার্।

লোকটা মাথা নেড়ে বলে,-

ডিপোতে চলে যাও-পিছে বাতচিত হবে।

বলেই জিপটা হাঁকিয়ে চলে যায় সে।

সব দেখে শুনে হোঁৎকা বলে,—শুনলি ওদের কথা? এসব শালা একটা গ্যাঙ। পটলাও বলে, স্-সেই ট্রেনের লোকটাকে দেখছি এখানে কিসের ধ-ধান্দা রে? হোঁৎকা বলে,–শোনস নি—হালায় চোর কাঠ হাতির দাঁত, বাঘের চামড়া এসবের বিজনেস করে? চোরের দল।

বলি, এসব তো বেআইনি কাজ রে। বনের দামি গাছ চুরি করে কাটছে, হাতি মারছে, বাঘ মারছে। বনকে তো এরাই শেষ করে দেবে রে। পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।

হোঁৎকা বলে—হে ত করছেই, আর আমাগোরও পথে বসাইছে, ওগোরে ছাড়ুম না। পটলা বলে—এখন চ-চুপ কর, ম-মাথা গরম করিস না।

ট্রাকটা এসে থামল, এদিকে-ওদিকে পাহাড়ের বুকে সামনের উপত্যকায়। কিছু বসতি দেখা যায়। বোধহয় ফরেস্ট অফিস, ফরেস্টের কর্মীদের কোয়ার্টার। রাস্তার ধারে একটা ছোট পাহাড়ী নদী কুলকুল করে বয়ে চলেছে।

ওপারের উপত্যকায় আদিবাসীদের কিছু ঘর, রঙিন লাল-কালো ছাই দিয়ে রং করা—বেশ পরিষ্কার ।

আর একটা পথ সামনের পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে, পাহাড়ের মাথায় বিস্তীর্ণ সমতলে বনবাংলো ডরমেটরি।

করে ঘুরছে আর তার থেকে নরম লাল লাল কাদামাটি মেশা জল ছিটিয়ে পড়ছে। হোঁৎকা আর গোবরা ছিল ওদিকে, ওদের দুজন মুহূর্তে অচেনা হয়ে গেল। নরম লাল মাটির কাদা স্প্রে করে ওদের দুজনকে যেন কেষ্টনগরের মাটির কোন কিম্ভূত মূর্তি বানিয়ে দিয়েছে। ট্রাকটা কোনমতে উঠল। আমরাও ধুলোকাদা মাখা অবস্থায় ট্রাকে উঠলাম, চালু হল ট্রাক। কিন্তু এবার শুরু হল অন্য উৎপাত। শুকনো পথে এসেও ইঞ্জিন প্রায়ই বন্ধ হয়, আর রূপসিং চেঁচায়,—আবে পটকা, ছোকরালোকো বোলো ঠেলনে হোগা। উত্তরে হোঁৎকা গর্জে ওঠে হালায় পয়সা লইছে দশ টাকা, আবার ঠেইল্যা দিতি হবে? ঠ্যালার মজুরি দাও !

রূপসিংও চেঁচায়, তব্ পড়ে, রহে জঙ্গলমে। রাতমে হাতি আয়েগা, খেল খতম! ঠেলরে ছোকরা, জাদা বাত মৎ কর।

আমরা চুপ করে যাই। ওই ড্রাইভার এখন তার নিজের জগতে এসে পৌঁছেছে। ডাঁট তো দেখাবেই। আমাদের করার কিছুই নেই ।

বনের মধ্যে এবার সমতল মত। তবে অরণ্য এখানেও গভীর।

হঠাৎ ট্রাকটা আবার থেমে গেল। পাশে ওদিক থেকে একটা জিপও এসে দাঁড়াল। রূপসিং ট্রাক থেকে নেমে গিয়ে লোকটাকে সেলাম করে।

মাঝবয়সি একটি বলিষ্ঠ লোক, পরনে দামি চামড়ার জ্যাকেট, চোখে গগল্স। রূপসিং এগিয়ে গিয়ে ওর হাতে একটা ব্রিফ কেস তুলে দিয়ে বলে, পঞ্চাশ হাজার দিয়া শেঠজি। আরও কিছু দামি লগ, আর হাতির দাঁত চেয়েছে, ভালো দামই দেবে সার্।

লোকটা মাথা নেড়ে বলে,-

ডিপোতে চলে যাও-পিছে বাতচিত হবে।

বলেই জিপটা হাঁকিয়ে চলে যায় সে।

সব দেখে শুনে হোঁৎকা বলে,—শুনলি ওদের কথা? এসব শালা একটা গ্যাঙ। পটলাও বলে, স্-সেই ট্রেনের লোকটাকে দেখছি এখানে কিসের ধ-ধান্দা রে? হোঁৎকা বলে,–শোনস নি—হালায় চোর কাঠ হাতির দাঁত, বাঘের চামড়া এসবের বিজনেস করে? চোরের দল।

বলি, এসব তো বেআইনি কাজ রে। বনের দামি গাছ চুরি করে কাটছে, হাতি মারছে, বাঘ মারছে। বনকে তো এরাই শেষ করে দেবে রে। পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।

হোঁৎকা বলে—হে ত করছেই, আর আমাগোরও পথে বসাইছে, ওগোরে ছাড়ুম না। পটলা বলে—এখন চ-চুপ কর, ম-মাথা গরম করিস না।

ট্রাকটা এসে থামল, এদিকে-ওদিকে পাহাড়ের বুকে সামনের উপত্যকায়। কিছু বসতি দেখা যায়। বোধহয় ফরেস্ট অফিস, ফরেস্টের কর্মীদের কোয়ার্টার। রাস্তার ধারে একটা ছোট পাহাড়ী নদী কুলকুল করে বয়ে চলেছে।

ওপারের উপত্যকায় আদিবাসীদের কিছু ঘর, রঙিন লাল-কালো ছাই দিয়ে রং করা—বেশ পরিষ্কার ।

আর একটা পথ সামনের পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে, পাহাড়ের মাথায় বিস্তীর্ণ সমতলে বনবাংলো ডরমেটরি।

রূপসিং-এর চ্যালা পটকা বলে ওঠে,–উতরো। থলকোবাদ বাংলো আগিয়া, ওহি পাহাড়কা উপর মে ।

অর্থাৎ যাত্রা শেষ। আমরাও নেমে পড়লাম ঝুপঝাপ্ করে, তখন বৈকাল হয় হয়।

সামনের নদীর জলধারা দেখে হোঁৎকা বলে, –তরা যা গিয়া, ডরমেটরিতে সিট রেডি কর । আমরা স্নান কইর‍্যা যাইত্যাছি উপরে। আমরা তিনজনে ওই পাহাড়ী চড়াই ভেঙে উপরের দিকে চলেছি, বেশ চড়াই, উঠতে বুকে টান ধরে। উপরে দেখা যায় বাংলোর কিছুটা।

গৌরব দত্ত ভেবেছিলেন, মিলিটারির জাঁদরেল অফিসার হবেন। মনে মনে তিনি স্বপ্ন দেখতেন, লড়াই-এ যাবেন। কামান বন্দুক চালাবেন, ইয়া গোঁফ আর দশাসই চেহারায় খাকি প্যান্ট আর শার্ট পরে পাড়ার মাঠে ছেলেদের ড্রিল করাতেন, হেঁড়ে গলায় চিৎকার করতেন ট্যান্ সেন—

জীবনে এর বেশি আর কিছু হয়নি গৌরব দত্তের। কারণ নিদারুণ ভূতের ভয়! দিনের বেলাতেই সেবার নাকি ভূত দেখে ভিরমি খেয়েছিলেন। মিলিটারি ভূতগুলো নাকি বেজায় শয়তান।

তাই মিলিটারিতে কিছুদিনের জন্য ভর্তি হয়ে ওই কঠিন জীবনের পরিশ্রম দেখে আয়েশি দত্তকুলতিলক মিলিটারি ছেড়ে পালিয়ে আসেন ।

কিন্তু তার হাঁকডাক তবু যায় না, বরং বেড়ে ওঠে। এখনও গৌরব দত্ত খাকি প্যান্ট বুশশার্ট পরেন। আর মিলিটারির স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে রেখেছেন ইয়া টাঙির মত একজোড়া পুরুষ্টু গোঁফ। এককালে কলকাতায় নিজস্ব বাড়ি ব্যবসাপত্র ছিল দত্ত পরিবারের। কিন্তু সে দুই পুরুষ আগে।

এখন কিনারাম, ভোগারাম থেকে বেচারামের দিনে এসে পড়েছে ওই দত্ত কুলতিলক। বিষয়-আশয় বাড়ির অংশ এখন বিক্রি করে দিয়ে বেলেঘাটার দিকে একটা ভাড়াবাড়িতে স্ত্রী মালতীদেবী আর তাদের দুই মেয়ে বর্ণা আর পর্ণাকে নিয়ে থাকেন। রোজগারপাতিও নেই গৌরব দত্তের, টুকটাক দালালি করে যা পায় তাতে সংসার, মেয়েদের লেখাপড়ার খরচাও জোটে না ।

বেলেঘাটার দিকে গৌরব দত্তের পৈতৃক প্রায় বিঘে খানেক জায়গা আছে। অতীতে এখানে ছিল জলা বাঁশ ঘেঁটু বন।

হঠাৎ একদিন কলকাতার ওই দিকটাও বাড়তে শুরু করল! বস্তি-জলা বুজিয়ে বিশাল বিশাল বাড়ি, চওড়া রাস্তা তৈরি হল। আর তারপরই ওই পূর্বপ্রান্তের বিস্তীর্ণ জলা বুজিয়ে শুরু হল সল্টলেক সিটি। ব্যস তারপর থেকেই ওইসব জায়গা হয়ে উঠল সোনার খনি। তিন-চার লাখ টাকা কাঠা।

গৌরব দত্তের ওই একবিঘের বাঁশবনের দাম উঠে গেল সত্তর লাখ টাকা।

আর চিটেগুড়ের আশপাশে যেমন মাছি জুটে যায়, তেমনি গৌরব দত্তের ওই সোনার খনির লোভেও তার আশপাশেও এসে জুটলো বেশ কিছু ছোট বড় মেজো ধরনের প্রমোটার

কেউ এর মধ্যে দত্তসাহেবকে মেজর দত্তই বানিয়েছে, কেউ আনে নানারকম ভেট, দাদা বৌদিদের সেবার জন্য ব্যস্ত।

এদের মধ্যে গৌরব দত্ত আর মালতী দুজনে কুনাল চৌধুরীকেই বেশি বিশ্বাস করে ফেলে। কুনাল চৌধুরী এর আগে দুটো বড় বাড়ি বানিয়ে বেশ ভালো লাভ রেখেই বিক্রি করেছে।

কুনালের এই ফ্ল্যাট বিক্রি করা ছাড়াও নানান ব্যবসা আছে। নিজের একটা অ্যামবাসাডার ছাড়াও সাইটে ঘোরার জন্য বেশ শক্ত পোক্ত জোঙ্গা জিপও আছে। তাছাড়া আছে কাঠের ব্যবসাও।

কুনালই বলে গৌরব দত্তকে,–মেজর সাহেব, আপনি হবেন আপনার জমিতে বাড়ি তৈরির প্রজেক্টের হাফ পার্টনার। জায়গা আপনার, বাড়ি তৈরির খরচ আমার। আপনার একটা ফ্ল্যাট থাকবে ওখানে আর লাভের আধা বখরা। আপনাকে ঠকাতে চাই না।

মালতীও খুশি হয়। বলে সে স্বামীকে,—এ তো ভালো কথা, তুমি রাজি হয়ে যাও।

গৌরব দত্তও তা জানে। কারণ তার সংসার চলে এখন কুনালের টাকাতেই। না চাইতেই কুনাল ওদের টাকা দেয়, তাদের দেখভাল করে। দত্তসাহেবের জন্য বিলেতি পাইপ, সেৱা তামাক আনে।

মালতী দত্ত প্রতিবারই মাসখানেকের জন্য কলকাতার বাইরে কোথাও বেড়াতে যায়। দত্ত পরিবারের এই বাৎসরিক ভ্রমণের ব্যাপারেও খরচ আছে। অথচ দত্তের তেমন কোনো ধরাবাঁধা রোজগার নেই ।

এবার সমস্যার সমাধান করতে এগিয়ে আসে ওই কুনাল চৌধুরী। সেই-ই বলে,—এবার চলুন সারাঙ্গার জঙ্গলে। দারুণ বন পাহাড় আর বাংলোও সুন্দর। বেশ নিরিবিলিতে কিছুদিন কাটিয়ে আসবে সবাই মিলে। হিল্লি দিল্লি তো অনেক দেখলেন, এবার প্রকৃতির রাজ্যকেই দেখুন।

মালতীও বলে,—তাই চলো, এবার বনেই যাই ।

গৌরব দত্ত বলে,—বনবাসে রান্নাবান্না খাওয়া-দাওয়ার কী হবে? কিছুই তো মেলে না সেখানে। কুনাল বলে,–সেখানের বাংলোর চৌকিদারই রান্নাবান্না করে দেবে। গাড়ি থাকবে। সপ্তাহে দু’দিন বাইরের শহরে এসে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যাব। ওখানে আমার অনেক চেনাজানা। কোনও অসুবিধা হবে না।

গাড়িতে প্রায় সাড়ে চারশো কিলোমিটার পথ, সকালে কলকাতা থেকে বের হয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সন্ধ্যা আটটা নাগাদ ওরা এসে বনের বাইরের শেষ শহর বড়বিলেই রইল একটা হোটেলে।

গৌরব দত্ত বলে,—তবে বনে রাতের বেলাতেই ঘুরতে হয়। না হলে বনকে চেনা যায় না। মালতী বলে,–রাত বিরেতে বাঘ সিংহের সামনে যাবে ?

গৌরব দত্ত তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে,—দূর! সেবার বুঝলে কুনাল, আফ্রিকার নাইরোবির জঙ্গলের গভীর রাতে জিপ নিয়ে ঘুরছি। ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেল। দেখি তিন দিকে তিনটে লায়ন ওৎ পেতে বসে আছে। মুখোমুখি দু’ঘণ্টা বসে কাটিয়েছি। সকাল হতে ওরা ঘুমোতে চলে গেল—আমিও জিপ ঠিক করে বের হয়ে এলাম। তাই বলছি, আফ্রিকার জঙ্গলে হেসে খেলে বেড়িয়েছি, তোমাদের সারাঙ্গা !

কিন্তু পরদিনই সারাঙ্গার আসল রূপ দেখে ঘাবড়ে যায় গৌরব দত্ত। সকালেই ওরা শহরে হাট-বাজার সেরে জিনিসপত্র গাড়িতে তুলে ব্রেকফাস্ট সেরে বের হয়ে সারাঙ্গার দিকে।

বিশাল পাহাড়গুলোর গা গভীর শাল সেগুন পিয়াশাল গামার নানা গাছে ঢাকা। পথটা ওই গভীর বনের বুক চিরে চলেছে। নীচে দিনের আলো ঠিকমত ঢোকে না। আবছা অন্ধকার আর ভিজে ভিজে। গাছগুলোয় শেওলা জমেছে।

গাছের বাকলগুলো কারা যেন কিছুটা টেনে ছিঁড়ছে। ড্রাইভার বলে, বুনো হাতিতে ওই বাকলগুলো খায় ৷

অর্থাৎ এই বনে হাতিদের আস্তানাও আছে। গৌরব দত্ত বিপন্ন চোখে এদিক ওদিকে তাকায় !

জিপটা চলেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। উপরের দিকে জঙ্গল কিছুটা কম। গৌরব দত্তর ভয় তবু যায় না। কেন যে মরতে শহর থেকে দূরে এই গভীর জঙ্গলে এসেছে, যত বাজে শখ। মালতী তখন খুব হৈ চৈ করছিল এখন এই গভীর জঙ্গলে ঢুকে তারও কথা বন্ধ হয়ে গেছে বরং তাদের মেয়ে পর্ণা আর বর্ণা খুশি হয়েছে।

দত্তসাহেব ধমকে ওঠে—চুপ কর। জঙ্গলে গান গাইতে নেই, জন্তু জানোয়ার এসে পড়বে। কুনাল বলে না-না। গাক্‌ না! কোন ভয় নেই। গাড়িকে কোনো জন্তুই অ্যাটাক করবে না। তবু বনের মধ্যে এখানে কিছু ফাঁকা জায়গা বাড়িঘর আছে। বনবিভাগের রেঞ্জারের অফিস স্টাফ, গার্ডদের বাসা। ওদিকে বেশ কিছু আদিবাসীদের ঘরবাড়ি ক্ষেতও রয়েছে।

আর ওপাশে টিলার উপর সুন্দর বাংলোটা দেখে ভালোই লাগে এবার মালতীর। পাহাড়টার মাথা উড়িয়ে সমতল করে সেখানে টেরাস গার্ডেন করা হয়েছে। ওদিকে ফরেস্ট বাংলোর আর একটা নতুন সংযোজন। ওখানেই রয়েছে ডরমেটরি আর কিছু ঘর।

ওই ফরেস্ট বাংলোর তিনটে ঘরে এসে উঠেছে গৌরব দত্ত আর কুনাল চৌধুরী। এবার চৌকিদার বলে,—বাড়িতে জরুর বিমার। হামি দশদিন ছুট্টি নিয়ে যাচ্ছে। অবাক হয় কুনাল,—তাহলে বাংলোয় রান্নাবান্না কাজকর্মের কী হবে? চৌকিদার বলে—আমি একজন লোক দিয়ে যাচ্ছি।

মালতী বলে,–সে পারবে তো?

চৌকিদার বলে,—একটু সমঝে দেবেন।

চৌকিদার তো গেল! রেখে গেল ওই লোকটিকে। বাংলোর পিছনে একটা চালা মত, একটা মহুয়াগাছের নীচে সেই চালাটাই রান্নাঘর, ওপাশে বাংলোর মাথায় একটা ট্যাঙ্কি বসানো। হ্যান্ডপাম্প আছে, ওতে পাম্প করে নীচের ওই ঝোরা থেকে জল তুলতে হয়।

নতুন লোকটা একেবারে কিছুই জানে না। খাস বুনো। ভাত যা রেঁধেছে, তাকে পিণ্ডি ই বলা যায়, আর রুটি! ওদের ময়দার তালকে একটু হাতে গোল করে আগুন ঝলসেছে, ভিতরে কাঁচাই রয়েছে। আর সবজি রেঁধেছে তাতে ভয়ানক ঝাল!

গৌরব মুখে দিয়ে গর্জে ওঠে,—একেবারে অখাদ্য !

লোকটা বলে মিনমিনে গলায়,—হম ই কম না করব!

ব্যস, অকূল পাথারে পড়ল মালতী। বলে সে, – কাজের লোক নেই, জল ওই নীচের ঝোরায়, এখন রান্না খাওয়ার কী হবে? কী করতে এই পোড়া বনবাসে এলাম গো!

কুনালও বের হয়ে গেছে। বিপদে পড়েছে এবার গৌরব দত্ত। বলে সে স্ত্রীকে – আহা, এত ভেঙে পড়লে চলবে না। দেখি কোনো লোকজন পাই কি না।

গোবর্ধন আর হোঁৎকা গা হাত পা ধুতে ঝোরার জলে নেমেছে। দুজনে স্নান সেরে লুঙ্গি বদলে পাথরে বসে জিনিসগুলো কেচে নিচ্ছে হঠাৎ কার ডাকে পিছন ফিরল হোঁৎকা, গোবরা।

গৌরব দত্ত। বলে সে,—কাজ করবে? অবশ্য খাওয়া থাকা ছাড়া মাইনেও দেব।

এ যেন মেঘ না চাইতে জল। গোবরা জানে ফান্ডের অবস্থা। এখন কিছু টাকার দরকার। তাই গোবরা শুধোয়, –কি কাজ স্যার ? কোথায় ?

দত্তসাহেব এগিয়ে আসে। বলে,—না কাজ তেমন কিছু নয়, ওই বাংলোয় আমরা দিন দশেক থাকব, একজন রান্নাবান্নার কাজ করবে, অন্যজন বাংলোর কাজ, ফাই ফরমাস খাটবে। থাকা খাওয়া ফ্রি আর দিনে তিরিশ টাকা করে পার হেড, দুজনে ষাট টাকা ।

হোঁৎকা কি বলতে যাবে, গোবরা তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,—এসব কাজ আমাদের করা স্যার, ওর নাম উদয় চাঁদ, জামশেদপুরে হোটেলে রান্নার কাজ করে। আর আমিও সেখানেই থাকি। রুম সার্ভিসের লোক। বেড়াতে এসেছি।

দত্তসাহেব খুশি হয়—গুড। ভেরি গুড। তাহলে কাজে লেগে যাও ।

হোঁৎকা আবার কি বলতে চায়, গোবরা তাকে থামিয়ে দেয়,—কিন্তু টাকাটা ভেরি ‘এসমল’ স্যার—ওটা পার হেড অন্তত ফর্টি করুন। নইলে—দত্ত সাহেব এমন সুযোগ ছাড়ে। তাড়াতাড়ি বলে, ঠিক আছে! তাই হবে। চলো।

ওদের নিয়ে দত্তসাহেব দিগ্বিজয়ী বীরের মত বাংলোয় উঠে এল। বাংলোর বাগানে মালতী মেয়েদের নিয়ে মুখ কালো করে বসে আছে। জল নেই রাতের খাওয়াও বোধহয় হবে না । কালই ফিরে যেতে হবে তাদের এই সুন্দর জগৎ থেকে।

এমন সময় দত্তসাহেব ঢোকে, এই উদয় আর এই বোধন-তোমার নতুন কাজের লোক, এদের কিচেন আর ওপাশের আউট-হাউস দেখিয়ে দাও, ওরা দুজনে ওখানে থাকবে ।

উদয় দারুণ রান্না করে, হোটেলের কুক। আর বুধো, তুমি মালপত্র রেখে ওই হ্যান্ডপাম্প চালু করো। ট্যাঙ্কে জল তুলতে হবে।

একটা চালাঘরই বলা যায়, দুটো নড়বড়ে তক্তপোষ পাতা। এই ওদের থাকার জায়গা । হোঁৎকা ঘরে ঢুকে ধপ্ করে বসে চেঁচিয়ে ওঠে,–এডা কি হইল? আমি উদো—হোটেলের কুক আর তুই বুধো-বেয়ারা? এহন?

হাসে গোবর্ধন—দিনে থাকা খাওয়া ফ্রি আর দুজনের আশি টাকা আমদানি। ছ-দিনে যাবার ভাড়া সব উঠে যাবে। ওদিকে ফান্ড তো ‘নিল’। এই টাকাটার খুব দরকার। উদো বুধো সেজে কদিন নাটক করে যা। আর রান্না ভাত ডাল রুটি সবজি এসব হয়ে যাবে। যা চা বানা-দেখলাম পাঁউরুটি মাখন ডিম সবই আছে মায় কলাও। খিদে লেগেছে চা দে সাহেবদের। আমাদেরও সাঁটানো হবে। তুই কিচেনে যা, আমি ট্যাঙ্কিতে জল তুলে দিচ্ছি।

গোবরার স্বাস্থ্যটা আমাদের মধ্যে সরেস। সে গিয়ে হ্যান্ড পাম্প চালাতে শুরু করে এবার । বাংলোয় খুশির সাড়া ওঠে। বর্ণা বলে,—মা, টাঙ্কিতে জল এসে গেছে ।

গুম হয়ে বসেছিল মালতী। তখনও চা মেলেনি। বিকেল হয়ে গেছে। হঠাৎ কার ডাক শুনে তাকাল।

মেমসাব চা—!

একেবারে ট্রেতে করে চা বিস্কুট এনে হাজির করেছে উদো,—নতুন কুক। দত্তসাহেব খুশিতে ফেটে পড়ে,–দ্যাখো, কেমন কাজের ছেলে দেখো! গুড-ভেরি গুড।

আমরা ওপাশের বিল্ডিং-এর একতলায় ডরমেটরিতে ঠাঁই পেয়েছি তিনজন তিনটে বেডে। ওদিকে পাহাড়ের নীচে একটা ক্যান্টিন আছে। ফরেস্ট কলোনির কিছু স্টল যারা এই বনবাসে ফ্যামিলি আনেনি, তারা খায় টায়, বিকেলে চা আর পোড়া বিস্কুটই মিলেছে এখানে। এখনই রাতের খাবারের কথা বলতে হবে অথচ হোঁৎকা আর গোবর্ধনের দেখা নেই।

পটলা শুধোয়,—দু-দুটোতে গে-গেল কোথায় বলত? শে-শেষে বাঘের পেটেই যায়নি তো?

এইসময় ওদিক থেকে হোঁৎকা আর গোবরা এসে পড়ে। গোবর্ধন কিছু বলার আগে হোঁৎকা বেশ ডাঁটসে একখানা একশো টাকার নম্বরী নোট পটলাকে দিয়ে বলে,—জ-জমা কইরা রাখ। ফিউচারে আরও দিমু।

অবাক হই,—টাকা কোথায় পেলি এখানে ?

—আরও পামু, ডেলি।

হোঁৎকার কথায় অবাক হই। গোবরাই বলে, বিজনেস ব্রেনটা কামে লাগালাম রে। ও এখন উদো-বাংলোর কুক, আর আমি বুধো, বেয়ারা। দুজনে জামশেদপুরের হোটেলের ছুটিতে বেড়াতে এসেছি। থাকা-খাওয়া ফ্রি। ডেলি মাইনে চল্লিশ ইনটু টু অর্থাৎ আশি টাকা। বলি,–এ কাজ কখনও করিসনি। পারবি ?

হোঁৎকা বলে,—পারুম, গিন্নীমা দিদিমণিরা ভালোই, ওই ধাড়িটা বেড়ালের ল্যাজের মত গোঁফ লইয়া হুমহাম করে। হাঁ, তোরা আমাগো চিনস না, আমরাও চিনি না। বুঝলি? ঘাড় নাড়ি। তারপর বলি,—এ কেমন বেড়ানো রে? কোন কিছু করার নেই, ঘোরার নেই, নো অ্যাডভেঞ্চার ?

হোঁৎকা বলে—দেখা যাক ।

আর এখানেও যে করার কিছু আছে সেটা হোঁৎকা, গোবর্ধন সন্ধ্যার পরই বুঝতে পারে। সন্ধ্যা নেমেছে বন পাহাড়ে। চারিদিক অতল অন্ধকারে ডুবে গেছে। এর মধ্যে হোঁৎকা কিচেনে কাঠ জ্বেলে রুটি ডাল সবজি করেছে।

মালতীও এসে হাত লাগায়। গোবরা ওদিকে বাংলোর ঘর ঝাঁট দিয়ে হ্যারিকেনের পলতে ঠিক করে বাতি জ্বেলেছে।

এইসময় বাংলোর বাইরে একটা জিপ এসে থামল, তার থেকে নামছে বলিষ্ঠ একটি মূর্তি। পরনে প্যান্ট, ঊর্ধ্বাঙ্গে চামড়ার জার্কিন, মাথায় টুপি।

গৌরব দত্তের প্রমোটার কুনাল।

সকালেই লাঞ্চ করে কুনাল বের হয়েছিল। কাজকর্ম সেরে এখানে ওখানে ঘুরে আদিবাসী বসতিতে গিয়ে মালের ব্যবস্থা করে এসেছে।

আসলে কুনাল তাদের দিয়ে চোরাশিকার করায়। হাতির দাঁতের দাম এখন দশ হাজার টাকা অবধি এক কেজির। একটা হাতির দুটো দাঁত-এর ওজন অন্তত কেজি আষ্টেক হবেই।

একজোড়া দাঁতের দাম অন্তত সত্তর হাজার টাকা। আর বাঘের চামড়ার দাম তো লাখ-এর উপর। তা বাদে হরিণের, চিতার চামড়া, ময়াল সাপের চামড়ার দামও কম নয়। এছাড়া দামি কাঠ পাচার তো করেই, গোপনে দামি গাছ কেটে রাতারাতি পাচারও করে।

মেজর দত্ত বলে,—আর বলো না কুনাল, তোমার চৌকিদারের লোক তো কিছুই জানে না। রান্না অখাদ্য, পাম্পে জল নেই–ভেগেছে।

সেকি! তাহলে উপায়? চমকে ওঠে কুনাল স্নান করতে হবে যে !

হাসে দত্তসাহেব। বলে,—উপায় করেছি হে। যিনি খান চিনি, তারে জোগান চিন্তামণি, তোমার কুক, বেয়ারা সবই পেয়েছি। ট্যাঙ্কিতে জলও রেডি। তবে ডেইলি দুজনকে আশি টাকা দিতে হবে।

কুনাল খুশি হয়,–নো ম্যাটার। দেবেন।

শিস দিতে দিতে সে তার ঘরের দিকে চলে যায়। মালতী এবার হাঁক পাড়ে,—উধো ! ছোটা সাহেবের জন্য ওমলেট আর চা আন। বুধো,—সাহেবের ঘর সাফ হয়েছে?

বুধো অর্থাৎ গোবরা প্রথমে খেয়ালই করেনি কে বুধো। তাই সাড়াও দেয়নি। এবার গিন্নীমার ডাকে চমক ভাঙে গোবরার, – দেখছি মেমসাহেব।

হোঁৎকা সাহেবের জন্য চা-বিস্কুট আর ওমলেট নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে দেখে, কুনাল তখন গোবরাকে নিয়ে পড়েছে।

রোজ মাইনে নিবি, আর কাজে ফাঁকি? গোবরা বলে,–আপনি ছিলেন না তাই সাফ করি নি।

-আবার জবাব। রাস্কেল ইডিয়ট!

হোঁৎকা চা ওমলেট নিয়ে ঢুকে ওই লোকটাকে দেখেই চিনে ফেলেছে। এই লোকটাই সেই চোরা শিকারিদের লিডার, বনের শত্রু। টাকার গরমে এর মেজাজও এখন সপ্তমে চড়ে আছে।

হোঁৎকা বলে,— গালি দ্যান কেন স্যার? কি করতি হবে কন, বুধো কইরা দিচ্ছে। চা ন্যান । কুনাল ভ্রূ কুঁচকে তাকালো, দ্যাখো, আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না, গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।

কিচেনে হোঁৎকা রান্না করছে, গোবরা এসে বলে, এ চাকরি ছেড়ে দেব।

হাসে হোঁৎকা—না। ওই লোকটার ঘর সাফ করার সময় খোঁজ কর মাল চালানের কাগজ, নোট বই। কোথায় কী করে, সব খবর নে। ওর মেজাজের বারোটা বাজাইমু।

কুনালকে খেতে হবে। আজ রাতেও মাল যাবে, কিছু হাতির দাঁতও পেয়েছে, কাঠের নীচে পাতা ডালের ভিতর কৌশলে ওই দুটোকে সবুজ রং করে ডাল সাজিয়ে পাচার করে। শেঠজির আড়তে মাল পৌঁছলে তার দায়িত্ব শেষ।

রাতের বেলায় জিপে চলেছে কুনাল। ও জানে না ওর পিছনে জিপের সিটের নীচে গুঁড়ি মেরে মালপত্রের আড়ালে চলেছে হোঁৎকা। একটা কালো কম্বল চাপা দিয়ে।

কুনাল চলেছে বনের মধ্যে একটা বস্তিতে।

সর্দার মত একজন বের হয়ে আসে বস্তি থেকে। ওদের কথায় বস্তির নামও জানা যায়—তিরুল পোষি।

অবাক হয়ে হোঁৎকা দেখে, দুটো হাতির দাঁত আর চ্যাটাই-এ মোড়া কিছু হরিণের চামড়া দেয় সে। টাকাও দেয় তাকে কুনাল।

তারপর ওরা আসে বনের মধ্যে যেখানে ওদের কাঠ কাটাই হচ্ছে কাঠুরিয়াদের অস্থায়ী বস্তিতে।

জিপের ভিতর থেকে সব দেখছে হোঁৎকা। পচা চামড়ার বিশ্রী গন্ধে এতক্ষণ তার দমবন্ধ হয়ে আসছিল, সেগুলো নিয়ে গেছে।

হোঁৎকা দেখে একজন গালকাটা লোককে, পরনে খাকি পোশাক। ফরেস্ট গার্ড। কুনাল চৌধুরী তাকে কিছু টাকা দিচ্ছে। লোকটা যেন ঘেয়ো কুকুরের মত লেজ নাড়ছে ওর সামনে। বলে সে,—ভাববেন না সাব। ট্রাক কেউ আটকাবে না। সব চেকপোস্টে বলা আছে। শচীন মহান্তিকে সবাই চেনে ৷

ওরা ফিরছে এবার বাংলোয়। জিপ থেকে নেমে কুনাল খুশি মনে বাংলোয় তার ঘরে গিয়ে ঢুকলো শিস দিতে দিতে। এখনও গভীর রাত্রি। হোঁৎকা সাবধানে নেমে তার ওই চালাঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঢুকল। গোবরা তখন নিশ্চিন্তে নাক ডাকাচ্ছে, হোঁৎকার এই অ্যাডভেঞ্চারের খবরও জানে না।

বাংলায় বেয়ারা আর কুক হওয়ার যে এত ঝকমারি তা হোঁৎকা, গোবরার মগজে আসেনি। তখন এমন চাকরি পাকা ফলের মত সামনে আসতে খপ্ করে ধরে নিয়েছিল। এরপর হাড়ে হাড়ে বুঝেছে ওই কুনাল চৌধুরীর মত একটা অমানুষের কাছে চাকরি করার জ্বালা কী!

হোঁৎকার রাতে ওইসব করতে গিয়ে ভালো ঘুম হয়নি, ভোরের দিকে ঘুম এসেছে, এমন সময় গৌরব দত্তের হাঁক-ডাকে ঘুম ভেঙে যায় ।

গৌরব দত্তের ভোরে ওঠা অভ্যাস, তখনই বেড-টি চাই। বেড-টি না হলে তার প্রাতঃকৃত্যাদি হবে না, এরপরে হাফপ্যান্ট আর কেড্স পরে মর্নিং ওয়াকে বের হবে।

তাই ভোরেই হাঁক পাড়ে,–এই উদো—ওঠো, উঠে পড়ো, বেড-টি বানাও।

এখনও তো রাত আছে স্যার।—হোঁৎকা জবাব দিতে গিয়ে দত্তসাহেবের হাতের ওয়াকিং স্টিক-এর খোঁচা খায়, – আবার জবাব। গেট আপ, হাউ লেজি বয়।

উঠতে হল হোঁৎকাকে। সাহেবের জন্য চা চাপায়। দত্তসাহেব এবার খোঁচা মারে গোবর্ধনকে, ইউ বুধো, উঠে পড়ো-

স্যার!-গোবরা পিট পিট করে বলে, এখন তো অনেক রাত ।

সাট আপ! ওঠো, এই জুতোগুলো একটু সাফ করে রং পালিশ করে বাংলোর বারান্দায় ঝাঁট দিয়ে চেয়ার টেবিল লাগাও।

সাত সকালে হোঁৎকা চা চাপিয়েছে আর গোবরা বসেছে সাহেব মেমসাহেবদের একগাদা জুতো নিয়ে, রং পালিশ করছে আর গজগজ করছে,—ছিঃ ছিঃ, সাতসকালে জুতো পালিশ!

হোঁৎকাও দেখেছে। বলে সে,—কর! তারপর দেখছি ব্যাটাদের। এর মধ্যেই কুনাল চৌধুরী গর্জন করে ওঠে,—চা লাগা! কী করিস ব্যাটারা? সব কটাকে লাথি মারতে হয়। তবে সযুত হবি তোরা।

গৌবর দত্ত মর্নিং ওয়াকে বের হয়েছে। পাহাড়ের উপর থেকে নামছে। ওদিকে কাঠের ব্রিজ পার হয়ে বড় রাস্তার ধারে যাবে ফরেস্ট কলোনির দিকে। আপন মনে গান করতে করতে চলেছে। হঠাৎ মনে হয় কে যেন বনের ভিতর থেকে বের হয়ে তার সঙ্গে দুলকি চালে হেলে দুলে চলেছে। বোধহয় বাংলোর কোনো বোর্ডারই।

দত্তসাহেব তাকে সম্বোধন জানায়,–গুড মর্নিং!

সঙ্গীটা সাড়া দেয় না। তবে পাশে পাশেই চলেছে। গৌরব দত্ত বলে,—কোথা থেকে আসা হচ্ছে? হ্যাল্লো-

হাতটা বাড়াতেই লোমশ গায়ে হাত পড়তে চমকে উঠল গৌরব দত্ত!

ভোরটা এখানে মনোরম। নতুন কচি পাতা এসেছে শালবনে, মহুয়া ফোটার দিন, ভোরের বাতাস মহুয়ার মিষ্টি গন্ধ, আর মহুয়ার লোভে এখন ভালুকের আনাগোনা বেড়ে যায়, বন থেকে একটা ভালুকই কি কৌতূহলবশে গৌরব দত্তকেও ভালুক মনে করে এসে জুটেছে। আর এবার ভালুককে নাগালের মধ্যে দেখে দত্তমশাই পরিত্রাহি চিৎকার করে দৌড়চ্ছে বাংলোর দিকে।

বাঁচাও, বাঁচাও !

ওর ওই চিৎকারে উপর বাংলো থেকে হোঁৎকা গোবরা দুটো চ্যালাকাঠ নিয়ে দৌড়ে এসেছে, পিছনে মালতী তার মেয়েরা আর্তনাদ করছে—একি সর্বনাশ হল গো!

দত্তমশায় দুহাত তুলে তুড়ি লাফ খাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে। ব্যাপার দেখে লজ্জায় বনের ভালুকও সরে গেছে। নীচের বাংলো থেকে আমরাও ছুটে গেছি ।

ভালুক তখন নেই। একা গৌরব দত্তই তখনও ওই উদ্দাম নৃত্য সহযোগে চিৎকার করে চলেছে। কুনাল চৌধুরী তো বন্দুক নিয়ে বের হয়ে আসে। বলে সে, – উড়িয়ে দেব ব্যাটাকে, এখানে ভালুক। অবশ্য বনের ভালুক তখন বনে, কুনাল চৌধুরী গোবরাকেই এবার বন্দুকের নল পেটে লাগিয়ে শাসায়,–সাহেবকে একা কেনে যেতে দিলি? যদি কিছু হত? এবার তুই সাহেবের সঙ্গে থাকবি। না হলে গুলি করে শেষ করে দেব। এ যেন গোবরারই দোষ! লোকটা একেবারে জানোয়ার ।

হোঁৎকা গোবরা একফাকে এসেছে আমাদের ঘরে, বলি,–এই চাকরি তোদের! জুতো সাফ করছিস আর উঠতে বসতে ধমকাচ্ছে ওই লোকটা। চাকরি ছেড়ে দে।

হোঁৎকা হাসে,—-শেষতক দেইখা যা। গোবর্ধনও এর মধ্যে অপারেশন শুরু করেছে। কুনাল চৌধুরীর ঘর সাফ করার অবকাশে এবার গোবরা বিছানার তলে ওর নোটবইটা হাতিয়েছে।

তাতে বেশ কিছু পার্টির নাম ঠিকানা আছে। যাদের সঙ্গে ও চোরাই কাঠ, বাঘ-চিতা- হরিণের চামড়া, হাতির দাঁতের কারবার লেনদেনও করে। মায়, কোন আদবাসী বস্তির কে ক’টা হাতির দাঁত দিয়েছে—চামড়া দিয়েছে, তার জন্যে কত টাকা নিয়েছে সে সব হিসাবও আছে।

আর আছে বুলাকী সোরি নাম। এই শেঠই মূল মদতদার আর মহাজন। হোঁৎকাও চিনেছে শেঠজিকে।

বলে, এই ব্যাটাই ট্রেনে আমাগো কাগজপত্র মাল সব লইয়া গেছে। আর এই ব্যাটাই ওই কুনালকে দিয়া এই জঘন্য কাজ করায়। ওটারেও দেখাইমু।

হোঁৎকার মুখে কুনালের এই আসল ব্যবসার কথা শুনে চমকে উঠি আমরা । পটলা বলে— —ব্যাটা দেশের শত্রু। বনের শত্রু।

হোঁৎকা বলে—তাই ওর সব খবরই জোগাড় করেছি এবার বাধা দিতেই হবে।

বলি—কী করে তা সম্ভব? ওদের বহু লোকজন, অনেক বড় চক্র ওদের। আর ফরেস্টের বাবুরাও যে টাকার লোভে ওর দলে কেউ নেই তা কি করে বলি। সরষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে, সেই সরষে দিয়ে ভূত ছাড়ানো যায় না রে।

পটলা বলে—স-সবাই এমন নয়। দেখ না রেঞ্জার সাহেবকে বলে যদি কিছু করতে পারি।

আমাদের কলকাতায় চিঠি দেবার কথা ছিল গুয়া স্টেশনে নেমে। বনে ঢোকবার আগে। কিন্তু সব ওলটপালট হয়ে গেছে—কোনমতে ট্রাকে চেপে বনে এসেছি, চিঠি দেবার কথা মনে ছিল না।

তাই কলকাতায় পটলার ঠাকুমা ভাবতে শুরু করেছে। একমাত্র বংশধর তার নাতি পটলচন্দ্রের জন্যই। আমরা তো ফাউ।

তাই পটলের বাবা কলকাতা থেকে ওই বড় বিলের বড় নেতা ওদেরই কোন আত্মীয় পল্টুবাবুকে ফোন করে। যেমন করে হোক বনবাংলো থেকে এই ছেলেগুলোর খবর চাই ।

পল্টু মিত্র এখানকার এম. পি। বড় ব্যবসাদারও। আর তেমনি দশাসই চেহারা, পল্টু মিত্র ফোন পেয়ে ভাবছে জঙ্গলের মধ্যে ফরেস্ট বাংলোয় যাবে কি না, কিন্তু কতকগুলো জরুরি কাজে তাকে দু’দিনের জন্যে পাটনা যেতে হবে। তারপরে বনে যেতে পারে, এর মধ্যেই অবশ্য খবর নিতে হবে।

তাই ফরেস্ট অফিসে চলে এল সে। দেখা হয়ে গেল থলকোবাদ-এর রেঞ্জার মিঃ ওঝার সঙ্গে। মিঃ ওঝা সৎ নিষ্ঠাবান অফিসার।

পল্টুবাবু বলে,–মিঃ ওঝা আপনার ফরেস্ট বাংলোয় পটল মানে প্রবুদ্ধকুমার মিত্র আর বন্ধুরা উঠেছে কি?

ওঝাজি বলে,—হ্যাঁ-হ্যাঁ স্যার। ক’জন ইয়ং বয় এসেছে বটে প্রবুদ্ধ মিত্র ইয়ে পটলবাবু

থাকতে পারে ওদের মধ্যে।

পল্টুবাবু বলে,—নিশ্চয়ই আছে। আপনি একটু গিয়ে ওর খবর নিয়ে আপনাদের অফিসে রেডিওগ্রাম করে দেবেন। আমার ভাগ্নে! ওকে একটু সাহায্য করবেন দরকার হলে। আমি পাটনায় চিফ মিনিস্টারের সঙ্গে কাজ সেরে ফিরে এসেই বনবাংলোয় যাব ওদের দেখতে। আপনি আজই গিয়ে বিকেল নাগাদ রেডিওগ্রাম করবেন, আমি কলকাতায় মেসেজ দিয়ে দেব। মিঃ ওঝা বলে, – ঠিক আছে স্যার।

হোঁৎকা-গোবরা গোপনে বেশ খবর সংগ্রহ করেছে। হোঁৎকা জেনেছে, এর মধ্যে কিছু হাতির দাঁত, বাঘের চামড়াও এসে যাবে।

খাবারে বিষ মিশিয়ে ওরা বনের বাঘকে মেরে ফেলে। হাতিকে গর্তের গভীরে কৌশলে ফেলে তাকে শেষ করে তার দাঁত হাড়গুলোও বস্তাবন্দি করে চালান দেয়। ভালো দামে বিক্রি হয় বাজারে।

আরও মাল পাচার করা হবে দু’একদিনের মধ্যে। তার তোড়জোড় চলেছে। ভাবছি, রেঞ্জারকে বলব কি না!

যেতে আর হল না। আমাদের ডরমেটরিতে এসে ঢুকলেন বলিষ্ঠ খাকি পোশাক পরা একটি ভদ্রলোক। আশ্চর্য, ইনিই তো রেঞ্জার সাহেব।

মিঃ ওঝা শুধোয় ভাঙা বাংলায়,—পটলবাবু কৌন আছে।

পটল তাকাল। রেঞ্জার বলে,—হামি মিঃ ওঝা। এখানের রেঞ্জার। তুমি এম. পি সাহেবের ভাজা তা তো বলোনি। এসেছ, এখানে বাড়িতেও চিঠি দাওনি। আভি বড়বিল হেডকোয়ার্টারে রেডিওগ্রাম করে তোমাদের খবর জানাতে হবে এম. পি সাবকে, উনি কলকাত্তায় ফোন করে দিবেন। সব ঠিক আছে তো পটলজি ?

পটল এবার মওকা পেয়ে বলে,–এখানে আমরা ভালোই আছি। কিন্তু বিরাট গড়বড় চলেছে। ওই কুনাল চৌধুরী বহুৎ বেআইনি কাজ করছে।

হোঁৎকাও ছিল এখানে। ও বলে,– হালায় বনকে সাফ কইরা দিব আর হাতি বাঘ হরিণ ও মাইরা শেষ কইরা দিব। ই বন যেন ওর বাপেরই।

মানে?—মিঃ ওঝা চমকে ওঠেন।

হ্যাঁ, রেঞ্জার সাহেব। -আমি বলি—এর ব্যবস্থা হওয়া দরকার ।

মিঃ ওঝা বলেন,–কিন্তু প্রমাণ? সব খবর তো চাই ।

হোঁৎকা বলে—যদি দিতি পারি?

মিঃ ওঝা দৃঢ়কণ্ঠে বলেন,—আমাকে বিশ্বাস করতে পারো! সব প্রমাণ পেলে আমি কাউকেই ছাড়ব না, সে যেই-ই হোক।

গোবরা বলে—শেঠ বুলাকি দাসই এদের মাথা, কুনাল চৌধুরী আর সে দুজনে এই সর্বনাশ করছে। সব খবর প্রমাণ কাগজপত্রও আপনাকে দেব আজই ।

তাহলে সন্ধ্যার পর রাতে এসো। না হয় দুপুরে নিরিবিলি থাকি, তখন এসো।

দুপুরবেলা দত্তসাহেব খেয়ে-দেয়ে নাক ডাকেন আর কুনাল বের হয়ে যায় বনের গভীরে ওর চোরা-কারবারের ধান্দায়।

এই দুপুরেই উদো বুধোর ছুটি মেলে। আজ উদো বলে মালতীকে,–মেমসাব, বস্তি থেকে কিছু আনাজপত্র, সবজি আনতে হবে।

মালতী বলে—কিছু টাকা নিয়ে তাই আনো গে।

ওরা দুজনে বের হয়। কাগজপত্র নিয়ে আমরাও চলে গেছি ফরেস্ট রেঞ্জারের অফিসে।

রেঞ্জার মিঃ ওঝার কাছে কিছু খবর ছিল বেআইনি কাঠ পাচার হয় মাঝে মাঝে, কিন্তু এইভাবে একটা চক্র তো কিছু বেআইনি কাজ করে চলেছে সে খবর ছিল না। আজ তাই ওই কাগজপত্র, নোটবই-এর ঠিকানা দেখে তিনিও সব নোট করে নেন ।

হোঁৎকা বলে—ওই সব আদিবাসী গ্রামের কিছু সৎ মানুষকে ওরা সর্বনাশা চোর ডাকাত বানিয়েছে। ওরাই বনের জানোয়ারদের মারছে—দামি গাছ চুরি করে কাটছে।

মিঃ ওঝা বলেন,—ওই কুনালকে হাতে-নাতেই ধরতে হবে। হোঁৎকা বলে,—সব খবরই দিলাম, ওই লোকগুলোর উপর নজর রাখুন আর কুনালের বন কাটাই যেখানে হচ্ছে সেখানেও রাতে নজর রাখুন সব দেখতে পাবেন। দু-একদিনের মধ্যে এরা আরও কিছু হাতির দাঁত, বাঘের চামড়া চোরাই কাঠ পাচার করবে।

এদিকে বাংলোয় ফিরে কুনাল উদো বুধোকে না দেখে গর্জন শুরু করেছে। দত্তসাহেবও গর্জায়,–কোথায় যায় ব্যাটারা? চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেব, এখনও চা হল না? বিকেল হয়ে গেছে।

আমরা ফিরে এসেছি বন অফিস থেকে, হোঁৎকা গোবরাও ওখানেই ছিল। তারপর ওরা বস্তিতে গেছে।

ফিরছে দুজনে কুমড়ো-পেঁপে-মুলো আর আন্ডা নিয়ে, কুনাল লাফ দিয়ে গিয়ে হোঁৎকার জামার কলার ধরেছে,—ইউ রাস্কেল।

আমরাও ব্যাপারটা দেখে চটে উঠি। পটলাই বলে, চুপ করে থাক।

হোঁৎকা বলে—দ্যাখছেন তো স্যার, বস্তিতে খুঁইজা খুঁইজা সবজি আন্ডা আনতে গেছলাম। কাল থেকে বাজার আসেনি তো।

চোপ। জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব। যা চা করগে।

হোঁৎকা জবাব দিল না। ওই জানোয়ারটার এ সবের সে কঠিন জবাবই দেবে। তাই সব অপমান মুখ বুজে সহ্য করে চলেছে।

সন্ধ্যা নামে। শাল মহুয়া গামার বনে আঁধার ঘনিয়ে আসে, কুনাল দিনভোর ঘুমিয়েছে, এবার রাতে তার কাজ শুরু হবে। আজই প্রচুর মাল পেয়ে গেছে সে। দু’জোড়া বিরাট হাতির দাঁত এসেছে, একটা আসলি বাঘের চামড়া—আর প্রচুর দামি রোজউড গাছও কেটেছে তারা।

ওদের গেটও খোলা থাকবে। ট্রাক বোঝাই ওই লাখ লাখ টাকার মাল বন থেকে বের হয়ে শেঠজির গুদামে পৌঁছে গেলে তার কোনও দায়িত্ব আর থাকবে না।

জিপ নিয়ে রাতের অন্ধকারে বের হয়ে গেল কুনাল চৌধুরী।

ওদিকের ঘর থেকে গৌরব দত্তের নাকে তখন ব্যান্ড ব্যাগপাইপ বাজছে। অন্যঘরে গিন্নীমা মেয়েরাও গভীর নিদ্রায় মগ্ন।

হোঁৎকা গোবরা ওদের পিছনের চালাঘর থেকে দরজাটা ভেজিয়ে বের হয়ে এসে আমাদের ডাকে,—আয় ৷

খবর আগেই দেওয়া ছিল মিঃ ওঝাকে। তিনি এর আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে তৈরি হয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

আমাদের দেখে বলেন,–এসো। তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

হোঁৎকা বলে—আইজ রাতে ওর মাল যাইব। শোনলাম চারখান হাতির দাঁত জোগাড় করছে, এ্যাকখান খাস রয়্যাল বেঙ্গলের চামড়া।

—ইস্। এইভাবে বনের হাতি বাঘকে মারছে ওরা? তবে আজই ওদের খেলা শেষ। আমি হেড কোয়ার্টারে ওয়ারলেস করে স্পেশাল ফোর্স পোস্টিং করেছি। বনে, ফরেস্টের আশপাশে। ফরেস্টের স্টাফরাও জানে না। আজ ওদের বেরুতে দেব না, হাতে-নাতেই ধরব। চলো—!

আমরা ফরেস্টের জিপেই রওনা হলাম। বেশ কিছুটা এগিয়ে গেল জিপটা অন্ধকারেই। হেডলাইট জ্বাললে দেখতে পাবে ওরা—তাই তারার আলোয় বনের বুকে মোরাম ঢালা রাস্তায় জিপটা কিছু পথ এসে থামল। আমরা নেমে এবার নীরবে বনের ভিতর চলেছি গাছের আড়ালে।

রাতের অরণ্যে বিচিত্র শব্দ ওঠে। ভারী বাতাসে কেমন অজানা সুবাস। হঠাৎ বনের এদিকে এসে সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় দেখা যায় আলো জ্বলছে। দু-তিনটে মশাল জ্বেলে ওরা ট্রাকে মাল তুলছে। দামি দামি কাঠ—ওই সব বহু মূল্যবান মালপত্র তুলে ট্রাক বোঝাই করে এবার ওরা রওনা দেবে।

আমরা সরে এলাম। রাত্রি তখন প্রায় বারোটা। রাক্ষুসে মশার কামড়ে হাত-পা জ্বলছে! পাহাড়ের উপর থেকে দেখা যায় নীচের রাস্তা দিয়ে ট্রাকটা রাতের অন্ধকারে খুব অল্প আলো জ্বেলে কোনমতে চলেছে। আর এবার বেশি দামি মালই যাচ্ছে। তাই পিছনে জিপ নিয়ে চলেছে কুনাল চৌধুরী নিজে, যাতে ফরেস্ট চৌকিতে কেউ না আটকায় বনের বাইরে বের হতে পারলে আর তাকে কেউ ধরতে পারবে না।

মিঃ ওঝাও তাঁর ওয়ারলেস মেশিনে বনের মধ্যেকার চেক পোস্ট আর মোবাইল গার্ডদের গাড়িতে খবর দিতে থাকেন। তারা যেন রেডি থাকে। ওই ট্রাককে ধরতেই হবে। এবং জিপের আরোহী ওই কুনালকেও। কোনোমতে যেন পালাতে না পারে।

আমরা ফরেস্ট বাংলোতে ফিরে এসেছি। হোঁৎকা গোবরাও ফিরে গেছে তাদের সেই চালাঘরের আউটহাউসে। যেন কোথাও কিছুই ঘটেনি। বাংলোর ওদিকের ঘরে তখনও ওই দত্তসাহেবের নাকের বাদ্যিতে কাড়া নাকাড়া বেজে চলেছে। ওরা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। কুনাল ফেরেনি।

ঘুম ভাঙে সকালে। এখানের সকালটা বেশ মিষ্টি! রকমারি পাখির ডাকে বনভূমি ভরে ওঠে। গাছে গাছে বসন্তের আগমনী, শাল গাছে এসেছে নতুন কচি হলুদ পত্রমঞ্জরী, মহুয়া ফোটে। বাতাসে তারই মদির সুবাস।

বাংলোটা তখনও নিঃশব্দ। হঠাৎ গর্জন শোনা যায় গৌরব দত্তের, বেড টি হল না। এখনও এত ঘুম! গুলি করে উড়িয়ে দেব! এ্যাই উদো—!

উদো ওরফে হোঁৎকা শুয়েছে দেরিতে। এখন সেই ভালুক দেখার পর থেকে দত্তসাহেব বেলা না হলে মর্নিং ওয়াকে যায় না। তবু ভোরে চা তার চাই-ই। আর ভালুকের ভয়ে বন্দুক নিয়ে ঘোরে, বাংলোর সামনের লনে।

হোঁৎকা বলে,–দিচ্ছি তো।

আবার জবাব! সাট আপ! গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেবো!

হোঁৎকা বলে—এত গুলি করলে এ চাকরি আর করুম না! আমি রেজিগনেশন দিতাছি সার !

বুধো ওরফে গোবরাও বলে.. – আমি চাকরি করব না।

হোয়াট। দুটোকেই গুলি করে শেষ করব। অবাধ্য ইডিয়ট-রাস্কেল, দেখছ বন্দুক! রীতিমত বন্দুক তুলে ধমকাচ্ছে দত্ত, এমন সময় হঠাৎ এসে পড়েন পল্টুবাবু নিজে। পাটনার কাজ সেরে আসার সময় পেয়েছেন তিনি।

পটলা ওঁকে আসতে দেখেই চিনেছে। আমরা সকালে লনেই বসেছিলাম। মামাবাবুকে দেখে পটলা এগিয়ে যায়।

পল্টুবাবুও বলে,—ভালো আছিস তো!

বলতে বলতে সে ফেরে দত্তের দিকে,একি করছেন? গুলি করবেন নাকি? দত্তসাহেব গর্জে ওঠে,—হু আর ইউ? আমরা লোককে গুলি করি কি না তা আমি বুঝব। তার জন্য আর কারোকে কৈফিয়ত দিতে রাজি নই। গেট আউট–!

পল্টুবাবু নিঃশব্দে তাকিয়ে দেখছে ওই বিচিত্র লোকটাকে।

এমন সময় জিপ নিয়ে এসে হাজির হয় রেঞ্জার মিঃ ওঝা। এসেই এম-পি সাহেবকে দেখে নমস্কার করেন।

-স্যার, আপনি!

পল্টু বাবু বলে,—এরা কারা! কথায় কথায় গুলি চালাতে যায়?

এবার মিঃ ওঝা বলে,–ডেঞ্জারাস লোক স্যার! ওদের একজনকে আজ হাতে-নাতে ধরেছি। এতদিন ধরে জঙ্গলের বহু ক্ষতি করেছে ওরা। ধরেছি আজ মালসমেত। তাই ওদের এখনি বাংলো থেকে বের করে দেব। এমন লোকদের বনে থাকার পারমিটও ক্যানসেল করে দেবো।

দত্তসাহেবের দিকে মিঃ ওঝা এগিয়ে যায়।

দত্তসাহেব শুনেছে ব্যাপারটা। শুধোয় সে, – মানে?

মিঃ ওঝা বলেন,—আপনারা এ মুহূর্তে সব চার্জ মিটিয়ে বাংলো ছেড়ে বনের বাইরে চলে যান। এখানে থাকার হুকুম নেই।

মানে,—এবার গৌরব দত্ত মিনমিনে গলায় বলে, আগে কুনাল আসুক ।

মিঃ ওঝা বলে,–সে আর আসবে না। সে এখন পুলিশ হাজতে। সেখান থেকে সদর আদালতে তোলা হবে।

চমকে ওঠে গৌরব দত্ত। টাকাকড়ি কোনো কালেই তার ছিল না। চিরকাল পরের পয়সাতেই ক্যারামতি করেছে। আজও বাংলোর খরচ, যাতায়াত সব ওই কুনালের ঘাড়েই চলেছে।

সুতরাং অথৈ জলে পড়ে যায় দত্তসাহেব ।

মিঃ ওঝা বলেন,–বের হয়ে আসুন বাংলো থেকে। আমি এখনই আপনাদের বের করে ওই ঘর তালাবন্ধ করে দেব। আর অফিসে গিয়ে চার্জ মিটিয়ে চলে যান আজই এখান থেকে। দত্তসাহেবের বেলুন চুপসে গেছে। সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।

এবার মালতীই বলে পল্টুবাবুকে,-বাবা, সব তো কুনালের কাছে। সে যে এই ধরনের ছেলে, তা তো জানতাম না, বিশ্বাস করো। এখন এই গহন বনে কি যে করি।

মিঃ ওঝা মাথা নাড়েন,–সেটা আপনাদের ব্যাপার, আমাকে ঘর খালি করতেই হবে । গোবরা বলে—কই দত্তসাহেব, তিনদিনের বেতন পাইনি, তিন আশি দুশো চল্লিশ টাকা, মিটিয়ে দিন চটপট। তারপর বেরোন এখান থেকে। অবশ্য আমাদের কাজও করে দিতে পারেন, করবেন নাকি?

গৌরব দত্ত অসহায়ভাবে গজরায়,—ব্যাটা কুনাল যে একটা ঠগ্ জোচ্চোর—ক্রিমিন্যাল, তা জানতাম না। এখন কী হবে?

মালতী বলে পল্টুবাবুকে,—তুমি একটা ব্যবস্থা করো বাবা।

পল্টুবাবুই শেষ অবধি ওদের নিজের গাড়িতে বের করে আনেন বন থেকে।

এখন ফরেস্ট বাংলো একেবারে খালি ।

পটল বলে, মামাবাবু, ক’দিন বহুৎ ঝামেলায় কেটেছে। এবার দু-তিনটে দিন শান্তিতে বনে থাকতে দিন, সামনের বুধবার সকালে জিপ পাঠাবেন। আমরা বন থেকে আপনার ওখানে যাব ।

মিঃ ওঝা সাপোর্ট করেন, তাই করুন স্যার। ছেলেদের সাহায্যেই বিরাট একটা চক্রকে ধরেছি। ওদের ক’দিন আরাম করতে দিন ।

সেবার বনভ্রমণটা ভালোই জমেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *