পটলার অগ্নিপরীক্ষা
টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বের হতে দেখি আমাদের পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের মেম্বারদের অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে কাঁপ ছটকানো ঘুড়ির মতই।
চাঁদিয়াল –একতো, লক্কা ঘুড়িগুলো যখন আকাশে ওড়ে তখন দেখতে দারুণ লাগে, আর মুক্ত উদার নীল আকাশে তারা খুশিতে ফরফর করে ওঠানামা করে, হেলেদুলে যেন আকাশে রাজত্বি করে ।
আর যখন এক একটা উড়ন্ত ঘুড়িকে কেটে নীল আকাশে ভাসিয়ে দেয় তখন তাদের মেজাজই আলাদা, বাজপাখির মত রাজকীয় ভাব ফুটে ওঠে ওদের উডুক্কু মেজাজে। আমরা পঞ্চ ক্লাবের সভ্যরাও কিছুটা তেমনি মেজাজ নিয়েই কুলেপাড়ার মধ্যগগনে বিরাজ করছিলাম।
আজ কালচারাল ফাংশা, কাল এ পুজো, সে পুজো, ফুটবল মরশুমে তো আমাদের অবস্থা এই অঞ্চলে খুদে ‘পেলে’র মতই। কেউ পেলে, কেউ গারিঞ্চা, কেউ ইউসিবিয়ো ইত্যাদি। পাড়ার সকলেই চিনত, আর পটলার দৌলতে অনিল কেবিনের ‘ডিম’ এর বংশনাশ করতাম । তারপর খরাত্রাণ, বন্যাত্রাণ এসব ত্রাণ টান-এর কার্যেও আমরাই ছিলাম অগ্রণী।
সেবার কদিনের বর্ষায় কুলেপাড়ার নামো বস্তি, তিন নম্বর বস্তি ডুবুডুবু হয়েছিল জমা জলে, খাটাপায়খানার গামলাগুলো বের হয়ে ভাসতে ভাসতে চলেছে, ঘরেও জল ঢুকছে অনেকের। এ হেন আপদকালে আমাদের সেক্রেটারি হোঁৎকাই এগিয়ে এল আমাদের নিয়ে।
আমরাই ওদের তুলে নিয়ে গিয়ে তাবত ইস্কুল ঘরে, মায় পটলাদের একটা গুদামে আশ্রয় দিয়েছিলাম। কাগজেও আমাদের উদ্ধারকার্যের ছবি বের করে দিয়েছিল এ পাড়ার ভটুক দা। ও কোন কাগজের অনাহারী (সঠিক কথাটা নাকি অনারারি) সংবাদদাতা। আমরা ওই পরিচয়েই জানতাম ওকে। তিনিই কাগজে খবরটা প্রকাশ করেছিলেন।
সব মিলিয়ে আমরা ছিলাম কুলেপাড়ার মুক্তাকাশে বিচরণশীল চাঁদিয়াল ঘুড়ির মতই স্বাধীন।
কিন্তু এত দিয়েও স্কুলের ইংরেজিস্যার নবনীবাবু, অঙ্কের গোবিন্দ স্যার মায় সংস্কৃতের হেডপণ্ডিত ভবানী স্যারকেও কায়দা করতে পারলাম না। হোঁৎকা আবার বাংলাতেও ফেল করেছে। গুপিস্যার তো বলেন- তুই বঙ্গসন্তান না কি রে?
অর্থাৎ জন্মবৃতান্ত তুলেও শুনতে হয়েছে।
হোঁৎকা কুল্যে চার বিষয়ে, পটলা ইংরাজিতে, ফটিক কুল্যে তিন সাবজেক্টে লটকেছে। আমিই কোনো রকমে বেদাগ অবস্থায় বের হয়েছি।
হোঁৎকা কটাই কর্মকারের দোকানে হাপরের মত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে— তহনই কইছিলাম আমার হইব না। কাকার কারখানাতেই কাম করুম। তরা শুনলি না। কইলি পড়। পইড়া কিছু হইব না। কৰ্মই ধৰ্ম ।
হোঁৎকা মাঝে মাঝে দার্শনিক হয়ে ওঠে, তখন অমনি বেশ দামি দামি কথা বলে। ফটিক এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। ক্লাবে সন্ধ্যার পর যেন শোকসভা বসেছে ওদের। কেবল ফুলমালা ধূপটুপই নেই। নাহলে তেমনি শোকস্তব্ধ পরিবেশ গড়ে উঠেছে।
ফটিক বলে—ইস্কুলে পড়া টড়ার চেয়ে সঙ্গীতবিদ্যাই বড় রে। ভাবছি মন প্রাণ দিয়ে এবার সঙ্গীতসেবাই করবো।
হোঁতকা বলে— কচু হইব এতে! অ্যাদ্দিন তো বমিই করছিলি, কী হইছে?
ফটিক আর্তনাদ করে ওঠে।
—ফুট কাটবি না হোঁৎকা, রক্তগঙ্গা বইয়ে দোব।
সুইসাইড করব।
আমি ঘাবড়ে যাই। ওদের মধ্যে আমিই ভালোভাবে পাস করে ওদের কাছে দোষী হয়েছি। তাই চুপ করেই ছিলাম। এবার রক্তটক্তের কথা, সুইসাইডের কথা শুনে ঘাবড়ে যাই। বলি, -আবার ওসব কেন, এখনও সময় আছে। পড়াশোনা কর।
আমার উপদেশ ওদের আশ্বস্ত করতে পারে না। হঠাৎ গোবরাকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে চাইলাম। ওর বাহন একটা ধ্যাড়ধেড়ে সাইকেল। ওটা নাকি ও উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে।
ইতিপূর্বে ওর বাবা সেদিনে ওটায় চড়ে সারা কলকাতা উত্তর দক্ষিণ-চব্বিশ পরগনার তাবত মেছো ভেড়ি পরিভ্রমণ করত। তার বয়স হতে তস্য ভ্রাতা ওটায় চড়ে বারাসাত অবধি তাগাদায় বের হত, তিনি গত হতে তাঁর কোনো যোগ্য ওয়ারিশন না থাকায় ওটা গোবরার দখলে এসেছে।
ততদিনে স্রেফ ফ্রেমখানা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বাকিটা গোবুরা লাগিয়ে এখন চালু করেছে। ওতে সে তাবত বেলেঘাটা কুলেপাড়া চষে বেড়ায়। অবশ্য ব্রেকগুলো আর লাগিয়ে বাজে খর্চা করেনি, ওর কাজ ঠ্যাং দিয়েই করে থাকে। আর বেলটেল লাগাবার দরকারও বোধ করেনি।
কারণ সাইকেলটা চললে যে রকম ঢং ঢং কড় কড় শব্দ ওঠে ওতেই বেলের কাজ হয়ে যায়। লোকজন আগেই ওর সাইকেলের শব্দ পেয়ে যায় ।
গোবরা এ যেন সাইকেলে চড়েই একটা পা দাওয়ায় ঠেকিয়ে গতিবেগ সামলে বলে। —সব্বোনাশ হয়ে গেছে র্যা।
হোঁৎকা উদাস নয়নে চাইল ওর দিকে। এর চেয়ে আর কী সর্বনাশ হতে পারে জানা ছিল না। ফটিক বলে।
—আর হতে কী বাকি আছে বল? বাবা তো চুলের মুঠি ধরে গর্জাচ্ছেন খুন করেঙ্গা । তাই ভাবছি অন্যের হাতে এ জীবন বিকিয়ে দেবার আগে নিজে হাতেই এটাকে শেষ করবো।উঃ—
গোবরা বলে—তাই করতে হবে এবার। ওদিকে ইস্কুলে তো ধেড়িয়েছিস, এবার কেলাবও তুলে দিতে হবে। কী নিয়ে থাকবি?
চাইলাম ওর দিকে। গোবরা তখনও ওর কথা শেষ করার চেষ্টা না করেই মোক্ষম ঘাটা দেয়। বলে সে।
—পটলাকে ওর কাকাবাবু ওর রাঙা পিসেমশাই না কে এক জাঁদরেল হেডমাস্টার আছেন কোন ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে সেখানেই চালান করছে। তিনমাস ওখানে তাঁর হেপাজতে রেখে একেবারে ফাইনালের মুখে আনবে।
চমকে উঠি সকলেই। পটলা আমাদের মধ্যমণি, কামধেনু, প্রতিপালক। ওদের অবস্থাও ভালো। ওর ঠাকুমার বিরাট সম্পত্তি, কারখানার ও-ই ভবিষ্যৎ ওয়ারিশান। ওর টাকাতেই ক্লাবের এত নামডাক, আমাদের এত গুডউইল অর্থাৎ সুনাম টুনাম। অনিল কেবিনের টোস্ট ওমলেটের বিল ও দেয়, গোকুলের কুলপিমালাই-এর দেনা ও শোধ করে, ভজুয়া ঝালমুড়িওয়ালা, এতোয়ারি ফুচকাওয়ালাদের দেনাও শোধ করে। ওদের অনেক বিল বাকি।
ক্লাব ব্যাডমিন্টন পড়েছে, তার খরচাও আছে। সর্বোপরি পটলার এই নির্বাসনের কথায় চমকে উঠি আমাদের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে। সূর্যহারা দিন হতে পারে, কিন্তু পটলাহারা পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের কথা ভাবাই যায় না।
হোঁৎকা চমকে ওঠে— কি কইলি? পটলা তো শুধু ইংরাজিতে কম নাম্বার পাইছে। তয় ওরে তাড়াইবো ক্যান? কলকাতায় থাইকা ইংরাজিতে পাকা হইতে পারবো না পটলা, ওরে ওই ধাপধাড়া গোবিন্দপুরের অজগাঁয়ে যাইবার লাগবো ইংরাজি শিক্ষকের জন্যে?
ফটিক বলে—
একে একে নিভিছে দেউটি!
স্বর্ণলঙ্কা ডুবিছে আঁধারে।
হোৎকা গর্জে ওঠে– নাটক ফাটক রাখ। এহন কী হইব ভাব। হালায় ওগোর ট্যাকা কে দেবে? তহন তো ওমলেট, কুলপি-ঝালমুড়ি ভরপেট খাইছস?
কাদের কথা ভেবে ফটিক বলে।
—ক্লাবে আমি রেজিকনেশন দেব। পদত্যাগ করবো— হোঁৎকা ফুঁসে ওঠে। —কইরা দ্যাখ? তর পদ দুইখানা খুইলা নিমু। টেংরি টুকরো কইরা দিমু।
হাতাহাতি বেধে যাবার উপক্রম। থামাই ওদের। —কী হচ্ছে তোদের! পটলার সঙ্গে কাল সকালেই দেখা করে ব্যাপারটা কি জানতে হবে।
হোঁৎকা বলে— তুই যা গিয়া। আমাগোর দেখলে ওর ছোটকাকা গুলি কইরা দিবে। তুই ‘গুড বয়’ তরে কিছু কইব না। তুই ম্যানেজ কর।
পরদিন সকালে পটলাদের বাড়ি যেতে দেখি ওর ছোটকাকাই এগিয়ে আসেন। ওদের বাড়িটাও বিরাট। পেছনে বেশ খানিকটা বাগান মত, আগেকার আমলের বাড়ি। বাগান পুকুরও রয়েছে। এদিকে তিনতলা বাড়িটায় ওরা থাকে।
দারোয়ান, মালি, চাকর বাকরের অভাব নেই। ওদিকে দুখানা গাড়ি ধোয়ামোছা হচ্ছে। সামনে বৈঠকখানা, ওপাশে পটলার ঘর।
পটলার ছোটাকাকা ওদের কারখানা দেখাশোনা করেন। সবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন তিনি ৷
ছোটাকাকাও আমাকে চেনেন। বলেন ।
—টেস্টে তো সেকেন্ড হয়েছো। না ।
ঘাড় নাড়ালাম । তিনি বলেন।
—ভালোভাবে পাস করতে হবে। নাহলে মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং এনট্রান্স কোন পরীক্ষাতেই বসতে পারবে না।
পরক্ষণেই বলেন তিনি ।
—পটলা ইংরাজিতে এত কাঁচা তা ভাবিনি। এখানে পড়াশোনা ঠিক মত হবে না। তাই ওকে বাইরেই পাঠাচ্ছি। কিছুদিন নিরিবিলিতে গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করুক। কি বলো? আমার কাছেই যেন পরামর্শ চাইছেন। অগত্যা আমি জানাই। —তা ভালোই হবে। ছোটকা খুশি হয়ে বলেন—গুড! পটলা আজই চলে যাচ্ছে। দেখা করবে তো, ওর ঘরে যাও। ওকেও বুঝিয়ে বলো ও যেন শায়েস্তাগঞ্জে গিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা করে।
জায়গাটার নামও জানা গেল। শায়েস্তাগঞ্জ? কিন্তু অবস্থান জানা যায় না, আর ম্যাপে ও বোধহয় ওসব জায়গার কোন নামধাম নেই ।
পটলার ঘরে গিয়ে দেখি ওর বইপত্র সব বাক্সবন্দি হয়ে গেছে, সুটকেশ জামা-কাপড়ও পোরা হয়েছে, পটলাই শুধু বাইরে রয়ে গেছে। উদাস বেদনার্ত চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে বলে পটলা ।
-আমারে শাস্তি দেবার জন্যে শ্-শ্ শায়েস্তা —গ।
পটলার ব্রেক ফেল করেছে। বিশেষ করে উত্তেজনার মুহূর্তে ওর জিবটা আলটাকরায়, আটকে যায়, অনেক কষ্টে আর সেটাকে মুক্ত করে বাকি কথাটা শেষ করতে হয় পটলাকে । আজ নিদারুণ দুঃখে ওর ব্রেক ফেল করেছে। আমিই বলি সান্ত্বনার সুরে—তিন মাস তো, দেখতে দেখতে কেটে যাবে রে শায়েস্তাগঞ্জে।
পটলা বলে-রাঙা পিসেমশাইকে চিনিস না। ড-ড- ডেঞ্জারাস হেডমাস্টার।
হেডমাস্টারদের কিছুটা চিনি। গুরুগম্ভীর টাইপের মুখ। হাসির ছিটেফোঁটা নেই। বুলডগ মার্কা চেহারা। অমনি কোন লোকের সঙ্গে একদিন বাস করলেই হাত ছেড়ে যাবে, পটলাকে তিন মাস কাটাতে হবে সেখানে। পটলাকে এর চেয়ে ওদের সুন্দরবনের কাঠের গোলাতে পাঠালেও ভালো করত। ওখানে বাঘটাঘ আছে, কিন্তু ওর পিসেমশাই তো সিংহবিশেষ।
পটলা হতাশ কণ্ঠে বলে— আর -বেঁচে ফিরে আসব না রে। একটা শোকসভা করিস যদি কিছু হয়ে যায়।
আমার চোখও জলে ভরে আসে। শুধোই, –তো ঠাকুমা মত দিল যেতে ?
পটলা বলে—ওর মেয়ের কাছে যাচ্ছি-উনি তো এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলো বুড়িও বিশ্বাসঘাতক কনস্পিরেটার নাম্বার ওয়ান। ষড়যন্ত্রকারী।
ছোটকাকার ডাকে চাইলাম। ছোটকাকা বলেন—চল পটলা। তোকে পৌঁছে দিয়ে আবার কাজে বেরুতে হবে। দশটায় ট্রেন, হরিপাল স্টেশনে লোক থাকবে, ওখান থেকে বাসে টেম্পোতে গিয়ে মাইলখানেক হাঁটতে হবে নবীগঞ্জ থেকে। কাছেই শায়েস্তাগঞ্জ। সব বলা আছে, চল। ও ঠিক পৌঁছে যাবি।
পটলার বই-এর পুঁটলি, সুটকেশ সব তুলে শেষমেষে পটলাকে তুলে ছোটকাকা বের হয়ে গেলেন। পটলার বাবা মা মায় ঠাকুমা অবধি এহেন করুণ দৃশ্যটা বেশ উৎসাহ ভরে দেখলেন।
আমি ছলছল চোখে পটলাকে বাঘ সিংঘের রাজত্বে নির্বাসন দিয়ে বের হয়ে এলাম ।
ক্লাবের জামতলায় হোঁৎকা – ফটিক– গোবরা আরও দু-একজন নতুন সভ্য বসে আছে হা পিত্যেশ করে। এর মধ্যে অনিল কেবিনের মালিকও পটলার নির্বাসনের খবর পেয়ে তার বাকি টাকার জন্যে এসে ধরেছে হোঁৎকাকেই।—তুমিই সেক্রেটারি, ক্লাবের টিফিনের টাকা তোমাকেই দিতে হবে ।
হোঁৎকা বলে –আমি পদত্যাগ কইরাছি। এখন প্রেসিডেন্টের কাছে যাও গিয়া ।
অর্থাৎ পটলাকেই ‘রেফার’ করছে সে। অনিল বলে –ওসব বুঝি না। তোমাকেই দিতে হবে। পরে আসব।
ফুচকাওয়ালা নোটিশ দিয়েছে। সাতরুপেয়া উধার হ্যায়। দেনে পাড়েগি।
ওরা ছটফট করছে এমন সময় আমাকে আসতে দেখে ওরা লাফ দিয়ে এসে একযোগে শুধোয়।
—কিছু হইল ? পটলারে আটকাইছিস?
ফটিক শুধোয়-থামরে তো র্যা?
জানাই—না। পটলকে একটু আগেই ওর ছোটকা গাড়িতে তুলে পাচার করে দিল শায়েস্তাগঞ্জে।
অস্ফুট আর্তনাদ ওঠে-এ্যাঁ! পটলা নাই?
বলি— পটলা আছে। তবে কদ্দিন বেঁচে থাকবে তা জানি না রে! ও বলে গেল, যদি তেমন কিছু হয় ওর ফোটোতে মালাটালা দিয়ে শোকসভা করবি।
হোঁৎকা গর্জে ওঠে— হক্কলের শোকসভাই করনের লাগবো। তার আগে ঝাঁপে লাঠি দেই কেলাব বন্ধ কইরা দে।
ফটিক করুণসুরে গেয়ে ওঠে— বাবুল মেরে নৈহার ছুটকে যায়।
হোঁৎকা বলে—চুপ মাইরা থাক্ ফটকে। নয়তো তবে মার্ডার করুম।
পটলা হরিপাল স্টেশনে নামতে একটি ছেলে এগিয়ে আসে। লোকজন-যাত্রীরা বের হচ্ছে। বেলা তখন দুপুর, মনমেজাজ ভালো নেই পটলার।
ছেলেটি নৃত্য করতে করতে আসছে। একটা পা যেন ছোট। বলে সে পটলাকে— তুমিই সুভাষচন্দ্র। না?
পটলার ওইটাই পোশাকি নাম। পটলা মাঝে মাঝে ওই নামও ভুলে যায়। আজও হকচকিয়ে চাইল ওর দিকে। ছেলেটি নৃত্যছন্দে একপায়ে ভর দিয়ে দেহটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলে। —কলকাতা থেকে আসছ শায়েস্তাগঞ্জে যাবে নৃসিংহবাবুর বাড়ি?
পটলার পিসেমশাই এর নামধামই ওসব। আর পটলারও এবার মনে পড়ে তার নামটা । বলে সে—হ্যাঁ!
ছেলেটি বলে-আমার নাম পরান। হেডস্যার আমাকে আর বোঁচাকে পাঠিয়েছেন তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য। কইরে–
বোঁচাও এসে পড়ে। বেশ ভরাটি গড়ন— তবে নাকটা কে যেন ওর কিলিয়ে ফাটিয়ে দিয়েছে। তাই বোধহয় বোঁচা নামই হয়ে গেছে তার।
ওরা দুজনে ওর বই-এর পুঁটলি –সুটকেশ নিয়ে নেচে নেচে চলেছে বাস এর দিকে। স্টেশনের বাইরেই একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাস না জনসমষ্টি একটা জমাট পুঞ্জ ঠিক বোঝা যায় না। ভিতরেও ঠাস বোঝাই, বাইরে বনেটে, সর্বাঙ্গে— পা দানিতে লোক ঝুলছে। আর কনডাকটার তখনও চিৎকার করছে।
খালি গাড়ি। নবীগঞ্জ কুসুমপুর তেড়েকোনা পচাখাল বোধহয় তারপর ও নরকপুরেও যাবে।
পটলা বলে—কোথায় উঠব?
ততক্ষণে পরান সেই ঘোড়া নৃত্য ঘোড়া বিশারদ এক পায়েই তর-তরিয়ে ছাদে উঠে গেছে, সেখানে সুটকেশ জমা করে বলে।
—উঠে পড়ো। জায়গা রেখেছি। পটল ইতিউতি করছে। বাসের ছাদে চড়ে ভ্রমণ ইতিপূর্বে সে করেনি, কিন্তু বোঁচা ততক্ষণে ওর পিছনে ঠেলে ওকে তুলে দিয়েছে গাড়ির মাথায় । নিজেও উঠেছে।
বোঁচা বলে—বাতা ধরে টাইট হয়ে বসে থাকো। নড়ো না। এ বাস ছাড়লে আজ আর বাস নেই। কাল মিলবে। এতেই যেতে হবে।
পটলা চোখ বুজে প্রাণপণে সেই লোহার ছোট্ট রেলিং ধরে বসে আছে। বাস চলেছে —আর রাস্তাও তেমনি। খানাখন্দে ভরা। বাসটা লাফাচ্ছে ঝাঁপাচ্ছে। মনে হয় এখুনি খাদে নেমে পড়বে।
পটলা ঘামছে, মনে হয় শায়েস্তাগঞ্জে আর এ জীবনে পৌঁছতে হবে না, তার আগেই সে ছিটকে পড়বে। হাড় গোড় চূর্ণ হয়ে শেষ হবে। অবশ্য হাড় গোড় এর মধ্যে আলগা হয়ে গেছে প্রায়।
এক একটা ঝাঁকানি দেয় বাসও আর নড়বড় করছে দেহটা। ওদিকে কে ওয়াক্ তুলে বমি করছে। ছাদ থেকে তরল বমিটা নীচের যাত্রীদের গা জামা ভিজিয়ে পড়ছে। কলরব উঠে।
কে কার কথা শোনে। বাস ছুটে চলেছে বিকট শব্দে। পটলার মনে হয় এ জীবনে আর কোনদিন কলকাতা ফিরতে পারবে না! বিদায় কলকাতা, বিদায় কুলেপাড়া, বিদায় পঞ্চপাণ্ডব ক্লাব ।
এখন বোধহয় ওরা আমতলায় আড্ডা দিচ্ছে। আর পটলা চলেছে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে কোন দূরে ।
কতক্ষণ চলেছে এভাবে জানে না পটলা। দু একবার পথে বাস থেমেছে, যত না যাত্রী উঠেছে নেমেছে তার থেকে বেশি।
একটা ছোট গঞ্জমত জায়গায় বাস থামতে বোঁচা লাফিয়ে নেমে পড়ে পটলার সুটকেশ, বই-এর পুঁটলি নামিয়ে বলে, নেমে এসো সুভাষ। নবীগঞ্জ এসে গেছি।
পটলা কোনমতে এর তার ঠেলায় ছাদ থেকে পাকা আমের মত পড়েছে, দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই। হাঁটু দুটো যেন ‘লুজ হয়ে গেছে। ফলে ধপাস্ করে মাটিতেই পড়েছে।
বোঁচা বলে—প্রথম প্রথম এ লাইনের বাসে উঠলে এমন হয়। দু-এক বার যাতায়াত করলে ‘সেট’ হয়ে যাবে। পা হাত নাড়া, দেখবে আবার লুজ হাড়গোড় ফিট’ হয়ে যাবে।
পটলা কোনমতে উঠে দাঁড়াল। হাতে পায়ের খিলটা এবার ঠিক হচ্ছে।
ল্যাংচা পরান বলে—মাইলটাক পথ, রিক্সা করে গেলে হেডস্যার রেগে যাবে। হেঁটেই চলো। উনি আবার ‘সেলফ্ হেলফটা বেশি পছন্দ করেন।
নাক বসা বোঁচা নাকি সুরে বলে—বাড়ির কাছে গে সুভাষ তোমার সুটকেশ পুঁটুলি তুমি নিজে বইবে। নাহলে উনি রেগে গিয়ে অনথ বাধাবেন। আমার নাকে সেবার কিল মেরে নাকই ফাটিয়ে দিলেন ।
ল্যাংচা পরান বলে ক্লাসে ইংরেজি ট্রানস্লেশন্ পারিনি, লাঠির ঘায়ে হাঁটুর মালাই চাকি ভেঙে দিয়েছিলেন—সিংহ স্যার।
পটলা চমকে ওঠে তার রাঙা পিসেমশাই-এর এ হেন পরিচয় পেয়ে। এর পা ভেঙেছে, ওর নাক ফাটিয়েছে, কার হাত ভেঙেছে, কার কি করেছে। এবার পটলার কি হবে কে জানে । পটলা মিনমিন করে বলে। তোমাদের দাগি করেছেন তাহলে ?
বোঁচা বলে—দেখবে শায়েস্তাগঞ্জে কত ছেলের হাত পা মচকানো — কপাল ফাটা, সব ক্লাসের ফার্স্ট সেকেণ্ড বয়রাই দাগি। তা তুমি তো এবার ফাইনাল দেবেনা?
পটলা বলে—দেখি পরীক্ষা দেবার মত অবস্থা থাকে কিনা। হাঁটছে তো হাঁটছেই। পাড়াগ্রামের মাইল যেন ফুরোতে চায় না। ধু ধু মাঠ। বেলা দুপুর গড়িয়ে গেছে। ক্ষিধে তেষ্টাও পেয়েছে। আর গা হাত পা তখনও টন টন করছে। পটলা শুধোয়—আর কতদূর? শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছতে পারবো তো?
বোঁচা বলে— ওই তো এসে গেছি। সামনেই ।
সামনে দূর দিগন্তে একটা গ্রামের রেখা দেখা যায় মাত্র। ওরা চলেছে ধূলি ধূসর কাঁচা সড়ক ধরে।
কাছাকাছি আসতে বোঁচা— পরান ওদের হাত থেকে সুটকেশ বই, বই-এর পুঁটুলি যুগপৎ পটলার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে বলে—
এবার সিধে চলে যাও। ওই যে স্কুল ওর লাগোয়া ওঁর বাড়ি। উনি আবার সেলফ্ হেলপ্ খুব পছন্দ করেন। তোমার সুটকেশ পুঁটুলি আমাদের হাতে দেখলে আবার নাক ফাটিয়ে দেবেন কি না কে জানে। গো অন্।
পটলার কোমর যেন ভেঙে পড়বে ওই পুস্তক ভর্তি সুটকেশের ভারে। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। খিদেতে পেট জ্বলছে। চোখে যেন সরষের ফুল দেখছে ওই ‘সেলফ হেলপ’ এর ঠ্যালায়। এমন জানলে এখানে কদাপি-ও আসত না।
কিন্তু আর ফেরার পথ নেই। দুপুরের স্তব্ধতা নেমেছে চারদিকে। স্কুলটা ওদিকে—কিছু বট আম পেয়ারা গাছও রয়েছে। পটলা ওই মোট পুঁটুলি নিয়ে টলতে টলতে মুটের মত আসছে। হঠাৎ বিকটা গর্জন শুনে চমকে ওঠে। যেন একটা বাঘ গজরাচ্ছে। গাঁ—গাঁ—গোঁ-গরর-
পটলা চমকে উঠেছে কে জানে বাঁশবনে বাঘই বের হয়েছে বোধহয়, কারণ এর আগে গুপি গায়েন বাঘা বায়েন ছবিতে এমনি বাঁশবনে বাঘ দেখেছে সে।
গাঁ-গরর-
পটলা আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে—ওরে বাবারে।
মাথার সুটকেশ বইপত্তর ছিটকে পড়েছে, পটলা বনবাদাড় ভেদ করে দৌড়তে গিয়ে হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়েছে, কপালটা কেটে রক্ত ঝরছে, হঠাৎ কাকে ওদিকের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে দেখে চাইল। পিসিমা পটলের পথ চেয়েছিল। কিন্তু তখনও আসেনি। এ বাড়ির কর্তা সিংহমশায় অবশ্য ঘড়ি ধরে চলেন। তাঁর খাওয়া হয়ে যায় বারোটার সময়। স্কুলে সকালে যান, স্কুল শুরু করিয়ে ওই সময় এসে খেয়ে এক পিরিয়ড গভীর নিদ্রা দিয়ে উঠে আবার স্কুলে যান। থাকেন সন্ধ্যা অবধি ।
পটলের পিসিমা ওকে খাইয়ে নিদ্রার ব্যবস্থা করে ঘরের কাজ করছিল হঠাৎ ওই বিকট চিৎকার শুনে বাইরে এসে পটলাকে ওই অবস্থায় দেখে চমকে ওঠে।
—তুই! পটল! একী ব্যাপার? এত মালপত্র নিয়ে তুই—পটল এবার পিসিমাকে দেখে কিছুটা ভরসা পেয়ে বলে ‘সেলফ হেলপ্’ করছিলাম। মানে নিজের জিনিস নিজেই আনছিলাম তা ওই—
ফের সেই বুক কাঁপানো গর্জন শুনে পটলা ভীতচকিত চাহনি মেলে চাইল। পিসিমা বুঝতে পেরে বলে।
-ওমা। তোর পিসেমশাই নাক ডাকছে রে।
—এ্যা! তাই নাকি। পটলা এবার চমকে ওঠে। পিসিমা বলে-ঘুমুলে সিংহমশায়ের নাক ডাকে কিনা। আয় বাবা-উঃ এত দেরি হ’ল।
জিনিসপত্র কুড়িয়ে নিয়ে সিংহের গুহাতে প্রবিষ্ট হল পটল চন্দর ।
ততক্ষণে পিরিয়ড ওভার হয়ে গেছে। সিংহমশায়ের সবকিছু ওই পিরিয়ড ধরে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট ঘুম—তারপর ঠিক ঘুম ভেঙে যায়। তিনি উঠে বাইরে এসে পটলাকে দেখে বলেন গুরুগম্ভীর স্বরে—এসে গেছো তাহলে? গুড। এবেলায় খেয়ে দেয়ে রেস্ট নাও। ও বেলায় দেখা যাবে ইংরিজিটা ।
পিসিমা বলে—এখন বাছা তেতে পুড়ে এল। ওসব রাখো তো।
সিংহমশায় বলেন—ওসবই আসল। ছাত্রানাং অধ্যয়নতপঃ। পড়াই ধ্যান জ্ঞান। ব্ৰত !
পটলা দেখছে ওর রাঙা পিসেমশাইকে। নামটাও জবরদস্ত ওঁর। ডবল সিংহের সমাহার। নৃসিংহ মুরারি সিংহ। দেহটাও তেমনি দশাসই। আর রাঙা পিসেমশাই না হয়ে আবলুশ পিসেমশাই হলেই নামটা মানানসই হত। পটল তবু ওঁকে প্রণাম করার জন্য এগিয়ে যেতে হুঙ্কার ধ্বনিত হয় ।
—চুল কোথায় কেটেছিলে ? কলকাতায়? পটলা নীরব। পিসেমশাই পুনর্বার গর্জে ওঠেন। —এই প্যান্ট! একি দাঁড়িয়ে সেলাই করানো হয়েছিল দেহের সঙ্গে লেপ্টে? এ্যাঁ !
পটল চমকে ওঠে। চুস প্যান্ট আর চুলও একটু বাহারেরই তার, অমিতাভ বচ্চনের স্টাইলে—যেন একটা বাবুই পাখির বাসা। পিসেমশাই ওকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বলেন— চিত্তবিকৃতির জন্যই অধ্যয়নে মনোসংযোগ করতে পারোনি। এবার দেখছি। পিসিমা কাতরস্বরে বলে— এখন বাছাকে ছেড়ে দাও। নাওয়া খাওয়া করুক বেচারা। নেহাত দয়াপরবশ হয়েই সিংহমশায় বলেন। —ঠিক আছে। তাই করুক। কিন্তু এরপর ওকে আমার ফর্মুলাতে চলতে হবে। গাধা পিটিয়ে বহু ঘোড়া বানিয়েছি। তোমার ভাইপোকেও এবার মানুষ করে দেবে এই এন-এম সিংহ। হাফপ্যান্ট আছে তোমার না সব এমনি জিনিসই এনেছো ?
—হাফ প্যান্ট! পটলা বলে— একটা এনেছি খেলা করবার জন্য। গর্জে ওঠেন সিংহমশায়—জীবনটা খেলা নয় ছোকরা। হাফপ্যান্ট পরলে নিষ্ঠা বাড়ে, আর কাঁচাকলায় মেধা বাড়ে। কোন মন্ত্রী অবশ্য এসব কথা বলে বিপদে পড়েছিল। পড়বেই তো—এ যুগে সত্যকথা বললে তাকে ঠাট্টা করে লোকে। আই হেট দেম্। আমি স্কুলে যাচ্ছি। সিংহমশায় নিষ্ক্রান্ত হতে এবার পটল দম ফিরে পায়।
পিসিমা বলে—ওর কথাবার্তাই এমনি পটল। স্নানটান করে নে। আর কলকাতায় একটা পৌঁছানো সংবাদ দিয়ে চিঠি দে। সবাই ভালো আছে তো? মা–দাদা বৌদিরা—
পটল ঘাড় নাড়ে। মনে হয় বলবে সে পটলাই মারা গেছে। পটলা সত্যিই মারা গেছে। আর একদিনের মধ্যেই সেটা ঘটেছে।
সকালেই সিংহমশায় ওকে নাপিত ডেকে চুল কাটিয়েছেন—চুল কাটা তো নয় ভেড়া কামানো। ভেড়ার গায়ের লোম যেমন ভাবে কেটে নেয়—ঠিক সেই ভাবেই নাপিত-নন্দন তার মাথার সেই স্টাইলিস্ট চুলগুলোকে কেটে একদম ঘাড়-জুলপির শাঁস বের করে দিয়েছে। কদম ছাঁট করে ছাঁটা—আর পরনে হাফ প্যান্ট আর শার্ট।
কলকাতার সব চিহ্ন মুছে গেছে পটলের দেহ থেকে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার কান্না পায়। নিজেকেই চিনতে পারে না। গর্জন ওঠে—পটলা, ব্যায়াম করেছো? পঞ্চাশটা ডন-বৈঠক দিতে হবে।
—দিচ্ছি তো।
পিসেমশাই ওকে ভোরেই ঠেলে তুলে দেন। পটলার কলকাতায় বেলা সাতটায় ওঠা অভ্যাস। উঠে চা চাই ।
আর এখানে? শীতে কাঁপছে তবু হাফপ্যান্ট গেঞ্জি পরে ডন-বৈঠক দিয়ে চলেছে। তারপর কলবেরুনো ছোলা—আদা—কাঁচা হলুদ আর একটু আখের গুড় দিয়ে জলপানি সেরে একটা ধুসো চাদর জড়িয়ে পড়তে বসতে হচ্ছে। তখন সূর্য কোথায় কে জানে—কাকপক্ষীরা কলরব
করছে মাত্র।
–জোরে? পস্ট করে উচ্চারণ করো। প্রতিটি সিলেবল পস্ট হবে। তারপর গ্রামার- ট্রানস্লেশন করে আনো।
ওদিকে এর মধ্যে চার পাঁচজন ছাত্র বসে গিয়েছে। কে আর্তনাদ করে ওঠে—আঁক্ ।
সিংহমশায়ের থাবার মৃদু স্পর্শেই ছেলেটা ছিটকে পড়ে ‘চিঁ চিঁ করছে। গর্জাচ্ছেন সিংহস্যার-ভাওয়েল কনসোনেন্ট জানিস না ভয়েস চেঞ্জ করবি কী করে। মারবো এ্যাক রদ্দা-
সে বেচারার ভয়েস ভয়ের চোটেই চেঞ্জ করে গেছে। চিঁ চিঁ করে সে।—মারবেন না স্যার ! এবার ঠিক করেছি।
পটলার ট্রানস্লেশন দেখে অভ্যাসমত সিংহমশায় ওর চুলের মুঠি ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন । কারন নাপিত এ ব্যাপারে পটলাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সিংহমশায় বলেন।
—কলকাতায় এই ইংরাজি শেখায়? টেন্স ভার্ব এসবও জানিস না? নিয়ে আয় গ্রামার। পটলাকে নিয়ে পিসেমশাই আড়ং ধোলাই শুরু করেন। ইংরাজি তারপর অঙ্ক। বৈকালে আবার সেই রগড়ানি। চলে অধিক রাত্রি অবধি।
এছাড়া পটলার অন্য কাজও আছে। কয়েকজন ছাত্রও সেই কাজ করে। সিংহমশায়ের বাড়ির লাগোয়া একটানা লম্বা একটা ব্যারাকমত ঘর খোপ খোপ করা, সেখানেও কয়েকজন গরিব ছাত্র থাকে। বোঁচা—পরান আরও অনেকেই। সকালে পড়াশোনার পর তাদের দৈহিক পরিশ্রমও কিছু করতে হয়। অবশ্য সিংহমশায় বলেন—এগ্রিকালচারাল ট্রেনিং।
নিঃসন্তান সিংহমশায়ের আশ্রয়ে থেকে ওরা পড়াশোনা করে। তাঁর বাগান খেতে ধান শাকসবজি যা হয় তাই থেকেই ওদের খাওয়া চলে।
তাই বাগানেও কমবেশি কাজ করতে হয় তাদের। পটলকেও বলেন সিংহমশায় কায়িক পরিশ্রমও দরকার। কোদাল চালাতে হবে।
পিসিমা আড়ালে বলে—কি বলছো গো ? দাদা শুনলেন সিংহমশায় গর্জে ওঠেন—তোমার দাদা ছেলেকে অমানুষ করে তুলেছিল আমি এই এন এম সিংহ ওকে মানুষ করে দেব। নো টক্!
পিসিমা চেনে কর্তাকে। তাই চুপ করে যায়। পটলা তখন কোদাল চালাচ্ছে কলাবাগানে। তাদের কলকাতার বাড়িতে রোজই মুরগি কাটা হয়, এখানে সিংহমশায়ের আস্তানায় ‘নো মাংস’ তিনি নিরামিষে বিশ্বাসী। তাই রোজ এখানে এখানে কলাগাছ কাটা হচ্ছে। থোড়-মোচা-কাঁচাকলা -গর্ভমোচা-কলা এভরিথিং রোজ চাই, তৎসহ পেঁপে-ডুমুর- সিম- বাঁধাকপি আর তারকেশ্বরের কুমড়ো। তার সঙ্গে অড়হড়ের ডাল।
পটলার কান্না আসে খেতে বসে। পিসিমা প্রথম প্রথম আড়ালে ডিম মাছ-এর ব্যবস্থা করেছিল কিন্তু সিংহমশায়ের গোচরে আসতে তিনি সাবধান করে দেন।
কোনো পক্ষপাতিত্ব চলবে না এখানে। ও পিসিমার আদর খেতে আসেনি। গুরুগৃহে এসেছে অধ্যয়ন করতে। কৃচ্ছ্রসাধন করতেই হবে। না পারে ওকে ‘রিটার্ন টু সেন্ডার’ করে দেবে এই এন এম সিংহ।
ওর ভবিষ্যৎ-এর কথা ভেবেই পিসিমা চুপ করে যায়। ক’টা মাস এই চলছে, পটলার যেমন অদৃষ্ট। পটলার ক’মাসেই চেহারা একেবারে বদলে গেছে। কদম ছাঁট চুল, খালি পায়ে চলাফেরা করে পা ধূলি ধূসর, সেই কলকাতাইয়া কমনীয়তা কিছুমাত্র নেই। পরনে হাফ প্যান্ট ময়লা শার্ট !
ভোর থেকে পড়া আর কাজ। দুপুরেও পড়া—সন্ধ্যাতেও। অবশ্য মাস দুয়েকের মধ্যে পটলা এখন ইংরেজিতে ভালো লিখতে পারছে, অঙ্কগুলোও আর জটিল ঠেকে না; বাংলা-সংস্কৃত বেশ সড়গড় হয়ে গেছে। এখন আকবর আর শাহজাহানে একাকার করে দেয় না। প্রথম থেকে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ মায় তার সন তারিখও সঠিক বলতে পারে। জ্যামিতি থিয়োরমে প্রবলেমও গুলিয়ে যায় না।
তবে ওই থোড় আর ডুমুর পেঁপে এখনও ঠিক রপ্ত করতে পারেনি। তবে কোদাল চালাতে শিখে গেছে। কিন্তু তারকেশ্বরের কুমড়োটা আদৌ সহ্য হচ্ছে না তাই পেটের অসুখ ধরিয়েছে। ফলে থানকুনি পাতাও গিলতে হচ্ছে।
কলকাতায় এসব খবর আমরা পেয়েছিলাম পরে, আমিই মাঝে মাঝে ওদের বাড়ি যাই। সেখানে নাকি চিঠি আসে পটলা ভালো আছে। ইংরেজি কেন সব সাবজেক্টে প্রভূত উন্নতি করে চলেছে।
এদিকে আমাদের দারুণ অবনতি ঘটেছে। পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের অবস্থা এখন খুবই শোচনীয়। মাঠে আর খেলাধুলো নেই, ফলে ঘাস গজিয়েছে। আমরাও সেই অনিল কেবিন, গোকুল কুলপিওয়ালার তাগাদার চোটে ক্লাব ছাড়া প্রায় ।
ফটিকই মাঝে মাঝে যায় আর ক্লাবের ঘরটায় গোবরার মামা এখন কুমড়োর গুদাম করেছে। অবশ্য দরকার হলেই কুমড়ো সব সরিয়ে নেবে বলেছে। এখন তারকেশ্বর থেকে ওরা ট্রাকবন্দি কুমড়ো এনে ‘হোলসেল’-এ বিক্রি করছে। গোবরাও কুমড়োপটাশ হয়ে উঠেছে কুমড়োর কমিশনে। ট্রাক নিয়ে তারকেশ্বরের বিভিন্ন অঞ্চলে যাচ্ছে।
তবু হোঁৎকা বলে— এতবড় ‘ডিবিট’টা মাইনা নিতে হবে? নেভার !
আমি জানাই পটলা ফিরে আসুক, হোঁৎকা বলে— যাদের পটলা নাই তাগোর কেলাব নাই? পটলা একটা ‘ট্রেটার,’ আমাগোর ফেলে থুইয়া পিসিমার আদর খাইতেছে। মাছ মাংস সাঁটতেছে। ওরে ছাইড়া ক্লাব করুম।
ফটিক বলে— নাহলে দুমাসে একটা পোস্টকার্ড দেয়নি। এই বন্ধু? ও নিজের তালে আছে রে। ও সেলফিস্ জায়েন্ট !
চুপ করে থাকি। বলি কি ভেবে।—কেমন আছে কে জানে। ওর ঠাকুমা তো কাল বলছিল ছোটকাকাকে খবর নিতে। ঠাকুমা নাকি ওকে আনতে চায় এখানে।
হোঁৎকা কি ভেবে বলে—ঠামার কাছে খবর নে। গোবরা বলে- শায়েস্তাগঞ্জের কাছে তো আমাদের ট্রাক যায়, এই শনিবার নবীগঞ্জের মেলা। প্রচুর কুমড়ো আসে কিনতে যাবো। ফুঁসে ওঠে হোঁৎকা—তুই থাম দিকি কুমড়োপটাশ? তর মামার কুমড়ো হঠিয়ে নিতি ক। ক্লাব না কুমড়োর গুদাম? হক্কলে হাসতিছে।
গোবরা চুপ করে যায় ।
ঠাকুমা অবশ্য কিছুদিন পর পটলার অভাবটা বুঝতে পারেন। পটলাই এ বাড়ির একমাত্র বংশধর। তাকে এখানে রেখে ভালো মাস্টার দিয়ে পড়ালেই পারত। কিন্তু ছেলেরা তা করেনি। এবার ঠাকমা বলে—পটলার ওখানে ঢের পড়া হয়েছে। এবার আন ওকে। সরোজও লিখেছে ওখানে নাকি পটলার শরীর টিকছে না।
সরোজ পটলার পিসিমার নাম। পিসিমা অবশ্য পটলাকে ওইভাবে থাকতে দেখে খুশি হয়নি। তার স্বামীর উপর কথা বলতে না পরলেও ঠারে ঠোরে মাকে কিছুটা আভাস দিয়েছে বোধহয় চিঠিতে।
কিন্তু ছোটকা বলেন—পটলা আরও একটা মাস থেকে তৈরি হয়ে আসুক। এখন তো কষ্ট করার সময়। কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না মা ।
ঠাকুমার ওইখানেই আপত্তি। কিন্তু ছেলেদের মত করাতে পারেননি।
তাই আমার কথায় বলেন পটলাকে একবার দেখে এসো না। কাছেই তো। গাড়ি ভাড়া টাড়া যা লাগে বলে নিজেই পঞ্চাশটাকা গছিয়ে দেন ঠাকুমা ।
হোঁৎকা সব শুনে বলে— ওর তো কেস গড়বড় মনে লয়। শায়েস্তাগঞ্জে লই যাই পটলারে শায়েস্তা করনের ব্যবস্থাই হইছে। ওরে উদ্ধার করতি লাগবো ।
আমি বলি-উদ্ধার করে কাম নাই, ওর বাবা কাকারা বুঝবে। শুধু খবরটা নিয়ে আসতে হবে।
গোবরা বলে—এ এ আর শক্ত কাম কী? নবীগঞ্জের মেলায় যাবো কুমড়ো কিনতে, তোরা ওই ফাঁকে খবর নিয়ে আসবি। কাছেই তো। চল আজ রাতেই ট্রাক যাবে।
কুমড়ো নিয়ে যে এমন বাণিজ্য হয় তা জানা ছিল না। মাঝরাতে ট্রাক নিয়ে বের হয়েছে গোবরা; ডানকুনি সিঙ্গুর হয়ে হরিপালের কাছে এসে সেই রাস্তা ছেড়ে আমরা চলেছি নবীগঞ্জের দিকে। দুদিকে মুক্ত প্রান্তর ধানখেত, দুচারটে গ্রামবসতও দেখা যায়। তখন সকাল হতে চলেছে।
ট্রাকওয়ালা কোন মোকামে কলকাতা থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া মালপত্র খালাস করে এবার আমাদের নিয়ে কুমড়ো গ্যস্ত করতে চলেছে নবীগঞ্জে ।
নবীগঞ্জের মদনমোহনের মেলার খুবই নামডাক। দূর-দূরান্তরের গ্রাম গঞ্জ থেকে কাতারে কাতারে লোকজন আসে। কারণ মদনমোহন নাকি খুবই জাগ্রত। সারা বছর ধরে এই এলাকার মানুষ নানা আশা নিয়ে দেবতার উদ্দেশে মানসিক করে। এই মেলার সময় সেই ঋণ শোধ করতে আসে।
বেশ বড়সড় মন্দির নাটমন্দির, সামনে বড় দিঘি। গাছগাছালি ঘেরা চত্বর। আর ওদিকে ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠে সাতদিন ধরে মেলা বসে।
দিনরাত মেলা জমে থাকে। বড় বড় দোকান-পশার আসে। জামা, কাপড় মনোহারী রকমারি মিষ্টির দোকান সার্কাস ম্যাজিক পুতুলনাচ-যাত্রা এসব তো হয়ই। বিদ্যুৎ চালিয়ে আকাশছোঁয়া নাগরদোলা আসে, আরও হাজারো রকম আকর্ষণের আমদানি হয়। এছাড়া গরুর গাড়ির চাকা, লাঙল কপাট জানলা—সবই আসে। আর চারদিকে চাষীদের এলাকা। তাই কৃষিবিভাগ থেকে বিরাট প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। দেড় হাত মুলো, এক কাঁদিতে দেড়শো নারকেল, তিরিশ কেজি সাইজের কুমড়ো, চোদ্দ হাত লম্বা আখ, চার সের বেগুন এসবও আনা হয় প্রদর্শনীতে। আর আসে কুমড়ো।
ফলে লোকজন ভেঙে পড়ে। এই কদিন শায়েস্তাগঞ্জের স্কুলের ছেলেদের নিয়ে স্বয়ং এন এম সিংহমহাশয় মেলায় পুলিশকে সহযোগিতা করেন। দলে দলে ভলেনটিয়ার থাকে মেলায়, বিশেষ করে মন্দিরের আশেপাশে, প্রবেশদ্বারেও মাইকে অনবরত ঘোষণা করা হচ্ছে কে কোথায় হারিয়ে গেছে। কাকে ফার্স্ট এড দিতে হবে। জনতা কোনদিকে যাবে ইত্যাদি।
ওই জনসমুদ্র দেখি আমরাও। আর দেখি মাঠে গাদা করা নধর সাইজের কুমড়ো। টাল হিসেবে দর। খুচরো ব্যাপার নেই। পাহাড়প্রমাণ কুমড়ো।
হোঁৎকা বলে—তুই মাল কেন গোবরা, দেহি শায়েস্তাগঞ্জের খবর নিইগা।
দুতিনজন রোগা পটকা খোঁড়া বোঁচা ছেলে জামার উপর লাল ফিতে আলপিন দিয়ে আটকানো, তারা বলে— ট্রাক এখানে নয় ওদিকে রাখো।
একদল আবার পথে দড়ি ধরে একবার এদিক চেপে মেয়েদের যাবার পথ করছে, তারা কিছু চলে গেলে, দড়িটা ওদিকে চেপে এবার পুরুষদের যেতে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার বাঁশি বাজিয়ে সংকেতও হচ্ছে।
একজন কালো মুগুরমার্কা দেহ নিয়ে হুঙ্কার ছাড়ে। সব যেন ঠিকমত হয় বয়েড। স্নান যাত্রার ভিড় বি কেয়ারফুল। ভলেনটিয়ার্স ট্রাক গাড়ি সব এখন হঠিয়ে দাও ওদিকে।
একটা সর্দার মত ছেলে নাচতে নাচতে বলে সব ঠিক হবে স্যার।
স্যার ওদিকে চলে গেলেন হন্তদন্ত হয়ে। চিৎকার করে পেংটি ভলেনটিয়ারের দল গাড়ি হঠাও।
হোৎকা বলে— হালায় আদাড় গাঁয়ে শিয়াল রাজা হইছে। আমাগোর শেখায় ভলেনটিয়ারি।
ওরা চিৎকার করে গাড়ি সরান। এখন কুমড়ো কেনা চলবে না। হোঁৎকা বলে— এহানে তো ভিড় নাই ৷
একজন বলে আবার জবাব। ওরে ক্যাপ্টেন সুভাষদাকে খবর দে।
হোঁৎকা হেসে ওঠে। বলে সে-
—আর্মুলা আবার পক্ষী, তোমাগোর আবার ক্যাপ্টেন? তারেই ডাকো, দেহি ক্যাম ক্যাপ্টেন।
ডাকতে হয় না, পি পি বাঁশি বাজছে। ভলেনটিয়ার বাহিনীও এমন অবাধ্য লোকদের দেখেনি। স্বয়ং ক্যাপ্টেনই এসে পড়েছে চিৎকার করে সে।
ক কি কি হয়েছে? এখানে এত ভিভিড় কেন? ট্রাক হঠাও।
হঠাৎ আমাদের দেখে পটলা চমকে ওঠে। ওর বীর দর্প থেমে গেছে। এগিয়ে আসে সে। কতদিন পর আমাদের দেখছে। জিবটা আলটাকরায় সেঁটে গেছে।
ত্ ত্ ত্ তোরা! এখানে?
আমরা প্রথমে ক্যাপ্টেনকে চিনতেই পারিনি। পটলার সেই তেলচুকচুকে অমিতাভ বচ্চন মার্কা চুল একদম কদমছাঁট করে ছাঁটা, পরনে নড়বড়ে হাফপ্যান্ট আর থাকি শার্ট, ধূলিধূসর পায়ে একজোড়া পুরোনো কেডস। মুখের সেই নধর ভাবটাব গিয়ে শীতের রুক্ষতা ফুটে উঠেছে, আর আধখানা হয়ে গেছে। ঈষৎ ল্যাংচাচ্ছে ওই ছাত্র বাহিনীর মতই, কপালেও একটা নতুন কাটা দাগ পটলার বদনকে বদলে দিয়েছে একেবারে। এ যেন অন্য পটলা কোন অজ গাঁইয়া ।
চমকে উঠি আমরাও। পটলাকে এখানে এইভাবে আবিষ্কার করব ভাবিনি।
–তুই! পটলা এখানে? এ কি হাল হয়েছে তোর? পটলাও তা জানে। তাই অভিমান ভরে বলে।— ‘কদিন পর শোকসভাই করতিস। কেন এলি?
হোঁৎকা বলে—ইংরাজিতে ক্যামন পাকা হইছিস তাই দেখতে কইছে তোর ঠাকুমায় ? ঠাকুমার নাম শুনে পটলা বলে।—ঠারে কইবি পটলা মরে গেছে। ডেড, এন্ড গান্। গো ‘ভারবের’ পাস্ট পারটিসিপল হয়ে গেছে গান্ ফট! আর কলকাতা বোধহয় ফেরা হবে না রে!
আমি ওকে ছাড়তে চাই না। পটলাকে এমনি করুণ অবস্থায় দেখে আমরাও কর্তব্য স্থির করে ফেলেছি, পটলা মোটেই ভালো নেই। ক্লান্ত শীর্ণ চেহারা। ওর ঠাকুমা—মা হয়তো সব খবর জানেন না। বলি ।
—আমাদের সঙ্গে কলকাতা ফিরে চল ট্রাকে।
পটলা বলে—সিংহমশায়কে চিনিস না। খবর পেলে তোদেরও ধরে নে গিয়ে দাগি করে ইংরাজি শেখাবে অঙ্ক কষাবে। দেখছিস না এদের?
ভলেনটিয়ার বাহিনীর প্রায় সকলেরই দেখি কেউ খোঁড়া—কারো কপাল কাটা; শুধোই । –ক্যামন মাস্টার রে !
পটলা বলে—তাই বলছি আমি মরছি, লেট মি ডাই। তোরা পালা। হোঁৎকা গর্জে ওঠে—ঢের দেখেছি এ্যামন মাস্টার? চল তুই না যাস্ তরে কল্লা ধরি ট্রাকে তুলে লই যামু তর ঠাকুমার কাছে। যা করবার ওই করবে।
হোঁৎকা পটলার জীর্ণ জামার কলার টেনে ধরে ওকে ট্রাকের দিকে নিয়ে চলেছে।
ভলেনটিয়ারের দল ও তাদের ক্যাপ্টেনকে এভাবে টেনে হিঁচড়ে ট্রাকজাত করতে দেখে একসঙ্গে ফুঁ ফাঁ শব্দে গোটাকতক বাঁশি বাজাতে শুরু করেছে। দু-চারজন ল্যাংচা মার্কা ভলেনটিয়ার এগিয়ে এসে বাধা দেবার চেষ্টা করতে তারাও হোঁৎকা আর ফটিকের মারের চোটে ছিটকে পড়েছে। কলরব ওঠে মেলায়।
দৌড়ে আসছে লোকজন। এত লোকের মাঝে ভলেনটিয়ারের ক্যাপটেনকে তুলে নিয়ে যারে এ হতে দেবে না।
আমরাও বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারি।
গোবরাও এর মধ্যে বেশ বাছাই সাইজের কুমড়োতে ট্রাক প্রায় বোঝাই করে তুলেছে, লোকজন এর মধ্যেই দোকানের ঝাঁপ-এর বাঁশ লাঠি নিয়ে তাড়া করেছে।
ভিড়ের মধ্যে দেখা যায় বিশালদেহী সিংহমশায়কে, বীরদর্পে হুঙ্কার ছাড়েন স্টপ দেম! থামাও—ওরা পটলাকে কিডন্যাপ করছে।
আমাদের আর থামার উপায় নেই, দেরি করলে গণধোলাই-এর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পালাতেই হবে। তাই পটলাসমেত ট্রাকে উঠেছি। জনতা ট্রাক ঘিরে ফেলার উপক্রম করছে। হঠাৎ বুদ্ধিটা মাথায় এসে যায়।
হোঁৎকা ওই সামনের জনতার উপর ট্রাক থেকে একটা আধমণি কুমড়ো তুলে ছুড়ে দেয়। বিরাট কুমড়োটা পড়েছে কার মাথায় তারপর মাটিতে পড়ে প্রচণ্ড শব্দে বিদীর্ণ হয়ে যায়, তারপরই ছুড়ছে আর একখান! কুমড়ো যে এমনি শব্দ করে বিস্ফোরিত হয় জানা ছিল না, আর এমনি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে তাও অজ্ঞাত ছিল।
আচমকা কুমড়োর আক্রমণে সামনের জনতা সরে যায়, কে চিৎকার করে বোমা বোমা মারছে-
সামনে খালি রাস্তা। ট্রাকওয়ালা এবার পঞ্চাশ মাইল গতিবেগ তুলে ছুটছে, পিছনের যারা তাড়া করেছিল তাদের উদ্দেশে দু চারটে দশ কেজি সাইজের কুমড়ো ছুড়তে তারাও কেটে পড়েছে।
ট্রাক তখন নবীগঞ্জের মেলা ছাড়িয়ে তারকেশ্বর রোডের দিকে ছুটে চলেছে, গোবরা খুশি। গোলমালে কুমড়ো মহাজনকে দামও দিতে পারেনি। মামার থেকেও সেটা ম্যানেজ হয়ে যাবে।
কলকাতা পৌঁছলাম তখন বৈকাল হয়ে গেছে।
ঠাকুমা পটলাকে ওই অবস্থায় দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ওর মাও অবাক হন। ঠাকুমা বলেন—ওকে এনে ভালোই করেছিস তোরা। এখানেই বাকি পড়াটা করুক।
ছোটকা গম্ভীর হয়ে যান।
অবশ্য সিংহমশায়ের উদ্যম বৃথা যায়নি। পটলা ওই ক’মাসের পড়াতেই ফার্স্ট ডিভিশনে গেছল।