পটলার জলসা
মদনা যে এমন গদ্দারি করবে আমাদের সঙ্গে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। এই মদনা সেদিন কুলেপাড়া ক্লাব থেকে হঠাবাজার হয়ে চলে এল। কুলেপাড়া ক্লাব মদনা আর তার তিনজন সহকর্মী ন্যাপা, বিশেদের ক্লাব থেকে আউট করে দিয়েছে, ওদের বিরুদ্ধে নাকি নানা অভিযোগ, ওরা কুলেপাড়া ক্লাবের নাম ডুবিয়েছে।
কুলেপাড়া ক্লাব আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের একেবারে জাতশত্রু। আমাদের নিজেদের খেলার মাঠ, ক্লাবঘর আছে অবশ্য এবারই হয়েছে আমাদের পটলার ঠাকুমার দৌলতে। ওদের জায়গা পটলার জন্যই আমরা ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছি।
প্রতিবার ঘটা করে শিল্ড ফাইনাল হয়, ফাংশনও করি এই মাঠে। ফটকে গান-বাজনার লাইনে আছে ওই শিল্পীদের আনে। দারুণ অনুষ্ঠান হয়। কুলেপাড়ার খেলার মাঠও নাই, তবু ফুটানি আছে, আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাস্তাতেই ম্যারাপ বেঁধে ফাংশনও করে। কিন্তু আমাদের টেক্কা দিতে পারে না।
সবদিক থেকে এই অঞ্চলে পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবই সেরা। কুলেপাড়া তিনহাত সরস্বতী করেছে, পটলা বলে পাঁচহাত উঁচু সরস্বতী কর। যা লাগে দেবো। আর ওদের তিনখান গেট হচ্ছে বিসর্জনে। হোঁৎকা বলে আমাগোর ন’খানা গেট হইব পটলা ।
সবদিক থেকে কুলেপাড়া ক্লাব হেরে যায়। আর তাই নাকি ওদের মধ্যেই বিরাট ঝগড়া শুরু হয়। মদনাই তার দলবল ওই ন্যাপা বিশেদের নিয়ে ওইসব অনুষ্ঠান করে। এবার কুলেপাড়ার সভ্যরা বলে—মদনা টাকা মারে, ভালো শিল্পীদের আনে না, তাই পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবই জিতে যায়। তাড়াও মদনাকে।
অপমানিত মদনাও ক্লাব থেকে বিতাড়িত হয়ে এবার আমাদের ক্লাবে এসে হাজির হয়, পরীক্ষা শেষ, সন্ধ্যাবেলায় তাই ক্লাবে আমি, হোঁৎকা, পটলা, ফটিক মায় গোবরাও রয়েছি। পটলা আজ টোস্ট ওমলেটের ব্যবস্থা করেছে ক্লাব ফান্ড থেকে, তারই সদ্ব্যবহার করছি। অবশ্য হোঁৎকার জন্য ডবল টোস্ট চাই। ওর পেটের খোলটা একটু বড়। হোঁৎকা তাও পেয়েছে। এমন সময় মদনাদের আসতে দেখে চাইলাম। মদনা এসেছে একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থায়, ওর সঙ্গী ন্যাপা বিশুও গরুচোরের মত দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। মদনা বলে,
—হোঁৎকা, ওই কুলেপাড়া ক্লাবকে মুছে দেব।
এ যেন ভূতের মুখে রামনাম। মদনা আমাদের চিরশত্রু ওই কুলেপাড়া ক্লাবের একটা স্তন্তই। সব অনুষ্ঠান সেখানে ওই অর্গানাইজ করে, খেলার মাঠে কুলেপাড়া ক্লাবের হয়ে ওই তাণ্ডবনৃত্য করে। ভাসানের সময় কুলেপাড়া ক্লাবকে ওই সবকিছু জুগিয়ে সাহায্য করে। আমাদের ক্লাবের নামে মুর্দাবাদই দিয়েছে এতদিন। আজ এই মদনাকে ওই কথা বলতে শুনে অবাক হই। হোঁৎকা শুধোয় কি কস্ মদনা ?
মদনা রাগে ফেটে পড়ে। বলে কুলেপাড়া ক্লাবের জন্য জান লড়িয়ে দিলাম আর এখন আমাকে বলে ‘থিফ’, চোর! বেইমান! আমার জন্যই ওদের ক্লাবের বদনাম! তাই ওই ক্লাব ছেড়ে চলে এসেছি, ওই কুলেপাড়া ক্লাবকে তুলে দেব। নাম নিশানা মিটা দেঙ্গে! নাম মুছে না দিই তো আমার নাম মদনাই নয় ।
ন্যাপা বলে গুরুকে খুব হ্যাটা করেছে ওরা। আমরাও চলে এসেছি।
সামনে আমাদের বাৎসরিক অনুষ্ঠান। শুনি কুলেপাড়াও নাকি ওই সময়ই আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনুষ্ঠান করবে। তাই মদনাকে এখন পেলে কুলেপাড়া ক্লাবকে জব্বর ঘা দিতে পারব। পটলা বলে তুই আসবি আমাদের ক-ক্লাবে?
মদনা বলে সিওর। আর এবারেই কুলেপাড়ার ফাংশনকে টেক্কা দিয়ে এখানেই ফাংশন করব। দেখবি মদনার এলেম। পটলা কি বলতে যায়, হোঁৎকা টোস্টের শেষটুকু মুখে পুরে বলে, পরশু আয় মদনা, তহন কথা হইব ।
মদনা বলে তাই আসব, তবে মদনার বাত হাতিকা দাঁত, একবার বের হয়ে এসেছি ওদের শেষ করব বলে, শেষ করবই। দেখবি।
ওরা চলে গেলে পটলা বলে ওকে নিয়ে নে হোঁৎকা, ক-কাজের ছেলে। ওকে টানতে পারলে কুলেপাড়া গন্ ফট্। ফুটে যাবে। হোঁৎকা বলে, ভাবতি দে হক্কলেরে। ফট্ কইরা বিলিভ করস না ।
গোবরা বলে, আমি শুনেছি মদনাকে ওরা আউট করে দিয়েছে।
পটলা বলে, ওদের শত্রু এখন মদন। শত্রুর শত্রুকে বন্ধু বলে মেনে নিলে ক-কাজ হয়। নে মদনাকে। কাজের ছেলে, এবার মুখের মত জবাব দিব ওই কুলেপাড়া ক্লাবকে ।
ফটিক চায় জমিয়ে অনুষ্ঠান হোক এবার। মদনা থাকলে অনুষ্ঠান আরও জমবে। তাই বলে, মদনাদের নে হোঁৎকা ।
আমি বলি, হোঁৎকা ঠিকই বলছে, মদনা অন্য ক্যাম্পের ছেলে আমাদের সঙ্গে মিলবে কি না দেখতে হবে তো, শেষে যদি কোন গোলমাল হয় ?
গোবরা বলে, তাহলে মদনাকেই ঠ্যাং ভেঙে ফেলে রাখব। গোবরা গায়ের জোরেই সব করতে চায়। মদনাকে পটলার চাই, পটলাও চায় কুলেপাড়া ক্লাবকে দেখাতে যে মদনাকেও তারা এনে ওদের ঘা দিয়েছে। ফটিক তো সায় দেয় ওতে। গোবরাও।
অর্থাৎ পাঁচজনের তিনজন একদিকে, আমি আর হোঁৎকা তাই যেন ভোটে হেরে গেছি। হোঁৎকা বলে, তয় নে কিন্তু কইছি একটু হুঁশিয়ার থাকতি হইব। মদনা যদি লেঙ্গি মাইরা দেয়? পটলা বলে, নো ফিয়ার। ও ওসব করবে না ।
মদনা বিশে ন্যাপাদের নিয়ে এবার আমাদের ক্লাবেই সামিল হল। পোস্টার লেখা, প্যাম্পলেট বিলি করা, ফেস্টুন টাঙানো সবতাতেই মদনা। মদনা কয়েকদিনের মধ্যে পটলার ডানহাত হয়ে উঠল। মদনাও যেন জান লড়িয়ে দেবে আমাদের জন্যে।
পটলা বলে, না, ছ-ছেল্লেটা খুব কাজের।
পটলার ভাব একটু গভীর হলে জিবটা আলটাকরায় সেট হয়ে যায়। পটলার কাছে আর্টিস্টদের লিস্ট ফেলে দেয় মদন। নামি-দামি আর্টিস্ট। মদনা বলে সন্ধ্যাদিকে আমি বললে গাইবে ওদিকে হৈমন্তীদি, শ্রীরাধাদি, এদিকে শৈবালদা, ইন্দ্রনীলদা আর নচিকেতাদা—ব্যস ফ্যাংশন কুলপি হয়ে যাবে। কুলেপাড়া যেন কোন আর্টিস্ট না পায়। ওদের কনট্রাক্ট করাব এখানে অন্য কোন আসরে গাইবে না। করুক কুলেপাড়া ফাংশন, দেখি ক্যামন বাপের ব্যাটা। ওদের প্যান্ডেলে স্রেফ মাছি উড়বে। মাছি।
দৃশ্যটা কল্পনা করেও তৃপ্তি পাই। কুলেপাড়া ক্লাব পথে বসবে, লোক হাসবে ওদের দেখে আর পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব রমরমিয়ে ফাংশন করবে ওই সব নামি শিল্পীদের নিয়ে।
পটলা বলে তাই ক-করতে হবে মদন ।
মদনার চ্যালা বিশু ন্যাপা বলে, করতে হবে কি? গুরু যখন বলেছে তখন করা হয়ে গেছে ধরে নাও।
ঘনঘন চা, টোস্ট আসছে মদনাদের জন্য। পটলাকে নিয়ে মদনা গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছে। শিল্পীদের বাড়িতে টাকা দিয়ে কনট্রাক্ট সই করিয়ে নিচ্ছে মদনা ।
বলে, কাজ সব আমার পাকা পটল ।
পটলাও খুশি। মদনা শিল্পীদের সই করা কাগজপত্র সব নিজের ব্যাগেই রেখে দেয়। বলে, সব একবারেই দেবো মায় হিসাব সমেত।
ফাংশনের দিন ঘনিয়ে আসছে, আমাদের সময় নেই। স্বপ্ন দেখছি এবার ওই কুলেপাড়া ক্লাবকে পথে বসাবোই। সব শিল্পী এখন আমাদের কাছে চুক্তিবদ্ধ, এ পাড়ায় আর কোন অনুষ্ঠান করবে না। পটলা বলে।
–দ্যাখ হোঁৎকা, তোরা তখন বকলি মদনাকে ভরসা ক-করা যায় না। ওই মদনাই কুলেপাড়াকে বধ করেছে। এবার নাম ফাটাবে ওই পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবেরই ওই মদনার জন্যই।
পরদিন সকাল থেকেই মদনা-বিশেদের দেখা নাই। আমি তখন আর্টিস্টদের লিস্ট করছি বিশাল করে হোর্ডিং লেখানো হবে, হ্যান্ডবিল ছাপাতে হবে। মদনার কাছে লিস্ট কিন্তু মদনার দেখা নেই, ফটিক সাইকেল হাঁকিয়ে, এদিক-ওদিক ঘুরে গলদঘর্ম অবস্থায় ফিরে এসে বলে বাড়িতে তো নেই মদনা। কোথায় গেছে কদিন। পটলা বলে তাহলে গেছে কোন আর্টিস্টদের বাড়ি। ফিরে এলেই পুরো লিস্ট পাবি। কাছেই গেছে কো-কোথাও!
এমন সময় হোঁৎকা ঢোকে বিধ্বস্ত অবস্থায়। হাতে একটা পোস্টার। হোঁৎকা বলে, আর্টিস্টদের লিস্টি আর পাইবি না, মদনা গদ্দারি করছে। তখন কইছিলাম শোনসনি, এহন দ্যাখ মজাখান।
এগিয়ে দেয় পোস্টারটা। কোন দেওয়াল থেকে ছিঁড়ে এনেছে। পিছনে আঁঠা লাগানো আর এদিকে লাল কালিতে লেখা বহু তারকা সমাবেশে কুলেপাড়া ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠান। অংশ নিচ্ছেন তারপরেই আমাদের বুক করা সব নামি-দামি শিল্পীবৃন্দের নাম। চমকে উঠি, একি এসব শিল্পীকে তো আমরাই বুক করেছি! হোঁৎকা বলে বুক তো করছিস টাকাও দিছস, তয় আমাগোর পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের নাম বুক না কইরা ওই কুলেপাড়া ক্লাবের নামেই বুক করছে মদনা, ক্লিন লেঙিই মারছে আমাগোর। এহন বোঝছস সেখান?
পটলা আর্তনাদ করে ওঠে, সে কি! তাই কাগজপত্র আমাকে দেয়নি মদনা, এই স-সব ক-করেছে?
গোবরা গর্জে ওঠে, মদনারে মার্ডার করব, ওর ঠ্যাং ভেঙেই দেব নির্ঘাৎ।
বলি ওসব ছেড়ে এখন খবর নে, ব্যাপারটা কি জানতে হবে। ক্রমশ খবরটা বের হয়। মদনা বিশের দল এখন ঝাঁকের কই আবার কুলেপাড়ার ঝাঁকে মিশে গেছে, আমরাও দেখি মদনা এখন কুলেপাড়ার ক্লাবের সকলের প্রিয় আপনজন। যে কুলেপাড়া ক্লাবকে সে মুছে ফেলে দিতে চেয়েছিল, সেই ক্লাবেরই এখন কর্মকর্তা। ওই নাকি সদর্পে বলে পঞ্চপাণ্ডবের সব কটাই ছাগল তাই অনায়াসেই ওদের ঘাড় মটকেছি। মরুক ছাগলের দল।
কথাটা আমাদের কানেও আসে। কিন্তু করার কিছুই নেই। আমাদের টাকায় আমাদের বোকা বানিয়ে মদনা এখন ফাংশন করতে চলেছে। আর আমাদের করার কিছুই নেই। পটলা তবুও চেষ্টা করে । শিল্পীদের কাছে গিয়ে বেশি টাকাও দিতে চায়। কিন্তু তারা বলে, কুলেপাড়া ক্লাবের টাকা নিয়ে চুক্তি করেছি, দশদিন ওখানে অন্য কোথাও অনুষ্ঠান করব না।
সন্ধ্যার আঁধার নেমেছে আমাদের ক্লাবঘরে। চুপচাপ বসে আছি। ওদিকে কুলেপাড়া ক্লাব অটোতে মাইক লাগিয়ে তাদের অনুষ্ঠানের শিল্পীদের নাম ঘোষণা করছে। আর ওদের কার্ডও বেশি দামে বিকোচ্ছে। এত শিল্পীর সমাবেশ করেছে কুলেপাড়া ক্লাব, এমন ফাংশন ইতিপূর্বে এখানে আর হয়নি।
পটলা বলে আ-আমি সু-সুইসাইড করব।
পটলার জন্যই এই সর্বনাশ হয়েছে তাই পটলা সুইসাইড করে লজ্জা এড়াতে চায়। গোবরা গজরাচ্ছে, মদনারে মার্ডার করব। ব্যাটা গদ্দার। বিশ্বাসঘাতক।
ফটিক বলে লোকে হাসছে রে। বলছে আমরা নাকি ছাগলপার্টি, গাধার দল।
আমি কোনো জবাব দিই না। যেন সবাই ক্লাবের মৃতদেহ আগলে রয়েছিল শেষ সৎকারের আশায়। হঠাৎ হোঁৎকা গর্জে ওঠে, একটা বিহিত করুম। পটলা সুইসাইড করতি হইব না । যা বলি তাই কর। ওই কুলেপাড়া ক্লাব মদনা দুইটাই ফিনিস হইব। প্রতিশোধ লমুই ।
পটলা বলে, পারবি হোঁৎকা ?
হোঁৎকা বলে—সিওর, ওদের ফাংশন ক্যামন জমজমাট হইব দেখবি ।
এবার নতুন আশা নিয়ে সে উৎসাহ নিয়ে, আমরাও এবার হোঁৎকার প্ল্যানটা শুনছি। হোঁৎকার মাথাতে নানা বুদ্ধি হঠাৎ হঠাৎ খেলে যায়, তাতে অনেক সমস্যার সমাধানও হয় বেশ বিচিত্রভাবে। এবারও একটা প্ল্যান এসেছে ওর মাথায়।
সব শুনে বলি, প্ল্যানটা ভালোই, তবে খুব সাবধানে আর গোপনে এসব করতে হবে। পটলা বলে, তাই করবি, টাকা যা লাগে দেব। ঠিকমত ক-কাজ যেন হয়। পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের বাঁচা-মরার প্রশ্ন জড়িত যে। ঠিকঠাক কাজ যেন হয়।
গোবরা বলে ওর জন্য ভাবিস না। ওই জীব-জন্তুর ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দে, আর সমী ওই টেলিফোন তুই পটলাদের বাড়ি থেকে পটাপট করতে থাকবি।
হোঁৎকা বলে বাকি সব ব্যবস্থা আমিই করুম। পটলা বেশ কিছু টাকা দিয়ে বলে, তাই কর। টাকা যা লাগে নে। এই গদ্দারির জবাব দিতেই হবে।
কুলেপাড়া ক্লাবের এখন রমরমা অবস্থা। ওদিকের বড় রাস্তায় ওরা বেশ বড়সড় প্যান্ডেল করেছে। ওদিকেই ধোপাদের আড্ডা, এদিকে বাড়ি—মাঝের পথে ওদের প্যান্ডেল । অফিসে হইচই চলছে। মদন দলনেতা। তার নামে আর ওদের প্রেসিডেন্ট ভূধরবাবুর নামে কার্ড ছাপা হয়েছে, বেশ চড়া দামেই দেওয়া হচ্ছে কার্ড। পাড়ার দেওয়ালে ওদের রঙিন পোস্টার ব্যানার লাগানো মাইকে পাড়া মুখর করে কুলেপাড়ার ক্লাবের জয়ধ্বনি ঘোষিত হয় ।
আমরা মুখ লুকিয়ে যাতায়াত করি। লোকে জানে হেরে গিয়ে পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব তাদের অনুষ্ঠান বন্ধ রেখেছে। লজ্জায় চলে গেছে কোথায় ওদের সভ্যরা।
কুলেপাড়ার অনুষ্ঠানের দিন সমাগত। মদন এখন খুবই ব্যস্ত। এখন সে কুলেপাড়ার হিরো। পরের পয়সায় এত শিল্পী পেয়ে গেছে। এত টাকা বাঁচিয়েছে ক্লাবের আর পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবকে ঠান্ডা করে দিয়েছে সুতরাং এদের কাছে মদন এখন হিরোই। ভূধরবাবুরও রাগ আমাদের উপর। আমাদের জন্যই নাকি সে ভোটে হারে। এবার এই অনুষ্ঠান করে নাম ফাটিয়ে জিতবে সে।
মদন এখন আমাদের দেখেও দেখে না। ফাংশনের মালকড়ি ভালো আমদানি হচ্ছে, আর শিল্পীদের টাকা দিতে হয়নি। তার অর্ধেক নাকি মদনই পাচ্ছে ক্লাব থেকে। তার দিনকাল ভালোই চলেছে, আমাদের দেখে বলে শ্লেষভরা কণ্ঠে, কিরে ফাংশন করবি না? এ্যা কী হল ? হোঁৎকা চুপ করে থাকে। আমরাও নীরব থাকি।
পটলাই গর্জায়, বি-বি-
হাসে মদনা, বিশ্বাসঘাতক? তোরা তো ছাগল ৷
গোবরা গর্জায়—দেব এক রদ্দা ।
আমি থামাই তাকে। হোঁৎকা বলে। চল এহান থেকে। আমরাই সরে আসি সব অপমান সহ্য করে। মদনা বিশের দল দাঁত বের করে হাসে।
হোঁৎকা বলে সব সায়লেন্ট থাকবি! যা করার ঠিকঠাক করতি হইব গোবরা—
গোবরা বলে, সব ব্যবস্থা করেছি, তোরা যে যার ডিউটি করে যা।
অনুষ্ঠানের দিন কুলেপাড়া ক্লাবের সভ্যদের ব্যস্ততার সীমা নেই। মদনা সব কাজের ভার ওদের সভ্যদের বুঝিয়ে দিয়েছে। একদল শিল্পীদের অভ্যর্থনা করবে। অন্যদল গেট সামলাচ্ছে। মদন নিজে অনুষ্ঠান পরিচালনা করবে। চোস্ত আর ঝকঝকে চিকনের কাজ করা গুরুপাঞ্জাবি পরে মদন মেক-আপ দিয়ে মাইকে তখন ইনিয়ে-বিনিয়ে কুলেপাড়া ক্লাবের মহান অবদানের কথা ঘোষণা করছে। বিশাল দেহ নিয়ে ভূধরবাবু গলায় মালা পরে, বোদা মুখ করে বসে আছে মঞ্চে।
প্যান্ডেল তো ভর্তি। স্টেজে লাল-নীল আলো জ্বালার পরীক্ষা চলেছে এরপর ক্লাবের সভ্য-সভ্যারা উদ্বোধন সঙ্গীত গাইবে নৃত্য সহকারে।
ওদিকে গ্রিনরুমে তখন নামিদামি তিনচার শিল্পীও হাজির। ছেলেরা বুকে ব্যাজ লাগিয়ে তাদের খাতির করছে। বক্তৃতার পর এবার সানাই বাদন চলেছে এরপর মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছে কুলেপাড়া ক্লাবের সভ্যসভ্যাদের সমবেত বেদগান পরিবেশিত হবে।
মঞ্চ ফাঁকা—লাল-নীল আলোর ট্রায়াল চলছে।
ওদিকে গোবরা ফটিক আর গোবরার ধোপাপাড়ার চ্যালারাও যে অন্ধকারে পুকুরপাড়ে তৈরি হয়ে আছে ওদের হাতে মুঠো মুঠো নস্যি আর গোবরা খোঁজখবর করে ধোপাপাড়া থেকে গোটা দশবারো গাধাও জোগাড় করে ওদিকে অন্ধকারে তৈরি হয়ে আছে লাঠি হাতে। মাইকে ঘোষণা হতেই গোবরা বলে ওঠে, স্টার্ট—
মঞ্চ প্যান্ডেলে দর্শকরা হঠাৎ কলরব করে ওঠে, মাইকে ঘোষণা চলছে সভ্যসভ্যাদের সমবেত বেদগান হঠাৎ বিকট চিৎকারে চাইল শ্রোতারা, ওদিকে তাড়া খেয়ে প্যান্ডেলের চাদর ঠেলে ঢুকছে গোটা দশেক গাধা গলায় লাল জবা ফুলের মালা আর ওদের দুই নাকে গোবরার দল মুঠোভর তাজা নস্যি পুরে দিতে ওই গাধার দল বিকট শব্দে হাঁচছে আর চিৎকার করছে তারস্বরে—হ্যাঁচ্চো হ্যাঁচ্চো ফ্যাঁচ্ হ্যাঁচ্চো আট-দশটা গাধা মালা পরে মঞ্চে ঢুকে ওই বেদম কোরাস চালু করেছে। মাইকে ওই গাধার হাঁচি আর আর্তনাদ তখন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিয়েছে—হ্যাঁচ্চো—হ্যাঁচ্চো-
কুলেপাড়ার সভ্যসভ্যারা এমন বেদগান গাইবে তা দর্শকরা ভাবেনি। ওরা হাসতে থাকে। এ কি বেদগান রে? এ যে গাধার দলের চিৎকার।
মদন বুঝতে পারেনি এমনি কাণ্ড ঘটবে। সে তার দলবল নিয়ে গাধাদের তাড়া করে। গাধার মত নিরীহ জীব যে মারাত্মক হতে পারে তা তাদের জানা ছিল না। চারপায়ে লাথি ছুঁড়তেই মদন ছিটকে পড়ে ওদিকে—কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে আর ধাবমান গাধার দল এবার জনারণ্যে কোনদিকে যাবে ভেবে না পেয়ে সামনের দিকেই দৌড়লো, সঙ্গে সেই চিৎকার—হ্যাঁচ্চো, হ্যাঁচ্চো, হ্যাঁচ—দর্শকরা এ হেন অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি ছিল না। তাড়া খেতেই গাধাগুলো যে যেদিকে পারে ছুটছে, ফলে দর্শকরাও এবার যে যেদিকে পারে দৌড়োল, চেয়ার ভাঙছে গাধার লাথিতে। মানুষজনের কলরব ওঠে, সেই সঙ্গে সমবেত গর্দভরাগিণীও চলেছে।
কয়েক মিনিট মাত্র, তার মধ্যেই প্যান্ডেল লণ্ডভণ্ড, লোকজনও উধাও। ওদিকে দুটো গাধা গ্রিনরুমের দিকে ছুটেছে। একজন ভলেনটিয়ার ছিটকে পড়ে, পালাও ।
শিল্পীরাও গাধার লাথি থেকে প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পারে বের হয়ে গাড়িতে উঠে কেটে পড়ে। জানে ফাংশন ভণ্ডুল হলে তারপর প্যান্ডেল ভাঙচুর হবে। পাবলিক ধরবে তাদেরও। কোনরকমে গাধার দল তো পালাল সব পণ্ড করে, আবার কর্মকর্তাদের পেটাতে লোকজন ভাঙা আসরে ফিরে আসে, কিন্তু শিল্পীরা আর ফেরেনি, তারা কেটে পড়েছে।
ওদিকে আমি তখন পটলার বাড়ি থেকে বাকি শিল্পীদের ফোন করছি, আমাদের ক্লাবে গোলমাল হচ্ছে আপনাদের অনুষ্ঠান বাতিল করা হল। না আসাই নিরাপদ। অন্যত্র অনুষ্ঠান থাকলে চলে যান ৷
মদনা কোনমতে মাথায় ফেট্টি বেঁধে মঞ্চে খাড়া হয়ে ঘোষণা করছে—বসুন, শান্ত হয়ে বসুন, অনুষ্ঠান যথারীতি হবে, শিল্পীরা এসে পড়বেন।
তাড়া খাওয়া দর্শকরা তো এবার মরিয়া। ঘণ্টাখানেক হয়ে গেছে, নামি-দামি শিল্পী কিছু ভেগেছে আগেই। বাকিদের পাত্তা নেই। তাই তারা এখানের অনুষ্ঠান বাতিল হতে অন্যত্র ধরে নিয়ে চলে গেছে। তাদেরও পাওয়া যাচ্ছে না।
তারপরই শুরু হয় ভাঙচুর। দর্শকরা গর্জন করে ফোরটোয়েনটিগিরি করা হচ্ছে, গাধার সং দেখাতে টাকা দিইছি?
কইরে শিল্পীরা কই? কে আওয়াজ দেয় ৷
ক্রমশ হাওয়া গরম হতে থাকে। দুচারটে ঢিল-পাটকেলও পড়া শুরু হয়। মড়মড় করে চেয়ার ভাঙছে, উত্তেজিত দর্শকদের উত্তেজনাও বাড়ছে। মদন ভূধরবাবু ব্যাপার গুরুতর দেখে ঘাবড়ে গেছে। উৎসাহী-ভলেনটিয়াররাও এবার ব্যাজ খুলে পকেটে পুরেছে দর্শকদের মার থেকে বাঁচার জন্য। ভাঙচুরের পর আরও কিছু করত দর্শকরা কিন্তু পুলিশই জোর করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে প্যান্ডেল মাইক বাঁচালো কোনমতে।
সারা রাত অবধি এই নাটকই চলেছিল তারপর মদন ভূধরবাবু অন্য কর্মকর্তাদের পুলিশ অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবার পর জনতা ফিরে যায়। অনুষ্ঠান মঞ্চে যেন দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেছে।
আমরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে সবই দেখছি। হোঁৎকা বলে—কি রে পটলা এহন খুশি? পটলা বলে, পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের মুখ রেখেছিস হোঁৎকা। উঃ মদনারে পুলিশ টানতে টানতে নে গেল—ওই মোটকা ভূধররেও। খুব খুশি হইছি।
গোবরা এসে জানায়, পুলিশ ওদের ক্লাবঘরেও তালা দিয়ে গেছে।
পটলা বলে, ভেরি গুড, চল এবার। কাল হোঁৎকার অনারে তোদের ক-কবজিভোর মাংস খাওয়াব।