পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

পটলাকে নিয়ে প্রবলেম

পটলাকে নিয়ে প্রবলেম

সেদিন কুলেপাড়ার আমাদের ক্লাব-এর মাঠে প্রতিদিনের মত আমরা সাগ্রহে পটলার প্রতীক্ষা করছি। কিন্তু পটলার দেখা তখনও মেলেনি।

পটলা মাঝে মাঝে ডুমুরের ফুলের মতই অদৃশ্য হয়ে যায়। কারণও আছে।

পটলা মস্ত বড় ঘরের ছেলে। তার বাবা, কাকাদের নানা কারখানা, করাতকল, তেলকল, মস্তবড় ওষুধের দোকান, কি নেই। বড় রাস্তার ওদিকে তাদের বিশাল বাড়ি—ওদিকে পুকুর, তার ঘাটও বাঁধানো, পাশে মন্দির তার মেজেতে মার্বেল পাথরে মোড়া, একদিকে রকমারি ফলের বাগান ।

বাড়িতে কর্ত্রী বলতে তার ঠাকমাই।

আর পটল সেই বড় বাড়ির একমাত্র সন্তান, শুধু সন্তানই নয়, বংশধর—অর্থাৎ কুলপ্রদীপই ।

সুতরাং পটলার দাম এমন হবেই। তবে আমাদের পাঁচজনের মধ্যে খুবই মিল, যদিও অবস্থার অনেক ফারাক তবুও আমাদের বন্ধুত্বের বাধা হয়নি।

আর তাই কুলেপাড়া-বেলেঘাটার তামাম মানুষ আমাদের পঞ্চপাণ্ডব বলেই জানে। আর আমাদের ক্লাবের নামও রেখেছি ওই ‘পঞ্চপাণ্ডব’ নামে।

আর পটলা তার ক্যাশিয়ার কাম প্রেসিডেন্ট। অবশ্য সেক্রেটারি আমাদের মধ্যে কেউ হয়, দলে আমরা কুল্যে পাঁচজন।

পটলা আমাদের মধ্যমণি।

তারপরই দলের সেক্রেটারি এখন বৃষকেতু ঘোষ, আমরা তাকে হোঁৎকা বলেই জানি। ওই বিকট নামটা স্কুলের খাতাতেই আছে।

ওর পিতৃদেব কোনোকালে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে এই মুলুকে আসছিলেন জীবিকার সন্ধানে, তারপর দেশবিভাগের পর দেশ জুড়ে এখানেই রয়েছেন সপরিবার। হোঁৎকার জন্মকর্ম কলকাতাতেই।

কিন্তু বাড়িতে মা-ঠাকুমারা পূর্ববঙ্গের ভাষাতেই কথা বলে, তাই হোঁৎকার মাতৃভাষা এই খাঁটি বাঙাল ভাষাই ।

ওই ভাষাতেই বাক্যালাপ করে সে। ইদানীং তাকেই সেক্রেটারি করেছি, বেশ হাট্টাকাট্টা চেহারা আর মাথায় নানা রকম ফন্দি, বুদ্ধি যেন কিলবিল করে। যে কোনো বিপদ সমস্যা হোক হোঁৎকা ক্লিন বের হয়ে আসবে।

মনে হয় সৃষ্টিকর্তা ওকে সৃষ্টি করার সময় ভিতরের খোলটা বেশ বড়সড় করে ফেলেছিলেন। সেই খোল ঠিকমত ভর্তি না হলে হোঁৎকার মেজাজ বিগড়ে যাবে। আর তাই আহার এবং আহার্যের প্রতি হোঁৎকার সহজাত আকর্ষণ বেশিই রয়ে গেছে।

আমাদের কেন পটলাকেও ওই হোঁৎকার বিশেষ জলযোগের ব্যবস্থা রাখতেই হয়, না হলে ওর পকেটে একটা পদত্যাগপত্র সব সময়েই মজুত থাকে। সেটা পেশ করে ক্লাব থেকে চলে যাবার ভয় দেখায় ৷

ওকে ছাড়াও যাবে না—তাই ওর জন্য পটলা সব ব্যবস্থাই রেখেছে। ঝালমুড়ি-ফুচকা- আলুকাবলিওয়ালাও বাঁধা আছে। আর আছে নকুলের দিলখুশ কেবিন

নকুল পটলাদের একটা বাড়ির নীচে ভাড়া নিয়ে ওই চায়ের দোকান চালায়। পটলার সেখানে নিজস্ব অ্যাকাউন্ট আছে। চা-চপ-কাটলেট-টোস্ট এসবের যোগান আসে ওখান থেকেই। আমরাও ভাগ পাই ।

আমাদের মধ্যে গোবর্ধনই সবচেয়ে বেশি শক্তিধর, বিরাট বাহু—মাসলগুলোও গুলির মত, কালো গোলগাল চেহারা।

ওর মামার এখানে বিশাল কুমড়োর আড়ত। এখানে খালের ধারে টিনের প্রকাণ্ড গুদাম। সেখানে থরে থরে সাজানো খোল থাকে ফুটবলের সাইজের বিশাল কুমড়ো। আর ওদিকে গাদা করা আছে নধর পুরু চালকুমড়ো—তাও নানা সাইজের।

কুমড়োর এত সাপ্লাই আসে তারকেশ্বর-জাঙ্গপাড়া, বর্ধমান এসব জায়গা থেকে। সারা বছর ধরেই স্রেফ কুমড়ো সাপ্লাই করে গোবরার অর্থাৎ আমাদের শ্রীমান গোবর্ধনের মামা লাল হয়ে গেল।

আর অন্যতম সভ্য ফটিক। শীর্ণ চেহারা—মাথায় বাবরি চুল, পিছন থেকে দেখলে ছেলে কি মেয়ে চিনতে ভুল হবে। ক্লাবের দরমার ঘরে বসে হারমোনিয়াম নিয়ে গলাই সাধে। কোন্ ওস্তাদের কাছে নাকি ক্লাসিকাল গান শিখছে। সেই গানের একটা কলিই বছরখানেক ধরে সাধছে ফটিকচন্দ্র।

—সইয়া না মারো গুলারিয়া-

এই সইয়া আর ওই লাইনটাকে নিয়ে ফটিক যেন চচ্চড়ি বানিয়ে ফেলেছে। বলে সে—রাগসঙ্গীত, চর্চা না করলে হয় না।

ওর গান শুনলেই রাগে আমাদের হাড়পিত্তি জ্বলে ওঠে, পটলা বলে—র-রাগ হয় বলেই তো ওকে বলে র-র-

পটলার ওই দোষ ।

মাঝে মাঝে ওর জিভটা ‘বিট্রে করে। কেমন বেমক্কা আলটাকরায় আটকে যায় আর বেশ কিছুক্ষণ ধরে রেকর্ডে ‘পিন’ আটকে গেলে যেমন একটা শব্দই বারবার বেজে ওঠে তেমনি সেই কথাটাই ‘রিপিট’ করতে থাকে। কোনোমতে জিভটা ফ্রি হলে আবার অন্য কথায় আসে। তবে, গোঁত খাওয়ার চান্স থেকেই যায় ।

আমিই ওই দলের মধ্যে নিরীহ বৈচিত্র্যহীন। তার জন্যই পটলার বিশেষ প্রিয়পাত্র।

সে দিন ক্লাবের ফুটবল টিম গড়া নিয়ে জরুরি মিটিং আছে আমাদের।

অবশ্য মিটিংয়ের আগেই ঝালমুড়ি আলুকাবলির ইটিং হয়ে গেছে।

হোঁৎকা ফুটবল টিমের চার্জে। প্রতিবার আমাদের টিমই এই এলাকার মধ্যে সেরা টিম হয়।

আর লোকাল সব ট্রফি আমরাই পাই।

তবে ওর জন্য চর্চাও বেশ করতে হয়।

ইদানীং, ওদিকে গজিয়ে উঠছে সেভেন বুলেট ক্লাব। তারাও এই বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে জোর করে মোটা টাকা চাঁদা তোলে। পিছনে কোনো পাড়ার কোনো তাবড় কর্তাও এসে জুটেছে। তার ভোটের সময় ওই ছেলেগুলো খুব খাটাখাটুনি করেছিল। তাতে দাদা জিতেও যায়।

ফলে দাদাই এখন তাদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আর তার মত খুঁটির জোরে সেভেন বুলেটস এখন বাজারে তোলা তুলে দারুণ ফুটবল টিম গড়েছে।

আর তারাই প্রচার করে, এবার তারা নাকি পঞ্চপাণ্ডবকে এক এক বুলেট দিয়ে উড়িয়ে দেবে। তাতেও তাদের দুটো বুলেট বেঁচে যাবে।

সব ট্রফিও জিতে নেবে তারাই ।

প্লেয়ারও পেয়েছে অনেক। তাদের সবাইকে নতুন বুট কিট ব্যাগ, জারসি সব ‘ফ্রি’ সাপ্লাই করবে আর টিফিনও দেবে দারুণ।

হোঁৎকা বলে—ওরে টিমে আমাগোর তিনচারজন প্লেয়ারও নাকি যাইব কইছ।

গোবরা বলে—তাদের নাম বল, ব্যাটাদের টেংরি খুলে নেব। খেলা জন্মের শোধ ঘুচিয়ে দেব তাদের। আমরা কি কম দিই তাদের। বল-কে কে যাবে? হোঁৎকা বলে—

তা জানি না, শুনত্যাছিলাম, হালায় পটলা এহনও আইল না। সমী, ডিমের মামলেট দিতি ক নকুলারে তার সঙ্গে খানকয় টোস্ট। ক্ষুধা পাইছে।

হোঁৎকার আবার ঘন ঘন খিদে পায়।

গোবরা বলে—মামার আড়তে যেতে হবে। কুমড়োর চালান আসবে দু ট্রাক। মাল দেখে নিতে হবে।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে—ওদিকে পটলার দেখা নাই—তুই যা গিয়া কুমড়োর চালান দ্যাখ । আমি হালায় রেজিকনেশানই দিমু, থো ফেলাই তর কেলাব। পকেট থেকে ফস্ করে সেই রেডিমেড রেজিগনেশান লেটারই বের করে হোঁৎকা।

সব গোলমাল হতে চলেছে।

আমি বলি বোস। ডিম টোস্ট আনি। খা—তারপর ভাবা যাবে।

ফটিকও তার অবস্থা গড়বড় দেখে তার সঙ্গীতসাধনা থামিয়ে বলে–

তোরা রোস । চা-পানি খা, আমি পটলাকে দেখে আসি।

আমি বলি দেখে আসা নয়; ধরেই আনবি তাকে। এদিকে সব গোলমাল হতে বসেছে।

ফটিক একটা ব্রেক বেলরিহীন মান্ধাতার আমলের সাইকেলই ব্যবহার করে। ওটা বোধ হয় ওর বাবা বাল্যকালে চড়ত, এখন উত্তরাধিকার সূত্রে ফটিক সেটা পেয়েছে। ফটিক সেই ধ্যাড়ধ্যাড়ে সাইকেলে চেপেই দিগ্বিজয় করছে এখন। ফটিক যাত্রা করবে এ হেন সময় রিকশার হর্ন শুনে চাইলাম।

জায়গাটা অন্ধকারই।

হুড়মুড় করে একটা রিকশা এসে থামে আর তার থেকে অবতীর্ণ হয়ে আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই পটলচন্দ্র বলে ওঠে দ-দ দেরি হয়ে গেল।

হোঁৎকা বলে—কেন! দেরিটা হইল ক্যান ?

পটলা বলে ওঠে—পিসিমা এসেছে—ওর দেওরের নাকি খু-খু- গোবর্ধনই পাদপূরণ করে খুব বিপদ?

হ্যাঁ। পটলা এবার শোনায়।

ওদের দেশের বাড়িতে সব নাকি কেড়ে নেবে কে একজন !

এত বড় অনাচার অত্যাচার ঘটবে পটলার লতাপাতার সম্পর্কের কারও উপর, এটা যেন আমাদেরই অপমান। পটলা বলে।

পিসিমার দেওর এসে হাজির।

বাবা তো বলেন কে-কে—

আবার জিভ আটকাচ্ছে। আমিই বলি—কেস করতে বলেছেন ?

পটলা জানায়, হ্যাঁ ।

হোঁৎকার অর্ডারি টোস্ট ওমলেটও এসেছে। আর সঙ্গে আমাদের ভাগের টোস্ট ওমলেটও এসেছে। হোঁৎকা এবার পদত্যাগপত্র পকেটস্থ করে বলে বিজ্ঞর মতো।

–কেস কাচারি কইরা কিছুই হইব না। আজকাল আইন আর নাই।

গোবরাও ওমলেট খেতে খেতে বলে—সত্যিই, তারকেশ্বরের মহাজন এক ট্রাক পচা কুমড়ো চালান দিল, মামা কেস করেও কিছু করতে পারেনি। জজ বলে কুমড়ো পচারই জিনিস। পচতেই পারে। ব্যস, মামলা ডিসমিস করে দিল।

পটলা বলে—এখন কী করা যাবে বলত। কিছু তো ক-ক-ক–

কোনোমতে জিভটাকে বন্ধনমুক্ত করে বলে—করতেই হবে।

হোঁৎকা এসব ব্যাপারে অনেক বুদ্ধি ধরে। সেই-ই এবার চা টোস্ট পর্ব শেষ করে বলে–ভাইবা দেখি। তর হেই পিসার ভাইয়ের সাথেই কথাবার্তা কইতে হইব। হকল ব্যাপারটা জানতি হইব, তয় কি করা যায় দেখুম। এদিকে ফুটবল টিম হইল না—পটলা বলে ওসব হয়ে যাবে। পি-পি-পিসা !

পটলা দম নিয়ে বসে—পিসার ভাই ওগোর প্রবলেম সলভ করতে পারলে মোটা টাকা ডো-ডো-কে বলে ডোনেশান !

হ্যাঁ তাই দেব। ক্যাশ।

ফটিক বলে—আর কালচারাল ফাংশান করতে হবে।

ওর নজর ওই ফাংশনের দিকে। নিজে জোর করে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যাবে, কোনোমতে তুলে আনতে না পারলে ইঁট পড়বে, তাই আমরাই ফটিককে তুলে আনি অসময়ে পর্দা ফেলে।

ওর ওই ফাংশনের কথায় হোঁৎকা গর্জে ওঠে।

তরে মার্ডার করুম ফটকে। একজনের সমূহ ডেঞ্জার, বিষয় বাগান চইলা যাইতেছে আর তুই গান গাইবি !

গোবরা বলে—হ্যাঁ, সেই সম্রাট নীরো, রোম পুড়ছে আর তিনি বেহালা বাজাচ্ছেন।

ফটিক চুপ করে যায় ।

পটলার পিসিমার দেওরের বিপদ মানে আমাদেরই বিপদ ।

হোঁৎকা বলে—কাল সকালেই যামু ওদের বাড়ি পটলা, তর হেই পিসার ভাইরে থাকতি কইবি।

হোঁৎকা কেসটা নিয়ে ভাবছে।

আমি বলি—কথায় বলে ‘মামার শালা, পিসের ভাই তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নাই ।” কে না কে! তার জন্য আবার ঝামেলায় জড়াবি? পাড়াগাঁয়ের ব্যাপার তেমন জানিস না । হোঁৎকা বলে—তাই তো জানতে চাই। আর পরোপকারই পরম ধর্ম। বুঝলি সমী | হোঁৎকা হঠাৎ এমন পরোপকারী হয়ে উঠবে তা ভাবিনি।

বলে হোঁৎকা—পটলা, ওই কথাই রইল, কাল সকালেই যামু ওগোর বাড়ি।

অর্থাৎ কাল সকালে হোঁৎকার ব্রেকফাস্ট হবে ওখানেই।

পটলার বাড়িটাও বিরাট।

তার ঠাকুর্দা তখন এই অঞ্চলে এসে জলাজমি হোগলা বাঁশের বনঘেরা জমি কিনেছিলেন প্রায় দশবিঘে স্রেফ জলের দরেই। এখন এই অঞ্চলে তার সোনার মত দাম। একসঙ্গে এতখানি জায়গা কারোরই নেই ।

পটলাদের তিন কাকার তিনখানা গাড়ি। সবার নিজস্ব গাড়ি একটা আর একটা গাড়ি রয়েছে পটলার মা-ঠাকুমায়ের জন্য। ঠাকমা বেশিরভাগ সময় মন্দিরেই থাকেন ।

পুকুরের ঘাটটা বাঁধানো, সিঁড়িগুলো জল থেকে উঠেছে, এদিকে তুলসীমঞ্চ, ওপাশে মার্বেল বসানো মন্দিরের মেজে, পিছনে নানা রকম ফুল-ফলের গাছে সাজানো বাগান ।

গ্রীষ্মের দিন, ওপাশে পাঁচিলঘেরা আমবাগানে গাছগুলো আমে যেন নুইয়ে পড়েছে। এদিকে বিরাট তিনতলা বসতবাড়ি। নীচে অফিসঘর, মা লক্ষ্মী যেন দুহাত ভরে ওদের দিয়েছে।

হোঁৎকাও যথাসময়ে এসে হাজির হয়। সবে গরমের ছুটি পড়েছে। স্কুলও নাই। তাই আমরা বাকি তিনমূর্তি ঠিক সময়েই এসে হাজির হয়েছি।

ওই বাড়িতে আমাদের যাতায়াত রয়েছে। পটলা মাঝে মাঝে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। নিজেও বিপদে পড়ে আর সেই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্যই আমাদেরও কাজে নামতে হয়।

এ নিয়ে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে।

তোমরাও তার অনেক কিছু জানো, তাই পটলার মা-ঠাকুমা আমাদের তো চেনেনই আর পটলার বাবা-কাকারাও চেনে এই বাকি চারজনকে।

মেজকাকা আমাদের দেখে বলেন—আবার কী হল? সামার ভেকেশানে নতুন কোনো প্রোগ্রাম হচ্ছে বুঝি?

গোবর্ধন বলে—তা নয়, পটলা ডেকেছে, পিসেমশাইয়ের ভাই এসেছেন—

মেজকাকু গাড়িতে উঠতে উঠতে বলেন–স্ট্রেট মন্দিরে চলে যাও, দেখা পাবে তার, ওই পিসের ভাই তো মন্দিরেই ধরনা দিয়েছে দেখলাম। দ্যাখ-যদি তার প্রবলেম সলভ করতে পারো ইয়ং মেন, সত্যি ও খুব বিপদে পড়েছে হে।

পটলার দর্শন পাওয়া গেল নাটমন্দিরেই, ওর ঠাকমাও রয়েছে, বুড়ি আমাদের খুবই স্নেহ করে। আমাদের দেখে একগাল হেসে ঠাকমা বলে—এসে গেছিস তোরা! আর ভয় নেই । হোঁৎকা এখানে ভক্তির অবতার, মন্দিরের দেবতাকে প্রণাম করে ঠাকমাকেও সভক্তি গড় করে, দেখাদেখি আমরাও প্রণাম করি।

ফটিক প্রণামের পর সাধা গলায় শুধোয়, – ভালো আছেন ঠাকমা ?

হ্যাঁ তা তোমার কেত্তন কবে শোনাচ্ছ? যা গাইলে সেদিন। ফটকে এখানে আমাদের না জানিয়ে একা একা এসে ঠাকমাকে কেত্তন শোনায়, তা জানা ছিল না।

অবশ্য আমরা দলবেঁধেই আসি ঠাকমার কাছে, কারণ পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের ফাংশন, ফুটবল টিম চালানোর বড় খরচটা জোগায় ঠাকমা ।

বুড়ির নাকি অঢেল টাকা ।

ওর নামে একটা কারখানা চলে, আর কোম্পানির কাগজ ব্যাঙ্কের টাকার যা সুদ আসে সেটা নাকি মাসে লাখের কাছাকাছি। অবশ্য ঠাকমার দান-ধ্যানও অনেক আছে। কিন্তু ফটিকের আমাদের না জানিয়ে এখানে কেত্তন গাইতে আসাটা ঠিক মেনে নিতে পারি না।

ঠাকমা বলে—বসো তোমরা, প্রসাদ আনি। আর কেশবকেও ডেকে পাঠাই, ওর কাছেই সব কথা শুনে যা হয় করো, বসো। ঠাকমা চলে যায় ওই পিসের ভাইকে খবর দিতে আর আমাদের ব্যবস্থা করতে।

ঠাকমা চলে যেতেই হোঁৎকা গর্জে ওঠে—ফটকে তুই একখান ট্রেটার। বিশ্বাসঘাতক।

ফটকে এবার বলে-আমার গান তোরা কেউ শুনিস? কুকুরের ডাক দিয়ে তুলে দিস। ঠাকমা আমার রাধে কেষ্টর গান কত মন দিয়ে শোনেন। শোনাব না? তুই বল সমী? আমাকেই সালিশি মেনে বসে সে।

হোঁৎকা বলে—আর কিছু আনসান কসনি তো আমাগোর নামে ।

না—না। বরং বলেছি তোরা খুব ভালো ছেলে— তবু হোঁৎকার ভরসা হয় না।

ঠাকমা আমাদের ক্লাবের রসদদার। ভালো কাজ করি ভালো ছেলে বলেই জানে। হোঁৎকা বলে-এবার অঙ্কে নয় আর ইংরাজিতে পাঁচ পাইছি কসনি তো।

হোঁৎকা অবশ্য পড়াশোনাতে অমন লাট খায় আর গোবর্ধন তো কুমড়ো মার্চেন্ট মামার দয়ায় আবার টেনেটুনে প্রমোশন পেয়েছে।

ফটকে বলে—না না তোদের ওসব কথা বলিনি। সমী ফার্স্ট হয়েছে সেইটাই বলেছি। হোঁৎকা বলে—হঃ ব্রাইট সাইডের কথাই কবি। আমাগোর ওইসব আসলি খবর এহানে ছাড়ছ শুনলি ওই সারেগামা লাইফের মত সাধা বন্ধ কইরা দিমু। গলা টিইপা দমবন্ধ কইরা ফিনিস করুম। হোঁৎকারে চেনস নাই ।

এমন সময় বাড়ির ঠাকুরকে পাতা ঝুড়ি বালতি ভর্তি নাশ প্রসাদ আনতে দেখে হোঁৎকার মেজাজটা খুশ হয়ে যায়। বলে সে–নে, প্রসাদ খালি, কইরে পটলা তুইও বোস। ঠাকুর মশায় গরম আনছে তো !

ঠাকমা তো এসেছে হাতে বড় এক বাক্স সেন মশায়ের সেরা সন্দেশ। হোঁৎকা তখন ডবল কচুরিতে গোটা আলুর দম পুরে বদনে চালান করছে। খাঁটি ঘিয়ের গরম কচুরি তৎসহ কাশ্মীরী আলুর দম। আহা ।

কাশ্মীরের লোকরাই এই আলুর দম খায় ।

স্বাদে গন্ধে মনোরম কচুরির সঙ্গে খেতে ত খাসা। হোঁৎকা তখন নিবিষ্টচিত্তে প্রসাদ গ্রহণে ব্যস্ত। জলখাবার মাত্র; তাতেই দিস্তে অর্থাৎ পঁচিশ পিস পার করে এখন সে রাজভোগ সেবনে ব্যস্ত। গোটা চারেক রাজভোগ, এরপর উৎকৃষ্ট কেশর ভোগ ।

নাহ। দেবতারা সুখে থাকুন তাদের এরকম উৎকৃষ্ট প্রসাদ পেলে তাদের ভক্ত হতে বিন্দুমাত্র বাধা নেই ।

প্রসাদ পর্ব শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে মন্দিরের থামে হেলান দিয়ে হোঁৎকা বেশ তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। এমন সময় দেখা যায় সেই পিসার ভাই কেশব দত্তকে।

ধীরে ধীরে মন্দিরে এসে কেশব দেবতার সামনে কাটা কলাগাছের মত আছড়ে পড়ে গড়াগড়ি খেতে থাকে আর কাতর কণ্ঠে আবেদন জানায়–রক্ষা কর দেবতা। দয়াময়, দয়া করো অধমকে ।

ওর কাতর কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয় কেসটা বেশ জটিলই।

ওখানে এক প্রস্থ গড়াগড়ি দিয়ে উঠে এসে কেশব ঠাকমাকেও প্রণাম করে।

ঠাকমা বলে—এই ছেলেদের ডেকেছি তোমার জন্যই কেশব। খুব কাজের ছেলে এরা । আমি এদের চিনি। তোমার সব কথা বলো এদের। হয়তো এরা তোমার সেই দুধে জমিদারনন্দনকে সংযুক্ত করতে পারবে।

কেশব দত্ত দেখছে আমাদের।

লোকটার গ্রাম্য চেহারা। তাতে একটা বিষণ্ণ ভাবই ফুটে উঠেছে। মনে হয়, সত্যি বিপদে পড়েছে সে। কেশব বলে—পারবে তোমরা আমাকে বাঁচাতে?

আমরা ভাবছি, কেশব বলে—পটলার বন্ধু তোমরা। অনেক কিছুই করেছ তোমরা শুনেছি। আমার সর্বস্ব গ্রাস করতে চায় ওই হাড়ভাঙা হলুদপুরের জমিদার ধনকেষ্ট বাবু। ডেঞ্জারাস লোক—ওর অত্যাচার থেকে যদি বাঁচতে পারো? সারা এলাকায় ও একটা শয়তানের ডেরা গড়ে তুলে সকলের সব কিছু গ্রাস করতে চায়।

হোঁৎকা বলে—কেসটা কি জানান, দেখি যদি কিছু করা যায়।

এবার কেশব দত্ত তার কাহিনিটা ব্যক্ত করে। বেশ গুছিয়েই বলে সে অনেক কথা। অনেক খবরই দেয় ওই অঞ্চল সম্বন্ধে।

কেশব দত্তের একটা সুন্দর বাগান আছে। তাতে একটা পুকুর আছে বিরাট আকারের। মাছও রয়েছে এক একটা আট-দশ কেজি সাইজের। জলে মাছে সমান। মাছ বিক্রি করেই বৎসরে তার আয় পঞ্চাশ-ষাট হাজারের বেশি। আর প্রায় ষাট বিঘের সরেস জাতের আমবাগান। ল্যাংড়া, বোম্বাই, গোলাপখাস, হিমসাগর, চৌষা কি জাতের আম নেই ? কলাবাগানেও রকমারি কলার চাষ করে সে। মর্তমান এক একটা ইয়া সাইজের, কাঁঠালি – সিঙ্গাপুরি এসব তো আছেই।

লিচু গাছও আছে চল্লিশটা। খাস মজঃফরপুর থেকে কলম এনে লাগানো। গাছ ভর্তি লিচুও হয়। আর কাঁঠালগাছও অনেক। এক একটা কাঁঠালের সাইজ, মন্দিরে কেত্তন করার সময় বাজানো হয় সেই খোলের মত। রস কাঁঠাল, খাজা কাঁঠাল সবই আছে। ওই বাগান থেকে কেশববাবুর আয় বছরে লাখ টাকারও বেশি।

এই বাগান পুকুর সব কিছু কোন্ মিথ্যা দলিলবলে ওই ধনকেষ্টবাবু গ্রাস করতে চায়। তার টাকার জোরও আছে আর লোকজনের অভাব নেই। সদরেও তার যাতায়াত আছে। চেনাজানা আছে মাতব্বরদের সঙ্গে।

তাই এই এলাকার যা কিছু ভালো জমি বাগান সব সে নানা ছলছুতোতে দখল করতে চায়। কেশববাবুর ভাই এখন মারা গেছেন। এতদিন পর ধনকেষ্টবাবু নাকি একটা দলিল বের করেছেন তাতে নাকি কেশববাবুর ভাই ওর কাছ থেকে ওই বাগান পুকুর বন্ধক রেখে টাকা নিয়েছিল।

কেশববাবুকে শোনাই—সত্যিই কি টাকা নিয়েছিলেন তিনি?

কেশববাবু বলে—না-না, সে বর্ধমানের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিল। তার টাকার কোনো দরকারই ছিল না। ওসব বাজে কথা। ওই দলিল জাল।

মামলাও করেছি স্যার। কিন্তু ওই ধনকেষ্ট এর মধ্যে সাক্ষী-সাবুদও যোগাড় করেছে। যদি হেরে যাই সর্বস্ব চলে যাবে। এখনই পুলিশ ওই বাগানে আমার যাওয়া নিষেধ করে হুকুমজারি করেছে। কি হবে বাবা ।

ধনকেষ্ট একা আমারই নয়, ওই এলাকায় অনেকের সর্বনাশ করেছে, আমাদের গ্রাম থেকে তাড়িয়ে ওই অঞ্চল একা দখল করতে চায়।

মনে হয়, প্রতিপক্ষ খুবই শক্ত ধাতের মানুষ ।

হোঁৎকা সব শুনে কি ভাবছে। পটলা বলে—কি কিছু একটা বল। পিসের ভাই কি কোনো সাহায্য পাবে না?

গোবর্ধন বলে—ওই ধনকেষ্টার নাম শুনেছি, ওদিকের থেকে মামার কুমড়োর অনেক চালানদার আসে ।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে। তর ওই কুমড়োর কথা ছাড় দেহি। ব্যাটা চেনে কেবল কুমড়ো। এহন একখান প্রবলেম সলভ করার কথা ভাবছি। ও কয় হেই এক কথা। গোবরা চুপ করে যায়।

স্কুলে জ্যামিতির প্রবলেম সলভ করার কথা হোঁৎকা ভাবতেও পারে না। ওসব তার মগজে ঢোকে না। কিন্তু বাস্তব জীবনের অনেক সমস্যাই সে সলভ করতে পারে, তা জানি।

ফটিক বলে–কেসটা খুবই সিরিয়াস।

হোঁৎকা এবার মন্তব্য করে—পটলা ওই ফিল্ডে যাতি হইব। যা করবার সেখানেই ভাইবা করতি হইব। এখানে বসে ওই কেসের কোনো সুরাহাই হইব না ।

কেশব দত্তও তাই চায় ৷

সেও বলে—ঠিক কথাই বলেছ তুমি, ওখানে না গেলে সব না দেখলে কিছু করা যাবে না। তাহলে এসো তোমরা ।

তারপরই বলে—গাছে এত আম কাঁঠাল-পুকুরে রকমারি মাছ। খয়রা বাটা—মৌরলা ইয়া সাইজের, এসব থেকেও এখন খাওয়াতে পারব না তোমাদের।

হোঁৎকা বলে—তার জন্যই যাইত্যাছি, দেখবেন সব ঠিক হই যাইব।

কেশব দত্ত বলে—তোমার মুখে ফুল-চন্দন পড়ুক বাবা। হোঁৎকা যে ফুল-চন্দনে আদৌ আগ্রহী নয়, তা কেশব দত্ত এখনও টের পায়নি।

পটলা বলে—এখন তো গরমের ছুটি। চল, দেশভ্রমণও হবে আর পিসার ভাইয়ের- কাজটা যদি উ—উ—

ওর জিভ বিট্রে করছে। মাঝে মাঝে ওটা হয়। আমি বলি, যদি উদ্ধার হয়।

পটলা ততক্ষণে ফ্রি হয়ে বলে—হ্যাঁ। তাহলে চল ওই পিসার ভাইয়ের দেশে।

ঠাকমা বলে হ্যাঁরে, ওই বটকেষ্ট।

না, ধনকেষ্ট, কেশব শুধরে দেয়।

ঠাকমা বলে—ওই ধনকেষ্ট শুনি সাংঘাতিক লোক। কোনো বিপদ আপদ হবে না তো। এসব লোক খুব বদবুদ্ধি ধরে।

কেশব দত্ত চুপ করে থাকে।

পটলাই বলে—ভয় পেয়ো না ঠাকমা। মেজকাকার বন্ধু ওই হুগলির এখন এস-পি তা জেনেছি।

হোঁৎকা অভয় দেয়—কোনো ভয় নেই ঠাকমা ৷

ফটিক গেয়ে ওঠে—দুর্গম গিরি, কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।

কেশব বলে তাহলে তোমরা এসো এই সপ্তাহেই। আমি কাল বাড়ি ফিরে গিয়ে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। আর পথ খরচা বাবদ—

কিছু টাকা বের করতে যাবে সে, ঠাকমা বাধা দেয়।

ওসব থাক কেশব। ওরা যাবে তার ব্যবস্থা সব আমিই করে দেব। তোমাকে ভাবতে হবে না। কোন্ পথে কীভাবে যাবে তুমি সেই সব বলে দাও। তোমাদের গ্রাম তো বহু দূরে, সভ্য জগতের ম্যাপে তার লেখাজোখাও নাই। তুমি কথা বলো-আমার পূজাপাঠের সময় হয়ে গেছে, উঠছি।

ঠাকমা চলে গেল। এবার স্নান করে পুজোয় বসবে। সেও ঘণ্টা কয়েকের ব্যাপার ।

কেশব দত্ত আমাদের তার গ্রামে যাবার পথ-যান-বাহনের কথা বলতে শুরু করে ।

ক’দিন পরই আমরা বের হবো।

এর মধ্যে ক্লাবে আমাদের বেশ কয়েকবার মিটিং-ও হয়েছে। শরৎ উকিলের কে সম্বন্ধী চুঁচড়ো কোর্টের উকিল তার নামেও চিঠি নেওয়া হয়েছে। মেজকাকাও এর মধ্যে ফোনে চুঁচুড়ার পুলিশের বড় সাহেবের সঙ্গেও কথা বলেছেন। আমাদের হাতে একটি চিঠিও দিয়েছেন তাঁকে।

এর মধ্যে হোঁৎকা তার কিছু চটপট ছদ্মবেশের সাজসরঞ্জামও নিয়েছে। নাইলন দড়ি, টর্চ, কিছু জরুরি ওষুধপত্রও সঙ্গে নিতে হয়েছে। পল্লীগ্রাম-হুট করে ডাক্তারও মিলবে না। তাই প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা দরকার।

ঠাকমা আমাদের প্রায় হাজারখানেক টাকা দিয়ে বলে, টাকাটা কাছে রাখবি।

হোঁৎকা বলে—এত টাকা! গাড়ি ভাড়া তো মাত্র পঁচিশ টাকা। যাতায়াত পঞ্চাশ- ঠাকমা বলে—বিদেশ বিভুঁই জায়গা। ওটা কাছে রাখ। আর সাবধানে থাকবি পটলা।

পটলা বলে—এ নিয়ে তুমি ভেব না।

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের দরজা ক’দিনের জন্য বন্ধ থাকল। আমরা মাঝে মাঝে এমন অভিযানে বের হই, তাই সকলেই জানে এটা—যে আবার বের হয়েছি।

পথটা যে এত জটিল তা জানতাম না ।

চুঁচুড়া স্টেশনে নেমে বাসে করে যেতে হবে পতিপুর। সেখানের হাটতলায় ওই বাস ছেড়ে দিয়ে আবার সেখান থেকে হাড়ভাঙা হলুদপুরের বাস ধরতে হবে।

অবশ্য বাস হাড়ভাঙা হলুদপুর অবধি যাবে না, ওখান থেকে একটা খাল পার হয়ে ওপারে পঞ্চায়েতের রাস্তা। সেখানে ভ্যান রিকশা মেলে—ওতে চেপে না হয় হেঁটে মাইল তিনেক গেলে তবেই সেই হাড়ভাঙা হলুদপুর পৌঁছানো যাবে।

হোঁৎকা বলে—তর পিসা আর গাঁ খুঁজে পায় নাই নাকি রে পটলা? ওহানে মানুষ থাকে ? ফটিক বলে—ওই তো আদর্শ গ্রাম। প্রকৃতির আদর্শ কোলে মুক্ত বায়ু।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে–কাব্যি করিস না ফটিক! তার চেয়ে বাদাম টাদাম পাস তো দ্যাখ, মুখে কিছু দিতি হইব। লং জার্নি।

গোবরাও শোনায়—দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর—

আরও শোনাতো সে, হোঁৎকার চাহনিতে থেমে গেল। আর এই সময় বাদামওয়ালাও এসে পড়ে ট্রেনে। হোঁৎকা শুধোয় এক ডজন প্যাকেট ও বাদামের ওইই দাও গিয়া। তা ফেরেস হইব তো?

বাদামওয়ালা একডজন প্যাকেট বাদামভাজা খানেওয়ালা পার্টি বিশেষ দেখেনি, আর সাতসকালেই এমন রসাল খদ্দের দেখে বলে-একেবারে খোলা থেকে নামিয়ে আনছি বাবু, হাতে গরম। দেখুন

হোঁৎকা এক ডজন বাদামের প্যাকেট নিয়ে জলযোগ শুরু করে ট্রেনেই, ট্রেন তখন শ্রীরামপুর ছেড়ে এগিয়ে চলেছে, চুঁচুড়া স্টেশন আসতে তখনও অনেক দেরি।

চুঁচুড়া স্টেশনে নেমে ওদিকে রেললাইনের নীচে অপেক্ষা করতে একটা পোলবার বাস এসে গেছে, হোঁৎকার ইচ্ছা ছিল স্টেশনের ওদিকের দোকানে গরম কচুরি ভাজছে-সেখানে বসে প্রাতরাশ সারার।

বলে—সমী, কচুরির খাসা গন্ধও উঠতাছে। গরম কচুরি খানকয় করি খাই ল। ওই পোলবায় কি পাইব কে জানে।

ফটিক বলে দীর্ঘ পথ, কিছু –

এমন সময় বাসটা এসে পড়ে, কনডাকটার হাঁকছে পোলবা পোলবা। খালি গাড়ি— পরের বাস আধা ঘণ্টাখানেক পর।

ওখান থেকে অনেক গোলমালের পথ। তাই বলি—কচুরি এখন থাক। যতটা পারিস এগিয়ে চল, পোলবাতেই খাবি।

পটলাও বলে—ওখানের পরোটা দারুণ। উইথ ছোলার ডাল। এখন বা-বাসে ওঠ।

অগত্যা মুখবুজে হোঁৎকা বাসে উঠল। গোবর্ধন উঠেছে। কনডাকটার হাঁকছে—খালি গাড়ি—খালি গাড়ি—

ফটিকের মেজাজটা ভালো নেই।

খাবারও জোটেনি, এমন গরম কচুরির লোভ ছাড়তে হয়েছে, সে বাসে উঠে বলে কনডাকটারকে খালি গাড়ি হাঁকছ, খালি কোথায় ?

ফটিক গর্জায় সব সিটই তো ভর্তি।

এর মধ্যে সব সিট বোঝাই। ভিতরে দাঁড়াবার উপায় নেই, চুঁচড়োর এত মানুষ যে পোলবার দিকে যাতায়াত করে জানা ছিল না।

কনডাকটার বলে—এখনও ফাঁকা? দেখছেন না। দাঁড়াবার জায়গা তো দিব্যি রয়েছে। দাঁড়িয়ে যেতে পারছেন এই বাপের ভাগ্যি। ঝুলতে তো হয়নি। অর্থাৎ ঝুলে যাওয়াই এখানের রীতি।

বাস চলেছে। আর দিল্লীরোড পার হয়ে যত গ্রামের দিকে চলেছে তত ভিড় বাড়ছে। পোলবার আজ হাট, তাই দুনিয়ার ব্যাপারী তাদের মালপত্তর নিয়ে ঠেলে উঠছে, কে আবার দুটো ছাগল, মায় বাচ্চা নিয়ে উঠেছে।

বাসটায় আর তিল ধারণের ঠাঁই নেই। আকণ্ঠ বোঝাই বাসটা টালমাটাল খেতে খেতে চলেছে। খানাখন্দে বোঝাই রাস্তা, মনে হয়, যে কোনো মুহূর্তে উলটে পড়বে, আর ভিতরে গুড়ের নাগরীর মত ঠাসা অবস্থাতেই দমবন্ধ হয়ে মারা পড়তে হবে ।

ঘেমে নেয়ে উঠেছি।

শেষ অবধি বাসটা এসে পোলবাতে নিরাপদে পৌঁছাল আমাদের ভাগ্যের জোরেই। নেমে যেন ধড়ে প্রাণ পাই ।

একে একে আমাদের পুরো টিমই নেমেছে মালপত্র নিয়ে, অবশ্য জামাগুলো ঘামে ভিজে তখন লাটপাট হয়ে গেছে। যেন হাঁড়ির ভেতর থেকে বের করে ওসব পরা হয়েছে। হাটতলা বিশাল এলাকা জুড়ে।

আর লোকজন—পসারীর দল জুটেছে অনেক। বিকিকিনি চলেছে।

এই ভিড় থেকে বের হয়ে ওপাশে একটু ফাঁকা মাঠের ধারে বটগাছের নীচে একটা খাবারের দোকানের বাইরে মাচায় বসে দম নিতে থাকি ।

এদিকটা কিছু ফাঁকা—পিছনে একটা বড় দিঘি, তার থেকে কিছুটা ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ওখানে বসে একটু দম নিয়ে এবার দোকানীকে জানাই—হাড়ভাঙা হলুদপুরের বাস কোথায় পাব ?

দোকানদার তখন আলুর চপ আর বেগুনি ভাজতে ব্যস্ত। তার সহকারী ঠোঙায় করে মুড়ি আর তেলেভাজা উইথ কাঁচালঙ্কা সাপ্লাই করছে খদ্দেরদের।

ছেলেটাই বলে—সে তো এই পুকুরের ওপারে ছাড়ে। তা এখনও দেরি আছে। আধঘণ্টা তো হবেই ৷

দুটো লোক ওদিকে বসে গব গব করে আলুর চপ আর মুড়ি খাচ্ছিল। কড়াই থেকে তোলা সদ্য ভাজা চপগুলোকেই গবাগব এভাবে কেউ গিলতে পারে জানা ছিল না। তাদের বোধহয় আগুন খাওয়াই অভ্যাস। ওরা আমাদের দিকে চাইছে।

হোঁৎকার পেটে তখন আগুন জ্বলছে, ফটিকও বলে বাসের দেরি রয়েছে। দুপুরে কখন পৌঁছব ঠিক নাই, এখানেই কিছু খেয়ে নে পটলা ।

হোঁৎকা বলে—না কচুরি! হালা মুড়ি চপ আর রসগোল্লাই দাও হে—একটু বেশি কইরাই দিবা ।

হোঁৎকা গণ্ডা তিনেক চপ আর ছোট একহাঁড়ি রসগোল্লা আর এক সানকি মুড়ি নিয়ে বসেছে জলযোগে। আমরা ভয়ে ভয়ে কিছু খেয়ে নিই। এরপর শুরু হবে যাত্রা, হাড়ভাঙা না মাথাভাঙা কোন্ গ্রামে কে জানে?

বাসটাকে দেখা যায় না।

একটা যেন মালপত্রের স্তূপ। বাইরে দুদিকে উপরে আর নীচে একটা করে বাঁশ বাঁধা। গাড়ির ভিতরে আর তিল ধারণের ঠাঁই নেই।

ছাদে আনাজপত্রের বস্তা, ঝুড়ি, মুরগির চ্যাঙাড়ি তার উপর সারবন্দি মানুষ বসেছে, আর এবার গাড়ির দুপাশে ওই বাঁশের উপর দাঁড়িয়ে আর একটা বাঁশ ধরে দুদিকে তা প্রায় জনা তিরিশ লোক ঝুলন্ত অবস্থায় যাবে।

আমরা ভিতরে ঠাঁই পাইনি, বাসের ছাদে দুটো বাঁধাকপির বস্তার উপর বসেছি।

ওপাশে দেখি দোকানের দেখা সেই দুটো লোকও রয়েছে। একজনের মাথায় চুল এক গাছিও নাই, প্রকাণ্ড টাক ঝকঝক করছে আর গোঁফজোড়াটা বেশ পুরুষ্ট। বিড়ালের ল্যাজের মত। অন্যজন জীর্ণ তবে নাকটা বড় যেন শকুনির মত ।

সে-ই শুধোয় হাড়ভাঙা হলুদপুর যাবে কার বাড়িতে? যেন কৈফিয়ত চাইছে সে। আমি দোকান থেকেই লোক দুটোকে দেখছি, কেমন ভালো লাগে না ওদের চাহনি। গোঁফওয়ালা লোকটা শুধোয়—কুথা থেকে আসা হচ্ছে? এ্যা কলকাতা থেকে?

লোকটা ঠিক বাঙালি নয়, তবে দীর্ঘদিন বাংলামুলুকে রয়েছে, বোধহয় তাই বাংলা কিছু শব্দ দেশওয়ালী ঢংয়ে বলতে শিখেছে।

আমি জবাব দিই না ।

হোঁৎকা তখন এই একধামা মুড়ি আর দেড় ডজন চপ উইথ একহাঁড়ি রসগোল্লা সেবন করে ঝিমুচ্ছে, গোবরা বলে — হ্যাঁ ।

-তা যাওয়া হবে কুথায় ? কার বাড়ি?

ফটিক তখন ওই বাসের টংয়ে চড়ে গুনগুন করে সুর ভাঁজছে। বাসটাও বেশ তালে তালে ওই হাড়গোড় ভাঙা রাস্তায় নেচে কুঁদে চলেছে সর্বাঙ্গে মানুষের চাদর জড়িয়ে।

চৈতমাসের মাঝামাঝি এর মধ্যেই দুপুরের রোদ যেন অগ্নিবৃষ্টি শুরু করেছে। বাতাস তো নয় যেন আগুনের হল্কা। বাসের ছাদে বসে রোস্ট হতে হতে চলেছি। এই পথের যেন শেষ নাই ৷

বাসটা থামছে, দু চারজন নামছে তো পাঁচজন ঠেলে উঠছে। যে যা পাচ্ছে তাই ধরে ঝুলে পড়ছে। একজন তো গোবরার ঠ্যাং ধরেই ঝুলছিল। কোনোমতে গোবর্ধন বলেই সামলে নিয়েছে। ওদিকে টাকওয়ালা তখনও জেরা করছে-কুথায় যাবে, কার বাড়ি?

আমিই বলি-থাম তো, রোদে গরমে মরছি ওকে জবাব দিতে হবে, চুপ করে বোস ।

লোকদুটো আমার জবাবে খুশি হয় না।

একজন বলে—কোই বাত পুছলে তার জবাব দিতে হয় খোকাবাবু। না দাও দিবে না। লোকটা আমাকে যেন শাসাচ্ছে।

হোঁৎকা চোখ খুলে দেখে আবার শিবনেত্র হয়ে ওই বাসের দোলানিতে ঝিমুতে থাকে। ঘণ্টাদেড়েক অন্তত রোদে পুড়েছি। উঃ, কি যাত্রা রে বাবা! পটলাকে শুধাই আর কতদূর রে?

পটলা বলে, এসে গেছি। ওই তো বাস থেকে ওখানে নামতে হবে ওটাই হাড়ভাঙার স্টপেজ।

শেষ অবধি এই যাত্রার পর্বও শেষ হয় ।

রাস্তার ধারে কয়েকটা চালাঘর। দু-চারটে পুরোনো বট অশ্বত্থ গাছ জায়গাটাকে ছায়াঘন করে রেখেছে মাঠের মধ্যে। মরুভূমির মধ্যে এটুকু যেন মরূদ্যানই

এখানে নেমে এবার ধড়ে প্রাণ ফিরে পাই। দুটো বাস জার্নি করে অর্ধেক প্রাণ যেন শেষ হয়ে গেছে। বাস থেকে নেমে দেখি যাত্রীরা এক জায়গায় ভিড় করেছে। যেন সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে। হইচই চলছে।

পরে দেখি সাংঘাতিক কিছু নয়। একটা টিউবওয়েলকে ঘিরে জলপানের প্রতিযোগিতা চলেছে। বাসটা বেশ কিছুক্ষণ এখানে এর জন্যই দাঁড়ায়। কনডাকটার ওদিকের খাল থেকে এক বালতি জল তুলে এনে গাড়ির রেডিয়েটারে জল ঢালছে—তখনও ওর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।

গাড়ির অবস্থাও আমাদের মত।

গাছতলার একটা চায়ের দোকানে বসে আমরা তখন ডাঙায় তোলা কাতলা মাছের মত খাবি খাচ্ছি।

হোঁৎকা বলে—তর পিসের ভাইয়ের সম্পত্তির দাম এখানে কানাকড়িও নয়। এখানে মানুষ থাকে?

চা দিক! সঙ্গে ওই বিস্কুট গণ্ডা দুই ।

বলি—এত খেলি একটু আগে!

হোঁৎকা বলে–পথের ধকল দেখসনি? সব হজম হই গেছে গিয়া ।

পটলা বলে–পিসের ভাইয়ের গাঁয়ে এসে গেছি। —গিয়েই তো ভাত খাবি ।

দোকানদার বলে—কোথায় যাবেন আপনারা

– হাড়ভাঙা হলুদপুর।

দোকানদার শুধোয়—কলকাতা থেকে আসা হচ্ছে বাবুদের? এর কণ্ঠস্বরে বিনীত ভাব। তাই বলি—হ্যাঁ।

এরপরই দোকানদার গলা তুলে হাঁক মারে–ওরে জগা, বেন্দা-এনারা এইসে গেছেন এই যে—হেথায়। পিসের ভাই বোধহয় আমাদের নিয়ে যাবার জন্য কোনো লোকজনকে পাঠিয়েছে। হাজার হোক কুটুম বাড়ির লোক। মান খাতির তো দেখাতেই হবে।

ওই দোকানদারের ডাকে এর মধ্যে তিনচারজন ছেলে, একজন মোটকা দাঁত বের করা লোকও এসে হাজির হয়। একজন সাইকেল ঠেলেই চলে আসে।

মোটকা দাঁতাল বনশুয়োরের মত লোকটা বলে—আসুন, আসুন। আপনাদের জন্যই এসেছি। ওরে গুপী, চা বিস্কুট দে, জল খাওয়া।

অন্যজন গদগদ হয়ে বলে—পথে কষ্ট হয়নি তো?

ওদের কথায় গোবরা বলে, যা ভিড় বাসে ।

একজন বলে, আজ তবু বাসে উঠতে পারছেন, অন্যদিন তো কাছেই যাওয়া যায় না। আমাদের জোর বরাত আপনারা এসে পড়েছেন ।

ফটিক তখন চায়ের কাপ তুলে মুক্ত প্রকৃতির ওই ঝলসানো সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে খুব জোরসে কালোয়াতি গানের সেই কলিটা গেয়ে চলেছে।

-সইয়া-না মারো-

মাচার উপর তখন সুর নিয়ে জোর মারামারি চলছে। উপস্থিত ওই মানুষগুলো যে কালোয়াতি গানের এত ভক্ত তা জানা ছিল না।

তারপর ওরাই আমাদের চা বিস্কুটের সব খরচা দেয়। একজন দৌড়ল ওপারে ভ্যান ঠিক করতে। পিসের ভাই আমাদের আপ্যায়নের এমনি ব্যবস্থা রেখেছিল তা জানতাম না ।

এর মধ্যে ওই চার-পাঁচজন পিছনে আরও বেশ ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে। আমাদের দিকে চেয়ে দেখছে তারা সম্ভ্রমপূর্ণ চাহনিতে।

কলকাতা নামক এক আজব জায়গা থেকে আমরা কটি বিচিত্র প্রাণী যেন ওই জগতে অবতীর্ণ হয়েছি নেহাত দয়া করেই।

ওই টাক আর গোঁফওয়ালা আর সেই প্যাকাটির মত লম্বা ওর অনুচর দু’জনে ওদিকের একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চেতে বসে আমাদের দিকে নজর রেখেছিল।

ওরা পোলবা থেকেই আমাদের সঙ্গে রয়েছে, নানা প্রশ্নও করেছে। টাকওয়ালা লোকটা তো রীতিমতো শাসানিই দিয়েছিল, কেন এখানে এসেছি তা বার বার জানতে চেয়েছিল। এবার আমাদের ওই দলপরিবৃত হয়ে যেতে দেখে ওরাও আমাদের পিছু ছেড়ে চলে গেল।

দোকানগুলোর পিছনেই একটা খাল। খালে জল যত না রয়েছে কাদা আর কচুরিপানা রয়েছে তার তুলনায় অনেক বেশি। আর সাঁকো বলতে আড়াআড়িভাবে দুখানা বাঁশ ফেলা আর ধরার জন্য রয়েছে একটা আলগা বাঁশ।

ওই দুখানা বাঁশের উপর দিয়েই ভারী বোঝা মাথায় নিয়ে গড়ের মাঠে ভেল্কিওয়ালাদের দড়ির উপর হাঁটার খেলার মত হেসে খেলে পার হয়ে চলেছে।

আমাদের ত ওই বাঁশবাজি দেখিয়ে পার হতে হবে ওই খাল। নড়বড় করছে খাঁচা, আর পিছলও। পা ফসকালে ওই কচুরিপানার দামে কাদার মধ্যে পুঁতে যেতে হবে। খুঁজে পাওয়া যাবে না।

হাড়ভাঙা হলুদপুর আসার যে এত দুর্ভোগ তা জানতাম না। গোবরা বলে–এর চেয়ে গৌরীশঙ্কর পর্বতের চূড়ায় ওঠা যে সহজ রে?

তবু ওই বাহিনী হাত ধরে কোনোমতে পার করে আমাদের। শুধোই—আর কতদূর?

একজন আঙুল দেখায়, দূর দিগন্তে লি লি করছে গ্রামসীমা—মাঠের বুক চিরে পঞ্চায়েতের তৈরি ইট পাতা একটা ফিট আষ্টেক পথের ইঙ্গিত ।

মোটকা লোকটা বলে—এই খালের উপর সাঁকো আর রাস্তা পাকা করার জন্য কয়েক লাখ টাকা স্যাংশন করা হয়েছিল। তা পঞ্চায়েত প্রধান ওসব না করে স্রেফ তিনখানা বাঁশ খরচা করে এই সাঁকো করেছে আর পিচ রাস্তার বদলে যা হয়েছে দেখছেন তো।

গোবরা শুধোয়, বাকি টাকা !

কে শোনায় ওসব। গেছে ধনকেষ্টবাবুর পকেটে। ওইই তো অঞ্চল প্রধান। ধনকেষ্ট নামটা চেনাই বোধ হয় ।

এ সেই পিসের ভাইয়ের জমি পুকুর বাগান হড়কাবার পার্টি। অর্থাৎ ধনকেষ্ট তাহলে এখানে জমিয়েই বসেছে, সব দিক থেকেই লুটপাট করছে।

বলি—ওকে সরাতে পারছে না এখানের লোক?

লোকটা বলে—চেষ্টাতে তো আছি আমরা, বাদলদাও বেশ উঠে পড়ে লেগেছে, এখানের মাস্টার, দেখা যাক কি হয়।

চলুন! গাড়ি তৈরি।

গাড়ি বলতে দেখি একটা খোলা ভ্যান রিকশা। ওতে ধানের বস্তা, গুড়ের টিন, মালপত্র বওয়া হয়, অভাবে যাত্রীও বয়।

তক্তাপাতা। কে বলে।

—বাবুদের জন্য দুটো বস্তা ফস্তা আন, বাবুরা বসবে-কে দুটো ধান ঝাড়া বস্তা এনে পেতে দেয়।

এবার আমাদের যাত্রা শুরু হল ।

গ্রামের নাম কে রেখেছিল হাড়ভাঙা তা জানি না, তবে এখানে আসতে গেলে হাড়গোড় যে ভাঙা খুবই সম্ভব তা বুঝেছি।

ওই ইটপাতা রাস্তার বহু জায়গায় ইট আর নেই, স্থানে স্থানে গর্ত হয়ে গেছে। ভ্যান রিকশায় আলুর বস্তা যায় আছাড় খেতে খেতে। তারা প্রতিবাদ করে না। কিন্তু মানুষ নামক জীব আর্তনাদ করে ওঠে।

কোমর যেন দেহছাড়া হয়ে যাবে, না হয় পাঁজরই ভেঙে দু-টুকরো হবে। আর মাথার উপর ওই রোদ। গ্রামসীমাও তেমনি অধরাই রয়েছে বেলা তিনটে বেজে চারটে হতে চলেছে। ভোরে কলকাতা থেকে বের হয়ে চলেছি এখনও পৌঁছবার নাম নেই ।

গাড়ির সঙ্গে ওরাও দলবেঁধে আসছে।

এবার এসে পৌঁছলাম গ্রামে। বাঁশবন আর বাঁশবন। জমাট অন্ধকার নেমেছে বাঁশবনে। পথের দুদিকে ঘনসন্নিবিষ্ট বাড়ি—এদিকে ওদিকে শুধু ডোবা আর বনবাদাড়। ওপাশে একটা পুরোনো আমলের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ঢোকাল ।

এককালে বেশ বনেদি জমিদার বাড়িই।

এখন পড়ন্ত অবস্থা। কাছারি বাড়িটা শূন্য ওদিকে ভেঙে পড়েছে। লোকজনও নাই। এককালে এখানে নায়েব, গোমস্তা প্রজা পাটকের ভিড় ছিল ।

আজ কেউ নেই ।

কাছারি বাড়ি পার হয়ে একটা ঢাকা বারান্দা দিয়ে ওপাশে আবার অন্যমহলে গিয়ে চোরা সিঁড়ি দিয়ে দোতলার একটা ঘরে তুলল।

আশেপাশে কোনো অন্য বাড়ি নেই।

এখানেও লোকজন বিশেষ আছে তা মনে হয় না ।

এই ক’জনই এল আর এবাড়ি থেকে একটা লোকও নীচে থেকে উঠে এল এ ঘরে। মেঝেতে ঢালাও ফরাস পাতা—ওদিকে জলের কুঁজো গেলাসও রাখা আছে। অর্থাৎ আমাদের আসার খবর জানা ছিল তাই সব ব্যবস্থাও করেছে।

সেই কালো মুষকো লোকটার নামও জেনেছি এর মধ্যে। ওর নাম বংশীগোপাল বাগ। অবশ্য বাগ না বলে ওকে বনশুয়োর বললেই ভালো হত। কথা বলে যেন ঘোঁৎ ঘোঁৎ করছে। ওকেই শুধোই—কিন্তু কেশববাবুকে দেখছি না ?

বংশীগোপাল বলে–দেখবে বইকী। সবাই আসবে। এর মধ্যে সেই বাড়ির লোকটা বলে—ওদিকে চানের জল রাখা আছে। চানটান করে নিন। ছেলেদের একজন বলে, হ্যাঁ, খুব ধকল গেছে। চানটান করে খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম করুন। সন্ধ্যার আগেই আসছি। ওদিকে সব ব্যবস্থা করতে হবে। ওরা তো চলে গেল ।

তখন শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে। তবু শুধোই—কিরে পটলা, তোর পিসের ভাইকে দেখছি না! হোঁৎকা তখন মাংসের খোশবু পেয়েছে বাতাসে, বলে সে, চান কইরা খাই ল । আইব এবার ওর পিসার ভাই ।

হোঁৎকা জামা খুলে বাতাসে আর একবার ঘ্রাণ নিয়ে বলে—মাংসটা ভালোই জমবে মনে হয়। আমি চান কইরা আইত্যাছি।

কুয়োর ঠান্ডা জলে স্নান করার পরেই খিদেটা এবার যেন চড়চড়িয়ে ওঠে। আর আয়োজনও ভালোই করেছে। তখন আর অন্য কিছু ভাবার সময়ও নাই।

গরম গরম ভাত, পটল ভাজা আর মাংসের ঝোল। মাংসও বেশ অনেকটা করে। আমরাও তার সদ্ব্যবহার করতে দ্বিধা করি না। আমের চাটনিটাও বেশ মুখরোচক করেছে। হোঁৎকা কেজিখানেক মাংস আর হাফ কেজি চালের ভাত শেষ করে এবার চিৎপাত হয়ে পড়ে সেই ঢালা ফরাসে।

একা হোঁৎকাই নয় আমরাও গড়ান দিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না।

সেই মোটা টাকওয়ালা লোকটার বিড়ালের ল্যাজের মত গোঁফ দুটো ফুলে উঠেছে। আমার বুকের উপর বসে যেন গলা টিপছে আর ওই সিঁটকে লোকটা একটা দা হাতে গর্জাচ্ছে।

হঠাৎ ওদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যায়। ধড়ফড়িয়ে উঠি, সেই টাকওয়ালা নয় বংশীগোপাল বাগ ডাকছে-দাদা! ও ভাইটি-এবার উঠে পড়ো। ওই যে গোবর্ধন বাবু—

ওদের ডাকাডাকিতে উঠে বসলাম। তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। ঘরে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে। তার আলোয় দেখি একা বংশী নয় সঙ্গে আরও বেশ কিছু কিছু ছেলেপুলেই রয়েছে। আর একজন একটা বড় জগে ধূমায়িত চা আর কয়েকটা মাটির গেলাস এনে চা-ও দেয়। আমরা চা খেতে থাকি।

এবার খেয়াল হয় কেশব দত্তের কথা। পটলার সেই পিসার ভাইয়ের এখনও দেখা নেই ।

বাইরে কোথায় মাইকে ঘোষণা চলছে।

কোথাও কোনো অনুষ্ঠান হবে বোধহয়, তার জন্য সে মাইকে তারস্বরে ঘোষণা করছে।— কলকাতার নামিদামি শিল্পী, গায়করা এসে গেছেন। তাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। তাদের অনুষ্ঠান দেখে জন্ম সার্থক করুন। এমন সুবর্ণসুযোগ হাড়ভাঙা হলুদপুরে আর পাবেন না। এ সুযোগ হেলায় হারাবেন না। আসুন রিকশায় হেঁটে দৌড়ে আসুন। সঙ্গে চট আনতে ভুলবেন না। চট লিয়ে আসবেন, প্রবেশ মূল্য তিন টাকা—দু টাকা মাত্তর ।

চট বগলে করে অনুষ্ঠান দেখার এদের আমন্ত্রণ আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। তাহলে এখানেও এত দূরে শিল্পপ্রেমী মানুষ আছে। আরও সান্ত্বনা পাই যে কলকাতার নামিদামি শিল্পীরা এখানেও আসে টুপাইস আমদানির জন্য।

চা পর্ব শেষ হতে পটলাই বলে—পিসের ভাই মানে কেশববাবুকে খবর দিন। তার সঙ্গে জরুরি দরকার আছে।

বংশী বলে—দরকার আবার কিসের স্যার? পুরো ক্যাশ তো আগাম মিটে দে এসেছি আপনার ভাইয়ের হাতে-

কি বলছেন এসব? চমকে উঠি আমি।

বংশীর এক চ্যালা বলে।—দুনম্বরী করে এখান থেকে সটকাতে পারবে না ছোকরা। গাঁয়ের নাম জানো? হাড়ভাঙা হলুদপুর। হাড় ভেঙে হলুদ পুরে দেব।

এবার ব্যাপারটা আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে।

আমি বলি—এসব ভুল বলছেন—আমরা কেশব দত্তের বাড়িতে যাচ্ছিলাম। এখানে আপনারাই এনে তুলেছেন।

বংশী বলে—তাহলে আপনারা আমাদের ফাংশানের জন্য আসেননি?

না। কিছুই জানি না আপনাদের অনুষ্ঠানের কথা। কিছু বলতে দিলেন না। এনে তুললেন এখানে, ভাবলাম কেশব দত্তেরই লোক আপনারা।

এমন সময় একটা ছেলে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে-সব্বোনাশ হয়ে গেছে বংশীদা !

বংশী বলে, কী হল? তুই তো গেছলি চুঁচড়ো স্টেশনে-

ছেলেটা বলে—কিন্তু ওখান থেকেই ওই ধনকেষ্টবাবুর লোকেরা গাড়ি নিয়ে গেছল, ওরাই আমাদের কলকাতা থেকে আসা শিল্পীদের তুলে নিয়ে আগে চলে এসেছে।

অন্যজন বলে।—এমনি কাণ্ড করবে ওই ধনকেষ্টর দল তা জানতাম। ওরা আমাদের ক্লাবের বেইজ্জত করবে। এদিকে বিবেক আর ভীম করার কেউ নাই, প্যানডেলে আগুন জ্বলবে।

বংশী বলে—সর্বনাশ হয়ে গেল। ভুল করে এদের তুলে আনলাম আর আসলি মালদের নে পালাল ওই ধনকেষ্টার দল। এখন কী হবে?

কে বলে—কেটে পড়ো দাদা গাঁ থেকে ।

ওদিকে প্যানডেল জ্বলবে, লোকজন মারদাঙ্গা করবে। উঃ ধনকেষ্ট আর কত শত্রুতা করবে আমাদের সঙ্গে। সব শেষ হয়ে গেল।এখন কি অনুষ্ঠান হবে।

কর্ণবধ পালায় নিয়তি ভীমই তো মেন পাৰ্ট ?

ওই নাটক আমাদের ক্লাবে এবারই করেছি। আর ফটিক নিয়তির রোলে ফাটাফাটি পার্ট করেছে, ভীম তো গোবর্ধন একেবারে অরিজিন্যাল। পটলাও ভালো গাইতে পারে। ওরা সত্যিই বিপদে পড়েছে ওই ধনকেষ্টর জন্যই। অনুষ্ঠান পণ্ড হলে সর্বনাশ হবে। ধনকেষ্টই তার লোকদের গোলমাল করতে পাঠাবে নিশ্চয়ই।

তাই ওদের বিপদের গুরুত্ব বুঝে বলি।—আপনাদের কর্ণবধ পালার নিয়তি, ভীম সবই পাবেন। একেবারে টপ।

ওরা যেন অকূলে কূল পায়। বলে—সত্যি !

—হ্যাঁ।

ফটিককে দেখিয়ে বলি—ও নিয়তি করেছে অন্তত কুড়ি নাইট। দারুণ গায়। আর ভীম ওই তো।

গোবর্ধনকে দেখছে ওরা। এবার ওদের মনে আশার আলো জাগে।

বংশী বলে—করবে ভাই? কোনোমতে রাতটা উদ্ধার করে দাও, বংশী বাগ তোমাদের জন্য জান লড়িয়ে দেবে।

কে বলে আজকের রাত পার হোক, তারপর ধনকেষ্টকে দেখব। আমাদের ক্লাবের পিছনে লাগা জন্মের মত ঘুচিয়ে দেবো।

বংশী বলে, পরের কথা পরে। এখন বলি জোর জোর মাইকিং কর। ব্যাটা ধনকেষ্টর পাড়ায় মাইক ঘোরা। অনুষ্ঠান হচ্ছে। সবুজ সাথীর দলকে কেউ দমাতে পারবে না—আজকের পালা কর্ণবধ! ঠিক রাত্রি দশটায় শুরু হবে। সুরপার্টিকে টাইম থাকতে আসরে বসিয়ে কনসার্ট শুরু করতে বল।

গ্রামে ধনকেষ্ট যে নানা কাণ্ড ঘটায় তা এসেই জেনেছি। আমাদেরও ওই ধনকেষ্টর বিরুদ্ধে কার্যে নামতে হবে।

এখানে আমাদের চেনা জানা মদত করার মত কেউ নাই। কেশব দত্ত একা কি সাহায্য করতে পারবে তা জানি না। তাই এদের হাতে রাখতে হবে।

আর সেই সুবর্ণ সুযোগ এখন আমাদের হাতে এসে গেছে। হোঁৎকা বলে।

—তা বুদ্ধিটা মন্দ করিসনি সমী। ফটকে জান লড়িয়ে গাইবি, একটো করবি। গোবরা-ভীম যেন এক্কেবারে মার কাটারি ভীম হয়। পাট মুখস্থ আছে তো? ফটিক তো এমন সুযোগ পাবে গাইবার ভাবেনি। সে এর মধ্যে হারমোনিয়াম আর বাঁশিদারকে আনিয়ে সব গান ঝালিয়ে নিয়েছে। গোবরাও ভীমের পার্ট হাতে পেয়ে আর একবার সড়গড় করে নেয়।

কেশব দত্ত জানে আমরা আসছি, তার বাড়িতে সেও আমাদের পথ চেয়ে আছে। কিন্তু বেলা শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামে তবু আমাদের দেখা না পেয়ে হতাশই হয়।

বাড়িতে তার স্ত্রী বলে—এত দূরের পথ, হয়তো কাল আসবে। কিন্তু রান্নাবান্না করলাম ওদের জন্য। কিন্তু আমাদের দর্শনও পায় না। ওর স্ত্রী শুধোয়—হ্যাঁ গো, আসবে তো? না হলে কী হবে আমাদের? কেশব দত্ত তেমন কোনো সদুত্তরই দিতে পারে না।

বলে—কলকাতার ছেলে। আমাদের জন্য বিপদের মধ্যে কেন আসবে?

তবু কেশবের বৃদ্ধা মা বলে, ওসব কেন বলছিস? যখন পটলার বন্ধু তারা ঠিকই আসবে। যা পথঘাটের অবস্থা কোথায় আটকে গেছে, না হয় কালই আসবে বাছারা।

বাছারা অর্থাৎ আমরা তখন সবুজসাথী দলের প্যান্ডেলের সাজঘরে। আমিও ইয়া দাড়ি লাগিয়ে গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে কমণ্ডলু হাতে ঋষি সেজে বসেছি।

সে এক পেল্লায় কাণ্ড। ফটিক তো এখন লালপাড় শাড়ি পরে ফলস চুল লাগিয়ে একদম নিয়তি সেজে গুনগুন করে গানের কলি ভাঁজছে আর গোবরা গদা হাতে দাঁত কিড়মিড় করে ভীমের মত সাজঘরে পায়চারি করছে। কর্তৃপক্ষ হোঁৎকাকেও কি একটা পার্ট দিতে চেয়েছিল কিন্তু ওর ওই খাঁটি বাঙাল ভাষা শুনে আর সাহস করেনি।

কারণ মহাভারতে তেমন কোনো বাঙাল চরিত্র নেই। তাই হোঁৎকা পার্ট না করে ওদের ভলেনটিয়ারদের নেতাই সেজে গিয়ে যাত্রার আসর ম্যানেজ করতে শুরু করেছে।

প্যানডেল থইথই করছে। কলকাতার নামিদামি আর্টিস্টরা এসে গেছে। লোকজন যেন ভেঙে পড়েছে। আর যত জোরে কনসার্ট বাজছে ততই দর্শকরা টিকিট কেটে ঢুকছে। ঢোলেও চাঁটি পড়ছে আরও জোরে। গুরুগুরু শব্দ ওঠে, কর্নেটওয়ালা গাল ফুলিয়ে তত উচ্চগ্রামে কর্নেট বাজাচ্ছে।

ধনকেষ্ট এই দিগরের বিশিষ্ট ব্যক্তি। এককালে অবশ্য ওর পিতৃদেব হাড়ভাঙা হলুদপুরের জমিদার মিত্র চৌধুরীদের গোমস্তা ছিল। পাইক সঙ্গে নিয়ে গ্রামে গ্রামে মহালে গিয়ে খাজনা তুলে চেকমুড়ি দিত। জমিদারের হাটে গাছতলায় বসে পড়ে ব্যাপারীদের কাছে হাটের তোলা তুলত। সবই অবশ্য জমিদারের তহবিলে জমা পড়ত না। তার থেকে অনেক টাকাই নিজের ফতুয়ার পকেটে না হয় গোপনে কাছায় বেঁধে আনত।

এই নেওয়ার অভ্যাসটা বাড়তে বাড়তে ক্রমশ স্বভাবেই পরিণত হয়। টাকা থেকে সেটা উপরে উঠল, বেনামিতে জমিদারের খাস জমি, বাগান পুকুর এসবও গ্রাস করতে শুরু করল।

আর জমিদারবাবুও বৃদ্ধ হয়েছেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। জামাই কোথাকার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ফলে বাইরে থাকতে হয়। জমিদারবাবুর দেখাশোনা করার তেমন কেউ নেই ।

ফলে ধনকেষ্টর বাবা হরেকেষ্ট দাশই সর্বস্ব গ্রাস করল।

আর ধনকেষ্টও বাবার যোগ্য পুত্র। যোগ্যই নয় বোধহয় বদবুদ্ধিতে বাবাকেও ছাড়িয়ে যায়। জমিদারবাবু মারা যেতে ধনকেষ্ট এবার এক দলিল বের করে, তাতে দেখা যায় জমিদারবাবু নাকি তার বসতবাড়ি বেশ কিছু বাগান ওই ধনকেষ্টকে বিক্রি করেছেন।

সেই খবর পেয়ে ডেপুটিগিন্নি অর্থাৎ জমিদারের মেয়ে আসে। ধনকেষ্টও এসে এবার তার দলিলের কথা জানিয়ে এসবের দখল চায়। নানা বাদ-বিতণ্ডার পর জমিদারের মেয়ে বন্দনা দেবীই স্বামীর চিঠি পেয়ে ফিরে যায়।

আর ধনকেষ্টই রাতারাতি এখানের জমিদার হয়ে বসে। এখন সেই জমিদারি চলে গেছে। কিন্তু ধনকেষ্ট ওই বিশাল বাড়ি সব সম্পত্তি দখল করে নানা ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। টাকার জোরে আর গ্রামের লোকদের নানাভাবে শাসিয়ে ভোটে জিতে এখানের প্রধানের পদ পরপর চারবার কায়েম করে রেকর্ড করতে চলেছে। সামনের বারও জিতবে।

ধনকেষ্ট ওই হলুদপুরের সবুজসাথী দলকেই তেমন কায়দা করতে পারেনি। ওখানে নেতা বাদলমাস্টার বেশ সৎ আর জনপ্রিয়।

তার ক্লাবের ওই অনুষ্ঠানকে পণ্ড করার জন্যই ধনকেষ্ট গোপনে সব খবর রেখেছে। তার চেলাদেরও গতি সর্বত্র। তারাও চায় হাড়ভাঙা হলুদপুরে বাদলমাস্টার অপদস্থ হোক প্যানডেল এরাই জ্বালিয়ে দেবে। তাই ওদের অনুষ্ঠান পণ্ড করার জন্যই ধনকেষ্ট ওই তাপ সিং আর নন্দ মাতালকে পাঠিয়েছিলেন যাতে বাস থেকেই ওরা সেই যাত্রার দলের লোকদের বিদায় করে।

টাকমাথা তাপ সিং আর নন্দ ফিরে এসে বলে যাত্রার দলের লোক কেউ আসেনি। কটা ফচকে ছোঁড়াদের দেখলাম। কোনো পিসে না মেসোর বাড়িতে আসছে।

ধনকেষ্ট আরও সাবধানী ব্যক্তি। সে ওর আগেই স্টেশনেই লোক পাঠিয়েছে গাড়ি দিয়ে। তার বিশ্বস্ত অনুচর কালীচরণ নিজে গিয়েছিল আর চুঁচুড়া স্টেশনে ওই দলের পাঁচ-সাত জন সাজের বাক্স টাক্স নিয়ে নামতেই খপ করে তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে এসেছে গোবিন্দপুর ঘাট অবধি।

গোবিন্দপুর বেশ বড় গঞ্জ। ধনকেষ্টর সেখানে ধানকল আড়ত এসব আছে।

আর গোবিন্দপুরের খাল বেয়ে জলপথে আসা যায় হাড়ভাঙা হলুদপুর। জমিদার বাড়ির পিছনেই সেই খাল। ধনকেষ্ট দুটো মজবুত নৌকায় ঘর বানিয়ে মোটর ফিট করে নিয়েছে।

সে ওই মোটর বোট হাঁকিয়ে যাতায়াত করে আরামে। তার ওই পথের কোনো দরকার নাই। তাই ওই পথের জন্য টাকা ফি বছর স্যাংশান হয় পঞ্চায়েত থেকে, ব্রিজও করানো হয় খাতায়-কলমে। আর লাখখানেক টাকা প্রতিবছর ওখান থেকেই তার পকেটে আসে। রাস্তা যেমন ছিল তেমনিই থাকে।

ধনকেষ্টর লোক কালীচরণ এর মধ্যে ওই পার্টিকে এনে হাজির করেছে ধনকেষ্টর বাড়িতে। ধনকেষ্টকে তারা বলে—টাকা নিয়েছি, ওদের যাত্রার আসরে যেতেই হবে। কেন আটকে রেখেছেন? আমরা যাবই ।

ধনকেষ্ট গর্জে ওঠে—কালী, ওদের বলে দে, যেন বের হবার চেষ্টা না করে। করলে লাশ পুঁতে দেব খালের বালিতে।

ওদের কালী বলে—বাবুরা, খান দান ঘুমোন। কাল ভোরে লঞ্চে করে গোবিন্দপুরে তুলে দেব। রা কাড়লে বিপদ হবে। লোকগুলোকে আটকে রেখে ধনকেষ্ট খুব খুশি হয়ে ঘন ঘন পা নাচাতে নাচাতে বলে—কালী এবার বিশ-পঁচিশজন ছেলেকে পাঠা। রেডি হয়ে যাবে। ওদের প্যানডেলে আজ যাত্রা হবে না। ওরা গোলমাল করে চেয়ার টেয়ার ভেঙে ওদের মাইক লাইট যা পাবে লুট করে নেবে। তেমন বুঝলে প্যানডেল জ্বালিয়েই দেবে। কালীচরণ এসব কার্যে খুবই অভ্যস্ত।

সে বলে—এ তো সামান্য কার্য বাবু, হয়ে যাবে। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

এতক্ষণ ওই পাড়ার যাত্রার আসরের মাইকও নীরব ছিল। বংশীগোপাল, বাদল মাজীরা সবাই চরম বিপদে পড়েছে। বেশ বুঝেছে ধনকেষ্ট তাদের এইভাবে সর্বনাশ করেছে। যাত্ৰা হবে না। টিকিটও বিক্রি করেছে।

লোকজন আসছে, জনতার ভিড় বাড়ছে তারপর যখন খবর পাবে কলকাতার অভিনেতারা আসেনি তখনই প্যানডেলে দক্ষযজ্ঞ শুরু হবে।

ঘাবড়ে গেছে ওরা ।

মাইকের বাদ্যিও থেমে যায়। এমন সময় আমাদের আশ্বাস পেয়ে বাদলমাস্টার বলে–বাঁচালে ভাই।

বংশী বলে—তাহলে ভূষিমাল ধরে আনিনি। কেশবদাকেও খবর পাঠাচ্ছি। তোমরা সব

মেক আপে বসো !

তারপরই গলা তুলে প্রচার পার্টিকে বলে—মাইকিং কর। ওই ধনকেষ্টর বাড়ির সামনে দিয়ে জোর জোর করে মাইক বাজাবি ।

ধনকেষ্ট হঠাৎ একসঙ্গে এতগুলো চোঙা চারদিকে সরব হয়ে উঠতে অবাক হয় ৷ ওরা ঘোষণা করছে কলকাতার দলের অভিনেতৃবৃন্দ এসে গেছেন। তাদের মনমাতানো অভিনয় দেখে ধন্য হন। আসুন—ধেয়ে আসুন-দৌড়ে আসুন—হেঁটে আসুন! সার্থক পালা কৰ্ণবধ দেখুন।

ধনকেষ্ট গর্জে ওঠে,—কারা আবার এল রে? ওদের যাত্রা হবে বলছে। কালী বলে—কে জানে হয়তো কালকেপুর থেকে দু-একজনকে ধরে এনে কলকাতার মাল বলে চালাচ্ছে। কিন্তু কলকাতার নাম করছে, এদের ঠিক এনেছিস তো?

ব্যাটারা ভূষিমাল !

কিন্তু আমাদের ফটিক যে ভূষিমাল নয় তা পয়লা সিনেই জানিয়ে দিয়েছে, জানিয়েছেও চমৎকার আর গানও ভালোই গায়, বিশেষ করে কালোয়াতি ধরনের গান। নিয়তির ওই রাগ-রাগিণীর উপর গান একখানা গাইতেই আসর মাত।

জনতা হাততালিতে ফেটে পড়ে। অনেকেই বলে, আরে কলকাতার নামি গাইয়ে, গাইবে না? দ্যাখ গান কাকে বলে। আমি তো দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে দমভোর চিৎকার করে কর্ণকে হুঙ্কার দিয়ে চলেছি। দাড়িতে বোধহয় ছারপোকা বাসা বেঁধেছে, গালে আঠা আর ছারপোকার পিটপিটুনি তবু থামেনি। হাত-পা ছুঁড়ে দাপাদাপি করছি। তখনকার দিনে মুনিরা নাকি পান থেকে চুন খসলেই অভিশাপ দিত।

সেই মেজাজে হুঙ্কার ছাড়তে যেন আসরে পায়রা উড়ে গেল। আমিও হাততালি কুড়িয়ে আসর মাতিয়ে কলকাতার নাম বজায় রাখলাম।

আর কর্ণ অর্জুন এদের তুলনায় অভিনয় করছে আমাদের ভীম অর্থাৎ গোবর্ধন অনেক সেরা। হাতে পেল্লায় গদা। গোবরা নেচে নেচে কথা বলছে আর গদা হাতে রীতিমত ক্যারাটের পোজ দিয়ে স্টেজ মাতিয়ে অ্যাকটিং করে চলেছে।

রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সিনে তো ডবল অ্যাকশান পেল একা ওই গোবরাই। ধনকেষ্টও এসেছে গোপনে।

তার দলবল আসরের এদিকে ওদিকে মজুত রয়েছে। কোনোরকম খুঁত পেলেই স্বমূর্তি ধারণ করবে। তারা দু-একটা ফোড়ন কাটতে গেছল। কিন্তু পাশের লোকজনরাই তাদের থামিয়ে দেয়।

-চুপ করে বোস।

কেউ বলে, এমন জমাটি যাত্রা বহুকাল দেখিনি। ভালো না লাগে উঠে যা। গোল করলে বের করে দেব ।

তারাও আর গোলমাল করতে পারে না।

যাত্রায় আমার নাম উঠেছে।

বাদলমাস্টার এখানের স্কুলের মাস্টার। সে ওই মিত্র চৌধুরী পরিবারেরই ছোট তরফের ছেলে। সেও চেনে ধনকেষ্টকে। বাদল এই এলাকা থেকে অঞ্চলের প্রতিনিধি, কিন্তু তার দল পঞ্চায়েতে বেশি নাই, তাই ধনকেষ্টকে সে ঘা মারতে পারেনি। তবু তার সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। এলাকায় ধনকেষ্টর প্রতিপক্ষ সেইই।

তাই বাদলকে জব্দ করার জন্যই ধনকেষ্ট এই করেছিল আজ। কিন্তু ধনকেষ্ট পারেনি। ওদের হাতে হঠাৎ কলকাতার ওই ক’টা ছেলে এসে গেছল। তারাই সব শুনে ওদের হয়ে আসরে নেমে বাজিমাত করেছে। বাদল দেখে হঠাৎ ধনকেষ্টবাবুকে, কালীচরণকে নিয়ে এদিকে এসেছিল সে, আর ধরা পড়ে যাবে ভাবেনি। বাদল সব জেনেও না জানার ভান করে ওকে আপ্যায়ন করে—আসুন, আসুন। যাত্রা দেখবেন না? ওরে দুখান চেয়ার দে। ডায়াসের পাশে। বসতে হয় ধনকেষ্টকে, ধনকেষ্ট ছটফট করছে।

বাদল, বংশীও এসে জোটে। বংশী শুধোয়—কেমন দেখছেন কেষ্টবাবু ?

ধনকেষ্টও অবাক হয়। নিয়তি দারুণ গাইছে। আসর মাতিয়ে দিয়েছে। আর ভীম তো ভীমই। সেজে গুজে গদা ঘুরিয়ে জোর অভিনয় করছে। বংশী বলে—কলকাতার অভিনেতা গজরায় মনে মনে ধনকেষ্ট। তাকে এভাবে উল্টে ফাঁসাবে। তার সব প্ল্যান বানচাল করে ওরা যাত্রা শেষ করল। হইহই পড়ে যায়।

ধনকেষ্ট কোনোমতে জ্বলতে জ্বলতে বের হয়ে আসে। গজরায়-এদের পেল কোত্থেকে? ওই ছোঁড়াগুলোকে? আমার নাকে ঝামা ঘষে দিল। কোনো কম্মের নোস তোরা। যে কটাকে ধরে এনেছিস ভোরেই পাচার করে দে। একটা কাজ যদি পারিস সঠিকমতো করতে।

যাত্রার পর এবার বাদল বংশীর দল আমাদের জড়িয়ে ধরে।

দারুণ বিপদ থেকে উদ্ধার করলে ভাই। এমন সময় কেশব দত্ত এসে হাজির হয়। সে এসেছিল যাত্রা দেখতে। অবশ্য আমি, ফটকে, গোবরা তো রীতিমত অন্য বেশে। চেনা সম্ভব ছিল না। তবে হোঁৎকা পটলার কোনো চান্স ছিল না। একজন খাস বাঙাল আর পটলার জিভ তো ব্রেক ফেল করে আটকে যায়। পটলারও বিপদ। সে এমনিই ছিল গ্রিনরুমে। কেশববাবু ভিতরে এসে ওকে আর হোঁৎকাকে দেখে অবাক।

–তোমরা এখানে ?

তারপরই বাদলমাস্টার বংশীদের ওই কথা শুনে কেশবও ভরসা পায়, বলে সে—তা সত্যি। ওরা অনেকের বিপদ নিবারণ করে হে। আমার ওখানেই তো ওদের আসার কথা, তা তোমরা পেলে কোথা থেকে?

বংশীগোপাল বলে—পেয়ে গেলাম নয়, কেশবদা, ভগবান জুটিয়ে দিয়েছেন। না হলে ধনকেষ্টর দল আজ আমাদের প্যান্ডেলে আগুন ধরিয়ে দিত। ওরাই বাঁচিয়েছে।

বাদল বলে—শুধু বাঁচায়নি, ধনকেষ্টকে মুখের মত জবাবও দিয়েছে।

এবার আমরাও ধড়াচূড়া ছেড়ে আসি।

কেশব দত্তও খুশি হয়। তাহলে ফুল টিমই এসে গেছে? ভেরি গুড।

তখন রাত্রি প্রায় বারোটা। বাদলমাস্টার বলে—কেশবদা, কাল সকালেই ওদের তোদের বাড়ি পৌঁছে দেব। আজ রাতে ওদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আমার ওখানেই হয়েছে। কেশব দত্ত বলে—পটল, তাহলে কাল সকালেই চলে আসবে আমার ওখানে। বংশী বলে—আমি নিজে পৌঁছে দেব।

রাতে খাবার দাবারের তোড়জোড় কম নয়। কর্মকর্তাদের দু একজনও খেতে বসেছে আমাদের সঙ্গে। রুটি, তার সঙ্গে মাছ আর মুরগির মাংস, শেষপাতে ইয়া সাইজের রাজভোগ । হোঁৎকা খেতে খেতে বলে–নাহ, আজ দারুণ নাটক করেছিল ফটকে। গোবরা তরে আর কুমড়ো কইব না-রে মামার আড়তে কুমড়ো। দারুণ পোজ পশ্চার দিতে আছিলি।

পটলা বলে—ওরাই সে সেভ করেছে।

হোঁৎকা মাংসের হাড় চিবুতে চিবুতে বলে তা সত্যিই। নালি আমাদের নামও খারাপ হইত। হালায় ধনার জন্যে।

যে করে হোক, ওরে, টাইট দিমুই।

বাদলমাস্টার শুনছে আমাদের কথাটা। বলে সে–পারবে তোমরা ওকে জব্দ করতে? —দেখি।

বাদল বলে—যা সাহায্যের দরকার হবে বলবে। আমরাও চাই ওর মুখোশ খুলে দিতে। কেশববাবুরও সর্বস্ব গ্রাস করার মতলব করেছে শুনলাম।

পটলা বলে—তাই তো আসা। দেখি যদি কিছু করা যায়। বংশী বলে, কেস কাছারি করেছে, উলটে শাসাচ্ছে ওকে। বাদল বলে কত লোকের যে সর্বনাশ করেছে তার ঠিক নাই। এখন কি সব ব্যবসা করে কে জানে। রাতের অন্ধকারে লঞ্চে নানা মালপত্র আসে।

—কী মাল ?

বংশী বলে কে জানে? ওর দাপট বেড়েই চলেছে। অঞ্চলপ্রধান। গোপালগঞ্জের থানার দারোগা তো ওর হাতের লোক।

হোঁৎকা সব কথা মন দিয়ে শোনে আর নীরবে মাংস ছেড়ে এবার রাজভোগের দিকে নজর দিয়েছে। বলে, নাহ্, আপনাগোর এহানের রাজভোগ খাসা। ওর পাতে আর হাফ ডজন রাজভোগ এসে পড়ে। হোঁৎকাকে বলি—এবার থামা, পেট ছাড়বে।

হোঁৎকা বলে—ডিসটার্ব করস না।

গ্রামের সকালটা সত্যই সুন্দর। ভোর হবার সময় থেকেই আকাশে রংয়ের খেলা শুরু হয়।

পাখিদের কলরব ওঠে। রকমারি পাখির ডাক সবুজ গাছপালা। এখন গ্রীষ্মের দিন। বেলা হলেই রোদ বাড়বে। তবু সকালটা মিষ্টিই ।

ঘুম ভাঙায় চা আনে বংশীগোপাল।

এরা প্রথমে এনেছিল ভুল করে। কিন্তু তাদের ওই যাত্রা উতরে যেতে এখন খুবই ভদ্র ব্যবহার করছে।

পটল বলে–হোঁৎকা। বাণ্ডিল বাঁধ। এরপর কেশববাবুর বাড়িতে যেতে হবে। আ-আসল কাজই বাকি।

হোঁৎকা বলে—হইব। চা খাতি দে।

কেশববাবু সকালেই সাইকেল নিয়ে হাজির। আমাদের নিয়ে যাবার গরজ তারই বেশি। আর আমাদের এলেমের পরিচয় তো কাল রাতেই পেয়েছে সে। বাদলবাবু, বংশী বলে—গ্রামেই তো থাকলে, দেখা হবে।

বের হয়ে এলাম আমরা।

কেশব দত্তের বাড়িটা গ্রামের এদিকে।

আমাদের পথে পড়ে ধনকেষ্টর দখল করা সেই প্রাসাদ। একটু দাঁড়ালাম। পিছনেই খালটা বয়ে গেছে। এদিকে বেশ বাগান—তারপর বাড়িটা। একদিকে নতুন করে গড়ে বাস করে ধনকেষ্ট। বাকি ওদিকটার পুরানো বাড়ি এখন মেরামত অভাবে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে।

কেদারবাবু বলে—এসবও জাল দলিল বলে দখল করা। লোকটার লোভও খুব।

কেশববাবুর বাড়িতে আমাদের জন্য ব্যবস্থা করাই ছিল। ওপাশে বৈঠকখানা বাড়ি, তার দোতলায় একটা হলঘর। লাগোয়া বাথরুমও রয়েছে। উঠানের কুয়ো থেকে পাম্প ফিট করে উপরে জল তোলার ব্যবস্থাও রয়েছে।

ওই হলঘরেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আর কেশববাবুর মা বলেন, কলকাতা থেকে এলে বাবা। এসময় পুকুরের মাছ, বাগানের আম, কাঁঠাল খাওয়াবো তার উপায় নেই । সব রাহুর গেরাসে যেতে বসেছে।

তবু ঘরের দুধ, পাশের পুকুরের মাছ ঠিকই জুটছে। সেইদিন দুপুরে খাবার পর এবার কেশববাবু তাদের উপর অত্যাচারের কাহিনি শোনায় ।

এর মধ্যে মামলাও করেছে। ধনকেষ্টও বাগান পুকুর দখলের জন্য মামলা লড়ছে। সামনের সপ্তাহে দিন পড়েছে চুঁচুড়া কোর্টে।

জেলা জজের আদালতে যদি হেরে যাই সব ওর দখলে চলে যাবে।

বৈকালে বাগান পুকুর দেখতে গেলাম ।

কেশব দত্ত অবশ্য কিছুটা সঙ্গে যায়। বলে সে, সামনেই বাগান, ওদিকে দেখবে বড় পুকুর। ফটিক বলে আপনি যাবেন না ?

কেশব বলে—কাছে যাব না। আমাদের উপর কোর্টের অর্ডার আছে। গেলে ধনকেষ্ট আদালতে জবরদখল, না হয় অনধিকার প্রবেশের কেস করে দেবে।

হোঁৎকা বলে যাবেন না। আমরাই যাইতাছি।

বাগানটা দেখার মতো। বিশাল আর সুন্দর। গাছগুলোয় প্রচুর আম এসেছে। আম কাঁঠাল লিচু, নানা ফলের গাছ ভরে ফল এসেছে। আর পুকুরের জলে মাছের ঘাই দেখে মনে হয় বড় বড় মাছই রয়েছে।

এমন লাখ কয়েক টাকার সম্পত্তি স্রেফ ধমক দিয়ে দখল করে নেবে লোকটা।

বাগানের ওদিক থেকে ফিরছি। হঠাৎ সেই টাকওয়ালা গোঁফসমেত লোকটাকে দেখে চাইলাম। লোকটাও বাগানের আশেপাশেই নজর রেখেছিল। আমাদের ওখানে দেখে এগিয়ে আসে। শুধোয় সে, এখানে ভি এসেছো? কি করছিলে তুমলোক? হোঁৎকা বলে ওঠে—তুম কোনো আছস রে? আমাদের জবাব চাইত্যাছ?

লোকটা এমন বিচিত্র ভাষা শোনেনি। সে গর্জে ওঠে, ইধার আসবে না।

কে-ক্যা-ক্যান, পটলাও চটে উঠেছে। চটে উঠলে ওর জিভটা আগেই বিট্রে করে। লোকটা বলে—এ ধনকেষ্টবাবুর হুকুম। নয়া কেউ এলে খপর দিতে হোবে। গোবরা বলে—তোর ধনকেষ্টকে বলগে—তার বাপ এসেছে। ফোট বে।

গোবরার ওই গর্জনে একা ওই টাকওয়ালা ঈষৎ ঘাবড়ে যায়। আমরাও এগিয়ে আসি । আর দেখি সেই টেকো লোকটা দূর থেকে আমাদের দিকে নজর রেখেছে। বোধহয় ও জানতে চায় কোথায় উঠেছি আমরা।

এর মধ্যে কেশববাবুও এসে পড়ে। সেও ওই ব্যাপারটা দেখেছে।

তাই শুধোয়, কি বলছিল ওই তাপ সিং?

ওর নামটাও জানতে পারি ।

–তাপ সিং।

কেশব দত্ত বলে—হ্যাঁ। ব্যাটা ওই ধনকেষ্টর লোক। এখানে তোমাদের ঘুরতে দেখে সন্দেহ করেছে। হোঁৎকা বলে—করুক গিয়া। পিসা বাগান পুকুরখান সরেস।

—কিন্তু কী হবে কে জানে ?

হোঁৎকা বলে—ওই ধনকেষ্টর দর্শন একবার পাওয়া দরকার। খবর দিতি হইব।

আমি বলি সে ঠিকই হবে। ব্যাটা আমাদের সব খবরই ঠিক পাচ্ছে।

ধনকেষ্ট কাল থেকেই বিগড়ে রয়েছে।

এমন প্ল্যানটা বানচাল হয়ে গেল। কাল থানায় খবর দিয়ে পুলিশও এনে রেখেছিল। সে তহবিল তছরুপ, পাবলিককে প্রতারণার দায়ে বাদল মাস্টারকে অ্যারেস্টও করাত, ক্লাবের সেক্রেটারি হিসাবে ওপাড়ার আরও কজনকে হাজতে পুরত, কিন্তু তা হয়নি।

ক’টা ছেলে কোথা থেকে উড়ে এসে তার বাড়া ভাতে ছাই দিল।

ধনকেষ্ট বৈকালে অফিসে বসে হিসাব করছে। তার গুদামে এখানে প্রচুর কেরোসিন তেল বেবি ফুড স্টক করা আছে। নামিদামি কোম্পানির বেবি ফুডের টিনভর্তি প্রচুর পেটি আনা হয়। সেগুলোয় সে আজেবাজে গুঁড়ো দুধ ময়দা মিশিয়ে পুরে চালান দেয় বিভিন্ন গঞ্জের পাইকেরি বাজারে। এছাড়া ইদানীং আরও সব কারবার শুরু করেছে। নিজের দুটো লঞ্চও খাল দিয়ে গঙ্গা নদী দিয়ে নানা রকম মাল আনা নেওয়া করে। তারই হিসাব করছে। সামনের সপ্তাহে ওই বাগান পুকুরের মামলার রায় বের হবে। তার আগেই সদরে যেতে হবে মামলার তদ্বিরের জন্য। জজ কোর্টে হেরে গেলে কেশব দত্ত হাইকোর্টে যেতে পারবে না। ওই সম্পত্তি তার দখলেই আসবে।

এমন সময় হঠাৎ তাপ সিংকে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখে শুধোয় সে-কী ব্যাপার ?

তাপ সিং বলে—ওই কালকের ছোকরাদের দেখলাম বাবুজি বাগান, পুকুরের চারোতরফে ঘুমছে আর কি বলাবলি করছে। আমি পুছ করতে হামাকে বলে-তোর বাবুর বাপ আছি হামরা। পাঁচটো বাপ !

ধমকে ওঠে ধনকেষ্ট তার পাঁচ পিতৃদেবের খবর পেয়ে।

-চোপ! কি যা তা বলছিস ?

তাপ সিং বলে আমি বোলছে না বাবুজি ঔরা বলছে। আউর দেখলাম ওই ছোকরা ওই কেশব দত্তের সঙ্গে ঘুরছে। ওর বাড়িতেই ভি রয়েছে।

এবার ধনকেষ্ট সজাগ হয়। তাপ সিং বলছে—ওরাই কাল বংশীবাবুদের সাথে ছিল। ওরাই রাতে নাচ করম ভি করেছে যাত্রার পালায় ।

-তাই নাকি! ধনকেষ্ট বলে—তাহলে ওরা যায়নি?

—না। খুদ দেখলো কেশববাবুর বাহার বাড়ির দোতলায় ডেরা গাড়ছে।

ধনকেষ্ট চিন্তায় পড়ে। তাহলে কেশব দত্তই ওদের এনেছে কলকাতার কোনো আত্মীয় বাড়ি থেকে ওকে জব্দ করার জন্য। আর ছেলেগুলো এসে কালই ধনকেষ্টর একটা জবর প্ল্যান বানচাল করে এবার তার ওই বাগান পুকুরের দখলেও বাধা দিতে চায় ৷

ধনকেষ্ট বলে—কালীকে ডেকে আন এখুনি! বলবি জরুরি দরকার আছে। তাপ সিং বুঝেছে একটা কিছু ঘটবে। তাই বলে সে—আভি যাচ্ছে আমি ।

সন্ধ্যার পর চা আর গরম চপ সহযোগে মুড়ি এসেছে। জমিয়ে চায়ের আসর বসেছে। বাদলবাবু, বংশীগোপালও এসে জুটেছে। কেশবাবুর মামলায় ওই বংশীও সাক্ষী, মামলার আলোচনাও হচ্ছে।

কথায় কথায় জজসাহেবের কথাও আসে।

জজসাহেব বগলাকান্তবাবু খুব কড়া বিচারক। তার বিচারে যা হবে হাইকোর্টও তা নড়াতে পাড়বে না।

কিন্তু খুব কড়া লোক ।

হোঁৎকা বলে তাকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বলা যাবে না? কেশব দত্ত বলে, কোনো কথাই শোনেন না তিনি। সাক্ষ্য প্রমাণ দেখেই বিচার করেন। আর ধনকেষ্ট এর মধ্যে গাঁয়ের দুতিন জনকে কিনে নিয়েছে। তারাই সাক্ষী দেবে। সব মিথ্যা সাক্ষী।

খুব ভাবনার কথা ।

রাতে খাওয়ার পর ভাবছি কী করা যায় ।

ভাবনা করেও পথ পাই না। কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না।

হঠাৎ রাতের অন্ধকারে কেমন দম বন্ধ হয়ে আসে। কি যেন বুকের উপর চেপে বসে গলা টিপে ধরেছে। কাদের দেখছি ছায়ামূর্তির মত ঘরে।

আর্তনাদ করে উঠি।

ওদিকে গোবরা কাকে জড়িয়ে ধরেছে। আর আমাদের সকলেই জেগে উঠতে লোকটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে বারান্দার দিকে ছুটে গেল। হোঁৎকার লাথি খেয়ে কে পটলাকে ছেড়ে দিয়ে দৌড়াল।

গোবরা যে লোকটাকে ধরেছিল সে প্রাণপণে গোবরার হাতে কামড়ে দিতে গোবরা ছেড়ে দেয় তাকে। দুতিনজন লোক এইভাবে বারান্দা থেকে গোয়ালের চালে সেখান থেকে নীচে লাফ দিয়ে কোনোমতে দৌড়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

আমাদের হইচইয়ের শব্দে ওদিক থেকে কেশববাবু, ওর মা-ও এসে পড়ে। চোরই ঢুকেছিল বোধহয়।

কিন্তু দেখা যায় একটা গামছা পড়ে আছে। এই চোরদের কেউ এটা ফেলে গেছে। চমকে উঠি। বলি—এ তো সেই তাপ সিংয়ের গামছা ।

কেশববাবু বলে—তাই তো। ও ব্যাটা এখানে? ব্যাটা ধনকেষ্টর হয়ে কত খুন করেছে তার ঠিক নাই৷

হোঁৎকা বলে—বুঝছস! ব্যাটা ধনকেষ্ট জানছে এর পিছনে লাগছি, তাই আমাদের শ্যাষ করতি পাঠাইছিল।

কেশব দত্তের মা চমকে ওঠে!

—মা গো! কি সর্বনাশই না হত। ওরে কেশব—বিষয় যায় যাক, ওই যমের সঙ্গে মামলায় কাজ নাই ।

হোঁৎকা বলে—ভাববেন না ঠাকমা। ওই ধনকেষ্ট ভীমরুলের চাকে ঘা দিছে, ওর জবাব নি দিই যামু না।

শুধোই—কী করবি?

হোঁৎকা বলে—ভাবতি দেতো। কুল ব্রেনে ভাবতি পারলে পথ হইবই। পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের আমাদের চেনেনি ধিনিকেষ্ট। ওরে নাচাই ছাড়ুম।

সকালে চা মুড়ি খেতে খেতে হোঁৎকা শুধোয় কেশবকে-আগেকার মামলার দিন কবে ? —এই বুধবার। আজ রবিবার।

হোঁৎকা বলে গোবরা তোর কুমড়োমামার বাড়ি ওই হুগলিতে না ?

—হ্যাঁ।

হোঁৎকা বলে তিনচার দিন সেখানেই থাকতি হইব। কেসের তদ্বির করণের লাগবো। গোবরা বলে—ও বাড়ি তো প্রায় খালিই থাকে। কুমড়োর গুদাম আর লোকজন আছে নীচের তলায়। উপরে থাকা যাবে।

হোঁৎকা বলে কেশবকে, আজই ওখানে যাইত্যাছি। আপনি মঙ্গলবার বৈকালে ওখানেই আসেন। বুধবার কেসে দেখি কি করা যায় ।

খরচা নাও কিছু। কেশব দত্ত টাকা দিতে চায়। আমাদের ফান্ডে ঠাকমার দেওয়া হাজার

টাকা আমার ব্যাগেই রয়েছে। হোঁৎকা বলে–টাকা লাগবো না। আছে।

হোঁৎকা চুঁচুড়ায় গিয়ে কি করবে কে জানে। হয়তো চেনাজানা কেউ আছে, তাকে ধরবে। অবশ্য পটলার কাকার বন্ধু সেই পুলিশের বড়কর্তাকেও জানাতে হবে ব্যাপারটা। তাই বের হলাম আমরা।

বাদলদাও এসেছে। সে বলে—একি, চলে যাচ্ছ আজই।

হোঁৎকা বলে—না। কাম সাইরাই আসুম এই সপ্তাহেই। আসল কামই তো বাকি। ধিনিকেষ্টর নেত্য দেখুম তখন। বের হই আমরা আবার সেই পথ ধরে। বাদলবাবু, বংশী বলে—আসবে কিন্তু, আশা নিয়ে রইলাম ।

খবর সবই রাখে ধনকেষ্ট। গত রাতে সে লোক পাঠিয়ে আমাদের উত্তম-মধ্যম দিয়ে ভয় দেখিয়ে এখান থেকে তাড়াতে চেয়েছিল। তাই সকালেই ওর লোক এসে খবর দেয়।

কর্তা কলকাতার বাবুরা এক রাতের ওষুধেই ভয় পেয়ে ল্যাজ তুলে পালাল।

তাপ সিংও বসেছিল। এসব যেন তার কেরামতিতেই হয়েছে। সে বলে, দেখুন হুজুর, তাপ সিংয়ের খেল।

ধনকেষ্ট খুশি। নগদ দশটাকা বকশিশ করে। তাপ সিং ওই বিশাল গোঁফে তা দিয়ে বলে—হমকো দেখেই এইসা ভয় পাইসে দেখেন বাবুজি ।

ধনকেষ্ট বলে—আমার পিছনে লাগবে? এই বুধবার মামলার রায় বের হবে। সাক্ষী প্রমাণ যা নিয়ে যাব দখল পাবই। সেদিন ঢাক-ঢোল বাজিয়ে বাগান পুকুরের দখল নেব।

কালীচরণ বলে ওই ঢাক-ঢোলও মজুত রাখব। বৃহস্পতিবারই দখল নিতে যাব। হ্যাঁ। সদরে যাবার ব্যবস্থা করো মঙ্গলবার।

কালীচরণ বলে লঞ্চ তো মাল আনতে যাবে। মাল ওদের রাতের অন্ধকারেই আসে ৷ এখন ধনকেষ্ট কলকাতাতেই ব্যবসা শুরু করেছে। বলে সে-সাবধানে মাল আনবি। আর এখানের মালও কিছু যাবে। সিধে ডকের জাহাজে তুলে দিতে হবে।

ইদানীং ধনকেষ্ট এক নতুন ব্যবসা শুরু করেছে। দূর গ্রাম-গ্রামান্তরে বহু প্রাচীন মন্দির আছে—তাদের দেবমূর্তি ও বহু প্রাচীনকালের দ্বারবাসিনীর পুরানো কেল্লার জঙ্গলেও বহু পাল সেন যুগের মূর্তির সন্ধান পেয়ে ওসব লোক দিয়ে চুরি করিয়ে আনে।

প্রায়ই অনেক মন্দিরের প্রাচীন মূর্তি চুরি যাচ্ছে। পুলিশেও রিপোর্ট হয়। খবরের কাগজেও এসব খবর ফলাও করে বের হয়। শোনা যাচ্ছে এই সব পুরাতন মূর্তি লাখ লাখ টাকা দামে বিদেশে পাচার হচ্ছে।

কিন্তু পুলিশে কোনো কিনারাই করতে পারেনি। সদরের পুলিশের কর্তাও বিপদে পড়েছে। এদিকে ওই কাজ সমানেই চলেছে।

ধনকেষ্ট অঞ্চলপ্রধান, সেও এখানের লোকদের চাপে পড়ে সদরে গেছে। কর্তাদের ও নালিশ করেছে।

কিন্তু আড়ালে সেই-ই এই ব্যবসা করে এখন প্রভূত রোজগার করছে, তার নিজস্ব দুটো লঞ্চ মাল বয়—আর গোপনে এসবও করে। অথচ বাইরে সেও আন্দোলন করে—এই জাতীয় সম্পদ চুরি বন্ধ করতেই হবে।

আপাতত কিছু দামি মূর্তিও আসার খবর আছে। তার খদ্দের ঠিক করতে কলকাতায় যাবে ধনকেষ্ট—ফেরার পথে মামলায় বিজয়ী হয়ে এসে ওই বাগানের দখল নেবে।

কেশবকে হারাতে পারলে তারপর গদাধর মাইতির ধানকলও দখল করবে। লোকটা খুব বেড়েছে। ধনকেষ্ট তার পরিকল্পনা মতই এগিয়ে চলেছে।

আমরা হুগলিতে এসে গোবরার মামার কুমড়োর গুদামের উপর বিরাজ করছি। এখানেও ঠাট বাট, লোকজন সবই আছে। ওদিকের গোয়ালে জার্সি গরুও রয়েছে, আর আছে দাড়িওয়ালা বিশাল একটা পাঁঠা ছাগল। ইয়া দাড়ি আর দুখানা শিং-ও বেশ পাকানো।

ছাগলটা তেমনি শয়তান। তার অভ্যাস সামনের দু-পা তুলে সিধে হয়ে দাঁড়িয়ে সপাটে বডিওয়েট দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে গুঁতো মারা। ছাগল যে এত মারকুটে হয় জানা ছিল না। গোবরা ওকে আদর করতে গেছে আর গোবরাকেই নিপুণ বক্সারের মত এইসা হাঁটুতে ঝেড়েছে এক গুঁতো যে গোবরাও ছিটকে পড়ে।

আমি তো লাফিয়ে সরে আসি। আমাকে ওইসা গুঁতো ঝাড়লে ছিটকে পড়ব।

গোবরা উঠে ছাগলটাকে মারতে যাবে, হোঁৎকা বলে মারিস না। ওই আমাগোর ফ্রন্ড । অবাক হই, বলি—তোর মতলব কি বলত হোঁৎকা? ছাগল, ওই শয়তান ছাগল হবে বন্ধু ওই ছাগলটাকে খোঁয়াড়েও নেয় না। সকালে বের হয়। বাজারের দিকে ঘুরে ফিরে এর কলা, ওর মুলো, তার আলু কপি খেয়ে বৈকালে হেলতে দুলতে ফিরে আসে এখানেই।

সেই দিন সন্ধ্যাতেই বাজারে গিয়ে হোঁৎকা আমরা কাছ থেকে শ তিনেক টাকা নিয়ে আম-আনারস-আপেল সরেস মর্তমান কলা—কিছু ফুল এসব কেনে। একটা নতুন ঝুড়ি। আর রঙিন কাগজ এসবও কেনে। শুধোই কি হবে এতে।

হোঁৎকা বলে, কাম আছে-যা কই কর।

বাড়িতে এসে রঙিন কাগজে একটা কালির খালি বোতলে জল পুরে মোড়া হল। আর সুন্দর করে ঝুড়িটাকে সাজানো হল—ফল, দু প্যাকেট মিষ্টি—ওই কাগজে মোড়া বোতল আর দুটো মুরগিও কিনে ঠ্যাংয়ে দড়ি বাঁধা হল আর ওই দাড়িওয়ালা ছাগলটাকে বাঁধা হল আজ

রাতে—সকালে যাতে না পালাতে পারে।

এরপর বাজারে একটা কুলিকে ভাড়া করে তার মাথায় ওই সুন্দর ঝুড়ি ফুল চাপানো হল আর দড়ি বাঁধা সেই দাড়িওয়ালা বোকা পাঁঠাকেও কিছু পাতা দেখিয়ে কুলির সঙ্গে যেতে বাধ্য করে হোঁৎকা বের হল।

ও বলে তরা আমারে এহন চেনস না, দূরে দূরে আইবি।

কোথায় চলেছে হোঁৎকা কে জানে!

নীরব অচেনা দর্শকের মত আমিও চলেছি ওর পিছনে, বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে পটলাও ওদিকে যেন পথ দিয়ে যাচ্ছে মাত্র।

জজসাহেবের বাংলোতেই সটান ঢুকেছে হোঁৎকা ওইসব মালপত্র আর ছাগলটাকে নিয়ে। বাবা, রামছাগলও কি ভেবে শান্তভাবে গুটি গুটি পায়ে গিয়ে ঢুকল ওই বাংলোয় !

জজ বগলাকান্তবাবু রাশভারী মেজাজের লোক। সকালে বাংলোর বসার ঘরে চা-পর্ব শেষ করে কিছু কেসের নথিপত্র দেখছেন। চুরুট খাওয়া তার অভ্যাস। চুরুটও ধরিয়েছেন। কড়া মেজাজের বিচারক। একেবারে ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তি। হঠাৎ হোঁৎকাকে ওইসব মালপত্র নিয়ে আর ওই ছাগল মুরগি নিয়ে ঢুকতে দেখে চাইলেন।

তার বাড়িতে ঢুকে এইসব ভেট দিতে পারে কেউ, এ তাঁর স্বপ্নেরও অতীত।

হোঁৎকা ওসব মালপত্র নামিয়ে প্রণাম করে বলে, আজ্ঞে হাড়ভাঙা হলুদপুরের অঞ্চল প্রধান ধনকেষ্ট সাহা মশায় হুজুরের কাছে সামান্য ভেট পাঠালেন—তার একটা বাগান দখলের মামলা আছে, এই বুধবার আপনার এজলাসে। আজ্ঞে এই যে মামলার নম্বরও দিয়েছেন। যদি দয়া করে কেসটা জিতিয়ে দ্যান –ধনকেষ্টবাবু আপনারে খুশি কইরা দেবেন। কাগজটাও রেখে দেয় হুজুরের টেবিলে।

এবার বগলাকান্তবাবু বোম ফাটার মত গর্জে ওঠেন।

হোয়াট! ওই ধনকেষ্ট সাহার এতবড় সাহস, আমাকে ঘুষ দিতে চায়? জানো তোমাকে অ্যারেস্ট করাতে পারি। জেলে দিতে পারি ?

চাষীর বেশে হোঁৎকা এবার কাঁদ কাঁদ হয়ে বলে—আমি তার চাকরমাত্র স্যার। পেটের দায়ে একাজ করছি হুজুর—এবারের মত মাপ করে দিন।

জজসাহেব গর্জে ওঠেন।

এসব নিয়ে এখুনি বের হয়ে যাও। গেট-আউট। বেয়ারা-বেয়ারা এসে পড়ে। এর মধ্যেই কাণ্ডটা ঘটে যায়।

সেই রামছাগলটা এবার স্বমূর্তি ধরে বেয়ারাকে এসে লম্ফঝম্ফ করতে দেখে তার সামনে গিয়ে পিছনের দুপায়ে ভর দিয়ে শিং উঁচিয়ে হেলে বডিওয়েট দিয়ে বেয়ারার ডান হাঁটুতেই ঝেড়েছে একখানা মোক্ষম আপার কাট আর বেচারা বেয়ারা ওই আঘাতে ছিটকে পড়ে মেঝেতে। একটা টেবিল ল্যাম্প ধরে সামলাতে গেছে, সেটাকে নিয়েই পড়েছে বেয়ারা আর ছাগলও এবারে জানলা টপকে লাফ দিয়ে সিধে দৌড়েছে বাজারের দিকে। বেয়ারার কপাল-হাঁটুতে চোট। হোঁৎকাও বেগতিক দেখে ওই ঝুড়ি মাথায় করে দৌড়ে গেট পার হয়ে বের হয় রাস্তায় ।

বের হতেই একটা চলন্ত রিকশাকে থামিয়ে মালপত্র নিয়ে সোজা একেবারে আমাদের ডেরায়।

এর মধ্যে আমরা ফিরে এসেছি। দেখি ব্যাক টু প্যাভিলিয়ান। শুধোই, কী হল?

হোঁৎকা হাতের মুরগি দুটো দেখিয়ে বলে–জমাট ফিস্ট হইব আজ রাতে। কাল দেখা যাউক কী হয়। চক্কর যা চালাইছি মনে হয় কাম হই যাবো ।

এবার ওই ফল মিষ্টি আমাদেরই ভোগে লাগে।

শুধোই, কেনই বা এসব কিনলি ?

হোঁৎকা বলে—ধনকেষ্টরে বাঁশ দিতি হইব না। কাল মামলা, চল গুপীনাথবাবুরে যাই কই গিয়া, কেশব পিসাও ওখানেই আইব।

পটলা বলে ক-কাজ হবে তো?

কাজের নমুনাটা দেখার জন্যই আমরাও আদালতে এসেছি। কেশব দত্তও এসেছে। তার উকিল গুপীনাথবাবু বলে—ওরা তো সাক্ষী, প্রমাণ, কাগজপত্র সব হাজির করেছে, যা কড়া জজসাহেব। কী যে হবে কে জানে।

এমন সময় দেখি ধনকেষ্টও গাড়ি থেকে নামছে। তার একপাশে কালীচরণ। দেখতে কাপালিকের মত চেহারা। ইয়া চুল, কপালে সিঁদুরের টিপ আর চোখ দুটোও সিন্দুরের মত লাল। ওদিকে সেই তাপ সিং। তার মাথায় এখন পাগড়ি তবে গোঁফ দুটো বেড়ালের ল্যাজের মত ঝুলে আছে তার বীরত্বের প্রতীক হয়ে

হোঁৎকা আর পটলা ওদিকে চা খাচ্ছে-আমরাও রয়েছি। কেশব দত্ত গুপীবাবুর সঙ্গে কথা বলছে হঠাৎ ধনকেষ্ট যেতে যেতে দাঁড়াল। তাপ সিংহ আমাদের চেনে।

আর ওদের সঙ্গে গিলেকরা পাঞ্জাবি কুঁচি ধুতি, হীরের বোতাম লাগানো জামা দেখেই বুঝেছি ইনিই বিখ্যাত ধনকেষ্টবাবু।

একবার তিনি থেমে গিয়ে আমাদের দিকে চাইলেন।

ওই চাহনিটাকে মনে হয় হিংস্র সাপের চাহনির মত আর চাপা রাগে যেন হিস্ হিস্ করছে বলে ধনকেষ্ট চাপাস্বরে বলে–ওই হাড়ভাঙা হলুদপুরমুখো হলে শেষ করে দেব। দেবে তো বুঝেছি। হোঁকাও এসে পড়ে। সেই-ই বলে—ক্যান ওটা কি আপনার বাবার জমিদারি যে যামু না?

ধনকেষ্ট বলে, কে হে ছোকরা ?

তাপ সিং গোঁফ মুচরে বলে, – মালিক বলেন তো ওটাকেই দিই খতম করে। ওরা এই কাজ যে খুব ভালো পারে তা বুঝেছি।

গোবরাও পজিশন নিয়েছে। ইদানীং ক্যারাটেও ভালো শিখেছে সে। ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্টও পেয়েছে। ওর একটা লাথিতে তাপ সিং নিরুত্তাপ হয়ে যাবে তা জানি।

কিন্তু ব্যাপারটা গড়াল না বেশি দূর। আদালতের পেয়াদা হাঁক পাড়ে—কেশব দত্ত—ধনকেষ্ট সাহা হাজির-কেশব দত্ত-ও—

অর্থাৎ মামলার ডাক পড়েছে তাই শুনে ধনকেষ্ট ওই বোঝাপড়া মুলতুবি রেখেই দৌড়াল। কেশব দত্তও বিনীতভাবে এজলাসে গিয়ে হাজিরা দেয় ।

জজসাহেব ওদিকের বারান্দায় তার খাস কামরা থেকে বের হয়ে আসছেন। পিছনে বেয়ারা। তার কপালে ব্যান্ডেজ, হাঁটুতেও বেশ জখম রয়েছে তা তার হাঁটা দেখলেই বোঝা যায়। কাল হোঁৎকার সেই শ্রীমান অজ ওই কাণ্ড বাধিয়েছে। জজসাহেব গিয়ে এজলাসে বসেন তখনও পেয়াদা হাঁকছে—

ধনকিষ্ট সাহা হা-জির-

জজসাহেব খুবই কড়া আর নিরপেক্ষ বিচারক। কালকের ঘটনাটায় তিনি খুবই ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। তাকে বাড়ি বয়ে প্রণামী দিতে আসার সাহস রাখে ওই ধনকেষ্ট। তিনি কেস নাম্বার, নাম, কার বিরুদ্ধে মামলা এসব কথাই মনে রেখেছেন। আর বেশ বুঝেছেন যে ওই ধনকেষ্ট একটা অসৎ লোক। তার মামলায় সাক্ষী প্রভৃতিতে প্রভূত গলদ আছে তাই সে ঘুষ দেবার কথা ভাবতে পারে। সমাজে এমনি অসৎ লোকদের তিনি সহজে ছাড়বেন না। না !

তাই ধনকেষ্টকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে দেখে চাইলেন। লোকটা উদ্ধত তা বোঝা যায় । নমস্কার করতেও জানে না।

গুপী উকিলকে কাল রাতেই বলা হয়েছিল ওর সব সাক্ষী মিথ্যা সাক্ষী দেবে। এদিকে কেশববাবুও বাদল মাস্টারকে এনেছে সাক্ষী হিসাবে।

গুপীনাথবাবু শুধোন ধনকেষ্টকে-

—পেশা!

—অঞ্চলপ্রধান !

গুপীনাথ হেঁকে ওঠে ধর্মাবতার, ইনি অঞ্চলপ্রধান হয়েই অর্থাদি রোজগার করেন। এই-ই ওর পেশা। সরকারি অর্থ তছরুপ করেন তা মহামান্য আদালতে দাঁড়িয়ে কবুল করেছেন। ধনকেষ্টর উকিল শুধরে দেয়—না হুজুর! ব্যবসাদি করেন উনি। ধনকেষ্ট পয়লা জেরাতেই কিছুটা বিপর্যস্ত। গুপীনাথ জেরা করে।

—ধনপতিবাবু ওই পুকুর, বাগান আপনার ?

ধনকেষ্ট বলে—আমার বাবার।

তিনি তো দশ বছর গত হয়েছেন। তিনি এর দখল নেননি। দশবছর চুপ করে থেকে হঠাৎ আজ আপনি এর দখলের মামলা করেছেন কেন?

ধনকেষ্ট ঘাবড়ে যায়। এসব কথা উঠবে তা ভাবেনি। ধনকেষ্ট এবারে চুপ করে থাকে। উকিল গুপীবাবু এবার এক এক করে সাক্ষীদের ডাকতে থাকে। ধনকেষ্টর প্রথম সাক্ষী নটবর দাশ। পেশায় নাপিত, হাটে ধনকেষ্টর দয়ায় ঘর পেয়ে সেলুন চালাচ্ছে।

নটবর বলে—আজ্ঞে ওই বাগান পুকুরের ফল মাছ বাবুর দয়ায় আমরাই খেয়েছি। ওসব বাবুরই অর্থাৎ বাবুর দখলেই ছিল।

গুপীনাথের জেরায় নটবর বলে আজ্ঞে হ্যাঁ। এখনও আছে।

গুপীনাথ বলে—হুজুর ধর্মাবতার, ওই ধনকেষ্টবাবু মামলা করার আগেই ওই বাগান পুকুর দখল করেছিলেন, সাক্ষী বলছে। অথচ ধনকেষ্টবাবু নিজে বলছেন—দখল পাবার জন্য এই মামলা করেছেন তিনমাস হল। এ সাক্ষী অসত্য বলছে আদালতে।

জজসাহেব নটবরের দিকে চাইতেই নটবর কেঁদে ওঠে—এসব জানি না হুজুর। ধনকেষ্টবাবুকে চটালে গাঁয়ের বাস উঠবে তাই যা বলতে বলেছেন তাই বলতে এসেছি। দোহাই হুজুর—

পরের সাক্ষী দোলগোবিন্দ কর্মকার।

তার নাম উঠতে তাকে আর পাওয়া যায় না। নটবরের মত ধুরন্দর লোকের কাঠগড়ায় মিথ্যা সাক্ষী দিতে এসে ওই হাল দেখে দোলগোবিন্দ আগেই সরে পড়েছে। উলটে বাদলবাবুই কেশব দত্তের হয়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় উঠে এবার ধনকেষ্টর বিপক্ষে বেশ কিছু কথা বলে জানায়, ওই বাগান এতদিন কেশববাবুর দখলেই রয়েছে। ওসবের মালিক তিনিই ।

জজসাহেব এমনি একটা ধারণাই করেছিলেন। তার মনে হয়, ধনকেষ্টবাবুর মত লোকদের অসাধ্য কিছুই নাই। তিনি সবদিক বিবেচনা করে কাগজপত্র কেশববাবুর হালফিল খাজনার রসিদ পরচা দেখে এই মামলা ডিসমিস করে দেন। বাগান পুকুরের মালিক কেশববাবুর বলেই রায় দেন আর ধনকেষ্টবাবু আদালতে যে দলিল পেশ করেছেন তার তদন্ত করতেও নির্দেশ দেন। এই দলিল যে জাল সেটা সত্য কি না তদন্ত করা হোক।

ধনকেষ্ট এবার চমকে ওঠে।

বাগান পুকুর তো গেলই। মামলায় গোহারান হেরেছে সে। আর ধনকেষ্ট জানে এই দলিল জাল। বাবার সই, কেশব দত্তের বাবার সই এসব জালই। কোনো আগেকার দলিলে ওদের সইয়ের সঙ্গে মেলালে তা ধরা পড়বে। তাতে জালিয়াতির দায়ে পড়বে ধনকেষ্ট। জেলবাসই হয়ে যাবে।

ধনকেষ্ট কোনোমতে বের হয়ে এল কাছারি থেকে।

কালীচরণ ওদিকে বটগাছের নীচে পলাতক সাক্ষী দোলগোবিন্দ, নরহরিদের ধরে শাসায়–পুঁতে দেব।

আর নটরবকে তাপ সিং এর মধ্যে দুচার রদ্দা দিয়ে ধরাশায়ী করেছে। ওদের জন্যই যেন তাদের কর্তা মামলায় হেরে গেছে।

কেশব দত্ত আজ আদালত থেকে বের হয়ে এসে আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে।

তোমরা না এলে আজ গোহারান হেরে যেতাম। সর্বস্ব চলে যেত।

বাদলমাস্টার বলে, এবার বুঝবে ধনকেষ্ট। চলো–ফেরা যাক ।

আমরা বলি—এক নম্বর ওষুধ দিছি, ধনকেষ্টরে এহনও পুরো ডোজ ওষুধ দিতি পারিনি। তাই চল ওখানেই। এবার আর ওই তিনটে বাস ধরে নয়— ঠাকমার দেওয়া টাকা এখনও সাতশোর মত আছে। তার থেকে দেড়শো টাকা কবুল করে একখানা ম্যাটাডোর ভ্যানে করেই এসে নামলাম আমরা সেই খালের ধারে।

ওদিকের মোড়ে তখন ধনকেষ্টর পাঠানো পঞ্চাশখানা ঢাকঢোল-কাঁসি, সব মজুত। তাপ সিং ওদের রেখে গেছে বিজয়ী ধনকেষ্টকে সাথে করে নিয়ে যাবার জন্য। এবার বাদলমাস্টার দেখে বংশীগোপাল হাজির ।

কথাটা হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ধনকেষ্ট ল্যাজেগোবরে হয়েছে। হেরে গেছে মামলায় । আরও কি সব তদন্ত হচ্ছে ওর নামে ।

সারা জনতা উল্লাসে চিৎকার করে ওঠে। আর তারাই ওই ঢাক ঢোল বাজিয়ে এবার আমাদের নিয়েই গ্রামে ঢোকে নাচতে নাচতে। সারা গ্রামের আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে।

আজ বহুদিন পর তারা ধনকেষ্টকে বিপর্যস্ত করতে পেরেছে। লোকটার লোভ আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েছিল। কোনোরকম প্রতিকার করতে পারেনি।

যে ওর বিপক্ষে বলতে গেছে তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে মেরে ধরে তাকে গ্রামছাড়া করেছে। দু-তিনজনকে গায়েব করে দিয়েছে খুন করে। কোনো শাস্তিই হয়নি ধনকেষ্টর। আজ ন্যায়বিচারই হয়েছে।

বাদ্যিবাজনা বাজছে।

ধনকেষ্ট এসে গ্রামে নেমেছে চোরের মত মুখ লুকিয়ে। আর দেখে তার টাকায় পাঠানো ওই ঢাক-ঢোল বাজিয়ে তারই পরাজয়ে ওরা আনন্দ উল্লাস করছে তারই বাড়ির সামনের রাস্তায়।

কালীচরণ বলে—মেরে হটাবো ওদের ?

ধনকেষ্ট দোতলা থেকে দেখছে, মশালের অনেক আলো জ্বলছে। সেই আলোয় দেখে আমাদেরও। ধনকেষ্ট বলে ওসব করিস না। ফৌজিদারিতে ফেলে দেবে। সময় খারাপ যাচ্ছে। গ্রহরাজকে কাল ডাক।

কালীচরণ বলে—বাড়ির সামনে নাচবে ঢাক-ঢোল বাজিয়ে ?

ধনকেষ্ট বলে নাচতে দে। পরে দেখা যাবে। আর ওই ছেলেগুলোর ওপর নজর রাখ। ওরাই যত নষ্টের দল। ওরা না এলে গাঁয়ের লোকদের দলে পেত না কেশব। আর ওই ছোঁড়াগুলোও বিচ্ছুর দল। উঃ—শোকে যেন ভেঙে পড়ছে ওই ধনকেষ্ট। এভাবে অপমানিত হয়নি সে জীবনে।

ধনকেষ্ট জানে এই অপমানের বদলা না নিতে পারলে তার গ্রামে আর সম্মান থাকবে না । আর ভোটে লোককে ভয় দেখিয়ে জিততেও পারবে না ।

অঞ্চলপ্রধান সেজে নানাভাবে প্রচুর টাকা আয় তো হয়ই আর একটা সম্মানের আসনে বসে বহু লোককে নিজের তাঁবে আনা যায়।

এই পঞ্চায়েতেও তার প্রতিষ্ঠা চলে যাবে। লোকে আর কেউ তাকে সমীহ করবে না। ভোটও দেবে না ।

তাই একটা কিছু করতেই হবে। ধনকেষ্ট ভাবছে কথাটা।

কেশব দত্তের বাড়িতে আনন্দের বন্যা নেমেছে। ওর মা আমাদের বলে—কি বলে আশীর্বাদ করব জানি না। ভাই, ভগবান তোদের অনেক কিছু দেন। আজ আমাদের তোরাই বাঁচালি ।

কেশব দত্তও খুশি।

পরদিন সেই গ্রামের লোকেরা আজকের এই শোভাযাত্রায় আসা মানুষদের খাওয়াবার ব্যবস্থা করে।

পরদিন সকালেই এবার সেই বড় পুকুরে জাল নামে। হ্যাঁ, মাছও রয়েছে ওখানে। এক একটা আটদশ কেজি সাইজের লালচে রুই। ইয়া সাইজের কাতলা। জালে পড়ে আকাশে লাফ মারে। তবু ধরা পড়ে।

মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। মাছের ঝোল মাছের মুড়োর মুড়িঘণ্ট আর ক্ষেতের কুমড়ো, আলুর তরকারি তৎসহ বাগানের পাকা আম।

বোম্বাই গোলাপখাসগুলোই পেকেছে। সেই সব আমই পাড়া হল। আর ভোজ।

গ্রামের ভোজের ব্যাপারই আলাদা। বংশীগোপাল দলবল নিয়ে এসেছে। রান্না করছে তারাই। বিশাল উঠানে বসে কয়েকশো লোক সেদিন খেল। সারা অঞ্চলের মানুষ আজ আনন্দ পেয়েছে।

সব খবরই আসে ধনকেষ্টর কাছে।

তার লোকজন সব নানা কাজে ব্যস্ত। রাতের অন্ধকারেই তার আসল কারবার চলে। লঞ্চের শব্দ ওঠে রাতেই ।

আমরা কদিন এখানেই রয়েছি।

এখন হোঁৎকাও বেশ গেড়ে বসেছে। বলে সে-ইস্কুল খুলতে দেরি আছে। ক’দিন টাটকা আম-লিচু-পুকুরের ফেরেস মাছ খাই লই। আর এখানে দুধের স্বাদ দেখছস? তগোর কলকাতায় হরিণঘাটা মাদার ডায়েরির কি ওসব দুধ র‍্যা? জল— স্রেফ ওয়াটার। দিনকতক রেস্ট লইয়া যামু।

অর্থাৎ এখন বাগানের ফল, পুকুরের মাছ আর বাড়ির দুধের লোভেই হোঁৎকা নড়বে না । বলে সে, গাঁখান ভালোই, এক ওই ধনকেষ্ট ছাড়া। পটলা বলে—রোজ রাতে লঞ্চ আসা-যাওয়া করে।

হোঁৎকা বলে–কেসখান জানতি হইব। হালারে দুনম্বর ডোজ দিতি হইব।

তাই রাতের বেলাতে আজ আমরা বের হয়েছি ওই খালের দিকে। গ্রামে কদিন থেকে ঘুরে পথঘাট কিছু জেনেছি। তবু ওদিকে যাবার জন্য বংশীগোপালও সঙ্গী হয়েছে আমাদের। ছেলেটা খুব সাহসী।

বলে সে—শুনি ধনকেষ্টর নানা কারবার। আর রাতে কি যে করে।

তার সামনেই বের হয়েছি আমরা। এদিকটা বেশ নির্জন। খালের ধার থেকেই ধনকেষ্টর দখল করা জমিদারবাড়ির পিছন দিক। ওখানেই লঞ্চঘাট।

রাতের বেলায় দেখি দুটো লঞ্চই এসেছে। তার থেকে কি সব মালপত্র নামছে। আর অন্য এক লঞ্চ থেকে নামছে দুজন প্যান্ট পরা লোক। দেখে মনে হয় বিদেশিই।

ধনকেষ্ট তাদের খাতির করে বাড়ির এদিকের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বসায়।

আমরা খালের ধারে ঝোপের মধ্যে বসে মশার কামড় খাচ্ছি। দেখা যায় ওপাশের ঘরে বসে বিদেশিদের কিসব মূর্তি দেখাচ্ছে ধনকেষ্ট।

বিদেশি সাহেব দুজনও ব্রিফকেস ভর্তি টাকা এনেছে। কি একটা মূর্তি দেখে দরদামও হচ্ছে। মশার কামড়ে অস্থির হই। তবু মারতে পারি না। হোঁৎকা ইশারায় জানায়—চুপ করে থাক ।

সে দেওয়াল ঘেঁষে এগিয়ে গিয়ে কাছ থেকে ওদের কথা কান করে শুনছে। দেখি টাকার লেনদেন হয়ে গেল। খানাপিনার আয়োজনও হয়েছে। এর মধ্যে কালীচরণ খড়ের বেড় দিয়ে মূর্তিটা প্যাক করে একটা কাঠের বাক্সেও পুরলো।

এরপরই সাহেবরা লঞ্চে উঠে গেল, কাঠের বাক্সটাকেও তোলা হল লঞ্চে। লঞ্চ চলে গেল।

এবার হঠাৎ পায়ের নীচে একটা লম্বা বস্তুকে এঁকেবেঁকে যেতে দেখে পটলা চিৎকার করে ওঠে সব ভুলে। স-সাপ !

লাফ দিয়ে সরে আসি সেখান থেকে আর তখুনিই ওদিকের ছাদ থেকে ধনকেষ্টর গলা ভেসে আসে।

—কে! কারা ওখানে?

জোরাল টর্চের আলো পড়ছে এদিকে-ওদিকে। ধনকেষ্ট টের পেয়েছে আমাদের উপস্থিতি। কালীচরণ, তাপ সিং আরও দু একজন দৌড়ে আসে। ধনকেষ্ট চিৎকার করে, -ধর, যেন পালাতে না পারে।

এদিক ওদিক টর্চের আলো পড়ছে। আমরাও দৌড়াচ্ছি। দুএকবার টর্চের আলোও পড়েছে আমার উপর।

পিছনে ধেয়ে আসছে নেকড়ে বাঘের মত কালীচরণের দল। ধরতে পারলে শেষ করে দেবে।

লাফ দিয়ে এসেছে তাপ সিং, ধরবেই আমাকে।

আমিও দুহাত দিয়ে তাপ সিংয়ের সেই বিড়ালের ল্যাজের মত পুরুষ্টু গোঁফ জোড়া ধরে ঝুলে পড়েছি। তাপ সিংয়ের গোঁফ পড়পড় করে ছিঁড়ছে আমার ওজনে। ঝুলন্ত দেহটাকে চেপে ধরেছে তাপ সিং। পালাচ্ছে—পাকড়া-পাকড়া ।

এমন সময় গোবরা বিপদ বুঝে এসে এইসা লাথি কষেছে যে তাপ সিং বাঁধের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়ে খালের জলে আর আমার হাতে উঠে আসে তাপ সিংয়ের সেই ল্যাজের মত কিছু গোঁফ

এই ফাঁকে সোজা দৌড় কষাই ।

কোনোমতে ছত্রভঙ্গ অবস্থায় ফিরে এলাম কেশব দত্তের বাড়িতে। পায়ে জল কাদা, হাত-পা ছিঁড়েছে বুনো কুলের কাঁটায়। হোঁৎকা বলে—খুব বিপদ গেছে গিয়া। পটলাই ডোবাইল। পটলা বলে—ইয়া সাপ।

আমি জানাই—ওটা ঢ্যামনা সাপ। কামড়ায় না ।

পটলা বলে—কি-কি করে জানব? যদি খ-খরিস হত?

হোঁৎকা বলে, চুপ মাইরা থাক। কারো রে কইবি না। হালা ধনকেষ্ট দেহি লাখ লাখ টাকার দুনম্বরি ব্যবসাও করছে। ওর আসল কারবারখান বুঝছি।

পটলা বলে—ব্যাটা ডেঞ্জারাস লোক।

হোঁৎকা বলে—তাই দেখছি, নে শুইয়া পড়। রাত হইছে।

ধনকেষ্ট প্রথম দিন থেকেই আমাদের উপর নজর রেখেছিল। আর ওই মামলায় হারার পর সেই বেয়ারার কাছে ও জেনেছে যে কে একজন তার লোক জজসাহেবের বাংলোয় ভেট এনে সাহেবকে চটিয়ে গেছে। তারপর এইভাবে মামলায় হেরেছে, তার বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে।

আর ওই ছেলেটাকেও দেখিয়ে দেয় বেয়ারা।

তিনি ওই হোঁৎকাই ।

রাগে জ্বলে ওঠে ধনকেষ্ট। ওই ছেলেগুলো এখানে এসে তার বুকে বসে এভাবে তাকে বিধ্বস্ত করবে এইটা মেনে নিতে পারেনি। ভাবছিল কিছু একটা করতে হবে।

আর আজকের রাতের ঘটনায় ধনকেষ্ট তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে। গ্রামে এতকাল ধরে এই মূর্তি পাচারের কাজ করছে। তার ঘরের গুদামে বহু লাখ টাকা দামের মূর্তি রয়েছে। রয়েছে অনেক কিছু। গ্রামের কোনো লোক তার দিকে নজর দিতে সাহস করেনি। অথচ এই ছেলেগুলো এসেছে তারই দুর্গে হানা দিতে। আজ ওরা বোধ হয় তার গোপন ব্যবসাটার খবরও পেয়েছে। আর ওদের ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না।

ধনকেষ্ট তাই এবার চরম ব্যবস্থাই নিতে চায়। ওদিকে তাপ সিং কাদা মাখা অবস্থায় জল থেকে উঠে দেখে তার শখের গোঁফ জোড়াটা আর নেই। কে যেন খামচে তুলে নিয়ে গেছে। চামড়া উঠে গেছে। তার বীরত্বের এহেন অবমাননায় গর্জে ওঠে সে। খুন করেগা।

ধনকেষ্ট বলে—খুন করতে হবে না। ওদের যে কটাকে পারিস তুলে আন। আজ রাতেই। তারপর ওদের ঠান্ডা করে দেব।

রাত্রি হয়ে গেছে।

আমরা ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ কাদের ধস্তাধস্তির শব্দে চমকে উঠি।

হোঁৎকা দৌড়ে বের হয়ে যায়। আমি ঠিক কী করব বুঝতে পারি না।

গোবরা চিৎকার করছে নীচে থেকে—নেমে আয় শিগগির।

ওদিকে কেশব দত্ত জেগে উঠেছে। চারিদিকে খোঁজাখুঁজি চলে। কিন্তু সবাই আছি, পটলাকেই পাওয়া যাচ্ছে না। সারা ঘরের জিনিসপত্রও তছনছ করা। ব্যাগগুলো এদিক ওদিকে পড়ে আছে।

গোবরা বলে—পটলাকেই পাওয়া যাচ্ছে না।

ফটিকের পাশেই শুয়েছিল সে। সেও ঘুমে অচেতন।

কেশব বলে—তোমরা টের পাওনি?

হোঁৎকা বলে—ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিসের শব্দে ঘুম ভাঙল। ফটিক এদিক ওদিকে খোঁজে। কেশবের মা বলে—ছেলেটা গেল কোথায়? বাথরুমে যায়নি তো?

বাথরুমও ফাঁকা।

ভোর হতেই খবরটা ছড়িয়ে পড়ে পটলাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরে কারা নাকি ঢুকেছিল। পটলাকে নিয়েই বিপদ।

এবার কী হবে কে জানে।

কেশবের মা বলে—কী হবে, কুটুমের ছেলে এমনি করে হারিয়ে যাবে এখান থেকে, কী জবাব দেব।

কেশব দত্তও ভাবনায় পড়ে।

কালকের রাতের সে-ই অভিযানের কথাটাও জানাতে পারি না। তবে মনে হয় এ ওই ধনকেষ্টরই কাজ। সেই প্রতিশোধ নেবার জন্য এমনি করে থাকতে পারে।

কেশব দত্ত বাদল মাস্টারকে নিয়ে থানায় যায়। আমরাও গেছি।

থানা মাইলখানেক দূরে গোপালগঞ্জে।

দারোগাবাবু ধনকেষ্টর বিশেষ পরিচিত। আর ধনকেষ্ট যে পুলিশকেও হাতে রাখবে সেইটাই স্বাভাবিক ব্যাপার।

পুলিশ অফিসার আমাদের দেখে চাইল বিরক্তভাবে। সাত সকালে তাকে জ্বালাতে এসে যেন অপরাধই করেছি আমরা

আমাদের কথা শুনে দারোগাবাবু টেবিলে তবলা বাজাতে বাজাতে বলে—দেখুন মামার বাড়িটাড়ি বেড়াতে গেছেন। কলকাতা চষা ছেলে এই অজ পাড়াগাঁয়ে হারিয়ে যাবে? বলেন কি বাদলবাবু? যান বাড়িতে বসে থাকুন। দেখবেন ঠিক ফিরে আসবে। যান।

এই বলে আমাদের বিদায় করতে চায় সে ৷

কেশববাবু বলে—থানায় একটা মিসিং ডাইরি করাতে হবে।

দারোগাবাবু এবারে দপ করে জ্বলে ওঠে। বলে—সে, ছেলেখেলা পেয়েছেন? যান—ওসব ব্যাপারে ডাইরি করা যায় না। আসুন তো।

তবু বাদলবাবু বলে—আমরা লিখিত রিপোর্ট দিয়ে যাচ্ছি। এইটা আপনার ওই কেরানিবাবুকে সই করে নিতে বলুন। তারপর কিছু করেন না করেন আপনাদের ব্যাপার । দারোগাবাবু যেন বেকায়দায় পড়েছে। তাই বলে—ওহে, দরখাস্ত নিয়ে নাও৷

এখানে কিছুই হবে না তা বুঝেছি।

তবু দরখাস্ত দিয়ে বের হবো এমন সময় ধনকেষ্টবাবুকে শোভাযাত্রা করে আসতে দেখে দারোগাবাবু নিজেই ঘর থেকে বের হয়ে এসে অভ্যর্থনা করে-আসুন ধনকেষ্টবাবু।

ধনকেষ্ট একা আসেনি। সঙ্গে সেই ভীষণ বডিগার্ড কালীচরণ রয়েছে। আর পিছনে একটা লোকের মাথায় ঝুড়িতে নানা টাটকা আনাজ, ফল-ফুলকপি, এক হাঁড়ি সন্দেশ আর দড়িতে ঝোলানো একটা কেজি তিনেক নধর রুই মাছ।

ধনকেষ্ট আমাদের থানায় দেখবে, তা ভাবেনি।

হঠাৎ দেখে বলে ওঠে—কিহে বাদল, তোমরা এখানে?

ফটিক ভালো ফটোও তুলতে পারে। দারোগাবাবুর সামনে নামানো সেই ভেট–ঝুলন্ত মাছ আর ধনকেষ্টর ভেট নিবেদনের দৃশ্যটা ফটিক এক ফাঁকে সুন্দরভাবে তুলে নেয় । ওরা ঠিক খেয়াল করে না।

বাদলবাবু বলে—কেশবের বাড়িতে এরা বেড়াতে এসেছিল কলকাতা থেকে। কাল রাত থেকে ওদের একজনকে পাওয়া যাচ্ছে না।

খবরটা শুনে ধনকেষ্টও সমবেদনা জানায় ।

সেকি গ্রামে বেড়াতে এসে উবে গেল? একি কাণ্ড। গ্রামের বদনাম, দেখো—দিঘি পুকুরে ডুবে যায়নি তো। কলকাতার ছেলে সাঁতার বোধ হয় জানে না। আহা—খুঁজে দেখো। দরদ দেখিয়ে ভিতরে চলে যায়।

আমরাও বের হয়ে আসি। হোঁৎকা বলে—কিছু বুঝলেন বাদলদা? হালায় ধনকেষ্ট থানায় আইসে ক্যান? আর আইজই।

বাদল বলে—এখানে ওকে প্রায়ই আসতে হয় ৷

হোঁৎকা কি ভাবছে।

বেলা হয়ে যায়, পটলার কোনো খোঁজই মেলে না।

গোবরা বলে-কেউ তাকে নিশ্চয়ই ধরে নিয়ে গেছে। কোথাও আটকে রেখেছে। হোঁৎকাও সায় দেয়।

—তাই। কাল রাতে ধনকেষ্টর ওখানে গেছলাম। পালাবার সময় ওরেই দেখছে। তাই ধনকেষ্টই ওরে মুখ বন্ধ করার জন্য তুলে নিয়ে গেছে।

কথাটা ভাবছি আমরাও। তবু বলি—কিন্তু প্রমাণ তো নেই। আর এখানের পুলিশও যে ধনকেষ্টর পোষা তা তো নিজেই দেখলি। ওরাও কিছুই করবে না। কোনো সাহায্যই পাবে না । উল্টে আমাদের ধরেই না হাজতে পুরে দেয়।

পটলাকে উদ্ধার করতেই হবে। ও আমাদের মধ্যমণি। কামধেনু। আর হোঁৎকার দায়িত্বেই ঠাকমা পটলাকে ছেড়েছে। হোঁৎকা তাই ভাবছে।

বলে হোঁৎকা–সত্যি তুই চটপটে বলিয়ে-কইয়ে আছস। বংশীদারে লই তুই আইজই চুঁচুড়ায় গিয়া পটলার কাকার চিঠিখানা ওখানের পুলিশের বড়কর্তারে দিবি। কইবি এখানে ওই ধনকিষ্টর সব ব্যবসার কথা। কাল রাইতের যা দেখছিস সবই কইবি। পটলাকে ধনকিষ্টই তুইলা লইয়া গেছে। ওখানেই রাখছে ওরে।

আমি বলি—কলকাতায় পটলাদের বাড়িতে ফোন করব?

হোঁৎকা বলে—না। আজ নয়। আর এক-দুদিন দেইখা করা যাবে ।

পটলার বিপদ। আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতেই হবে ওকে বের করার জন্য। তাই আমি বংশীগোপালকে নিয়ে বের হয়ে গেলাম সদরের উদ্দেশে।

সেই দীর্ঘ পথ দুখানা বাস বদল করে বৈকাল নাগাদ সদরে পৌঁছে খুঁজে খুঁজে এক রিকশাওয়ালাকে ভর করে পুলিশ সাহেবের বাংলোয় পৌঁছলাম

এর মধ্যে শহরে এক বিচিত্র ঘটনা ঘটে গেছে। আজ সকালেই গঙ্গার ধারে একটা লঞ্চ থেকে দুজন বিদেশি কাঠের বাক্স নিয়ে লঞ্চঘাট থেকে রিকশা নিয়ে স্টেশনের দিকে আসছিল। সেই বাক্সটা নামাতে গিয়ে অসাবধানে হাত থেকে পড়ে ভেঙে যেতে তার ভিতর থেকে কষ্টি পাথরের কোনো দেবমূর্তি বের হয়ে পড়ে।

লোকজনও জুটে যায় ।

কাগজে মূর্তি চুরির খবর অনেকেই জেনেছে। হঠাৎ ওই দুই বিদেশি সাহেবকে হিন্দু মূর্তিসমেত দেখে তারা আলোচনা শুরু করে। আর এই ফাঁকে সেই বিদেশি দুজন মূর্তি ফেলেই সরে পড়ে। তাদের আর পাত্তা মেলে না।

পুলিশের হাতে মূর্তি দেয় জনসাধারণ।

এই নিয়ে শহরে বেশ মিছিলও হয়েছে। পুলিশের চোখের সামনে এই সব মূর্তি পাচার হচ্ছে এ নিয়ে খবরের কাগজের সাংবাদিকরাও প্রশ্ন তোলে। এস-পি সাহেবের অফিসেও ডেপুটেশন দিয়েছে। জেলা পুলিশের বড়কর্তা বাবুও এবার ভাবনায় পড়েছেন। ওই মূর্তিপাচারকারীর দল খুবই সক্রিয়, আর তার পিছনে নিশ্চয়ই অর্থবান—প্রতিষ্ঠাবান লোকজনই রয়েছে।

তিনি জনসাধারণকে আশ্বাস দেন—আমরা এর জোর তদন্ত করছি। যেভাবেই হোক, ওই জাতীয় মহামূল্যবান সম্পদ বিদেশে পাচার যারা করছে তাদের ধরা হবেই।

কথাই দিয়েছেন তিনি ।

কিন্তু কিভাবে তদন্ত করাবেন—কোন্ পথে এগোবেন তার কোনো হদিস এখনও করতে পারেননি। অন্য অফিসারদের সঙ্গে মিটিংও করেছেন। কিন্তু সুরাহার কোনো উপায় এখনও বের করতে পারেননি।

বৈকালে ক্লান্ত হয়ে বাংলোয় ফিরেছেন সুবিনয়বাবু। সবে চায়ের কাপ নিয়ে বসেছেন স্নান সেরে এমন সময় আমাদের ঢুকতে দেখে চাইলেন।

কোথা থেকে আসছ? কী দরকার?

ওর হাতে পটলার মেজকাকার চিঠিখানা তুলে দিই আমি।

সুবিনয়বাবু চিঠিখানা দেখে আমাদের বসতে বলেন ইশারায়। চিঠিখানা পড়তে থাকেন। পড়া শেষ হলে শুধোন — কী ব্যাপার ?

এবার আমিই সব ঘটনা বলতে থাকি ।

ধনকেষ্ট সাহার কিছু ইতিহাস বংশীগোপালই গ্রাম্য ভাষায় শোনায়। তার অত্যাচারের নানা কথা আর তার পরের ঘটনাগুলোর বর্ণনা দিই আমি।

আর গতরাত্রে ধনকেষ্টর বাড়িতে যা যা দেখেছিলাম সেই ঘটনাগুলোর নিপুণ বর্ণনা দিই। সেই দুই বিদেশির কথা—মূর্তির কথাও।

আর আমাদের সে দেখে ফেলেছিল। তারপর রাতে ওর লোকই পটলাকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে।

থানায় যাওনি?

পুলিশ সাহেবের কথায় এবার আমি এক মোক্ষম প্রমাণই পেশ করি। ফটিক দারোগাবাবু আর ধনকেষ্টবাবুর ভেট দানের দৃশ্যটা সুন্দরভাবে তুলেছিল। এখানে এসে ফোটোর দোকান থেকে ডবল খরচা দিয়ে ওটাকে বেশ বড় করেই তৈরি করে এনেছিলাম। সেই ফোটোটা বড় সাহেবের টেবিলে দিয়ে বলি—

দারোগাবাবু আমাদের ডাইরি নেননি। নেবেন কেন স্যার? ধনকেষ্টবাবু ওকে হাতে করে রেখেছেন। কেমন ভেট নেন দারোগাবাবু তার কাছ থেকে দেখুন? তিনি ধনকেষ্টর বিরুদ্ধে কিছুই করবেন না।

এস-পি সাহেব ওই কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের কর্তব্যের ছবি দেখে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন। বলেন—ননসেন্স। এদের জন্য সারা পুলিশ বিভাগের বদনাম হয় ।

এসবের ব্যবস্থা করছি।

এস. পি সাহেব বলেন—ওই বিদেশিরা যে মূর্তি নিয়ে আসছিল ধনকেষ্টবাবুর ওখান থেকে সেটা জানলে কী করে?

আমি জানাই। দেখলাম একটা মূর্তিকে খড় দিয়ে জড়িয়ে বস্তায় পুরে একটা কাঠের বাক্সে পুরে দিল কালীচরণ।

—কালীচরণ।

এস. পি সাহেবের কথায় জানাই–ও ধনকেষ্টর এক নম্বর সহচর। আর ওই বিদেশিদের কাছে ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিল ধনকেষ্টবাবু। তারপর ওরা ধনকেষ্টবাবুর লঞ্চ কি যেন নাম হ্যাঁ। এস-এল ধনপতি, ওতে চড়ে বের হয়ে গেল তখন রাত প্রায় এগারোটা হবে।

পুলিশসাহেব সব কিছু নোট করে নেন।

তাঁর কাছে ঘটনাটা এবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই চটমোড়া খড় জড়ানো অবস্থাতেই মূর্তিটাকে কাঠের বাক্সে এখানে পাওয়া গেছে। তবে সেই বিদেশি দুজনকে পাওয়া যায়নি।

কারা গোলমাল বুঝে এই দামি মাল ফেলে রেখেই পালিয়ে গেছে। তবে ক্রেতাদের ঠিকানা না পাওয়া গেলেও বিক্রেতা এবং পাচারকারীর নাম-ঠিকানা পেয়ে গেছেন তিনি।

আর পুলিশসাহেবও বুঝেছেন এই চক্র ইতিমধ্যে স্থানীয় দারোগাকেও হাতে এনে এই কাজ করছে। তার প্রমাণও পেয়েছেন তিনি।

সেই চক্র মালপাচার করেই থামেনি। তাদের এই কাজের খবর পেয়েছে এই পটলা । তাই তাকেও গুম করেছে। দরকার হলে প্রমাণ লোপ করার জন্য খুনও করতে পারে।

তাই পুলিশসুপার ফোন তোলেন। আর্দালি ধরেছে ওদিকে। এস. পি বলেন—ডি. এস-পি সাহেবকে এখুনি আমার বাংলোয় আসতে বলো। খুবই জরুরি দরকার।

এবার এস. পি সাহেব আমাদের দিকে চাইলেন ফোন রেখে। বলেন চা-টা খাও। আর রাতে এখানেই থাকবে। তোমাদের দরকার পড়তে পারে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও করছি। বেয়ারাকে ডেকে বলেন—এদের গেস্টরুমে থাকার ব্যবস্থা করে দাও। ওরা এখন এখানেই থাকবে। যাও।

বেয়ারার সঙ্গে বের হয়ে বারান্দার একপ্রান্তে একটা ঘরে এসে ঢুকলাম। দুটো খাট-বিছানা লাগোয়া বাথরুম সবই আছে।

মনে হল ওদিকে বেশ কর্মব্যস্ততা শুরু হয়েছে। দু’একটা—জিপ এসে থামল। ওদিকের একটা ঘরে বোধহয় ওয়ারলেস সেট আছে, রেডিও ম্যাসেজ পাঠানো রিসিভ করা হয় ওখানে। ওখানে যেন কর্মব্যস্ততা পড়েছে।

আশা করতে পারি পটলচন্দ্রের অনুসন্ধানের জোর ব্যবস্থাই চলেছে। হয়তো এবার তার সন্ধান মিলতে পারে। জানি না হোঁৎকারা ওখানে এখন কী করছে?

রাত নেমেছে গ্রামে। সন্ধ্যার মুখে এখনও গ্রামে শিয়ালের ডাক শোনা যায়। সন্ধ্যা বেলাতেই তাদের কোরাস গানের আসর বসে হুক্কা হুয়া হুয়া !

তারপর আহার্যের সন্ধানে বের হয়। তখন বিশেষ চিৎকার করে না। শিকার সাবধান হয়ে যাবে বলে। তবে দু’একটা দলছুট শিয়াল চিৎকার করে। আবার থেমে যায়।

হোঁৎকা বের হয়েছে গোবরা ফটিককে নিয়ে। ওদের গন্তব্যস্থল ধনকেষ্টর বাড়ির ওদিকে। পথ প্রদর্শক হিসাবে চলেছে বাদলমাস্টারের ছোট ভাই পরেশ। ছেলেটা খুবই সাহসী আর হোঁৎকার দলে এর মধ্যে মিশে গেছে। বৈকালে একসঙ্গে ফুটবলও খেলে হোঁৎকা-গোবরা। রাতের বেলা এদিকটা নির্জন।

ঘন বাঁশ বন, পিটুলি গাছে ভরা। আর বুনো কাঁটাঝোপও আছে। ওপাশে ধনকেষ্টর নতুন বাড়ি। এদিকটায় এখন ধ্বংসস্তূপই। তবু দোতলা বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে কোনোমতে। স্তব্ধ চারিদিক।

মাঝে মাঝে দু-একটা শিয়ালের ডাক, পাখির ডানার ঝটপটানি শোনা যায়। বাতাসে মিশেছে খালের বুকে জলের ঢেউ ভাঙার শব্দ।

আমরা ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি। পরেশ এসব জায়গায় আসা-যাওয়া করে । লুকোচুরিও খেলে এখানে। দেওয়ালে এর মধ্যে দু’একটা বট অশ্বত্থের গাছও গজিয়েছে, পরেশ বলে-একটু দেখে আসব।

গোবরা শুধোয় কেন ?

পরেশ বলে চাপাস্বরে—ত্যানারা আছেন।

—মানে?

পরেশ হাসে। নমস্কার করে বলে।—মা মনসার বাহনরা গো। এসব তো ত্যানাদেরই আস্তানা। চমকে ওঠে ফটিক।

কালরাতে পটলাও এমনি সাপ দেখেই কেস ভণ্ডুল করেছিল। পরেশ অভয় দেয়—তাদের গায়ে পা না দিলে ওরা কিছু বলে না। এসো।

একটা উঠান মত।

চারিদিক ভগ্নপ্রাসাদের স্তূপ। হঠাৎ ওদিকের দোতলার একটা ঘরে যেন ক্ষীণ আলোর আভা দেখা যায়। কাদের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরও শোনা যায় ।

হোঁৎকা ভাঙা দেওয়ালের আড়ালে লুকোয় যাতে উপর থেকে টর্চ ফেলেও কেউ তাদের দেখতে না পায় ।

হোঁৎকা এবার চমকে ওঠে। উপরের ঘর থেকে শোনা যায় ধনকেষ্টর চাপা গর্জন। কাকে যেন শাসাচ্ছে সে৷

–বল। এখানে কেন এসেছিলি তোরা?

ওই কলকাতা থেকে এখানে এসে ধনকেষ্টর উপর গোয়েন্দাগিরি। শেষ করে দেব তোকে। কথাগুলো ধনকেষ্টর।

আর বলছে নিশ্চয় পটলাকে। না হলে কলকাতা থেকে আসার কথা বলবে কেন।

পটলা ভাবতে পারেনি রাতের অন্ধকারে হানা দিয়ে ওই ধনকেষ্টর দল তাকেই এনে তুলবে। ঘুম ভেঙে যেতেই অনুভব করে পটলা তার দুহাত কারা বেঁধে ফেলে মুখে একটা দুর্গন্ধময় গামছার মত কি গুঁজে দিয়েছে যাতে কোনোরকম আওয়াজ করতে না পারে।

হোঁৎকারা জেগে ওঠার আগেই তাকে ঘাড়ে করে নীচে নামিয়ে ওরা দৌড়ালো। ছটফট করে পটলা, কিন্তু করার কিছুই নাই।

কোথায়, কেন তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা ভাবতেও পারে না পটলা। শেষ অবধি অন্ধকারে বন-বাদাড় ভেদ করে তাকে এনে এই ভাঙা বাড়িটাতে তুলেছে।

আর ধনকেষ্টকে দেখে পটলা চিনতে পারে। ধনকেষ্ট বলে একটাকে মাত্তর এনেছিস কালী? বাকিগুলোকে ছেড়ে রেখে এলি যে? কালীচরণ বলে—খোঁজ-খবর নিয়ে দেখেছি এইটাই পালের গোদা! আর একসঙ্গে সবগুলোকে তুলে আনলে সামলাতে পারবেন না । যা বিচ্ছুর দল। ধনকেষ্ট মাথা নাড়ে।

—তা যা বলেছিস। হাড় শয়তান এরা। আমার ভাতে হাত দিয়েছে, ওদের কাউকে জ্যান্ত ফিরে যেতে দেব না। আপাতত এটাকেই আটকে রাখ। তারপর কালী বলে।

—এইটাই ওদের পাণ্ডা। মস্ত বড়লোকের একমাত্র ছেলে।

ধনকেষ্ট কি ভেবে বলে।—তাহলে বুদ্ধি আছে তো দেখছি।

পটলার হাত পায়ের বাঁধন খোলেনি। মুখটা খুলেছে পটলা বলে—আমাকে কে-কে কে ধরে এনেছ? ধনকেষ্ট নিজেও ঈষৎ তোতলা। সে পটলাকে ওইভাবে কথা বলতে দেখে গর্জে ওঠে।

ই-ই-ইয়ার্কি হচ্ছে আ-আমার সঙ্গে।—ভেংচাবি আমাকে?

পটলাও অবাক। তার মতই জিভটা মাঝে মাঝে যে আলটাকরায় সেট হয়ে যায় ধনকেষ্টর তা জানত না।

পটলা বলে—ভ-ভ্যাংচাব কেন?

ফে-ফের! ধনকেষ্ট ফুসে ওঠে। বলে সে—খ-খবরদার ।

কালীচরণ ব্যাপারটা বুঝে বলে—কত্তা। ওই ছেলেটাও তোতলা গো! দেখছনি ত-ত করছে।

ধনকেষ্ট এবার চুপ করে যায়।

বলে সে—আটকে রাখ এটাকে। যেন পালাতে না পারে। বাকিগুলোকেও এবার জালে ফেলে গলা টিপে শেষ করতে হবে। এটা হাঁড়ির ক-কই মাছের মত জিয়ানো থাকুক। প-পরে দেখব।

পটলাকে দিনভোর হাত-পা বেঁধে ওই ভাঙা ঘরে আটকে রেখেছে। চারিদিকে ধ্বংসস্তূপ এখানে কোনো মানুষজন আসে না ।

দুপুরে একটা থালায় ভাত—তাও কড়কড়ে আর বাটিতে একটু ডাল তাতেই কুমড়ো মত কি দেওয়া, তাই এনেছে একটা লোক।

আর দুটো লোক ওপাশের ঘরে তালাই পেতে শুয়ে বসে রয়েছে। ওরাই তার পাহারাদার। খাবারটা দিয়ে বলে লোকটা–নাও, খেয়ে নাও ।

পটলা ওই ফাটা লালচালের ভাত আর ওই একটু ডাল তরকারির মিশ্রণ দেখে বলে—ওসব আমি খাই না।

লোকটা লালচে দাঁত বের করে বলে—একি তোমার মামার বাড়ি। যে মাছ-মাংস ভাত পাবে। যা পাচ্ছ তাই খাও। এদিকের কে বলে—আরে মদনা ও ব্যাটা না খায় আমাকেই দে। ওরটাও খেয়ে নিই। ওর রাজভোগ খাওয়া অভ্যাস—উপোসই দিক।

লোকটা তার খাবারও অনায়াসেই খেয়ে নিল। দেখছে পটলা। কুঁজোর জল খেয়েই চুপচাপ বসে থাকে পটলা ।

মনে পড়ে হোঁৎকাদের কথা।

এতক্ষণ ধরে তার খবর নাই। ওরা নিশ্চয়ই খুঁজছে তাকে। কিন্তু এই ধনকেষ্ট যে তাকে এখানে এনেছে সে খবর ওরা পায়নি এখনও। পেলে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করবে।

পটলাও ভাবতে পারে না কি করে খবরটা পাঠাবে।

দিন কেটে যায়, তখনও পটলা কোনো খবর পাঠাতে পারেনি। এই ধ্বংসপুরীতে বৈকালের পরই সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসে।

ধনকেষ্ট আজ বেশ খুশিই।

কাল রাতে বিদেশিদের কাছে দশলাখ নগদ টাকার বিনিময়ে ওই মূর্তিটা পাচার করেছে। ওরা এসব কাজের পুরানো লোক। ভারতবর্ষের নানা প্রদেশে ওদের এজেন্ট ছড়িয়ে আছে। নানা প্রদেশ থেকে বহু মূল্যবান প্রাচীন মূর্তি সংগ্রহ করে ওরা জাহাজে না হয় প্লেনে নেপাল, বাংলাদেশ থেকেও নানা উপায়ে বিদেশে ওসব চালান করে। সেখানের বহু কোটি কোটি ডলারের মালিকরা চড়া দামে ওইসব পুরাবস্তু কেনে।

ওই বিদেশিরা কাল ধনকেষ্টর কাছ থেকে নগদ টাকায় মাল নিয়ে গেছে আবার সামনের সপ্তাহেই আসবে। তাই ধনকেষ্টও এইদিন আরও দুতিনটে বহু প্রাচীন মূর্তি সংগ্রহ করে এনেছে।

ভালোই চলছিল তার বাণিজ্য। হঠাৎ এই ছেলেগুলো এসে ক’দিনের মধ্যেই তার এতদিনের তিল তিল পরিশ্রম করে গড়ে তোলা সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূলে ফাটল ধরিয়েছে। ধনকেষ্টর হাত থেকে ওই বাগান পুকুর ছিনিয়ে নিয়েছে। গ্রামের লোকের সামনে দেখিয়ে দিয়েছে ধনকেষ্টকেও আঘাত করে পিছু হটানো যায়।

বাদলমাস্টারের দলও তাই সাহস পেয়ে তার বাড়ির সামনে নেচে-কুঁদে খেউড় গেয়ে সেই সাবধানবাণী শুনিয়ে গেছে।

আর তারপর ওই ছেলেগুলো রাতের অন্ধকারে তার উপর গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছে। একটাকে ধরেছে। বাকি ক’টার ব্যবস্থা আজই করবে।

ধনকেষ্ট তাই থানায় গেছল। দারোগাবাবুকে ওই ভেট আর নগদ বেশ কিছু টাকা দিয়ে এসেছে।

আজ রাতেই কালীচরণের দল গ্রামের ধনকেষ্টর এক বশংবদ লোক গিরিধারীর বাড়িতে চুরির অভিনয় করবে। গিরিধারীও চোর চোর বলে চেঁচাবে। লোকজন জুটে যাবে। চোর ধরার জন্য তারা দৌড়াদৌড়ি করে কেশব দত্তের বাড়ির সামনে হাজির হয়ে চিৎকার করবে – চোর এখানে ঢুকেছে। বের করে দাও।

ধনকেষ্ট বলে—কালী, সবাইকে ঠিকঠাক বলে রেখেছিস তো?

কালী বলে হ্যাঁ। গিরিধারীও সব জানে। গদাইদেরও ফিট করে রেখেছি। ওরা চোরের পিছনে দৌড়ে কেশব দত্তের বাড়ির সামনে গে হুজ্জুতি করবে।

ধনকেষ্ট এর পরের কাজও করে রেখেছে।

বলে থানাতেও খবর যাবে। দারোগা বাকি ছোঁড়াদের টেনে বের করবে। গদাইরা যেন বলে ওদেরই পালাতে দেখেছে অন্ধকারে।

পটলা শুনছে প্ল্যানটা। বলে সে—ওরা চুরি করতে যাবে কে-কেন? কালী ধমকায় চোপ বে। ওদেরই চুরির দায়ে কোমরে দড়ি পরিয়ে জেলে পাঠাব। আর তোকে ধনকেষ্ট বলে গলা টিপে শেষ করে খালের পলিতে পুঁতে দে-দেব। হাড়ভাঙা হলুদপুরে এসে ক-কলকাতার কে-কেদ্দানি দেখানো বের করে দেব।

পটলা চমকে ওঠে। একেবারে নিখুঁত পরিকল্পনা করে আঁটঘাট বেঁধেই পা ফেলে এই ধনকেষ্ট।

এবার সে এখানের অঞ্চলপ্রধান। পুলিশও তার হাতের লোক। হোঁৎকাদের চুরির দায়ে ধরে চোর সাজাতে তার সাক্ষাৎ প্রমাণের অভাব হবে না। ফলে তার বন্ধুদের বিনা দোষে জেলই হবে চুরির দায়ে ।

আর তার পরিণাম যে ভীষণ তাও বুঝেছে পটলা। বলে সে—ওদের ছে-ছেড়ে দিন। আমার যা হয় হোক ।

ধনকেষ্ট এবার ঠা ঠা করে হাসছে। শত্রুকে পিষে মেরে ফেলেই সে আনন্দ পায়। পটলার কথায় বলে—ধনকেষ্টর ল্যাজে পা দিয়েছ। গোখরো সাপের ল্যাজে পা দিলে কি-কি হয়? ছোবল খেতেই হয় ছো-ছোকরা।

ধনকেষ্ট বলে—কালী। রাত হয়েছে। যা শুভ কাজ সেরে ফেল। গিরিধারীকে বলে—থানায় যা। গদাইরাও যেন ঠিকমতো চেল্লামিল্লি দৌড়ঝাঁপ করে। ওই ছোঁড়াগুলোকে থানার লকআপে পুরে তবে এসে খবর দিবি ।

এমন সময় একজন খবর দেয়—কর্তাবাবু, নীচে দারোগাবাবু এসেছে। অবাক হয় ধনকেষ্ট।—এ সময় দারোগাবাবু! এখানে ?

লোকটা বলে—বললেন খুব জরুরি দরকার আছে আপনার সঙ্গে। এখুনিই চলুন।

দারোগাবাবু এখানে বেশ আরামেই ছিল। এসেছিল গোলকগঞ্জ থানায় দুবলা পাতলা হয়ে । এক মেয়ের বিয়ে দিয়ে ক্যাশকড়িও কমে গেছল। খুব হতাশ হয়েই টাউন থানা থেকে এই ধাপধাড়া গোলকগঞ্জে এসেছিল।

কিন্তু ক’বছরেই ধনকেষ্টবাবুর কল্যাণে এখন নগদ টাকাও প্রচুর জমিয়েছে স্বনামে বেনামে, আর খাঁটি দুধ-ঘি-মাছ-মাংসের ভেট পেয়ে ক’বছরেই নেওয়াপাতি ভুঁড়িও গজিয়েছে। ধনকেষ্টবাবু নানা কারবার করে তা জানে দারোগা শশীপদবাবু। তা করুক তবে ধনকেষ্ট মাসিক হাজার দশেক করে প্রণামীও দেয়। এ ছাড়াও নানা ভাবেই শশীপদবাবু ম্যানেজ করে ক’বছরেই গুছিয়ে নিয়েছে। শালার নামে সল্টলেকে বাড়িও তুলেছে। ভালোই চলছিল।

হঠাৎ ওই ছেলেগুলো কলকাতা থেকে এখানে এসে শুকনো ঝামেলা বাধিয়ে বসল। ধনকেষ্টবাবু বিপদে পড়ল আর সেই সঙ্গে ফেঁসে গেল শশীপদ দারোগাও। আজ সন্ধ্যাতেই সদর থেকে আর্জেন্ট রেডিও মেসেজ এসেছে, তাকে এখুনিই ওই থানার চার্জ বুঝিয়ে দিতে হবে সেকেন্ড অফিসারকে। কাল সকালে গিয়েই ওকে এখান থেকে আরও পাঁচমাইল ভিতরে ক্ষীরপুর থানায় জয়েন করে সেখান থেকে রিপোর্ট পাঠাতে হবে সদরে।

ওই বদলির অর্ডার পেয়ে চমকে ওঠে শশী দারোগা। হঠাৎ এমনিই অঘটন কেন ঘটল তাই ভাবতে থাকে। ক্ষীরপুর থানায় পোস্টিং করা হয় অযোগ্য কর্মীদেরই। একেবারে অজ পাড়াগাঁ । ছোটবাবুও অর্ডার পেয়েছে।

তাকে এক্ষুনি চার্জ বুঝে নিতে হবে। ছোট দারোগা দেখেছে ধনকেষ্টর অত্যাচার। সে ওই লোকটাকে সহ্য করতে পারে না। বড়বাবু তার অফিসার; তার অনাচারও দেখেছে।

এবার তার প্রতিকারই করেছেন পুলিশ সুপার।

কিন্তু শশীপদও ধুরন্ধর লোক। সদরে তারও কিছু লাইন আছে। এবার তারাই জানায় আসল খবরটা।

পুলিশ সুপারের এক বন্ধুর ভাইপো মিসিং হয়েছে শশীপদবাবুর এলাকা থেকে। তাকে কারা কিডন্যাপ করেছে। আর শশীবাবু সেই কেস ডাইরিও করেনি।

ফলে খবর এসে পৌঁছায় খোদ সাহেবের কাছে। আর একটা দারুণ ঘটনা ধরা পড়েছে স্টেশনে। দুই বিদেশি মূর্তি পাচার করছিল। তারা হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে। মূর্তি ফেলে তারা পালিয়েছে তবে পুলিশ মূর্তি পাচারকারীর খবরও জেনেছে। এসব ঘটেছে শশীপদবাবুর থানাতেই। এসব চালান চলছে অনেক দিন ধরে। শশীপদ এসব নিয়ে কোনো অ্যাকশনই নেয়নি।

তাই তাকে বদলি করে এরপর তদন্ত করে বিভাগীয় শাস্তিও দেওয়া হবে।

এবার বুঝেছে শশীপদ কেসের গুরুত্বটা। ওই ছেলেগুলোর পিছনে রয়েছে কলকাতার কোনো বড় ব্যবসায়ী, মন্ত্রীদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।

আর শশীপদ দারোগা তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে আবার আজ রাতে ধনকেষ্টর টাকা খেয়ে তাদের মিথ্যা চুরির দায়ে হাজতে পুরতে গেছল।

এবার ওই হাজতে তাকেই না ঢুকতে হয়।

শশীবাবুর খেল এখানে খতম হয়েছে। এই থানার আর কেউ সে নয়। চার্জ বুঝিয়ে দিয়েছে ছোটবাবুকে, কাল সকালেই চলে যেতে হবে।

তাই ছুটে এসেছে শশীপদ দারোগা ওই ধনকেষ্টবাবুর কাছে।

ধনকেষ্ট দারোগার জরুরি তলব পেয়ে ওই ভাঙাবাড়ির নীচেই নেমে আসে। ঝড়োকাকের মত চেহারা এখন শশীপদ দারোগার। খুবই ঘাবড়ে গেছে সে।

ধনকেষ্ট বলে—আসুন দারোগাবাবু, চলুন বৈঠকখানায় বসা যাক। কালী চা-কফি।

দারোগা বলে—ওসবের দরকার নাই।

ধনকেষ্ট বলে—তাহলে ওই ছোঁড়াদের হাজত বাসের ব্যবস্থা করুন। কাল সকালেই সদরে চালান করে দিন ওদের। জেলেই থাকুক গে ।

দারোগা বলে—ওসব মতলব ছাড়ুন ধনকেষ্টবাবু, এবার নিজেদেরই না জেলে যেতে হয়। এ্যা। জেলের কথায় চমকে ওঠে ধনকেষ্ট। শুধোয়– কেন? কী হল যে জেলে যেতে হবে?

শশীপদ এবার তার বদলির কথা, ওই ছেলেগুলো খোদ পুলিশ সুপারের বন্ধুর চেনা, তার কাছেই খবর চলে গেছে।—এসবও জানায়। আর ওই মূর্তি পাচারের খবরও জেনেছে পুলিশ। দুই বিদেশি সাহেব কোনোমতে পালিয়েছে। পুলিশ ধনকেষ্টর পাচার করা মূর্তিটাকেও ধরেছে। এবার ধনকেষ্টর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।

ধনকেষ্ট কাতর স্বরে বলে—এবারের মত বাঁচান দারোগাবাবু, যা লাগে, যত টাকা লাগে দেব। বাঁচান ।

শশী দারোগাই আজ বিপন্ন। তাকে সহজে ছাড়বে না কর্তৃপক্ষ। তার কর্তব্যের অবহেলার জন্য সাজা পেতে হবে।

শশী বলে–কে, কাকে বাঁচায় ধনকেষ্টবাবু? নিজেই আর এখানের কেউ নই ।

তাহলে কি হবে? ধনকেষ্ট বলে—ওই ছোট দারোগা তো শুনি সাধুপুরুষ। ও তো আমাকে ছাড়বে না।

শশীপদ অভিজ্ঞ লোক। পুলিশ বিভাগের বেশ কিছু খবর রাখে। ও বুঝেছে কিডন্যাপ-এর চার্জ তো আছেই, পুলিশ ওই মূর্তি পাচারকারীদেরও ছাড়বে না।

হয়তো কড়া হাতেই এটার তদন্ত শুরু হবে। শশীপদ বলে—ধনকেষ্টবাবু, পুলিশ সুপার খুব কড়া লোক। মূর্তি পাচারের জোর তদন্ত হবে। তার উপর ওই ছেলেটাকে কিডন্যাপ করে আটকে রেখেছেন—

ধনকেষ্টও এবার ভয় পায়। শশী বলে–যে কোনো মুহূর্তে পুলিশ সাহেব স্পেশাল টিম নিয়ে এখানে হানা দিতে পারে।

ধনকেষ্ট চমকে ওঠে।

–সেকি! তাহলে তো ধনেপ্রাণে মারা পড়ব।

শশী বলে—যে ভাবে হোক এই রাতে সব মূর্তি আর ওই ছেলেটাকে অন্যত্র পাচার করে দেন। পুলিশ এখানে যেন কিছু না পায়। তাহলে সে কিছুটা হালকা হবে। না হলে হাতেনাতে ধরলে আর বাঁচার পথ থাকবে না।

ধনকেষ্টও কথাটা ভাবছে।

শশীপদ বলে—হাতে সময় নাই, যা করার এক্ষুনিই করুন আর আমি যেসব বলে গেছি সেকথা যেন কোনোদিন প্রকাশ না হয়। চলি-

দারোগা চলে যাবার পরও ধনকেষ্ট অনেকক্ষণ কি ভাবছে। তার সাম্রাজ্যের বুকে এমনি ফাটল ধরবে ভাবতে পারেনি ।

তার দৃষ্টি ঘোরে কালীর ডাকে—এখন কি হবে কর্তা !

কালী ত সব শুনেছে, ধনকেষ্ট এবার সজাগ হয়ে ওঠে।

যে ভাবে হোক কাটতেই হবে তাকে।

এই বাড়ির গুদামে বেশ কয়েকটা দামি মূর্তি রয়েছে। এছাড়া, ব্রিফকেস ভর্তি রয়েছে থাক থাক টাকা আর বিপদ হয়েছে ওই ছেলেটাকে নিয়ে!

পুলিশ এসে এসব মাল—ছেলেটাকে দেখতে পেলে তাকে অ্যারেস্টই করবে।

ধরা দেবে না ধনকেষ্ট।

যে ভাবে হোক এই সব মালপত্র নিয়ে রাতারাতি সে খাল ধরে গিয়ে গঙ্গায় পড়তে পারলে সোজা কলকাতায় চলে যাবে। পথে কোথাও ছেলেটাকে ছেড়ে দেবে, যেখানে যায় যাক সে। না হয় গলা টিপে শেষ করে পাথর পুরে বস্তায় জড়িয়ে গঙ্গার বুকে ডুবিয়ে দেবে।

সব প্রমাণ লোপ হয়ে যাবে।

ধনকেষ্ট বলে—যা বলি ঝটপট কর। আর সারেংকে বল, এক পিপে ডিজেল, তেমনি মোবিল যেন তুলে নেয়! দূরের পথ যেতে হবে, দেরি যেন না করে। চল আমার সঙ্গে।

পটলা ঠিক বুঝতে পারল না। সে উপর থেকে কিছু কিছু কথা শুনেছিল।

একটা সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে তা অনুমান করে সে, কিন্তু আসলে কী ঘটেছে তা বুঝতে পারে না। রাতের অন্ধকারেই তার হাত বেঁধে মুখে ন্যাকড়া পুরে কোনোমতে টানতে টানতে এনে ওই লঞ্চেও তোলা হল। এর মধ্যে চট বস্তা জড়ানো বেশ কিছু মাল, বড় সুটকেস কয়েকটা, খাবার জল-কিছু খাবারও তোলা হয়েছে। গাংয়ের বুকে রাত্রির অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে দেখে ধনকেষ্টও খুব উত্তেজিত। কালীচরণসহ আরও বেশ কিছু লোক উঠেছে। আর লঞ্চও ছেড়ে দেয় !

ধনকেষ্ট নিষেধ করে—সার্চলাইট জ্বালাবি না। গাংয়ে তারার আলো পড়েছে।

চেনা গাং—জোরে চল, ভোরের আগেই বড় গাংয়ে পড়তে হবে। লঞ্চটা বেগে চলেছে। ইঞ্জিনের একটানা শব্দ ওঠে।

পটলাকে ওরা আটকে রেখেছে নীচের একটা বেঞ্চে।

কোণের দিকে বসিয়েছে তাকে যাতে বাইরে থেকে সহজে কারোও নজরে না আসে। হাত-পা বাঁধা পটলার।

না হলে সাঁতারে পটলা খুব পারদর্শী।

গঙ্গার বুকে দীর্ঘ সাঁতারেও সে যোগ দেয়, প্রাইজও পেয়েছে। তার কাছে এই খাল কিছুই নয়।

লাফ দিয়ে জলে পড়ে পালাতে হবে যে ভাবে হোক, কিন্তু হাত-পা বাঁধা কিছু করার নেই । চুপচাপ বসে আকাশ-পাতাল ভাবছে ।

হোঁৎকারাও জানতে পারেনি যে তাদের চুরির দায়ে অ্যারেস্ট করে হাজতে পাঠাবার সব ব্যবস্থাই করেছে ধনকেষ্ট। তাদের বিপদই হত।

কেবল সুপারের রেডিও ম্যাসেজই বাঁচিয়েছে তাদের। দারোগাও চিৎপটাং আর ধনকেষ্ট এবার চাচা আপন পরান বাঁচা। তাই তারা এ যাত্রা বেঁচে গেছে।

তবু রাতের অন্ধকারে বের হয়েছে তারা। হোঁৎকা গোবরার দল সাবধানে সেই ভাঙা বাড়িতে এসেছে। চারিদিক নির্জন। কেউ কোথাও নেই। এখানে ওখানে খুঁজছে তারা। পটলার দেখা মেলে না।

একটা ঘরে দেখা যায় পটলার একটা রুমালই পড়ে আছে। আর কিছুই নেই।

মেঝেতে তাকাই। জলের ‘কুঁজো’ও রয়েছে। চারিদিকে পড়ে আছে বিড়ি দেশলাই কাঠি, কিন্তু কেউ কোথাও নাই ।

গোবরা বলে—এখানেই ছিল পটলা। ব্যাটারা পাহারা দিয়ে আটকে রেখেছিল কিন্তু গেল কোথায়।

তার জবাব মেলে না ।

ওই বিরাট ধ্বংসস্তূপ ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। ওরা সাবধানে খালের দিকে আসে। সেখানেও কেউ নাই। ঘরে আলো জ্বলে না।

হোঁৎকা বলে–কেস গড়বড় !

গোবরা বলে–লঞ্চও নাই। ব্যাটারা তাহলে কি পটলাকে নিয়ে কোথাও পালালো ? কি হবে এখন?

আমিও ঠিক ব্যাপারটা বুঝতে পারি না।

রাত দুপুর হবে। গেস্টরুমে খেয়ে দেয়ে শুয়েছি সবে। চোখ লেগে এসেছে। হঠাৎ বেয়ারার ডাকে চাইলাম।

বেয়ারা বলে—সাহেব আপনাদের তৈরি হতে বললেন। এক্ষুনি বের হতে হবে। জিপ তৈরিই ছিল।

সুবিনয়বাবু জি. এফ. পি আরও কজন অফিসারও এসেছে। আমাদের নিয়ে জিপ এসে গঙ্গার ধারে থামল।

দেখি সেখানে তখন বেশ কিছু পুলিশ হাজির। দু-তিনটে লঞ্চে উঠে ওরা এবার গঙ্গা ছেড়ে বড় খালে ঢুকে চলেছে। দুখানা লঞ্চও চলেছে রাতের অন্ধকারে খালের বুক চিরে |

পথে কোনো নৌকা দেখলে তাকে সার্চলাইট ফেলে দেখছে, কি সব জিজ্ঞাসাবাদও করছে, আবার চলেছে।

তখন ভোর হয় হয়।

হঠাৎ দেখা যায় ওদিক থেকে একটা লঞ্চ আসছিল সেটা এই দুটো লঞ্চকে দেখে সটান মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করতেই পুলিশ হুঁশিয়ার করে।

ওই লঞ্চকে ধরতেই হবে। ও পালাচ্ছে কেন? জোরে চল। আরও জোরে।

এবার পুলিশ লঞ্চও ছুটছে। মাঝেমাঝে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে এদের তীব্র সাইরেন বাজছে। ওই লঞ্চটাও পালাতে চায় ৷

ধনকেষ্ট ভাবতে পারেনি যে এইভাবে পুলিশ তার পথ আটকে দেবে। তবু শেষ চেষ্টা হিসাবে পালাতে হবে।

পটলাও দেখেছে ব্যাপারটা।

দুটো লঞ্চও যেন তেড়ে আসছে। পুলিশ লঞ্চের গতিবেগের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না ধনকেষ্টর মাল বওয়া লঞ্চ। তাই ওরা এসে ঘিরে ফেলে লঞ্চটা।

ধনকেষ্ট ওই লঞ্চ থেকে চটে মোড়া মূর্তিগুলোকে খালের জলে ফেলার চেষ্টা করতে ওই লঞ্চ থেকে রাইফেল উঁচিয়ে ধরে পুলিশ।

মাইকে ঘোষণা করা হয়—কিছু জলে ফেলার চেষ্টা করো না ধনকেষ্ট। তোমার লঞ্চ আমরা ঘিরে ফেলেছি। লঞ্চ থামাও না হলে গুলি চালাতে বাধ্য হবো !

সারেংও থাকে ওপরে।

সে দেখছে ওই উদ্যত রাইফেল। তাই সেও লঞ্চ থামিয়ে দেয়।

আর এবার পুলিশ সুপারের পিছনে আমিও ওই লঞ্চে উঠে পটলাকে বন্দি অবস্থায় দেখে ছুটে যাই।

পটলা !

ওর হাতপায়ের বাঁধন খুলে দিতে পটলাও মুক্ত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে।

সমী—ওরা?

বলি—ওরা ভালোই আছে।

পটলা বলে—ওই ধনকেষ্ট আমাকে জলে ডুবিয়ে মারত। পুলিশ সুপার বলেন—আর কেউ তোমাকে মারবে না। এবার ধনকেষ্টবাবুকেই তার পাপের সব শাস্তি দেওয়া হবে। ওকে অ্যারেস্ট করুন।

—স্যার! ধনকেষ্ট আর্তনাদ করে ওঠে।

কিন্তু পুলিশ তাকে হাতকড়ি পরিয়েছে। আর লঞ্চেই পাওয়া যায় সাত-আটটা দামি মূর্তি, যার মূল্য কোটিখানেক টাকা আর দুই সুটকেস বোঝাই কয়েক লাখ টাকা আর সোনার বিস্কুট—তাও কেজি তিনেক হবে।

সারা গ্রামের লোক এবার খালের ঘাটে ভেঙে পড়েছে হাতকড়ি-পরা এতদিনের সেই প্রবলপ্রতাপ ধনকেষ্টবাবুকে দেখতে। কালীচরণ—তাপ সিংয়ের দলের ছাগলের দড়ির মত কোমরে দড়ি বাঁধা।

তাদের গুদামে আরও অনেক মাল পাওয়া যায়। সিন্দুকে পাওয়া যায় সারা এলাকার মানুষের লুটে নেওয়া সম্পত্তির জাল দলিল।

আজ ধনকেষ্টর সব বেলুন চুপসে গেছে।

সারা গ্রামের মানুষ আজ খান-পঞ্চাশেক ঢাক-ঢোল নিয়ে গাঁয়ে বিজয় মিছিল বের করে, তার আগে আগে চলেছি আমরা।

আজ গ্রামের মানুষের মহাশত্রু নিপাত হয়েছে। ধনকেষ্টর সবকিছু পুলিশ আটকেছে।— তার দলবলকেও ।

এবার বলি–হোঁৎকা ফিরে চল কলকাতায় ।

হোঁৎকা বলে—গ্রামের মানুষের আজ মহাভোজ। ভোজটা না খাইয়া যামু?

বাদলমাস্টার বলে—না-না। ভোজে তোমরা থাকবে না, তা কি হয়! তোমরাই তো এই ভোজের মূলে।

কেশব দত্তের পুকুরে জাল পড়েছে। সে এই ভোজের সব মাছ জোগাবে। আর মাছের সাইজও দারুণ। এক-একটা আট কেজির কম নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *