পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

পটলার নাট্যচর্চা

পটলার নাট্যচর্চা

পটলা খুবই রেগে গেছে। রাগাটাই স্বাভাবিক। ‘তিনসঙ্গী ক্লাব’ ওকে তাদের নাটকে অভিনয় করার জন্য নিয়ে গেছে, বন্দীপুরের রাজপুত্রের রোল। এর আগে পটলা ক্লাবে মুকুট-এর নাটকেও রাজপুত্রের অভিনয় করেছিল। পটলার চেহারাখানা সুন্দরই। ফর্সা রং, টানা টানা চোখ, বেশ গত্তিলাগা শরীর।

কিন্তু গোল বাধে পটলা যখন কথা বলে।

জিবটা আলটাকরায় আটকে যায় বেশ টাইট হয়ে। আর পটলাও ব্যাকুলভাবে জিবটাকে ছাড়াবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে।

ফলে অঘটন ঘটে তখুনিই।

বন্দীপুরের রাজপুত্রবেশী পটলা প্রথম অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যে প্রথম গাড্ডায় পড়ল। এতক্ষণ অবধি কোনোরকমে সাবধানে পার্ট বলে এসেছে। খুব তেজি সিন নয়। তৃতীয় দৃশ্য থেকেই নাটক জমে উঠেছে। রাজপুত্রকে এবার তার পিতৃদেব রাজধানী থেকে তাড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করছে।

উত্তেজিত রাজপুত্র এইবার পিতৃদেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। সেই মুহূর্তেই রাজপুত্রের জিবটা গেল জম্পেশ হয়ে আলটাকরায় আটকে।

পিতা…ত…ত…

জিব আর ছাড়ে না। সেঁটে লেগে গেছে। পটলার দু চোখ কপালে উঠেছে, তরবারি বের করে শূন্যে তুলেছে কিন্তু বাক্য আর সরে না—ত ত…তো—

তিনসঙ্গী ক্লাবের হলধরের ছিল এই পার্ট। সে আবার ল্যাংড়া। রাজপুত্র ল্যাংড়া হলে অচল, ওদের মোশন মাস্টার তাই বাতিল করেছিল হলধরকে। হলধরের অন্য দলবলও রেডি ছিল। এবার তারাই আওয়াজ দেয়—ব্যাকগিয়ার মারছে রে। শালা তোতলা—

পটলা ততক্ষণে জিবটাকে ছাড়িয়ে বীরদর্পে হুঙ্কার তোলে—মারে করিব বধ! তারপর রাজ্য প–প-প-

জবাবে ওরা একঝাঁক গুলি ছুঁড়ল।

আবার চেঁচালাম, বোকামো কোরো না। বিশাল হিন্দুস্থানী ফৌজ তোমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। তোমাদের সাহায্যকারী দলকে আমরা মেরে বর্ডারের ওপারে ভাসিয়ে দিয়েছি। এটাই শেষ সুযোগ, আত্মসমর্পণ কর।

এবার জঙ্গীরা কোনো জবাব দিল না। গুলিও ছুঁড়ল না।

সুখদেব রেডিওতে বলল, ওরা হাল ছাড়বে না। বেকার চেষ্টা স্যার

হুঁ। আমি বললাম ।

লেট আস কিল দেম স্যার। চলুন, ছেঁচে আসি ব্যাটাদের।

দাঁড়াও। আমি বললাম, জয়কারা বলো। সমস্ত দল।

আমার নির্দেশে সৈন্যবাহিনীর সব কটা দল নিজ নিজ ঐতিহ্য অনুযায়ী জয়ধ্বনি দিতে শুরু করল। যুদ্ধের চরম মুহূর্তে অ্যাটাক শুরু করবার আগে এরকম জয়ধ্বনি দেওয়া হয়। শিখ সৈন্য গর্জন করল, বোলে সো নিহাল, সৎ শ্রী অকাল।

ডোগরা সৈন্যদল বলল, বোলে জয়, ভগবতী মাতা শেরাওয়ালি দুর্গে—

গোর্খা সৈন্যরা উত্তরের পাহাড়ে কুকরি খুলে মাথার ওপর তুলল। আয়ো গোরখালি—ই— ই—

রি-ইনফোর্সমেন্টের মারাঠি সৈন্যরা গর্জে উঠল, হর হর মহাদেও-

অতগুলি সৈন্যদলের সম্মিলিত জয়ধ্বনি মেঘের আওয়াজের মত গমগম করতে লাগল প্রতিধ্বনিত হল পাহাড়ে পাহাড়ে। আমি চোঙে চেঁচালাম, এই শেষ সুযোগ। যারা যার আত্মসমর্পণ করতে চাও-

এবার গেরিলাদের দলে একটা ব্যাপার ঘটল। প্রথমে ক্যাট ক্যাট, তারপর ক্যাটা ক্যাট ক্যাট, কয়েক রাউণ্ড গুলির শব্দ পাওয়া গেল। গেরিলারা নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনি শুরু করল। আত্মসমর্পণে ইচ্ছুকরাই দলে ভারী ছিল। খানিক পরে গুলির শব্দ থামল। একের পর এক জঙ্গীরা দুহাত ওপরে তুলে বেরিয়ে আসতে লাগল ব্যাহকের আড়াল থেকে। বিভিন্ন জাতির বিশাল ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভয়ে ওরা অস্ত্রত্যাগ করে বসল, সব আদর্শ, অস্ত্রশিক্ষা জলাঞ্জলি দিয়ে।

একটিমাত্র বুলেট ব্যবহার করে নীলসান্দ ব্যাহকের যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী জয়লাভ করল। হতাহত–শত্রুর পক্ষে সাত জন নিহত, আহত শূন্য, বন্দী চৌত্রিশ জন। ভারতীয় পক্ষে হতাহত শূন্য। সাত জন শত্রুর মধ্যে ছয় জনই মারা পড়েছে নিজেদের গুলিতে, তার মধে জঙ্গীদের এরিয়া কমাণ্ডার মহম্মদ মকবুল লোনও রয়েছে।

চোখধাঁধানো বিজয়। কর্নেল রেডিওতে চেঁচালেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে, দারুণ অভিনন্দন, বুদ্ধদেব। বীরচক্রের জন্য তোমাদের নাম সুপারিশ করা হচ্ছে।

থ্যাংক ইউ স্যার। আজকের আসল হিরো কিন্তু লেফটেনান্ট সুখদেব। মেডেলটা ওরই পাওয়া উচিত।

সন্ধের আগেই আমরা মহুয়াতে নেমে এলাম। সুখদেব সিং আজকের রাতটা এখানেই কাটাবে। কাল সকালে ও ফিরে যাবে ঈগলের বাসায়, মানে ওর ক্যাম্পে, পাহাড়ের টঙে সন্ধের পর আমি হেড-কোয়ার্টারে ফোন করলাম মেজর শ্রীবাস্তবকে। স্যার, আমার ক্যাসেটটার কি হল ?

ও প্রান্তে আজিজুলের গলা পেলাম, হ্যাঁ স্যার। আমি আজিজুল বলছি। না, স্যার, পুরে শহরে কোথাও পাওয়া গেল না। আমি তো কদিন আগেই বাড়ি গিয়েছিলাম ঈদের ছুটিতে আপনি যদি বলতেন, নিয়ে আসতাম।

দূর ছাই! আমি হাসি, আমি কি জানতাম? ভেবেছিলাম ছুটি পাব।

ভোরে রেডিও খুলবেন, স্যার। আমি তো প্রায়ই বাংলা সেন্টার ধরতে পারি।

নিরাশ মনে ঘুমোতে গেলাম। পাগল নাকি, বাংলা সেন্টার! শেষরাতে ঘুম ভাঙল রেডিওটা বিছানাতেই ছিল। নব ঘোরাতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে কানে এল, অভ্রান্ত কণ্ঠস্বর, য দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা—

বাংলা নয়। হিন্দিতেও একটা সংস্করণ আছে ওই অনুষ্ঠানের। তবে চণ্ডীপাঠ সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের, গানগুলিও বাংলা। মহুয়ার সেই সুদূর পর্বতমালার কোলে যেখানে ঝিলম নদীর কলকল শব্দ ছাড়া শেষরাতে অন্য কোনো শব্দ নেই, পাথরের একতলা বাড়ি থেকে চারদিকে উপচে পড়ল সুরের নদী। বাজল আবার সুরের বেণু।

কলকাতার বাড়িতে হলে মা এখন চা বসাতেন। আমি শুয়ে শুয়ে আধঘুমে শুনি। হঠাৎ চটকা ভেঙে দেখি আর্দালি হরপ্রীত। চা এনেছে।

সৎ শ্রী অকাল সাব। আ কেরা পোগরাম, সাব ?

বাংলা ভাষায় গুরুবাণী পাঠ। ওকে বলি । বীরেন ভদ্র এতক্ষণে কেঁদে ফেলেছেন। স্তব্ধ হয়ে সমস্ত ক্যাম্প শুনছে সেই কান্না। মাগো, আমাদের শুভবোধ দাও ।

মহিষাসুরের পরাজয় অনিবার্য। চিরকাল।

দর্শককুলের মধ্য থেকে আওয়াজ ওঠে—পেড়ে ফেলব!

কে সরবে ঘোষণা করে—পালচাপা দেব।

কে আবার হেঁকে ওঠে—প্যাদাব পটলা ।

প’কারান্ত অনেক রকম ব্যবস্থাই পাকাপাকি নেবার কথা ঘোষণা করে তারা শেষ অবধি পটলচন্দ্র ভিতরে এসেছে, এই শীতেও ঘামছে।

মোশন মাস্টার ততক্ষণে গোলমাল থামাবার জন্য জিপসি নাচ-এর ব্যবস্থা করেছে মঞ্চে। আমরাও গেছি, পটলা আমাদের ক্লাবের প্রধান সভ্য। দায়ে-অদায়ে পটলাই টাকাকড়ি দেয়, আলুকাবলি-ফুচকা মায় গুপির দোকানের চা-বিস্কুট-মামলেট-এর বিল মেটায়। বাবার বিরাট ব্যবসা—ওদিকে গুদাম, করাতকল!

এ হেন পটলাকে ‘হায়ার’ করে এনেছে অভিনয় করার জন্য, আমরাও এসেছি, কিন্তু পটলার যে এমনি বিপদ হবে ভাবিনি। পটলা দর্শকদের ওই সব মন্তব্যে তরবারি খাপে পুরে রণে ভঙ্গ দিয়ে এসে সাজঘরে সেঁদিয়েছে। লড়ে যা ।

আমরা বলি-ভয় কি পটলা! এবার ঠিক হয়ে যাবে।

না, পারব তো র‍্যা! পটলা শুধোয়।

হোঁৎকা আমাদের ক্লাবের পারমানেন্ট বৃকোদর সাজে। সে বলে-আলবত পারবি। লড়ে যা।

কিন্তু ওদের ক্লাবের ডিরেক্টার কন্দর্পদা এর মধ্যে মনস্থির করে ফেলেছে তোতলা রাজপুত্রের চেয়ে ল্যাংড়া খোঁড়া রাজপুত্রই ভালো হবে। বলে সে—হলধর, তুই মেকআপ করে নে। নেকস্ট সিন থেকে তুই রাজপুত্রের রোলে নামবি। পার্ট মুখস্থ আছে তো?

হলধর বলে—হ্যাঁ। পুরো।

কন্দর্পবাবু ড্রেসারকে বলে—ওকেই রাজপুত্র সাজাও। পটল, তোমার ড্রেস খুলে দাও। এ যেন কাপড় খুলে নেবার মতই অপমান ।

পটলা রাগে গরগর করছে। এই ঝুটো মুক্তোর মালা, জরির পোশাক, টিনের তলোয়ার সব ফেলে রাজপুত্র আবার পটলাতে পরিণত হল।

পটলার গোঁফজোড়াটা স্পিরিট গাম দিয়ে সাঁটা ছিল, সহজে ছাড়ানো যাবে না। ড্রেসারের টানাটানিতে সে বলে—নারকেল তেল দেন।

ড্রেসার বলে—কোথায় পাব নারকেল তেল-ফেল? রাজপুত্রের সিন এখুনিই, গোঁফ আভি মাংতা ।

ড্রেসার হ্যাঁচকা টানে চামড়া যেন তুলে ফেলবে। পটলার চোখ দিয়ে জল বের হয়ে আসে অপমানে, জ্বালায় ।

রাগে দুঃখে অপমানে বের হয়ে এল পটলা। আমরাও চলে আসছি। তখন মঞ্চে ল্যাংড়া হলধর নেচে নেচে রাজপুত্রের পার্ট করে চলেছে।

পটলা বলে—ত-তিনসঙ্গী ক-ক্লাবকে দেখিয়ে দেব ন-নাটক কাকে বলে !

ফটিক আমাদের মিউজিক ডিরেক্টার কাম অভিনেতা। ফটিক বলে—হ্যাঁ, দেখাতেই হবে। ন্যাড়া দেশজ ভাষায় শোনায়— দেইখা লমু ওগোরে, তয় আমার নাম ন্যাড়া হাওলাদার। পটলার অপমানটা আমাদের অপমানই আর পটলাকে যে তিনসঙ্গী ক্লাব পোশাক কেড়ে নিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে, এ খবরটা সারা পাড়া জেনে গেছে।

অবশ্য তিনসঙ্গী ক্লাবের নাটকে দুর্ঘটনা কিছু ঘটেছে। তৃতীয় অঙ্কে নাকি রাজার দাড়ি-চুল সব খসে পড়ে বিনোদ দত্তের টাক মাথা বের হয়ে পড়েছিল যুদ্ধের সিনে, আর দুটো পটকা সাজঘরে বেকায়দায় ফেটে গিয়েছিল, তাতে হলধরের প্যান্টুল বেশ খানিকটা পুড়ে গেছল, রাজপুত্র তালিমারা প্যান্ট পরে যুদ্ধ করার সময় ল্যাংড়া পায়ে হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়েছিল দর্শকদের ঘাড়ে।

কন্দর্পবাবু ড্রপসিন ফেলেছিল ঠিকই, হলধর কিন্তু তখন মঞ্চ থেকে নীচে। পরাজিত রাজপুত্র প্যান্টুল ফাটা অবস্থায় মুঠো করে ধরে দর্শকদের মধ্য দিয়ে প্রস্থান করেছিল। তাতে অবশ্য পটলার দুঃখ ঘোচেনি।

পরদিনই ‘পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবে’র জরুরি মিটিং-এ ঠিক হয় নাটকই হবে। এবার হবে প্রগেসিভ নাটক—‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’। লিখেছে আমাদের ক্লাবের গদাই গড়াই। ইদানীং গদাই-এর দুখানা নাটকের মুক্ত অঙ্গনে অভিনয় চলছে মাঝে মাঝে। একখানা তো ছায়া-কায়া নাটক। ভূত-মানুষ অনেক কিছু আছে। অমৃতবার্তা কাগজে দারুণ সমালোচনা বের হয়েছে।

নাট্যকার গদাই বলে—সবকিছু বাস্তব করতে হবে। সে সব ব্যবস্থা করে দেব। আর পটলা যে অভিনয় করতে পারে তাও দেখিয়ে দেব। হিরো-একেবারে টপ্ টু বটম্। আর নো ডায়ালগ। নতুনত্ব করতে হবে। ডায়ালগ বলবে অন্য সবাই। হিরো কথা বলতে পারে না । মূক, বধির। খুব সিমপ্যাথেটিক রোল। দেশের জন্য ফাঁসিতে আত্মত্যাগ করল।

ন্যাড়া সব শুনে বলে—তা মন্দ হইব না। হালায় এহন চোরের দ্যাশে দ্যাশপ্রেমিকদের নাটক হক্কলেই লইব ।

ফটিক কালোয়াতি গান গায়। শীর্ণ লম্বা চেহারা। সে শুধোয়—মিউজিক ক্যামন হইব ? গদাই গম্ভীর ভাবে বলে-ভালো হবে।

পটলা খুব খুশি। এবার কথা-টথা বলতে হবে না। পোজপশ্চারেই মেরে দেবে। হোঁৎকা বলে, মন্দ হবে না প্যাঁচটা।

চা-মামলেট এসে গেছে। গদাই গড়াই নাটক পড়ছে। চোখ-মুখ পাকিয়ে হাত-পা ছুড়ে গদাই নাটকে প্রাণ সঞ্চার করেছে আর পটলা দেখছে তার চরিত্রটা।

হ্যাঁ! মনের মত একটা রোল পেয়েছে। এবার এই চরিত্রই হবে তার ধ্যানজ্ঞান, পটলা বলে।

—ন-নাটক জ-জ-জমবে দারুণ। যা পোস্টার লাগা। নো ফিয়ার !

হোঁৎকা করছে জবরদস্ত পুলিশ অফিসার। সেই আমাদের আর্টিস্ট। হোঁৎকা আমি ফটিক লেগে গেছি পোস্টার লিখতে।

গদাইদা বলে-ছাপা পোস্টারও চাই, না হলে প্রেস্টিজ থাকবে না ।

পটলা অভয় দেয় – হোগা !

কুলেপাড়ার দেওয়াল, গাছের ডাল, বাড়ির থাম, মোড়ের দেওয়াল ছেয়ে গেছে পোস্টারে। পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের অবদান। গদাই গড়াই-এর নাটক ফাঁসির মঞ্চ থেকে

শ্রেষ্ঠাংশে—পটলচন্দর, হোঁৎকা —ইত্যাদি।

সঙ্গীত পরিচালকের নাম বাদ পড়েছিল—ফটিক তো ক্লাব-এ রেজিগনেশন লেটার লিখে এনেছিল। পটলা থামায় তাকে।

-ত—তোর নামও থাকছে এবার!

দ্বিতীয়বার পোস্টার ছাপা হয়ে দেওয়াল ভরে গেল – ফটিকচন্দ্র সুরকার।

তিনসঙ্গী ক্লাবও খবর পেয়েছে এবার নতুন প্রয়োগ রীতিতে নাটক মঞ্চস্থ করছি আমরা। পটলার পিসি শুধোয়—হ্যাঁরে পটল, তা ঠাকুরদেবতার পালা-টালা হবে তো? রাধাকেষ্ট শিবদুর্গা, এ-সব থাকবে ?

পিসিমা থোক টাকা চাঁদা দেন। সেবার দক্ষযজ্ঞ পালা দেখে আর হোঁৎকার শিব সেজে ওই দুমদাম নৃত্য দেখে পিসি মহাখুশি। তাই পিসি দশ টাকা চাঁদা দেন।

পিসির কথায় হোঁৎকা বলে—থাকবে বৈকি পিসিমা। তবে পিসি, শিবের সঙ্গে এবার অসুরের যুদ্ধ-টুদ্ধ হবে, তাই আরও কিছু বেশি চাঁদা দিতে হবে। কেষ্টও থাকবে কিনা!

পিসিমা শিব-দৈত্য-কেষ্ট এসব দেখার লোভেই পনেরো টাকা নগদ দিলেন। নরহরি দত্তের জমাটি ব্যবসা। এককালে দত্তমশায় কারবার করে আর সুদ বন্ধকিতে বেশ রোজগার করেছেন। এখন ছেলেরা কারবার দেখে। দত্তমশায় সকাল বিকাল রকে বসে খঞ্জনী বাজিয়ে নামগান করেন। দত্তমশায়ও শুধোন, কেত্তন-টেত্তন হবে তো?

ফটির বলে—তা হবে দত্তমশায়। নামগান হবে আর ভক্তিমূলক গীতও আছে।

গদাই গড়াই এদিকে ক্লাবঘরের মেঝেতে চক দিয়ে দাগ কেটে এক একজনকে দাঁড় করিয়েছে দাবার ছকের ঘুঁটির মত। মেপে মেপে চলতে হবে—কথা বলতে হবে।

মুস্কিল হয়েছে ন্যাড়াকে নিয়ে, ন্যাড়া এ জন্মে বাংলাদেশ দেখেনি, কিন্তু মাতৃভাষা ওর আদি অকৃত্রিম পদ্মাপারের বুলি। ন্যাড়া রিহার্সেল দিতে গিয়ে সেই ভাষাই বলে ফেলে—তোদের দ্যাশ থান তাড়াইমুই আর ইংরেজ কুত্তা, হালায় গুলি-বোম মাইরা উড়াইয়া দিমু।

নাট্যকার গদাই গড়াই গর্জে ওঠে—এসটপ্! এসটপ্! কিসু হচ্ছে না ।

ন্যাড়া ঘাবড়ে গিয়ে বলে,

—ক্যান হইব না? পশ্চারখ্যান দ্যাখলা নি !

—না। এদিশী ভাষায় বলো— লোভী ইংরেজ, তোদের এই দেশ থেকে তাড়াইবোই।

ন্যাড়া বিড়বিড় করে—কি যে কওঁ !

ধনপতিদা থিয়েটারের ভক্ত। তিনিই এগিয়ে এসেছেন। পটলার ছোটকাকা বলেন— থিয়েটার করছিস আবার! সেবার দক্ষযজ্ঞ করে তো ডেকরেটারের আড়াইশো টাকা, ড্রেসারের দেড়শো টাকা গচ্চা দিতে হল।

গদাই বলে-এবার ড্রেস লাগবে না। সোশ্যাল ড্রামা।

ছোটকাকা বলেন—আর কোনো হাঙ্গামা হলে সব কটাকে দূর করব।

পটলা মত দেয়—কি-কিসু হবে না।

পটলার বাবা অবশ্য কড়া ধাতের মানুষ। পটলার এক একটা বাতিক নিয়ে তিনিও বিপদে পড়েন। পটলা যখন যেটা ধরে তখন সেটা একনিষ্ঠ ভাবে করে। কবিতা লেখা নিয়েই সেবার আত্মবিসর্জন দিতে বসেছিল। দিন কতক ফুটবল নিয়ে মাতলো। পেলে হবে। হাঁটুর মালাইচাকি ঘুরে গিয়ে মাসখানেক প্লাস্টার করে পড়ে থাকার পর সে বাতিক গেছে। এবার নাটক নিয়ে পড়েছে। জাতীয় নাট্যশালা গড়ার প্ল্যানও করছে।

পটলার বাবা বলেন—শিশির ভাদুড়ি হবেন! এদিকে ক্লাসের পরীক্ষার নম্বর তো দেখছি। থিয়েটার করা ঘুচিয়ে দেব।

তবু মা, পিসির জন্য পটলা বেঁচে যায়। মা বলেন—ছেলেমানুষের খেয়াল, দু দিনেই থেমে যাবে।

পটলা আড়ালে বলে আমাদের—দেখবি নাটকের পথ বদলে দেব। পটলচন্দর যা নিয়ে পড়ে, তার শেষ দেখে, বুঝলি? দরকার হয় শহিদ হয়ে যাব নাটকের জন্যই।

হোঁৎকা বলে, ওসব পরে হবি—এখন কার্ড বিলি হয়ে গেছে, পোস্টার পড়েছে, এসটেজ বাঁধা হচ্ছে। এখন হোস না ।

দেশপ্রেমী তরুণ ত্রিদিবের রোল করছে পটলা। দেশকে ভালোবাসার অপরাধে ইংরেজের ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিতে হবে তাকে। ডায়ালগ বলতে শেষ সিনে-বন্দে মাতরম্! পটলার ওই কথাটা যাতে ক্লিয়ার বের হয়, তার জন্যই আজকাল সে কথায় কথায় বন্দে মাতরম্ ধ্বনি দিচ্ছে। মহড়ার পর গুপির চায়ের দোকানে গিয়ে আউড়ে দেয় – গুপি, দশটা ম-মামলেট আর চ-চা। বন্দে মাতরম্।

লোকে লোকারণ্য। সারা মাঠ ভরে গেছে। নাটক শুরু হতে দেরি নেই। গদাই গড়াই বাস্তবধর্মী নাটক করছে, এর মধ্যে ডেকরেটারকে দিয়ে বেশ মজবুত শালকাঠের ফ্রেম করে ফাঁসি-কাঠ বানিয়েছে। আমি শুধোই—এ যে বেশ পোক্ত গো গদাইদা!

গদাই বলে—পটলাকে রিয়্যাল সিন করতে হবে। তাই পোক্ত চাই ওটা।

চমকে উঠি—সেবার নবপল্লীর ‘ক্ষুদিরাম’ বই দেখেছিলাম, ফাঁসির মঞ্চই করেছিল, এসব তো করেনি।

গদাই ধমকে ওঠে—ফাঁসির সিন-এর তুই কি বুঝবি! এইটাই আমার ক্লাইমেক্স সিন, যা মেকআপ করে নিজের পার্ট গিয়ে পড়গে। এসব ব্যাপার তোরা কিছু বুঝবি না।

পটলা দারুণ মেকআপ নিয়েছে। একেবারে মূর্তিমান দেশপ্রেমিকই হয়ে গেছে। খদ্দরের ময়লা পাঞ্জাবি, কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ, পায়ে চঞ্চল।

হোঁৎকাও জবরদস্ত পুলিশ অফিসার সেজেছে। কোমরে চামড়ার খাপে রিভলভার, ওটা অবশ্য ওর ভাইপো টাবলুর। সে এর মধ্যে দুবার দখলদারি জানিয়ে গেছে।

পটলা অবশ্য এবার নিরাপদে পার্ট করছে। দর্শকরাও ভেবেছিল পটলা ডায়ালগ শুরু করলেই মজা হবে। তোতলামিটা বেশি হয় নার্ভাস হলে, ওকে নার্ভাস করে দিতে পারলেই ব্যস !

কিন্তু হতাশ হয় তারা। পটলার ডায়ালগ নেই। পটলা স্রেফ চোখ ছানাবড়া করে, হাত-পা নেড়ে অভিনয় করছে, মাঝে মাঝে অব্যক্ত গোঙানি করে পুলিশরূপী হোঁৎকার কোঁতকা খেয়ে । বড় বড় হাততালি পড়ছে।

গদাই-এর বুকখানা ফুলে উঠেছে। এর মধ্যে ন্যাড়াই আওয়াজ খেল। দেশনেতার ভূমিকায় সে উত্তেজিত হয়ে লেকচার দিতে দিতে হঠাৎ থেমে গেল, পার্ট ভুলে মেরেছে। জানতাম মারবেই।

দশ লাইন কবিতা মুখস্থ পারে না যে, সে ওই ভাষা বলতে পারবে না তা জানতাম। ইদানীং পটলার ডান হাত সে। তাই পটলার জোরেই ওই পার্ট পেয়েছিল। আর স্রেফ ভুলে যেতেই দর্শকদের দিকে চেয়ে জিব বের করেছে মাকালীর মত।

হৈ-হৈ শব্দ ওঠে।

পরক্ষণেই ন্যাড়া গর্জে ওঠে–হালার ইংরাজের বাচ্চা, তোগোর এই সুনার বাংলা থনে তাড়াইমু—

হাসির তুবড়ি ছোটে!

ন্যাড়া ফিরে আসতে গদাই ওর চুলের মুঠি ধরেছে, শেষ করে দেব ব্যাটাকে। কতবার বলেছি ঠিক করে বল।

ন্যাড়া গজরায়—ভুইলা গেলাম পার্টখান, এক জম্পেশ কতা ল্যাখছ, হালায় মনে থাকব ক্যান। আর হইব না ।

পুলিশরূপী হোঁৎকা একবার হুঙ্কার ছাড়তে গিয়ে গোঁফ জোড়াটাই রেখে এসেছে মঞ্চে। আর নরেশের মঞ্চে ঢুকে হাঁটু দুটো ঠকঠকিয়ে কাপতে শুরু করেছিল। গদাই যত বলে এসটেডি, কিন্তু সে শোনে, কার কথা? কাঁপুনির চোটে পার্ট না বলেই সে পালিয়ে এসেছে তুমুল হাততালির মধ্যে। কেবল পটল আজ একাই পার্ট করে যাচ্ছে। একেবারে ধ্যানস্থ অভিনেতা হাততালিও কুড়োচ্ছে।

শেষ দৃশ্য। আমি বলি, ওসব রিয়্যাল করে কাজ নাই রে। ধমকে ওঠে গদাই ।

ফাঁসির মঞ্চ রেডি। গদাই শেষবারের মত চেক আপ করে সিন তুলেছে হুইসিল বাজিয়ে। দেশপ্রেমিকের ফাঁসি হবে। পটলাও প্রাণ দিয়ে অভিনয় করছে। দারুণ গ্যাস খেয়েছে সে। সে বলে, অভিনয় করতে হবে মনপ্রাণ দিয়ে-

পিছনে নিধু ব্যায়লাদার আর পশুপতি বাঁশের বাঁশিতে করুণ করুণ সুর বাজাচ্ছে। গদাই লাল আলোর ফোকাস দিয়েছে মঞ্চে। পিছনে নেপথ্যে বন্দে মাতরম্ ধ্বনি ওঠে। পটলাও ঝুলে পড়েছে।

তারপর ঘোঁতনার একটা বড় ডায়ালগ। কলরব লোকজন স্তব্ধ! পটলা সত্যিকার দড়িতেই ঝুলে পড়েছে। আর ঘোঁতনা চোখ বুজে করুণ সুরে ডায়ালগ শুরু করবে, হঠাৎ কাণ্ডটা বেধে যায়। নিজেও এবার বুঝেছে ব্যাপারটা। গলায় চাপ পড়তেই ফাঁসির মঞ্চের মাঝখানের কাঠটা দু হাতে হোরাইজোনটাল বার ধরা করে ধরে চিৎকার করছে, অ্যাই হোঁৎকা, দড়িটা কেটে দে। গলায় লাগছে।

অ্যাই হোঁৎকা। দ-দ-দড়িটা ক্ ক্—

হোঁৎকা তখন পুলিশ অফিসার, তার হুকুমেই ওকে টাটকা ফাঁসিতে লটকানো হয়েছে, সে খোলে কি করে! এদিকে ফাঁসির আসামী তখন বারে দোল খাচ্ছে সার্কাসের ক্লাউনের মত। কলরব, হইচই চলছে দর্শকদের মধ্যে।

এই ফাঁকে ফাঁসির সুতলির দড়িটাও পটাং করে ছিঁড়ে গিয়েছে। আর দেশপ্রেমী মৃত্যুঞ্জয় বীর বালক ফাঁসির মঞ্চ থেকে টপাক করে নেমে সিধে ভিতরে দৌড় দিয়েছে। তখনও স্টেজের সামনে ঘোঁতনা করুণ সুরে মৃত্যুঞ্জয় বীরের প্রশস্তি গাইছে।

তুমুল হাসির শব্দে ওর চমক ভাঙে। কোথায় শহিদ? ফাঁসির মঞ্চ ফাঁকা। পটলা কেটে পড়েছে।

আর সামনে উদ্দাম হাসিতে ফেটে পড়ছে দর্শককুল। কে আওয়াজ দেয়—কাট্ বে। যবনিকা পতন হয়ে যায় ।

গদাই তখন গর্জাচ্ছে—নাটকের তেইশটা বাজিয়ে দিলি পটলা। ভীরু কাওয়ার্ড।

ন্যাড়া বলে–তয় কি গলায় দড়ি দিই মরবে? ফ্যালাই তোমার থ্যাটার। আপনি বাঁচলি বাপের নাম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *