পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

পটলার ইন্দ্রজাল

পটলার ইন্দ্রজাল

পটলা ইদানীং ম্যাজিক নিয়ে পড়েছে। কিছুদিন আগে ওর কাকার কাছে বহরমপুরে গিয়ে ওখানে এক সুবীরকুমার না কার যাদুর খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে ওই দিকে ঝুঁকেছে বেশ কিছুদিন থেকে।

সেই যাদুকরের তাঁবুতেই যাতায়াত করে বেশ কিছু খেলা শিখেছে, হাত সাফাই, তাসের খেলা—এসব শিখে এরপর বাক্স থেকে বের হবার খেলা প্র্যাকটিস করছে। একদিন নাকি আলমারিতে বন্ধ হয়ে নিজেই দমবন্ধ হয়ে টেসে যাবার উপক্রম হতে ওর ছোটকাকা আলমারি থেকে বের করে দু চারটে চড় চাপড় দিয়ে বাসের টিকিট কেটে ওকে আবার তার বাবা মায়ের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিল।

কিন্তু পটলার ঘাড় থেকে ভূত তবু নামেনি। এখানে এসেও দিনরাত ওই সব ম্যাজিকের নক্সা হচ্ছে, বটতলার বই-এর দোকান থেকে লাল কালিতে ছাপা বহু পবিত্র ম্যাজিকের বইও এনেছে। ও বলে—নি-নিজেই ভ্যানিস্ হতে পারি, অলি একটা কোকিলের ডিম পেলে। কোকিলের ডিম স্বর্ণভস্মে রঞ্জিত করে মুখে রাখলে ম—মানুষ ত—ভ্যানিস হয়ে যায়।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে—তরে ভ্যানিস্ করতি এত সব লাগবো না। ফিনিশ কইরা তরে ভ্যানিস্ করুম। ক্লাবের ফাংশন—টাকা পয়সার দরকার তাই দ্যাখ এহন ওসব ছাইড়া।

আমরাও ভাবনায় পড়েছি। ক্লাবের ডে টু ডে খরচাও কম নয়। আলুকাবলি, ঝালমুড়ি, ফুচকা, নকুলের দোকানের চা এসবের পয়সা জোগায় পটলাই। যদি এখন পি-সি সরকার এর মত ম্যাজিসিয়ান হয়ে ওঠে, দেশ বিদেশে ঘোরে আমাদের কি হবে !

কিন্তু পটলা এখন ম্যাজিসিয়ান হয়ে গেছে। বাড়ির দু’তিনটে বিড়ালের উপর নাকি হিপনোটিজম চালিয়ে তাদের কায়দা করেছে। আর তাদের করাতকল থেকে একটা ছোট মটর লাগিয়ে করাত দিয়ে এবার কাউকে দুখণ্ড করে আবার জোড়া লাগাবার চেষ্টাও করবে।

এহেন পটলা আমাদের ক্লাবের আর্থিক অনটনের কথা শুনে বলে—কু-কুছ পরোয়া নাই । এবার রাসের মেলায় ম্যাজিক দেখিয়ে ক্লাবের জন্য ম্—মোটা টাকা তুলে দেবো। ত–তোরা একটু হেল্প করলেই হয়ে যাবে।

অবাক হই—তুই ম্যাজিক দেখাবি?

হাসে পটলা বিজ্ঞের মত। বলো স—সিওর। এতদিন কি শিখলাম ত—তাহলে!

হোঁৎকা বলে—কিন্তু তাতে তো খরচা লাগবো। তাঁবু-এটেজ-যন্ত্রপাতি, বাদ্যি বাজনা— ফটিক একপায়ে খাড়া। সে সঙ্গীত বিশারদ। এহেন মৌকা ছাড়তে সে রাজি নয়। ফটিক বলে মিউজিক এর জন্য ভাবতে হবে না। ওসব করে দেবো। বাঁশি-বেউলো-তবলা একটা ড্রাম। ওসব ক্লাবেই আছে।

পটলা মাথা নাড়ে–গুড়! আর তাঁবু স্টেজ-এর খরচা টিকিট বিক্রি থেকেই এসে যাবে, তাছাড়াও লাভ থাকবে। ব-ব্যবসা বুঝিস?

ওটা আমাদের চেয়ে পটলা বেশি বোঝে। ওর বাবা-কাকারা এখানের বড় ব্যবসায়ী; আড়ত, তেলকল, করাতকল বড় দোকান সব আছে। পটলা বলে–নবমী ডেকরেটার এর নটবরবাবুকে বলেছি। দু-দুশো টাকা অ্যাডভান্স দিলে তাঁবু স্টেজ সব বানিয়ে দেবে।

হোঁৎকা আশাভরে বলে—তয় ভাবনা নাই। দিনকার সেল হইতে ওগো ডেলি টাকা দিমু। পটলা তখুনি কাগজ কলম নিয়ে বসে পড়ে। আমরাও দারুণ উৎসাহী হয়ে উঠেছি। পটলার অঙ্কে মাথা খুব সাফ। সে দুপাতায় হিসাব করে দেখায় ডেলি দুটো শো-তে কম করে আড়াই শো টাকা ধরে পাঁচশো তো হবেই। ছুটির দিন ম্যাটিনিতেও শ’খানেক। সেটা ফালতু রোজগার। ডেলি চারশো করে হলেও দশ দিন মেলা থাকে। নিদেন চার হাজার বিক্রি হবেই। তাঁবু স্টেজ ভাড়া হাজার টাকা, পাবলিসিটি পাঁচশো, ইলেকট্রিক দুশো—টিফিন ক’জনের তিনশো। সাকুল্যে দু হাজার খরচা, আর পাচ্ছি চার হাজার। পটলা থার্ড স্যারের মত প্রশ্ন করে। -তা-তাহলে ল-লাভ ?

আমরা জানাই—দু হাজার।

দু হাজার টাকা পঞ্চপাণ্ডবের হাতে এলে এবারে হেমন্তদাকে এনেই প্রোগ্রাম করানো হবে, নিদেন সেল হবে দশ হাজার টাকা পটলা বলে,—দিস্ ইজ বিজনেস। দু হাজার থেকে—দ-দশ হাজার। লাভ আট হাজার ।

মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম। হোঁৎকা বেদম গ্যাস খেয়ে বলে, নাইমা পড়। পোস্টার দিমু-পটলা দি ম্যাজিসিয়ান।

আমি এর মধ্যে ডজন খানেক কবিতা লিখেছি। স্কুল ম্যাগাজিনে কবিতা ছাপা হয়েছে। তারই জোরে জানাই-ওটা না। পটলকুমারের ইন্দ্রজাল—এই হবে ব্যানার।

ভোটে ওই নামই গৃহীত হল।

পটলা বলে-দিদিমাকে হ-হাতিয়েছি। তিনশো টাকা ম-ম্যানেজড।

সুতরাং কাজে নামতে আর বাধা নেই। পটলার দিদিমার জয়জয়কার হোক। নাতি তার পি-সি সরকার হবেই এবার। গোকুল প্রেসে হ্যান্ডবিল ছাপা হচ্ছে, গোবরার মামা কোন সিনেমা হলের ম্যানেজার। তাদের চেনা প্রেসে তিনশো লাল নীল পোস্টারও ছাপা হয়ে গেছে। পটলকুমারের পাগড়িতে পালক গোঁজা ছবি সমেত (অবশ্য ছবিতে পটলাকে চেনা যাচ্ছে না)। ডেকরেটার কোম্পানির নসবাবু বলে—

– পাঁচশো টাকা আগাম দিতে হবে।

আমাদের বাজেট বর্তমানে দুশো টাকা, তার বেশি দেবার সাধ্য নেই। কিন্তু নসবাবুও রাজি হবে না। বলে—অর্ধেক দিতে হবে।

তীরে এসে তরী ডোবে আর কি? ওদিকে রাসতলায় মেলার কাজ শুরু হয়েছে। বিরাট উঁচু বিজলি নাগরদোলা, হাত পা হীন মাস্টার জগুর অত্যাশ্চর্য খেলার পোস্টার পড়েছে, তাঁবুর বাঁশ খুটি এসে গেছে, দোকান পশার বসছে। আমাদের জায়গায় শুধু চ্যাটাই এ পোস্টার ঝুলছে। পটলকুমারের ইন্দ্রজালের। যেন দড়িতে ওই পটলকুমারকে আমরা লটকে দিয়েছি।

হোঁৎকা বলে—নসুবাবু একখান শয়তান–ডেভিল। শেষ অবধি আর দুশো টাকা ম্যানেজ করা হল। আখতার খাঁ কাবুলিওয়ালার পাড়াতে অনেকদিনের ব্যবসা। মাঝে মাঝে দুপুরের রোদে টাকার ‘তাগাদায়’ এলে গরম লাগলে ক্লাবে এসে জিরোয়। জলটল খায়। সেই সূত্রেই আমাদের সঙ্গে পরিচয়। এহেন আখতার খাঁ আমাদের সেদিন চুপচাপ বসে থাকতে দেখে শুধোয়—কি হোয়েসে বাবা লোগরা। হোঁৎকা বাবু?

হাতের মুঠো থেকে নিদেন আট হাজার টাকা বের হয়ে যাবে মাত্র দুশো টাকার জন্যে, এই খবর শুনে লম্বা চওড়া দশাসই চেহারার আখতার খাঁ-এর কঠিন বুকটা নরম হয়। বলে সে—তিক্ হ্যায় হোঁৎকাবাবু শোচো মৎ, হম্ দেগা ।

অবাক হই আমরা—তুমি দুশো টাকা দেবে খাঁ সাহেব? আখতার খাঁ তামাটে দাড়ি নেড়ে বলে হ্যাঁ! লেকিন সুদ্ দিতে হোবে। দুশো রুপেয়া দিবে, তুম্ হোঁৎকাবাবু এক মাহিনার অন্তর দোশো রুপেয়া হামাকে আসল আর চল্লিশ রুপেয়া সুদ, দোশো চালিশ রুপেয়া হামাকে দিবে।

আমাদের কাগজে কলমে ইন্দ্রজাল থেকে নিট লাভ দুহাজার টাকা। ফাংশন করলে তো ক্লিন আট হাজার, সেটা না করলেও দু হাজার থাকছেই। পটলার হিসাব খুবই সাফ। তাই হোঁৎকা, গোবরা সমস্বরে বলে—তাই পাবে খাঁ সাহেব। কিন্তু টাকার আজই যে দরকার ।

—হোবে! খাঁ সাহেব ওয়াসটি-এর পকেট থেকে রসিদ বই বের করে বলে হোঁৎকাকে–দস্তখৎ করো। লেকিন ছুদ মে আগারি কাট লেতা হ্যায়, স্রিফ তুমকো বারে পিছু লেগা ।

হোঁৎকা ইংরাজিতে বেশ পাকাপোক্ত ভাবে সই করে, গোবর্ধন হল তার জামিনদার। ওর বাবার বাজারে সোনা রূপার দোকান আছে। খাঁ সাহেব তার ভিতরের পকেট থেকে দোমড়ানো দুখানা একশো টাকার নোট দিয়ে দেয়।

এরপর ঝড় বয়ে যায় পঞ্চপাণ্ডবের ক্লাবের দরমাঘেরা আস্তানায়। পটলা গিয়ে ডেকরেটারকে চারশো টাকা আগাম দিয়ে কাজ শুরু করিয়েছে। গোবর্ধন নিজে দাঁড়িয়ে থিয়েটারের স্টেজ বাঁধায়, সে ওই কাজে লেগেছে। পটলার সময় নেই।

হোঁৎকা আমি এর মধ্যে লাল শালুর উপর লম্বা টুপি, ছক্কর বক্কর প্যান্ট পরা ছবি-কোনটা বাক্সবন্দি অবস্থায় মুক্তির সংগ্রাম, করাত দিয়ে মানুষ আধখানা করার বিপর্যয় কাণ্ডের ছবি সেটে ব্যানার করেছি। আর পাড়ার ভুতো, ন্যাপলা – গোবিন্দের দল স্রেফ ভাঁড়ের চা আর লেড়ো বিস্কুট চুষে সারা এলাকার বাড়ির থাম, বটগাছ রেললাইনের গা—ভরিয়ে দিয়েছে পটলকুমারের পোস্টারে।

পটলাও খুব ব্যস্ত। নতুন খেলার মহড়া দিচ্ছে, হোঁৎকাকে সহকারী করে নিয়েছে। হোঁৎকা ওদের পাড়ার বুড়ো ভবেশ উকিলকে ম্যানেজ করে তার একটা ঢলঢলে কালো প্যান্ট আর কোট বাগিয়ে রীতিমত কাগজ খেয়ে কাগজের নল বের করার খেলাটা শিখে নিয়েছে। তারপরই পটলকুমারের সঙ্গে স্টেজে খেলা দেখাবে।

ফটিক তার চ্যালাদের নিয়ে বাঁশি—বেহালা আর ড্রামে গুরু গুরু শব্দ তুলে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক-এর মহলা দিচ্ছে। ক্লাবের থিয়েটারে লাইট দেয় পঞ্চা, সেও এসে হাজির হয়েছে একান্ন টাকা অ্যাডভান্স নিয়ে দু-তিনটি ফোকাসের মুখে লাল নীল বেগুনি কাগজ লাগিয়ে আলো ফেলছে।

আমি আর গোবরা এদিক সামলাচ্ছি। কাউন্টারেও বসতে হবে। হোঁৎকা বলে—তরাই দেখ। নগদ পয়সা হুঁশিয়ার; থাকবে গোবরার হাতে ক্যাশ।

সে বলে—ক্যাশে কিন্তু আর আশি নয়া পয়সা আছে। ইন্দ্রজাল বিশারদ পটলা বলে—তোরা কাওয়ার্ড। দেখবি আজ থেকেই পয়সা ছপ্পর ফুঁড়ে আসবে।

মেলা জমে উঠেছে এবার জোর। মাঠ-মন্দিরের চত্বর—রাসতলা, দিঘির ধার ছাড়িয়ে চলে বড় রাস্তা অবধি। আমাদের পটলকুমারের ইন্দ্রজালের তাঁবুটা পড়েছে সামনেই। লাল নীল ব্যানার-এ ওই সব বহু বিচিত্র খেলার ছবি, মাঝখানে পটলার রাজা বাদশার মত উষ্ণীষপরা ছবি দারুণ মানিয়েছে। পটলকুমার-এর অন্তর্ধান, ‘ভ্যানিশিং-পটল’ নাকি দারুণ খেলা !

এর মধ্যে ফটিক করতাল-হারমোনিয়াম-বাঁশি-বেহালা নিয়ে মাইকের সামনে সুরলহরী তুলছে। মাঝে মাঝে হোঁৎকা হেঁড়ে গলায় ঘোষণা করছে—মিশর এর পিরামিড থেকে যাদুবিদ্যা শিখে পটলকুমার আজ প্রথম অভিবাদন জানাইত্যাছেন দর্শকগো। আহেন—চক্ষু সার্থক করেন। পৃথিবীর নবম আশ্চর্য দ্যাখেন—শ্রীপটলকুমার-এর ইন্দ্রজাল। ফটিক এর পরই দুরু দুরু শব্দে ড্রাম বাজিয়ে চলেছে।

পটলকুমার এখন বেশ চালু হয়ে উঠেছে। স্টেজে পঞ্চা, ফোকাস ফিট করেছে, ফটিকও যন্ত্রপাতি নিয়ে বসেছে। হোঁৎকা ভূপেন উকিলের দুসাইজ বড় প্যান্ট আর ঢলঢলে কোট সঙ্গে কালো টাই বেঁধে পাকা সহকারী হয়ে গেছে।

লোকজন ঢুকছে তাঁবুতে। চেয়ার পিছনে সামনে তেরপল পেতে লোয়ার ক্লাস। গোবর্ধন ফটাফট্ টিকিট কাটছে, পয়সা নিচ্ছে। ওদিকে বসেছে ন্যাপলা। হোঁৎকা একফাঁকে এসে দেখে যায়।

বলছে–বিক্রি বাটা ক্যামন রে?

জানাই—লোয়ার ক্লাস ফুল, আপার ক্লাসও ফুল হয়ে যাবে ।

হোঁৎকা বলে—ভেরিগুড। তালি তিন শো ট্যাকা হইব ।

ওদিকে পাটকলের মজুর-রা ঢুকছে দল বেঁধে, কুলেপাড়ার রতে, নীলু–পিকুদের দলকেও দেখলাম টিকিট কেটেছে। ওরা পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের শত্রু, আমাদের ফাংশানে এসে পিক্‌ দেয়, গোলমাল করে। থিয়েটারে আওয়াজ দেয়। সে তো বিনাপয়সাতেই করে কিছুটা রেখে ঢেকে। এখন পয়সা দিয়ে ঢুকছে। কী হবে কে জানে। বলি হোঁৎকাকে— পটলা সব ম্যাজিক ট্যাজিক ঠিক ঠিক দেখাতে পারবে তো রে।

হোঁৎকাও এখন পটলকুমারের এক নম্বর চ্যালা। সেও নাকি এই ম্যাজিকের দলকে আরও বড় করবে। দেশবিদেশে ঘুরবে। তাছাড়া পয়লা শোতেই হাউসফুল হতে দেখে হোঁৎকার সাহস বেড়ে গেছে। বলে সে-পারবে না মানে? ওর নাম দেখস্ ফাইটা পড়বো ফার্স্ট শোর পরই । দশদিনে হক্কল শো হাউসফুল টানব। আর ‘ভ্যানিসিং পটলা’ আইটেম খান যা করছে—হক্কলই ভ্যানিস্ হইব। টিকিট বেইচ্যা যা, দরকার হয় বিশপঁচিশখান একস্ট্রা সিট দিয়া দিবি। কামাইয়া ল-

ঝিনি ঝিনি সুরে ফটিক কোম্পানির আবহ সঙ্গীত বাজছে। হাউসফুল। একস্ট্রা সিটও পড়েছে। এখনকার মত টিকিট বিক্রি বন্ধ। কাউন্টারের ফোকরের সামনে দু’এক রাউন্ড লড়াইও হয়ে গেছে মিশরের পিরামিড-এর মধ্যে শিখে আসা ম্যাজিক দেখার জন্য। লাইন পড়বে একটু পর থেকেই।

তাঁবুতে তখন পঞ্চার লাল নীল বেগুনি আলোর কেরামতি আর দপ করে লাল আলো জ্বলে ওঠে। মঞ্চে দেখা যায় রাজপুত্রের মত জরির ভাড়া করা যাত্রার দলের পোশাক পরা পটলকুমারকে, মাথায় তাজ-গলায় ঝুটো মুক্তোর মালা, হাতে কালো ছোট একটা লাঠি। চড় চড় শব্দে হাততালি পড়ে। পটলা মাথা নুইয়ে দর্শকদের অভিনন্দন জানায়।

তার প্রথম খেলা ‘ওয়াটার অব ইন্ডিয়া’– দিদিমার একটা পুরানো কমণ্ডলু। তার মধ্যে থেকে জলটা ফেলে দিয়ে ওপাশের একটা ঢাকা স্ট্যান্ড এর মধ্যে রেখেছে কমণ্ডলুটাকে। পটলকুমার মাথা খাটিয়ে সাইফন্ যোগে নীচে দিয়ে নল এনে কমণ্ডলুর মধ্যে সেই পাইপ রেখেছে যাতে জল জমতে পারে সবসময়।

তারপর ওর বাক্স থেকে রুমাল শাঁখআলু বের করার খেলা। হোঁকাও গালে রং মেখে কালো প্যান্ট কোট টাই পরে সাহেব সেজে সেই বাক্স এগিয়ে দিচ্ছে, পটলকুমার ইল্লিগিল্লি পো–বিজাতীয় ভাষায় চিৎকার করে ফড়ফড় করে রঙিন রুমাল বের করছে, দুচারটে শাঁখআলু বের করে ছুঁড়ে দিচ্ছে দর্শকদের মধ্যে। চড় চড় হাততালি পড়ে। খেলা জমে উঠেছে। এরপরই খোল থেকে বের করে পায়রা !

তারপরই ঘটনাটা ঘটে যায়, হোঁৎকা চিৎকার করে ওঠে দেশজ ভাষায়-ধর। ধর হালায় পটলা !

তার আগেই পায়রা দুটো স্যাৎ করে বাক্সয় পোরার আগেই উড়ে যায়, ডানা বাঁধা হয়নি ঠিকমত। এবার পায়রা বের করে তাক লাগাবার কথা। তার আগে পায়রাই উড়ে গেছে।

দর্শকরা হৈ চৈ করছে, তাঁবুর ভিতর হকচকিয়ে গিয়ে পায়রা দুটো বনবনিয়ে উড়ছে। সিটি বাজছে তারস্বরে। কে চিৎকার করে।

—এইবার ঘুঘু চরাবি পটলা !

কুলেপাড়ার পিতু তিনু মস্তানের দল আওয়াজ দিচ্ছে আর পায়রা দুটো ঘুরে ঘুরে উড়ছে। সারা তাঁবুর দর্শকরা পায়রা ওড়ানোই দেখছে সিটি বাজিয়ে।

শেষ অবধি কানাতের ফাঁক পেয়ে ওরা উড়ে বের হয়ে গেল আকাশে। পটলকুমার ঘামছে–হোঁৎকাকে যেন খুন করেই ফেলবে। তবু ভরাটি গলায় পটলকুমার যাদুকাঠি নেড়ে হাঁক দেয়-ওয়াটার অব ইন্ডিয়া।

কমণ্ডুলুটা তুলেই চমকে ওঠে। তাড়াতাড়িতে দিদিমার বাতিল ফুটো কমণ্ডলুটা নিয়ে এসেছে, পাইপের জল যা এসেছে ফুটো দিয়ে সোজা চৌকির নীচে পড়ে গেছে। কমণ্ডলু শূন্য। কে চিৎকার করে—ওয়াটার কইরে—খরায় সব ওয়াটার শুকিয়ে গেছে। এখন গর্জন করে ওঠে—পহা দিয়ে ম্যাজিক দেখতে ঢুকেছি, পেঁদিয়ে মেক্ ওয়াটার করিয়ে দেব।

চমকে উঠি। হৈচৈ দানা বাঁধছে। এ যাত্রা বাঁচিয়ে দিল ন্যাপলা। ইন্টারভ্যালে দু’একটা নাচ-এর ব্যবস্থাও রেখেছিল পটলকুমার। ন্যাপলা সাপুড়ে সেজে ফটিকের ঝমাঝম বাজনার তালে নাচতে নাচতে এসেছে। ন্যাপলা যাত্রার দলে নাচে, বেশ জমিয়ে দেয়। উত্তেজিত দর্শকদল তবু কিছুটা চুপ করে, তখন ন্যাপলার উপর লাল, নীল, বেগুনি আলোর বন্যা বইয়ে দিয়েছে লাইটম্যান।

ভিতরে গিয়ে দেখি পটলা আর হোঁৎকায় হাতাহাতি হবার জোগাড়। হোঁৎকা গর্জাচ্ছে—ফুটো কমণ্ডলু আনছস— পায়রাটারে বাঁধলাম, খুলছে কোন হালায়? তর ফুটানির বাজি দেখামু না—

ওকে থামাই—চুপ কর হোঁৎকা। ম্যানেজ হয়ে গেছে। এখন ভালো করে বাকি খেলা দেখা দারুণ হবে কিন্তু।

এরপর পটলকুমারের মানুষ দ্বিখণ্ডীকরণ খেলা, দুচারটে ছোট আইটেমের পর এই খেলা দেখায়, তারপর প্রধান এবং শেষ খেলা ভ্যানিশিং পটলা ।

ওদিকে পরের শোর টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। ফুটো কমণ্ডলুটাকে বদলে এনেছে গিরিধারী, সত্তুদের দুটো নতুন পায়রাও এসে গেছে আবার। এবার আর ভুল হবে না । ইন্টারভ্যালের পর দুতিনটে খেলা বেশ নির্বিবাদেই হয়ে গেল। এরপর সেই মানুষ কাটার খেলা ।

উত্তেজিত দর্শকদের অনেকে শান্ত হয়েছে, টেবিলে শুয়েছে নামো বস্তির রমু। তাকে দশটাকা দিতে হবে। তার কাজের মধ্যে শুয়ে চাদর চাপা দেবে, তারপরই টেবিলের ডালা খুলে নীচে চলে যাবে, করাতটা চালু হবার আগেই। আবার করাত বন্ধ হলে উপরে আসবে। করাত তাকে যাদু বলে কাটতে পারেনি।

রমু বলে—ভালো বিক্রি হয়েছে পঁচিশ টাকা দিতে হবে।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে—ক্যান দিমু। দশ দিছি—বেশি চাইলে এক্কেবারে করাত দিই ফাড়ি দিব হালায়।

রমুর ভয় হয়। টেবিলে শুইয়েছে তাকে, উপরে ধারালো কাঠকলের করাত, চক চক করছে। পটলকুমার লেকচার দিচ্ছে—রানিং স্। মানুষটাকে দ্বিখণ্ডিত করে দেব আমাদের সামনে—

হঠাৎ লাফ দিয়ে ওঠে রমু, বিকট শব্দে চিৎকার করছে। হোঁৎকাও টিপে ধরেছে তাকে। রমু চিৎকার করে—বাঁচাও। আমাকে এরা সত্যি সত্যি কেটে ফেলবে—বাঁচাও ওরে বাবা—বিকট চিৎকার আর ধস্তাধস্তিতে এবার কুলেপাড়ার পিনু-তিনু-পাটকলের মজুরের দল লাফ দিয়ে ওঠে। পায়রা উড়ে গেছে—জলও আনতে পারেনি—হোঁৎকা একবার চিৎপাত হয়ে পড়ে খেলা মাটি করেছে, তার উপর ওই খুন-খারাপির ব্যাপারে এবার বেশ কয়েকজন লাফ দিয়ে উঠেছে স্টেজে। নসুবাবু ডেকরেটার স্টেজ তেমন যুৎসই করেনি। ওদের লাফানিতে সবশুদ্ধ মড় মড় করে ভেঙে পড়েছে।

তারপরই শুরু হয়ে যায় কুরুক্ষেত্র কাণ্ড। কে চিৎকার করে।—ধর ব্যাটাদের। পটলকুমারের পটল তুলে দে।

কে খপ্ করে ধরেছে হোঁৎকাকেই, বেকায়দায় ভাঙা স্টেজের উপর পড়ে আছে হোঁৎকা, ধরে ফেলছে তাকে, ঢলঢলে প্যান্টটাই রয়ে গেল তার হাতে। হোঁৎকা প্যান্ট ফেলে আন্ডারওয়ার পরে সটকেছে, পটলাকে ওরা ধরেছে। ওর রাজপুত্রের ভাড়া করা জরির পোশাক ফর্দাফাঁই হয়ে গেছে, কপালটা কার ঘুসিতে ফুলে গেছে। ফটিক তার আগেই হারমোনিয়াম-ড্রাম নিয়ে দৌড়েছে।

গোবর্ধন হিসাবি ছেলে; তাঁবুর মধ্যের সংগ্রাম তখন বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে। ফড় ফড় করে ফাঁদছে তাঁবু, কানাত। কে পট করে খুঁটিই তুলেছে। চারিদিকে কলরব আর্তনাদ। দর্শকরা দৌড়াদৌড়ি করে বের হবার চেষ্টা করতে সারা তাঁবুই ফেড়ে ফেলেছে, বাঁশের খুঁটিগুলোয় চাপ পড়তে দু চারটে তাঁবুর ছাউনির তেরপল নিয়েই পড়ে যায় ।

গোবরা সুটকেশের ক্যাশ নিয়ে ওই ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে বলে।—ফুটে যা সমী।

তবু বলি—পটলা, হোঁৎকা ওরা কোথায়?

গোবরা বলে—সব ভ্যানিশ হয়ে গেছে। এই বেলা কেটে পড়। ধরতে পারলে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেবে ।

তখন দর্শকরা টিকিটের পয়সা উসুল করার জন্য বাঁশখুঁটি-চেয়ার—কেউ পটলার ওয়াটার অব ইন্ডিয়ার ফুটো কমণ্ডলু–কে হোঁৎকার পরনের ভূপেন উকিলের ঢলঢলে প্যান্টটা হাতিয়ে বেরুচ্ছে, তাঁবু ভেঙে পড়েছে, কে সুন্দর লাল শালুর ব্যানারটাই টেনে পাগড়ি করে নিয়ে গেল, যেন লুটপাট শুরু হয়েছে।

ততক্ষণে পটলা হাওয়া কেটেছে, হোঁৎকাও বেপাত্তা। শেষ অবধি পুলিশ এসে পড়ে। আমরা সকলেই তখন ‘ভ্যানিশ’ হয়ে গেছি।

এরপর কদিন ধরেই গা ঢাকা দিয়ে ফিরছি আমরা। আখতার খাঁ সাহেব জোব্বা লাঠি নিয়ে ক্লাবঘরের দরজায় দম্মাদম বাড়ি মেরে হুঙ্কার তোলে।

—হোঁৎকা কাঁহা বাগ্‌লো, মেরা রুপেয়া, ছুদ-সবকুচু উশুল কর লেগা যব্ পাকড়ে গা । নকুলের দোকান, লেকের ধারে—ক্লাবের মাঠ তন্নতন্ন করে খুঁজছে খাঁ সাহেব। ওদিকে ডেকরেটার নসবাবুও ঘুরছে আমাদের সন্ধানে বিরাট এক লিস্টি হাতে নিয়ে।

তার তেরপল—বাঁশ-চেয়ার—তক্তা-যা হারিয়েছে, তাও কম নয়। কুল্যে হাজার দুয়েক টাকা তো হবেই।

বাধ্য হয়েই রাসমেলা ছেড়ে পটলার মামারবাড়ির অজপাড়াগাঁয়ে এসেছি। হোঁৎকা গর্জায়—তর হিসাব পুরোপুরি ভুল আছিল পটলা। দুহাজার টাকা লাভ হইব? তারপর অষ্ট হাজার টাকা। এহন অষ্টরম্ভা দেহি চক্ষে। উঃ ফেরবারও পথ নাই রে। ইন্দ্রজাল যা দেখাইলি, হক্কলেরে ভ্যানিশ্ কইরা ছাড়লি ।

আপাতত অজ্ঞাতবাসে রয়েছি, কবে স্বস্থানে ফিরব জানি না। পটলার জন্যে আর কত দুর্ভোগ সইতে হবে কে জানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *