পটলার কারসাজি
পটলা আবার এক প্রবলেম নিয়ে পড়েছে। প্রবলেম অর্থাৎ সমস্যাগুলো যেন পটলার আশেপাশেই থাকে গা-ঢাকা দিয়ে, যখন তখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এবারও তাই হয়েছে।
পটলা এবার বড় মামার বাড়ির গ্রামে গিয়েছিল পুজোর সময়। পটলার মামারা অনেকেই এখন ওই গ্রামে স্থায়ীভাবে থাকেন না। শহরে তাঁদের বাড়ি, ব্যবসাপত্র ।
শহর থেকে ওই গ্রাম প্রায়, তিরিশ মাইল দূরে। এককালে ওসব অঞ্চল ঘন শাল, মহুয়ার বনে ঢাকা ছিল। পটলার দাদু ছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার। পুরোনো সাবেকি আমলের চকমিলানো বাড়ি। চারপাশে যত্ন করে আম, কাঁঠাল, লিচু গাছ লাগিয়েছিলেন।
এখন জমিদারি আর নেই, দাদুও মারা গেছেন। তবে নামডাক রয়ে গেছে। গ্রামের বাড়িতে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় শশীবাবু থাকেন। তিনিই জমিজায়গা দেখাশোনা করেন। মামারা পুজোতে গ্রামের বাড়িতে যান, কারণ পৈত্রিক দুর্গাপুজোটা এখনও রয়ে গেছে। বেশ ধুমধাম করেই হয়।
পটলা সেবার মামাদের সঙ্গে দেশের বাড়িতে গিয়ে ওই রুক্ষ পার্বত্য অঞ্চলের মানুষদের দেখে এসেছে।
আর কলকাতায় ফিরে সেদিন ক্লাবে এসে ঘোষণা করে,—আমি পল্লীগ্রামে গিয়ে সেখানকার মানুষদের পাশে দাঁড়াব, শিক্ষার আলো বিতরণ করব। রবীন্দ্রনাথ ব-ব বলেছেন-
বেশি আবেগ চাপলে পটলার জিবটা আলটাকরায় মাঝে মাঝে সেট হয়ে যায়।
হোঁৎকা, ক্লাবের মাঠে শুধু মুখেই বসেছিল । ক’দিন পটলা অর্থাৎ আমাদের ক্যাশিয়ারই ছিল না, ক্লাবের পকেটের স্বাস্থ্যও তাই খারাপই চলছে। হোঁৎকা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে–ঝালমুড়ি, ফুচকা কিছু আছে? তয় তর কথা শুনুম—নয় তো যাই সেভেন বুলেটস্ ক্লাবেই। ওগোর ওখানে টোস্ট-ওমলেট দিব কইছে।
হোঁৎকা উঠছে, গোবর্ধনই বাধা দেয়। বলে,—বসো। টোস্টই হবে। পটলা—কেমন বেড়িয়ে এলি শোনা। ফটিক—জগাদাকে বলে আয় পটলার হিসেবে যেন টোস্ট-ওমলেট পাঠায় এখানে।
হোঁৎকা তাড়া দেয়,—তুই লইয়া আয় সঙ্গে কইরা। যেন গরম থাকে। ক’ পটলা, কি যেন কইছিলি?
পটলার কাছে এই কটা টাকা তেমন কিছুই নয়। বিরাট পরিবারের একমাত্র বংশধর সে। ওর বাবা-কাকাদের বিশাল ব্যবসা, আর ঠাকুমার নয়নমণি। দুটো বাজারের মালিক ওর ঠাকুমা। সুতরাং পটলাই আমাদের ক্লাবের কামধেনু। পটলার নানা প্রবলেম আমাদেরই সল্ভ করতে হয়।
এবার, পটলা ঘোষণা করে,—দেশের মানুষের জন্য কিছু করা দরকার। তাই ভাবছি ওই দূর পাড়াগাঁ কুসুমডিতেই যাব।
পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের মূল সভ্য বলতে আমি, ফটিক, গোবর্ধন, হোঁৎকা। ফটিক আবার গানের চর্চা করে। একটা লাইনই প্রায় বছর খানেক ধরে রবারের মত টেনে লম্বা করে, আর গিটকারি দিয়ে তান তোলে। গোবর্ধনকে দেখতে গিরিগোবর্ধনের মতই। তার মামার সঙ্গে সে কুমড়ো, চালকুমড়ো ইদানীং চিটে গুড়ের কারবার করে। আর সেক্রেটারি ওই হোঁৎকা। বেশ প্ৰমাণ সাইজের গতরখানা। মাথায় ওর বদবুদ্ধি যেন ঠাসা আছে। সাহসও ওর অনেক। ঠান্ডা মাথায় সব সমস্যার সমাধান করতে পারে। তবে দোষ একটাই একটু বেশি মাত্রায় পেটুক। খিদের সময় কিছু না খেলে ওর মাথা গরম হয়ে যায়।
—পটলার কথায় এবার হোঁৎকা বলে আবার একখান ঝামেলা পাকাইবি পটলা ?
পটলা বলে–ঝামেলা কে-কেন? ম-মহৎ কাজ। তোরা না যাস এ-একাই যাব। পটলার ঠাকুমা নাতির এহেন প্রতিজ্ঞার কথা শুনে চমকে ওঠে,―অ, বৌমা, পটলা কি বলে দ্যাখো! সে তো বনবাদাড়—একেবারে বুনো জায়গা, বুনো হাতির পাল ঘোরে- পটলা বলে,—তাদেরই দেখার কেউ নেই ঠাকুমা। শিক্ষার আলো পায়নি তারা। আমাকেই যে যেতে হবে ।
পটলার যে কথা সেই কাজ। ও যাবেই। এর মধ্যে বেশ কিছু অ আ ক খ—ইত্যাদির বই, স্লেট-পেন্সিল এসব কেনা হয়েছে। বেশ কয়েক ব্যাগ লজেন্সও কিনেছে। কচিকাঁচা পড়ুয়াদের আকর্ষণ করার জন্য ।
আর এই কারণেই ঠাকুমার ডাক পড়েছে। ও বাড়ির পুরনো চাকর শম্ভু পটলার এই ডেরা চেনে। সে সন্ধ্যার মুখেই এসে আমাদের খবর দেয়,—ঠাকমা ডাকছে। জোর তলব।
হোঁৎকা বলে,—পটলার ক্লাবে আর নাই, রেজিকনেশন দিমু।
গোবর্ধন বলে,—মাথা গরম করিস না। স্কুলের তো এখন ছুটি, চল ঠাকুমা কি বলে শুনে আসি।
পটলার ঠাকুমা আমাদের দেখে বলে,—এসেছিস? দ্যাখ গে পটলার কাণ্ড! কোথায় বুনোদেশে যাচ্ছে—কি যে করি! থামাতেও পারছি না। তোরাও যা সঙ্গে ।
গোবরা বলে,— ঠাকমা, কুমড়ার সিজন। মাল কিনতে হচ্ছে।
—ওদেশে কুমড়ো পাবি জলের দরে।
ঠাকুমার কথায় গোবরা খুশি হয়। জলের দরে কিনে এনে এখানে পাইকেরি চার টাকা কেজি বেচলে প্রচুর লাভ হবে।
ফটিক তো গান বেঁধে বসে আছে।
পটলার মা বলে,—হোঁৎকা, পুকুরের মাছ, গরুর দুধ, বাগানের আম কাঁঠালও আছে। আর মুরগিও সস্তা।
হোঁৎকার পেটুক মন এবার নেচে ওঠে। বলে,—ঠামা আপনি যহন কইছেন—যামু। তারপরই হোঁৎকা প্যাচটা কষে,–মুশকিল হইছে ফুটবল টিম লইয়া। মানে এহানে না থাকলি চাঁদাও উঠব না, টাকা না হলি টিমও হইব না।
গোবর্ধনও ধুয়ো ধরে,তাই তো যাবার সমস্যা হচ্ছে। ঠাকুমা বলে,—কত টাকা চাঁদা তুলিস তোরা ?
হোঁৎকা বলে ওঠে,—ধরেন হাজার সাতেক তো লাগবোই। দোরে দোরে ঘুরতি হয়। ঠাকুমা বলে—দোরে দোরে ঘুরে ভিক্ষে করতে হবে না। সরকার মশাই—
সরকার মশাই হাজির থাকে গিন্নিমার আশপাশেই। সে-ও এসে হাজির হয়, – ডাকছেন-
ঠাকুমা বলে,—এদের ক্লাবের নামে দশ হাজার টাকা দান বাবদ লিখে টাকাটা আজই দিন। যে আজ্ঞে।—সরকার মশাইও সায় দেন ।
এবার ঠাকমা বলে—ওই ফুটবলের সমস্যাটা মিটে গেল। তোরা তৈরি হয়ে নে ভাই, পটলাকে একা ছাড়তে মন চায় না।
পটলার সঙ্গে যাবার আর কোনো বাধাই নেই ।
রাতের ট্রেন, সন্ধ্যায় খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা ট্রেনে উঠেছি। সরকারমশাই আগে থেকেই রিজার্ভেশন করে রেখেছিল, তাই বার্থ পেতে অসুবিধা হয়নি। আমরা পাঁচজনই বেশ আরাম করে শুয়েছি। গাড়িও চলছে। সেকেন্ড ক্লাস ক্যুপে থাক-থাক তিনটে করে ছ’টা বাঙ্ক আমরা পাঁচজনে পাঁচটা দখল করেছি, আর নিচে এক বয়স্ক টাক-মাথাঅলা ভদ্রলোক রয়েছেন।
নীল মৃদু আলো জ্বলছে, কামরার সবাই ঘুমে মগ্ন, হঠাৎ ওদিক থেকে কাদের কঠিন কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,—কেউ নড়বে না। যে যেখানে আছ, সব জানলা বন্ধ করে বসে থাক। খবরদার! কাজে বাধা দিলে গুলি চলবে।
দেখি কামরার দরজাগুলো লক করে জানলার স্টিলের সাটার, কাচের শার্সি অবধি বন্ধ করে দিচ্ছে কয়েকজন লোক। আর ওদের হাতে উদ্যত রিভলবার, ভোজালি, রড। কারো হাতে ছুরি, কামরার আলোয় চকচক করছে। ওরা সব জানালা বন্ধ করে দিচ্ছে, যাতে কোনো শব্দ বাইরে না যায় ।
পটলা বলে,—ডা-ডাকাত !
আজকাল ট্রেনে ডাকাতি প্রায় রোজকার ঘটনা। কিন্তু আমাদের ট্রেনে আজই ডাকাত পড়বে ভাবিনি।
ওদিকে এক একটা ক্যুপে দুজন করে ঢুকে লুটপাট শুরু করে দিয়েছে।
বেশ মিষ্টি সুরেই আমাদের বাঙ্কের নীচেকার ভদ্রলোককে এক ডাকাত বলল, – ক্যা হ্যায়, দেও বাবা !
ভদ্রলোক জামার পকেট থেকে শতখানেক টাকা বের করতে একজন বলে,—বাবা! এহি ? লোকটি বলে,–এই আছে।
ওদের মনঃপুত হয় না কথাটা। রড দিয়ে এটাচিতে কয়েকটা ঘা মারতে এটাচিটা ফেটে যায়। ভিতর থেকে জামা কাপড় টেনে বের করে কাগজের মধ্যে একটা ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট, অর্থাৎ ব্যাঙ্ক ছাড়া ভাঙানো যাবে না দেখে গর্জে ওঠে,—পঞ্চাশ হাজার রুপেয়ার ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট! নগদ ক্যাশ কিউ নেহি লায়া ?
অর্থাৎ নগদ টাকা না এনে ব্যাঙ্কের ড্রাফ্ট এনে ভদ্রলোক যেন ওদের পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্ষতি করেছেন। এবার ওদের একজন সেই ড্রাফ্টটা ছিঁড়ে ফেলে গর্জে ওঠে,—অব ক্যা হোগা? কৌন্ বাঁচায়েগা ?
এরপর ওরা ভদ্রলোককে নির্দয়ভাবে মারতে থাকে।
হোঁৎকা বাঙ্কের উপর থেকে নামতেই একজন ওর বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে শাসায়,–একদম চুপ থাকবি ।
লোকটা ওর পকেটে হাত ঢুকিয়ে গোটা পঞ্চাশ টাকা বের করে নিয়ে প্যান্ট-জামা সার্চ করছে। গোবরাও নিঃস্ব। তারও সব গেছে।
আমি বলি,—ভদ্রলোককে মারছ কেন ?
একজন আমার গালে সপাটে চড় মেরে গর্জায়,—চুপ!
ওদিকে মেয়েদের কার কানের দুল খুলতে সময় লাগছে দেখে ভোজালি দিয়ে কানের লতিই কেটে নেয়, দুল সমেত। কান্না, আর্তনাদ ওঠে।
ওই নিষ্ঠুর পশুর দল সবার সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে, নির্দয়ভাবে মেরে আহত করে, মাঝমাঠে চেন টেনে গাড়ি থামিয়ে বীরের মত নেমে চলে গেল।
তারপর চিৎকার কান্নাকাটি শুনে পাশের কামরার লোকজন এল, গার্ডসাহেবও এল । পেছনে পেছনে ভুঁড়ি দুলিয়ে রাইফেল কাঁধে দুজন মোটকা পুলিশ এসে শুধোয়,—ক্যা হুয়া ! আপ্লোক ক্যা করতা থা?
যাত্রীরা চটে আগুন। কেউ বলে,—কোথায়, ঘুমচ্ছিলে পুলিশ সাহেব? কি হয়েছে এখনও ঘুমচোখে দেখতে পাচ্ছ না? এইভাবে মেরে সর্বস্ব লুটে নিয়ে গেছে !
—ক্যায়সে হুয়া ?
হোঁৎকা বলে ওঠে,– হুক্কা হুয়া !
পুলিশপুঙ্গব জবরদস্ত মোচ পাকিয়ে গর্জে ওঠে, – কৌন?
ডাকাতদের ধরতে না পারলেও নিরীহ সর্বস্বান্ত যাত্রীদের যে ধরে বেঁধে হাজতে পুরতে পারে সেইটাই ঘোষণা করে।
কে একজন বলে,—থানায় গিয়ে কেস লেখাতে হবে!
ওরা তাতেও রাজি নয়। ট্রেন এতক্ষণ দাঁড়াতে পারবে না। শেষ অবধি যাত্রীরা বলে, – -ট্রেন যেতেই দেব না।
যাই হোক, একটা কাগজে কেস লেখানোর পর ট্রেন ছাড়ল।
এর কয়েকটা স্টেশন পরই নামব আমরা। বলি, – সবই তো গেছে! হোঁৎকা বলে, না, আছে কিছু! ব্যাটারা সন্ধান পায় নাই।
এই বলে হোঁৎকা তার পায়ের মোজা খুলে তার ভিতর থেকে ক্লাবের ফুটবল টিম তৈরি করার পর হাজার তিনেক টাকা বেঁচেছিল। সেইটা বের করে।
পটলা বলে,এই মাত্র স-সম্বল! এখন এই দিয়ে নিরক্ষরতা দূর ক-করতে হবে?
হোঁৎকা বলে,–লোকগোর শিক্ষা দিবি দে, তর এই ডাকাতগোর কিছু শিক্ষা দিতেই লাগব । ব্যাটারা এক্কেবারে জানোয়ার। ওই কপালকাটা, ওদিকের বাবরি চুলওলা, আর মুখে বসন্তের দাগওলা সর্দার মত লোকটা। ছেলেগুলোরে যদি পাইতাম—এমন শিক্ষা দিতাম ওরা ভুলতি পারত না।
গোবর্ধন বলে, – ঠিক বলেছিস, ওই শয়তানদের যদি ধরতে পারতাম দু একটাকে
ফটিক ভয়ে তখনও বিবর্ণ হয়ে আছে। পটলাও ভাবছে কথাটা। ওই শয়তানদের শিক্ষা দেওয়া দরকার ।
ট্রেন ততক্ষণে আমাদের নামার স্টেশনে এসে গেছে। জেলার সদর শহর। আমরা মারধর খেয়ে সব হারিয়ে ঝুলঝাড়া অবস্থায় নামলাম ।
পটলার মামাদের শহরেও বিরাট বাড়ি। বাজারে ব্যবসাপত্র আছে। আমাদের নিতে গাড়ি নিয়ে এসেছে পটলের মামাতো ভাই বিশ্বনাথ। বিশু আমাদের বয়সী, এবার স্কুল ফাইনাল দিয়েছে।
আমাদের দেখে বিশু বলে,–এ কি হাল হয়েছে তোমাদের পটলদা !
পটলা ডাকাতদের ব্যবহারের মৃদু প্রতিবাদ করতে একজন ডাকাত ওর মাথাটা কামরার বাঙ্কেই ধরে ঠুসে দেয়। বরাতজোর বলে, ফাটেনি। তবে একটা আমড়ার আঁটির মত আব হয়ে গেছে। হোঁৎকার ডান বুকে ভোজালির বাঁটের ঘা মেরেছে—এখন টনটন করছে। ফটিকের বাবরি চুল একগোছা টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে।
বিশুর কথায় বলি, তোমাদের দেশ কি ডাকাতের রাজ্য হে, কি হাল করেছে দ্যাখো আমাদের !
বিশু বলে, – তাই নাকি! ডাকাতি এখানেও প্রায়ই হয় আজকাল।
—কেউ কিছু করে না?
বিশু বলে, – কি করবে?
অর্থাৎ এরা এটাকে সহজভাবেই মেনে নিয়েছে। বিশু বলে,—চলো, গাড়িতে ওঠো। পটলদার আবটা তো বেশ বড়ই হয়েছে দেখছি!
হোঁৎকা বলে, – মাথা ফাটেনি এই ঢের! ওগোরে ছাড়ুম না ।
গোবর্ধনও গজরাচ্ছে। তাকে ওদের কে বেশ কয়েকটা জব্বর লাথি মেরেছে।
স্টেশন থেকেই শহরের শুরু। বেশ বড় বড় গুদাম, দু-একটা কারখানা। বাড়িও রয়েছে অনেক। আমাদের গাড়িটা মূল শহরকে বাঁয়ে রেখে এগিয়ে চলেছে। লালমাটির বুকে শাল মহুয়ার গাছ-ও দেখা যায়।
বিশু বলে,—এখানে ডাকাতি হয় প্রায়ই।
আমি বলি,—এখানেও! এই বনেও ?
শহরের ওদিকে একটা ছোট ঢিলা। তার নীচে দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। জল বিশেষ নেই—বালির বিস্তারই বেশি। মাঝে একফালি জলধারা বয়ে চলেছে।
তার ওদিকে ওর মামাদের পাঁচিলঘেরা বিরাট এলাকা। আশপাশেও দু’চারটে আধুনিক ধরনের বাড়ি দেখা যায়। তবে এদের বাড়িটার এলাকা অনেকখানি জুড়ে। গেটে দারোয়ান রয়েছে। গেট খুলে দিতে গাড়িটা ভিতরে ঢুকে গেল। দুপাশে মহুয়া গাছ ছাড়া আম, লিচু, কাঁঠাল গাছও রয়েছে। গ্যারেজে কয়েকটা গাড়িও।
পটলার মামা-মামিরা এসে পড়েন। তারাও আমাদের মুখে ট্রেনে ডাকাতির খবর শুনে আর আমাদের হাল দেখে বলেন,—চারিদিকে এখন এই সবই ঘটছে।
থাকা খাবার ব্যবস্থা খুবই ভালো। বাড়ির ওদিকে বাগানের লাগোয়া একটা বড় হলঘরে পাঁচটা খাট পাতা,—তাতে ডানলোপিলোর গদি, মশারি সবই রয়েছে। পাশের ঘরটাতে থাকে বিশু। নীচে আর কেউ থাকে না। ওদিকে ড্রইংরুম, লাইব্রেরি, মামার দুটো অফিসঘরও আছে। তবে সেগুলো হলের ওদিকে। এপাশটা আমাদের দখলে। জানলা বা ঘরের দরজা খুললেই ফুলের বাগান।
হোঁৎকা বিশুকে বলে,—আপাতত এখানেই ক’দিন থাকতি হচ্ছে। চলো তোমাদের দেশটা দেহি একটু।
বিশুও একপায়ে খাড়া। সে-ও এর মধ্যে এ বাড়ির তরুণ ড্রাইভার নন্টুকে হাত করে নিজেই ফাঁকা ডাঙায় গাড়ি চালানো শিখেছে। তবে তার লাইসেন্স নেই, তাই গাড়ি চালাতে দেন না বাবা-কাকারা ।
মামিমাও বলেন,—তোরা নন্টুকে নিয়ে গিয়ে বনের মধ্যে মা ভবানীর মন্দির, সেবক পাহাড়, এদিক ওদিক ঘুরে আয়, ভালো লাগবে ।
তবে সাবধান করেন,—খবরদার বিশু, বনপাহাড়ের পথে তুই জিপ চালাবি না। বিশু বাধ্য ছেলের মতই বলে, –না-না ।
আমরা বের হয়েছি অঞ্চলটাকে দেখতে। শহরেও একপাক দিয়ে আসি। বেশ বড় শহর। বড় বড় গুদাম, কিছু কলকারখানাও রয়েছে ওদিকে। বিহারের লাগোয়া অঞ্চল, তাই লোহার ছোটখাটো অনেক কারখানাই আছে। তারা টাটা, দুর্গাপুর, কলকাতাতেও নানা ধরনের মালপত্র সাপ্লাই দেয়। ট্রাকবোঝাই লোহা, সিমেন্ট—এসবও যাচ্ছে।
আমরা চলেছি এবার বনের দিকে।
বিশু বলে,—এসব শেঠ নাগরমলের এলাকা। নাগরনগর বলে জায়গাটাকে।
নন্টু বলে,—ওই শেঠজি নাকি আগে খুবই গরিব ছিল। দেখতে দেখতে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। শহরেও বিরাট দোকান, ব্যবসা, গাড়ি। আর এখানে বিরাট বাগানবাড়ি করেছে। ওই যে—
দেখি বনের ধারে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বাগান আর তার মধ্যে আধুনিক ধরনের বাড়ি। নাগরমলের কারখানা—গুদামও রয়েছে এখানে। কয়েকটা ট্রাকে মালপত্র তোলা হচ্ছে। বড় ছোট নানা ধরনের পেটি, বস্তা প্যাকেট উঠছে।
পথের ধারে একটা বেঁটে বটগাছের নীচে চায়ের দোকান। চা তেলেভাজা মুড়ি—এসব বিক্রি হয়।
সামনের রাস্তাটা বনের দিকে চলে গেছে। ওইখানে বনের মধ্যে কোনো সামন্ত রাজার পরিত্যক্ত গড়। ওইটাই দেখতে চলেছি আমরা।
চায়ের দোকান দেখে নন্টু গাড়িটা ওখানে থামায়।
বিশু একা আসেনি, ওর সঙ্গে পোষা কুকুর লাইকাকেও এনেছে। মাঝারি সাইজের তাগড়া অ্যালসেসিয়ান। প্রথমে আমাদের দেখে লাইকা বেশ কড়া নজরেই চেয়েছিল। গলা থেকে চাপা গরগর শব্দও বের হয়।
কিন্তু বিশু তাকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর সে আমাদের বন্ধু বলে মেনে নিয়েছে।
নন্টু গাড়িটা একটু দূরে একটা শালগাছের ছায়ায় রেখে চা খেতে গেছে, আমরাও নেমে দেখছি জায়গাটা। এককালে এসব ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল, এখনও বেশ ঝোপ-ঝাড় রয়েছে। হঠাৎ ওদিকে চোখ পড়তে চমকে উঠি। ইশারায় হোঁৎকাকে দেখাই লোক দুটোকে। ওরা একটা মোটরবাইক থেকে নেমে ওই গুদামের দিকে চলেছে। এপাশে গাছের আড়াল থেকে ওদের মুখগুলো স্পষ্ট দেখা যায় ।
গতরাতের ট্রেন ডাকাতির কথা কোনোদিনই ভুলব না। সেই নিষ্ঠুর হিংস্র লোকগুলোর মুখ আমাদের চোখের সামনে বারবার ফুটে ওঠে। সেই গালকাটা। সেই লম্বা চুল নাক-ভাঙা লোকদুটোকে তাই এখানে দেখে চমকে উঠি।
হোঁৎকা বলে,—হালারা এহানে? নাগরমলের গুদামে ক্যান? ওকে থামাই। বলি,—খবর নিতে হবে। তারপর দেখা যাবে।
হোঁৎকা পারলে সেই মারের বদলা নিতে এখুনিই লড়ে যাবে মনে হয়। কিন্তু এসময় ওদের কিছু করলে বাকিগুলো সাবধান হয়ে যাবে। ওদের দলসমেত ধরা যাবে না। তাই থামাই ওকে । লোকদুটো গুদামের দিকে এগোচ্ছে। গুদামের ম্যানেজারও চেনে ওদের। দেখলাম বেশ খাতিরই করে,—আও কালুয়া, আও সোনা—চলো অন্দর!
গালকাটা লোকটার নামই কালুয়া। সে-ই শুধোয়,—নাগরমলজি হ্যায় ?
—চলো অন্দর ।
ওরা চলে যায়। মনে হয় ওরা নাগরমলজির খুবই চেনা।
নন্টু ততক্ষণে চা খেয়ে এসেছে। পটলারা গাড়ির মধ্যেই গরম হাওয়ার জন্য কাচ তুলে রেখেছিল। ওরা এই ব্যাপারটা ঠিক খেয়াল করেনি। নন্টু আবার গাড়ি চালাতে শুরু করে।
কাঁসাই নদী বনের বুক চিরে এসেছে। দুদিকে পাথরের স্তর, তাই নদীর বিস্তার এখানে কম। দুদিকে গভীর বন। হাতিও এদিকে আসে মাঝে মাঝে। উঁচু বিশাল টিলাটাকে কেন্দ্র করে অতীতের কোনো সামন্ত রাজা এখানে কেল্লা তৈরি করেছিল।
কেল্লার মধ্যে বিশাল প্রাঙ্গণ, তার ওদিকে প্রাসাদ। সব প্রায় ভেঙে পড়েছে, তবু কিছু কিছু এখনও কালের আঘাত বুকে নিয়ে টিঁকে আছে। তবে সাপ-খোপ চামচিকের রাজত্ব চলছে বর্তমানে। বনের বাঘও এসে থাকে।
নন্টু বলে,—বাঘ খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। নিজের থাবা, গা সর্বদা চেটে সাফ রাখে। এমনকী যে জায়গায় থাকে, সেটাকেও থাবা দিয়ে, ল্যাজ দিয়ে ঝেঁটিয়ে সাফ-সুতরো করে রাখে। দেখুন না—এই ঘরগুলো! ওরা না হলে কে এসব সাফ করে রাখবে?
দেখে মনে হয় যেন মানুষজন আসে এখানে, তাই এত সাফ। কিন্তু এই গভীর বনের দুর্গম এই ভাঙা কেল্লায় কে আসবে?
ভিতরের দিকে চলেছি, হঠাৎ দেখি খালি সিগারেটের প্যাকেট পড়ে আছে। নীচে সোজা নেমে গেছে পাথরের স্তর, তার নীচে নদী।
হঠাৎ কিসের গন্ধ পেয়ে লাইকা গর্জন করে ছুটে যায়, ওই ভাঙা মহলের দিকে। বিশু ডাকছে,—লাইকা! লাইকা !
আমি বলি,—হঠাৎ কি দেখে ছুটে গেল ওটা ?
বিশুও ছুটেছে ওর পিছনে। আমরাও।
ভাঙা খিলান—প্রায়ান্ধকার একটা ঘর। সঙ্গে টর্চ ছিল! আলোয় দেখি লাইকা মেঝেকে শুঁকছে, পা দিয়ে আঁচড়াচ্ছে।
কোথাও কিছু নেই, লাইকাকে ওইভাবে আঁচড়াতে দেখে অবাক হই। বিশু ওকে টেনে নিয়ে আসে।
তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। চারিদিকে পাখিদের কলরব। কেমন থমথমে পরিবেশ।
নন্টু বলে,—সন্ধ্যার পর এখানে কেউ থাকে না। চলেন ।
ফিরে এসেছি গাড়ির কাছে। লাইকা কেমন ছটফট করছে। দৌড়ে এসে গাড়ির চারিদিক শুঁকতে থাকে, আর গরগর করে। গাড়িতে উঠলাম সকলে। স্টার্ট দিতে গিয়ে দেখা যায় গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না। নতুন গাড়ি। ইঞ্জিন, ডায়নামো সবই ঠিক আছে। পরে দেখা যায় পেট্রল ট্যাঙ্কের চাবি খোলা, আর ফুল ট্যাঙ্কি পেট্রল একেবারে হাওয়া।
চমকে ওঠে নন্টু,–পেট্রল কে নিল? এত পেট্রল ?
আমরাও চমকে উঠি—সে কি! এই গভীর বনের মধ্যে পড়ে থাকতে হবে?
নন্টু গাড়ি থেকে নেমে পিছনের হুটের দরজা বন্ধ দেখে নিশ্চিন্ত হয়। বলে,—হুটের ভিতর জেরিক্যানে আলাদা পাঁচ লিটার পেট্রল রাখা আছে। ব্যাটারা সেটার সন্ধান পায়নি । হুট খুলে সেটা বের করে ট্যাঙ্কে ঢেলে এবার গাড়ি স্টার্ট করে।
হোঁৎকা বলে,—কিন্তু হালায় পেট্রল কে লইছে বনের মধ্যে? কারোরে তো দেখিনি। আমি জানাই,—আমরা তাদের না দেখলেও তারা ঠিকই দেখেছে আমাদের।
—হালায় কারা?
হোঁৎকার কথায় গোবরা বলে,–সেইটাই তো প্রশ্ন। জবাব এখন না হোক, পরে পাবি । গাড়িটা আসছে সরু মোরাম ঢালা বনের পথে। দুদিকে গভীর বনে সন্ধ্যার ম্লান ছায়া নামছে। নির্জন পথ। হঠাৎ সামনে একটা গাছের গুঁড়ি পড়ে থাকতে দেখে নন্টু গাড়ি থামায়। বিশু বলে,—এটা এল কোথা থেকে?
নন্টু নেমেছে, আমরাও। গুঁড়িটাকে ঠেলে সরিয়ে রাস্তা সাফ করতে হবে। হাত লাগিয়েছি আমরা, এমন সময় বনের মধ্যে থেকে দুমদাম পাথর বৃষ্টি শুরু হয়। গাড়ির উপরও পড়ে দু’-চারটে। আমরা হতবাক ।
লাইকা তীরবেগে ছুটে যায়, বনের মধ্যে।
বিশু চিৎকার করছে। কিন্তু বনের মধ্যে থেকে শোনা যায় লাইকার গর্জন। কারা বনের মধ্যে দিয়ে ছুটে পালাচ্ছে। তারা ভাবেনি এভাবে আক্রান্ত হতে হবে।
পাথর বৃষ্টি থেমেছে, আমরাও ছুটে যাই।
কিন্তু গভীর বনে কাউকে দেখা যায় না। বিশুর ডাকাডাকিতে লাইকা ফিরে আসে। পটলা বলে,—ওরাই পে-পেট্রল চুরি করে আমাদের উপর হা-হামলা করেছে।
নন্টু বলে,—ডাকাতের দলই। চলুন, বন থেকে বের হয়ে যাই।
হোঁৎকা বলে,—চারিদিকেই দেহি চোর ডাকাতের রাজত্ব। হালায়, ওই গালকাটা ট্রেন-ডাকাতের দলও দেহি শহরে নাগরমলের ওখানে ঘুরছে, আর বনের মধ্যেও ডাকাত !
বিশু বলে,—এখানে নানা রকম ডাকাতি, খুন-খারাপি প্রায়ই হয়। নাগরমলবাবু এখানকার নেতা, উনিও চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কিছুই করতে পারেননি। ওদের উৎপাত বেড়েই চলেছে। হোঁৎকা বলে,–তর নাগরমল লোকখান ক্যামন রে?
বিশু বলে,—খুব ভালো লোক। দেখা করতে চাস তো কালকে নিয়ে যাব।
হোঁৎকা বলে,—যামু। তয় শোন সবাই, আজ কেল্লার বনে যা হইছে বাড়িতে কারোরে কইবি না ।
বারান্দায় মামাবাবু-মামিমারা যেন আমাদেরই জন্য পথ চেয়েছিলেন। আমাদের দেখে নিশ্চিন্ত হন।
মামিমা শুধোন,–এত দেরি? আমরা তো ভাবছি !
আমি বলি,এদিক ওদিকে ঘুরছিলাম।
মামিমা বলেন, – যাও, হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় ছেড়ে ফেলো।
নাগরমল শেঠজির সম্বন্ধে ছোট মামাবাবু অনেক কথাই বলেন। শহরের মধ্যে এখন অন্যতম প্রতিষ্ঠাবান লোক সে। সামান্য অবস্থা থেকে নিজের চেষ্টায় উদ্যমে এখন এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটা কারখানা বানিয়ে অনেকের রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা করেছেন।
এছাড়া বিশাল ধানকলও রয়েছে এলাকার এখান ওখানে। চাষের সময় গরিব প্রান্তিক চাষীদের তিনি চাষ করার জন্য বীজধান, সার, পাম্পসেট—এসব দেন। অবশ্য টাকাটা ফসল উঠলে তুলে নেন। ফলে এলাকার সব ধানই যায় তাঁর ধানকলে। চাষীও কিছু পায়।
শহরের কলেজের জন্য জমিও দিয়েছেন। বেশ সজ্জন সমাজসেবী। তাই এলাকার মানুষ তাঁকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করেছে। শহরের বড় বড় আমলা, খোদ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের কর্তাদের সঙ্গেও তাঁর খুব খাতির।
মামাবাবু বলেন,– আমাদের অনবরত বলছেন, এদিকে বনের ধারে না থেকে শহরে ওঁর অনেক জায়গা আছে, সেখানে বাড়ি করতে। খরচাও উনিই দিতে চান।
মামিমা বলেন,—শ্বশুরের তৈরি বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি না, ও যতই বলুক। তোমার ওই নাগরমলজি যত চেষ্টাই করুক না কেন, আমি নড়বো না। ও ভাবে, যা ইচ্ছা করবে তাই পেয়ে যাবে। এখন তো এই অঞ্চলের নেতা, জেলার মাথা। ধরাকে সরা দেখছেন।
রাত হয়ে আসে। চারদিকে স্তব্ধতা নামে। খাওয়া-দাওয়ার পর শুয়ে পড়েছি। নীচের পাশাপাশি দুটো ঘরে আমরা, আর ওদিকে বিশু। কাল রাতে ঘুম হয়নি, আজ সারাদিন ও ঘোরাঘুরিতে গেছে, তাই শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়েছি।
রাত কত জানি না, হঠাৎ লাইকার ভরাটি গলার চিৎকার আর ওপাশের মালি দারোয়ানদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় ৷
বাড়ির সকলেই উঠে পড়েছে। বাইরের বারান্দা ও বাগানের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা আলোয় দেখা যায় চকিতের মধ্যে কে যেন ছুটে ঘন আমবাগানের মধ্যে ঢুকে গেল।
লাইকা ছুটে যায়, মালি, লোকজনও। আমরাও যে যা হাতে পেয়েছি তাই নিয়েই দৌড়চ্ছি। বিশুর হাতে একটা হকি স্টিক। হোঁৎকা খাটের তলা থেকে একটা রড পেয়েছে, তাই নিয়েই দৌড়চ্ছে।
মামিমা চিৎকার করেন,–তোমরা যাবে না। অ্যাই বিশু—যাসনে! ওরা দেখছে।
কে কার কথা শোনে?
কিন্তু দৌড়নোই সার হয়। সারা বাগান, এদিক ওদিক খুঁজেও কাউকে পাওয়া যায় না। দারোয়ানরা বলে,দেখা দো আদমি উধার গিয়া। বাবালোগকা ঘর কা উধার।
—কিন্তু গেল কোথায় ?
ছোটমামা বলেন,—কি দারোয়ানজি? রাতে ভাং-টাং খাও নাকি ?
আমরাও ঘরে ফিরে যাই।
হোঁৎকা বলে,—আমারও মনে হয় দুইজনেরে দেখছি। হালায় কাল রাতে সব টাকা পয়সা সখের হাতঘড়িটা গেছে গিয়া। আজও বনে পাথরের ঘা খাইয়া ফিরছি, হালায় ঘুমাইতেই দিব না !
পটলা বলে,–ত-তাই বলছি, গ্রামের বাড়িতেই চল। শ্-শান্তিতে থাকবি, দেশের, দ-দশের কাজও করতে পারবি।
হোঁৎকা বলে,—মার খাইয়া পালাইতে হইব? হেই দুইজনেরে ট্রেনে মারের জবাব না দিয়া যামু না। দেশোদ্ধার করনের কাজ পরে করলেও চলবো, এহন ওগোরে সযুত কইরা শিক্ষা না দিয়া যামু না।
গোবর্ধন বলে,—কিছু করার আগে ওই নাগরমলের দর্শন করা দরকার।
নন্টুই নিয়ে চলেছে আমাদের নাগরমলের বাড়িতে। সকাল নটা থেকে ঘণ্টাখানেক নাগরমল তার বসার ঘরে আমজনতাকে দর্শন দেন। এখানে মানুষদের অভাব অভিযোগের কথা শোনেন। তারপর নিজের বিভিন্ন কারখানা, শহরের ব্যবসাপত্র দেখতে বের হয়ে যান। গেটটা খোলা, দারোয়ানও রয়েছে। ভিতরে লাল কাঁকর বিছানো পথের দুপাশে সযত্নবর্ধিত সবুজ ঘাসের লন। ওদিকে বিস্তীর্ণ গোলাপ বাগান ।
গাড়ি ভিতরে ঢুকে বেশ কিছুটা গিয়ে তবে বাড়ির পোর্টিকো। এই জঙ্গল মহলেও অতি আধুনিক স্টাইলের বাড়ি বানিয়েছে নাগরমলজি।
ড্রইংরুমটাও বেশ সুন্দর করে সাজানো। একটা সিংহাসনের মত সোফায় বসে আছে বিশাল চেহারার লোকটা। দেখতে বিশাল, তবে দেখে মনে হয় ঠিক মেদের ভারে থলথলে নয়, সলিড চেহারা। মুখটাও বিরাট। একটা লোক ওকে দলাইমলাই করছে, আর নাগরমলজিকে ঘিরে বেশ কিছু গ্রাম্য লোকজন কি সব বলছে। নাগরমলজি বলে,—মুন্সীজি, ইদের বাতচিৎ সব শুনে লোট কর লিজিয়ে, পিছু হামাকে দিবে।
তাদের উদ্দেশে বলে,—তুম লোগ্ চিন্তা মৎ করো, হম দেখতা হ্যায়, কুছ না কুছ জরুর করব।
লোকটা রাজস্থানী হয়েও ঠেট বিহারী টানে কথা বলে। মনে হয় ছেলেবেলাটা বিহারের কোনো গ্রামাঞ্চলে কেটেছে, তাই কথার মধ্যে বিহারী টানও এসে পড়ে।
আমাদের দেখে চাইল নাগরমল।
বিশুকে দেখে বলে,–আরে বোনারজি সাব আসো আসো। কি খোবর? এনাদের তো পহচানতে পারল না ।
বিশুই পরিচয় করিয়ে দেয় পটলাকে দেখিয়ে,—এই পটলদা আমার পিসতুতো দাদা, কলকাতায় থাকে। এরা ওর বন্ধু। এখানে বেড়াতে এসেছে।
—হ্যাঁ। কলকাতা ছোড়কেই বনজঙ্গলমে বেড়াতে আসলো? বাঃ! কিমন লাগছে ইটা ? নাগরমলজি শেষ প্রশ্নটা করেছে আমাদের উদ্দেশেই। জানাই,—খুব সুন্দর জায়গা। বন-নদী। বনের মধ্যে প্রাচীন একটা গড়ও দেখলাম।
নাগরমলজি একটু অবাক হয়,—উধার উ ঘন জঙ্গলমে ভি গেল ? লেকিন হাথি, বহুৎ সাপ, বিচ বিচ মে চিতা ভি আসে উধার। বহুৎ খতরনক জায়গা।
হোঁৎকা বলে,—এসব জায়গাই শুনি গিয়া ডাকাতের রাজ্যি। ট্রেনেও ডাকাতি হয়, পথে-ঘাটেও হইতাছে।
হাসে নাগরমল,—শহর কলকাতায় ভি তো ডাকাতের রাজ আছে বাবুজি! বড়া বড়া -ডাকাইত,ইধার তো ছোটা মোটা কুছ হোয়।
তারপরই প্রসঙ্গ বদলাবার জন্যই যেন হাঁক পাড়ে,—আরে এ লখনিয়া। কলকাত্তাসে বাবুলোক এল খাতিরদারি কুছ তো কোর। লস্যি লাও ।
লস্যিটা ভালোই, আর খেতেও হল আমাদের। নাগরমলজি বলে, – দু-চারদিন থাকবে তো?
পটল বলে,–না, আমাদের গ্রামের দিকে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে নিরক্ষর লোকদের লেখাপড়া শেখাব ।
নাগরমলজি যেন নিশ্চিন্ত হয়। বলে,—সে বহুৎ আচ্ছা কাম আছে বাবুজি। ইয়ং লেড়কারা ভি দেশের জন্য শোচছে—ই দেখে আমার খুশ দিল হোয়ে গেলো। যাইয়ে–ই কাম করিয়ে। আমরা উঠে পড়ি। বাইরে বের হয়ে এসে হোঁৎকা বলে,–লোকটারে কেমন দেখস? গোবর্ধন ওরফে গোবরা বলে,—ঘোড়েল লোক বলেই মনে হল। দেশের মানুষের দুঃখে যেন গলে পড়ছে !
আমরা বের হয়ে এসে ওদিকে দাঁড়িয়েছি। দু’তিনটে কারখানা এখন বন্ধ। তবু দেখি গেট খুলে ক’টা লরি বের হচ্ছে। তাতে তেরপল ঢাকা কি সব মাল রয়েছে।
হোঁৎকা বলে,–কারখানা বন্ধ আছে গিয়া, তয় মাল কি যাইত্যাছে রে?
আমরাও ঠিক বুঝতে পারি না।
ট্রাকগুলোর দিকে নজর রাখছি, হঠাৎ হর্নের শব্দে সচকিত হয়ে পথ ছেড়ে দাঁড়ালাম, দেখি নাগরমলের বাড়ির দিক থেকে একটা জিপ তেড়ে ফুঁড়ে আসছে এইদিকে। আমরা সরে না গেলে ধাক্কা দিয়ে ছিটকে ফেলে বের হয়ে যেত।
ট্রাকগুলোও ফুল স্পিডে চলছে। জিপটা ওইদিকেই গেল। চমকে উঠে দেখি জিপে বসে আছে সেই গালকাটা, আর চালাচ্ছে সেই ট্রেনে দেখা লম্বা চুলওয়ালা শয়তানটা।
দেখা যায় জিপটা গিয়ে ওই ট্রাকগুলোর পিছন নিল। যেন ওই মালপত্র পাহারা দিয়েই নিয়ে চলেছে কোথাও কোনো বিশেষ মতলবে।
ট্রাকগুলো জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।
হোঁৎকা বলে,লোকটা চায় না আমরা এহানে থাকি !
আমারও মনে হয় কথাটা। ও আমাদের এখান থেকে যেন প্রকারান্তরে চলে যেতেই বলেছে, ওই দেশসেবার নাম করে।
গোবর্ধন বলে, —ব্যাটার ট্রাক বোঝাই মাল বনের মধ্যে কোথায় গেল বল তো?
বিশু বলে,–বনের ওদিকে শুরু হয়েছে গ্রাম-অঞ্চল, চলে গেছে দলমা পাহাড় অবধি। ওখানে ওসব যন্ত্রপাতি কি কাজে লাগবে ?
অর্থাৎ কেমন একটা রহস্য ঘনিয়ে ওঠে। আর ওই ডাকাতগুলো যে নাগরমলেরই লোক এটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
ফিরে আসি বাড়িতে। হোঁৎকার জায়গাটা ভালো লেগেছে। বিশেষ করে মামিমাকে। কারণ খাবার-দাবারের আয়োজন প্রচুর। পটলা বলে,—মামাবাবুকে বলি ওদের দেশের বাড়িতে যাবার ব্যবস্থা করে দিতে। আসল ক-কাজই তো বাকি!
হোঁৎকা বলে,—নিজে আগে স্কুল ফাইনাল পাস কর দেহি, তারপর অন্যরে পড়া লিখা শিখাইবি।
এমন সময় ছোটমামাকে ঘরে ঢুকতে দেখি। কলেজ থেকে বের হয়ে ছোটমামা পারিবারিক কনট্রাক্টারি ব্যবসা দেখাশোনা করে। মোটরবাইক হাঁকিয়ে ঘোরে। বেশ হাসিখুশি মানুষটি বিজনমামা ।
বিজনমামা বলে,-শুনলাম কাল বনের মধ্যে গড় দেখতে গিয়েছিলে?
পটল বলে,—হ্যাঁ!
মামাবাবু বলে,—ঠিক করোনি। ওখানে গেলেই লোকে বিপদে পড়ে। শুধাই,কেন?
মামা বলে,–সেইটাই তো রহস্য।
আমি শুধাই,—আচ্ছা, ওই নাগরমল লোকটা কেমন?
এবার মামা বলে,—ওকে দেখেছ ?
ঘাড় নাড়ি।
মামা বলে,–লোকটা গভীর জলের মাছ। ওর সবকিছুই অন্যের লুট করা মাল। জনসাধারণ, সরকার, ব্যাঙ্ক—যখন যাকে পারে ঠকায়। আর বাইরের খোলসটা সম্পূর্ণ অন্য। খুব সজ্জন, কথাও মিষ্টি।
–ওর এক কারখানা ?
—এও এক কৌশল! বিভিন্ন ব্যাঙ্ক থেকে লাখ লাখ টাকা, সরকার থেকে কাঁচামালের কোটা—এসব ঘোলাপথে আদায় করে। আর অন্ধকারে ওর অনুচররা দুর্গাপুর-খড়গপুর- জামশেদপুর ও অন্য জায়গায় কারখানার লাখ-লাখ টাকার চোরাই মাল এনে গোপনে দ্বিগুণ তিনগুণ দামে বিক্রি করে।
সেই সঙ্গে দেশের নেতা সেজে বসে আছে। সারা এলাকার মানুষ ওর ভয়ে কিছু বলতে পারে না। ওর দলবল যথেচ্ছভাবে চুরি-ডাকাতি খুন-খারাপি করে।
বলি, পুলিশ কিছু করে না?
মামাবাবু বলে,—সরষের মধ্যে ভূত থাকলে আর ওঝা কি করবে! ওসব ওর কেনা। তবে শুনেছি, নতুন পুলিশ সুপার নাকি এখন ওর সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিচ্ছে। চুরি-ডাকাতি তদন্ত করতে নেমে পুলিশ নাকি ওর লোকদের সন্দেহ করছে। কিন্তু হাতে নাতে ধরতে না পারলে, কোনো প্রমাণ না পেলে—কি করবে?
নন্টু বলে ওঠে,—ওদের অনেক কাহিনি আমি জানি। ওই ব্যাটা কালুয়া, ন্যাপাদের কীর্তিকলাপও জানি।
মামাবাবু ওর দিকে চাইল। বলে,—ওদের ঘাঁটাস না নন্টু, ওরা ডেনজারাস লোক। আর তোমাদেরও বলি, ওদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকবে।
আমরাও ভেবেছি কথাটা।
আমি বলি,—কিন্তু এর আগে আমরা এমন কিছু লোককে সযুত করেছি মামাবাবু।
মামা বলে,–হ্যাঁ, পটলার কাছ থেকে শুনেছি।
পটলা সঙ্গে সঙ্গে শোনায়,—যদি মদত দাও, ঠ-ঠান্ডা করে দেব ওদের। ওদের পি-পিছনে যে আছে তাকেও ৷
হঠাৎ কার পায়ের শব্দে চাইলাম। পায়ের শব্দে ঠিক নয়, ট্রেতে করে চা আনছিল এবাড়ির চাকরটা। ওকে সবাই মুণ্ডা বলে ডাকে। কালো নাক চ্যাপ্টা একটা লোক। চোখ দুটো ছোট ছোট কেমন পিটপিট করে চায়।
মুণ্ডা বিড়ালের মত নিঃশব্দে যাতায়াত করে। ওকে প্রথমে দেখেই কেমন বিচিত্র এক জীব মনে হয়েছিল।
মামা বলে,কি করছিলি দাঁড়িয়ে ?
ঘাড় বেঁকিয়ে বলে,—কিছুই করিনি। চা—
—দিয়ে চলে যা ।
লোকটা ট্রে-টা নামিয়ে চলে গেল।
এ ঘরেই কথাবার্তা হচ্ছিল। আমাদের ঘরটা ওদিকে। বড়মামা মামিও বের হয়েছে শহরে, বাড়িতে বিশেষ কেউ নেই ৷
মামাবাবু চা খেয়ে নণ্টুকে নিয়ে বের হয়ে যায় কি কাজে। আমরা বের হব বিকেলে। এদিকের ঘরে এসে দেখি আমাদের ব্যাগ সুটকেশ সব খোলা। কে যেন জিনিসপত্র সব তন্ন তন্ন করে দেখেছে
আমাদের ব্যাগে বেশ কিছু নাইলনের দড়ি, ছুরি, ইঁট—এসব থাকে। আমি এর মধ্যে ওই পুরোনো কেল্লা ঘুরে এসে তার একটা স্কেচও করেছিলাম। কে সেসব নিয়ে গেছে। মায় পটলার লেখা ডাইরিটাও। পটলা তার ডাইরিতে ট্রেন ডাকাতির বিবরণ একেবারে বিশদভাবে লিখেছিল। অপরাধীদের চেহারার বর্ণনাও ছিল তাতে। আর তাদের যে ওই নাগরমলের ট্রাকে দেখেছে, তাও লিখেছিল।
এগুলো ওদের হাতে পড়লে আমাদের বিপদই হবে।
তাই হোঁৎকা বলে,–কে করছে এই কাজ? ঘরের মধ্য হইতে মাল সাফ!
মামিমা বলেন,–বাড়ি থেকে এসব কে নেবে?
দেখা যায় মুণ্ডা তখন বাড়িতে নেই। কোথায় গেল সে?
একটু পরে দেখা যায়, মুণ্ডা ফিরছে সাইকেল নিয়ে। হ্যান্ডেলে আনাজপত্রের থলে। মামা শুধায়,—কোথায় গেছলি?
মুণ্ডা বলে,—আপনারা ছিলেন না, বাবুদের চা দিয়ে বাজারে গেলাম, আনাজপত্র আনলাম বটে।
দুপুরে খাওয়ার পর নিজেদের ঘরে শুয়ে আলোচনা করছি, হোঁৎকা বলে,–একবার ওই জঙ্গলের কেল্লায় যেতে হবে।
জানাই,-সেবার পাথর খেয়ে এসেছি, এবার যদি গুলি করে কেউ ?
পটলা বলে,—ভ-ভয় পাই না ।
পটলা মাঝে মাঝে বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
ওদিকে ছোট মামাবাবু ফিরে এসেছে। তার মন মেজাজ ভালো নেই। শহরে ট্যুরিস্ট লজ তৈরি করার জন্য সে টেন্ডার দিয়েছিল। ভেবেছিল সে-ই কাজটা পাবে। কিন্তু আজ টেন্ডারের ফল বের হয়েছে, দেখা যায় টেন্ডার পেয়েছে ওই শেঠজিরই এক বেনামদার। অর্থাৎ শেঠজিই গোপনে কলকাঠি নেড়ে ছোটমামাকে আউট করে নিজেই কাজটা হাতিয়েছে।
আমরা এ ঘরে কথাবার্তা বলছি। দুপুর হয়ে আসছে। হোঁৎকা বাজার থেকে ফেরে। বেশ খুশিই। বলে,—ভালো বাগদা চিংড়ি পাইছি, এক্কেবারে ফ্রেশ। নাহ, জায়গাটা ভালোই।
এতক্ষণ এদিকেই ছিলাম। এবার আমাদের ঘরে গিয়ে দেখি পটলা নেই।
গোবরা বলে,—সেটা গেল কোথায়?
আমি বলি,—আছে আশপাশে কোথাও ।
ওদিকে বেলা বাড়ছে। মামিমা স্নান করার জন্য তাড়া দেন। মামাবাবুরাও সব ফিরেছে। পটলা এখনও ফেরেনি।
এবার ভাবনায় পড়ি আমরা। ওর মাথায় পোকা আছে, মাঝে মাঝে নড়ে ওঠে সেটা। আর তখন কি করবে তা সে নিজেই জানে না ।
মামিমা বলেন,–কোথায় গেল পটল? তোমরা স্নান খাওয়া করো, সে এর মধ্যেই এসে পড়বে।
হোঁৎকা বলে,—শান্তিতে খামু, তারও উপায় নাই ওই ইডিয়টটার জন্যে ।
পটল এর মধ্যে তার হিসাবমত ভেবে নিয়েছে। মনে হয় ওই বনের মধ্যে কেল্লাতে বিশেষ কোনো রহস্য আছে। ওই নাগরমলজির প্রভূত সম্পদ হঠাৎ এল কোথা থেকে? মামাদেরও .উৎখাত করতে চায় লোকটা। পটল সেই শক্তির উৎসের সন্ধান করতেই বের হয়েছে।
ছায়াঘন পথ ধরে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সে এগিয়ে যায়। বাতাসে শাল ফুলের মঞ্জরীর গন্ধ। পটলা জানে একা যাওয়াই নিরাপদ এসব কাজে। প্রতিপক্ষ যদি কেউ থাকে, সে টেরও পাবে না। ওকে দেখতে হবে কেল্লার ভিতরটা ঘুরে।
ওখানে ট্রেন-ডাকাতদের সন্ধানও পেয়ে যেতে পারে। তাই চুপি চুপি চলেছে পটল। কিছু খবর পেলে বন্ধুদের সামনে তার গুরুত্ব বেড়ে যাবে।
পটলা চলেছে, ও জানতেও পারেনি যে প্রতিপক্ষ আমরা আসার পর থেকেই সজাগ হয়ে গেছে। ওই নাগরমলজি এমনিতে বাইরে মৃদুভাষী হলেও, ওর ভিতরের রূপটা একেবারে আলাদা। খুবই ধূর্ত। কখন কি রূপ ধরতে হয়, কখন কাকে প্রণাম করতে হয়, আবার কখন তারই গলা টিপে ধরতে হয় এসব সে-ভালোভাবেই জানে।
নাগরমলজির হাতে লোকজনের অভাব নেই। বিশেষ কিছু লোকও পুষে রেখেছে সে। নাগরমলজি তাঁর সাম্রাজ্য চালাতে গিয়ে বেশ বুঝেছে, গুপ্তচর বাহিনী না থাকলে এই ধরনের ব্যবসা করা যাবে না। সব খবর আগে জানার দরকার, সেই মত ব্যবস্থা নিতে দেরি করা চলবে না।
তাই খবর দেবার লোকও আছে সর্বত্র। তারাই পটলাদের খবরাখবর দেয়, আর ওই বাড়ি থেকে ডাইরি পাচার হয়ে চলে যায় নাগরমলজির কাছে।
নাগরমলজি ওসব দেখে চমকে ওঠে।
ডাইরিটা তার বিশ্বস্ত মুন্সীজিই তাকে পড়ে শোনায় ।
-ট্রেন-ডাকাতদের খবরও এরা পেয়েছে। কালুয়ার কথা ভি লিখেছে, চুলওয়ালা নন্দুয়ার বাত ভি!
ক্যা!—চমকে ওঠে নাগরমল। বলে, ওই বাচ্চা লোক বহুত্ খতরনক হ্যায়, উ লোককো সিধা কর দো!
হঠাৎ গর্জে ওঠে নাগরমল। কি ভেবে বলে, কালুয়াকো বোলাও ।
কালুয়া শেঠজির ডাকে গিয়ে হাজির হয়। জানে শেঠজি ডাকলে তার জন্য বিশেষ কাজের ফরমাশই করবে।
কালুয়া বুঝেছে তাদেরও তৈরি হতে হবে। ওই ছেলেগুলোকে সে-ও দেখেছে এদিকে ঘুরতে। তারও ভালো ঠেকেনি। তাই কালুয়া বলে,–বন্দোবস্ত করছি শেঠজি।
কালুয়াও নজর রেখেছিল সামনের চায়ের দোকান থেকে পটলের মামাদের ওই বড় বাড়িটার উপর। হঠাৎ পটলকে একা বের হতে দেখে সে একটু অবাক হয়। দেখে ছেলেটা এদিক ওদিক চেয়ে বনের দিকে এগিয়ে চলেছে একাই। এবার কালুয়াও ওদিকে রাখা জিপে তার দুজন চ্যালাকে নিয়ে ওঠে। মতলবটা সে ভেবেই রেখেছে। ওই একটা চ্যাংড়াকেই নয়, দলকে দলই ধরবে তারা। আপাতত ওদের একটাকে পেয়েই মতলব ফেঁদে ফেলে।
পটলা চলেছে একা বনের মধ্যে দিয়ে। হঠাৎ জিপটাকে পিছন থেকে আসতে দেখে চাইল। কিছু করার আগেই জিপটা ওর পাশে এসে সশব্দে ব্রেক কষে থামল। দু-তিনজন লোক লাফ দিয়ে নেমে পটলাকে ধরে ফেলে।
পটলা পালাবার চেষ্টাও করতে পারে না। ওরা তাকে ধরে নাকে তীব্র গন্ধমাখা একটা রুমাল ঠেসে ধরার কিছুক্ষণের মধ্যেই পটলার চোখ বুজে আসে। তারপর আর পটলার কিছু মনে নেই। দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পরও পটলার কোনো পাত্তাই মেলে না।
হোঁৎকা বলে,—কই গেল ব্যাটায়? এক কলসি দুধে এক ফোঁটা চোনা ফ্যালাইল ওই পটলা ।
পটলার মামাবাবু এর মধ্যে শহরে ওদের আত্মীয়দের বাড়িতে ফোন করে–যদি পটলা গিয়ে থাকে সেখানে। কিন্তু কোথাও পটলার কোনো হদিশই নেই
ছোটমামা এর মধ্যে চারিদিক ঘুরে খবর আনেন কাল রাতেই জঙ্গলের মধ্যে ট্রেন ডাকাতি হয়েছে। ডাকাতরা অনেক মালপত্র লুট করে একজন যাত্রীকে গুলি করে মেরেছে। পুলিশ সাহেবও এ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। কারণ খবরের কাগজে এখানকার নৈরাজ্য নিয়ে নানা কথা লেখা হয়েছে।
আমরাও বিকালে বের হয়েছি। মনে হয় পটলার কোনো বিপদই হয়েছে। কিন্তু হোঁৎকা বলে,—এসব কথা কইবি না। চল নাগরমলের ওখানেই যামু।
গোবরা বলে,—গিয়ে কোনো লাভ হবে? কিছু করে থাকলেও ও ব্যাটা কিছুই বলবে না। উল্টে আমাদেরও বিপদে না ফেলে।
আমি বলি তা পারবে না। হাওয়াটা বরং বোঝা যাবে। ওকে বলবো, আপনার কথামত গ্রামের মানুষের সেবা করতেই আমরা চলে যাচ্ছি।
হোঁৎকা বলে,—তা মন্দ হইব না। চল দেহি।
নাগরমলজির বাড়ির ওদিকে একটা বন্ধ মিলের গেটে কিছু জনতার ভিড়। ওটাকেও বোধহয় বন্ধ করেছে নাগরমল।
চায়ের দোকানেও জটলা। আমরা চলেছি নাগরমলের বাড়ির পানে। গেট খোলাই । বারান্দায় লোকজন রয়েছে, নাগরমল বসে আছে। হঠাৎ ওদিকে মুন্সীজির সঙ্গে একজনকে কথা বলতে দেখে অবাক হই। লোকটা গাছের আড়ালে থাকার জন্য আমাদের দেখতে পায়নি। আমি বলি,–হোঁৎকা, দেখেছিস ওই লোকটাকে? ব্যাটা মুণ্ডা এখানে কেন?
হোঁৎকাও দেখেছে। সে বলে,—তাই তো দেহি। ব্যাটা টাকাও লয় দেহি ওই মুন্সীর কাছ থিকা। এবার বুঝছি ডাইরি এসব কোথায় গেছে গিয়া ।
গোবর্ধন বলে,– পটলার ব্যাপারটাও নিশ্চয়ই নাগরমল সব জানে ।
হোঁৎকা বলে,—চুপ মাইরা থাক। ব্যাটা মুণ্ডা যাইতাছে, ও যেন আমাগোর না দেইখা ফ্যালে। পরে দেখুম ওরে।
নাগরমলজি আমাদের দেখে হঠাৎ যেন গম্ভীর হয়ে ওঠে, সেটা আমাদেরও নজর এড়ায় না। কিন্তু নিপুণ অভিনেতার মত চকিতের মধ্যে সেই ভাবটা বদলে আমাদের আপ্যায়ন করে । —আইয়ে বাবালোগ! আরে মুনিয়া, বাবালোগকো বাস্তে মালাই লস্যি লিয়ে আয় । বৈঠিয়ে, ক্যায়সে আয়া ?
আমি বলি,—আমরা গ্রামেই চলে যাচ্ছি, আপনার কথাটা যে সত্যি তা বুঝেছি, গ্রামেই
আসল কাজ করতে হবে।
নাগরলজি বলে,—হ্যাঁ, অব ঠিক সমঝেছে। গাঁওমে কাম করনা হোগা। ওর জন্যেই হামি ভি শহরে থাকলো না।
মানুষের সেবার জন্যে গাঁও গাঁও ঘুরি। হ্যাঁ- সেই গোরা বাবাকো দেখছে না ?
অর্থাৎ পটলার কথাই বলছে সে। শুধোয়, – সে কুথায় ?
তার আসল খবরটা বোধহয় ও না জানার ভানই করছে। হোঁৎকা বলে,–সে আসেনি। দেশ-গ্রামে যাব তাই মালপত্র গোছগাছ করতিছে।
নাগরমল বলে,—বহুৎ আচ্ছা কাম করতে এসেছে তুমলোক
দরকার হোলে হামাকে ভি জানাবে, হম ভি থোড়া বহুৎ সেবা করতে পারলে খুশ্ হবো। হোঁৎকা বলে,—জানাবো। দরকার পড়লি আপনার কাছেও আইমু।
আমরা উঠে পড়ি। পটলার অন্তর্ধানের প্রসঙ্গে কোনো কথাই উঠল না।
এদিকে সন্ধ্যা নামছে। নাগরমলের বারান্দায় আলো জ্বলে উঠেছে। বাগানে শ্বেত পাথরের ফোয়ারা থেকে জলকণা উঠছে আর আলো পড়ে সেখানে রং-এর ফুলঝুরি ফুটছে।
এত সুন্দরের অতলে রয়েছে যেন জমাট একটা অন্ধকারের রাজ্য। সেই অন্ধকারের জীবরাই পটলাকে কোথায় লুকিয়েছে–এ কথাটাই বার বার মনে হয় ।
বের হয়ে আসছি, হোঁৎকা বলে,–পিছন দিকটাই দেখার লাগবো ।
পাঁচিলের পাশ দিয়ে অন্ধকারে চলেছি আমরা। ওপাশে বাড়ির পিছন দিককার দরজা। অবশ্য সেটাও বেশ সুরক্ষিত। মোটা পাতের সাটার নামানো। গাছ গাছালির জন্য জায়গাটা বেশ অন্ধকার।
হঠাৎ কাকে দেখে চাইলাম। শীর্ণ লম্বামত একটা ছেলে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা তৈরি। হোঁৎকা ক্যারাটের ব্ল্যাক বেল্ট, গোবরাও বক্সিং-এ চ্যাম্পিয়ন। দরকার হলে ছেলেটাকে বেকায়দায় ফেলতে দেরি হবে না।
ছেলেটার উপর টর্চ ফেলতে সে ইশারায় আমাদের চুপ করতে বলে এগিয়ে আসে।
ছেলেটা বলে,–আমার নাম সজল। এদের বাড়িতে আমার বাবা কাজ করত। বাবা আর বেঁচে নেই। আমিই এখানে থাকি।
আমরা দেখছি ওকে।
ছেলেটা বলে,—নাগরমলজি সাংঘাতিক লোক। ওর অনেক গোপন খবর বাবা জেনে ফেলেছিল, তাই নাগরমল বাবাকে খুন করে লাশ কোথায় গুম করে দেয় ।
সজল বলে,—আমি পরে সব জেনেছি। কিন্তু কিছু করার শক্তি আমার নেই, আমি একা । তাই চুপ করে মুখ বুজে ওর বাড়িতেই আছি। ক’দিন ধরে তোমাদের দেখছি। নাগরমল তোমাদের ডাইরি, কাগজপত্র সব হাতে পেয়ে গেছে। তাই তোমাদের ও শেষ করে দেবে। ওর লোকদের ও বলেছে; ওই কালুয়ার দল তোমাদের ছাড়বে না ।
হোঁৎকা বলে,—আমরা ওই বিজনবাবুদের বাড়িতে আছি। সজল বিশুকে দেখিয়ে বলে।
—ওকে চিনি, বিশুবাবুকে।
হোঁৎকা বলে,—ওই নাগরমলকে আমরাই সযুত করে যাব।
ছেলেটা যেন আশান্বিত হয়। বলে,— পারবে? ওর দু-নম্বরী কারবারের অনেক কাগজপত্রের খবর আমি জানি। তোমাদের দিতে পারি, যাতে সবাই ওর আসল রূপটাকে চিনতে পারে।
গোবর্ধন বলে,—তুমি ওর দলের লোক কি না কি করে জানব?
সজল বলে,—তাহলে সেদিন থেকেই তোমাদের খবর নিতাম না। জানো, তোমাদের ওখানে যে চাকরটা আছে—
মুণ্ডা! —আমিই নামটা বলি।
–হ্যাঁ, ওই তোমাদের ঘর থেকে ডাইরি, কাগজপত্র সব এনে দিয়েছে শেঠজিকে। শেঠজিই ওকে তোমাদের ওখানে কাজে পাঠিয়েছে, যাতে ও-বাড়ির সব খবর এখানে সে দিতে পারে ।
বিশু বলে, – তুমি মাঝে মাঝে ওই নবীনের চায়ের দোকানে এসে নবুদাকে কোনো খবর থাকলে বলে যাবে, আমাদের কিছু বলার থাকলে আমরাও ওকেই বলে আসব।
সজল বলে,—তাই ভালো। বাইরে দেখা হলে আমরা যেন কেউ কাউকেই চিনি না। হঠাৎ দূরের রাস্তা থেকে গাড়ির হেডলাইটের এক ঝলক আলো এসে পড়ে এদিকে। সজল চকিতের মধ্যে সরে যায় ঝোপের আড়ালে। বলে, – কাল ভোরে নবুর দোকানে কথা হবে। এখন ভিতরে যাচ্ছি। তোমরাও চলে যাও ৷
সে ওই দেওয়ালের ওদিকে নীচু ডালটা ধরে গাছে উঠে গেল। ডাল বেয়ে বোধহয় বাগানে নামার কোনো ব্যবস্থা করা আছে।
আমরা দেরি করে ফিরে দেখি মামাদের মধ্যে ভাবনার ছায়া নেমেছে। মামিমা আমাদের শুধান,—পেলে পটলকে?
কিন্তু পটলকে আমাদের সঙ্গে না দেখেই বুঝেছেন যে আমরা তাকে পাইনি।
মুণ্ডা যথারীতি চায়ের ট্রে নিয়ে চুপি চুপি ঢুকছে। বলে,—চা এনেছি।
বিশু বলে,–রাখো, আসছি।
বিশু চেনে মুণ্ডার ঘরটা। বাগানের ওদিকে দু-তিনটে ঘর আছে। হোঁৎকা বিশুকে নিয়ে এই ফাঁকে ওখানে এসে হানা দেয়।
মুণ্ডা ট্রে রেখে বাবুদের সামনে থেকে চায়ের শূন্য কাপগুলো তুলছে, হোঁৎকা বিশু তখনও ফেরেনি।
মামিমা বলেন,—ওরা কোথায় গেল আবার? চা ঠান্ডা হয়ে গেল। মুণ্ডা বিনীতভাবে বলে,—আবার করে আনছি মা !
এমন সময় হোঁৎকা ঢুকল গম্ভীরভাবে। পিছনে বিশু। হোঁৎকা বলে,—থাক তার দরকার হইব না। তুমিও বসো ! মুণ্ডা বলে,–কি যে বলেন!
হোঁৎকা গর্জে ওঠে—যা কইছি তাই করো।
সকলেই চমকে ওঠে। হোঁৎকা বলে,–ছোটমামা, আপনারা দুধকলা দিয়া ঘরে কালসাপ পোষছেন।
মানে?—ছোটমামা অবাক হয় ।
হোঁৎকা বলে,–দ্যাখেন ছোটমামা, আপনার কনট্রাকটারির টেন্ডারের কাগজপত্র, পটলার ডাইরি—সব ওর ঘরে পাইছি। ওই ব্যাটাই সব নাগরমলের কাছে পাচার করেছে। তাই দেখে নাগরমল শেঠ তার ভাতিজার নামে টেন্ডারের দর কমিয়ে দিয়ে আপনার কাজ হাতাইছে।
ছোটমামা ওসব কাগজ দেখে চমকে ওঠে,—তাই তো! এসব কাজ তুই করিস ? মামিমা বলেন, –মাথা গরম করো না। এখানে হৈ চৈ না করাই ভালো, ওরা সাবধান হয়ে যাবে।
ছোটমামা বলে,—মুণ্ডাকে আটকে রাখো, ও যেন বাইরে যেতে না পারে ।
হোঁৎকা মুণ্ডাকে বলে, — কাগজপত্র চুরি কইরা কারে দেখাইছস ?
মুণ্ডা চুপ করে থাকে। ছোটমামা রেগেই ছিল, সে এবার ওর ঘাড় ধরে দু-চারটে রদ্দা বসাতে মামিমা বাধা দেন,করছ কি বিজন ?
বিজন, অর্থাৎ ছোটমামা বলে,—যে রোগের যে ওষুধ তাই দিচ্ছি। কি ভেবেছে ও? মারের ভয়ে মুণ্ডা এবার বলে,—ওই শেঠজিকে দিয়েছি।
হোঁৎকা বলে,—এবার বুঝছেন, পটলারে কারা আটকাইছে? ওই শেঠজিই।
বড় মামাবাবু বলেন,—আমি যাচ্ছি তার কাছে।
ছোটমামা বলে ওঠে,–শেঠজি এসব কথা স্বীকার তো করবেই না, উলটে পটলেরই বিপদ ঘটাবার চেষ্টা করবে। যা শয়তান ও !
তাহলে?—বড়মামা ভাবনায় পড়েন।
ছোটমামা বলে,কলকাতায় পটলের কাকাকে খবর দিচ্ছি ফোনে, ওখানকার পুলিশের আই. জি. ওর পরিচিত, ওখান থেকে এখানের পুলিশ মহলে চাপ দিক। আমরা এদিকে খোঁজখবর করছি।
হোঁৎকা বলে,— পটলার বাড়িতে খবর পাইলে ওর ঠাকুমা, মা ভাইঙ্গা পড়বে। এহন খবর দিতে হইব না। আমরাই দেখছি। পরে যা হয় করবেন।
ভেবেছিলাম মুণ্ডাকে চাপ দিলেই কিছু খবর বের হবে। তাই মুণ্ডাকে ওর ঘরে আটকে রেখে আমরা জেরা শুরু করি।
—কোথায় রেখেছে পটলাকে তোর শেঠজি?
মুণ্ডা বলে,—জানি না সাব ।
হোঁৎকা সপাটে একটা ঘুসি মারে।
গোবরা বলে না বললে মেরে তোর হাত পা ভেঙে লাশ বানিয়ে দেব।
মুণ্ডা বলে,-আমি সত্যিই জানি না। শেঠজি আমাদের ওর কারখানার অফিসঘর অবধি যেতে দেয়, তার ওদিকে কোনোদিন যাইনি।
—তুই কালুয়াকে চিনিস?
আমার কথায় একটু চমকে ওঠে সে। হোঁৎকা বলে—মুখ বুজি থাকলি চলবেনি বাপধন, মুখ খোলাতি জানি। দিমু অ্যাক্ ঘা?
মুণ্ডা হোঁৎকার ঘা-এর জোর মালুম পেয়েছে। বলে,—ওকে দেখেছি শেঠজির মোকামে । –কি করে ও? বল –
মুণ্ডা বলে,—শুনি অনেক আকামই করে, বোমা গুলি টুলিও চালায় ।
—কোথায় থাকে সে ?
—ওই কারখানার পিছনে লালবস্তিতে।
গোবরা বলে—এই পর্যন্ত আজ থাক। ওটাকে আটকে রাখ।
ওই কালুয়ার খবর নিই, পটলার সন্ধান না পাওয়া অবধি ওটাকে আটকে রাখতে হবে এখানে।
হোঁৎকা বলে,—লালবস্তিটা কোথায় আবার?-
বিশু বলে,—লালবস্তি আমি চিনি।
তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সন্ধ্যার পর এদিকে দু-একটা আলো টিম টিম করে জ্বলে। বন্ধ কারখানাগুলো ভূতের বাড়ির মত দাঁড়িয়ে আছে এখানে ওখানে।
আমরা চলেছি ক’জন। বিশু পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। খোলা জায়গায় একটা গাছের নীচে কারা চারপাই পেতে হুঁকো টানছে। ওদেরই একজনকে শুধাই, কালুয়া এখানে থাকে?
কালুয়ার নাম শুনে ওরা আমাদের দিকে চেয়ে আপাদমস্তক দেখে। একজন বলে,—হ্যাঁ, ওইদিকে সোজা যাও, বাঁ হাতে লাল পেলাসটিকের চাল, ওটাই ।
আমরা এগিয়ে চলেছি, হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে কাকে উদয় হতে দেখে চাইলাম। কর্কশ কণ্ঠস্বর, চোখ দুটো যেন কোটরে বসা—কাকে চাই ?
বিশুই বলে—কালুয়া আছে ?
লোকটা বলে,–না, ভোরে বেরিয়ে গেছে।
—কখন ফিরবে?
-জানি না ।
হঠাৎ দু’দিক থেকে বেশ কয়েকজন আমাদের ঘিরে ধরে। একজন বিশুর হাত থেকে টর্চটা কেড়ে নিতে চায়। গোবরা লোকটাকে সপাটে লাথি মারতে, সে ছিটকে পড়ে আর্তনাদ করে ওঠে। আর ততক্ষণে হোঁৎকা একজনের গলার সামনে ছুরিটা ধরে বলে,–কেউ এক পা এগোলে একেই শেষ করব।
লোকগুলো ভাবেনি যে ওদের আক্রমণ এমনিভাবে প্রতিরোধ করব আমরা।
হোঁৎকা ছুরিটা ওর গলায় ঠেকিয়ে বলে,—চল, বাইরে চল, বাইরে এসে এবার দেখি বস্তির লোকরাও থেমে গেছে। বেশ খানিকটা লোকটাকে এনে এবার তাকে ছেড়ে দিতেই সে দৌড়ে পালালো।
গোবরা বলে,—ব্যাটা যে এখানেই থাকে, সেটা নিশ্চিত।
মামাবাবুরাও শোনেন আমাদের অভিজ্ঞতার কথা। নন্টু ড্রাইভার আমাদের সঙ্গে যায়নি। সব শুনে সে বলে,—আমাকে নে যাননি কেন? ব্যাটাদের দু-একটাকে ঘা কতক দিয়ে আসতাম ।
হঠাৎ অন্ধকারে লাইকার চিৎকার কানে এল।
দারোয়ান বলে,–একটা ছেলেকে আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়।
—নিয়ে এসো আমাদের ঘরে।
সজলকে দেখেই চিনতে পারি।
—সজল! বোসো !
সজল এদিক ওদিকে চাইছে। তাকে বলি,এখানে বাইরের লোক কেউ নেই। বলো কি ব্যাপার।
সজল বলে,—একটু আগে কালুয়া এসেছিল শেঠজির কাছে। কারা নাকি তাদের বস্তিতে গেছল ওর সন্ধানে। ও আর ওই মাল রাখতে চায় না তার ঘরে।
-কি মাল ?
সজল বলে,—ওদের হাতে অনেক মালই থাকে। তবে এটা নাকি সোনা-দানা চোরাই মাল কিছু নয়। বোধহয় একটা ছেলেকেই আটকে রেখেছে ওখানে! সে নাকি পালাবার চেষ্টা করতে তার মুখ-টুখ হাত-পা বেঁধে রেখেছে।
আমরা চমকে উঠি। তাহলে আমরা ওদের বাধা অগ্রাহ্য করে এগোলে নিশ্চয়ই পটলাকে উদ্ধার করতে পারতাম। ভাবতেও পারিনি যে ওই নোংরার মধ্যে ওরা পটলাকে আটকে রাখবে।
হোঁৎকা শুধায়-এখন কোথায় সে?
সজল বলে–শেঠজি ওকে তার জঙ্গলের ডেরায় নিয়ে যেতে বলেছে।
-সে কি!
সজল বলে,–এতক্ষণে বোধহয় তাকে নিয়েও চলে গেছে।
—সেটা কোনখানে ?
সজল বলে,—শুনেছি জঙ্গলের মধ্যে একটা সুরক্ষিত আস্তানা ওরা তৈরি করেছে। সেখানে অনেক চোরাই মালও থাকে। আমি যাই, দেরি হলে ওরা খোঁজাখুঁজি করবে।
সজল চলে যেতে বলি-আমার মন বলছে পটলাকে ওই কেল্লার মধ্যেই কোথাও আটকে রেখেছে।
গোবরা বলে,—তাহলে এই রাতেই আমাদের ওখানে যাওয়া দরকার। ওরা নিশ্চয়ই ভাবতে পারবে না যে এই রাতেই এত তাড়াতাড়ি আমরা ওদের ডেরায় হানা দেব।
বিশু বলে,–সেই ভালো।
নন্টুও তৈরি। সে বলে বাড়ি থেকে গাড়ি নিলে জানতে পারবে, আমার বন্ধুর জিপ আছে—সেটা নিয়ে পাঁচিলের ওদিকে থাকব।
বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়তে আমাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। দড়ি, টর্চ, ছুরি সব গোছানোই ছিল। আমরা এর মধ্যে খিড়কির দরজা দিয়ে ডুপ্লিকেট চাবি জোগাড় করে নীরবে বের হয়ে গেছি। লাইকা কুকুরটাকেও সঙ্গে নিয়েছি।
বাড়ির পিছনে জিপও রেখেছে নন্টু। আমরা হেডলাইট নিভিয়ে তারার আলোয় কোনোমতে এগিয়ে চলি।
নাগরমলজি খুব হিসেবি লোক।
পটলাকে আটকে রেখে ক্রমশ জানতে পারে, একে মোচড় দিলে লাখখানেক টাকা মুক্তিপণ আদায় করা যাবে।
তাই নাগরমলজি কালুয়াদের নামেই কলকাতায় পটলের বাড়িতে ফোন করে ঘোষণা করেন,—আপনার ছেলেকে আমরা আটকে রেখেছি। যদি তাকে পেতে চান দশ লাখ টাকা নিয়ে ভীমপুর স্টেশনের নীচে নদীর ব্রিজে আসবেন। পুলিশে খবর দিলে ফল ভালো হবে না । খবরটা পেয়ে কলকাতায় পটলের বাড়িতে নেমেছে আতঙ্কের কালো ছায়া। ঠাকুমা খবরটা শুনে চমকে ওঠে—যে ভয় করছিলাম তাই হল! ডাকাতি করেছে ওই পটলকেই!
পটলের মায়ের চোখে জল। সে বলল, – কি হবে মা?
বুড়ি বলে,—চলো, টাকাই দেব ওই ম্যাপড়াদের। পটলের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। আজই চলো।
ছোটকাকা বলেন—আগে খবর নিই, ওর মামাদের ফোন করি, তারপর যা হয় করা যাবে। পটলের বাবা বলেন,—ডাকাতদের টাকা আমি দেব না। পুলিশের আই. জি. সাহেবকে ফোন করছি, এ কি মগের মুলুক !
ঠাকুমা বলে,-টাকা নিয়ে ধুয়ে জল খাবি? যদি আমার পটলের কিছু হয়ে যায় ?
তবু পটলের বাবা পুলিশের বড়কর্তাকে ফোন করে ওই অঞ্চলের উপদ্রব, ডাকাতির কথা জানান। তাঁর ছেলের ওইভাবে অপহরণ, আর মুক্তিপণ দাবী করার খবরও জানান।
এবার পুলিশের টনক নড়ে। খোদ বড়সাহেব চেনেন পটলের বাবাকে। শহরের নামকরা পরিবার। পরিচিতি অনেক দূর অবধি। অর্থাৎ জল অনেক দূর অবধি গড়াতে পারে।
গভীর রাতে ফোনটা বাজছে। পটলার মামা-মামিরা জেগে।
ফোন আসছে কলকাতায় পটলদের বাড়ি থেকে। ওর বাবা ফোন করছে। মা কান্নাভেজা স্বরে বলে,—একি সর্বনাশ হল দাদা! ডাকাতরা পটলকে চুরি করে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে, আমাদের কাছে ফোন করেছে একদিনের মধ্যে দশলাখ টাকা না দিলে তাকে শেষ করে দেবে। চমকে ওঠেন মামাবাবু, সে কি! পটলকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না, আমরাও খুঁজছি সবাই আর ডাকাতরা তোমাদের সিধে ফোন করেছে টাকার জন্য? নাম্বার পেল কোথায় ? ওদিক থেকে বলেন পটলের মা, – বোধহয় পটলের কাছেই পেয়েছে। ওর বন্ধুরা কোথায়? তাদের ডেকে দাও! কথা বলব।
এবার নীচের ঘরে ছেলেদের ডাকতে গিয়েই ছোট মামাবাবু চমকে ওঠে। দুটো ঘরেই ছেলেদের কেউ নেই। বিশুও নেই, মায় কুকুরটা অবধি নেই। ঘর ফাঁকা
চমকে ওঠেন মামা—গেল কোথায় সব ?
ওদিকে ফোনে কথা বলার জন্য লাইন ধরে আছে পটলের মা।
তাড়া দেয়,– কি হল ?
ছোটমামা এসে খবর দেয়,–ছেলেগুলোকে দেখছি না। ঘর ফাঁকা ।
মা এদিক থেকে চমকে ওঠে—সৌর তাহলে তাদেরও ধরে নিয়ে গেছে! এখন কি হবে? বড়মামা বলেন,“দেখছি!
ঠাকুমা ফুঁসে ওঠে,—আর দেখে কাজ নাই বাছা! যা দেখার এবার আমরাই দেখছি। যাচ্ছি
ওখানে।
ফোনটা কেটে যায় ৷
এবার বড়মামা, ছোটমামাও বিপদে পড়েন। মামিমার চোখে জল,—মুখ দেখাবার উপায় রইল না। ছেলেগুলোকে ভালো রাখো ঠাকুর। বড়মামা বলেন থানাতেই চলো।
ছোটমামা বলেন,–ওখানে গিয়ে লাভ হবে না। থানার দারোগা নাগরমলের ধামাধরা। যেতে হয় পুলিশ সুপারের কাছেই চলো দাদা। শুনেছি নতুন এসেছেন, খুব কাজের লোক ।
ওদিকে রাতের অন্ধকারে আমাদের জিপটা চলেছে বনের রাস্তা ধরে। নন্টু এখানকার ছেলে। এই বনের অন্ধিসন্ধি তার জানা। সে বলে,—গড়ে যাবার ভালো রাস্তাটা দিয়ে যাওয়া যাবে না। ওই পথে নিশ্চয়ই নাগরমলের চর রয়েছে, ওরা আগেই খবর পেয়ে যাবে।
—তাহলে?
আমার কথায় নন্টু বলে—বনের ভিতরে যাবার অন্য রাস্তা আছে, ওটা দিয়ে গড়ের পিছনদিকে পৌঁছান যায়। সেদিকে জঙ্গলও গভীর, সহজে কেউ যায় না। ওই পথে যাওয়াই নিরাপদ ।
তাই আমরা হেডলাইট নিভিয়ে ম্লান চাঁদের আলোয় ঢাকা পথে চলেছি।
জিপটাকে বনের মধ্যে রেখে আমরা নামলাম। এখান থেকে নদীটাকে দেখা যায় । নদীর বুক থেকে উঠেছে গড়ের প্রাচীর। ওই স্তব্ধ অন্ধকারাচ্ছন্ন কেল্লার দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকি।
প্রাচীনকালের কেল্লা, তখন হয়তো এই নদীর ধারে জনবসতি ছিল। এখন জনহীন অরণ্য। অতীতের স্মৃতি বুকে নিয়ে ওই কেল্লা দাঁড়িয়ে আছে। তবে মাঝে মাঝে ধ্বসে পড়েছে, পাঁচিলের ফাটলে বট অশ্বত্থ গাছ জন্মেছে ।
তাতে অবশ্য আমাদেরই সুবিধে। টর্চের আলোয় ওই সব পথের সন্ধান করে এবার অভিযানের জন্য তৈরি হই ।
নাইলনের দড়িগুলোর প্রান্তে মজবুত আংটা লাগানো। ওই আংটাসমেত দড়িগুলো উপরের দিকে ছুঁড়ে দিতে দু-একটা আংটা ওই গাছের ডালে আটকে যায়। তারপর ওই দড়ি ধরে আমরা অনায়াসেই কেল্লার ছাদে উঠে পড়ি।
সেখানেও ঝোপ-ঝাপ রয়েছে। ওরই আড়ালে বসে এবার দেখি দলের সবাই উঠে এসেছে, মায় লাইকাও ।
কেল্লার এলাকাটা এবার দেখতে পাই। অনেকখানি এলাকা জুড়ে কেল্লাটা। এককালে বেশ সুরক্ষিতই ছিল। নদী থেকে কেল্লার চারদিকে খাল কেটে অতীতে জলভরা থাকত। এখন খালগুলো সংস্কারের অভাবে মজে গেছে। বনবাদাড় গজিয়েছে।
এই বিস্তীর্ণ এলাকায় কোথায় খুঁজব পটলাকে? আমরা ছাদের আলসের পাশ দিয়ে অন্ধকারে চলতে থাকি সিঁড়ির সন্ধানে।
বেশ খানিকটা এসে দেখি নীচের আঙিনায় একটা লোক। ওর হাতে বল্লম। লোকটা ওই সিঁড়ির পথেই পাহারায় রয়েছে।
হোঁৎকার ইশারায় আমরা থামলাম। বিশু লাইকাকে ধরে রেখেছে। ও নীচে নামার জন্য ছটফট করছে।
আমরা চুপিসাড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছি। লোকটা বোধহয় দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমচ্ছিল। তাই আমাদের পায়ের শব্দ পায়নি।
গোবরা অতর্কিতে লোকটার ঘাড়ের কাছে ক্যারাটের এক জোর ঝটকা মারতে লোকটা নীরবে কাটা কলাগাছের মত সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে ।
আমরাও তৈরি ছিলাম।
ওর মাথার পাগড়িটা খুলে ওর মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে বেশ জোরসে ওর হাত পা বেঁধে তুলে এনে পাঁচিলের কোণে জমা করে দিলাম। লোকটার ফতুয়ার পকেটে কয়েকটা বড় বড় সেকেলে ধরনের চাবি পাওয়া যেতে হোঁৎকা সেগুলো হাতিয়ে নেয়। আর নন্টু ওর বল্লমটার দখল নিয়েছে।
এবার এদিক ওদিক দেখছি। দূর থেকে কথার শব্দ ভেসে আসছে। অর্থাৎ আরও লোকজন এখানে আছে। তবে কাউকে দেখতে পাই না ।
আমরা সামনের খিলান পথ ধরে এগোতে থাকি। ওদিক থেকে যেন মৃদু আলোর আভা আসছে।
আমরা একটা মজবুত দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ালাম পথটা এখানেই থেমে গেছে । দরজায় একটা তালা ঝুলছে। হোঁৎকা সেই চাবির গোছা থেকে একটা একটা করে চাবি দিয়ে তালা খোলার চেষ্টা করে। হঠাৎ একটা চাবিতে তালাটা খুলে যায়।
সাবধানে বন্ধ দরজা খুলতেই চমকে উঠি। মেঝেতে হাত পা বাঁধা কে পড়ে আছে? পটলা নাকি? এত সহজে পটলার সন্ধান পাব ভাবিনি।
এগিয়ে যাই।
টর্চের আলোয় এবার বন্দীও আমাদের দিকে চাইল। তাকে দেখে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। —সজল! তুমি ।
সজলের কপালে রক্তের দাগ, মুখে আঘাতের চিহ্ন। হাত-পা বেঁধে কারা এখানে ফেলে রেখেছে।
ওর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিই। বেশ খানিকটা জল খেয়ে সজল বলে—ওই শেঠজির লোক আমার উপর নজর রেখেছিল। তোমাদের বাড়ি হতে বের হবার পরই আমাকে ধরে জোর করে এখানে এনেছে। ওরা জানতে পেরেছে যে আমি তোমাদের কাছে গেছি।
হোঁৎকা বলে,—এখানে এসেছি আমাদের বন্ধুর সন্ধানে। কিন্তু কোথায় যে তাকে রেখেছে জানতে পারছি না ।
সজল গলা নামিয়ে বলে,–এখানে ওদের অনেক গুপ্তঘর আছে। সবগুলোর খবর আমিও জানি না। চলো, দেখা যাক যদি সন্ধান মেলে।
এবার সাবধানে এগোতে থাকি। এদিকের বড় একটা ঘরে দেখা যায় বিরাট বড় বড় কাপড়ের গাঁট। ওদিকে নতুন টায়ারের স্তূপ, দেওয়াল অবধি সাজানো নানা ধরনের যন্ত্রপাতির প্যাকেট।
সজল বলে,—এসব শেঠজির ওয়াগন থেকে লুঠ করা মালের গুদাম। সব মাল এখানে এসে জমা হয়। তারপর এখান থেকে পাচার করা হয় ।
হঠাৎ যেন দেওয়াল ফুঁড়ে দুটো ছায়ামূর্তির আবির্ভাব ঘটে,–ব্যাটা এখানে এসেছিস? অন্যজন গর্জে ওঠে,–বাঘের গর্তে সেঁদিয়েছিস নেংটি ইঁদুরের দল তোদেরও ব্যবস্থা করছি।
তেড়ে আসে ওরা, হাতে ভোজালি।
হঠাৎ হোঁৎকা একটা পাথর তুলে নিয়ে সজোরে ছুঁড়তেই সেটা একজনের কপালে গিয়ে লাগে। আর লোকটা চকিতের জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে সেখানেই আছড়ে পড়ে। আর পরমুহূর্তেই লাইকা গিয়ে লাফ দিয়ে অন্যজনের টুটি টিপে ধরতে তার হাত থেকে ভোজালিটা পড়ে যায়। আমরা তাকে এবার ধরে ফেলি।
লাইকার হাত থেকে বাঁচলেও সে আমাদের হাত থেকে বাঁচে না। তার সামনে তারই ভোজালি তুলে ধরে বলি,—পটল নামের সেই ছেলেটাকে কোথায় রেখেছে বল!
লোকটা বলে,—জানি না।
গোবরার সপাটে লাথি খেয়ে এবার অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে সে।
হোঁৎকা গজরায়,—ক ঠিক কইরা, নালি তরে কাইটা ফেলুম! বল – উদ্যত ভোজালি দেখে লোকটা বলে,-বলছি।
গোবরা বলে,—বলতে হবে না, নিয়ে চল আমাদের। চল। লোকটা বলে,–শেঠজি জানতে পারলে মেরে ফেলবে
গোবরা বলে,–না বললে আমরাই মারব তোকে।
লোকটা বুঝেছে সমূহ বিপদ। তাই বলে সে,—ঠিক আছে। চলো এদিকে। লোকটা আগে আগে চলেছে, পিছনে চলেছি আমরা। লাইকাও চলেছে। সে হঠাৎ কিছুটা গিয়েই থেমে যায়। বাতাসে কিসের ঘ্রাণ নিয়ে পিছু হঠে এসে চিৎকার করে।
আমি বলি,–বিশু ওকে থামা, ওর চিৎকারে অন্যরা এসে পড়লে বিপদ হবে।
বিশু ওকে থামাবার চেষ্টা করে। লোকটা বলে,—ওই ঘরের ওদিকে একটা ঘরে রেখেছে তোমাদের বন্ধুকে।
সামনে চাতাল মত, তারপর আবার একটা দরজা। ওই ঘরের ওপাশেই কোনো অন্ধকার পাথরের কারাগারে পটলাকে আটকে রেখেছে। তাকে উদ্ধার করতেই হবে।
আমি হোঁৎকা দুজনে এগিয়ে যাই দরজাটা খোলার জন্য। এদিকে গোবরা লোকটাকে আটকে রেখেছে। হঠাৎ লোকটা নিমেষের মধ্যে এক ঝটকায় গোবরার হাত ছাড়িয়ে, নিজেকে মুক্ত করে ছুটে পালাবার চেষ্টা করতেই লাইকা ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লোকটা ততক্ষণে দেওয়ালের কাছে পৌঁছে গেছে আর আমরাও আবিষ্কার করি মেঝেটা নিমেষের মধ্যে আমাদের পায়ের নীচে থেকে সরে গেল ।
একটা অন্ধকার গভীর গর্তের মধ্যে পড়ে গেছি আমি আর হোঁৎকা। বাকিরা মেঝের সীমানার বাইরে ছিল বলে ওরা পড়েনি। আর আশ্চর্যের কথা উপরের সেই মেঝেটাও আবার জোড়া লেগে গেছে।
হাতে পায়ে সামান্য চোট লাগলেও সেটা গ্রাহ্যের মধ্যে আনিনি। নীচের ওই অন্ধকার পুরীতে দেখি একটা পথও রয়েছে। অর্থাৎ এটা কেল্লার মাটির নীচের মহলই বলা যেতে পারে। হোঁৎকা বিপদের মধ্যেও বেশ মাথা ঠান্ডা রেখেই কাজ করতে পারে।
আমি বলি,—এখন কি হবে? পটলাকে খুঁজতে এসে নিজেরাই তো বন্দী হয়ে গেলাম। হোঁৎকা বলে,—হাওয়া চলাচল করতাছে, পথ নিশ্চয়ই আছে, চল দেহি।
আমরা এবার সামনের সরু বারান্দা মত পথটা দিয়ে চলেছি। টর্চের আলোয় দেখা যায় আশপাশে জমাট প্রাচীর। ওদিকে দু-একটা ঘরও আছে, তবে নীচের সুরক্ষিত অঞ্চল, তাই দরজায় তালা নেই। ঘরের মধ্যে কি আছে দেখার সময় আমাদের নেই, এখন বের হবার পথ খুঁজতে হবে।
হঠাৎ একটা ঘরের মধ্যে কার অস্ফুট গোঙানির আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালাম। হোঁৎকা কান পেতে আওয়াজটা শুনে বলে,—কারো গলার স্বর শুনছি না!
এবার সরু পথের পাশে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াই। টর্চ জ্বেলে সাবধানে এগিয়ে যাই। কে জানে এও কোনো কৌশল কিনা!
টর্চের আলোয় ঘরের কোণে দেখি একটা খাটিয়ার সঙ্গে বাঁধা রয়েছে আমাদের পটলাই। পটলার মুখে স্টিকিং-প্লাস্টার, হাত দুটো বাঁধা। পা-ও
আমাদের দেখেছে পটলা। কিন্তু মুখ বন্ধ থাকার জন্যে কোনো কথাই বলতে পারছে না । আমরা ওর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে মুখের স্টিকিং-প্লাস্টারটা সাবধানে তুলে দিতে পটলা বলে,—ত-তোরা ।
আমরা আমাদের অভিযানের ব্যাপারটা জানাই আর এখানে অতর্কিতে কিভাবে হুড়মুড়িয়ে এসে পৌঁছেছি, তা-ও বলি।
পটলা বলে,—ওই কা— কালুয়া, ট্রেনের ডাকাতগুলো এ-এখানেই থাকে। স-সবাই ওই নাগরমলেরই লোক। ওই কালুয়াই আমাকে একটা ঝুপড়ি থেকে এখানে এনেছিল। ওই গলি দিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নামিয়েছিল।
তাহলে ওঠা-নামার জন্য অন্য পথও আছে?
কতক্ষণ ধরে এই পাতালপুরীতে বন্ধ রয়েছি জানি না। ঘড়ি দেখে খেয়াল হয় ছ’টা বেজে গেছে। অর্থাৎ বাইরে এখন সকাল। শালবনের মাথায় নদীর বিস্তীর্ণ বালুচরে এখন দিনের আলো ফুটেছে। এবার আমাদেরও বের হবার পথ খুঁজতে হবে ।
পটলার জন্য কিছু জলও রেখেছিল কুঁজোতে। সেই জল খেয়ে বের হই মুক্তিপথের
সন্ধানে।
এদিকে ওদিকে চলেছি। ধারে পাশে দু’একটা পাথরের খিলানও রয়েছে।
হঠাৎ ওদিক থেকে সরু পথে বেশ জোর হাওয়া আসছে মনে হল। কোনো খোলা জানলা দিয়ে যেমন জোরে ঝড়ের হাওয়া আসে।
হোঁৎকা বলে,—এত জোরে হাওয়া আসতিছে—
আমি বলি,–ওইদিক থেকে আসছে।
আমরা ওই পথে এগিয়ে চলি। নীচের জমি স্যাঁতসেঁতে। উপরের খিলানগুলো এখানে একটু নিচু। মাথা নিচু করে চলেছি।
হঠাৎ জোরালো টর্চের আলোয় পাতালপুরীর অন্ধকার উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আর কারা পিছন থেকে বলে ওঠেন—কালুয়া, ব্যাটাচ্ছেলেটা এখানে!
কালুয়া গর্জে ওঠে—বহুত রূপয়াকা মাল! এইসা ভেগে গেলে শেঠজি আমাদেরই জবাই করবে। পাকড়ো!
ওরা ছুটে আসছে।
হোঁৎকা একজনকে সপাটে লাথি মারতে সে ছিটকে পড়ে। পটলাও দৌড়চ্ছে।
ওরা তিন-চারজন মিলে হোঁৎকা আর পটলাকে ঘিরে ফেলতে, আমি একটা থামের পাশ দিয়ে সোজা অন্ধকারেই ছুটতে থাকি।
আমরা ক’জন ছিলাম কালুয়ার দল ঠিক খেয়াল করেনি। ওদের নজর পটলার দিকেই। হোঁৎকাকে দেখে কে বলে,—এটাই তাহলে উপর থেকে খাঁচাকলে পড়েছে!
আমি দূর থেকে দেখছি, পটলা হোঁৎকাকে ওরা দড়ি দিয়ে বাঁধছে। আমার করার কিছুই নেই। কোনোরকম শব্দ পেলে আমাকেও এসে ধরবে, তাই দূরে ওইভাবে লুকিয়ে রইলাম। পটলাকে উদ্ধার করেও বের হয়ে যেতে পারলাম না। ওরা এসে পড়ে আবার পটলাকে তো নিয়ে গেলই, সেই সঙ্গে হোঁৎকাকেও নিয়ে যাচ্ছে। আমি তখনও থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছি।
ওরা চলে যাবার পর বুঝতে পারি এই অজানা অচেনা পাষাণপুরীতে আমি একাই বন্দী হয়ে আছি।
বাইরের হাওয়াটা এখন জোরে বইছে। ওই হাওয়াই এই পাতালপুরীর বদ্ধ পরিবেশে তাজা প্রাণের খবর আনে। আমি এবার ওই দিকেই এগোতে থাকি। কিছুটা যাওয়ার পর দেখা যায় পাথরগুলো এক জায়গায় ভেঙে পড়েছে। আর সেই ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ে বালুচর, শালবন। অর্থাৎ মুক্তির পথ আমার সামনে।
বাইরে এদিকে কোনো লোকজন পাহারাতে আছে কিনা জানা দরকার। কিন্তু তেমন কাউকে দেখা যায় না। বেলাও হয়ে গেছে। চারিদিকে রোদের সোনালী আভা।
বের হয়ে ওই জঙ্গলের আড়াল থেকে চেয়ে দেখি বিশাল কেল্লাটাকে। ওর কোন্ অতল গহ্বরে আটকে রয়েছে পটলা, অন্যরা।
এখন আমাকেই যেভাবে হোক ওদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে।
শেঠ নাগরমল জানে ওই পটলা তার কাছে বিশাল অঙ্কের ব্যাঙ্ক চেক, তাই তার উপর নজর রেখেছিল। আশা ছিল টাকাটা সহজেই পাবে, তারপর ছেড়ে দেবে পটলাকে।
কিন্তু হঠাৎ কেল্লার মধ্যে বাইরের ওই ছেলেদের আমদানী হতে দেখে চমকে ওঠে শেঠজি । এটা ছিল তার কল্পনার বাইরে। আমাদের দলের এহেন দুঃসাহসে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে।
শেঠজি জেনে গেছে যে তার এতদিনের নিরাপদ কেল্লার মধ্যে এবার বাইরের বেশ ক’জন ঢুকেছে। তারা অনেককিছুই জেনে যাবে। তার পক্ষে এটা খুবই বিপজ্জনক ঘটনা। তাই শেঠজি বলে,—কালুয়া, সবকটাকে ধরে অন্ধকার গুম ঘরে আটকে রাখ, যেন একটাও বেরুতে না পারে। এত বড় হিম্মৎ ওদের, আমার পিছনে লাগবে।
কালুয়াও জানে তাদের সকলকেই বাঁচতে হবে। তাই সারা কেল্লায় তার লোকজন ছড়িয়ে পড়ে।
ওদিকে আমি আর হোঁৎকা পাতালপুরীতে ঢুকে যাবার পর মেঝেটা আবার কি কৌশলে যথাস্থানে সেট্ হয়ে যায়। গোবর্ধন ফটিক বিশুরা দেখে আমরা দুজন নেই। লাইকা কুকুরটা লাফ দিয়ে মেঝেতে এসে পা দিয়ে আঁচড়াতে থাকে, আর গোঁ গোঁ করতে থাকে।
গোবরা বলে,—ওইখানে কুকুরটা কালও আঁচড়ে ছিল, চিৎকার করেছিল। ওখানে কোনো গড়বড় আছে সেটা ও আগেই বুঝেছিল, আমরা বুঝতে পারিনি।
ফটিক বলে,—এখন কি হবে? এক পটলাকে আটকে ছিল, এখন সঙ্গী হোঁৎকাকেও আটকেছে ওরা!
বিশু, নন্টুও ভাবনায় পড়ে।
সজল বলে,–শেঠজি সাংঘাতিক লোক। ওর লোকজনও টের পেয়ে গেছে আমরা এখানে এসেছি।
ফটিক বলে,—চল, বের হয়ে যাই। বাইরে গিয়ে পুলিশকে খবর দিতে হবে, পটলার মামাদেরও।
হঠাৎ দু’তিনটে টর্চের আলো এসে পড়ে ওদের উপর। কে বলে,—বাকি ক’টা এখানেই রয়েছে, ধর ব্যাটাদের।
ওরা এগিয়ে আসছে, হঠাৎ লাইকা অন্ধকার ফুঁড়ে লাফ দিয়ে গিয়ে ওদের দলের পয়লা নম্বর সর্দারের টুটি টিপে ধরে। ওই প্রচণ্ড লাফের ধাক্কায় লোকটার হাতের পিস্তল ছিটকে পড়ে।
পিস্তলটা ছিটকে পড়তেই গোবর্ধন সেটা কুড়িয়ে নেয়। গোবর্ধনের মামার রিভলবার আছে, গোবরা লুকিয়ে চুরিয়ে সেটা দু-চারবার ফায়ারও করেছে। এবার প্রাণ বাঁচাবার জন্যই গোবরা ওটা তুলে বলে,-এক পা এগোলে গুলি করব।
লোকগুলো দেখছে সর্দারের ওই অবস্থা, আর গোবরার হাতে সর্দারের পিস্তল। ওরা থেমে যায়।
গোবরা বলে,–কোথায় রেখেছিস পটলাকে?
লাইকা সর্দারকে ছেড়ে দিয়ে এবার লোকগুলোর দিকে লাফ মারে। এদিকে উদ্যত পিস্তল, ওদিকে মৃত্যুদূতের মত কুকুর। অন্ধকারেই যে যেদিকে পারে দৌড়ে পালায় ।
মেঝেতে পড়ে আছে লোকটা, ভয়ে বিবর্ণ। গলাটা ফুটো গয়নি, তবে কাঁধে বেশ চোট পেয়েছে। লোকটা কালুয়ার সহচর। একেই ট্রেন ডাকাতি করতে দেখেছিল সবাই।
এবার গোবর্ধন ওর পেটে পা চাপিয়ে বলে,—খুব যে বীরত্ব দেখাচ্ছিলি সেদিন ট্রেনে, নিরীহ প্যাসেঞ্জারদের মারিস, লুটিস, এবার ?
লোকটা আর্তনাদ করে,—শেঠজি করায়।
দু’তিনটে উল্টো-পাল্টা লাথি মারতে সে কাতরাতে থাকে। গোবরা ওকে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ওইখানে ফেলে রেখে বলে,—থাক এখানে। পরে এটার ব্যবস্থা করব। বিশু বলে,—ওরা জেনে ফেলেছে আমরা এসেছি, বাকিগুলো পালিয়ে গিয়ে এতক্ষণে নিশ্চয়ই খবরও দিয়েছে নাগরমলকে।
গোবরা বলে,–ভয় কি? হাতে পিস্তল আছে, অন্য অস্ত্রও আছে। ওদের সঙ্গে লড়তে হয় লড়ব, তবু পটলা হোঁৎকাদের এখানে ফেলে যাব না।
নীচের মহলে তখন হোঁৎকা আর পটলাকে ধরে ফেলেছে কালুয়া। শেঠ নাগরমলও এসেছে। মালপত্রের তদারক করতে। সে এসে ব্যাপারটা বুঝে খেপে উঠেছে। কালুয়া ওদের ধরে আনতে এবার শেঠজি বলে,—পালাবি এখান থেকে! এই কেল্লায় কতজনের লাশ গুম করেছি তা জানস? এবার তোদেরও শেষ করে দেব।
পটলা বলে,–আ-আমরা কি করেছি?
—কি করিসনি? আমার কারবারে বাধা দিবি? এখানে খুন করে পুঁতে দেব। মাটিতে আর
দুটো কঙ্কালের সংখ্যা বাড়বে মাত্র।
হঠাৎ পাতালপুরী কাঁপিয়ে পর পর দু-তিনটে বোমা ফাটে। বদ্ধ বাতাস বারুদের গন্ধে ভরে ওঠে আর কেঁপে ওঠে সারা কেল্লা।
চমকে ওঠে শেঠজি—ক্যা হুয়া! এতনা আওয়াজ?
গোবরার দল এগোচ্ছিল, এবার ওই পাতালপুরীর শয়তানের দল প্রথম পালিয়ে গিয়ে দলবেঁধে গোবরার দলের উপর আক্রমণ করার চেষ্টা করে। ওরা এগিয়ে আসছে।
গোবর্ধন-নন্টুরা দেখেছে সামনে বিপদ।
লোকগুলো গর্জে ওঠে—শেষ করে দে ব্যাটাদের।
ওরা এগিয়ে আসছে, আর তারপরই নন্টু পরপর দুটো বোমা ছোড়ে ওদের লক্ষ্য করে। প্রচণ্ড শব্দে ফাটে বোমাগুলো। বেশ কয়েকজন ছিটকে পড়েছে। বাকিরা তখন আর নেই । ওই ধোঁয়ার আড়ালেই তারা যে যেদিকে পেরেছে দৌড়েছে।
গোবরা দেখে পিছনে বের হবার খিলান পথ, তিনদিকে জমাট দেওয়াল আর সামনে ওই পলায়মান শত্রুর দল।
এবার বিশু বলে,—এখন কি হবে? ওরা সবাই জেনে গেছে।
গোবরা বলে,—তা সত্যি, এখানেই ঘাঁটি গেড়ে থাকতে হবে, থামের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে। ওদিক থেকেই ওরা আসতে পারে, এলেই বোঝাপড়া হবে।
শেঠ নাগরমল ওই বিকট আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে। তার সুরক্ষিত কেল্লায় নিশ্চয়ই পুলিশ ঢুকেছে। সে ভাবতেই পারেনি যে এখানে এসে কেউ হানা দেবে ।
ছুটে আসছে সে।
হোঁৎকা পটলাও খুশি হয় ওদের ওই অবস্থা দেখে। কিন্তু তাদের করার কিছুই নেই । একেবারে বেঁধে রেখেছে তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে।
এমনসময় ওই লোকগুলো ছুটে আসে।
শেঠজি শুধায়,—ক্যা হুয়া ?
কে বলে,—তিন-চারজন একটা ইয়া কুত্তা নিয়ে এসে ঢুকেছে। তারা লালটুকে পেড়ে ফেলেছে, আমরা ভি ওদের ধরতে গেলাম এই সা বোম মারল-
গর্জে ওঠে শেঠজি,–কারা! কারা ঢুকছে এখানে ?
—সে মালুম নেহি।
শেঠজি বলে,–কালুয়া, চল তো। ওই বাঁদরের দলই ঢুকেছে, দুটোকে আটকেছি, বাকিগুলোকেও খতম করে দিতে হবে, একটাও যেন পালাতে না পারে।
ওরা এবার তৈরি হয়েই চলেছে ওই শত্রুদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে। চোখে মুখে ফুটে ওঠে আদিম হিংস্রতার ছায়া।
আমি তখন জঙ্গলের মধ্য দিয়েই চলেছি একা। শালবন—নীচেও ঝোপ-জঙ্গল, তার মাঝে একটু পথের রেখা জেগে আছে। হঠাৎ বনের মধ্যে গুরু গুরু শব্দ শুনে থামলাম।
দেখা যায় মোরাম ঢাকা বনের রাস্তাটার কাছেই এসে গেছি। আর শহরের দিক থেকে বেশ
কিছু গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। শালবনের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে চেয়ে থাকি, দেখি বনের
মাথায় গাড়ি আসছে লাল ধুলো উড়িয়ে।
একটা নয়, বেশ কয়েকটা গাড়ি। পুলিশ ভ্যান, জিপ রয়েছে কয়েকটা। তার পিছনে পটলার মামার গাড়িগুলো দেখে মনে ভরসা পাই ।
ওরাও তাহলে এইদিকেই আসছে। আমিও রাস্তার উপরে উঠে এসে হাত নাড়তে থাকি । বনের মধ্যে একলা আমাকে দেখে গাড়িগুলো থেমে যায়। পুলিশ সুপার নিজেই রয়েছেন। ওদিক থেকে পটলার বাবাও এসেছেন। মামা শুধোন,—তুমি! ওরা সব কোথায়?
আমি জানাই কেল্লার মধ্যেই রয়ে গেছে তারা, ওদের শেঠজির লোক আটকে রেখেছে। পুলিশ সাহেব বলেন, – সে কি! তাহলে যা ভেবেছিলাম তাই ঘটেছে।
এবার পুলিশ ফোর্স এসে কেল্লাটাকে ঘিরে ফেলে। মাইকে ঘোষণা করা হয়, ধরা দিন শেঠজি, পুলিশ ফোর্স বাধ্য হয়ে ভিতরে ঢুকবে।
কেল্লার বুরুজের উপর এসে গুঁড়ি মেরে চারিদিক দেখে শেঠজি এবার বুঝতে পারে এই পুলিশের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়। ওদিকে বেশ কিছু পুলিশ ফোর্স নিয়ে পুলিশ সাহেব নিজে আমার দেখানো পথে ভিতরে গিয়ে হাজির হন, পাতালপুরীর অন্ধকার পুলিশের ইমার্জেন্সি আলোয় ভরে ওঠে। পাতালপুরী থেকে হোঁৎকা পটলাকে উদ্ধার করে এবার ওই কালুয়ার দলকে তাড়া করে পুলিশ।
শেঠজিও বুঝেছে পালাবার আর পথ নেই। কালুয়াও দলবল সমেত ধরা পড়ে।
এবার পুলিশ সার্চ শুরু করে অবাক হয়। কেল্লার বিস্তীর্ণ ওই ঘরগুলোতে রাশি রাশি বিভিন্ন কোম্পানির লাখ লাখ টাকার দামি মাল রাখা, সবই ওয়াগন ভাঙার মাল।
হোঁৎকা বলে,—স্যার, এখানের ট্রেন-ডাকাতির মূলেও এরাই।
পুলিশ সাহেব ওয়ারলেসে জরুরি খবর পাঠান। আর বিশাল ওই চোরাই মালের ভাণ্ডার পাহারার ব্যবস্থা করেন, ওদের প্রিজন ভ্যানে তুলে সদরে চালান করেন।
ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত বিধ্বস্ত দেহ নিয়ে আমরা পটলার মামার বাড়িতে ফিরে দেখি পটলার মা-ঠাকুমাও এসে পড়েছে। আমাদের সদলবলে ফিরতে দেখে বলেন,—ঠাকুর তোদের ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে দিয়েছেন। উঃ! এবার বাড়ি চল। ঢের হয়েছে।
মামিমা বলেন,–মা, ক’দিন ধরেই ওদের খুব ধকল গেছে। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়াও হয়নি। ওদের একটু বিশ্রাম নিতে দেন, তারপর যাবার কথা হবে।
সারা শহরে তখন সাড়া পড়ে গেছে। ওই শেঠ নাগরমল এতকাল এখানে আতঙ্কের রাজত্ব চালিয়েছিল, সেই আতঙ্কের কালোছায়া এবার লোকের মন থেকে মুছে গেছে।
এতদিন পর এই এলাকার মানুষ যেন রাহুমুক্ত হয়েছে আমাদের জন্য। পটলার গ্রামে গিয়ে শিক্ষার প্রসার করা আর সম্ভব হয়নি।
হোঁৎকা বলে,—তয় এক শয়তানকে উচিত শিক্ষা দিতে পারছি, ইডাও কম কি!