পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

পটলার বনভ্রমণ

পটলার বনভ্রমণ

সুখে থাকতে ভূতে কিল মারে বলে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে। মানে সংসারে বেশ কিছু মানুষ আছে তারা সুখে-শান্তিতে থাকতে চায় না। যেভাবেই হোক কোনো একটা অশান্তিকর ব্যাপারে জড়িয়ে পড়বেই। কথাটা আমাদের বন্ধু পটলার বেলাতে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। নিজে তো অশান্তিতে জড়াবেই, আর সেই সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের আমাদের বাকি চারজনকেও জড়াবে।

বেশ ছবির মতো সুন্দরই সবকিছু ছিল। আমরা অর্থাৎ আমি, পটলা, হোঁৎকা, ফটিক মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি। গোবরা এত করেও টেস্টে অ্যালাউ হল না। হবে কী করে! মামার বিরাট কুমড়োর ব্যবসা। এবার নাকি বিদেশেও কুমড়ো এক্সপোর্ট করছে। গোবরাও সারা বাংলা ঘুরে ঘুরে কুমড়ো কালেকশন করে জোগান দিতে ব্যস্ত ছিল। কুমড়োর জন্যই অ্যালাউ হয়নি। লাউ-কুমড়োর মধ্যে নাকি মিল নেই। তাই অ্যালাউ হয়নি গোবরা। আমরা তাকে সান্ত্বনা দিই, তুই পাকা হয়ে অ্যালাউ হবি, সামনের বছর।

পটলা এর মধ্যে প্রোগ্রামও করে ফেলেছে, এবার সে অরণ্যভ্রমণে যাবে। আর ইদানীং পটলা বন-জঙ্গল নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা শুরু করেছে। অরণ্যই হল আজকের গ্রিন হাউস ব্যাঙ্ক, উষ্ণায়ন থেকে পৃথিবীর মানুষকে বাঁচাতে পারে এই বনজঙ্গল, গাছই মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু, একদল শয়তান নিজেদের হীন উদ্দেশ্যের জন্য এই অরণ্যকে ধ্বংস করছে—এই সব নিয়ে রীতিমতো ভাষণ দিতে শুরু করেছে পটলা। আমরা পটলার সেসব কথা মন দিয়ে না হোক কান দিয়ে অন্তত শোনার ভান করি। কারণ পটলাই আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের ক্যাশিয়ার। ক্যাশও নেই, ক্যাশবাক্সও নেই। তবু সেই-ই ক্যাশিয়ার। এতদিনের চা-টোস্ট, সিঙ্গাড়া, আইসক্রিম, এসব খরচা ওই-ই জোগায়। বিরাট বনেদি বাড়ির একমাত্র বংশধর। ওর বাবা-কাকার দুটো কারখানা, ওর ঠাকমার নামে এই এলাকায় বিরাট বাজার। বাড়িতে নিত্যপূজা হয়। ওর ঠাকমা রোজ ডেকে পাঠিয়ে আমাদের গোপালের ভোগ খাওয়ান। লুচি, কিশমিশ দেওয়া ছোলার ডাল, ছানার কালিয়া, পায়েস। তাঁর দয়াতেই পটলার হাতে ক্যাশ আসে। তাই পটলাকেই আমরা ক্যাশিয়ার বানিয়েছি।

বেশ চলছিল আমাদের প্রসাদ সেবা, খেলাধুলো। ফটিক আমাদের ক্লাবের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। পড়াশোনার পাশাপাশি কোন ওস্তাদজির কাছে গানও শিখছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে। আর ক্লাবে-বাড়িতে হারমোনিয়াম নিয়ে তা-না-নানা করে। ওর ওস্তাদ ওকে শিখিয়েছে— ‘কাঁহা গ্যায়ে ঘনশ্যাম’। সেই তিনটে কথাই নানা সুরে, নানা তালে সে রেওয়াজ করে। আমরা বলি—তারপর কী রে? ঘনশ্যাম গেল কোথায়? ফটিক বলে—পরের লাইন রেওয়াজ করাবে ছ’মাস পর। আগে এটাই রপ্ত করি। তারপর আবার ইনিয়ে-বিনিয়ে সুর তোলে-কাঁহা গ্যায়ে-

হোঁৎকা বলে—তর দেশ ভারতবর্ষে। ঘনশ্যামরে যেখানে মন চায় যেতে দে। তুই থাম! আর গাওনের দরকার নাই।

ফটিক বলে—পরের লাইনটা পাব এবার ।

এমনি দিনে সব শান্তি নষ্ট করে পটলা বলে, পিসেমশাইকে চিঠি দিয়েছিলাম। তিনিও লিখেছেন, চলে আয়। বন-পাহাড় ঘুরে যাবি। দেখবি কেমন বন, চোখ-জুড়োনো সবুজ। আর সাতশো পাহাড়ের দেশ সারান্দা। সেই বন-পাহাড় দেখে যা। এখনও অব্দি একটা পাহাড়ই দেখিনি, তায় একসঙ্গে সাতশো পাহাড় দেখব ভেবে রীতিমতো ভয়ই পাই। সেবার দেওঘরের ত্রিকূট পাহাড়ে গিয়ে পালকি নিয়ে যা ফ্যাসাদে পড়েছিলাম, এবার সাতশো পাহাড় আর গহন বন! কী যে হবে জানি না !

হোঁৎকা যেন আগুনে ঘি ফোড়ন দেয়। বলে সে, ফরেস্ট তো যাইরি! তর পিসেমশায়ের ত শহরে খুব নামডাক! তায় বনবাংলোতেই যাইমু। বনকে যদি দেখতেই হয় ফরেস্ট বাংলোতেই থাকার লাগব ।

একে মা মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ। পটলা বলে, কথাটা মন্দ বলিসনি! সারান্দার গহন অরণ্যেও অনেক ভালো ফরেস্ট বাংলো আছে। আজই বাংলোর পারমিশানের জন্য বনকর্তাদের চিঠি দিচ্ছি।

পটলার মাথার সুপ্ত পোকাটা নড়ে ওঠে। বলে পটলা, দারুণ হবে! হোঁৎকা আর আমি ওই বনবাংলোয় চলে যাব। পিসেমশাই ওই সারান্দার গহন বনের মধ্যে ফরেস্ট বাংলোয় থাকতে দেবেন না। তিনি বলবেন—সকালে বনে যাও—দিনভোর বনে ঘুরে সন্ধ্যার মুখে শহরে ফিরে এসো। খুব সাবধানী লোক তিনি। তাই ভাবছি আমরা বন ঘুরে তবে শহরে আসব।

আমি বলি—তোরা তো ফরেস্ট বাংলোয় থেকে বন দেখবি ঠিক করেছিস, শুনেছি সারান্দায় বাঘ-হাতির পাল, বাইসনের দল, ভালুক, হরিণ, সম্বর সবই আছে ?

পটলা বলে—আছে তো! দলে দলে আছে নানা প্রাণী। ওদের দেখতে গেলে রাতের অন্ধকারে জিপ নিয়ে স্পটলাইট নিয়ে বের হতে হয়। বনবাংলোয় না থাকলে রাতে বের হওয়া যায় না।

হোঁৎকা বলে বেশ বীরদর্পে-তোগোর মুরগির কলজে! বাঘ-হাতির পাল দেখলে প্যান্ট বাসন্তী কালার কইরা ফেলবি! তাই তগোর রাতে বনে লই যামু না। পটলা আর আমিই যামু তারপর কি দ্যাখলাম, কি করলাম সব কমু পরে পিসেমশাই-এর বাড়ি আইস্যা—

এর মধ্যেও হোঁৎকা যে এমন ডেয়ার ডেভিল হয়ে উঠবে তা ভাবিনি।

পটলা বলে, ঘাবড়াস না! পরে তোদেরও বনে নিয়ে যাব। আমরা ব্যাপারটা দেখে-বুঝে আসি ।

গোবরা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। সে এবার বলে, কোনো প্রবলেম হবে না তো! হোঁৎকা এখন পটলার সাপোর্টার! সে বলে, না-না, কুন প্রবলেম হইব না !

হোঁৎকার কথাটা ভালো লাগেনি। তাও বলি, গোবরা, আমরা তো ভিতুর ডিম! ওদের দুজনকে যেতে দে— ওরাই সামলাক্! আমাদের ভেবে লাভ কি?

পটলা বলে—না-না, তোরাও তো যাচ্ছিস বনে! ঠিক সাতদিন পর। সমী, ইংরাজিটা তো তুই ভালো জানিস। বনবিভাগের কর্তাদের লিখে দে, ওই ফরেস্ট বাংলো বুক করার জন্য। একটা ঘর চাই সাতদিনের জন্য। তারিখটাও লিখে দে।

অর্থাৎ পটলার ওসব হিসাবও হয়ে গেছে। গোবরা বিজনেস বোঝে। সে বলে, ক্লাবের ক্যাশ তো খালি! বেড়ানোর খরচা— ?

পটলা বলে, ওর জন্য ভাবিস না। ঠাকমাকে বলে রেখেছি। ক্যাশ ম্যানেজ হয়ে যাবে। একটা লিস্ট করতে হবে। ওখানে কিছুই পাওয়া যায় না। তাই ইস্টিশানে নেমে লোকাল বাজার থেকে সবকিছু নিয়ে নেব। ফর্দ করে নিবি।

টিকিট কাটা হয়ে গেছে। এর মধ্যে পটলা অরণ্যজগৎ, বন্যপ্রাণীজগৎ নিয়ে বেশ কিছু বইও জোগাড় করেছে। বলে—বনে যাবি, বন্যপ্রাণীদের সম্বন্ধে কিছু পড়াশোনা করে নে। সারান্দার শালবন সারা এশিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ।

গোবরা বলে-কেন? তরাই-এর শালও খুব ভালো।

পটলা বলে—সারান্দাতেই রয়েছে সবচেয়ে প্রাচীন শালগাছ। এর এক-একটার পরিধি বারো ফিটেরও বেশি। আর মানেও সেরা। তাছাড়া সেগুন, নিমশাল, গামহার, আরও অনেক ভালো গাছ আছে। আর বন্যজন্তুর তো অভাব নেই। পাল পাল হরিণ, হাতি, সম্বর, ভালুক তো আছেই। এমনকী চিতা, বাইসনও আছে।

গোবরা বলে-এত দামি গাছ, এত প্রাণী ওখানে—তাহলে চোরাশিকারিও আছে ওখানে। বনের মধ্যে শুনেছি তাদেরও দাপট কম নয়।

পটলা বলে—তা হতেও পারে। আমাদের তাতে কী। আমাদের বন আর বন্যপ্রাণী দেখা নিয়ে কথা ৷

হোঁৎকা বলে—আর কয়দিন বনে গিয়া ফ্রেশ অক্সিজেন লইয়া আসুম। মুনি-ঋষিরা একশো বছর কেন বাঁচে জানস্? ওই অক্সিজেন আর পিওর ফ্রুটস্—

হোঁৎকাও আমাদের বন সম্বন্ধে জ্ঞান দিতে শুরু করেছে।

এর মধ্যে বনবিভাগ থেকে দুজনের জন্য ফরেস্ট বাংলোর ঘর বুকিং-এর চিঠিও এসে গেছে। পটলা আর হোঁৎকা কালই চলে যাবে। আমরা যাব সাতদিন পর। বড়বিল স্টেশনে নামব। পটলার পিসেমশাই-এর ওখানে বিরাট কাঠের গোলা, করাতকল। আর ওখানের পাহাড়ে রয়েছে অফুরান খনিজ লোহা, অর্থাৎ আয়রন ওর। সেই আয়রন ওর তুলে চলে যায় নামী কারখানায়। তাঁর বন-পাহাড়ের এদিকে-ওদিকে নাকি দু-তিনটে বাংলো। তারই একটাতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। পটলারা যাবে বনপাহাড়ের শেষ স্টেশন অবধি। বন থেকে কাঠ বোঝাই ট্রাক বাইরে আসে, সেইসব ফেরত ট্রাক ধরে ওরা বনের মধ্যে গিয়ে ফরেস্ট বাংলোয় থাকবে সাতদিন। তারপর আবার বন থেকে বেরিয়ে ট্রাক ধরে পিসেমশাই-এর বাংলোতে পৌঁছাবে। আর আমরাও সেদিন সকাল ন’টার গিয়ে নামব। একসঙ্গেই যাব পিসেমশাই-এর বাড়ি। পিসেমশাইও জানবে আমরা একসঙ্গে কলকাতা থেকে আসছি।

আমরা পটলা আর হোঁৎকাকে ট্রেনে তুলে দিই। উপর-নীচ দুটো বার্থ। দুজনে বেশ গুছিয়ে বসেছে। এবার নজর পড়ে সহযাত্রীদের দিকে। ওদিকে বার্থে বসে আছে মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক। কপালে রক্তচন্দনের তিলক। বেশ ভক্তি ভক্তি ভাব। নিরীহ গোছের চেহারা। পাশে আরও কয়েকজন। ভদ্রলোক এর মধ্যে প্রকৃতির মহাশক্তির সম্বন্ধে অনেক গূঢ়তত্ত্ব নাকি প্রকাশ করা শুরু করেছে। হিন্দি দেহাতি টানের সঙ্গে বাংলা মেশানো। কথা শুনে মনে হয় ভদ্রলোক অবাঙালিই। তবে বাঙালিদের সঙ্গে ওঠা-বসা আছে। বাংলা ভাষাটাও ভাঙা ভাঙা বলার চেষ্টা করে। ‘ভক্তিমার্গই একদম সমার্গ—সত্যপথ! ভক্তিভরে ঈশ্বরকা ভজনা করো, জরুর দর্শন মিলেগা।’

পটলা বলে—মহারাজ, আপনি ঈশ্বরকে দেখেছেন?

অবশ্য ভদ্রলোকের পরনে সাদা ধুতি, শার্ট। সঙ্গে একজন বছর বাইশের ছেলে। মহারাজের বেশও নয়। তবু পটলা তাকে মহারাজ বলে।

ভদ্রলোক বলে, কৌশিশ করছি বেটা! সব্ তাঁরই লীলা! জয় সীয়ারাম-

ট্রেন তখন ছুটে চলেছে। খড়্গপুর ছাড়িয়ে শালবনের সীমা শুরু হয়েছে। রাতের অন্ধকারে বন কালো রেখার মতো দেখায়। ওদিকে বসে আছে আর এক ভদ্রলোক। জীর্ণ লম্বাটে চেহারা। টিকালো নাক, চোখ দুটোও বড় বড়। সব দেখছে সে। আর কান খাড়া করে মহারাজের মূল্যবান ভাষণ শুনছে। সঙ্গে তার স্ত্রী আর ছোট ছেলে। ওরা যে ঈশ্বরের কথায় তত বিশ্বাসী নয় তা বোঝা গেল।

এবার মহারাজ তার পোঁটলা থেকে একটা বড় সাইজের টিফিন বাক্স বের করে। তাতে দেখা যায় কড়াইশুঁটির কচুরি, আলুভাজা, নতুন গুড়ের পায়েস আর বেশ বড় সাইজের কালাকাঁদ। হোঁৎকা একটু বেশি পেটুক। সে এবার এইসব খাবার দেখে মহারাজের শ্রীচরণে মণপ্রাণ ঢেলে দেয়। বলে, আপনি সাক্ষাৎ দেবতা, মহারাজ !

ভদ্রলোক ঈষৎ হেসে বলে—নেহি নেহি, আরে আমি তো সেবক আছি। এ তিওয়ারি, ইন লোগোকো প্রসাদ দো-

তিওয়ারিও এক টুকরো খবরের কাগজে দুটো কচুরি, আলুভাজা, এক হাতা পায়েস আর দুটো কালাকাঁদ দেয়। মহারাজ বলে, বাবাজিকা প্রসাদ, লেও বেটা–

বেশ তৃপ্তিভরে এবং ভক্তিভরে হোঁৎকা সেই খাবার খায়।

ট্রেন তখন বক্সার পার করে ঘড়িবাড়ির দিকে চলেছে। অন্ধকারের বুক চিরে ট্রেন ছুটছে। আশপাশের যাত্রীরা ঘুমিয়ে পড়েছে। পটলা স্বপ্ন দেখছে সারান্দার গভীর বনে সে আর হোঁৎকা চলেছে। ছায়াঘন অরণ্য-পাহাড় বেষ্টিত পথ। সাবধানে পা ফেলে চলেছে তারা বনের পথে। হঠাৎ গা-ছমছম করা স্তব্ধতা ভেদ করে ওঠে হাতির চিৎকার। একপাল হাতি এদিকেই আসছে ডালপালা ভাঙতে ভাঙতে। ওরা দুজনে সামনের দিকে জঙ্গল ভেঙে ছোটার চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। ছিটকে পড়ে। পায়ে কাঁটা ফুটেছে। এদিকে সামনে হাতির পাল। পটলা চিৎকার করে উঠে বসে। তারপরই সদ্য ঘুমভাঙা চোখে দেখছে আশপাশ।

ট্রেনের বার্থে শুয়েছিল সে। রাতের অন্ধকারও আর নেই। ট্রেনটা প্রায় খালি হয়ে গেছে। সেই শীর্ণকায় লম্বা লোকটা ওর পা ধরে নাড়া দিচ্ছে। পটলা চোখ চাইতে বলে, লাস্ট স্টেশন এসে গেল! বলছিলে এখানে নামবে! গাড়ি তো এখানেই থেমে যাবে। আবার একঘণ্টা পর ফিরে যাবে।

পটলার খেয়াল হয়। এত ঘুম ঘুমিয়েছিল টেরই পায়নি। হোঁৎকা এখনও ঘুমোচ্ছে। পটলা হোঁৎকাকে ডাকে, অ্যাই হোঁৎকা, আর কত ঘুমোবি ? ওঠ-এবার নামতে হবে। ওঠ।

ঠেলাঠেলি করেও হোঁৎকাকে জাগানো যায় না। তারপর জোরে ধাক্কা দিতে হোঁৎকা এবার ধড়মড় করে উঠে বসে। গাড়ি তখন শেষ স্টেশনে ইন করছে। ওরা মালপত্র নামাতে গিয়ে শেখ যেখানে তাদের ব্যাগপত্র রেখেছিল সেই জায়গাটা খালি। চারটে ছোট-বড় ব্যাগের একটাও নেই। যে ব্যাগটা মাথায় দিয়েছিল, মাত্র সেটাই আছে।

পটলা চমকে ওঠে—আমাদের ব্যাগ?

সেই লোকটা নামতে নামতে বলে—তোমাদের ব্যাগ? ওসব তো ওই মহারাজের ব্যাগ? ওরা তো সব নিয়ে টাটানগরে নেমে চলে গেছে।

হোঁৎকা বলে—বুঝেছি! ক্যান এত ঘুমাইছি! মাদক মেশানো খাবার খাইয়াই ক্যামন ঘুম আইল! এহনও যাইত্যাছে না-

পটলা বলে—এখন কী হবে?

ওরা প্লাটফর্মে নেমেছে। এবার ভালো করে দেখে স্টেশনটাকে। উঁচু প্লাটফর্মও নেই । ওদিকেই একটা পাহাড়। পাহাড়টা যেন এখানেই শেষ হয়ে গেছে। তাতে শাল, মহুয়া নানান গাছে ভরা। নির্জন স্টেশনে ট্রেনটা দম নিচ্ছে। দিনের আলো থাকতে থাকতে এই জায়গা থেকে সে পালাবে ।

চারদিকে পাহাড় আর সবুজের কলরব। বনভূমি। ওদিকে স্টেশনের বাইরে দু-একটা ঝুপড়ির দোকান। ওদিকে কাঠের স্তূপ। দু-একটা ট্রাকও দেখা যায়। হোঁৎকা বলে, সবই তো গেছে গিয়া, চল, আমরাও ফিইর্যা যাই। পকেটে যা আছে তাতে ফেরার ভাড়া হই যাবে ।

কিন্তু ওই বনভূমি, রহস্যভরা পাহাড় যেন পটলাকে টানে। সে বলে, আমার কাছে কিছু টাকা আরও আছে। দু’খানা জামা-প্যান্টও। এসেছি যখন বনবাংলোতে চল। ফিরে গেলে ওরা সবাই হাসবে।

তা সত্যি! প্রসাদ খেয়ে এমনভাবে সব হারাতে হবে তা ভাবেনি হোঁৎকা।

হোঁৎকা বলে—মহারাজ নয়, ও ব্যাটা মহাচোর! কান মইল্যা সব লইয়া গেছে গিয়া । পটলা বলে—তবু আমাদের থামাতে পারবে না! দেখি বনবাংলো যাবার কোনো কিছু পাই

কিনা !

হোঁৎকা বলে—ওই ঝুপড়ির দোকানে চল। বনে কী পাবি কে জানে! কিছু খাই লইতে হইব যাবার আগে।

স্টেশনের বাইরে উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ। দূরে একটা আলোর মতো দেখা যায়।

পাহাড় এখানে চারদিকে। মধ্যে একটু উপত্যকার মতো। নিচু জায়গাতে সামান্য চাষবাস হয়। ছোট্ট নদীটা ওই পাহাড়ের দিক থেকে এসে উপত্যকার মধ্যে দিয়ে ঘুরে আবার এদিকে পাহাড়শ্রেণির কোন গলিপথে হারিয়ে গেছে। এই নদীর ধারে গড়ে উঠেছে ঝুপড়িগুলো। ওদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে নানা সাইজের কাঠের গুঁড়ির টাল। বন থেকে নানা ধরনের কাঠ আসে। এখান থেকে ট্রেনে, ট্রাকে উঠে শহরে, কল-কারখানায় চলে যায়। বন থেকে কাঠ এনে এখানে ড্রাইভাররা মাল খালাস করে আবার বনের গভীরে ফিরে যায় কাঠ আনার জন্য। নদীর জলে ড্রাইভাররা গাড়িগুলোকে ধুয়ে নেয়। নিজেরা জিরিয়ে নিয়ে রুটি-তড়কা খেয়ে আবার বনে ফেরে। তাই দু-চারটে ঝুপড়ির দোকানও গড়ে উঠেছে। হোঁৎকা-পটলার খিদেও পেয়েছে। তার ওদিকে যাও। বন-বাংলোতে যাবার ট্রাকগুলো ওখানের গেটেই থামে। ওখানে গেলে

সর্দারজিকে পাবে।

পটলা-হোঁৎকা খুঁজে খুঁজে সেই গেটেই পৌঁছয়। কয়েকটা ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে খাটে বসে ড্রাইভাররা রুটি-তড়কা খাচ্ছে। পটলা-হোঁৎকা ওদেরই জিজ্ঞাসা করে, থলকোবাদ ফরেস্ট বাংলোয় যাব আমরা। কোনো ট্রাক মিলবে?

সর্দারজি তখন তড়কার মধ্যে থাকা একটা কাঁচালঙ্কা চিবিয়েছে। আর বুনো কাঁচালঙ্কা তেমনি ঝাল। ঝালের চোটে তখন তার অবস্থা কাহিল। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই সে। হুস হাস করছে। লালা ঝরছে ঝালের চোটে। ওর হেল্পার খালাসিরা বেগতিক দেখে পটলাদের বলে, ওস্তাদকো তন্ মত্ করো? চলো হামিসে বাত করবে।

ওকে থলকোবাদে নিয়ে যাবার কথা বলতে খালাসিটা জানায়, দো আদমি তিস রুপেয়া লাগবে।

পটলা বলে—অনেক বেশি বলছ তুমি।

দুসরা কোই ট্রাকসে যাইয়ে! খালাসি নির্বিকার চিত্তে জবাব দেয়। কারণ সে জানে ওখানে যাবার আর অন্য কোনো গাড়ি নেই। ওদেরও যেতে হবে। শেষে দরদস্তুর করে দুজনের পঁচিশ টাকায় রফা হয়। এবার ড্রাইভারও লঙ্কার ঝাল সামলে নিয়ে বলে, কাঁহা রুপেয়া? অর্থাৎ ভাড়াটা আগামই দিতে হবে। টাকা দিয়ে দেয় পটলা।

খালাসি বলে-আধাঘণ্টার মধ্যে তৈয়ার হো যাইয়ে, গাড়ি ছেড়ে দেবে।

বেলা তখন বারোটা প্রায়। বনে কী জুটবে জানা নেই। তাই ওই তড়কা-রুটি খেয়ে নিয়ে ট্রাকে ওঠে। আর ট্রাকও চলতে শুরু করে। ফাঁকা প্রান্তর ছাড়িয়ে ট্রাকটা এবার বন-পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। রাস্তা বলতে মোরাম ফেলা বনবিভাগের অস্থায়ী রাস্তার মতো কিছুটা। শীতের মরশুমে বনে পারমিট দিয়ে গাছ কাটানো হয়। সেইসব লগ বের করার জন্য অস্থায়ী পথও চাই। বর্ষার জলে তা মুছে যায়। সেই এবড়ো-খেবড়ো পথ দিয়ে ট্রাক চলেছে। আর পটলা-হোঁৎকা যেন ট্রাকের পিছনে ফুটন্ত কড়াই-এর জলে আলু-পটল সিদ্ধ করার মতো লাফালাফি করছে। এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ছে। আর সেই কষ্টকে ভোলার জন্য পটলা গান শুরু করেছে, আমাদের যাত্রা হল শুরু এবার ওগো কর্ণধার !

হোঁৎকা একটা রড ধরে কোনোমতে স্থির হয়ে বসে থাকার চেষ্টা করছে। দু’দিকে গভীর বন। পুরুষ্টু শাল-গামহার-শিয়াশাল, আরও নানা গাছের ঘন সমাবেশ। বন ক্রমশ গভীরতর হয়েছে। রোদ এখানে একচিলতে কোনোমতে আসে। ঘন সন্নিবেশিত গাছগুলো। সবাই এখানে ভিড় ঠেলে মাথা আকাশের দিকে তুলে সূর্যের আলোর প্রত্যাশী। প্রতিযোগিতা চলছে সবার মধ্যে। হঠাৎ গাছের ঘন ডালে একটা কিসের শব্দ শুনে হোঁৎকা গাছের উপরের দিকে চাইল। দেখে একটা বিরাট ময়ূর এদের ট্রাকের আওয়াজ শুনে ভারী দেহ নিয়ে উড়ে গেল আড়ালে। হোঁৎকা বলে ওঠে—দেখছিস্! একখান ময়ূর।

ট্রাকের সামনের রাস্তায় দুটো হরিণ নিমেষের মধ্যে লাফ দিয়ে রাস্তা পার হয়ে বনের গভীরে হারিয়ে যায়। পিছনে শোনা যায় একটা চাপা গর্জন। কোনো লোভী হায়না শিকার হারাবার রাগে গর্গর্ করছে। আতঙ্ক জাগে ওদের মনে। এই বন যেন কেমন রহস্যে ভরা।

ট্রাকটা পাহাড়ের নীচে একদিকে এসেছে। সামনেই একটা পাহাড়ি নদী। জল বেশি না। তার চেয়ে বেশি রয়েছে পাঁক-কাদা। দুটো পাহাড়শ্রেণির মাঝে একটা জলনিকাশি ঝোরা। গাড়িটা কাদায় নেমেই আটকে গেছে। গিয়ারি দিয়ে গাড়ি তোলার চেষ্টা করছে। গাড়ি নড়ে না । ড্রাইভার চেষ্টা করে গাড়ি যেন জগদ্দল পাথরের মতো বসে গেছে। পটলা তখনও প্রকৃতির প্রেমে মশগুল হয়ে গাইছে—‘আমি চঞ্চল হে, সুদূরের পিয়াসী।’

হঠাৎ খালাসির তীব্র কণ্ঠে গর্জন শুনে থামল সে। খালাসি চিৎকার করে,– আবে কিশোরকা বাচ্চা! গানা ছোড়কে হাত লাগাও ।

ওদের হাঁক-ডাকে পটলা নামে ট্রাক থেকে। আর ড্রাইভারও গাড়ি তোলার চেষ্টা করছে। এরাও ঠেলে প্রাণপণে। সকলের ঠেলায় গাড়ি একটু এগোচ্ছে তারপর আবার পিছনে গড়িয়ে আসছে। আর কাদা-জল ছিটকে আসছে। এ জলের রং লালচে। আর সেই জল-কাদা সারা গায়ে-মুখে লাগে পটলা আর হোঁৎকার। ওদের আর চেনা যায় না। ঠেলেঠুলে গাড়ি স্টার্ট হল। ঝোরার জলে কাদা-মাটি ধুয়ে ভিজে শার্ট-প্যান্ট পরেই ট্রাকে উঠল।

পটলা বলে—আর কাদা মেখে গাড়ি ঠেলব না । হোঁৎকা বলে—টাকা দিচ্ছি, গাড়ি ঠেলুম ক্যান্ খালাসি বলে–তব উতর যাও। পায়দল যাও !

এই গভীর গহন বনে সেটা সম্ভব নয়। তাই কাদা মুছে আবার ট্রাকে ওঠে পরবর্তী কোনো ঝোরার বুক থেকে গাড়ি ঠেলে তোলার জন্য তৈরি হয়ে।

বেলাও বাড়ছে। ট্রাক চলেছে গুড় গুড় করে বনের পথে। এই পথের যেন শেষ নেই। হোঁৎকা শুধোয়, থলকোবাদ আর কদ্দুর ?

হঠাৎ শান্ত বনের মধ্যে ওঠে ঝড়ের শব্দ। মড়মড় করে ডালপালা ভাঙছে। ওদিক থেকে একটা তীক্ষ্ণ ডাক আসে। সামনের পথটায় দেখা যায় বনের একটা অংশ। চাতাল মতো। গাছপালা এখানে কম। দু’দিকেই বনভূমি। মাঝের জায়গাটায় দেখা যায় বনের ওদিক থেকে একপাল হাতি আসছে। হোঁৎকা অস্ফুট আর্তনাদ করে, পালা, হাতি—

খালাসি ওকে ইশারায় চুপ করতে বলে। আর ড্রাইভারও ইঞ্জিন বন্ধ করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হাতির পাল প্রায় চল্লিশ গজ দূরে। একটা বিরাট দাঁতাল হাতি ট্রাকটা দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানেই। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গর্জন করে তীব্রকণ্ঠে আর থামের মতো পা ঠুকতে থাকে। যেন শাসাচ্ছে এদের। তবে কেউ এসে আক্রমণ করে না। ওদিকে হাতির পাল একে একে পার হয়ে এদিকের বনে যেতে সেই দাঁতাল হাতিও এবার পিছু পিছু বনে যায় ।

পটলা-হোঁৎকা এতক্ষণ দম বন্ধ করে ছিল। হাতিগুলো চলে যেতে খালাসি বলে, ওদের কোনো লুকসান না করলে ওরাও কোনো লুকসান করে না ।

হোঁৎকা বলে—ই কোথায় আইছিস রে, পটলা? বন দেইখ্যা কাম নাই। চল, ফিরে চল। ফেরার পথও আর নেই। এখন বনবাংলোতেই যেতে হবে। তারপর ওখানে গিয়ে ফেরার কথা ভাবা যাবে।

থলকোবাদ বনবাংলো বনের গভীরে গড়ে উঠেছে ব্রিটিশদের আমল থেকেই। বনের মধ্যে এত বড় বনবিভাগের নানা ধরনের কাজ চালাবার জন্য, নতুন বনাঞ্চল তৈরির জন্য, পথঘাট তৈরির জন্য এবং বনের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বেশ বড় একটা ফরেস্ট কলোনিও আছে। রেঞ্জার, অন্য স্টাফদের কোয়ার্টার, অফিস, পশু চিকিৎসালয় সবই আছে। আর এখানেই গড়ে উঠেছে আদিবাসীদের বড়সড় জনপদ। প্রাইমারি স্কুল, গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র সবই আছে। আর সপ্তাহে দু’দিন এই বনের গহনেও হাট বসে। এই সবকিছু থেকে একটু দূরে পাহাড়ের উপর গড়ে উঠেছে সুন্দর বাংলো। বেশ কয়েকটা ঘর রয়েছে। লাগোয়া বাথ-রুম। পাহাড়টা ঘিরে বয়ে গেছে একটা ছোট পাহাড়ি ঝোরা। হাঁটুভোর জল থাকে। তার উপর একটা কাঠের ব্রিজমতো আছে। সেই ব্রিজ পার হয়ে পাহাড়ের গায়ে চড়াই ভেঙে রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে। গাড়ি উঠে যায় উপরে। বাংলোর সামনে এদিক-ওদিক সুন্দর সাজানো বাগান। আর পাহাড়ের গায়ে কার্নিশ বের করে কাঠের তক্তা দিয়ে বসার ব্যবস্থাও আছে। দীর্ঘ শাল গাছ-গুলোর মাথা এসে পায়ে ঠেকে। আর কানে আসে প্রবহমান ঝোরার কলকল শব্দ ।

মাঝে মাঝেই তাই অরণ্যপ্রেমীদের অনেকেই পারমিট নিয়ে চলে আসে এখানে। বনের গভীরে রয়েছে লিগিবদা ওয়াচ টাওয়ার। গহন বনের মধ্যে ঝোরার জল বইছে। ঝোরার ধারে গাছের ডালে চটের থলেতে নুন টাঙানো। বনবিভাগ থেকে ওগুলো টাঙিয়ে রাখা হয়। বন্যপ্রাণীরা এসে নুন খায়। জল খায়। কাদায় ঘাসে লুটোপুটি খায়। ওয়াচ টাওয়ার থেকে তাদের দেখা যায়। প্রথমে আসে রাতের অন্ধকারে তৃণভোজী প্রাণীরা। হাতি, বাইসন, হরিণ, সম্বর ইত্যাদি। আর বনের রাজা বাঘ যখন আসে তখন এরা সরে যায়। নীলাভ চোখের দৃষ্টি নিয়ে বনের ভিতর থেকে বের হয়। বাতাসে ওঠে উৎকট গন্ধ। শিকারের সন্ধানে ঘোরে। বন্য জীবনের বহু বৈচিত্র্যও দেখা যায় এখানে।

ভূধর বিশ্বাস কলকাতায় থাকে। তার কাঠের ব্যবসা রয়েছে নিমতলার ওদিকে। ভূধরের কাঠের ব্যবসা ওর বাবা তাঁর বন্ধু অজয় সেনের সঙ্গে শুরু করেছিলেন। আজ অজয়বাবুর বয়স হয়েছে। স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। ওঁদের কোনো ছেলেপুলে নেই। বালিগঞ্জ এলাকায় বিশাল বাগানঘেরা বাড়ি। আরও কীসব ব্যবসা আছে। অজয়বাবু, তাঁর স্ত্রী মানসী দেবী ওঁদের বন্ধুর ছেলে ভূধরকে ছেলেবেলা থেকেই দেখছেন। তাকে স্নেহ করেন। তবে অজয় সেন ঠিক করেছেন কাঠের ব্যবসাটা ভূধরকে দিয়ে যাবেন, আর বালিগঞ্জের বাড়ি ও অন্যসব ব্যবসা কোনো ধর্মীয় সংস্থাকে দান করে দেবেন। তাঁর ইচ্ছা মিশনকে এসব দান করলে এই অর্থ সৎকাজেই লাগবে ।

ভূধর এসব শোনে মাত্র। সে এখন কাঠের ব্যবসা চালাচ্ছে। বাইরে থেকে বন ইজারা নিয়ে শাল, সেগুন, আরও নানা কাঠ আমদানি করে। তবে ভূধরের নজর অজয়বাবুর সাম্রাজ্যের দিকে। যেভাবে হোক এসব সেই-ই দখল করবে। তবে ভূধর খুবই সাবধানী আর চতুর। তাই এসব মনের কথা ভুলেও অজয়ববুর কাছে প্রকাশ করে না। বরং বলে, তাই ভালো কাকাবাবু, মিশনের হতে এসব তুলে দিলে সৎকাজে লাগবে।

অজয়বাবুর বয়স হয়েছে। স্ত্রী মানসী দেবীও সংসার ছেড়ে দূরে গিয়ে ঠাকুরের নাম করতে চান। তাই ভূধর বলে, কাকাবাবু, আমি তো বনে যাই কাঠের ব্যবসার জন্য। চলুন, বনে সুন্দর ফরেস্ট বাংলো আছে। সেখানে থেকে নিরিবিলিতে ঈশ্বরকে ডাকবেন। মুনি-ঋষিরা তো বনে থেকেই ঈশ্বর সাধনা করেন।

কথাটা অজয়বাবুর মনে ধরে। মানসীও বলেন, তাই চলো, কিছুদিন বনবাসেই থেকে আসা যাক।

ভূধর মনস্থির করেছে বনে নিয়ে গিয়ে কোনোমতে এদের দিয়ে বিষয়-সম্পত্তি লিখিয়ে নেবার একটা মরিয়া চেষ্টাই করবে।

ভূধর বনে-পাহাড়ে আসে। শহরের মানুষ। বন সম্বন্ধে, বন্যপ্রাণী সম্বন্ধে বিশেষ করে বাঘ-হাতি সম্বন্ধে তার ভয় আছে। তবে টাকার জন্য সে সবই করতে পারে। বনজগতেও সাধারণ সহজ-সরল আদিবাসীদের মধ্যে থেকে সে বেশকিছু অন্য প্রকৃতির মানুষকে খুঁজে বের করেছে। তাদের টাকা দিয়ে সে তার কাজগুলো করায়। গাছ কাটার জন্য বনবিভাগকে টাকা দিয়ে পারমিট নিতে হয়। বনবিভাগের কর্মীরা কোন গাছ কাটা হবে তার নির্দেশ দিয়ে সেইসব গাছে হলুদ রং-এর ছাপ দিয়ে দেয়। কী পরিমাণ গাছ কাটা হবে তারও নির্দেশ থাকে। ভূধরদের খেলা শুরু হয় এরপর। বনবিভাগের কর্মীদের ম্যানেজ করে আরও বেশি পরিমাণ গাছ কাটাই করে। একই পারমিট তিনবার-চারবার দেখিয়ে তিন-চার গুণ কাঠ কাটাই করে বনকে ধ্বংস করে। আর কিছু আদিবাসী চোরাশিকারিদের টাকা দিয়ে রেখেছে। তারা বন্যপ্রাণী মেরে হাতির দাঁত, বাঘের চামড়া, হরিণের শিং এসব সংগ্রহ করে। ভূধর তার কাঠের চালানের সঙ্গে এসব কলকাতায় পাচার করে, যা থেকে তার লাখ লাখ টাকা আমদানি। তবে বাইরে থেকে ভূধরকে দেখলে কিচ্ছুটি বোঝা যাবে না।

এসব ছাড়াও এবার ভূধর অজয়বাবুর সম্পদ দখল করার জন্যই তাঁকে সস্ত্রীক টানা গাড়িতে করে এই গভীর বনের মধ্যে বাংলোয় এনেছে। অজয়বাবু, মানসীদেবী শহরের ভিড় থেকে দূর নির্জনে এই বনবাংলোয় এসে খুশিই হন। তবে সবকিছু তো একসঙ্গে মেলে না। বাংলোয় ওঁরা বাইরে থেকে চাল, ডাল, তেল, ঘি, মালপত্র, মাছ, সবই এনেছেন। এখানের বাংলোয় কাজের লোকের বড় অভাব। হতদরিদ্র এই আদিবাসীরা ভাত খেতে পায় পাঁচ-সাতদিন অন্তর। এদের খাদ্য বলতে কন্দমূল সিদ্ধ, মকাই সিদ্ধ, বন্য লতাপাতা নুন দিয়ে ঘাঁটা । আনাজপত্র ভালো রাঁধতেও জানে না। বেগুন পোড়া, শাকসিদ্ধ ইত্যাদিই খায়। তাই রান্না করার লোক এখানে তেমন মেলে না। অজয়বাবু দেখেন ওদের খাবার দিয়ে গেল কোনোরকমে—গলা ভাত, আলুপোড়া, বেগুন পোড়া। ডাল যা করেছে তা ভাতের মতো জমাট। তাতে নুনও নেই। সেইসঙ্গে খানিকটা ধানিলঙ্কা পুড়িয়ে দিয়েছে। মেনু দেখে মানসী চমকে ওঠেন।

একি! এই আধপোড়া পিণ্ডি খেতে হবে? ও ভূধর !

ভূধর এখানে এসে তার নিজের একনম্বরী আর দু’নম্বরী ব্যবসার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে। কোনো দু’নম্বরী একট্রাক মাল গেছে স্টেশন বাজারে মহাজনের কাছে। অনেক টাকার মাল। এখনও ওরা ফেরেনি। ট্রাকওয়ালার কাছে যেতে হবে টাকা আনতে। ভূধর বলে—তাই তো শ্বেছি! বাংলোয় কাজ করার, রান্না করার লোকও পাচ্ছি না ।

অজয়বাবু বলেন—অনেক তো খুঁজলে? এবার আমি নিজে খুঁজে দেখি যদি বাংলো কাজের জন্য কোনো লোক পাই কিনা। বাংলোয় একজন কাজ জানা বেয়ারা চাই।

মানসী বলেন—এই বনমানুষদের মধ্যে এমন লোক পাবে না। নিজেদেরই এখানে দেখছি হাত পুড়িয়ে রাঁধতে হবে। কাজকর্মও করতে হবে।

ভূধর দায়িত্ব এড়াতে চায়। সে বলে-তাই দেখুন। যদি কোনো কাজের লোক পান! রান্না-বান্না তো করতে হবে! নাহলে যে উপোস দিতে হবে।

ওদিকে ট্রাক ফেরার সময় হচ্ছে। ভূধর বলে, আমার কাজ আছে। আমি চলি, কাকাবাবু ! ভূধর জিপ নিয়ে চলে যায় ।

বনের মাঝখানে চেক পোস্ট। একটা খুঁটি পোঁতা। তাতে একটা খুঁটি আড়াআড়িভাবে লাগানো। কোনো গাড়ি এলে বনবিভাগের লোকরা তা চেক করে দড়ি খুলে দেয়। বাঁশটা উঠে যায়। পথও পরিষ্কার হয়ে যায়। গাড়ি চলে যেতে বাঁশ আবার নেমে যায়। এত পাহারা দেবার কারণ বনবিভাগের অগোচরে যাতে কোনো বে-আইনি কাজ না হয় !

ভূধর না খেয়েই বের হয়ে যায়! মানসী অজয়বাবুকে বলেন, তুমি খাবে না?

অজয়বাবু বলেন—দেখি, কাজের লোক যদি পাই তখন খাব। ওই চাল সিদ্ধ আর বেগুন পোড়া আদিবাসীদেরই দিয়ে দাও। আমি বরং চিঁড়ে-মুড়ি খেয়েই থাকব। লোক আমি জোগাড় করবই। বের হয়ে যান অজয়বাবু ফরেস্ট কলোনির দিকে কাজের লোকের সন্ধানে।

ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত পটলা-হোঁৎকা ট্রাকে বসে আছে। পথের জমা জল-কাদা সারা শরীরে ভর্তি হয়ে আছে। মুখে-চোখে ক্লান্তির ছাপ। আর জনহীন বনে হাতির পাল দেখেই ওরা খানিকটা ঘাবড়ে গেছে। ফরেস্টে যে কখন কী ঘটে তা ওরা বুঝেছে।

হঠাৎ বনের মধ্যে একটা জিপ আসতে দেখে ট্রাকটা থামে। জিপটাও এসে থামে ট্রাকের কাছে। ট্রাক থেকে দেখে পটলা-হোঁৎকা, ড্রাইভার তার সিটের নীচ থেকে একটা টাকার থলে নিয়ে এগিয়ে গেল জিপের আরোহীর দিকে। টাকার থলেটা সেই তরুণের হাতে দিয়ে বলে, মহাজন দিয়া। অউর বোলা, উড্ অউর দো ট্রাক চাহিয়ে, অউর দো শের কা চামড়া, হাতি কা দাঁত ভি।

পটলা-হোঁৎকা ট্রাকে বসে শুনছে ওদের কথা। জিপের সেই তরুণ বলে, কাঠ কাল দো ট্রাকই যায়েগা। তুম্ রাত কো জঙ্গলমে আও সর্দারজি!

এই বলে তার হাতের থলে থেকে একমুঠো টাকা ড্রাইভারের হাতে দিয়ে জিপে উঠে বলে, চলি, রাতে ভেট হোগা ৷ হুঁশিয়ার !

জিপটা চলে যায়! ট্রাকটাও এবার বনের রাস্তা দিয়ে চলে গেল। একটা জায়গায় এসে থামে। খালাসি বলে, যাও, থলকোবাদ আ গিয়া! ফরেস্ট বাংলো উধার! উ টিলাকা উপর।

জায়গাটা এক নজর দেখে ভালোই লাগে। চারদিকে গভীর বনে ঢাকা আদিম রহস্যময় পাহাড়। এই উপত্যকাতে কিছু ঘর-বাড়ি—জমিজিরাতও আছে। সামান্য চাষবাসও হয় । পাহাড়ের গায়ে একটা সুন্দর ছোট্ট বাংলো। কে বলে—ওটা নিখিল সাহেবের বাংলো। আজীব সে আদমি। এই বনের তিনি ছিলেন বড়কর্তা। রিটায়ার করার পর একাই এই বনে থেকে গেছিলেন। আদিবাসীদের মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন, আর ভালোবাসেন এই অরণ্যকে।

হোঁৎকা বলে—নিখিল সাহেব নয়, ওঁর নাম হওয়া উচিত বুনো সাহেব, নাহলে এই গভীর বনে কেউ পড়ে থাকে? চল গিয়া বনবাংলোর দিকে—

দূর থেকে দেখা যায় সেই টিলার উপর গাছ-গাছালি ঘেরা ছবির মতো বাংলোটাকে। পটলা বলে—দারুণ সিনসিনারি!

হোঁৎকা বলে—প্যাট ভরবো সিনসিনারি দেইখ্যা? ইখানে দোকান বলতে তো ওই মুদির দোকান একটা! খাওনের কী হইব?

পটলা বলে—চল দেখি, বাংলোর চৌকিদার কিছু দিতে পারে।

ওরা আসছে দুজনে। জামা-প্যান্টে কাদা-জলের শুকনো ছাপ। আর একদিনের জল-কাদাতেই কলকাতার ভদ্র ছাপটা মুছে গেছে।

অ্যাই শোনো, শুনছো? এই ছোকরারা?

এই পরিবেশে হঠাৎ ওই ডাক শুনে পটলা-হোঁৎকা দুজনেই চাইল। দেখে ওদিক থেকে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ওদের দিকে এগিয়ে আসছেন।

পটলা বলে—আমাদের বলছেন?

ভদ্রলোক কাছে এসে দুজনকে আপাদমস্তক যেন জরিপ করে দেখছেন। পটলা-হোঁৎকা দুজনের অবস্থাই শোচনীয়। বেশ বুঝেছে তারা হুট করে খাবার না নিয়ে এখানে এসে ঠিক করেনি। পকেটটার অবস্থাও বিশেষ ভালো না। এখানে থাকার খরচা দিয়ে খাবার পয়সাও দু’দিনের জন্যও থাকবে না। আর ফিরবে কী করে সেটাও ভাবেনি তারা।

ভদ্রলোক শুধোন—কী করা হয় কাজকর্ম ?

পটলার মুখে যেন কথাটা এসে যায়—জামশেদপুরে একটা হোটেলে কাজ করি দুজনে। এদিকে এসেছি।

ভদ্রলোক যেন হাতে চাঁদ পান। বলেন—অ্যাঁ, হোটেলে কাজ করো দুজনেই।

হোঁৎকা বলে—হঃ বয়-বেয়ারার কাজ! ওখানে ভালো লাগত্যাছে না। তাই চ‍ইল্যা আইলাম ।

অজয়বাবুও বলেন—গুড়! ভেরি গুড! তা এখানে কয়েকদিন আমরা ওই বনবাংলোয় আছি। চলো না ওখানে। মাত্র তিনজন আমরা। এখানে ওই আদিবাসীদের রান্না ঠিকমতো পছন্দ হচ্ছে না। একটু কুকিং-এর কাজ আর তুমি বেয়ারার কাজই করে দেবে। ওখানেই থাকবে খাবে-দাবেও আমাদের সঙ্গে। আর ডেলি দুজনে একশো টাকা করেও পাবে। কাজ খুব সামান্যই। ডেলি দুজনে দুশো টাকা। এছাড়া থাকা-খাওয়া!

পটলা কোনোদিন এসব কাজ করেনি। তাদের বাড়িতে, তাদের কারখানায় এমন কত লোকই কাজ করে। এই বনে এসেছে বেড়াতে। তাকে যে এরকম বেয়ারার কাজ করতে হবে তা ভাবেনি। হোঁৎকা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সে টুকটাক বাড়ির কাজও করে। এখানে এসে বিপদেই পড়েছে। তবু ক’দিন আহার-আশ্রয় পাবে। আর দিনে দুশো টাকা করে পাবে। ওদের খরচা করতেও হবে না। পটলা কিছু বলার আগেই হোঁৎকা বলে, আপনি বুড়া মানুষ, বনবাংলোয় এসে বিপদে পড়েছেন দেহি !

অজয়বাবু বলেন—সত্যি বড় বিপদে পড়েছি হে! দিন পাঁচ-সাত থাকব ।

হোঁৎকা বলে—ঠিক আছে, আপনি যহন কইছেন—কইর‍্যা দিমু। বয়-বেয়ারার কাজ সব জানি আমরা।

গুড! তাহলে চলো বাংলোয় ! অজয়বাবু তাদের নিয়ে এবার পথের ধারে কাঠের ব্রিজ পার হয়ে টিলার উপর উঠতে থাকেন।

হোঁৎকা পটলাকে বলে—চল, সব ঠিকঠাকই হইব।

বাংলোতে মানসী একা। তিনিও ভাবনাতে পড়েছেন কাজের লোকের জন্য। এই বনবাংলোতে এসে হাঁপিয়েও উঠেছেন। কোথাও যাবার উপায় নেই। টিভি-রেডিও-সিনেমা নেই। সন্ধ্যা থেকে নামে আদিম অন্ধকার। তখন বাংলোর বাইরে থাকাও নিরাপদ নয়। গত রাত্রেই তো হাতির পাল এসে বাগানের সাজানো বাহারি ফুলের টবগুলোকে নিয়ে ফুটবল খেলে গেছে। সেদিন রাতে একটা সাবধানী চিতাকে আসতে দেখেছিলেন। মাঝে মাঝে হায়নার দলও আসে। দাঁতাল শুয়োরও ঘোরাফেরা করে।

এই তো অবস্থা! তার উপর যদি রান্নার লোক, কাজের লোক না পান চলবে কী করে! ভূধর তো এখানে এসে বনে বনে ঘোরে। তার কাঠের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে রাতেও জিপ নিয়ে বের হয় ।

একাই রয়েছেন মানসী বাংলোতে। আশপাশে লোকজন আর কেউ নেই। পিছনেই গভীর জঙ্গল। যে কোনো মুহূর্তে ভালুক, হাতি চলে আসতে পারে। তাই দিন দুপুরেও তিনি দরজা বন্ধ করে আছেন ৷ বিশ্রী লাগছে এখানে। হঠাৎ কাদের কথা শুনে সাহসে ভর করে দরজা খুলে বের হয়ে দেখেন বিজয়ীর মতো ফিরছেন অজয়বাবু। সঙ্গে দুটি ছেলে। অজয়বাবু বলেন, গিনি নাও, তোমার জন্য এই যে হোটেলের ট্রেনড বেয়ারা এনেছি। এরমধ্যে অজয়বাবু এদের নাম ও জিজ্ঞাসা করেছেন ।

হোঁৎকাই বলে, এর নাম চঞ্চল গাঙ্গুলি, ব্রাহ্মণ। আমার নাম মঙ্গল দাস। আমরা হোটেল নন্দনে কাজ করতাম। ওখানে আমাদের চঙ্গু আর মঙ্গু বলেই ডাকতেন সবাই।

অজয়বাবু বলেন—গিন্নি, এ চঙ্গু আর এ মঙ্গু। জামশেদপুরের নামী হোটেলের স্টাফ। ক’দিনের জন্য বনে বেড়াতে এসেছে। আমি ধরে আনলাম। সব দেখিয়ে দাও এদের। চঙ্গু, আগে চা হোক। দেখি, চা কেমন করো!

মানসী দেখছেন ওদের। ওরা যে ক্লান্ত বিধ্বস্ত তা বুঝেছেন। মানসীর নিজের সন্তান নেই। ছেলে দুটোকে তাঁর ভালো লেগেছে। দুঃখও হয়, কাজের জন্য অসহায় দুটো ছেলে এই বনে ও এসেছে। মানসী বলেন—ওরা সবে এসেছে এতটা পথ, ওদের হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিতে দাও। আউট হাউসে গিয়ে জামা-প্যান্ট বদলাক, তারপর ওসব হবে। তারপর ওদের বলেন—ওদিকে তোমাদের থাকার ঘর। ওখানে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নাও। জল-টল খেয়ে কাজ করবে।

পটলা-হোঁৎকারা এইসব প্যাঁচ-এর ব্যাপার দেখে বেশ চমকে উঠেছে। এবার আউট হাউসে এসে পটলা বলে,—এটা কী করলি? বেড়াতে এসে চাকরগিরি করতে হবে?

হোঁৎকা বলে—নিজেদের পকেট তো গড়ের মাঠ! থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা না করলে এখানে থাকা যাবে না। বাঘ-হাতিতেই শেষ কইরা দিবে। তাই কইত্যাসি, তুই ভাবিস না। আমিই ম্যাজে কইরা দিমু। তোরে কিছু করতে হইব না ।

পটলা গজগজ করে—চঙ্গু-মঙ্গু হয়ে থাকতে হবে !

হোঁৎকা বলে–পুরুষের দশ দশা। কখনও হাতি, কখনও মশা। এহন না হয় মশা হইয়াই থাকি ফিরা গিয়া আবার হাতি হইব। চল, চা করছি। তুই কাপ-প্লেট গুলান ট্রেতে সাজাই ল । তার আগে পাঁউরুটি, মাখন, চিনি কলা, সন্দেশও আছে দেখি অনেক। খাইয়া ল—ক্ষুধা শান্ত হইলে মন-মেজাজও ঠাণ্ডা হইব ।

পটলা-হোঁৎকা এবার বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে উদর সেবা করে। বেশ বুঝেছে এখানে খাওয়া-দাওয়া ভালোই হবে। হোঁৎকা চায়ের আয়োজন করতে থাকে।

বিকালের দিকে ফিরেছে ভূধর। তবে তার দলবলকে খবর দিতে হবে। আজ রাতেই চোরা কাটাই হবে দক্ষিণের বনে। বিশাল একটা সেগুন গাছকে রাতারাতি কেটে টুকরো টুকরো করে চালান করে দিতে হবে। আর ডমরুকে বলতে হবে হাতির দাঁতের জন্য, বাঘের চামড়ার জন্য। এগুলো বেশ ভালো দামেই চালান হয়। লাখ লাখ টাকার ব্যাপার। ডমরু এই অঞ্চলের নামী চোরাশিকারি। তার দলে বাছা বাছা শিকারি আছে। ওরা বনের নানা প্রান্তে ঘোরে। সঙ্গে থাকে ছোরা, রাইফেল। তার গুলিতে হাতি-বাঘও লুটিয়ে পড়ে। ওরা কাজ শেষ করে হাতির দাঁত বাঘের চামড়া, হরিণের শিং নিয়েই সরে পড়ে। বনবিভাগের কর্তারা পরে মৃত জন্তুর দেহটা পায় আর ব্যাপারটা বুঝতে পারে।

এইভাবে একটা চক্র টাকার লোভে বনভূমির সবুজ বনসম্পদকে-বনের প্রাণীদের শেষ করে অরণ্যকেই নিঃশেষ করতে চায়। ভূধর তাদেরই একজন। তাদের অত্যাচারের কথা এখন কর্তারাও জেনেছেন। অপরাধীদের ধরার চেষ্টাও চলছে। তবে নানা কারণে তা আর হয়ে উঠছে না।

মিঃ নিখিল রায় ছিলেন ডিভিশন্যাল ফরেস্ট অফিসার। বনবিভাগের পদস্থ কর্তা। তিনি অরণ্যজগতেরই লোক হয়ে গেছেন। বন্যপ্রাণীদের ভালোবাসেন। বনে বনে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন আরণ্যক প্রাণীদের চরিত্রকে। বাঘ মাংসাশী প্রাণী। শিকার করে অন্য প্রাণীকে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রাণীকে সে মারে না। আর মানুষের লোভ অত্যন্ত বেশি। সে নিজের জন্য নয়, তার পরিবারের জন্য, তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও সঞ্চয় করে রাখে। তাই সবকিছু সে লুট করে নিতে চায়। পশুরা তা করে না। আর তাকে বিরক্ত না করলে সে অন্য প্রাণীকে আক্রমণও করে না। মানুষের এই সহাবস্থান নীতি নেই যা পশুর জগতে আছে।

নিখিলবাবু রিটায়ার করার পরও এই বনভূমিতে রয়ে গেছেন। স্ত্রী গত হয়েছেন। ছেলেরাও পড়াশুনা শেষ করে ভালো চাকরি করছে। তারা শহরে থাকে। নিখিলবাবু আর ফিরে যাননি। তিনি যখন যুবক ছিলেন তখন বন্যপ্রাণী শিকার বে-আইনি ছিল না। তখন তিনিও বাঘ, হরিণ, হাতি শিকার করেছেন। এখন তিনিই তাদের রক্ষার কাজ করেন

সাধ্যমতো।

বর্তমান রেঞ্জার মি. মিত্রও নিখিলবাবুর অধীনে কাজ করেছে। সেও ভদ্রলোককে তাই খুবই শ্রদ্ধা করে। কোনও পরামর্শের প্রয়োজন হলে ছুটে আসে নিখিলবাবুর কাছে। নিখিলবাবুর ঘরে দু’তিনটে বাঘের চামড়া ট্যান করে তার ভিতর খড়-তুলো ইত্যাদি পুরে পূর্ণসাইজের বাঘই বানিয়ে রাখা আছে। হঠাৎ কেউ ঘরে ঢুকলে তার মনে হবে আলোছায়ায় যেন জ্যান্ত বাঘই বসে আছে। দরজার উপর হরিণের মাথা। বাইসনের মাথাও আছে। নিখিলবাবু বলেন—অতীতের ভুলের চিহ্ন ওগুলো। আর রাইফেল চালানোও অনেকদিন আগে ছেড়ে দিয়েছি। তবে মনে হচ্ছে, ওগুলো আবার বের করতে হবে।

ইদানীং এই রেঞ্জে বেশ কিছু অন্ধকারের লোক গোপনে দামি গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। আবার বাঘ, হাতি, হরিণও শিকার করছে চামড়া, দাঁত পাবার আশায়। নিখিলবাবু বলেন, বনকে বাঁচাও, মিত্র। দ্যাখো, হয়তো সরষের মধ্যেই ভূত আছে। তাদের ধরার চেষ্টা করো। বাংলোর বাগানে বিকালের পড়ন্ত রোদ হলুদ আভা এনেছে। ওদিকে দূরে পাহাড়ের কোলে সূর্য অস্ত গেছে। পটলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে এই দৃশ্য। পরনে ওর হাফ প্যান্ট আর সাদা শার্ট। এখানে এসে ওদের নাম-পোশাক সবই বদলে গেছে। হোঁৎকার পরনেও একই রকম পোশাক। সে ট্রেতে টি-পট, কাপ সাজিয়ে নিয়ে গিয়ে নামায়। অজয়বাবু বলেন ভূধরকে, এই হল মঙ্গু, আর ওই যে চঙ্গু। জামশেদপুরের একটা হোটেলের বেয়ারা।

মানসী বলেন—বেশ ভালো ছেলে দুজন। কাজের খোঁজে এই বনে এসেছে।

পটলা-হোঁৎকা এখানে ভূধরকে দেখবে তা ভাবেনি। ওকে দেখেই চিনতে পারে ওরা দুজনে। এই লোকটাই যে ওই ট্রাক ড্রাইভার সর্দারজির সঙ্গে দু’নম্বরী ব্যবসা চালায় তা বুঝেছে। আর তাকে এই বাংলোতেই থাকতে দেখে একটু অবাকই হয়। অবশ্য ভূধর ওদের ট্রাকে দেখতে পায়নি। সে ব্যস্ত ছিল চোরাচালানের কথা বলতে। তাই সে বাংলোতে পটলা-হোঁৎকাকে দেখে বলে, সত্যি, কাকাবাবুর এলেম আছে। এই বনে এসেও ঠিক কাজের লোক বের করেছেন।

অজয়বাবু চায়ের কাপ তুলে নিয়ে তাতে চুমুক দিয়ে বলেন, নাহে, মঙ্গু চাও বেশ ভালো তৈরি করেছে।

এ যাত্রাটা পার হয়েছে ওরা। রাতে এবার রান্না করতে হবে রুটি আর কযা মুরগি। পটলা বলে, এবার কী করবি হোঁৎকা? রুটি করতে গেলে তো গোল হবে না, ইন্ডিয়ার ম্যাপই হবে। আর কষা মুরগি, ও তো খেয়েইছি এতদিন। এবারে বাঁচবি কী করে।

হোঁৎকা বলে-গোবিন্দর দোকানে মুরগি-রুটি বানাতে দেখেছি। ঠিক বানাই দিমু। তুই আটায় জল দে—আটা মাখতে হইব।

একটা গামলায় আটা নিয়ে পটলা তাতে বেশ খানিকটা জল ঢেলে দেয়।

হোঁৎকা চিৎকার করে—অ্যাই থাম্-থাম্‌

আর থাম্! ততক্ষণে গামলার আটা সিন্নিতে পরিণত হয়েছে। জল আর আটা মিশে তরল একটা কিছু হয়ে গেছে। আর সেই হাত মুখে ঠেকিয়েছে। ফলে তার মুখ-মাথা আটায় ভর্তি হয়ে গেছে।

একি করেছ! অ্যাঁ-

মানসী ঘরে ঢুকে দুই আটারঞ্জিত মূর্তিকে দেখে হেসে ফেলেন।

হোঁৎকা বলে—রুটি কইরত্যাছি মাসিমা!

মানসী হাসছেন—এ যে আটার লেই হয়েছে! খানিকটা ফেলে দিয়ে আরও আটা দাও ওতে। রুটি করতেও জানো না! আর মাংস ?

মাংস তখন ওদিকে তেমনই রয়েছে। আলু কাটতে গিয়ে হোঁৎকা এর মধ্যে তার আঙুলও কেটেছে। মানসী দেখছেন ওদের।

বলেন—এসব কাজ কখনও করেছ বলে তো মনে হয় না! করেছ ?

পটলা বলে—না মাসিমা, সাহেব কিছু বলার আগেই আমাদের ধরে আনলেন।

হোঁৎকা বলে—আমাগোর থাকার জায়গাও নাই, খাবার টাকাও নাই । এহানে থাকতে-খেতে পামু, তাই চইলা আইছি।

মানসী দেখছেন দুই বিচিত্র মূর্তিকে। শুনছেন ওদের কথা। কী ভেবে বলেন মানসী—ঠিক আছে। কাউকে বলবে না এসব কথা। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। চঙ্গু, এই আটার লেই খানিকটা ফেলে এতে আরও আটা দিয়ে শক্ত করে মাখো। আর মঙ্গু, মাংস রান্নাটা আমি যেভাবে বলছি সেইমতো করো। সিদ্ধ হলে ডাকবে। কতটা কী দিতে হবে দেখিয়ে দেব।

পটলা-হোঁৎকা হাতে-নাতে ধরা পড়তে পড়তে মাসিমার জন্যই কোনোমতে বেঁচে গেছে। মাসিমাকে তাদের আসল পরিচয়ও দিয়েছে। মানসী সব শুনে বলেন, খুব সাহস তো তোমাদের !

আর পটলারাও জানতে পারে এই ভূধরবাবু, অজয়বাবু বা মানসীদেবীর রক্তের সম্পর্কের কেউ না। অজয়বাবুর বন্ধুর ছেলে। তাঁদের দয়াতেই মানুষ হয়েছে ভূধর। তাঁদের টাকাতেই এই বনে কাঠের ব্যবসা করে।

পটলা-হোঁৎকা এখন এখানে চঙ্গু-মঙ্গু নামেই পরিচিত। রাতের খাবার আজ ভালোই হয়েছে। ভূধর খাবার টেবিলে বসে অজয়বাবুকে বাঘের গল্পও বলেছে। অজয়বাবুর কণ্ঠে ভয়ের সুর।—বাঘ আছে জেনেও বনে এইভাবে কেন ঘোরো?

ভূধর বলে—বাঘের ভয় আমার নেই! কত বাঘ দেখেছি বনে। বাঘ, হাতি, বাইসন—এসবকে ভয় পাই না। প্রায়ই তো বাঘ-হাতির সামনে পড়ি। নো ফিয়ার-

বটে।

পটলা-হোঁৎকা শুনছে। ভূধরবাবুর উপর তাদেরও সন্দেহ কেমন বাড়ে। লোকটা সাহসী

রাতের খাওয়া শেষ হবার পর ভূধর বের হয়ে যায়। তার নাকি কী জরুরি কাজ আছে। অজয়বাবু ও মানসীদেবীও শুয়ে পড়েন। নিশুতি বাংলো। ওদিকের ঘরে পটলা-হোঁৎকা রয়েছে। ওরা দেখে বনের দিক থেকে মাঝে মাঝে টর্চের আলোর ঝলক ওঠে। আবার নিভেও যায়। হোঁৎকা বলে, ওই ভূধরবাবু রাতে বনে বের হইল, কী করে ওরা? চল দেইখ্যা আসি— পটলা বলে—এত রাতে বনে যাবি?

হোঁৎকা বলে—ভূধরবাবু যদি যাইতে পারে, আমরাও যামু—চল হুঁশিয়ার!

এর মধ্যে ওরা দুজনে দিনের আলোয় বনকলোনি আর আদিবাসী বস্তির খানিকটা দেখেছে। ওদিকেই বন। দুজনে চলেছে রাতে। ভূধর এর মধ্যে তার লোকদের গাছ কাটাই করে পাচার করার ব্যবস্থা করে খুশি মনে ফিরছে। বনের ভিতরে একটা ছোট্ট ঝরনার জল পড়ার শব্দ কানে আসে। দু’দিকে ঘন বন। একটা ছোট মন্দিরও রয়েছে। আর সেটাকে কেন্দ্ৰ করে দু’একটা ঘরও তৈরি হয়েছে। ভূধর সেই মন্দিরে আসে। সেখানে কালীমূর্তি রয়েছে। রয়েছে একটা শিবলিঙ্গ। পূজারী ভজনলালও ভূধরকে চেনে। ভূধরকে দেখে ভজনলাল বলে—ক্যা, ভূধরবাবু—ব্যবসা তো ভালোই চলছে!

ভূধর জানে কিসের ব্যবসার কথা বলছে ভজনলাল। ভূধর বলে, কই আর চলছে। হাতির দাঁত, বাঘের চামড়ার বহুৎ ডিমান্ড ! মাল মিলছে না !

ভজনলাল এককালে ছিল বনের চোরাশিকারি। যেমন সাহস আর তেমনি তার অব্যর্থ লক্ষ্য। অতীতে বহু শিকার করেছে রাজা-জমিদারদের জন্য। পরে শিকার নিষিদ্ধ হতে সে চোরা কাঠের কাজ আর চোরাশিকার করছে তার লোকজন দিয়ে। মন্দিরের পূজারী সেজে থাকে। মাঝে মাঝে শোনা যায় ধর্মের ভাষণের সঙ্গে লুকিয়ে সংগ্রহ করা হাতির দাঁত, বাঘের চামড়ার ব্যবসার কথা। সারা বনে তার চ্যালারা এ কাজ করে। আর ভজন মহারাজ মাঝে মাঝে শহরে গিয়ে সব লেনদেন সেরে আসে। ভূধরও তার খরিদ্দার।

ভজনলাল বলে, এখন বনবিভাগ ভি বহুৎ হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। আর নিখিলবাবু, ওই “রিটায়ার্ড ডি. এফ. ও ভি লোকজন নিয়ে বনে ঘুরছে। কামকাজ করা মুশকিল হয়ে গেছে।

ভূধর জানে ভজনের এসব কথা বলার কারণ, সেও চায় আরও টাকা । ভূধর বলে, টাকা ভালোই পাবে ভজন। ওসব মাল আমার চাই।

টাকাও বেশ কিছু আগাম দিয়ে বের হয়ে আসে ভূধর ।

পটলা-হোঁৎকা এসেছে মন্দিরের বাইরে। টর্চের আলো জ্বলে ওঠে। ভূধর আর ভজন বাইরে এসেছে। ভূধর টর্চের আলো জ্বেলেছে। ওপাশে ঝোপের আড়ালে পটলা আর হোঁৎকা । একফালি আলোয় ওরা দেখছে ভজনলালকে। ওর মুখটা দেখেই হোঁৎকা চমকে ওঠে। সেই মুখখানাকে তারা ভোলেনি।

হোঁৎকা বলে—পটলা, লোকটারে দেখছিস? সেই ট্রেনের দেখা মহারাজ না? ওই তো আমাগোর পাঁচ হাজার টাকার ব্যাগও লইছে—

পটলাও দেখে লোকটাকে। এই বনের ধারে বিরাট মন্দির করে সাধু সেজে বসে আছে। আর দু’নম্বরী ধান্দাই করে এখানে। নাহলে এই ভূধরবাবুরা এখানে আসবে কেন?

ভজন ভিতরে চলে গেছে। জিপটা তখন একটু দূরে বনের ধারে। একটা নালার জন্য গাড়ি আনতে পারেনি মন্দিরের কাছে অবধি। ভূধর আসছে অন্ধকারে জিপের দিকে। চারদিকে গাছ-গাছালির ঘন সমাবেশ। এদিকে ঝর্নার জলধারা নীচে একটা জলাশয়ের সৃষ্টি করেছে। বনের জন্তু-জানোয়ার এখানে জল খেতে আসে। চারদিক থমথমে। শুধু গাছ-গাছালির শনশন শব্দ ওঠে। তারাগুলো জ্বলছে।

হঠাৎ গাছের ওদিকে শব্দটা শুনে ভূধর থমকে দাঁড়াল। টর্চের আলো দিয়ে চারদিকটা দেখছে। ঝোপটা নড়ে ওঠে। যেন ডোরাকাটা একটা কী দেখেছে সে। আর এক লহমা ও দাঁড়িয়ে থাকেনি সে। ভূধর সামনের মহুয়া গাছটার একটা ডাল ধরে প্রাণপণে লাফ দিয়ে গাছে ওঠে। তারপরই অস্ফুট কণ্ঠে চিৎকার শুরু করে–বাঘ-বাঘ – বাঘ—

ভারী দেহটা ডালে দুলছে আর ঝুলন্ত মূর্তিটা চিৎকার করছে, বাঘ—বাঘ—

পটলা-হোঁৎকা ভূধরকে এড়াবার জন্যই ঝোপের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়েছে। তারাও ভাবেনি যে তাদের ডালপালা নড়ার শব্দ শুনে ভূধরবাবু এমনি একটা কাণ্ড করবে।

ঝোপের ভিতর থেকে দেখছে পটলা-হোঁৎকা। হাসিও পায় ভূধরের কাণ্ড দেখে। হঠাৎ আর একটা টর্চের আলো এসে পড়ে। ভূধরের টর্চ তো নীচে! পটলারা দেখে আর একজন বয়স্ক লোক হাতে টর্চ আর রাইফেল নিয়ে আসছেন। হাঁক পাড়েন তিনি, ভূধরবাবু—অ্যাই ভূধরবাবু! বাঘ নয়, আমি। মিঃ রায়। নীচে আসুন ।

এবার ওঁর কণ্ঠস্বর শুনে আর টর্চের আলো দেখে ভূধরবাবু কোনোরকমে হাত, হাঁটু সব ছিঁড়ে গাছ থেকে নীচে নেমে আসে। ভূধর গাছ থেকে নেমে সামনে ভদ্রলোককে দেখে যেন আশ্বস্ত হয়ে যায়। থতমত খেয়ে বলে—রায় সাহেব, আপনি? একটু মায়ের মন্দিরে এসেছিলাম ।

আর বাঘ মনে করে গাছে চড়ে গেছিলেন? তাও নিচু ডালে! বাঘ তো অনায়াসেই ধরতে পারত আপনাকে! এভাবে রাতের বেলা বনে ঘুরবেন না। চলুন—

ওরা বের হয়ে যায়। এবার ঝোপ থেকে পটলা-হোঁৎকাও বের হয়ে বাংলোয় ফিরে আসে। পটলা বলে—ভূধরবাবুও জোচ্চোর মহারাজের কাছে যায়। নিশ্চয়ই ওরা বনের মধ্যে দু’নম্বরী অনেক কাজই করে। তবে ওই মিঃ রায়কে তো চিনলাম না! ওর খোঁজ নিতে হবে।

পরদিন এখানের হাট। বনের মধ্যে আজ যেন সাড়া পড়ে যায়। সকাল থেকে বন অফিসের সামনে মাঠের মধ্যে ট্রাকে করে দোকানদাররা এসে তাদের বেসাতি সাজাচ্ছে। কয়েকটা মুদির দোকান। রয়েছে সস্তা ধুতি, গামছা, গেঞ্জি। কেউ এনেছে টুকটাক মনিহারি জিনিস। বনের মধ্যে দু’চারজন আদিবাসী বস্তি থেকে ছেলেমেয়েরা সেজেগুজে মাদল নিয়ে গানের আসরও বসায়। আর সাধারণ লোক কেউ কুমড়ো, বেগুন নিয়ে বসেছে। এই হাটই তাদের মিলনক্ষেত্র । আজ বনবিভাগের ছুটি। পটলা-হোঁৎকাও বের হয়েছে বাংলো থেকে। হাটে আসার পথে একটা বাগানঘেরা বাড়িতে একটা পুকুরে পদ্মফুল দেখে থমকে দাঁড়ায়। বাগানে একটা বকুল গাছের নীচে বসে আছেন কাল রাতের দেখা সেই ভদ্রলোক। গত রাতে তাঁর পরনে ছিল প্যান্ট-শার্ট-হান্টার শু, হাতে রাইফেল। আজ লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। পটলা-হোঁৎকাকে দেখে তিনি চাইলেন। শুধোন, কী চাই? এসো ভিতরে এসো।

ওরা দুজনে ভিতরে যায়। পটলা বলে, আপনার বাগান দেখছিলাম। কী সুন্দর বাগান! সবুজ গাছ-গাছালি, কত ফুল! এই বনের মধ্যেই–

হাসেন মিঃ রায়—হ্যাঁ, আমি আর শহরে ফিরে যাইনি! রিটায়ার করার পর এখানেই রয়েছি। বনকে ভালোবাসি। এই বন, বনের প্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখতে চাই। তবে মানুষই নিজের লোভ আর হীন স্বার্থের জন্যই এসব শেষ করবে!

পটলা-হোঁৎকার পরনে এখন নিজেদের পোশাক। বয়-বেয়ারার পোশাক ছেড়েই বের হয়েছে। মিঃ রায় বলেন, চলো ভিতরে চলো। চা খাবে তো! বনে বেড়াতে এসেছ বুঝি ! পটলা বলে—তাই বলতে পারেন !

হোঁৎকা বলে—ও পটলা, আমি শিবাজী, ডাক নাম হোঁৎকা! কলকাতা থনে আইতাছি! রায়সাহেব বলেন—তোমরা ও ঘরে গিয়ে বসো। আমি আসছি। এখানে কথা বলারও লোক নেই। তবু তোমাদের সঙ্গে কথা বলা যাবে।

ওদিকের ঘরের দরজা খুলে দিয়ে নিজে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন।

দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে পটলা আর হোঁৎকা। ঘরের জানলাগুলো প্রায়ই বন্ধ। ফাঁকফোকর দিয়ে একটু আলোর আভাস আসছে মাত্র। পটলা-হোঁৎকা ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায়। ঘরের মেঝেতে বসে আছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। মিঃ রায়ই ঘরে ঢুকে ব্যাপারটা দেখে বুঝতে পেরে বলেন, ওগুলো জ্যান্ত নয়, মরা—

পাশের জানালাটা খুলে দিতে এবার দিনের আলো ঘরে এসে ঢোকে। এবার দেখা যায় বিশাল ঘরটাকে। ওদিকে একটা দাঁতালো হাতির দাঁত সমেত মাথা। হরিণের শিং। মিঃ রায় বলেন, ওসব অতীতের দুষ্কর্মের চিহ্ন। এখন ওদের বাঁচাতে চাই—ড্রইংরুমের আলমারিতে রয়েছে বেশ কিছু বই। আর পাশের আলমারিতে রয়েছে তিন-চারটে রাইফেল। মিঃ রায় বলেন, তখন এসব কিনেছিলাম।

মিঃ রায় এর মধ্যে আলমারি থেকে সঞ্চয়িতা বের করে বৃক্ষবন্দনা কবিতাটা শোনান। বলেন, এই অরণ্যকে মানুষ শেষ করে দিতে চাইছে। এ হতে দিতে পারি না। তাই বনে বনে রাতেও ঘুরি। কিন্তু চেষ্টা করেও চোরাশিকার বন্ধ করতে পারছি না।

এসে পড়েন মিঃ মিত্র। তরুণ রেঞ্জ অফিসার। মিঃ রায় বলেন, মিত্র, এসো। এরা কলকাতার ছাত্র। বনে এসেছে। এদের বনের কথাই বলছিলাম।

মিত্র বলেন—খবর আসছে বনের গভীরে চোরা কাটাই চলছে। কালই দুটো বড় সেগুন গাছ পাচার হয়ে গেছে! আর শুনলাম ছোট ফুলিয়াতে দুটো দাঁতাল হাতিও মারা পড়েছে। এসব কি বন্ধ হবে না, সাহেব?

মিঃ রায় বলেন— বনে কড়া পাহারা বসাও। সব ট্রাকের দিকে নজরদারি বাড়াও। বনের কাঠের কারবারি যারা আছে তাদের দিকেও নজর রাখো। এসব কাজে ওদের হাত নিশ্চয়ই আছে। তাদের হাতে-নাতে ধরতেই হবে। তারা বনের শত্রু, মানুষের শত্রু।

পটলা-হোঁৎকা সব শোনে। বলে পটলা, আমরা আজ আসি, স্যার। হাটে যেতে হবে। মিঃ রায় বলেন—ঠিক আছে। চলে এসো মাঝে মাঝে। তবু কথা বলা যাবে। একাই থাকি তো!

ওরা বেরিয়ে আসে। হোঁৎকা বলে, ওই কাঠচোর আর চোরাশিকারিদের লইয়া এরা বিপদে পড়ছে। হালারা এমন সুন্দর বন শ্যাষ কইরা দিবে। কিছু করনের লাগব !

বনের পথ দিয়ে হাঁটছে ওরা। হঠাৎ জিপের শব্দ শুনে এরা বনের ভিতর আড়াল হয়ে যায়। দেখা যায় হাট থেকে ফিরছে ভূধর তার জিপ নিয়ে। আর রয়েছে সেই ভজন মহারাজ। পিছনের সিটে দু-তিনজন ভীষণ-দর্শন লোক। জিপটা চলে গেল বনের দিকে।

হোঁৎকা বলে, দেখলি, ভূধর নির্ঘাৎ কিছু একটা করবেই! ওর মতলব সুবিধার নয়! চল গিয়া কই মিঃ মিত্রকে।

মিঃ মিত্র অফিসেই ছিলেন। বনবিভাগের অফিসে টাঙানো রয়েছে সারা বনের একটা বড় ম্যাপ। মিত্র হঠাৎ এদের দেখে চাইলেন। একটু আগেই তিনি ওদের মিঃ রায়ের ওখানে দেখেছেন। তাই এদের দেখে বলেন— এসো—এসো! হঠাৎ এদিকে ?

পটলা বলে—দেখলাম ভূধর তার জিপে মন্দিরের পূজারীকে নিয়ে বনের ভিতর চলে গেল।

মিঃ মিত্র বলেন- সেকি! আজ তো বন কাটাই বন্ধ!

হোঁৎকা বলে—এদের মতলব নিশ্চয়ই খারাপ!

মিঃ মিত্র বলেন—আমি দেখছি। আর তোমরা তো বনবাংলোতেই আছ! ওর উপর একটু নজর রাখো! সব খবর আমাদের জানাবে !

পটলা-হোঁৎকা ফিরেছে বাংলোয়! যথারীতি ভূধরের পাত্তা নেই। দুপুরে নাকি সে ফিরবে না! কীসব জরুরি কাজ আছে! পটলা-হোঁৎকাও নিশ্চিন্ত হয়। এর মধ্যে মানসীও রান্নার কাজ এগিয়ে রেখেছেন। এরা হাট থেকে আনাজপত্র, ডিম, মুরগি এনে রান্নার কাজে হাত লাগায় । অজয়বাবু বলেন, ভূধর বন দেখাবে বলে নিয়ে এসে দিনরাত নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত।

মানসী বলেন—আর বন-বাদাড় দেখে কাজ নেই! ঘরে ফিরে চলো! ভূধর থাকে থাকুক তার কাজ নিয়ে। এর চেয়ে পুরীতে গেলে ভালো হত—তা না ওর পাল্লায় পড়ে এলে এই বনবাসে !

ভূধরের উপর এঁরা যে খুশি নন তা বুঝেছে পটলা-হোঁৎকা।

দুপুরে বাংলো নিঝঝুম। অজয়বাবু-মানসী খাওয়ার পর ঘুমাচ্ছেন ওঁদের ঘরে। পটলা-হোঁৎকা ভূধরের ঘরের জনালা খুলে দেখে একটা রড সহজেই খোলা যায়। ওরা সেই রডটা খুলে সাবধানে ঘরে ঢোকে। এ ঘরেই ভূধর তার জিনিসপত্র রেখেছে। টেবিলে ডায়েরি, হিসবের খাতা ছড়ানো। বিছানা এলোমেলো। জামাকাপড় যত্রতত্র ছড়ানো। এ ঘরে ভূধর কাউকে ঢুকতে দেয় না। ওর বিছানা তুলতেই দেখে গদির নিচে একটা বন্দুক আর একটা কাগজের বাক্সে বেশ কিছু বুলেটও রয়েছে। অথচ বনবিভাগের পারমিটে লেখা আছে কেউ বন্দুক নিয়ে বনে ঢুকতে পারবে না।

হোঁৎকা বলে, কার্তুজগুলান লই চল! বন্দুকেও যেন গুলি না থাকে !

পটলা ওই ডায়েরি-নোটবইগুলো হাতিয়ে নিয়ে কার্তুজগুলোও তুলে নেয়। তারপর এদিক-ওদিক দেখে, না কেউ কোথাও নেই—ওরা জানলা দিয়ে বের হয়ে এসে আবার রডটা যথাস্থানে লাগিয়ে দেয় ।

পটলার গোয়েন্দাগিরির কিছু অভিজ্ঞতা আছে। বহু গোয়েন্দা গল্প সে পড়েছে। আর ওর এক কাকা গোয়েন্দা বিভাগের পদস্থ অফিসারও। পটলা এবার ভূধরের কাগজের মধ্যে একটা বনের ম্যাপ আর তার কিছুটা অংশ লাল মার্ক করা দেখে। আর হিসাবের খাতায় বেশ কিছু মোটা অঙ্কের টাকা আর ভজনলালকে দেওয়া বেশ কিছু টাকার হিসাব দেখে। তাছাড়াও বেশ কিছু নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর দেখে। আর দেখা যায় একটা দানপত্রের খসড়া। সেটা পড়ে পটলা বলে, দ্যাখ, ভূধরবাবুর মতলব! হোঁৎকাও পড়ে কাগজপত্রগুলো। তাতে লেখা আছে যে, অজয় সেন নাকি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে তাঁর বালিগঞ্জের বাড়ি-ব্যবসা, সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি শ্রীভূধর বিশ্বাসকে দানপত্র করে দিয়েছেন।

হোঁৎকা বলে—এডা কী রে! মাসিমারে ফাঁসাইবার মতলব!

পটলা বলে—এর বিহিত করতেই হবে। এসব কাগজপত্র এখানে রাখা ঠিক হবে না । ঠিক জায়গায় জমা করে দিয়ে আসতে হবে। চল।

নিখিল রায় দুপুরে ঘুমোন না। বইপত্র নিয়েই থাকেন। হঠাৎ এসময় পটলা-হোঁৎকাকে দেখে খুশিই হন। পটলা এসে ওর থলে থেকে সব কাগজপত্র বের করে নিখিলবাবুকে দেখায়। কাগজপত্র দেখে মিঃ রায় চমকে ওঠেন।

আমার সন্দেহ তাহলে মিথ্যে হয়নি। ওই ছেলেটা এতদিন ধরে এখানে এসে এইসব করছে। খুব উপকার করেছ তোমরা! এতে অনেক কাজ হবে। আমি এখুনি ডেকে পাঠাচ্ছি ফরেস্ট পুলিশকে। তবে তোমরাও সাবধানে থেকো। যদি গোলমাল বোঝ আমাকে খবর

দেবে।

বিকেল নামছে। ভূধরের সকাল থেকে কোনো খবর নেই। বিকেলের চা এনেছে হোঁৎকা মানসী-অজয়বাবু চা খাচ্ছেন। মানসী ওদের জন্যও টেবিলে চা দিয়ে বলেন, তোমরাও খাও।

এটা অবশ্য ভূধরের চোখে পড়লে ভূধর চটেই যেত। এখন সে নেই। এবার পটলাই দানপত্রের দলিলটা মাসিমার হাতে দিয়ে বলে, কাগজটা আবর্জনার মধ্যে পড়েছিল। হাতে পড়তে নিয়ে এলাম। ছোট সাহেবের দরকারি কাগজ নয় তো!

মানসী কাগজটা দেখে চমকে ওঠেন! তাঁর স্বামী যে তাঁকে না জানিয়ে এতবড় সিদ্ধান্ত নেবেন তা ভাবতেও পারেননি। মানসী কাগজটা অজয়বাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, পড়ে দ্যাখো! তখনই বলেছিলাম ওর মতলব ভালো নয়! এই বনে এনে আমাদের চরম সর্বনাশই করতে চায়।

অজয়বাবু কাগজটা পড়ে চোখ বড় বড় করে বলেন, এটা পেলে কোথায় ? পটলা বলে—ওসব আবর্জনার মধ্যে পড়েছিল!

অজয়বাবু বলেন-না-না, এসব বাজে কথা! এসব কাজ কেন করতে যাবে ভূধর ? কাগজগুলো নিজেই ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে উপরের বারান্দা থেকে উড়িয়ে দেন। হাওয়ায় সেগুলো উড়ে যায়।

ভূধর আজ লোকজন নিয়ে বনে এসেছে। আজ রবিবার। বনে কাটাই হয় না। নির্জন বন । ভজনের লোকরা অবশ্য দিনের বেলায় শিকার কম করে। রাতের অন্ধকারেই তাদের সুবিধা বেশি। এরমধ্যে ভূধর দুটো গাছ কেটে ফেলেছে। লরিও এসে গেছে। এবার টুকরো করে লরিতে তোলার পালা। গাছগুলোকে বোঝাই করে আজই পাচার করতে হবে। লাখ টাকার মাল। হঠাৎ বনের মধ্যে স্তব্ধতা ভেদ করে গাড়ির শব্দ শুনে চাইল ভূধর! ও জানে আজ বনবাবুরা হাটেই থাকবে। এদিকে কেউ আসবে না। হঠাৎ গাড়ির আওয়াজে চমকে ওঠে নিমেষের মধ্যে এরাও লরিতে মাল তুলে নিয়ে পালায়। সব মাল তোলাও হয়নি। বেগতিক দেখে ভূধরও জিপ নিয়ে কেটে পড়ে।

মিঃ মিত্র আজ খবরটা নিখিলবাবুর কাছ থেকে পেয়েছেন। ওই ম্যাপ-ডায়েরিতেই লেখা ছিল জায়গার কথা। মিঃ রায়ের কাছে খবর পেয়েছিলন ভূধরবাবু বনে গেছেন। আর সেটা যাচাই করার জন্যই মিঃ মিত্র নিজে এসেছেন বনবাংলোতে। আর সেখানে ভূধরবাবুকে না দেখতে পেয়েই ফোর্স নিয়ে বনের ভিতর যান। কিন্তু গিয়ে দেখেন কাটা গাছটার গুঁড়িও পড়ে আছে! আসামিরা ফেরার। মিত্র বলেন,–ইস্, হাত ফসকে বের হয়ে গেল ব্যাটারা ! একটাকেও ধরা গেল না !

তবে ধরা না গেলেও যারা এসব করে এসেছে এতদিন বিনা বাধায়, তারাও এবার বুঝেছে যে তাদেরও এবার প্রবল বাধার সামনে পড়তে হবে ।

ভূধর কোনোমতে সেদিন তার লোকজন নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। অনেক টাকাই তার লোকসান হয়েছে। বনবিভাগ সব গাছই সিজ করেছে। ভূধরও ভাবছে কী করে বনবিভাগের লোক এসব খবর পেল! তাকে এবার অন্য কাজটাও সারতে হবে !

আজ বেশ জ্বালাভরা মন নিয়েই ফিরেছে ভূধর বনবাংলোয়। এতদিন ধরে সে এই বনে তার দাপট চালিয়ে এসেছে, লুঠতরাজ করেছে। আজ সে প্রথম বাধা পেল। বেশ বুঝেছে এই বাধা আরও বাড়বে। তাই তার ভবিষ্যতের ব্যবস্থাও তাকে করতে হবে।

ঘরে ঢুকে প্রথমে তেমন কিছু টের পায়নি ভূধর! সে তার কর্মপন্থা ঠিক করে ফেলেছে। রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর বাংলো নিস্তব্ধতায় ঢেকে যায়। পটলা-হোঁৎকা আউট হাউসে এসে শোবার ব্যবস্থা করছে।

হঠাৎ বাংলো থেকে মানসীদেবী-অজয়বাবুর কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে শোনা যায় ভূধরের কণ্ঠস্বর ! ভূধর বলে, আমার কথা শুনতেই হবে !

রাতে ভূধর সেই দানপত্রের আসল কপিটা এনে অজয়বাবুকে বলে, এটাতে সই করে দিন ! অজয়বাবু চমকে ওঠেন। মানসীও দেখেছেন কাগজটা! বলেন, তা কী করে হবে? তাই হবে! আমি যা বলছি তাই করুন। এতে সই না করলে এই বন থেকে বের হতেই পারবেন না! দুজনকে মেরে লাশ গভীর জঙ্গলে ফেলে দেব। কেউ জানতেও পারবে না!

ভূধর আজ তার আসল স্বরূপটা দেখায়। এঁরা বিপন্ন।

মানসীই বলেন, ঠিক আছে। তুমি ছাড়া আমাদের আর কেই-ই বা আছে! তোমাকেই সব লিখে দেব। আজ রাত হয়েছে, বুড়ো মানুষটাকে শান্তিতে ঘুমাতে দাও। কাল সকালেই সই করবেন।

অজয়বাবুও অসহায় কণ্ঠে বলেন—কাল সকালে সই করে দেব।

ভূধর বলে—ঠিক দেবেন তো?

দেব। নিশ্চয়ই দেব ।

ভূধর কী ভেবে বলে—ঠিক আছে, তাই হবে। তবে যা করার কালকেই করতে হবে। চলে যায় ভূধর নিজের ঘরে। বাইরে থেকে সব শুনেছে পটলারা।

হোঁৎকা বলে, কেস তো জনডিস রে!

পটলা বলে—একটা কিছু করতেই হবে। ওই শয়তানকে উচিত শিক্ষাই দিতে হবে। অজয়বাবুও এবার ভাবনায় পড়েছেন। ভাবছেন কী করা যায়। হঠাৎ আবছা অন্ধকারে কাকে আসতে দেখে চাইলেন মানসী। তারা-জ্বলা আলোয় পটলা-হোঁৎকাকে আসতে দেখে মানসী বলেন, তোমরা ?

পটলা ইশারায় ওঁকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বলে, আমরা সব শুনেছি মাসিমা! আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। আর একটু রাত হোক। তারপর যা করার করব! এই রাতেই বাংলো থেকে পালাতে হবে। আপনারা তৈরি থাকুন ।

ভূধরের আজ সারাদিন খুব ধকল গেছে, তাই বিছানায় পড়তেই তার দু’চোখে ঘুম নামে। নাক ডাকতেও শুরু করে! পটলারা এবার ঘরের দরজায় বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়ে অজয়বাবুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাংলো থেকে।

সেই রাতেই পটলারা অজয়বাবু আর মানসীদেবীকে নিয়ে আসে নিখিল রায়ের বাংলোতে। নিখিলবাবুর সঙ্গে পটলাদের আগেই কথা হয়েছিল। সেইমতো তিনি দরজা খুলে ওদের ভিতরে ডেকে নেন। দেখছেন নিখিলবাবু, অজয়-মানসীদেবীকে।

মানসী বলেন—ওই ভূধরের দলবল ভালো নয়, ও যে এতবড় শয়তান তা ভাবিনি! রাত বাড়ছে। পটলা বলে, আমাদের বাংলোয় ফিরতে হবে।

নিখিলবাবু বলেন—সাবধানে যাবে। আর ভূধরের উপর নজর রাখবে। এদিকে যা করার আমি করছি!

পটলা-হোঁৎকা রাতেই বাংলোর আউট হাউসে ফিরে আসে! সকালে মিঃ মিত্র রায়বাবুর বাংলোয় এসে সব শুনে অবাক হন! রায়বাবু সেই ডায়েরি-কাগজপত্র মিত্রকে দেন। মিঃ মিত্ৰ সব দেখে অবাক হয়ে বলেন, অনেক প্রমাণই হাতে পেয়েছি। ওরা যে এমনি ডেরা গেড়েছে তা জানতাম না। আমি এখুনি ফোর্স ডাকছি।

ভোরবেলাতেই মিঃ মিত্র ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।

ভূধরের আজ ঘুম ভাঙে একটু দেরিতেই। চোখ খুলে আশপাশের পরিবেশটা বুঝতে পেরেই সে চমকে ওঠে। দেখে সে তার ঘরে নয়, ঘুমোচ্ছিল লক-আপের মধ্যেই। পাশে ভজনলাল আর তার দলের কিছু লোক। লাফ দিয়ে ওঠে ভূধর–একি আমি এখানে কেন?

এবার দেখা যায় মিঃ মিত্রকে। মিশুর মিত্রে বলেন, আমরাই আপনাকে এখানে এনেছি ভূধরবাবু। আপনার দলবল সমেত। সব প্রমাণই আমাদের হাতে এসে গেছে। দিনের পর দিন যে চোরা কাটাই-পোচিং-এর কাজ করেছেন তার শাস্তি আপনাকে পেতেই হবে।

থানাতেই আনা হয়েছে মন্দির থেকে উদ্ধার করা হাতির দাঁত, বাঘের চামড়া, হরিণের শিং। যার বাজারদর কয়েক লাখ টাকা।

অজয়বাবুও এসব দেখে অবাক। তিনি ভাবতেই পারেননি যে তাঁর ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে ভূধর এসব কাজ করত। তাঁরও চরম সর্বনাশ করতে চেয়েছিল। তিনিও এবার নিশ্চিন্ত হন। ওরা ফিরে আসে বনবাংলোতে। আজ তিনি পটলা-হোঁৎকার প্রতি কৃতজ্ঞ।

আমি, গোবরা, ফটিক তখন বড়বিল স্টেশনে নেমেছি। পটলাদের এখানে থাকার কথা কিন্তু তাদের পাত্তা নেই। আমরাও ভাবনায় পড়ি। এর মধ্যে পিসেমশাইও এসে গেছেন আমাদের নিতে। তিনি পটলা-হোঁৎকাকে না দেখতে পেয়ে বলেন, তোদের পঞ্চপাণ্ডবের বাকি দুজন কইরে?

এবার আমি ভয়ে সমস্ত ঘটনা পিসেমশাইকে জানাই। পিসেমশাই সব শুনে চমকে ওঠেন, সেকি! ওরা একসপ্তাহ আগেই থলকোবাদ গেছে! অথচ তাদের কোনো খবর নেই ! আমরাও ভাবছি। সত্যিই চিন্তার ব্যাপার !

পিসেমশাই বলেন—কালই আমি যাব থলকোবাদ বাংলোয়।

আমি বলি—আমরাও যাব ।

আমরা পিসেমশাইকে নিয়ে বাংলোয় পৌঁছেছি। পটলা-হোঁৎকা তখন চঙ্গু-মঙ্গুর বেশে চা সার্ভ করছে। পিসেমশাই তখন ওদের দেখে চিৎকার করেন, কি রে, পটলা-হোঁৎকা, তোরা এখানে চা খাওয়াচ্ছিস! আর আমরা কত চিন্তা করছি!

অজয়বাবু অবাক হয়ে বলেন—ওরা চঙ্গু-মঙ্গু! আপনি ভুল করছেন!

এবার মানসীই সব কথা বলেন অজয়বাবুকে। অজয়বাবু এবং আমরাও অবাক হই সব শোনার পর। পটলা যে এরকম একটা কাণ্ড করতে পারে আমাদের ধারণাই ছিল না। অজয়বাবু বলেন-তোমরা যে এত বড় বাড়ির ছেলে তা লুকিয়ে ঠিক করোনি। অযথা তোমাদের দিয়ে বয়-বেয়ারার কাজ করালাম।

হোঁৎকা বলে–কইয়া দিলে এমন অ্যাডভেঞ্চার আর হইত না !

আমরাও গর্বিত হই পটলার এরকম দুঃসাহসিক কাজে। সত্যিই বনভ্রমণ ওদের সার্থক হয়েছে।

সেই রাতটা আমরাও বাংলোতে থেকে পরদিন ফিরে এলাম পিসেমশাই-এর বাড়িতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *