পটলার আইডিয়া
পটলার মাথায় আবার একটা আইডিয়া এসেছে।
অবশ্য এই আইডিয়াগুলো মাঝে মাঝে পটলার মাথায় ঠেলে ওঠে। বর্ষাকালে নরম মাটিতে গজানো ব্যাঙের ছাতার মত। কাঠে যেমন ঘুণপোকা লাগে—কুরে কুরে কাঠকে খায়, পটলার মাথাতে তেমনি আইডিয়ার ঘুণপোকা পার্মানেন্ট বাসা বেঁধে আছে। মাঝে মাঝে চাগিয়ে ওঠে আর তখনই পটলার কর্মযজ্ঞ শুরু হয়।
এই নিয়েই বাধে ঝামেলা। এসব ঝামেলার কথা পটলা প্রসঙ্গে তোমরাও কিছু কিছু জেনেছ।
এবার পটলা পড়েছে নিরক্ষরতা দূরীকরণ নিয়ে।
অবশ্য কিছুদিন আগেই পটলা সেদিন ক্লাবের মাঠে আমাদের ফুল কমিটিকে ন্যাপার দোকানের ডবল ডিমের ওমলেট, টোস্ট আর চা খাইয়ে মেজাজ খুশ করে জানায়,-বুঝলি, স-সমাজের জন্য বা কিছু স-সমাজসেবার কাজ করতে হবে।
হোঁৎকা তখন ওমলেটের শেষ পর্যায়ে এসে টোস্ট সহকারে চিবুচ্ছে। সে বলে—সমাজসেবার কাজ! হেটা তো হকলেই করত্যাছে। কাগজে দেখসনি? মিঠুন, তগোর সৌরভ থনে শুরু কইরা প্রসেনজিৎ-টিৎ হকলেই করত্যাছে। বন্যাত্রাণ, খরাত্রাণ, থ্যালা…কী কয় রে?—
আমি জানাই ‘থ্যালাসেমিয়া’।
—হঃ! আরো কত কী কাজকাম করত্যাছে।
পটলা বলে—ওরা তো করছেই। ক-করুক, আমরা পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব থনে নতুন কি-কিছু করব। স-সমাজের বুক থেকে নিরক্ষরতা দূর করব।
গোবর্ধন, অর্থাৎ আমাদের অন্যতম সভ্য গোবরার চেহারাটা বেশ গোলগাল। ওর মামার কলকাতায় হোলসেল কুমড়োর ব্যবসা। কুমড়োর গুদামে থেকে ওটারও কুমড়োর মত চেহারা হয়েছে। তিন বছর ধরে ক্লাস নাইনে গড়ান দিচ্ছে। এ হেন গোবর্ধন লেখাপড়ার কথা শুনে বলে,—ধ্যাৎ, তার চে মাঠে ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্প কর। এখন সৌরভের জোর বাজার, দেখবি কত দিদি-মাসিমার দল তাদের হ্যাংলা-প্যাংলা, টিকটিকির মত ছেলেদের নে আসবে মাঠে। মাসে দুশো টাকা রেট, ক্লাবেরও নাম কাটবে ।
ফটিক কালোয়াতি গানের চর্চা করে। ক্লাবের একটা দরমার বেড়ার ঘরে বসে হারমোনিয়াম নিয়ে ‘মেরে সঁইয়া’ নিয়ে ঘণ্টা দেড়েক চেল্লামেল্লি করে চলেছে, তা বছরখানেক ধরে। ওকে বলি,
—আর গান নাই রে! ওই একই গান, ‘মেরে সঁইয়া’?
ফটিক বলে—এ কি তোর আধুনিক গান, যে তিনখান গান তুলে পাড়ায় পাড়ায় ফাংশন করতে বেরুতে হবে? এসব তানসেনের ঘরানা—জন্মভোর সাধতে হয়।
তাই সে সেধেই চলেছে। ফটিক আরও বলে—তার চে সঙ্গীত শিক্ষার ক্লাস চালু কর। আমি তো আছি।
হোঁৎকা চা-টোস্ট শেষ করে, একটা ঢেকুর তুলে বলে-তার চে ক’পঞ্চপাণ্ডব কেলাব তুইলাই দিমু।
অবশ্য পটলাকে চটানো সম্ভব নয়। কারণ ক্লাব-মাঠ তাদের জায়গাতে। সে-ই আমাদের ক্লাবের কামধেনু। সে বলে—
—নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজ এর আগে এদিকে কোনো ক্লাবই করেনি। এক্কেবারে নতুন ব্যাপার। খ-খরচার জন্য ভাবিসনি। দেখবি, পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের নাম যা কাটবে!
অগত্যা রাজি হতে হল। হোঁৎকা বলে—কর, তয় আমার বিদ্যার বহর তো জানস, তায় মাস্টারি, শুনে লোকে হাসব।
গোবরা ক্লাসে গড়ান দিলে কী হবে, মাস্টার হবার লোভেই বলে, ঠিক আছে। হোঁৎকা বলে—তালি ওই নিরক্ষরই কর-
পটলা শুধরে দেয়—নি-নিরক্ষরতা দূ-দু-
পটলার জিভটা বিনা নোটিশে যখন-তখন আলটাকরায় সেট হয়ে যায়। আমিই পাদপূরণ করি—দূরীকরণ।
পটলা বলে—হ্যাঁ, তাহলে কা-কাজে লেগে পড়। কী করতে হবে বলছি, ঘটাও এসে যাবে।
পটলা ওদের বংশের একমাত্র বংশপ্রদীপ। বাবা-কাকাদের বিরাট ব্যবসা-কারখানা, এদিকের বহু জায়গা, বাড়ি, বাজার রয়েছে। পটলার টাকার অভাব নাই ।
এর মধ্যে ক্লাবের মাথায় নতুন সাইনবোর্ড উঠেছে—‘নিরক্ষরতা দূরীকরণ বিদ্যালয় পরিচালনায় পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব’। ক্লাবের বড় ঘরটায় এর মধ্যে বড় শতরঞ্চি বাড়তি লাইট ফিট করা হয়েছে। হোঁৎকা বলে পটলা, তার ইস্কুল বেশ ঘটা কইরা ওপন করতি হইবো । ফটিক বলে—সিওর! উদ্বোধন সঙ্গীত, সভাপতি…
হোঁৎকা বলে—পটলা, কিছু খরচা করতি হইবো–সভাপতি ঠিক করছি, ফাংশনও হইবে। পটলাও শ-পাঁচেক টাকা বের করে দেয়।
এর মধ্যে সারা এলাকায় কথাটা প্রচার হয়ে গেছে। নিরক্ষরতা দূরীকরণের ফেস্টুন পড়েছে। ফটিক, হোঁৎকা দু’জনেই মাঠে মুক্ত মঞ্চ করেছে। সভাপতি পাড়ার এম. এল. এ. কৃতান্তবাবু আর প্রধান অতিথি বাজারের মাছের বড় আড়ৎদার পুনুবাবু।
পুনুবাবুর চেহারাটা ভেটকি মাছের মত বেশ নধর, মাথাটা ছোট। মাঠের আড়তে বসে বসে ওর গায়ে মাছের আঁশটে গন্ধ। তবু সে নাকি স্কুলের ফান্ডে হাজার টাকা দিয়ে এই পদ লাভ করেছে। কোনো সদ্য গজিয়ে ওঠা কেবল টিভির লোকও ক্যামেরা নিয়ে এসেছে।
ফটিকের উদ্বোধনী সঙ্গীত। হোঁৎকা বলে আড়ালে—তিন মিনিট তর টাইম ফটকে। তারপর ব্যা ব্যা করছস তো, তরে এই আধলা ইট মারুম।
ফটিক বলে—তান-আলাপ….
হোঁৎকা গর্জে ওঠে—যা পারস ওই তিন মিনিটেই কর, নালি তরে বিলাপই করতি হইব। তারপর বক্তিতা, পাঁচুদার ভাষণ।
ফাংশন শুরু হবার আগে দেখি ছাত্রের দলও আসছে। ওসব হোঁৎকা-পটলা জোগাড় করেছে, গোবরাদের গুদামের গোটা দুয়েক প্রমাণ সাইজের তারকেশ্বরী কুমড়োও এসেছে। ত্যানারাও পড়বেন। দেখি, রূপকথা সিনেমার সামনের টিকিট ব্ল্যাক পার্টির দু-চারজনও আছে। ওরা সিনেমার সামনে নতুন নামতা পড়ে—পাঁচ কা দশ, দশ কা পরো। এখানে ওরা কী পড়বে জানি না। দেখি সিঁটকে মদনাকে, এলাকার কুখ্যাত সিঁধেল চোর। পাড়ার লোকের ঘটিবাটি, আলনার জামাকাপড় হরণ করে। সেও এসেছে পড়তে।
আর এসেছে বাজারপাড়ার বেশ কিছু মাল, যারা নিখুঁত ব্লেড চালিয়ে লোকজনের পকেট সাফ করে, ব্যাগও কাটে নিপুণভাবে। আর ওদিকে আগে থেকেই ছাত্রদের শতরঞ্চিতে বসে ঝিমুচ্ছে বংশীলাল। সে আবার জলপথের যাত্রী। দ্রব্যগুণে এখন ঝিমুচ্ছে। সেও অক্ষর জ্ঞান অর্জন করতে চায় ।
আমি বলি–এসব কী ছাত্র রে?
পটলা তখন সমাজসেবার নেশায় মশগুল। সে বলে-এদেরই প্রকৃত শি-শিক্ষার দরকার। মিটিঙে এলাকার মানুষ ভেঙে পড়ে। ফটিক তখন পুরো স্পিডে ‘সঁইয়া’র গান ফিনিশ করেছে। হাততালি পড়ছে। হোঁৎকা নিশ্চিন্ত ফটিক পাঁচ মিনিটেই ‘সইয়া’র গান সেরেছে।
তারপর পাঁচুদা, এখানকার জননেতা। পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব যে সমাজের নিরক্ষরতা দূর করতে নেমেছে তার জন্য তাদের দেবতাই বানিয়ে দেয় (সামনে ভোট, তাই এত আমড়াগাছি)। আর মাছের কারবারি পুনুবাবু, ইদানীং মাছের দর বেড়েছে, তাই খুশি হয়ে ছাত্রদের আশীর্বাদ করে। তারপর কাউন্সিলের ভুতোদাও সব ক্লাবকে পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের মহান আদর্শ অনুসরণ করতে বলে। তারাই প্রকৃত সমাজসেবা করছে। এরপর ওইসব মার্কামারা ছাত্রদের বলে, তোমরা মন দিয়ে পড়বে। বিদ্যালাভ করে নিজেদের ধন্য করবে।
সভা শেষ। এরপর ছাত্রদের নিয়ে পড়ি আমরা। বংশী উঠে পড়ে। বলি—কোথায় চললে ? বংশী বলে—পড়া তো হবে যত ঠ্যালার কাজ। ঠেক থেকে দু’ঢোক ঢেলে এসে ফিট হয়ে বসব মাইরি—বংশী দৌড়োল।
অন্য ছাত্ররা তখন বই-শ্লেট-পেন্সিল নিয়ে বসেছে মন দিয়ে।
পাড়ার লোকও অবাক হয় ওই ছাত্রদের দেখে। পটলার নিরক্ষরতা দূরীকরণ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ঠিকুজি কুষ্ঠী এলাকার সব মানুষেরই জানা।
ওদের মধ্যে ন্যাপাও এসেছে। তার ডান হাতের তালু নাই। কথিত আছে যে, বোমা বাঁধতে গিয়ে ওর হাতটাই উড়ে গেছিল। তবে এখনও সে বোমের ব্যবসা করে। বাঁ হাতেই উৎকৃষ্ট বোম বাঁধে।
এ হেন কৃতী ছাত্রদের বিদ্যাদানের সুযোগ পেয়ে আমরাও ধন্য হয়েছি।
পটলা বলে—এদেরই শি-শিক্ষার আলো দরকার।
হোঁৎকা তখন কোনো ছাত্রকে নিয়ে পড়েছে।
শ্লেটে দাগা বুলোচ্ছে অনেকে। ন্যাপা বাঁ হাতেই দাগা বুলোচ্ছে, বংশীও এর মধ্যে ফিট হয়ে ঢুকছে টলতে টলতে। হোঁৎকা গর্জে ওঠে ছাত্রের এ হেন ব্যবহারে। বলে—গেট আউট। বংশী বলে—তাহলে আজ ছুটি?
পটলা বলে-ওসব খেয়ে ইস্কুলে আসবে না। ওসব ছাড়ো বংশী।
বংশী বলে ওঠে—লাও ঠ্যালা। যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে মাস্টার। পড়তে হলে ওসব চলবে না?
পটলা বলে—না ।
বংশী বলে—তা’লে পড়ে আর কাজ নাই। ই বড় বাজে জিনিস।
পটলা ছাত্র হটাতে চায় না। বিদ্যাদান করবেই। তাই বলে-ওদিকে বই নিয়ে বসো । বংশী বসে পড়ে। অবশ্য চোখও খোলে না, বইও নেয় না। ঝিমুতে থাকে ।
নিরক্ষরতা কতদূর দূরীকরণ হচ্ছে তা জানি না, তবে আমাদের ইস্কুলে ছাত্রদের জমায়েত ঠিকই হয়। পাড়াতেও নাম কাটে—হ্যাঁ, কাজের কাজ করছে।
সেদিন পটলা স্কুলের পর চা-টোস্ট আনাতে দেবে আমাদের জন্য, পকেটে হাত দিয়েই হাতটা হঠাৎ সিধে বের হয়ে যায়। পকেট সাফ, মানিব্যাগে শ-চারেক টাকা ছিল, নাই ৷ পটলা চমকে ওঠে—আরে, কে পকেট সাফ করেছে? চা-চারশো টাকা !
হোঁৎকা বলে—কেউ গুরুদক্ষিণা দিছে তবে। হালা আর ছাত্র পাইলি না? ওগোরই কাম পটলা বলে—না, না, বাজারেই গেছে। ছেলেরা কেউ করেনি।
ক’দিন পরেই ফটিক সকালে ক্লাবে গলা সাধতে এসে দেখে হারমোনিয়ামটা নাই। বাক্সটা পড়ে আছে, মাল সাফ !
ফটিক আর্তনাদ করে—আমার হারমোনিয়াম কোথায় গেল ?
খবর পেয়ে গেলাম। পটলা-হোঁৎকাও এসেছে।
গোবরা বলে—ওই ছাত্রদেরই কাজ। সেদিন পটলার পকেট সাফ করেছে, আজ গেল হারমোনিয়াম। এটাও ওদেরই কারো কাজ। হোঁৎকা বলে—পটলা তর ছাত্রদের লই যা। নালি কুনদিন কেলাবই সাফ কইরা দিবো।
পটলা বলে—না, না, ওরা এসব কাজ আর করে না। শিক্ষার আলো পেলে ওরা বদলাবেই।
এর কিছুদিন পর পাড়ায় হইচই ওঠে, মোড়ের ইলেকট্রিকের দোকানে চুরি হয়েছে শাটার-এর তালা ভেঙে। টিভি, টেপ, ইস্ত্রি নানা কিছু চুরি গেছে। অনেক টাকার মাল । পুলিশও আসে সেখানে। দোকানদার বিভূতিবাবু কপাল চাপড়াচ্ছে।
খবর আসে, এর আগেও পাড়ার গোবিন্দবাবুর নীচের ঘর থেকে জামাকাপড়, রেডিও চুরি হয়েছে।
সাত নম্বরের হরিধনবাবুর বাড়িতেও চোর হানা দিয়েছিল। তবে বিশেষ কিছু নিতে পারেনি। হরিধনবাবুর মেজ ছেলে জেগে উঠে আলো জ্বালাতেই চোর দু’জন পাঁচিল টপকে গলির অন্ধকারে পালিয়েছিল। অবশ্য তার আগে ওরাই পাড়ার সব আলো নিভিয়ে অভিযানে এসেছিল।
নিশিকান্তবাবুও এবার গর্জে ওঠে পুলিশের সামনে—পাড়ায় চোর, পকেটমারের ডিপো হয়েছে মশায়। সেদিন এই গলিতে আমার পকেট কাটা গেল—আড়াইশো টাকা সাফ! কী হচ্ছে এখানে? আজ দোকানে ডাকাতি হয়ে গেল !
সমবেত জনতা এবার পুলিশকেই ধরে। পুলিশ অফিসার বলে—আমরা দেখছি।
পাড়ায় খোঁজ-খবর চলছে। অবশ্য, আমাদের নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজও চলছে। ছাত্রসংখ্যা দু-চারজন বেড়েছে, পটলাও খুশি।
সেদিন দোকানে চুরির খবর দেখেছি আমরা। হোঁৎকা ভাবনায় পড়েছে। গোবরাও বলে – মামার গুদামে আবার চুরি না হয় !
হোঁৎকা বলে—কী পাইব সেখানে? কুমড়া আর চালকুমড়া লইব কোন ব্যাটা? চুপ মাইরা থাক গোবরা।
গোবরা বলে—কুমড়োর কেজি এখন সাত টাকা। কম দাম?
পটলা বলে—ওসব ছাড়। এই সপ্তাহে ছাত্রদের পরীক্ষা নিতে হবে। কে কতটা শিখল জানা দরকার।
হোঁৎকা বলে—কিন্তু এদিকে পাড়ায় যা হইত্যাছে, ডিফেন্স পার্টি করনের লাগবো। তর ছাত্রদের নিই একখান ডিফেন্স পার্টি করুম ।
পটলা বলে—ওদের পড়াশোনায় ডিসটার্ব করিস না। মন দিয়ে পড়ছে, ওদের পড়তে দে। ক্লাবের ওদিকে একটা ঘরে পুরোনো বাতিল খবরের কাগজ, ভাঙা ক্যারাম বোর্ড, গোলপোস্টের জাল, দুর্গাপুজোর কাঠামো, হাবিজাবি জিনিসে ঠাসা থাকে। ওঘরে কেউ ঢোকে না। বন্ধই থাকে।
সেদিন পাড়ার দোকানে ডাকাতির পর পুলিশ এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে ক্লাবে এসেছে। ফটিকের হারমোনিয়াম নাই, একটা তানপুরা এনে ফটিক সেই ‘সঁইয়া’কে নিয়ে পড়েছে। ওদিকে গোবরা বারবেল করছে। পুলিশ দেখে চাইল তারা।
পুলিশ অফিসার এদিক-ওদিক দেখে, তারপর সেই বন্ধ ঘরটা দেখিয়ে বলে—এটা খোলো। ফটিক বলে,-দরজা ভেজানোই থাকে ঠেলুন, খুলে যাবে।
পুলিশ ঠেলতেই দরজা খুলে যায়। পুলিশ ভেতরে ঢুকে দেখে জালের তলায় কাঠামোর পিছনে রয়েছে কয়েকটা টিভি, টেপ। সেই দোকানদার বিভূতিবাবু বলে-এসব আমার দোকানেরই চুরি যাওয়া মাল। ফটিক অবাক, এখানে এসব কারা রেখে গেল? দরজা তো খোলাই থাকে।
এরপরই সেক্রেটারি হোঁৎকা আর প্রেসিডেন্ট পটলার খোঁজ পড়ে। আমরাও গেছি।
পটলার কাকাও গাড়ি নিয়ে এসে পড়েন। হইহই ব্যাপার। কুলেপাড়ার ক্লাব চিরকাল আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, তারা এতদিন আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে চুপ করে ছিল। এবার তারাই বলে—চুরির ইস্কুল করেছে এরা। তাই বলি, পাড়ায় হঠাৎ চুরি-চামারি, পকেটমারি বেড়ে গেল কেন ? বুঝুন এবার।
পুলিশ অফিসারও সব খবর রাখেন।
পটলার নিরক্ষরতা দূরীকরণের ক্লাসের ছাত্রদের নামগুলো দেখে এবার পুলিশ অফিসার বলে—এলাকার জুয়েলগুলোর অনেকের নামই দেখছি। ওগুলোকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওষুধ দিলেই সব খবর বের হবে।
পটলা বলে—আর কোনো দল ওদের বিপদে ফেলার জন্যই এসব এখানে রাখতে পারে। পুলিশ অফিসার এর মধ্যেই লোক পাঠিয়ে গোটা পাঁচেক ছাত্রকে ধরেছে। তাদের দু-চার ঘা দিতে তারা স্বীকার করে এ কাজ তাদেরই। সব মাল পাচার করতে পারেনি। এই বন্ধ ঘরে বাকিগুলো রেখেছিল পরে সময়মত নিয়ে যাবার জন্য।
চুরির কিনারা হতে এবার পুলিশ ছাত্রদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পটলার নিরক্ষরতা দূরীকরণ বিদ্যালয়ের সুনাম এই পর্যায়ে দাঁড়াবে, ভাবিনি। আমরাও হতাশ।
পুলিশ অফিসার বলে—শোনো পটলবাবু; এরা জীবনের ইস্কুলে এইসবই এত শিখেছে যে তোমার অক্ষর পরিচয়ের এইটুকু আলো এদের মনের শেডের অন্ধকার দূর করতে পারবে না । তোমরা বরং যারা ছোট, জীবনের এই শেডের অন্ধকার দেখেনি এখনো, তাদের মধ্যেই শিক্ষার কথা ভাবো। হয়তো তাতেই সত্যিকার কাজ হবে। কাঁচামাটির তাল নিয়ে ভালো কিছু গড়া যায়, এই পোড়ামাটি দিয়ে নয়।
সেদিন ওর কথাটা সত্যি মনে হয়েছিল। পটলাও বলে—এই ধেড়েদের নিয়ে আর নয়, রে, সারা এলাকার পথের ছেলেমেয়েদের নিয়েই ইস্কুল হবে।
এখন আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের ইস্কুল কচিকাঁচাদের কলরবেই মুখর হয়ে ওঠে। পাড়ায় আর চুরি-চামারিও হয় না। পাড়ার বহু মানুষও এখন আমাদের নিরক্ষরতা দূরীকরণের কাজে নানাভাবে সাহায্য করছেন।
পটলা বলে—কী রে, ইস্কুল কেমন চলছে? আমার আইডিয়া কেমন, বল ?
হোঁৎকা বলে—ভালোই। তয় অগোর সাথে বকাঝকা কইরা গলা শুকাই গেছে গিয়া । চা-টোস্ট আনতি কইয়া দে। হঃ, সাথে ওমলেটও দিতি ক, ডবল ডিমের ওমলেট।